বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৪

পূর্বে প্রকাশিতের পর
অর্থাৎ, নারী-পুরুষ, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমান কর্মের জন্য অসমান পারিশ্রমিক সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। এখানে এসডিজির ৫নং লক্ষ্যমাত্রা (Gender Equality) এবং ৮নং (Decent Work & Economic Growth)-এর সাদৃশ্য দৃশ্যমান।
বাহাত্তরের সংবিধানের অতিগুরুত্বপূর্ণ ২০নং ধারা নিয়ে আরও কয়েকটি কথা যোগ করা দরকার। ২০নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারার ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’- এই নীতি কোন সূত্র থেকে আহরিত হয়েছিল? ইংরেজি পাঠে এই নীতিটিকে লেখা হয়েছিল এভাবে :
everyone shall be paid for his work on the basis of the principle ‘from each according to his abilities, to each according to his work’.

প্রত্যেকে যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হবেন এবং প্রত্যেকে যে যার কর্ম/শ্রম/অবদান (work/labour/contribution) অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবেন- এই বণ্টন নীতি এলো কোথা থেকে? এই বণ্টন-সূত্রের পেছনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রভাব এসেছিল, সন্দেহ নেই। তার মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সমাজতান্ত্রিক চিন্তার দীর্ঘ ঐতিহ্য, যা বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল পাশ্চাত্যের সমতাবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্রে স্থাপিত করে। কথাটা কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি করে।
যোগ্য/সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও কাজের পরিমাণ/গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়াকে সমাজতান্ত্রিক বণ্টন নীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। এ নিয়ে বিতর্কাতীতভাবে ঐকমত্য বিরাজ করছে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি-তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের মধ্যে। এবং এ বিষয়ে আলোচনা উঠলে প্রথমেই সবাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন কার্ল মার্কসের জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত রচনা ‘ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম’ লেখাটির প্রতি। ১৮৭৫ সালের এই লেখাটিতে মার্কস ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী সমাজের দুই স্তরের প্রতি ইঙ্গিত করেন (পরবর্তীকালে, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থের ৫ম অধ্যায়ে লেনিন ১৯১৭ সালে একে গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্নেষণ করেন)। প্রথম বা নিচের স্তরে সমাজ যখন কেবল পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হতে শুরু করেছে- তখন আয়-উপার্জনের প্রধানতম উৎস হবে শ্রম-সূত্রে প্রাপ্ত আয়। এই সমাজে আয়-বণ্টন নির্ধারিত হবে যথাসাধ্য সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং শ্রমের পরিমাণ ও গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার নীতির মাধ্যমে। শ্রম বলতে এখানে শুধু কায়িক শ্রমের মজুরদের বোঝানো হচ্ছে না। এখানে মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের সঙ্গে জড়িত ‘হোয়াইট কলার’ শ্রমিক প্রাতিষ্ঠানিক তথা সেবা খাতের কারিগররাও অন্তর্ভুক্ত। সৃষ্টিশীল শ্রমের শিল্পীরাও এখানে রয়েছেন। এই প্রথম স্তরের সমাজটিকেই সাধারণত ‘সমাজতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এ ধরনের সমাজেও আয়ের বণ্টনে অসমতা থাকবে, কেননা প্রত্যেকের কাজের সামর্থ্য, পরিমাণ ও কাজের গুণাবলি (উৎকর্ষতা, উপাদনশীলতা, দক্ষতা) সমান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ ধরনের সমাজে শ্রমজনিত পার্থক্য সূত্রে যেটুকু আয়-বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তা পুঁজিবাদী সমাজের আয়-বৈষম্যের চেয়ে অনেক কম হওয়ার কথা। এর কারণ, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রম ছাড়াও শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানা-পার্থক্যের কারণেই অনেক আয়-বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। উদাহরণত, অনেক বেশি জমি থাকার কারণে কোনোরূপ শ্রম না দিয়েও কেউ ওই জমিকে কেবল ভাড়া খাটিয়ে অনেক আয় করতে পারেন। যেটা একজন ভূমিহীন চাষির পক্ষ করা সম্ভব নয়; তার পক্ষে মজুরি-শ্রমের কাজে নিয়োজিত হয়েই কেবল উপার্জন করা সম্ভব। একই ভাবে, একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে নিয়মিত পরিশ্রম করেই আয়-উপার্জন করতে হয়। কিন্তু একাধিক গার্মেন্টস কারখানার মালিক যিনি তাকে হয়তো তার ফ্যাক্টরিতে কোনো শ্রম না দিয়েই বা সামান্য শ্রম দিয়েই শুধু মালিক হওয়ার কারণেই অনেক বেশি আয় করা সম্ভব। শুধু কৃষি জমি নয়, অন্যান্য সম্পদ ভাড়া খাটিয়েও-এবং তেমন কোনো প্রত্যক্ষ শ্রম বা তদারকি শ্রম না করেও- অনেক আয় উপার্জন করা সম্ভব, যাকে আমরা ‘ভাড়াজীবী আয়’ (Rentier Income) বলতে পারি। গত এক দশক আগে আমি একজনকে চিনতাম, যার ঢাকা শহরে ৬৫টির মতো ফ্ল্যাট ছিল। এখন হয়তো তার ফ্ল্যাটের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এসব ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে এবং তেমন কোনো প্রত্যক্ষ শ্রম করা ছাড়াই সেই লোক প্রতি মাসে অনেক আয় করে থাকে। আমাদের দেশে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার বিষয়টি এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক কথায়, ‘প্রোপার্টি ইনকাম’ আয়ের একটি প্রধান উৎস এ ধরনের সমাজে। তবে এখানে দুটো ফুটনোট রাখা দরকার। প্রথম ফুটনোটটি হলো, এমন কোনো ধারণা পোষণ করা উচিত নয় যে পুঁজির মালিক কেবলই ভাড়া খাটিয়ে বা অন্যকে দিয়ে মজুর খাটিয়েই আয়-উপার্জন করে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এদের একটা অংশকেই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় নামতে হয় বা নতুন কোনো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে অবলম্বন করতে হয়। এর জন্য তাকে সময় সময় ঝুঁকি নিতে হয়, যথেষ্ট উদ্ভাবনী শ্রমও ব্যয় করতে হয়- যাকে আমরা এক কথায় শিল্পোদ্যোক্তা  (entrepreneurship) ফ্যাক্টরের ‘অবদান’ বলতে পারি। মার্কসও এটা প্রকান্তরে স্বীকার করে গেছেন নতুন প্রযুক্তি ও নতুন প্রোডাক্টের উদ্ভাবনের মাধ্যমে সাময়িককালের জন্য হলেও ‘surplus profit’ আহরণের সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে।
দ্বিতীয় ফুটনোটটি হলো- এরকম ধারণা আঁকড়ে ধরে রাখা উচিত নয় যে, সমাজতন্ত্রের নাগরিকেরা শুধু আয় করতে পারবেন কাজ করারই সুবাদে। শ্রমবহির্ভূত অন্যবিধ আয়েরও সুযোগ রয়েছে তাদের।Democratic Propertied Income স্কুলের চিন্তকেরা এরকম প্রস্তাব দিয়েছেন যে, সামাজিক মালিকানার অংশ হিসেবে প্রতিটি নাগরিকই রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার capital stock থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘ডিভিডেন্ড আয়’ লাভ করতে পারবেন। আর সমবায়ী মালিকানার ক্ষেত্রে প্রতিটি সমবায়ের সদস্য তার সমবায়ের পুঁজি খাটানো বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘ডিভিডেন্ড আয়’ লাভ করতে পারবেন। মার্কেট সোশ্যালিজমের প্রবক্তা জন রোমার  (Roemer) যে ‘কুপন সোশ্যালিজম’-এর প্রস্তাব করেছিলেন তা ডেমোক্রেটিক propertied income-এরই একটি নির্দিষ্ট সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। এসব চিন্তা শুধু ইউটোপিয়ান জল্পনা-কল্পনা নয়। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে যখন শিল্পায়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে প্রবল জনঅসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, তখন ২০০৮ সালের দিকে ইকনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় বেশ কিছু খ্যাতনামা বাঙালি অর্থনীতিবিদ একত্রে একটি রচনায় প্রস্তাব রেখেছিলেন যে, এই উদ্যোগের ফলে যারা জমি হারাবেন তাদেরকে তাদের জমিতে স্থাপিত কল-কারখানার ‘ইকুইটি-মূলধনের’ অংশীদার করা হোক। তাতে করে তারা (এবং তাদের উত্তর পুরুষেরা) সেই ইকুইটি মূলধনের ওপরে ‘মালিকানা বাবদ’ নির্দিষ্ট পরিমাণে ডিভিডেন্ড ইনকাম পাবেন। পরবর্তীকালে, একই ধরনের প্রস্তাব রেখেছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের জন্য। পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের মজুরি এমনিতেই বেশি নয়, তার কারণ এই শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হয়। যার জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মজুরি দেওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। এই অবস্থার কিছুটা নিরসন ঘটে যদি উপরোক্ত শিল্পসমূহে ইকুইটির অংশীদারে পরিণত করা যায় ওই নারী শ্রমিকদের। এর ফলে তাদের আয়ের দ্বিবিধ উৎস হতে পারে শ্রম সূত্রে প্রাপ্ত আয় ও শ্রমবহির্ভূত ইকুইটি সূত্রে মালিকানা বাবদ প্রাপ্ত আয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শ্রম-অনুযায়ী পারিশ্রমিকের পাশাপাশি পুঁজির মালিকানার অংশীদার হিসেবে ডিভিডেন্ড ইনকামের লাভের সুযোগ যৌক্তিকভাবেই নিহিত হয়েছিল। Democratic Propertied Income-এর ধারণা নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে টমাস পিকেটি, এন্থনি এটকিনসন প্রমুখের লেখায়। আজকে যে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (UBI)-এর ধারণা জোরেশোরে সর্বত্র স্বীকৃত হচ্ছে তারও পেছনে রয়েছে সমাজের নাগরিক হিসেবে Social Product-এর অংশীদার হিসেবে প্রত্যেকেরই নূ্যনতম আয় পাওয়ার অধিকারের দাবি। UBI সকলই পাবেন- তা তিনি শ্রম করুন বা নাই করুন। UBI-এর মতো সর্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত মানের ও সুলভ মূল্যের গণপরিবহন ব্যবস্থা শ্রম সূত্রের বাইরে প্রাপ্তব্য আয়ের উদাহরণ মাত্র। এসব উদাহরণ শুধু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘নাগরিক’ হওয়ার জন্য বাড়তি আয় উপার্জনের (বা ব্যয় সাশ্রয়ের) সুবিধা পাওয়ার অধিকারবোধকে ইঙ্গিত করে। এ ধরনের সুবিধার যতই সম্প্রসারণ হচ্ছে ততই যেন এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে যে, মানুষকে শুধু শ্রমিক হিসেবে দেখার আগে তাকে প্রথমে ‘পূর্ণ অধিকার বিশিষ্ট নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। UBI, সর্বজনীন চিকিৎসা, সর্বজনীন শিক্ষা, সর্বজনীন সুরক্ষা, সর্বজনীন গণপরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি শ্রমের পরিমাণ ও গুণের ওপর নির্ভর না করে মানুষের ‘চাহিদার’ ওপরে নির্ভর করবে। এছাড়াও আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম ও বিনোদনের অবকাশ পাওয়ার অধিকারের কথা। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের ব্যবস্থা থেকে ইতোমধ্যেই বর্তমান বিশ্ব ‘সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও চাহিদা অনুযায়ী বণ্টনের’ ব্যবস্থার দিকে চলা শুরু করেছে। এই উত্তরণ সবচেয়ে বেশি সার্থক হয় যখন (ক) সমাজ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উচ্চস্তরে পৌঁছায় এবং যখন (খ) সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সর্বস্তরে সম্প্রসারিত হতে থাকে। এই স্তরকেই মার্কস নতুন সমাজের দ্বিতীয় ও উচ্চতম স্তর তথা সাম্যবাদী সমাজ বলেছেন। Ability/Labour স্তর থেকে Ability/Need স্তরে সমাজের এই ক্রমান্বয় কিন্তু অবধারিত বিকাশকে স্বীকার করে নিয়েই বাহাত্তরের সংবিধানের ১০নং অনুচ্ছেদের Just and egalitarian socity
এবং ২০ নং অনুচ্ছেদের Principle ‘from each acording to his abilities to each acording to his work’ এর বিধান সংযোজিত হয়েছে- এটা মনে রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত অর্থনৈতিক দর্শনের প্রেক্ষিতে দুটো অভিযোগের কথা তুলতে চাই। একটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘বামপন্থী’ অবস্থান থেকে; আরেকটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘ডানপন্থী’ অবস্থান থেকে। ‘বামপন্থী’ অভিযোগের মর্মার্থ হলো, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৫নং ধারার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’, ১৭নং ধারার ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’, ১৮নং ধারার ‘জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা’, ১৯নং ধারার ‘সুযোগের সমতা’ এবং ২০নং ধারার ‘কর্মের অধিকার ও সম্মান’ এসবই সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূলনীতি’র অধ্যায়ে সন্নিবেশিত কেবল। এইসব ‘ভালো ভালো’ কথাগুলো সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে স্থান পায়নি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে স্থান পেলে এসবের বাস্তবায়নের পেছনে রাষ্ট্রের সচেষ্ট দায়বদ্ধতা থাকত। বঙ্গবন্ধু (ও তার নিকটতম সহকর্মীরা) এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। পাল্টা যুক্তি তারা দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালেই- গণপরিষদে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন। তাদের যুক্তি ছিল, ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে যেসব অধিকার দেওয়া আছে সেগুলোর আশু বাস্তবায়ন না ঘটলে বা ব্যত্যয় ঘটলে তার জন্য নাগরিকেরা অবিলম্বে কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি সুবিধা সকলের জন্য আশু-ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চিত করার সম্ভব নয় বলেই এসব উন্নয়ন-ধারাকে রাষ্ট্রের ‘মৌলিক নীতিমালার’ ভেতরে রাখা হয়েছে ‘ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নযোগ্য অধিকার’ হিসেবে, বা যাকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেছেন- ‘progressively realizable rights’। প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির সাথে সাথে রাষ্ট্রের ব্যয় বরাদ্দের সক্ষমতা বাড়তে থাকলে এসব অধ্যায়কে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা সহজতর হবে।
এবারে আসি ‘ডানপন্থী’ অভিযোগের বিষয়ে। ইতোপূর্বে আমি বলেছি, বঙ্গবন্ধু তার ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’কে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাননি। এরিক ওলিন রাইট (wright) দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা ভিত্তিক ব্যবস্থা হচ্ছে একটি রাষ্ট্রতন্ত্র (statism)-এটি সমাজতন্ত্র নয়। সমাজতন্ত্রের মূল সারবস্তু হচ্ছে সমাজ ও সমাজের স্বার্থে অর্থনীতি পরিচালনা করা-সেখানে সমাজই মুখ্য। রাষ্ট্র মুখ্য নয়। এ চিন্তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ভাবনার বিরুদ্ধে সমাজনির্ভর ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় (যেটি রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’ পর্বের চিন্তাতেও দেখতে পাই)। [ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


কিন্তু দেখা গেল এই ঘোষণার পরেও দরিদ্র শ্রেণি থেকে আসা এবং অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠী সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারল না। সামরিক দক্ষতা অর্জনের জন্য শারীরিক সক্ষমতা ও পারঙ্গমতা একটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ- যেটা অপুষ্টি ও অসুখে ভোগা জনগোষ্ঠীর পক্ষে অর্জন করা স্বাভাবিকভাবেই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে সুযোগের সমতা নীতি ঘোষণার আগে ও পরে সামরিক বাহিনীতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ করাকে নিশ্চিত করা গেল না। বাহিনীটি মূলত অবস্থাপন্ন শ্রেণি বা গোত্রের মধ্যেই সীমিত হয়ে থাকল। বার্নার্ড উইলিয়ামস এখানে যে উদাহরণ টেনেছেন তা একেবারে বিরল নয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ দমনে পাঞ্জাবের যোদ্ধা-শ্রেণিকে ব্যবহার করা হয়েছিল দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের নানা এলাকায়। এর পুরস্কারস্বরূপ সেন্ট্রাল পাঞ্জাবে সেনা সদস্যদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধরনের ভূস্বামী তথা সামরিক শ্রেণি বা গোত্রের জন্ম হয় পাঞ্জাব প্রদেশে ঔপনিবেশিক পরিচর্যায়। এই শ্রেণিটিই পরবর্তীতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে দেশভাগের পর থেকে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। সমাজতাত্ত্বিক হামজা আলাভী এদিকটির প্রতি দৃষ্টিপাত করেছিলেন। এখনও সেন্ট্রাল পাঞ্জাবের অবস্থাপন্ন ঘরের এক ভাই যায় কৃষি ব্যবস্থাপনায়, আরেক ভাই যায় সামরিক বাহিনীতে এবং অন্য কোনো ভাই যায় বেসামরিক সরকারি চাকরিতে।
শিক্ষা, চিকিৎসা ও চাকরি ক্ষেত্রে ‘সুযোগের সমতা’ ঘোষিত হয়ে আসছে প্রায় প্রতিটি দেশেই। বিলেতে-আমেরিকায় বিভিন্ন করপোরেট সেক্টরের বিজ্ঞাপনে এখন লেখা থাকে ‘আমরা সুযোগের সমতার নীতিতে বিশ্বাসী’। কিন্তু সমস্যার গভীরে না পৌঁছানোর কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সুযোগের সমতার নীতি পর্যবসিত হয় ‘প্রতীকী সমতার’ নীতিতে। যাকে সমতার সাহিত্যে বলা হয়েছে  formal equality of opportunity বলে। এর বিপরীতে ন্যায়বাদী দার্শনিকেরা প্রস্তাব করেছেন ‘প্রকৃত সমতা’ বা  substantive equality of opportunity-র কথা। এবং খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে বাহাত্তরের সংবিধানে প্রতীকী সমতা নয়, প্রকৃত সমতার কথাই বোঝানো হয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে ১৯নং অনুচ্ছেদের ২নং ধারা, যেখানে অবস্থাজনিত কারণে সৃষ্ট অসাম্যকে দূর করার জন্য সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি প্রণিধানযোগ্য :
‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষা, চাকরি এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুযোগের ‘প্রকৃত সমতা’ অর্জনের চ্যালেঞ্জটি আরও ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করা দরকার। কতটুকু বৈষম্য আমরা স্বীকার করে নিতে পারি? নৈয়ায়িক দার্শনিকদের জন্য এটা একটা বড় প্রশ্ন। সুযোগের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পেলেই বৈষম্য দূরীভূত হয়ে যাবে না। একটি সবার জন্য উন্মুক্ত দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ প্রথম হয়, কেউ লক্ষ্যে পৌঁছায় সবার শেষে। এ ধরনের বৈষম্যকে প্রকৃত অর্থে অনাকাঙ্ক্ষিত বৈষম্য বলা চলে না। নৈয়ায়িকেরা সেই বৈষম্যকেই স্বীকার করতে রাজি যেটুকু মানুষে মানুষে ‘উদ্যমের ফারাকের’ কারণে সৃষ্টি হয়। যে-বৈষম্য ‘অবস্থার চাপে’ পড়ে সৃষ্টি হয় সেটি নিরসনযোগ্য বৈষম্য। যদি গ্রামের স্কুল থেকে আগত একজন শিক্ষার্থীকে (যার পরিবারে বা যার স্কুলে ইংরেজি শেখার কোনো আয়োজন বা পরিস্থিতি নেই) শহরের স্কুল থেকে আগত একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করতে হয় এমন এক পরীক্ষায় যেখানে ইংরেজিতেই কেবল পরীক্ষাপত্র করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীর হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা জন রোমার (Roemer) যাকে বলেছেন ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’, বা এলিজাবেথ এন্ডারসন যাকে বলেছেন ‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম (Luck egalitarianism), সেটি এ ক্ষেত্রে রক্ষিত হয়নি।
‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম’-এর মূল কথা হলো নিম্নরূপ :’While inequalities are unjust if they derive from differences in people’s circumstances-because circumstances are a matter of brute luck– they are just if the are the product of people’s voluntary choice.’

অর্থাৎ শুধুমাত্র নিজস্ব নির্বাচন বা পছন্দের কারণে অথবা উদ্যমের তারতম্যের কারণে যদি কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তাহলে তা মেনে নেওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রেও কথা থাকে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে থাকে স্কুলের বাইরে ‘প্রাইভেট ক্লাস’ করার কারণে। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের সে-সংগতি নেই। জেরাল্ড কোহেন (G. A. Cohen) এরকম ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম’-র নীতি দাবি করে যে রাষ্ট্র এ ধরনের সমস্যা সুরাহা করার চেষ্টা করবে বা অন্তত সমাধান করতে সচেষ্ট হবে। যেমন, এই উদাহরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল ছুটির পরে নিখরচায় বাড়তি কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করবে এবং এর জন্য যে বাড়তি ব্যয় হবে তার দায়িত্ব নেবে। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণার তারতম্যের কারণে যে-বৈষম্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে শিক্ষা ক্ষেত্রে, তার বেলায় কী করা হবে? দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিতের পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাবা-মার অনুপ্রেরণা ও পরিবারের কারণে পড়াশোনায় অনেক বেশি তৎপর হয়ে থাকে। খেটে-খাওয়া মজুর পরিবারের বাবা-মা উভয়েই হাড়ভাঙা খাটুনির সঙ্গে জড়িত। সারাদিনের শেষে সন্তানদের ‘হোমওয়ার্ক’ দেখার সামর্থ্য তাদের নেই বললেই চলে। লাক্‌-ইগালিটারিয়ানিজম বলে যে এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের অনেক কিছু করার আছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রি-স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা চালু করলে অনুপ্রেরণা বা উৎসাহের ক্ষেত্রে খামতি অনেকটুকু কমে আসবে। পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিভা বিকাশে সহায়ক এবং আত্মবিশ্বাস জোগায় যেটা স্কুলের পারফরম্যান্সেও প্রতিফলিত হতে বাধ্য। কভিডের সময় আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি যে, অনলাইন এডুকেশনের ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের বৈষম্য আসলেই প্রকট। করোনার সময়ে যখন লকডাউনের কারণে স্কুলে পাঠদান বন্ধ রইল, ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনলাইনে ঠিকই ক্লাস করতে পারল। ও-লেভেল এ-লেভেল পরীক্ষা দিতে পারল। গরিব পরিবারে একটি করে মোবাইল আছে বটে, কিন্তু স্মার্টফোনের সুবিধা এখনও অত্যন্ত কম। শহর এলাকার বাইরে ইন্টারনেট স্পিডও তুলনামূলকভাবে কম। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ করা প্রয়োজন যাতে করে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের সুযোগের সমান অধিকার নিশ্চিত হয় শিক্ষার মতো অধিকারের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, নৈয়ায়িক দার্শনিকদের সূত্র ধরে- ‘সুযোগের সমতা’ বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯তম অনুচ্ছেদে কোনো প্রতীকী অর্থে বলা হয়নি। এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি। যেটি সুযোগের সমতা বিধানে অবস্থার চাপে সৃষ্ট বৈষম্য বা ‘নির্দয় দুর্ভাগ্য’ (Brute luck) জনিত বৈষম্যকে দূরীভূত করে সবার জন্য সুযোগের দ্বার সমানভাবে খোলা রাখতে বদ্ধপরিকর। এক কথায়, ১৯নং অনুচ্ছেদ শুধু non-discrimination principle-এর ঘোষণাতেই আটকে থাকেনি। ১৯ নং অনুচ্ছেদের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার’ কথা, আর এর ২ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের কথা’। ১নং ধারায় বলা হয়েছে : ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ আজকে যেটা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস-এর ১নং (No Poverty) ২নং  (Zero Hunger), ৩নং (Good Health & Well-being), ৪নং (Quality Education),
, ৫নং (Gender Equality), ৬নং  (Clean Water and Sanitation), ৭নং (Affordable & Clean Energy), এবং ৮নং (Decent Work & Economic Growth) লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, ‘৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার এবং ৭২ সালের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ পূরণের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে’ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা এবং এর মাধ্যমে ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করার কথা। শুধু বিষয়টাকে মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যেই সীমিত রাখা হয়নি। সেখানে আরও বলা ছিল ‘কর্মের অধিকার’ নিশ্চিত করার কথা এবং ‘যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার’ প্রদানের গুরুত্ব। যারা পিছিয়ে পড়ে থাকবেন দারিদ্র্যের বিষ-বৃত্তের ভেতরে, তাদের প্রতি রাষ্ট্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হাল-আমলের তথাকথিত ‘সোশ্যাল প্রটেকশন’ কর্মসূচির বহু আগেই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের চিন্তায় এসেছিল পিছনে-পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার কথা, যার সংজ্ঞা ছিল নিম্নরূপ:
‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।’
শুধু ‘সুযোগের সমতার’ অধিকার নয়, আরও বেশি কিছু ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনে। তিনি বুঝেছিলেন যে ইক্যুয়ালিটি অব অপরচুনিটি সুষম বণ্টনের সমাজের দিকে এগোনোর একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত বটে, কিন্তু যথেষ্ট পূর্বশর্ত নয়। সমাজের একটি মুষ্টিমেয় অংশই উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ লাভ করে দরিদ্র দশা থেকে সচ্ছল দশায় উন্নীত হতে পারবে। সকলের ক্ষেত্রে অদৃষ্ট সমান প্রসন্ন হয় না, সকলের ন্যাচারাল বুৎপত্তি বা প্রতিভাও সমান নয়। কিন্তু তাই বলে কি যারা দীনের চেয়ে দীন, যারা আজীবন কায়িক শ্রমের ভেতরে, খেটে-খাওয়া মানুষ যাদের বলি, তাদের কাজের কি মূল্যায়ন করা হবে না? তারা কি ফ্রন্টলাইন বা এসেনসিয়াল ওয়ার্কার্স হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হবেন না? তাদের কি সমান নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা  (Common Good) পাওয়ার অধিকার নেই? বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্যে বিশেষ করে ১৪ নং অনুচ্ছেদের প্রস্তাব করেছিলেন:
‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে, এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’
এবং তার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে মেহনতি মানুষকে সহায়তা করতে হবে, দেখভাল করতে হবে। আজকের Universal Basic Income-র ধারণার পূর্বছায়াও আমরা এখানে দেখতে পাই। অন্যত্র- ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রকারান্তরে তিনি উল্লেখ করলেন ‘equality of outcomes’-এর কথা। এটি এসডিজির ১০নং লক্ষ্যমাত্রা ‘বৈষম্য হ্রাস করা’র সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সেদিন তিনি বলেছিলেন:
‘এই সরকার ন্যায়ভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন। সেইসব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যারা পাটচাষিদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন, তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতোমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫০০ ডাক্তারকে নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশে মানুষ মানুষে, ব্যক্তিত্বে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতর উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি।’
বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধিই বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯(২) ধারায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ করার জন্য এবং নাগরিকদের মধ্যে ‘সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত’ করার জন্য ‘সর্বত্র সুষম সুযোগ-সুবিধাদান’ প্রদানে রাষ্ট্রের তরফে ‘কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার কথা। পরিশেষে, ২০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের কথা:
‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে এবং প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ এই নীতির ভিত্তিতে ‘প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


প্রথমটি ছিল- সকলের জন্য সমান লিবার্টি বা স্বাধীনতার প্রস্তাব। দ্বিতীয়টি ছিল- সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কত দূর পর্যন্ত স্বীকার্য তা নিয়ে তার উপলব্ধি। ‘সবচেয়ে গরিবকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা’ দিতে হবে সবার আগে, সবার জন্য ‘মৌলিক চাহিদা’ পূরণের ক্ষেত্রে- এটি তার ন্যায়বাদী সমাজের একটি প্রধান পূর্বশর্ত ছিল। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, তার নির্দেশিত মুক্ত ও সামাজিক ন্যায়ের সমাজেও মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ আরোপিত হয়েছিল। যেমন, বহুত্ববাদিতা তিনি চেয়েছেন, কিন্তু সেই বহুত্ববাদিতাকে হতে হবে যুক্তিযুক্ত- এজন্যই তার নাম দিয়েছেন ‘Reasonable Pluralism’ বলে। কিন্তু কোনটা (এবং কতদূর পর্যন্ত) হবে যুক্তিসংগত বহুত্ববাদ, তার সীমানা নির্ধারণ কেবল মাত্র জনগণের মধ্যে মুক্ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পন্ন করা সম্ভব। অমর্ত্য সেন যাকে (জন স্টুয়ার্ট মিলের অনুসরণে) বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি সরকার-ব্যবস্থা যেখানে সবকিছু পরিচালনা করা হয় ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে’ (‘রুলিং বাই ডিসকাশন’)। সংসদ সেরূপ মুক্ত পর্যালোচনার জন্য একটি প্রধানতম প্ল্যাটফর্ম। এটি বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাদের একটি মৌল পূর্বানুমান  (Premise)।
Lost in Translation দিয়ে এই অধ্যায়টি শুরু করেছিলাম। এবারে অনুবাদের একটি সমস্যা দিয়ে নতুন প্রসঙ্গে যেতে চাই। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে, ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটির অনুবাদ সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি ভাষ্যে সমার্থক ব্যঞ্জনা পায়নি। বাংলা পাঠে সমাজতন্ত্র ধারণাটি অনেক বেশি ‘র‌্যাডিকেল’ ইংরেজি পাঠের তুলনায়। র‌্যাডিকেল এই অর্থে যে, বাংলা ভাষ্যটি অনেক বেশি যুগান্তকারী, বিপ্লবাত্মক ও ‘সুদূরের পিয়াসী’। ইংরেজি পাঠ সে তুলনায় অনেক বেশি ধীরে-চলা নীতির, সংস্কারবাদী ও আশু কর্মসূচির। এটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
১০ নং আর্টিকেল-এর ইংরেজি পাঠে লেখা হয়েছিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ : ‘Socialist economic system’, ‘attainment of a just and egalitarian society’ Ges ‘free from the exploitation of man by man’। এই প্রতিটি বাক্যাংশই অনেক অর্থের ভারে নুয়ে আছে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেম establish করার’ যথার্থ অর্থ কী তা ধ্রুপদি মার্কসবাদে নির্দিষ্ট করা ছিল না। মার্কসবাদ ছাড়া অন্যান্য ধারার সমাজতন্ত্রেও অর্থটি নির্দিষ্ট হয়ে নেই। যেমন, জন স্টুয়ার্ট মিল নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবতেন, সমাজতন্ত্র নিয়ে তার ট্রিটিজ রয়েছে। কিন্তু সেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ‘ফেবিয়ান সোশ্যালিজম’-এর ফারাক আছে। আধুনিক অর্থনীতির জনক আলফ্রেড মার্শাল অর্থশাস্ত্রে নব্য-ধ্রুপদি ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিন্তু সমাজ-চিন্তায় তিনি নিজেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবেই দেখেছেন। ‘টু মার্শালস’ বইতে মার্শালের দ্বৈত-চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ব্লুমসবিউরি গ্রুপের বিদগ্ধ সদস্য ও দিকপাল অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস প্রথাগত সমাজতন্ত্রের কট্টর সমালোচক ছিলেন, কিন্তু নিজেকে তিনি ‘বামধারার’ অর্থনীতিবিদ হিসেবেই ভাবতেন, বিশেষত অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রশ্নে জোরালো অবস্থান নিয়ে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেমের’ অন্য একটি প্রচলিত অর্থ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’-এর মডেল অনুসরণ করা। কিন্তু সেটি বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা সংবিধানের আলোচনায় আগেভাগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সে ধরনের মডেল এদেশে হবার নয়। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান অনগ্রসর পটভূমিতে সে ধরনের উন্নয়নের ছকে ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অর্থনীতি’র মডেলকে আশ্রয় করে এগোবার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। ১৯৭৩ সালে গৃহীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলেও সেই বাস্তববোধের স্বীকৃতি ছিল। এখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য রাস্তা দেখতে হবে, যাতে করে ন্যায়ানুগ, সমতাবাদী ও শোষণমুক্ত সমাজ কালক্রমে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
‘জাস্ট অ্যান্ড ইগালিটারিয়ান সোসাইটি’ বাক্যাংশ নিয়েও বাংলা ও ইংরেজি পাঠে বড় রকমের ধন্দের সৃষ্টি হলো। ড. আনিসুজ্জামান কমিটি ‘জাস্ট’-এর বঙ্গানুবাদ ঠিকই করলেন ‘ন্যায়ানুগ’, কিন্তু গোল বাধল ‘ইগালিটারিয়ান’ শব্দটির বাংলা নিয়ে। ড. কামাল লিখলেন ‘egalitarian society’; ড. আনিসুজ্জামান লিখলেন ‘সাম্যবাদী সমাজ’। আপাতঃদৃষ্টিতে দুটোকেই সমার্থক শব্দ মনে হলেও এরা আদৌ সমার্থক নয় বর্ণে-গন্ধে, ঐতিহ্যে, পরম্পরায়। egalitarianism নানা ধারার মতবাদেই, নানা ধরনের সংবিধানেই আছে। যে কোনো ‘লিবারেল বুর্জোয়া’ ধারার টেক্সটেই ‘egalitarian society’ শব্দবন্ধটি খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়, অস্বাভাবিকও নয়। এর একটা কারণ- অর্থনীতিতে না হোক, রাজনীতিতে egalitarianism অর্থাৎ Political equality, এবং মৌলিক অধিকারের equality প্রতিশ্রুত হয়ে থাকে। এর শুরু ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের দর্শনে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এটি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করেছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, যার স্লোগান ছিল- ‘লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি’। ইকুয়ালিটি ফরাসি উচ্চারণে হয় ‘ইগালিতে’- সেখান থেকে ইংরেজিতে তার পুনর্জন্ম egalitarian ব্যাঞ্জনায়। আমি বলতে চাইছি, কী ঐতিহাসিকভাবে এবং ব্যুৎপত্তিগতভাবে ড. কামাল যখন   just and egalitarian society ব্যবহার করে ছিলেন তিনি কমিউনিস্ট অর্থে, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অর্থে খুব সম্ভবত ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করেছিলেন লিবারেল পলিটিক্যাল ফিলোসফির পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির বহুল প্রচলিত অর্থে। ফরাসি বিপ্লবের Spirit-এ। কিন্তু ড. আনিসুজ্জামানের হাতে পড়ে সেটা হয়ে গেল- ‘সাম্যবাদী সমাজ’। তিনি এর পরিবর্তে ‘সমতাবাদী সমাজ’, ‘সুষম বণ্টনের সমাজ’ নানা ধরনের বিকল্প ভাবতে পারতেন বা নতুন শব্দ উদ্ভাবন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি হাত বাড়ালেন এমন একটি শব্দের প্রতি যার অর্থ বহুকাল ধরে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে সংজ্ঞায়িত হয়ে আছে। মার্কসবাদী প্রগতিবাদী দর্শনের যে কোনো টেক্সটে যখন ‘সাম্যবাদী সমাজ’ শব্দটি লেখা হয়, তখন তার একটিই (বা প্রধানতম) মানে হচ্ছে- মার্কস-এঙ্গেলসের নির্দেশিত পথের ‘সাম্যবাদী সমাজ’। যে সাম্যবাদী সমাজের দুই ধাপ- প্রথমটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত নিচু পর্যায়ে)। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাম্যবাদী সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত উঁচু পর্যায়ে)। এটি হতেই পারে না যে ড. আনিসুজ্জামান বা তার সহ-অনুবাদকগণ ‘সাম্যবাদী সমাজ’ লেখার ‘ছায়া-অর্থ’ বা  Connotation জানতেন না। অন্তত ড. আনিসুজ্জামান- যিনি এক সময়ে (পঞ্চাশের দশকে) কিছুকালের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন (এবং পরবর্তীকালেও এ ধারার সংলগ্ন আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন)- সাম্যবাদী সমাজ লেখার গভীরতর তাৎপর্য ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন বা বুঝতে পারার কথা।
প্রশ্ন উঠবে, অনুবাদটি যে যথাযথ হলো না আক্ষরিক ও রাজনৈতিক উভয় অর্থে, সেটি আনিসুজ্জামানের হাত থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হলেও সংবিধান-কমিটির অন্য সদস্যদের তো এই অনুবাদের দার্শনিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য চোখে পড়ার কথা। তাহলে সেটি নিয়ে সেদিনের গণপরিষদে তর্ক ওঠেনি কেন? সংবিধান-কমিটিতেও এ নিয়ে বাদানুবাদ হতে পারত অল্পবিস্তর। সেটা হয়েছিল কিনা আজ সেটা জানবার প্রায় উপায় নেই। আমরা শুধু এটুকু জানি যে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম বা ড. কামাল হোসেন কেউই  egalitarian society-র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সাম্যবাদী সমাজ’ প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে আপত্তি জানাননি। হতে পারে তারাও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দেশটিকে ওইরকম একটি আদর্শ বা আদর্শায়িত সমাজের দিকেই কালক্রমে- অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও চড়াই-উৎরাইয়ের ক্লেশ-যন্ত্রণা স্বীকার করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই এই যাত্রা হতো গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণ করে- অগণতান্ত্রিক পরমত অসহিষ্ণু পথে নয়- সন্দেহ নেই। সমতামুখী সমাজের দিকেই এগোতে চেয়েছিলেন তারা। অন্তত সেরকম স্বপ্ন তাদের ছিল। সে জন্যেই আনিসুজ্জামানের অনুবাদে তারা আপত্তি জানাননি সেদিন কেউই।
১০. ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘শ্রম-অনুযায়ী বণ্টন’
আগেই বলেছি, সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাভিত্তিক সমাজ নয়। সমাজতন্ত্রকে এমনকি শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানা নিরিখে বিচার করা চলে না। মালিকানার বিচার সমাজতন্ত্রের একটি মূল দিক। তবে একমাত্র দিক নয়, প্রধানতম দিকও নয়। এর কারণ সমাজতন্ত্র প্রতিশ্রুতি দেয় প্রত্যেক নাগরিককে ‘সুযোগের সমতা’র অধিকার। সুযোগের সমতা বা equality of opportunity সমাজতন্ত্রের মৌলিক শর্তের একটি অবশ্য পূরণীয় শর্ত। সমাজতন্ত্রের চরিত্রে রয়েছে ‘সামাজিক মালিকানা’ (যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানার নানা দেশ-কাল ভেদে বিভিন্ন মিশ্রণ)। কিন্তু সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে একটা বিশেষ লক্ষ্যে, আর সেটা হচ্ছে সকল নাগরিকের মধ্যে ‘সুযোগের সমান অধিকারের’ প্রতিষ্ঠা করা। মালিকানা- তা সে রাষ্ট্রীয় হোক বা ব্যক্তি মালিকানাই হোক- কেবল উদ্দেশ্য সিদ্ধির ‘উপায়’ মাত্র। উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে সমাজতন্ত্রের চরিত্রে বিকৃতি দেখা দিতে বাধ্য। নানা দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার অভিজ্ঞতায় এটা দেখা গেছে- কখনও ‘স্তালিনীয় সমাজতন্ত্রে’র মডেলে পণ্য-অর্থ সম্পর্ককে হালকা করে দেখার মাধ্যমে। কখনও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ওপরে মাত্রাতিরিক্ত জোর দিয়ে, কখনও না-পরিকল্পনা না-বাজার এমন একটা জগাখিচুড়িপূর্ণ ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’ কর্মসূচি হাতে নিয়ে (যেমনটা হয়েছিল গর্বাচেভের সংস্কার-প্রচেষ্টার আমলে)। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ প্রায় প্রতিটি ‘সমাজতান্ত্রিক দেশেই’ মালিকানা সম্পর্কের বিশুদ্ধতা রক্ষায় বেশি তৎপর হতে গিয়ে আসল উদ্দেশ্য জনকল্যাণ থেকে দৃষ্টি সরে গেছে সময় সময়। সে জন্যেই সমাজতন্ত্র কী তা বোঝার জন্য consequentialist দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রকে টিকতে হলে তাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ভাষায় কথা বলতে হবে, ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলতে শিখতে হবে। যার ইঙ্গিত রেখেছিলেন মার্কস ‘ক্রিটিক অব দ্য গথা প্রোগ্রামে’ যেখানে সমাজতন্ত্রকে ক্রমশ মানবচাহিদামুখীন (Need based society) সমাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন মার্কস। বাহাত্তরের সংবিধানের আদি প্রণেতারা ও বঙ্গবন্ধু ‘অধিকারের ভাষাতেই’ সমাজতন্ত্রকে দেখতে চেয়েছেন- শুধু মালিকানা-সম্পর্কের নিরিখে দেখতে চাননি। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ সংবিধানের ১৯ এবং ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ। এ নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা সীমিত রাখব। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যার জন্য এ দুই অনুচ্ছেদের পদ্ধতিগত গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯নং অনুচ্ছেদে ১নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার কথা’, আর ২নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের’ কথা। ১নং ধারায় অতি সংক্ষেপে বলা হয়েছে : ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ অতি সংক্ষেপেই চুম্বক-বাক্য হিসেবে ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটির’ কথা লেখা হয়েছে বিশদ ব্যাখ্যা না করেই। কোন কোন সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করা হবে বা বেশি জোর দেওয়া হবে, কতটুকু সমতা বিধান করা হবে (কতটা গভীর গিয়ে বৈষম্যের প্রশ্নটি সমাধা করা হবে); কোন কোন ক্ষেত্রে সমতা-বিধানের প্রশ্নটি সবার আগে সমাধান করা জরুরি, এবং কী ধরনের সুযোগের ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্নটি ক্রমান্বয়ে অর্জিত হবে এসব প্রশ্নই প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভেতরে। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে প্রচুর আলোচনা, গণ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। তার কিছু কিছু দিকের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।
সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে গেলে প্রথমেই এসে পড়ে সুযোগের ক্ষেত্রে ‘আদি-বৈষম্য’ (initial inequality) দূর করার সমস্যাটি। এ ক্ষেত্রে বার্নার্ড উইলিয়ামস একটি উপদেশ দিয়েছেন। ধরা যাক কোনো একটি দেশে নীতি-নির্ধারকেরা ঠিক করলেন যে কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় বা বিশেষ কোনো যোদ্ধা-শ্রেণি বা গোত্র (ইংরেজিতে যাকে বলে- warrior class) থেকেই সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হবে ব্যাপারটা এমন নয়। এবার থেকে সমাজের সকল স্তরের মানুষেরাই সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার ‘সমান সুযোগ’ পাবেন। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে ‘সুযোগের সমতা’ পূর্ব-ঘোষিত হলো।
[ক্রমশ]