এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

স্বৈরশাসকদের নিয়ে এদোয়ার্দো গালিয়েনোর অতি-উৎসাহের কারণ দ্বি-বিধ। প্রথম কারণটি ব্যক্তিগত। তিনি ছিলেন বামপন্থি সাংবাদিক ও লেখক। যে বছর আয়েন্দের চিলিতে পিনোশের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, সে বছরই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হয় উরুগুয়ে নামক দেশটিতে। গালিয়েনোর জন্মভূূমি উরুগুয়েতে, সেখানেই ‘মিছিল’ বা ‘মার্চ’ [স্পেনীয় ভাষায় Marcha] পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তার খ্যাতি লাভ। এই পত্রিকায় মারিও ভার্গাস ইয়োসার মতো লেখকরা নিয়মিত লিখতেন। যা হোক, উরুগুয়েতে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে গালিয়েনোকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছাড়া পেয়ে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যেতে হয় তাকে। সেখানে উদ্বাস্তু জীবনের মধ্যেই ‘ক্রাইসিস’ নামে একটি বামধারার পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিন বছর না যেতেই ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনাতেও একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ডানপন্থি এই ক্যুর নেতৃত্ব দেন লে. জেনারেল ভিদেলা। ইসাবেলা পেরন-এর সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল ভিদেলা ক্ষমতায় আসেন। কথিত আছে, এই ক্যুর পরপর যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার আর্জেন্টিনার সামরিক নেতৃত্বের সাথে বেশ কয়েক বার ‘মিটিং’ করেন এবং বলেন, তাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ‘নিষ্ফ্ক্রিয় করে দেওয়া’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরোধী দলনের অভিযোগ ওঠার আগেভাগেই এ কাজটি সেরে ফেলার পরামর্শ দেন কিসিঞ্জার। এ রকম পরিস্থিতিতে আবারও দেশ ছাড়তে হয় গালিয়েনোকে। এবার তিনি পাড়ি জমান স্পেনের উদ্দেশে। এই স্পেনে বসেই তিনি লেখেন তার বিখ্যাত ট্রিলজি ‘মেমোরি অব ফায়ার’- বহ্ন্যুৎসবের স্মৃতি। আমাদের এখানে হলে হয়তো আমরা বলতাম ‘আগুন-জলের গল্প’। কেবল ১৯৮৫ সালেই গালিয়েনো ফিরতে পারেন নিজের দেশে, উরুগুয়ের রাজধানী মন্তেভিদিয়োতে। গণতন্ত্র সবে ফিরতে শুরু করেছে সেখানে। এই সেই দেশ, যেখানে কোনো মানবিক অধিকারে রীতি-নীতি মানা হয়নি। উরুগুয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদককে হেলিকপ্টারের সাথে বেঁধে এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এ রকম শুনেছি। কিন্তু গালিয়েনোর কাছে উরুগুয়ে নয়, সমগ্র লাতিন মহাদেশের পর্যায়ক্রমিক সামরিক স্বৈরশাসনের অভ্যুদয়ই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং এ কারণেই তার লেখা পত্রে স্বৈরশাসকদের প্রবল উপস্থিতি দেখা যায়।

কিন্তু এর পেছনে দ্বিতীয় কারণও ছিল। যদি ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা তার না-ও থাকত, তাহলেও এদোয়ার্দো গালিয়েনো সম্ভবত এভাবেই লিখতেন বা ভাবতেন। দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রবল উপস্থিতির পেছনে অনেকটি কারণ কাজ করে থাকবে। এই মহাদেশে প্রথমে কলোনিয়াল অভিযান চালায় স্পেনীয়রা (এবং পর্তুগিজরা)। মায়া, ইনকা, আজটেক প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতা অধ্যুষিত মহাদেশকে স্বর্ণখনির লোভে পদানত করার জন্য সামরিক অভিযান চালায় তারা। স্থানীয় অধিবাসীদের রাজত্বগুলো ছলে-বলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। গালিয়েনো নানা অনু-গল্পে এই গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা ও কাহিনী লিখেছেন। ১৫৩৩ সালে স্পেনীয় কনকুইস্তাদর বা বিজয়-পিপাসু ফ্রান্সিসকো পিসারো পেরু অধিকার করে নেন। এই যুদ্ধে এবং পরবর্তীকালের ইউরোপ থেকে ‘আমদানি করা’ মহামারিতে নিহত হয় পেরুর ৯০ শতাংশ স্থানীয় জনসাধারণ, যাদের অধিকাংশই ছিল ইনকা সম্প্রদায়ভুক্ত। ইনকাদের সম্রাট আতাহুয়ালপাকে [Atahualpa] নির্মমভাবে খুন করা হয়। গালিয়েনো এই শঠতাপূর্ণ বিজয় নিয়ে লিখেছেন, আর সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে- এই পেরুর ইনকাদের থেকে ইউরোপ এবং এক পর্যায়ে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে আলুর চাষ। আজকে যাকে ‘মেডিকেল মারিজুয়ানা’ হিসেবে প্রচার করা হয়, তারও আদিভূমি পেরুতে।

লাতিন আমেরিকায় এই আদিম, বর্বরতম ঔপনিবেশিক অভিযানের স্মৃতি গালিয়েনো ভুলে দিতে চাননি। এর সাথে তিনি সংযুক্ত করেন পরবর্তীকালের (উনিশ-বিশ শতকের) ‘অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিস্তার। তখন আর উপনিবেশবাদ শুধু স্বর্ণখনির লোভে সীমিত নেই।

৩. সাম্রাজ্য :প্রেম নাকি প্রতারণা?

‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল’ প্রবন্ধে মার্কস এ রকম মন্তব্য করেছিলেন যে, এই শাসনের ফলে যেমন ভারতবাসীর ওপরে দুর্গতি নেমে এসেছে, তেমনি এর প্রতিক্রিয়ায় এর আবদ্ধ নিশ্চলা জীবনে সূচিত হচ্ছে প্রগতির ধারা। প্রত্যন্ত উপনিবেশে পাশ্চাত্য-আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে, ভেঙে পড়ছে তার চিরাচরিত পেছনে-টানা মূল্যবোধের প্রাচ্যীয় জগৎ। যিনি ধ্বংস করেন, তিনিই আবার সৃষ্টি করছেন। উপনিবেশে ব্রিটিশ শাসনের এই দ্বিবিধ ফলাফল যুগপৎ বিনাশী ও সৃষ্টিশীল, একাধারে ধ্বংসাত্মক ও কল্যাণকামী ভূমিকা সম্পর্কে মার্কসের মূল্যায়ন নিয়ে ইতিপূর্বে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। এ প্রশ্নে এসে এদোয়ার্দো গালিয়েনো মার্কসকেও ছেড়ে কথা বলতেন না। মার্কস যদি বলে থাকেন যে, এযাবৎকালের ইতিহাস মূলত শ্রেণিযুদ্ধের ইতিহাস; তাহলে গালিয়েনো ভাবতেন, এযাবৎকালের ইতিহাস মূলত এক জাতির তরফে অন্য জাতির ওপর অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখানোর ইতিহাস। সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা-বলয়ের বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে। এখানে প্রেম নেই; থাকলেও তা সাময়িক; অপ্রেমই এখানে মূল সুর; প্রতারণাই এখানে চরম পরিণাম। এ জন্যই অনেকটা আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে গালিয়েনো সাম্রাজ্যের শঠতার কাহিনী একের পর এক লিখে গেছেন। এক পর্যায়ে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে বাংলার ওপরে। এই ঔপনিবেশিক গল্পের শুরু ইংলন্ডে আর শেষ ঢাকায়।

মুক্ত বাণিজ্য নামক এক রূপকথার জন্ম কীভাবে ইংলন্ডে জন্ম নিল; প্রথমে সে বয়ান করেছেন গালিয়েনো। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা প্রথম জেমস ও প্রথম চার্লসের শাসনামলে ব্রিটেনের ‘শিশু-শিল্প’কে রক্ষার জন্য নানাবিধ সংরক্ষণমূলক নীতি হাতে নেয় ইংরেজ সরকার। তারা কাঁচামাল হিসেবে পশম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়; বিলাসবহুল পোশাক তৈরিতেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বস্ত্রের ব্যবহার অপরিহার্য এ নিয়ম করে; ফ্রান্স ও হল্যান্ডের মতো দেশ থেকে শিল্পপণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের আগেও অর্থনৈতিক চিন্তা ছিল, কিন্তু তা ছিল মূলত সংরক্ষণমূলক [যাকে বলে ‘প্রোটেকশনিস্ট’] নীতিকে ঘিরে। এ রকমই একজন চিন্তক ছিলেন সপ্তদশ শতকের শুরুতে ‘রবিনসন ক্রুসো’র রচয়িতা ড্যানিয়েল ডেফো। গল্পের বই ছাড়াও অর্থনীতির নানা বিষয়ে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন। এরই একটিতে তিনি বলেন, ব্রিটিশ টেক্সটাইল শিল্পকে গতিশীল করার জন্য ইংরেজ সরকারের ‘সংরক্ষণমূলক’ নীতি খুবই কার্যকর ছিল। ইংরেজ রাজারা ‘শুল্ক্কের দেয়াল’ নির্মাণ না করলে এবং স্থানীয় শিল্পকে উপযুক্ত কর-প্রণোদনা না দিলে এই শিল্পের বিকাশ সম্ভবপর ছিল না। এই বিকাশ এতটাই ত্বরান্বিত হয়েছে যে আগামী দিনে বিশ্বের প্রতিটি দেশ বা উপনিবেশ ‘ব্রিটিশ পণ্যের ওপরেই নির্ভরশীল থাকবে।’ ডেফোর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক ছিল বলতে হয়। কেননা, পরবর্তী দুশো বছর ধরে ব্রিটেন যা করে বড় হয়েছে, তারই উল্টোটা প্রয়োগ করেছে সে অন্যদের প্রতি। অবস্থানিরপেক্ষভাবে প্রচার করেছে ‘অবাধ বাণিজ্য’-এর জয়গান। জার্মান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিখ লিস্ট এটা দেখে বলেছিলেন, ‘উপরে উঠিয়ে মইটা ফেলে দিয়েছে ইংরেজরা।’ রাতের বেলায় যখন গরিব দেশগুলোর ঘুম হয় না, তখন ধনী দেশের মন্ত্রণাদাতারা মুক্ত বাণিজ্যের রূপকথা শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে থাকে।

এই রূপকথাই অন্য রকম শোনায় ঔপনিবেশিক বাংলার পটভূমিতে। গালিয়েনো লিখেছেন যে, বাংলা থেকে সুতি ও রেশমি কাপড় আমদানিতে প্রথমদিকে অতি-উচ্চ হারে শুল্ক্ক বসানো হতো। ১৬৮৫ সাল থেকে এই শুল্ক্ক বসানো হতে থাকে, এক পর্যায়ে কাপড় আমদানি প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয়। এত বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও ইংলন্ডে শিল্প-বিপ্লব শুরু হওয়ার পর প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত-বাংলার বস্ত্রশিল্প বেঁচে ছিল। ম্যানচেস্টার থেকে বস্ত্র যখন বাংলায় আসত, তখন তাতে কিন্তু আমদানি শুল্ক্ক বসানো হয়নি। কারণ ততদিনে ফ্রি-মার্কেটের তত্ত্ব রুলিং আইডিওলজি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটেনে। গুণগত মান ভালো থাকার জন্যে এবং স্বল্প উৎপাদন মূল্যের কারণে অসম প্রতিযোগিতার ভেতরেও অনেক দিন টিকে ছিল বাংলার বস্ত্র উৎপাদকরা। উনিশ শতকের গোড়াতে যখন ওদের ওপরে এক বিষম করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখনই কেবল ওরা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এই বি-শিল্পায়নের পরিবেশে ম্যানচেস্টারের টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বাংলার বাজার ও ঘরে ঢুকতে থাকে। ঢাকার ওপরে এই অসম প্রতিযোগিতার ফল হয়েছিল মারাত্মক। গালিয়েনো লিখেছেন :

‘প্রবাদপ্রতিম লর্ড ক্লাইভ যে ঢাকাকে [সমৃদ্ধি-ঐশ্বর্য] লন্ডন ও ম্যানচেস্টার শহরের সাথে তুলনা করতেন, সেই শহরটি এই পর্যায়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে। পাঁচজনের মধ্যে চারজনই শহর ছেড়ে চলে যায়। তারপরও বাংলার শিল্প খাতের কেন্দ্র ছিল ঢাকা, তবে তা বস্ত্রশিল্পের জন্য নয়; আফিম উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই আফিমের অতিরিক্ত সেবন করতে গিয়েই এক সময় মৃত্যু হয় ক্লাইভের।’

অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী নিয়ে আরো অনেক গল্প আছে গালিয়েনোর ঝুলিতে। ‘গালিভার’স ট্রাভেলস’ বইটিকে তিনি উপনিবেশ-অভিযানের ন্যারেটিভ হিসেবে পাঠ করেছেন। এর লেখক জোনাথান সুইফট্‌-এর মনে কী ছিল, তা জানা যায় না। তবে অনেক সময় তাকে মনে হয় আসলে তিনি একজন ‘অন্তর্ঘাতমূলক’ লেখক; উপনিবেশবাদবিরোধী চিন্তাবিদ। ‘গালিভার’স ট্রাভেলস’এ-র সর্বশেষ পরিচ্ছেদে কীভাবে কিছু বর্বর জলদস্যুর হাতে স্থানীয় অধিবাসীরা পরাজিত হলো এবং নেটিভদের দেশকে এক অবাধ লুণ্ঠণক্ষেত্র তথা উপনিবেশে পরিণত করা হলো, তার প্রায় পরাবাস্তববাদী বর্ণনা রয়েছে। মূলের বর্ণনাটি এতই তীক্ষষ্ট ও মর্মভেদী যে অনুবাদে তা হারিয়ে যাক সেটা আমি চাই না :

A crew of pirates goes on shore to rob and plunder, they see a harmless people, are entertained with kindness; they give the country a new name; they take formal possession of it for their king; they set up a rotten plank, or a stone, for a memorial.
Here commences a new dominion, acquired with a title by divine right. Natives are driven out or destroyed; their princes tortured to discover their gold; a free license given to all acts of inhumanity and lust, the earth reeking with the blood of its inhabitants : and this execrable crew of butchers, employed in so pious an expedition, is a modern colony, sent to convert and civilize an idolatrous and barbarous people!

সন্দেহ কি, জোনাথান সুইফটকে এক সময় ‘উন্মাদ’ বলে অভিহিত করা হবে খোদ ব্রিটেনে।

[ক্রমশ]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৫

২. এদোয়ার্দো গালিয়েনোর জীবন

পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ-এ সেদিন ছিল এদোয়ার্দো গালিয়েনোর ‘মিররস্‌’ বই নিয়ে ভাষণ; গালিয়েনোর গল্প বলার ধরনে এক ‘রহস্যময় জাদু’ থাকে- এরকম একটি আপ্তবাক্য বলেছিলেন ঔপন্যাসিক ইসাবেলা আয়েন্দে। গালিয়েনো কাজ করতে চান ভাস্করের মতো। প্রথমে তিনি ইতিহাস, প্রবন্ধ বা লোককাহিনি ঘেঁটে ‘তথ্য’ আহরণ করেন, তারপর তিনি তৈরি করেন এর প্রথম-পাঠ। সেই পাঠের ওপরে তিনি অনেক বছর ধরে কাজ করতে থাকেন যতক্ষণ-না এর বর্ণনাভঙ্গি, বক্তব্য, বক্তব্যের প্রধান ও অপ্রধান মুহূর্ত তার মনোমত হয়ে দাঁড়ায়। তার অনু-রচনাগুলো অনেকটা গানের মতো- স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ- পর্যায়ক্রমে তা ধ্বনি থেকে কবিতায় পরিণত হয়। একজন প্রাবন্ধিককে প্রথমাবধি একজন ‘স্টাইলিস্ট’ হতেই হয়। রিল্ক্কের মতো তিনিও লিখে রেখে যেতে পারতেন- ‘একজন তরুণ প্রাবন্ধিকের প্রতি’ কোনো গাঢ় উপদেশাবলি। যেমন, ধরা যাক, তিনি লিখতে চান স্পেনের দোর্দণ্ড প্রতাপ জেনারেল ফ্রাংকো সম্পর্কে। স্পেনের বিখ্যাত রক্তক্ষয়ী সিভিল ওয়ারে রিপাবলিকপন্থিদের হারিয়ে জেনারেল ফ্রাংকো ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৩৯ সালে, এবং ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন নিরঙ্কুশ ডিক্টেটরশিপ অব্যাহত রেখে। না-প্রাচ্য না-পাশ্চাত্য কোনো শক্তিই তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারেনি। এহেন প্রতাপশালী জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোকে নিয়ে এক পাতার মধ্যে কী লেখা যায়, যা হবে তার নিষ্ঠুর চরিত্রের ইঙ্গিতবাহী, আবার একই সঙ্গে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য? গালিয়েনো এ নিয়ে অনেক ভেবেছেন, তারপর তার মনে হয়েছে জেনারেল ফ্রাংকোর পক্ষীশিকার নিয়েই বরং লেখা যাক। বিবরণীটি অনেকটা এরকম, তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘হান্টার অব স্টোরিস্‌’ থেকে সংগৃহীত :

‘বধ করার মধ্যে একটা নিষ্ঠুর আনন্দ রয়েছে। তা সে নোংরা ঘেঁটে বেড়ানো কাক বা সরোবরের রাজহংসী বা একজন গণতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রী যে-ই হোক না কেন। তবে কোয়েল পাখি শিকারে ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর বিশেষ আগ্রহ ছিল বরাবর। ১৯৫৯ সালের অক্টোবরের এক দিনে জেনারেল ফ্রাংকো ৪ হাজার ৬০০টি কোয়েল পাখি বধ করেছিলেন, তারই করা পূর্বতন সব রেকর্ড ভেঙে।

আলোকচিত্রী শিল্পীরা সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে অমর করে রেখেছিলেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে বিজয়ী বেশে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার পায়ের নিচে লুটোপুটি খাচ্ছে তার যুদ্ধজয়ের সামগ্রী- মৃত চোখ-উল্টে পড়া অসংখ্য কোয়েল পাখি।’

এসব ক্ষেত্রে এদোয়ার্দো গালিয়েনো যেটা করে থাকেন, তিনি যুক্ত করেন অনেক প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ। যেমন ডিক্টেটরদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত খাটো ছিলেন ফ্রাংকো- পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি, যেখানে হিটলার ছিলেন পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি, আর মুসোলিনি- পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ফটোগ্রাফাররা এমনভাবে ছবি তুলতেন যাতে করে এই অপেক্ষাকৃত খর্বকায় একনায়কদের বেশি খাটো না দেখায়। আমাদের দেশেও অনেক খর্বকায় জেনারেল ছিলেন- যারা সময় সময় ডিক্টেটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছেন- তারাও অত্যন্ত ক্যামেরা সচেতন ছিলেন। ‘তৃতীয় মাত্রা’য় একবার এক-এগারোর অন্যতম নায়ক জেনারেল মইন-এর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। তখন দেখে মনেই হয়নি যে তিনি এতটা খর্বকায়। আসলে ক্ষমতার লেন্স আর ফটোগ্রাফারদের লেন্স দুই-ই এই জেনারেলদের সুউচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করায়।

অন্যত্র, গালিয়েনো এক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ সামরিক ডিক্টেটরের কথা বলেছেন, যার নাম আউগুস্তো পিনোচেট বা পিনোশে। চিলির এই নির্মম মিলিটারি ডিক্টেটর তার জীবদ্দশায় হাজার হাজার বই সংগ্রহ করেন তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির জন্য। রাজকোষের অনেক অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি, সেসবের অনেকটাই সময়মতো আমেরিকার রিগস ব্যাংকের ডলার-অ্যাকাউন্টে পাচার করেছেন তিনি। তবে জনতার অর্থ নিয়ে তিনি প্রচুর বইও কিনেছেন। তিনি বই কিনতেন পড়ার জন্য নয়, শুধু ‘সংগ্রহ’ করার জন্য। কে জানে এই ডিক্টেটরের বুকের ভেতরে বইয়ের জন্য হাহাকার কী কারণে বাসা বেঁধেছিল! পিনোশের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে শুধু নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ওপরেই ৮৮৭টি বই ছিল। মূল্যবান চামড়ায় বাঁধানো সেসব খণ্ড। আর গ্রন্থাগারের বইয়ের তাকে তাকে বোনাপার্টের অনেক মূর্তি সসম্মানে রাখা হয়েছিল। সংগৃহীত প্রতিটি বইয়ে পিনোশের ব্যক্তিগত মোড়ক বসানো। যেন ভাবীকাল তাকে এভাবেই মনে রাখে। জেনারেল পিনোশে-র এই কখনোই না-পড়া গ্রন্থরাজি এখন বিরাজ করছে চিলির সামরিক বাহিনীর ওয়ার কলেজের ‘প্রেসিডেন্ট আউগুস্তো পিনোশে উগার্তে লাইব্রেরি’তে। এই লাইব্রেরিটি পিনোশে নিজেই তৈরি করেছিলেন- ভবিষ্যতের সামরিক শাসকদের ‘আলোকপ্রাপ্তি’র জন্য।

এদোয়ার্দো গালিয়েনো কাউকেই কোনো কিছুকেই তার ক্ষুরধার বিশ্নেষণের জরিপ থেকে বাদ দেননি। ‘মিররস্‌’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন ইংরেজ দার্শনিক জন লক-এর কথা। ‘স্বাধীনতা’র দার্শনিক বললে লক-এর কথাই প্রথমে মনে পড়বে। তার লেখায় তিনি অবাধ বাণিজ্য, কারখানা, অবাধ প্রতিযোগিতা, ‘অবাধ নিয়োগ ও ছাঁটাই’ এসবের প্রয়োজনীয়তা অবাধে লিখে গেছেন। সেই সাথে বলেছেন অবাধে বিনিয়োগ করার স্বাধীনতার কথাও। তিনি যখন ‘এন এসে কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এর মতো দার্শনিক গ্রন্থ লিখছেন, সে সময়েই ‘রয়াল আফ্রিকান কোম্পানি’র স্টক কেনার ক্ষেত্রে তার সঞ্চয়কে ব্যয় করেন। গালিয়েনো লিখছেন, এই কোম্পানির যৌথ মালিকানায় ছিলেন ব্রিটিশ রাজপরিবার এবং মুক্ত-বাণিজ্যপন্থি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াস অ্যান্ড র‌্যাশনাল’ বণিকগোষ্ঠী। এই কোম্পানির মূল কাজ ছিল আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কালো মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে কিনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা।

এ রকম দ্বিচারিতা আরেকজন ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মধ্যেও ছিল। সারাজীবন তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করে গিয়েছেন; একপর্যায়ে কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকও হন। কোম্পানির চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও এর নীতি নির্ধারণে মিলের পরোক্ষ ভূমিকা অব্যাহত ছিল। ১৮৬০-এর দশকে অন লিবার্টি, অন রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট, ‘নারীমুক্তি’, এমনকি ‘সমাজতন্ত্র’ ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। সারা বিশ্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে একটা ‘সভ্য চেহারা’ দেওয়া ছিল তার অন্যতম বড় কীর্তি। ঔপনিবেশিক দ্বিচারিতার অনেকগুলো উদাহরণ দিয়েছেন গালিয়েনো। ক্রীতদাসের প্রথা একসময় ইংল্যান্ডে এবং তার দেখাদেখি সারা ইউরোপেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে গেল। রোমক সাম্রাজ্যের পতনের একটি কারণ ছিল ক্রীতদাসের বিদ্রোহ। চার্চ ঘোষণা দিয়েছিল, যে কাউকে ক্রীতদাস করা ঈশ্বরের চোখে ঘোরতর অন্যায় কাজ। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিচারকেরা রায় দিলেন, ক্রীতদাস নিয়ে বাণিজ্য (স্লেভ-ট্রেড) করা আইনত গর্হিতকর অপরাধ। মনে হতে পারে যে, এর পর ‘ক্রীতদাস-বাণিজ্য’ উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই বাণিজ্য থামল না। ষোড়শ, সপ্তদশ, অষ্টাদশ, এমনকি উনিশ শতকেও এই বাণিজ্য শুধু-ই থেমে থাকেনি তা-ই নয়, আফ্রিকায় উপনিবেশ সম্প্রসারণের সাথে সাথে ক্রীতদাসের বাণিজ্য নজিরবিহীনভাবে বেড়ে গেল। আগে ক্রীতদাস কেনা হতো কেবল উপকূলীয় বন্দর এলাকা থেকে। আফ্রিকার ভেতর প্রদেশে যাওয়ার ফলে উন্মোচিত হলো তার সমৃদ্ধ খনিজসম্পদ, তাতে করে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্রুত পরিণত করা হলো ক্রীতদাসে, যাদের জোরপূর্বক খাটানো হতো খনিগুলোতে। এই ক্রীতদাসদের একটা অংশকে আবার ‘আন্তঃমহাদেশীয়’ স্লেভ-ট্রেডে ব্যবহার করা হতো : লাভজনকভাবে খনিও চলত, আমেরিকার সাথে বহির্বাণিজ্যও নির্বিঘ্নে চলত ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয়ের সুবাদে।

১৮৮৫ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ ভাগাভাগির সম্মেলন। ইংরেজ, ফরাসি, বেলজীয়, ওলন্দাজ, জার্মান প্রভৃতি পরাশক্তির মধ্যে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের ভাগবাটোয়ারার সম্মেলন ছিল এটিই। এই সম্মেলনে বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের সম্মানে তাকে উপহার দেওয়া হলো ‘কঙ্গো’ নামক দেশটি- তার ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ হিসেবে। অচিরেই তিনি দুর্গম কঙ্গোকে একটি বাণিজ্য-ক্ষেত্র করে তুললেন। কঙ্গো হয়ে দাঁড়াল ‘হাতির দাঁতের’ সবচেয়ে বড় রপ্তানির উৎস; কঙ্গো থেকে সুলভে এবং প্রচুর পরিমাণে আসতে থাকল ‘রাবার’, যেটি সদ্য-আবিস্কৃত মোটরগাড়ির টায়ার হিসেবে বিশ্বজুড়ে ব্যবহূত হতে থাকে; কঙ্গো থেকে অবাধে আমদানি হতে থাকল রক্তমুখী হীরে- আমেরিকা-ইউরোপে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য আংটি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। এসবই হলো কঙ্গোর জনসাধারণকে ক্রীতদাস বানিয়ে অর্থাৎ ক্রীতদাস শ্রমের সুবাদে। ইতিহাসের বইপত্রে ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত তিরিশ বছরকে বলা হয়ে থাকে ‘নিখিল বিশ্ব-শান্তির যুগ’, যা কেবল ভেঙে যায় প্রথম মহাযুদ্ধের পরেই। জার্মানি তার আফ্রিকার উপনিবেশগুলো হারায়, আর ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-বেলজিয়াম তাদের উপনিবেশের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়।

কীভাবে সম্ভব হলো উনিশ শতকের পটভূমিতে সভ্য ইউরোপ, আধুনিক ইউরোপ, বিজ্ঞানমনস্ক ইউরোপ, শিল্পোন্নত ইউরোপের দ্বারা এই ‘ক্রীতদাস-নির্ভর’ অর্থনীতির পরিচালনা? এর অন্তর্নিহিত যুক্তি-জাল পাওয়া যায় জন স্টুয়ার্ট মিলের রচনায়। তিনি সারাবিশ্বের মানবগোষ্ঠীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন : সভ্য, আধাসভ্য ও অসভ্য। ‘সভ্য’ হচ্ছে ইউরোপ, সমগ্র বিশ্ববাসীকে সভ্য করার দায়িত্ব তার। ‘আধাসভ্য’ হচ্ছে ভারতবর্ষ- সেখানে ‘সংহত’ ধরনের নীতি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী মিল। আর ‘অসভ্য’ হচ্ছে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার আদিবাসী স্থানীয় জনগোষ্ঠী- তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে রূঢ় ও কর্কশ আচরণে পিছু-পা না হতে বলছেন মিল। তার আগে অবশ্য এ রকম কথা আরো কেউ কেউ বলেছেন। দার্শনিক হেগেল লক্ষ্য করেছিলেন যে, আফ্রিকার কোনো ‘ইতিহাস নেই’, একে শুধু ‘বর্বরতা আর নৃশংসতার’ কেস-স্টাডি হিসেবে পড়া চলে। দার্শনিক জীবতাত্ত্বিক, নৃতত্ত্ববিদ এবং উনিশ শতকের ‘ভিক্টোরিয়ান যুগের’ অন্যতম প্রধান লিবারেল তাত্ত্বিক হার্বার্ট স্পেন্সার অনেকটা ভেবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সভ্যতার উচিত হবে ‘পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সব অনগ্রসর জাতিকে মুছে ফেলা’, প্রগতির রথের নিচে এসব বাধাকে চূর্ণ না করতে পারলে সভ্যতাকে অগ্রসর করা যাবে না।

বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডকে নিয়ে কঙ্গোর গল্প বলতে গিয়ে অবধারিতভাবে একসময় চলে এসেছে ঔপন্যাসিক জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’-এর কথা। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে কুর্টজ, যার সাইড-পেশা হচ্ছে হাঁতির দাঁতের ব্যবসা করা। কনরাড নিজে কঙ্গোতে গিয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক বাহিনীতে কর্মরত অফিসার ক্যাপ্টেন লিওন রোম-কে মনে রেখে তিনি গড়ে তুলেছিলেন কুর্টজ-এর চরিত্র। কুর্টজ-এর শাসনে কোনো নেটিভই সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না- চারপেয়ে জন্তুর মতো অবস্থানে থেকে নেটিভরা কুর্টজ-এর আদেশ গ্রহণ করত। তার প্রাসাদোপম গৃহে প্রবেশের মুখে ফুল দিয়ে সাজানো ছিল পর পর বিশটি ধাপ, প্রতিটি ধাপের মধ্যে থাকত একটি কালো মানুষের বিদ্রোহী কাটামুণ্ডু। যখন তিনি ক্রীতদাস বা হাতি শিকার না করতেন, অর্থাৎ অবসর সময়ে, ক্যাপ্টেন কুর্টজ আঁকতেন নিসর্গ-চিত্র, রচনা করতেন কবিতা, সংগ্রহ করতেন প্রজাপতি। এইভাবে সভ্যতা আর অসভ্যতা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করত তার মধ্যে। কনরাডের চোখে, কুর্টজই ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদ, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলছেন- ‘ছোট ইংরেজ’।
[ক্রমশ]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৪
১. পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ

ওয়াশিংটন ডিসির ভেননেস্‌ ও টেনলিটাউন মেট্রোর মাঝখানে ফুটফুটে বইয়ের দোকান পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ। দুই মেট্রোর মাঝখানের হাঁটাপথে বাস্তবিকই এক মাইল শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে। উপর-নিচ মিলিয়ে বেশ দীর্ঘ পরিসরের দোকান, তাতে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন বিষয়ের বই। এ রকম বইয়ের দোকান কি আমাদের দেশেও নেই? আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু যেটা পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজকে আর দশটা বইয়ের দোকান বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট বুক স্টোর থেকে আলাদা করে, সেটা হলো তার ধারাবাহিক সেমিনার- বিভিন্ন বইকে ঘিরে আলোচনা-চক্র। আর সেসব বইয়ের আলোচনা করেন লেখকেরা নিজেই, পরে থাকে প্রশ্নোত্তর পর্ব, সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের অনুষ্ঠান। শুরু হয় সন্ধ্যে ৬টার দিকে। প্রতি মাসে অন্তত আটটা বইয়ের আলোচনা হয়। শিল্প-সাহিত্যের বইয়ের তাকগুলো যেখানে, সেখানেই শেল্কম্ফ সরিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। মোটামুটি একশ’টা চেয়ারের ব্যবস্থা, তবে সে রকম আলোচক হলে চারপাশে বইয়ের তাক ধরে সামনে-পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে আরও অনেক লোক। কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে আরও বেশি আগ্রহী শ্রোতার ভিড় জমাবার সম্ভাবনা যেখানে- সেখানে বইয়ের আলোচনা স্থানান্তরিত হয় সিক্সথ স্ট্রিটের চার্চের ভেতরে। যে রকমটা হয়েছিল সালমান রুশদীর বেলায়। অরুন্ধতী রায়ের নতুন উপন্যাসের জন্যও বড় জায়গার প্রয়োজন হয়েছিল। হিলারি ক্লিনটনের স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের আলোচনাও হয়েছিল ওই চার্চে। কিন্তু বেশিরভাগ লেখক-ঔপন্যাসিক ‘মেমোয়ারিস্ট’-কবি-ইতিহাসবিদ-প্রবন্ধকাররাই পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজের অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন। কে আসেননি এখানে? স্তালিন-জীবনীকার স্টিফেন কতকিন, অর্থনীতিবদ পল ক্রুগম্যান, পোয়েট লোরিয়েট ট্রেসি স্মিথ, প্রবন্ধকার টা-নাহাসি কোটস, ‘এক্সিট ওয়েস্ট’-এর লেখক মোহ্‌সিন হামিদ- সবাই আগ্রহ নিয়ে থাকেন এখানে এসে নিজের সৃষ্টিকর্মের ওপরে কিছু বলার জন্য। ক্লিনটন, বুশ, ওবামা, ট্রাম্প যিনিই প্রেসিডেন্ট থাকুন না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই লাইব্রেরি বা বুক স্টোরকেন্দ্রিক ‘সাব-কালচারটি’ এখনও আগের মতোই জীবন্ত হয়ে রয়েছে। শুধু পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ নয়, বড়-ছোট শহরের বইয়ের দোকানকে ঘিরে আলোচনা-চক্র (এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিডিং ক্লাবের মতো পাঠচক্র) ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে গত একশ’ বছর ধরে।

এ রকমই একটি বইয়ের আলোচনায় এসেছিলেন এদোয়ার্দো গালিয়েনো (Eduardo Galeano)। ২০০৯ সালের শীতের এক সন্ধ্যায় গালিয়েনো আসবেন পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজে- এটা জেনে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি। গালিয়েনোকে স্বচক্ষে দেখতে পাওয়ার এই সম্ভাবনাকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করা চলে না। লাতিন আমেরিকার ডিক্টেটরশিপ ও তার প্রতি মার্কিনিদের অব্যাহত নির্বিচার সমর্থন নিয়ে তার ‘ওপেন ভেইনস্‌ অব লাতিন আমেরিকা’ ছাড়ার পর থেকেই তার প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠি। আমাদের দেশে আমরা যেহেতু সুদীর্ঘকাল সামরিক বাহিনীর দীর্ঘ ছায়ায় কাটিয়েছি (এবং এখনও তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির গুজবের রেশ শহর-ঢাকার বুক থেকে মিলিয়ে যায়নি) লাতিন আমেরিকার ডিক্টেটরশিপ ও সামরিকতন্ত্র নিয়ে বেশি করে জানার স্বাভাবিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রজন্মের মধ্যে। একাত্তরের স্বাধীনতা তো মিলিটারি ডিক্টেটরশিপের বিরুদ্ধে এক সুদীর্ঘ লড়াইয়েরই ফসল। পঁচাত্তরের পরে ক্যু-পাল্টা ক্যু, জেনারেলদের আমল, সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, বেসামরিক সরকার-প্রশাসনের প্রতি ঠান্ডা যুদ্ধের কায়দায় বিভিন্ন পর্বের সামরিক চাপ আমাদের প্রজন্মের প্রতি পাকিস্তানের সামরিক অর্থনীতির ওপরে বিশেষজ্ঞ আয়েশা সিদ্দিকার সাবধানবাণী ‘কখনও সামরিকতন্ত্রকে খাল কেটে কুমিরের মতো ডেকে এনো না’, এক-এগারোর হুমকি-ধামকি, সেলিঞ্জারের অ্যাংরি ইয়াংম্যানের মতো দেশোদ্ধারে ব্রতী মিথিক্যাল অ্যাংরি ইয়াং অফিসারবৃন্দ- এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতেই আমাদের জীবন প্রায় কেটে গেল। সন্দেহ কী যে আমাদের মধ্যে ওই তরুণ বয়সেই আগ্রহ সৃষ্টি হবে চিলির নেরুদার কবিতা আর তার প্রতিপক্ষ জেনারেলদের প্রতি বা কলম্বিয়ার মার্কেজের উপন্যাস আর তার নিঃসঙ্গ কর্নেলের প্রতি, পেরুর ভার্গাস ইয়োসার উপন্যাস, নিকারাগুয়ার এর্নেস্তো কার্দেনালের কবিতা, ইকুয়েডরের অসওয়াল্কেন্ধা গইয়াসামিন (Guayasamin)-এর চিত্রকর্ম, মেক্সিকোর গল্পকার কার্লোস দ্য ফুয়েন্তেস, কবি অক্টাভিও পাজ, সেন্টার-পেরিফেরি স্কুলের লাতিন আমেরিকার ‘ডিপেনডেন্‌সিরা’ তত্ত্বের প্রণেতারা (লাকলাউ, কারদোসো), উরুগুয়ের প্রাবন্ধিক-সাহিত্যিক এদোয়ার্দো গালিয়েনো এবং সেই সূত্রে সমগ্র লাতিন মহাদেশই আমাদের আত্মার কাছাকাছি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আজ সামরিকতন্ত্র কেবল টিকে আছে আফ্রিকার কিছু দেশে :সারা লাতিন আমেরিকাতেই দুর্বল হোক সবল হোক বিরাজ করছে নানা চরিত্রের গণতন্ত্র। পূর্ব এশিয়ার একদা-সামরিকতন্ত্র অধ্যুষিত দেশগুলোতেও এসেছে গণতান্ত্রিক শাসন, যদিও দেশভেদে তার গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু অনেকটাই প্রশ্নকীর্ণ। এক সময় সুদীর্ঘকাল একচ্ছত্র শাসন করা সামরিকতন্ত্র এখন পিছু হটেছে দক্ষিণ এশিয়াতেও- যেমন পাকিস্তানে। তবে সর্বত্র পিছু হটলেও সামরিকতন্ত্রের নেপথ্য-প্রভাব কমেনি। তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ এখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে, সে একাই সামরিকতন্ত্রকে মোকাবিলা করতে পারবে। গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ যদি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটের’ আদলে গড়ে উঠতে পারে, যদি তার কল্যাণকামী দিকটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তবেই জনগণ কেবল সেই গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সঙ্গী হবে। এবং সম্ভাব্য সামরিক-হুমকি বা ‘এক-এগারো’র বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু যদি এ দেশের পুঁজিবাদ ক্রমেই অতি-ধনীদের করালগ্রাসে চলে যায়, তবে নেমে আসতে পারে মাৎস্যন্যায়। যার অপেক্ষায় থাকবে সামরিকতন্ত্রের ঝুঁকি। এটাই লাতিন আমেরিকার শিক্ষা। এ নিয়েই সারা জীবন গল্প, অনুগল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস, দর্শন লিখে গেছেন এদোয়ার্দো গালিয়েনো। তার স্মৃতি এক গোটা জনগোষ্ঠীর স্মৃতির মতন। কিছুই ভোলা হয়নি তাতে, কোনো প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গই বাদ পড়েনি, মণি-মুক্তার মতো সেসব অভিজ্ঞতার স্মৃতি-বিস্মৃতি সংকলন করেছেন গালিয়েনো। আমাকেও বলেছিলেন, ‘আপনি এ রকম একটা চেষ্টা করে দেখুন না কেন দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে? আপনাদেরও তো রয়েছে- আমি জানি- কত বলা কত না-বলা সংগ্রামের ইতিহাস, কথা ও কাহিনি।’
[ক্রমশ]

পভার্টি ট্র্যাপ ও আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য: সিলেটে রবীন্দ্রনাথের ভাষণ (Poverty Trap and Poverty of Aspiration: Tagore in Sylhet)

পর্ব ::৩৩

৫. আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য

কিন্তু শ্রীহট্ট কলেজে তার ভাষণের উদ্দেশ্য ছিল অন্যত্র নিহিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নয়, উন্নয়নের দৃষ্টিকোণকেই রবীন্দ্রনাথ সেখানে বেশি করে প্রাধান্য দিয়েছেন। দরিদ্ররা যে চিরকালেই দারিদ্র্যের ফাঁদে থেকে যায়, তার মূল কারণের মধ্যে ‘আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য’ও একটি। সাম্প্রতিক উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রেও ‘পভার্টি অব এসপিরেশন’ একটি স্বীকৃত ধারণা। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার সহকর্মীদের একটি বড় পর্যবেক্ষণ হলো- গরিবরা গরিব শুধু তাদের বৈষয়িক অবস্থার কারণে নয়, এর মূলে রয়েছে তাদের উপরে-ওঠার উচ্চাকাঙ্খার অভাব। একবার সেই আকাঙ্খাকে প্ররোচিত করতে পারলে-সেটা ‘ক্ষুদ্র প্রণোদনা’ দিয়েই অর্জন সম্ভবুদরিদ্রের মৃদুমন্দ চলাকে বৃহৎ উল্লম্ম্ফনে পরিবর্তন করা যায়। এটাকে অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন-‘উদ্বুদ্ধকরণের অর্থনীতি’ বা nudge-economics. যার মাধ্যমে গরিব মানুষের আচরণ-কার্যকলাপের ধরন-ধারণা পরিবর্তন করা সম্ভব। যাতে করে তারা দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে একশো বছর আগেই এই দারিদ্র্য-ফাঁদের তত্ত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি শ্রীহট্ট ভাষণে সেদিন বলেছিলেন :’যদি মূলের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখব আমাদের যে দারিদ্র্য সে আত্মারই দারিদ্র্য। …নদী যখন মরে যায় তখন দেখতে পাই গর্ত এবং বালি, সেই শূন্যতার সেই শুস্কতার অস্তিত্ব নিয়ে বিলাপ করবার কথা নেই। আসল বিলাপের কারণ নদীর সচল ধারার অভাব নিয়ে। আত্মার সচল প্রবাহ যখন শুস্ক তখনি আচারের নীরস নিশ্চলতা।’

আচারের নিশ্চলতা আসে গতানুগতিকতার বৃত্তে নিজেকে বেঁধে ফেলার মানসিকতার কারণে। রবীন্দ্রনাথ এর কারণ অন্যত্র দেখেছিলেন আমাদের বহুধা-বিভক্ত জাত-পাতসর্বস্ব ধর্মাচারের মধ্যে। ‘আকাঙ্ক্ষা’ প্রবন্ধে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন শিক্ষা-ব্যবস্থার দীনতা নিয়ে। কোন জাতিকে যদি ধ্বংস করে দিতে চাও তাহলে তার শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ভেতর-থেকে ধ্বংস করে দাও- এই ছিল তার মত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এ প্রসঙ্গে :’আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে শিশুকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব করি। অর্থাৎ সেটাকে কাজে খাটাবার আগেই তাকে খাটো করে দিই। অনেক সময়ে বড় বয়সে সংসারের ঝড়-ঝাপটার মধ্যে পড়ে আমাদের আকাঙ্খার পাখা জীর্ণ হয়ে যায়। তখন আমাদের বিষয়বুদ্ধি, অর্থাৎ ছোট বুদ্ধিটাই বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, শিশুকাল থেকেই আমরা বড় রাস্তায় চলবার পাথেয় ভার হালকা করে দিই।’

এই বলে রবীন্দ্রনাথ তার নিজের গড়া শান্তিনিকেতনের উদাহরণ টেনে আনলেন। সেখানেও কিছুতেই ছাত্র-ছাত্রীদের পুঁথিগত বিদ্যার প্রভাব থেকে সরিয়ে আনা যাচ্ছিল না। ‘নিজের বিদ্যালয়ে ছোট ছোট বালকদের মধ্যেই সেটা আমি অনুভব করি। প্রথমে কয় বৎসর একরকম বেশ চলে কিন্তু ছেলেরা যেই থার্ড ক্লাসে গিয়ে পৌঁছয় অমনি বিদ্যা অর্জন সম্বন্ধে তাদের বিষয়বুদ্ধি জেগে ওঠে। অমনি তারা হিসাব করতে শিখতে বসে। তখন থেকে তারা বলতে আরম্ভ করে, আমরা শিখব না, আমরা পাস করব। অর্থাৎ যে পথে যথাসম্ভব কম জেনে যতদূর সম্ভব বেশি মার্ক পাওয়া যায় আমরা সেই পথে চলব।’

একেই অর্থনীতিবিদ ল্যান্ট প্রিচেট আখ্যায়িত করেছেন ‘জানার সংকট’ বা লার্নিং ক্রাইসিস বলে। আমরা ডিগ্রি পাচ্ছি, কিন্তু যা জানা দরকার ছিল তা জানছি না। রবীন্দ্রনাথ একে কেবল উন্নতমানের শিক্ষা-পদ্ধতি বা ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’-এর সমস্যা হিসেবে দেখছেন না। বেশি করে জানার ইচ্ছাটাই মরে যাচ্ছে, বিশেষ করে এটা মরে যাচ্ছে গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য। কোন ভাবে পাশ করে সরকারী চাকুরে হওয়ার ইঁদুর-দৌড়ে গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই নিয়োজিত। জানার জন্য জানা- এই আকাঙ্খা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। এ-ই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চরম দুর্ভাবনা।

শিক্ষার নানা আনুষ্ঠানিক ধাপ অতিক্রম করা হচ্ছে, কিন্তু জ্ঞান বাড়ছে না, ‘জানার সংকট’ থেকে যাচ্ছে- এর ফলে একভাবে দেখলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়লেও দেশ থেকে অন্ধকার দূর হচ্ছে না। দেশের উন্নয়নে এই শিক্ষা যথাযথ অবদান রাখতে পারছে না। আর সেটা দেখে যারা দেশের বাজেট প্রণয়ন করেন, তারা শিক্ষার পেছনে বাজেট-বরাদ্দ বাড়াতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এক ধরনের বিষ-বৃত্তের সৃষ্টি হচ্ছে এতে। শুধু পরীক্ষা-পাসের শিক্ষায় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে; কিন্তু দেশ ও দশের উন্নয়ন বেগবান হয় কিনা- সে প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের সংশয় ছিল। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘আকাঙ্ক্ষা’ ভাষণে স্পষ্ট করে তার ভিন্নমত উত্থাপন করেছেন : ‘যে দেশে বিদ্যালয়ে কেবল দেখতে পাই, ছাত্র নোটবুকের পত্রপুট মেলে ধরে বিদ্যার মুষ্টি ভিক্ষা করছে, কিম্বা পরীক্ষার পাসের দিকে তাকিয়ে টেক্‌স্‌ট্‌ বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যার উঞ্ছবৃত্তিতে নিযুক্ত; যে দেশে মানুষের বড় প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্রেই পরের কাছে ভিক্ষা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে, নিজের হাতে দেশের লোকে দেশকে কিছুই দিচ্ছে না- না স্বাস্থ্য, না অন্ন, না জ্ঞান, না শক্তি; যে দেশে কর্মের ক্ষেত্রে সংকীর্ণ, কর্মের চেষ্টা দুর্বল, যে দেশে শিল্পকলায় মানুষ আপন প্রাণ মন আত্মার আনন্দকে নব নব রূপে সৃষ্টি করছে না; যে দেশে অভ্যাসের বন্ধনে সংস্কারের জালে মানুষের মন এবং অনুষ্ঠান বদ্ধবিজড়িত; যে দেশে প্রশ্ন করা, বিচার করা, নূতন করে চিন্তা করা, ও সেই চিন্তা ব্যবহারে প্রয়োগ করা কেবল যে নেই তা নয় সেটা নিষিদ্ধ এবং নিন্দনীয়, সেই দেশে আপন সমাজে আত্মাকে দেখতে পায় না, কেবল হাতের হাতকড়া, পায়ের বেড়ি এবং মৃতযুগের আবর্জনা-রাশিকেই চারদিকে দেখতে পায়, জড় বিধিকে দেখে, জাগ্রত বিধাতাকে দেখে না।’

পরীক্ষা-পাসের দাসত্ব থেকে জানার বা জ্ঞানের সংকট শুধু আর শিক্ষা ক্ষেত্রের দীনতায় সীমিত রইল না। এই শিক্ষার সংকটের কারণে ভিন্ন রুচির মানুষের জন্ম হলো, যার হাত দিয়ে উন্নয়ন বেগবান করা প্রায় অসম্ভব। এ কথা রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য লেখাতেও নানাভাবে বলেছেন। শিক্ষাকে তাৎক্ষণিকের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করতে চাইলে হিতে বিপরীত ঘটে। রবীন্দ্রনাথের ‘তোতাকাহিনী’ এ প্রসঙ্গে মনে পড়বে। ‘আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক ভাষণের দু’বছর পূর্বে ‘সবুজপত্র’ সাময়িকীতে প্রকাশিত রূপক-গল্পে তিনি লিখেছিলেন :’এক যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত; শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত; জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে। রাজা বলিলেন, ‘এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।’ মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও।’ এর ফল কী হয়েছিল, তা আমাদের জানা। পাখিকে পুঁথি-শিক্ষা দিতে গিয়ে রাশি রাশি পুঁথির পাতা তাকে গেলানো হলো। জীবনাবসান হলো তার এক পর্যায়ে। পরীক্ষা-পাসের তাড়নায় একালের ছাত্র-ছাত্রীদেরও তোতাকাহিনীর পাখির দশা হওয়ার উপক্রম। তাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেতে বসেছে, মহৎ কিছু করার স্বপ্ন প্রায় অবলুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ যে-যুগে এসব কথা বলেছিলেন, আজ সে কথা এই ‘ম্যাস এডুকেশন’-এর যুগে আরো প্রাসঙ্গিক। জনমানসে শিক্ষার যে বাসনা জেগেছে, সেটাকে যেমন বিবেচনায় নিতে হবে, কীভাবে শিক্ষার সাধনাকে অন্তত দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তনগুলোতে উৎসাহিত করা যায় সেদিকটি নিয়েও রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাবতে বলেছেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি ‘নালন্দা বিক্রমশীলা তক্ষশীলা’র উদাহরণ টেনে বিশ্ববিদ্যালয়কে তত্ত্বজ্ঞানীদের মিলনক্ষেত্র করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন; আবার অন্যদিকে যারা উচ্চশিক্ষার সোপানে উন্নীত হবে না, তাদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার চেয়েছেন। জ্ঞানের বৈষয়িক দিককে তিনি অস্বীকার করেন নি। তিনি জ্ঞানের সাধনার দিকের সর্বাত্মক বিকাশ চেয়েছিলেন কেবল। ইউরোপের ছকে নয়, আমাদের দেশের আদলে আমাদের প্রয়োজন মাথায় রেখে আমরা যেন বিদ্যায়তন গড়ে তুলি; সেটা তিনি চেয়েছিলেন। অথচ আমরা একে একে দেশের উচ্চ বিদ্যায়তনগুলো শেষ করে দিচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বলেছেন: ‘যে-জ্ঞান আমাদের সত্যের দিকে নিয়ে যায় গোড়া থেকেই সেই জ্ঞানের সঙ্গে অসত্য ব্যবহার। এর কি অভিশাপ আমাদের দেশের পরে লাগছে না? এই জন্যেই কি জ্ঞানের যজ্ঞে আমরা ভিক্ষার ঝুলি হাতে দূরে বাইরে বসে নেই? আপিসের বড় বাবু হয়েই কি আমাদের এই অপমান ঘুচবে? …সব বড় দেশে যে বড় আকাঙ্ক্ষা মানুষকে আপন শক্তিতে আপন ভাবনায় আপন হাতে সৃষ্টি করবারই গৌরব দান করে আমরা সেই আকাঙ্ক্ষাকেই কেবল যে বিসর্জন করছি তা নয়, দল বেঁধে লোক ডেকে বিসর্জনের ঢাক পিটিয়ে সেই তালে তাণ্ডব নৃত্য করছি।’ এখনো সেই তাণ্ডব নৃত্যই আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে।

৬. আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য থেকে পরনির্ভরতা

একশো বছর আগে সিলেটে রবীন্দ্রনাথ যে আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্যের কথা বলেছিলেন, তার ফলে শুধু চাকরি খোঁজা তরুণ সম্প্রদায়েরই সৃষ্টি হচ্ছে না, ‘বড় কিছু’ করার ইচ্ছেও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এর থেকে জন্ম নিয়েছে এক অভূতপূর্ব পরনির্ভরশীল মানসিকতার। সিলেটে আসার কয়েক বছর আগে একটি প্রবন্ধে তিনি ভরসার ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাবের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছিলেন :

“আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, অপরে আমাদের শক্তি সম্বন্ধে সর্বদা সন্দেহ প্রকাশ করে বলিয়াই এবং সেই সন্দেহকে মিথ্যা প্রমাণ করিবার কোনো ক্ষেত্র পাই না বলিয়াই অন্তরে তন্তরে নিজের সম্বন্ধেও একটা সন্দেহ বদ্ধমূল হইয়া যায়। এমনি করিয়া আপনার প্রতি যে লোক বিশ্বাস হারায় সে কোনো বড়ো নদী পাড়ি দিবার চেষ্টা পর্যন্তও করিতে পারে না; অতি ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে ডাঙ্গার কাছে কাছে সে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং তাহাতেই সে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকে এবং যেদিন সে কোনো গতিকে কাগবাজার হইতে বরানগর পর্যন্ত উজান ঠেলিয়া যাইতে পারে সেদিন সে মনে করে, ‘আমি অবিকল কলম্বাসের সমতুল্য কীর্তি করিয়াছি।”

চাকরি লাভের জন্য যে শিক্ষা তাতে শিক্ষার চেয়ে চাকরির প্রাপ্তিই বড় লক্ষ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তুমি কেরানির চেয়ে বড়ো, ডেপুটি মুনসেফের চেয়ে বড়ো’- এটাই আমাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে। কেননা, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জাতি হিসেবে, সমষ্টি হিসেবে, আরো উপরে, ঐ উপরে ওঠার।’ ‘পাখির ছানা তো বিএ পাস করিয়া উড়িতে শেখে না; উড়িতে পায় বলিয়াই উড়িতে শেখে।’ কিন্তু আমাদের উড়বার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। রাষ্ট্রজীবনে জ্ঞান-তপস্যার স্বীকৃতি ও গুরুত্ব কমে এসেছে। অনুকৃতিকেই আমরা পরম আরাধ্য বলে বিবেচনা করছি। এভাবে চললে দেশ হিসেবেও আমরা পিছিয়ে যাব, পেছনের সারিতে পড়ে থাকব চিরকাল। রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানজগতের পরনির্ভরতাকে শেষের বিচারে আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্যের সাথে যুক্ত করে দেখেছেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটা পাঠ করলে সে বিষয়ে কোনো সংশয় থাকে না :’যে ইতিহাস ইংরেজি কেতাবে পড়িয়াছি তাহাই আমাদের একমাত্র ইতিহাসের বিদ্যা, যে পলিটিক্যাল ইকোনমি মুখস্থ করিয়াছি তাহাই আমাদের একমাত্র পলিটিক্যাল ইকোনমি। যাহা কিছু পড়িয়াছি তাহা আমাদিগকে ভূতের মতো পাইয়া বসিয়াছে… আমরা মনে করিতেছি। পলিটিক্যাল সভ্যতা ছাড়া সভ্যতার আর কোনো আকার হইতেই পারে না।… মানুষ যদি এমন করিয়া শিক্ষার নীচে চাপা পড়িয়া যায়, সেটাকে কোনোমতেই মঙ্গল বলিতে পারি না।… আমরা জগতের ইতিহাসকে নিজের স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে দেখিতে সাহস করিলাম কৈ, আমরা পলিটিক্যাল ইকোনমিকে নিজের স্বাধীন গবেষণার দ্বারা যাচাই করিলাম কোথায়?’

[এই বিষয় সমাপ্ত]