এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৮

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

লুই আরাগঁ-এর কাব্যবিচার মানলে এ কথা বোঝা কষ্ট নয় যে, কেন এলিয়ট বিষ্ণু দে বা তার সমসাময়িক প্রজন্মের কাছে ঈর্ষণীয় মানদণ্ড হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিলেন। প্রথমত, কবিতার নতুন ‘ফর্ম’ উদ্ভাবনের এলিয়ট (তার অগ্রজ ইয়েটসর মতো) অসাধারণ অর্জন দেখিয়ে ছিলেন। তাই বিষ্ণু দে বলতে চেয়েছিলেন যে, ‘এলিয়টের ডগ্‌মা অবশ্যই আমাদের পক্ষে অগ্রাহ্য। কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর সাহায্য স্বীকার্য। … ইংরেজি, ইউরোপীয় এবং আমাদের নিজেদেরই সাহিত্যের ঐতিহ্য সন্ধানে তাই এলিয়টের নিদর্শন শ্রদ্ধেয়। এবং এ সন্ধান এক রকম নির্মাণ, কর্মিষ্ঠ পরিবর্তন, এ কথা এলিয়টই অত ভালো করে সাহিত্য প্রসঙ্গে বলেন প্রথমে। ঐতিহ্য বিচারে মার্কস যেমন করে ‘শেক্সপিয়র বালজাক, গয়টে, হায়নে কিংবা ইবসেনকে’ দেখেছিলেন, এলিয়টকেও সেভাবে দেখতে চেয়েছেন তিনি। দ্বিতীয়ত, শুধু ‘কর্ম’ বিচারের মানদণ্ডে নয়, বিষ্ণু দে এলিয়টকে দেখেছিলেন একই কবিতার পতাকার তলে বিচিত্রবিধ বিষয়বস্তু সমাবেশ করার নিরিখেও। কবিতা যে শুধু আত্মকেন্দ্রিক ‘নার্সিসিস্টিক’ প্রক্রিয়ার ফসল নয়, এর ভেতর দিয়ে যে পরিপার্শ্ব জনান্তিকে কথা কয়ে ওঠে তা এলিয়টের কবিতা পড়লে বোঝা যায়। তাই বিষ্ণু দে বলেছেন, ফোর কোয়ারটেট্‌সের ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস্‌’ই এর কবিতাচতুষ্টয়ের মধ্যে সবচেয়ে আঁটসাঁট কবিতা : ‘এখানে এলিয়ট শেষ করেছেন এয়ার-রেড রাত্রির জাঁকালো বর্ণনার পরে নটিংহ্যামের রয়্যালিস্ট চ্যাপেলে প্রথম চার্লসের নৈশাভিযানে যখন অন্তর্যুদ্ধে রয়্যালিস্টরা হেরে গেল। অবিসম্বাদী কবিত্বে এলিয়ট আর্তনাদ করেছেন পার্টি-রাজনীতির নশ্বরতায়। মৃত্যুতে, কালস্রোতে রয়্যালিস্টও শূন্যে বিলীয়মান, কী হবে কিছু ক’রে, ল’ড়ে, তাই হায় হায়।’ প্রু-ফ্রকের আত্মকেন্দ্রিক জগতের চেয়ে এই বোধ অনেক দূরের। তৃতীয়ত, বিষ্ণু দে মনে করেছেন, ‘পটভূমি ভিন্ন হলেও এলিয়টের অভিজ্ঞতার তুল্য মেলে আমাদের মধ্যে।’ আর সে কারণেই এলিয়টের সব কবিতার অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ‘বাধা থাকলে তাঁর রীতি আমাদের সহায়, এমনকি তাঁর কবিতার অলঙ্কার অঙ্গবিন্যাস, জগৎ ভিন্ন হলেও।’

সবশেষ, বিষ্ণু দে দৃষ্টি দিয়েছেন এলিয়টের ওরিয়েন্টালিজমের প্রতি। আমরা সচকিত না হয়ে পারি না যখন তাকে বলতে শুনি- ‘গীতা’ এলিয়টকে ‘তাঁর কাব্যের চমকপ্রদ রসদ জুগিয়েছে’। এলিয়ট কেন এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন এ প্রশ্নও তার মনে দেখা দিয়েছিল। ‘টি এস এলিয়টের মহাপ্রস্থান’ প্রবন্ধটি শুরুই হয় এলিয়টের ‘দ্য ড্রাই স্যারভেজেস’ থেকে বহু-উদ্ধৃত লাইনটির সূত্র দিয়ে। এর বঙ্গানুবাদ আমার সাধ্যাতীত, বিষ্ণু দেও চেষ্টা করেননি।

‘I Sometimes wonder if that is what Krishna meart-Among other things- or one way of putting the same thing : That the future is a faded song, a Royl Rose or Lavender spray of wistful regret for those who are not have to regret, Pressed between yellow leaves of a book that has never been opened.
And the way up is the way down, the way forward is the way back.
You cannot face it steadily, but this thing is sure.
That time is no healer : The Patient is no longer here.

রবীন্দ্রনাথও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনমৃত্যুর ছলার অনিবার্যতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এলিয়টেও পাই সেই বেদনার্ত উপলব্ধি-‘What man has made of man!’

ফোর কোয়ারটেটস্‌-এর দ্য ড্রাই স্যালভেজেস-এ এসে আমরা যে হঠাৎ করে কৃষ্ণের রেফারেন্স পাই তা আকস্মিক- এক ধরনের নাটকীয় অনুপ্রবেশ বলে মনে হতে পারে। এ ধরনের ওরিয়েন্টাল মোহ কী নেহাতই কাব্যের উদ্ভাবনী তাগিদে জন্ম নিয়েছিল। নাকি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দীর্ঘকালের পাঠ, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনা? এ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজব আমরা পরবর্তী অংশে।

৪. এলিয়টের ওরিয়েন্টলিজম

প্রাচ্যীয় দর্শনের প্রতি এলিয়টের মুগ্ধ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছিল দ্য ড্রাই সালভেজেসের বহু আগে থেকেই এলিয়টের হার্ভার্ড-সহপাঠী দার্শনিক রবার্ট র‌্যাট্রে ১৯৪০ সালের ৩রা মে রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে জানান একটি অবাক করা তথ্য :’আমি জানি না আপনি জানেন কিনা, আমার হার্ভার্ডের জনৈক সহপাঠী সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি এখন বিখ্যাত কবি-টি.এস. এলিয়ট।’ সেই সন্ধ্যা বলতে র‌্যাট্রে স্মরণ করেছেন ১৯১৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পাঠের কথা। সেই সন্ধ্যার রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন ‘দ্য প্রবলেম অব ইভিল’ (পরবর্তীতে ‘সাধনা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত) বিষয়ে। প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধ সমগ্রে স্থান পেয়েছে। সেই সন্ধ্যার স্মৃতিচারণ করে র‌্যাট্রে দীর্ঘ ২৭ বছর পরে রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখছেন : এলিয়টের সাথে তিন হার্ভার্ডে ভারতীয় দর্শনের ওপরে কোর্স নিয়েছিলেন : ‘আমরা একত্রে ভারতীয় দর্শন পড়তাম। এমন হতে পারে যে ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় তার ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ চরণটি সেদিনের সন্ধ্যায় আপনার পাঠ স্পেশাল স্মৃতি থেকে উঠে এসেছিল’ আমি তার কবিতার ভক্ত নই, কিন্তু বর্তমান খ্যাতির কথা চিন্তা করে এ তথ্য জানানো প্রাসঙ্গিক মনে হলো। এটি শুধু চিঠিতে নয়, রাট্রে দ্য এনকোয়্যারার পত্রিকার (১৬ মে ১৯৪০) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখেন :’ববীন্দ্রনাথ যখন হার্ভার্ডে ছিলেন তখন অধ্যাপক ও মিসেস উড্‌স একবার তার সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য অতিথিসৎকারের আয়োজন করেছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন টি. এস. এলিয়ট- তিনি আমাদের সহপাঠী ছিলেন (আমরা দুজনেই ভারতীয় দর্শন নিয়েছিলাম)। এই পার্টিতে রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক উড্‌সের অনুরোধে উপনিষদ থেকে শ্নোক আবৃত্তি করেন, কোনো যন্ত্রের অনুষঙ্গ ছাড়াই খুব সহজভাবে তাঁর নিজের রচিত গান গেয়ে শোনান এবং তখনো অপ্রকাশিত ‘ডাকঘর’ নাটক থেকে পাঠ করেন। অসাধারণ কেটেছিল সেই সন্ধ্যাটি। সমীর সেনগুপ্ত রচিত ‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’ গ্রন্থে র‌্যাট্রে রবীন্দ্রনাথ পত্রালাপের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।

র‌্যাট্রের চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত হয়েছিলেন। এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ তিনি আগেই পাঠ করেছিলেন। কিন্তু এটি তিনিও আন্দাজ করতে পারেননি ওয়েস্ট ল্যান্ডের সমাপ্তি চরণটির পেছনে তার অপ্রত্যক্ষ অবদান ছিল। র‌্যাট্রেকে যে-চিঠি রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তরে লেখেন, তা নিম্নরূপ :

‘আপনি মি. টি. এস. এলিয়ট সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা খুব কৌতূহলের সাথে পড়লাম- তার কাব্যের কোন কোন অংশ তাদের আলোড়ন জাগানিয়া ক্ষমতায় ও অসাধারণ শিল্প সৌকর্যে আমাকে বিস্মিত করেছে। বেশ কিছুকাল পূর্বে আমি তাঁর ‘জার্নি অব দ্য ম্যাজাই’ কবিতাটি অনুবাদ করেছি এবং র‌্যাট্রের যে-সম্ভাবনার কথা তুলেছেন তা কষ্টকল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উপনিষদের প্রতিটি মন্ত্রের সমাপ্তি হয় আনুষ্ঠানিক রীতিতে- ‘ওম শান্তি, ওম শান্তি, ওম শান্তি’ শব্দটি তিনবার উচ্চারণ করে। সেদিনও উড্‌স সাহেবের বাসায় রবীন্দ্রনাথ এটি করে থাকবেন। অন্যদিকে, এলিয়ট শুধু সেই সন্ধ্যাতেই নয়, অন্যত্রও রবীন্দ্রনাথকে শুনে থাকবেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানেও এলিয়টের উপস্থিত থাকার কথা। রবীন্দ্রনাথ হার্ভার্ডে অন্তত চারটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন- একটি অধ্যাপক উড্‌স-এর দর্শন ক্লাসে। একটি হার্ভার্ড ফিলোসফিক্যাল ক্লাবে এবং তৃতীয়টি এন্ড ওভার স্কুলের ডিভিনিটি ক্লাবে। এ ছাড়াও এমার্সন হলে Realication of Brahma নামে বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অন্তত অধ্যাপক উড্‌সের ক্লাসে এলিয়টের উপস্থিত থাকার কথা। এই বক্তৃতাগুলো রবীন্দ্রনাথের কবি-পরিচিতির পাশাপাশি তাকে দার্শনিক-পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সন্দেহ নেই। অধ্যাপক উড্‌স কবিকে জানিয়ে ছিলেন যে তাঁর এই প্রবন্ধগুলো একত্রিত করে বই-আকারে দ্রুত প্রকাশ করা দরকার এবং তিনি স্বয়ং এক্ষেত্রে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। শুধু তা-ই নয়, এই প্রবন্ধ-সংকলনের ভূমিকাও লিখতে তার আগ্রহের কথা জানান, উড্‌স : ‘আপনাকে যেসব চিন্তাবিদ প্রভাবিত করেছেন সে সম্পর্কে আরো জানতে চাই আমি, বিশেষত কবীর-এর বিষয়ে। আপনি বা [ক্ষিতিমোহন] সেন এ ব্যাপারে তথ্য জানালে আমি আপনার দর্শনের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রচনা করতে পারতাম।’ এ কথা প্রশান্ত কুমার পাল তার ‘রবিজীবনীর’ ৬ষ্ঠ খণ্ডে জানিয়েছেন আমাদের। সে বছর রবীন্দ্রনাথ শুধু হার্ভার্ডেই নয়, আর্বানা ও শিকাগোসহ অন্যান্য শহরেও গুরুগম্ভীর দার্শনিক বিষয়ে ‘গদ্য-বক্তৃতা’ দিয়েছিলেন, যা পরে তার ‘সাধনা’ প্রবন্ধমালায় মূল ইংরেজিতেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯১২-১৩ সালের ইউরোপে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফরকে এক অর্থে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক হয়ে ওঠার বছর বলা যায়। কবি হিসেবে নোবেল প্রাপ্তির আগে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের একজন দার্শনিক হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন এ কথাও মনে হতে পারে।

তবে ওয়েস্ট র‌্যাট্রের শেষ চরণে এলিয়ট যে সহসা শান্তি-স্ত্রোত্র পাঠক করে বলে উঠলেন ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ (অবশ্য ‘ওম’ শব্দটা বাদ দিয়ে) সেটা কেবল রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রাণিত হয়ে রচিত হয়েছিল। এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে। ওয়েস্ট ল্যান্ডের রচনা কাল আরো পরে-১৯২১ বা তার কিছু কাল আগে থেকে। রবীন্দ্রনাথ যখন হার্ভার্ডে গেছেন সেটা ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনার সাত-আট বছর আগে। ফলে ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনার কালে এত বছর আগের স্মৃতি এলিয়টের মধ্যে কাজ করছিল তা নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। সুবিদিত যে, ওয়েস্ট ল্যান্ডে পূর্ববর্তী বিভিন্ন সাহিত্যিক ও দার্শনিক ঐতিহ্যের পদচিহ্ন রয়ে গেছে। সেগুলো এলিয়ট রেখে-ঢেকে রাখতে চাননি। বরং বহু পাদটীকা দিয়ে পাঠককে তার শ্রমনিষ্ঠ নির্মাণের প্রতি গোড়া থেকেই সজাগ রাখতে চেয়েছেন। এলিয়টের এনসাইক্লোপেডিক মননের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার বন্ধু কবি এজরা পাউন্ডের ‘লাইন-বাই-লাইন’ ধরে গভীর পাঠ। পাউন্ডের ক্ষুরধার সমালোচনার মুখে কেটে ফেলতে হয়েছে ওয়েস্ট ল্যান্ডের আদি-পাঠের প্রায় অর্ধেক ভাগ। পাউন্ড নিজে এ নিয়ে এলিয়টকে হাস্যোচ্ছলে লিখেছেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে :

‘These are the Poems of Eliot
… … … … … …
If you must needs enquire
Know diligent Reader
That on each Occasion
Ezra performed the Caesarean Operation’

পাউন্ড বা এলিয়ট আদি-খসড়ার ওপরে সংশোধনী চলাকালে কোথাও রবীন্দ্রনাথের কোনো উল্লেখ করেননি পাণ্ডুলিপির ভেতরে। পরবর্তীতেও এ নিয়ে দু’জনের কেউই কোনো মন্তব্য করেননি।

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

লেখাটিতে এলিয়ট এসেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে। সাহিত্যের প্রভাবক কী- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এখানে জীবনানন্দ। শুধুমাত্র এলিয়টের উদ্ৃব্দতির অংশটুকু ইংরেজিতে রেখে বাদবাকি অংশের প্রয়োজনীয় লাইনগুলো বাংলায় বেশ কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েই তার তর্জমা করে দিচ্ছি। এতে করে সমালোচক জীবনানন্দের বিশ্বাসের জায়গাটি কিছুটা হলেও ফুটে ওঠে :

‘খুব দূরবর্তীভাবে আমি হয়ত রাজনীতির ছাত্র। অর্থনীতিবিদ হতে কখনো চেষ্টা করিনি। আধুনিক বিশ্বের নানাবিধ সমস্যার অর্থবহ ও যুক্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার বিজ্ঞান হচ্ছে এই শাস্ত্র। …. আমি জানি আধুনিক জগতের রাজনৈতিক সম্পর্কজাল ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ না বুঝতে পারলে… আজকের হতাশা ও আশা কোনোটারই সঠিক পরিমাণ করা যাবে না। কেন আমরা যারা অক্ষরজীবী- তথাকথিত ‘ম্যান অব লেটার্স’- তাদেরকে বিশেষ করে সমসাময়িক রাজনীতি বা অর্থনীতির মধ্যে অবগাহন করতে হবে? … এর একটি প্রধান কারণ হয়তো এই যে, আমরা কোন পৃথিবী নেই যাকে যে কোন অর্থেই একটি বাসযোগ্য সুখী ভুবন বলা যায়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকের কার্যকারণের ঘনিষ্ঠ উপলব্ধির দ্বারা আমরা এ কথা বুঝতে পারি। এটাও জানি, এই দুর্গতির থেকে সহসা পরিত্রাণের উপায় নেই। তারপরও এ দেশের বা অন্য দেশের বা সারা পৃথিবীরই সংকট জেনে এ কথা বুঝতে পারি, ভবিষ্যতের পৃথিবীর অর্থনৈতিক ভিত্তি ত্রুটিমুক্ত করেই এবং রাজনৈতিক মাৎসন্যায় দূর করেই এগোতে হবে আমাদের। এ কাজে অক্ষরজীবীদের ভূমিকা কতটুকু তা স্পষ্ট নয়। বর্তমান সমাজের ধারায় তারা অনেকটাই ‘মিস-ফিট’। হয়ত আগামীতে অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত সমাজ এলেও শিল্পী-সাহিত্যিকদেরকে প্রথমে আবদ্ধ করে রাখা হবে। বর্তমান অবস্থায় রাজনীতির সমস্যায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের জড়িয়ে পড়তেই হবে এমন কোন কথা নেই।

তাদের শুধু মনে রাখতে হবে- কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে, সর্বত্রই পলিটিক্স হচ্ছে ‘পাওয়ার-পলিটিক্স’ কেবল এবং এই পলিটিক্সই নানা ভাবে, নানা নামে, নানা ঐতিহ্যের টানে ও ভাবাদর্শের (বিভিন্ন বিরোধী তত্ত্বের সমাবেশের) ছত্রছায়ায় অর্থনীতিতে স্থান করে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই রাজনীতি ও অর্থনীতি এক বৃহদাংশ মানব জাতিকে কখনো সান্ত্বনা দিয়ে, কখনো প্রতারণা করে, কখনো অনুপ্রাণিত করে, আবার কখনো সংগ্রামের ডাক দিয়ে প্ররোচিত করে যাচ্ছে।… অক্ষরজীবীরা আধুনিক সম্পর্কজালের এই মৌলিক অসুখ অনুভব করেন- এসবের কোথাও তারাও সিস্টেমের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছেন। এখান থেকে তার পরিত্রাণ নেই- পরিত্রাণ কোথাও নেই। তার কাছে মনে হতে পারে যে, সামনেই কোন পিচঢালা, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাস্তা খোলা রয়ে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, এ রকম কোনো পন্থা আমাদের সামনে খোলা থাকবে না, অন্তত আগামী কয়েক দশকে তার সম্ভাবনা নেই।… অক্ষরজীবীরা এই অবস্থায় তার সাহিত্য-রচনায় আগামীর সুখী সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের কাহিনী রচনা করবেন, এটা আমি প্রত্যাশা করতে পারি না। আবার তারা রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে আজকের দিনের বিরতিহীন দুঃখ-দুর্শশার খুঁটিনাটি নির্মাণে ব্যাপৃত হবেন সে বাধ্যবাধকতাও তার নেই।… সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে এক ধরনের সংকট নেমে এসেছে। বিশ্ব-জোড়া উথাল-পাথালের এই সময়ে স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ভালো মানের উপন্যাসকে নিকৃষ্ট মানের উপন্যাস থেকে পৃথক করার চাবিকাঠি যেন হারিয়ে ফেলেছি; রাজনীতির শ্বাসরুদ্ধকর প্রভাব থেকে উপন্যাসকে বাঁচানো যাচ্ছে না, বা কবিতাকে অর্থনৈতিক ছায়া থেকে।… এই নতুন যুগের সঙ্গে সাহিত্যকে মানিয়ে চলতে হবে ঠিক, কিন্তু অন্যান্য যোগসূত্রকে অস্বীকার না করে, যা বর্তমানের বা ভবিষ্যতের বাইরে [এবং যা সেই অর্থে হবে- চিরকালের]।… এটা বোঝার জন্য সাম্প্রতিক ব্রিটিশ সাহিত্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই।’ এটা বলে জীবনানন্দ এলিয়টের ‘Triumphal march’ কবিতা থেকে একটি উদ্ৃব্দতি দিলেন :

ÔWe can wait with our stools and our sausages.
What comes first? Can you see? Tell us. It is
5,800,000 rifles and carbines,
102,000 machine guns,
28,000 trench mortars,
53,000 field and heavy guns,
I cannot tell how many projectiles, mines and fuses.

তার পরপরই জীবনানন্দের মন্তব্য হলো :”ঠিক এভাবেই যে [পরিসংখ্যান উদ্ৃব্দত করে] এখানে তাকে প্রকাশ করতে হলো সেই ভঙ্গিমাটি আমার দৃষ্টি কেড়েছে। তবে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এবং ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’-এর কবিতাগুলোর বেশিরভাগ জুড়েই রয়েছে এ ধরনের বলবার ভঙ্গি। এর পেছনে রয়েছে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার তীব্র চাপ- যার ভেতরে কবিতার ‘ফিউশন’ ঘটে থাকে। এবং সেটাই আসলে দেখার বিষয়।”

এর ছয় বছর বাদে এলিয়টের প্রসঙ্গ উঠে আসে তার ‘The Three Voices of poetry’ কাব্যবিষয়ক প্রবন্ধ-গ্রন্থের আলোচনায়। এই বক্তৃতায় এলিয়ট তিন ধরনের কবিকণ্ঠের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি স্বগতোক্তিমূলক; দ্বিতীয়টি রচিত শ্রোতাদের উদ্দেশ করে; আর তৃতীয় কবিকণ্ঠটি নৈর্ব্যক্তিক ধাঁচে গড়া। তবে জীবনানন্দ বলছেন, এসবই বিশুদ্ধ বিভাগ, অনেক কবিতাই মিশ্ররীতিতে বোনা- যেখানে কবি কখনো বলছেন, ‘নেহাতই নিজের কানে-কানে বা জনান্তিকে’, আবার কখনো বলছেন নাট্যরীতিতে- কেবল ‘নিজেকে-মাত্র স্মরণ করে নয়।’ এলিয়টের বক্তব্য হচ্ছে, ‘কবিতা ত্রিস্বরা- যদিও নিজের শ্রেণি অনুযায়ী একটা প্রধান সুর বহন করে চলেছে [প্রতিটি কবি]।’

এলিয়ট সম্পর্কে জীবনানন্দের সতর্ক প্রশস্তি ছিল। সে প্রেক্ষিতে বিষ্ণু দে-র উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো। ১৯৩২ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এলিয়ট নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন বিষ্ণু দে। এমনকি ১৯৭১ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণকালে তিনি বিশেষ করে স্মরণ করেন এলিয়টের কথা : “আবার আমি স্মরণ করি এখানে টি. এস. এলিয়টকে। তার ‘ঐতিহ্য’ ও ব্যক্তিক গুণীপনা আমাকে আবার বিকাশে সাহায্য করেছিল প্রচুর।’ এলিয়ট সম্পর্কে বিষ্ণু দে-র সুবিখ্যাত প্রবন্ধ তিনটি হলো- ‘টি.এস. এলিয়টের মহাপ্রস্থান’ (‘রুচি ও প্রগতি’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত), ‘টমাস স্টার্নস এলিয়ট’ (‘এলোমেলো জীবন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত) এবং ‘এলিয়ট প্রসঙ্গ’। এলিয়ট সম্পর্কে বিষ্ণু দে-র ঘনিষ্ঠ মনোযোগ কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না। বিষ্ণু দে শুধু মার্কসবাদে দীক্ষিত ছিলেন না, মার্কসবাদ সম্পর্কে বৃত্তের বাইরে গিয়ে তত্ত্ব-চিন্তা করেছিলেন। এ জন্যই যখন তিনি বলেন, ‘অজ্ঞাতসারেই এলিয়টের সমালোচনায় মার্কস অঙ্গীকৃত, তাঁর কাব্যের যুক্তিতে সাম্যবাদীর আরম্ভ, যদিও হয়ত সে-সত্য তিনি জানেন না বা মানেন না’- তাকে আমরা অযৌক্তিক দাবি বলে উড়িয়ে দিতে পারি না।

বিষ্ণু দে-র এলিয়টকে বুঝতে হলে বিষ্ণু দে-র আরাগঁকে বুঝতে হবে আগে। লুই আরাগঁ ছিলেন যুদ্ধোত্তর ফ্রান্সে পুরোধা কবি, পল এলুরাবের মতোই খ্যাতিমান ও প্রগতি-পন্থার পথিক। সেই আরাগঁ একদা বলেছিলেন, ‘কাব্যের ইতিহাস তার টেক্‌নিকের ইতিহাস। যারা আমাদের নীরব করতে চায় তারা সেই শ্রেণির নিকৃষ্ট লেখক, যারা কিছুই নির্মাণ করেনি, যারা শুধু গোটা কয়েক ছক টেনে প্যাঁচ কষেই ক্ষান্ত হয়। আমি ত আজ অবধি কবিতার প্রতিটি অঙ্গ বিষয়ে না-ভেবে, আগের লেখা আর পড়া কাব্যাবলি বিষয়ে সচেতন না-হ’য়ে কোন কবিতা লিখিনি।’

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism, and Tagore)

পর্ব ::২৬

[পূর্ব প্রকাশের পর]

পরবর্তী যুগে এ ‘নাউ’ ও ‘ফ্রন্টিয়ার’-এর মতো সাহসী পত্রিকার সম্পাদক হয়ে সমর সেন ক্ষুরধার কলম ধরেছিলেন ঘনায়মান স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষাট-সত্তরের দশকে। বাংলায় যেমন লেখা হয়েছিল তার অনুপম গদ্য-গ্রন্থ ‘বাবু বৃত্তান্ত’, ইংরেজিতে লেখা তার কলামগুলোও ছিল তেমনিভাবে একাধারে যুক্তিনিষ্ঠ ও সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ। এ যেন সমর সেন চল্লিশের যুগের ব্ল্যাক-আউটের রাত্রিতে বসে এলিয়ট পাঠ করে চলেছেন, এলিয়টের স্বকণ্ঠে আবৃত্তি শুনবেন বলে উদগ্রীব হয়ে রেডিওর সামনে বসে আছেন এবং আর সব কবিদেরও সেই আবৃত্তি শুনতে বলছেন। একগুচ্ছ উদাহরণ :

১. বুদ্ধদেব বসুকে ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসের এক চিঠিতে এলিয়টের ফোর কোয়ারটেট্‌স নিয়ে লিখছেন :’গতকাল এলিয়ট BBC-তে East Coker-এর আবৃত্তি করলেন। চমৎকার লাগল। আপনি শুনেছেন না কি? আসছে সপ্তাহে Burnt Norton পড়বেন। দিনটা এখনও announce করেনি। এলিয়টের গলায় mature melancholy উপভোগ্য।’

২. বিষুষ্ণ দে’কে ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে এক চিঠিতে লিখছেন : ‘আসছে মঙ্গলবার রাত্রি আটটার সময় (ওঝঞ) এলিয়টের একটি বক্তৃতা আছে বিবিসি থেকে।’

৩. বিষ্ণু দে’কে ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আবার এক চিঠিতে লিখছেন :’মাঝে বিবিসিতে পরপর তিন সপ্তাহে এলিয়ট সাহেব East Coker, Burnt Norton ও Dry Salvages পড়বেন। সবচেয়ে ভালো হয়েছিল প্রথমটি। কিন্তু দেখলাম আপনার চেয়ে সুধীন বাবুর আবৃত্তির সঙ্গে এলিয়ট সাহেবের আরো মিল।’

সমর সেনের ওপরে এলিয়টের প্রভাব নিয়ে অমিয় কুমার বাগচী তার ‘সমর সেন ও ভারতীয় বুদ্ধিজীবীর সমস্যা’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে ইতিহাসের মধ্যে অনেক ভুলভুলাইয়া ও চোরাগলি থাকে। সে রকমই কানাগলির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর তারই যন্ত্রণাবোধ প্রকাশিত সমর সেনের কবিতায় ও গদ্যে : ‘এলিয়টের জীবনধারণ ও জীবনকৃতির সঙ্গে সমর সেনের জীবনধারণা ও জীবনপাতের ইতিহাস একেবারেই মেলে না। এলিয়টের মতো এবং এলিয়ট-প্রভাবিত আরও বিশিষ্ট বাঙালি কবির মতো তিনি জানতেন বোদ্ধা মানুষের আত্মম্ভরিতা কত ঠুনকো। কত দুর্বলাভিত্তি। কত অর্থহীন। কিন্তু এই নির্বেদ থেকে বাঁচার জন্যে অ্যাংলো-ক্যাথলিকের বিশ্বাসের কোনো ভারতীয় সংস্করণ তিনি খোঁজেন নি। প্রাচীন ভারতের স্বপ্নে নিজেকে মজিয়ে দিতে চান নি অথবা বিশুদ্ধ সংস্কৃতির পিছনে সারাজীবন ধাওয়া করে বেড়ান নি।’

মূল ইংরেজি স্তবক যেখানে এলিয়ট ইতিহাসের ভুলভুলাইয়ার কথা পেরেছিলেন, তা এই রকম। বিখ্যাত সেই উপলব্ধি :

‘After such Knowledge, what forgiveness? Think now History has many Cunning Passages, Continued corridors And issues, deceives with whispering ambitions, Guides us by vanities.’

সমর সেন (বা বিষ্ণু দে’র) জীবন চর্চা ও আদর্শ এলিয়টের থেকে পৃথক ছিল, কিন্তু তার বিষণ্ণ উচ্চারণের ধরনেরও উপলব্ধির ছায়া পড়েছিল তাদের কাব্যে।

অমন যে নিভৃতচারী জীবনানন্দ, তিনিও এলিয়টের প্রতি জানিয়েছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জীবনানন্দের নানা লেখায় এলিয়টের আলোচনা অনিবার্যভাবেই এসে পড়েছে। কবিতা কি কেবল কিছু স্মরণযোগ্য লাইনের সমাবেশ? এই প্রশ্ন তুলে জীবনানন্দ তার সমসাময়িক কাব্যধারা সম্পর্কে লিখলেন :

‘রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় উক্তির স্মরণযোগ্যতার প্রাচুর্যই খুব বেশি; ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্লেভারনেস’। ঠিক সে-জিনিস নয়- তার চেয়ে খানিকটা উঁচু তারে বাঁধা লাইন ও পঙ্‌ক্তির সমষ্টিই ঢের বেশি। একেই অনেকে কবিতা বলতে চান। আধুনিক ইংরেজি কাব্যের ক্ষেত্রেও দেখি এ রকম লাইন ও ‘স্ট্যানজা’ নিয়ে, যা সৃষ্ট হচ্ছে তা-ই কাব্য বলে পরিচিত হয়ে আসছে।

এ কথা বলার পরপরই তিনি ব্যতিক্রমী কবি হিসেবে এলিয়টের উদাহরণ দিলেন :

“এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর কোনও অংশকেই বাকচাল এমনকি সহনীয় চাতুর্য বললেও অন্যায় করা হবে হয়তো, কিন্তু কানিংস ইত্যাদি অনেকের কবিতা অবান্তর চাতুরী ছাড়া আর কিছুই নয়। অডেন, স্পেন্ডর, ম্যাকনিস প্রমুখ কবির অনেক লেখাও এই ধরনের। এজরা পাউন্ড-এর আগেকার রচনাগুলো বাস্তবিকই কবিতা- তাঁর আধুনিক কাল্টোজ মহাকাব্যের অর্থ ও ইঙ্গিত বুঝবার ক্ষমতা আমাদের তো দূরের কথা, স্বয়ং ইয়েটস-এর কপালেও ঘটে ওঠেনি; এলিয়টও কি বুঝেছেন?”

স্পষ্টতই এলিয়টকে তিনি আর সকলের থেকে আলাদা সারিতে দেখেছেন তার প্রিয় কবি ইয়েটস-এর সাথে একই স্তরে। উপরের উদ্ৃব্দতি দুটো ‘উত্তর-রৈবিক বাংলা কাব্য’ (১৯৪৫) থেকে নেওয়া। জীবনানন্দের বেশিরভাগ প্রবন্ধই হয় অপ্রকাশিত থেকে গেছে তার জীবদ্দশায়, অথবা প্রকাশিত হয়েছিল কোনো কলেজ-পত্রিকায় বা স্বল্পখ্যাত স্বল্পায়ু সাময়িকীতে। এর ফলে এলিয়টের প্রতি জীবনানন্দের গভীর উপলব্ধির কথা অনেকটাই আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। যেমন, কবিতার সমালোচনায় প্রথম অধিকার কবিদেরই, এমনকি তারাই হতে পারেন কবিতার শ্রেষ্ঠ সমালোচক- এলিয়টের এই আপ্তবাক্যের প্রতি জীবনানন্দের সমর্থন ছিল। ‘কবিতা, তার আলোচনা’ (১৯৪৯) প্রবন্ধে এলিয়ট অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি লিখছেন :

‘আমাদের দেশে গত দশ-পনেরো বছরে দেখা গেছে এমন সব লোক কবিতা সঙ্গীত মজলিসি সমাজকথা দেশ-বিদেশের মাঝে ও মেজাজ সম্বন্ধে একই নিঃশ্বাসে ভাষ্যকারের ভূমিকায় এমন আশ্চর্য সিদ্ধি দেখিয়ে গেছেন যে, কবি ও কবিতা কতকগুলো কবিতার বই ও সংকলন সম্পর্কে অনেক আধাআধি সত্য ও অস্পষ্ট ধারণা এখনও জের টানছে।… এ রকম মানুষদের হাতে কোনও যুগের কোনও দশকের কাব্যের বড় সমালোচনা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। সমালোচনার ক্ষতি হবে তাতে; কবিতারও ক্ষতি হবে; পাঠকেরাও ভুল জিনিস চাইবেন কবিতার কাছ থেকে।

কবিতার সৎ সমালোচনা আসতে পারে কবিদের কাছে থেকেই- বড় কবিরাই উপহার দিতে পারবেন কাব্যের বড় সমালোচনার-এর উদাহরণ হিসেবে জীবনানন্দ স্মরণ করলেন এলিয়ট প্রমুখ কবিকে :

‘ইংলন্ডে কবিতার বিশেষ পাঠ- বড় সমালোচনা কবিদের দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে করা হয়েছে : ড্রাইডে-এর পর জনসন। তার পর কোলরিজ, অল্প পরিসরে খুব বিখ্যাতভাবে ওয়র্ডসওয়র্থ পত্রের ভিতর দিয়ে কিটস, ডিকেন্স-এ শেলি, পরে আর্নল্ড, ইয়েটস ও পাউন্ড- আজকাল এলিয়ট।’

এলিয়টের প্রসঙ্গ আরো বিস্তৃত হয়ে এসেছে ‘আধুনিক কবিতা’ (১৯৫০) প্রবন্ধে :

‘কিছুকাল থেকে এলিয়টকে নিয়ে নানা দিকের উৎসুক ভাবুক ও পণ্ডিত মহলে- য়ুনিভার্সিটিতেও কথাবার্তা চলছে… (এলিয়ট সম্বন্ধে কয়েকখানা প্রায়-প্রামাণ্য আলোচনার বইও ব্রিটিশ সমালোচকদের হাতে তৈরি হয়ে গিয়েছে)।’ একই প্রবন্ধে কবিদের করা কবিতার আলোচনার ভেতরে উৎকর্ষের পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে আবারো জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথ ও এলিয়টের প্রসঙ্গ একযোগে টেনে আনছেন :

‘রবীন্দ্রনাথ শেলিকে আর্নল্ড-এর চেয়ে স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন এবং এলিয়ট ইংলন্ডের জর্জীয় কবি ও সমালোচকদের চেয়ে বেশি যুক্তিসিদ্ধ ভাবে। আমার মনে হয়, এলিয়ট যা পেরেছেন তার চেয়ে বেশি সংশ্নেষপূর্ণ প্রাণবত্তার ইংলন্ডের উনিশ শতকের কোনও-কোনও কবিকে ধরতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ- যদিও এলিয়ট-এর বিচার ও বিশ্নেষণ, ও যে-ভাষায় তা প্রকাশ করা হয়েছে, সেই সমীচীন মেধাউজ্জ্বল স্পষ্টতার ফলে, আমরা … যা জ্ঞান লাভ করেছি- এলিয়ট-এর সমালোচনা অবর্তমান থাকলে সেটা পাওয়া কঠিন হত নিশ্চয়ই।’ তার পরপরই পাঠককে সতর্ক করে দিচ্ছেন জীবনানন্দ- ‘এলিয়ট-এর সমালোচনার পদ্ধতি ও মীমাংসার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মতভেদ রয়েছে আনেকখানি যদিও।’

এ তো গেল ‘সমালোচক’ এলিয়ট সম্পর্কে জীবনানন্দের অভিব্যক্তি। কিন্তু তার কবিতা সম্পর্কে কী ভেবেছিলেন জীবনানন্দ? ১৯৩৭ সালের একটি অপ্রকাশিত লেখায় তিনি অনুভূতিকে জীবনানন্দীয় ধরনে এভাবে প্রকাশ করেছিলেন। ‘কবিতা ও কঙ্কাবতী’ শীর্ষক লেখার খসড়ায় তিনি লিখছেন :

“টি. এস. এলিয়ট-এর কবিতা সম্বন্ধে কোনও কথা বলতে আমি নানা কারণে দ্বিধা বোধ করি। কিন্তু তবুও তাঁর ‘দ্য লাভ সঙ অফ আলফ্রেড প্রুফ্রক’ পড়ে যদি তরুণ-তরুণীরা মনে করেন মানবপ্রেমের নব-সংস্কারের বাণী নিয়ে এসেছেন কবি, এসেছেন একজন নতুন সমাজ-সংস্কারক- এসো, আমরা আমাদের জীবনে তাঁর প্রেমের-সংস্কারকে প্রতিষ্ঠিত করে ক্রমে-ক্রমে ‘হলো ম্যান’ এবং ‘হলো ওম্যান’ হয়ে যাই, তা হলে বুঝতে হবে এলিয়ট-এর ছেঁড়া ছেঁড়া সৌন্দর্য-কুয়াশাকে ধরতে না পেরে হাড় নিয়ে খটখট করছে তারা। এলিয়ট-এর কবিতা যেখানে বাস্তবিকই কবিতা, সেখানে মুখ্যত সমাজ সংস্কার সৃষ্টি; শুধু বা কোনও সংস্কারই তারা নয়। কবি চিত্তের আবেগেই সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন।”

এলিয়টের কবিতার বৃহৎ পরিসর আলোচনা জীবনানন্দ করেছেন অবশ্য তার একটি স্বল্প পরিচিত ইংরেজি লেখায়। সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পাদিত ‘কনটেম্পোরারি’ বইতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, কমরেড পাবলিশার্স থেকে। এই প্রবন্ধের প্রথম লাইনটি ‘অন্য জীবনানন্দ’ সম্পর্কে আমাদেরকে সচকিত করে : : ‘I may be a student of politics- in a faint way’ । ঐ প্রবন্ধে এলিয়টকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কাব্যালোচনা করেছেন তিনি।

[ক্রমশ]