মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫১

পূর্বে প্রকাশিতের পর

৬. নিম্নবর্গের প্রতিক্রিয়া

স্থানীয় জনগণের মধ্যে জনস্বাস্থ্য- কার্যক্রমের কার্যত অনুপস্থিতির ফল হয়েছিল মারাত্মক। তাদের বড় একটি অংশ ঝুঁকে পড়েছিল বিভিন্ন রোগের দেবদেবীর (দেবীরই প্রাবল্য সে তালিকায় অবশ্য বেশি) সাধনায়, আর ক্ষুদ্র একটি অংশ রমেশ বা জগমোহনের মতো নিয়োজিত ছিল আত্মশক্তি-অনুপ্রাণিত স্বনির্ভর স্বাস্থ্য কার্যক্রমে। এদের একটি ধারা ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদকে’ প্রতিহত করতে চেয়েছে অনেকটা ভাবাদর্শগত বা রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত হয়েই। এ প্রসঙ্গে ১৯৩০-র দশকে প্রকাশিত ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ উল্লেখ করা যেতে পারে।

সাধারণ পঞ্জিকার তুলনায় এই ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ পার্থক্য ছিল এই যে, এখানে শুধু গ্রহ-তিথির আসা-যাওয়ার সংবাদই থাকত না, স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শও দেওয়া হতো। গীতার সদুপদেশ কে-ই বা শুনে বা মনে রাখে, কেননা তার বক্তব্য বেশ জটিল। পঞ্জিকাকে যদি ‘স্বাস্থ্য-গীতা’ করে তোলা যায়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শ বৃহত্তর (শিক্ষিত) জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সেসব স্বাস্থ্য-পরামর্শের মধ্যে দুটি ধারা ছিল। একটি হচ্ছে, বিদেশি বিশেষত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচনা; অপরটি হচ্ছে দেশীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রশংসা। বিদেশি চিকিৎসার পদ্ধতি এ দেশে অচল, কেননা বিদেশি জীবনচর্চার ধরন এ দেশের জল-হাওয়ার সাথে মিলবে না। এ দেশের মানুষের শরীরের উন্নতির জন্য চাই এর সংস্কৃতি-ধর্ম-পরিবেশের উপযোগী স্বাস্থ্য-জ্ঞান। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সমর্থকরা যেভাবে টীকা দিয়ে বা সুঁই ফুটিয়ে রোগ নিরাময় করতে চাচ্ছে, এটা আপামর জনগণের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাদের রক্ষা করার জন্য আছে এ দেশেরই শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র। এই অভিমত স্পষ্টতই ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের তত্ত্বকে এরা সন্দেহের চোখে দেখেছেন- প্রায় ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’ বলে ভেবেছেন- এক প্রকার ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার ও বায়ো-পাওয়ার ধারণার থেকে এই প্রতিরোধের ডিসকোর্স একেবারেই আলাদা। একে নিছক আধুনিকতার’ সাথে ‘প্রাক্‌-আধুনিকতার’ দ্বন্দ্ব, বা ‘প্রগতিপন্থা’ আর ‘রক্ষণশীলতার’ মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল করা হবে। এই দ্বন্দ্ব তৈরিই হতো না, বা হলেও এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না, যদি উনিশ-বিশ শতকে এ দেশের মহামারি বা মারির উদ্ভব মোকাবিলায় ইংরেজ সরকার প্রকৃত অর্থেই জনগণের স্বাস্থ্য-পরিস্থিতি বা জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হতেন।

এ ক্ষেত্রে আমি মো. উমর মুশতাকের ‘পাবলিক হেলথ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া : এ ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব দ্য হিস্টরি অন মেডিকেল স্টাডিসেস অ্যান্ড ডিজিজ প্রিভেনশন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধটির সাহায্য নিয়েছি। সবিস্তারে বলি। সিপাহি বিদ্রোহের পরে ১৮৬৮ সালে বাংলায় একটি পৃথক ‘সিভিল মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’ গঠিত হয় এবং ১৮৬৯ সালে একটি ‘পাবলিক হেলথ কমিশনার’-এর পদ সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই বিভাগ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। কেবলমাত্র ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সাংবিধানিক সংস্কারের পরেই সুস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং জন্ম-মৃত্যু সংক্রান্ত ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ বিভাগের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৮০ সালে পৌরসভা এলাকায় এবং ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বাসরত সকল শিশুদের জন্য টীকাদান বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এর প্রয়োগ সীমিত ছিল মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮০-৮১ সালে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে টীকাদানের হার ছিল মাত্র ২.৭ শতাংশ; ১৯০২-০৩ সালে তা সামান্য বেড়ে ৩.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ, উপনিবেশের গ্রামাঞ্চল এই টীকা কার্যক্রমের বাইরে ছিল। অথচ কিছুদিন পর পর মহামারির মুখোমুখি হতে হয়েছে উপনিবেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে। যেমন, প্লেগ হয়েছে ১৮১২ সালে গুজরাটে ও সিন্ধু প্রদেশে (প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছিল এর তাণ্ডবলীলা); হয়েছে ১৮২৮-২৯ সালে পাঞ্জাবে; ১৮৩৬ সালে রাজপুতানায়; ১৮৯৬ সাল থেকে ব্যুবনিক প্লেগ প্রথমে মারাত্মক আকার ধারণ করে বোম্বাই, পুনে, কলকাতা ও করাচির মতো বড় বড় শহরে এবং পরে সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে যায়। এক হিসাবে, ১৯০৩ সাল পর্যন্ত প্লেগের কারণে মারা যায় প্রায় ২০ লাখ লোক। এবার আসি কলেরার প্রসঙ্গে। ১৮১৭-২১ সালজুড়ে মহামারি হিসেবে কলেরা বাংলা থেকে শুরু হয়ে এক সময় সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর জন্য দায়ী করা হয় ট্রপিক্যাল দেশের জন-হাওয়াকে এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে দলবেঁধে মেলা উদযাপন, ধর্মীয় উৎসব পালন, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি ‘সাংস্কৃতিক উপাদানকে’। ১৮৬৮ সালে এসে কলেরা মহামারির কারণ খতিয়ে দেখতে সর্বপ্রথম ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি করে

ঔপনিবেশিক সরকার। কলেরা রোধে বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং পয়নিস্কাশন ব্যবস্থার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা এ নিয়েও কমিটির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৮৬২ সাল থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে, পাঞ্জাবে, বাংলায় কলেরা প্রায় প্রতি বছরই দেখা দিয়েছিল। একই কথা খাটে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে। তবে এ ক্ষেত্রে ১৮৮১ সালের পর থেকে কিছুটা ‘ব্রেক-থ্রু’ হয়। সেটা ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসেসের অধীনে সদ্য যোগ দেওয়া সার্জেন্ট মেজর রোনাল্ড রসের গবেষণার কারণে। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় এনোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট ছড়ানোর চক্র তিনি আবিস্কার করেছিলেন (এর জন্য ১৯০২ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান)। কুইনাইনের বড়ি চালু হওয়ার পরও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ চলতেই থাকে। তার একটি বড় কারণ হলো মশার বিস্তার রোধে ব্যর্থতা এবং ‘ড্রেইনেজ সিস্টেমের’ শোচনীয় পরিস্থিতি। এত সাতকাহন সবিস্তারে উল্লেখ করার কারণ হলো, উনিশ-বিশ শতকে (স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত) কি জনস্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে, কি বিভিন্ন মহামারির বিস্তাররোধে তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়নি উপনিবেশের পটভূমিতে। ঔপনিবেশিক সরকারের কাছ থেকে দমন-পীড়ন-লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা কেবল পেয়েছে এ দেশের জনগণ, কোনো ‘বায়ো-পাওয়ার’-এর অভিজ্ঞতা মেলেনি তাদের। সন্দেহ কী, স্থানীয় জনগণের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসা-পদ্ধতি ও পাশ্চাত্যের প্রচার করা ‘জনস্বাস্থ্যের’ ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিরূপ ও প্রতিরোধী মনোভাব এখানে গড়ে উঠবে। সেকালের পঞ্জিকা ঘাটলে এ রকম প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তকে শনাক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের ‘পাঁজিতে স্বাস্থ্যচর্চা’ প্রবন্ধের ওপরে (গৌতম ভদ্র সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত) আমি নির্ভর করেছি।

মহামারির মুখে পড়ে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জয়গান গাওয়া হয়েছে এভাবে :

‘যুগে যুগে সামাজিক রাষ্ট্রীয় আকার,

কিছু কিছু রূপান্তর হয় বটে তার।

অবিকৃত কিন্তু স্বাস্থ্য-বিধি সনাতন;

হাসিমুখে বলিয়াছি সে সব বচন,

চরক, সুশ্রুত, অত্রী, হায়ীত, নারদ,

মনু, পরাশর আদি লিখেছে বিশদ,

আয়ু রক্ষণের কত মহামূল্য কথা!

ঘটে দুঃখ সে সবার করিলে অন্যথা।’

যেটা বিস্ময়কর, মহামারির কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে সনাতন ধর্মের পতন এবং ক্রমবর্ধমান অনৈতিকতাকে। অবশ্য পাশাপাশি পাশ্চাত্যের জীবাণু তত্ত্বেরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অগ্রাধিকার স্বীকার করেই। ধর্মের পতন এবং নৈতিকতার স্খলন যে-স্বাস্থ্যহানির জন্য দায়ী তাতে স্বাস্থ্য-গীতার লেখকদের মনে কোনো সন্দেহ নেই:

‘বিরুদ্ধ ভোজন আর অহিত ভোজন,

অসাধু আলাপ, বৃথা কালের যাপন;

পুস্করিণীতে শৌচত্যাগ, ঘরে থুথু ফেলা,

বাসিমুখে পানাহার, নিদ্রা সন্ধ্যা বেলা,

অবৈধ সঙ্গম আদি বদভ্যাস হয়;-

জানিবে শাস্ত্রীয় বাক্য মিথ্যা ইহা নয়।’

পাশ্চাত্যের জীবাণু-তত্ত্বের সাথে মেশানো হয়েছে প্রাচ্যের আয়ুর্বেদশাস্ত্র। এসেছে মহামারি প্রতিরোধের প্রসঙ্গ :

‘এইবার বলি কিছু জীবাণু-জীবন;

বিবিধ রোগের যারা প্রধান কারণ।

আয়ুর্বেদে ইহাদেরই সূক্ষ্ণ কৃমি নাম,

এদেরই মারণ-মন্ত্র দেছে যজু: সাম।

যত কিছু সংক্রামক প্রাণহারী ব্যাধি,

এই সূক্ষ্ণ জীবদান সে সবার আদি।

বিসূচিকা, ক্ষয়কাস, ম্যালেরিয়া আর,

দাঁতের গোড়ার রোগ, ধনুষ্টংকার,

তালু-ক্ষত, বাতশ্নেষ্ফ্মা, আর কালাজ্বর,

আমাশয় আদি জন্মে জীবাণু-ভিতর।

চর্ম্মচক্ষে ইহাদের দেখা নাহি যায়;

নিতে হয় অণুবীক্ষ্য-যন্ত্রের সহায়।’

দেখা যাচ্ছে, ১৯২৬ সালের এই পঞ্জিকাটিতে যে ধরনের ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’ প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে যেমন আছে সনাতনী রক্ষণশীলতা, তেমনি আছে আধুনিক বিজ্ঞানকে স্বীকার করার দৃষ্টিভঙ্গি। আয়ুর্বেদ এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মধ্যে একটা সংশ্নেষণ করে ভারতীয় ধারার একটা আধুনিকতা সৃষ্টিরও চেষ্টা পাই এতে। এই ‘স্বাস্থ্যধর্ম গৃহ পঞ্জিকা’ বের করেছিলেন কার্তিক চন্দ্র বসু- তিনি নিজে পাশ্চাত্য ডাক্তারি বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন এবং ১৮৯৯ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সুবিখ্যাত বেঙ্গল কেমিক্যালসে যোগ দেন। একপর্যায়ে রোগ নিরূপণ ও ভেষজ ওষুধ তৈরি করার জন্য নিজেই শুরু করেন ‘বোসেজ ল্যাবরেটরি।’ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে ভেষজ তত্ত্বের মিল ঘটিয়ে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এভাবেই মহামারি স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছিল।

তবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদের সাথে শহরের এবং গ্রামের নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। প্রতিদিনের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামের মধ্যে যখন তারা মারি বা মহামারিতে আক্রান্ত হতেন, তখন তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল দূরের ঈশ্বর যাকে তারা নানা দেব-দেবীর বিগ্রহ মূর্তিতে পূজা করত। এই ঐতিহ্য পুরাকাল থেকেই চলে আসছে। কুশান যুগে যক্ষ-দেবী হারিতি (ঐধৎরঃর)-এর পূজা করা হতো – ইনি তুষ্ট থাকলে সকল আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করতেন। এর মধ্যে ছিল গুটি-বসন্ত, উচ্চহারে শিশু-মৃত্যু, জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃ-মৃত্যু প্রভৃতি। কথিত আছে, পরে তিনি বুদ্ধদেবের শিষ্যা হয়ে বৌদ্ধ দেবী হয়ে ওঠেন। কনিস্ক সাম্রাজ্যে গুটি-বসন্তের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন বৌদ্ধ -স্তুপার ভেতরে হারিতিকে উৎসর্গ করা বিগ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়। হারিতি দেবীর ক্ষমতা ছিল জ্বরের উচ্চমাত্রাকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার- এর ফলে যে কোন জ্বরকে শীতল করার দেবী হিসেবেও তাকে দেখা হয়। পরবর্তীতে এই হারিতি দেবীই বাংলায় এসে হয়ে ওঠেন লোক-দেবী শীতলা-নামের ভেতরেই তার ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে। ‘শীতল করে দিতে পারেন’ সব জ্বরকে, এবং এভাবেই তিনি সারিয়ে তোলেন জ্বরের রোগীকে। শুধু গুটিবসন্ত নয়, সকল জ্বরের উপশমের দেবী হচ্ছেন এই শীতলা দেবী। অন্ত্যজ শ্রেণীর নাপিত, মুচি, কামার, কুমোর, চর্মকার প্রভৃতি পেশাবর্গের মধ্যে (সাধারণভাবে দক্ষিণবঙ্গের কৃষক শ্রেণীর ভেতরে) শীতলা দেবীকে জাগ্রত দেবী হিসেবে সাড়ম্বরে পূজা করা হয়ে থাকে এখনো। লোক-কল্পনায় কোন অজ্ঞাত কারণে শীতলা দেবীর বাহন হচ্ছে গাধা-হয়তো ভারবাহী প্রাণীকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়েছে বাহন রূপে। গুটিবসন্ত ও হামের দেবী যেমন শীতলা, তেমনি কলেরার দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ওলাই চন্ডী (হিন্দুদের মধ্যে) এবং ওলা বিবি (মুসলমানদের মধ্যে)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক রালফ নিকোলাস মনে করেন যে, বাংলায় লোক-দেবী হিসেবে মনসা ও শীতলা উভয় দেবীরই পূজা বলেও শীতলাই খানিকটা এগিয়ে আছেন। অন্য কিছু চর্চায়, সর্পদেবী মনসা ও ষষ্ঠীর সাথে শীতলা দেবীকে অভিন্ত জ্ঞান করা হয়েছে। বোম্বাইয়ের পূর্ব-কথিত ১৮৯৯ সালের প্লেগের সময়ে এক ‘প্লেগমাতার’ আবির্ভাব হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘বোম্বাই কি মায়ান’, কিন্তু তার পূজা হতো শীতলা মন্দিরে। এ নিয়ে ও.ঔ.ঈধঃধহধপয তার ‘ প্লেগ এন্ড দ্যা ইন্ডিয়ান ভিলেজ : ১৮১৬-১৯১৪’ প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তবে শীতলা দেবীর নাম প্রদেশ-ভেদে ভিন্ন হতে পারে। তামিলনাড়ূতে বসন্ত রোগের দেবীর নাম মারি আম্মা, দক্ষিণ আরকটে তার নাম কান্নি আম্মা। নাম যা-ই হোক, এই সকল লোকদেবীর পূজা-অর্চনার উদ্দেশ্য একটাই- জনস্বাস্থ্য- সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মহামারি থেকে রক্ষা করা।

[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫০
পূর্বে প্রকাশিতের পর
ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো- ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে… ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা। অন্য সবকিছুরই স্থান তার নীচে।’ এভাবেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শহরে ক্যান্টনমেন্ট, সিভিল লাইন, হিল স্টেশন, সামার রিসোর্ট ইত্যাদি। এক কথায়, প্রথম প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর হলো, ঔপনিবেশিক আমলের জনস্বাস্থ্য নীতি ছিল বৈষম্যমূলক এবং সেখানে জনগণের কোনো স্থান ছিল না। এটি ছিল মূলত এলিটদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য নীতি। জনগণ পেত তার নিজস্ব বিশ্বাসে-চর্চায় ঘেরা এক সংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাৎপদ স্বাস্থ্য খাত, আর এলিটরা পেত সেকালের মানদণ্ডে আধুনিক ও উন্নততর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা।
এই দ্বৈত খাতবিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য চিন্তা উপনিবেশ-উত্তর আধুনিক রাষ্ট্রেও পরিলক্ষিত হয়। এ দেশে তাই দেখতে পাচ্ছি যে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা’ গড়ে ওঠেনি, যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই নূ্যনতম এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাবেন নির্ভরযোগ্যভাবে। কেন গড়ে ওঠেনি তার একটা কারণ বোধ করি এই যে, এলিটরা ভেবেছিলেন তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য ‘জনস্বাস্থ্য’ জাতীয় কোনো ব্যবস্থার আদৌ দরকার নেই। সে রকম বিপদ এলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা লাভ করা যাবে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর তো এমন কিছু দূরত্বে অবস্থান করছে না! কিন্তু এখন করোনাকালের লকডাউনের কারণে তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ। এখন বুঝি তারা বুঝতে পারছে, আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশের ভেতরেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বর্তমানের মহামারি-সংকট তো নয়ই, ভবিষ্যতের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিও মোকাবিলা করা যাবে না। কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে আদৌ আশাবাদী নই। বিল গেটসের মতো আমিও মনে করি, পরিবর্তন আসে তবেই যদি মনে থাকে। কিন্তু মানুষের স্মৃতি খুবই স্বল্পায়ু।
৫. মহামারির প্রভাব : রাষ্ট্রে-দর্শনে
প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারির প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়েছে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে। এই প্রভাব যেমন পড়েছে সমাজে-রাষ্ট্রে, তেমনি সাহিত্যে-দর্শনে। সামগ্রিকভাবে মানবজীবনের ইতিহাসে। অতীত আলোচনার একটি তাৎপর্য ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনার ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তার সুবিখ্যাত ‘রেকুইম ফর এ নান’ উপন্যাসের একটি উক্তি অনেকটা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে- The past is never dead. It’s not even past| এবার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু ব্যক্তি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করেছিলেন এ কথা জানতে চেয়ে, কেন তাদের রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে বাধ্য করছে? স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে তাদের কি মুক্ত থাকার অধিকার নেই? এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফিরে যেতে হলো অতীতে- ১৮৯৭ সালের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্যাক্ট’কে সাক্ষী মানতে হলো। মমতা বললেন, ‘যাতে কেউই আরোগ্য লাভ না করে কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যেতে না পারে- জনগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে- [১৮৯৭ সালের] আইন পুনরুজ্জীবিত করা হলো।’
অতীত যদিও নবায়িত হয়ে ফিরে আসে পুনরায়, অবস্থাভেদে তার প্রত্যাবর্তনের ‘ইমপ্যাক্ট’ হয় বিভিন্ন রকম। মহামারির অভিঘাত বিভিন্ন সমাজে ও কালে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে এসেছে। মহামারি প্রতিরোধে ইউরোপের চিন্তার বিবর্তন উঠে এসেছে মিশেল ফুকোর লেখায়। লন্ডনের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ’ (যা ছিল ব্যুবনিক প্লেগ)-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে লন্ডন শহরে ১৬৬৫ সালে। এতে শহরটির ১৫ শতাংশ নাগরিকই মৃত্যুবরণ করেন। এই প্লেগে আরও অনেক বেশি লোকের মৃত্যু হতে পারত, কিন্তু অধিকাংশ লোকই যে যেভাবে পারে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। স্বয়ং রাজা (দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্ব তখন) তার সভাসদসহ অক্সফোর্ডে পালিয়ে যান। আজকে যেখানে অলগেট (Aldgate)- যেখানে এখন অধিকাংশ বাঙালি ও অভিবাসী বাস করেন- সেই এলাকাটিকে প্লেগে নিহতদের গণকবর দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন। এ রকমই আরেকটি গণকবর ক্ষেত্র ছিল ফিনস্‌বিউরি ফিল্ডস্‌। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল জনতার প্রতিক্রিয়া। যে বাড়িতে কোনো প্লেগের রোগী পাওয়া যেত সেই বাড়িকে বাইরের থেকে সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হতো। এতে করে ওই খানার অন্যান্য সদস্যেরও মৃত্যু হতো- প্লেগে অথবা অনাহারে! ঠিক পরের বছরে (১৬৬৬ সালে) লন্ডনে অগ্নিকাণ্ডে তার পুরো কেন্দ্রস্থলই ভস্মীভূত হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, এই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল প্লেগবাহী ইঁদুরেরা। এই প্লেগ হওয়ার প্রায় ৬০ বছর পরে রবিনসন ক্রুসোর লেখক ড্যানিয়েল ড্যাফো লেখেন ‘এ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’। ড্যাফো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, কিন্তু এমনভাবে লিখেছেন বিবরণী যেন তিনি ঘটনা-পরম্পরার সামনেই অবস্থান করেছিলেন।
১৩৪৬-৪৮ সালের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ আর ১৬৬৫ সালের ‘গ্রেট প্লেগ’ দুটিই ছিল প্লেগের মহামারি। এই অভিজ্ঞতা থেকে দুটো সুস্পষ্ট প্রবণতা বেরিয়ে আসে, যা রাষ্ট্রকে স্বৈরাচারী ক্ষমতা-প্রয়োগের পরিবর্তে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’ (Disciplinary Power)  বা জনজীবনে নিয়ম-শৃঙ্খলা আচরণভিত্তিক ক্ষমতা-প্রয়োগের দিকে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন আসত না যদি-না প্লেগের মতো মহামারি হতো। এই মহামারির সুবাদে রাষ্ট্র বাধ্য করে নাগরিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলতে। নাগরিকদের সমন্ত জীবনচর্চা তখন থেকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ মডেলে আবর্তিত হতে থাকে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে বশীভূত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যস্ততায়। উদ্ভাবিত হয় জবরদস্তিমূলক কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি ‘স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন থাকার’ (বা সেলফ আইসোলেশন) অভ্যাস। করোনারকালেও এখন আমরা এদেশে বা বিশ্বজুড়েই ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের প্রয়োগ দেখছি। বিদেশফেরত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবর্গ বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বলেছেন যে তাদেরকে এয়ারপোর্টে ‘১৪ দিনের’ সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে এবং সেটি তারা এখন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। করোনার মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রেরও একটি নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর বলয়। প্রতিদিন রোগতত্ত্ব বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য-বুলেটিন পড়ে শোনাচ্ছে টিভিতে এবং নাগরিকরা তা শুনে তাদের প্রাত্যহিকের জীবনযাপনে স্বাস্থবিধি মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন- অন্তত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায়। কোয়ারেন্টাইন বা সেলফ্‌ কোয়ারেন্টাইনে থাকছে সংক্রমিত খানাসমূহ (ব্যক্তি বা পরিবার), কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সমগ্র পাড়া বা গোটা এলাকাই। এভাবেই শৃঙ্খলাবদ্ধ নাগরিকে পরিণত হচ্ছি আমরা- হয়তো ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, কোরিয়া, চীন বা সিঙ্গাপুরের মতো অতটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নই এখনও- কিন্তু গতিমুখটা সেদিকেই। একটা চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞানকে অবলম্বন করে এই ক্ষমতার প্রয়োগ করছে রাষ্ট্র। এটি খারাপ না ভালো- সে বিবেচনায় ফুকো যাননি। তিনি শুধু দেখিয়েছেন কীভাবে ডেসপট বা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে শাসন করার পরিবর্তে অন্য ধরনের বিশেষায়িত ‘ক্ষমতারও’ উদ্ভব হয় এবং রাষ্ট্র তার প্রজাকুলের ওপরে প্রভুত্ব করার জন্য একটি বাড়তি হাতিয়ার পেয়ে যায়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে প্লেগ নামক মহামারি প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের প্রচলিত দমনমূলক যন্ত্রগুলোর পাশাপাশি এই অদৃষ্টপূর্ব শৃঙ্খলাপরায়ণ অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজের উদ্ভব হয়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দীপেশ চক্রবর্তী ও অন্যদের সূত্র ধরে উপনিবেশিক পটভূমিতে মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে আমরা ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এরই প্রয়োগ দেখেছি। যার ভিত্তি ছিল কোয়ারেন্টাইন মডেল এবং শ্বেতাঙ্গদের জন্য ‘বিচ্ছিন্ন থাকার’ ক্যান্টনমেন্ট মডেল- যা নেটিভদের কাছ থেকে উপনিবেশের অফিসার-সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
তবে ১৮২৬-৩৭ সালের একের পর এক বিধ্বংসী কলেরা মহামারি প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খোদ ইংল্যান্ডেই এই কোয়ারেন্টাইন ও সেলফ আইসোলেশনভিত্তিক ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর মডেল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই মহামারিকে ‘এশিয়াটিক কলেরা প্যানডেমিক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় যেহেতু এটার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বঙ্গদেশে। বাংলায় এই মহামারির শুরু ১৮১৭-২৪ কালপর্বে; ধীরে ধীরে তা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগের জন্য হয়তো কার্যকর ছিল, কিন্তু কলেরা কোয়ারেন্টাইন মানে না। এর জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আরও সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির। ঠিক এ রকম সন্ধিক্ষণে জন্ম নিল আরেক অদৃষ্টপূর্ব অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজ- যার ভিত্তি হলো ‘বায়ো-পাওয়ার’  (Bio-Power)। এর মানে এই নয় যে আগের শৃঙ্খলাপরায়ণতাভিত্তিক ক্ষমতার প্রয়োগ বা ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার রাষ্ট্র-ক্ষমতার বলয় থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষা না করে আর কাজ চালানো যাচ্ছিল না। কলেরা, বসন্ত, হাম, যক্ষ্ণা প্রভৃতি রোগের ঘন ঘন প্রাদুর্ভাব রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল Bio-Power-র কথা ভাবতে। ১৮৩০-র দশকে চার্টিস্টদের আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল শ্রমিকদের বাসস্থানের সমস্যা- তাদের জীবনযাপনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা ছিল কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারির প্রজনন ক্ষেত্র। শ্রমিকদের অমানবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে তরুণ মার্কস লিখেছেন সে সময়ে ‘দ্য হাউসিং প্রবলেমস্‌’, আর তরুণ অ্যাংগেলস্‌ লিখেছেন ‘কন্ডিশনস্‌ অব ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’। এক কথায়,  Disciplinary Power স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে তার একচ্ছত্র হেজিমনি হারাল নতুন পরিস্থিতিতে। তবে এর প্রয়োগ যথারীতি চলতে থাকল জীবনযাত্রার অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত কল-কারখানায়, জেলখানায় এবং বিদ্যানিকেতনে (ফুকো সে সম্পর্কে আলাদা করে লিখেছেন তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে)।
১৮৯৭ সালের ঔপনিবেশিক ভারতের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্য্যাক্ট’ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারকে তুলে ধরেছে। প্লেগে সংক্রমিত হলে সরকারি পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে বেঁধে হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়েছে সেখানে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রায় পুরোটাজুড়েই এই জোর করে ‘বিচ্ছিন্ন রাখার’ নীতিই কার্যকর ছিল। আমরা আগেই দেখেছি, প্রকৃত অর্থে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি, বা উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতির বহুল প্রসার করার দিকে অগ্রসর হয়নি উপনিবেশের সরকার। সেটা হলে আমরা ঔপনিবেশিক বায়ো-পাওয়ারকে বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখতে পেতাম। ১৮৯৭ সালের এপিডেমিক ডিজিসেস অ্যাক্ট যখন প্রণীত হচ্ছে, তার পরের বছরেই কলকাতায় প্লেগের আক্রমণ হবে, আর ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে লেগে যাবে প্লেগ নিয়ে দাঙ্গা। অর্থাৎ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের ‘ডিসিপ্লিন’ উপনিবেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করা যায়নি। ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২) গ্রন্থে ভূদেব এ নিয়ে ইতিপূর্বেই কড়া অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, ভারতবর্ষে ৬০ বছর ও তার ওপরে বয়স্ক লোকের সংখ্যা (১৮৮১ সালের আদমশুমাুরি অনুযায়ী) মাত্র ৪ শতাংশ। এর কারণ, এখানে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি, এবং অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে দুর্ভিক্ষে অথবা কিছুদিন পর পর ঘটে যাওয়া মারি-মহামারিতে ভারতবর্ষের মানুষ অকালেই মারা যাচ্ছে। ভূদেব অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘অনূ্যন পাঁচ কোটি ভারতবাসী অর্ধাশনে জীবনযাপন করে… এক প্রকার নিশ্চয় হইয়াই গিয়াছে যে, প্রতি দশ এগারো বৎসর অন্তর ভারতবর্ষে একটি করিয়া বৃহৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাহার পরেই একটি করিয়া মহামারি আসিয়া উপস্থিত হয়।’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। প্রায় একই সময়ে লেখা ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কেন ‘চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু’ লিখেছেন তার কারণটি বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।
ফুকোর ভাষ্য থেকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে মহামারি রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের ধরন ও ধারণাকে বদলে দিয়েছিল। রানী ভিক্টোরিয়া উনিশ শতকে লন্ডন শহরে পয়ঃনিস্কাশন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এভাবেই সেখানে গড়ে ওঠে আন্ডারগ্রাউন্ড স্যুয়ারেজ সিস্টেম (যেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে জার্মান বিমান হামলার সময় রাত্রিকালীন ‘শেল্টার’ হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল)। এই যে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলো মহামারি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য তাকেই ফুকো বলেছেন ইরড়-চড়বিৎ। উপনিবেশের দেশগুলো এই ইরড়-চড়বিৎ-এর সুবিধাটুকু পায়নি।
[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

মহামারি প্রতিরোধ :ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভূমিকা
উপরের সব প্রশ্নের এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। শুধু দ্বিতীয় প্রশ্নটির কয়েকটি দিকের প্রতি সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জন্য ‘জনস্বাস্থ্যের’ বিষয়টি ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত। বাণিজ্য করতে এসে বঙ্গদেশে তিনটি গ্রাম নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন তার কাজ-কর্ম শুরু করে তখনও ‘জনস্বাস্থ্য’ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হারানোর পর বাংলায় (এবং বাংলাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য প্রদেশ) অবাধ উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ এলো কোম্পানির সামনে প্রথম বারের মতো। আরো বেশি বেশি করে সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দিল। কোম্পানি শাসনের অংশ হিসেবে দাঁড় করাতে হলো এক নতুন আমলাতন্ত্রের। এ জন্য অনেক শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারী বিলেত থেকে এলেন; তা ছাড়া ভাগ্যান্বেষী ইংরেজরা তো ছিলেনই, যারা নতুন উপনিবেশে এসে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই ঔপনির্বেশিক কর্মযজ্ঞের পথে প্রধান বাধা হয়ে দঁড়িয়েছিল এদেশের আলো-হাওয়া। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘শরীর, সম্পদ ও রাষ্ট্র :ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জন সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, জনস্বাস্থ্যের মূল নিহিত ছিল ‘একটি নিতান্তই সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনীতিক প্রশ্নে : শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা কি গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়তে পারবেন?’ এই প্রয়োজন মেটাতেই ১৭৬৮ সালে প্রকাশিত হয় জে. লিন্ড রচিত বই- এসে অন ডিসিসেস ইন্সিডেন্ট অফ ইউরোপিয়ানস ইন হট ক্লাইমেটস। এর কয়েক বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিকেল সার্ভিস চালু হয় ১৭৬৪ সালে। সে সময়কার ‘রুলিং আইডিয়া’ ছিল- গরম দেশগুলোর আবহাওয়া শ্বেতাঙ্গ মানুষদের জন্য আখেরে অস্বাস্থ্যকর। ফলে সেখানে তাদের দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব চালানো কঠিন। এই থিওরির ভিত্তি ছিল- ‘মায়াস্‌মা’ বা পূতিবাষ্প তত্ত্ব। মায়াস্‌মা বা অশুভ হাওয়া-তত্ত্বের জন্ম চতুর্দশ শতাব্দীর ইউরোপে, যখন ‘কালো মৃত্যু’র (Black Death) করাল-গ্রাসে ইউরোপের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৩৪৬-৪৮ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে প্লেগের কারণে এই মৃত্যু ঘটে। এর আগেও প্লেগ এসেছিল ইউরোপে, কিন্তু সেবার চীন থেকে প্লেগের যে স্ট্রেইনটি আসে তা লণ্ডভণ্ড করে দেয় ইউরোপের সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির সবকিছু। সে সময়ের বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার মান আজকের মতো ছিল না। সে জন্যই অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই তত্ত্বের মূল কথা ছিল, প্লেগ ও কলেরার মতো রোগগুলি পচনশীল দেহ (মানুষ বা প্রাণী) থেকে বাতাসে ছড়ায় এবং একবার সেই ‘খারাপ বাতাস’ গায়ে লাগলে মানুষ তাতে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ১৮৬০ সালে যখন ‘জীবাণু-তত্ত্ব’ আবিস্কৃত হলো তখন জন্ম হলো এক নতুন শাস্ত্রের, যার নাম ট্রপিক্যাল মেডিসিন। পচনশীল শরীর এবং হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো এই শরীর-নির্গত অশুভ বাষ্পকণা- এর বিপরীতে পরবর্তীকালে এসেছিল জীবাণু-তত্ত্ব অর্থাৎ প্লেগ, কলেরা, বসন্ত প্রতিটি রোগের পেছনে রয়েছে বিশেষ বিশেষ জীবাণুর ক্রিয়াশীলতা। প্রতিটি মারি, মহামারি বা গুরুতর ব্যাধির মূলে আসলে কাজ করছে ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু। এই তত্ত্ব আবিস্কারের ফলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল- অন্তত স্বাস্থ্যগত দিক থেকে। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৯৮ সালে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি এখন স্থির নিশ্চিত যে, শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপনা করা সম্ভব।’ কিন্তু এ কথা তো বলা হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ-জয়ের প্রায় দেড়শ’ বছর পরে। ১৮ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এবং প্রায় উনিশ শতকজুড়ে তাহলে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটিকে সামাল দেওয়া হয়েছিল কী করে? নাকি জনস্বাস্থ্য বলতে সে রকম কিছু ছিলই না তখন?
সমসাময়িক নানা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে কোম্পানির সৈন্যদের মহামারি থেকে রক্ষা করাই ছিল জনস্বাস্থ্যের মূল মনোযোগের বিষয়। ১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতে ইউরোপীয় সৈন্য ও অফিসারদের মধ্যে মৃত্যুর ৯৪ শতাংশই ছিল নানাবিধ অসুখের কারণে। এর মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া জাতীয় জ্বর, কলেরা, রক্ত-আমাশা, উদরাময় প্রভৃতি অসুখ। এসব অসুখ থেকে বাঁচার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় ছিল উপনিবেশের প্রজাদের বাসস্থানের পরিবেশের উন্নতি ও উন্নত স্বাস্থ্যবিধির প্রবর্তন (যথা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিস্কাশন, যেখানে সেখানে থুতু-কফ না ফেলা, স্যানিটেশন, হাত ধোয়ার অভ্যাস ইত্যাদি)। এটা হলে কিছুদিন পরপর সংক্রামক মারির আশঙ্কা অনেকখানি লুপ্ত হতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষে এ-দায়িত্ব পালন করা কঠিন। তার উদ্দেশ্য এখানে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ প্রতিষ্ঠা নয়, বরং অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব মেনে কী করে শোষণের মাত্রা আরো তীব্র করে সম্পদ-পাচার দ্রুত গতিতে নিষ্পন্ন করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা। আইনের প্রয়োগের সূত্রে বলা হলেও এর বৃহত্তর তাৎপর্য রয়ে গেছে। উনিশ শতকের মানদণ্ড অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের যেসব রীতি ইংল্যান্ডে প্রয়োগ করা হয়েছে, পরাধীন ভারতবর্ষে তা একেবারেই অনুসৃত হয়নি। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হয়নি। পার্থ চ্যাটার্জী একেই বলেছিলেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। উনিশ শতকজুড়েই বাংলাদেশের গ্রাম ছিল একটি উপেক্ষিত বিষয়- বিশেষত জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ (১৮৮২) গ্রন্থটির কোন কোন অংশে রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভর না করে ‘পরিবার’কে সক্রিয় করতে চাওয়া হয়েছে এই কারণেই। মমার্থ এই যে, ঔপনিবেশিক রাজশক্তির কাছে জনস্বাস্থ্য-রক্ষা কর্মসূচি প্রত্যাশা করে লাভ নেই। ভারতবাসীকে বাঁচাতে হলে পারিবারিক পর্যায়েই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, নতুবা কলেরা-বসন্তে মৃত্যুবরণ করতে হবে। ভূদেবের গ্রন্থের পঞ্চদশ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘পরিচ্ছন্নতা’। সেখানে বিবরণটি এই রকম :
‘দেহ এবং গৃহস্থিত সমুদয় সামগ্রী সুবিশুদ্ধ এবং সুপরিস্কৃৃত রাখিবার অবশ্যকর্ত্তব্যতাও শাস্ত্রে যথোচিত পরিমাণে উল্লিখিত আছে। গৃহের এবং গৃহস্থিত দ্রব্যের যথোচিত বিলেপন ও সন্মার্জ্জনাদি, স্নান, ভোজন, আচমন, বস্ত্রাদির পরিবর্ত্তন প্রভৃতি ব্যাপার আমাদিগের অবশ্যকরণীয় প্রাত্যহিক কার্য্যের মধ্যেই নির্দিষ্ট। বিশেষত :গৃহস্থের বাটীতে দেববিগ্রহ ও ঠাকুরঘর রাখিবার ব্যবস্থা করিয়া সচল গৃহস্থেরই শুচিতার এবং পরিচ্ছন্নতার এক একটি আদর্শ পাইবার উপায় করা হইয়াছে। ঠাকুরঘর যেভাবে রাখ, আজকের সকল ঘর সেইভাবে রাখিলেই হইল। বস্তুত :শুচিতাপ্রিয় য়িহুদীদিগের মধ্যে সংক্রামক রোগ অল্প হয়। তাহার কারণ এই যে, গৃহে এবং গৃহোপকরণ সমস্ত অতি সুপরিস্কৃৃত করিয়া রাখিবার নিমিত্ত উহাদিগের ধর্মশাস্ত্রে আদেশ আছে, এবং য়িহুদীরা আপনাদের শাস্ত্রের আদেশ সমস্ত ভক্তিপূর্বক প্রতিপালন করে।’
তবে ভূদেব এটাও লক্ষ্য করেছেন- অর্থনৈতিক উন্নতি না হলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় উন্নতি ঘটানো একান্তভাবেই কঠিন। ‘পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকিতে সকলেই চায়- উহা ধর্ম্ম্য, স্বাস্থ্যকর এবং সাক্ষাৎ সুখপ্রদ। কিন্তু এ কথাও বলি, পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকা কিঞ্চিৎ ব্যয়সাধ্য ব্যাপার; লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হওয়া সম্যক ঘটিয়া উঠে না।’ অবশ্য যদি রাষ্ট্রতরফে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ব্যাপক জন-সচেতনা কার্যক্রম পরিচালিত হত বা আধুনিক যুগের ন্যায় স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, আবর্জনা পয়ঃনিস্কাশন প্রণালী, সুপেয় ও নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হত, তাহলে গরীবরাও পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রমে সমান তালে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে এটা আশা করা সম্ভব ছিল না।
১৯১২ সালে এদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম পাবলিক হেলথ্‌ ডাইরেক্টরেট-এর প্রতিষ্ঠা হয়। কলেরা, বসন্ত, প্লেগ জাতীয় মহামারিতে অনেক সেনা সদস্যের মৃত্যু এই প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে। অবশ্য এতে করে জনগণের স্বাস্থ্যে কোন গুণগত পরিবর্তন আসেনি। এদেশের জনসাধারণকে মারি বা মহামারি মোকাবিলায় মূলত নিজের চেষ্টার ওপরেই নির্ভর করতে হয়েছে। পাবলিক হেলথ্‌ ডিপার্টমেন্ট ‘স্বাস্থ্যবিধি’ লিখে প্রচার করেনি। তাই ভূদেবের মতো প্রাচীনপন্থি পণ্ডিতকে ‘রোগীর সেবা’ করার বিধান লিখতে হয়েছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভূদেবকে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হয়েছে :
‘গৃহস্বামী সকলকে সতর্ক করিয়া দিবেন, যেন পীড়িতের বিছানা, বালিস, বস্ত্রাদি বাটীর অপর কাহার বস্ত্রাদির সহিত না মিশে-তাহার মল, মূত্র, ক্লেদাদি বাটী হইতে অধিক দূরে নিক্ষিপ্ত এবং পরিস্কৃৃত হয়- তাহার ব্যবহূত পাত্রাদি বাটীর সাধারণ পাত্রাদি হইতে স্বতন্ত্র থাকে- এবং সেবকেরা যতদূর পারেন, যে কাপড়ে … ঘরে থাকেন, সে কাপড় না ছাড়িয়া বাটীর অপর লোকের …ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না আইসেন।’ এ যেন হাল আমলের করোনার কালের ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বিধিমালা তৈরি করছেন ভূদেব মুখ্যোপাধ্যায়।
তবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র একেবারেই এদেশীয় জনগণের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিরুত্তাপ ছিল, তা নয়। রাষ্ট্রের নিস্পৃহ হওয়ার উপায় ছিল না যখন কোন সামাজিক বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বড় আকারের সমাবেশ করার আশংকা তৈরি করত। বিশেষত, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে, এই সচেতনতা আরো তীক্ষষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেসব স্থানে প্রচুর জনসমাবেশ হতো, ঔপনিবেশিক সরকার সেসব স্থানের ওপরে কড়া নজরদারি রাখতেন। সাব-অলটার্ন হিস্টোরিয়ান ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ সরকার হরিদ্বারের কুম্ভমেলা, এলাহাবাদের প্রয়োগের মেলা, পুরীর জগন্নাথধাম, অল্প্রব্দপ্রদেশের তিরুপতি, তামিলদেশের কাঞ্চিপুরম, মহারাষ্ট্রের নাসিক প্রভৃতি ধর্মীয় মেলা ও তীর্থস্থানে বড় ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি দেখতেন। এসব উৎসব এলেই তারা ‘নার্ভাস’ বোধ করতেন। গণহারে যেহেতু তখন প্রতিষেধক ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না- সময়টাকে মোটা দাগে ‘প্রি-ভ্যাকসিনেশন যুগ’ বলতে পারি- উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া ঔপনিবেশিক সরকারের বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দল বেঁধে তীর্থযাত্রা, গঙ্গায় স্নান, ঈদের বড় জমায়েত ইত্যাদি সামাজিক প্রথায় হাত দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিরতই থাকতে হয় রাষ্ট্রপক্ষকে। বিশেষত ১৮৯৯ সালের প্লেগ দমনের একটা পর্যায়ে বোম্বাই ও অন্যান্য শহরে যখন দাঙ্গা বেধে যায়, তার পরে আর রাষ্ট্রশক্তি জনজীবনে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করেনি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনযাত্রায় উদ্ধুদ্ধ করা নয় (যা ছিল ভূদেব, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের উদ্দেশ্য)। বরং নিজেদেরকেই মহামারি বা মারির ‘অশুভ হাওয়া’ থেকে রক্ষা করা। এলক্ষ্যেই ইংরেজ সৈন্য, অফিসার ও রাজকর্মচারীরা যেখানে থাকতেন, সেগুলোকে ‘মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট’-এর আদলে শহরের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি শহরে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় ইংরেজদের চলা-ফেরা, রাস্তা-ঘাট, বাসস্থান, ক্লাব, খেলার মাঠের জন্য স্বতন্ত্র এলাকা, যার সংস্পর্শে আসার কোন সুযোগ ছিল না ‘নেটিভদের’। ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো – ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে…ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা।
[ক্রমশ]

মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল

এ সময়ই পদ্মা বোট থেকে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় প্লেগ ত খুব জেগে উঠচে। আপনার বুঝি স্থানত্যাগ করতে সম্মত নন?’

এ প্রসংগে নিবেদিতার কথাও উল্লেখ করা যায়। বিবেকানন্দের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মিস মার্গারেট নোবল আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। বিবেকানন্দ ওর নাম দেন- ‘নিবেদিতা’। নিবেদিতা যখন ১৮৯৮ সালে কলকাতায় পা রাখলেন, তখন চতুর্দিকে প্লেগের পদধ্বনি। ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দাঙ্গাও হয়। কলকাতা তথা বঙ্গদেশেও এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। ‘নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ :এক বিতর্কিত সম্পর্কের উন্মোচন’ বইতে দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষে অমানুষিক সেবাকাজ চালিয়ে কলকাতায় ফিরে নিবেদিতা ম্যালেরিয়া ও “ব্রেন ফিভারে” [সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া অথবা এন্‌কেফেলাইটিস] শয্যাশায়ী।’ সেসময় মানে ১৯০৬ সাল। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে লিখেছিলেন- ‘নিবেদিতা যে আপনার ওখানে পীড়িত অবস্থায় তাহা আমি জানিতাম না – আমি একখানা বই চাহিয়া তাঁহাকে কলিকাতার ঠিকানায় কয়েকদিন হইল পত্র লিখিয়াছি। আপনি দয়া করিয়া এমন ব্যবস্থা করিবেন যে, পত্রের যেন তিনি কোন নোটিস না লন। তাঁহাকে আমার সাদর নমস্কার জানাইবেন এবং বলিবেন যে, উৎসুক চিত্তে তাঁহার আরোগ্য প্রত্যাশায় রহিলাম।’ নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ। সুহৃদ জগদীশচন্দ্রের মাধ্যমে নিবেদিতার সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবোটে অতিথি হয়েও গিয়েছিলেন তিনি, পূর্ববঙ্গের কৃষকদের অন্তঃপুরে গিয়ে আপনজনের মত করে গ্রামের মা-বোনদের সাথে কথা বলেছেন। গেছেন অনেকবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও। এই যাওয়ার পেছনে ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের পরিবারকুলের একাংশকে বিবেকানন্দ-নিবেদিতার সংঘ-কার্যক্রমে “দলে ভেড়ানোর” ইচ্ছেও তার থাকা অসম্ভব ছিল না। সরলা দেবীকে তো প্রায় দলে টেনেই নিয়েছিলেন। এ নিয়েও রবীন্দ্রনাথের সাথে মনোমালিন্য হতে পারে তার। তার ছোট মেয়েকে (মীরা?) ইংরেজি শেখানোর জন্য অনুরোধ নিবেদিতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- সেটাও একটা কারণ হতে পারে। নিবেদিতার প্রত্যাখ্যান ছিল তীক্ষষ্ট, এমনকি রূঢ়:’সে কি! ঠাকুরবংশের মেয়েকে একটি বিলাতী খুকি বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে!’ শুধু তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথের পাশ্চাত্য-বিমুগ্ধতার প্রতি কটাক্ষ করে আইরীশ নিবেদিতা বললেন :”ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতায় আপনি এমনই আবিষ্ট হয়েছেন যে নিজের মেয়েকে ফোটবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চান?” এই অসংকোচে মত রাখার প্রবণতা নিবেদিতার মধ্যে ছিল। রবীন্দ্রনাথের সাথে জাগতিক আধ্যাত্মিক মত ও পথ নিয়ে মাঝেমাঝেই তুমুল তর্ক বেঁধে যেত। তার সবটুকু আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু জেনেছি যে (সাহিত্যিক বনফুলের স্মৃতিচারণার সুবাদে), ‘গোরা’ উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিতে নিবেদিতাই পীড়াপিড়ি করেছিলেন এবং এর ফলে উপন্যাসের বিয়োগান্ত পরিণতি একটি ইতিবাচক সমাপ্তিতে শেষ হয়। বনফুল লিখেছেন :

“[গোরার ] শেষটা বদল দিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। নিবেদিতা নাছোড় হয়ে ধরে বসল। আবার ঢেলে সাজালাম সব।”

“গোরার শেষটা অন্যরকম ছিল?”

“হ্যাঁ। আমি গল্পটা বিয়োগান্ত করেছিলাম।…গল্পটা ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীতে বেরুচ্ছিল। কিন্তু ওটা আগেই লেখা হয়েছিল আমার। নিবেদিতা তখন বলল- গোরার শেষটা কী রকম করেছেন দেখি। দেখালাম। পড়েই সে বলে উঠল- না না, এ রকম হতে পারে না। ওদের মিলন না হলে বড়ই নিদারুণ ব্যাপার হবে যে। বাস্তব জগতে যা ঘটে না কাব্যের জগতেও কবি সেটা ঘটিয়ে দেবেন না? কাব্যের ও জগৎ তো আপনার সৃষ্টি, ওখানে আপনি অত নিষ্ঠুর হবেন না। ওদের মিলন ঘটিয়ে দিন। দিতেই হবে। এমন জেদ করতে লাগলে যে রাজি হতে হলো। সবটা আবার ঢেলে সাজালাম।” গোরা উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা করেছিলেন তা আর কারো জন্য তিনি কখনো করেননি। এর একটি কারণ হতে পারে, দেশব্রতী গোরার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন নিবেদিতারই কাছ থেকে। শিল্পী নন্দলাল বসু স্মৃতিচারণা করেছেন পদ্মায় বোটে করে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র ও নিবেদিতার আলাপচারিতা সম্পর্কে :’তাহাদের আলোচনার বিষয় আমি কিছু জানি না। তবে শুনেছি, ‘গোরা’ উপন্যাসের hero গোরা সিস্টারকে মনে করে করেছিলেন।’ আমার ধারণা, নিবেদিতার আদর্শ-রূপ তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৮৯৮ সালে কলকাতার প্লেগের সময়ে। ভয়-ভ্রুক্ষেপহীনভাবে নিবেদিতা তখন প্রকৃতই আর্তের ‘ভগিনী’ হয়ে প্লেগের মত মহামারীর কালে বিপন্নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই তেজোদৃপ্ত মূর্তি, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ এবং সন্ন্যাসিনীর মত ত্যাগী পথচলা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মত ছিল না।

প্লেগের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে সেসময়ই। এর আগে প্লেগ সম্পর্কে শুনেছেন, কিন্তু অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা, ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করা, আর্তজনের পাশে দাঁড়ানো তার এই প্রথম এবং তা সিস্টার নিবেদিতার সাথে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। এ সম্পর্কে প্রথমে শুনব এডওয়ার্ড টমসনের (বিখ্যাত ইংরেজ বামপন্থী দার্শনিক ই, পি, টমসনের পিতা) ভাষ্যে। টমসন লিখেছেন : ‘That year [1998] plague broke out in Calcutta; she [Sister Nivedita] organized relief work, assisted by Tagore’ । দ্বিতীয় উৎস শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণা :’সেইসময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন।’ পরের বছরে, অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে প্লেগ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছিল কলকাতায়। প্লেগের টিকা দিতে জনগণের একাংশের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা ছিল। যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না, সেখানে বিদেশী শাসকের টিকা নিয়ে শেষটায় ‘জাত খোয়াতে হবে নাকি’, এই অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। ‘ঈধষপঁঃঃধ ঘড়ঃবং নু ধহ ঊহমষরংয খধফু’ শীর্ষক রচনায় নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন যে, কয়েকটি পরিবার, বিশেষত ঠাকুর পরিবার দৃঢ়তার সহিত এই বিক্ষোভ প্রশমন করিতে চাহিয়াছেন’। ১৯০৯-এ গোরা প্রকাশের দু’বছরের মাথাতেই নিবেদিতার মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির চমকপ্রদ অনুবাদ নিবেদিতারই করা (তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়)। তিনিই রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রথম অনুবাদিকা। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু- রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতার দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার নাম দিয়েছিলেন- লোকমাতা।

আমি বলতে চাইছি যে, মহামারীর ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো, গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস। মহামারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় তার ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায় (স্বদেশী সমাজ, লোকহিত প্রভৃতি প্রবন্ধে), এমনকি তার এই সময়কার দেশাত্মবোধক গানের বিচ্ছিন্ন চরণে। রোগক্লিষ্ট আর্তমানবতার বেদনাকে অনন্ত শক্তির বোধে রূপান্তরের জন্যই রচিত হয় তার নৈবেদ্য ও গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও সংগীত। মারী ও মহামারী তার সৃষ্টিশীলতাকে মানবতাবাদের দিকে প্রভাবিত করেছে।

এই মানবতাবাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের জগমোহন চরিত্র। তিনি আস্তিক বা নাস্তিক সে পরিচয় গৌণ। তার পরিচয় তিনি প্লেগের দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেননি। এক-অর্থে, নাস্তিক জগমোহন আস্তিক নিবেদিতার কাউন্টার-পয়েন্ট। সেই ১৮৯৮ সালে- যে বছরে কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল- নিবেদিতাও রাস্তায় নেমেছিলেন, জগমোহনও রাস্তায় নেমেছিলেন। নিবেদিতা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু জগমোহন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বিবরণটা এই :

‘যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তক্‌মা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল। শচীশের বাপ হরিমোহন ভাবিলেন, তাঁর প্রতিবেশী চামারগুলোকে সকলের আগে প্লেগে ধরিবে, সেইসঙ্গে তাঁরও গুষ্টিসুদ্ধ সহমরণ নিশ্চিত। ঘর ছাড়িয়া পালাইবার পূর্বে তিনি একবার দাদাকে গিয়া বলিলেন, দাদা, কালনায় গঙ্গার ধারে বাড়ি পাইয়াছি, যদি-

জগমোহন বলিলেন, বিলক্ষণ! এদের ফেলিয়া যাই কী করিয়া?

কাদের?

ঐ-যে চামারদের।’

একথা শুনে হরিমোহন তার ছেলে শচীশকে বললেন তার সাথে গঙ্গার ধারের বাড়িতে চলে যেতে।

[ক্রমশ]