আকবর আলি খানের রচনাকর্ম

আকবর আলি খান বহুমাত্রিক সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। সাধারণত দুই ধরনের সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ দেখা যায়। একদল নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডিতেই বিচরণ করতে ভালোবাসেন, তাঁদের আমরা স্পেশালিস্ট বলি। আরেক দল আছেন, তাঁরা নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে আরও বহুবিধ ক্ষেত্রে উৎসাহ দেখান, বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। আকবর আলি খান ছিলেন দ্বিতীয় ধারার সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসাহ প্রসারিত হয়েছিল বনলতা সেন থেকে দারিদ্র্য বিশ্নেষণ অবধি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশিষ্টতা খোঁজার পাশাপাশি পরার্থপরতার অর্থনীতি অনুসন্ধান, সুশাসন সম্পর্কিত ফ্রেন্ডলি ফায়ার বইটি থেকে আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। তবে বহুবিধ বিষয়ে বিচরণ করলেও, তিনি প্রথমত ও প্রধানত ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। ইতিহাসচিন্তা তাঁর সমাজচিন্তাকে ধারণ করেছে। তাঁর অর্থনৈতিক বিশ্নেষণকে সমৃদ্ধ করেছে। এসবই জানা কথা। আমি এখানে কয়েকটি বইয়ের সূত্রে, যে সুবাদে আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা করার, সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলব।
১. নেশনের প্রাক-ইতিহাস
প্রথমেই আসি তাঁর সবচেয়ে মৌলিক ও সুবিদিত কারণে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ডিসকভারি অব বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বইটির শিরোনাম শুনে পাঠকমাত্রেরই মনে পড়তে পারে ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া শীর্ষক জওহরলাল নেহরুর বইটির কথা। জওহরলাল নেহরু লিখিত বইটি ছিল মূলত বর্ণনামূলক এবং সময়ের ধারাবাহিকতাকে ধরার চেষ্টা। পক্ষান্তরে আকবর আলি খানের ডিসকভারি অব বাংলাদেশ মূলত বিশ্নেষণাত্মক এবং তাঁর অভিনিবেশ ছিল- কী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণ করা যায়।
বাংলাদেশ বা পূর্ববঙ্গকে ঘিরে যে ভূখণ্ড বা তার অধিবাসী যারা, তাদের যে বৈশিষ্ট্য, তা তাদেরকে ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা করে। শুধু তাই নয়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড-ভূগোলের অধিবাসীদের থেকেও তাদের বিশিষ্ট করে। সেই বিশিষ্টকরণের সূত্র খুঁজছিলেন আকবর আলি খান। সেদিক থেকে এটি একটি চমৎকার পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণজাত গবেষণা গ্রন্থ। এখানে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল কয়েকটি। একটি হচ্ছে- এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতার দিক কী কী। তিনি সেই ক্ষেত্রে দেখেছিলেন- এই ভূখণ্ড লেস রেজিমেন্টেড, কম শৃঙ্খলাবদ্ধ। তিনি যেটা বলেছেন, বাংলাদেশের গ্রাম হচ্ছে ওপেন জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। এর বিপরীতে উত্তর ভারতীয় গ্রামগুলোকে বলেছেন ক্লোজড জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। সেই সমস্ত গ্রামে ঢুকতে গেলে একটা সীমানা প্রাচীর পেরোতে হয়। বাউন্ডারি দেওয়া। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের তুলনাতেও বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে মনে হয়েছে, সেগুলো অনেক ছড়ানো ছিটানো। সেখানে অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে, ফাটল রয়ে গেছে। তিনি বলছেন, এর কারণ বোধকরি এই যে, এই গ্রামগুলো কোনো সবল ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর কখনও ছিল না বা মাথা নত করেনি। বরং অন্যান্য জায়গা থেকে অত্যাচারিত বা এক্সক্লুডেড হয়ে যারা এই ভূখণ্ডে এসেছে, তারা সহজে আশ্রয় নিতে পেরেছে। জিওগ্রাফির সঙ্গে সোশ্যাল এক্সক্লুশন এবংপলিটিক্যাল ইসলামের একটি আন্তঃসংযোগ তিনি স্থাপন করেছেন। এই সূত্রে তিনি আরও লক্ষ্য করেন, ইসলাম যে এই পূর্ববঙ্গে একাদশ শতক থেকে বিস্তার লাভ করেছিল, তার পেছনে মূলত কোন কোন উপাদান কাজ করেছে। এ নিয়ে আলাদা করে তাঁর আরেকটি বই বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। যার নাম ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য :একটি ঐতিহাসিক বিশ্নেষণ’।
সেখানে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য ছিল- অসির বলে ইসলাম প্রচারিত হয়নি। তখনকার যুগে বাংলার, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনপদ বলে কিছু ছিল না। এটি ছিল মূলত প্রত্যন্ত এলাকা, যেটিকে এগ্রারিয়ান ফ্রন্টিয়ার বলেছেন তিনি। এক কথায়- জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের শুরুতে আমরা যে রকম বর্ণনা পাই :জঙ্গলাকীর্ণ একটি ভূখণ্ড এবং সেখানে মূলত যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বা নির্যাতিত অথবা সহায়সম্বলহীন, মরিয়া- ডেসপারেট, সেই জনগোষ্ঠীই কেবল বাস করতে উৎসাহী হবে। এই ডেসপারেট জনগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গের তুলনামূলক অনগ্রসর, বিপৎসংকুুুল, জঙ্গলাকীর্ণ, নদীপরিকীর্ণ, শ্বাপদসংকুুল এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের জীবনধারণের জন্য বসবাসের স্বার্থে সেই জঙ্গল কেটে জনপদ গড়েছে। এই বন কেটে বসত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন একাধারে ধর্মীয় ও কৃষক নেতা। এই কৃষকদের জন্য যাঁরা বাঁচার লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের মধ্যে পুরোভাগে ধর্মীয় নেতারা ছিলেন। সেই সুবাদে ইসলাম এখানে সহজে বঞ্চিত, অন্ত্যজ, এক্সক্লুডেড মানুষের মাঝে আসন গাড়তে সক্ষম হয়। এই ব্যাখ্যাটি রিচার্ড ইটন আদিতে দিয়েছিলেন তাঁর দ্য রাইজ অব ইসলাম-এ দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার গ্রন্থে। কিন্তু এখানে আকবর আলি খান কিছু কারেক্টিভ এনেছেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় মাজারের কনসেনট্রেশন সম্পর্কিত ম্যাপ তৈরি করে দেখিয়ে বলেছেন- সর্বত্র কিন্তু পীর-আউলিয়ার সমাবেশ এক রকম ছিল না। তারপরও ইসলামের ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে। সুতরাং এটা শুধু পেজেন্ট কাম রিলিজিয়াস লিডারশিপের ব্যাপার ছিল না। এটার আরেকটা কারণ ছিল- ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে যাঁরা এই ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে নতুন ধর্ম ও রীতি অভ্যাসের ভলান্টারি অ্যাডাপটেশন। অনেকটা পুশ-পুল ইফেক্টের মতো দুটি দিকই এখানে কাজ করেছে।
ওই বইতে আকবর আলি খান আরেকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, কেন আমাদের দেশে বৃহৎ অর্গানাইজেশন, সোশ্যাল অর্গানাইজেশনগুলো সফল হয় না। কেন আমাদের দেশে স্তালিনীয় কায়দার সুশৃঙ্খল দল দাঁড়ায় না। কেন আমাদের দেশে বড় যেসব উদ্যোগ আমরা নিতে চাই, সেগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাঁর ধারণা, যে কারণে আমরা অপেক্ষাকৃত মুক্তগ্রাম, মুক্তসমাজ এবং অন্যকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী (যার একটি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গাকে আমরা অতি স্বল্প সময়ে আশ্রয় দিতে পেরেছি); এসব যেমন আমাদের শক্তির দিক, তেমনি আমাদের দুর্বলতার দিক হচ্ছে- আমরা কারও একক নেতৃত্ব বা লিডারশিপের ধার ধারি না। এর ফলে আমাদের ভেতর একটি সেন্ট্রিফিউগাল টেন্ডেন্সি (কেন্দ্রবিমুখী প্রবণতা) সৃষ্টি হয়। আমাদের সমাজ সংগঠনে একটি অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
তাঁর উত্তর হচ্ছে, এই ধরনের সমাজ-মানসিক কাঠামোয় সেই ধরনের অর্থনৈতিক সংগঠন বেশি কার্যকর হবে, যেখানে ইন্ডিভিজুয়ালিজম, ব্যক্তি উদ্যোগ বা স্বল্প পরিসরের গ্রুপ-উদ্যোগগুলো কাজ করবে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি দেখালেন, আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে দ্রুততম সময়ে ব্যক্তিখাত গড়ে উঠল, বিকাশপ্রাপ্ত হলো। এক কথায় বলতে গেলে মার্কেট লিবারেলিজমের পক্ষে একটা সোশিওলজিকাল আর্গুমেন্ট তিনি উপস্থাপন করলেন। আরেকটি উদাহরণ তিনি দিলেন, কেন গ্রামীণ ব্যাংক বা ব্র্যাকের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো এখানে সফল হলো। কেননা এগুলোর দল সংখ্যা মূলত পাঁচ থেকে দশ, ঊর্ধ্বে ত্রিশ। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরের অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো এই অঞ্চলে কাজ করতে বেশি সক্ষম বা কাজে বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা। তিনি আরও একটি যুক্তি সেখানে দিলেন, সেটি হচ্ছে- অ্যাগ্রো ইকোলজিকাল আর্গুমেন্ট। তিনি বললেন, দক্ষিণ ভারত বা পশ্চিম ভারতে যেখানে অপেক্ষাকৃত শুস্ক মৌসুমি এলাকা, যেখানে মূলত সারফেস ওয়াটার-নির্ভর সেচ ব্যবস্থা করতে হয় কৃষিকাজের জন্য, সে ক্ষেত্রে কৃষকদের রাষ্ট্রের ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভর করতে হয়। এই কারণে ওইসব এলাকায় আমরা ক্যানাল ইরিগেশন (খাল খনন) সিস্টেম পাই, আমরা হাইড্রোলিক সভ্যতার (জলকেন্দ্রিক সভ্যতা) নিদর্শন পাই। এর বিপরীতে আমরা যখন পূর্ব বাংলায় আসি, দেখি যে নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে এখানে গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশন অপেক্ষাকৃত সফলতা পায় এবং গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশনের মধ্যেও সেখানে ডিপ টিউবওয়েলের চাইতে দেখতে পাই শ্যালো টিউবওয়েল উদ্যোগের ছড়াছড়ি।
এক কথায় বলতে গেলে, আকবর আলি খানের ইতিহাসচর্চার মধ্যে পূর্ববঙ্গের বৈশিষ্ট্য খোঁজার ক্ষেত্রে তিনি অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, ইকোলজি, প্রযুক্তি, মানুষের মনস্তত্ত্বসহ বিভিন্ন ছড়ানো ছিটানো ফ্যাক্টটরকে একত্রে সন্নিবেশিত করতে পেরেছেন। এজন্য তাঁর বিচার-বিশ্নেষণগুলো অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে।
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে বলে রাখি, তিনি ভূমিকাতে আরও একটি কথা বলেছিলেন। তাঁর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করা। পরবর্তী সময়ে তিনি আমাকে একান্তেও বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মাল্টিপল থিয়েটারে হয়েছিল। মঞ্চের এক অংশের ওপর যদি কেবল আলোকপাত করা হয়, তাহলে ভুল হবে। একই সময়ে অন্য থিয়েটারগুলোতেও সেই নাটকের অন্যান্য অংশ অভিনীত হচ্ছিল। সে কারণে ওই ধরনের কম্প্রিহেনসিভ হিস্ট্রি লেখার জন্য যে ধরনের পরিশ্রম, যে ধরনের কালেক্টিভের সমবেত সাধনার প্রয়োজন, সেটি নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব হবে বলে তিনি দেখছেন না। বিশেষত সমসাময়িক রাজনীতির বাদানুবাদের কারণে; তাঁর ভাষায়- ডিউ টু কনটেম্পরারি পলিটিকাল স্কোয়াবলস। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি বসে না থেকে যেটি করতে পারেন সেটি হচ্ছে- এই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ইতিহাসের একটি প্রাক-ইতিহাস রচনা করা। ডিসকভারি অব বাংলাদেশের যে উন্মোচন, সেটি প্রাক-ঐতিহাসিক ন্যারেটিভের একটি নিদর্শন।
বইটি আমাকে এত বেশি আকৃষ্ট করেছিল যে আমি বইটির শুধু একটি বুক রিভিউ নয়, একটি রিভিউ আর্টিকেল রচনা করি। সেটি একটি গবেষণাধর্মী জার্নাল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। সেখানে আকবর আলি খানের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আমি কিছুটা বাহাস করার চেষ্টা করি। কিছু কিছু অভিযোগ আমি সেখানে এনেছিলাম। যেমন আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম- তিনিও বঙ্কিমের মতো আমাদের বলছেন- বাঙালির ইতিহাস নাই, এই ইতিহাস কে লিখিবে, আমি লিখিব তুমি লিখিবে; সেই রকম একটি জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার উৎসাহে তিনি এই বইটি লিখলেন কিনা? কেননা আমরা যদি দুইশ-তিনশ বছর আগে যাই, সেখানে তো ন্যাশনালিজমের- এজ আ পলিটিকাল কনসেপ্ট- কোনো স্ম্ফুরণ দেখি না। এটি তো অনেক পরের ঘটনা। রেনাঁ এবং তাঁর পরবর্তী যাঁরা পলিটিকাল ন্যাশনালিজমের প্রবক্তা, তাঁদের সময়ের ঘটনা। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে। আমার আপত্তি ছিল এই বইয়ের সাবটাইটেলে। সাবটাইটেল ছিল- এক্সপ্লরেশনস ইনটু ডাইনামিকস অব এ অব হিডেন নেশন। উনি যেটাকে হিডেন ন্যাশনালিজম বলছেন, সেটাকে ফর্মুলা হিসেবে নিলে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তা হলো, আমরা এই রকম হিডেন ন্যাশনালিজমের উৎস সন্ধানে চর্যাপদ বা তারও আগে পিছিয়ে যেতে পারি। আর এতে করে ইতিহাসের নিয়মের বরখেলাপ হয় কিনা? তদুপরি আমি কিছুটা রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম গ্রন্থের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের সমস্যাটাকে বড় করে দেখেছিলাম। জাতীয়তাবাদকে এজ এ কনসেপ্ট- স্বয়ম্ভু, অ্যাবসোলুট, অবশ্যপালনীয় কনসেপ্ট হিসেবে অন্তত তখন পর্যন্ত মনে করিনি।
জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে তাঁর একটি প্রধান বক্তব্য ছিল- জাতীয়তাবাদ শুধু একটি মাত্রায় গড়ে ওঠে না। সেখানে ভৌগোলিক এবং আদর্শিক- এই দুটো মাত্রাতেই প্রভাব আসে। এবং আকবর আলি খান পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে দেখেছেন- এখানে ফেইথ মূলত ইসলাম হলেও, নানা ধরনের সংকর বিশ্বাসের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে ফেইথের মধ্যেও অনেক রকমের বৈচিত্র্য এসেছে। অন্যদিকে আবার আমাদের ভৌগোলিক কিছু অভিন্নতার কারণে, নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে, বন্যা-ঝড় এসব প্রাত্যহিক উপদ্রবের কারণে আমাদের কতগুলো জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। কতগুলো সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এখানে আমরা দেখতে পাই, যেগুলো আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের যে পিউরিটি, তার পাশাপাশি ভৌগোলিক ইমপিউরিটির সঙ্গে মিলেমিশে মিথস্ট্ক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশ্বাস ও বসতি- এই দুই উপাদান মিলে এমন একটি জাতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পূর্ববঙ্গে, যেটি অন্য কোনো ভূখণ্ডের সঙ্গে মেলে না। কারণ তারা এ দেশের মতো এতটা পরিমাণে নদীনির্ভর দেশ নয়, যতটা পরিমাণে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা ঝড়-বাদল ও নদীর ওপরে নির্ভরশীল। এটিও জাতীয়তাবাদের বিচার-বিশ্নেষণের ক্ষেত্রে তাঁর একটি অনন্য অ্যাপ্রোচ।
এক অর্থে, যদিও এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক পুরোপুরি নয়, তবু না মনে করে পারছি না, আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও যখন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিতে সংসদে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন- আমার চোখে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাংলার মাটি, জল, নদী, আকাশ। এর বেশি আপনারা আর সংজ্ঞায়িত করতে যাবেন না। গেলেই বিপদ বাধবে। আরও বেশি ঠোকাঠুকি হবে। বঙ্গবন্ধু একটা পর্যায়ে বুঝেছিলেন যে, জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করতে গেলেই বিপদের সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে একটু এমবিগু্যয়াস এবং ইকোলজিকাল ফ্রেমে দেখলে অনেক বেশি নিরাপদ উপস্থাপনা হয়। আকবর আলি খানও অনেকটা এই আলোকেই বারবার জোর দিয়েছেন ফেইথ ও হ্যাবিট্যাটের মিথস্ট্ক্রিয়ার ওপরে। বিশ্বাস ও বসতির পারস্পরিক প্রভাব সমুচয়ের ওপরে।
২. স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতার অর্থনীতি
আকবর আলি খানের দ্বিতীয় বইটি ছিল পরার্থপরতার অর্থনীতি নিয়ে এবং নামেই এর বৈচিত্র্যের পরিচয়। আমরা জানি, আমাদের সনাতন অর্থনীতি মূলত স্বার্থপরতার অর্থনীতি। কেননা তার প্রথম সবকই হলো- এডাম স্মিথের অনুসরণে- মানুষ যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে, সেটি তার নিজস্ব স্বার্থ দ্বারা প্ররোচিত হয়েই করে। কিন্তু বাজার অর্থনীতির অদৃশ্য হাতের কল্যাণে বিভিন্ন স্বার্থমুখী উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনে।
কিন্তু স্বার্থপরতার অর্থনীতি বা ইন্ডিভিজুয়াল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিপরীতে আকবর আলি খানের বইয়ের নামটি ছিল- পরার্থপরতার অর্থনীতি। পরার্থপরতা, যেখানে স্বার্থের কোনো বালাই নেই, পরোপকার করছি নিঃস্বার্থভাবে; সেটির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা। এর মানে এই নয় যে, লেখক বলছেন, স্বার্থপরতার অর্থনীতির কোনো জায়গা নেই আমাদের জীবনে এবং আমাদেরকে সব সময় বা বেশিরভাগ সময় পরোপকার, নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে আর পুরো দেশ-সমাজটা এভাবে পরিচালিত হবে।
এ ধরনের কোনো ইউটোপীয় ধারণায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি শুধু বলছেন, সমাজ, রাষ্ট্র বা অর্থনীতি যদি কেবল ব্যক্তিস্বার্থনির্ভর নীতিতে পরিচালিত হয়, তাতে সমাজে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না এবং এ ক্ষেত্রে তিনি কেনেথ এরোর এই উক্তি মনে করিয়ে দিয়েছেন- পুঁজিবাদকে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি চালাতে হলেও, তাকে একটা পর্যায়ে নিঃস্বার্থ, জনস্বার্থমুখিন, ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিস্ট, ওয়েলফেয়ার স্টেটমূলক নীতিমালা গ্রহণ করতে হয়। এভাবে স্বার্থপরতাকে টিকিয়ে রাখতে হলেও পরার্থপরতা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা দৈনন্দিন জীবনযাপনে যে ধরনের পণ্যসেবা ভোগ করে থাকি, তার সবটাই বাজার থেকে প্রাপ্ত না। যেমন আইনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য, টিকাদান, জনশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা। এসব বিষয় বাজারদরে যাচাই করা যায় না। এগুলো সর্বমানুষের মৌলিক অধিকার। যেটা আমাদের সংবিধানেও আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য- এগুলো হচ্ছে মৌলিক প্রয়োজন। এই বেসিক নিডস সব সময় বাজার দ্বারা প্রাপ্ত হয় না। বাজারমুখিন কর্মকাণ্ড এগুলোর প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে পারে, সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে কিন্তু শুধু বাজারনির্ভর ব্যবস্থায় কোনো দেশই ১০০ শতাংশ নিরক্ষরতা দূর করতে পারেনি, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা-মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তৃত করতে পারেনি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বেসিক নিরাপত্তা বিধান করতে পারেনি।
এই বইটি লেখার পেছনে স্পষ্টতই দেখা যায়, সেই সময় আকবর আলি খান ভাবছিলেন কোন ধরনের সমাজ হবে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী। সেটি কি কেবলই অবাধ বাজারমুখিন অর্থনীতি হবে, সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি হবে, নাকি পাশাপাশি সামাজিক দায়দায়িত্ব বহনকারী প্রতিষ্ঠানাদি সংগঠন আয়োজন গড়ে তুলবে। নিজে তিনি দীর্ঘকাল সরকারের অর্থ সচিব ছিলেন, পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। তিনি খুব কাছ থেকে সরকার ও রাষ্ট্রের কার্যাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও হয়তোবা তাঁর মনে হয়েছে, বই লিখে জানান দেওয়া উচিত- আমরা বাজার অর্থনীতির দিকে সদর্পে হাঁটছি বটে কিন্তু তার রশিটা থাকতে হবে পরার্থপর জনকল্যাণের অর্থনীতির কেন্দ্রে। এবং এ দুটোরই সম্মিলন তিনি চেয়েছেন : বাজার ও রাষ্ট্র, স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা, মানুষের ব্যক্তি প্রয়োজন ও সামষ্টিক প্রয়োজন। এক পর্যায়ে তিনি সামাজিক পুঁজি এবং এর মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়েছেন অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশের জন্য।
এই বইটিরও আমি একটি সমালোচনা লিখি ২০০১ সালে। এটি বিআইডিএস কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক ‘উন্নয়ন সমীক্ষা’-তে বেরোয়। সেখানে আমি এই বইটির মূল প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে বলি, বাংলাদেশের মতো দেশে যদি আমরা ওয়েলফেয়ার স্টেট বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে আমাদের নীতিমালার মধ্যে কত শতাংশ আমরা ব্যক্তি উদ্যোগের অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি আর কত শতাংশ পরার্থপরতার অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি, সেগুলোর চুলচেরা বিশ্নেষণ হওয়া উচিত। প্রতি বছর বাজেট এলে যে কথা আমরা প্রায়ই মনে রাখি না।
৩. তার আগে চাই গণতন্ত্র
২০১০-এর দশকে এসে আকবর আলি খানের রচনায় আমরা বিষয়াদির একটা বিপুল বৈচিত্র্য দেখতে পাই। ক্রমে তিনি অর্থনৈতিক ইতিহাস, ইকোনমিক হিস্টোরিয়ান অথবা অর্থনীতিবিদের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচরণ করতে থাকেন। সেখানে তিনি যা কিছু তাঁর কাছে উৎসাহজনক মনে হয়েছে, কৌতূহলকে উস্কে দিয়েছে, তা তিনি অনুসন্ধান করতে পিছপা হননি। অনেক সময় এ ক্ষেত্রে বিতর্কেরও জন্ম নিয়েছে।
যেমন বনলতা সেন আলোচনায় তাঁর একটি মত হচ্ছে- বনলতা সেন বলে সত্যিই একজন ছিলেন এবং বাস্তব জীবনেই তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল। হয়তো প্রেম বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল- এ রকমও তিনি স্পষ্ট করে ইঙ্গিত দিয়েছেন। থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার- এটির তিনি একটি ফ্রয়েডীয় বিশ্নেষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে তিনি ভূমেন্দ্র গুহর ‘জীবনানন্দ দাশের ডায়রি’ ব্যবহার করেছেন, যেটি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। জীবনানন্দের কবিতা বিশ্নেষণে তথ্য বিচারের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন আকবর আলি খান।
সুশাসনের বিষয়টি তাঁকে বিভিন্ন সময় ভাবিয়েছে। একটা বড় কারণ, তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। স্বল্পকালীন হলেও তিনি রাষ্ট্রের উচ্চতর মহল, উচ্চতর স্তর থেকে সুশাসনের সমস্যা আমাদের মতো দেশে প্রত্যক্ষ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান হন। সেই কমিশনের অস্তিত্ব এখন নেই।
সেখান থেকেও তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমাদের দেশে কত ধরনের রেগুলেশনের সমস্যা। রেগুলেশন বাস্তবায়নের সমস্যা। যানবাহন, রাস্তার ট্রাফিক, বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংকের ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে ওয়াসার জলের কোয়ালিটি, জনস্বাস্থ্য থেকে জনশিক্ষা- সব জায়গায়ই আমরা দেখতে পাচ্ছি গুণগত মান নির্ণয়ের সমস্যা। একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, একটা প্রমিতীকরণ, একটা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ধরে গুণমানকে বজায় রাখার সমস্যা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সুশাসন নিয়ে তিনি একাধিক বই বাংলা ও ইংরেজিতে রচনা করেছেন এবং সেখানে তাঁর মূল বক্তব্য হচ্ছে- একেবারে যে রাতারাতি একটি দুঃশাসনের থেকে আমরা সুশাসনের উচ্চতম স্তরে পৌঁছে যাব, ব্যাপারটা এমন নয়। মানুষের মধ্যে সুশাসনের চাহিদা গড়ে উঠতে হয় এবং সুশাসনের চাহিদাটি গড়ে ওঠে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষা বৃদ্ধি- সেগুলোর সাপেক্ষে। কিন্তু এর মানে এ-ও নয়, আমরা নিষ্ফ্ক্রিয় বসে থাকব বা একটা দীর্ঘ সময়ের দিকে মুখ রেখে চলব এবং অজানা সুশাসনের ভবিষ্যতের দিকে এগোব।
সময় লাগলেও কতিপয় ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অবিলম্বে জরুরি। যেখানে আমরা কোনোভাবে ছাড় দিতে প্রস্তুত নই। যেমন- আপনি যদি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন এক্স-রে মেশিনটি ঠিকমতো কাজ করছে না, ইসিজি মেশিনটি সঠিক ফল দিচ্ছে না বা সময়মতো সেখানে জরুরি বিভাগে ডাক্তার বা নার্সকে পাচ্ছেন না, যেখানে আপনি আপনার রোগী নিয়ে এসেছেন জরুরি চিকিৎসার জন্য, সেই ধরনের সুশাসনের অভাব কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না বা সাময়িক অসুখ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
একইভাবে আমরা যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে সুশাসনের কথা বলি, ধরা যাক বেসিক এডুকেশনের ক্ষেত্রে যদি শিক্ষকের অনুপস্থিতি থাকে, যদি শিক্ষক স্কুলে না পড়িয়ে কোচিং সেন্টারে পড়াতে বেশি আগ্রহী হন, যদি কোচিং সেন্টারই স্কুলের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়- এ ধরনের সুশাসনের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বিশৃঙ্খলা এবং সর্বোত্তম সুশাসনের মাঝখানে আমাদের যে কোনো চয়েস নেই, তা বলা যাবে না। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবিলম্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যদিও আরও বৃহত্তর বলয়ে রেগুলেশন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সময় লাগবে। তিনি এ নিয়ে অনেক উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার’ বইতে।
এ ক্ষেত্রে বলে রাখি, আকবর আলি খানের রচনার প্রসাদগুণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তিনি সরসভাবে জটিল তত্ত্বের কথা বলতে পারেন। সেজন্য প্রয়োজনে তিনি অনেক সময় নাসিরউদ্দিন হোজ্জার বিভিন্ন গল্প বলে বিষয়টাকে প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর লেখাতে প্রায়ই স্কিট, চুটকি নানা ধরনের এনিকডোটাল রম্য কাহিনি বা বিবরণ থাকে এবং সেটি এত বেশি প্রাসঙ্গিকভাবে আসে যে তা বিশ্নেষণেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর এ রকম একটি বই বোধ করি ২০১৩-এর দিকে বেরিয়েছিল। তার নাম আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। যেটার রিভিউ হয়েছিল কলকাতার দেশ পত্রিকায়। দেশ পত্রিকার সমালোচক লিখেছেন, বইটি পড়ে এটুকুন অন্তত বলতে পারা যায় যে লেখক কষে বাংলা লিখতে জানেন! তাঁর লেখার যে ধারা এবং লেখার যে সরস রচনাশৈলী, তা দেখে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। সেটি মিথ্যা নয়, কারণ তাঁর অত্যন্ত সুলিখিত সাবলীল ইংরেজিতে নির্মিত রচনা এবং পরবর্তীকালে তাঁর বাংলা লেখাগুলোতেও দেখেছি হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে, সহজ যুক্তির মাধ্যমে, কখনও কোনো সামান্য উদ্ধৃতির মাধ্যমে তিনি গুরুগম্ভীর বিষয়টির অবতারণা করেছেন এবং সাধারণ পাঠকের মধ্যে সহজেই তাঁর বিষয়বস্তুটি গেঁথে যাচ্ছে। এটি তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য।
শেষ পর্যায়ে আকবর আলি খান অনেক লেখা লিখেছেন। এর মধ্যে একটি-দুটি বলে আমি শেষ করব। একটি হচ্ছে, দারিদ্র্য নিয়ে তিনি একটি সুবিশাল গ্রন্থ লিখেছেন এবং সেখানে তিনি দারিদ্র্যের উৎপত্তি, ইতিহাস, তার মূল্যায়ন পদ্ধতি, দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতিমালা- এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি নিয়ে আমি বিশদ আলোচনা এখানে করতে চাই না কিন্তু যেটি আমার বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, শেষের কয়েক বছরে তিনি বারবার গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ এনেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায় এবং আগে যদি তাঁর যুক্তি ছিল- আমাদের দেশের অধিবাসীরা অর্থনৈতিক কারণেই মার্কেট লিবারেল বা বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে পারে, কারণ তারা অনেক বেশি অসামষ্টিক বা অনেক বেশি ইন্ডিভিজুয়াল, ব্যক্তিকেন্দ্রিক; পরবর্তী সময়ে সেটাকে তিনি কাউন্টার পয়েন্ট ধরে লিখলেন, শুধু মার্কেট লিবারেল ক্যাপিটালিজমের পথে হাঁটলেই চলবে না, পরার্থপরতা বা জনকল্যাণের কথাও ভাবতে হবে। সেজন্য পরার্থপরতার অর্থনীতি লেখা হয়েছিল।
কিন্তু মার্কেটই করি আর নন-মার্কেটই করি, উভয়টাতেই আমাদের লাগবে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, প্রমিতীকরণ, রেগুলেশন, তার বাস্তবায়ন, সুশাসনের বাস্তবায়ন। সেজন্য তিনি সুশাসনকেন্দ্রিক রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু এই সুশাসনকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে গণতন্ত্র না এলে আমাদের মতো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এই কনক্লুশনটির আগে থেকে পূর্বাভাস মেলেনি। মার্কেট লিবারেলিজমের পাশাপাশি ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম, আবার এ দুইকে বাস্তবায়ন করার জন্য সুশাসনের অর্থনীতি আর সুশাসনের অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন বা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা- এটি যে প্রবলতর পূর্বশর্ত, সেটি আগে তিনি অনুধাবন করেননি। কিন্তু ২০০০ দশকের শেষের দিকে এসে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে সেটির উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সর্বশেষ যে রচনা প্রকাশিত হয়েছে সমকালে, কালের খেয়াতে গত ৯ সেপ্টেম্বর সেখানেও এর প্রমাণ মেলে। আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নিয়ে আলোচনা উপলক্ষে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ছিল না বলে পাকিস্তানে ফেডারেলিজমটা টেকেনি এবং ফেডারেলিজম ভেঙে টু ইউনিটের প্রস্তাবনা করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধানে যেসব অধিকার থাকতে পারত, সেগুলো আসেনি। দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠে এবং দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বৈষম্য, বিশেষ করে আঞ্চলিক বৈষম্য আরও গেড়ে বসে। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’। আকবর আলি খান লিখতে পারতেন- ‘তার আগে চাই গণতন্ত্র’।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আবুল মনসুর আহমেদের যুক্তি মেনেই বলতে হয়- গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের ধারা টিকিয়ে রাখা কঠিন। অন্য অনেক দেশে হয়তো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র ছাড়াই এবং দীর্ঘকাল সেভাবে চলতে চলতে একসময় গণতন্ত্র আঙুর ফলের মতো জনগণের পাত্রে এসে পড়ে যায়, সে রকম অবস্থা আমাদের নয়। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের মতো মডেল নিয়ে আমরা চলতে পারব না। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’-এর মডেলটিকে আকবর আলি খান কার্যত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান। এ ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে- অন্তত আমাদের মতো দেশের যে মনস্তত্ত্ব, অস্থিরতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর কাউকে স্ট্যালিনীয় কায়দার এককেন্দ্রিক শাসনের কেন্দ্রে না মানার প্রবণতা- এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের পৃথক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় যেখানে দীর্ঘকাল, ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে চলেছে একদলীয় এককেন্দ্রিক শাসন, তার সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা তাই যথাযথ হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁর কনক্লুশন মূলত দাঁড়ায় এই যে- আমাদের দেশের মুক্তি মিলবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়েই এবং এক দলের দীর্ঘকাল শাসনে না থাকার মধ্য দিয়েই এটার সফল পরিণতি হয়তো দেখা যাবে।
আকবর আলি খানের এই বক্তব্যও আমাদের সচকিত করে, কেননা এখানে তিনটি কথা বলেছেন। একটি বলেছেন যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভবন দরকার। ডিসেন্ট্রালাইজেশন দরকার। আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে এই ডিসেন্ট্রালাইজেশন সহসা সম্ভব নয়, সেটি পাঁচ-দশ বছরের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে হয়। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি কোনোভাবেই ছাড় দিতে নারাজ, সেটি হচ্ছে সময়মতো কারচুপিহীন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা। সেটি তাঁর দিক থেকে নূ্যনতম পূর্বশর্ত ওই ধরনের সুশাসনসমৃদ্ধ পরার্থপরতার মূল্যবোধে ঋদ্ধ একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির সফল বিকাশের জন্য এবং সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কিছু সংস্কার আনতে হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার সাপেক্ষে সংসদ সদস্য বণ্টনের কথা। উইনারস টেক ইট অল- সেই ধরনের প্রচলিত নির্বাচনের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি বলেছেন, আমরা কি নিউজিল্যান্ডের মতো বা অন্য যেসব দেশ আনুপাতিক ভোটপ্রাপ্তির বিচারে সংসদে প্রার্থী সংখ্যা নির্ধারণ করবে, সেই দিকে যেতে পারি কিনা। অর্থাৎ প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশনের সিস্টেমে যেতে পারি কিনা। এতে তিনি বলেছেন, প্রতিযোগী দলের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে এবং অনেক বেশি স্ট্যাবল গণতন্ত্রের জন্ম হবে। তবে লেখক এ নিয়ে তাঁর শেষ কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে আরও গবেষণা করা উচিত।
এ বিষয়টি নজরুল ইসলাম বা অন্যদের লেখায় আগেও এসেছিল, কিন্তু এটি দেখলাম আকবর আলি খানেও খুব বিশদভাবে এসেছে। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আরও গবেষণা জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ তিনি চান অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি, সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি পলিটিকাল উন্নয়ন হোক। সমানতালেই হোক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন না এলে যে অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং সামাজিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে- এ কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
৪. সংক্ষিপ্তসার
এক কথায় বলতে গেলে আকবর আলি খান ছিলেন একজন বহুমাত্রিক মননের মানুষ। আটাত্তর বছরের জীবনে তিনি একাধিক ভূমিকা পালন করেছেন- কখনও সরকারি আমলা হিসেবে, কখনও শিক্ষক হিসেবে, কখনও সাহসী প্রাবন্ধিক হিসেবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি আঁচড়ও তাঁর মধ্যে থেকে গিয়েছিল এবং এর ফলে তাঁকে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, সেটি তিনি কখনও প্রকাশ্যে বলেননি। যেমন বলেননি শেষের দিকে তাঁর স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর কত কষ্ট হতো লিখতে এবং এক পর্যায়ে তিনি লিখতেই পারতেন না, যেহেতু তাঁর ডান হাতটাই তখন কাজ করত না। তখন তিনি মুখে বলে যেতেন এবং অন্যরা লিখতেন এবং তিনি সেটাকে সেভাবেই কারেকশন করে বা কম কারেকশন করে প্রকাশের জন্য তৈরি করতেন।
এটি যে কোনো লেখকের পক্ষেই যন্ত্রণা এবং তাঁর মতো এত খুঁতখুঁতে লেখক, এত পুর্ণাঙ্গ লেখকের পক্ষে তো এ যন্ত্রণা আরও বেশি। তা সত্ত্বেও তিনি একপ্রকার নিজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেই এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তার ফলে আমরা অনেক রচনা পেয়েছি। এটি আমাদেরকে তাঁকে সব সময় মনে করিয়ে দেবে।
আকবর আলি খানের রচনা, তাঁর সব লেখাপত্র সবাই আরও মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, বিতর্ক করবেন, আলোচনা করবেন এবং আরও উন্নত গবেষণার দিকে অগ্রসর হবেন- এই আশা রাখছি। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্যই তাঁর রচনাবলির সংগ্রহ অবিলম্বে প্রকাশ হওয়া এখন জরুরি।

মধ্যাহ্নের সমাজ

হুমায়ূন আহমেদ [১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২]

কেন ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসটি লিখতে হলো তাঁকে- এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সময়কে’ ধারণ করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। সচরাচর যেসব বিষয় নিয়ে তাঁর চরিত্ররা মাথা ঘামায় না- রাজনীতি, কাল, সমাজ- সে সবকিছুকে আর গল্পের বাইরে রাখা গেল না। কেননা, গল্পটাই কতদূর এগোলো মানুষ- তা নিয়ে। ১৯০৫ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের সমাজ কীভাবে বদলে যেতে থাকল এ রকম কোনো ইতিহাসবোধে তাঁকে পেয়ে বসেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি-প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরীফকে জানিয়েছিলেন যে, নিজের জীবন ভাঙিয়ে আর কত উপন্যাস লেখা যায়! সে জন্যেই নাকি তাঁকে ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’র মতো ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। তিনি খুব সচেতন প্রয়োজনেই এই ইতিহাস-প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন বোধ করি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ব্যাখ্যাটা এরকম :’আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই নি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তো বা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি, সময়টাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগোতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তার পরেও।’
এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘তারপরেও’ বলতে গল্প ছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন সচেতনতার প্রতি কি তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন? আর ইতিহাস-গল্প মিলিয়ে যদি কিছু লিখবেন তাহলে ১৯০৫ সাল থেকেই তা শুরু করবেন কেন? সময় ধরার ইচ্ছের কথা বলছেন, কিন্তু কোন কালপর্বে শুরু করে কোথায় তার যতি টানবেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে যে-সময়কে অনুভব করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ অবধি। কেন এই বিশেষ সময়ের টানাপোড়েনের মধ্যে তাঁকে প্রবেশ করতে হলো- সেটা একটা প্রশ্ন। তার চেয়েও গুরুত্বপূূর্ণ প্রশ্ন হলো, উপন্যাসটিতে যে সমাজকে তিনি এঁকেছেন, সেই সমাজচিত্র সে সমাজকল্পিত, না বাস্তব, সে প্রশ্নে পরে আসা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্রটাকে তিনি কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে আঁকলেন? আজকের যুগের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিচালিত সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যাহ্নের সমাজকে মনে হবে কোন অচিনপুরের গল্প- এক আধুনিক ইউটোপিয়া। এই উপন্যাস ভর করে আছে আদর্শস্থানীয় দুই চরিত্রের ওপরে, যাঁর একজন হরিচরণ সাহা এবং অন্যজন মওলানা ইদ্রিস। এই দুই শুভবোধসম্পন্ন মানুষ- বস্তুত নিয়ত এবাদতে রত সূফী-সন্তই বলা চলে তাদের- যাঁরা সবসময়েই কী করে মানুষের উপকার করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত, তাঁরাই উপন্যাসের ঘটনাবলির ওপরে বৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন শুরুর লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের শুরু হয় যে-পুকুরঘাটে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ হয় একই পুকুরঘাটে; কেবল শুরুর দৃশ্যে ছিলেন হরিচরণ, শেষের দৃশ্যে মওলানা ইদ্রিস। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র- ভালো স্বভাবের ও মন্দ স্বভাবের চরিত্ররা সবাই এদের নিয়েই, এদের পাশে রেখেই যার যার জীবন কাটায়, যার যার মতো করে মৃত্যুবরণ করে।
মধ্যাহ্নের সমাজের বড় শক্তি তার অন্তর্নিহিত নৈতিক শ্রেয়বোধ। এর প্রধান উৎস হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিসের মতো মানুষেরা হলেও অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষ যাঁরা, তাঁরাও প্রবল মানবিকতায় আক্রান্ত। তাঁরা পারতপক্ষে অন্যায় করেন না, বা করলেও পরিহার্য বলে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। জুলেখা, শরীফা, মনিশংকর, শিবশংকর, আতর- তাঁরা সবাই পৃথিবীতে ভালোমানুষের পাল্লা ভারী করেছেন। আর লাবুস তো জুলেখার পুত্রসন্তান হলেও আসলে হরিচরণ-মওলানা ইদ্রিসের আধ্যাত্মিক সন্তান। লাবুস শহরে এলে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটত, খুবই স্বাভাবিক হতো তার হিমু-হওয়া! তার মানে এই নয় যে, এই সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত ছিল না। সংঘাত-দ্বন্দ্ব-অনাচার ছিল যদিও, কিন্তু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। হরিচরণের নিজের পাটের আড়ত রয়েছে, ‘সাহা’ যেহেতু সেহেতু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা তার উপার্জনের স্বাভাবিক উৎস। সুতরাং বাণিজ্যবিরোধী ছিল না ওই সমাজ। যে অঞ্চল নিয়ে এই উপন্যাস তার হাওরেই সওদাগররা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় তাদের নৌবাণিজ্যের নাও ভাসিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ধারা থাকলেও এ ধরনের সমাজে টাকার শক্তিতে মানুষের ক্ষমতাকে মাপা হয়নি। শশাংক পালের মতো জমিদার বা ধনু শেখের মতো কুটিল ব্যবসায়ী মানুষও সমীহ করে চলেছে হরিচরণকে- সেটা তার অর্থের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি তার নৈতিক স্বভাবের কারণে। আরেকটি দিক হচ্ছে, মধ্যাহ্নের সমাজে স্বার্থপরতাই ব্যক্তির একমাত্র প্রণোদনা নয়; এখানে পরার্থপরতার বোধ সহজাতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বিভিন্ন স্তরে। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের আজকের এই অপরাহেপ্তর সমাজ বাণিজ্যিক বোধের সমাজ। উনিশ-বিশ শতকের [অন্তত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ও মোটা দাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত] অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর মূল্যবোধের থেকে আজকের এই সমাজ মৌলিকভাবেই আলাদা। মধ্যাহ্নে অনায়াসে সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে। এখানে বৃক্ষের অসুখ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, জুলেখা গায় উকিল মুন্সি ও রাধারমণের গান, রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদের হাহাকার, হাওরের ঢেউয়ে বেজে ওঠে। সেটা যে কেবল নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য, তা মনে করেননি লেখক। ব্যাপক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আদান-প্রদানকে ধারণ করেছিল এই মধ্যাহ্নের সমাজ। সেখানে কোন চিহ্নটা কার, বা কোন গানের লাইনটা কোন সম্প্রদায়ের জীবনবোধ থেকে উঠে এসেছে- সেটা হিন্দুর নাকি মুসলমানের, মজুরের নাকি অবস্থাপন্ন কৃষকের- সেটা বের করাটা দুরূহ। ওই সমাজের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি।
এ রকম সমাজের কাহিনি কি ইউটোপিয়ার মতো শোনাচ্ছে? হোক ইউটোপিয়া, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই কল্পকথা নির্মাণে [নাকি বাস্তবেই গল্পটা এভাবেই তিনি শুনেছিলেন] এত শ্রম ও মেধা ঢালবেন কেন? আমার ধারণা, মধ্যাহ্নের ভূমিকায় পুরো কারণটা হুমায়ূন আহমেদ বলেননি। শুধু ‘সময়’কে ধরার জন্য ওই বিশেষ কালপর্বের প্রতি চোখ ফেরাননি তিনি; আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল আমাদের মন ও মননকে নাড়া দেওয়ার জন্যে। হয়তো উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সমাজের অন্তরাল প্রাণশক্তির উৎস কোথায়, তা দেখানো চোখে আঙ্গুল দিয়ে।
২.
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিস্কৃতি নাই।’ মধ্যাহ্ন উপন্যাসে সেই পাপকে অবলীলাক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পাপের মধ্যে সহাবস্থানকেই চূড়ান্ত মানেনি। শশাংক পালের মতো অত্যাচারী জমিদারেরা এতকাল নিরীহ রায়তের পেছনে লেগেছে। তার মৃত্যুর পরে ধনু শেখের মতো ব্যবসায়ীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। শশাংক পালের যোগাযোগ ছিল কলকাতার প্রশাসনের সাথে, ধনু শেখ নিয়েছে মুসলিম লীগের আশ্রয়। স্বদেশি আন্দোলনের তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর হাতে আহত হতে হয় তাকে; শেষ পর্যন্ত এলাকার মানুষই দাঙ্গা ঘটানোর ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাকে দায়ী করে এবং তার ক্ষমতার ভিত দুর্বল করে দেয়। আর শশাংক পালের মৃত্যু হয় কোনো অব্যাখ্যাত ব্যাধিতে। শশাংক পাল, ধনু শেখের প্ররোচনার কারণে হোক, আর দুই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমে বেড়ে যাওয়া ভেদবুদ্ধির কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মধ্যাহ্নের সমাজেও ঢুকতে থাকে। রাতের অন্ধকারে একদল আরেক দলের লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়, একপক্ষ আরেক পক্ষের জাতিনাশ, ধর্মনাশ করে, বাড়িতে আগুন লাগায়, পুলিশের কাছে মিথ্যে মামলা দিয়ে, হুমকি দিয়ে এলাকা পরিত্যাগে বাধ্য করে, নষ্ট মেয়ের অপবাদ দেয়, হাওরের নির্জনে এনে ধর্ষণ করে, জায়গা-জমি বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এসবই হয়, কিন্তু এটা মধ্যাহ্নের সমাজের অন্দরমহলকে ছুঁতে পারে না। কোনো লৌকিক বা অলৌকিক কারণে এর মানুষগুলো পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে।
পরস্পরের পাশে সহায়-সমর্থনের উদাহরণ অনেক এই উপন্যাসে। আমি এখানে দু’একটি উদাহরণ দেব। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে মওলানা ইদ্রিস রওনা হয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দিকে। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বগুড়ার পরিবর্তে রংপুরে চলে গেছেন। এক পর্যায়ে রাত হলে তাঁকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে একটি হিন্দু পরিবার। লক্ষণ দাসের পরিবার কাছেরই এক মন্দিরের সেবায়েত। ওই বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। খাবারেরও ব্যবস্থা হয়েছে- অবশ্য রাখা হয়েছে উঠানেই। লোকটা তাকে বলেছে, ‘মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।’ মওলানা তাতেই খুশি। তিনি নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে দোয়া চাইলেন, যাতে এই পরোপকারী পরিবারটির প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। এ সময়ে কপালে চওড়া করে সিঁদুর দেয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মওলানার সামনে এসে দাঁড়াল প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকে। মওলানার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল চলে যেতে : ‘দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকাপয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন’।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে পাপ আছে তা অস্বীকার না করে স্বীকার করাই ভালো, স্বীকার করলে যদি আমরা পরিত্রাণের পথ পাই। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেও, করার মাঝেই, থমকে দাঁড়িয়েছে অথবা স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ধনু শেখ এলাকার মসজিদের ইমাম নিয়ামত হোসেনকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ‘জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?’ আপাতত সম্মতি দিলেও চে’ গুয়েভারার চেয়ে কোনো অংশে কম যান না ইমাম নিয়ামত হোসেন। রাতের অন্ধকারে মনিশংকরের কাছে গিয়ে বলে দিয়েছেন, কাল জুমার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। শুধু তা-ই নয়, পরদিন জুমার নামাজ শেষে ইমাম নিয়ামত মওলানা ইদ্রিসকে আমন্ত্রণ জানালেন কিছু বলার জন্যে। ইদ্রিসকে বহুদিন ধরে হরিচরণ সাহার বাসায় আশ্রয়ের পর থেকেই হিন্দুদের সঙ্গে উঠা-বসা করার জন্যে একঘরে করে রেখেছে ধনু শেখ। মওলানা ইদ্রিস দাঙ্গা ঘটানোর পরিস্থিতি বদলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সুরা হুজুরাত এর তেরো নম্বর আয়াতের স্মরণ করলেন, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করে পরে বিভক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে, যাতে তারা ‘একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে’। দোয়া পাঠের সময় ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে এক উদারনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এলাকায়। অত্যাচারী শশাংক পাল মারা যাওয়ার পর তার মুখাগ্নি করতে তাঁর স্বধর্মের কেউ রাজি হলো না। হয়তো তিনি সারাজীবন অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলেন বলে, হয়তো অত্যাচারী ছিলেন বলে। মুসলমান হয়ে মওলানা ইদ্রিস এগিয়ে এলেন এক্ষেত্রে। সমস্যা হলো পুরোহিতের সাথে তাঁকেও কিছু মন্ত্র পড়তে হলো শেষকৃত্যের প্রয়োজনে। এর জন্যে কাফের বলে ফতোয়া দেওয়া হলো তাঁর বিরুদ্ধে। লাবুস এসে প্রতিবাদ করে বলল, ‘লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু মুসলমান কী? লাশ নামাজ কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না’। অন্যত্র, লাবুস ও ইদ্রিসের মধ্যে অন্য একটি ধর্মীয় আলাপের বিনিময় হয়। ইদ্রিসের শিশুবয়সী মেয়ে পুষ্পরানীকে দুধ খাওয়ানোর কেউ নেই। তার স্ত্রী জুলেখা তাকে পরিত্যাগ করে গেছেন। এদিকে গ্রামের বাগাদিপাড়ার মেয়ে ষোলো-সতেরো বয়সী কালী গতকালই তার মেয়েকে হারিয়েছে। পুষ্পরানীকে পেয়ে সাগ্রহে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে সে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠেই শোনা যাক : ‘মাওলানা ইদ্রিস লাবুসের কাছে হিন্দু-মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দু-মুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই। লাবুসের কথায় মাওলানা হকচকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেননি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।’ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাত্যহিকের সাংস্কৃতিক ব্যবহারিক বিনিময়ের এ রকম অনেক উদাহরণ আরও ছড়িয়ে আছে। আজকের এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যুগে ধর্ম-ধর্ম করে আমাদের নগর ও গ্রামের জীবন এখন ব্যতিব্যস্ত। লাবুস-মওলানা ইদ্রিস হরিচরণের মতো চরিত্ররা কি আছে এখনও আমাদের আশেপাশে কোথাও?
৩.
তাহলে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানে মিলে একটা যে অভিন্ন সংস্কৃতি, তলার দিকে গড়ে উঠেছিল, শত কংগ্রেসী লীগ রাজনীতির ডামাডোলেও যেটা পুরোপুরি ধসে যায়নি, সে রকম কোনো শুভনীতিবোধসম্পন্ন অস্তিত্বকেই আমাদের ‘মধ্যাহ্ন’ অর্থাৎ ‘স্বর্ণযুগ’ বলছেন লেখক? আজ সেই মধ্যাহ্ন গড়িয়ে এই সমাজ- এই তিমিরবিলাসী সমাজ উপনীত হয়েছে তার অপরাহেপ্ত। ‘অপরাহপ্ত’ কথাটা আমি ‘লেইট ক্যাপিটলিজম’-এর তাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচক ফ্রেডেরিক জেমসনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। বাণিজ্যনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে, শিল্পকেও মানবসত্ত্বাকে ক্রমাগত ‘ব্যবহূত-ব্যবহূত’ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বর্জ্যের মতো পাগলার লেগুনের মতো অন্ধকার কোণে। হুমায়ূন আহমেদ এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর সমাজকে মন থেকে কখনও মেনে নিতে পারেননি। হিমুকে দিয়েছেন এই বাণিজ্যিক সমাজকে বিদ্রূপ করার মনোমুগ্ধকর ক্ষমতা। ‘অয়োময়’-এর মির্জা হেরে যাচ্ছে উঠতি বণিক শ্রেণির কাছে, যেভাবে ধনু শেখের কাছে হেরে গিয়েছিলেন শশাংক পাল। তবু স্রষ্টার পক্ষপাতিত্ব পরাজিতের দিকেই। সত্যজিতের ‘জলসাঘর’-এর শেষ দৃশ্যে বিশ্বাম্ভর কোথায় মিলিয়ে যান সে খবর আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমাদের মনে থেকে যায় শেষ সংগীতসভার নৃত্যগীতের রেশ। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষে আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ আসন্ন, ভিটেমাটি ছাড়ছে দু’তরফেই, নতুন রাষ্ট্রজীবনের শুরু হবে সীমান্তের দু’দিকেই। পাকিস্তান হচ্ছে ‘কৃষকের ইউটোপিয়া’ গবেষকরা রায় দিয়েছেন, শুধু কিছু মানুষের মনে শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। হরিচরণ সাহা মারা গেছেন, লাবুস মৃত্যুশয্যায়, মওলানা ইদ্রিস সবচেয়ে বেশি নিরাশ্রয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।’ হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিস ছিলেন এই পাপবিদ্ধ সমাজের রক্ষাকবচ- তাঁরা আঁকড়ে ছিলেন সমাজের ভালোত্বকে শুভবোধকে, মঙ্গল কামনাকে। তাঁরা সমাজকে অন্ধকার খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে দেননি।
মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষটা এ রকম। লাবুস, যে কিনা আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎকে নায়কের মতো লালন করেছে, সে মারা যাচ্ছে। কোনো অব্যাখ্যাত অসুখে তাকে আক্রান্ত করেছে। অসুখ নিয়েই সে এসেছে নির্জন পুকুরের ঘাটে এবং সেখানে হঠাৎই সে তার মৃত মাকে দেখতে পাচ্ছে কাছে। একপর্যায়ে মার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার এই মৃত মার নাম জুলেখা। যিনি জীবিত থাকাকালে স্বয়ং উকিল মুন্সীকে গান শুনিয়েছেন এবং নজরুল যাঁকে দিয়ে কলকাতায় গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি এবারে গুনগুন করে গান ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বইটির শেষ দুটি লাইন, যা পড়তে থাকলে এখনও আমি এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করি : ‘মওলানা ইদ্রিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে। পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনোখানে।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোসেন মিয়া ময়নাদ্বীপের সমতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের বান্ধবপুর তেমনি একটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র, সেখানে সব গোত্রের ও বর্ণের মানুষেরা মানবিক মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরবে। তবে এই অপরাহেপ্তর সমাজের কাছে হুমায়ূনের এই ইতিহাসপাঠ কল্পজগতের ভাষ্য বলে মনে হতে পারে।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের মাইলফলক


পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক আমাদের ঋণ দেবে কী দেবে না, কিংবা অন্য কোনো পক্ষের কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাব কী পাব না; অথবা কারও সাহায্য ছাড়া আমরা নিজেরাই সেতুটা নির্মাণ করতে পারব কিনা- এমন নানা প্রশ্নমুখর বাস্তবতার দিনে ২০১২ সালে আমি বলেছিলাম, আমাদের অসাধারণ কিছু করতে হবে। আমাদের জানান দেওয়া উচিত যে, আমরা বাঙালি জাতি- আমাদের ইচ্ছে মতো নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর অভ্যাসটা তোমাদের বদল করতে হবে। আমরা আর সেই আগের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাসের পাত্র হওয়া জাতি নেই। বিশ্বকে জানান দেওয়ার জন্যই হোক বা নিজেদের উন্নতির জন্যই হোক, নিজেদের শক্তি দিয়ে সেই স্বপ্টেম্নর পদ্মা সেতুটা একদিন সত্যিই বানানো সম্ভব হতে পারে- বলা যায়, এ নিয়ে আমার এক ধরনের আস্থা ছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মোটা দাগে যে হিসাবগুলো সেদিন আমাদের সামনে ছিল, সেই হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে খুব সাধারণভাবেই আমার ভাবনা হয়েছিল এবং এখনও হয় যে, যাঁরা সন্দেহপ্রবণ, তাঁরা সেদিন কেন ভেবেছিলেন যে এটা আমাদের নিজেদের টাকায় করা সম্ভব নয়? আজকে আমাদের জিডিপি ৪১০ বিলিয়ন ডলার- পদ্মা সেতুর সেতু অংশের খরচ দিয়ে তাকে ভাগ করলে আসে ১ শতাংশেরও কিছুটা কম। অর্থাৎ আমরা আজকে আমাদের জিডিপি’র ১ শতাংশ খরচ করেই একটা পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারি।
২০১২ সালে এই পরিসংখ্যানগুলো হয়তো আরেকটু দুর্বল ছিল। তখনও আমাদের রপ্তানি অত বেগবান হয়নি, আমাদের রেমিট্যান্সও ততটা বেগবান ছিল না তখন, আমাদের সক্ষমতাটাও অতটা পরিস্কার হয়নি হয়তো। হয়তো সে জন্যেই আমাদের অনেকের মনে সন্দেহটা ছিল। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাতো একটা সেতু মাত্র- এত বড় একটা দেশ, তার বৈদেশিক আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে নিজের টাকায় এমন একটা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না?
আমরা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক সাহায্যের ছায়ায় ছিলাম। একটা বড় গাছের ছায়ার নিচে থাকলে যেমন অন্য চারাগাছগুলো বেড়ে উঠতে পারে না, তেমনি আমাদের আত্মবিশ্বাসের চারাগুলোও এতদিন বেড়ে উঠতে পারেনি। ছায়াটা সরে যেতেই আমরা দেখতে পারলাম যে আমাদের মাথার ওপরে তো দিব্যি রোদ আছে- আমরা এখন নিজেদের মতো করেই বড় হতে পারব। ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক সাহায্য ছিল আমাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। সেটা কমতে কমতে আজকের দিনে এসে ১ শতাংশে পরিণত হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনটা পরিসংখ্যানে ঘটলেও মনের মধ্যেতো ঘটেনি এর আগে। মনে মনে হয়তো এখনও আমরা ভাবছি যে, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আমরা বোধ হয় চলতে পারব না, কেউ না করে দিলে কিংবা কেউ হাতে ধরে না শিখিয়ে দিলে আমরা হয়তো পারব না। কিন্তু দিন একটু একটু করে বদলে গেছে- আমাদের তরুণ প্রকৌশলী, যাঁরা পদ্মা সেতুর কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটাও দেখার মতো। তাঁরা অনেকেই এখন বলছেন যে, তাঁরা ভবিষ্যতে যেকোনো জটিল প্রকল্প সামাল দিতে পারবেন। এই আত্মনির্ভরতাগুলো একেকটা জাতি ধাপে ধাপে অর্জন করে থাকে। একের পর এক ধাপ পার হয়ে হয়ে কিংবা কিছু কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে আবিস্কার করতে শেখে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের আত্মবিশ্বাসের একটা বৃহত্তম ধাপ। তার আগে যেমন ৬-দফার মাধ্যমে দুই অর্থনীতি শীর্ষক একটা যুক্তির ধাপ আমরা পার হয়ে এসেছি, যার মাধ্যমে আমাদের ভেতর স্বাধিকার আন্দোলন করার জন্য একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। এগুলোই আমাদের জাতি গঠনের একেকটা মাইলফলক। আমি মনে করি আমাদের সংবিধান আমাদের জন্য যেমন একটি মাইলফলক, পদ্মা সেতুও তেমনি একটি মাইলফলক। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আসলে এত বড় রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলাম- মূলত তখনই আমরা এলডিসি অতিক্রম করে গিয়েছিলাম। হিসাবে আমাদের এলডিসি অতিক্রম হয়তো আরও পরে হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে এলডিসিস্তর থেকে আমরা তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম, যখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন আমরা নিজেদের টাকাতেই এটা করতে পারব। সেতুর অর্থনৈতিক অভিঘাত এবং অন্যান্য অনেক বিশ্নেষণের চেয়েও এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি ঘটনারই যেমন একটা ব্যবহারিক মূল্য থাকে, তেমনি তার একটা আত্মন্তিক মূল্যও থাকে। পদ্মা সেতুর সেই আত্মন্তিক গুরুত্বটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। একটা কঠিন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর থেকে যার মাধ্যমে আমরা একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে, নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম একটা জাতি হিসেবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি। সেখানে অনেক ঝুঁকি ছিল; এবং অনেকেই বলেছেনও যে, এই ঝুঁকি আমরা সামলাতে পারব না; কিংবা আমাদের রয়েসয়ে চলা উচিত। কেননা বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থা যদি আমাদের থেকে সরে যায়, তাহলে আমাদের উন্নয়ন ধসে পড়বে, আমরা না খেয়ে মারা যাব, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, আমরা নৈরাজ্যের মধ্যে গিয়ে পড়ব ইত্যাদি। কিন্তু তেমন পরিস্থিতিতেই আমরা আশার আলো দেখেছিলাম- আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ছিল, আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল, রেমিট্যান্স বাড়ছিল। এ সমস্ত আরও অনেক কারণেই তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা ভাবতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে কিন্তু অতটাতো দুর্বল আমরা নই।
আমি সেদিন বলেছিলাম পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থানের জন্য আমাদের বাজেটে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, সেতুর প্রস্তাবিত ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় মুদ্রা এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমেই সংস্থান করা সম্ভব ছিল। আজকেও বলছি, স্থানীয় মুদ্রায় পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থান করা আমাদের পক্ষে তখনও কঠিন ছিল না, এখনও কঠিন নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ সংস্থান নিয়ে খানিকটা প্রশ্নবোধকতা ছিল, এখন তা একেবারেই নেই। এখন আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের যে প্রবাহ, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের যে স্ট্রেংথ, আমাদের খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা- এ অবস্থায় দাঁড়িয়েই আমরা আজ জিডিপির মাত্র ২-৩ শতাংশ খরচ করে পদ্মা সেতুর মতো আরও দুইটা সেতু তৈরি করতে সক্ষম।

আমি মনে করি আমাদের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের একটা নির্দেশক হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। আমরা বলছি না যে, অন্যদের সাহায্য ছাড়া কিংবা বিদেশি প্রযুক্তি ছাড়া, বিদেশের সঙ্গে মেলবন্ধন ছাড়া আমরা সবকিছুই করে ফেলব- কিন্তু আমরা এটা বলছি যে, যদি কেউ নাও আসে তবুও এখন একলা চলার শক্তি আমাদের আছে। এটাতো আগে বলতে পারতাম না। এখন আমরা বলতে পারি। কেবল বলতেই পারি তা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তাকে সমর্থনও করে; আমাদের বুদ্ধিমত্তার সামর্থ্য তাকে সমর্থন করে, আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি বা কৃৎকৌশলগত সামর্থ্য সেটাকে সমর্থন করে, আমাদের প্রকৌশলীরা সেটাকে সমর্থন করেন, অর্থনীতিবিদরা সেটাকে নিয়ে ভাবতে পারেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটা নিয়ে আরও দূরদর্শীভাবে পথরেখা আঁকতে পারেন। এ সমস্ত বিষয়ই হচ্ছে আমাদের উন্নতির জন্য মূল্যবান উপাদান, যার মাধ্যমে মূলত একটা জাতি পরিপকস্ফ হয়ে ওঠে এবং আমি মনে করি বাংলাদেশের ৫০ বছরে সংবিধান থেকে শুরু করে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ- এই যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, এটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইতিহাস।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের যে পর্যায়ে আছে, এটা হচ্ছে মেগা প্রকল্পের পর্যায়। পৃথিবীর উন্নত সব দেশেরই এসব বড় ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাছাড়া আমাদের জনকল্পনাতেও আজ উন্নত যোগাযোগের চাহিদা ও স্বপ্টম্ন তৈরি হয়েছে। বলা যায়, যার একটা রূপান্তর হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের একটা নতুন জোয়ার তৈরিতে নিঃসন্দেহে এই সেতু অবদান রাখতে সক্ষম হবে। যে জোয়ার স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক শিল্পক্ষেত্রগুলোর একটা অংশ খুলনা শহরের দিকে স্থানান্তরিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা শহরটি আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম শহরে পরিণত হবার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিরই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের নতুন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ একত্র হয়ে একটা বড় ধরনের ফলাফল এনে দেবে।
সব মিলিয়ে আমি যেটা বলতে চাই তা হলো, এই সেতু নির্মাণের একটা ব্যবহারিক উপকারিতা আছে- সেটা আমরা ভোগ করব; সেটা আগামীতে আরও বাড়বে, সেটা আরও বাড়ানোর জন্য আমাদের স্থানীয়ভাবে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে সেতুর প্রতীকী তাৎপর্য- এর আত্মন্তিক তাৎপর্য। তা হচ্ছে যে, আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। একটা বৃহৎ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের টাকায় নিজেদের সেতু নির্মাণ করেছি। এটা যখন করতে পেরেছি, তাহলে আগামীতে অবশ্যই আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পারব।

লেখক :অর্থনীতিবিদ মহাপরিচালক, বিআইডিএস

প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি

‘কতদূর এগোলো মানুষ’- এই পঙ্‌ক্তিটি লিখেছিলেন কবি আল মাহমুদ। আজ পঞ্চাশ বছর পরে আমরা এই প্রশ্ন করতে পারি যে, কতদূর এগোলো দেশ, মানুষ, সমাজ? সেটা বুঝতে গেলে নানা পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা পরিসংখ্যান বা সূচক দিয়ে সেই পথপরিক্রমার গল্পগাথা রচনা করতে পারি। আমরা ইচ্ছে করলে গাণিতিক মডেল দিয়ে সেই পথপরিক্রমার ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারি। ইচ্ছে করলে অতিব্যক্তিক পর্যায়ে অতিতুচ্ছ মানুষের জীবনের পথপরিক্রমা দিয়েও রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমাকে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। যেমন আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষেরও জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমার বিভিন্ন পর্যায়কে মেলানো সম্ভব।
আমার জন্ম ১৯৫৮ সালে- যে বছর আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলেন। ১৯৬৪ সালে যখন আমার ৬ বছর বয়স- আওয়ামী লীগ নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হলো এবং তার সাধারণ সম্পাদক হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় জীবনের এই ইতিবাচক রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি দুটো ঋণাত্মক ঘটনাও সে বছর ঘটেছিল। ১৯৬৪ সালেই ঘটে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ‘বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু এবং আরও অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক মানুষই তখন রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এক অর্থে সেটিই ছিল ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের শুরুর পর্যায়।
দ্বিতীয় ঋণাত্মক ঘটনাটি ঘটে যখন ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন মস্কো এবং চীনের শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। সেটিও ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করেছিল। মস্কোপন্থি এবং চীনপন্থি বিভাজনে দুর্বল হয়ে পড়েছিল প্রগতিশীল শক্তির আন্দোলন; যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশে এখনও চলছে।
১৯৬৯ সালে আমি সর্বপ্রথম নিজেকে পত্রিকার পাঠক হিসেবে আবিস্কার করি। তখন বাসায় পূর্বদেশ আসত এবং সেই পূর্বদেশের পাতায় আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণী প্রতিদিন ছাপা হতো। অতিআগ্রহ নিয়ে সেটি আমি পড়তাম। তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সেই থেকে রাজনীতির প্রতি একটু একটু করে জানা-বোঝার আগ্রহ আমার বাড়তে থাকে।
সত্তর সালের মধ্যে আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনে এক ধরনের রাজনৈতিক মনোজাগতিক বিপ্লব ঘটে যায়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতন হয়, শেখ মুজিব জেল থেকে বের হয়ে আসেন। ১৯৭০ সালে আসাদ মারা যান। যে রাস্তা দিয়ে আমরা প্রতিদিন বাসে করে স্কুলে যেতাম, সেই আইয়ুব গেটের নাম আমাদের চোখের সামনে আসাদ গেটে রূপান্তরিত হয়। সে বছরই ঘূর্ণিঝড় প্রবলভাবে নাড়া দেয় আমাদের সবাইকে। আমরা পয়ষট্টি সালে একবার অনুভব করেছিলাম যে, নিজেদেরকে আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। কেননা তখন পাক-ভারত যুদ্ধ চলছিল পশ্চিম ফ্রন্টে। সে সময় পূর্ব ফ্রন্ট ছিল অরক্ষিত। ১৯৭০ সালে দ্বিতীয়বার আমরা অনুভব করলাম যে, আমরা অরক্ষিত। ঘূর্ণিঝড়ে এত বড় সংখ্যক মানুষ (প্রায় ৫ লাখ) মারা গেল- অথচ তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী প্রায় এগিয়েই এলো না। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও তীব্রতর হয়েছিল সেদিন। আমি অনেকটা মনে করি বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণের পেছনে এবং সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পেছনে এই ঘূর্ণিঝড়ের পরোক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকা কাজ করে থাকবে।
এই প্রথম আমরা চোখের সামনে দেখতে পেলাম ঘূর্ণিঝড়ে নিহত এত অসংখ্য মানুষের ছবি। পত্রিকার পাতায়, কবিতার পঙ্‌ক্তিতে, রাজনৈতিক চায়ের আড্ডায় সর্বত্র এই বোধটা গভীরভাবে সঞ্চারিত হলো। তাই আজকে যখন আমরা বলি, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা থেকে ১৯৭১- এই পাঁচ বছরের মধ্যে কী করে একটি জনগোষ্ঠী একটি বিচ্ছিন্নতাবাদের চেতনায় দীক্ষিত হলো এবং একটি নতুনতর রাষ্ট্রের জন্ম দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, তার কার্যকারণ খুঁজতে হবে এই সমস্ত ঘটনার অভিঘাতের মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, এই সমস্ত আপাত তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে কতগুলো মূল্যবোধও এখন আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। সেই মূল্যবোধগুলো আমরা একদিনে পাইনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ আমরা ছেষষ্টি সাল থেকে সর্বপ্রথম প্রবলভাবে জাগ্রত হতে দেখলাম, যার সূত্রপাত হয়েছিল আটচল্লিশ-বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সেই সমস্ত ঘটনার অভিঘাতে জাতীয়তাবাদ আরও বেশি শানিত রূপ ধারণ করে, যার একটা প্রাথমিক বিবরণী আমরা পাই শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থে।
সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটি কে কখন প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন জানা নেই, কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতা বোধের আন্দোলন গভীরতর বিকাশ পায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে। এই সময়েই আধুনিক বাংলা কবিতারও বিপুল প্রসার ঘটে। আমাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন অনেক বেশি সেক্যুলার চেতনায় ঋদ্ধ হতে থাকে। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যখন বঙ্গবন্ধু সরাসরিভাবে অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষার পক্ষে উচ্চারণ করেন, তখন তা একেবারেই রাজনৈতিক অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে একটি ক্রমান্বয়ে পরিণতিপ্রাপ্ত অনুভূতির যৌক্তিক প্রতিষ্ঠা। এভাবেই আমাদের দেশের অসাম্প্রদায়িকতাবোধ এবং সেক্যুলার রাজনীতির প্রাথমিক ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা পায়। সত্তর সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তার স্বাক্ষর আমরা পাই। সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং তারও আগের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু সমতাবাদী সমাজের আকাঙ্ক্ষা তথা সমাজতন্ত্রের কথাটা জোরেশোরে এবং স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন। আর গণতন্ত্রের কথাতো পূর্বাপর দাবি হিসেবে ছিলই।
পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ১৯৫৪ সালের যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটি হয়েছিল ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার ভিত্তিতে। কিন্তু ধর্ম নির্বিশেষে যে নির্বাচন প্রথা, সত্তরের নির্বাচনেই সেটি প্রথম বাস্তবায়িত হয়। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্বোধন কিন্তু প্রথম ঘটে সত্তর সালের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং সেই নির্বাচনের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সেটি পরোক্ষ স্বীকৃতি লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স তেরো। এই তেরো বছর বয়সে চিত্রপরিচালক তারকোভস্কির ‘ইভানভের শৈশবকালের’ মতন চোখ দিয়ে আমি দেখেছিলাম যুদ্ধের সন্ত্রাস, বিদ্রোহ, গ্লানি ও ভয়। এই সমস্ত অনুভূতি তখন আমাকে তাড়া করে ফিরেছিল। এরই মধ্যে আমার বড় ভাই যুদ্ধে গেলেন। আমার বাবা মুজিবনগর সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে উত্তর-পূর্ব সেক্টরের বিভিন্ন ক্যাম্পের দেখাশোনার কাজ করছেন। যুদ্ধের ভেতরে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘জয়বাংলা’ ইত্যাদি পত্রিকা- যেখানে রণাঙ্গনের খবরাখবর থাকত। আমি সেগুলো নিয়মিত পাঠ করতাম। সেই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের কথা তো থাকতই।
আমার এবং আমার মতো অনেক মানুষের মনেই তখন একটা স্বাধীন উদারনৈতিক বাংলাদেশের রূপকল্প মনের মধ্যে জেগে ওঠে। ১৯৭২ সালে আমরা যে বাংলাদেশ পাই, তার প্রথম একটা মৌলিক উপাদান ছিল এই স্বাধীনতা এবং উদার নৈতিকতাসমৃদ্ধ বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয় যে মৌলিক উপাদান আমরা দেখতে পাই তা হলো, রাতারাতি যেন বদলে গিয়েছিল জনচৈতন্যের চেহারা। সেদিনের জনআকাঙ্ক্ষার কথাটি হয়তো আজকে গালভারী কথার মতো শোনায়, কিন্তু জনআকাঙ্ক্ষা সত্যি সত্যি তখন একটা শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। সকল মানুষের চোখেই ১৯৭২ সালের সেই সময়ে দ্রুত বড় হয়ে ওঠার একটা আকাঙ্ক্ষা বা এক জীবনে এই অর্জনগুলো সম্ভব- সেই প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। কিন্তু এই শুভবোধের পাশাপাশি উন্নয়নের জন্য যে জনআকাঙ্ক্ষার বিস্ম্ফোরণের প্রয়োজন, তার পাশাপাশি তখন আমরা প্রাথমিক নৈরাজ্যেরও বিস্তার ঘটতে দেখি। ১৯৭৪ সালে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। একদল ছাত্রের ধর্মঘটের কারণে সেই সময় অধিকাংশ দিনই কোনো ক্লাস হচ্ছে না; এমনকি প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার যে ক্লাস টেস্ট, সেটিও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তখনই আমরা জাসদ এবং এ জাতীয় সংগঠনের অভ্যুদয় দেখি এবং তাদের রাজনীতির প্রভাব সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর একটা ঘোরতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বৈকি। প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ এসব সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হলেও পরবর্তীকালে এর কারণে একটা বড় অংশ তরুণের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যারা এর আঁচ বাঁচিয়ে চলতে পেরেছিলাম বা শিখেছিলাম- তাদের ঠাঁই হয় ব্রিটিশ কাউন্সিল বা আমেরিকান সেন্টার লাইব্রেরির ভেতরে। কেননা তখন কলেজে প্রায় কোনো লেখাপড়াই হতো না। এই একই সময়ে আমরা দেখতে পাই নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা। তার মধ্যে হঠাৎ বিত্তের ঝলকানি, ব্রিফকেস ব্যবসায়ীর হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা বা অবাঙালি মালিকানাধীন পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে বসা ইত্যাদিও রয়েছে। একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই চরমপন্থি বিভিন্ন রাজনীতির বিকাশ, যার ফলে অনেক রকমের গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছিল সাধারণ মানুষসহ অনেক রাজনীতিবিদ। একটা হিসাবে দেখা যায় যে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার রাজনৈতিক ব্যক্তি বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মী গুপ্ত হত্যায় নিহত হয়েছিলেন।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ আমাদের আরেকটা দিক থেকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। আমরা এর আগে কখনও চোখের সামনে দুর্ভিক্ষের মৃত্যু দেখতে পাইনি। গল্প-উপন্যাসে পড়েছি। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র জয়গুনের চরিত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, বা তারও আগে ‘অশনিসংকেত’ বা তারাশঙ্করের ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসের মাধ্যমে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে ঢাকার মতন শহরে ঢাকা কলেজের সামনে সমগ্র জনকোলাহলের মধ্যে মানুষ মারা যাচ্ছে বা বস্ত্রহীন মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে- এই দৃশ্য দেখা আমার সেবারই প্রথম। এখন বুঝতে পারি খাদ্য সাহায্যের ওপরে নির্ভরতা কী ভয়ানকভাবে একটি রাষ্ট্র বা জাতিকে পঙ্গু করে দেয়। বাহাত্তরের খরা, তিয়াত্তর সালের বন্যা এবং চুয়াত্তরের উপর্যুপরি দুইবারের বিধ্বংসী বন্যায় সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বণ্টন ব্যবস্থা এবং উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার কোথাও গিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। রাশিয়া নিজেই তখন আমেরিকার কাছ থেকে গম সাহায্য নিচ্ছিল। আমেরিকার কাছে সাহায্য চাওয়ায় চুয়াত্তরের জুন মাসে সোজা বলে দিয়েছিল যে, যেহেতু কিউবাতে বাংলাদেশ পাট রপ্তানি করেছে, সেহেতু তাকে পিএল ৪৮০-এর শর্ত অনুযায়ী কোনো খাদ্য সাহায্য দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সরকার তখন বলেছিল, ‘এই নিয়ম আমাদের জানা ছিল না; ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে যখন আমরা কিউবাতে পাট রপ্তানি করি, তখনতো সেই তথ্য আপনারা জানতেন। কিন্তু তখনতো আপনারা বলেননি।’ পরবর্তীকালে [অমর্ত্য সেনের স্ত্রী] অর্থনৈতিক চিন্তক, ঐতিহাসিক এমা রথচাইল্ড ফরেন এফেয়ার্স সাময়িকীতে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি লেখায় বলেছিলেন, কিউবায় রপ্তানির কারণে পিএল ৪৮০-এর খাদ্য সাহায্য দেওয়া যাবে না- এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত অবস্থান। কেননা মিসর বাংলাদেশেরও আগে কিউবাতে পাট রপ্তানি করেছিল, তবু পিএল ৪৮০-এর অধীনে তার খাদ্য সাহায্য পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশকে এক প্রকার শাস্তি দেবার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে তিনি ধারণা করেন। এরকমই ছিল সেই সময়ের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ খুবই সীমিত ছিল। সুতরাং বহির্বাণিজ্য সূত্রে খাদ্য শস্য ক্রয় করে বণ্টনের সুযোগ ছিল সীমিত। একাধিক বক্তৃতা, আলোচনায়, সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার অসহায়তার কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভিক্ষুক জাতির কোনো মান-ইজ্জত থাকে না। আমি জায়গায় জায়গায় গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারব না।
এইরকম একটি পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সাময়িককালের জন্য-মতান্তরে ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য-বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেন। এর প্রধান কারণ ছিল- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নয়। এ নিয়েও একটি ভ্রান্ত প্রচারণা দেশ চালু আছে। কেননা তখন ১৯৭৩ সালের নির্বাচন অনুযায়ী পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের ছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব বা আইন পাস করার জন্য তার জরুরি অবস্থা বা বাকশাল জাতীয় ব্যবস্থা বা অন্য কোনো অথরিটিরিয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কারণ, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব ছিল। সুতরাং এর তাগিদটা রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার কারণে উদ্ভূত হয়নি। মূলত উদ্ভূত হয়েছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে সাময়িক সময়ের জন্য কড়া শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করানোর জন্য; কক্ষচ্যুত রেলগাড়িকে রেললাইনের ওপরে তোলার জন্য। এবং ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসেও এটির সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল ১৯৭৪ সালের গোড়া থেকেই। তৎকালীন নেতৃত্ব-যার মধ্যে সিপিবি এবং ন্যাপও রয়েছে- তারা বুঝতে পারছিলেন যে দেশটাকে একটা ডামাডোলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে এবং এটাকে রোখার জন্য জুন মাস থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিবি এবং ন্যাপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এই আলোচনায় অংশ নেন। দেশে যে একটা জরুরি অবস্থা আনা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে বামপন্থি সমালোচকেরা শুধু নয় দক্ষিণপন্থি সমালোচকদেরও যেমন খন্দকার আব্দুল হামিদকে লিখতে দেখেছি। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি লিখেছেন, ‘শোনা যাইতেছে দেশে ইমার্জেন্সি আসিতেছে’। অর্থাৎ, অবস্থা যে ক্রমশ ওই আপৎকালীন জরুরি অবস্থার টিপিং পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছিল, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমি বিশেষভাবে এ কথাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, বাকশালের পুনরুদ্ধার কর্মসূচির মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ছিল, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। যেমন আমাদের সংবিধানে যে চার মূলনীতি গৃহীত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা- তার বিশদ মূল্যায়ন করার চেষ্টা এই কর্মসূচিতে রয়েছে। যেমন মালিকানা সম্পর্কের ব্যাপারে সংবিধানে বলা হয়েছে, আমাদের তিন ধরনের মালিকানা থাকতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানা। এ সমবায় মালিকানার আইডিয়াটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করা হয় বাকশালের কর্মসূচিতে। যেমন প্রতিটি জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়নে সম্ভব হলে পরীক্ষামূলকভাবে একটি করে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ করা যায় কিনা, তার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ জমি যার তারই থাকবে, কিন্তু জমির অংশ, শ্রমের অংশ এবং পুঁজির অংশ সবটা মিলিয়ে কৃষি খাতে একটা বণ্টননীতি করা যায় কিনা, সেটার কথা তিনি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে বলেছিলেন। বলেননি যে এটাই সর্বত্র একবারে চালু হয়ে যেতে হবে, বলেছিলেন পরীক্ষা করে দেখা যাক। কেন এটা করতে হবে? কারণ, বাংলাদেশে একটা বড় বাস্তবতা হচ্ছে যে, এ দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের প্রতি বর্গকিলোমিটারে যদি ১২০০ জন মানুষ বসবাস করে, ভারতে বাস করে ৪০০ জন। এর থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশ কীরকম ঘনবসতির দেশ। সেই দেশে জমির সিলিং দিয়ে জমি পুনর্বণ্টন করার যে প্রথাগত নিয়ম চালু আছে নানা দেশে, সেই নিয়ম বাস্তবায়ন করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং সংগত কারণেই এখানে কিছু সমবায় উদ্যোগকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে তখনও কিন্তু নগরায়ণ তেমনভাবে হয়নি। তখন নগরে জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫ শতাংশ। সুতরাং এমন নয় যে, গ্রামের মানুষ বা কৃষি খাতের মানুষকে সরিয়ে আমরা রাতারাতি নগরের মানুষে পরিণত করতে পারতাম। আজকের এই নগরায়ণ তখন ছিল না। যেটি এখন অনেকটা সহজতর হয়েছে, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এখন গ্রামে থেকেও একটা পরিবারের কোনো সদস্য শহরে এসে কাজ করতে পারেন, গ্রামে টাকা পাঠাতে পারেন। অথবা অনেক ক্ষেত্রে তারা বিদেশে যেতে পারেন। কিংবা কেউ কেউ ধীরে ধীরে শহরে পুরোপুরি স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারেন। এই সুযোগটা তখন ছিল না। সুতরাং একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে সমবায় কর্মসূচিটিকে সর্বাত্মকভাবে প্রায় সকল অর্থনীতিবিদই সমর্থন জানিয়েছিলেন। আমার জানা মতে তখনকার দিনের প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞ, দেশ নিয়ে চিন্তা করেন এমন মানুষেরা জানিয়েছিলেন যে, এই কো-অপারেটিভ এক্সপেরিমেন্ট করা যেতে পারে। এখানে একটি কথা বলা দরকার যে, ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল, যাতে অংশগ্রহণ করেন রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডসহ বহু দেশের অর্থনীতিবিদেরা। সম্মেলনের এক পর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান এবং সেই দলের নেতা অস্টিন রবিনসন তখন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন যে, ‘আপনি যে সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন সেটি কি আমদের একটু বুঝিয়ে বলবেন?’ বঙ্গবন্ধু তখন বলেন, ‘আমাদের সমাজতন্ত্র হলো বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র, বাংলাদেশের মতো করে সমাজতন্ত্র। এর বেশি অতিরিক্ত কোনো সংজ্ঞার দরকার নেই।’ তখন এ সম্পর্কে অস্টিন রবিনসন বলেছিলেন, শেখ মুজিবের এই উত্তরটি কোনো চতুর উত্তর ছিল না, এটি প্রকৃতপক্ষেই বাস্তব জ্ঞানভিত্তিক উত্তর ছিল, কেননা বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা সমতামুখী সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা কোনো গতবাধা মডেল অনুসরণ করে হতে পারে না। কিংবা রাশিয়া বা ভিয়েতনাম ধরে এটাকে অনুসরণ করা যেতে পারে না। বাংলাদেশের মনমানসিকতার সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, ক্যাপাসিটি- এসব মিলিয়েই সেটা গড়ে উঠতে হবে।

সব সময় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা কোনো উন্নত আধুনিক পুঁজিবাদী দেশের বা কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের বা কোনো দেশেরই মডেল অনুকরণ করে বড় হতে পারব না। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার আছে। সেদিক থেকে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ অনেকটা দেং শিয়াও পিং-এর বাংলাদেশ। সেখানে মূল জোরটা দেওয়া হবে কাজটা সফল হলো কিনা তার ওপরে। বেড়াল সাদা না কালো সেই আলোচনাটা অত গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার চাইতে বড় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বেড়ালটি ইঁদুর মারতে পারে কিনা। দেং শিয়াও পিং-এর মতোই বঙ্গবন্ধুর একটি বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান ছিল, সজাগ টনটনে। এবং সে জন্যই তিনি ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগের সীমা প্রথমে ২৫ লাখ, পরে ৩ কোটি, তারপরে ৩০ কোটি পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনের ৩ কোটি বা ৩০ কোটি আজকের যুগে একশ-দুশ কোটি টাকার সমতুল্য। সুতরাং এটা মনে রাখতে হবে যে, তিনি মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোক্তার বিকাশ পরিপূর্ণভাবে চেয়েছিলেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে ওই সিলিংটাকে তিনি আরও পর্যালোচনা করার পক্ষপাতি ছিলেন। কালক্রমে এটা সংসদে রিভাইজড হবে সেটাই ছিল আইডিয়া।
বাংলাদেশ যে আজকে এতদূর এগিয়েছে তার একটা বড় কারণ হলো- বাংলাদেশের যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তারা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন। তারা একপেশে, শুধু বাজারমুখী অর্থনীতি বা শুধু রাষ্ট্রনির্ভর অর্থনীতির পেছনে ছোটেননি। এটা বিশেষভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
একাত্তরে স্বাধীনতা যদি বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক অর্জন হয়, বাঙালি জাতির পক্ষে দ্বিতীয় মৌলিক অর্জন হচ্ছে ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে। নব্বই সালে আমার বয়স ৩২ বছর। তখন এই বয়সের আশপাশে যাদের বয়স তারা প্রায় সকলেই সেদিন ঢাকার রাস্তায় ছিলেন। এবং তারা সকলেই সেদিন দ্বিতীয়বারের স্বাধীনতা অর্জনকে উপলব্ধি করেছিলেন। মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের এই পরাজয়টি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এর মধ্য দিয়ে মিলিটারি শাসন অনিবার্য নয় এবং তা ছাড়াই যে সিভিলিয়ান শাসনে দেশ পরিচালিত হতে পারে এমন একটি মূল্যবোধের জন্ম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ পনেরো বছর পরে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রতি একটা অঙ্গীকারের সূচনা হয়। এবং আমাদের আজকের যে অর্থনৈতিক অর্জন তার সূচনাটা হয় মূলত নব্বই দশক থেকেই।
এখন পরিসংখ্যানের প্রশ্নে আসি। আমরা যদি নব্বই সাল থেকে আন্তদেশ শুমারির একটা বিচার-বিশ্নেষণ করি, তাহলে আমরা দেখতে পাবো, যে সমস্ত খাতে অর্থনৈতিক সামাজিক সাফল্য আমাদের এসেছে- তার সূচনা নব্বই দশক থেকে হাঁটিহাঁটি করে শুরু হলেও মূলত এই সাফল্যের মূল অভিঘাত এসে পড়েছে দু’হাজার দশের দশকে। সেটা আমরা শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে বলি, গড় আয়ুস্কালের ক্ষেত্রে বলি, মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বলি, নারী শ্রমের অংশগ্রহণ হারের ক্ষেত্রে বলি, জিডিপি গ্রোথের উল্লম্ম্ফনের ক্ষেত্রে বলি, দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে বলি, জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বিস্তারের ক্ষেত্রে বলি এই সমস্ত ক্ষেত্রেই আমরা এক সময় যে দেশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেই পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে আছি। এমনকি পাশের বৃহৎ দেশ ভারত তার তুলনায় আমরা অনেক সামাজিক সূচকে এগিয়ে আছি, যার সঙ্গে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি জড়িত। এমনকি অর্থনৈতিক সূচকেও ভারতের সঙ্গে যে ব্যবধান আমাদের ছিল, ধরা যাক মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে ব্যবধান- সেটিও আমরা লক্ষণীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে পেরেছি। সেটা পিপিপি হিসেবেই বলা হোক বা সাধারণভাবে কারেন্ট ইউএস ডলারের বিচারেই বলা হোক। এমনকি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, কারেন্ট ইউএস ডলারে ভারতের মাথাপিছু আয়কেও আমরা টেক্কা দিয়েছি। এই পরিবর্তনগুলো সহসা অর্জিত হয়নি। এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে কাজ করেছে চারটি ফ্যাক্টর। একটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; যেটা দিয়ে আমি বাহাত্তর সালের কথা বলে শুরু করেছিলাম। জনগণের আকাঙ্ক্ষার এই ফ্যাক্টর আর সমস্ত ক্ষেত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। দ্বিতীয় ফ্যাক্টর কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি। উচ্চ আকাঙ্ক্ষার কারণে জনগণ আর নিজেকে প্রথাগত পেশায় আবদ্ধ রাখতে চাইছে না। সে আর মান্ধাতা আমলের কৃষিতে বিশ্বাসী নয়। সে চাইছে নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে এবং এরই ফলে আমরা দেখতে পাই যে, কৃষিখাতে একটা বিরাট প্রযুক্তিগত বিকাশ ঘটে গেছে। যে কৃষিক্ষেত্রে আগে লাঙল ছাড়া চাষ করা যেত না, সেখানে প্রায় সর্বত্রই এখন পাওয়ার টিলারের ব্যবহার। যেখানে আমরা গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না, সেখানে এখন আমরা পোলট্রি, লাইভস্টক এমনকি গো-পালন সেক্টরেও অভাবিত উন্নতি করেছি গত পাঁচ-সাত বছরে। মৎস্য উৎপাদন এবং মাথাপিছু মাছের ভোগের পরিমাণেও আমরা এগিয়ে আছি। এই সবটাই ঘটেছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে। মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে, তার বদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা না থাকলে এত দ্রুত এটা সম্ভব হতো না। এর পেছনে আরও একটা প্রাতিষ্ঠানিক কারণের উল্লেখ করতে চাই, আমাদের দেশে প্রথাগতভাবে যেটা সত্তরের দশকে ভুলভাবে ভাবা হয়েছিল যে, কৃষিতে সামন্তবাদী অবশেষ রয়ে গেছে। অথচ যেখানে সামন্তবাদী অবশেষের প্রাবল্য ভারত ও পাকিস্তানের কৃষিখাতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম। আধা সামন্তবাদের প্রাবল্য আমাদের দেশে বলতে গেলে আজ নেই। আমাদের দেশের শ্রমিক অনেক বেশি চলমান, তারা অনেক বেশি বিদেশ ও শহরমুখীন। আমাদের গ্রামের যে মান্ধাতা আমলের ক্ষমতা কাঠামো, আশি-নব্বই দশকে তাকে অতি সহজেই চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়েছে এবং এর ফলে দেখা যাচ্ছে যে বর্গা বাজারে একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। আগে যেখানে বর্গাচাষি, ভাগচাষি ছিল প্রধান প্রথা, সেখানে চলে এসেছে চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে বার্ষিক চুক্তির বদলে সিজনাল চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং এই চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের অধীনে যে জমি- সেটিতো কমেইনি, বরং ১৯৮৮ সালের ২৩ শতাংশের বদলে এখন প্রায় ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই ৫০ শতাংশের মধ্যে প্রায় অর্ধেক জমি চাষাবাদ করছেন কার্যত ভূমিহীন বর্গাচাষিরা। এটি যে কতবড় সামাজিক উত্থান এবং পরিবর্তনের নির্দেশক, তা বলে পুরোপুরি বোঝানো যাবে না। আমি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, গ্রামজীবনে একে একটি সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক অর্জন হিসেবে শনাক্ত করতে চাই।
তৃতীয় যে অর্জনটি গ্রামে হয়েছে, এবং যার প্রভাব আমরা আগামীতেও দেখতে পাবো- সেটি হচ্ছে ‘মিশ্র ধরনের’ খানার উদ্ভব। এই ধরনের খানাগুলো ঠিক কৃষিতেও পুরোপুরি নয়, অকৃষিতেও পুরোপুরি নয়। যে খানাগুলোর কিছু সদস্য কৃষিতে নিয়োজিত, কিছু সদস্য অকৃষিতে নিয়োজিত। এই খানাগুলোকে আমি মিশ্র খানা বলছি। মিশ্র খানার শতকরা হার গত এক দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এদের আরও বেশি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন এবং তার জন্য আমাদের ছোট শহরগুলোর উন্নয়ন আবশ্যক। কেননা মিশ্র খানাগুলো বাস করে গ্রামাঞ্চলে। তারা যদি অকৃষি খাতে আরও বেশি যুক্ত হয়, তাহলে সবচাইতে ভালো হয় গ্রামের বাইরে ছোট ছোট শহরে কাজ করে দিনের শেষে যাতে ঘরে ফিরে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। যেটা শ্রীলঙ্কাতে আছে। যেহেতু শ্রীলঙ্কাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক বেশি সমৃদ্ধ, তারা সকালে গিয়ে রাতে রেলে করে ঘরে ফিরে আসতে পারে। এই রকম ব্যবস্থা যদি চালু করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে আগামী এক দশকে এই মিশ্র খানার পরিমাণ আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
চতুর্থ যে বিষয়টি এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে, সেটি আমাদের নারী শ্রমশক্তির বিকাশ। আমাদের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৩৬ শতাংশ। সেটি ভারতের ৩০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। এবং পাকিস্তানের চাইতে তো অনেক বেশিই। এটি এমনকি সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই হারটিকে আরও উন্নত করা প্রয়োজন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মালয়েশিয়ার ৫৫ শতাংশ বা চীনের ৬০ শতাংশের হারে নিয়ে যেতে গেলে আমাদের আরও কসরত করতে হবে। কিন্তু যতটুকু প্রসারিত হয়েছে সেটির অর্থনৈতিক সামাজিক অভিঘাত খুবই লক্ষণীয়। সেটি কেবল সমাজের জন্যই শুভ হয়নি, যারা এই পরিবর্তনটা এনেছেন সেই নারীদের জীবনেই শুভ ফল বয়ে এনেছে। আমাদের দেশ এখন অনেকখানি এগিয়ে গেছে মূলত এই জেন্ডার ডেভেলপমেন্টের কারণে। এই অর্থে একজন সমাজবিজ্ঞানী সম্প্রতি বলেছেন যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন কি মূলত নারীনির্ভর উন্নয়ন? এই কথাটির মধ্যে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে কিন্তু এর মধ্যে সত্যতা অনেকখানি। একে আরও সবল এবং সফল করতে হবে এবং এটা হতে পেরেছে দুই-তিনটা পার্শ্ব ফ্যাক্টরের কারণে। তার মধ্যে একটা অবশ্যই রপ্তানিমুখীন শিল্পের বিকাশ-যেটিকে আমরা গার্মেন্ট শিল্প হিসেবে দেখি। যদিও এখন অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও এটি ঘটছে। এর পেছনে কিছুটা গ্রামপর্যায়ে ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধিও অবদান রেখেছে। অনেক ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা নারীর ক্ষেত্রে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সরবরাহ বেড়েছে এবং তারা নানা ধরনের উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে নিয়োজিত হতে পেরেছেন। লাইভস্টক ও পোলট্রি সেক্টরের বিকাশও এ ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। এমনকি কৃষিখাতেও অনেক নারী এগিয়ে এসেছেন। এবং এর মাধ্যমে এক ধরনের ফেমিনাইজেশন ঘটছে গ্রামাঞ্চলের কৃষি এবং অকৃষি খাতে, সেটিও লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু এটাকে আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন, বিশেষত আমি মনে করি ঢাকায় মধ্যবিত্ত নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের হার বরং একটু কম। সেইখানে আমাদের জড়তাটা কাটিয়ে ওঠা দরকার এবং এক্ষেত্রে সহায়তার দিগন্ত আরও প্রসারিত করা দরকার।
গত পঞ্চাশ বছরে অনেক বঞ্চনা নিরাশার মধ্য দিয়ে আমাদের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আমাদের কৃষি নিয়ে নৈরাশ্য ছিল; কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না, কারণ কৃষির উৎপাদন সম্পর্ক হচ্ছে আধা সামন্ততান্ত্রিক। শিল্প খাত নিয়ে নৈরাশ্য ছিল যে, বলা হতো বাঙালিরা প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যোক্তা। তারা আধুনিক শিল্প-কলকারখানা চালাতে জানে না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও নৈরাশ্য ছিল। কেননা আমাদের দেশ এমনিতেই সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের নৈরাশ্য ছিল প্রবৃদ্ধি নিয়ে, কেননা এখানে প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এর ফলে শুধু যে ফসলহানি হয় তাই নয়, কোনো আধুনিক শিল্পোদ্যোক্তাও এখানে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। বন্যায় তার ব্যবসা ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এমন অনেক নৈরাশ্যকে আমাদের দেখতে হয়েছে আমাদেরই জীবদ্দশায় গত পঞ্চাশ বছরে। এবং সত্তর-আশি-নব্বই দশকে এই নৈরাশ্যবাদগুলো ছিল খুবই প্রবল, যার চিহ্ন আমরা খুঁজে পাই তৎকালীন সমসাময়িক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাহিত্যে। এখন অবশ্য একটা উল্টো সুর বইছে। এখন আমরা সর্বত্র আশাবাদের কথা শুনছি। ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা শুনছি। এখন অনেকেই আছেন যারা ইতিবাচকতার কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়েন। তারা বলতে চান যে, সব পরিবর্তনতো ইতিবাচক হয়নি। এখনও তো অনেক পরিবর্তন বাকি এবং সেটা হওয়া সম্ভব নয়, কেননা বিভিন্ন সমস্যা আমাদের জর্জরিত করছে। এর মধ্যে সমস্যা রয়েছে সুশাসন নিয়ে, গণতন্ত্র নিয়ে, উন্নত মানের শিক্ষা নিয়ে, স্বাস্থ্যসেবার পরিধি নিয়ে, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ নিয়ে আছে এক ধরনের ব্যর্থতাবোধ। আমার কথা হচ্ছে- এই ধরনের আশা এবং নিরাশার মধ্য দিয়েই আমাদের আগামী ২০ বছর চলতে হবে। আশার দিকটিকেও আমাদের সংহত করতে হবে, নিরাশার দিকটিকেও আমাদের যথাসম্ভব উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো জাতির বিকাশ সহসা এবং অতিদ্রুত করা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের অধিবাসীদের যখন এই প্রশ্ন করা হয় যে, তারা কীভাবে উন্নয়ন করল- তখন তারা বলে, ‘আমাদের এই যে উন্নয়ন আপনারা দেখছেন, সেটা করতে গিয়ে আমাদের বাবা-মা, পিতামহ-পিতামহীদের পিঠ ভেঙে গেছে। তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এবং এই অমানুষিক খাটুনিতে তারা জীবনে আর কোনো কিছু পাননি। স্বপ্ন দেখেছেন, কষ্ট করেছেন কিন্তু বাস্তব জীবনে নিজেরা আর কোনো কিছু ভোগ করে যেতে পারেননি। তারা সব কিছু করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।’ অর্থাৎ সেখানে একটা-দুইটা প্রজন্ম এমন অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। যখন আমরা অতিদ্রুত কোনো কিছু অর্জন করতে চাই বা পারি না বলে হতাশা বোধ করি- তখন আমাদেরও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রম। এবং এই পরিশ্রম করার মানেই হচ্ছে যে, কিছু অর্জনের জন্য একটা সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিশ্রম করে যাওয়া। সেই সময়টাতো আমাদের নিজেদের দিতে হবে। তাই বলছি, আমাদের যে অস্থিরতা, আমাদের যে অসম্পূর্ণতা, আমাদের যে তীক্ষষ্ট ব্যর্থতাবোধ- সেটাকে পরিশীলিত করতে হবে ইতিহাসের মাপকাঠিতে। যে জিনিসটা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে অর্জন সম্ভব, সেটি হয়তো আপনি চাইতে পারেন বিশ-ত্রিশ বছরে। কিন্তু পাঁচ বা দশ বছরের মধ্যেই সেটা নাটকীয়ভাবে চাইতে পারেন না। আপনাকে সেই ফল পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা আর পরিশ্রম করতে হবে। আমি মনে করি যে, একটা জাতির মধ্যে সেই ধৈর্য ও স্থৈর্য থাকা প্রয়োজন। আমি আমার জীবদ্দশায় অনেক সফলতা দেখতে চেয়েছিলাম- যার কিছু কিছু দেখতে পেয়েছি। কখনও ভাবিনি নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য শাসনের অবসান হবে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সারাজীবন ধরেই দেখব দক্ষিণ অফ্রিকায় সাদা এবং কালোদের এই বিভাজন চলছে। কিন্তু সেই বিভাজন টেকেনি। আমি আমার জীবদ্দশায় কখনও ভাবিনি যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং প্রথাগত সমাজতন্ত্রের দেশগুলো এক-দুই বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ে বিলীন হয়ে যাবে। সেটাও দেখেছি। সুতরাং কিছু কিছু ভালো যা আমরা ভাবিনি কিন্তু ঘটেছে, কিছু কিছু অভাবনীয় ঘটনা যা ভাবিনি সেগুলোও ঘটেছে। আমাদের কিছু পাওয়া এবং কিছু না পাওয়াটাকে মেনে নিতে হবে। এবং অপেক্ষা করতে হবে আরও ভালো দিনের জন্য; আর তার জন্য পরিশ্রম করে যেতে হবে। সেটা আমার জীবদ্দশায় হোক বা না হোক।
লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতি
বিশ্নেষক

বাংলাদেশ ও ভারত তুলনামূলক উন্নয়ন

বাংলাদেশ এগোচ্ছে, কিন্তু ঠিক কতটা এগোচ্ছে সেটা জানার জন্য তার আগের অবস্থার সঙ্গে পরের অবস্থার তুলনা করা যেমন জরুরি, তেমনি ওই একই সময়পর্বে অন্য দেশগুলো কেমন বা কতদূর এগিয়েছে তা জানাটা সহায়ক হতে পারে। প্রসংগ সূত্রে আজকাল প্রায়ই ভারতের সঙ্গে প্রতিতুলনা চলে আসে। জনমনে সেটা অনেককাল ধরে চলছিলই, কিন্তু অর্থশাস্ত্রে এর সূত্রপাত করেন জঁ দ্রেজ। ২০০৪ সালে একটি নিবন্ধে তিনি বাংলাদেশের হঠাৎ-উত্থান প্রত্যক্ষ করে লিখেছিলেন :’বাংলাদেশ শোজ দ্য ওয়ে’। ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু বিষয়ে শিখতে পারে এই আইডিয়াটা তারই। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেন:
‘Bangladesh is no paradise to human development…It is still one of the most deprived countries in the world. However, social indicators in Bangladesh are improving quite rapidly. Whether one looks at infant mortality, or vaccination rates, or school participation, or child nutrition, or fertility rates, the message is similar: living conditions are rapidly improving not just for a privileged elite but also for the population at large.’

এর ৯ বছর পরে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে লেখা ‘এন আনসারটেইন গ্লোরি :ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কন্ট্রাডিকশনস্‌’ বইটিতে জঁ দ্রেজ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপি-সূচক, শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতি মানদণ্ডে জীবনযাত্রার মানের মধ্যে একটি পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা উত্থাপন করেন। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান দিয়ে সে বইয়ে তারা দেখান যে মাথাপিছু আয়ে ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সূচকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। মাথাপিছু জাতীয় আয়ই জীবনযাত্রার মানের একমাত্র বা প্রধান নির্দেশক নয়, একথা অমর্ত্য সেন অতীতে বহুবারই উল্লেখ করেছেন। কখনও শ্রীলঙ্কার প্রসংগ টেনেছেন, কখনও ভারতের কেরালা রাজ্যের উদাহরণ তুলে ধরেছেন। ইদানীং বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আনছেন। ২০১৩ সালের ওই বইতে দ্রেজ-সেন লিখেছেন:
‘Bangladesh has overtaken India in terms of a wide range of basic social indicators, including life expectancy, child survival, enhanced immunization rates, reduced fertility rates, and even some (not all) schooling indicators… Most social indicators now look better in Bangladesh than in India, despite Bangladesh having less than half of India’s per capita income.’

এখন এই শেষোক্ত অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। এখন অবশ্য মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় বেশ কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু সেই ব্যবধানও দ্রুত কমে আসছে। আগে (অর্থাৎ ২০১০ সালে) বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ২৮৮৩ পিপিপি ডলার (২০১৭ সালের স্থিরীকৃত মূল্যে), আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৪২৩৭ পিপিপি ডলার। অর্থাৎ ভারতের মাথাপিছু আয় ২০১০ সালে বাংলাদেশের থেকে ৪৭ শতাংশ বেশি ছিল। ২০১৯ সালে (কভিডের আগেই) অবস্থাটা কিছুটা বদলে যায়। দুই দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান (পিপিপি ডলারে) নেমে গিয়েছিল ৪১ শতাংশে। মাথাপিছু জাতীয় আয় বা জিএনআই-এর সূচকে তুলনামূলক ব্যবধান ছিল আরও কম- মাত্র ২২ শতাংশ (২০২০ সালে ভারতে মাথাপিছু জিএনআই ছিল ৬০৬০ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশে ৪৯৭৬ পিপিপি ডলার)। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, পিপিপি ডলারের মাপকাঠিতেও ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় এখন আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের তুলনায় দ্বিগুণ এগিয়ে নেই। বাংলাদেশের জাতীয় আয় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমেই ভারতের সঙ্গে তার ব্যবধান কমিয়ে এনেছে এবং আনছে। এর কারণ বোঝাও দুস্কর নয়। ২০১০-১৫ কালপর্বে বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় বা জিএনআই-র গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬-২০ পর্বে বাংলাদেশে এই প্রবৃদ্ধি হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশে, পক্ষান্তরে ভারতে তা দাঁড়ায় মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশে। অর্থাৎ ভারতে লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার, আর বাংলাদেশে লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। এর ফলে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। এটাই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা।
ক্রমশ যে বাংলাদেশ শুধু সামাজিক সূচকে নয়, মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখেও ভারতের সঙ্গে এক কদমে পা ফেলছে, তার কারণ কী? আমি তিনটি উপাদানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। প্রথমত, বাংলাদেশ ক্রমেই একটি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ন্যাশনে’ পরিণত হচ্ছে। ১৯৯০ সালে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অনুপাত ছিল ১৩ দশমিক ২ শতাংশ; সেটা বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশে। ডানি রডরিকের ভাষায় বলতে হয়, ভারতে গত তিন দশকে ‘প্রি-ম্যাচিউর ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ হয়েছে। অর্থাৎ শিল্পায়নের চাহিদা পূরণ না করেই এটি তড়িঘড়ি করে সার্ভিস সেক্টরের দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে কৃষিখাতে ‘উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি’ তুলনামূলকভাবে অধিক হারে বিরাজ করছে ভারতে বাংলাদেশের তুলনায়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে কৃষিতে মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৩৮ ভাগ নিয়োজিত ছিল; ভারতে এই হার ছিল ৪৩ শতাংশ। একই কারণে, বাংলাদেশের নগরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে বেশি ভারতের তুলনায়। ২০২০ সালে জনসংখ্যার মধ্যে নগরের অংশ শতকরা ৩৫ ভাগ, আর বাংলাদেশে ৩৮ ভাগ। অথচ ১৯৯০ সালে ভারতে নগর-জনসংখ্যার অনুপাত বাংলাদেশের চেয়ে বেশিই ছিল (যথাক্রমে ২৬ ভাগ ও ২০ ভাগ)। অর্থাৎ, গত তিন দশকে ভারত ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড হয়েছে শুধু নয়, এটি নগরায়ণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত, শ্রমের বাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় পিছিয়েই ছিল: তখন নারীদের ক্ষেত্রে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ এবং ভারতে ৩০ শতাংশ। ২০১৯ সালে পাই এর বিপরীত চিত্র। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাংলাদেশে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে, আর ভারতে বাড়ে তো নাই, বরং কমে গেছে ২১ শতাংশে। মোটা দাগে বলা যায়, বাংলাদেশে নারীর ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ বেড়েছে ভারতের তুলনায়। এর সুফল পড়েছে চারদিকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীর স্কুলগামিতার হার এতে করে উৎসাহিত হয়েছে। ভাবা যায় যে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে এই হার ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ (ভারতে তখন ৩৫ শতাংশ)? এর পরবর্তী তিন দশকে দুই দেশেই ‘ছাত্রী উপবৃত্তি’ ও ‘সর্বশিক্ষা-অভিযান’ জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু ফলাফলে এখন এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের স্কুলগামিতার হার ৭৮ শতাংশ, ভারতে যেখানে ৭৪ শতাংশ। একই কথা খাটে শিশু পুষ্টির ক্ষেত্রেও। ১৯৯০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুদের মধ্যে খর্বতার হার বাংলাদেশে ছিল ৬৩ শতাংশ আর ভারতে ৬২ শতাংশ। ২০১৯ সালে এই হার ভারতের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে কম (বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ, আর ভারতে ৩৫ শতাংশ)। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতি সংবেদনশীল আরও নানা সূচকে বাংলাদেশ প্রথম দিকে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও বর্তমানে এগিয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, তথ্য-উপাত্ত বিচার করে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ভারতের পতনশীল সূচক-প্রবণতার শুরু ২০১৪ সালের পর থেকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সামাজিক অগ্রগতি যেকোনো মানদণ্ডেই ২০১০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ ভারতের জন্য সন্তোষজনক ছিল না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে- যেমন ম্যানুফ্যাকচারিং জিডিপির অনুপাত, নগরায়ণ, বা শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় (এবং কিছুটা অপ্রত্যাশিত) অধোগমন হয়েছে। এর প্রধান কারণ মনে হয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সূত্রে নিহিত। বিগত বছরগুলোয় অবিমৃষ্যকারী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ভারতের অর্থনীতিতে (যার মধ্যে সবার আগে আসে ‘ডিমনিটাইজেশন’ বা হঠাৎ করে পাঁচশ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়ার হঠকারী সিদ্ধান্ত)। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিছু কিছু রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা বৃদ্ধিকারী পদক্ষেপে (৩৭০ ধারা বিলোপ; ‘অনুপ্রবেশকারী খেদাও’ আন্দোলন; ‘সিএএ বিল’ ঘিরে অসহিষ্ণুতা)। সামগ্রিকভাবে, ‘হিন্দুত্ব’-এর চড়া সুরের রাজনীতি অর্থনীতির জন্যে অতিপ্রয়োজনীয় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ‘সামাজিক পুঁজিতে’ অবক্ষয় ধরিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে ‘ক্ষতিকর স্থিতাবস্থা’ থেকে অর্থনীতির জন্য ‘সহায়ক স্থিতাবস্থায়’ পৌঁছানো না গেলে অর্থনৈতিক-সামাজিক সূচকে অধোগমন ঠেকানো কঠিন।
এখানে গোড়ায় একটা আপত্তি উঠতে পারে। কেউ বলতে পারেন যে ভারত এত বড় দেশ এবং তার মধ্যে এত রাজ্যের সমাহার। তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিতুলনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত। তারচেয়ে বরং বাংলাদেশের তুলনা সাজে ভিয়েতনামের সঙ্গে। সেক্ষেত্রে বলতে হয় বাংলাদেশ ভৌগোলিক মানদণ্ডে ছোট হলেও জনসংখ্যার মানদণ্ডে ছোট নয়। এটি বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। তাছাড়া, জনঘনত্বের বিচারে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘন-জনবসতির দেশ। সেদিক থেকেও দেখা দরকার যে বাংলাদেশ প্রতিকূল ঘন-জনবসতির চাপ সহ্য করেও কীভাবে অন্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে অর্থনীতির বা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রতিযোগিতায়। সেক্ষেত্রে আমাদের শুধু তুলনামূলক মাথাপিছু জাতীয় আয়ের দিকে তাকানোই যথেষ্ট নয়। দেখতে হবে অন্যান্য সামাজিক সূচকের দিকেও। ২০১১ সালের দিকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের পাল্লা ঝুঁকে ছিল অনেক সূচকে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে অবস্থা কি এখনও আছে? যদি থাকে, তাহলে এর কারণ কী?
এই সাফল্যের অংশীদার সকলেই : রাষ্ট্র, ব্যক্তি খাত, এনজিও ও মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ। জিডিপির আন্তঃকালীন ও তুলনামূলক তুলনায় যাদের আপত্তি (আপত্তিটা অবশ্য সংগত কারণেই) তাদের বলি, এই সাফল্য দৃশ্যমান নানা সূচকেই। দ্রেজ-সেন যেসব সূচকের কথা বলেছিলেন তার প্রায় প্রতিটিতেই বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় এগিয়ে আছে। ১.৯০ পিপিপি ডলারের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল ১৪ শতাংশ; ভারতে তা ছিল ২০ শতাংশ। ভারতে প্রবৃদ্ধি শুধু ২০১০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে তুলনামূলকভাবে শ্নথতর হয়েছে তা-ই নয়, এর গুণগত মান বরাবরই ছিল বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা খারাপ। যেমন, ‘গ্রোথ ভলাটাইলিটি’ বা প্রবৃদ্ধির বছর-বছর অস্থিরতা বা উঠানামার সূচকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা ছিল ভারতের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল। অস্থিরতার সূচক ২০১০ দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে ছিল ০ দশমিক ৩৫, আর ভারতে ১ দশমিক ২৩। ২০১০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এটি দু’দেশেই বেড়েছে, তবে ভারতে বেড়েছে আরও বেশি হারে। ২০১৬-২০ কালপর্বে বাংলাদেশে এই সূচক গিয়ে হয়েছে ২ দশমিক ১, আর ভারতে এই সূচক পৌঁছেছে ৫ দশমিক ৮-এ। প্রবৃদ্ধির অস্থিরতা বাড়লে সমাজ-জীবনেও অস্থিরতা বাড়ে এবং সামাজিক সূচকের অগ্রগতিও আড়ষ্ট হয়ে যায়।
তাছাড়া, এটাও লক্ষ্য করার মতো ভারতে বৈষম্যের হার আমাদের দেশের তুলনায় বেশ উঁচুতে এবং এটি বরাবরের একটি প্রবণতা। ১৯৯২ সালে ভোগ-ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিমাপের জিনি-সহগ ছিল ভারতের ক্ষেত্রে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১১ সালে ভারতের ক্ষেত্রে এই জিনি সূচকের পরিমাপ হচ্ছে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বাড়েনি। ভারতের ক্ষেত্রে কোনো তথ্য নেই। কোনো অব্যাখ্যাত কারণে ২০১১ সালের পর থেকে ভারত তার ‘দারিদ্র্য পরিস্থিতি’ রিপোর্ট করা বন্ধ রেখেছে। বৈষম্যের মাত্রা বেশি থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আবেদন কমে যায়। এর ফলে সমাজে অন্যান্য বৈষম্য (জাত-পাত, ধর্মভেদ, জাতিভেদ এ জাতীয় ‘হরাইজন্টাল ইনইকুয়ালিটি’) প্ররোচিত হয়ে থাকে। বিভেদকামী রাজনীতি ও সামাজিক শক্তির বিস্তার ঘটে। ভারতের উন্নয়ন-অভিজ্ঞতায় আমরা এর চিহ্ন খুঁজে পাই। উন্নয়নের এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশকেও অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে এবং অগ্রিম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়নের প্রতিযোগিতায়-অন্য সব প্রতিযোগিতার মতই-একবার অবতীর্ণ হলে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কয় না।
লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতি বিশ্নেষক

বাজেট, রাষ্ট্র ও নাগরিক অর্থনীতি

বাজেট নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি; আমরা আসলে বাজেট নিয়ে আলোচনা করি না। অর্থনীতি, সমাজ, গোটা রাষ্ট্রই কেমন চলছে- সবকিছু নিয়েই আমরা আমাদের নাগরিক মতামত রাখি, উদ্বিগ্ন হই; সাফল্যে-অর্জনে উদ্বেলিত হই। এ বছরের বাজেট নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তির সময়ে এ বাজেট এসেছে। করোনার বিশ্বব্যাপী অভিঘাতের দ্বিতীয় বছরের কালে এ বাজেট ঘোষিত হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের দশম ধারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন- ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করার।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতক উদযাপনের বছরে এসেছে এই বাজেট। তলাবিহীন ঝুড়ি, উন্নয়নের পরীক্ষা-ক্ষেত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ-ঝুঁকির প্রতীক, দুর্নীতির দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন ইত্যাদি অভিযোগের পর অভিযোগে আক্রান্ত ছিল একদা বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি। সেখান থেকে আমরা কয়েক বছর আগেই বেরিয়ে এসেছি। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। অতি সম্প্রতি আমাদের উত্তরণ ঘটেছে স্বল্পোন্নত এলডিসিভুক্ত গ্রুপ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মূল স্রোতধারায়। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির বিচারে আমরা বহুদিন ধরে বিশ্বের প্রথম ২০টি দেশের ভেতরে। কভিডের আগের অবস্থায় আমরা ছিলাম দশকে দশকে ক্রমাগতভাবে বেড়ে ওঠা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আমরা বেড়ে উঠেছি চার/সাড়ে চার শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার থেকে বিশ্বস্তভাবে ছয়/সাড়ে ছয়, সাত/সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারে (শেষের দিকে আট শতাংশ লক্ষ্যমাত্রাও ছুঁয়েছি আমরা)। ২০০০ সালে আমরা ছিলাম পাকিস্তানের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অনেক নিচে; এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়
পাকিস্তানের দ্বিগুণ। ২০১৬ সালে আমাদের চরম দারিদ্র্যের হার (১.৯০ পিপিপি ডলারের মানদণ্ডে) ছিল ১৫ শতাংশ; সে সময়ে ভারতের চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। আয়-প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য ছাড়াও মেয়েদের স্কুলগামিতার হার, শিশু-অপুষ্টির হার, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার প্রভৃতি সামাজিক সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ায় (শ্রীলঙ্কাকে বাদ দিলে) আমরা এগিয়ে আছি। আর আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় তো যোজন যোজন এগিয়ে। তারপরও জাতি হিসেবে প্রতি বছর বাজেট এলেই বাংলাদেশের জনসমাজ- শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আলোড়িত হয়- এটা শুধু আমাদের তর্কপ্রিয় স্বভাবকেই ইঙ্গিত করে না। দার্শনিকরা যাকে বলেছেন ‘পাবলিক রিজন’- সেই নাগরিক-বোধ আমাদের দেশে অন্য অনেক সমাজের চেয়ে অনেক বেশি প্রাগ্রসর। শানিত ও তীক্ষষ্ট। আমাদের দেখভালের দায়-দায়িত্ব সরকারের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত বোধ করি না। ‘গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে’; আমরা সেই সাহসী উদ্দাম জাতির বংশধর। নিজেদের বিষয়-আশয় আমরা নিজেরাই বুঝে নিতে প্রস্তুত। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় সরকারের সাহায্য এলে ভালো। কিন্তুযদি না-ও আসে, তাতে আমরা বসে নেই। আমরা শৃঙ্খলভাঙা দ্রাবিড় তিমিরবিনাশী জাতি। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন জনবসতির দেশ; তাও তেমন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া। কিন্তু এই স্বল্প-সম্পদ ও উচ্চ-ঝুঁকির ঘন জনবসতির দেশে বাস করেও- হয়তো বাস করি বলেই আমরা ডেসপারেটভাবে নির্ভীক, উদ্যমপরায়ণ জাতি। এ জন্যই করোনার বছরেও আমরা নুয়ে পড়ি না; আমাদের শ্রমিকদের বিদেশ থেকে পাঠানো রক্ত জল করা অর্থ সমস্ত পরিসংখ্যানগত প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়; আমাদের কৃষকরা নিত্যনতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে নতুনতর প্রযুক্তি আশ্রয় করে সৃষ্টি করে দেন কৃষি ও খাদ্য-নিরাপত্তার এক বিশাল মজবুত সামাজিক সুরক্ষার পাটাতন। আমাদের পোশাকশিল্পের তরুণ প্রজন্মের নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা করোনাকে উপেক্ষা করে হাসিমুখে টিকিয়ে রাখেন রপ্তানিমুখী উন্নয়নের ধারা। আরভিন আদিগার উপন্যাসে একটি ‘হোয়াইট টাইগার’-এর বর্ণনা ছিল। এদেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিজনকেই আমার মনে হয় একেকটি হোয়াইট টাইগার। উদ্যমী, ভ্রূক্ষেপহীন, সুযোগ সন্ধানে তৎপর, কষ্টসহিষ্ণু, আশা ও উচ্চাশায় বুক বেঁধে থাকা প্রাণ। এদেশকে পিছু টেনে রাখা অসম্ভব। এই অন্তর্নিহিত ‘সামাজিক পুঁজি’ সচরাচর বাজেট আলোচনায় ধরা পড়ে না।
২.
কভিড-১৯ বাংলাদেশকে (ও বিশ্বকে) আঘাত করার একটি বছর পেরিয়েছে। এরই মধ্যে আমরা করোনার একটি বড় ঢেউ প্রত্যক্ষ করেছি। ২০২১-২২ সালের বাজেট দেওয়ার দু’মাস আগেই আমরা করোনার আরেকটি ঢেউকে আসতে দেখেছি। এটি সহসাই আমাদের করোনায় মৃত্যুসংখ্যাকে ১০০-এর ওপরে নিয়ে গিয়েছিল; সংক্রমণের হারকেও উন্নীত করছিল ২০ শতাংশের ওপরে। সার্বিকভাবে পরবর্তী আংশিক লকডাউনের (এবং বর্ডার বন্ধ করে দেওয়ায়) কারণে করোনার মাত্রা এখন অনেক কমে এসেছে। এটা স্বস্তিদায়ক সংবাদ, যদিও নীতিনির্ধারকরা নজর রাখছেন বর্ডার এলাকার জেলাগুলোর দিকে; পাছে সেখানে করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ করোনা এখনও আমাদের দুর্ভাবনার প্রধানতম বিষয় হয়ে থাকছে। এই বাজেটেও সেটা থেকেছে। অর্থমন্ত্রী নিজেই তার বক্তৃতায় এটি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের গত ১২ বছরের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে আমরা দারিদ্র্য দূর করে ও স্বল্প-উন্নত দেশের তালিকা হতে বেরিয়ে এসে একটি উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে যাত্রা করেছি। কিন্তু জাতীয় জীবনের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে করোনাভাইরাসজনিত সংকট আমাদের অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্যান্য আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’ করোনার দ্বিতীয় বছরের মধ্যে আমরা আছি, এবং পরিস্থিতির বিচারে মনে হয় যে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। যতদিন দেশের অধিকাংশ জনগণকে আমরা টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে না পারব এবং যতদিন বিশ্বজুড়ে কভিডের ছায়া অপসৃত না হবে, ততদিনই এই অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। এটাই বাস্তবতা। এ জন্যই গত বছরের বাজেটের মতো এ বছরের বাজেটকেও আমি বলতে চাই ‘ঝুঁকি মোকাবিলা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বাজেট’। অর্থাৎ এখানে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ানো মূল লক্ষ্য না- যদি বাড়ে তো ভালোই, তবে পরিকল্পনাবিদ বা রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশামতো না বাড়লেও ক্ষতি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত জনকল্যাণের দিকে চোখ রেখে সামগ্রিকভাবে করোনার ঝুঁকি সামাল দেওয়া যাচ্ছে ও অর্থনীতির ওপরে সেই করোনার ঝুঁকির অভিঘাতকে প্রশমিত করা যাচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে, টিকাদানের ব্যবস্থা না থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে সম্মানজনক মাত্রায়- বিশ্বব্যাংকের মতে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ; এডিবির মতে ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ; সরকারি তথ্যমতে আনুমানিক ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বিপরীতে, ভারতের অর্থনীতিতে কোনো পজিটিভ প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, বরং সংকোচন (নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি) ঘটেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ বা ৫ প্রবৃদ্ধি হার যা-ই হোক না কেন, এটা অর্জিত হয়েছে তিনটি প্রধান ফ্যাক্টরের কারণে। এই তিনটি ফ্যাক্টর হলো- যথাক্রমে কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি। এই তিনটি আয়ের উৎসই গ্রামীণ দারিদ্র্য কমায় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে। এবং সেটাই ঘটেছে বাংলাদেশে। ২০২০ সালের প্রতি ত্রৈমাসিকের জন্য আমরা দারিদ্র্যের প্রাক্কলন করেছিলাম। তাতে প্রথম প্রান্তিকে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল ২০ শতাংশ। কভিডের প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা এক লাফে চলে যায় ২৯ শতাংশে। তৃতীয় প্রান্তিকে তা নেমে আসে ২৭ শতাংশে, এবং চতুর্থ প্রান্তিকে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। চারটি প্রান্তিক মিলিয়ে সারা বছরের গড় দারিদ্র্য দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ২৪ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। একইভাবে ২০২০ সালে চরম দারিদ্র্যের হার চার প্রান্তিক মিলিয়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ১৩ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কভিড আমাদের পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। ২০১৬ এবং ২০২০-এর মধ্যে দারিদ্র্য-পরিস্থিতিতে কোনো সামগ্রিক অগ্রগতি হয়নি। বরং চরম দারিদ্র্য কিছুটা বেড়েছে।
আমাদের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই যে পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে যাওয়া- এটি হচ্ছে কর্কশ বাস্তবতা। এর ফলে অন্য সব লক্ষ্যমাত্রা থেকেও আমরা পিছিয়ে পড়ব। কভিডের আগে যেভাবে উন্নয়নের ধারা চলছিল, তাতে ২০৩০ সালের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-১ (জিরো পভার্টি) অর্জন করা কঠিন ছিল না আমাদের। আগামী ১০ বছর গড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন করলেই তা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন তা এত সহজ হবে না। যদি আগামী ১০ বছর গড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করি (এ বছরের বাজেটে যেটা ধরা হয়েছে) তাহলেও ২০৩০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে যাবে। একই কথা খাটে অন্যান্য নন-ইনকাম সূচক তথা শিশুপুষ্টি ও মাতৃপুষ্টির ক্ষেত্রেও। তাহলে এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে? প্রথমত, শুধু প্রবৃদ্ধির সড়কের ওপরে নির্ভর না করে সরাসরি আঘাত হানতে হবে, যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন ডাইরেক্ট ইনকাম ট্রান্সফার। এটা হতে পারে প্রত্যক্ষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অথবা ঋণ ও অন্যান্য প্রণোদনার মাধ্যমে স্ব-নিয়োজিত কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করে। এতে হয়তো বাজেট-ঘাটতি জিডিপির স্বাভাবিক ৪-৫ শতাংশের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। যেমনটা হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে বা প্রস্তাবিত হচ্ছে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের ক্ষেত্রে। এই দুটো বছরেই বাজেট ঘাটতি থাকছে জিডিপির ৬ শতাংশের কিছুটা ওপরে। কিন্তু এই বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বেয়াড়া রকমের বেশি নয়। ভারতের ক্ষেত্রে সংকটের বছরে এই ঘাটতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের প্রধান স্বয়ং বলেছেন, এই ঘাটতি সংকট মোকাবিলায় এমনকি ১০ শতাংশ হলেও দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। দেখা যাচ্ছে, মনিটারিস্ট আর কেইনসীয়দের মধ্যে যুদ্ধে আপাতত কেইনসীয়দের পক্ষেই পাল্লা ভারি। সেটা খোদ বিশ্বজুড়েই। আশার কথা, আমরা বহুকাল পরে সাহস করে ওয়াশিংটন কনসেন্সাস থেকে বেরিয়ে ঘাটতি অর্থায়নের কথা বলতে পারছি এবং স্বয়ং অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় এটি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, শুধু ঘাটতি-অর্থায়ন করাই যথেষ্ট নয়। অর্থের সদ্ব্যবহারও করা চাই। এ ব্যাপারে সবাই কম-বেশি একমত- মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত অর্থ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে খামতি আছে। কভিডের বছরে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যয় সক্ষমতার অভাব চোখে পড়ার মতো। সবাই চাচ্ছে, এই কভিডের সুবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য দপ্তর ও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত বাস্তবিকই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মতো পারঙ্গম জনস্বাস্থ্য খাত হয়ে উঠুক। এই একটি বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোযোগ জনগণ আশা করে। এই খাতকে শক্তিশালী করার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টরের স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করা প্রয়োজন। এনজিওগুলোরও মাস্ক ইত্যাদি কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
৩.
আসলে অনেকেই চাইছেন করোনাকে উপলক্ষ করে পুরো অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক সিস্টেমকেই সংস্কার করতে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক অর্থে এরা পুঁজিবাদের মধ্যে দুটি ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রথমটি রক্ষণশীল পুঁজিবাদের ধারা, দ্বিতীয়টি প্রগতিশীল পুঁজিবাদের ধারা। একাংশ চাইছেন পুরোনো ধারাই অব্যাহত রাখতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, নিকট অতীতের ধারা অনুসরণ করে যেহেতু ভালো অর্জন করা গেছে- মধ্যম আয়ের স্তরে প্রবেশ করা গেছে, দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বেগবান হয়েছে, অবকাঠামোর চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে- সেহেতু এই স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনার দরকার কী? এরা প্রবৃদ্ধির মূল কাঠামোটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে কভিডের বছরে কিছু নতুন উপাদান সংযোজন করতে চান। যেমন, স্টিমুলাস কর্মসূচি, অতিদরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও রিলিফ কর্মসূচি ইত্যাদি। স্বাস্থ্য খাতেও এরা ‘সংস্কার’ চান, তবে সেটা ‘যুগান্তকারী’ কিছু নয়। দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেলে যেমন সংস্কার করতে হয় সেরকমই কিছু করতে অভিলাষী তারা।
দ্বিতীয় ধারার নীতি-আলোচকরা করোনার সংকটকে সিস্টেম পরিবর্তন করার একটা ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন। তারা চান গতিশীল নেতৃত্বে জনস্বাস্থ্য খাতকে ওয়েলফেয়ার স্টেট মডেলে ঢেলে সাজাতে, নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র করতে কম্যুনিটি হেলথ ক্লিনিকের কায়দায়। প্রতিটি জেলা শহরে ভালো করোনা চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে এবং পর্যাপ্ত টেস্টের ব্যবস্থা করতে। ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনিশিয়ানেরও যথেষ্ট সরবরাহ বাড়াতে। বেসরকারি খাতকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কাজে আরও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে। অনিশ্চয়তার কভিডের ওপরে দেশে গবেষণাচর্চাকে উৎসাহিত করতে। দেশের ভেতরেই করোনার টিকা উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য যাবতীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে। প্রণোদনা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে এরা বৈষম্য, দুর্নীতি ও বঞ্চনা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ। এদের কথাটাও অর্থমন্ত্রীর শোনা দরকার। আমরা শুধু ‘ওয়েলফেয়ার’ বিতরণ করতে চাই না; উন্নত দেশের মতো ওয়েলফেয়ার স্টেটও হতে চাই।

অর্থনীতিবিদ, মহাপরিচালক, বিআইডিএস

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫১

পূর্বে প্রকাশিতের পর

৬. নিম্নবর্গের প্রতিক্রিয়া

স্থানীয় জনগণের মধ্যে জনস্বাস্থ্য- কার্যক্রমের কার্যত অনুপস্থিতির ফল হয়েছিল মারাত্মক। তাদের বড় একটি অংশ ঝুঁকে পড়েছিল বিভিন্ন রোগের দেবদেবীর (দেবীরই প্রাবল্য সে তালিকায় অবশ্য বেশি) সাধনায়, আর ক্ষুদ্র একটি অংশ রমেশ বা জগমোহনের মতো নিয়োজিত ছিল আত্মশক্তি-অনুপ্রাণিত স্বনির্ভর স্বাস্থ্য কার্যক্রমে। এদের একটি ধারা ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদকে’ প্রতিহত করতে চেয়েছে অনেকটা ভাবাদর্শগত বা রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত হয়েই। এ প্রসঙ্গে ১৯৩০-র দশকে প্রকাশিত ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ উল্লেখ করা যেতে পারে।

সাধারণ পঞ্জিকার তুলনায় এই ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ পার্থক্য ছিল এই যে, এখানে শুধু গ্রহ-তিথির আসা-যাওয়ার সংবাদই থাকত না, স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শও দেওয়া হতো। গীতার সদুপদেশ কে-ই বা শুনে বা মনে রাখে, কেননা তার বক্তব্য বেশ জটিল। পঞ্জিকাকে যদি ‘স্বাস্থ্য-গীতা’ করে তোলা যায়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শ বৃহত্তর (শিক্ষিত) জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সেসব স্বাস্থ্য-পরামর্শের মধ্যে দুটি ধারা ছিল। একটি হচ্ছে, বিদেশি বিশেষত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচনা; অপরটি হচ্ছে দেশীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রশংসা। বিদেশি চিকিৎসার পদ্ধতি এ দেশে অচল, কেননা বিদেশি জীবনচর্চার ধরন এ দেশের জল-হাওয়ার সাথে মিলবে না। এ দেশের মানুষের শরীরের উন্নতির জন্য চাই এর সংস্কৃতি-ধর্ম-পরিবেশের উপযোগী স্বাস্থ্য-জ্ঞান। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সমর্থকরা যেভাবে টীকা দিয়ে বা সুঁই ফুটিয়ে রোগ নিরাময় করতে চাচ্ছে, এটা আপামর জনগণের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাদের রক্ষা করার জন্য আছে এ দেশেরই শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র। এই অভিমত স্পষ্টতই ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের তত্ত্বকে এরা সন্দেহের চোখে দেখেছেন- প্রায় ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’ বলে ভেবেছেন- এক প্রকার ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার ও বায়ো-পাওয়ার ধারণার থেকে এই প্রতিরোধের ডিসকোর্স একেবারেই আলাদা। একে নিছক আধুনিকতার’ সাথে ‘প্রাক্‌-আধুনিকতার’ দ্বন্দ্ব, বা ‘প্রগতিপন্থা’ আর ‘রক্ষণশীলতার’ মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল করা হবে। এই দ্বন্দ্ব তৈরিই হতো না, বা হলেও এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না, যদি উনিশ-বিশ শতকে এ দেশের মহামারি বা মারির উদ্ভব মোকাবিলায় ইংরেজ সরকার প্রকৃত অর্থেই জনগণের স্বাস্থ্য-পরিস্থিতি বা জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হতেন।

এ ক্ষেত্রে আমি মো. উমর মুশতাকের ‘পাবলিক হেলথ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া : এ ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব দ্য হিস্টরি অন মেডিকেল স্টাডিসেস অ্যান্ড ডিজিজ প্রিভেনশন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধটির সাহায্য নিয়েছি। সবিস্তারে বলি। সিপাহি বিদ্রোহের পরে ১৮৬৮ সালে বাংলায় একটি পৃথক ‘সিভিল মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’ গঠিত হয় এবং ১৮৬৯ সালে একটি ‘পাবলিক হেলথ কমিশনার’-এর পদ সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই বিভাগ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। কেবলমাত্র ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সাংবিধানিক সংস্কারের পরেই সুস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং জন্ম-মৃত্যু সংক্রান্ত ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ বিভাগের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৮০ সালে পৌরসভা এলাকায় এবং ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বাসরত সকল শিশুদের জন্য টীকাদান বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এর প্রয়োগ সীমিত ছিল মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮০-৮১ সালে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে টীকাদানের হার ছিল মাত্র ২.৭ শতাংশ; ১৯০২-০৩ সালে তা সামান্য বেড়ে ৩.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ, উপনিবেশের গ্রামাঞ্চল এই টীকা কার্যক্রমের বাইরে ছিল। অথচ কিছুদিন পর পর মহামারির মুখোমুখি হতে হয়েছে উপনিবেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে। যেমন, প্লেগ হয়েছে ১৮১২ সালে গুজরাটে ও সিন্ধু প্রদেশে (প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছিল এর তাণ্ডবলীলা); হয়েছে ১৮২৮-২৯ সালে পাঞ্জাবে; ১৮৩৬ সালে রাজপুতানায়; ১৮৯৬ সাল থেকে ব্যুবনিক প্লেগ প্রথমে মারাত্মক আকার ধারণ করে বোম্বাই, পুনে, কলকাতা ও করাচির মতো বড় বড় শহরে এবং পরে সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে যায়। এক হিসাবে, ১৯০৩ সাল পর্যন্ত প্লেগের কারণে মারা যায় প্রায় ২০ লাখ লোক। এবার আসি কলেরার প্রসঙ্গে। ১৮১৭-২১ সালজুড়ে মহামারি হিসেবে কলেরা বাংলা থেকে শুরু হয়ে এক সময় সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর জন্য দায়ী করা হয় ট্রপিক্যাল দেশের জন-হাওয়াকে এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে দলবেঁধে মেলা উদযাপন, ধর্মীয় উৎসব পালন, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি ‘সাংস্কৃতিক উপাদানকে’। ১৮৬৮ সালে এসে কলেরা মহামারির কারণ খতিয়ে দেখতে সর্বপ্রথম ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি করে

ঔপনিবেশিক সরকার। কলেরা রোধে বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং পয়নিস্কাশন ব্যবস্থার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা এ নিয়েও কমিটির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৮৬২ সাল থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে, পাঞ্জাবে, বাংলায় কলেরা প্রায় প্রতি বছরই দেখা দিয়েছিল। একই কথা খাটে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে। তবে এ ক্ষেত্রে ১৮৮১ সালের পর থেকে কিছুটা ‘ব্রেক-থ্রু’ হয়। সেটা ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসেসের অধীনে সদ্য যোগ দেওয়া সার্জেন্ট মেজর রোনাল্ড রসের গবেষণার কারণে। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় এনোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট ছড়ানোর চক্র তিনি আবিস্কার করেছিলেন (এর জন্য ১৯০২ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান)। কুইনাইনের বড়ি চালু হওয়ার পরও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ চলতেই থাকে। তার একটি বড় কারণ হলো মশার বিস্তার রোধে ব্যর্থতা এবং ‘ড্রেইনেজ সিস্টেমের’ শোচনীয় পরিস্থিতি। এত সাতকাহন সবিস্তারে উল্লেখ করার কারণ হলো, উনিশ-বিশ শতকে (স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত) কি জনস্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে, কি বিভিন্ন মহামারির বিস্তাররোধে তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়নি উপনিবেশের পটভূমিতে। ঔপনিবেশিক সরকারের কাছ থেকে দমন-পীড়ন-লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা কেবল পেয়েছে এ দেশের জনগণ, কোনো ‘বায়ো-পাওয়ার’-এর অভিজ্ঞতা মেলেনি তাদের। সন্দেহ কী, স্থানীয় জনগণের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসা-পদ্ধতি ও পাশ্চাত্যের প্রচার করা ‘জনস্বাস্থ্যের’ ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিরূপ ও প্রতিরোধী মনোভাব এখানে গড়ে উঠবে। সেকালের পঞ্জিকা ঘাটলে এ রকম প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তকে শনাক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের ‘পাঁজিতে স্বাস্থ্যচর্চা’ প্রবন্ধের ওপরে (গৌতম ভদ্র সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত) আমি নির্ভর করেছি।

মহামারির মুখে পড়ে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জয়গান গাওয়া হয়েছে এভাবে :

‘যুগে যুগে সামাজিক রাষ্ট্রীয় আকার,

কিছু কিছু রূপান্তর হয় বটে তার।

অবিকৃত কিন্তু স্বাস্থ্য-বিধি সনাতন;

হাসিমুখে বলিয়াছি সে সব বচন,

চরক, সুশ্রুত, অত্রী, হায়ীত, নারদ,

মনু, পরাশর আদি লিখেছে বিশদ,

আয়ু রক্ষণের কত মহামূল্য কথা!

ঘটে দুঃখ সে সবার করিলে অন্যথা।’

যেটা বিস্ময়কর, মহামারির কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে সনাতন ধর্মের পতন এবং ক্রমবর্ধমান অনৈতিকতাকে। অবশ্য পাশাপাশি পাশ্চাত্যের জীবাণু তত্ত্বেরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অগ্রাধিকার স্বীকার করেই। ধর্মের পতন এবং নৈতিকতার স্খলন যে-স্বাস্থ্যহানির জন্য দায়ী তাতে স্বাস্থ্য-গীতার লেখকদের মনে কোনো সন্দেহ নেই:

‘বিরুদ্ধ ভোজন আর অহিত ভোজন,

অসাধু আলাপ, বৃথা কালের যাপন;

পুস্করিণীতে শৌচত্যাগ, ঘরে থুথু ফেলা,

বাসিমুখে পানাহার, নিদ্রা সন্ধ্যা বেলা,

অবৈধ সঙ্গম আদি বদভ্যাস হয়;-

জানিবে শাস্ত্রীয় বাক্য মিথ্যা ইহা নয়।’

পাশ্চাত্যের জীবাণু-তত্ত্বের সাথে মেশানো হয়েছে প্রাচ্যের আয়ুর্বেদশাস্ত্র। এসেছে মহামারি প্রতিরোধের প্রসঙ্গ :

‘এইবার বলি কিছু জীবাণু-জীবন;

বিবিধ রোগের যারা প্রধান কারণ।

আয়ুর্বেদে ইহাদেরই সূক্ষ্ণ কৃমি নাম,

এদেরই মারণ-মন্ত্র দেছে যজু: সাম।

যত কিছু সংক্রামক প্রাণহারী ব্যাধি,

এই সূক্ষ্ণ জীবদান সে সবার আদি।

বিসূচিকা, ক্ষয়কাস, ম্যালেরিয়া আর,

দাঁতের গোড়ার রোগ, ধনুষ্টংকার,

তালু-ক্ষত, বাতশ্নেষ্ফ্মা, আর কালাজ্বর,

আমাশয় আদি জন্মে জীবাণু-ভিতর।

চর্ম্মচক্ষে ইহাদের দেখা নাহি যায়;

নিতে হয় অণুবীক্ষ্য-যন্ত্রের সহায়।’

দেখা যাচ্ছে, ১৯২৬ সালের এই পঞ্জিকাটিতে যে ধরনের ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’ প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে যেমন আছে সনাতনী রক্ষণশীলতা, তেমনি আছে আধুনিক বিজ্ঞানকে স্বীকার করার দৃষ্টিভঙ্গি। আয়ুর্বেদ এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মধ্যে একটা সংশ্নেষণ করে ভারতীয় ধারার একটা আধুনিকতা সৃষ্টিরও চেষ্টা পাই এতে। এই ‘স্বাস্থ্যধর্ম গৃহ পঞ্জিকা’ বের করেছিলেন কার্তিক চন্দ্র বসু- তিনি নিজে পাশ্চাত্য ডাক্তারি বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন এবং ১৮৯৯ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সুবিখ্যাত বেঙ্গল কেমিক্যালসে যোগ দেন। একপর্যায়ে রোগ নিরূপণ ও ভেষজ ওষুধ তৈরি করার জন্য নিজেই শুরু করেন ‘বোসেজ ল্যাবরেটরি।’ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে ভেষজ তত্ত্বের মিল ঘটিয়ে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এভাবেই মহামারি স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছিল।

তবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদের সাথে শহরের এবং গ্রামের নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। প্রতিদিনের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামের মধ্যে যখন তারা মারি বা মহামারিতে আক্রান্ত হতেন, তখন তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল দূরের ঈশ্বর যাকে তারা নানা দেব-দেবীর বিগ্রহ মূর্তিতে পূজা করত। এই ঐতিহ্য পুরাকাল থেকেই চলে আসছে। কুশান যুগে যক্ষ-দেবী হারিতি (ঐধৎরঃর)-এর পূজা করা হতো – ইনি তুষ্ট থাকলে সকল আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করতেন। এর মধ্যে ছিল গুটি-বসন্ত, উচ্চহারে শিশু-মৃত্যু, জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃ-মৃত্যু প্রভৃতি। কথিত আছে, পরে তিনি বুদ্ধদেবের শিষ্যা হয়ে বৌদ্ধ দেবী হয়ে ওঠেন। কনিস্ক সাম্রাজ্যে গুটি-বসন্তের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন বৌদ্ধ -স্তুপার ভেতরে হারিতিকে উৎসর্গ করা বিগ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়। হারিতি দেবীর ক্ষমতা ছিল জ্বরের উচ্চমাত্রাকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার- এর ফলে যে কোন জ্বরকে শীতল করার দেবী হিসেবেও তাকে দেখা হয়। পরবর্তীতে এই হারিতি দেবীই বাংলায় এসে হয়ে ওঠেন লোক-দেবী শীতলা-নামের ভেতরেই তার ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে। ‘শীতল করে দিতে পারেন’ সব জ্বরকে, এবং এভাবেই তিনি সারিয়ে তোলেন জ্বরের রোগীকে। শুধু গুটিবসন্ত নয়, সকল জ্বরের উপশমের দেবী হচ্ছেন এই শীতলা দেবী। অন্ত্যজ শ্রেণীর নাপিত, মুচি, কামার, কুমোর, চর্মকার প্রভৃতি পেশাবর্গের মধ্যে (সাধারণভাবে দক্ষিণবঙ্গের কৃষক শ্রেণীর ভেতরে) শীতলা দেবীকে জাগ্রত দেবী হিসেবে সাড়ম্বরে পূজা করা হয়ে থাকে এখনো। লোক-কল্পনায় কোন অজ্ঞাত কারণে শীতলা দেবীর বাহন হচ্ছে গাধা-হয়তো ভারবাহী প্রাণীকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়েছে বাহন রূপে। গুটিবসন্ত ও হামের দেবী যেমন শীতলা, তেমনি কলেরার দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ওলাই চন্ডী (হিন্দুদের মধ্যে) এবং ওলা বিবি (মুসলমানদের মধ্যে)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক রালফ নিকোলাস মনে করেন যে, বাংলায় লোক-দেবী হিসেবে মনসা ও শীতলা উভয় দেবীরই পূজা বলেও শীতলাই খানিকটা এগিয়ে আছেন। অন্য কিছু চর্চায়, সর্পদেবী মনসা ও ষষ্ঠীর সাথে শীতলা দেবীকে অভিন্ত জ্ঞান করা হয়েছে। বোম্বাইয়ের পূর্ব-কথিত ১৮৯৯ সালের প্লেগের সময়ে এক ‘প্লেগমাতার’ আবির্ভাব হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘বোম্বাই কি মায়ান’, কিন্তু তার পূজা হতো শীতলা মন্দিরে। এ নিয়ে ও.ঔ.ঈধঃধহধপয তার ‘ প্লেগ এন্ড দ্যা ইন্ডিয়ান ভিলেজ : ১৮১৬-১৯১৪’ প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তবে শীতলা দেবীর নাম প্রদেশ-ভেদে ভিন্ন হতে পারে। তামিলনাড়ূতে বসন্ত রোগের দেবীর নাম মারি আম্মা, দক্ষিণ আরকটে তার নাম কান্নি আম্মা। নাম যা-ই হোক, এই সকল লোকদেবীর পূজা-অর্চনার উদ্দেশ্য একটাই- জনস্বাস্থ্য- সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মহামারি থেকে রক্ষা করা।

[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫০
পূর্বে প্রকাশিতের পর
ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো- ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে… ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা। অন্য সবকিছুরই স্থান তার নীচে।’ এভাবেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শহরে ক্যান্টনমেন্ট, সিভিল লাইন, হিল স্টেশন, সামার রিসোর্ট ইত্যাদি। এক কথায়, প্রথম প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর হলো, ঔপনিবেশিক আমলের জনস্বাস্থ্য নীতি ছিল বৈষম্যমূলক এবং সেখানে জনগণের কোনো স্থান ছিল না। এটি ছিল মূলত এলিটদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য নীতি। জনগণ পেত তার নিজস্ব বিশ্বাসে-চর্চায় ঘেরা এক সংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাৎপদ স্বাস্থ্য খাত, আর এলিটরা পেত সেকালের মানদণ্ডে আধুনিক ও উন্নততর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা।
এই দ্বৈত খাতবিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য চিন্তা উপনিবেশ-উত্তর আধুনিক রাষ্ট্রেও পরিলক্ষিত হয়। এ দেশে তাই দেখতে পাচ্ছি যে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা’ গড়ে ওঠেনি, যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই নূ্যনতম এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাবেন নির্ভরযোগ্যভাবে। কেন গড়ে ওঠেনি তার একটা কারণ বোধ করি এই যে, এলিটরা ভেবেছিলেন তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য ‘জনস্বাস্থ্য’ জাতীয় কোনো ব্যবস্থার আদৌ দরকার নেই। সে রকম বিপদ এলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা লাভ করা যাবে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর তো এমন কিছু দূরত্বে অবস্থান করছে না! কিন্তু এখন করোনাকালের লকডাউনের কারণে তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ। এখন বুঝি তারা বুঝতে পারছে, আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশের ভেতরেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বর্তমানের মহামারি-সংকট তো নয়ই, ভবিষ্যতের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিও মোকাবিলা করা যাবে না। কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে আদৌ আশাবাদী নই। বিল গেটসের মতো আমিও মনে করি, পরিবর্তন আসে তবেই যদি মনে থাকে। কিন্তু মানুষের স্মৃতি খুবই স্বল্পায়ু।
৫. মহামারির প্রভাব : রাষ্ট্রে-দর্শনে
প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারির প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়েছে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে। এই প্রভাব যেমন পড়েছে সমাজে-রাষ্ট্রে, তেমনি সাহিত্যে-দর্শনে। সামগ্রিকভাবে মানবজীবনের ইতিহাসে। অতীত আলোচনার একটি তাৎপর্য ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনার ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তার সুবিখ্যাত ‘রেকুইম ফর এ নান’ উপন্যাসের একটি উক্তি অনেকটা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে- The past is never dead. It’s not even past| এবার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু ব্যক্তি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করেছিলেন এ কথা জানতে চেয়ে, কেন তাদের রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে বাধ্য করছে? স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে তাদের কি মুক্ত থাকার অধিকার নেই? এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফিরে যেতে হলো অতীতে- ১৮৯৭ সালের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্যাক্ট’কে সাক্ষী মানতে হলো। মমতা বললেন, ‘যাতে কেউই আরোগ্য লাভ না করে কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যেতে না পারে- জনগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে- [১৮৯৭ সালের] আইন পুনরুজ্জীবিত করা হলো।’
অতীত যদিও নবায়িত হয়ে ফিরে আসে পুনরায়, অবস্থাভেদে তার প্রত্যাবর্তনের ‘ইমপ্যাক্ট’ হয় বিভিন্ন রকম। মহামারির অভিঘাত বিভিন্ন সমাজে ও কালে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে এসেছে। মহামারি প্রতিরোধে ইউরোপের চিন্তার বিবর্তন উঠে এসেছে মিশেল ফুকোর লেখায়। লন্ডনের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ’ (যা ছিল ব্যুবনিক প্লেগ)-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে লন্ডন শহরে ১৬৬৫ সালে। এতে শহরটির ১৫ শতাংশ নাগরিকই মৃত্যুবরণ করেন। এই প্লেগে আরও অনেক বেশি লোকের মৃত্যু হতে পারত, কিন্তু অধিকাংশ লোকই যে যেভাবে পারে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। স্বয়ং রাজা (দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্ব তখন) তার সভাসদসহ অক্সফোর্ডে পালিয়ে যান। আজকে যেখানে অলগেট (Aldgate)- যেখানে এখন অধিকাংশ বাঙালি ও অভিবাসী বাস করেন- সেই এলাকাটিকে প্লেগে নিহতদের গণকবর দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন। এ রকমই আরেকটি গণকবর ক্ষেত্র ছিল ফিনস্‌বিউরি ফিল্ডস্‌। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল জনতার প্রতিক্রিয়া। যে বাড়িতে কোনো প্লেগের রোগী পাওয়া যেত সেই বাড়িকে বাইরের থেকে সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হতো। এতে করে ওই খানার অন্যান্য সদস্যেরও মৃত্যু হতো- প্লেগে অথবা অনাহারে! ঠিক পরের বছরে (১৬৬৬ সালে) লন্ডনে অগ্নিকাণ্ডে তার পুরো কেন্দ্রস্থলই ভস্মীভূত হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, এই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল প্লেগবাহী ইঁদুরেরা। এই প্লেগ হওয়ার প্রায় ৬০ বছর পরে রবিনসন ক্রুসোর লেখক ড্যানিয়েল ড্যাফো লেখেন ‘এ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’। ড্যাফো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, কিন্তু এমনভাবে লিখেছেন বিবরণী যেন তিনি ঘটনা-পরম্পরার সামনেই অবস্থান করেছিলেন।
১৩৪৬-৪৮ সালের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ আর ১৬৬৫ সালের ‘গ্রেট প্লেগ’ দুটিই ছিল প্লেগের মহামারি। এই অভিজ্ঞতা থেকে দুটো সুস্পষ্ট প্রবণতা বেরিয়ে আসে, যা রাষ্ট্রকে স্বৈরাচারী ক্ষমতা-প্রয়োগের পরিবর্তে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’ (Disciplinary Power)  বা জনজীবনে নিয়ম-শৃঙ্খলা আচরণভিত্তিক ক্ষমতা-প্রয়োগের দিকে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন আসত না যদি-না প্লেগের মতো মহামারি হতো। এই মহামারির সুবাদে রাষ্ট্র বাধ্য করে নাগরিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলতে। নাগরিকদের সমন্ত জীবনচর্চা তখন থেকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ মডেলে আবর্তিত হতে থাকে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে বশীভূত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যস্ততায়। উদ্ভাবিত হয় জবরদস্তিমূলক কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি ‘স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন থাকার’ (বা সেলফ আইসোলেশন) অভ্যাস। করোনারকালেও এখন আমরা এদেশে বা বিশ্বজুড়েই ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের প্রয়োগ দেখছি। বিদেশফেরত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবর্গ বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বলেছেন যে তাদেরকে এয়ারপোর্টে ‘১৪ দিনের’ সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে এবং সেটি তারা এখন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। করোনার মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রেরও একটি নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর বলয়। প্রতিদিন রোগতত্ত্ব বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য-বুলেটিন পড়ে শোনাচ্ছে টিভিতে এবং নাগরিকরা তা শুনে তাদের প্রাত্যহিকের জীবনযাপনে স্বাস্থবিধি মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন- অন্তত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায়। কোয়ারেন্টাইন বা সেলফ্‌ কোয়ারেন্টাইনে থাকছে সংক্রমিত খানাসমূহ (ব্যক্তি বা পরিবার), কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সমগ্র পাড়া বা গোটা এলাকাই। এভাবেই শৃঙ্খলাবদ্ধ নাগরিকে পরিণত হচ্ছি আমরা- হয়তো ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, কোরিয়া, চীন বা সিঙ্গাপুরের মতো অতটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নই এখনও- কিন্তু গতিমুখটা সেদিকেই। একটা চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞানকে অবলম্বন করে এই ক্ষমতার প্রয়োগ করছে রাষ্ট্র। এটি খারাপ না ভালো- সে বিবেচনায় ফুকো যাননি। তিনি শুধু দেখিয়েছেন কীভাবে ডেসপট বা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে শাসন করার পরিবর্তে অন্য ধরনের বিশেষায়িত ‘ক্ষমতারও’ উদ্ভব হয় এবং রাষ্ট্র তার প্রজাকুলের ওপরে প্রভুত্ব করার জন্য একটি বাড়তি হাতিয়ার পেয়ে যায়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে প্লেগ নামক মহামারি প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের প্রচলিত দমনমূলক যন্ত্রগুলোর পাশাপাশি এই অদৃষ্টপূর্ব শৃঙ্খলাপরায়ণ অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজের উদ্ভব হয়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দীপেশ চক্রবর্তী ও অন্যদের সূত্র ধরে উপনিবেশিক পটভূমিতে মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে আমরা ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এরই প্রয়োগ দেখেছি। যার ভিত্তি ছিল কোয়ারেন্টাইন মডেল এবং শ্বেতাঙ্গদের জন্য ‘বিচ্ছিন্ন থাকার’ ক্যান্টনমেন্ট মডেল- যা নেটিভদের কাছ থেকে উপনিবেশের অফিসার-সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
তবে ১৮২৬-৩৭ সালের একের পর এক বিধ্বংসী কলেরা মহামারি প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খোদ ইংল্যান্ডেই এই কোয়ারেন্টাইন ও সেলফ আইসোলেশনভিত্তিক ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর মডেল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই মহামারিকে ‘এশিয়াটিক কলেরা প্যানডেমিক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় যেহেতু এটার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বঙ্গদেশে। বাংলায় এই মহামারির শুরু ১৮১৭-২৪ কালপর্বে; ধীরে ধীরে তা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগের জন্য হয়তো কার্যকর ছিল, কিন্তু কলেরা কোয়ারেন্টাইন মানে না। এর জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আরও সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির। ঠিক এ রকম সন্ধিক্ষণে জন্ম নিল আরেক অদৃষ্টপূর্ব অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজ- যার ভিত্তি হলো ‘বায়ো-পাওয়ার’  (Bio-Power)। এর মানে এই নয় যে আগের শৃঙ্খলাপরায়ণতাভিত্তিক ক্ষমতার প্রয়োগ বা ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার রাষ্ট্র-ক্ষমতার বলয় থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষা না করে আর কাজ চালানো যাচ্ছিল না। কলেরা, বসন্ত, হাম, যক্ষ্ণা প্রভৃতি রোগের ঘন ঘন প্রাদুর্ভাব রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল Bio-Power-র কথা ভাবতে। ১৮৩০-র দশকে চার্টিস্টদের আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল শ্রমিকদের বাসস্থানের সমস্যা- তাদের জীবনযাপনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা ছিল কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারির প্রজনন ক্ষেত্র। শ্রমিকদের অমানবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে তরুণ মার্কস লিখেছেন সে সময়ে ‘দ্য হাউসিং প্রবলেমস্‌’, আর তরুণ অ্যাংগেলস্‌ লিখেছেন ‘কন্ডিশনস্‌ অব ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’। এক কথায়,  Disciplinary Power স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে তার একচ্ছত্র হেজিমনি হারাল নতুন পরিস্থিতিতে। তবে এর প্রয়োগ যথারীতি চলতে থাকল জীবনযাত্রার অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত কল-কারখানায়, জেলখানায় এবং বিদ্যানিকেতনে (ফুকো সে সম্পর্কে আলাদা করে লিখেছেন তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে)।
১৮৯৭ সালের ঔপনিবেশিক ভারতের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্য্যাক্ট’ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারকে তুলে ধরেছে। প্লেগে সংক্রমিত হলে সরকারি পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে বেঁধে হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়েছে সেখানে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রায় পুরোটাজুড়েই এই জোর করে ‘বিচ্ছিন্ন রাখার’ নীতিই কার্যকর ছিল। আমরা আগেই দেখেছি, প্রকৃত অর্থে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি, বা উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতির বহুল প্রসার করার দিকে অগ্রসর হয়নি উপনিবেশের সরকার। সেটা হলে আমরা ঔপনিবেশিক বায়ো-পাওয়ারকে বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখতে পেতাম। ১৮৯৭ সালের এপিডেমিক ডিজিসেস অ্যাক্ট যখন প্রণীত হচ্ছে, তার পরের বছরেই কলকাতায় প্লেগের আক্রমণ হবে, আর ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে লেগে যাবে প্লেগ নিয়ে দাঙ্গা। অর্থাৎ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের ‘ডিসিপ্লিন’ উপনিবেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করা যায়নি। ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২) গ্রন্থে ভূদেব এ নিয়ে ইতিপূর্বেই কড়া অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, ভারতবর্ষে ৬০ বছর ও তার ওপরে বয়স্ক লোকের সংখ্যা (১৮৮১ সালের আদমশুমাুরি অনুযায়ী) মাত্র ৪ শতাংশ। এর কারণ, এখানে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি, এবং অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে দুর্ভিক্ষে অথবা কিছুদিন পর পর ঘটে যাওয়া মারি-মহামারিতে ভারতবর্ষের মানুষ অকালেই মারা যাচ্ছে। ভূদেব অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘অনূ্যন পাঁচ কোটি ভারতবাসী অর্ধাশনে জীবনযাপন করে… এক প্রকার নিশ্চয় হইয়াই গিয়াছে যে, প্রতি দশ এগারো বৎসর অন্তর ভারতবর্ষে একটি করিয়া বৃহৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাহার পরেই একটি করিয়া মহামারি আসিয়া উপস্থিত হয়।’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। প্রায় একই সময়ে লেখা ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কেন ‘চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু’ লিখেছেন তার কারণটি বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।
ফুকোর ভাষ্য থেকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে মহামারি রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের ধরন ও ধারণাকে বদলে দিয়েছিল। রানী ভিক্টোরিয়া উনিশ শতকে লন্ডন শহরে পয়ঃনিস্কাশন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এভাবেই সেখানে গড়ে ওঠে আন্ডারগ্রাউন্ড স্যুয়ারেজ সিস্টেম (যেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে জার্মান বিমান হামলার সময় রাত্রিকালীন ‘শেল্টার’ হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল)। এই যে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলো মহামারি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য তাকেই ফুকো বলেছেন ইরড়-চড়বিৎ। উপনিবেশের দেশগুলো এই ইরড়-চড়বিৎ-এর সুবিধাটুকু পায়নি।
[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

মহামারি প্রতিরোধ :ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভূমিকা
উপরের সব প্রশ্নের এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। শুধু দ্বিতীয় প্রশ্নটির কয়েকটি দিকের প্রতি সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জন্য ‘জনস্বাস্থ্যের’ বিষয়টি ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত। বাণিজ্য করতে এসে বঙ্গদেশে তিনটি গ্রাম নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন তার কাজ-কর্ম শুরু করে তখনও ‘জনস্বাস্থ্য’ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হারানোর পর বাংলায় (এবং বাংলাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য প্রদেশ) অবাধ উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ এলো কোম্পানির সামনে প্রথম বারের মতো। আরো বেশি বেশি করে সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দিল। কোম্পানি শাসনের অংশ হিসেবে দাঁড় করাতে হলো এক নতুন আমলাতন্ত্রের। এ জন্য অনেক শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারী বিলেত থেকে এলেন; তা ছাড়া ভাগ্যান্বেষী ইংরেজরা তো ছিলেনই, যারা নতুন উপনিবেশে এসে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই ঔপনির্বেশিক কর্মযজ্ঞের পথে প্রধান বাধা হয়ে দঁড়িয়েছিল এদেশের আলো-হাওয়া। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘শরীর, সম্পদ ও রাষ্ট্র :ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জন সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, জনস্বাস্থ্যের মূল নিহিত ছিল ‘একটি নিতান্তই সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনীতিক প্রশ্নে : শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা কি গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়তে পারবেন?’ এই প্রয়োজন মেটাতেই ১৭৬৮ সালে প্রকাশিত হয় জে. লিন্ড রচিত বই- এসে অন ডিসিসেস ইন্সিডেন্ট অফ ইউরোপিয়ানস ইন হট ক্লাইমেটস। এর কয়েক বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিকেল সার্ভিস চালু হয় ১৭৬৪ সালে। সে সময়কার ‘রুলিং আইডিয়া’ ছিল- গরম দেশগুলোর আবহাওয়া শ্বেতাঙ্গ মানুষদের জন্য আখেরে অস্বাস্থ্যকর। ফলে সেখানে তাদের দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব চালানো কঠিন। এই থিওরির ভিত্তি ছিল- ‘মায়াস্‌মা’ বা পূতিবাষ্প তত্ত্ব। মায়াস্‌মা বা অশুভ হাওয়া-তত্ত্বের জন্ম চতুর্দশ শতাব্দীর ইউরোপে, যখন ‘কালো মৃত্যু’র (Black Death) করাল-গ্রাসে ইউরোপের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৩৪৬-৪৮ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে প্লেগের কারণে এই মৃত্যু ঘটে। এর আগেও প্লেগ এসেছিল ইউরোপে, কিন্তু সেবার চীন থেকে প্লেগের যে স্ট্রেইনটি আসে তা লণ্ডভণ্ড করে দেয় ইউরোপের সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির সবকিছু। সে সময়ের বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার মান আজকের মতো ছিল না। সে জন্যই অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই তত্ত্বের মূল কথা ছিল, প্লেগ ও কলেরার মতো রোগগুলি পচনশীল দেহ (মানুষ বা প্রাণী) থেকে বাতাসে ছড়ায় এবং একবার সেই ‘খারাপ বাতাস’ গায়ে লাগলে মানুষ তাতে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ১৮৬০ সালে যখন ‘জীবাণু-তত্ত্ব’ আবিস্কৃত হলো তখন জন্ম হলো এক নতুন শাস্ত্রের, যার নাম ট্রপিক্যাল মেডিসিন। পচনশীল শরীর এবং হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো এই শরীর-নির্গত অশুভ বাষ্পকণা- এর বিপরীতে পরবর্তীকালে এসেছিল জীবাণু-তত্ত্ব অর্থাৎ প্লেগ, কলেরা, বসন্ত প্রতিটি রোগের পেছনে রয়েছে বিশেষ বিশেষ জীবাণুর ক্রিয়াশীলতা। প্রতিটি মারি, মহামারি বা গুরুতর ব্যাধির মূলে আসলে কাজ করছে ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু। এই তত্ত্ব আবিস্কারের ফলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল- অন্তত স্বাস্থ্যগত দিক থেকে। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৯৮ সালে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি এখন স্থির নিশ্চিত যে, শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপনা করা সম্ভব।’ কিন্তু এ কথা তো বলা হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ-জয়ের প্রায় দেড়শ’ বছর পরে। ১৮ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এবং প্রায় উনিশ শতকজুড়ে তাহলে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটিকে সামাল দেওয়া হয়েছিল কী করে? নাকি জনস্বাস্থ্য বলতে সে রকম কিছু ছিলই না তখন?
সমসাময়িক নানা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে কোম্পানির সৈন্যদের মহামারি থেকে রক্ষা করাই ছিল জনস্বাস্থ্যের মূল মনোযোগের বিষয়। ১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতে ইউরোপীয় সৈন্য ও অফিসারদের মধ্যে মৃত্যুর ৯৪ শতাংশই ছিল নানাবিধ অসুখের কারণে। এর মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া জাতীয় জ্বর, কলেরা, রক্ত-আমাশা, উদরাময় প্রভৃতি অসুখ। এসব অসুখ থেকে বাঁচার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় ছিল উপনিবেশের প্রজাদের বাসস্থানের পরিবেশের উন্নতি ও উন্নত স্বাস্থ্যবিধির প্রবর্তন (যথা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিস্কাশন, যেখানে সেখানে থুতু-কফ না ফেলা, স্যানিটেশন, হাত ধোয়ার অভ্যাস ইত্যাদি)। এটা হলে কিছুদিন পরপর সংক্রামক মারির আশঙ্কা অনেকখানি লুপ্ত হতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষে এ-দায়িত্ব পালন করা কঠিন। তার উদ্দেশ্য এখানে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ প্রতিষ্ঠা নয়, বরং অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব মেনে কী করে শোষণের মাত্রা আরো তীব্র করে সম্পদ-পাচার দ্রুত গতিতে নিষ্পন্ন করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা। আইনের প্রয়োগের সূত্রে বলা হলেও এর বৃহত্তর তাৎপর্য রয়ে গেছে। উনিশ শতকের মানদণ্ড অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের যেসব রীতি ইংল্যান্ডে প্রয়োগ করা হয়েছে, পরাধীন ভারতবর্ষে তা একেবারেই অনুসৃত হয়নি। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হয়নি। পার্থ চ্যাটার্জী একেই বলেছিলেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। উনিশ শতকজুড়েই বাংলাদেশের গ্রাম ছিল একটি উপেক্ষিত বিষয়- বিশেষত জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ (১৮৮২) গ্রন্থটির কোন কোন অংশে রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভর না করে ‘পরিবার’কে সক্রিয় করতে চাওয়া হয়েছে এই কারণেই। মমার্থ এই যে, ঔপনিবেশিক রাজশক্তির কাছে জনস্বাস্থ্য-রক্ষা কর্মসূচি প্রত্যাশা করে লাভ নেই। ভারতবাসীকে বাঁচাতে হলে পারিবারিক পর্যায়েই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, নতুবা কলেরা-বসন্তে মৃত্যুবরণ করতে হবে। ভূদেবের গ্রন্থের পঞ্চদশ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘পরিচ্ছন্নতা’। সেখানে বিবরণটি এই রকম :
‘দেহ এবং গৃহস্থিত সমুদয় সামগ্রী সুবিশুদ্ধ এবং সুপরিস্কৃৃত রাখিবার অবশ্যকর্ত্তব্যতাও শাস্ত্রে যথোচিত পরিমাণে উল্লিখিত আছে। গৃহের এবং গৃহস্থিত দ্রব্যের যথোচিত বিলেপন ও সন্মার্জ্জনাদি, স্নান, ভোজন, আচমন, বস্ত্রাদির পরিবর্ত্তন প্রভৃতি ব্যাপার আমাদিগের অবশ্যকরণীয় প্রাত্যহিক কার্য্যের মধ্যেই নির্দিষ্ট। বিশেষত :গৃহস্থের বাটীতে দেববিগ্রহ ও ঠাকুরঘর রাখিবার ব্যবস্থা করিয়া সচল গৃহস্থেরই শুচিতার এবং পরিচ্ছন্নতার এক একটি আদর্শ পাইবার উপায় করা হইয়াছে। ঠাকুরঘর যেভাবে রাখ, আজকের সকল ঘর সেইভাবে রাখিলেই হইল। বস্তুত :শুচিতাপ্রিয় য়িহুদীদিগের মধ্যে সংক্রামক রোগ অল্প হয়। তাহার কারণ এই যে, গৃহে এবং গৃহোপকরণ সমস্ত অতি সুপরিস্কৃৃত করিয়া রাখিবার নিমিত্ত উহাদিগের ধর্মশাস্ত্রে আদেশ আছে, এবং য়িহুদীরা আপনাদের শাস্ত্রের আদেশ সমস্ত ভক্তিপূর্বক প্রতিপালন করে।’
তবে ভূদেব এটাও লক্ষ্য করেছেন- অর্থনৈতিক উন্নতি না হলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় উন্নতি ঘটানো একান্তভাবেই কঠিন। ‘পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকিতে সকলেই চায়- উহা ধর্ম্ম্য, স্বাস্থ্যকর এবং সাক্ষাৎ সুখপ্রদ। কিন্তু এ কথাও বলি, পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকা কিঞ্চিৎ ব্যয়সাধ্য ব্যাপার; লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হওয়া সম্যক ঘটিয়া উঠে না।’ অবশ্য যদি রাষ্ট্রতরফে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ব্যাপক জন-সচেতনা কার্যক্রম পরিচালিত হত বা আধুনিক যুগের ন্যায় স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, আবর্জনা পয়ঃনিস্কাশন প্রণালী, সুপেয় ও নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হত, তাহলে গরীবরাও পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রমে সমান তালে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে এটা আশা করা সম্ভব ছিল না।
১৯১২ সালে এদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম পাবলিক হেলথ্‌ ডাইরেক্টরেট-এর প্রতিষ্ঠা হয়। কলেরা, বসন্ত, প্লেগ জাতীয় মহামারিতে অনেক সেনা সদস্যের মৃত্যু এই প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে। অবশ্য এতে করে জনগণের স্বাস্থ্যে কোন গুণগত পরিবর্তন আসেনি। এদেশের জনসাধারণকে মারি বা মহামারি মোকাবিলায় মূলত নিজের চেষ্টার ওপরেই নির্ভর করতে হয়েছে। পাবলিক হেলথ্‌ ডিপার্টমেন্ট ‘স্বাস্থ্যবিধি’ লিখে প্রচার করেনি। তাই ভূদেবের মতো প্রাচীনপন্থি পণ্ডিতকে ‘রোগীর সেবা’ করার বিধান লিখতে হয়েছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভূদেবকে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হয়েছে :
‘গৃহস্বামী সকলকে সতর্ক করিয়া দিবেন, যেন পীড়িতের বিছানা, বালিস, বস্ত্রাদি বাটীর অপর কাহার বস্ত্রাদির সহিত না মিশে-তাহার মল, মূত্র, ক্লেদাদি বাটী হইতে অধিক দূরে নিক্ষিপ্ত এবং পরিস্কৃৃত হয়- তাহার ব্যবহূত পাত্রাদি বাটীর সাধারণ পাত্রাদি হইতে স্বতন্ত্র থাকে- এবং সেবকেরা যতদূর পারেন, যে কাপড়ে … ঘরে থাকেন, সে কাপড় না ছাড়িয়া বাটীর অপর লোকের …ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না আইসেন।’ এ যেন হাল আমলের করোনার কালের ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বিধিমালা তৈরি করছেন ভূদেব মুখ্যোপাধ্যায়।
তবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র একেবারেই এদেশীয় জনগণের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিরুত্তাপ ছিল, তা নয়। রাষ্ট্রের নিস্পৃহ হওয়ার উপায় ছিল না যখন কোন সামাজিক বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বড় আকারের সমাবেশ করার আশংকা তৈরি করত। বিশেষত, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে, এই সচেতনতা আরো তীক্ষষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেসব স্থানে প্রচুর জনসমাবেশ হতো, ঔপনিবেশিক সরকার সেসব স্থানের ওপরে কড়া নজরদারি রাখতেন। সাব-অলটার্ন হিস্টোরিয়ান ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ সরকার হরিদ্বারের কুম্ভমেলা, এলাহাবাদের প্রয়োগের মেলা, পুরীর জগন্নাথধাম, অল্প্রব্দপ্রদেশের তিরুপতি, তামিলদেশের কাঞ্চিপুরম, মহারাষ্ট্রের নাসিক প্রভৃতি ধর্মীয় মেলা ও তীর্থস্থানে বড় ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি দেখতেন। এসব উৎসব এলেই তারা ‘নার্ভাস’ বোধ করতেন। গণহারে যেহেতু তখন প্রতিষেধক ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না- সময়টাকে মোটা দাগে ‘প্রি-ভ্যাকসিনেশন যুগ’ বলতে পারি- উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া ঔপনিবেশিক সরকারের বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দল বেঁধে তীর্থযাত্রা, গঙ্গায় স্নান, ঈদের বড় জমায়েত ইত্যাদি সামাজিক প্রথায় হাত দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিরতই থাকতে হয় রাষ্ট্রপক্ষকে। বিশেষত ১৮৯৯ সালের প্লেগ দমনের একটা পর্যায়ে বোম্বাই ও অন্যান্য শহরে যখন দাঙ্গা বেধে যায়, তার পরে আর রাষ্ট্রশক্তি জনজীবনে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করেনি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনযাত্রায় উদ্ধুদ্ধ করা নয় (যা ছিল ভূদেব, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের উদ্দেশ্য)। বরং নিজেদেরকেই মহামারি বা মারির ‘অশুভ হাওয়া’ থেকে রক্ষা করা। এলক্ষ্যেই ইংরেজ সৈন্য, অফিসার ও রাজকর্মচারীরা যেখানে থাকতেন, সেগুলোকে ‘মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট’-এর আদলে শহরের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি শহরে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় ইংরেজদের চলা-ফেরা, রাস্তা-ঘাট, বাসস্থান, ক্লাব, খেলার মাঠের জন্য স্বতন্ত্র এলাকা, যার সংস্পর্শে আসার কোন সুযোগ ছিল না ‘নেটিভদের’। ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো – ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে…ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা।
[ক্রমশ]

মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল

এ সময়ই পদ্মা বোট থেকে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় প্লেগ ত খুব জেগে উঠচে। আপনার বুঝি স্থানত্যাগ করতে সম্মত নন?’

এ প্রসংগে নিবেদিতার কথাও উল্লেখ করা যায়। বিবেকানন্দের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মিস মার্গারেট নোবল আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। বিবেকানন্দ ওর নাম দেন- ‘নিবেদিতা’। নিবেদিতা যখন ১৮৯৮ সালে কলকাতায় পা রাখলেন, তখন চতুর্দিকে প্লেগের পদধ্বনি। ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দাঙ্গাও হয়। কলকাতা তথা বঙ্গদেশেও এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। ‘নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ :এক বিতর্কিত সম্পর্কের উন্মোচন’ বইতে দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষে অমানুষিক সেবাকাজ চালিয়ে কলকাতায় ফিরে নিবেদিতা ম্যালেরিয়া ও “ব্রেন ফিভারে” [সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া অথবা এন্‌কেফেলাইটিস] শয্যাশায়ী।’ সেসময় মানে ১৯০৬ সাল। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে লিখেছিলেন- ‘নিবেদিতা যে আপনার ওখানে পীড়িত অবস্থায় তাহা আমি জানিতাম না – আমি একখানা বই চাহিয়া তাঁহাকে কলিকাতার ঠিকানায় কয়েকদিন হইল পত্র লিখিয়াছি। আপনি দয়া করিয়া এমন ব্যবস্থা করিবেন যে, পত্রের যেন তিনি কোন নোটিস না লন। তাঁহাকে আমার সাদর নমস্কার জানাইবেন এবং বলিবেন যে, উৎসুক চিত্তে তাঁহার আরোগ্য প্রত্যাশায় রহিলাম।’ নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ। সুহৃদ জগদীশচন্দ্রের মাধ্যমে নিবেদিতার সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবোটে অতিথি হয়েও গিয়েছিলেন তিনি, পূর্ববঙ্গের কৃষকদের অন্তঃপুরে গিয়ে আপনজনের মত করে গ্রামের মা-বোনদের সাথে কথা বলেছেন। গেছেন অনেকবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও। এই যাওয়ার পেছনে ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের পরিবারকুলের একাংশকে বিবেকানন্দ-নিবেদিতার সংঘ-কার্যক্রমে “দলে ভেড়ানোর” ইচ্ছেও তার থাকা অসম্ভব ছিল না। সরলা দেবীকে তো প্রায় দলে টেনেই নিয়েছিলেন। এ নিয়েও রবীন্দ্রনাথের সাথে মনোমালিন্য হতে পারে তার। তার ছোট মেয়েকে (মীরা?) ইংরেজি শেখানোর জন্য অনুরোধ নিবেদিতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- সেটাও একটা কারণ হতে পারে। নিবেদিতার প্রত্যাখ্যান ছিল তীক্ষষ্ট, এমনকি রূঢ়:’সে কি! ঠাকুরবংশের মেয়েকে একটি বিলাতী খুকি বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে!’ শুধু তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথের পাশ্চাত্য-বিমুগ্ধতার প্রতি কটাক্ষ করে আইরীশ নিবেদিতা বললেন :”ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতায় আপনি এমনই আবিষ্ট হয়েছেন যে নিজের মেয়েকে ফোটবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চান?” এই অসংকোচে মত রাখার প্রবণতা নিবেদিতার মধ্যে ছিল। রবীন্দ্রনাথের সাথে জাগতিক আধ্যাত্মিক মত ও পথ নিয়ে মাঝেমাঝেই তুমুল তর্ক বেঁধে যেত। তার সবটুকু আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু জেনেছি যে (সাহিত্যিক বনফুলের স্মৃতিচারণার সুবাদে), ‘গোরা’ উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিতে নিবেদিতাই পীড়াপিড়ি করেছিলেন এবং এর ফলে উপন্যাসের বিয়োগান্ত পরিণতি একটি ইতিবাচক সমাপ্তিতে শেষ হয়। বনফুল লিখেছেন :

“[গোরার ] শেষটা বদল দিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। নিবেদিতা নাছোড় হয়ে ধরে বসল। আবার ঢেলে সাজালাম সব।”

“গোরার শেষটা অন্যরকম ছিল?”

“হ্যাঁ। আমি গল্পটা বিয়োগান্ত করেছিলাম।…গল্পটা ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীতে বেরুচ্ছিল। কিন্তু ওটা আগেই লেখা হয়েছিল আমার। নিবেদিতা তখন বলল- গোরার শেষটা কী রকম করেছেন দেখি। দেখালাম। পড়েই সে বলে উঠল- না না, এ রকম হতে পারে না। ওদের মিলন না হলে বড়ই নিদারুণ ব্যাপার হবে যে। বাস্তব জগতে যা ঘটে না কাব্যের জগতেও কবি সেটা ঘটিয়ে দেবেন না? কাব্যের ও জগৎ তো আপনার সৃষ্টি, ওখানে আপনি অত নিষ্ঠুর হবেন না। ওদের মিলন ঘটিয়ে দিন। দিতেই হবে। এমন জেদ করতে লাগলে যে রাজি হতে হলো। সবটা আবার ঢেলে সাজালাম।” গোরা উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা করেছিলেন তা আর কারো জন্য তিনি কখনো করেননি। এর একটি কারণ হতে পারে, দেশব্রতী গোরার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন নিবেদিতারই কাছ থেকে। শিল্পী নন্দলাল বসু স্মৃতিচারণা করেছেন পদ্মায় বোটে করে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র ও নিবেদিতার আলাপচারিতা সম্পর্কে :’তাহাদের আলোচনার বিষয় আমি কিছু জানি না। তবে শুনেছি, ‘গোরা’ উপন্যাসের hero গোরা সিস্টারকে মনে করে করেছিলেন।’ আমার ধারণা, নিবেদিতার আদর্শ-রূপ তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৮৯৮ সালে কলকাতার প্লেগের সময়ে। ভয়-ভ্রুক্ষেপহীনভাবে নিবেদিতা তখন প্রকৃতই আর্তের ‘ভগিনী’ হয়ে প্লেগের মত মহামারীর কালে বিপন্নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই তেজোদৃপ্ত মূর্তি, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ এবং সন্ন্যাসিনীর মত ত্যাগী পথচলা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মত ছিল না।

প্লেগের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে সেসময়ই। এর আগে প্লেগ সম্পর্কে শুনেছেন, কিন্তু অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা, ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করা, আর্তজনের পাশে দাঁড়ানো তার এই প্রথম এবং তা সিস্টার নিবেদিতার সাথে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। এ সম্পর্কে প্রথমে শুনব এডওয়ার্ড টমসনের (বিখ্যাত ইংরেজ বামপন্থী দার্শনিক ই, পি, টমসনের পিতা) ভাষ্যে। টমসন লিখেছেন : ‘That year [1998] plague broke out in Calcutta; she [Sister Nivedita] organized relief work, assisted by Tagore’ । দ্বিতীয় উৎস শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণা :’সেইসময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন।’ পরের বছরে, অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে প্লেগ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছিল কলকাতায়। প্লেগের টিকা দিতে জনগণের একাংশের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা ছিল। যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না, সেখানে বিদেশী শাসকের টিকা নিয়ে শেষটায় ‘জাত খোয়াতে হবে নাকি’, এই অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। ‘ঈধষপঁঃঃধ ঘড়ঃবং নু ধহ ঊহমষরংয খধফু’ শীর্ষক রচনায় নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন যে, কয়েকটি পরিবার, বিশেষত ঠাকুর পরিবার দৃঢ়তার সহিত এই বিক্ষোভ প্রশমন করিতে চাহিয়াছেন’। ১৯০৯-এ গোরা প্রকাশের দু’বছরের মাথাতেই নিবেদিতার মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির চমকপ্রদ অনুবাদ নিবেদিতারই করা (তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়)। তিনিই রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রথম অনুবাদিকা। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু- রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতার দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার নাম দিয়েছিলেন- লোকমাতা।

আমি বলতে চাইছি যে, মহামারীর ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো, গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস। মহামারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় তার ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায় (স্বদেশী সমাজ, লোকহিত প্রভৃতি প্রবন্ধে), এমনকি তার এই সময়কার দেশাত্মবোধক গানের বিচ্ছিন্ন চরণে। রোগক্লিষ্ট আর্তমানবতার বেদনাকে অনন্ত শক্তির বোধে রূপান্তরের জন্যই রচিত হয় তার নৈবেদ্য ও গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও সংগীত। মারী ও মহামারী তার সৃষ্টিশীলতাকে মানবতাবাদের দিকে প্রভাবিত করেছে।

এই মানবতাবাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের জগমোহন চরিত্র। তিনি আস্তিক বা নাস্তিক সে পরিচয় গৌণ। তার পরিচয় তিনি প্লেগের দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেননি। এক-অর্থে, নাস্তিক জগমোহন আস্তিক নিবেদিতার কাউন্টার-পয়েন্ট। সেই ১৮৯৮ সালে- যে বছরে কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল- নিবেদিতাও রাস্তায় নেমেছিলেন, জগমোহনও রাস্তায় নেমেছিলেন। নিবেদিতা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু জগমোহন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বিবরণটা এই :

‘যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তক্‌মা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল। শচীশের বাপ হরিমোহন ভাবিলেন, তাঁর প্রতিবেশী চামারগুলোকে সকলের আগে প্লেগে ধরিবে, সেইসঙ্গে তাঁরও গুষ্টিসুদ্ধ সহমরণ নিশ্চিত। ঘর ছাড়িয়া পালাইবার পূর্বে তিনি একবার দাদাকে গিয়া বলিলেন, দাদা, কালনায় গঙ্গার ধারে বাড়ি পাইয়াছি, যদি-

জগমোহন বলিলেন, বিলক্ষণ! এদের ফেলিয়া যাই কী করিয়া?

কাদের?

ঐ-যে চামারদের।’

একথা শুনে হরিমোহন তার ছেলে শচীশকে বললেন তার সাথে গঙ্গার ধারের বাড়িতে চলে যেতে।

[ক্রমশ]