Home

Welcome to the professional and personal website of Binayak Sen. He is a well-known economist in Bangladesh, working mainly on growth, poverty, inequality and human development issues. Binayak has wide-ranging interests in the social sciences and humanities, and has written on topics that go beyond economic issues. He also has a passion for literature, and contributes frequently to literary criticism as well as poetry translation into Bengali.

This site is intended to collect Binayak’s writings over the past two decades in broad areas of the social sciences and humanities. Parts of the site are still under construction, so we appreciate your patience.

Recent Posts

রণজিৎ গুহ ও নিম্নবর্গ নিয়ে তাঁর ইতিহাস-চর্চা

পর্ব : ০৫[পূর্বে প্রকাশের পর]


রণজিৎ গুহ [২৩ মে ১৯২৩–২৮ এপ্রিল ২০২৩]

নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাহলে কী করতে পারেন? তিনি বিরোধী ইতিহাস লিখতে পারেন, যেখানে উচ্চবর্গের আধিপত্য অস্বীকার করে নিম্নবর্গ তার নিজের ঐতিহাসিক উদ্যমের কথা বলতে পারে। নিজের ক্রিয়াকলাপের কর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে পারে। সে ইতিহাস কখনোই পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ইতিহাসের সামগ্রিকতা অর্জন করতে পারবে না। নিম্নবর্গ কখনোই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারবে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস তাই অনিবার্যভাবে আংশিক, অসংলগ্ন, অসম্পূর্ণ। … আসলে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসচর্চার মহলে যে-ভূমিকায় ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল, সেটা হয় এক ধরনের র‍্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাস কিংবা ‘হিস্ট্রি ফ্রম বিলো’– তল থেকে দেখা ইতিহাস। সত্তর-আশির দশকে ইউরোপে এই ধরনের ইতিহাস লেখার খুব চল হয়েছিল। ক্রিস্টোফার হিল, এডওয়ার্ড টমসন, এরিক হব্সবম প্রভৃতি ইংরেজ মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকের ধারা অনুসরণ করে অনেকেই তখন ইউরোপের পুঁজিবাদ আর যন্ত্রসভ্যতার অগ্রগতির ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যাওয়া বিস্মৃত, অবহেলিত জনগোষ্ঠী ও তাদের ভিন্নতর জীবনযাত্রার কথা লিখছিলেন। এই ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’ প্রধানত ইতিহাস রচনায় বাদ পড়ে যাওয়া অনেক ঘটনা, মতাদর্শ, স্মৃতি খুঁজে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। … ‘সাবল্টার্ন স্টাডিজ’-এর লেখকরাও যে ইউরোপের র‍্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাসের কাজ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ তফাত ছিল। … ভারতবর্ষের মতো দেশের ক্ষেত্রে ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসকে কিন্তু এ রকম কোনো ছকের ভেতরে বেঁধে রাখা কঠিন ছিল। ভারতে পুঁজিবাদী আধুনিকতার বিবর্তনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে গল্পের শেষটা অত নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়নি। বিশ্বের অন্যত্র যা ঘটেছে, ভারতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এই ফর্মুলাটা যদি মাথায় চেপে বসে না থাকে, তাহলে ‘তল থেকে দেখা’ ভারতীয় ইতিহাসের লেখক সহজেই দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর গবেষণার উপাদান থেকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক মৌলিক প্রশ্ন তোলার সুযোগ খোলা রয়েছে। … লিবারেল জাতীয়তাবাদ এবং মার্ক্সবাদ– দুই ধরনের ইতিহাস রচনার প্রতিষ্ঠিত ছক সম্বন্ধেই ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর লেখকদের মনে সংশয় ছিল। র‍্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় নেমে তাঁরা তাঁদের বর্ণনাকে কোনো নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইলেন না। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরিণতি আধুনিক সমাজের কোনো নির্দিষ্ট ও পরিচিত ধারণার বাস্তবায়ন, এই কাহিনিসূত্রটি তাঁরা বারবারই অস্বীকার করতে লাগলেন তাঁদের লেখায়। তাই ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাস হিসেবেও ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর লেখা বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে রইল ইতিহাসচর্চার মহলে।” ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’ (History from Below) এবং ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ (Subaltern History) এই দুই ধারার মধ্যে তাহলে দেখা যাচ্ছে কিছু পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। প্রথমত, এ দুইয়ের মধ্যে রয়ে গেছে পটভূমিগত (Context) পার্থক্য। ‘তল দেখা ইতিহাস’ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল ইউরোপীয় বা উত্তর-আমেরিকার ‘আধুনিক’ অভিজ্ঞতার ওপরে। নিম্নবর্গের ইতিহাসের বিষয় হচ্ছে উপনিবেশ, আধা-উপনিবেশ ও উপনিবেশ-উত্তর অভিজ্ঞতা। একের অভিজ্ঞতা অন্যের সাথে মেলার কথা নয়: একটি যদি হয় সরলরেখা, অন্যটি তাহলে বক্ররেখা (crooked line)। ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামো আমাদেরকে মৌলিকভাবে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করায়, যার সাথে ইউরোপ-আমেরিকার অভিজ্ঞতার কোনো তুলনাই হয় না। সেজন্যই কাছাকাছি শোনালেও ‘নিম্নবর্গের’ ইতিহাসচর্চা ও ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসচর্চা ধারণাগতভাবে ভিন্ন হতে বাধ্য। এ দুই ধারার ইতিহাসচর্চার মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্য অভিনিবেশের বিষয়বস্তুর মধ্যে। ‘তল থেকে দেখা’ ও ‘মার্ক্সবাদী’ ইতিহাসচর্চা উভয়েরই মূল ঝোঁকটা শ্রেণিগত বিশ্লেষণের দিকে। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা শুধু শ্রেণি নয়, তার নজর পড়ে অন্যান্য শোষণ-বঞ্চনার প্রতিও। নারীদের একান্ত নিজস্ব সংগ্রাম নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনকি যখন পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা যুদ্ধ করেছে তখনও তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর তুলে আনার আলাদা গুরুত্ব শেষ হয়ে যায় না। অধস্তনতার বেদনাকে যেমন আঁকতে হবে, তেমনি তুলে আনতে হবে তার স্ব-নিয়ন্ত্রণপ্রয়াসী (Agency) আচরণ। সেটা শুধু সুলতানা রাজিয়া বা ঝাঁসির রানীর ক্ষেত্রে নয়, ‘অশনি সংকেত’-এর অনঙ্গ-বৌ বা ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র জয়গুনের ক্ষেত্রেও। ‘ইতিহাসের ক্ষুদ্র আওয়াজ’ (The Small Voice of History) প্রবন্ধে রণজিৎ গুহ বলেছেন যে পূর্বের ঐতিহাসিক বিবরণীগুলো যেমন ছিল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক (statist), তেমনি ছিল পুরুষকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব, পার্টি, সংগঠন শব্দগুলোই ছিল বড় বেশি পুরুষঘেঁষা। এসব গল্পে নারীদের কোনো স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর ছিল না। নারীরা ছিল নিষ্ক্রিয় কর্তা, উদ্যমহীন ও ইতিহাসের বাসযাত্রায় চালকের আসন থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে বসা নীরব যাত্রীদের মতো। নিম্নবর্গের ইতিহাস এভাবে নিষ্ক্রিয়ভাবে নারীকে দেখবে না। রণজিৎ গুহ লিখেছেন : “In a new historical account this metaphysical view will clash with the idea that women were agents rather than instruments of the movement which was itself constituted by their participation. This will inevitably destroy the image of women as passive beneficiaries of a struggle for ‘equal rights’ waged by others on their behalf.” নারীদের ‘মুক্ত করতে গিয়ে’ নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক অপরাপর অধস্তন ও শোষিত ‘অপর জনগোষ্ঠীদের’ প্রতিও নজর দেবেন। এর মধ্যে প্রথমেই চলে আসে ‘নীচু জাত ও সম্প্রদায়ের’ প্রসঙ্গ। ভারতবর্ষে এই জাতপাতের ফারাক এখনও তীব্র ও সজীব; ইতিহাসে এই ফারাক আরও বেশি তীব্র ও জীবন্ত। এমনকি ‘আধুনিক’ ভোটযুদ্ধ ও নির্বাচনী ইতিহাসে উঁচু জাত বনাম নীচু জাতের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক মেরূকরণ কোনো শ্রেণি আলোচনা থেকে কম চিত্তাকর্ষক নয়। এরই সাথে যুক্ত করতে হয় স্বজাতি-ভিন্ন জাতি ব্যবধানের কথা। এককথায়, প্রতিটি বর্ণেরই নিজস্ব ব্যর্থতা ও উত্থানের কাহিনি রচনা করবে নিম্নবর্গের ইতিহাস। সব শেষে বলতে হবে আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, চেহারা-সুরতে ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংগ্রামের কথা। সংখ্যায় ক্ষুদ্র বলেই তাদেরকে আমাদের চোখে পড়ে না। প্রায় অদৃশ্য, পাহাড়ে-জঙ্গলে থাকা, আদিবাসী নৃগোষ্ঠীকে তো একেবারেই চোখে পড়ে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস এই শেষোক্ত জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষভাবে আলো ফেলবে। রণজিৎ গুহ লিখেছেন : “I feel that women’s voice, once it is heard, will activate and make audible the other small voices as well … I want historiography to push the logic of its revision to a point where the very idea of instrumentality, the last refuge of elitism, will be interrogated and re-assessed not only with regard to women but all participants.” বর্ণ, জাত বা নারী এসব সামাজিক বর্গের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার অর্থ এই নয় যে ‘শ্রেণি’ বিষয়টি নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। পার্থক্য এই যে, মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের চর্চায় শ্রেণির প্রতি যেমন একটা কেন্দ্রীয় মনোযোগ থাকে, সেরকমটা সাব–অল্টার্ন স্টাডিজের বেলায় নয়। তারা বরং উৎসাহী শ্রেণি/বর্ণ, শ্রেণি/জাত, শ্রেণি/নারী এই যুগলের মধ্যে আড়াআড়ি বিভক্তি (intersectionality)-কে ধরার জন্য। যেমন, ডোম সম্প্রদায় অর্থনৈতিক বিচারেও ‘দীনের হতে দীন’; সামাজিক বিচারেও ‘সবার অধম’; প্রকৃতপক্ষে সামাজিক কলঙ্কচিহ্ন বয়ে বেড়াতে হয় তাদের সারাজীবন। কোন ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতিকে ‘অশুচি’ বা অপবিত্র জ্ঞান করা হয় ‘ভদ্রসমাজে’। তদুপরি তাদেরকে গণ্য করা হয় (বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসকদের বর্ণনায়) অপরাধপ্রবণ উপজাতি বা ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ হিসেবে। অনেকটা ইউরোপের রোমা ‘জিপসি’ সম্প্রদায়ের মতো। এই ইন্টারসেকশনালিটিকে রণজিৎ গুহ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে ঔপনিবেশিক নৃতত্ত্বের বরাত দিয়ে : ‘ডোম জন্মায় অড়হর খেতে, ছোটবেলা থেকেই সে চুরি করতে শেখে। জীবনের প্রথম থেকেই সে পতিতের মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার ওপর ছাদ ছাড়াই সে বাঁচে, থাকে না পরের দিনের অন্নের কোনো সংস্থান। পুলিশের তাড়নায় জীবনভর সে পালিয়ে বেড়ায় এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে। গ্রাম থেকে সে সদাই বহিষ্কৃত। … সে আছে হিন্দু ধর্মের নাগালের বাইরে। … সভ্যতার অগ্রগতি তাকে শুধু আরও অবনমনের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।’ উপরের বর্ণনায় আমরা ‘ইন্টারসেকশনালিটির’ প্রায় সবগুলো উপাদান পাই। এই অচ্ছুৎ মানুষদের ‘প্রান্তিকতাকে’ শুধু অর্থনৈতিক শ্রেণিগত অবস্থান বিচার করে সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। এই কথাটা নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা জোরেশোরে বলবেন। দীপেশ চক্রবর্তীর প্রথম বই ‘রিথিংকিং ওয়ার্কিং ক্লাস হিস্ট্রি’-কে ইন্টারসেকশনালিটি ধারণার একটি আদি-প্রয়োগ হিসেবে দেখা চলে। শ্রমিক হলেই তা সবচেয়ে ‘প্রগতিশীল’ শ্রেণি এই ধারণা মার্ক্সীয় ধারায় একটি প্রগাঢ় বিশ্বাস হিসেবে কাজ করে আসছে। তাই যদি হবে তাহলে শ্রমিক এলাকায় সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত দাঙ্গা বাধে কী করে? মার্ক্সবাদীরা এ ক্ষেত্রে ‘ক্লাস-ফর-ইটসেলফ’ (সক্রিয় শ্রেণি) বনাম ‘ক্লাস-ইন-ইটসেলফ’ (নিষ্ক্রিয় শ্রেণি) বলে এই ধাঁধার মীমাংসা করার চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু তাতে করে শ্রেণির মধ্যে ধর্মভেদ ও জাতপাতের সমস্যার সুরাহা হয় না। শিল্প-শ্রমিক শ্রেণি অন্যের শৃঙ্খল মোচন করতে এগিয়ে আসেনি, এমনকি নিজের শৃঙ্খলও মোচন করেনি– কিছু স্মরণীয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে। অর্থাৎ, সামাজিক মুক্তির বৃহত্তর পরিসরে ‘প্রলেতারিয়েত’ একটি বিমূর্ত রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে থেকে গেছে। এককথায়, নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক শ্রমিক শ্রেণি সম্পর্কে পূর্বানুমানভিত্তিক কোনো মহিমান্বিত ধারণা অনুসরণ করে অগ্রসর হবেন না। এটা শুধু শ্রমিক শ্রেণি নয়, সব অর্থনৈতিক শ্রেণির সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন, মার্ক্সবাদী সাহিত্যের একটি প্রধান প্রবণতা ছিল কৃষক জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক শ্রেণির তুলনায় তুলনামূলক কম প্রগতিশীল বা অনগ্রসর সামাজিক শ্রেণি হিসেবে ভাবা। চীন-ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার পরে এই প্রবণতা এখন কমে এসেছে, কিন্তু তার পরও আমাদের দেশে বিভিন্ন বাম দলের দলিলে-ঘোষণাপত্রে ‘মধ্যকৃষক হচ্ছে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দোদুল্যমান মিত্র’ ধরনের আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষকদের দোষ যে কৃষক সর্বহারা নয়; জমির প্রতি তার ক্ষুধা পূর্বাপর– এমনকি ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। এককথায়, কৃষককে ঠিক বিশ্বাস করা চলে না জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে। অথচ আমাদের দেশের ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা গেছে যে, কৃষকরাও শ্রমিকের চাইতে কম যায়নি আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে। ১৯৫২ সালের ছাত্র-আন্দোলনের ছাত্ররা ছিল কৃষকেরই সন্তান; ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাধারণ মুক্তিসেনাদের অধিকাংশই ছিল গাঁওগেরামের কৃষক। ১৯৬৯ সালে আয়ুবশাহির পতনের পেছনে যেমন ছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টের শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল চল্লিশের শেষার্ধে কৃষক-আদিবাসীদের তেভাগা-টংক-নানকার আন্দোলন; যা সাতচল্লিশের পর মুসলিম লীগ সরকারের ভিত কিছুটা হলেও কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কোন শ্রেণি কখন বিদ্রোহ করবে বা আন্দোলন-সংগ্রামে শামিল হবে, সেটা আগে থেকে বলে দেওয়ার মতো গল্প অনুসারে পরিচালিত হয় না। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের বিদ্রোহ তো শুধু শ্রেণি-কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা করাই যায় না– এ কথা নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা বলবেন। এর চেয়েও বড় কথা, কোনো একটি আন্দোলনের নাম বা ব্যানার, তার আপাত রাজনৈতিক আদর্শ বা সংগঠনের পরিচিতি যা-ই হোক না কেন, তাতে অংশগ্রহণকারী সবাই একই আদর্শ বা সংগঠনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সমবেত হন না। অংশগ্রহণকারী সবারই যার যার নিজস্ব কারণ থাকে– সেটা ব্যানার বা সংগঠনের আদর্শের সাথে মিলতেও পারে, না-ও পারে। এই যার যার ‘নিজস্ব কারণ’ বের করার দায়িত্ব নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের। একটি উদাহরণ দেব এ সূত্রে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনে নানা শ্রেণির মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন। স্বৈরাচার-বিরোধিতা ছিল প্রকাশ্য রাজনৈতিক আদর্শ– ব্যানারে ব্যানারে সে কথাই লেখা ছিল। সেসময় পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। আমরা কি হলফ করে জানি যে নূর হোসেন সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্যই সেদিন সেই মিছিলে গিয়েছিলেন? আমার এখনও মনে পড়ে যেদিন এরশাদ পদত্যাগ করলেন, সেদিন ঢাকার তোপখানা রোডের মোড়ের কাছে একটি লোক বিড়বিড় করছিল– ‘আজ কেমন স্বাধীন স্বাধীন লাগছে!’ কেউ কি জানে কেন সে এই কথা বলেছিল? যেন একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চারপাশে বিরাজ করছিল এবং এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে আমরা সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিন। কিন্তু এটা আমার ইন্টারপ্রিটেশন; সেই লোকটি স্বাধীনতার অন্য কোনো অর্থ তৈরি করে থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই কথাটিই বলার চেষ্টা করেছিলেন শামসুর রাহমান তাঁর ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় : ‘এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?/ এখানে তো নেই বোনাস ভাউচারের খেলা নেই’। সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করেই এ কথা বলা, কিন্তু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সেদিন যারা জড়ো হয়েছিল তাদের প্রাণ একসূত্রে বাঁধা ছিল না। কবিতাটির একটি বড় অংশ এখানে উদ্ধৃত করা প্রয়োজন : ‘এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের? এখানে তো বোনাস ভাউচারের খেলা নেই কিংবা নেই মায়া কোনো গোলটেবিলের, শাসনতন্ত্রের ভেলকিবাজি … আমি দূর পলাশতলীর হাড্ডিসার ক্লান্ত এক ফতুর কৃষক … আমি চটকলের শ্রমিক, আমি মৃত রমাকান্ত-কামারের নয়ন পুত্তলি, আমি মাটিলেপা উঠোনের উদাস কুমোর, প্রায় ক্ষ্যাপা, গ্রাম উজাড়ের সাক্ষী, আমি তাঁতি সঙ্গীহীন … আমি রাজস্ব দফতরের করুণ কেরানি, মাছি-মারা তাড়া-খাওয়া, আমি ছাত্র, উজ্জ্বল তরুণ, আমি নব্য কালের লেখক, আমার হৃদয়ে চর্যাপদের হরিণী নিত্য করে আসা-যাওয়া …’ জাতীয়তাবাদী ইতিহাস-চর্চায় সব আন্দোলন-সংগ্রামকেই ‘একসূত্রে বাঁধা’ হিসেবে দেখা হয়। সেসব আন্দোলন-সংগ্রামে যোগদানের আপন আপন কারণ খুঁজে বের করার তাগিদ নেই সেখানে। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক সেই ঐক্যের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দেখবেন; সমগ্রের মধ্যে ভগ্নাংশকে দেখবেন; প্রতিটি কণ্ঠস্বরকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে শনাক্ত করবেন। এই মর্মে জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে (আরেকজন দিকপাল সাব-অল্টার্ন ঐতিহাসিক) লিখেছেন: ‘ভগ্নাংশের সমর্থনে : দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?’ পার্থ চ্যাটার্জী লিখেছেন আরও স্পষ্ট করে : ‘নেশন অ্যান্ড ইটস ফ্রাগমেন্টস’; এর মর্মার্থ হলো– জাতি-রাষ্ট্রের নানা অংশ, গোষ্ঠী, শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার তারা আলাদা ধারা হিসেবেই শেষাবধি থেকে গেছে। একটি জাতিতে তারা মিলতে পারে নাই। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’– সেই মহামিলন রাজনৈতিক ভাষণে-দাবিতে-সংবিধানে শুধু থেকে গেছে; বাস্তবে তা হয় নাই। কেন হয় নাই সে প্রশ্নের সওয়াল-জবাব নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা করবেন। অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতি নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকদের বিশেষ মনোযোগ কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্বুদ্ধ? সেটা কি বস্তুবাদী নাকি ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি? হিউম্যানিজম নাকি পপুলিজম? মার্ক্সবাদ নাকি ‘ডিসিডেন্ট লেফট’? নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার পেছনে কোন দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে, সেটা জানা জরুরি বৈকি। এ বিষয়ে দীপেশ চক্রবর্তী এক জায়গায় লিখেছেন : ‘১৮৯৭ সালে বোম্বাইয়ের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ সরকারের প্লেগ-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তার ইতিহাস আজ কেন লিখব? নিছক নিম্নবর্গের বিরোধিতার ইতিহাস লিখতে চাই বলে? সেটা তো পপুলিজম। মানুষ হাজারো বাধার মধ্যেও তার সংগ্রামী সত্তাকে জিইয়ে রাখে, এই কথাটার পুনঃপ্রচার করতে চাই বলে? সেটা তো হিউম্যানিজম। এর বাইরেও তো একটি ইতিহাস আছে …’ এর বাইরের ইতিহাস– যাকে ‘অন্য ইতিহাস’ বলেছি এই অধ্যায়ের শুরুতে– তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন দীপেশ চক্রবর্তী। ব্যাখ্যাটি স্পষ্টতই মার্ক্সের ‘রাষ্ট্রের ক্রম-বিলুপ্তি’ (withering away of the state) তত্ত্বের দ্বারা অন্তত আংশিকভাবে প্রভাবিত। হয়তো এই চিন্তার মধ্যে ‘এনার্কিস্ট’ ধ্যান-ধারণাও কাজ করেছে। দীপেশ লিখেছেন : ‘রাষ্ট্রের ভিত্তি– লেনিন যেমন বলেছিলেন– সংগঠিত হিংসায়। হিংসার মাধ্যমেই তার জন্ম। নিজেকে বৈধ প্রমাণ করতে তাঁর কতগুলো ‘কল্যাণকর’ মতাদর্শের সাহায্য নিতে হয়। আবার এগুলোই তাঁর হাতে অস্ত্রবিশেষ। অথচ গান্ধীবাদীভাবেই ভাবুন বা মার্ক্সবাদীভাবেই ভাবুন, শেষ বিচারে মানুষের মুক্তি রাষ্ট্রের অবলুপ্তিতে ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে, তাই রাষ্ট্রের ক্ষমতার চরিত্র বোঝা দরকার। এবং তেমনি বোঝা প্রয়োজন ইতিহাসে রাষ্ট্র-বিরোধিতার সূত্রগুলো কোথায়, কারণ একদিন আবার মানুষের মুক্তির কাহিনির সূত্রপাত সেইসব জায়গা থেকে করতে হবে।’ নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্রমেই মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠা ভূমিকার বিরোধিতা একটি বড় দিক রণজিৎ গুহ ও তাঁর অনুপ্রাণিত সাব-অল্টার্ন স্কুলের ঐতিহাসিকদের দর্শনে। তার মানে এই নয় যে রণজিৎ গুহ প্রথাগত মার্ক্সবাদের যুক্তি বিন্যাসের মধ্যেই আটকে থাকতে চেয়েছিলেন। ‘বামপন্থি’ তিনি (এবং তাঁর সহযোগীরা) অবশ্যই, তবে তাঁরা ভিন্নমতাবলম্বী বাম বা ‘ডিসিডেন্ট লেফট’ গোত্রের। রণজিৎ নিজে একসময় কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিআই)-এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন চল্লিশের দশকে এবং পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে। সেসময় তিনি চীনসহ নানা পূর্ব ইউরোপীয় দেশে সিপিআইয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রতিনিধি হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্বচক্ষে দেখেছেন নতুন সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণের প্রচেষ্টা এসব দেশে। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিবাদে সিপিআইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর থেকে অফিসিয়াল পার্টি লাইনের বাইরের লোক ছিলেন তিনি– বামপন্থিদের মধ্যে অনেকটাই অপাঙ্‌ক্তেয়। সুতরাং ডিসিডেন্ট লেফট-ই বলব তাঁকে এবং তাঁর অনুপ্রাণিত অন্য ইতিহাসের সহযোগীদের। যদিও তাঁদের ‘ডিসিডেন্ট’ হয়ে ওঠা ঘটেছিল ভিন্ন ভিন্ন কারণে। কাকতালীয়ভাবে বলি, রণজিতের প্রায় একই সময়ে মিশেল ফুকোও ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আগ্রাসন তাঁর ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বামপন্থি বলয়ে থাকলেও আর কখনোই পার্টির বলয়ে তিনি ফিরে যাননি। এ রকম ঘটেছিল ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত আগ্রাসনের পরেও। জাঁক দেরিদা ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টির বলয় থেকে এই সময়ে বেরিয়ে আসেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ সাল এই কুড়ি বছর রণজিৎ গুহের একান্ত নিরিবিলি গবেষণার জীবন। ফরাসি জানেন তিনি, ফলে ইংরেজিতে বার হবার আগেই ক্লদ-লেভি স্ট্রস, রোলা বার্থ, মিশেল ফুকো, জাঁক দেরিদা প্রমুখের লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন। মার্ক্সবাদের অনুশীলন তো পূর্বাপর ছিলই। সাথে সাথে সংস্কৃত ভাষাটাও রপ্ত করেছিলেন তরুণ বয়সেই (রণজিতের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবপ্রসাদ গুহ ছিলেন পালি ভাষার ওপরে একজন ‘অথরিটি’)। সাথে ছিল সাহিত্য পাঠের বিপুল প্রস্তুতি। এসবই তাঁকে সাহায্য করেছিল নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার প্রকল্প সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ গড়ে তুলতে।

[ক্রমশ]

  1. রণজিৎ গুহ ও নিম্নবর্গ নিয়ে তাঁর ইতিহাস-চর্চা Leave a reply
  2. রণজিৎ গুহ ও নিম্নবর্গ নিয়ে তাঁর ইতিহাস-চর্চা Leave a reply
  3. রণজিৎ গুহ ও নিম্নবর্গ নিয়ে তাঁর ইতিহাস-চর্চা Leave a reply
  4. রণজিৎ গুহ ও নিম্নবর্গ নিয়ে তাঁর ইতিহাস-চর্চা Leave a reply
  5. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য Leave a reply
  6. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য Leave a reply
  7. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য Leave a reply
  8. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য Leave a reply
  9. বামপন্থী নজরুল   Leave a reply