পর্ব ::২৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
লুই আরাগঁ-এর কাব্যবিচার মানলে এ কথা বোঝা কষ্ট নয় যে, কেন এলিয়ট বিষ্ণু দে বা তার সমসাময়িক প্রজন্মের কাছে ঈর্ষণীয় মানদণ্ড হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিলেন। প্রথমত, কবিতার নতুন ‘ফর্ম’ উদ্ভাবনের এলিয়ট (তার অগ্রজ ইয়েটসর মতো) অসাধারণ অর্জন দেখিয়ে ছিলেন। তাই বিষ্ণু দে বলতে চেয়েছিলেন যে, ‘এলিয়টের ডগ্মা অবশ্যই আমাদের পক্ষে অগ্রাহ্য। কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর সাহায্য স্বীকার্য। … ইংরেজি, ইউরোপীয় এবং আমাদের নিজেদেরই সাহিত্যের ঐতিহ্য সন্ধানে তাই এলিয়টের নিদর্শন শ্রদ্ধেয়। এবং এ সন্ধান এক রকম নির্মাণ, কর্মিষ্ঠ পরিবর্তন, এ কথা এলিয়টই অত ভালো করে সাহিত্য প্রসঙ্গে বলেন প্রথমে। ঐতিহ্য বিচারে মার্কস যেমন করে ‘শেক্সপিয়র বালজাক, গয়টে, হায়নে কিংবা ইবসেনকে’ দেখেছিলেন, এলিয়টকেও সেভাবে দেখতে চেয়েছেন তিনি। দ্বিতীয়ত, শুধু ‘কর্ম’ বিচারের মানদণ্ডে নয়, বিষ্ণু দে এলিয়টকে দেখেছিলেন একই কবিতার পতাকার তলে বিচিত্রবিধ বিষয়বস্তু সমাবেশ করার নিরিখেও। কবিতা যে শুধু আত্মকেন্দ্রিক ‘নার্সিসিস্টিক’ প্রক্রিয়ার ফসল নয়, এর ভেতর দিয়ে যে পরিপার্শ্ব জনান্তিকে কথা কয়ে ওঠে তা এলিয়টের কবিতা পড়লে বোঝা যায়। তাই বিষ্ণু দে বলেছেন, ফোর কোয়ারটেট্সের ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস্’ই এর কবিতাচতুষ্টয়ের মধ্যে সবচেয়ে আঁটসাঁট কবিতা : ‘এখানে এলিয়ট শেষ করেছেন এয়ার-রেড রাত্রির জাঁকালো বর্ণনার পরে নটিংহ্যামের রয়্যালিস্ট চ্যাপেলে প্রথম চার্লসের নৈশাভিযানে যখন অন্তর্যুদ্ধে রয়্যালিস্টরা হেরে গেল। অবিসম্বাদী কবিত্বে এলিয়ট আর্তনাদ করেছেন পার্টি-রাজনীতির নশ্বরতায়। মৃত্যুতে, কালস্রোতে রয়্যালিস্টও শূন্যে বিলীয়মান, কী হবে কিছু ক’রে, ল’ড়ে, তাই হায় হায়।’ প্রু-ফ্রকের আত্মকেন্দ্রিক জগতের চেয়ে এই বোধ অনেক দূরের। তৃতীয়ত, বিষ্ণু দে মনে করেছেন, ‘পটভূমি ভিন্ন হলেও এলিয়টের অভিজ্ঞতার তুল্য মেলে আমাদের মধ্যে।’ আর সে কারণেই এলিয়টের সব কবিতার অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ‘বাধা থাকলে তাঁর রীতি আমাদের সহায়, এমনকি তাঁর কবিতার অলঙ্কার অঙ্গবিন্যাস, জগৎ ভিন্ন হলেও।’
সবশেষ, বিষ্ণু দে দৃষ্টি দিয়েছেন এলিয়টের ওরিয়েন্টালিজমের প্রতি। আমরা সচকিত না হয়ে পারি না যখন তাকে বলতে শুনি- ‘গীতা’ এলিয়টকে ‘তাঁর কাব্যের চমকপ্রদ রসদ জুগিয়েছে’। এলিয়ট কেন এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন এ প্রশ্নও তার মনে দেখা দিয়েছিল। ‘টি এস এলিয়টের মহাপ্রস্থান’ প্রবন্ধটি শুরুই হয় এলিয়টের ‘দ্য ড্রাই স্যারভেজেস’ থেকে বহু-উদ্ধৃত লাইনটির সূত্র দিয়ে। এর বঙ্গানুবাদ আমার সাধ্যাতীত, বিষ্ণু দেও চেষ্টা করেননি।
‘I Sometimes wonder if that is what Krishna meart-Among other things- or one way of putting the same thing : That the future is a faded song, a Royl Rose or Lavender spray of wistful regret for those who are not have to regret, Pressed between yellow leaves of a book that has never been opened.
And the way up is the way down, the way forward is the way back.
You cannot face it steadily, but this thing is sure.
That time is no healer : The Patient is no longer here.
রবীন্দ্রনাথও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনমৃত্যুর ছলার অনিবার্যতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এলিয়টেও পাই সেই বেদনার্ত উপলব্ধি-‘What man has made of man!’
ফোর কোয়ারটেটস্-এর দ্য ড্রাই স্যালভেজেস-এ এসে আমরা যে হঠাৎ করে কৃষ্ণের রেফারেন্স পাই তা আকস্মিক- এক ধরনের নাটকীয় অনুপ্রবেশ বলে মনে হতে পারে। এ ধরনের ওরিয়েন্টাল মোহ কী নেহাতই কাব্যের উদ্ভাবনী তাগিদে জন্ম নিয়েছিল। নাকি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দীর্ঘকালের পাঠ, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনা? এ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজব আমরা পরবর্তী অংশে।
৪. এলিয়টের ওরিয়েন্টলিজম
প্রাচ্যীয় দর্শনের প্রতি এলিয়টের মুগ্ধ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছিল দ্য ড্রাই সালভেজেসের বহু আগে থেকেই এলিয়টের হার্ভার্ড-সহপাঠী দার্শনিক রবার্ট র্যাট্রে ১৯৪০ সালের ৩রা মে রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে জানান একটি অবাক করা তথ্য :’আমি জানি না আপনি জানেন কিনা, আমার হার্ভার্ডের জনৈক সহপাঠী সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি এখন বিখ্যাত কবি-টি.এস. এলিয়ট।’ সেই সন্ধ্যা বলতে র্যাট্রে স্মরণ করেছেন ১৯১৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পাঠের কথা। সেই সন্ধ্যার রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন ‘দ্য প্রবলেম অব ইভিল’ (পরবর্তীতে ‘সাধনা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত) বিষয়ে। প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধ সমগ্রে স্থান পেয়েছে। সেই সন্ধ্যার স্মৃতিচারণ করে র্যাট্রে দীর্ঘ ২৭ বছর পরে রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখছেন : এলিয়টের সাথে তিন হার্ভার্ডে ভারতীয় দর্শনের ওপরে কোর্স নিয়েছিলেন : ‘আমরা একত্রে ভারতীয় দর্শন পড়তাম। এমন হতে পারে যে ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় তার ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ চরণটি সেদিনের সন্ধ্যায় আপনার পাঠ স্পেশাল স্মৃতি থেকে উঠে এসেছিল’ আমি তার কবিতার ভক্ত নই, কিন্তু বর্তমান খ্যাতির কথা চিন্তা করে এ তথ্য জানানো প্রাসঙ্গিক মনে হলো। এটি শুধু চিঠিতে নয়, রাট্রে দ্য এনকোয়্যারার পত্রিকার (১৬ মে ১৯৪০) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখেন :’ববীন্দ্রনাথ যখন হার্ভার্ডে ছিলেন তখন অধ্যাপক ও মিসেস উড্স একবার তার সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য অতিথিসৎকারের আয়োজন করেছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন টি. এস. এলিয়ট- তিনি আমাদের সহপাঠী ছিলেন (আমরা দুজনেই ভারতীয় দর্শন নিয়েছিলাম)। এই পার্টিতে রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক উড্সের অনুরোধে উপনিষদ থেকে শ্নোক আবৃত্তি করেন, কোনো যন্ত্রের অনুষঙ্গ ছাড়াই খুব সহজভাবে তাঁর নিজের রচিত গান গেয়ে শোনান এবং তখনো অপ্রকাশিত ‘ডাকঘর’ নাটক থেকে পাঠ করেন। অসাধারণ কেটেছিল সেই সন্ধ্যাটি। সমীর সেনগুপ্ত রচিত ‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’ গ্রন্থে র্যাট্রে রবীন্দ্রনাথ পত্রালাপের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।
র্যাট্রের চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত হয়েছিলেন। এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ তিনি আগেই পাঠ করেছিলেন। কিন্তু এটি তিনিও আন্দাজ করতে পারেননি ওয়েস্ট ল্যান্ডের সমাপ্তি চরণটির পেছনে তার অপ্রত্যক্ষ অবদান ছিল। র্যাট্রেকে যে-চিঠি রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তরে লেখেন, তা নিম্নরূপ :
‘আপনি মি. টি. এস. এলিয়ট সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা খুব কৌতূহলের সাথে পড়লাম- তার কাব্যের কোন কোন অংশ তাদের আলোড়ন জাগানিয়া ক্ষমতায় ও অসাধারণ শিল্প সৌকর্যে আমাকে বিস্মিত করেছে। বেশ কিছুকাল পূর্বে আমি তাঁর ‘জার্নি অব দ্য ম্যাজাই’ কবিতাটি অনুবাদ করেছি এবং র্যাট্রের যে-সম্ভাবনার কথা তুলেছেন তা কষ্টকল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উপনিষদের প্রতিটি মন্ত্রের সমাপ্তি হয় আনুষ্ঠানিক রীতিতে- ‘ওম শান্তি, ওম শান্তি, ওম শান্তি’ শব্দটি তিনবার উচ্চারণ করে। সেদিনও উড্স সাহেবের বাসায় রবীন্দ্রনাথ এটি করে থাকবেন। অন্যদিকে, এলিয়ট শুধু সেই সন্ধ্যাতেই নয়, অন্যত্রও রবীন্দ্রনাথকে শুনে থাকবেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানেও এলিয়টের উপস্থিত থাকার কথা। রবীন্দ্রনাথ হার্ভার্ডে অন্তত চারটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন- একটি অধ্যাপক উড্স-এর দর্শন ক্লাসে। একটি হার্ভার্ড ফিলোসফিক্যাল ক্লাবে এবং তৃতীয়টি এন্ড ওভার স্কুলের ডিভিনিটি ক্লাবে। এ ছাড়াও এমার্সন হলে Realication of Brahma নামে বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অন্তত অধ্যাপক উড্সের ক্লাসে এলিয়টের উপস্থিত থাকার কথা। এই বক্তৃতাগুলো রবীন্দ্রনাথের কবি-পরিচিতির পাশাপাশি তাকে দার্শনিক-পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সন্দেহ নেই। অধ্যাপক উড্স কবিকে জানিয়ে ছিলেন যে তাঁর এই প্রবন্ধগুলো একত্রিত করে বই-আকারে দ্রুত প্রকাশ করা দরকার এবং তিনি স্বয়ং এক্ষেত্রে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। শুধু তা-ই নয়, এই প্রবন্ধ-সংকলনের ভূমিকাও লিখতে তার আগ্রহের কথা জানান, উড্স : ‘আপনাকে যেসব চিন্তাবিদ প্রভাবিত করেছেন সে সম্পর্কে আরো জানতে চাই আমি, বিশেষত কবীর-এর বিষয়ে। আপনি বা [ক্ষিতিমোহন] সেন এ ব্যাপারে তথ্য জানালে আমি আপনার দর্শনের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রচনা করতে পারতাম।’ এ কথা প্রশান্ত কুমার পাল তার ‘রবিজীবনীর’ ৬ষ্ঠ খণ্ডে জানিয়েছেন আমাদের। সে বছর রবীন্দ্রনাথ শুধু হার্ভার্ডেই নয়, আর্বানা ও শিকাগোসহ অন্যান্য শহরেও গুরুগম্ভীর দার্শনিক বিষয়ে ‘গদ্য-বক্তৃতা’ দিয়েছিলেন, যা পরে তার ‘সাধনা’ প্রবন্ধমালায় মূল ইংরেজিতেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯১২-১৩ সালের ইউরোপে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফরকে এক অর্থে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক হয়ে ওঠার বছর বলা যায়। কবি হিসেবে নোবেল প্রাপ্তির আগে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের একজন দার্শনিক হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন এ কথাও মনে হতে পারে।
তবে ওয়েস্ট র্যাট্রের শেষ চরণে এলিয়ট যে সহসা শান্তি-স্ত্রোত্র পাঠক করে বলে উঠলেন ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ (অবশ্য ‘ওম’ শব্দটা বাদ দিয়ে) সেটা কেবল রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রাণিত হয়ে রচিত হয়েছিল। এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে। ওয়েস্ট ল্যান্ডের রচনা কাল আরো পরে-১৯২১ বা তার কিছু কাল আগে থেকে। রবীন্দ্রনাথ যখন হার্ভার্ডে গেছেন সেটা ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনার সাত-আট বছর আগে। ফলে ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনার কালে এত বছর আগের স্মৃতি এলিয়টের মধ্যে কাজ করছিল তা নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। সুবিদিত যে, ওয়েস্ট ল্যান্ডে পূর্ববর্তী বিভিন্ন সাহিত্যিক ও দার্শনিক ঐতিহ্যের পদচিহ্ন রয়ে গেছে। সেগুলো এলিয়ট রেখে-ঢেকে রাখতে চাননি। বরং বহু পাদটীকা দিয়ে পাঠককে তার শ্রমনিষ্ঠ নির্মাণের প্রতি গোড়া থেকেই সজাগ রাখতে চেয়েছেন। এলিয়টের এনসাইক্লোপেডিক মননের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার বন্ধু কবি এজরা পাউন্ডের ‘লাইন-বাই-লাইন’ ধরে গভীর পাঠ। পাউন্ডের ক্ষুরধার সমালোচনার মুখে কেটে ফেলতে হয়েছে ওয়েস্ট ল্যান্ডের আদি-পাঠের প্রায় অর্ধেক ভাগ। পাউন্ড নিজে এ নিয়ে এলিয়টকে হাস্যোচ্ছলে লিখেছেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে :
‘These are the Poems of Eliot
… … … … … …
If you must needs enquire
Know diligent Reader
That on each Occasion
Ezra performed the Caesarean Operation’
পাউন্ড বা এলিয়ট আদি-খসড়ার ওপরে সংশোধনী চলাকালে কোথাও রবীন্দ্রনাথের কোনো উল্লেখ করেননি পাণ্ডুলিপির ভেতরে। পরবর্তীতেও এ নিয়ে দু’জনের কেউই কোনো মন্তব্য করেননি।
[ক্রমশ]