পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৯

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

২. লোহানীর স্বীকৃতির প্রশ্ন

১৯৮৭ সালে ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যার জন্য লোহানীর ওপরে মতিউর রহমানের সঙ্গে মিলে আমি একটি পরিচিতিমূলক লেখা তৈরি করি। আশির দশকে বসে জানা সম্ভব ছিল না লোহানীর কোথায় এবং কীভাবে মৃত্যু ঘটেছিল। রুশ মহাফেজখানার তরফে তখন যেটা জানানো হয়, সেটা হলো একটা ‘ওয়ান-ওয়ে টিকিট’ কেটে রাশিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ২০০৩ সালে আলোকচিত্রী ডেভিড কিং ‘অর্ডিনারি সিটিজেনস :দ্য ভিকটিম অব স্টালিন’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। তিরিশের শুদ্ধি অভিযানের যুগে তৎকালীন সোভিয়েত পার্টির সদস্য এবং অসদস্য সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যারা অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের নাম ও ছবি সংবলিত বই ছিল এটি। কিং-এর বইয়ের ১৩৫নং পাতায় হঠাৎই আবিস্কৃত হন লোহানী। যারা নেপথ্য কাহিনি জানেন না, তাদের পক্ষে বোঝা শক্ত যে, এই লোহানী আমাদেরই সিরাজগঞ্জের লোহানী। কেননা, সেখানেও তার পরিচিতি হিসেবে লেখা নিম্নরূপ :

‘১৮৯২ সালে ভারতে জন্ম। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।’

বিষণ্ণ সে পোর্ট্রেট। বোঝা যায় যে, এনকেভেদের (কেজিবির পূর্বসূরি) জেলে অত্যাচারের এক ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই যেন আর অবশিষ্ট নেই। এমনটাই লাগছে জিনোভিয়েভ-এর ছবিও। ১৯১৯ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত কমিনটার্নের চেয়ারম্যান জিনোভিয়েভ। স্টালিনের কীর্তির বিরুদ্ধাচরণের দায়ে তাকে ১৯২৭ সালে বহিস্কার করা হয়। ১৯৩৬ সালে শুদ্ধি অভিযানের প্রথম ধাপে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। ঠিক তারই দু’বছর পরে লোহানীর মৃত্যু হয়-ওই ফায়ারিং স্কোয়াডেই। জিনোভিয়েভ ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য- রাজনৈতিক মতপার্থক্য গুরুতর আকার ধারণ করেছিল ২০-এর দশকের শেষে। কিন্তু লোহানী তিরিশের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবু তার মৃত্যু হলো কেন এমনভাবে? গোপেন চক্রবর্তীর মতো তিনিও তো অব্যাহতি পেয়ে যেতে পারতেন রুদ্ররোষ থেকে।

আমার অনুমান সেটা হয়নি দুই কারণে। প্রথমত, তিনি এমএন রায়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন একটা বড় সময় পর্যন্ত। ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব জাসেস’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এমএন রায়; কিন্তু প্যারিস থেকে সেটি প্রকাশ করার দায়িত্ব ছিল লোহানীরই ওপরে। প্যারিসের পাট গুটিয়ে এক সময় লোহানীকে চলে আসতে হয় মস্কোয়। ততদিনে এমএন রায়ের সঙ্গে সোভিয়েত পার্টির বিরোধ তুঙ্গে। বিশের দশকে চীনের প্রতি কমিনটার্নের নীতিনির্ধারণের নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিলেন রায়। এটা শেষ পর্যন্ত হটকারী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ট্রটক্সি-পন্থি ‘পারমানেন্ট রিভ্যুলিউশন’-র ধারার প্রতিও সহানুভূতি ছিল তার। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রটস্কি রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হন, প্রায় একই সময়ে এমএন রায়কেও কমিনটার্ন থেকে বহিস্কার করা হয়। ফলে ট্রটস্কি-এমএন রায়-লোহানী এমন একটি যোগসূত্র টানা বিচিত্র ছিল না এনকেভেদের গোয়েন্দাদের পক্ষে। বিশেষত ১৯৩৮ সালে এর দায়িত্ব যখন গিয়ে পড়ে ইয়েজভের ওপরে। ১৯৩৮-৪০ পর্বে ইয়েজভের হাতেই পরিচালিত হয় সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৩৪-৩৬ পর্বে ইয়াগোদার এনকেভেদে এবং ১৯৪০-৫৩ পর্বে বেরিয়া’র কেজিবির তুলনায় অনেক বেশি নিষ্ঠুর ছিল ইয়েজভের এনকেভেদে। রুশ ভাষায় ইয়েজভের কাল বা ‘ইয়েজভশিনা’ নামে একটি প্রবাদবাক্যই চালু হয়ে গেছে নিষ্ঠুর শাসন বোঝাতে। ফলে এ সময়ে ট্রটস্কির বা এমএন রায়ের সঙ্গে কোনো প্রকার সুদূর বা নিকট সংশ্নিষ্টতাও লোহানীর জন্য চরম আশঙ্কার কারণ হতে পারত।

দ্বিতীয় একটি কারণও ক্রিয়াশীল ছিল। লোহানী ১৯২১ সালে মস্কোয় প্রথমবারের মতো আসার আগে বার্লিনে অবস্থান করছিলেন। বার্লিনে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি ‘গ্রুপ’ গড়ে উঠেছিল। বার্লিনে ১৯১৬-১৮ সাল থেকেই এরা জড়ো হতে থাকেন; তার কারণ- এখানে বিপ্লব-পরিস্থিতির সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের পর ইউরোপের সবচেয়ে সফল বিপ্লবের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বার্লিনে। এখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের সময় থেকেই। সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের বেশিরভাগ নেতাই ছিলেন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ভেতরে বিপ্লব আশঙ্কা আরও তীব্র হতে থাকে। ‘স্পাটার্ক’ গ্রুপের নেতৃত্বে চলে আসেন কার্ল লিবক্‌নেখট, রোজা লুক্সেমবার্গ। এরা অক্টোবরের বিপ্লবের ধারায় ‘বিশ্ব-বিপ্লবকে’ সম্পন্ন করার স্বপ্ন দেখতেন। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি এ রকম একটি প্রায়-সফল অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কাইজারের সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন কার্ল ও রোজা দু’জনেই। এই অভ্যুত্থানের পটভূমিকায় রচিত হয়েছে আলফ্রেড ডবলিনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বার্লিন আলেকজান্ডার প্লাজ’। বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাজ বা স্কয়ারের চারপাশে শ্রমজীবী মানুষের বসবাস (যেমন আমাদের একদার তেজগাঁও, টঙ্গী, ডেমরা বা হাল আমলের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল)। এই উপন্যাস কতটা মৌলিক ও চিত্তাকর্ষক তা বোঝানোর জন্য বলি যে, একে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তুলনা করেছেন জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসের সঙ্গে; অন্যরা এর বর্ণনারীতির সঙ্গে প্রতিতুলনা করেছেন কাফকার বর্ণনারীতির। ২০০২ সালের এক জরিপে এই বইটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০০টি বইয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (যা এখনও বাংলায় অনূদিত হয়নি)। এই আলেকজান্ডার প্লাজ-এর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের টানে লন্ডন ছেড়ে ১৯১৮ সালেই বার্লিনে চলে এসেছিলেন লোহানী। সেখানে এসে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের (সরোজিনী নাইডুর ভাই) বিপ্লবী গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৯ সালের কার্ল লিবক্‌নেখট ও রোজা লুক্সেমবুর্গের বিপ্লব-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এই জার্মান-গ্রুপ অন্যত্র সরে পড়তে বাধ্য হয়- প্রথমে প্যারিসে এবং পরে রাশিয়ায়। সেভাবেই বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মস্কোয় আসেন লোহানী ১৯২১ সালে। তখনও তারা ‘কমিউনিস্ট’ হননি- তাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল ব্রিটিশ-শাসন থেকে পরাধীন ভারতবর্ষকে মুক্ত করা। সে লক্ষ্যে নতুন রাশিয়ার সাহায্য কামনা করছিলেন তারা এবং সে কারণেই লেনিনের সঙ্গে তারা দেখা করতে চেয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, সে সময়ে ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভারতবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের একত্র করার জন্যই বার্লিন-কমিটির পত্তন হয়েছিল এবং বীরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ‘বার্লিন গ্রুপ’ এ লক্ষ্যেই কাজ করছিল। ১৯২১ সালে লোহানী যখন মস্কোয়, তখন তিনি তিরিশের কোঠাও পার হননি।

বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘ক্যারিশম্যাটিক’ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ‘চ্যাট্টো’ নামে সবাই ডাকত তাকে। তিরিশের যুগে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর যাদেরই ‘জার্মান কানেকশন’ ছিল তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো রাশিয়ায়। কিরভের মৃত্যুর পর শুদ্ধি অভিযানের মাত্রা বেড়ে যায়। সর্বত্র জার্মান গুপ্তচর খুঁজতে থাকে এনকেভেদে। এরই ধারাবাহিকতায় বীরেন্দ্রনাথকে জার্মান গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ তিনি ছিলেন একশো শতাংশ বিপ্লবী, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ‘লীগ এগেইনস্ট ইম্পেরিয়ালিজম’ আহূত ১৯২৭ সালের ব্রাসেলস কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন তিনি। যেখানে তরুণ নেহেরু অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩০-৩২-এর মধ্যে ‘ইনপ্রেকর’-এর পাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ‘অতি-বাম’ নীতির বিরুদ্ধে ২৮টির মতো প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন চীনের ভাবী প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কমিনটার্নের সেক্রেটারি-জেনারেল জর্জি ডিমিট্রভকে ১৯৩৫ সালে দুঃখ করে জানিয়ে ছিলেন যে, ‘কমিনটার্নের সক্রিয় কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’ তাকে। ত্রূক্রপস্কায়াকেও চিঠি লিখেছিলেন এই মর্মে। শেষের দিকে তার গতিবিধি ছিল নিয়ন্ত্রিত। ক্লিমেন্স পাম ডাট (রজনী পাম ডাট-এর ভাই) লিখেছেন যে, চ্যাট্টোকে তিনি ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে লেনিনগ্রাদের একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর এথনোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে ‘শেষবার দেখেছিলেন’। এহেন বীরেন্দ্রনাথকে ১৯৩৭ সালের ১৫ জুলাই গ্রেপ্তার করা হলো ‘গণশত্রু’ অভিযোগে, কেননা তিনি জার্মানদের হয়ে ‘গুপ্তচর বৃত্তি করেছেন’। এই মিথ্যে অভিযোগে ১৯৩৭ সালের ৩১ আগস্ট মৃত্যু হলো তার ফায়ারিং স্কোয়াডে। সেই তালিকায় ছিলেন আরও ১৮৪ জন; এই নির্দেশে স্বাক্ষর করেন স্তালিন, মলোটভ, ভরশিলব, জদানভ ও কাগানোভিচ। চ্যাট্টো যখন চলে গেলেন, লোহানীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, তার ওপরেও এনকেভেদে-এর করাল ছায়া নেমে আসছে। যে কোনো অনুসন্ধানে চ্যাট্টোর কর্মকাণ্ডের ইতিহাস খুঁড়লেই লোহানীর নামও চলে আসবে। সে সময়ে লোহানীকেও নজরদারির মধ্যে থাকতে হতো। চ্যাট্টোকে কমিনটার্নের কাজ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর লোহানীকেও ক্রমশ কমিনটার্নের বলয় থেকে সরিয়ে আনা হয়। তিনি কেবল মাঝে মাঝে অনুবাদের কাজ করতেন- ব্যাপারটা এই পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লোহানি গ্রেপ্তার হন ‘প্রতি-বিপ্লবী’ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। পাবনার সিরাজগঞ্জ থেকে মস্কোর লুবিয়ানকা জেল- এভাবেই নির্বাপিত হয় লোহানীর ৪৬ বছরের জীবন।

চ্যাট্টো মারা যাওয়ার প্রায় বিশ বছর পরে রাশিয়ায় সরকারি সফরে আসেন নেহেরু। তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চান তিনি। কেজিবি মহলে (ততদিনে এনকেভেদে-র নতুন নাম কেজিবি) এই নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়। তারই পরিণতিতে সোভিয়েত পার্টি স্বীকার করে নেয় যে, শুদ্ধি-অভিযানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন বীরেন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে অবনী মুখার্জীর নামও উঠে আসে। গুপ্তচরবৃত্তির সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ (Rehabilitation) করা হয় তাদের। কিন্তু সেই সনদপত্রে লোহানীর নাম ছিল না। পূর্ববঙ্গের লোহানীর কথা নেহেরুর কানে কেউ তোলেনি। শত শত অন্যায় মৃত্যুর মিছিলে লোহানীর নামও তখন সোভিয়েত নেতৃত্বের দৃষ্টি এড়িয়ে থাকবে। যদি স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী কখনও মস্কো সফরে যান, যদি তারা লোহানীর ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ চান, তবে তারা বর্তমান রাশিয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে লোহানীর বিষয়টি তুলতে পারেন। ঠিক যেমনভাবে ভিন্ন মতাদর্শের হয়েও নেহেরু ক্রুশেভের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চেয়েছিলেন। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুতিনের কাছে লোহানীর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন। তাহলে শুধু লোহানীর মরণোত্তর স্বীকৃতিই নয়, তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত বিভিন্ন বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্রের দেখাও মিলতে পারে রাশিয়ার স্টেট হিস্টোরি আর্কাইভ থেকে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিবেচনায় এটা আশা করাই যেতে পারে।

তবে বেসরকারিভাবে ‘মস্কো নিউজ’ একটি কাজ করেছিল। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে এটি প্রকাশিত হয়। সেখানে আরও কয়েকজন ভারতের বিপ্লবীদের সঙ্গে লোহানীর নামও উঠে আসে। সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে তালাশ করতে গিয়ে রুশ ভাষার ইন্টারনেটে ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ (রাসত্রিয়েলনিয়ে স্পিসকি) পাই। এর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য, যেখানে লোহানী মস্কোর কোন সড়কের কোন বাড়িতে বাস করতেন এবং কোন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে সে তথ্যও দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৫৭ সালেই তাকে ‘Rehabilitated’ করা হয়েছে সোভিয়েত রাষ্ট্রের তরফে- এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সংযোজন করা হয়েছে। তার মানে, সোভিয়েত বা রাশিয়ার সরকারের কাছে লোহানী তার সম্মান মরণোত্তরভাবে হলেও ফিরে পেয়েছেন। তাকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে বিস্মৃতির গর্ভ থেকে। শুধু আমাদের রাষ্ট্রের বা ইতিহাসের কাছেই তার যথাযথ পুনরুদ্ধার হয়নি। বাংলাদেশের কাছে তিনি এখনও শুধু একটি নাম, শুধুই নাম। এখানে তিনি বিস্মৃতির অতলে ধূসর হয়ে আছেন অনাদরে-অবহেলায়। ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ থেকে পুরো উদ্ৃব্দতিটি অনুবাদ করে তুলে দিচ্ছি :

‘লুহানী গুলাম আম্বিয়া খান।

১৮৯২ সালে জন্ম, সিরাজগঞ্জ শহরে, রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির (বলসেভিক)-এর সদস্য; সোভিয়েত রেডিও-কমিটির অনুবাদক।

বাস করতেন :মস্কো বলশই ইওঝেনস্কি পেরুলক; হাউস ১৬/৬, ফ্ল্যাট ৩৬।

গ্রেপ্তার : ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি।

অভিযুক্ত :১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর (‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউ. এস. এস. আর’ কর্তৃক অভিযুক্ত); অভিযোগ : গুপ্তচরবৃত্তি।

১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু।

কবর :মস্কো অঞ্চলের (অবলান্তের) ‘কম্যুনারকা’ গোরস্তান। ১৯৫৭ সালের ৯ জুলাই ‘রি-হেভিলিটেটেড’; ‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউএসএসআর-র আদেশ বলে।’

মানুষের জীবন এমনিতেই বিস্ময়কর। বিংশ শতকের বিপ্লবীদের জীবন আরও বিস্ময়কর। [ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৮

লোহানীর প্যারিস

অধ্যাপক ফিলিপ বেনোয়া আমার প্রায় সমবয়েসী। কৃত্তিবাস রামায়ণ নিয়ে মৌলিক গবেষণা রয়েছে তার। যে রামায়ণকে আমরা ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ’ বলে জানি, তার কোনো মূল পাঠ কোথাও পাওয়া যায়নি। ষোড়শ শতকের এই বাঙালি মহাকবি সম্পর্কে প্রায় কিছুই আমরা জানি না বলতে গেলে। ব্রিটিশরা এ দেশে আসার পরে শ্রীরামপুরের ডেনিশ মিশনারিদের উদ্যোগে প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় কৃত্তিবাসের রামায়ণ। সেটিই বাংলায় প্রকাশিত প্রথম বই। শুধুমাত্র এ কারণেই কৃত্তিবাস সম্পর্কে আমাদের আরেকটু উৎসাহী হওয়া দরকার। ষোড়শ শতকের পরের দুইশ’ বছরে কৃত্তিবাসের রচনার বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে পাঠের তারতম্য দেখা যায়। বেনোয়া জানালেন যে, এগুলোর মধ্যে কোনটা ‘মূল’, সেটা প্রমাণ করা কঠিন। রামায়ণের আদি-স্রষ্টা বাল্মীকির মতোই বাংলায় রামায়ণের স্রষ্টা কৃত্তিবাসের জীবন আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে অদ্যাবধি। বেনোয়া বাল্মীকির রামায়ণ ও কৃত্তিবাসের রামায়ণের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্নেষণ করেছেন। তাকে প্রশ্ন করি, ‘কাশিরাম দাস নিয়ে কি কোনো কাজ হয়েছে?’ বাংলায় মহাভারতের রচয়িতা কাশিরাম দাস সম্পর্কেও কোনো গবেষণা কাজ হয়নি এখন পর্যন্ত- বেনোয়ার স্পষ্ট উত্তর। বুঝলাম, কৃত্তিবাসের রামায়ণ বা কাশিরাম দাসের মহাভারত এখনও রূপকথার জগতের মতো আমাদের স্মৃতিতে বা শ্রুতিতেই রয়ে গেছে কেবল। এখানেই পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য। ভারতে হিন্দুত্ব নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে চলেছে। সেখানে হিন্দুত্ববাদীরা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মসীযুদ্ধ করছেন। কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণ ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করে চলেছেন পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদরা। সে নিয়েও আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের অন্ত নেই। আমরা যত তাড়াতাড়ি এডোয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ পড়ে প্রাচ্যবিদদের কাজগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকি, তার সিকি ভাগ কষ্টও করতে চাই না নিজেদের সাহিত্য-ইতিহাস-সংস্কৃতি নিয়ে প্রাচ্যবিদদের মতো মৌলিক গবেষণা করার পেছনে। অধ্যাপক বেনোয়াকে দুই দশক ধরে সংস্কৃত পড়তে হয়েছে, তারপর তিনি ‘প্রাচ্যবিদ’ হয়েছেন। আমার মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সভায় অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, মধ্যযুগের বাংলা নিয়ে ভালো গবেষণা হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে দ্রুত। কেননা ‘এখনকার গবেষকেরা কেউ কষ্ট করে সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষা শিখতে শ্রম দিতে নারাজ।’

বেনোয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল প্যারিসে মেট্রো ‘বিবিলিওতেক নাসিওনাল’-এর কাছাকাছি একটি স্থানে। প্যারিসে এসে আমাকে জানতে হচ্ছে কৃত্তিবাস ও কাশিরাম দাসের কথা। এ ধরনের আলাপ তো ঢাকাতেও উত্তরার জসীম উদ্‌দীনের মোড়ে দাঁড়িয়ে হতে পারত। বেনোয়া শুধু কৃত্তিবাসই জানেন না, তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও খবর রাখেন। কথায় কথায় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা উঠল। বললাম, ‘রুদ্র আর আমি একই ক্লাসে একই কলেজে একই সময়ে পড়েছি। ও ছিল আর্টসের ছাত্র, আর আমি সায়েন্সে। ওর গোড়ার দিককার কবিতাগুলো লেখা হতো যখন, তখন থেকে আমার সঙ্গে পরিচয়। ‘তখন’ শব্দকে ‘তখোন’ করে লিখত। তাই নিয়ে সমালোচনা করতাম ওকে আমরা। নিজের কবিতা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা ছিল তার। তারপরও কবি হওয়ার জন্য মাঝ-দুপুরের রৌদ্রের ভেতরে সে ঝাঁকড়া চুল নিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে গেছে ঢাকার রাস্তায়।’ শুনে হাসলেন বেনোয়া। পরিস্কার বাংলায় বললেন, ‘রুদ্রর কবিতা আমি পড়েছি। ও খুবই শক্তিশালী কবি।’

সতেরো বছর পরে প্যারিসে আসা। এখানে বসেই মার্কস রচনা করেন তার ১৮৪৪ সালের ‘ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’, যা ‘প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’ হিসেবে ছাত্রাবস্থায় জেনেছিলাম। তরুণ মার্কসের ‘মানবতাবাদী’ রচনার সারসংক্ষেপ এখানে- এই প্যারিসে বসেই। এখানেই জন্ম নিয়েছে তার বিখ্যাত ‘এলিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতাবাদ বিষয়ক তত্ত্ব। জন স্টুয়ার্ট মিলের আগে এখানেই প্রথম তিনি লেখেন ‘স্বাধীনতা’ বা ফ্রিডম সম্পর্কে ভাবনা-উদ্রেককারী ইস্তেহার। এই প্যারিস তরুণ মার্কসের যেমন, তেমনি মার্কসের প্রায় সমান বয়েসী কবি শার্ল বোদলেয়ারেরও। প্যারিস মানেই বোদলেয়ারের প্যারিস- তার বিখ্যাত রচনা ‘Paris Spleen’ এই শহরকে ঘিরেই। যারা আক্রান্ত- কবিতা দীর্ঘকাল পড়েননি, তাদের উচিত বোদলেয়ারের এই ৫০টি ছোট ছোট গদ্য-কবিতার সংকলন দিয়ে নিমগ্ন-পাঠ শুরু করা। তার মৃত্যুর দু’বছর পরে ১৮৬৯ সালে এটি প্রকাশিত হয়। বোদলেয়ার ১৮৪৮ সালের বিপ্লব-প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেননি। কিন্তু এর জোরালো সমর্থক ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, প্যারিস যতই আধুনিক হয়ে উঠছে ততই সেখানে বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। এই উপলব্ধি সবচেয়ে তীব্রভাবে প্রকাশিত হয় তার Le Spleen de Paris বইটিতে। বইটির শিরোনামে ‘Spleen’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ প্লীহা, তবে অ্যানাটমির এই ‘অর্গানটি’ কবির আরাধ্য বিষয় নয়। ঝঢ়ষববহ শব্দটির অন্য একটি অর্থও রয়েছে। সেটি হলো- ‘কোনো আপতিক কারণ ছাড়াই বিষণ্ণতা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণাবোধ।’ আধুনিকতার পথে সৃষ্ট বৈষম্যকে সেভাবেই দেখেছেন বোদলেয়ার। এ বইয়ের একটি কবিতার নাম ‘Eyes of the Poor’। ঝকঝকে নতুন একটি কাব্যের দিকে তাকিয়ে আছে একটি দরিদ্র পরিবার। সেটা দেখে বাক্যের ভেতরে বসা কবি বিচলিত বোধ করছেন : ‘Not only was I moved by that family of eyes, but I felt a little ashamed of our glasses and decanters, larger than our thrist….’। এ রকম বৈষম্যের পরিবেশে সুস্থির থাকা, সুস্থ থাকা কঠিন। সে জন্যই বোদলেয়ার বলছেন, যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলছেন, ‘তোমাকে সবসময় বুঁদ হয়ে থাকতে হবে… সময় তোমার কাঁধের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এবং তুমি ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছ নিচে, মাটির দিকে; তোমাকে বুঁদ হয়ে থাকতে হবে বিরতিহীনভাবে।’ এই বিচ্ছিন্নতাবোধ বা এলিয়েনেশন মার্কসীয়। যারা অন্য বোধের চর্চা করছেন, তাদেরকে মনে রাখতে হবে, মার্কসের ‘প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’ আর বোদলেয়ারের ‘প্যারিস স্পিল্গন’ একই সময় ও মনোভূমি থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত।

যখন সতেরো বছর আগে প্যারিসে আসি OECD-র একটি ‘ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’-এর আলোচক হিসেবে, তখন আমার মাথায় ছিল মার্কসের প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট আর বোদলেয়ারের প্যারিস। আসার আগে অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খান (স্যার) বলে দিয়েছিলেন, Louvre দেখার আগে D’orsay মিউজিয়াম দেখে আসবেন। দু’দিন থাকছেন, সে কারণেই বলছি। D’orsay-তে সব ইম্প্রেশনিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকর্ম এক জায়গায় পেয়ে যাবেন।’ অধ্যাপক খান নিজে একজন চিত্রশিল্পী; ইমপ্রেশনিজম ধারার ছবি আঁকার নিরিবিলি চর্চা করে আসছেন দীর্ঘকাল ধরে। তার কথামতো সেবার D’orsay মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। একটা পুরো বিকেল সেখানে কাটিয়েছি। পুরোনো একটি রেলস্টেশনকে কীভাবে কেবল উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে ‘মিউজিয়ামে’ রূপান্তর করে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া যায়, তার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা এটি। সেবার তাতেই এতটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে Louvre ও তার মোনালিসা আমার অধরাই থেকে গিয়েছিল। তার পরও এতগুলো বছর বাদে প্যারিসে আসার পরে আমার প্রথমেই মনে পড়ল ফ্রান্সের ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা বিবিলিওতেক নাসিওনালের কথাই। আমার অবচেতন মনের ভেতরেও কোথাও এর সূত্র ছিল নিশ্চয়ই। সেদিন অধ্যাপক ফিলিপ বেনোয়ারের সঙ্গে কৃত্তিবাস বিষয়ক আলাপ করতে করতে তিনি হঠাৎ আমাকে দেখালেন লাইব্রেরিটি। ‘ঐ যে দেখছেন, আধখোলা বইয়ের মতো বিল্ডিং তিনটি, ওটাই ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল লাইব্রেরি।’ আর আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল গ্যাব্রিয়েলা লোহানীর চিঠিটির কথা।

গ্যাব্রিয়েলা লোহানী ১৯২৫ সালের দিকের একটি চিঠিতে পাবনায় তার শাশুড়িকে লিখছেন প্যারিস থেকে। যার মমার্থ হলো- ‘মাজু (লোহানী) খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে একটি বইয়ের ওপরে।’ বোঝা যাচ্ছে, গোলাম আম্বিয়া খান লোহানী শুধু প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হননি; একটি ‘বই লেখার’ কাজেও ব্যাপৃত ছিলেন সে সময়ে। তার মানে, ১৯২৪-২৫ সালে প্যারিসে অবস্থানকালেই এই লেখা তিনি শুরু করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে যখন প্রথম গ্যাব্রিয়েলার চিঠিটি পড়ি, তখনই আমার মনে হয়েছিল, এই বইটি হয়তো প্রকাশিত হয়েছে পরে এবং হয়ে থাকলে তা হয়তো বিবিলিওতেক নাসিওনালের সংগ্রহশালায় পাওয়া যেতেও পারে। স্বয়ং এমএন রায় যার সম্পর্কে তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, বিভিন্ন ভাষাভাষী লোহানীর বুদ্ধি ছিল ‘তরোয়ালের মত ধারালো’। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লোহানীর জার্মান, ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা নিয়ে তার আত্মজৈবনিক রচনা ‘যাত্রী’তে শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। এমএন রায় ধারণা করেছেন যে, ১৯২১ সালে লেনিনকে পাঠানো ‘থিসিস অন ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোয়েশ্চেনস’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ‘বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, গোলাম আম্বিয়া লোহানী ও পাণ্ডুরাঙ্গ খানখোজে’ ত্রয়ীর নাম-সংবলিত হলেও আসলে রচনাটি লোহানীরই- ওদের মধ্যে আর কারও এটা লেখার ক্ষমতা ছিল না। গঙ্গাধর অধিকারী কর্তৃক নানা খণ্ডে সম্পাদিত ‘হিস্টরি অব কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া’ বইতে লোহানীর নানা উল্লেখ রয়েছে এবং তার বিভিন্ন ইংরেজি রচনা সেখানে সংকলিতও হয়েছে। যদিও রুশ, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় লেখা তার বিভিন্ন রচনা এখনও সংকলিত হওয়ার অপেক্ষায়। এই লোহানীর জন্ম বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। শিক্ষাগ্রহণ আলিগড়ে এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে; একাধারে মার্কস, মিল, লেনিন ও কেইনস্‌ বিভিন্ন স্কুলের রচনাবলির সঙ্গে তিনি ছিলেন পরিচিত, স্তালিনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৩৮ সালের এক দিনে বুখারিনের মতো ভিন্নমতাবলম্বী অন্য কমরেডদের সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। আমাদের দেশের মুক্তি-সংগ্রামের স্মৃতি-মিউজিয়ামের অন্তত কোনো একটি কর্নারে, কোনো একটি পাদটিকায়, কোনো একটি ব্যানারে বা বইতে তার নাম থাকার কথা ছিল। তিনিই ছিলেন, কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদেরও আগে প্রথম বাঙালি মুসলিম কম্যুনিস্ট। এবং ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অনেক আগেই তত্ত্বে-তথ্যে-মননে জ্বলজ্বল করা এক নাম। যারা ১৯২৮ সালে কমিনটার্নের ষষ্ঠ কংগ্রেসে ডি-কলোনাইজেশন প্রশ্নে অটো কুমিনিন-লোহানীর বিতর্ক পড়েছেন (অধিকারীর বইতে তা যথাবিহিতভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে) তারাই এর পাণ্ডিত্যে বিস্মিত হবেন। লোহানীর নাম, তার জীবনী এবং প্রকাশিত/অপ্রকাশিত লেখার সংকলন আমাদের স্মৃতির আড়ালে থেকে যাবে- এটা সহজে মেনে নেওয়া যায় না। কোনো স্কুলের পাঠ্যবইতে তার নাম কখনও উচ্চারিত হবে না- এটাও অপ্রত্যাশিত। লোহানীর ফরাসি স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলা লোহানী জানিয়েছিলেন, প্যারিস থেকে ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব মাসেস’ সাময়িকীটি প্রকাশের পাশাপাশি তখন একটি ‘বইয়ের ওপরেও’ কাজ করছিলেন লোহানী। তার অদেখা শাশুড়ি মাকে মিথ্যে কথা কেন বলবেন তিনি? হয়তো প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে অথবা মস্কোর ইতিহাস বিষয়ক মহাফেজখানায় তার বইটির একদিন ঠিক খোঁজ মিলবে। ঠিক যেমন আবুল হাসান ‘এপিটাফ’-এ লিখেছিলেন, ‘একদিন আকাশ আলো মিলে যায়, মেলে’; তেমনভাবেই লোহানী আমাদের ইতিহাসে-সাহিত্যে হবেন একদিন স্বতঃপ্রকাশিত।

[ক্রমশ]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৭

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৪. অন্যান্য প্রসঙ্গ

এদোয়ার্দো গালিয়েনো ঘণ্টাখানেক বলেছিলেন সেদিন ‘পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ’-এর সন্ধ্যায়। আমার থেকে-থেকে চোখ চলে যাচ্ছিল গালিয়েনোর ঢেউ খেলানো সাদা পশমের মতো চুলের দিকে। ‘মিররস’-এর অনুকরণে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কিছু লেখার পরিকল্পনা তার রয়েছে কি-না জানার জন্য প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব, কিন্তু আমার পড়াশোনা কম এই এলাকা নিয়ে।’ তারপর উল্টো আমাকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন- ‘তারচে’ বরং আপনি আগ্রহ নিয়ে করুন না কেন সেটা?’ পরে অবশ্য বুঝেছি যে, কথাটা নিতান্ত বিনয়ের সৌজন্য থেকেই বলা। এই ভূখণ্ড সম্পর্কে- এমনকি বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালোই জানতেন তিনি। তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘হান্টার অব স্টোরিস’ বইতে হঠাৎ পেয়ে যাই বাংলাদেশের উল্লেখ :

‘২০১২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের এক ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে ১১০ জন শ্রমিক মারা যায়। এ ধরনের ঘাম-ঝরানো কারখানাতে অধিকার বা নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরের বছরের এপ্রিলে দগ্ধ হয়ে মারা যায় আরও ১ হাজার ১২৭ জন শ্রমিক আরেকটি এমনই ঘাম ঝরানো ফ্যাক্টরিতে। ইতিহাসে যেসব দাসের কথা আমরা পড়তে পাই, এরাও তেমনি আধুনিক যুগের অদৃশ্য দাস। তাদের অস্তিত্বের মতোই তাদের বেতনও দৃশ্যমান নয়। যেমন নয় দৈনিক এক ডলারে বেঁচে থাকা। যেটা প্রকাশ্যে দেখা যায় তাহলো এদেরই হাতে তৈরি করা পোশাক-সামগ্রী, তাদের গায়ে সুদৃশ্য দামের ট্যাগ লাগানো, আর যেগুলো বিক্রি হচ্ছে ওয়ালমার্ট, জেসি পেনি, সিয়ার্স, বেনটেন, এইচ অ্যান্ড এম প্রভৃতি বিপণিবিতানে।’

নায়লা কবীর অবশ্য গালিয়েনোর ‘অদৃশ্য দাস’ বলার সাথে সহমত করবেন না। নায়লা লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে দীর্ঘকাল ধরে পড়াচ্ছেন। বর্তমানে ফেমিনিস্ট ইকোনমিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের সভাপতিও তিনি। বাংলাদেশের এই সুযোগ্য সন্তান শুধু বাংলাদেশের নারীদের ওপরেই মৌলিক গবেষণা করেননি। নারীবাদী অর্থনীতি বা ফেমিনিস্ট ইকোনমিক্সের ওপরে তার গবেষণা কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক ও পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ইংরেজিতে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারেন, তেমনি বলিষ্ঠ তার লেখনী। ২০০০ সালে নায়লা কবীর একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য পাওয়ার টু চুজ’ (Power to choose)। সেখানে তার মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল যে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের নারী-শ্রমিকরা ফ্যাক্টরির পরিবেশে কাজ করার সুবাদে ‘ক্ষমতায়িত হয়ে উঠেছে- অন্তত সুদূর লন্ডনে ঘরে বসে কাজ করছে এমন বাঙালি নারী-শ্রমিকদের তুলনায়। অর্থনৈতিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ- বিশেষত ঘরের বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর বিচরণ- তার জীবনমানের উন্নতি ও তাকে ‘ক্ষমতাবান’ করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; এটিই ছিল নায়লার মূল তর্ক। গালিয়েনো অবশ্য লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতার সাক্ষী, তিনি হয়তো নায়লাকে বলতেন, ‘অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নারীকে ক্ষমতাবান করে ঠিকই, কিন্তু সবই নির্ভর করছে তার দর-কষাকষির ক্ষমতার ওপরে।’ এ দেশের পোশাক-শিল্পের নারীরা এখনও সেই ক্ষমতা পুরোপুরি অর্জন করেননি তাদের ‘দেশি মালিক’ আর ‘বিদেশি ক্রেতাদের’ সঙ্গে দর-কষাকষি করার ক্ষেত্রে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরে বিদেশি ক্রেতারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স ইনিশিয়েটিভের। এতে ইমারত সুরক্ষা, অগ্নিনির্বাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা শুভ পরিবর্তন আসলেও নারী পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সামান্যই বেড়েছে। শ্রমবহির্ভূত কাজের পরিবেশেও খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।

গালিয়েনো নিজের জীবনের টুকরো-টাকরা স্মৃতি নিয়ে কিছু খণ্ডদৃশ্য লিখেছেন। তার ‘মেমরি অব ফায়ার’ বইটির শেষ খণ্ডে সামরিক শাসিত উরুগুয়ের ‘কনিষ্ঠতম রাজনৈতিক বন্দি’ সম্পর্কে একটি এন্ট্রি রয়েছে। সে ছিল পাঁচ বছরের একটি মেয়ে, তার অপরাধ ছিল একটাই :তার নাম রাখা হয়েছিল ‘মাইলাই’। ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে মার্কিন সেনা দল মাইলাই নামে গোটা একটা গ্রামকেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উরুগুয়েতে তখন চলছে প্রবল সামরিক শাসন। মাইলাই নাম উচ্চারণও তখন অপরাধ। আর সেখানে কিনা জলজ্যান্ত একটি মেয়ে- হোক না সে পাঁচ বছরের মেয়ে; এই নাম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে (বা পার্কে-মাঠে-কিন্ডারগার্টেনে দাপটের সঙ্গে হেসেখেলে দিন কাটাচ্ছে)। গালিয়েনো লিখেছেন যে, বইটি বেরুনোর পর অনেক বাবা-মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন তিনি। তারাও তাদের নবজাতকের নাম ‘মাইলাই’ রাখতে চান। কিন্তু প্রশাসন তাতে বাগড়া দিচ্ছে। এমনকি ১৯৯৯ সালে আর্জেন্টিনার এক মা তাকে লিখেছেন, ‘আমার মেয়েকে এখনও নথিবদ্ধ করা যায়নি।’ জন্ম ও মৃত্যুর রেজিস্ট্রি করা এখন এ দেশেও বাধ্যতামূলক। লাতিন আমেরিকায় তা আগেই চালু হয়েছিল আমাদের দেশের তুলনায়। আন-ডকুমেন্টেড থেকে গেছে তার মেয়ে অদ্যাবধি- এই ছিল পাঠিকার অভিযোগ। এসব দেশে নাম তালিকাভুক্ত করাতে গেলে সমস্যা অনেক। কোনো সেইন্টের নাম নিতে চাইলে কাজটা সহজ হয়ে যেত। কিন্তু মাইলাই তো সে রকম কোনো নাম নয়। একে পাওয়া যাবে না অভিধানে, ন্যাশনাল রেজিস্ট্রির ইতোমধ্যে তালিকাবদ্ধ নামের সারিতেও এর দেখা মিলবে না। মাইলাই-এর কোনো অধিকার নেই কার্যত নিজেকে মাইলাই বলে ডাকার।

একবার চিলির সালভাদর আয়েন্দের সঙ্গে সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল গালিয়েনোর। নিজ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এক রক্তাক্ত ক্যু-তে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিহত হন আয়েন্দে। সেটাই বলতে গেলে প্রথম ‘নয়-এগারো’। এই ক্যুর পেছনে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের সরাসরি প্ররোচনা ছিল। যা হোক, গালিয়েনো যে ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন তা এর বেশ কিছুকাল আগে, তখনও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। তখন ছিল শীতের সময়। চিলির দক্ষিণের প্রদেশ পুন্টা আরেনাতে সবে বরফ পড়তে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে বাইরের তুলার মতো বরফ নেমে আসার দৃশ্য দেখতে দেখতে আয়েন্দে তার নির্বাচনী বক্তৃতার একটি খসড়া দেখালেন গালিয়েনোকে। আগামীকালই একটি বক্তৃতা দিতে হবে তাকে। বক্তৃতা যথারীতি হলো। কিন্তু গালিয়েনো খেয়াল করলেন যে, আয়েন্দের বক্তৃতায় কী করে যেন একটি নতুন লাইন ঢুকে গেছে। যেটা গতকাল রাতে পড়া খসড়ার মধ্যে ছিল না। সমবেত জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি শুনতে পেলেন আয়েন্দে বলছেন :’যেসব ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন, সেসবের জন্যে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে অর্থ রয়েছে।’ এটা কি ছিল কোনো অনিচ্ছাকৃত ভবিষ্যদ্বাণী, কে জানে!

লোর্কা নিয়েও একাধিক গল্প বলেছেন তিনি। ফ্রাংকোর স্পেনে কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কার মৃত্যুর পর অনেককাল তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি। তার জনপ্রিয় নাটকগুলো নিষিদ্ধ ছিল। লোর্কার মৃত্যুর বহু বছর পরে- ফ্রাংকো তখনও জীবিত- উরুগুয়ের এক নাট্য দল গেল মাদ্রিদে। সাহস করে লোর্কার একটি নাটক মঞ্চস্থ করল তারা। নাটকের শেষে চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কোনো হাততালি শোনা গেল না। দর্শক সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে পা দিয়ে মেঝের ওপরে এক সাথে শব্দ করতে লাগল অনেকক্ষণ। নাটকের কুশীলবরা প্রথমে বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে। এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছে দর্শকরা! তাদের অভিনয় কলাকৌশল কি সেরূপ হয়নি? তাহলে এমন ধরনের ব্যবহার কেন দর্শকদের? বহু দিন পরে কুশীলবদের একজন এদোয়ার্দো গালিয়েনোকে বুঝিয়েছিলেন যে, পা দিয়ে শব্দ কেন তুলেছিলেন মাদ্রিদের দর্শকরা? তারা লোর্কার জন্য সেই শব্দ তুলে হল প্রকম্পিত করেছিলেন সেদিন। লোর্কা, যাকে কেবল বামেদের সমর্থক এবং বৃত্তের বাইরের মানুষ হওয়ার অভিযোগে অযথা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাকে বলেছিলেন দর্শকরা- ‘ফেদেরিকো, দ্যাখো, তুমি এখনও আমাদের মধ্যে কীভাবে বেঁচে আছ।’ এই গল্পটা গালিয়েনো বর্ণনা করছিলেন মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে। সেদিনের সন্ধ্যায় গালিয়েনোর বক্তৃতা পাঠ শেষে অবাক করা কাণ্ড ঘটল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অনুষ্ঠানে সমবেত ছয় হাজার মানুষের পায়ের শব্দে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উঠেছিল। তারাও বলতে চেয়েছিল- ‘গালিয়েনো, তুমি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছ।’

[এই বিষয় সমাপ্ত]