পর্ব ::২৫
[পূর্ব প্রকাশের পর]
এটা বলার পর তিনি এলিয়টের প্রুফ্রক কাব্যগ্রন্থের ‘প্রিলিউড’ কবিতার প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকটি অনুবাদ করে আধুনিক কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্যের দিকটি দেখালেন। আমি শুধু প্রথম স্তবকটি মূলের ইংরেজি পাঠ ও তার রবীন্দ্র্রনাথ-কৃত অনুবাদ নিচে তুলে ধরছি।
‘The winter evening settles down
With smell of steaks in passage ways
Six o’clock.
The burnt-out ends of smoky days.
And now a gusty shower wraps
the grimy scraps
Of withered leaves about your feet
And newspapers from vacant lots
the showers beat
On broken blinds and chimney-pots,
And at the corner of the street
A lonely cab-horse steams and stamps’
রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদ :
‘এ-ঘরে ও-ঘরে যাবার রাস্তায় সিদ্ধ মাংসর গন্ধ,
তাই নিয়ে শীতের সন্ধ্যা জমে এল।
এখন ছ’টা-
ধোঁয়াটে দিন, পোড়ো বাতি, যে অংশে ঠেকল।
বাদলের হাওয়া পায়ের কাছে উড়িয়ে আনে
পোড়ো জমি থেকে ঝুলমাখা শুকনো পাতা
আর ছেঁড়া খবরের কাগজ।
ভাঙা সার্শি আর চিম্নির চোঙের উপর
বৃষ্টির ঝাপট লাগে,
আর রাস্তার কোণে একা দাঁড়িয়ে এক ভাড়াটে গাড়ির ঘোড়া,
ভাপ উঠছে তার গা দিয়ে আর সে মাটিতে ঠুকছে খুর।
পুনশ্চ ও পরিচয়ে প্রকাশিত অনূদিত কবিতার মধ্য দিয়ে এলিয়টের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস ভালো-লাগার যে-প্রকাশ ঘটেছিল, তা আমৃত্যু অটুট ছিল। ১৯৩৬ সালের স্পেনিশ সিভিল ওয়ারের সময় জেনারেল ফ্রাংকোর বাহিনীর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের পক্ষে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’ গঠিত হয়েছিল। সেখানে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীই প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন বা পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এলিয়টের বিবৃতির জন্য তাকে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাতে স্বাক্ষর করেন নি। এটি অনেক প্রগতিমনা শিল্পী-সাহিত্যিককে ক্ষুব্ধ করেছিল। এটা ঠিক যে, এজরা পাউন্ডের মত ফ্যাসিবাদী শক্তির পক্ষে এলিয়ট কখনোই ঝোঁকেন নি, কিন্তু তারপরও তার কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। অমিয় চক্রবর্তী এলিয়টের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের দিকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন। বিষ্ণু দে এলিয়টের ভক্ত- সে অভিযোগ মানেন নি। বলেছিলেন, ‘পাউন্ডের মতো এলিয়ট [ফ্যাসিজমের স্নায়ুবিকারে] ঝোঁকেন নি। তাঁর বিবেচনায় ইংরেজি গির্জার আশ্রয়ে ক্যাথলিক ঐতিহ্যের নিরাপদ দিব্যভাবের আবেদন বেশি।’ রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক মত নিয়ে তরুণ কবিকুলের মধ্যকার এই বিতর্ক সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু এলিয়টের কবিকৃতির মূল্যায়নে তা কোন প্রভাব ফেলেনি। কামাখ্যাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি সেকথা নির্দি্বধায় প্রকাশ করেছেন। ১৯৪০ সালে লেখা এ চিঠিটি [শারদীয় দেশ, ১৯৭৩] এলিয়ট ও আধুনিক কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :
‘এলিয়ট অডেন প্রভৃতি আধুনিক ইংরেজ কবির মনে বর্তমান কালের দুর্যোগের যে আঘাত লেগেছে সেটা সত্য এবং প্রচণ্ড। সেই সংঘাতে চিন্তার তরঙ্গ উঠে আগেকার কালের অভ্যস্ত ভাষাধারার কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। ভঙ্গি বদল হয়েছে কিন্তু তাঁদের রচনায় এ যুগের বাণী উঠছে জেগে কতক স্পষ্ট রূপ নিয়ে কতক অস্পষ্ট ব্যঞ্জনায়। তাঁরা যথার্থ কবি এইজন্যে বাণী তাঁদের মনে আলোড়িত হয়ে উঠলে সেটা ব্যক্ত না করে থাকতে পারেন না বলেই লেখেন। কিন্তু যে সাহিত্যে মানুষকে বলবার মতো কোনো বাক্য দুর্নিবার হয়ে ওঠেনি কেবলমাত্র একটা এলোমেলো প্যার্টান্ চলেছে আঁকাবাকা আঁকজোক কেটে সেখানে মন কোন একটা দান পায় না কেবল হুঁচোট খেয়ে খেয়ে মরে। সে সাহিত্যে একটা কোনো তাৎপর্য হাৎরিয়ে বেড়ানোর মতো ক্লান্তিকর আর কিছুই নেই।’
এলিয়ট একুশের আধুনিকতার অকৃত্রিম অনুভূতিকে ব্যক্ত করছে এজন্যই তাদের কাব্য-প্রকাশ অনবদ্য হতে পেরেছে, এ-ই ছিল কবির অভিমত। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ কবিতা আর ১৯৪০ সালে লেখা উপরোক্ত চিঠির মধ্যবর্তী সময়ে এলিয়টের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের চিঠি-পত্রে এসেছে বেশ কয়েক বার। এর থেকে বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের এলিয়ট-অনুরুক্তি সময়ের সাথে কেবল গভীরতর হয়েছে। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পাই কবির সাথে অমিয় চক্রবর্তীর পত্রালাপে। বাংলার তরুণ প্রজন্মের আধুনিক কবিকুলকে তিনি অনুকৃতির পথে নয়, তাদের ‘স্বাভাবিক প্রাণগত অভিব্যক্তির’ পথে চলতে বলছেন। ১৯৩৯ সালের এই চিঠিতে কবি বলছেন :’দেশ-বিদেশ থেকে নানারকম ভাবের প্রেরণা এসে পৌঁছেচে আমার মনে এবং রচনায়, তাকে স্বীকার করে নিয়েছি, তা আমার কাব্যদেহকে হয় তো বল দিয়েছে পুষ্টি দিয়েছে কিন্তু কোনো বাইরের আদর্শ তার স্বাভাবিক রূপকে বদল করে দেয় নি। … যে কবিদের কাব্যরূপ অভিব্যক্তির প্রাণিক নিয়মপথে চলেছে তাঁদের রচনার স্বভাব আধুনিকও হতে পারে সনাতনীও হতে পারে অথবা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু তার চেহারাটা হবে তাঁদেরই, সে কখনোই এলিয়টের বা অডিনের বা এজরা পাউন্ডের ছাঁচে ঢালাই করা হতেই পারে না। … যে কবির কবিত্ব পরের চেহারা ধার করে বেড়ায় সত্যকার আধুনিক হওয়া কি তার কর্ম?’
রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে অবিশ্রাম লেখালিখির পাশাপাশি বিরামহীনভাবে অন্যদের লেখা বই-পত্র পাঠ করে গেছেন। বিচিত্রবিধ বিষয়ে কৌতূহল ছিল তাঁর। নানাভাবে সেসব বই-পত্র সংগ্রহ করেছেন। বিশ শতকের আধুনিক ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। পাঠক রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার ইতিহাস এখনো আমাদের চোখের সামনে সম্যকভাবে ফুটে ওঠে নি। এর কিছু সংকেত পাই তার চিঠি-পত্রে। অমিয় চক্রবর্তী তাকে বিভিন্ন সূত্রের খবর পাঠাতেন, মাঝে মাঝে বই-পত্র যোগাড় করে পাঠাতেন। এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখছেন :’তুমি এখনকার ইংরেজ কবিদের যে সব নমুনা কপি করে পাঠাচ্চ পড়ে আমার খুব ভালো লাগচে,- সংশয় ছিল আমি বুঝি দূরে পড়ে গেছি, আধুনিকদের নাগাল পাব না- এই কবিতাগুলি পড়ে বুঝতে পারলুম আমার অবস্থা অত্যন্ত বেশি শোচনীয় হয়নি। তুমি যদি এই সময়ে কাছে থাকতে তোমার সাহায্যে বর্তমান সাহিত্যের তীর্থ পরিক্রমা সারতে পারতুম।’ অমিয় চক্রবর্তী তাকে এলিয়টের কাব্য-নাট্য ‘দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন’ পাঠিয়েছিলেন। পড়ে কবি লিখেছেন :’ঋধসরষু জবঁহরড়হ বইখানি গভীরভাবে ভালো লেগেছে। যদি মন স্থির করতে পারি পরে তোমাকে কিছু লিখব।’ কী বলতে চেয়েছিলেন, তা আর পরে লেখা হয়ে ওঠেনি।
রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, এলিয়ট তিরিশের যুগের হিড়িক মেনে প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চান নি। এলিয়টের অনুসারীদের মধ্যে বামধারার কবি স্টিফেন স্পেন্ডারও ছিলেন। ইংরেজ ঔপন্যাসিক ই. এম. ফস্টার এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের একটি ছোট্ট সমালোচনা করেছিলেন। এদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তা এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যবিশ্বাসের মিলের জায়গাটিকে বুঝতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন :
‘স্পেন্ডর ও ফস্টরের দুটি চটি বই পড়লুম। আমার নিজের মত এই যে আমরা অর্থনীতি বা ধর্মনীতিতে যে দলেরই লোক হই আমাদের সেই দলাদলি যে সাহিত্যকে বিশেষ ছাঁদে গড়ে তুলবেই এমন কোনো কথা নেই। রসের দিক থেকে মানুষের ভালমন্দ লাগা কোনো মতকে মানতে বাধ্য নয়। আমার মনটা হয়তো সোশিয়ালিস্ট, আমার কর্মক্ষেত্রে তা ভিতর থেকে প্রকাশ পেতেও পারে কিন্তু উর্বশী কবিতাকে যে স্পর্শও করে না। … মার্কসিজমের ছোঁয়াচ যদি কারো কবিতায় লাগে, অর্থাৎ কাব্যের জাত রেখে লাগে, তাহলে আপত্তির কথা নেই, কিন্তু যদি নাই লাগে তাহলে কি জাত তুলে গাল দেওয়া শোভা পায়?’
এলিয়টের ‘ফোর কোয়ারটেটস্’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়ে নি। এর কারণ এর দীর্ঘ কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে। পড়লে সেটি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়াত বিষয়বস্তুর গুণেই। এটি ছিল এলিয়টের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এর ভাব ও ছন্দ-ব্যঞ্জনা সব ধারার কবির মধ্যেই আলোড়ন ফেলেছিল। সেই উচ্ছ্বাসের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় ‘মার্কসবাদী’ কবি সমর সেনের চিঠি-পত্রে।
৩. তরুণতর প্রজন্মের চোখে এলিয়ট
বিশেষভাবে সমর সেনের কথাইবা তুললাম কেন? তার একটা কারণ ‘বুর্জোয়া-ডেকাডেন্সের’ রূপকার এলিয়টের প্রতি সমাজ-পরিবর্তনকামী ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সাথী সমর সেন কেন উৎসুক হয়ে উঠবেন- এ নিয়ে বাড়তি কৌতূহল হতেই পারে। দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অরুণ সেনের ছেলে সমর সেন প্রথম যৌবনে কবিতা লিখে রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এরা সকলেই সমর সেনের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন। চল্লিশের যুগে বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু বরাবরই ছিলেন বৃত্তের বাইরের দলছুট মানুষ। প্রগতিশীল রাজনীতি নিয়ে পরিহাস করতে জানতেন তিনি যেমন, সবার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সংকীর্ণতা নিয়ে বিদ্রূপ করতে পিছু-পা হতেন না সেই তরুণ বয়সেই। একবার বুদ্ধদেব বসুকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য নিয়ে চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন- ‘সুকান্ত কি মহাকবি? আমার কল্পনা ও বোধশক্তি এত কমে গিয়েছে যে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি না।’ বিষ্ণু দে-কে তির্যকভাবে আখ্যায়িত করতেন ‘মহাকবি’ বলে। তার শ্নেষাত্মক বচন থেকে প্রায় কেউই রক্ষা পাননি। বিষ্ণু দেকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘ধূর্জটিবাবু আজকাল আবার সমালোচনার নামে সুধীন্দ্রনাথের চর্চা শুরু করেছেন। বাংলা কবিতা=সুধীন্দ্রনাথ; সুধীন্দ্রনাথ=ভারতীয় ঐতিহ্য। … তারপর রবীন্দ্রনাথ আবার তাঁকে কী যেন করার ভার মৃত্যুর পূর্বে দিয়ে গিয়েছেন।’ একবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছেন, ‘শুনে সুখী হবেন যে রবীন্দ্র রচনাবলী মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। এখন পর্যন্ত কোনো মহান ‘সত্যের’ মুখোমুখি হইনি।’ সবাইকেই তিনি কমবেশি শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু গুরুবাদ, প্রশ্নাতীতভাবে সবাইকে মেনে নেওয়ার রীতি, চাটুকারবৃত্তি এসবের লক্ষণ দেখলে সমর সেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং মনের ভাব তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন না। ভারতবর্ষের বা বাঙালির ইতিহাস তার কাছে খুব গৌরবময় মনে হতো না। ব্রেখটের মতো সমর সেনও জাতীয় ইতিহাসের মধ্যে কেবলই অত্যাচার-অবমাননা-শোষণের ছায়া দেখেছিলেন। চল্লিশ দশকের শুরুতেই তিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন :
‘আমরা বাঙালী মীরজাফরী অতীত; মেকলের বিষবৃক্ষের ফল।
অনেক দিন ভেবেছি,
অনেক বার ভেবেছি:
ভবিষ্যতে বীজবাহী না হয়। এ বিষবৃক্ষ শেষ হোক…’
অন্যত্র, নতুন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে লিখেছেন,
‘মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবীতে আলো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।
কলতলার ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্ত ক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক সভ্যতার রুক্ষ মরুভূমি।’
[ক্রমশ]