অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. বিনায়ক সেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক। তাঁর মৌলিক গবেষণার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, বৈষম্য, শ্রমবাজার, সামাজিক সুরক্ষা, মানব উন্নয়ন, সুশাসন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ইত্যাদি। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৩০টির বেশি গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গত তিন দশকে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন। দেশের গত তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ‘অর্থনীতিবিদ প্যানেল’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। বিনায়ক সেন ১৯৮২ সালে রাশিয়ার মস্কো লমনসভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে এমএসসি এবং ১৯৮৫ সালে ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সমকাল: এবারের জাতীয় বাজেটকে মোটাদাগে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিনায়ক সেন: বর্তমান বিশ্ব এবং অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো কোনো বাজেট হয়তো দেওয়া যেত। তবে যেটি দেওয়া হয়েছে, তা একেবারে খারাপ হয়নি। গত কয়েক মাস দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান ওঠানামার কারণে আশঙ্কা করা হয়েছিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল এ বছর অর্জিত হবে না। আমার মনে হয়, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেখার কোনো কারণ নেই।
এর পেছনে আমি দুটো কারণ বলছি। গত কয়েক বছরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার একই রকম আছে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বিনিয়োগের হার ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বিনিয়োগের হার মোটামুটি একই হওয়ার পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কখনও ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, কখনও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, কখনও ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, কখনও ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং এবার বাজেটে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ বেশ ওঠানামা ছিল। এর মানে শুধু বিনিয়োগের হার দ্বারাই প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত হয় না। বাহ্যিক অভিঘাত এলে প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বিনিয়োগ একই থাকলে যদি উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং অন্যান্য সামাজিক সূচক শক্তিশালী থাকে, অর্থাৎ আমরা যাকে রেজিলিয়েন্স বা ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বলি, সেটি থাকলে প্রবৃদ্ধির হার ভালো থাকে। তা ছাড়া এ বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে প্রবৃদ্ধির ওপর কিছুটা বাড়তি সুফল আমরা দেখতে পাব। তবে কৃচ্ছ্র সাধনের এ বছরে চাহিদা ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, এখন তো একটা অভিঘাত এসেছে। তবে এটি কভিডের মতো অভিঘাত কিনা দেখতে হবে। আমার মতে, অবশ্যই নয়। কভিডের অভিঘাতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। এখনকার যে অভিঘাত, তা সুনির্দিষ্ট অর্থাৎ তেল, গ্যাস এবং খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা আমদানিনির্ভর। কিন্তু খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর নই। চালের ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। গম কিছুটা আমদানি করতে হয়। সেটারও একটা রাস্তা আমরা বের করেছি। ভারত থেকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অনেক গম আমদানি করছি। এ কারণে খাদ্যশস্যের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল। চালের দাম তিন থেকে চার টাকার মতো কেজিতে বেড়েছে। যদি আমরা চালের সরকারি সংগ্রহ বা ক্রয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারি, তাহলে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অনেকটা সহজ হবে। তবে আমাদের মজুত করার ক্ষমতা সীমিত। ২০ লাখ টনের মতো চাল মজুত করার সামর্থ্য আছে। বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, এ বছর ২০ লাখ থেকে ৩১ লাখ টন মজুত করার সামর্থ্য অর্জন করা হবে। এটি আগেই করা উচিত ছিল। ১০ বছর ধরে আটটি সাইলো নির্মাণাধীন। আশুগঞ্জ এবং আরও দুয়েকটা হয়তো দ্রুত হয়ে যাবে। বাকিগুলোর কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে। সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সমগ্র উৎপাদনের ৬ শতাংশের মতো ক্রয় করে। আমাদের অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক ঝুঁকি বিবেচনায় এটি অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। তাহলে খাদ্যশস্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকবে না। তবে এ বছর উপর্যুপরি বন্যা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে আমন উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে।
আমার মতে, এবারের বাজেট ভারসাম্যপূর্ণ। আমদানির রাশ টানা এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের উৎপাদনকে সহায়তা করার পদক্ষেপ রয়েছে। দেশীয় শিল্পের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ।
সমকাল: আপনি কি মনে করেন, বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?
বিনায়ক সেন: বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বছর যত না প্রবৃদ্ধির বছর, তার চাইতে বেশি হলো সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষার বছর। দুর্গতির বছরে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার প্রধান সূচক তিনটি- মূল্যস্ম্ফীতির হার, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্য এবং বাজেট ঘাটতি সহনীয় রাখা। তিনটি ক্ষেত্রেই আমরা যথাসময়ে উদ্যোগ নিয়েছি। খাদ্যশস্যের মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ভালো। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই। সরকার বলেছে, ধাপে ধাপে অল্প করে দাম সমন্বয় করা হবে। বাজেট ঘাটতি মোটামুটি একটা সীমার মধ্যে (জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ) রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারি ব্যয়ের হার কমিয়ে আনা হয়েছে, যা অস্বস্তির বছরে বাজেটের একটা ভালো দিক। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আগামী অর্থবছরে যা কমিয়ে ১৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর মানে, সচেতনভাবে সরকারি ব্যয়ের অনুপাত কমানো হয়েছে। এর পেছনে কারণ হলো, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত আকাঙ্ক্ষা করতেন, সরকারি ব্যয় জিডিপির ২০ শতাংশে উন্নীত হোক। ভারতে যেখানে এটি ২৪ শতাংশ। বেশি ব্যয় করলে সরকার জনগণের জন্য অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু এ বছর সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ব্যয় বাড়ানোর চাইতে ব্যবহারের ওপর এবং অসমাপ্ত অগ্রাধিকার প্রকল্পে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমদানিনির্ভর নয় এমন খাত, বিশেষ করে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন উৎসাহিত করা হয়েছে এবং পোশাক ও পোশাকবহির্ভূত রপ্তানি খাতের মধ্যে আয়করের হারে সমতা আনা হয়েছে। এর ফলে রপ্তানি একদিকে বাড়বে, অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রেমিট্যান্স বাড়বে। সেই সঙ্গে আমদানির চাহিদা, যা গত বছরে সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৬০ শতাংশের মতো বেড়েছিল, সেখানে রাশ টানা হয়েছে বাজেটের আগেই। এখন হয়তো এটি ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে। এর ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমদানি প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের মধ্যে নেমে যাবে বলে মনে হয়। এসব উদ্যোগ না নিলে চলতি হিসাবে ঘাটতি জিডিপির ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ হয়ে যেত। এখন মনে হচ্ছে, ঘাটতি ২ থেকে আড়াই শতাংশের মধ্যে থাকবে। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়ে, বিনিময় হার বাড়িয়ে এবং বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এলসি মার্জিনের হার বাড়ানো হয়েছে। তবে এগুলো দুর্বল ‘পলিসি ইনস্ট্রুমেন্ট’। এ কারণে টাকার বাজার নির্ধারিত মূল্যমানের দিকেই যেতে হয়েছে।
বাজেট ঘাটতির ক্ষেত্রেও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে মূল্যস্ম্ফীতির হার আগামী অর্থবছরে বড় কোনো মাথাব্যথার কারণ হবে বলে মনে হয় না, যদি বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ না করে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হলো মূল্যস্ম্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা। যদি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যেও থাকে তাহলে দুর্গতির বছরে তা খারাপ নয়। ২০১০-এর দশকের প্রথমার্ধে মূল্যস্ফীতির হার ৭ থেকে ৮ শতাংশ ছিল। এর কারণ ছিল, ২০০৭-০৮ এর অর্থনৈতিক সংকটের রেশ চলছিল। এর পরে কিছুটা কমে আসে। এখন আবার বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশে একটু বাড়বে, এটা স্বাভাবিক।
সব মিলিয়ে বলব, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে বাজেট দেওয়া হয়েছে। এখন বুঝতে হবে, স্থিতিশীলতা না হয় অর্জিত হলো; প্রবৃদ্ধি কি সাড়ে ৭ শতাংশ অর্জিত হবে? প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। দুর্গতির বছরে যদি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশও হয় এবং সেই প্রবৃদ্ধি যদি কম বৈষম্যপূর্ণ থাকে, তাহলে বৈষম্যযুক্ত সাড়ে ৭ শতাংশের চেয়েও তা ভালো।
সমকাল: বাজেট কি বৈষম্য কমানোর দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে বলে মনে হয়?
বিনায়ক সেন: বৈষম্য কমানোর প্রবৃদ্ধির দিকে যদি আমরা যেতে চাই তাহলে যেগুলো বৈষম্য বাড়ায়, এমন পদক্ষেপ বাদ দিতে হবে। পুরো বাজেট বক্তৃতায় সম্পদ করের কোনো আলাপ দেখলাম না। দ্বিতীয় কথা হলো, আর্থিক খাত নিয়ে তেমন কোনো আলাপ নেই। মন্দ ঋণ নিয়ে কিছু বলা হয়নি। যদিও এটি বাজেটের বিষয় নয়। তবে বাজেটের ওপর পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। মাঝে মাঝে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মন্দ ঋণ মওকুফ করে দিতে হয়। অন্যদিকে যদি খেলাপি ঋণ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায় অথবা দেশের ভেতর থেকে ফেরত না আসে, তাহলে উৎপাদনশীল ঋণগ্রহীতারা ঠিকমতো ঋণ পান না। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং কর প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অর্থমন্ত্রী যদি বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার পরিকল্পনা করেন, তাহলে দেশের ভেতরে যাঁরা টাকা নিয়ে ফেরত না দিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন, তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারছেন না কেন?
আমার মতে, বৈষম্য কমাতে যাঁদের সুবাদে জিডিপি বাড়ছে, তাঁদের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখনও ১০০ টাকা। কিছু সুবিধা মিলিয়ে বড়জোর ২০০ টাকা হতে পারে। এটা তো হতে পারে না। শিল্প শ্রমিক বিশেষত পোশাক শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৫ বছর কর্মক্ষম থাকে। যে সময়টা তারা কর্মক্ষেত্রে ঢোকে, তখন হলো পড়ার সময়। আমার ধারণা, একটা সময়ে তাদের মোবিলিটি আটকে যায়। তারা গ্রামে চলে যায় কিংবা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে অন্য খাতে কাজ করে। সুতরাং তাদের জন্য শুধু সামাজিক সুরক্ষা নয়; নৈশকালীন শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দেশ গঠনের জন্য জার্মানি এবং ব্রিটেনে এটি ব্যাপকভাবে করা হয়েছে। সুতরাং শিল্পায়নের পাশাপাশি শ্রমিক পরিবারের জন্য নৈশকালীন সাধারণ শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষার জন্য সার্বিক একটি পরিকল্পনা নিতে হবে। তাদের জন্য বহু কিছু করার বাকি।
সমকাল: সামাজিক নিরাপত্তা খাত তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে অনেকে বলছেন। আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
বিনায়ক সেন: সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হবে। সবার জন্য একটা পেনশন স্কিমের দিকে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। আগামী অর্থবছরে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, তা দেখার বিষয়। তবে অভিপ্রায়টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা নিঃসন্দেহে অনেক বড় উদ্যোগ।
আমার মতে, প্রবৃদ্ধি সুষম করতে হলে এত সম্পদ, এত প্রবৃদ্ধি যাদের জন্য, সেই শিল্প শ্রমিকদের জন্য বাড়তি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে শিল্প খাত। ১৯৯১-৯২ সালে ম্যানুফাকচারিং বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১০ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে তা হয়েছে ২০ শতাংশ। শিল্প খাতে শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে, জিডিপিতে অবদানও বেড়েছে। উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সামাজিক অভিঘাতের দিক থেকে শিল্প খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শ্রমিক পরিবার কমবেশি বঞ্চিত। মূলত সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গ্রাম ঘিরে এবং শহরের কিছু বস্তিবাসী এর মধ্যে রয়েছে। আমার প্রস্তাব, ৫০ লাখ পোশাক শ্রমিক এবং এর বাইরের ৩০ লাখ শ্রমিকের জন্য অন্তত চাল-ডাল-ভোজ্যতেলের রেশন ব্যবস্থা চালু করা হোক। এটি করা সহজ। আমরা নগর দরিদ্রদের তালিকা নেই বলে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করছি। টার্গেটিং কীভাবে করব, কখন হবে টার্গেটিং- এভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। এ জন্য নির্দিষ্টভাবে আশুলিয়া, টঙ্গী, ডেমরা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার আশপাশে গড়ে ওঠা বৃহৎ শিল্পকারখানা এলাকায় যেখানে প্রচুর শ্রমিক পরিবার বাস করে, সেখানে রেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ জন্য নতুন করে কোনো টার্গেটিং লাগবে না। এতেশিল্প মালিকদেরও লাভ হবে। কারণ, মজুরি না বাড়লেও রেশন চালু হলে শ্রমিকদের জন্য মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়া সহজ হবে। এ জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটলে হবে না। একটি সুসমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে করতে হবে।
সমকাল: বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর পরিশোধের মাধ্যমে বৈধতা দানের উদ্যোগকে কীভাবে দেখেন?
বিনায়ক সেন: পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ এখনকার সময়ের জন্য মোটামুটি ভালো এই বিবেচনায় যে, এতে যদি কিছু টাকা ফেরত আসে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি একটি মরিয়া চেষ্টা। পানামা পেপারসে যাঁদের নাম আছে, বিদেশে যাঁরা ব্যাংকে টাকা রেখেছেন, তাঁরা ফেরত আনবেন বলে মনে হয় না। নিয়ে আসার ইচ্ছা থাকলে তো তাঁরা এখনই পারেন। ওই টাকা তাঁরা বিদেশ থেকে নিয়ে এসে কালো টাকা সাদা করার বিধানের সুযোগ নিতে পারেন। আমার মনে হয়, দেশের ভেতরে যে টাকা কালো হয়ে আছে এবং সাদা করা হয়নি, সেই টাকা হুন্ডি হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে এবং সাদা হয়ে সগর্বে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে আবার দেশে ঢুকবে। কিছু লোক হয়তো আসলেই বিদেশে থাকা সম্পদ দেশে এনে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি ঘটবে বেশি।
সমকাল: শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা আরেকটু অগ্রাধিকার পেতে পারত কিনা?
বিনায়ক সেন: বাজেটের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়েনি। শিক্ষায় সামান্য বেড়েছে, তবে প্রাথমিক শিক্ষায়। সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমেছে। এ রকম একটি সংকোচনের বছরে কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি কাটছাঁট করা উচিত হয়নি। অসহায় মানুষের জন্য ৫০০ টাকা কিংবা ৭০০ টাকা করে ভাতা অনেক বছর ধরে চলছে। এটি অবশ্যই বাড়ানো উচিত। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের যে বাজেট, তা তো অর্ধেকের মতো খরচই হয় না। বাজেটে যে ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানো অর্থাৎ তাদের ব্যয় করার সামর্থ্য বাড়ানো। সরকার যদি তা করতে পারে তাহলে অন্তত যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা খরচ হবে। সরকার শহর এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক চালুর চিন্তা করতে পারে। কভিডের সময় দেখা গেছে, শহরের মানুষের জন্য কোনো কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক নেই। অন্যদিকে পুষ্টির ক্ষেত্রে অনেক বেশি বৈষম্য বিদ্যমান। শহর এলাকায় সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবার এবং সবচেয়ে গরিব ২০ শতাংশ পরিবারের মধ্যে খর্বকায় শিশু থাকার পার্থক্য তিন গুণ। ধনী-গরিবের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে এত!
আমি একটি বিশেষ প্রস্তাব করতে চাই এবং তা হলো শিক্ষাকেন্দ্রিক একটি ২৪ ঘণ্টার টেলিভিশন চ্যানেল চালু করা। ভারত এবারের বাজেটে উন্নয়নকেন্দ্রিক একটি টিভি চ্যানেল চালুর ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষার জন্য টিভি চ্যানেল চালু করলে এ খাতে ঘাটতি কমানো এবং ধনী ও গরিবের বৈষম্য অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।