ইশতেহার কি আমাদের জন্য (What is our manifest?)

আমরা ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে সময়ের গ্রন্থিগুলো পার হচ্ছি। অনেকটা যেন রজ্জুপথে চলা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই মহাপতনের দিকে। একটা জাতি এত দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম চাপের মধ্যে থেকে সুস্থ থাকতে পারে না। তাই সামগ্রিকভাবে এবারের নির্বাচনটা আর দশটা নির্বাচনের মতো গতানুগতিক নির্বাচন নয়। তার দুটি কারণ। একটি কারণ হচ্ছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অচিরেই পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার যে সরকার নির্বাচিত হবে, সে সরকারই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। কেবল উৎসব উদযাপনই নয়, এর সঙ্গে আরও কিছু দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জও তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন- পঞ্চাশ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলাম, পঞ্চাশ বছর পরে এসে আমাদের অর্জনটাই বা কী হলো, আর আমরা সামনের পথটাই বা কীভাবে পাড়ি দেব? এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সময় এসে গেছে।

যেভাবে গত দশটি বছর পার করেছি, সামনের দশটি বছর ততটা নির্বিঘ্নে কাটবে না। সেই অর্থে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এবং এতে যে দলগুলো অংশগ্রহণ করছে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সেই তাগিদটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে এমডিজির পরে এখন এসডিজি এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজিগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা; আরেকটি হচ্ছে ২০৩০ সালে অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিটা গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশি হয়। আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। অঙ্কের হিসাবে বললেও সেটি ১১ বছর। এই ১১ বছরের মধ্যেই আমাদের দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্য হ্রাসকারী দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে হবে। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কিন্তু আলাদাভাবে কিছু লক্ষ্য গ্রহণ করেছি। যেমন এর একটি হচ্ছে, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো।

১. আদি প্রতিশ্রুতি ও তার আজকের অর্থ

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ইশতেহারে কী থাকা উচিত, তা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হতে পারে। আমি যে আলোচনাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, সেটা হচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও অস্তিত্বগতভাবে মানুষের মতোই। তারও সত্তার পরিবর্তন হয়। মানুষের সত্তা যেমন একই রূপ থাকে না; শৈশবে-কৈশোরে, যৌবনে বা বার্ধক্যে তার রূপ বদল হয়। তেমনি রাজনৈতিক দলেরও কিন্তু সত্তার বিবর্তন হয়। এর অর্থ হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও তার মূল নীতিমালাগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল নীতিমালার মধ্যে যেটা মৌলিক, যেটা আমাদের সংবিধানে রয়েছে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এ চারটি নীতি ১৯৭২ সালে যে অর্থ নিয়ে এসেছিল, সে অর্থ আজও তারা সমানভাবে বহন করে কি-না এবং বহন করে থাকলে এর নতুনতর অর্থ কী, সেটা খোঁজার জায়গা হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। নির্বাচনী ইশতেহারে সে সম্পর্কে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং সুচিন্তিত বক্তব্য থাকা উচিত। যেমন ধরা যাক, আগে সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝানো হতো এবং অনেকেই বুঝতেন জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানা, উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা এবং এ জাতীয় পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে যেটা এসেছিল। ধারণাটা যখন এসেছে তখনও কিন্তু বিতর্কটা হয়েছিল, এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী? এবং আমাদের গণপরিষদে একটা দীর্ঘ বিতর্কও হয়েছিল এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় সে অর্থটা কেমন, তা নিয়ে। মার্ক্স কখনও চিন্তা করেননি যে, বৈষম্য বাড়লে সমাজতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হবে আর বৈষম্য কমলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। সেভাবে তিনি সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়ন করেননি। তিনি সমাজতন্ত্রকে একটি নতুন মৌলিক সভ্যতার ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে একদিকে বাজার পুঁজিবাদকে আশ্রয় করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার আমরা সমাজতন্ত্রের কথাও বলছি। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদও থাকছে, আবার সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাও থাকছে। দুটো মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের চেহারাটা কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি সুইডেন বা জার্মানির মতো একটা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি! না কানাডার মতো সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি, নাকি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতে চাচ্ছি, যেখানে ট্রাম্পচালিত সরকার আসে এবং প্রধানত নানা ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে স্বাস্থ্য খাতের নিশ্চয়তা নেই, হাই স্কুলের পরে শিক্ষার খরচ চালানো নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার কানাডা, সুইডেন বা জার্মানির মতো দেশে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের অধিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী ধারার হলেও জনগণকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মৌলিক সুবিধাদি কতটা পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কত গভীরে দেওয়া হবে- সেটার ওপরে ভিত্তি করে এক দেশ কিন্তু আরেক দেশ থেকে আলাদা। আমরাও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারি। বাংলাদেশ যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, তার অর্থটা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিজে মনে করি যে, আমাদের দেশে নিজস্ব ধরনের একটা সামাজিক গণতন্ত্র গড়ে ওঠার বস্তুগত অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আজকের অবস্থাটা থেকে আমরা যদি একটা সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চাই, তাহলে লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট করে বলা দরকার; এবং সেটাকে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

ঠিক তেমনিভাবে আসে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বোঝানো হতো, ধর্ম এবং রাষ্ট্র পরস্পর বিযুক্ত। ধর্ম হচ্ছে প্রাইভেট স্ম্ফিয়ারের আর রাষ্ট্রকার্য হচ্ছে পাবলিক স্ম্ফিয়ারের। সেই বিযুক্তির ধারণা থেকে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞাটা আমরা পেয়েছি বা নানাভাবে এসেছে, তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধর্ম পালনের সমান অধিকার। এ ক্ষেত্রে যেমন একটা স্লোগান প্রচলিত আছে- ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।

কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আরেকটু চিন্তা করার সুযোগ আছে। দার্শনিক হাবেরমাস যেমন বলেছেন, ‘উই হ্যাভ এনটার্ড ইনটু এ পোস্টসেকুলার এজ’। অর্থাৎ আমরা এখন এক ধর্মনিরপেক্ষতা-উত্তর সমাজে বাস করছি। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ যে শক্তি, তাকে এখন নতুন করে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে যেতে হচ্ছে। এই যে সংলাপে নতুন করে যেতে হচ্ছে, ধর্মীয় শক্তিকে সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্বীকার করতে হচ্ছে- এটা কিন্তু নতুন উপলব্ধি। সেটা ইউরোপে বসে ২০০৪ সালে তিনি লিখেছিলেন। কথাটা আমাদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও সত্য এবং বাংলাদেশের জন্যও সত্য। আমরা এখন শুধু অসাম্প্রদায়িকতা এবং শুধু ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই সংজ্ঞাতে আটকে না থেকে একটু বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে পারি- কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য শক্তিকে আমরা সামাজিক রূপান্তরের কাজে ও উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে পারি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমরা যে স্বীকৃতি দিয়েছি, সেটাকে কেউ কেউ বলতে পারেন, এই স্বীকৃতিটা এসেছে ওই ধরনের উপলব্ধি থেকে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে তারা মূলধারার শিক্ষাস্তরের সঙ্গে কতটুকু পরিমাণে সমান, সেটা নিরূপণের দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তায়। এই নিরূপণে যদি দেখা যায়, দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়ে গেছে, ঘাটতি রয়ে গেছে- তাহলে সেই ঘাটতিগুলো পূরণে আরও যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। সেটাকেই মূলত প্রকৃত স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্রের মতো এ বিষয়টিকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা যারা ভাবেন, তারা এখন নতুন করে বলুক- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তারা এখন কীভাবে দেখছেন? সেটা কি মুসলিম লীগের সেই মুসলিম বেঙ্গলের পুরনো ধারণার মধ্যেই আটকে আছে, নাকি তাকে আরও সম্প্রসারিত করে নতুনভাবে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দেখছেন; যে জাতীয়তাবাদের অংশ আদিবাসী থেকে শুরু করে সমতল ও পাহাড়ের সবাই; নাকি যেখানেই বাঙালি আছে, তাদের সবাই এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত? এককথায় প্রতিটি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের মূল চারটি আদর্শের বা প্রতিশ্রুতির সমসাময়িক অর্থবহতা সম্পর্কে একটা প্রতিফলন দরকার এই নির্বাচনী ইশতেহারগুলোয়।

২. দারিদ্র্য কমছে, বৈষম্য বাড়ছে

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইশতেহারে আমাদের জন্য প্রত্যাশিত কী কী প্রসঙ্গ আসতে পারে? একটা হচ্ছে, যে অর্থনীতিতে গত এক দশকে কিছু কিছু ইতিবাচক প্রবণতা জন্ম নিয়েছে, তার মধ্যে মোটামুটি স্বীকৃত একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই যে আজকে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬-সাড়ে ৬ শতাংশ করে বাড়ছে; কোনো কোনো বছর ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এটি ভালো দিক। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা, দারিদ্র্যও ধীরে ধীরে কমে আসার কথা। বাস্তবে দারিদ্র্য কমছেও। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত করতে পারি, মেয়েদের স্কুলগামিতার হার বাড়ছে, শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। এই যে প্রবৃদ্ধি বাড়া, দারিদ্র্য কমে আসা, মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়া- এর কারণে কতগুলো সামাজিক সূচকেও পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের সূচকে, বিশেষ করে প্রিভেনটিভ হেলথ কেয়ারে এবং শিক্ষাসূচকে আমরা অনেকগুলো ধাপ পার হচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গেই আবার জড়িত হয়ে পড়ছে কতগুলো নেতিবাচক দিক; যেগুলোকে ইতিবাচক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাচ্ছে না। অ্যাঙ্গেলসের একটা কথা ছিল যে, বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়তে থাকলে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রভুত্ব করার সামর্থ্য কমে যায়। আমাদের দেশেও বোধকরি এটা ঘটেছে। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’-এর শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্র যেমন লিখেছিলেন, ‘আজিকালি শোনা যায় দেশের খুব শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।’ এই শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্যও সত্য। কিন্তু তারপরই বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে, ‘কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? আমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, আমি তুমি কি দেশ! হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত- তাহাদের কি শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে?’ এই প্রশ্নটা তিনি রেখেছিলেন। এই প্রশ্নটাতে আমাদের টুইস্টটা হচ্ছে, হ্যাঁ এই শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দারিদ্র্য কমছে। তবে সবার কমছে না, এখনও কিছু চরম দরিদ্র পরিবার রয়ে গেছে হাওর অঞ্চলে বা বিভিন্ন উপদ্রুত উপকূলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কমছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি যেটা হচ্ছে, বৈষম্য বল্কগ্দাহীনভাবে বাড়ছে। সেটা বাড়ছে সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানেই। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, বৈষম্য ৪৪ শতাংশ থেকে এখন ৪৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সাধারণত বলা হয় যে, যখন জিনি কোইফিশিয়েন্ট ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা অতি উচ্চ বৈষম্যের স্তরে প্রবেশ করি, যাতে শুধু লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ও চীন প্রবেশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৈষম্যের হার ৪৫ শতাংশের মতো। ইউরোপিয়ান অনেক দেশে বৈষম্যের হার আরও কম। সুতরাং যদিও আমরা নিল্ফেম্নান্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছি- তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের প্রবৃদ্ধির অর্জনটা অনেকখানি ম্লান হয়ে যাচ্ছে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে। সে জন্যই ইশতেহারে একটা সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, প্রবৃদ্ধি বাড়াব, দারিদ্র্য কমাব; কিন্তু বৈষম্যকে বেশিদূর বাড়তে না দিয়েই। অর্থাৎ বৈষম্যের লাগাম ধরে রেখেই আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াব। এটা একটা মৌলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যদি বৈষম্যকে এভাবে বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দুটো কুফল দেখা দেবে। প্রথমত, প্রবৃদ্ধি একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক জিনি সূচকের বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে সামাজিক বৈষম্য। একশ্রেণির সঙ্গে আরেক শ্রেণির বৈষম্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। আমি সন্দেহ করি, সাম্প্রতিককালে যে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- আগামীতে হয়তো আমরা এমন আরও তরুণের আন্দোলন দেখতে পাব- যার পেছনে কাজ করেছে বা করবে এই বৈষম্যের উস্কানি। তার কারণ হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখছি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির সুফলগুলো সবার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। কর্মসংস্থানগুলো গুণগত মানের হয়ে, উপযুক্ত হয়ে তার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন একটা সামান্য ধরনের সামাজিক অস্থিরতা বা নড়াচড়াই বড় ধরনের দুর্বিপাকের আশঙ্কা বয়ে নিয়ে আসছে- এটার মূল কারণ হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান যথাযথ মানের হতে পারছে না। এবং সেইসঙ্গে মানুষে মানুষে যে আয়বৈষম্য, সম্পদে বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য, যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্য- এসব মানুষকে আহত করছে। সেটা নানাভাবে, নানা উপায়ে বহিঃপ্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আমাদের মতো দেশে এখনও পর্যন্ত যথার্থ অর্থে একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দাঁড়ায়নি। যেটা উন্নত বিশ্বে তো বটেই, মাঝারি উন্নত দেশেও আছে। যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই একই ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন। মূলত তারা একই র‌্যাপিড ম্যাস ট্রান্সপোর্টে চড়ে কাজে যাচ্ছেন। এর ফলে একে অপরের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যাতায়াত করতে করতে একটা অভিন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠছে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিটি ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা একেকটি নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য বাঁধা। উচ্চবিত্তরা নিজস্ব গাড়িতে চড়ছেন, মধ্যবিত্ত বাস-রিকশায় চড়ছেন, নিম্নবিত্ত হেঁটে যাচ্ছেন।

সুতরাং বৈষম্যের ব্যাপারে যে কোনো সময়ের নির্বাচনের তুলনায় এবার আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করি। তাদের ইশতেহারে চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকায় সর্বশীর্ষে এই বৈষম্য দূর করার কথা রাখা উচিত। শুধু একটি নীতি নিয়ে এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সকলের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ বৃদ্ধি করা- উন্নত বাসস্থান, উন্নত শিক্ষা, উন্নত কর্মসংস্থান, উন্নত ঋণপ্রাপ্তি প্রভৃতি সুযোগ যাতে কেবল ধনীদেরই মধ্যে সীমিত না থাকে। রাষ্ট্রের পুনর্বণ্টনমূলক নীতিমালাকে, যথা- রাজস্ব-ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে ফলপ্রসূ সম্পত্তি-করের প্রবর্তন করতে হবে।

৩. ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ?

বৈষম্যের পরে আমি যে দ্বিতীয় নেতিবাচক প্রবণতার কথাটি বলছি সেটি হচ্ছে, ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদের আশঙ্কা। আমার ধারণা, আমাদের দেশে ক্রমশ একটা ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ ব্যবস্থা গেড়ে বসছে। মূলত পুঁজিবাদের যে স্বাভাবিক শক্তি, নিজেকে নিজে শোধন করার যে প্রক্রিয়া- সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় এই ঝুঁকির মাধ্যমে। পুঁজিবাদ সব সময়ই পুঁজিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ঝুঁকির সামনে ঠেলে দিয়ে। আবার বাজারের বাইরের অনেক বিষয়ও পুঁজিবাদের বিকাশে কাজ করে। যেমন আমি চাইলেই আমার পাশের জমিটা দখল করতে পারি না। আমি চাইলেই ব্যাংকের টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত না দিয়ে দিনের পর দিন চলতে পারি না। চাইলেই মুনাফা থেকে যে কর-রাজস্ব দেওয়ার কথা, তা পরিশোধ না করে বড় ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারি না। অনেক উন্নত দেশের জন্যই এসব কথা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বে তো বটেই, গত এক দশকেও দেখছি এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের জন্য এই ঝুঁকিগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে বাজারের যে ঝুঁকি, সেটা থাকলেও বাজারবহির্ভূত যে ঝুঁকি- অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য তাকে যে ঝুঁকিগুলো বহন করতে হবে, সেগুলো কমে গেছে। তার মানে পুঁজিপতিরা এসব নিয়ম না পালন করে উল্টো এসবকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। এটাকেই আমরা বলছি ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ। এই ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদেই ক্রনি পুঁজিবাদের জন্ম হয়। এবং ক্রনি পুঁজিবাদের কারণেই তারা এটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছে। কারণ তারা ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে। যার সুবাদে প্রচুর ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করেও অনেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন বিনিয়োগগুলোর ওপর নানাভাবে এসবের প্রভাব পড়ছে। নতুন ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, নতুন ঋণের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, আইন না মানার একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। আর এই সবকিছুকেই আমি সামগ্রিকভাবে ‘ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ’ নামে আখ্যায়িত করছি। এই টার্মটি ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে, পুঁজিবাদের ভেতরে থেকেই পুঁজিবাদের যে অবনতি হচ্ছে, এর মাধ্যমে সেটাকে প্রশ্ন করা সম্ভব। এ রকম ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ যদি চলে, তাহলে সেই ঝুঁকিটা আসলে সমাজকেই বহন করতে হয়। পুঁজিপতি শ্রেণি সেই ঝুঁকি বহন করছে না। অথচ কথা ছিল উল্টোটা হওয়ার, যে পুঁজিপতি শ্রেণি ঝুঁকি নেবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে- এর মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে উল্টো। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে চাই শক্ত মেরুদণ্ডের নিয়মনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জোট। এটা শুধু একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। আবার এটা না হলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিকাশের পরবর্তী ধাপে যেতে পারব না।

৪. রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব

এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা কোনো বায়বীয় বিষয় নিয়ে হবে না, এটা হবে সেই নির্বাচনী দর্শনের যে পুনঃসংজ্ঞায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছিলাম, সেটাকে কেন্দ্র করে। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা হতে হবে এই যে, নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেটাকে মোকাবেলা করার জন্যই। আমাদের নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। এর জন্য নতুনভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আগে আমরা ভাবতাম, পুঁজিবাদী দেশ হওয়ার অর্থই হচ্ছে আমরা পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সুফলগুলো লাভ করব। কিন্তু এখন দেখা গেছে, এখানে পদে পদে রাষ্ট্রের একটা সহায়ক ভূমিকা রয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে সে দায়িত্ব পালন করবে, তার জন্য দরকার তার তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসন। সে যাদের ওপর খবরদারি করবে, সে তাদের বন্ধু হতে পারবে না। রাষ্ট্রকে তাই একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা একটা প্রাথমিক ধাপ, যাতে করে তারা সহসাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে না পারেন। এ ছাড়া মেধাবী তরুণদের সরকারি কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থেই মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে। এবং এ আমলাতন্ত্র হতে হবে উন্নয়ন আমলাতন্ত্র। শুধু সরকারি দপ্তর বা রাষ্ট্রযন্ত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাসপাতাল- সর্বত্রই। সবখানেই আমরা দেখতে চাই সবচেয়ে যোগ্য মেধাবী নেতৃত্ব। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো উপায়েই এসব করতে হবে। আমরা যদি ছোট মাপের স্বপ্নও দেখে থাকি, বড় মাপের কিছু মানুষকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের সম্মানিত করতে হবে। সেটা না করলে আমাদের ছোট মাপের স্বপ্নও দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।

নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই দায়িত্ব আছে পরস্পরের কাছাকাছি আসার। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণির এই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে। এখানে কেবল পার্টির যারা বুদ্ধিজীবী তাদেরকেই নয়, ননপার্টিজান বুদ্ধিজীবীদেরও জায়গা করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেভাবেই হোক, এই দূরত্ব বেশি দিন থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। তাই আমাদের এমন একটা সামাজিক অঙ্গীকার দরকার, যেখানে সব পক্ষের প্রাজ্ঞজনের স্থান আছে। সবাই যাতে বুঝতে পারে, আমি যে রাজনৈতিক মতেরই হই না কেন, আমার একটা আলাদা আদরণীয় স্থান আছে রাষ্ট্রসভায়। এটাই ভারতবর্ষীয় রীতি :রাজন্যবর্গ সব সময়েই পণ্ডিতদের সম্মান করে এসেছেন।

৫. বহুবার বলা তবু অসমাপ্ত যে কাজগুলো

সর্বশেষ যে কথাগুলো বলতে চাই, সে কথাগুলো বহু মানুষ বহুবার বলেছেন; কিন্তু কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তা বাস্তবায়িত হতে হতে হয়নি। সেখান থেকে তিনটা কাজের কথা আমি বলতে চাই, যা অসমাপ্ত থেকে গেছে। অথচ এর ব্যাপারে করণীয়গুলো সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই একমত। সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের জন্য অবশ্যপালনীয় একটা কাজ। কারণ, জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের দেশ হচ্ছে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। অষ্টম দেশ রাশিয়া! আর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মোট জনসংখ্যার আকারটাই আসলে প্রধান বিবেচ্য। এমনকি আমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারও হই, তা সত্ত্বেও সীমিত আকারে হলেও এক-তৃতীয়াংশ বাজেট নিচের দিকের সরকারগুলোকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি। এখন সেটা পুরনো ১৯ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, নাকি ৬৪ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, সেই যৌক্তিক বিভাজনটাও করা উচিত।

দ্বিতীয়ত, এই বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে প্যারাডক্সটি হচ্ছে, যে সরকারকে আমরা স্থানীয় সরকারে নির্বাচন করছি, তাকে আমরা ক্ষমতায়ন করছি না। যেমন উপজেলা সরকার- নির্বাচন করেছি, ক্ষমতায়ন করিনি। অন্যদিকে যেটি নির্বাচিত এবং ক্ষমতায়িত, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ সরকার- তার ক্ষমতা অতিসংকুচিত। সে সামান্যই অর্জন করতে পারে, কারণ তার হাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু এটা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বইও লিখেছেন, অনেক সভা-সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব একটা এগোয়নি। ভারত তাদের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীতে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে যে, সেখানে তিন স্তরের সরকার হবে। আর সেই তিন স্তরের সবচেয়ে নিচের স্তর হলো গ্রাম পঞ্চায়েত। দু-একটা রাজ্য বাদ দিলে এখন সেখানে সর্বত্রই এই তিন স্তরের সরকার চলছে। এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নিয়মিতভাবেই অর্থনৈতিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। স্থানীয় স্বশাসনের এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজস্ব আহরণের পরিমাণও বেড়ে গেছে।

এর পরের যে চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে, আমাদের গুণগত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের ধনী-গরিবে বৈষম্য শুধু অর্থে নয়, সম্পদে নয়, শিক্ষার গুণেও। কেউ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়ছে, কেউ আবার একেবারে নিম্নমানের স্কুলে পড়ছে। কেউ আবার এ দুই ধারার বাইরে মাদ্রাসায় পড়ছে। কেউ আবার একটা পাঁচমিশালির মধ্যে আছে। দেশের আগামীর সন্তানদের এ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা থাকা উচিত নির্বাচনী ইশতেহারে। যে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে কেমন দেশ চাই? আমরা কি সার্ভিস সেক্টর নেশন হবো নাকি আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং নেশন হবো? এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার যে চিন্তা- তার একটা প্রতিফলন ইশতেহারে থাকবে না, তা তো হয় না। তা ছাড়া যেখানে প্রচলিত শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ, সেখানে অপ্রথাগত বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রভূত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে, চীনের অভিজ্ঞতাও হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। আর শুধু বর্তমানে আটকে না থেকে, ২০৩০ সালে আমাদের কী ধরনের দক্ষতা লাগবে, সেই দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা এখন থেকেই তো করতে হবে।

তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সবকিছুর মূলে থাকে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে যেমন একজন ব্যক্তিমানুষের জীবনে বিঘ্ন ঘটে, তেমনি জাতীয় জীবনেও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় সব সময়ই যে কোনো আলোচনায় অবকাঠামো, আইন, উন্নয়ন এসব নানা বিষয়ের আড়ালে পড়ে যায় স্বাস্থ্যসেবা। তাই স্বাস্থ্য খাত নিয়েও অবশ্যই ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকা চাই। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু সময়ের দাবি অনুযায়ী যেন সে অগ্রগতি খুবই নগণ্য। গরিব-মধ্যবিত্ত নাগরিকের সুচিকিৎসা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে পরিকল্পনার উপস্থিতি ইশতেহারে থাকা উচিত।

সবশেষে বলতে চাই, গত পাঁচ বছরের ম্যাক্রো পরিসংখ্যানেও আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়া সত্ত্বেও এবং দারিদ্র্য কমার পরও কিছু কিছু সূচকে একটা নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন ধরুন, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহকে আমরা যদি জিডিপির অনুপাতে প্রকাশ করি, তাহলে দেখা যাবে এটা কমে গেছে। যদি আমরা রফতানি প্রবৃদ্ধি হার দেখি, সেটাও কমে গেছে। এই অবনতিশীল প্রবণতাকে ফেরাতে হবে। একই সঙ্গে বরাবরই আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছিলাম, বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ২০১০-এর দশকে খুব একটা বাড়েনি। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা মেটানো গেলেও তার আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ দিকগুলোর প্রতি নতুন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রসঙ্গ থাকলে বলা যাবে যে ইশতেহার আমাদের জন্য। তবে সবকিছুই কালের এবং শ্রেণিস্বার্থের অধীন।

Original in সমকাল

The middle class is growing

Abdul Bayes, Mahabub Hossain and ANM Mahfuzur Rahman

Binayak Sen, an eminent economist and a Research Director of the Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS), recently completed a research work on ‘Middle Class’ (henceforth MC) in Bangladesh, especially relating to growth trends, drivers and policy implications. He deserves special thanks for invoking an interest in a topic hitherto untouched by Bangladeshi economists. At the moment, Middle Income Country (MIC) is the coin in circulation, not Middle Class population. We all know that Binayak has been a very powerful, if not the pioneer, researcher in poverty-related research in Bangladesh. His motivation in taking up MC reportedly springs from the emerging shift of focus on the ‘Middle Segment of Income Distribution’. According to his views, there are two main arguments for which MC should occupy the front seat in the days to come. The first one relates mostly to growth and employment. MC is considered to be good for inclusive growth – the larger the size or density of MC, the better it is for economic growth. The growth of MC (a) injects more stability into growth process due to less volatility associated with regular (salaried) jobs, (b) helps to accelerate the aggregate growth rate by releasing the domestic demand constraints to growth, and by fostering higher labour productivity, managerial skills and entrepreneurship; and (c) enables reduction of poverty faster than in countries with lower class density. On the other hand, the second arguments mostly apply to governance and risks.

MC has beneficial institutional externalities such as (a) larger size associated with higher institutional quality via demand-driven economic governance channel, (b) improved quality of democracy through better and concerted articulation of democratic aspirations in areas of ‘core governance’. Again, ignoring the role of MC invites significant downside risks. Widespread discontent of middle class – especially among youth -with respect to deteriorating income distribution or mobility could cause political instability and social strife.

To start with, Sen attempted to draw a MC line that embraces economic definition of MC (income-based). Although no unique definition of MC- even of income-based – exists around the world, he adapted various versions in national context to use for estimating the size and growth of the MC. The data for the analysis came from Household Income and Expenditure (HIES) over 1991-2010 when identified four groups (expressed as per person per day in PPP dollar using 2005 PPP) as follows: (a) Poor (below $1.25, (b) Vulnerable non-poor ($1.25-2.00); (c) Middle Class ($2.00-3.00), (d) Upper middle class ($3.00-4.00) and (e) Rich ( $4.00).

The researcher observed a few interesting trends. There has been a significant rise in the share of national MC over the period between 1992 and 2000. Only 9 per cent of the national population belonged to this cohort; the matched figure went up to 20 per cent in 2010. The comparable figures for other regions are as follows: India 24 per cent; China 62 per cent, South Asia (including India) 17 per cent, Sub-Sahara Africa 26 per cent, and East Asia (including China) 59 per cent.

From a static view, Bangladesh falls behind others in terms of the proportion of MC people but ‘doubling the size of middle class is a dramatic success by any measure. If the present trend continues, middle class will comprise 25 per cent of national population in 2025 and 33 per cent in 2030’. Second, as the size of national MC grew bigger, the poverty reduction rate became faster. The author provides no explanation of how it happened although we expect it in detailed discussions. Third, there is a considerable bulge around $1.25 and $2.00 line. This indicates that the potential vulnerability to downward mobility (descent) pressures reign high. Fourth, these estimates need to be re-visited for robustness check in the light of US$ 1.90 line in 2011 PPP adopted by the World Bank for global poverty analysis very recently. “However, there is little doubt that expanding middle class has been good for stability of growth and accelerated poverty reduction in the 2000s…” Again, the process awaits explanations.

Policy implications? The graduation to MC from poor is adducible to post-secondary education (especially English education), salaried jobs in the service sector, ‘digital divide’, access to financial saving institution etc. The growth of MC has been driven by property price appreciation and unequal spread of human capital (post-secondary education). Universalising social protection and health care will help overcome bulging around poverty and middle class lines. Balancing between ‘pro-poor growth’ and ‘pro-middle class growth policies’ is the most pressing policy challenges in defining inclusiveness etc.

In an apparently ‘ambitious’ attempt, we have adapted Binayak Sen’s methodology to determine the growth and size of middle class in rural Bangladesh. The basis of our data is MH Data Base (Mahabub Hossain Data Base) comprising the repeat sample survey of households of 62 villages in 1988, 2000 and 2014. A la Binayak Sen, we wanted to have a glimpse into the growth of rural MC over time. We observe that roughly 7 per cent of rural population was in MC category in 1988. This compares with about 14 per cent in 2000 and 21 per cent in 2014. The rich segment, on the other hand, shot up from 3 per cent to about 18 and 37 per cent respectively during same periods of time. Our findings thus seem to corroborate Sen’s observations about MC growth in Bangladesh.

The growth in rural areas has mostly been greased by remittances – accounting for one-fourths of household income from 6.0 per cent and business – claiming one-fifths from one-tenths of household income. The growth of commercial agriculture in tandem with expansion of non-farm activities – as supported by expanded road communication – could have contributed to the growth of middle class in rural areas. The mundane message is that in the days to come, research on ascent and descent centring MC line would replace that of poverty line.

Abdul Bayes is Professor of Economics at Jahangirnagar University, (late) Mahabub Hossain was Distinguished Professor, BRAC University and Mahfuzur Rahman is Coordinator, Data Management Unit, RED/BRAC.

Source: Financial Express

বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ (Bangladesh’s expanding middle-class)

middle_class_info

Prothom-Alo: সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যবিত্ত
বাংলাদেশে দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হচ্ছে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশাল অংশ চাকরি করে। তারা এখন ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা জমির মালিক। তারা ইন্টারনেটও ব্যবহার করে। টাকাপয়সা রাখে ব্যাংক হিসাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন মধ্যবিত্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মধ্যবিত্ত হবে। এ তথ্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)। গবেষণাটি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। গতকাল বৃহস্পতিবার গবেষণার এ ফল প্রকাশ করা হয়। যাঁরা দৈনিক দুই থেকে তিন ডলার (পিপিপি হিসাবে) আয় করেন, তাঁদের মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ হিসাবটি স্বীকৃত। বিআইডিএস এ গবেষণাটি করেছে ঢাকা শহরের ১২টি এলাকায়। গবেষণার নমুনার সংখ্যা ৮০৯। গবেষণাটি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্তের সেই হিসাবটি ২০১০ সাল ধরে করা হয়েছে। অতীতের একই প্রবণতা ধরে নেওয়া হলে ২০১৫ সালে এসে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী মোট জনগোষ্ঠীর সাড়ে ২২ শতাংশ হবে। বিস্তারিত ->

সমকাল (Samakal): ২০৩০ সালে মধ্যবিত্ত হবে ৩৩ শতাংশ
দেশে মধ্যবিত্তের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত দুই দশকে মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৩ সালে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএসের এক বছরের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে ‘বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের আকার ও প্রবৃদ্ধি’ বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন। বিস্তারিত ->

Financial Express: BIDS study reveals growing middle class BD’s dramatic success
There has been a significant rise in the share of middle class group in the country over the last one decade (1992-2000). If the trend continues, the middle income class will comprise about 25 per cent of the country’s total population in 2025 and 33 per cent in 2030. Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) Researcher Director Dr Binayak Sen revealed the information while presenting a keynote paper on “Size and Growth of Middle Class in Bangladesh” at BIDS Research ALMANAC, 2014-2015. Read more ->

Daily Star: Bangladesh’s middle-class expanding
One-fourth, or 25 percent, of the total population will belong to the middle-class income category by 2025, thanks to greater access to education, finance and IT services, and private sector employment, a recent study found. At present, 20 percent of the population belongs to the middle-income category in Bangladesh in contrast to 24.1 percent in neighbouring India. Read more ->

Dhaka Tribune: BIDS: Middle-class people to reach 33% by 2030
The middle-class group is expected to stand at 33% of the country’s total population by 2030, says Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS). Over the last two decades, the country witnessed a remarkable rise in middle class group, it said, adding that if the trend continues, the country is expected to add 25% of its total population by 2025. It said only 9% of the population belonged to this category decades back and in 2010, this group accounted for 20%. BIDS Research Director Binayak Sen revealed the information in his keynote paper on “Size and Growth of Middle Class in Bangladesh” at the BIDS dissemination event on presentations from the BIDS Research Almanac 2014-2015, at BIDS yesterday. Read more ->

One-third population to be middle-class by ’33
The size of middle class population in the country may soar to one-third of the total population by the year 2033, which is now 20 percent, says a latest BIDS study. The study entitled: ‘Size and Growth of Middle Class in Bangladesh: Trends, Drivers and Policy Implications,’ published on Thursday, considered those in the segment whose per day income is 2 to 3 US dollars. Research Director at the Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) Dr Binayak Sen, who conducted the study, said the middle-class size now more than doubled to 20 percent from 1990 level of 9 percent and it could soar to 25 percent by 2025 and to 33 percent by 2033, according to their assessment. Read more ->

প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হওয়া অবাস্তব নয়

Dr. Binayak Sen photoপ্রস্তাবিত বাজেট, দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক খাত, দুর্নীতি, সুশাসন, রাজস্ব সংগ্রহসহ ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সমতামুখী প্রবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন তিনি। বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের এই সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল ও বইপত্রে ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

প্রথম আলো : প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো?
বিনায়ক সেন : বাজেট নিয়ে আশির দশকে, এমনকি ষাটের দশকেও সমালোচনা থাকত। এখন তা ছিদ্রান্বেষী নিন্দা ও লাগামছাড়া স্তাবকতা—এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, যেখানে যতটুকু ভালো হয়েছে, তা বলা উচিত। আর মন্দ হলে মন্দ বলতে হবে। একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, শক্তিশালী দিককেও দুর্বলতম বলা হচ্ছে। এই প্রবণতা আমার কাছে পরিহার্য। যেমন ধরুন, আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরাটা খুবই বাস্তবোচিত হয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাভাবিক বছর পেলে ৭ শতাংশ অর্জন করা অবাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, ঘাটতি বাজেট ১৫ বছর ধরেই ৪-৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে। তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতিও ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে আশা করা যায় দেশে ভালো ফলন ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার কারণে।
প্রথম আলো : তিনটি কারণকে বিবেচনায় নিয়েই আপনার এত বড় আশাবাদ? সার্বিকভাবে দেশের মৌলিক বাজেট–শৃঙ্খলা কি ঠিক আছে?
বিনায়ক সেন : আমি বলব সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট–শৃঙ্খলা একরকম ঠিকই আছে। এখন যদি দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারল না, তখন ব্যয়ের কাঠামো কাটছাঁট করতে হবে। আর এই কাটছাঁটের পরও যদি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে, প্রবৃদ্ধির হার যদি ৭ শতাংশ অর্জন করা যায়, মূল্যস্ফীতি যদি ৬ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকে, তাহলে আমি এটাকে সময়োচিত ও বাস্তবোচিত বাজেটই বলব। এটা বলার পরই আমি মূল কথাটি বলতে চাইছি।
প্রথম আলো : সেটা কী?
বিনায়ক সেন : মূল কথাটা হচ্ছে আমরা এখনো আলোচনাটা সাধারণ মানের প্রবৃদ্ধির মধ্যেই আটকে রাখছি। সমতামুখী প্রবৃদ্ধি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলছি না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির তিনটি মাত্রা রয়েছে। একটা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা। প্রবৃদ্ধিকে ওঠা–নামা থেকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধিকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, অর্থাৎ এতে সমাজের সবার ও দেশের সব অঞ্চলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে আয়বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ যত দিন যাচ্ছে, তত আমরা অধিক বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হতে পারছি কি না। ২০১০ সালের আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, আয়বৈষম্যের সূচক বেশ উঁচু পর্যায়ে চলে গেছে।
প্রথম আলো : সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা কতটুকু কী করতে পারছি?
বিনায়ক সেন : প্রথমটি মোটামুটি অর্জিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা অর্জনে ধারাবাহিকতা রয়েছে আমাদের। অনেকেই একে ৬ শতাংশের ফাঁদ বলছেন, কিন্তু আমি ‘ফাঁদ’ বলতে রাজি নই। একনাগাড়ে প্রায় এক দশক ধরে ৬ শতাংশ হার অর্জনের দেশ খুব বেশি নেই। এক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সংকটও তৈরি হয়েছে। সবকিছুর পরও স্থায়িত্বশীলতার নিক্তিতে আমাদের অর্জন বেশ ভালোই বলা যায়।
প্রথম আলো : বাকি দুটির অবস্থা তাহলে ভালো নয়?
বিনায়ক সেন : না, সেটা না। যেমন অংশগ্রহণমূলক দিক থেকে আমি বলব আংশিক সাফল্য এসেছে। দুই দশক আগেও শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ১৫ শতাংশ। এখন ৩৩-৩৪ শতাংশ। এটা ৬০ শতাংশে উন্নীত করা গেলে প্রবৃদ্ধি যেমন ত্বরান্বিত হবে, আয়ও বাড়বে। আবার যুবশক্তির মধ্যে পোশাক ও কৃষি খাতের অদক্ষ-আধা দক্ষ শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান যথেষ্ট। কিন্তু স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ থেকে সাফল্য পাইনি। কারণ, আমাদের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সব কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে চালিত। এবারের বাজেট বক্তব্যে অবশ্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে বণ্টনবৈষম্য দূর করার ইঙ্গিত রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অর্থায়নে একটা আলাদা কৌশলপত্র হওয়ার কথা। সেটা যদি সত্যি হয়, এবার থেকেই যেন বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের জন্য রাখা হয়। ভারতের কেরালায় যা আছে এক-তৃতীয়াংশ।
প্রথম আলো : সে হিসাবে বাজেটের মোট আকার থেকে স্থানীয় সরকারের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিচ্ছেন?
বিনায়ক সেন : হ্যাঁ। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য থাকতে পারে। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা থাকতে পারে নগরাঞ্চলের জন্য। এতে লাভ যেটা হবে, প্রতিবছর বাজেট বাস্তবায়ন করতে না পারার যে সমালোচনা আছে, সেটা দূর হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে না, ততটুকু বরাদ্দ দিলেও একটা কাজ হবে। আর তাতে দরিদ্র অঞ্চল, বিশেষ করে হাওর, লবণাক্তপ্রবণ, বন ও পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষও সমানভাবে উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে।
প্রথম আলো : বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কিছু বললেন না?
বিনায়ক সেন : বাজেট বক্তব্যে এটি প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে সম্পদবৈষম্য। সম্পদবৈষম্যকে যদি আঘাত করতে হয়, তাহলে সম্পদের ওপর আয়কর সারচার্জ সংগ্রহের বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করতে হবে। বড় দুর্বলতা হলো সম্পদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না। ভিত্তি ধরা হচ্ছে সম্পদ ক্রয়মূল্যকে, ন্যায্য বাজারমূল্যকে নয়। ফলে মাত্র ১০ হাজার লোক এই আয়কর সারচার্জ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদের মালিক মাত্র ১০ হাজার লোক—এটা অবিশ্বাস্য।
প্রথম আলো : সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন থেকে সরকার কীভাবে লাভবান হতে পারে?
বিনায়ক সেন : এতে রাজস্ব আয় বাড়বে, যা বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি কয়েক বছরে দেশে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। বিশেষ করে নগরাঞ্চলে। তাঁদের কাছ থেকে আয়কর সারচার্জ এবং/অথবা প্রত্যক্ষ সম্পদ-করের মাধ্যমে (যা এখনো বাজেটে নেই) অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করা সম্ভব। তবে দুই বছর ধরেই একটি ভালো দিক লক্ষ করছি। এখন প্রত্যক্ষ বা আয়করকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগ সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনেরই উদ্যোগ। পোশাকশিল্পসহ প্রতিষ্ঠিত রপ্তানি খাতগুলো থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর ১ শতাংশ হারে কর বসানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা প্রবৃদ্ধিকে সমতামুখী করবে। আর শিশু-শিল্প হলে কর-রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যারা ভালো প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তাদের থেকে কিছুটা আয়কর আদায় করা জরুরি।
প্রথম আলো : কিন্তু মানুষের প্রথম চাওয়া হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও যানজট নিরসন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
বিনায়ক সেন : প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে—আমাদের এখন সে ধরনের অবকাঠামো দরকার। আবার প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাও বড় কথা। মানুষ নগরমুখী হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ হয়ে যাবে। তাদের সমস্যার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আগে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ছিল কৃষি অর্থনীতি ও রপ্তানি, এখন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে হবে নগর অর্থনীতি ও রপ্তানি। ফলে নগরে ও নগরবাসীর জন্য এখন বেশি হারে বিনিয়োগ করতে হবে। যানজট নগরবাসীর কর্মজীবনের বড় একটা সময় খেয়ে ফেলছে। বাজেটে যানজট নিরসনে বা নগর অর্থনীতি উন্নয়নে তেমন কোনো কৌশলগত নির্দেশনা নেই। ঢাকার বাইরে শহরগুলোর অবকাঠামোগত পরিবেশ আরও খারাপ, অথচ শহরেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি করে জড়ো হচ্ছে। আর অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতির একটা উদ্যোগ সরকার নিলেও এর কোনো ফল দেখা যায়নি। পিপিপিতে ৪৩টি প্রকল্প নিয়ে অর্থমন্ত্রী আর জানালেন না কোনটির কী হাল? বিদ্যুৎ যেমন জাতীয় তাগিদ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, অবকাঠামো খাতেরও একই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
প্রথম আলো : তাহলেই কি সমতামুখী প্রবৃদ্ধি আসবে?
বিনায়ক সেন : না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির জন্য আরও দরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভালো বরাদ্দ। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রয়োজনের ধারে-কাছেই তিনি যেতে পারেননি। স্বাস্থ্য খাতেরও একই অবস্থা। এ দুই খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতায় বিস্মিত না হয়ে পারি না। পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা মাসে ৩০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে রাজি থাকলেও তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা পলিসি চালু করা যায়নি।
শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিও রয়েছে। যেমন মাদ্রাসাশিক্ষা থেকে সবচেয়ে কম ফল (রিটার্ন) পাওয়া যায়। অথচ মাদ্রাসাশিক্ষা-ব্যবস্থায় যদি কারিগরি শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যায়, ভালো ফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় আমাদের বুয়েট ভালো, ঢাকা মেডিকেল কলেজও (ডিএমসি) ভালো। দরকার ছিল বুয়েটের মতো আরও পাঁচটা ‘বুয়েট’ করা, ডিএমসির মতো পাঁচটা ‘ডিএমসি’ করা। ভারতে যেমন করে প্রথম সারির বেশ কিছু আইআইএম, আইআইটি ও মেডিকেল কলেজ আছে। সেদিকে আমরা গুরুত্বই দিচ্ছি না। মোটের ওপর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আগামী ১০ বছরে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রিকার্ডো হাউসম্যান সম্প্রতি হিসাব করে বলেছেন, শ্রমশক্তির মান গড়ে তিন বছর স্কুলশিক্ষা থেকে আট বছর স্কুলশিক্ষার মানে উত্তীর্ণ করতে পারলে জিডিপির আকার শুধু এ কারণেই দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
প্রথম আলো : আমাদের আর্থিক খাত কি ঠিকভাবে চলছে? দুর্নীতি কী করে কমবে, সুশাসনের কী হলো?
বিনায়ক সেন : খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কর-রেয়াত এবং ব্যাংকঋণ—এ দুই বিকল্পের ক্ষেত্রে একজন শিল্পপতি যদি দেখেন ব্যাংকঋণ ফেরত দিতে হচ্ছে না, তখন কর-প্রণোদনা কাজ করবে না। কর-প্রণোদনার নীতি আর্থিক-প্রণোদনার নীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আর্থিক খাতে এখনো শৃঙ্খলার অভাব। উচ্চ খেলাপি ঋণের হার থেকে আমরা বের হতে পারছি না। উচিত হবে সোনালী ব্যাংককে হাতে রেখে বাকিগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া। কেননা, সরকারি খাতেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ বেশি। অন্যদিকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, বেসরকারীকরণের পর তা যেন গুটি কয়েক মুখচেনা শিল্প-ব্যাংক পরিবারের কাছে চলে না যায়।
দুর্নীতি হ্রাস বা সুশাসন চালু সরকার চাইলে অনেকখানিই পারবে। বলছি না যে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খাতভিত্তিক সুশাসন তো আমরা চাইতেই পারি; অন্তত কয়েকটি খাতে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে যারা টাকা কামাচ্ছে, তাদেরও ধরা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর যৌথভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে নজরদারি করলে অবৈধ উপায়ে টাকা কামানো, কর ফাঁকি দেওয়া ও খেলাপি হওয়া—এসব রোধ করা অনেকখানিই সম্ভব।
প্রথম আলো : করদাতার সংখ্যা সরকার তেমন বাড়াতে পারছে না। কোনো পরামর্শ?
বিনায়ক সেন : ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। আরও চার কোটি মানুষ আছে দারিদ্র্যঝুঁকিতে। বাকি থাকল আট কোটি মানুষ, তথা ১ কোটি ৬০ লাখ পরিবার (পরিবারপ্রতি পাঁচজন হিসাবে)। পরিবারে যদি একজন আয় করেন, তাহলেও আয়করের আওতায় আসতে পারেন ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যক্তি। এর মধ্যে শহরবাসী ৫০ লাখ। অথচ বর্তমানে আয়কর দেন কেবল ১০ লাখ লোক। শুধু নগরমুখী করেও প্রায় পাঁচ গুণ আয়করদাতা বাড়ানো সম্ভব। তাই বলব যে উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস সম্প্রসারিত না করে শহর পর্যায়ে এর কার্যক্রম আরও জোরদার করা হোক।
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কীভাবে দেখছেন?
বিনায়ক সেন : নদী আমাদের প্রাণ, ট্রানজিট তাঁদের প্রাণ। কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকে আমরা তাঁদের পানির বিনিময়ে ট্রানজিট দিতে পারি।
প্রথম আলো : আপনাকে বাজেট প্রণয়নের দায়িত্ব দিলে কোন খাতে অগ্রাধিকার দিতেন?
বিনায়ক সেন : অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে। অবকাঠামো উন্নয়নের গুরুত্বের কথা যদি বলি, দেখুন, এক যমুনা সেতুর কারণে আশির দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ থেকে আমরা ২০০০ সালের পর ৫-এর ওপরে উঠেছি। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হলে নিশ্চয়ই ৭-এর ওপরে ওঠা সহজ হবে। আর নীল (সমুদ্র) অর্থনীতি চাঙা করতে পারলে তো কথাই নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।

তিমিরবিনাশী সমাজের দিকে? (Towards an Enlightened Society?)

বিনায়ক সেন

১. প্রথাগত মতাদর্শের বিপর্যয়
আমরা অর্থনীতিবিদ্যার একটি সংকটের মধ্যে আছি। কোনো আপ্তবাক্যেই আমরা আর আস্থাবান থাকতে পারছি না। একসময়ের বহুশ্রুত ‘মিশ্র-অর্থনীতি’ এখন আর প্রায় ব্যবহারই হয় না বলতে গেলে। আমাদের যৌবনে মিশ্র-অর্থনীতিই ছিল সব তত্ত্বের সারাৎসার। ব্যক্তি খাত থাকবে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ছাড়া অর্থনীতির চাকা দ্রুত এগোবে না_ এ রকম একটি স্লোগান আমাদের খুবই প্রভাবিত করেছিল। কেইনসীয় অর্থনীতির উত্থান, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর ধারণা, উপনিবেশ থেকে সবে বেরোনো দেশগুলোর রাষ্ট্রের উপায়ান্তরহীন ভূমিকা এর পেছনে কাজ করে থাকবে। এরই ভাবাদর্শগত ছায়ায় কেটেছে বাংলাদেশের সত্তরের দশক।

আশির দশকের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় তেল-সংকটের পর থেকে শুরু করে প্রায় দুই দশক একচ্ছত্র রাজত্ব করেছে অন্য একটি ধারণা। অবাধ বাজার অর্থনীতির তত্ত্ব অর্থনীতির যুক্তি-তর্কে যতটা তারও বেশি সহায়-সমর্থন পেয়েছিল রেগান-থ্যাচারের রাজনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়ে। তেল-সংকটের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লাতিন আমেরিকায় দেখা দেয় ঋণ পরিশোধের সংকট। এখানেই প্রথম শুরু হয় ‘কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি’_ আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের তখন মন্ত্র ছিল ‘স্টেবিলাইজেশন, লিবারেলাইজেশন এবং গ্রোথ’। অবাধ বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করলে শুধু সংকটের অবসান ঘটবে তা-ই নয়, অর্থনীতির প্রধান প্রধান সমস্যারও অবসান ঘটবে। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় প্রথাগত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে গেছে। মিশ্র-অর্থনীতি ও পরিকল্পনাময় অর্থনীতির বিপরীতে বাজার অর্থনীতির মতাদর্শকে সেদিন মনে হচ্ছিল অপ্রতিরোধ্য ও সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত আদর্শ বলে। দার্শনিক কান্ট_ হেগেলের ছাত্র ফুকোয়ামা যখন লিখলেন, বার্লিন দেয়ালের পতনের মধ্য দিয়ে শ্রেণী-যুদ্ধের তথা ইতিহাসের অবসান ঘটেছে তখন তা সময়ের স্বাভাবিক দাবি হিসেবেই অনেকে গ্রহণ করেছেন।

বার্লিনের দেয়াল ভাঙার পর আরও প্রায় ২৫ বছর কেটে গেছে। এ সময়ের অভিজ্ঞতা অবাধ বাজার অর্থনীতির ও তার আদর্শের সমাজ-রাষ্ট্রের পক্ষে যায়নি। প্রথমত, অর্থনীতিবিদ পিকেটি দেখিয়েছেন যে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ধারণা পরিত্যাগ করার ফলে উন্নত বিশ্বের সমাজ হয়েছে আরও বেশি বৈষম্যমূলক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের তিন দশকে (গোল্ডেন এইজ অব ক্যাপিটালিজম) জাতীয় আয়ে পুঁজির তুলনায় শ্রমের অনুপাত যা-ওবা বাড়ছিল, সে ধারা কমতে থাকে সত্তরের দশকের শেষদিকে এবং পরবর্তী দু’দশকে তা একেবারেই শুকিয়ে আসে। ফলে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই বেড়েছে সম্পদ, আয় ও ক্ষমতার বৈষম্য। অবাধ বাজার অর্থনীতি শ্রীবৃদ্ধি এনেছে বটে; কিন্তু তার সুফল পেয়েছে মূলত একটা শ্রেণী : বড় কারবারের মালিক, সিইও, ব্যাংকার, শিল্পপতি, পুঁজিবাজারের ফটকাবাজ, রাজনৈতিক প্রকল্পের সুবিধাভোগী লবিস্ট বা দালালগোষ্ঠী। এরা সমাজের ১ শতাংশ অথচ এদের কাছে এসব দেশের ৬০ শতাংশ সম্পদ চলে গেছে। গত ২৫ বছরের অবাধ বাজার অর্থনীতির ফলে জন্ম নিয়েছে ‘সুপার-রিচ’ নামক একটি শ্রেণীর। এদেরই ওপর প্রগ্রেসিভ হারে কর বসানোর প্রস্তাব করেছেন তিনি; আয়ের ওপরে কর তো বটেই, সম্পদের ওপরও দৃষ্টি তার। পিকেটির মতই যে শিরোধার্য তা নয়, তবে তার বইটির প্রশংসা করে সমালোচনা লিখেছেন তিনজন নোবেলজয়ী, এটাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো তথ্য নয় (এর মধ্যে আছেন_ রবার্ট সলো, পল ত্রুক্রগম্যান ও জোসেফ স্টিগলিৎস)। অবাধ বাজার অর্থনীতি যে আপনাআপনি বণ্টনের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না সেটা পিকেটি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বড় আকারে প্রমাণ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে না আনা গেলে সামাজিক দুর্বিপাক বাড়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় নতুন করে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলো দেখা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে_ ফার্গুসনসহ বিভিন্ন শহরে বর্ণ-বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভের একটি উদাহরণ_ এদের পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কার্যকারণ। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, আয়-বৈষম্য, ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকট ও চলমান মন্দা, সামাজিক খাত বিশেষত স্বাস্থ্য খাতের অচলাবস্থা নির্ধন ও স্বল্পবিত্ত মানুষের মন থেকে ‘একটি বাড়ি, অনেক সুযোগ’-এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া আমেরিকান ড্রিম ভেঙে দিয়েছে। এখন ভরসা তৃতীয় বিশ্বের অভিবাসী সস্তা শ্রম ও মেধার জোগানের ওপর। কিন্তু মন্দা পরিস্থিতিতে এ নিয়েও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে অভিবাসী ও স্থানীয় শ্রমের ভেতরই।

তৃতীয়ত, অবাধ বাজার অর্থনীতির তত্ত্ব রাজত্ব করেছে শুধু অর্থনৈতিক যুক্তি-তর্কের ওপর নির্ভর করে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। অবাধ বাজার অর্থনীতি বা নিও-লিবারেলিজম হচ্ছে ‘একটা প্যাকেজ’। সেখানে একটা নিলে আরও কিছু উপাদান ফাও হিসেবে গছিয়ে দেওয়া হয়। এ রকমই একটি ‘ফাও’ হচ্ছে নিউ কনজারভেটিজম, মূলত খ্রিস্টীয় ধর্মাদর্শের ওপরে এর ভিত্তি দাঁড় করানো হয়েছে, যার ব্যাখ্যাও অতি-সংকীর্ণ ধর্মবোধের দ্বারা নির্মিত। লিও স্ট্রাউসের মতবাদকে নিউ কনজারভেটিজমের অনুপ্রেরণা বলে ধরা হলেও এর অনুসারীরা গুরুমারা শিষ্যে পরিণত হয়েছেন। সামাজিক নীতিতে শিষ্যরা ‘ফ্যামিলি ভ্যালুস’-এর গুণকীর্তন করেন, ধর্মীয় নীতিতে তারা ‘ইসলামিস্ট’ শক্তিকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন এবং রাজনীতিতে তারা শুধু সেসব সরকারকেই মানতে প্রস্তুত যারা হবেন তাদের একনিষ্ঠ স্বার্থবাহী। সাদ্দামকে সরানোর জন্য ইরাক যুদ্ধ শুরু করার কিছুদিন পরই লিও স্ট্রাউসের কন্যা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ খোলা কলম লিখে প্রতিবাদ করলেন। তার বক্তব্য_ পল উলফোভিচ, রিচার্ড পারলে, কন্ডোলিজা রাইস এসব ‘নিউ-কন’ তাত্তি্বকরা যা বলছেন তার সঙ্গে লিও স্ট্রাউসের দর্শনের কোনো মিল নেই। বুশের ইরাক আক্রমণের তীব্র সমালোচকে পরিণত হন তিনি (যেমন_ মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মওদুদীর ছেলে এ দেশে এসে)।

চতুর্থত, অবাধ বাজার অর্থনীতির মতাদর্শ সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সে সূত্রে কান্টের ‘চিরস্থায়ী শান্তির’ মতো নিখিল প্রশান্তি বিশ্বে নেমে আসবে, যুদ্ধ বিগ্রহহীন বিশ্বের তত্ত্বও প্রচার করেছিল। দেখা গেল যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ হয়নি, বরং তা ক্রমাগত নতুন নতুন মাত্রা পেয়ে চলেছে স্থানীয় ও আঞ্চলিক নানা পর্যায়ে। সোভিয়েতের অবসান হলেও যুদ্ধের অবসান হয়নি, সমরবাদ আজও বাড়-বাড়ন্ত। ২০১৪ সালে নিঃশব্দে পালিত হলো ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরুর শতবার্ষিকী। ১০০ বছর আগে লেনিন লিখেছিলেন_ ‘যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্য চলতে পারে না।’ ওবামার যুগে এসেও দেখতে পাচ্ছি এ কথা খাটছে। লেনিনের অনেক কথা হয়তো মিলেছে অথবা মেলেনি; কিন্তু অন্তত এ পর্যবেক্ষণটি আজও এতসব এক বিশ্ব তত্ত্ব, পোস্ট মডার্নিজম, পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিজমের পরও সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে।

আর ‘গণতন্ত্র’? অবাধ বাজার অর্থনীতির সঙ্গে বলা হয়েছিল গণতন্ত্র সর্বত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। আমি সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কে যাচ্ছি না। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা থাকবেন বা না থাকবেন এটি ঠিক করা গণতন্ত্রের একটি আবশ্যকীয় দিক। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক সংজ্ঞার বাইরে যাওয়ারও দরকার আছে। অমর্ত্য সেন এক বক্তৃতায় বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসনকার্য চালানো’ (গভর্নিং বাই ডিসকাশন)। এটিও গণতন্ত্রের একটি মর্মগত উপলব্ধি। অন্যদিকে সমাজের ‘সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়নের’ কথাও আমরা শুনেছি_ এটি বোধকরি ম্যাক্সিম্যালিস্ট অভিধা। এই ৩টি সংজ্ঞার যেটিকেই আশ্রয় করা হোক না কেন, বার্লিন দেয়াল পতনের পরের ২৫ বছরে গণতন্ত্রের অবস্থা বিশ্বজুড়েই ভালো নয়। অনেক দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে আবার পিছু হটতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও দেখা দিচ্ছে মিশ্র বা ‘সংকর গণতন্ত্রের’ নানা অসম্পূর্ণ রূপ। ২০০০-এর দশক থেকে অনেকটা ইরাক যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত এসবের সমান্তরালে_ গণতন্ত্রের প্রবণতায় অসুস্থতা বা পিছু হটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। লিটারেচারে একে বলা হচ্ছে, পশ্চাৎপসরণ বা ডেমোক্রেটিক ব্যাকট্রেকিং। শুধু তাই নয়, পার্থ চ্যাটার্জি লিখেছেন, পুঁজিবাদ নিজেই হয়ে পড়েছে তার বিঘোষিত গণতন্ত্রের বিরোধী সত্তা। ক্যাপিটালিজম এগেইনস্ট ডেমোক্রেসি।

নিরঙ্কুশ পরিকল্পনার অর্থনীতি নিয়ে মোহভঙ্গের যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত কারণ রয়েছে। মিশ্র অর্থনীতির প্রতিও আস্থা নেই। বাকি ছিল_ অবাধ বাজার অর্থনীতি। ২৫ বছর আগে তার যে অপ্রতিরোধ্য ভাবমূর্তি ছিল সেটি এখন অনেকটাই ঝাঁপসা হয়ে এসেছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি সমালোচনার মুখে পড়ছে ওপরে বর্ণিত ৫টি কারণে। সাধারণভাবে এখন আর বলা যাবে না যে, একটি আদর্শ অর্থনীতির মডেল আমাদের চোখের সামনে রয়েছে_ আমাদের কাজ হচ্ছে তাকে কেবল যথাসাধ্য অনুসরণ করা। আমাদের ঝুঁলিতে নিরঙ্কুশ পরিকল্পনার অর্থনীতি, মিশ্র অর্থনীতি ও অবাধ বাজার অর্থনীতির বিশ্ব-অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সেসব খণ্ডচিত্র মাত্র। এই অর্থে আমি বলেছি শুরুতে, আমরা অর্থনীতিবিদ্যার একটি সংকটের মধ্যে আছি। জীবনানন্দ ‘তিমিরবিনাশী’ সমাজের প্রতীক্ষায় ছিলেন। আমাদের সে লক্ষ্যে তত্ত্বগত চর্চাকে নিরুৎসাহ করা নয়, বরং আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সে চর্চাকে আরও বেশি মেধা, মনন ও নিষ্ঠায় ধারালো করে তুলতে হবে।

২. ব্যাস্টিক ও সমষ্টির মেলবন্ধন
চোখের সামনে কোনো আরাধ্য অর্থনৈতিক মতাদর্শ আর নেই, এক অর্থে এটা ভালোই। রাস্তাটা এখন ডেড-এন্ডে পেঁৗছেছে অভিযানের সমাপ্তি, এখনই প্রকৃত যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হতে পারে। কোনোটা জাতীয়তাবাদসম্মত, কোনোটা পুঁজিবাদী ধারার, কোনোটা সমাজতন্ত্রের পক্ষে_ এসব বিবেচনা আর বড় নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বিশ্বজোড়া গরিবরা ওপরে উঠছে, মধ্যবিত্তের আকার বড় হচ্ছে, নারীদের কণ্ঠস্বর ও অবস্থান জোরালো হচ্ছে, অভিবাসীরা মেধা ও প্রবৃদ্ধির জোগান দিচ্ছেন। আর রয়েছে সারাবিশ্বেরই এক-তৃতীয়াংশের বেশি তরুণ-যুবাগোষ্ঠী_ এরা সবকিছুই গ্রহণ করতে প্রস্তুত; কিন্তু কোনো কিছুকে পরীক্ষা না করে যাচাই-বাছাই না করে নির্বিচারে মেনে নেওয়ার পাত্র নয়। গর্বাচেভ সমাজতন্ত্রকে নবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সে কথা রাখেননি, বরং গোটা ব্যবস্থাকেই অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। ওবামা পুঁজিবাদকে সহনীয় ও মানবিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সে কথা রাখতে পারেননি, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আমলেই জড়িয়ে পড়েছে নতুন নতুন ড্রোন যুদ্ধ, আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং নতুন স্নায়ুযুদ্ধে। এরা নিজেদের দেশে প্রথম দিকে ‘চেইঞ্জ-এজেন্ট’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সাধারণ মানুষ তাতে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু শেষাবধি তারা হতাশই হয়েছে। আমি ক্লিনটন-ডেমোক্র্যাট আর বেল্গয়ারের নিউ লেবারের কথা না-ই তুললাম এখানে। সামগ্রিকভাবে একটি উদার-সহনশীল জনকল্যাণমুখী সুষম বণ্টনের সমাজ দিতে পারেনি এদের শাসনাধীন সরকারগুলো।

কিন্তু তাতে জনসমস্যার সমাধান খোঁজার তাগিদ তো কমে যায়নি। তবে প্রশ্নটাকে এখন নতুন করে পেশ করতে হবে। অন্ধ মতাদর্শ নয়, বরং বাস্তব অনুশীলনে ও ক্রমাগত তত্ত্বচর্চার পরিশীলনে যা নিজ দেশের মানুষের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ’ বলে মনে হবে তার একাধিক বিকল্প মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। একেক দেশের পরিস্থিতিতে তা হবে হয়তো একেক রকম, যদিও এ নবভাবনার কিছু প্রাথমিক সূত্রের তত্ত্ব-তালাশ করা সম্ভব। এই তত্ত্ব-তালাশের উৎস হতে হবে নানা স্থানিক সূত্রে গাঁথা। এতে সাহিত্য থাকবে, বিজ্ঞান থাকবে, সংস্কৃতি থাকবে, প্রশাসন থাকবে_ এর চিন্তার উৎস হবে বিভিন্ন, স্বেচ্ছাকৃতভাবে ‘একলেকটিক’। একলেকটিক হওয়া মানে_ বহু উৎসের প্রতি হাত বাড়ানো; নির্বিচারে অগ্রসর হওয়া নয়। এখানে রবীন্দ্রনাথ, মার্কস উভয়ই থাকবেন, মিল ও গ্রামসি এরাও থাকবেন, যেমন থাকবেন লালন ও রামমোহন রায়, রোকেয়া ও গান্ধী, চার্বাক, সন্ত কবীর ও ইবনে আরাবি। হারিয়ে যাওয়া ইসলামী সভ্যতা ও লোকজ দর্শন-সংস্কৃতি, আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন জাদুঘর ও উপনিষদের দুর্লভ গ্রন্থরাজি, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য, সব মানবিক জ্ঞানের আধার হবে এই নতুন মননশীলতা। বাংলাদেশে নতুন সভ্যতার নির্মাণ করতে চাইলে এই বহুমুখী সংগ্রহশীলতার প্রয়োজন। তিনটি উদাহরণ টানছি।

বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ রচনাটির কথা অনেকেরই মনে আছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান চালচিত্রের এক জায়গায় মিল খুঁজে পাই। প্রবৃদ্ধি নাকি সমতামুখী প্রবৃদ্ধি, এই বিতর্ক বোঝার জন্য রচনাটি জরুরি পাঠ্য বলে মনে হতে পারে, অন্তত পরিকল্পনাবিদ ও অর্থনীতিবিদদের জন্য। সেখানে বঙ্কিম শুরু করেছেন এই বলে_ ‘আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, আমাদের দেশে বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বটে; কিন্তু তাতে করে কি জনকল্যাণ বাড়ছে, বণ্টন আরও সুষম হচ্ছে? এ প্রশ্ন বঙ্কিম তুললেন সেখানে। অবকাঠামো নির্মাণ মানেই ‘দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে’ এ ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন_

‘কি মঙ্গল, দেখিতে পাইতেছ না? ঐ দেখ, ভাগীরথীর যে উত্তাল তরঙ্গমালায় দিগ্গঞ্জ ভাসিয়া গিয়াছিল, অগি্নময়ী তরণি ক্রীড়াশীল হংসের ন্যায় তাহাকে বিদীর্ণ করিয়া বাণিজ্য দ্রব্য বহিয়া ছুটিতেছে। ঐ যে দেখিতেছ, রাজপথ, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ঐ স্থানে সন্ধ্যার পর, হয় কাদায় পিছলে পা ভাঙিয়া পড়িয়া থাকিতে, না হয় দস্যু হস্তে প্রাণত্যাগ করিতে; এখন সেখানে গ্যাসের প্রভাবে কোটি চন্দ্র জ্বলিতেছে_ এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে, কাহার এত মঙ্গল? ঐ যে হাসিম শেখ, আর রামা কৈর্বত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাতায়, খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্তিচর্মাবশিষ্ট বলদে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চসিতেছে, উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?_ বল দেখি চষ্মা নাকে বাবু! ইহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে? তুমি লেখাপড়া শিখিয়া ইহাদিগের কি মঙ্গল সাধিয়াছ?’

বঙ্কিমচন্দ্রের অবস্থান স্পষ্ট : শুধু অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটালেই বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলেই দেশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। ‘দেশের মঙ্গল? দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন?_ হিসাব করিলে তাহারাই দেশ_ দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী; যেখানে তাহাদের মঙ্গল নাই, সেখানে দেশের মঙ্গল নাই।’ অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি যদি সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে না পারে সে প্রবৃদ্ধিতে কীসের মঙ্গল, কীসের জনকল্যাণ?

বঙ্কিমচন্দ্র কোনো বামপন্থি ছিলেন না। না হয়েও, তিনি আজকের দিনের পরিভাষায় যাকে বলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বা সমতামুখী প্রবৃদ্ধি কিসে এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। জন স্টুয়ার্ট মিলের ছাত্র (যদিও ‘একলব্য ছাত্র’_ কেননা মিলের সাথে তার কখনও দেখা হয়নি) বিধায় বঙ্কিম ‘প্রিন্সিপালস অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ ভালো করে পড়েছিলেন। ‘বাণিজ্যের তুলনামূলক সুবিধা-তত্ত্বে’ তার আস্থা ছিল। ওই লেখাতেই তিনি বলেছেন, ‘বিদেশীয় বাণিজ্য কারণ আমাদিগের দেশের ধনবৃদ্ধি হইতেছে।’ কিন্তু সেটা স্বীকার করার অর্থ এই নয় যে, দেশের ভেতরে অন্যায় সম্পদ যারা কেন্দ্রীভূত করছেন বৈধ ও অবৈধ উপায়ে তাদের ছাড় দিতে হবে। যেমন_ জমিদার শ্রেণীভিত্তিক যে ভূমি ব্যবস্থা তাকে তিনি সর্বাংশে নিন্দা করেছেন : ‘জীবের শত্রু জীব; মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য; বাঙালি কৃষকের শত্রু বাঙালি ভূস্বামী। ব্যাঘ্রাদি বৃহজ্জন্তু, ছাগাদি ক্ষুদ্র জন্তুগণকে ভক্ষণ করে; জমিদার নামক, বড় মানুষ, কৃষক নামক ছোট মানুষকে ভক্ষণ করে।’ সমস্ত তথ্য-উপাত্ত বিচার করে বঙ্কিম এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, জমিদারি ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়াই ভালো, এর পরিবর্তে বাংলায় চালু হওয়া উচিত রায়তওয়ারি বা প্রজাওয়ারি মালিকানায় জমি বন্দোবস্ত। এ রকম র‌্যাডিকেল প্রস্তাব যার, তিনি বাস্তবে কোনো সোশ্যালিস্ট বা সিন্ডিক্যালিস্ট ছিলেন না। অর্থনীতির নির্মোহ বিশ্লেষণই তাকে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের (আজকের পরিভাষায়, রফতানিমুখী উন্নয়নের) পাশাপাশি কৃষক ও গ্রামমুখিন উন্নয়ন চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রশ্নে অবিচল রেখেছিল। ১৮৭২ সালে লেখা প্রবন্ধটি হান্টারের ‘এনালস্ অব রুরাল বেঙ্গল’ গবেষণার পূর্বসূরি। রচনাটির যুক্তিগুলো বাংলার প্রথম আদমশুমারির আগেই পরিকল্পিত হয়েছিল।

‘দেশের শ্রীবৃদ্ধি’ ও ‘কৃষকের কল্যাণ’_ যথাক্রমে সামষ্টিক ও ব্যাস্টিক এ দুই অর্থনৈতিক দিককে বঙ্কিম তার লেখায় মেলাতে চেয়েছেন। সে চিন্তায় সুশাসনেরও স্থান রয়েছে। সেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা রয়েছে, রয়েছে ‘আদিম ধনসঞ্চয়’-এর কথাও। ‘রুল অব ল’-এর জাঁতাকলে পড়ে কত কৃষক আইন-আদালত করে কবে সর্বস্ব হারাল তার মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে এতে। বস্তুত, উন্নয়ন অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্রের এ লেখাটির তুল্য বিশ্লেষণাত্মক লেখা সর্বত্রই দুর্লভ। এটি উন্নয়ন অর্থনীতির পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পঠিত হতে পারবে।

দ্বিতীয় উদাহরণটি রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে নেওয়া। রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাতেও ব্যাস্টি ও সমষ্টির কল্যাণের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা বড় আকারে উত্থাপিত হয়েছে। রাশিয়ায় বলশেভিক মত চলছে; কিন্তু সে মত কালের বিচারে টিকবে কি-না এ নিয়ে তার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যকে আজকের দিনেও অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়। নতুন সোভিয়েত ব্যবস্থাকে নির্বিচারে গাল-মন্দও করেননি, আবার ভক্তি বিগলিত চোখেও দেখতে চাননি। তিনি লিখছেন, ‘সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে মার্কসীয় অর্থনৈতিক মতটা সম্পূর্ণ গ্রাহ্য কি-না সে কথা বলবার সময় আজও আসেনি; কেননা এ মত এতদিন প্রধানত পুঁথির মধ্যেই টলে টলে বেড়াচ্ছিল, এমন বৃহৎ ক্ষেত্রে এত বড় সাহসের সঙ্গে ছাড়া পায়নি। পরীক্ষার ভিতর দিয়ে পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এ মতের কতটুকু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আজ নিশ্চিত কেউ বলতে পারে না।’ স্বার্থপরতা একেবারে ছেড়ে দিলে আপদ বাড়তে পারে, মানব প্রকৃতির স্বভাবজ সম্পত্তি-পরায়ণতা একেবারে ছেঁটে ফেলতে চাইলে এ ‘সিস্টেম’ হয়তো টিকবে না। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি পরার্থপরতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য খুঁজেছেন। এই মেলানোর তত্ত্বে তার পক্ষপাতিত্ব অবশ্য সামষ্টিক জনকল্যাণের দিকে, বাজার অর্থনীতির স্বার্থবুদ্ধির প্রতি নয়। এ ক্ষেত্রে নিখুঁত সমাধান তার জানা নেই : “ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যখন উৎকট স্বার্থপরতায় পেঁৗছিয়ে সমাজে নানা প্রকার উৎপাত মথিত করে তখন উপদেষ্টা বলেন, ‘স্বার্থ থেকে স্ব-টাকে এক কোপে দাও উড়িয়ে। তাহলেই সমস্ত ঠিক চলবে।’ তাতে হয়তো উৎপাত কমতে পারে। কিন্তু চলার পথ বন্ধ হওয়া অসম্ভব নয়।” ব্যক্তির জন্য ইনসেনটিভ ও জনকল্যাণের ওয়েলফেয়ার ইকোনমিক্সের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে রবীন্দ্রনাথ এ প্রশ্নে পূর্বাপর সচেতন ছিলেন। ১৯২০-এর দশকে লেখা ‘সংহতি’ প্রবন্ধেও এর পূর্বলেখ পাই আমরা।

তৃতীয় উদাহরণটি নজরুলের ‘ছুৎমার্গ’ রচনা থেকে নেওয়া। শ্রেণীর নামে, জাতের নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে সামাজিক ছুৎমার্গকে প্রশ্রয় দিলে কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়নই সামাজিক উন্নতির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারে না। এডাম স্মিথের মতাদর্শ ছিল সামাজিক ছুৎমার্গহীন এক ‘অর্থনৈতিক মানব’-এর সমাজের। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ অবাধ বাজার অর্থনীতিকে শিরোধার্য করেছে, কিন্তু ‘অর্থনৈতিক মানব’ তত্ত্বকে যৌক্তিকভাবে স্বীকার করেনি। ফলে বেশকিছুটা প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন ঘটলেও সামাজিক জাত-পাত-ধর্ম-আচার প্রভৃতির ভেদবুদ্ধি থেকে আমাদের মতো দেশগুলোর মুক্তি মেলেনি। সামাজিকভাবে আমরা ‘ছাড়া-ছাড়া’ থাকব আর অর্থনৈতিকভাবে আমরা ‘একত্রিত’ হব_ বাজার অর্থনীতির এই সামাজিক মতাদর্শ অবাস্তব। আমেরিকা-ইউরোপের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, শত মাল্টিকালচারালিজম আওড়ানো সত্ত্বেও সেখানে ‘সামাজিক প্রভেদ’ ঘুচেনি বা ‘সামাজিক দেওয়া-নেওয়ার’ সম্পর্ক বিভিন্ন সামাজিক বর্গের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পায়নি। নজরুল লিখছেন, ‘আমাদের গভীর বিশ্বাস যে, হিন্দু মুসলমান মিলনের প্রধান অন্তরায় হইতেছে এই ছোঁয়াছুঁয়ির জঘন্য ব্যাপারটাই। … বিবেকানন্দ বলিয়াছেন যে, ভারতে যেদিন হইতে এই ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটার উৎপত্তি সেদিন হইতেই ভারতের পতন, মুসলমান আগমনে নয়। … মানুষ হইয়া মানুষকে কুকুর-বিড়ালের মতো এত ঘৃণা করা মনুষ্যত্বের ও আত্মার অবমাননা করা নয় কি? … হিংসা, দ্বেষ জাতিগত রেষারেষির কি সাংঘাতিক বীজ রোপণ করিতেছ তোমরা! অথচ মঞ্চে দাঁড়াইয়া বলিতেছ, ‘ভাই মুসলমান এস, ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই!’ ‘কী ভীষণ প্রতারণা! মিথ্যার কি বিশ্রী মোহজাল! এই দিয়া তুমি একটা অখণ্ড জাতি গড়িয়া তুলিবে?’ নরেন্দ্র মোদির আধুনিক ভারত-তত্ত্ব বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলে যাওয়ার কংগ্রেসি তত্ত্ব এ প্রেক্ষিতেই আমাদের দেখতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক উদারীকরণ করে ভারতীয় সমাজ আধুনিক হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে সামাজিক ‘ছুৎমার্গ’ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারছে। জাত-পাতের ব্যবধান ডিঙিয়ে পরস্পরকে আপনার, ‘সমকক্ষ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ‘কাছের করে’ জানতে হবে। নইলে কাঙ্ক্ষিত সমাজের সূত্রপাত ঘটবে না।

ইচ্ছা করেই অন্যান্য বাঙালি তাত্তি্বক, চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকদের কথা এ প্রসঙ্গে বাদ রাখলাম। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমার বলার কথা ছিল যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন চিন্তা বড় বেশি পরনির্ভরশীল তত্ত্বের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্থানীয় চিন্তার সূত্রে অর্থনৈতিক তত্ত্বকে আমরা সেভাবে দাঁড় করাতে পারিনি। অথচ সে সম্ভাবনা বিশদভাবে রয়ে গেছে পূর্বসূরিদের চিন্তা-ভাবনায়। প্রবৃদ্ধি হলেই আমরা ধরে নিচ্ছি তা অবধারিতভাবে জনকল্যাণমুখী এবং সে কারণেই ফি-বছর প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিতর্ক একটি প্রথাগত সংলাপে পরিণত হচ্ছে। সমতামুখিন প্রবৃদ্ধি কিসে সাধিত হবে সে ধরনের প্রশ্নে আমরা প্রবেশ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছি। দারিদ্র্য কমছে বলে কিছুটা আত্মপ্রসাদ বোধ করছি, দারিদ্র্য কমার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাইছি না। তুলনামূলকভাবে অদক্ষ শ্রমের কল্যাণ হচ্ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তুলনামূলকভাবে অদক্ষ শ্রমজীবী মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানরা আগামীতে মধ্যবিত্তে পরিণত হবে কি-না এই মৌলিক সামাজিক সচলতার প্রশ্নটি অধরাই থেকে যাচ্ছে। তা ছাড়া, হাড় ভাঙা খাটুনির পর হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত্তের পুষ্টির সমস্যা এখনও চলে যায়নি। দেশের হয়তো শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, ‘মঙ্গলের ছড়াছড়ি হচ্ছে’; কিন্তু ‘চরম দরিদ্রে’ থাকা মানুষরা কিন্তু এখনও সংখ্যায় প্রায় ২ কোটির মতো। এরা এখনও ‘দীনের হতে দীন’। তিন বেলা হয়তো এরা খেতে পারছে; কিন্তু মৌলিক অনেক নাগরিক সুবিধা থেকে এরা এখনও বঞ্চিত। ক্ষমতার কাছে এরা এখনও অসহায়। মধ্য আয়ের দেশ হয়তো অচিরেই আমরা হতে পারব; কিন্তু চরম দরিদ্র মানুষের অবস্থার পরিবর্তন না হলে এই শ্রীবৃদ্ধিতে সান্ত্বনা নেই। আছে কি?

লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতি বিশ্লেষক

বিত্ত ও বৈষম্য (Wealth and Inequality)

বিনায়ক সেন

১. টমাস পিকেটির নতুন বই
২০১৪ সালের মে মাসের ৭ তারিখে ৪৩ বছর পূর্ণ হলো টমাস পিকেটির। পিকেটি প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক। ঠিক এক মাস আগে বেরিয়েছে তাঁর দ্বিতীয় বই ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’। চারপাশে রীতিমতো হৈ চৈ পড়ে গেছে এ বই নিয়ে। নোবেল জয়ী অর্থনীতির অধ্যাপক পল ত্রুক্রগম্যান এ বইয়ের আলোচনাই করেছেন ‘নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস’ শীর্ষক খ্যাতনামা পাক্ষিকে। বলেছেন, পিকেটির বই সম্ভবত ‘এক দশকের মধ্যে অর্থনীতির ওপর প্রকাশিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই’। এ বই ২০টি শিল্পোন্নত দেশের ওপর গত তিনশ’ বছরের তথ্য-উপাত্ত জড়ো করে পুনরায় বৈষম্যের প্রশ্নটিকে মেইন স্ট্রিম অর্থনীতির মূল প্রসঙ্গের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছে। এখন বোঝা যায় কেন পুঁজিবাদকে রবীন্দ্রনাথ ‘যক্ষপুরী’ নাম দিয়েছিলেন। পিকেটি তাঁর বইয়ে যক্ষের ধন-সম্পদের সঙ্গে বৈষম্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন।

মার্কস তার পুঁজি গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন কী করে পুঁজির ক্রমাগত সঞ্চয়নের (অ্যাকুমুলেশন) অবধারিত পরিণতি হচ্ছে সমাজে ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য। পিকেটি-কর্তৃক সংগৃহীত উনিশ শতকের তথ্য মার্কসের এ দাবিকে সমর্থন করে। দৃষ্টিকটুভাবে বাড়তে থাকা আয়-বৈষম্যের পরিণতিতে এভাবেই দেখা দিয়েছিল ১৯১৪-১৮ সালের প্রথম মহাযুদ্ধ। অন্যদিকে সাইমন কুজেনেস গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি দেখালেন, জাতীয় আয়ে পুঁজির অনুপাতে ক্রমাগত বৃদ্ধি যে ঘটতেই থাকবে এমন কোনো কথা নেই। শিল্প-বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে এটা ঘটলেও পরবর্তীতে প্রযুক্তিগত উন্নতি ও শিক্ষার বিকাশের কারণে জাতীয় আয়ে পুঁজির অনুপাত কমে আসবে বা এক জায়গায় স্থিতিশীল হবে। আয়-বৈষম্য গোড়ার দিকে বাড়লেও পরবর্তীতে কমতে থাকবে। দুই মহাযুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কুজনেস দেখালেন প্রথমে বাড়া ও পরে কমার এই প্রবণতা। অর্থাৎ মার্কসের উনিশ শতকীয় গবেষণা থেকে লাগামছাড়া বৈষম্য বৃদ্ধির যে চিত্র বেরিয়ে এসেছিল, তার বিপরীতে তাতে কুজনেস এক আশাবাদী চিত্র আঁকলেন। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম : পুঁজিবাদে যখন ঘর বেঁধেছি, তখন বৈষম্যে আর কী ভয়!

পিকেটির যুক্তি হচ্ছে, মার্কসের নেতিবাচক পূর্বাভাস কেবল আংশিকভাবে সত্য : শিল্পোন্নত দেশের কোনো কোনো পর্যায় সম্পর্কে তা খাটে। কিন্তু সবসময় নয়। একইভাবে তাঁর যুক্তি হচ্ছে, কুজনেসের আশাবাদী উচ্ছ্বাসের পেছনে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিসংখ্যানগত ভিত্তি নেই। দুই যুদ্ধের মধ্যকার সময়ে শিল্পমন্দার কারণে পুঁজির বিকাশ বিঘি্নত হয়েছিল। যুদ্ধের সময়ে অনেক পুঁজি-পণ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের দুই দশকে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেটের অভ্যুদয় ও ট্রেড ইউনিয়নের শক্তিশালী ভূমিকার কারণে পুঁজির লাগামছাড়া বৃদ্ধিকে কিছুটা রাশ টানা গিয়েছিল। ফলে ওই সময়-পর্বে বৈষম্য কিছুটা হ্রাস পেয়ে থাকবে। কিন্তু এ অবস্থাটা বদলে যায় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে এবং এখনও এর মধ্যেই আছি আমরা। এই সময়টা শ্রমের বিরুদ্ধে পুঁজির ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার কাল। জাতীয় আয়ে পুঁজির অংশ দ্রুত বাড়তে থাকে আবারও; আর শ্রমের অংশ ক্রমাগত কমতে থাকে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফের বাড়তে থাকে ধনী-গরিবে আয়-বৈষম্য। এই প্রবণতাটি ২০০০-এর দশকে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পেঁৗছেছে। কিন্তু এটাই পিকেটির প্রধান বক্তব্য নয়।

তাঁর আরও দাবি :শিল্পোন্নত দেশে পুঁজির ক্রমাগত সঞ্চয়নের প্রক্রিয়ায় সমাজের ‘সর্বোচ্চ ১ শতাংশের’ হাতে আয় (ইনকাম) ও বিত্ত (অ্যাসেট) দুই-ই উত্তরোত্তর কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশ কেউই এর থেকে বাদ পড়ছে না। তাঁর আরও একটি দাবি, এসবই শুধু অর্থনীতির উপাদানের কারণে হচ্ছে না। ১৯৮০ সাল থেকে বৈষম্য-বৃদ্ধির যে ধারাবাহিক প্রবণতা পাই, তার পেছনে কাজ করেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবকও। কোন শ্রেণীর জন্য কী ধরনের কর বসবে বা কী ধরনের ব্যাংক-অর্থায়ন নীতি গ্রহণ করা হবে, তা রাজনীতিতে যারা প্রভাবশালী তাদের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছে।

পিকেটির বইতে তিনশ’ বছরের বিচিত্রবিধ তথ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে এক সুদৃঢ় অর্থনৈতিক বয়ান উপস্থাপন করা হয়েছে। শিল্পোন্নত দেশের অভিজ্ঞতা তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন নির্মোহভাবে। এক্ষেত্রে তিনি মার্কসের সহযাত্রী। মার্কসের মতোই তিনি যুক্তি দিয়েছেন, ‘পুঁজিবাদের মৌলিক কাঠামোগত দ্বন্দ্ব’ হচ্ছে এ ব্যবস্থায় অর্থনীতির ‘প্রবৃদ্ধি হারের’ তুলনায় ‘পুঁজির থেকে রিটার্নের হার’ বেশি করে বাড়তে থাকা। দীর্ঘমেয়াদে শিল্পোন্নত দেশে বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির হার যদি ১-২ শতাংশ, সেখানে পুঁজি বিনিয়োগে রিটার্নের হার হয় ৪-৫ শতাংশ (বলে রাখি, উন্নত দেশগুলোয় সর্বাধুনিক ‘ফ্রন্টিয়ার’ প্রযুক্তির ক্রিয়াশীলতার কারণে সেখানে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় কখনোই ১-২ শতাংশের বেশি হয় না)। এই দুইয়ের মধ্যে ফারাকটা দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ও যুদ্ধ-পরবর্তী এক-দুই দশকে কমে গিয়েছিল, কিন্তু এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। পুঁজির ক্রমাগত বৃদ্ধিতে রাশ টানা না গেলে তা শিল্পোন্নত দেশে উত্তরোত্তর বৈষম্য, সামাজিক অস্থিরতা, এমনকি যুদ্ধ-বিপ্লব পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করতে পারে। এজন্যই পিকেটির বই নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট এত আতঙ্কিত।

এ অবস্থা থেকে পিকেটি অবশ্য যুক্তি খুঁজেছেন পুঁজির ওপরে ‘প্রগ্রেসিভ’ হারে বাৎসরিক কর বসানোর মধ্যে। তাঁর মতে, পুঁজির রিটার্নের ওপর হস্তক্ষেপ করে লাভ নেই। কেননা এতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করা হবে। কিন্তু পুঁজির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ওপর ক্রমবর্ধমান হারে কর বসানোই যেতে পারে। যেমন যাদের পুঁজির পরিমাণ ১০ লাখ ডলারের কম সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ০.৫ শতাংশ বাৎসরিক কর, ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ ডলারের পুঁজি বা সম্পদ যাদের, তাদের ওপর ১ শতাংশ কর, ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি ডলার পুঁজি বা সম্পদ যাদের তাদের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ কর, এভাবে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কর বসানো যেতে পারে।

বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে পুঁজির উত্তরোত্তর মালিকানার ওপরে বর্ধিত হারে কর বসানোর পক্ষে অন্যবিধ উপাত্তও সম্প্রতি জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। ব্রিটেনে সরকারি পর্যায়ে পরিচালিত বিত্ত-জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, ২০০৮-১০ সালে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পরিবার মোট বিত্তের ৪৪ শতাংশের অধিকারী। একই চিত্র যুক্তরাষ্ট্রেও। অবশ্য পিকেটির লেখায় উল্টো প্রবণতার কথাও উলিলখিত হয়েছে। বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে যে দুটো শুভ প্রভাবকের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ধারাবাহিকভাবে প্রযুক্তিগত উন্নতির দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ও শিক্ষার সর্বাত্মক বিস্তারের মাধ্যমে শ্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি। চীন ও পূর্ব এশিয়ার তাইওয়ান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশ এ দুটো প্রভাবককে আশ্রয় করেই দ্রুত উন্নতি লাভ করেছে এবং এতে বিশ্বব্যাপী পুঁজি ও শ্রমের মধ্যকার বৈষম্যের মাত্রা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছুটা শুভ সূচনাও হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এসব উদাহরণ হাতেগোনা কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমিত। তার ওপরে, এসব দেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের পর্যায়ে শিল্পোন্নত দেশের মতোই দ্রুত বৈষম্য বৃদ্ধির অশুভ প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।

পিকেটি মন্তব্য করেছেন, পুঁজির উপরে প্রগ্রেসিভ হারে কর বসানোর নীতি কার্যকর করতে হলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন। পুঁজি যে রকম বিশ্ব অর্থনীতিতে স্বচ্ছন্দ ও সচল, সেখানে সে সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে পারে। তাকে ধরা অত সহজ নয়। কিন্তু পিকেটি এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পুঁজির এই অতিমাত্রায় সঞ্চয়ন বা দৌরাত্ম্য ‘বাজার ব্যবস্থার কোনো ত্রুটির ফসল নয়’। বিশুদ্ধ ও নিখুঁত বাজার ব্যবস্থাতেও পুঁজির রিটার্নের হার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশিই হবে। আর এই ধারা থেকে গেলে বৈষম্য বাড়তে বাধ্য এবং এক পর্যায়ে লাগামছাড়া বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতাকে উস্কে দেবে। এই পয়েন্টে তিনি আবারও মার্কসের সহগামী; দু’জনেই পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত বিরোধ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন।

অর্থাৎ বাজার ব্যবস্থা পুঁজির এই বল্গাহীন বিকাশের ধারাকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। পিকেটি বলছেন :”ইয়েট পিওর অ্যান্ড পারফেক্ট কমপিটিশন ক্যান নট অল্টার দ্য ইনইকুয়ালিটি অব রিটার্ন অন ক্যাপিটাল বিইং গ্রেটার দ্যান দ্য রেট অব গ্রোথ অব ইকোনমি। দিস ইজ নট দ্য কনসেকুয়েন্স অব এনি মার্কেট ‘ইমপারফেকশন’।” শেষ পর্যন্ত তিনি সমস্যার মুক্তি খুঁজেছেন ‘পুঁজিবাদের ওপর গণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ’ নেওয়ার মধ্যে। ইউরোপিয়ান ডেমোক্রেসির সেরা ঐতিহ্য ধরে গণতন্ত্রকে গভীরতর, বিস্তৃততর ও পূর্ণতর করার মধ্যে। পিকেটির স্বদেশীয় প্যারিসবাসী দার্শনিক জাঁক দেরিদাঁ এ ক্ষেত্রে একই কথা বলেছিলেন নব্বইয়ের দশকে। পুঁজির শাসন তার গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে; গণতন্ত্রকে এখন আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তবে সেই গণতন্ত্র দেরিদাঁর ভাষায় ‘এখনও আসতে বাকি’।

২. আমাদের ‘১ শতাংশ’
পিকেটি তাঁর নতুন বইয়ে দ্রুত বৃদ্ধিশীল বিত্ত-বৈষম্যের মূলে ক্রিয়াশীল দেখেছেন সংকীর্ণ এক শ্রেণীর কাছে পুঁজির ক্রমাগত হারে জড়ো হওয়াকে। এই দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতাকে রোধ করার জন্য তিনি দু’ধরনের নীতির কথা বলেছেন। একটি হচ্ছে, পুঁজির বল্গাহীন কুক্ষিগতকরণের ধারাকে ‘প্রগ্রেসিভ’ হারে কর বসিয়ে নিরুৎসাহিত করা। অন্যটি হচ্ছে, প্রযুক্তিগত উন্নতি ও শিক্ষার আলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে পুঁজির বিকেন্দ্রীভবন করা ও শ্রমের দক্ষতা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা। প্রথমটি যদি হয়ে থাকে ‘ডাইভারজেন্সকে’ কমিয়ে আনার নীতি, দ্বিতীয়টি তবে ‘কনভারজেন্স’কে লালন করার উপায়। দুঃখের বিষয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রযুক্তিগত উন্নতির বিকাশ খুবই অসম, এমনকি শিক্ষার সরলতম সূচকেও দেশে দেশে ব্যবধান এখনও অত্যন্ত দৃষ্টিকটু পর্যায়ে রয়েছে। আর দেশের ভেতরে প্রযুক্তির অধিকারে এবং শিক্ষার স্তরে/মানে ধনী-গরিবে বৈষম্য বা বৈপরীত্য আরও করুণ। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু জাতীয় আয়ে পুঁজি আর শ্রমের অধিকারের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে তাই নয়। বৈষম্য চোখে পড়ার মতো বেড়েছে শ্রমের ভেতরেই_ দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে, হাইস্কুল থেকে ‘ঝরে পড়া শ্রমিক’ আর ‘কলেজ-শিক্ষিত শ্রমিকের’ মধ্যে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বল্প-শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে আয়ের ব্যবধান ক্রমেই প্রকট হারে বাড়ছে। বাংলাদেশেও বাড়ছে। কিন্তু আমি এখানে পিকেটির মূল প্রতিপাদ্য শতাংশের হাতে ক্রমেই কুক্ষিগত হওয়া পুঁজি বা সম্পদ এ প্রসঙ্গে সবাইকেই আরেকটু ভাবতে বলব। কেননা,ম ‘১ শতাংশের ক্ষমতা’র প্রসঙ্গটি আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে গত দুই দশকের গণতান্ত্রিক ডিসকোর্সের মধ্যে প্রায় অনালোচিত থেকে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা সত্যি বিস্ময়কর। ১ শতাংশের সম্পদের প্রসঙ্গটি অনালোচিত থাকছে গণতন্ত্রের যুগেই! অথচ যখন গণতন্ত্র ছিল না, তখন এ নিয়ে বেশ জোরেশোরে আলোচনা হতো। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যগগনে, সেই সুদূর ষাটের দশকে, আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘পাকিস্তানের অর্থনীতিতে তেইশ পরিবারের’ নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ। পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ খাদিজা হক এই ‘তেইশ পরিবার’ শনাক্ত করেছিলেন; পরবর্তী সময়ে স্টিফেন হোয়াইট ‘একচলি্লশ পরিবারের’ সম্পদ নিরূপণ করেছিলেন। আরও পরে, সোভিয়েত অর্থনীতিবিদ সের্গেই বারানভ পূর্ব পাকিস্তানের সময়েই ‘১৬ জন বাঙালি পরিবারের’ তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন, যার উল্লেখ রয়েছে রেহমান সোবহানের লেখায়। স্বাধীনতার পর আশির দশকে যখন গণতন্ত্র নেই এ দেশে, তখন আবারও নতুন করে ১ শতাংশের ক্ষমতার প্রসঙ্গ উঠেছিল। এই আলোচনায় বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেদিনের বামশক্তি। আমার বেশ মনে পড়ে, ১৯৮৭ সালের গোড়ার দিকে এক ঝকঝকে অপরাহ্নে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ বললেন, ‘দেশ আজ পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মতো দুই অর্থনীতিতে ভাগ হয়ে গেছে। এই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় বৃহৎ ধনিক গোষ্ঠী ও পরিবার। আপনারা তাদের পরিসংখ্যান দিয়ে খুঁজে বার করুন।’ মোহাম্মদ ফরহাদের পরনে ছিল ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি এবং যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন তাঁর চোখেমুখে এক শান্ত বিপ্লবী দৃঢ়তা ফুটে উঠেছিল। ততদিনে ‘একতা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বের হতে শুরু করেছে ‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনী’। এই মর্মে একটি বইও বেরিয়েছিল পরে মতিউর রহমান ও সৈয়দ আজিজুল হকের গ্রন্থনায়। পিকেটির ধৈর্য, দক্ষতা, সুযোগ ও অধ্যবসায় কোনোটাই আমাদের ছিল না। পরিসংখ্যানগতভাবে শতাংশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও বিত্তকে আমরা সেদিন তুলে ধরতে পারিনি। ১৯৮৮ সালে ‘বাংলাদেশে বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ’ শীর্ষক বাংলায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। মনে পড়ে, অধুনা-বিলুপ্ত ‘মুক্তির দিগন্ত’ নামক মাসিক পত্রিকায় (এটির কিছুটা কৌলীন্য ছিল সেকালে ‘ওয়ার্ল্ড মার্কসিস্ট রিভিয়্যু’র অনুবাদ-পত্রিকা হিসেবে)। তাতে ‘৩৬টি পরিবার’ শনাক্ত করা হয়েছিল যারা একই সাথে সে সময়কার ব্যাংক, বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে যুক্ত ছিলেন, আবার সরকারি ব্যাংকের বৃহৎ ঋণগ্রহীতা ও খেলাপিও ছিলেন। পরে ১৯৯১ সালে, প্রাইভেটাইজেশন নিয়ে ইংরেজিতে লিখতে গিয়ে এ পরিবারগুলো নিয়ে ‘নিয়ন্ত্রণ’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলাম। অগ্রজ এমএম আকাশও সে সময় এ নিয়ে আলাদা করে লিখেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ‘১ শতাংশের প্রভাব’ নিয়ে আরও লেখা ও গবেষণার প্রয়োজন ছিল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, আমাদের ‘রাজনৈতিক সমাজ’ ও ‘সিভিল সমাজ’ কেউই গত দু’দশকে ‘১ শতাংশের ক্ষমতা’ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি।

আমাদের কর্তাব্যক্তিদের মাঝেমধ্যে বলতে শুনি, বাংলাদেশ নানা দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই যেমন, উন্নত বিশ্বে বৈষম্য নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে অথচ ‘এ দেশে তো আয়-বৈষম্য তেমন একটা বাড়ছে না’। বরং ২০০৫ ও ২০১০ সালের বিবিএস জরিপ হিসেবে নিলে দেখা যাচ্ছে, শহর এলাকায় আয়-বৈষম্য একই আছে অথবা কিছুটা যেন কমেছে! এঁদের যুক্তিতে, পিকেটির লেখা তাই এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তা ছাড়া উন্নয়নের যে পর্যায়ে বাংলাদেশ এখন, সেখানে দারিদ্র্য কমাটাই মূল কথা; বৈষম্য যদি কিছুটা বেড়েও থাকে। তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তাই কি?

বৈষম্যের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পিকেটিকে আঠারো শতকের ফ্রান্সের দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটতে হয়েছে (জেমস্কারা স্ট্যাটিসটিক হাতড়ানো লেনিনের মতো)। এমনকি ফিরে যেতে হয়েছে জেন অস্টেন বা বালজাকের উপন্যাসের পাতায়, যেখানে তাঁরা উল্লেখ করছেন পাত্র-পাত্রীর জমিদারি সম্পদ, বিনিয়োগ ও রিটার্নের কথা। তা ছাড়া ‘লুক্সেমবার্গ প্রকল্পের’ আওতায় পশ্চিম ইউরোপে দীর্ঘকাল ধরে সম্পাদিত হচ্ছে আয়-ব্যয় জরিপ। যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে প্রতি দু-তিন বছর অন্তর সম্পন্ন হচ্ছে ‘বিত্তের ওপর জরিপ’ বা ওয়েলথ সার্ভে। সম্পদ জরিপের কোনোটাই কখনও আমাদের দেশে হয়নি; এখনও হয় না। যেটা হয়ে থাকে, সেটা হচ্ছে খানা-পর্যায়ে আয়-ব্যয় জরিপ। কিন্তু তাতে অতি গরিবদের অংশগ্রহণ থাকে, গরিবের থাকে, মধ্যবিত্তের থাকে। কিন্তু শহর এলাকার (বিশেষত, ঢাকা ও চট্টগ্রাম) ধনিক পরিবারের বলতে গেলে অংশগ্রহণই থাকে না। আর ঢাকার অতি-ধনিক পরিবারদের ওপর আয়-ব্যয় জরিপ চালানোর মতো ক্ষমতা নেই বিবিএসের। কেননা, যারা প্রশ্নের উত্তর দেবেন তারা তো মহাপরাক্রমশালী। উত্তর দিতে না চাইলে কার সাধ্য তাদের বাধ্য করে! ফলে গবেষণা কর্মকর্তাদের ওই সব ধনাঢ্য পরিবারের ফটক থেকেই ফিরে আসতে হয়। সন্দেহ কি, এর ফলে তথ্য যা পাওয়া যায় তাতে মনে হতেই পারে, ২০০০-এর দশকে শহর এলাকায় আয়-বৈষম্যের মাত্রা নিরূপক জিনি-সহগের মাত্রা একই আছে। বেশ কমে গেলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকত না। কেননা, এর সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির কোনো মিল নেই এ নেহাতই পরিসংখ্যানগত ত্রুটিজনিত বিভ্রম।

আশির দশকের ‘অ-গণতান্ত্রিক’ প্রেক্ষিতের তুলনায় ২০১০-এর দশকের ‘গণতান্ত্রিক’ পরিবেশে আমাদের ১ শতাংশের বিত্ত, প্রভাব ও প্রতিপত্তি যে আরও অনেক গুণে বেড়েছে তার সপক্ষে সরাসরি তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করা এখন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। সেকালে সহজেই সরকারি ব্যাংকের সূত্রে ঋণ-গ্রহণ ও খেলাপি ঋণের তথ্য সংগ্রহ করা যেত। এখন ওয়ান-স্টপ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে ওপরওয়ালার ইচ্ছা ব্যতীত অক্ষর-পরিমাণ তথ্য-পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। সে সময় যারা তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন তাঁরা নিজেরাই এখন ১ শতাংশ অথবা ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছেন। ‘সবকিছুই কালের ও শ্রেণী-স্বার্থের অধীন’ এ নিয়ম মেনে তারা সামরিক বহিনীর শৃঙ্খলা নিয়ে নীরবতা পালন করছেন। ফলে গবেষকের কার্যোদ্ধার হওয়া এখন দুরূহ। বৃহৎ করদাতা যাঁরা তাঁরা কারা এবং তাঁদের কাছে সম্পদ কত, এটিও জানার উপায় নেই। এমনকি গবেষণার প্রয়োজনেও। তথ্য অধিকার আইনের প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ। তবে তারপরও কিছু পরোক্ষ সূচক তৈরি করা যায়, যার থেকে ১ শতাংশের ক্রমবর্ধমান বিত্ত ও প্রতিপত্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মেলে।

দেশীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা আশির দশকের গোড়ায় যেখানে ছিল ৬-৭টি, এখন তার সংখ্যা ৩১। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ৮টি ইসলামিক কমার্শিয়াল ব্যাংক। অনুরূপভাবে বীমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। এসব ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা-পরিচালককে বোধকরি ১ শতাংশের মধ্যে গণ্য করা যায়। এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত দেশের ৩০টির বেশি টিভি চ্যানেলের উদ্যোক্তাদেরও। পত্রিকা মালিকদেরও। স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত, কোম্পানির সংখ্যা এ সময়ে বেড়েছে। এর মধ্যে ‘কনগ্গ্নমারেটের’ (শিল্প-ব্যবসা গ্রুপ যারা একাধিক খাতে বিচরণরত) সংখ্যাই ৩০টি। এরাও ১ শতাংশের মধ্যে পড়েন। বিশ বছর আগে ঢাকায় ডেভেলপারের সংখ্যা ছিল ৫টিরও কম। এখন ২৫০টির মতো। রিহ্যাবের প্রধান ৫০টি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গত দুই দশকে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে আনুুমানিক ৫-৬ লাখের মতো। ফ্ল্যাটের গড় মূল্য এই সময়কালে পরে প্রায় ১০-১৫ গুণ বেড়েছে। এই ফ্ল্যাট কেনার মতো অর্থ-বিত্ত যাঁদের হাতে তাঁরা ১ শতাংশ না হন, ৫ শতাংশের মধ্যে নিশ্চয়ই পড়েন। তবে এঁদের মধ্যে ১ শতাংশ চেনার উপায় হচ্ছে, কোন এলাকায় তাদের বাস ও একাধিক ফ্ল্যাট বা বাড়ি আছে কি-না সে তথ্য। আমি একজনকে জানি, যার ঢাকা শহরে ৬০টির বেশি ফ্ল্যাট আছে। আর একাধিক ফ্ল্যাট আছে অনেকেরই।

এই ধনাঢ্য শ্রেণী কোনো সম্পদ-কর দেন না। কেননা আমাদের দেশে কোনো ওয়েলথ-ট্যাক্সের প্রথা নেই। সম্পদ-করের কথা শুনলেই কেউ কেউ অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত নয় এ ধরনের কথা বলতে থাকেন। এ কর আছে ভারতসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশে ও প্রায় সব উন্নত দেশেই। ভারতে ১ শতাংশ হারে এ কর বসানো হয়ে থাকে ‘নিট’ পরিসম্পদের ওপর। অর্থাৎ সম্পত্তির মূল্যায়নে গৃহীত ঋণ বাদ রাখা হয়। দ্বিতীয় ফ্ল্যাট বা জমির প্লটই (সেটা শহরের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে হলে) শুধু সম্পদের মধ্যে ধরা হয়। ভারতীয় মূল্যে ৩০ লাখের ওপরে সম্পদ যাদের তাদের ক্ষেত্রেই ১ শতাংশ সম্পদ-কর বসানো হয়। আমরা পিকেটির যুক্তি অনুসারে এখানেও ‘প্রগ্রেসিভ’ হারে পুঁজি বা সম্পদের ওপরে কর ধার্যের সুপারিশ করতে পারি। এতে অনায়াসে প্রতি বছরে অতিরিক্ত ১০০০-২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আসবে, যা অতি-দরিদ্রের ‘উপরে টেনে তোলা’ ক্ষেত্রে ব্যয় করা যায়। বর্তমানে ধনী ব্যক্তির আয়করের ওপর ‘সারচার্জের’ নামে যা আহরিত হয় তার পরিমাণ অতি-নগণ্য (গত বছরে ছিল মাত্র ১৩১ কোটি টাকার মতো)।

কিন্তু শুধু সম্পত্তি কর বসিয়ে এই ১ শতাংশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যেই এদের আর্থিক প্রভাব আছে, যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। নির্বাচনী ব্যয় ও প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সংস্কার না এলে এই প্রভাব চলতেই থাকবে। গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে রাজনৈতিক সমাজ নয়, বরং যাদের দ্বারা তারা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত_ সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ‘১ শতাংশ’ শ্রেণী। কালক্রমে এমনকি রাজার চেয়েও অধিক পরাক্রমশালী হয়ে দাঁড়াতে পারে এই শ্রেণীর প্রভাব-প্রতিপত্তি। যক্ষপুরীর রাজা এক সময় এ কথা বুঝতে পেরে তার নিজেরই গড়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য নন্দিনীর সাহায্য চেয়েছিলেন। যক্ষের ধন জড়ো করার মধ্যে জীবনের সহজ সুখ নিহিত নেই। রক্তকরবী নাটকের এই ছিল মর্মবাণী। নন্দিনীকে রাজা তাই বলেছিলেন :’আমার যা আছে সব বোঝা হয়ে আছে। সোনাকে জমিয়ে তুলে তো পরশমণি হয় না’। পিকেটি ক্রমবর্ধমান বিত্ত-বৈষ্যমের অশুভ পরিণতির দিকে দৃষ্টিপাত করে আমাদের এ সরল সত্যের কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

বিনায়ক সেন
লেখক
প্রাবন্ধিক
গবেষক

Original post on Samakal here.

How political culture matches “Poor Economics”

Binayak Sen

It is often said that “every nation gets the government it deserves”, a quote popularly misattributed to diverse commentators such as Alexis de Tocqueville and Abraham Lincoln but that is in fact derived from Joseph de Maistre’s publication in the Lettres et Opuscules. There is a grain of truth in this. Governance conditions improve more in the context of active citizenry empowered with actionable rights, than in the context of passive citizenship. Political leadership of a given nation-state is a reflection of its constituency i.e. “endogenous” to the characteristics of its citizens. A more nuanced epigram stems from Leninist dialectics where Ulyanov said that “politics is the concentrated expression of economics”. One should not interpret this as yet another iteration of economic determinism where economics dictates what happens to politics. Articulated in the height of the New Economic Policy amidst civil war, when the survival of the new born Socialist state was at stake, the Leninist epigram defined protecting economic peace at any costs as the cornerstone of political governance. There is only a very limited zone of subjectivity within which politics can be truly free and independent of the compulsions dictated by economic interests. The present intervention further narrows down on one aspect of such economic moments by focusing on poverty dynamics and the consequences that such dynamics hold for the nature of political culture.

This article makes two main points. First, the central narrative of the last two decades of economic development can be summarized by a silent but dramatic ascent of the poor. Second, this ascent of the poor, although deservedly celebrated in its own right, has implications for the nature of Bangladeshi politics as seen in the persistence of the overall low-level of democracy.

It may be noted that the poor’s rapid ascent has also made its footprints in the sphere of cultural productions, notably in the rising significance of religion in the context of a weak but moderate Muslim democracy. But, this question will be dealt with in a separate essay.

1. Structure and Agency

Bangladesh has been subjected to oscillating pessimism and optimism in the last 42 years. At one time Bangladesh was dubbed the test case for development. In another time it was seen as the role model of least developed countries (LDCs) in making progress on economic and social fronts. Such oscillations between positive and negative appraisals is not exceptional – it is arguably a common characteristic of many low income countries passing through the phases of stagnation, renewal and retrogression. Sometimes economic institutions grow but political institutions lag behind, displaying the complex interrelations between economic, social and political indicators. Underdevelopment is conceptually expressed not just at the level of low income but also in the unpredicted mismatches between economic and political dimensions of development. Since early last year, the country has been viewed mainly through a pessimistic lens.

This essay glosses over the acuteness of the currently burning issue of post-election political settlements. There has been endless commentary on the subject, especially on the critical importance of an inclusive, free and fair election that would ensure the participation of the historically two major nationalist political parties. The relevance of party-inclusiveness can be seen from the fact that each of these major parties had roughly about 33 to 40 percent share of the votes cast, even when they failed to win majority seats in the parliament (as per 2001 and 2008 elections). The interest in the present intervention however lies in examining the forces of inertia—why things remain as they are—that tend to reproduce the disconnects between economic progress and political regress.

Early entrants into the global capitalist system had the initial advantage in maintaining the complex dynamics between economic and political developments. Historically, in developed countries of the West, economic development could be given exclusive primacy for a long time while paying little attention to political development. Early capitalist transformations of these economies did not require the commensurate – by now established as a universal standard – practice of liberal politics. This was not only true in the case of policies adopted in the New World (colonies) but also in the case of political practices adopted in the Old World (metropolis)—the terms old and new being used originally from the European perspective. Comparative economic history shows that there has been a significant time lag between economic and political moments in the development of Western modernity. Market capitalist institutions developed much earlier than the political institutions of democracy based on universal suffrage. In contrast, developing countries saw the nationalist acceptance of the “idea of democracy” based on universal suffrage much earlier than the corresponding capitalist institutions found their roots in such societies. Although the idea of free and fair electoral democracy based on multi-party system remained popular in these societies it lacked other “institutional ingredients” that make democracy work. Part of the problems stems from ignoring participation and public reason as a precondition to democratic order. The ruling coalition typically lacked imagination and authenticity, and as a result, it lapsed mainly into a “mimicry of democracy” compared to the Western standard achieved today (the problem of mimicry has a pervasive existence in early stages of development, including in articulating nationalism and the idea of Nation).

Bangladesh’s experience of the last two decades, however, suggests that decent long-term economic development can take place even under political regimes engaged in such a mimicry of democracy. That raises a legitimate question: what explains the continued democratic mimicry in the face of such economic development? In other contexts, arguably, such a mismatch between economic and political moments (unstable political equilibrium) would not have lasted long: it would lead either to authoritarian rule or to a more acceptable order of inclusive democracy. What is it in our past development that makes democratic mimicry persistent? It is easy to invoke the continued personal rivalry between the two main leaders of the country—recent telephonic conversation expressed it more clearly–as explanation for the persistence of democratic mimicry. This answer is too easy to be taken seriously. There must be some “structural factors” that underline such democratic mimicry. The interest, therefore, is in understanding the persistence of democratic mimicry in such dynamic economic contexts as Bangladesh where economic conditions for full-blown democracy are not ripe as yet. The problem is analogous to explaining the trend towards mean reversion in finance literature. It is useful to know why things do not improve although (unlike some countries of Sub-Saharan Africa) they do not fall apart either here.

The article takes a long term view on current disillusionment, arguing that the very factors that gave rise to our economic success also contained elements that contributed to democratic underdevelopment or even backtracking, marked by dysfunctionality of political institutions with negative spill-overs on the society at large through sporadic uncontrolled outbreak of extremist violence. In taking this long term view, it specifically focuses on the “structure-agency” framework whereby the main actors of economic development also shape the nature of political subjectivity.

For the purposes of this essay, the term “upper class” denotes the governing class and consists of the political elite, the higher echelon of the business class, the top government functionaries and NGO leaders, and the upper crust of military bureaucracy. The term “middle class” refers to routine business and factory owners, self-employed family entrepreneurs, English-educated salaried workers, managers, teachers, doctors, engineers and other professionals, medium level NGO functionaries, as well as civil society think-tanks and opinion makers. This is in contrast to the “lower class” which consists of peasants, industrial workers, day laborers, transport workers, petty commodity producers, and in general diverse mix of subaltern and marginal social groups.

2. “Poor” Economics

Abhijit Banerjee and Esther Duflo in their influential book “Poor Economics: A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty” explored the micro institutional arrangements that benefit the poor most and drew our attention to the choice that policy makers have in designing pro-poor programs and plans. Their phrase “poor economics” is borrowed here to exemplify a path of economic development which rests primarily on the productive use of relatively unskilled labor, resulting in their rapid economic mobility and quality of life improvements. This is “poor” economics because it works well for the poor both as beneficiaries and actors as opposed to a path of development–which can be termed “non-poor” economics–where the main actors and beneficiaries are the middle class and the rich. The uniqueness of Bangladesh’s development that drew global attention is the way poor economics worked particularly well for the poor, resulting in a rapid movement out of poverty within a short span of time with commensurate improvements in social indicators and/ or human development.

The basic narrative of Bangladeshi economic successes is well known, but like most stories of success it can be told differently. “Seeing like the poor” would mean tracing how these economic successes impacted the economic lives of the poor. The four main economic drivers of growth and development in the past two decades have been improvements in agriculture, rural non-farm sector, export led industrialization and remittances. Bangladesh’s efforts in giving impetus to its poor through these four economic drivers was supported by simultaneous social investments in basic health and human development, such as providing decent coverage of preventive health care and primary through secondary education, especially for the female population and the poor. Without the latter, the poor’s participation in those sectorial drivers would not have been successful – for example, exposure to basic literacy and primary education is required for an average female laborer to participate in the ready-made garments (RMG) sector.

While agriculture and rural non-farm sector were the mainstays of development in the 80s and 90s, beginning with the 2000s, export led industrialization and foreign remittances began to play a more prominent role. Rise in agricultural productivity freed up surplus farm labor for non-farm jobs and resulted in rapid internal migration to cities, a development that was supported by export growth and a mode of urbanization where construction sector growth was backed up by remittance. This process of transformation is mentioned elsewhere by the author in a collaborative paper with Mahabub Hossain and Yasuyuki Sawada for the WDR 2013 for Jobs. The truly striking facet in this story of transformation is the crucial role of relatively unskilled labor, noticeably including female labor from the 2000s onwards, in the agriculture, rural non- farm, export led industries, and construction sectors.

This has resulted in the economic ascent of relatively unskilled labor — the poor and the poorest — along the poverty and human development ladder. The mystery of the success in meeting the MDGs at a relatively low level of income, for which Bangladesh is so applauded at home and abroad, lies herein. Bangladesh’s development irrespective of political regimes and ideological orientations cannot be understood merely by looking at macro growth figures – it requires close examination of micro statistics of the ascendancy of the poor across the four main drivers previously mentioned.

While this story is well known to close economic observers of Bangladesh, less discussed is the impact of “poor” economics on other aspects of economic, social and political lives. The virtual lack of rapid and mass public transport in urban areas is one of the most striking economic expressions of inadequacies of democratic culture in Bangladesh. The poor simply lacked the citizen voice to demand decent public transport both in terms of intra-city travel and inter-city connectivity. The absence of citizen voice has been a general problem afflicting the entire range of public services. Had the middle class been the driving force of economic development, the likelihood is that it would have been more successful in extracting better quality public services from the state. In most countries of the world there is a broad correlation between the level of middle class activism and the development of urban transportation. A cursory comparison of the capitals of the two Bengals, Kolkata and Dhaka, illustrates this point well with the former enjoying far greater choices of public transport services. In all advanced democracies where the middle class remains an influential voting constituency, the creation and/or maintenance of a decent and inclusive public transport is regarded as a political good.

The corollary question is why the voices of the non-poor have also not been strong enough to extract better quality public services in Bangladesh? Given the faster poverty reduction in the last two decades, with the poverty headcount declining from approximately 62% in 1991/92 to 32% in 2010, one might have expected a significant qualitative change in the supply of public services. This has not happened because of two factors, one economic and the other sociological. Rapid moving out of poverty was not matched by an equally rapid increase in the population share of the middle class since there is an analytical gap between crossing the poverty line and becoming part of the middle class. Recall that the non-poor is a mixed category comprising of vulnerable non-poor (those in the vicinity of $1.25-2 line), lower middle class ($2-3 line), upper middle class ($3-4 line) and upper class (above $4 line). This article deliberately deviates from the internationally suggested definition of measuring middle class as being in the range $2-10 line because of the low average income of Bangladeshis. In the last two decades, of those who escaped poverty very few entered into the stratum of upper middle class, but instead most of them found themselves in the vulnerable non-poor and lower middle class categories. Swelling in the ranks of specifically these two categories is one reason why poverty reduction was not translated into improved quality of public services measured in terms of broad-based access, beneficiary satisfaction, significant impact, and low corruption. However, the issue is not only the relatively small size of the upper middle class. The middle class is not just an economic category but also a sociological category. The core of the middle class was classically defined by the English-educated workers and those employed in salaried jobs. The proportion of workers with English education (loosely defined as educated above class 10) and salaried jobs has increased much less dramatically than the rate of poverty reduction, thus effectively explaining the smaller traction of the sociological middle class with regard to improvement of public services and the democratic politics of public goods provisioning.

From the view-point of public economics, the issue of distributive justice is an important consideration in explaining the quality of growth and development. Successful democracies cannot afford to ignore the issue of distribution even from the electoral angle of winning over the “median voter”. Bangladesh has been experiencing sharp rises in inequality of income and assets over the last two decades. But, equally striking has been the simultaneous increase in the “tolerance for inequality”. Here too poor economics played a role of crucial difference. In a sense, the success of poor economics came as part of a Faustian bargain. While poverty was reduced, inequality in the distribution of income, assets and power rose sharply. It can be argued that the latter was an outcome of an attitude of political permissiveness towards corruption. Inequality of unearned incomes is likely to be higher than the inequality of earned incomes. It is likely that inequality of unearned income sustained by corruption and violation of legal norms–rather than human capital and skill based differences in income and asset acquisition—has fueled this sharp rise of inequality in income and assets. Widespread media coverage of the wealth statements of the ruling coalition candidates that were submitted to the Election Commission in the recent January 2014 election indicates that possibility. This has possibly been a reflection of the wider pattern of the accumulation process that underpins the formation of upper class and upper middle class. Such a process of wealth accumulation and the causal role of illegal incomes are likely to be captured inadequately in the HIES data, thus misleading the true extent of worsening ground realities in this respect.

The ultimate consequence of sharp rise in inequality was the diversion of focus of the politically influential upper and upper middle classes from improving the public services by holding the state actors accountable. Inequality enabled these privileged classes to rely more on private exclusive services (such as private transport, private security services, private clinics, and private schools) to form an enclave of their own with little traction with the system of distribution of public services.

Nevertheless, such elitism in the Bangladesh context was different from similar situations in Africa in that it also permitted a considerable degree of economic mobility for the poor. This helped to mitigate the bite of inequality on social peace and stability to some extent. Essentially, the poor did not object to the unprecedented concentration of economic power so long as they could also improve their fortunes. Politically, such an appeasing “class compromise” translated into subservient acceptance of the low quality of political culture. Such a class compromise on the part of the poor was, in turn, additionally rewarded by the governing coalition through implementing anti-poverty programs. The latter include social protection transfers and basic human development programs that benefited the poor families. Admittedly, such programs were not successful in equal measures between the poor and the poorest, rural and urban areas, and between ethnic majority and minority identities.

To summarize, in this implicit social contract, the poor benefit but the middle class and upper class benefit much more on the backs of the poor. Tolerance of such inequality will depend on the durability of success of this covenant. As long as this basic compact holds on, the poor economics shows a path of development that is much better than economic stagnation with worsening poverty along with exclusive reliance on a wasteful rent-seeking path of development. The sustenance of Bangladeshi democracy, up till now, rested on the political marketing of this covenant. The next section will argue that the success of this compact also contains elements that undermined itself, as reflected in political culture.

3. “Poor” Politics

Poor economics had significant footprints on the entire ensemble of relations that contribute to the low quality of political culture: the choice of political candidates, the relationship between the major political parties, the degree of inner-party democracy, the pattern of personal loyalty to the leaders and leader-worship, the rhetoric of political leaders, and, in general, the level of political discourse. Democratic mimicry is apparent in all of these.

The process that contributed to the low quality of public services in Bangladesh, as described in the previous section, is equally applicable to the production of low quality political governance. As long as the political class regarded the poor to be the median voter, the leaders did not feel enough electoral pressure to change the existing political and administrative practices both within the party and within various branches of the state. This is paradoxical since rapid poverty reduction in the last two decades also meant that a typical median voter now would actually be a potentially demanding non-poor (the new class of “movers” out of poverty). Nevertheless, the basic power equation underlying the political economy of public policy has not varied. This is because the new median non-poor voter still does not represent the electoral power of the middle class and is likely to be a representative of the vulnerable non-poor variety, lacking economic and political allies. Furthermore, his demands and psychology do not vary significantly from those of the poor voter. As a result, even though the country’s political scene has witnessed the practice of democratic mimicry for the last two decades, the procedural practice by itself did not lead incrementally to desired democratic transformation. The latter seems to be a tall order to attain for poor economics.

Not only has the social dynamics, seen through the angle of changing profile of the median voter, failed to create sufficient political pressure for political reform, it may have become an excuse for the political leaders to evade and postpone institutional changes that are being demanded of them. For example, the need for modernization in politics—campaign finance reform and inner-party democracy for instance–has been indefinitely postponed by invoking the argument that such reforms while desirable are not practical given the stage of economic development. This political underdevelopment was not addressed by the prevalent strategies, articulated in the global discourse, which focused instead on basic needs in the 1970s, structural adjustment in the 1980s, and MDGs in the 1990s. These strategies, while vastly different, nevertheless operated within a narrow definition of development and did not give equal priority to easily monitorable political indicators along with economic and social indicators. This further reduced the compulsions to improve political culture. Instead, the focus of politics and politicians turned towards appealing to the lowest common denominator of the population, thus preventing a higher level of political discourse corresponding to the standards of the sociological middle class.

The failures of the poor and vulnerable non-poor in this regard are perhaps understandable, but why was the middle class not able to change political culture? The small size of the middle class segment cannot be invoked as an adequate explanation here. In the 1960s, the Bengali middle classes could provide political leadership during the national liberation movement, even though it was proportionately smaller then than it is now. Why then is the comparatively larger middle class now incapable of effecting political reforms? After all, the share of the economic middle class has increased from about 8% to 19% between 1991/92 and 2010 (according to author’s estimates using the Chen-Ravallion line for middle class). Back in the 1960s, the newly formed middle class or the vernacular elite were the children of peasants and the consequent national liberation movement drew on the resources of a deeply peasant Bengali nationalism, which had broad based national appeal. This is no longer the case. The urban middle class is now distant from the peasant mode of economic and cultural lives. They may walk on the streets of Dhaka but actually feel more at home in living in the global village of the advanced countries. A vast Bangladeshi diaspora continues to feed the dreams and aspirations of this class. In short, formation of economic middle class per se does not mean the growth of political middle class willing to fight for the modernist ideals of political democracy. In addition, the middle class has also been a beneficiary of the system of poor economics, especially through urban property development, exports and remittances, and enjoyed their share of the spoils of corruption and rent-seeking. Ultimately, this has subdued and defused their reformist potential to take on both parties of the political equation–the government and the opposition alliance–even on basic libertarian issues such as political repression by the state and opposition violence against ordinary citizens, including ethnic and religious minorities. A recent telling example is the inability of the business class to enforce discipline on the political process even at the cost of their own financial interests. Arguably, the democratic activism by the middle class would have been more likely in the context of economic decay. This has been a central thesis of Benjamin Friedman in his book “The Moral Consequences of Economic Growth”. On the other side, the political class could easily disregard the demands of the middle class because political leaders are aware of and rely significantly on the support of the lower class when it comes to electoral democracy.

Perry Anderson once noted that the economic causes underlying the dynamics of Tahrir Square movement were linked with vast educated unemployment along with rural distress. The Bangladesh scenario has been different (so far) from that context because of the success of poor economics, as discussed in the preceding section. This description should not mean that the members of the lower class have no agency of their own against the profit, power and privileges of the upper class. In fact, in the past two decades the members of lower class have repeatedly demonstrated their agency by replacing one party by another in successive elections but stopped short of demanding a higher quality of political representation. Their surprisingly enthusiastic turnout in past elections under the guise of festive participation can then be interpreted also as a subversive activity of the lower class corrosive to one-party rule. In the West, such subversion has been tamed by the ruling classes, resulting in low voter turnout and political apathy. In our case, participation in elections has been an art of popular resistance. This is the key reason why the people feel so disenfranchised by the prevalence of uncontested seats in the recently held one-sided election.

The sustainability of maintaining this democratic mimicry based on poor economics would be eventually challenged in the process of development. The essay takes a long-term of view on political reforms based on class formation, class dynamics and class action. The dialectics of poverty reduction contains the seeds for such change – as education and literacy increases, the first generation movers out of poverty who have relied on the four economic drivers of poor economics will graduate into the category of English-educated salaried middle class in a more industrialized and urbanized settings. Alternatively, the current middle class could become more active in demanding political change. This evolutionary path of transition from poor economics to middle class economics is not devoid of tensions, slippages, conflicts and revolutions. Studying other countries experiencing rapid poverty reduction under democratic mimicry may hold some useful lessons in this regard but will have to remain a topic for another article.

Binayak Sen is Research Director at the Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS).

সংখ্যালঘু বনাম আত্মপরিচয়ের স্বাধীনতা

প্রথম কিস্তি

আমি কি সংখ্যালঘু? এক অর্থে প্রশ্ন রাখাটাই হাস্যকর। আমার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া নামই বলে দিচ্ছে আমি কী। এ নিয়ে বাহাস করার অর্থই হয় না। তবে বিষয়টা অত সরল না-ও হতে পারে। আজকাল সংখ্যালঘু কথাটার ‘সংখ্যায় লঘু’ এমন একটা কোনো সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সংখ্যায় মেজরিটি হয়েও কেউ কার্যত মাইনরিটি হতে পারে। সারা বিশ্বে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি, শিশুমৃত্যুর হারে অনেক বৈষম্য থেকে যাওয়ার পরেও। তারপরও কি আমরা বলতে পারি যে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ? সংখ্যায় বেশি হওয়ার পরেও সংখ্যালঘুর মতো অধস্তন অবস্থান তাদের। তার মানে ব্যাপারটা শুধু সংখ্যায় (নিউমেরিক্যালি) বেশি-কমের বিবেচনা নয়। মূল প্রশ্নটা হচ্ছে—কে কত বেশি ক্ষমতাবান? নারীরা পুরুষদের চেয়ে এখনো কম ক্ষমতাবান বলেই সংখ্যায় বেশি হয়েও তারা সংখ্যালঘু। সুতরাং সংখ্যায় বেশি-কম যা-ই থাক না কেন, কোনো সামাজিক গোষ্ঠী বা গ্রুপ বা ব্যক্তি ‘ক্ষমতা হারিয়ে’ কীভাবে সংখ্যালঘু ‘হয়ে ওঠে’, সেটিই হচ্ছে প্রথম বিচার্য বিষয়। ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় অনেকেই বলেছেন, নারীরা ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’। যখন আপনি সংখ্যালঘু হয়ে ওঠেন, তখন আপনি নিজেকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ ভাবতে শুরু করেন। জ্যাঁ পল সার্ত্র বলেছিলেন, একজন ইহুদি হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যাকে অ্যান্টি-সেমিটিকরা ইহুদি বলে ডাকে। তাঁর কথার সূত্র ধরে বলা যায়, একজন সংখ্যালঘু হচ্ছে সেই মানুষ, যাকে একজন সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বলে ডাকে, যেমন: ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কোনো ব্যক্তি নিজেকে ‘উপজাতি’ বলে পরিচিত করে না, তাকে ‘উপজাতি’ বলে কোনো বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

সমাজে প্রতিটি ব্যক্তিরই নানা পরিচয় থাকে। কোন পরিচয়ে কে কখন কতটা নিজেকে জাহির করবে, সেই স্বাধীনতাটা সবার সমান নয়। আত্মপরিচয় (আইডেনটিটি) জাহির করার স্বাধীনতা যে সমাজে যত বেশি, সেই সমাজে ব্যক্তির স্বাধীনতাও তত বেশি এবং সেই সমাজও তত বেশি উন্নত। অমর্ত্য সেন তাঁর আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স বইয়ে নিজের বিভিন্ন পরিচয় তুলে ধরেছেন। আমার অক্ষম অনুবাদে তা দাঁড়ায় এমন: ‘আমি একই সঙ্গে হতে পারি একজন এশীয়, একজন ভারতীয় নাগরিক, একজন বাঙালি, যার রয়েছে বাংলাদেশি পূর্বপুরুষ, একজন মার্কিন দেশে বা ব্রিটেনে বসবাসকারী, একজন অর্থনীতিবিদ, দর্শনচর্চায় অনুপ্রবেশকারী, একজন লেখক, একজন সংস্কৃত ভাষায় বিশেষজ্ঞ, সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্রে জোরালোভাবে বিশ্বাসী, একজন পুরুষ, একজন নারীবাদী, একজন “হেটেরোসেক্সুয়াল”, কিন্তু সমকামীদের অধিকারের পক্ষাবলম্বনকারী, যার জীবনযাত্রার ধরন কোনো বিশেষ ধর্মের সঙ্গে খাপ খায় না (নন-রিলিজিয়াস), সে এসেছে হিন্দু সামাজিক পটভূমি (ব্যাকগ্রাউন্ড) থেকে, সে অ-ব্রাহ্মণ, এবং সে বিশ্বাস করে না মৃত্যু-পরবর্তী কোনো জীবনে (আফটার লাইফে), বা এই প্রশ্ন যদি তাকে করা হয়, সে এ-ও বলবে—সে বিশ্বাস করে না কোনো পূর্ব-জন্মেও। এটা হচ্ছে বিভিন্ন আত্মপরিচয়ের একটি ক্ষুদ্র নমুনা-চয়ন, যার প্রতিটাতেই আমি হয়তো একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত—এবং চাইলে এ রকম আরও অনেক পরিচয়ের সদস্য হতে পারি আমি; সবকিছুই নির্ভর করবে পরিস্থিতির বিচারে কোন পরিচয়টা সেই মুহূর্তে আমাকে বেশি টানছে, তার ওপর।’ অমর্ত্য সেনের স্বাধীনতা আছে বিভিন্ন পরিচয়ের মধ্যে লাগসই পরিচয়টা অবস্থাভেদে, পছন্দ অনুযায়ী ও রুচির বিচারে বেছে নেওয়ার। এই ‘বাছাইয়ের স্বাধীনতা’ সবার থাকে না, সব শ্রেণীর থাকে না, সব সমাজে থাকে না।

অমর্ত্য সেন বইটি লিখেছিলেন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে প্রচারিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংঘাত’-এর তত্ত্ব। সংঘাত বলতে পাশ্চাত্য ও ইসলামি সভ্যতার মধ্যে এক মূলগত দ্বন্দ্বের ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন স্যামুয়েল হান্টিংটন ও তাঁর অনুসারীরা। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বরের পরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নানাভাবে পাশ্চাত্যের শত্রু বানিয়ে এই তত্ত্বকে বাস্তবেই কাজে লাগানো হয়েছিল। তারই বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা ও প্রতিবাদ হিসেবে অমর্ত্য সেন ২০০৬ সালে বইটি লিখেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, পাশ্চাত্য ও ইসলামের মধ্যে এই বিরোধ আবিষ্কার ছিল একটি দুষ্ট-পরিকল্পনা। প্রথাগত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর সারা বিশ্বকে এক পরাশক্তির অধীনে আনার ও সর্বত্র আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘সভ্যতার সংঘাত’-এর তত্ত্ব জোরেশোরে অনুসৃত হয়েছিল। কিন্তু অমর্ত্য সেন এই বই লেখার আরও বহু বছর আগে থেকেই আমি আবছা করে বুঝতে পেরেছিলাম, প্রতিটি ব্যক্তিকেই কোনো বিশেষ আত্মপরিচয়ে সমাজ বা রাষ্ট্র বা ধর্ম বেঁধে দিতে পারে না। কোন পরিচয়ে সে নিজেকে কখন পরিচিতি করাতে চায়, সেই ‘বাছাইয়ের স্বাধীনতা’ তার চাই—এটা তার মৌলিক মানবিক অধিকার। এবং সে কারণেই কৈশোর থেকেই কেউ আমাকে ‘সংখ্যালঘু’ বললে আপত্তি করেছি, পারলে প্রতিবাদ করেছি, না করলেও মেনে নিইনি।

এর জন্য আমার পারিবারিক ঐতিহ্যও কিছুটা দায়ী। আমি এখানে কোনো ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার কথা তুলছি না। আমার ধারণা, এ রকম অভিজ্ঞতা আরও অনেকের জীবনেই হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সেটা মনে রেখেই দু-একটি আত্মজৈবনিক তথ্য যোগ করব এখানে। ব্যাখ্যার প্রয়োজনেই এই আত্মকথন—তার জন্য আগেই তত্ত্বজ্ঞ পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার মা ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের মধ্যে তাঁর পরিচয়কে সীমিত রাখেননি। ঈদে বা শবেবরাতের অনুষ্ঠানে নিজে উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করতেন, বাসায় হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে দাওয়াতও দিতেন। উৎসবে বা সংকটে পড়লে মাজারে ‘মানত’ করা ছিল তাঁর সংসারের প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব কিছু ‘ভোকাবুলারি’ ছিল। হাইকোর্টের মাজার ‘গরম পীরের মাজার’, ফলে মাজারের পাশ দিয়ে গেলে হাত তুলে শ্রদ্ধা জানানো চাই। নইলে আধ্যাত্মিক গুরু রুষ্ট হবেন। মিরপুরের মাজার আবার ছিল ‘ঠান্ডা পীরের মাজার’—তিনি দুর্বাসা মুনি নন, সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে দোষ নেন না। আমাদের বাসায় জন্মাবধি দেখেছি নানা সময়ে বিভিন্ন মুসলমান আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন পুণ্যবান ব্যক্তিরা এসেছেন। তাঁদের যথাবিহিত যত্ন করা হয়েছে। ফলে নিজেকে ‘সংখ্যালঘু’ ভাবার কোনো যুক্তি শৈশব থেকেই পাইনি। মা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাতেন—যদি হিন্দু ধর্মে তাঁর অন্তর্ভুক্তিকে ভারতমুখিনতার সঙ্গে সমীকরণ করা হতো। পাড়ার বাজারে পেঁয়াজ কিনতে গেলে যদি বিক্রেতা তাঁকে বলত, ‘দাদি, আপনাদের দ্যাশ থেকে আইছে।’ মা উত্তরে বলেছেন, ‘তাই নাকি, জানতাম না তো সিলেটে আজকাল এসব পেঁয়াজ হচ্ছে,’ এবং তারপরেই তিরস্কার করে বলে উঠতেন, ‘দাদির সঙ্গে ফাজলামি করার আর বিষয় পাওনি, না?’ বিক্রেতা লজ্জিত হতো, ‘না, দাদি, ভুল হয়ে গেছে’—এমনটাই বলত। তিনি বাজারের সবার কাছে ছিলেন ‘সর্বজনীন দাদি’। শুনেছি, মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ শেষবারের মতো দেখার জন্য অনেক লোক তাঁর বাসায় জড়ো হয়েছিলেন, যাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলমান। আমার ধারণা, আমার বাবাও এই মতেরই মানুষ ছিলেন। দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন—অসংখ্য ছাত্র ১৯৫৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সে প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়েছে। মানুষ বড়ই রহস্যময় জীব। আমি মৃত্যুর পরে তাঁকে একবার মাত্র স্বপ্নে দেখেছি, কিন্তু তাঁর পূর্বতন (মুসলমান) ছাত্ররা ও সহকর্মীরা—যাঁরা পরবর্তী সময়ে উচ্চতর পদে আসীন হয়েছিলেন—তাঁকে নাকি অনেকবারই স্বপ্নে দেখেছেন এবং সদা-হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবিতে দেখেছেন। তাঁরা ফোন করে বা দেখা করে আমাকে তা বলার তাগিদ অনুভব করেছেন। আমি পারমার্থিক বিষয়ে নিবিষ্ট নই, কিন্তু আমার শুধু বলার কথা—হিন্দু-মুসলমান আত্মপরিচয়ের বিভিন্নতা সেখানে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। ফলে আমার পক্ষে, নিজেকে ‘সংখ্যালঘু’ ভাবা কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

দ্বিতীয় একটি কারণও ছিল। আর সেটা মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। আমার বাবা অধ্যক্ষ বি বি সেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সংগঠকের ভূমিকায়। প্রবাসী বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ১৯৭১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন সমগ্র নর্থ-ইস্ট সেক্টরের ‘এডুকেশন অফিসার’ হিসেবে। শিলংয়ে সে সময় বাংলাদেশ সরকারের একটি অস্থায়ী কার্যালয় ছিল। কাজটা ছিল রিলিফ ও মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের পরিচালনার কাজে অংশ নেওয়া। ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঢাকায় প্রবেশ করেন। তারপর আবার ফিরে গেছেন তাঁর পূর্বতন কর্মক্ষেত্রে অধ্যক্ষ হিসেবে। এ দেশে বীরাঙ্গনাদের প্রথম কারিগরি প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১৯৭২-৭৩ সালে তাঁর পরিচালিত প্রতিষ্ঠানেই। মুজিবনগর সরকারে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা সবাই নাকি একটি করে ‘প্রমোশন’ পেয়েছিলেন। সেদিক থেকে তিনি ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তবে স্বীকৃতি বা পদোন্নতি নিয়ে তাঁর মনে কখনো ক্ষোভ ছিল না। এই না-পাওয়াটাকে তিনি তাঁর ‘সংখ্যালঘু’ পরিচিতির সঙ্গে কখনোই যুক্ত করেননি। দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। একবার পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যার মুখে। সেবার পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার তাঁর পাকিস্তানি বস-এর ছোট ভাই হওয়ায় তিনি প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। আরেকবার এই স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কোনো অব্যাখ্যাত কারণে ১৯৭৫-এর নভেম্বরে, সেনা-অভ্যুত্থানের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে (বর্তমান লেখকসহ)। এই গ্রেপ্তার ছিল ভুল-বোঝাবুঝির, গ্রেপ্তার এবং যাঁরা এটা করেছিলেন তাঁরা পরবর্তী সময়ে তাঁদের উপাত্তগত ভুল বুঝতে পেরে অত্যন্ত বিব্রতবোধ করেছিলেন। সে রকম শুনেছি। তবে আমার গর্বের ব্যাপার যে আমার বড় ভাই ছিলেন একজন লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা। মুজিববাহিনীতে নয়, সে সুযোগও তাঁর ছিল। তিনি সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে (এফএফ) যোগ দেন ৪ নম্বর সেক্টরে। জানের তোয়াক্কা না করে তিনি যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁকে আমরা সারা শরীরে জোঁকে-খাওয়া অবস্থায় দেখতে পাই নয় মাস যুদ্ধের পরেই। কিছুদিন ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার দায়িত্বপূর্ণ কাজেও ছিলেন, কিন্তু তদানীন্তন নেতৃত্বের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৭৪ সালেই ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি নেন। সেটাও (পরে শুনেছি) স্বাধীনতার পরে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা একজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতার মুখ গলে তাঁর কানে এসে পৌঁছেছিল, বা এমনই কিছুর প্রতিবাদে। এরপর বাদবাকি জীবনটা প্রায় প্রবাসেই কাটালেন কোনো প্রবল অভিমান বুকে নিয়ে। এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের গর্বিত সদস্য হিসেবে ‘সংখ্যালঘু’ আত্মপরিচয়টা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মতো আমারও আপত্তির যথেষ্ট কারণ ছিল ও আছে।

তৃতীয় একটি কারণও রয়েছে, তবে সেটা মোটামুটি প্রকাশ্যেই ধারণ করে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং কালক্রমে কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলাম। ফলে নিজেকে ‘সংখ্যালঘু’ ভাবার কোনো কারণ ছিল না, কেননা পার্টিতে মণি সিংহ বা মোহাম্মদ ফরহাদ, জিতেন ঘোষ বা হাতেম আলী, মণিকৃষ্ণ সেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজয় রায়, মতিউর রহমান বা মনজুরুল আহসান খান—এসব নামের মধ্যে কোনো সম্প্রদায়গত বিবেচনাবোধ কখনোই মনে স্থান পাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। আমার প্রথম ও প্রধান আত্মপরিচয় ছিল—আমি সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রের প্রগতির পক্ষের লোক। আমাকে ‘সংখ্যালঘু’ বললেই (বলতে পারেন অনেকেই) আমি তা মানব কেন? ঠিক একইভাবে, পারিবারিক দিক থেকে একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়ার কারণে আমার স্ত্রীও (যতই তাঁকে বোঝানো যাক) নিজেকে এখনো ‘সংখ্যালঘু’ বলে ভাবতে চান না বা পারেন না।

মোট কথা, অমর্ত্য সেনের দার্শনিক গ্রন্থটা পড়ার আগে থেকেই আমি বুঝতে শিখেছিলাম যে বিভিন্ন আত্মপরিচয়ের মধ্যে কোন পরিচয়টা কখন কী পরিমাণে আমি জাহির করব, সে স্বাধীনতাটা আমাকে দেওয়া দরকার বা আমার অর্জন করা দরকার। কিন্তু এসব কথা আমি বাঁশখালীর ওই সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া মাতৃসমা নারীটিকে বোঝাব কী করে? বস্তুত, আমি তাঁকে সংখ্যালঘুও বলতে চাইছি না। তাঁর পরনের পোশাক, তাঁর ঘর-গৃহস্থালি, তাঁর পরিবেশ-প্রকৃতি আমাকে বলে দিচ্ছে, অন্য কোনো শব্দবন্ধ প্রযুক্ত হওয়া দরকার এ ক্ষেত্রে। আমি তাঁকে অনন্যোপায় হয়ে বলছি—তিনি আসলে অতি-সংখ্যালঘু।

দ্বিতীয় কিস্তি: অতি-সংখ্যালঘুর ওপরে আক্রমণ: প্রচলিত ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা
বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক।