বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


পঞ্চমত, কমন গুড-এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য ও গণশিক্ষা ছাড়াও চলে আসবে গণপরিবহনের প্রসঙ্গ। দেশের গণপরিবহন ‘গণ’ ছাড়া চলবে তা তো হতে পারে না। উচ্চবিত্তরা চলবেন প্রাইভেট গাড়িতে; মধ্যবিত্তরা চলবেন গাড়িতে বা উবারে করে, অথবা রিকশায় চড়ে; আর গরিবরা চলবেন বাসে-টেম্পোতে করে, আর অতিদরিদ্ররা হেঁটে। বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার মতো পরিবহন খাতেও চলছে নানামুখী ধারা। কেবল নেই তাতে প্রকৃত অর্থে গণপরিবহন, যেখানে ধনী-মধ্যবিত্ত-গরিব একসঙ্গে চলে। অথচ উন্নত দেশে ভ্রমণের প্রথম চোখে পড়ার বিষয়ই হলো সেখানকার গণপরিবহনের বিকশিত রূপ। বাসে বলুন, ট্রামে বলুন, ট্রলি বাসে বলুন, ট্রানজিট রেলে অথবা মেট্রোতে বলুন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষই একসঙ্গে চড়ছে ও চলছে। এই একই দৃশ্য আমি ছাত্রাবস্থায় মস্কো শহরে দেখেছি এবং পরবর্তীকালে কর্মজীবনের বড় অংশ যেখানে কেটেছে সেই ওয়াশিংটনে দেখেছি। অর্থাৎ সনাতনি সমাজতন্ত্র ও আধুনিকতম পুঁজিবাদে গণপরিবহনকে গুরুত্বপূর্ণ ‘কমন গুড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিভক্তি থাকবেই, কিন্তু তাই বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো প্রকট বিভক্তি থাকতেই হবে এমন কোনো কঠোর নিয়ম নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা মাত্রাতিরিক্তভাবে বিভক্ত। এই শ্রেণিবিভক্ত পরিবহন ব্যবস্থা দূর না হলে এবং প্রকৃত অর্থে সবার জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো সবার জন্য গণপরিবহন (তথা ‘সিস্টেম অব মাস ট্রানজিট’) প্রবর্তিত না হলে গণতন্ত্র সকলের জন্য অর্থবহ হবে না। এটা চলতে থাকলে ক্রমাগত যানজটে ও বায়ুদূষণে শুধু যে স্বাস্থ্যহানি ও কালক্ষেপণের অর্থনৈতিক মাশুল দিতে হবে তা-ই নয়। আমার ধারণা, উপযুক্ত গণপরিবহন না থাকার কারণে আমাদের ‘প্রাইভেট সেভিংস’ কমে যাচ্ছে (টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত যানবাহন কেনার জন্যে); শহর এলাকায় বসতি আরও বেশি ঘন হয়ে উঠছে এবং বাড়িভাড়া আরও বেশি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ছে, যার ভুক্তভোগী সবাই কম-বেশি হচ্ছেন, কিন্তু বিশেষভাবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্নবিত্তের মানুষেরা। সমাজতন্ত্রীরা এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। প্রকৃত অর্থে সবার জন্য সুলভ ও নান্দনিক গণপরিবহন শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রেরও দাবি।

ষষ্ঠত, জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও গণপরিবহন এদের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান হচ্ছে পরিবেশসম্মত উন্নয়ন এবং নিরাপত্তাপূর্ণ জীবন (শেষেরটি না বললেও চলে)। দুঃখের বিষয়, ঐতিহাসিকভাবে পুঁজিবাদী দেশগুলো যখন গড়ে উঠেছিল এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল তখন পরিবেশ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক হঠকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে এসব দেশ পরিবেশ বিষয়ে আরও সচেতন হয়ে ওঠে এবং নানামুখী উদ্যোগ নিতে থাকে। আমাদের দেশে কী বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, কী উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নির্বাচনে পরিবেশ-সচেতনতাকে যথেষ্ট আমলে নেওয়া হয় না। নদী নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা প্রকল্পগুলোয় অনেক ক্ষেত্রেই নদীরক্ষা বা শহররক্ষার নামে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি এখন এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গেছে যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র উপন্যাসের নামের মতো চারপাশ থেকে ধ্বনি উঠেছে কেবলু ‘কাঁদো, নদী কাঁদো’। নদীমাতৃক দেশে আমরা এখনও নদীভিত্তিক পরিবহন ও জনপদ গড়ে তুলতে পারিনি। নদী মরুভূমিতে হারিয়ে যায়নি, পানি উন্নয়ন পরিকল্পনার ফাঁদে পড়ে এমনকি স্মৃতি থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী নিশ্চিহ্ন, আর বেঁচে-বর্তে থাকা প্রায় অধিকাংশ নদীর শাখা-প্রশাখা মরে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত সমস্যাবলি। পরিবেশের পরিবর্তনের ঝুঁকির সঙ্গে মানানসই শহর কী করে গড়ে তোলা যাবে- এসব প্রশ্ন উঠছে। উপদ্রুত উপকূলের জনপদ ভাঙনের মুখে। বাংলাদেশ দুঃস্বপ্ন দেখে- সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ সমুদ্রের নোনাজলে তলিয়ে যাচ্ছে। একই সমস্যা দেখি বন-পাহাড় রক্ষার ক্ষেত্রেও। পাহাড় বৃক্ষহীন, বন উজাড়, পাহাড়ে নামছে ধস, বিপন্ন পশু-পাখি- তারা কার কাছে ফরিয়াদ চাইবে? সমাজতন্ত্রীরা এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।

সবশেষে বলব, বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের তুলনায় আয়-বৈষম্য নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের মানদণ্ডে কিছুটা বেশি। এই বৈষম্য সময়ের সঙ্গে অল্প অল্প করে বাড়ছে। এখন সেটা বেড়ে প্রায় বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বৈষম্য মাপার জিনি সূচক ১৯৭৩/৭৪ সালের ০.৩৬ থেকে ক্রমশ বেড়ে ২০১৬/১৭ সালে ০.৪৮-এ এসে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃত আয়-বৈষম্য আরও বেশি হবে, কেননা সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ধনী লোকেরা বিবিএসের আয়-ব্যয় জরিপে কদাচিত অন্তর্ভুক্ত হন। শুধু আয়-বৈষম্য নয়, সম্পদ-বৈষম্যেও আমাদের অবনতি হচ্ছে। ২০১৯ সালের MICS জরিপ অনুযায়ী সারা দেশের মাত্র ৬ শতাংশ খানায় কম্পিউটার বা ল্যাপটপ আছে; ৫০ শতাংশের এখনও একটি টেলিভিশন নেই; ইন্টারনেট যোগাযোগ নেই ৬২ শতাংশ গৃহে।

কেউ কেউ বলতে পারেন, দেশে যে বৈষম্য বাড়ছে এতে অতটা দুশ্চিন্তার কিছু নেই। স্বল্প-আয়ের দেশগুলোয় আয়-বৈষম্যের মাত্রা কম থাকে; এরপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় আয় বাড়তে থাকলে আয়-বৈষম্য বাড়তে থাকে; সেটি বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে এসে আবার কমতে শুরু করে। অর্থাৎ আয়ের সঙ্গে বৈষম্যের মাত্রার সম্পর্ক সরলরেখার মতো নয়। প্রথমে কম, মাঝখানে বেশি, এবং সবশেষে আবারও কম। এই প্রবণতাকে নোবেল-অর্থনৈতিক সাইমন কুজনেস্‌ প্রথম শনাক্ত করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে জরিপের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বিচার করলে বৈষম্যের কমা-বাড়া-কমার প্রবণতা আর প্রমাণিত থাকছে না। আয় বাড়লেও বৈষম্য কমার লক্ষণ নেই; এমনকি বৈষম্যের উল্লম্ম্ফনের জন্যেই ওইসব দেশে জাতীয় আয় যথাযথভাবে বাড়তে পারছে না। গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট যে, যেসব দেশে বৈষম্য অতি উচ্চমাত্রায় (জিনি সূচক ০.৫০-র থেকে বেশি) অবস্থান করছে, সেসব দেশে প্রবৃদ্ধি একসময় শ্নথ হয়ে আসে এবং দারিদ্র্য নিরসনের গতিও থমকে যায়। মোট কথা, জাতীয় আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়-বৈষম্যও বাড়ছে-এতে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ওপরের আলোচনা থেকে এটুকু স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘কমন গুড’ তথা জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, গণপরিবহন, পরিবেশ সংবেদনশীল উন্নয়ন বিষয়ে অনেক প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়ে গেছে। সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়েও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে সমতামুখীন সমাজ চেয়েছিলেন তা এখনও ‘অসমাপ্ত প্রকল্প’ হিসেবেই রয়ে গেছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং আদর্শিক আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। শাসক দল আর ৫০ বছর আগেকার মতো গরিব-মধ্যবিত্তের পার্টি নয়; এটি এখন অনেক বেশি ধনিক শ্রেণিনির্ভর পার্টি। ১৯৭২-৭৫ সালে যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ছিলেন তারা এখন হয়তো উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা ধনিক শ্রেণির কাতারে। এর পেছনে খানিকটা তথ্য-প্রমাণও রয়েছে। ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টে সংসদ-সদস্যের বেশিরভাগই ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মধ্য কৃষক, চিকিৎসা, শিক্ষকতা বা আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। খুব কমই ছিলেন তখন বৃহৎ ট্রেডার ও শিল্পপতি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন সংসদ সদস্যের অধিকাংশই কোনো-না-কোনো শিল্পের মালিক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। মধ্য কৃষক বা মধ্যবিত্ত ঘরের থেকে আসা সংসদ সদস্য খুবই কম (কৃষক-শ্রমিক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা সংসদ সদস্য নেই বললেই চলে)। এ তথ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের বিশ্নেষণ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সংসদ-সদস্যদের শ্রেণি-পরিচয়ে এই ধনিক-অভিমুখীনতার কারণে বিশেষ কায়েমী স্বার্থের বলয়ের দ্বারা অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এবং এই যুক্তিতে জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও গণপরিবহনের ক্ষেত্রে নাটকীয় শুভ পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে বৈকি। বৈষম্যরোধকারী নীতিমালা গ্রহণেও সংসদ সদস্য বা নীতিপ্রণেতাদের তৎপর হতে দেখা যায় না তেমন। কররাজস্ব নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে (যেমন সম্পদ-কর বসানোর ক্ষেত্রে) অথবা সরকারি ব্যয় বরাদ্দে সামাজিক সুরক্ষার অংশ বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ‘কমিটমেন্ট’ আবশ্যক ছিল তা দৃশ্যত পরিলক্ষিত হয় না। সংসদের অধিকাংশ সদস্য উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনিক শ্রেণিভুক্ত হওয়ার কারণে গরিব শ্রেণি অভিমুখীন নীতিমালা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। শুধু তা-ই নয়, কেবল ধনিক শ্রেণির স্বার্থে নীতিমালা বা প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার (যাকে বলে ‘পলিসি ক্যাপচার’ বা ‘রেন্ট ক্যাপচার’) আশঙ্কা দেখা দেয়।

কিন্তু এই যুক্তিটা সঠিক না-ও হতে পারে। এমনও হতে পারে যে আমাদের দেশে ঐতিহ্যবাহী ধনিক শ্রেণি বা ক্লাসিক বুর্জোয়া পরিবার-গোষ্ঠী আদিতে না থাকার কারণে ধনিক পরিবারের সংখ্যা কালক্রমে বেড়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র হাতে-গোনা কিছু পরিবারের কাছে জিম্মি হয়নি। এই যুক্তিতে যেভাবে ভারতে টাটা-বিড়লা বা পাকিস্তানে আদমজী-দাউদ কয়েকটি একচেটিয়া (মনোপলি) পরিবার শিল্প-ব্যবসা খাতে আত্মপ্রকাশ করেছিল আমাদের দেশে এখনও সেই প্রবণতা দেখা দেয়নি। বেসরকারি ব্যাংক-বীমা ও শিল্প খাতে শতাধিক বৃহৎ ধনিকগোষ্ঠী বিচরণ করলেও তাদের নীতিমালা প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা সীমিত। এদের একটা বড় অংশেরই রয়েছে রপ্তানিমুখীন গার্মেন্টস শিল্প চালানোর অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ এক দশক বা দুই দশক আগেও তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদের এখনও মনোপলি বা একচেটিয়া পুঁজির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। ফলে তাদের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের তরফে (নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে) এখনও একটি আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা ‘রিলেটিভ অটোনমি’ রয়ে গেছে। সবকিছুর জন্যে তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার দরকার নেই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের। এর ফলে-কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া-অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা তাদের উন্নয়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন সেসবের দ্রুতই সমাধান করা গেছে। কভিড-উত্তরকালে প্রবৃদ্ধি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল রাষ্ট্র দ্রুতই তার মীমাংসা দিতে পেরেছে। কভিড-উত্তর ইনসেনটিভ প্যাকেজের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই বেসরকারি গার্মেন্টস্‌ খাতের জন্য ব্যয়িত হয়েছে ‘ওয়েজ সাবসিডি’ হিসেবে। এর সুফল পেয়ে থাকবেন গার্মেন্টস্‌ কারখানার শ্রমিকেরা। তারপরও বলতে হয়, বেসরকারি খাতনির্ভর উন্নয়নের পথে নতুন প্রযুক্তি বা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলেও বেসরকারি মালিকদের সংগঠন বা সাধারণভাবে এদেশের পুঁজিপতি শ্রেণি নিজের গরজে এদেশের রাষ্ট্রকে একটি ‘জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে’ (‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’) পরিণত করে ফেলবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। হয় শক্ত হাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব (যেমন, বিসমার্কের জার্মানিতে ‘সোশ্যাল স্টেট’-এর ক্ষেত্রে) বা দেশের ভেতরে ‘নিচে থেকে’ গড়ে-ওঠা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন অথবা শাসক দলের ওয়েলফেয়ার স্টেটমুখী সচেতন পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ চিন্তাধারাকে একবিংশ শতাব্দীর পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করতে পারে। শুধু বেসরকারি ব্যবসায়ী শিল্পপতি-ব্যাংকারদের দিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন, সংসদ বা শ্রেণি এককভাবে এই কাজটি করতে পারবে না।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রের অর্থ যদি হয় সামাজিক ন্যায়বিচার (সোশ্যাল জাস্টিস), আর সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থ যদি হয় ‘ন্যায়ের’ বাস্তবায়ন, তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- ন্যায় কী এবং সেই ন্যায়দর্শনের ভিত্তি কী? নিচের উদাহরণটি প্রমাণ করে, সব সময় এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। প্রায়োগিক নীতিমালা অনেক সময় ডগমাটিক হলে চলে না। অবস্থাভেদে নীতিকে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনকে আশ্রয় করে চলতে হয়। অমর্ত্য সেন একটি ছোট্ট উদাহরণের মাধ্যমে এটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইতে যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের চেহারা কেমন হওয়া উচিত- তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। বইতে পাত্রপাত্রীর নাম তিনি যেভাবে দিয়েছেন, এখানে আমি তা একটু বদলে দিলাম। ধরা যাক, যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদের নাম আসগর, করিম ও শ্যামল। এদের মধ্যে একটি বাঁশি কে পাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসগর খুব ভালো বাঁশি বাজায়। এটা শ্যামল ও করিম উভয়েই জানে। যেহেতু এটি রাষ্ট্র থেকে দেওয়া হচ্ছে, তাই বাঁশিটা পাওয়ার অধিকার তারই। আবার করিমের জন্ম খুব দরিদ্র পরিবারে। সে কখনও এমন সুন্দর বাঁশি দেখেনি। এমন একটি বাঁশি পাওয়ার আকুতি তার মধ্যে আছে। তারও দাবি, তাকেই এটা দেওয়া হোক। আর এদের মধ্যে শ্যামলের দাবি, বাঁশি বানানো তার পিতৃপুরুষের কাজ, সে-ই এই বাঁশি বানিয়েছে। তার থেকেই রাষ্ট্র নিয়েছে, এখন দিতে চাইছে। তাই এটি তারই প্রাপ্য। এখন কার বাঁশি পাওয়া উচিত, সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টিতে তা দেখতে চাইলে একেক দৃষ্টিকোণ থেকে একেক ধরনের উত্তর পাব। যিনি দক্ষতাকে সম্পদ বণ্টন বা পুনর্বণ্টনের মূল ভিত্তি বলে মনে করেন, তিনি আসগরকে বাঁশি দেওয়ার পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যারা হিতবাদী (ইউটিলিটারিয়ান) দর্শনের লোক, যাদের মধ্যে জেরেমি বেন্থাম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো উদারনৈতিক বা লিবারেল দর্শনের প্রবক্তারাও পড়েন, তারা বলবেন- করিমকেই এটা দেওয়া সামাজিকভাবে ন্যায়সংগত। আবার মার্ক্সবাদীরা যুক্তি দেবেন, শ্যামলের বানানো জিনিস তাকে না দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা শ্যামলেরই প্রাপ্য।
ওপরের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, সামাজিক ন্যায়ের কোনো একক বা সর্বাত্মক সংজ্ঞা নেই, যেটা দিয়ে সব রকমের বণ্টন নীতিমালা গ্রহণ করতে পারি। একেক সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের একেক রকমের ন্যায়দর্শনের আশ্রয় নিতে হয়। এর তাৎপর্য হচ্ছে, সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একমাত্রিক চিন্তার সুযোগ নেই। সমাজতন্ত্রের ধারণার মধ্যে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনের চর্চার ও অবস্থাভেদে তার বিশিষ্ট প্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে। যেমন :বাঁশিটা আসগর, করিম ও শ্যামল- এই তিনজনার মধ্যে কাকে দেওয়া হবে, এই জটিল ন্যায়সংকটের পাশাপাশি আরও কয়েকটা প্রসঙ্গ অবতারণা করা যায়। বাঁশিটা কে পাবে, এর উত্তর মুলতবি থাকলেও এটা পরিস্কার যে বাঁশিটা অন্তত এমন কাউকে দেওয়া উচিত নয়, যিনি কিনা কেবল বাঁশির ‘মজুতদারী’ করেছেন। ধরা যাক, তার নাম সোহেল। অর্থাৎ তিনি আসগরের মতো দক্ষ বাঁশিবাদকও নন; করিমের মতো একটা বাঁশি হাতে পাওয়ার অভাববোধজনিত তীব্র আকুতিও তার নেই; আবার শ্যামলের মতো বাঁশিটা তিনি উৎপাদনও করেননি। তার শুধু আগ্রহ, বেশি বেশি করে বাঁশি কিনে ‘স্টক’ করে রাখা, আর দাম বেশি পেলে সেটা বিক্রি করে ‘ব্যক্তিগত মুনাফা’ বৃদ্ধি করা। মুনাফা অর্জন ছাড়া বাঁশির সুর-লহরী নিয়ে তার কোনো বাড়তি আগ্রহ নেই। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের নীতি খুব পরিস্কার :আসগর, করিম বা শ্যামল যাকেই অবশেষে বাঁশিটি দেওয়া হোক না কেন, অন্তত সোহেলকে ওই বাঁশিটি দেওয়া ন্যায়সংগত হবে না। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়মীমাংসা জটিল হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সোহেলের মতো লোকদের কাছে যাতে করে উত্তরোত্তর বাঁশির ঘণীভবন (কনসেন্ট্রেশন) বাড়তে না থাকে- অর্থনীতির পরিভাষায় concentration of economic power, যাতে করে সহনশীল মাত্রার মধ্যে বিরাজ করে- সেদিকে রাষ্ট্র খেয়াল রাখবে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কাছে প্রত্যাশা। ন্যায়দার্শনিক জন রাউলস আরেকটি প্রত্যাশার কথা বলেছেন। ‘টু প্রিন্সিপলস্‌ অব জাস্টিস’ নীতিতে সমাজে কতটা আয়বৈষম্য গ্রহণযোগ্য, তার একটি ফর্মুলা তিনি বেঁধে দিয়েছেন। মানুষের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিক চাহিদা পূরণের (primary goods) দরকার হয়। এই চাহিদাকে যেসব পণ্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে পড়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ‘যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর’ স্বাধীনতা, ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ প্রভৃতি। স্বাধীনতার চাহিদাকেও আমি প্রাইমারি গুডসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছি, কেননা (রাউলসের মতে) স্বাধীনতা ছাড়া শুধু অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতির সংস্থান অনেকখানি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এটা বোঝাতেই তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের জীবন পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।’ যা হোক, রাউলসের ফর্মুলাটি হলো, সমাজের সবচেয়ে অভাবপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের ‘মৌলিক চাহিদা’ সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে (যাকে অন্যত্র তিনি ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপল’ বলেছেন)। এদের ‘মৌলিক চাহিদা’ আগে পূরণের পর সমাজে যেটুকু বৈষম্য থাকবে, তা হয়তো ‘গ্রহণযোগ্য’। সমাজতন্ত্রের ন্যায়দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মনোগ্রাহী হলেও (এ জন্যই এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে) কতগুলো সমস্যা তার পরও থেকেই যায়।
প্রথমত, এই রাউলসীয় ফর্মুলা থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে সমাজ থেকে দারিদ্র্য যদি আগে দূর যায়, তাহলে আপেক্ষিক বৈষম্য নিয়ে দুর্ভাবনার অত দরকার নেই। এটি ন্যায়ের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে, কিন্তু সমাধানটি সবার ভালো না-ও লাগতে পারে। সমাজ থেকে না হয় দারিদ্র্য মুছে গেল, তারপরও মানুষ আপেক্ষিক বৈষম্য সম্পর্কে আলাদাভাবে সংবেদনশীল। উন্নত দেশের মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলোর সিইও যে বেতন পান, সেই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে নিচের স্তরের কর্মচারী (যিনি হয়তো দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে দাঁড়ানো) পান তার চেয়েও ৪০ ভাগ কম পারিশ্রমিক। এতটা বৈষম্য সমাজে কি থাকা উচিত? এ প্রশ্নটা সমাজতন্ত্রীরা করবেন। কতটা বৈষম্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য, এটি শুধু অর্থনীতিবিদরা ঠিক করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত, মৌলিক চাহিদা ও তার ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত যে ‘দারিদ্র্য’, তাকে আরও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে হবে। এসব চাহিদার কিছু কিছু পূরণ হবে ‘প্রাইভেট গুডস’-এর (বা বাজার থেকে অভিরুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিসপত্র বা সেবা কেনার) দ্বারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বাসস্থান এসব প্রয়োজন কি শুধু ‘প্রাইভেট গুডস’-এর বলয়ে থাকবে, নাকি সেগুলো পড়বে ‘পাবলিক গুডস’-এর বলয়ে (অথবা প্রাইভেট-পাবলিক ‘মিশ্র’ খাতে)? কানাডায়-যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য খাতকে মূলত ‘কমন গুডস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড একই পথের অনুসারী। এসব দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত চিকিৎসাসেবার সুযোগ সীমিত। এর অর্থ দাঁড়ায় যে এসব দেশে অসুখে ভুগলে কোনো পরিবার বা ব্যক্তি বিপন্ন বোধ করেন না। কেননা, তিনি জানেন যে তার চিকিৎসাসেবার প্রায় সব দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সোভিয়েত পতনের পরও পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই স্বাস্থ্য খাতকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ হিসেবেই দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদার বিষয়টি ‘মৌলিক নীতিমালার’ অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্যটি এখন ‘মৌলিক অধিকারের’ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবাকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ করা হয়নি। হালআমলের ‘ওবামা কেয়ার’-এর মাধ্যমে কিছু কিছু স্বাস্থ্যসেবাকে কোনো কোনো গ্রুপের জন্য (যেমন- ৬৫-ঊর্ধ্ব লোকেদের জন্য) নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে রাষ্ট্রের তরফে, এটা ঠিক। কিন্তু অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবাই অধিকাংশ মানুষের জন্য এখনও ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এ দেশে আমেরিকার পথে (যেখানে স্বাস্থ্যসেবা মূলত ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপরে নির্ভরশীল) এগোব, নাকি যুক্তরাজ্য-রাশিয়ার পথে এগোব (যেখানে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র সাধারণভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার)? এই বিতর্কটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা তুলবেন।

তৃতীয়ত, কোন পণ্য, সেবা বা প্রয়োজন কতটা পরিমাণে ব্যক্তি খাতে বা রাষ্ট্রীয় খাতে থাকবে, তা যুগের হাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। এর অর্থ, আগে থেকেই ঠিক করা যাবে না যে ক, খ, গ, ঘ খাতগুলো শুধু ব্যক্তি খাতে থাকবে; আর য, র, ল, ব খাতগুলো শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকবে। সমাজতন্ত্র মানে ১০০% রাষ্ট্রায়ত্ত খাত- এ ধরনের ধারণার বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর কালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহদায়তন শিল্প খাতে কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকলেও ক্ষুদ্র-মাঝারি খাতগুলো তখন ব্যক্তি খাতে ছিল। ক্রমে ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ইনভেস্টমেন্ট সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত শতকের আশি-নব্বই দশকে আলোচনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। সে সময়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হয় যে প্রায় সব খাতের অর্থনৈতিক ইউনিটকেই কেবল ব্যক্তি খাতের জন্য সংরক্ষিত করা হতে থাকে। এতে করে বাধাবন্ধনহীন ব্যক্তিগত মুনাফাচালিত ও সংকীর্ণ স্বার্থের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। মুখে ব্যক্তি খাত বলা হলেও প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত করপোরেট ক্যাপিটালিজমের দিকেই ধাবিত হয়। ব্যাংক-বীমা খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিরাষ্ট্রীয়করণ ও অবাধ ঋণপ্রবাহের মাধ্যমে রাতারাতি এক বৃহৎ ধনিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে আশি-নব্বইয়ের দশকে এবং পরেও তা অব্যাহত থাকে। ব্যাংকিং খাতের জন্য এই বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্বত্র সুফলদায়ী হয়নি। অনাদায়ী ও মন্দ ঋণের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বেড়েছে তা-ই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ‘নিচে থেকে’ গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতেও ব্যর্থ হয় অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। এককথায়, আমরা সে সময়ে অতিমাত্রায় বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র- যেটি একটি জনকল্যাণধর্মী মিশ্র খাতের সমর্থক- এই বল্কগ্দাহীন মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের বিকাশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে।

চতুর্থত, বৈষম্য শুধু আয়ের ক্ষেত্রে নয়, জীবনযাত্রার অন্যান্য আয়বহির্ভূত সূচকেও একে বিচার করতে হবে। রাউলস যখন দরিদ্রতমদের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা বলেছিলেন, তিনি গরিব ও ধনীর জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবেননি। প্রত্যেকের জন্যই শিক্ষা একটি পাবলিক বা কমন গুড। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা হবে প্রায় সবার জন্য সমান মানসম্পন্ন। উন্নত দেশে এসব স্তরে কোনো বৈষম্য করা হয় না। পাবলিক এডুকেশন (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সবার জন্য সমান গুণসম্পন্ন এবং অবৈতনিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও এই ব্যবস্থা বিদ্যমান। পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে এবং রাশিয়ায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণও অনেক ক্ষেত্রে অবৈতনিক- শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভার সঙ্গে সংগতি রেখে সেখানে টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার’ কথা বললেও এখন পর্যন্ত একটি ‘কমন স্কুল সিস্টেম’ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যার মাধ্যমে ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা গা ঘষাঘষি করে এক শ্রেণিতে পড়ালেখা করতে পারবে। এখন মাদ্রাসায় যায় মূলত অতিদরিদ্রদের ছেলেমেয়েরা; বাংলা মিডিয়াম স্কুলে যায় গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা; আর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যায় উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম আরও সূক্ষ্ণ প্রভেদ করা সম্ভব। এর ফলে চাকরিজীবনে প্রবেশের আগেই বিভিন্ন আয়ের মানুষের মধ্যে গভীর শ্রেণিবিভাজন ঘটে যায়। কমন স্কুল না থাকার জন্য সামাজিক (ঊর্ধ্বমুখী) সচলতা কমে যায়। নিচের আয়ের মানুষ ওপরের আয়ের স্তরে প্রবেশ লাভ করতে ব্যর্থ হয় প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নানা স্তরের মধ্যে পাঠদানের গুণে-মানে বৈষম্যের কারণে। সংগত কারণেই এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আলোচনার একটি মুখ্য বিষয়বস্তু।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


অর্ধ-সত্যের ভিত্তিতে ডিজইনফরমেশন ক্যামপেইন চালানোর পটভূমি গড়ে দিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ঠান্ডা যুদ্ধ। ‘ঠান্ডা’ হলেও যুদ্ধের রক্তারক্তিতে সেটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধের চেয়ে কম যায় না। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ওয়াশিংটন পোস্ট তড়িঘড়ি করে লিখল যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আবার সবকিছু পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে: ‘ইসলামাবাদ, পিকিং এবং ওয়াশিংটন তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করবে বলে মনে হয়।’
এই সূত্রে প্রবন্ধের লেখক লুই সিমনস্‌ মৃত্যুর কারণও নির্দিষ্ট করলেন:
‘যদিও এ অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ হিসেবে শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী শাসন, তার অযোগ্যতা এবং দুর্নীতিপরায়ণতার কথা তুলে ধরা হয়েছে, তবু প্রথম থেকেই দিল্লি-মস্কোর সঙ্গে বেশি মাখামাখির জন্য জনগণ মুজিবকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল। অতীতে যেমন দুঃখ-দুর্দশার জন্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যেই অর্থনৈতিক শোষণ চালু করার জন্য ভারত সরকার ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অভিযুক্ত করেছে। পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে উদ্ভূত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে ঘাত-প্রতিঘাতের জন্ম দিয়েছে, তারই ফল হচ্ছে শেখ মুজিবের পতন ও মৃত্যু।’
লুই সিমনস্‌ আরও বললেন, ‘হঠাৎ এই গতি পরিবর্তন শুধু মিসেস গান্ধীকে নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বিচলিত করতে বাধ্য। এতদিন তারা চীনকে আগলে রাখার প্রয়াসে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এসেছিলেন।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে বৃহৎ পরাশক্তির দ্বন্দ্ব, ভারত, চীন, পাকিস্তান ইত্যাকার শক্তির ভারসাম্যের সমীকরণ জড়িত এমনটাই ইঙ্গিত করা হলো।
এটা এখন অনেকটাই স্পেকুলেশনের বিষয় যে মুজিব-হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিক্সন প্রশাসন-সিআইএ জড়িত ছিল, কী ছিল না। মিজানুর রহমান খানের গবেষণাধর্মী বইটিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। লরেন্স লিফসুলজ্‌ তার ‘বাংলাদেশ :দ্য আনফিনিশড রিভোলিউশন’ বইতে স্পষ্ট ইংগিত করেছিলেন যে সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার আয়োজন সম্পর্কে পূর্বাপর অবগত ছিল। খোন্দকার মোশতাক আমেরিকান লবির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন বহুকাল থেকেই (অন্তত ১৯৭১ সাল থেকে তো বটেই)-একথা এখন প্রমাণিত।  Rogue States এবং Killing Hope-র লেখক উইলিয়াম ব্লুমকে আমি চিঠি লিখেছিলাম মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকা প্রসঙ্গে তিনি কিছু জানেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, মুজিব-হত্যা তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল না। তিনি তার বইয়ে মূলত লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার ওপরেই মনোনিবেশ করেছেন। পক্ষান্তরে, আমার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তিগত আলাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞরা সিআইএ-র জড়িত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেননি। ঢাকায় সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে অভ্যুত্থানের বিষয়টি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ন্যাপ-সিপিবির পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে অরক্ষিত থাকার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে। কমরেড মণি সিংহ নিজে এ বিষয়ে বলেছিলেন, মোজাফফর আহমদও বলেছিলেন বাড়তি নিরাপত্তা গ্রহণের বিষয়ে। দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিংগার গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্‌স স্পষ্টত অবস্থান নিয়েছিলেন মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকার পক্ষে। সেখানে হিচেনস সরাসরিভাবে অভিযোগটি তুলেছেন: ‘Kissinger was responsible for the killing of thousands of people, including Sheikh Mujibur Rahman’। একদিন নিশ্চয়ই এর পক্ষে বা বিপক্ষে অকাট্য প্রমাণ মিলবে। কোনো গোপন উইকিলিকসে ফাঁস হয়ে পড়বে মার্কিন প্রশাসনের আর্কাইভে লুকিয়ে থাকা, এখনও অপ্রকাশিত, কোনো দলিল-পত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের দেশি-বিদেশি চক্রান্তের খুঁটিনাটি।
তবে মুজিব-হত্যার পরপরই যেভাবে ইং-মার্কিন মূলধারার পত্র-পত্রিকাগুলো সমস্বরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ক্যারেকটার-এসাসিনেশনে লেগে গিয়েছিল তা আজ কিছু অবাক করে বৈকি। তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে শুধু ‘ডিক্টেটর’ বলে আক্রমণ করা নয়, তার পরিবারের সদস্যদের কারও কারও প্রতি কল্পিত অভিযোগ ছড়াতেও তারা সেদিন দ্বিধা করেনি। গুজবের প্রকাশ ও প্রচার করা সাধারণত সৎ সাংবাদিকতার নিয়ম-রীতিবিরুদ্ধ। প্রায় অসভ্যতার পর্যায়ে এটি পড়ে। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্‌ পত্রিকায় কেভিন রেপার্টি মুজিব সম্পর্কে কল্পিত অভিযোগ এনে লিখেছেন :’নিজের পরিবারের লোকজনের আর্থিক স্বার্থ আদায়ের প্রতি তার নজর ছিল। তিনি নিজে ঘুষ নিয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। কারণ তা নেওয়ার তো তার প্রয়োজন ছিল না।…তবে অনেকেই তার ছেলেদের এবং অন্য আত্মীয়দের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।…গল্পটি সত্য না বানানো তা বিচার করতে যাওয়া অবান্তর, কারণ বহু লোক এ গল্পের সত্যতায় বিশ্বাস করে এবং এ গল্প বহু লোকের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে।’ এই হচ্ছে পাশ্চাত্যের সৎ-সাংবাদিকতার নমুনা! দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করে- কখনও শেখ মনি, কখনও গাজী গোলাম মোস্তফাকে ঘিরে গাল-গল্প বানিয়ে এবং গুজব ছড়িয়ে। এর জন্য ঢাকার তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে মুজিববিদ্বেষী মনোবৃত্তিও কম দায়ী নয়। মুজিব খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না; মুজিব বুদ্ধিজীবীদের অপছন্দ করেন; মুজিব সবসময় ইনসিকিওরিটিতে ভুগতে থাকেন; মুজিব তার অহমিকাবোধে আবদ্ধ; এসব কথা পাশ্চাত্যের অনেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনর্গল লিখতে দ্বিধা করেননি। এভাবে ‘ফেইক নিউজ’ তারা তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে শুধু ‘হক-কথা’কে দায়ী করলে ভুল করা হবে। আজ তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,’ ‘আমার দেখা নয়াচীন’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে সেদিনের জটিল-কুটিল সমালোচক স্বভাবের ঢাকার মধ্যবিত্তদের অনেকেরই কিছুটা হলেও বোধোদয় ঘটছে হয়তো। তারা এখন ভাবছেন যে শেখ মুজিবকে ‘যতটা অশিক্ষিত’ বলে মনে করে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম, ততটা অশিক্ষিত তিনি নন আসলে। চিন্তাবিদ না হলেও সবকিছু নিয়েই চিন্তা করতে পারেন দেখছি! ঢাকার মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে এই অসাধুতা গত ৫০ বছর ধরে দেখে আসছি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মুজিব নাকি ইংরেজি বলতে ভুল করেছিলেন, সে নিয়ে কী হাস্য-তামাশা সেদিন মধ্যবিত্তদের ড্রইং রুমে। আজ তারাই বলছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে আমাদের তাকে বুঝতে। হি ওয়াজ আ গ্রেট, গ্রেট ম্যান।’ এই শঠতা আমাদের পীড়া দেয়। এই মধ্যবিত্তের সঙ্গে শঠতার দৌড়ে সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটেছেন সেদিনের বিদেশি সাংবাদিকেরা। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করাই ভুল হয়েছিল এমন মন্তব্য ছিল তাদের। ১৯৭৫ সালের ৩০ জানুয়ারি সংখ্যায় বোস্টন হেরাল্ড মন্তব্য করেছে:
”আরও পরিহাস এই যে, যে পাকিস্তানের উৎপীড়ন থেকে তিনি তার দেশবাসীকে মুক্ত করেছিলেন, সেই পাকিস্তান আজ অধিকতর মুক্ত এবং সমৃদ্ধ। গত সোমবার ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌’ প্রকাশ করেছে যে, তিন বছর আগে পরাজয় ও অবমাননা ভোগ সত্ত্বেও পাকিস্তান আজ অপ্রত্যাশিতভাবে এশিয়া মহাদেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সজীব দেশ হিসাবে দেখা দিয়েছে। যদিও এখনও গরিব দেশ, কিন্তু পাকিস্তানে অনাহারে লোক মরছে না। তাদের জীবনযাত্রার মান বেড়ে চলেছে এবং ‘দি টাইমস্‌’ পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের সরকার ধ্বংসাবশেষ কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।…পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আদর্শবাদীরা যখন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য চিৎকার করছিল, তখন আমেরিকার উচিত ছিল, পাকিস্তানকে আরও সবল সমর্থন দেওয়া।’

অবশ্য ভুট্টোর পাকিস্তানের এই প্রশংসা অচিরেই মুছে যাবে পাশ্চাত্যের সাংবাদিকবলয় থেকে। আফগানিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে ঠান্ডা যুদ্ধের লড়াইয়ে বিশ্বস্ত সাথি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন জেনারেল জিয়াউল হক। এবং ভুট্টোকে ‘হঠকারী পপুলিস্ট’ বলে ছুড়ে দেওয়া হবে অস্বীকারের খাতায়।

১৫. বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত প্রকল্প ও আজকের বাংলাদেশ
বাকশালের মাধ্যমে সমতামুখিন সমাজের স্বপ্টম্ন বাস্তবায়নের নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা বাকশালের কর্মসূচিতে ধারণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি বড় স্তম্ভ ছিল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ। সেটি বাকশালের কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে সেভাবে আলোচনায় আসেনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ফলে বাহাত্তরের সংবিধান ও বাকশাল কর্মসূচিতে বিধৃত সমতামুখিন সমাজের সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া হয়। শুধু ভুলে যাওয়াই নয়, অর্থনীতি-রাজনীতি চলতে থাকে এক নিষ্ঠুর অমানবিক সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫-১৯৯০ পর্বে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছে একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সে সময়ে যারা ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর গঠন বা তার কার্যাবলির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকতেন, তাদের প্রত্যেকেই নানা ধরনের দৈহিক-মানসিক-বৈষয়িক হয়রানির শিকার হতেন। আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে নিছক বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে ১৫ আগস্টের শোকসভায় উপস্থিত থাকাকে বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্ণধাররা ভালো চোখে দেখতেন না। তা সে বিলেতেই হোক, আর তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেই হোক। মৃত বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা হচ্ছে, তাকে প্রতীক রেখে তরুণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হচ্ছে এক জায়গায়, তাকে মনে রেখে তারা সমতামুখিন সমাজের কথা বলছে, এটা জিয়া-এরশাদের সামরিক সরকার আর তাদের অধীন দূতাবাসগুলোর পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হতো। যারা সেদিন সেসব গোপন বা প্রকাশ্য সভায় জড়ো হতেন ওয়াশিংটনে, লন্ডনে, মস্কোয় কিংবা ঢাকায়; তারা ঝুঁকি নিয়েই অংশ নিতেন সেখানে। তাদের নামের তালিকা চলে যেত গোয়েন্দা দপ্তরে। জীবিত মুজিবের তুলনায় মৃত মুজিবের প্রভাব প্রতিবছরেই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর নাম ক্রমশ অর্থনৈতিক সমতা, সামাজিক ন্যায় এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমার্থক ধারণায় পরিণত হচ্ছিল সচেতন অথবা অসচেতনভাবে। এই যোগাযোগ সময়ের সঙ্গে আরও দৃঢ় গণভিত্তি পেয়েছে। আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং সমতামুখিন আকাঙ্ক্ষার আলোচনা তাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’? এ প্রশ্ন আজ উঠতেই পারে।
সমকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে গতিধারা বিশ্নেষণের কাজটি বর্তমান লেখার আওতার বাইরে। কিন্তু কিছু প্রাথমিক মন্তব্য করা যায়। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ ধারণাটি নিয়ে সর্বস্তরে (পাঠ্যবইসহ বলছি) যতটা আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল, ততটা এ দেশে এখনও হয়নি। ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজতন্ত্র নির্মাণের’ বর্তমান কালের চ্যালেঞ্জ আলোচনা করার জন্য নূ্যনতম শর্ত হলোু সমাজতন্ত্রকে আগে ‘কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা। বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির অংশ হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে ঠিকই (২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে), কিন্তু এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে করা হয়নি। গণতন্ত্র ও মার্কেট-ইকোনমি রেখে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কীভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প হতে পারে, তা নিয়ে গভীর আলোচনার দরকার রয়েছে। স্বাধীনতা, উৎপাদন-নৈপুণ্য এবং বণ্টনগত সাম্যু এই ত্রিবিধ লক্ষ্যের মধ্যে সমীকরণ কষতে হবে এবং উন্নয়নের নানামাত্রিক ঝোঁকের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। সামাজিক ন্যায়-দর্শনের একটি উদাহরণ দিয়ে সমস্যাটি চিহ্নিত করা যায়।
[ক্রমশ]