বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৯২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


১৯৮২ সালে দৈনিক সংবাদের একটি লেখায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবু জাফর শামসুদ্দীন এ বিষয়ে লিখেছেন:

‘বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি [ভাসানী] পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির উদ্দেশে তাঁর সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ঐ আসসালামু আলাইকুম তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতা এবং যাঁদের উদ্দেশে উচ্চারিত হয়েছিল তাঁরা উভয় পক্ষই উপলব্ধি করেছিলেন। আমার ক্ষুদ্র মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তজ্জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প ঐ ‘আসসালামু আলাইকুম’ ধ্বনির মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল।’

আবু জাফর শামসুদ্দীনের অনুভূতিটি কিছুটা অতিরঞ্জিত। রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ১৯৪৭-৭০ পর্বের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক ধারা-উপধারার মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে জেগে উঠতে দেখা যায়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান (ও ক্রমবর্ধমান) বৈষ্যম্যের প্রেক্ষিতের পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যেও এই বৈষম্য-বোধ ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু মওলানা ভাসানীর কণ্ঠে বেজে ওঠা কাগমারীর ডাক ‘আসসালামু আলাইকুম’ তৎকালীন রাজনৈতিক মহলে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ভাসানীর ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার প্রত্যুত্তরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বিবৃতি দিতে হয়েছিল। দলের যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সামাদ এক বিবৃতিতে বলেন:

‘সম্প্রতি কাগমারীতে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনকে কেন্দ্র করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি সর্বজননন্দিত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের হীন অপপ্রচার তাঁহাকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করিতেছে। …আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি মানুষের প্রাণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রথম হইতেই সন্নিবেশিত রহিয়াছে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে ২১ দফার মধ্যে দেশরক্ষা, মুদ্রা ও বৈদেশিক বিষয় ব্যতীত আর সমগ্র বিষয় প্রদেশের হাতে ছাড়িয়া দেওয়ার পক্ষে পূর্ববাংলার সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ তাহাদের চূড়ান্ত রায় প্রদান করিয়াছে। …শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেব তাঁহার সারগর্ভ বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের উপর বিশেষ জোর দিয়া বলেন যে, গত এক বৎসর মুসলিম লীগ বিভিন্ন দিক দিয়া পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করিয়াছে। পূর্ব বাংলা আজ শ্মশানে পরিণত হইয়াছে। …এরপরেও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকরা পূর্ব পাকিস্তান শোষণ করিতে থাকে তাহা হইলে এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর পূর্ব বাংলার সচেতন জনসাধারণ অপেক্ষা করিয়া অতীতের ন্যায় শোষকদিগকে বলিবে ‘আস্‌সালামু আলাইকুম।’

স্টকহোম শাস্তি সম্মেলনে বিশ্ব শান্তির জন্য ভাসানী বক্তৃতা দিতে গিয়ে আবেগময় ভাষায় বলেছিলেন: “ইসলাম আমার ধর্ম। ইসলাম আমার দর্শন। ইসলাম আমার সাধনা। আর যে ইসলামের উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘সলম’ থেকে যার অর্থই হচ্ছে শান্তি। কাজেই আমি বিশ্বাস করি কোনো মুসলমানই শান্তির প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। …শান্তির ধর্মের অনুগামীরূপে বাকি জীবনটি আমার উৎসর্গ করেছি শান্তির কাজে, মানবতার কাজে। বিশ্বব্যাপী আজকে শান্তি আন্দোলন আমার কাছে তাই ধর্মীয় কর্তব্য।”

কাগমারী সম্মেলনেও ভাসানী ধর্মীয় প্রতীক অবলম্বন করেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে ‘আস্‌সালামু আলাইকুম’ জানালেন। ধর্মে বিশ্বাস এই দুই উদাহরণেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কনটেন্ট তুলে ধরার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। স্টকহোম এবং কাগমারী উভয় সম্মেলনেই মওলানা ভাসানী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও বিশ্বশান্তির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। তিনি তার ধর্ম পরিচয় ব্যবহার করেছেন সক্রিয়ভাবে সাম্রাজ্য, সাম্প্রদায়িকতা ও অশান্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। বাংলাদেশের সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ধারাটিকে এই আলোকেও বিচার করতে হবে।

চতুর্থত, ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই মওলানা ভাসানী ঢাকা ‘নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন’ শীর্ষক এক সভা আয়োজন করেন। এটি ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের প্রস্তুতি সম্মেলন। সেখানে প্রদত্ত ভাষণেও ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনৈতিক দর্শনের তাৎপর্যপূর্ণ সংশ্লেষণ দেখতে পাই। সেখানে ভাসানী বলেন :’পাক-ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বহু লোকের বহু ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস আমাদের সম্মুখে মওজুদ আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত ত্যাগী ও দেশপ্রেমিকদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতার পূর্বে অথবা কিছুদিন পরেই আমাদিগকে চিরদিনের জন্য তাহাদের সাধনা ও আদর্শ হইতে বঞ্চিত করিয়া আল্লাহর ইচ্ছায় পরলোকগমন করিয়াছেন। আজ যাঁহারা পাকিস্তানের কর্ণধার ইহাদের মধ্যে যখনই যে দল ক্ষমতা দখল করিয়াছে তাহাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছেন যাহারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো প্রকারের কোরবানি বা নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। নির্যাতিত নেতা যেরূপভাবে দেশের নির্যাতিত জনসাধারণের প্রতি দরদ রাখে যাহারা জীবনে কখনো জালেমের জুলুমে পতিত হন নাই তাহাদের পক্ষে দেশের প্রতি সেরূপ দরদ রাখা সম্ভবপর নহে।’

ন্যাপের গঠনতন্ত্রে জনকল্যাণমুখী, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বিভিন্ন ধারা যুক্ত হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা উচ্চারণ না করলেও গঠনতন্ত্র পড়লে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, মওলানা ভাসানীর ন্যাপ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেরই অনুরূপ স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শের ভিত্তি হিসেবে। সেখানে স্পষ্ট করে ‘লক্ষ্য’ হিসেবে বলা ছিল :

‘শাসনতান্ত্রিক, আইনসম্মত ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল প্রচার বিদেশি প্রভাব হইতে মুক্ত করিয়া পাকিস্তানে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা কায়েম করা যাহাতে রাষ্ট্রের জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ থাকিবে না এবং সকল প্রকার নির্যাতন ও শোষণের অবসান হইবে। ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও সমাজব্যবস্থায় আইনের দৃষ্টিতে প্রতিটি লোকের সমান অধিকার এবং ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতিধর্ম ও সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের চাকরি, আশ্রয়, শিক্ষা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ধর্মীয় অধিকার প্রয়োগের পূর্ণ অধিকার থাকিবে।’

ন্যাপের গঠনতন্ত্রেও বলা ছিল ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের’ কথা: ‘ফেডারেল সরকারের অধীনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য নিল্ফেম্নাক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করা হইবে: পাকিস্টত্মানের উভয় অংশকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দান। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি ও মুদ্রা শুধু এই তিনটি ছাড়া অন্যান্য সকল বিষয়ের পরিচালনভার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের উপর ন্যস্ত করা। …অবিলম্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে উল্লিখিত মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। ধর্মীয় বিশ্বাস ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল নাগরিক যাহাতে স্ব-স্ব নিয়ম-কানুন পালন করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা করা।’

বস্তুতপক্ষে পথ ও রণকৌশলের কিছুটা পার্থক্য সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে রাষ্ট্র নির্মাণ ও শোষণমুক্ত জনকল্যাণমুখী সামাজিক ন্যায়বিচারের ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধারার অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ ও তৎপরবর্তী ৬ দফার লক্ষ্য, আদর্শ, কর্মসূচি ও আন্দোলনের সাথে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের একটি বরাবর পরস্পর-সহানুভূতিশীল পরিপূরক অবস্থান ছিল। মাঝে মাঝে ন্যাপের ‘হঠকারী বামপন্থি’দের অংশের চাপ এবং আওয়ামী লীগের ‘রক্ষণশীল ডানপন্থি’ অংশের চাপ এই দুই দলকে রণকৌশলের প্রশ্নে বিপরীতমুখী অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু মূল স্রোতধারার মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলের প্রবণতাই বেশি দেখা যায়। একেক সময়ে এ-ও আমার মনে হয়েছে যেন মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৬ দফা পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রাম-নির্বাচন ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে আগাম শলা পরামর্শ করেই রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন। যা আপাতদৃষ্টিতে কখনো কখনো পরস্পরবিরোধী বলে মনে হলেও আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গতিমুখকে কণ্টকমুক্ত ও অগ্রগামী করে রেখেছিল। মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে সাময়িককালের জন্যে হলেও ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ নীতি গ্রহণের জন্য অভিযোগ তোলা হয়েছে কোন কোন ভাষ্যে। আবার সেই মওলানা ভাসানীকে ১৯৬৮-৬৯ সালে (বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে বন্দি) আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবকে ‘জেলের তালা ভেঙে’ কারামুক্ত করার ক্ষেত্রে এবং আইয়ুবশাহি পতনের ক্ষেত্রে তার অবিশ্রান্ত ভূমিকা ভুলে যাবার নয়। আইয়ুবের পতনের পর সাপ্তাহিক টাইম তাকে ‘পোয়েট অব ভায়োলেন্স’ আখ্যা দিয়ে লিখেছিল:

“Wreathed by a wispy beard, his face reflects an almost otherworldly serenity. As he plays with his grandchildren in a tiny village 60 miles north of the East Pakistan capital of Dacca, Abdul Hamid Bhashani, 86, looks the part of a Moslem maulana or guru, and to millions of Bengali peasants, he is. But the kindly grandfather is also Pakistan’s most outspoken advocate of violence. As much as any one man, Bhashani inspired the riots that last month forced President Ayub Khan to step down from the presidency. Now Bhashani is the most severe single threat to a fragile peace brought to the troubled and geographically divided land by the imposition of martial law. Under fear of harsh penalties, Pakistan’s other politicians, including Bhashani’s chief Bengali rival, moderate Sheikh Mujibur Rahman, have kept silent. Not Bhashani, who continues to receive newsmen and followers at his bamboo-walled hut.”

১৯৬৯ সালের ১৮ই এপ্রিল শুক্রবার সংখ্যার সাপ্তাহিক টাইম সাময়িকীর রিপোর্টার ডেন কগিন যেটা বুঝতে পারেননি যে, এই আপাত-মডারেট বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তখন ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের। ধাপে ধাপে ক্রেসেন্ডোর মতো উচ্চতায় তিনি নিয়ে যাবেন এই সংগ্রামকে তার অন্তিম লক্ষ্যের দিকে। এই যাত্রায় মাঝে মাঝে পিছিয়ে পড়লেও তার হাত ছাড়বেন না মওলানা ভাসানী, কেননা তিনি জানেন যে তার দল ন্যাপের ইয়াং টার্কস্‌রা নয়, তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সকল সহযোদ্ধার মধ্যে কেবল অনুজপ্রতিম মুজিবই পারেন এই বিপুল চড়াই-উৎরাইয়ের সংগ্রামে লক্ষ্য না হারিয়ে নেতৃত্ব দিতে। বলেছিলেনও ভাসানী এ নিয়েু বঙ্গবন্ধুর মতো জন-উদ্দীপক সাংগঠনিক প্রতিভা তার পরবর্তী প্রজন্মের আর কারো মধ্যে তিনি খুঁজে পাননি। ভাসানীকে বিদেশিরা নাম দিয়েছিল প্রফেট অব ভায়োলেন্স, আর বঙ্গবন্ধুকে তারা নাম দিয়েছিল পোয়েট অব পলিটিক্স বলে।

কেউ কেউ বলে থাকেন যে, মওলানা ভাসানী নাকি বঙ্গবন্ধু ও তার দলকে প্রায় শতভাগ জয়ী করার জন্যই ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ন্যাপকে অংশগ্রহণ করতে দেননি। ইতোপূর্বেই আমি উল্লেখ করেছি যে, এ নিয়ে কমরেড হায়দার আকবর খান রনোকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। তারা তখন ভাসানী ন্যাপের মধ্যেই ছিলেন। রনো আমাকে বলেছেন যে, ভাসানীর এই অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ছিল তার ‘গ্রেটেস্ট পলিটিক্যাল ব্লান্ডার’। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করে আমারও সে কথা মনে হয়েছে। ভাসানীর ন্যাপ অংশ নিলেও বঙ্গবন্ধু ও তার আওয়ামী লীগের তৎকালীন বিপুল ও অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তার মুখে সর্বোচ্চ ১৫-২০টির বেশি সিট পাওয়া সম্ভব ছিল না ১৯৭০-র নির্বাচনে। কিন্তু পরবর্তীকালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদে সংবিধান ও অন্যান্য পলিসি ডিবেটে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের থেকে নির্বাচিত ‘প্রগতিশীল’ সদস্যরা গঠনমূলক কিন্তু সক্রিয় বিরোধী ভূমিকা রাখতে পারতেন। শুধু ন্যাপের (মোজাফ্‌ফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা পার্বত্য অঞ্চল থেকে নির্বাচিত মানবেন্দ্র লারমার ওপরে নির্ভর করতে হতো না ‘বিরোধী কণ্ঠস্বরের’ জন্য।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারির প্রচারপত্রে ভাসানী নিল্ফেম্নাক্ত আহ্বান জানান : ‘দেশের নানাবিধ সমস্যার সমাধানের উপায় উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমি আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি হইতে সপ্তাহব্যাপী সন্তোষ কাগমারীতে এক বিরাট সম্মেলন আহ্বান করিয়াছি। দল, মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করিয়া জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন জোরদার করুন।’ ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয় : ‘* সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক। * ঐতিহাসিক মহান ২১ দফা আদায়ের ডাক। * চাষি, মজুর, কামার, কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সকল শ্রেণির মিলনের ডাক। * পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠনের ডাক। * ২১ দফার পূর্ণ রূপায়ণের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ, ইহা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই।’
সম্মেলনের প্রাক্কালে ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন : ‘আমি কোনো প্রকার যুদ্ধজোটে বিশ্বাস করি না। বিশ্বশান্তির পরিপন্থি যে কোনো প্রকার যুদ্ধজোট মানব সভ্যতা ও মুক্তির পথে বাধাস্বরূপ। …যত কঠিন বাধাই আসুক না কেন, আমি পাকিস্তানের জনগণের প্রকৃত কল্যাণের জন্য স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির সংগ্রাম করিয়া যাইব। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, এই নীতি পাকিস্তানের জনগণের প্রকৃত মুক্তি ও শান্তির পথ প্রশস্ত করিবে।’
৭ ফেব্রুয়ারি সকালে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয় সন্তোষের জমিদারদের একটি ভবনে। অধিবেশনে ৮৯৬ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশনে ভাসানী একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যাতে তিনি বলেন : ‘জনসাধারণের অগাধ বিশ্বাস ছিল তখন মুসলিম লীগের উপর।…কিন্তু মাত্র ৯টি বছর না যেতেই আজ মুসলিম লীগ জনসাধারণের মন থেকে ধুয়েমুছে গেল। এত বড় একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এরূপ অবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।’ ঐ ভাষণেই আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘সাবধান হওয়া সহজ হবে’ বলে তিনি মুসলিম লীগের ভুল ও পতনের কারণগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “প্রথমত, ক্ষমতা তাদের মাথা গুলিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তারা ব্যক্তিগত ও দলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনলেন। তৃতীয়ত, মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশই ‘রাজনৈতিক সভা-সমিতিকে প্রধানত ধর্মমূলক ওয়াজ-নসিহতের জলসা’য় পরিণত করলেন। চতুর্থত, মুসলমানের আল্লাহ এক, ধর্ম এক, রসুল এক এবং কেতাব এক- এই যুক্তিতে রাজনৈতিক দলও হবে এক বলে প্রচার চালালেন তারা। একই যুক্তিতে তারা বলে যেতে লাগলেন, বিরোধী দল মাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী। পঞ্চমত, মুসলিম লীগের কর্ণধারগণ পাকিস্তান তাদের ব্যক্তিগত জমিদারি মনে করে নিজেদের ব্যাংক ব্যালান্স এবং সম্পত্তি ইত্যাদির জন্য রাষ্ট্রের ধন ও সম্পদ নির্লজ্জ লুণ্ঠনে মত্ত হলেন। তা অতীতের সমস্ত রাজনৈতিক অসততা, দুর্নীতি, ফেরেববাজি ও চুরিচামারিকে হার মানাবে।”
এর পর মওলানা তার নিজের দলের সরকার সম্পর্কে বলেন : ‘বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের জন্য সরকারি দলের মতোই সমান প্রয়োজন বলে মনে করতে হবে।… মোটকথা, পূর্ণ পার্লামেন্টারি শাসন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হবে আমাদের লক্ষ্যস্থল। এখন পর্যন্ত আমাদের অনেক কাজ বাকি। একুশ দফা ওয়াদার মূল দফা এবং আওয়ামী লীগ মেনিফেস্টোরও প্রধান কথা হলো পররাষ্ট্র, মুদ্রা এবং দেশরক্ষা বিভাগ ছাড়া আর সব বিভাগের ভার প্রদেশকে দিতে হবে। কারণ, যতদিন না পূর্ব পাকিস্তান তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার পূর্ণ ক্ষমতা পাচ্ছে; যতদিন না শিল্প ও বাণিজ্য, রেলওয়ে, পোস্ট অফিস প্রভৃতি বিভাগের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে আসছে; যতদিন না পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক বিচারে দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইউনিট বলে স্বীকার করা হচ্ছে; ততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সম্ভব নয়।’
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা নিয়ে আবু জাফর শামসুদ্দীন তার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি সম্মেলনের তোরণগুলোর নাম-নির্বাচনের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল :
‘যতদূর মনে পড়ছে তার মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল প্রমুখের নাম বহনকারী তোরণও ছিল। ১৯১৯-২১ এবং ১৯৩০-৩২ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের প্রতি মওলানা ভাসানী বিশেষ শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করতেন। মওলানা সাহেব স্থাপিত কাগমারী কলেজের নাম মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ। মোট কথা, কাগমারীর আয়োজন ছিল অভূর্তপূর্ব।’
আরেক নেতা নূরুল হক চৌধুরী তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন :’আমি ডেলিগেট হিসেবে সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম। টাঙ্গাইলে ঢুকেই দেখি হজরত মোহাম্মদ তোরণ, তারপর তোরণ আর তোরণ। গান্ধী তোরণ, মওলানা মোহাম্মদ আলী তোরণ, নজরুল তোরণ, ইকবাল তোরণ, নেতাজি সুভাষ বসু তোরণ, হাজি শরীয়ত তোরণ, তিতুমীর তোরণ, নেহরু তোরণ, হাজি মোহাম্মদ মুহসীন তোরণ, সিআর দাশ তোরণ, লেনিন তোরণ, স্ট্যালিন তোরণ, মাও সে তুং তোরণ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন, শেলি, হালি, রুমি, ইমাম আবু হানিফা, গাজ্জালি তোরণ- টাঙ্গাইল থেকে সন্তোষ পর্যন্ত মোট ৫১টি তোরণ। সর্বশেষ তোরণ ছিল কায়েদ-ই আযম তোরণ।’
কাগমারী সম্মেলনের স্বাগত ভাষণে মওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের সাথে এই সম্মেলনের নিকট সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। তার ভাষণে উঠে আসে বার্ট্রান্ড রাসেল, পাবলো নেরুদা, ম্যাক্সিম গোর্কির কথা। এখানে উল্লেখ্য এর তিন বছর আগে ১৯৫৪ সালে স্টকহোমের শান্তি সম্মেলনে ভাসানী বিশ্ব শান্তি পরিষদের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এই বিশ্ব শান্তি পরিষদই পরবর্তী সময়ে (১৯৭৩ সালে) বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে সম্মানিত করেছিল। স্টকহোমে ভাসানীর সফরসঙ্গী ছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ শীর্ষক বইয়ে ভাসানীর সফর সম্পর্কে একটি অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে মওলানার সাথে তার হোটেলে এসে সাক্ষাৎ করেন বিশ্বের দুই বিখ্যাত কবিু তুরস্কের নির্বাসিত কবি নাজিম হিকমত ও চিলির নির্বাসিত কবি পাবলো নেরুদা। ইলিয়াসের ভাষ্যে মওলানা ভাসানী যখন ‘পরস্পরের নিকট হতে বিদায় নিচ্ছিলেন তখন তিন মনীষীর মুখেই ফুটে উঠেছিলো শান্তি ও সান্তনার প্রদীপ্ত আভা।’ স্টকহোমের ভাষণে ভাসানী বলেছিলেন: “বন্ধুগণ, আজ থেকে সাত বছর আগে এই স্টকহোম শহর থেকেই সর্বপ্রথম উত্থিত হয় শান্তির আওয়াজ। ‘স্টকহোম আবেদন’ নামে খ্যাত শান্তির আবেদনে স্বাক্ষর দান ও স্বাক্ষর সংগ্রহে সেদিন যারা উদ্যোগী হয়েছিলেন, আমি তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধা জানাই। আমি শ্রদ্ধা জানাই সেই মহান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনকে যিনি আমরণ সংগ্রাম করেছেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমি অভিনন্দন জানাই বিশ্ব-সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শ-কে যিনি ছিলেন বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। আমি শ্রদ্ধা জানাই বৈজ্ঞানিক জুলিও কুরিকে যাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা মানবতাকে হানাহানি ও রক্তারক্তি থেকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবীর বুকে শাশ্বত শান্তির নির্মল পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমি শ্রদ্ধা জানাই সোভিয়েত ইউনিয়নের কালজয়ী ঔপন্যাসিক ইলিয়া ইরেনবুর্গকে যার অমর লেখনী আজ নিয়োজিত মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ ও চিরস্থায়ী মৈত্রী স্থাপনের কাজে।” একই কথা ভাসানী বললেন কাগমারী সম্মেলনে। স্টকহোম সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন: ‘সাল্ফ্রাজ্যবাদের ইতিহাস কপটতার ইতিহাস। সকল মানুষকে সকল কালের জন্য সে ইতিহাস প্রবঞ্চিত করতে পারে না বটে কিন্তু সাময়িকভাবে হলেও সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন দেশে কতিপয় ভাড়াটে সমর্থক জোগাড় করতে সমর্থ হয়।…আজ সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ সকল প্রকার সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিপক্ষে। …সে জনতার মিছিলে শরিক হয়েছেন আমেরিকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক হেমিংওয়ে, হাওয়ার্ড ফাস্ট, সংগীতজ্ঞ পল রবসন, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন আর রোজেনবার্গ দম্পতির মতো অসংখ্য পরিবার।’ কাগমারী সম্মেলনের ভাষণে ভাসানী এর সাথে যুক্ত করলেন সাম্প্রদায়িক সমস্যার কথা। সম্মেলনের প্রত্যক্ষদর্শী আবু জাফর শামসুদ্দিনের মতে ভাসানী এই সম্মেলনে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সমস্যার ওপরে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন:\হ’ভাসানী বলেন, সাম্প্রদায়িক সমস্যা আজ পাকিস্তান ও ভারতের জনগণের সবচেয়ে বড় দুশমন। এই সমস্যা নির্মূল করতে না পারলে এই দুই দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। তাদের সমস্ত উন্নয়নের উদ্যোগ বরবাদ হয়ে যাবে।…আধুনিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বাস করে থাকে। পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যদিও এটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ দেশ হিন্দুর, বৌদ্ধদের, খ্রিষ্টানদের, আদিবাসী-উপজাতীয় সকলের।…তিনি বলেন, ভারত পাকিস্তান বৈরিতা দুই দেশকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করবে।…তিনি এদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের কারণগুলো খুঁজে বের করার কথাও বলেন।’
কাগমারী সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন ঔপন্যাসিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ। এই সম্মেলনে একদিন ভাসানীর সাথে তারাশঙ্করের কথা হয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ জানিয়েছেন, মওলানা তারাশঙ্করকে বলেন, ‘যে সকল হিন্দু বাড়িঘর ফেলে এখান থেকে ভারতে চলে গিয়েছে তাদের আবার ফেরত আসা উচিত। আমরা তাদের পূর্ণ মর্যাদায় স্বদেশে বসবাসের ব্যবস্থা করব। ভারত থেকে যে সকল মুসলমান মোহাজের এখানে আসবে তারাও এক ভিন্ন সংস্কৃতিতে আরামে নেই। ব্যাপক হারে দেশ ত্যাগের বিরুদ্ধে দু’দেশের সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।’
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ও বিশ্ব আঞ্চলিক শান্তির সপক্ষে প্রদত্ত জোরালো যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে রক্ষণশীল মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। দৈনিক আজাদ তার সম্পাদকীয়তে লিখেছিল: ‘মওলানা ভাসানীর ভাষণে এমন কতকগুলি উক্তি আছে, যাতে সত্যভাবে পাকিস্তানীমাত্রই শঙ্কিত না হইয়া পারেন না। মোছলেম লীগের নিন্দায় মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণে একেবারে পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছেন: তা হোন, কিন্তু বেসামাল হইয়া তিনি এমন কথাও বলিয়া ফেলিয়াছেন: প্রাক-পাকিস্তান যুগেও মোছলেম লীগের কোনো অস্তিবাচক জীবনদর্শন ছিল না। প্রধানত বিদ্বেষকে অলম্বন করে সেদিন আমাদের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে। জিঘাংসার নিবৃত্তি হলে আমরা কী গড়ে তুলব সেদিন এ কথা আমাদের কোনো নেতা চিন্তা করেননি এবং চিন্তা করেননি বলেই পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত সত্যকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলো না।’
১৯৫৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক আজাদের ঐ দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে মওলানা ভাসানীর মূল প্রক্রিয়াকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল: “পাকিস্তান সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করেন বলিয়াই কি মওলানা ভাসানী ইহাকে আজ রসাতলে লইয়া যাইবার মতলব আঁটিয়াছেন? তাঁর এই মতলব ধরা পড়িয়াছে তাঁর আর একটি উক্তিতে। তিনি বলিয়াছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ যদি বন্ধ না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসিবে, যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাইবে ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থাৎ পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে।”
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আসল অর্থ হচ্ছে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- এরা সবাই মানুষ। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে মানবিকতাবাদ (হিউম্যানিজম)। এটা বোঝার জন্য ইউরোপীয় রেনেসাঁর মানবিকতাবাদী দর্শন বোঝার দরকার নাই। আমাদের সমাজের ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত জনজীবনের মৌলিক মানবিকতাবাদকে উপলব্ধি করাই যথেষ্ট। এ জন্যই আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও অন্য ধর্মের লোককে আপনার আত্মীয় ও প্রতিবেশী বলে জ্ঞান করেছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েন সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে সময় সময় আচ্ছন্ন করেছে বটে, কিন্তু আমাদের ধর্ম-সম্প্রদায়ে মিলনের ইতিহাসই হচ্ছে মৌলিক ধারক। এ কথা রবীন্দ্রনাথও গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। মনসুরউদ্দীনের ‘হারামণি’ বইটির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনে নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। … বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি- এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই একত্র হয়েছে, অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। … এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়। বিবাদে বিরোধে বর্বরতা।’ এই মানবিকতাকে তুলে ধরতেই সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আলাদা করে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়েছিল।
আজকে কালক্রমে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের প্লাবনে ধর্মনিরপেক্ষতার আদি-প্রতিশ্রুতি অনেকটাই সাইডলাইনে চলে গেছে বলে মনে হতে পারে। এক সময় (১৯৬৬ সালে) বদরুদ্দীন উমর লিখতে পেরেছিলেন অবলীলায় ‘স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের বাস্তব জীবনক্ষেত্রে যা কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে তাদের কোনোটিই কিন্তু ধর্মচিন্তার ফল নয়। … এ দেশের মুখ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনসমূহ- যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, শিল্পোন্নয়ন ও সমতা রক্ষার আন্দোলন ইত্যাদি ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ নয়। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে এগুলির আবেদন প্রায় ধর্মবিরোধী। ধর্মীয় আন্দোলনের প্রচেষ্টা যে ইদানীং কিছু কিছু হয়নি তা নয়। কিন্তু এ আন্দোলনের মধ্যে আগেকার সেই জৌলুস এবং মোহমুগ্ধতা আর থাকেনি। জীবনের সাথে এ জাতীয় আন্দোলনের যোগাযোগ যেন আজ অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। এ কারণেই এ দেশে ধর্মীয় বাধানিষেধ এবং নানা সংস্কার সত্ত্বেও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মীয় চিন্তার সে পূর্ব আবেদন আর নেই।’
ওপরের কথাগুলো লিখিত হয়েছে ১৯৬৬ সালে। সেদিনের তুলনায় আজকের অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে ঘরে-বাইরে। সম্প্রতি স্বয়ং বদরুদ্দীন উমরও আবার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বইটি আজকের প্রেক্ষিতে লিখলে কথাগুলো অন্যভাবে বলতেন।
ধর্মবিশ্বাসী হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানোর আরো একটি উদাহরণ মওলানা ভাসানী। সময় সময় রাজনৈতিক কোন কোন অব্যাখ্যাত স্ব-বিরোধিতা বলে মনে হতে পারে ভাসানীর কিছু কিছু পদক্ষেপ। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে কোন সন্দেহ নেই যে মওলানা ভাসানী ছিলেন এদেশের ইতিহাসে অসাম্প্রদায়িক, সামন্তবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থের জন্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই করা এক ব্যতিক্রমী ও বর্ণিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ভাসানীর সুদীর্ঘ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ রাজনৈতিক জীবনের এবং জীবন-দর্শনের মূল্যায়ন করার স্থান এখানে সীমিত। এ নিয়ে একটি বড় পরিসরের বিশ্নেষণমূলক কাজ হওয়া দরকার। আমি এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গির সাপেক্ষে কয়েকটি মন্তব্য রাখছি কেবল।
প্রথমত, মওলানা ভাসানীর মানস-গঠনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রভাব এসেছিল। রাজনৈতিক জীবনের সূচনা পর্বেই তিনি ভিন্ন ধারার পথিক ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাকে প্রভাবিত করেছিলেন, এটা জানা যায়। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কোন দলের সাথেই তিনি ঘনিষ্ঠ হতে চাননি। চরমপন্থি বিপ্লববাদীদের দলেও তিনি নিজেকে দেখতে চাননি। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আলোচনা তাকে টানত, কিন্তু তার অবস্থানও তাকে কাছে টানতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন :
“ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘সাহস ও আপসহীনতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা পছন্দ হয়, কিন্তু সমস্যা হলো, তিনি শুধু মুসলমানদের জন্যেই কথা বলেন এবং উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নিন্দা করেন। যে-সকল হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা শুধু হিন্দুদের জন্যে কথা বলে যে-ভুলটা করেছেন; সিরাজীও শুধু তার নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষে কথা বলে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করছেন। যদিও মুসলমানদের পক্ষেও তখন কথা বলার লোকের প্রয়োজন ছিল। আবদুল হামিদ [ভাসানী] অত্যাচারিত ও দরিদ্রের পক্ষেু সেই অত্যাচারিত ও দরিদ্রের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দু’সম্প্রদায়েরই মানুষ আছে, তবে ঘটনাক্রমে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি।”
মওলানা ভাসানী আজীবন ধর্মান্তরের বিরোধিতা করে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ একটি তথ্য উল্লেখ করেছেন : ‘পীর হিসেবে তাঁর মুরিদান ও ভক্তের মধ্যে হিন্দু মুসলমান নানা সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল। ১৯৬৯-এ আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের মধ্যে একদিন সন্তোষে রমেশ দেবনাথ নামে এক দরিদ্র হিন্দু সস্ত্রীক গিয়ে ভাসানীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তিনি জানতে চান, তাদের কী পেশা। তারা জানান যে, তারা জাতে যোগী (নিম্নবর্ণের হিন্দু) কিন্তু এক সময় স্বর্ণকার ছিলেন। এখন আর সোনা-রূপার অলংকার কেউ বানাতে আসে না। জমিজমা তেমন নেই। অনেক ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে। মওলানা তাদের জিজ্ঞেস করেন, মুসলমান হলে তাদের আয় বাড়বে কিনা, আল্লাহ খুশি হয়ে তাদের ধনদৌলত দেবেন কিনা? তারা মাথা নিচু করে নিরুত্তর থাকেন। ভাসানী তাদের বলেন, ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানে অধিকাংশ মুসলমান কী সুখে আছে দেখছো না? পড়ালেখা কিছু জানলে বাড়িতে গিয়ে নিজের ধর্মগ্রন্থ গীতা পড়ো গিয়ে; দুনিয়াতে কোনো ধর্মই খারাপ নয়। গুরুকে প্রণাম করে দেবনাথ দম্পতি বিদায় নেন।’
সৈয়দ আবুল মকসুদের বয়ানে ভাসানীর ধর্মান্তরের বিরোধিতা প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায় কাজী আনোয়ার-উল-হকের কাছে। ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ভাসানী কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখানে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য যান আনোয়ার-উল-হক, তখন তিনি পুলিশের ডিআইডি (বিশেষ শাখা)। হাসপাতালের কেবিনে ভাসানী তার কাছে অতীত দিনের স্মৃতিচারণে বসেন। তিনি আসামের আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আসামে আমার মুরিদদের মধ্যে হিন্দুও ছিলো, মুসলমানও ছিলো। আমি ধর্মান্তর পছন্দ করি না। অনেক মুসলমান নেতা আমাকে ধর্মান্তরের জন্য পরামর্শ দিতেন। আমি রাজি হইনি। ১৯৩৫ থেকে ‘৪৭ পর্যন্ত বারো বছরে যদি আমি চাইতাম তবে লাখ লাখ আদিবাসী ও হিন্দুকে আমি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারতাম। আসামকে পূর্ব বাংলার মতোই মুসলমান মেজরিটি প্রভিন্স বানাতে পারতাম। জীবনে একজন হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীকে আমি মুসলমান করিনি। তাতে লাভ কী? আমার হিন্দু শিষ্যদের ঠিকমতো তাদের ধর্মকর্ম করার পরামর্শ দিতাম।’
ভাসানী প্রায়ই বলতেন, ‘দুনিয়ায় মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত, জালেম আর মজলুম। জালেম হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলমান হোক; তার বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম চলবেই।’
দ্বিতীয়ত, সুবিদিত যে ভাসানীই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। আবার তারই সভাপতিত্বে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নামকরণ বদলের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই কাউন্সিল অধিবেশনে অসাম্প্রদায়িক রূপান্তরের লক্ষ্যে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবেই ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম হয় আওয়ামী লীগ। সেই অধিবেশনেই, যেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন- গৃহীত হয় প্রস্তাব, যেখানে বলা হয়েছিল :’পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যেসব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হইয়াছে।’ অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা পূর্বাপর বহমান ছিল। সেই অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ভাসানী বলেন :’এই দুই বছরের ভেতর আমি ইউরোপের নানান দেশ ভ্রমণ করিয়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়ভাবে পরিচিত হইবার ও নানা প্রকারের তথ্য সংগ্রহ করিবার সুযোগ পাইয়াছি এবং সেই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায় এই অভিজ্ঞতা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণের পথে সহায়তা করিবে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।
পাকিস্তান অর্জনের সময় যে বিরাট উন্মাদনা আট কোটি মানুষের জীবনকে নবচেতনা ও বিরাট সম্ভাবনার আশায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, সে আশা-আকাঙ্ক্ষা মানুষের অবসন্ন ও হতাশ প্রাণে এক রঙিন স্বপ্নের সৃষ্টি করিয়াছিল, নবলব্ধ পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নর-নারীর প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তর দেশকে সুখী সমৃদ্ধশালী করিয়া স্বর্গরাজ্য করিবার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করিয়াছিল। আট বছরের লীগশাহির কুশাসন ও অমানুষিক অত্যাচার, অবিচার, দুর্নীতি, বেইমানি, দাগাবাজি সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনার স্বপ্নকে ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দিল।….আমরা মুসলমানু পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বলিয়া ঘোষণা করা হইবে এই চিৎকার উঠিতেছে কিন্তু ইসলামী জীবন-যাপন করিবার কথা কাহারও মনে হইতেছে না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অত্যাচার, অবিচার অবাধে চলিতেছে। ঘোড়দৌড়, বেশ্যাবৃত্তি, মদ্যপান, জুয়া প্রভৃতি অন্যায় কার্য দেশে কেবল চলিতেছেই না; সরকারও যেন ইহার পৃষ্ঠপোষকতা করিতেছেন। পাপের ভারে দেশ ধ্বংসের পথে।… দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র গঠনের কথা বলা হইতেছে। পাকিস্তানে শুধু মুসলমানই পাকিস্তানি নহে; বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু সকলেই পাকিস্তানি জাতি। পাকিস্তানে চারি জাতির বাস যাহারা কল্পনা করেন তাহারা ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে চতুষ্পদের স্থান বলিয়া ছাড়িবেন, এই ভয় হয়। পাকিস্তানে মুসলমান শতকরা আশিজন, এমতাবস্থায় পৃথক নির্বাচনের দাবি আমাদের পক্ষে অযৌক্তিক। দুই জাতির ভিত্তিতে আমরা পাকিস্তান সংগ্রাম করিয়াছিলাম এই যুক্তির ভিত্তিতে- হিন্দুরা যদি হিন্দু পাকিস্তান বা পাক হিন্দুস্তান নামে ভিন্ন প্রদেশের দাবি করিয়া বসেন তাহা হইলে কোন যুক্তি দ্বারা তাহার প্রতিবাদ করিতে পারি। এই প্রসঙ্গে আমরা কায়েদে আযমের বাণীর কথা উল্লেখ করিতে চাই। তিনি বলিয়াছিলেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক ভিত্তিতে মুসলমান ও হিন্দু নিজেদের জাতীয়তা ভুলিয়া শুধু পাকিস্তানিই হইবেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আর অন্য কোনো দেশ নাগরিকদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে নাই। ইহা সভ্যতার পরিপন্থি। যুক্ত নির্বাচন প্রথা না হইলে চেকোশ্নোভাকিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইবে। …বন্ধুগণ, আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করার একটা প্রশ্ন দুই বছর পূর্বেই উঠিয়াছে এবং বিগত কাউন্সিল অধিবেশনে শাসনতন্ত্র [গঠনতন্ত্র] গৃহীত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের নাম সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করিবার ভার আমার উপর ন্যস্ত করা হইয়াছিল। আমি ভিন্ন ভিন্ন জেলা, মহকুমা আওয়ামী লীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, দেশের অধিকাংশ লোকই, বিশেষত কর্মীদের বহুলাংশই প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক করার শুধু পক্ষপাতীই নন; জোর দাবিও জানাইয়াছেন।’
তৃতীয়ত, পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে ভাসানীর আহ্বানে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
[ক্রমশ]