হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: হাইকু

হাইকু

অন্তহীন রাত্রি
আজ একটি ঘ্রাণের চেয়ে
বেশি কিছু নয়


ঠিক ভোর হওয়ার আগে ভুলে যাওয়া
স্বপ্নই কি ছিল সেটি,
নাকি আদতে তা কিছুই ছিল না?


লোকটা মারা গেছে
তার মুখমন্ডলের দাঁড়ি সে কথা জানে না
তার নোখ তখনো বেড়ে চলেছে


চাঁদের আলোয়
যে-ছায়া ক্রমেই বড় হয়
সে একটাই ছায়া


পুরোনো হাত এখনো
কবিতার লাইন সাজিয়ে চলেছে
বিস্মৃতির দিকে

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রা মানে কি?

প্রশ্নটাই যে অবান্তর। এর উত্তর আমার ভাল ভাবেই জানা।

এর মানে স্তব্ধতায় প্রহর গোনা, আর কখন সশব্দে বেজে উঠবে এলার্ম এই ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, এর মানে স্বাভাবিক শ্বাস ফেলার নিস্ফল ম্যাজিক, এর মানে শরীরের ভার এপাশ ওপাশ করে সইয়ে নেবার, এর মানে জোর করে চোখের পাতা বন্ধ করে রাখা, এ কোন তীক্ষ্ণ চেতনা নয়–জ্বরেরই মগ্ন অবস্থা যেন, এর মানে বহু দিন আগে পড়া কোন বিচ্ছিন্ন স্তবক বিড়বিড় করে আওড়ানো ফের, এর মানে যখন অন্যেরা ঘুমন্ত তখন একা একা জেগে থাকার অপরাধবোধ, ঘোরের ভেতরে অবচেতনে ডুবে যেতে চাওয়া, তবু অবচেতনে ডুবে যেতে না পারা, এর মানে বেঁচে থাকার ত্রাস, ত্রাসের মধ্যে বেঁচে থাকা, এর মানে আরো একটি ধন্দলাগা দিনের শুরু।

জীবনী-শক্তি মানে কি?

এর মানে এক মানব দেহে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা আতংক, যে-দেহের ক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে,এর মানে দশকের পর দশক ধরে অনিদ্রার মধ্যে বাস, কোন সময়ের এককেই যাকে মাপা যায় না,এর মানে নিজের ভেতরে বয়ে বেড়ানো অনেক সমুদ্র আর পিরামিডের ভার,অনেক দুর্লভ গ্রন্থরাজি, প্রাচীন বংশের ধারা, হজরত আদম যেসব ভোর দেখেছিলেন তার স্মৃতি, এর মানে এক জায়গাতে আটকে থাকার অনুভূতি, যেরকম আমি বাঁধা পড়ে আছি আজ এই দেহের সাথে, আমার কন্ঠস্বরের সাথে, যার আওয়াজ আমি শুনতে চাই না সেই স্বীয় নামের সাথে, প্রতিদিনের অসংখ্য খুচরো বিবরণ, যার উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যে-ল্যাটিন আমি জানি না অথচ যার জন্যে আমি তৃষ্ণার্ত, এসব কিছুর সাথে,এর মানে হচ্ছে নিজেকে কেবলই মৃত্যুর ভেতরে ডোবানোর চেষ্টা, তবু মৃত্যুর মধ্যে ডুবতে না পারা, এর মানে হচ্ছে বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকতে হবে এই বোধে আবারও চলতে শুরু করা।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আত্মহত্যা

আত্মহত্যা
একটা নক্ষত্রও, আজ এই রাতে অবশিষ্ট থাকবে না।
থাকবে না রাত্রিরও কোন অবশেষ।
আমার মৃত্যুর সাথে
এই বিশ্বের অসহ্য বোঝা নেমে যাবে।
আমি সরিয়ে ফেলব সব পিরামিড, সব পদকগুলো,
সব কটি মহাদেশ, সব মুখচ্ছবি।
আমি মুছে ফেলব তিল তিল করে জমানো অতীত।
আমি ইতিহাসকে করব ছাই, ছাইকে—আরো ধূসর কিছু।
এই মুহূর্তে আমি শেষ সূর্যাস্তকে দেখছি।
এই মুহূর্তে আমি শুনছি শেষ পাখীর গান।
কেউ আমার এই শূণ্যতার উত্তরাধিকারী নয়।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: চতুস্পদী

চতুস্পদী
অন্যদেরও মৃত্যু এই সময়ে, কিন্তু সেসব দূর অতীতের গল্প।
এই সমাগত ঋতু–সবাই জানে–মৃত্যুর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
ইয়াকুব আল -মনসুরের নিতান্ত প্রজা আমি,
তবে কি আমারও মৃত্যু হবে গোলাপের মত, আর আরিস্ততল?

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আদম তোমারই দেহের ছাই

আদম তোমারই দেহের ছাই
তরবারি সেভাবেই খসে পড়বে, যেভাবে বৃক্ষ থেকে ফল।
কৃষ্টালও ততটা নাজুক, যতটাই গ্রানাইট পাথর।
সব কিছুই ছাই হয় তার নিজস্ব নিয়মে।
লোহাতে যেমন লুকানো তার মর্চে-ধরা স্বভাব। ধ্বনিতে যেমন প্রতিধ্বনি।
আদি পিতা আদম –সে তোমারই দেহের ছাই।
প্রথম স্বর্গোদ্যানই হবে শেষ স্বর্গোদ্যান।
নাইটিংগেল পাখী ও গ্রীক কবি পিন্ডার দুজনই অভিন্ন কলরব।
সূর্যোদয় সূর্যাস্তরই প্রতিচ্ছবি।
মাইসেনিয়ান সম্রাট—কবরে শায়িত এক স্বর্ণালী মুখোশ মাত্র।
সবচেয়ে উঁচু দেয়ালও সবচেয়ে জরাজীর্ণ ভগ্নস্তূপ।
রাজা উরকুইজা, আততায়ীর ছোরা যাকে ছুঁতে পারেনি, তারও পরিণতি এমন।
আয়নায় যে মুখ আজকে নিজেকে দেখেছে
সে গতকালের মুখ নয়। রাত্রি তাকে বদলে ফেলেছে রাতারাতি।
কাল এভাবেই সূক্ষ্ম, অনবরত, ভাংচুর করছে আমাদের।

হিরাক্লিটাসের সেই প্রবাদের অবিরল বয়ে যাওয়া
জল যদি হতে পারতাম আমি,
যদি হতে পারতাম সেই আদি ও অকৃত্রিম অগ্নি,
কিন্তু আজ এই দীর্ঘ অফুরান দিনের শেষে
নিজেকে আমার একা লাগছে এবং মনে হচ্ছে,
আমি কখনোই আর পরিত্রাণ পাব না।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: সীমানাগুলো

সীমানাগুলো
ভার্লেনের একটি লাইন আর কখনোই মনে পড়বে না আমার।
কাছের একটি রাস্তা যেখানে আমার যাওয়া হবে না কোনদিন।
একটি আয়না শেষবারের মত দেখে নিল আমাকে।
একটি দরজা পৃথিবীর শেষ দিন অব্দি বন্ধ হয়ে গেল।
আমার লাইব্রেরীর অনেকগুলো বই (মিলিয়ে দেখছি এখন)
আর কখনোই খোলা হবে না।
এই গ্রীষ্মে আমার বয়স হবে পঞ্চাশ।
মৃত্যু আমাকে ব্যবহার করে চলেছে ক্রমাগত।