বিনায়ক সেন
১. আমার বন্ধুদের লড়াই
বাংলাদেশে এখন, এই মুহূর্তে, ‘সেক্যুলারপন্থি’দের সঙ্গে ‘গণতন্ত্রপন্থি’দের লড়াই প্রবল আকার ধারণ করেছে। অস্বীকার করব না যে, এই লড়াই নিয়ে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এখন এক ধরনের নৈতিক মুছিবতের মধ্যে আছি। আমার প্রিয় বন্ধুদের একটি দল যে কোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করে ছাড়বেই। তাঁদের যুক্তি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজ সমাধা না করা গেলে দেশে সেক্যুলারিজম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। এর জন্য সাময়িকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেও তারা রাজি। আমার প্রিয় বন্ধুদের অন্য একটি দল যে কোনো মূল্যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের যুক্তি, অবাধ ও সব দলের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ একটি নির্বাচন করা না গেলে দেশ প্রবল সংকটের মধ্যে পড়বে। কেননা এতে করে সরকার লেজিটিমেসির অভাবে ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনে তারা সেক্যুলারিজমকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। এমনকি এর জন্য এমন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও তারা মেনে নিতে রাজি, যেটি হয়তো হবে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন নিয়ে, হয়তো যুদ্ধাপরাধের বিচার সুদীর্ঘ কালের জন্য স্থগিত বা শ্লথ করার বিনিময়েই। সত্যের খাতিরে অবশ্য বলা দরকার, আমার বন্ধুদের দু’দলই যুদ্ধাপরাধের বিচার ও গণতন্ত্র উভয়েরই বাস্তবায়ন চান, কিন্তু এ দুই লক্ষ্যের মধ্যে যদি সংঘর্ষ বাধে তাহলে তাদের একেকজনের পক্ষপাতিত্ব থাকবে একেক দিকে। ইয়েভতুশেঙ্কো তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব শুধু ভালো আর মন্দের মধ্যে হয় না। অনেক রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব ঘটে থাকে [কম] ভালো আর [বেশি] ভালোর মধ্যে। ভালো আর মন্দের লড়াই এ দেশকে অতীতে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। ভালো আর ভালোর লড়াই এবার এ দেশকে খাদের ভেতরে ফেলে দিতে চলেছে।
২. ভুলগুলো কোথায় হয়েছিল
ভুলের সূত্রপাত হয়েছিল সত্তর দশকেই। পঁচাত্তরে মুজিব প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে নিহত হলেন। বাহাত্তরের সংবিধানের আদি প্রতিশ্রুতি_ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র_ রাষ্ট্র যদি দীর্ঘদিন ধরে ধারণ করতে পারত তাহলে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারায় এরই মধ্যে একটি সবল গণতান্ত্রিক [পুঁজিবাদী] সমাজ ও অর্থনীতি এ দেশে গড়ে উঠত। উন্নয়নের নিচু পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে অবিকশিত। তখন সক্ষম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব সময়ের আগে এগিয়ে থাকার কারণে_ যাকে আমরা ‘দূরদর্শিতা’ বলি_ ‘প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি’ অনেকটাই পুষিয়ে নিতে পারে। উপনিবেশ থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার আদি পর্যায়ে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় [ভারতে] জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব এবং সেসব দেশের রূপান্তরধর্মী আর্থ-সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এসব দেশের কোনো কোনোটিতে ছিল একদলীয় শাসন, কোনোটিতে ছিল গণতন্ত্র, আবার কোনো কোনোটিতে সক্রিয় ছিল সামরিক নেতৃত্ব। প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব যাই হোক, একটি বিষয় ছিল অভিন্ন। দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এসব দেশে অব্যাহত ছিল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের শাসন, যারা গোড়াতে উপনিবেশের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল বা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকা এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আদি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব বর্ণবৈষম্যবাদের রাজনৈতিক অবসানের পর থেকেই আজ পর্যন্ত সক্রিয় ও ক্ষমতাসীন রয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক বর্ণবৈষম্যবাদের অবসানের লক্ষ্যের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপথগামী না হয়ে অব্যাহতভাবে এগোতে পেরেছে। কেন উন্নয়নের গোড়ার পর্যায়ে আদি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার জন্য উপনিবেশ-উত্তর পূর্ব এশিয়া বা ভারতের দিকে তাকানোরও প্রয়োজন নেই। উন্নত দেশগুলোর যখন পুঁজিবাদ সংহত ও বিকাশমান করা প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল, সেখানেও একই অভিজ্ঞতাকে আদি পর্যায়ে দেখতে পাই। বোনাপার্টের ফ্রান্স, বিসমার্কের জার্মানি বা মেইজির জাপান এর উজ্জ্বল উদাহরণ। সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রে বলতে পারি যে, লেনিন যদি বিপ্লবের সাত বছরের মাথায় মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা না যেতেন, রাশিয়া আরও উন্নত ও আকর্ষণীয় সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের সঙ্গে অগ্রসর হতে পারত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ‘মুক্তিযুদ্ধ নামক বিপ্লবে’র চার বছরের মাথায় আমরা হারালাম মুজিবকে শুধু নয়, নির্মমতম জেলহত্যার মধ্য দিয়ে তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতৃত্বকেও। মৃত্যুকালে মুজিবের বয়স হয়েছিল ৫৫, আর তাজউদ্দীনের ৫০। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোড়ার পর্বে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের এই শূন্যতা অর্থনৈতিকভাবে পুঁজিবাদকে দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল করতে দেয়নি। অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে এদেশকে সুস্থ ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক’ ধারায় বিকশিত হতে দেয়নি। এ দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীল সম্ভাবনাগুলোকেও করেছে পরবর্তী দশকে অনেকটাই পথহারা। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পরপরই এক বছরের মাথায় জিন্নাহর মৃত্যু সে দেশের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দিয়েছিল, যার অনুরণন এখনও চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের আদি-চেতনার বাস্তবায়নকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। মুজিব-তাজউদ্দীন যেখানে নেই সেরকম ভূমিকা পালন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। পরবর্তী শাসনামল প্রমাণ করে তাঁর সে দক্ষতাও ছিল। এর ফলে সুস্থ ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রাজনৈতিক পূর্বশর্ত হিসেবে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের কাম্য ভূমিকা তাঁর কাছ থেকেও আসতে পারত। কিন্তু বাড়তি দুর্ভাগ্য এ দেশের। জিয়া সে ধারায় এগোতে পারলেন না। সে পথে এগোতে চেয়েছিলেন কি-না পুরোপুরি, সে তর্কের এখনও মীমাংসা হয়নি। আমাকে আদিতে সিপিবি-ঘরানার একজন [প্রাক্তন] বামপন্থি নেতা বলেছেন, ক্ষমতায় আসার পরপরই জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী ও বাম নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়ে সমর্থন ও সহযোগিতা চেয়েছিলেন। সোভিয়েত পার্টি সত্তরের দশকে জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা জাতীয়তাবাদী শক্তির অংশ হিসেবেই দেখেছিল। জিয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তিদের একটি বৃহত্তর সমঝোতার সম্ভাবনা তখন সৃষ্টি হয়েছিল। এই পটভূমিতেই জিয়ার খালকাটা বিপ্লবকে ও হ্যাঁ-না ভোটে জিয়াকে তৎকালীন সিপিবির নেতৃত্ব সমর্থন দিয়ে থাকবেন। কিন্তু সমঝোতার এই সম্ভাবনা স্থায়ী হয়নি। তা ছাড়া জিয়া নিজেই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, যার ফলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির অস্তিত্ব অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাহেরের মৃত্যু ছিল এরই ধারাবাহিকতায়।আমি বলতে চাইছি, মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বাম ধারার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সমঝোতা ও ঐক্যের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়া এ দেশের রাজনৈতিক বিকাশের ওপর একটি দীর্ঘস্থায়ী অশুভ প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে এ দেশের রাজনীতির প্রধানতম দ্বন্দ্ব_ ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থানের ঝুঁকি_ মোকাবেলা করা একা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী শক্তির পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর জন্য কতটা জিয়া নিজে দায়ী, আর কতটা বাম প্রগতিশীলরা দায়ী, তা রাজনৈতিক ইতিহাসবিদরা একদিন নির্ধারণ করবেন। জিয়া ও মূলধারার মুক্তিযুদ্ধের শক্তির মধ্যে সেদিন ওই সমঝোতা হলে দেশে আরও আগে সুস্থ পুঁজিবাদী ধারা গড়ে উঠতে পারত এবং পুঁজিবাদী ধারার বিকাশও হতো আরও বেগবান। রাষ্ট্রও হতো আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী। সমাজ-সংস্কৃতি হতো আরও বেশি উদার ও অন্তর্ভুক্তি-প্রবণ। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হতো আরও বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও সহনশীল। পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতেই আরও বেশি দক্ষ ও গণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই প্রধান দলই তখনও থাকত, কিন্তু দুটো দলই [বা তার সৃষ্ট জোটই] হতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। দুটো দলই তখন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করত সমানভাবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে পূর্বাপর সমানভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকত। দুটো দলকেই সমানভাবে পাওয়া যেত মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সোচ্চার। দুটো দলের মধ্যেই এখনও যারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছেন তারা এই না হতে পারার মর্মবেদনা বুঝবেন।জিয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী ও বাম প্রগতিশীল শক্তির সমঝোতার সম্ভাবনা বাস্তবায়ন না হতে পারার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকবে। যেমন_ জিয়া-সরকারের চরিত্র গোড়া থেকেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধীকারী শাহ আজিজুর রহমানের জিয়া-সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ ছিল একটি সামান্য উদাহরণ। শুধু সরকারের চরিত্রে নয়, দলের চরিত্রের ওপরও এটি দীর্ঘমেয়াদি অশুভ প্রভাব ফেলে। নবগঠিত দল বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এক অস্বস্তিকর সহাবস্থানে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়। দলটিতে দেখা দেয় প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের প্রবণতা। এর সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে ২০০১-২০০৬ পর্বে। বিএনপির নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযুদ্ধের শক্তি প্রথমবারের মতো তখন বুঝতে পারছিলেন জোটের ভেতর ও বাইরে ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রবল অস্তিত্ব। এ নিয়ে তাদের মধ্যে নীরব অভিযোগ ও মনোকষ্ট দেখেছি। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ও ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে এ অবস্থানটি তখন তাদের নীরবে সয়ে নিতে হয়েছিল। এ অবস্থা এখনও চলছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ডানপন্থি শক্তির সঙ্গে জোটের ভেতরে ও বাইরে সমঝোতা করে চলা ছাড়া যেন এ মুহূর্তে তাদের গত্যন্তর নেই! এ নিয়ে প্রবলভাবে চিন্তিত বিএনপির ভেতরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও নেতৃত্ব। দলটি যখন প্রবল সরকারি চাপের মুখে তখন ডানপন্থি শক্তিকে মোকাবেলা করার বিষয়টিকে তারা ‘ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখছে’ যেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বিএনপি আজ ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে ছাড় শুধু নয়, তার ওপর চরমভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমনকি সাধারণ সাংগঠনিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড টিকিয়ে রাখার জন্য। এমন অমাবস্যায় দলটি এর আগে কখনও পড়েনি। অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। গত দুই বছরে বিএনপির রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বেড়েছে মূলত সরকারের অজনপ্রিয়তার কারণে। অবাধ ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে বিএনপি এককভাবেই ক্ষমতায় আসীন হতে পারত বা তার কাছাকাছি অবস্থানে যেতে পারত। ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধার তার কোনো দরকার ছিল না। সত্তর দশকেও দলটি গড়ার সময় এ রকম ছাড় দেওয়ার দরকার ছিল না, এখনও সে প্রয়োজনীয়তা এ দলটির নেই। দুঃখের বিষয়, আমার প্রিয় বন্ধুদের যে অংশটি গণতন্ত্রপন্থি তারা এ নিয়ে ততটা সোচ্চার নন। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার পেছনে সরকারের একগুঁয়েমি যেমন দায়ী, ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে প্রধান বিরোধী দলও যে সমান দায়ী, সে কথা তাঁরা জোরের সঙ্গে বলতে চান না। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী গ্রামগঞ্জে-মফস্বল শহরে এমনকি রাজধানীর বুকে যেভাবে সহিংসতা করেছে তাতে যে কোনো নাগরিক বিপন্ন বোধ না করে পারবেন না। দেশের কিছু কিছু এলাকা সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী_ এ রকম কিছু জেলা, এই অশুভ শক্তির ‘মুক্তাঞ্চলে’ পরিণত হয়েছে। দেশের ভেতরে কিছু কিছু স্থানের খবর পড়ে মনে হয় এগুলো বাংলাদেশে নয়, বরং আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কঙ্গো বা সুদানের খবর পড়ছি। বাংলাদেশ যে আজ ‘সহিংস দেশে’র পরিচিতি পাচ্ছে এর পেছনে কি এই অশুভ শক্তির উত্থান প্রধানত দায়ী নয়? সরকারের একতরফা নির্বাচন করার কৌশলকে বর্তমান সংকটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলনকে কি সমানভাবে দায়ী করা যুক্তিসঙ্গত ছিল না? এপক্ষকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বললে ওপক্ষও কি ‘ফ্যাসিবাদী’ বলার যথেষ্ট কারণ ইতিমধ্যেই সৃষ্টি করে থাকেনি? সেদিক থেকে দেখলে ২০১৩ সালের শেষে ২৮ ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিপিডি-টিআইবি প্রমুখ আয়োজিত ‘নাগরিক সভা’ আমাদেরকে একরূপ হতাশই করেছে।
৩. একটি শেষ মুহূর্তের অসম্পূর্ণ সংলাপ
এ নিয়ে যা লিখছি তা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও টিভিতে দেখানো খবর এবং মুখ্য উদ্যোক্তাদের একাধিক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। এতে করে পুরো চিত্রটা পাওয়া নাও যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই সেদিনের ‘নাগরিক সভা’য় সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দুর্ভাবনা। যেখানে আরও কিছুদিন নির্বাচন পেছানোর সাংবিধানিক সুযোগ ছিল, সেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ রেখে নির্বাচন করলে যে সংকট কাটবে না, এটিই ছিল আলোচনার প্রধান সুর। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিপন্ন হবে না, রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটবে না, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। সংলাপে বিদ্বজ্জনরা এ নিয়ে চিন্তিত মন্তব্য করেছেন। এ রকম চলতে থাকলে তৃতীয় কোনো অসাংবিধানিক শক্তি চলে আসতে পারে এক পর্যায়ে, এ আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যেন কার্যত সৃষ্টি করেছে আরও একটি এক-এগারোর আশঙ্কা, সুতরাং এর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়_ এ যুক্তিও পরোক্ষভাবে শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আরও যেন কিছু কথা, কিছু নাগরিক সামাজিক কমিটমেন্টের ভাষ্য আমরা শুনতে চেয়েছিলাম রাজধানীর এই উচ্চবর্গের মানুষ, তথা বিদ্বজ্জনদের কাছ থেকে।কী বলা হয়েছিল সেদিন, তার চেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কী তাঁরা বলেননি সেদিন। কেউ কেউ হয়তো বলে থাকবেন, কিন্তু সেটি ওই আলোচনার প্রধান সুর ছিল না। প্রথমত, সময়ের বিচারে নাগরিক সভাটি দেরিতে, বড় দেরিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি তাদের শুরু করা উচিত ছিল বছর খানেক বা তারও আগে। এতে করে নাগরিক সমাজ আরও নানা বিষয়ে প্রভাব ফেলার বা অন্তত নিজেদের বিবেকি মত রাখার সুযোগ পেতেন। উদাহরণত, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তারা বছর খানেক আগেই সভা ডাকতে পারতেন। গণজাগরণ মঞ্চের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও তারা বিতর্ক করতে পারতেন। চরম ডানপন্থি শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধা প্রধান বিরোধী গণতান্ত্রিক দলের পক্ষে সমীচীন হয়েছে কি-না সে প্রশ্নে তারা দিনব্যাপী আলোচনা-ডায়ালগ করতে পারতেন। কেন এসব বিষয় নিয়ে তারা উচ্চকিত হননি তা তারাই জানেন। দেশের পরিস্থিতি তাহলে হয়তো এ পর্যায়ে গড়াত না। দ্বিতীয়ত, অগণতান্ত্রিকতা আজ সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। সরকার যেমন ‘অগণতান্ত্রিক’ আচরণ করেছে, বিরোধী দলের আন্দোলনেও ‘অগণতান্ত্রিক’ আচরণ স্পষ্ট। গত এক বছর ধরে আন্দোলনের নামে যে হারে সহিংসতা হয়েছে জেলায় জেলায়, তাতে বিরোধী রাজনীতির ‘অগণতান্ত্রিকতা’ দৃশ্যমান। তৃতীয়ত, ধরা যাক, এই মুহূর্তে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলো। এবং এও ধরে নেওয়া যাক, আগের নির্বাচনগুলোয় গত দুই দশকে যেমনটা ঘটেছে, বিরোধী জোট এবারে জয়ী হলো। কিন্তু তাতে করে গণতান্ত্রিকতার প্রতিষ্ঠা হবে তারই বা নিশ্চয়তা কী? সহিংস অগণতান্ত্রিকতার অনুশীলন করে যে অশুভ শক্তিকে আমরা প্রশ্রয় পেতে দেখলাম তারা তো তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবে। সেটাই কি আমরা চাই? আমরা কি চাই যুদ্ধাপরাধের বিচার_ ৪২ বছর পরে যে কোনো কারণেই হোক যখন সবে শুরু হয়েছে_ থেমে যাক? একবার অপরাধীদের হাতে ক্ষমতা গেলে বা তারা ছাড়া পেলে কী ভয়ঙ্কর অমাবস্যা নেমে আসবে এ দেশে, এ নিয়ে তো চরম দুর্ভাবনা নাগরিক সভার উদ্যোক্তাদের কথায় এবং বার্তায় দেখতে পেলাম না। চতুর্থত, উদ্যোক্তারা তো একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’র কথা বলতে পারতেন। যে চুক্তিতে বলা হতো, অবাধ, স্বচ্ছ ও সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য নয়। যে চুক্তিতে এ-ও বলা হতো, চরম ডানপন্থি সহিংস শক্তির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদচারণা গ্রহণযোগ্য নয়। জন রাউলসের ‘রিজনিবল প্লুরালিজম’ সংজ্ঞায় এই সহিংস শক্তি পড়ে না। যে চুক্তিতে বলা হতো, অসাম্প্রদায়িকতা ও সেক্যুলার মূল্যবোধ ছাড়া নির্বাচনী গণতন্ত্র কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র হতে পারে না। যে চুক্তিতে বলা হতো যে, বাহাত্তরের মূল চারটি নীতি আসলে পরস্পরের পরিপূরক। সমাজতন্ত্র ছাড়া যেমন গণতন্ত্র জনকল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, তেমনি গণতন্ত্র ছাড়া সমাজতন্ত্র একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। সেক্যুলারিজম ছাড়া জাতীয়তবাদ শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। সেক্যুলারিজম বর্ণবৈষম্যবাদের মতো ধর্মবৈষম্যবাদের আশঙ্কাকে দূর করে। এবং সবশেষে নাগরিক সভার অনেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত প্রার্থীদের ‘হলফনামার’ সূত্র ধরে একহাত নিয়েছেন সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের। বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে সম্ভবত অবৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণের সম্ভাবনার কথা। এই উদ্বেগে কারও আপত্তি থাকার কথা নয় সাধারণভাবে। কিন্তু এই উদ্বেগ আরও বিস্তৃত পরিসরে ব্যক্ত হওয়া উচিত ছিল। নাগরিক সভার উচ্চবর্গের অংশগ্রহণকারীরা বলতে পারতেন, হলফনামায় যে সম্পদ আহরণের চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা সাধারণভাবে কম-বেশি সত্য উচ্চবর্গের সবার ক্ষেত্রেই। যারাই এ সময়ে [গত এক দশকে] রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাশালী হয়েছেন_ তা তিনি সরকার দলেই থাকুন, আর বিরোধী দলেই থাকুন_ তাঁরাই দ্রুত অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন। পাওয়ার, প্রফিট আর প্রিভিলেজ_ এ তিনের বরপুত্র হয়েছেন তাঁরা। প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থাকা যে উচ্চবর্গের নাগরিক সমাজ সেদিনের নাগরিক সভায় অংশ নিয়েছিলেন তারাও হয়তো কম-বেশি এই সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়ার বাইরে নন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে সরকারদলীয় প্রার্থীদের সম্পদ হয়তো বেড়েছে ৭ গুণ, সে তুলনায় বিরোধীদলীয় সদস্যদের সম্পদ হয়তো বেড়েছে ৪ গুণ এবং উচ্চবর্গের নাগরিক সমাজের সদস্যদের বেড়েছে হয়তো ২ অথবা ৩ গুণ [নাগরিক সমাজের যে অংশটি ব্যবসায়ী শিল্পপতি তাদেরকে এখানে ইচ্ছে করেই বাদ রাখছি]। একই সময়ে আমলাদের অর্থবিত্তও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়ে থাকবে। করপোরেট ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার যারা তাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। সংখ্যাগুলো কাল্পনিক, কিন্তু সমাজে আয় ও সম্পদ-বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করার সুবাদে বলতে পারি_ এ ধরনের প্যাটার্ন বাস্তবতার বাইরে নয়। এ প্রশ্নেও বলতে বাধ্য, সেদিনের নাগরিক সভার হলফনামা সম্পর্কিত আলোচনা নিতান্ত একপেশে মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গগুলো আগামীতে উপস্থাপনের সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি।কিন্তু আমি এসব কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কে? আমি তো উটপাখি, সমাজের-ইতিহাসের ওপর দিয়ে ঝড়-ঝঞ্ছা যখন বয়ে যাবে তখন আমার বালিতে মুখ গুঁজে থাকার কথা। ‘উটপাখী’ কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশিদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার/তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।/অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ বাংলাদেশ নাকি ধ্বংসের কিনারে গিয়ে বারবার ফিরে আসে। কিন্তু এ রকম কোনো মৌল সূত্রের রক্ষাকবচ আসলে নেই। যা ঘটছে এখন বাংলাদেশে, যা ঘটতে যাচ্ছে, তার জন্য সমানভাবে দায়ী থাকবে সরকার, বিরোধী দল ও সিভিল সমাজ। শুনেছি, উটপাখিরাও আসলে বালিতে মুখ লুকায় না। বালিতে তারা মুখ গুঁজে ডিমকে রক্ষা করার জন্য। নিতান্ত জীবন-চর্চার প্রয়োজনেই। তাই উটপাখিদের তুলনা দেওয়াটা তাদের জন্য হবে অপমানকর। সরদার ফজলুল করীম এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মানুষ আসলে মানুষকে মারতে পারে না। হয় মানুষ অমানুষকে [পশুকে] মারে, অথবা অমানুষ [পশু] মানুষকে মারে। আমরা এই ভয়াবহ সমীকরণের মধ্যে বাস করছি।
লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতিবিদ
Original post on Samakal here.