এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৫

[পূর্ব প্রকাশের পর]

এটা বলার পর তিনি এলিয়টের প্রুফ্রক কাব্যগ্রন্থের ‘প্রিলিউড’ কবিতার প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকটি অনুবাদ করে আধুনিক কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্যের দিকটি দেখালেন। আমি শুধু প্রথম স্তবকটি মূলের ইংরেজি পাঠ ও তার রবীন্দ্র্রনাথ-কৃত অনুবাদ নিচে তুলে ধরছি।

‘The winter evening settles down
With smell of steaks in passage ways
Six o’clock.
The burnt-out ends of smoky days.
And now a gusty shower wraps
the grimy scraps
Of withered leaves about your feet
And newspapers from vacant lots
the showers beat
On broken blinds and chimney-pots,
And at the corner of the street
A lonely cab-horse steams and stamps’

রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদ :

‘এ-ঘরে ও-ঘরে যাবার রাস্তায় সিদ্ধ মাংসর গন্ধ,

তাই নিয়ে শীতের সন্ধ্যা জমে এল।

এখন ছ’টা-

ধোঁয়াটে দিন, পোড়ো বাতি, যে অংশে ঠেকল।

বাদলের হাওয়া পায়ের কাছে উড়িয়ে আনে

পোড়ো জমি থেকে ঝুলমাখা শুকনো পাতা

আর ছেঁড়া খবরের কাগজ।

ভাঙা সার্শি আর চিম্‌নির চোঙের উপর

বৃষ্টির ঝাপট লাগে,

আর রাস্তার কোণে একা দাঁড়িয়ে এক ভাড়াটে গাড়ির ঘোড়া,

ভাপ উঠছে তার গা দিয়ে আর সে মাটিতে ঠুকছে খুর।

পুনশ্চ ও পরিচয়ে প্রকাশিত অনূদিত কবিতার মধ্য দিয়ে এলিয়টের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস ভালো-লাগার যে-প্রকাশ ঘটেছিল, তা আমৃত্যু অটুট ছিল। ১৯৩৬ সালের স্পেনিশ সিভিল ওয়ারের সময় জেনারেল ফ্রাংকোর বাহিনীর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের পক্ষে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’ গঠিত হয়েছিল। সেখানে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীই প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন বা পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এলিয়টের বিবৃতির জন্য তাকে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাতে স্বাক্ষর করেন নি। এটি অনেক প্রগতিমনা শিল্পী-সাহিত্যিককে ক্ষুব্ধ করেছিল। এটা ঠিক যে, এজরা পাউন্ডের মত ফ্যাসিবাদী শক্তির পক্ষে এলিয়ট কখনোই ঝোঁকেন নি, কিন্তু তারপরও তার কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। অমিয় চক্রবর্তী এলিয়টের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের দিকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন। বিষ্ণু দে এলিয়টের ভক্ত- সে অভিযোগ মানেন নি। বলেছিলেন, ‘পাউন্ডের মতো এলিয়ট [ফ্যাসিজমের স্নায়ুবিকারে] ঝোঁকেন নি। তাঁর বিবেচনায় ইংরেজি গির্জার আশ্রয়ে ক্যাথলিক ঐতিহ্যের নিরাপদ দিব্যভাবের আবেদন বেশি।’ রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক মত নিয়ে তরুণ কবিকুলের মধ্যকার এই বিতর্ক সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু এলিয়টের কবিকৃতির মূল্যায়নে তা কোন প্রভাব ফেলেনি। কামাখ্যাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি সেকথা নির্দি্বধায় প্রকাশ করেছেন। ১৯৪০ সালে লেখা এ চিঠিটি [শারদীয় দেশ, ১৯৭৩] এলিয়ট ও আধুনিক কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :

‘এলিয়ট অডেন প্রভৃতি আধুনিক ইংরেজ কবির মনে বর্তমান কালের দুর্যোগের যে আঘাত লেগেছে সেটা সত্য এবং প্রচণ্ড। সেই সংঘাতে চিন্তার তরঙ্গ উঠে আগেকার কালের অভ্যস্ত ভাষাধারার কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। ভঙ্গি বদল হয়েছে কিন্তু তাঁদের রচনায় এ যুগের বাণী উঠছে জেগে কতক স্পষ্ট রূপ নিয়ে কতক অস্পষ্ট ব্যঞ্জনায়। তাঁরা যথার্থ কবি এইজন্যে বাণী তাঁদের মনে আলোড়িত হয়ে উঠলে সেটা ব্যক্ত না করে থাকতে পারেন না বলেই লেখেন। কিন্তু যে সাহিত্যে মানুষকে বলবার মতো কোনো বাক্য দুর্নিবার হয়ে ওঠেনি কেবলমাত্র একটা এলোমেলো প্যার্টা‌ন্‌ চলেছে আঁকাবাকা আঁকজোক কেটে সেখানে মন কোন একটা দান পায় না কেবল হুঁচোট খেয়ে খেয়ে মরে। সে সাহিত্যে একটা কোনো তাৎপর্য হাৎরিয়ে বেড়ানোর মতো ক্লান্তিকর আর কিছুই নেই।’

এলিয়ট একুশের আধুনিকতার অকৃত্রিম অনুভূতিকে ব্যক্ত করছে এজন্যই তাদের কাব্য-প্রকাশ অনবদ্য হতে পেরেছে, এ-ই ছিল কবির অভিমত। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ কবিতা আর ১৯৪০ সালে লেখা উপরোক্ত চিঠির মধ্যবর্তী সময়ে এলিয়টের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের চিঠি-পত্রে এসেছে বেশ কয়েক বার। এর থেকে বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের এলিয়ট-অনুরুক্তি সময়ের সাথে কেবল গভীরতর হয়েছে। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পাই কবির সাথে অমিয় চক্রবর্তীর পত্রালাপে। বাংলার তরুণ প্রজন্মের আধুনিক কবিকুলকে তিনি অনুকৃতির পথে নয়, তাদের ‘স্বাভাবিক প্রাণগত অভিব্যক্তির’ পথে চলতে বলছেন। ১৯৩৯ সালের এই চিঠিতে কবি বলছেন :’দেশ-বিদেশ থেকে নানারকম ভাবের প্রেরণা এসে পৌঁছেচে আমার মনে এবং রচনায়, তাকে স্বীকার করে নিয়েছি, তা আমার কাব্যদেহকে হয় তো বল দিয়েছে পুষ্টি দিয়েছে কিন্তু কোনো বাইরের আদর্শ তার স্বাভাবিক রূপকে বদল করে দেয় নি। … যে কবিদের কাব্যরূপ অভিব্যক্তির প্রাণিক নিয়মপথে চলেছে তাঁদের রচনার স্বভাব আধুনিকও হতে পারে সনাতনীও হতে পারে অথবা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু তার চেহারাটা হবে তাঁদেরই, সে কখনোই এলিয়টের বা অডিনের বা এজরা পাউন্ডের ছাঁচে ঢালাই করা হতেই পারে না। … যে কবির কবিত্ব পরের চেহারা ধার করে বেড়ায় সত্যকার আধুনিক হওয়া কি তার কর্ম?’

রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে অবিশ্রাম লেখালিখির পাশাপাশি বিরামহীনভাবে অন্যদের লেখা বই-পত্র পাঠ করে গেছেন। বিচিত্রবিধ বিষয়ে কৌতূহল ছিল তাঁর। নানাভাবে সেসব বই-পত্র সংগ্রহ করেছেন। বিশ শতকের আধুনিক ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। পাঠক রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার ইতিহাস এখনো আমাদের চোখের সামনে সম্যকভাবে ফুটে ওঠে নি। এর কিছু সংকেত পাই তার চিঠি-পত্রে। অমিয় চক্রবর্তী তাকে বিভিন্ন সূত্রের খবর পাঠাতেন, মাঝে মাঝে বই-পত্র যোগাড় করে পাঠাতেন। এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখছেন :’তুমি এখনকার ইংরেজ কবিদের যে সব নমুনা কপি করে পাঠাচ্চ পড়ে আমার খুব ভালো লাগচে,- সংশয় ছিল আমি বুঝি দূরে পড়ে গেছি, আধুনিকদের নাগাল পাব না- এই কবিতাগুলি পড়ে বুঝতে পারলুম আমার অবস্থা অত্যন্ত বেশি শোচনীয় হয়নি। তুমি যদি এই সময়ে কাছে থাকতে তোমার সাহায্যে বর্তমান সাহিত্যের তীর্থ পরিক্রমা সারতে পারতুম।’ অমিয় চক্রবর্তী তাকে এলিয়টের কাব্য-নাট্য ‘দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন’ পাঠিয়েছিলেন। পড়ে কবি লিখেছেন :’ঋধসরষু জবঁহরড়হ বইখানি গভীরভাবে ভালো লেগেছে। যদি মন স্থির করতে পারি পরে তোমাকে কিছু লিখব।’ কী বলতে চেয়েছিলেন, তা আর পরে লেখা হয়ে ওঠেনি।

রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, এলিয়ট তিরিশের যুগের হিড়িক মেনে প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চান নি। এলিয়টের অনুসারীদের মধ্যে বামধারার কবি স্টিফেন স্পেন্ডারও ছিলেন। ইংরেজ ঔপন্যাসিক ই. এম. ফস্টার এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের একটি ছোট্ট সমালোচনা করেছিলেন। এদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তা এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যবিশ্বাসের মিলের জায়গাটিকে বুঝতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন :

‘স্পেন্ডর ও ফস্টরের দুটি চটি বই পড়লুম। আমার নিজের মত এই যে আমরা অর্থনীতি বা ধর্মনীতিতে যে দলেরই লোক হই আমাদের সেই দলাদলি যে সাহিত্যকে বিশেষ ছাঁদে গড়ে তুলবেই এমন কোনো কথা নেই। রসের দিক থেকে মানুষের ভালমন্দ লাগা কোনো মতকে মানতে বাধ্য নয়। আমার মনটা হয়তো সোশিয়ালিস্ট, আমার কর্মক্ষেত্রে তা ভিতর থেকে প্রকাশ পেতেও পারে কিন্তু উর্বশী কবিতাকে যে স্পর্শও করে না। … মার্কসিজমের ছোঁয়াচ যদি কারো কবিতায় লাগে, অর্থাৎ কাব্যের জাত রেখে লাগে, তাহলে আপত্তির কথা নেই, কিন্তু যদি নাই লাগে তাহলে কি জাত তুলে গাল দেওয়া শোভা পায়?’

এলিয়টের ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়ে নি। এর কারণ এর দীর্ঘ কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে। পড়লে সেটি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়াত বিষয়বস্তুর গুণেই। এটি ছিল এলিয়টের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এর ভাব ও ছন্দ-ব্যঞ্জনা সব ধারার কবির মধ্যেই আলোড়ন ফেলেছিল। সেই উচ্ছ্বাসের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় ‘মার্কসবাদী’ কবি সমর সেনের চিঠি-পত্রে।

৩. তরুণতর প্রজন্মের চোখে এলিয়ট

বিশেষভাবে সমর সেনের কথাইবা তুললাম কেন? তার একটা কারণ ‘বুর্জোয়া-ডেকাডেন্সের’ রূপকার এলিয়টের প্রতি সমাজ-পরিবর্তনকামী ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সাথী সমর সেন কেন উৎসুক হয়ে উঠবেন- এ নিয়ে বাড়তি কৌতূহল হতেই পারে। দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অরুণ সেনের ছেলে সমর সেন প্রথম যৌবনে কবিতা লিখে রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এরা সকলেই সমর সেনের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন। চল্লিশের যুগে বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু বরাবরই ছিলেন বৃত্তের বাইরের দলছুট মানুষ। প্রগতিশীল রাজনীতি নিয়ে পরিহাস করতে জানতেন তিনি যেমন, সবার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সংকীর্ণতা নিয়ে বিদ্রূপ করতে পিছু-পা হতেন না সেই তরুণ বয়সেই। একবার বুদ্ধদেব বসুকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য নিয়ে চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন- ‘সুকান্ত কি মহাকবি? আমার কল্পনা ও বোধশক্তি এত কমে গিয়েছে যে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি না।’ বিষ্ণু দে-কে তির্যকভাবে আখ্যায়িত করতেন ‘মহাকবি’ বলে। তার শ্নেষাত্মক বচন থেকে প্রায় কেউই রক্ষা পাননি। বিষ্ণু দেকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘ধূর্জটিবাবু আজকাল আবার সমালোচনার নামে সুধীন্দ্রনাথের চর্চা শুরু করেছেন। বাংলা কবিতা=সুধীন্দ্রনাথ; সুধীন্দ্রনাথ=ভারতীয় ঐতিহ্য। … তারপর রবীন্দ্রনাথ আবার তাঁকে কী যেন করার ভার মৃত্যুর পূর্বে দিয়ে গিয়েছেন।’ একবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছেন, ‘শুনে সুখী হবেন যে রবীন্দ্র রচনাবলী মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। এখন পর্যন্ত কোনো মহান ‘সত্যের’ মুখোমুখি হইনি।’ সবাইকেই তিনি কমবেশি শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু গুরুবাদ, প্রশ্নাতীতভাবে সবাইকে মেনে নেওয়ার রীতি, চাটুকারবৃত্তি এসবের লক্ষণ দেখলে সমর সেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং মনের ভাব তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন না। ভারতবর্ষের বা বাঙালির ইতিহাস তার কাছে খুব গৌরবময় মনে হতো না। ব্রেখটের মতো সমর সেনও জাতীয় ইতিহাসের মধ্যে কেবলই অত্যাচার-অবমাননা-শোষণের ছায়া দেখেছিলেন। চল্লিশ দশকের শুরুতেই তিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন :

‘আমরা বাঙালী মীরজাফরী অতীত; মেকলের বিষবৃক্ষের ফল।
অনেক দিন ভেবেছি,
অনেক বার ভেবেছি:
ভবিষ্যতে বীজবাহী না হয়। এ বিষবৃক্ষ শেষ হোক…’
অন্যত্র, নতুন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে লিখেছেন,
‘মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবীতে আলো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।
কলতলার ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্ত ক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক সভ্যতার রুক্ষ মরুভূমি।’
[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৪

[পূর্ব প্রকাশের পর]

২. রবীন্দ্রনাথের এলিয়ট

টি.এস. এলিয়ট নিয়ে গত এক শতাব্দী ধরে এত লেখালিখি হয়েছে যে, এ নিয়ে বাড়তি কোনো তথ্য বা তত্ত্ব যোগ করা দুরাশা মাত্র। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ যেমন, ইংরেজি কবিতার ক্ষেত্রে এলিয়টও তেমনি। তারপরও এলিয়ট পাঠে কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধে যার উত্তর সহজে মেলে না। আমার কাছে প্রশ্নগুলো ধাঁধার মত মনে হয়। এই প্রশ্নগুলোকে তিনটি শিরোনামে বিন্যস্ত করা যায় :

ক. রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু এলিয়ট রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে এত নির্বিকার ছিলেন কেন? তার প্রবন্ধ-সাহিত্যে, এমনকি সম্প্রতি ৩-খণ্ডে প্রকাশিত এলিয়টের সংগৃহীত চিঠিপত্রে কোথাও রবীন্দ্রনাথের কোন উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এলিয়ট-সখা এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন, পত্রালাপ করেছেন, গিয়ে একাধিকবার সরাসরি দেখা করেছেন, কিন্তু এলিয়ট এত দৃষ্টিকটুভাবে নীরব কেন ছিলেন পূর্বাপর? অথচ দু’জনেই তো ছিলেন কম-বেশি একই পথের পথিক- একত্ববাদী (ইউনিটেরিয়ান) আদর্শে, বিশ্বজনীন চিন্তায় ও পূর্ব-পশ্চিমের যোগসূত্র স্থাপনে তৎপর?

খ. এলিয়ট পরবর্তী জীবনে খ্রিষ্টীয় ধর্মাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েন, এ রকম কথা চালু রয়েছে। কিন্তু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য ধর্ম, ভাষা ও দর্শনের ছাত্র হিসেবে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় বেশ কিছুটা দক্ষতা জন্মেছিল তার। পাণিনি-ভতৃহরি পাঠ করেছিলেন তিনি। পতঞ্জলির দর্শন, সাংখ্য, উপনিষদ সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন ছিল তার। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে তার বাস্তবিক অনুরাগ ছিল। এলিয়টের কবিতায় ও সামগ্রিক দর্শনবোধে প্রাচ্যবিদ্যার প্রভাব কতখানি ফলদায়ী হয়েছিল?

গ. তৃতীয় প্রশ্নটি আধুনিকতার পাশ্চাত্যনির্ভর সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা নিয়ে। আধুনিক চিত্রকলায় পিকাসোর কিউবিস্ট নিরীক্ষার ওপরে আফ্রিকার চিত্রকলার (মুখোশ ও ভাস্কর্য) প্রভাব সুবিদিত। এমনটাই ঘটেছিল পল ক্লী-র ক্ষেত্রে। এনি এলবার্সের শিল্পকলায় যেমন প্রভাব ফেলেছিল আজটেকদের আর্ট। অর্থাৎ প্রতীচ্যের আধুনিকতার নির্মাণে প্রাচ্যের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল। এলিয়টের বা পাউন্ডের কাব্যচর্চায় ‘আধুনিকতার’ নির্মাণে প্রাচ্যের সরাসরি বা পরোক্ষ অবদানের যে সাক্ষ্য মেলে, তাতে করে কি পাশ্চাত্যনির্ভর আধুনিকতার ইতিহাসকেই পুনর্লিখন করার তাগিদ দেখা দেয় না? তাতে করে ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী যাকে বলেছিলেন, ‘Provincializing Europe’ সে ধরনের তাগিদেরই বাড়তি সমর্থন পাওযা যায় না কি?

রবীন্দ্রনাথের তরফে এলিয়টের প্রতি মনোযোগী উৎসাহের সপক্ষে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত জড়ো করা সম্ভব। সেগুলো সংক্ষেপে একঝলক দেখে নিতে পারি।

১. বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন গদ্য কবিতা বিষয়ে লিখবার জন্য। সেই তাগিদে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার ‘গদ্যকাব্য’ প্রবন্ধটি, যেটি বুদ্ধদের-সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে (পরবর্তীকালে ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ গ্রন্থে ‘কাব্য ও ছন্দ’ নামে প্রকাশিত)। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ যে পত্র লেখেন তাতে এলিয়টের নাম উঠে আসে :

‘গদ্যকাব্য সম্বন্ধে তর্ক না করে যথেচ্ছা লিখে যাওয়াই ভালো। আজ যারা আপত্তি করচে কাল তারা নকল করবে। এলিয়ট প্রমুখ অনেক কবি নির্মিল নিশ্ছন্দ কবিতা লিখে চলেচেন…’

২. কবি বিষুষ্ণ দের ‘চোরাবালি’ কাব্যগ্রন্থে বিদেশি প্রসঙ্গ- অনুষঙ্গের প্রাবল্য দেখে রবীন্দ্রনাথের অস্বস্তি হয়েছিল। এ নিয়ে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। সেখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের Waste Land, Ash-Wednesday, Ariel Poems প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ কতটা ঘনিষ্ঠভাবে কতটা মনোযোগের সাথে পাঠ করেছিলেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটা তুলে ধরছি : ‘… বিষ্ণু দের লেখার একটা কারণে আমার খটকা লাগে। আমরা য়ুরোপীয় সাহিত্য এক সময়ে গভীর আনন্দ ও অধ্যবসায়ের সঙ্গেই পড়েছিলুম। মনটা তার সঙ্গে ভাবের কারবার করেছিল, কিন্তু বিদেশি নামগুলো স্বভাবতই রচনার মধ্যে এসে পড়ে না। … ক্রেসিডা গ্রীক পুরাণের তর্জমা থেকে পড়েছি, তার সঙ্গে মনের এত বেশি মাখামাখি হয়নি যে, ভাবের অন্তরঙ্গমহলে যখন তখন আপনি এসে চেনা জায়গা নিতে পারে। এলিয়ট-এর কবিতার ভাষার আত্মীয়মহলে অসঙ্কোচে বিদেশি নামের বা পুরাণের ঢুকে পড়া দেখেছি, তাঁর এই বিশেষত্ব এত স্বকীয় যে, অন্য কারো পক্ষে এটা অনুকরণের সুস্পষ্ট মুদ্রাদোষ হয়ে পড়ে। এ রকম স্খলন যদি দৈবাৎ হয় তবে সেটা নিয়ে লজ্জিত হওয়া প্রত্যাশা করি কিন্তু বার বার যদি হয়, তবে সেটাকে কী বলব? বিশেষত তুলনা করে দেখলে দেখা যাবে যে, দেশীয় পুরাণ থেকে তার কবিতায় নামগুলি পথ পায় না। সহজ বলেই কি?’

এখানে বলা দরকার যে, এলিয়ট তার কবিতার নির্মাণে অন্য সূত্র থেকে (অন্য কবির লেখা, পুরান মহাকাব্য বা দার্শনিক টেক্সটের) বিচ্ছিন্ন লাইন, উপমা, চিত্রকল্প, খণ্ড সংলাপ, বাক্যাংশ প্রায়শ ব্যবহার করতেন। সেসব মৃত লাইন এলিয়টের হাতে ব্যবহূত হয়ে এক নতুন জীবন পেত; কখনো কখনো মূলের অর্থই বদলে যেত; আবার কখনো নতুনের সাহচর্যে এসে পুরাতন ভাবভঙ্গি অপ্রত্যাশিতভাবে আধুনিকতার দ্যোতনা পেত। রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, এ কাজটি এলিয়ট অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সম্পাদন করেছেন বলেই এটি তার কাব্যকলার একটি জরুরি প্রকরণ-অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

৩. কবি বিষ্ণু দে এলিয়টের Ariel Poem-এর প্রথম কবিতা ‘Journey of Magi’ অনুবাদ করে ‘সংশোধনের জন্য’ রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এটির তিনটি পাঠ পাওয়া যায়। বিষ্ণু দের অনুবাদ সংশোধন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, “ইতিমধ্যে শ্রী বিষ্ণু দে ‘পুনশ্চ’-এর নকলে ‘এলিয়ট’-এর একটা তর্জ্জমা পাঠিয়াছিল, পড়ে দেখলুম। কমলি ছোড়তি নেই- গদ্যের ঘাড়ে পদ্য কামড়ে ধরেচে।” বিষ্ণু দের নিজের অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথের হাতে সংশোধিত হয়ে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর আরেকটি পাঠ পাওয়া যায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘স্বগত’ প্রবন্ধমালার ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে। আর সবশেষ পাঠটি সংকলিত হয় ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ শিরোনামে। এই তিনটি পাঠের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য বয়ে গেছে। ধারণা হয় যে, রবীন্দ্রনাথ সে পর্যায়ে (১৯৩০-৩১ সালের কথা হচ্ছে এখানে) বাংলায় গদ্যছন্দের প্রকাশভঙ্গি, সীমা-পরিসীমা নিয়ে অনবরত ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করে চলেছিলেন। আর এ ক্ষেত্রে তিনি এলিয়টের কবিতাকেই বিশেষ করে বেছে নিয়েছিলেন। এর থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়ার পর্বের টালমাটাল পথ চলার ছবিটিও বেশ ফুটে ওঠে। ‘জার্নি অব দি মেজাই’ কবিতাটির প্রথম স্তবকের তিনটি পাঠ যথাক্রমে নিচে তুলে ধরা হলো। সমগ্র কবিতা ধরলে পাঠান্তরের অমিল আরো বেশি করে চোখে পড়বে।

ক. বিষ্ণু দে-কৃত অনুবাদ :

‘আমাদের সে যাত্রা হিমে
বছরের সবচেয়ে খারাপ সময়ে
অভিযান ওরকম দীর্ঘ অভিযান :
পথঘাট কাদায় গভীর ক্ষুরধার হাওয়া
দুর্গম পথ, শীতের চরম।
আর উটগুলি উত্ত্যক্ত, খুরে ঘা, তেরছা মেজাজ
থেকে থেকে শুয়ে পড়ে গলন্ত বরফে।’
খ. বিষ্ণু দে-কে প্রেরিত রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক সংশোধিত পাঠ :
‘শীতরুক্ষ আমাদের যাত্রা,
ভ্রমণ দূরদেশের দিকে।
অত দীর্ঘ ভ্রমণের সময় এ তো নয় একেবারেই।
পথ দুর্গম, বাতাস ক্ষুরের মত শান দেওয়া
কনকনে শীত।
উটগুলো হয়রান, পায়ে ক্ষত, বিরক্ত বিমুখ, তারা
গলে-পড়া বরফে শুয়ে শুয়ে পড়ে।’
গ. সুধীন্দ্রনাথের ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদের উদ্ৃব্দতি :
‘কনকনে ঠাণ্ডায় হল আমাদের যাত্রা-
ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সবচেয়ে খারাপ,
রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,
একেবারে দুর্জয় শীত।
উটগুলোর ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা মেজাজ চড়া,
তারা শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।’
ঘ. ‘পরিচয়’ পত্রিকায় (মাঘ-১৩৩৯), প্রকাশিত [ও ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ নামে অন্তর্ভুক্ত] রবীন্দ্রনাথ-কৃত এলিয়টের অনুবাদ :

‘কন্‌কন্‌ে ঠাণ্ডায় আমাদের যাত্রা-
ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সব চেয়ে খারাপ,
রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,
একেবারে দুর্জয় শীত।
ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা, মেজাজ-চড়া উটগুলো
শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।’
তবে ‘পুনশ্চ’ কাব্যে এলিয়টের কবিতা যে ‘তীর্থযাত্রী’ শিরোনামে অনূদিত হয়ে সমমানে স্থান পেল তা আকস্মিকভাবে ঘটেনি। যে বছর পুনশ্চ প্রকাশ পায়, সে বছরই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রবন্ধ ‘আধুনিক কাব্য’ (১৯৩২)। সেখানে রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রুফ্রক’ (১৯১৭) থেকে দীর্ঘ উদ্ৃব্দতি দিচ্ছেন আধুনিক (গদ্য) কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার জন্য। কোন বিষয়ই আর কবিতার ত্রিসীমার বাইরে থাকছে না- এটি বোঝাতে তিনি এলিয়টকেই বেছে নিয়েছেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে :

‘কেউ সুন্দর, কেউ অসুন্দর; কেউ কাজের, কেউ অকাজের; কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ছুতোয় কাউকে বাতিল করে দেওয়া অসম্ভব। সাহিত্যে, চিত্রকলাতেও সেইরকম। কোনো রূপের সৃষ্টি যদি হয়ে তাকে তো আর কোনো জবাবদিহি নেই; যদি না হয়ে থাকে, যদি তার সত্তার জোর না থাকে, শুধু থাকে ভাবলালিত্য, তা হলে সেটা বর্জনীয়। এইজন্য আজকের দিনে যে সাহিত্য আধুনিকের ধর্ম মেনেছে, সে সাবেককালের কৌলীন্যের লক্ষণ সাবধানে মিলিয়ে জাত বাঁচিয়ে চলাকে অবজ্ঞা করে, তার বাছবিচার নেই। এলিয়টের কাব্য এইরকম হালের কাব্য, ব্রিজেসের কাব্য তা নয়।’

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

নতুন প্রসঙ্গ

পর্ব ::২৩

১. টি.এস. এলিয়ট : আধুনিক ধারার পথিকৃৎ

‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে ষাট-সত্তর দশকের কবিতার আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে বলতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঘুরে-ফিরে বোদলেয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন। ষাটের দশকের শুরুতে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে ‘শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা’ প্রকাশের পর দুই বাংলাতেই কবিকুলের ওপরে ফরাসি প্রভাব ঘনীভূত হয়েছিল। অধ্যাপক সায়ীদ লিখেছেন :

‘পশ্চিম ইয়োরোপ আর আমেরিকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যসর্বস্ব রুগ্‌ণ ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতি ধারার… ঘুণেধরা ও বিকারগ্রস্ত প্রবণতাগুলো… আমাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছিল। আমেরিকার বিটনিকদের প্রভাব পড়েছিল সরাসরি। পশ্চিমবঙ্গের তরুণ সাহিত্যের অবক্ষয়ী ধারাটি হয়ে উঠেছিল আমাদের দোসর। তবে বাইরের যেসব অবক্ষয়ী প্রভাব আমাদের সাহিত্যিকভাবে আক্রান্ত করেছিল, তার মধ্যে আমার মনে হয়, সবচেয়ে সর্বাত্মক ও গভীর ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি কবি বোদলেয়ারের প্রভাব।’

এই বিবরণীতে কোথাও টি.এস. এলিয়টের উল্লেখ নেই। পরোক্ষভাবে, এক জায়গায় ‘ফাঁপা মানুষ’ কথাটার উল্লেখ রয়েছে, যা এলিয়টের ÔWe are the hollow menÕ’-এর প্রতি ইঙ্গিত। এটি কিছুটা বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না। তিরিশের যুগে রবীন্দ্রনাথের সাথে বুদ্ধদেব বসুদের যখন চিঠিপত্রে তর্কালাপ হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি নিয়ে, তখন প্রথমেই যে-নামটি চলে এসেছে সেটি এলিয়টের নাম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের একাধিক কবিতার অনুবাদ করেছেন; সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘স্বগত’ গ্রন্থে এলিয়টকে নিয়ে উদ্ৃব্দতি-বহুল একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন; বিষ্ণু দে আলাদা করে প্রকাশ করেছেন ‘এলিঅটের কবিতা’ শীর্ষক অনূদিত কাব্যগ্রন্থ; জীবনানন্দ দাশের একাধিক প্রবন্ধে ঘুরে-ফিরে এসেছে এলিয়টের নাম। ওয়েস্টল্যান্ড ও ফোর কোয়ারটেটস্‌ যার হাত দিয়ে বেরিয়েছে তার সম্পর্কে ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে বিস্ময়কর নীরবতা কৌতূহলোদ্দীপক, সন্দেহ নেই। বিশেষত যদি মনে রাখি যে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংকট, অবক্ষয় ও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে প্রবল প্রভাববিস্তারকারী কবিতা এলিয়টের হাত দিয়েই নিষ্ফ্ক্রান্ত হয়েছিল। এই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ইংরেজিতে লিখিত হওয়ার কারণে এলিয়টের অনেক কবিতাই বা কবিতার নানা বিচ্ছিন্ন পঙ্‌ক্তিমালাই পাঠকের মুখে মুখে ফিরত। বোদলেয়ারের ক্ষেত্রে যেটা সম্ভবপর ছিল না বুদ্ধদেব বসুর অনুপম অনুবাদের পরও।

আমরা যারা সত্তর দশকে এলিয়টের কবিতার নিমগ্ন পাঠক ছিলাম, তাদের কাছে এলিয়টের স্থান ছিল হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। ‘লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক’ আমরা ঘরে-বাইরে আবৃত্তি করেছি :

‘Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherised upon a table’

অথবা,

‘In the room the women come and go
Talking of Michelangelo’

অথবা,

‘I grow old… I grow old…
I shall wear the bottoms of my trousers rolled.’

বা

‘There will be time to murder and create,
And time for all the works and days of hands
That lift and drop a question on your plate;
Time for you and time for me,
And time yet for a hundred indecisions,
And for a hundred visions and revisions,
Before the taking of a toast and tea’

এবং সবশেষে

ÔNo! I am not prince Hamlet, nor was meant to be;
Am an attendant lord, one that will do
To swell a progress, start a score or twoÕ

‘প্রুফ্রক’ লেখা হয়েছিল ১৯১৭ সালে- প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতরে। এই যুদ্ধের ধংসাবশেষের ওপরে ১৯২২ সালে লেখা হয় এলিয়টের সর্বাধিক পরিচিত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড।’ এই কাব্যগ্রন্থটিও আমাদের প্রজন্মের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আধুনিকতার জন্মই বলতে গেলে হয়েছিল ঐ বছরে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ উপন্যাস, হারমান হেস-এর সিদ্ধার্থ, এবং বরিস পাস্তারনাকের ‘মাই লাইফ সিস্টার’ (জীবন আমার বোন)। [ঐ বছরেই প্রকাশ পায় আইনস্টাইনের ‘দ্য মিনিং অব রিলেটিভিটি]। প্রুফ্রক আমাদের মুগ্ধ করেছিল ঠিক, কিন্তু ওয়েস্ট ল্যান্ড আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কবিতার মধ্যে নাটকীয় সংলাপ স্থাপনা, উক্তি ও পুনরুক্তি, আকস্মিক দার্শনিক স্বগত সংলাপ, ঘরের ও বাইরের পৃথিবীর মধ্যকার দেয়াল ভেঙে-পড়া, প্রথাগত মূল্যবোধের বিপর্যয়, ইতি ও নেতির দ্বন্দ্বে দীর্ণ শূন্য মানুষ, সভ্যতার সংকট- এই সবই ছিল সেখানে। এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে আধুনিকতার মৌলিক অনুভব হয়েছিল। পরপর কয়েকটি বহু-উদ্ৃব্দত লাইন নিচে তুলে ধরছি :

১. April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.

২. Unreal City,
Under the brown fog of a winter dawn,
A crowd flowed over London Bridge, so many.
I had not thought death had undone so many.

৩.‘My nerves are bad to-night. Yes, bad. Stay with me.’
‘Speak to me. Why do you never speak. Speak’
‘What are you thinking of? What thinking? What?’
‘I never know what you are thinking. Think.’

৪. I think we are in rats’ alley
Where the dead men lost their bones.

৫. ‘What shall I do now? What shall I do?’
‘I shall rush out as I am, and walk the street.’
‘With my hair down, so. what shall we do tomorrow? ‘What shall we ever do?’
The hot water at ten.
And if it rains, a closed car at four.
And we shall play a game of chess.
Pressing lidless eyes and waiting for a knock upon the door.

৬. When lovely woman stoops to folly and
Paces about her room again, alone.
She smoothes her hair with automatic hand.
And puts a record on the gramophone.

৭. Who is the third who walks always beside you?
… … … … … … …
I do not know whether a man or a woman
– But who is that on the other side of you?

১০. 10. London Bridge is falling down falling down falling down
… … … … … … …
These fragments I have shored against my ruins.
… … … … … … …
Datta. Dayadhvam. Damyata.
Shantih shantih shantih

কবি নিজে ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যগ্রন্থের জন্য পাদটীকা প্রস্তুত করেছিলেন। ওয়েস্ট ল্যান্ডের আদি খসড়ার সাথে প্রকাশিত পাঠের মধ্যে স্থানে স্থানে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছিল। কিছুটা কবি এজরা পাউন্ডের খুঁটিনাটি মন্তব্যের কারণে, কিছুটা কবির নিজের পুনর্চিন্তায়। কবি-কৃত পাদটীকার সংখ্যা ছিল ৪৩৩টি; কিন্তু তাতেও এই দীর্ঘ কবিতার সম্পূর্ণ উপলব্ধি হয় না। উনিশ বছর বয়সে যখন পাঠ করেছি, তখনও ওয়েস্ট ল্যান্ড হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, যদিও সমস্ত অনুষঙ্গ সে বয়সে করায়ত্ত হয়নি। একষট্টি বছরে যখন পাঠ করেছি, তখন অনেকটাই বুঝেছি যে কোন লাইনটা কোন বই থেকে বা কোন সাহিত্যিক প্রয়োজন মেটাতে লেখা, কিন্তু তারপরও রহস্য এতটুকু কমেনি। এ বই এলিয়টকে চূড়ান্ত খ্যাতি এনে দিয়েছিল- ইংরেজি আধুনিক কাব্য চর্চার জগতে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছিল শীর্ষস্থানীয় আসনে। কিন্তু তারপরও কবির যাত্রা থেমে থাকেনি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে- লেখা হবে তার ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’; এর মধ্যকার ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস’ কবিতাটি হবে তার মহত্তম সৃষ্টি।

আমার মনে পড়ে, অগ্রজ অর্থনীতিবিদ (ও কবি) আবু আবদুল্লাহর প্রিয় কাব্যগ্রন্থের একটি ছিল এলিয়টের ফোর কোয়ারটেটস্‌। আবু আবদুল্লাহর কাব্যরুচির ওপরে আমার পূর্বাপর অগাধ নির্ভরতা ছিল। এই কাব্যগ্রন্থের থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক স্তবক ও পঙ্‌ক্তিমালা তার মুখে আবৃত্তি হতে শোনা গেছে। তার বড় ভাই অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার মত তিনিও ছিলেন কবিতার বড় সমজদার ও আবৃত্তিকার। আবু আবদুল্লাহ অনর্গল পড়ে যাচ্ছেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছি :

১১. Houses live and die : there is a time for building
And a time for living and for generation

১২. There is, it seems to us,
At best, only a limited value
In the knowledge derived from experience.
The knowledge imposes a pattern, and falsifies,
For the pattern is new in every moment
And every moment is a new and shocking
Valuation of all we have been.

১৩. So here I am, in the middle way, having had twenty years
Twenty years largely wasted …
Trying to learn to use words, and every attempt
Is a wholly new start, and a different kind of failure.

১৪. We shall not cease from exploration
And the end of all our exploring
Will be to arrive where we started
And know the place for the first time.

কবি হায়াৎ সাইফের সাথে আবু আবদুল্লাহর একটি যুগলবন্দি- এক মলাটে দুই জনের আলাদা আলাদা কবিতা সংবলিত কাব্যগ্রন্থ- বেরিয়েছিল, মনে পড়ে।

[ক্রমশ]