বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আবুল ফজল একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ‘শেখ মুজিব :তাঁকে যেমন দেখেছি’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে, কিন্তু মূল লেখাগুলো রচিত হয়েছে বেশ আগেই। লেখাগুলো স্মৃতিচারণমূলক- অনেকক্ষেত্রে ‘রোজনামচা’ থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দেওয়া। ১৯৭৬ সালের ২৬ আগস্ট একটি রোজনামচায় তিনি লিখেছেন:
‘নিঃসন্দেহে শেখ ছিলেন এ যুগের সর্বপ্রধান বাঙালী। যে সর্বপ্রধান বাঙালীকে আমরা বাঙালীরাই কি না নিজের হাতে হত্যা করলাম! আশ্চর্য, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও সত্য হলো। বাঙালীকে বাঙালী বলে পরিচয় দিতে কে জুগিয়েছিল সাহস? শেখ মুজিব নয় কি? বজ্রগর্ভ আর অমিত প্রেরণার উৎস ‘জয় বাংলা’ শ্নোগান কে তুলে দিয়েছিল বাঙালীর মুখে? শেখ মুজিব নয় কি? জিন্দাবাদে সে জোর, সে চেতনা, সে উদ্দীপনা কোথায়? জয় বাংলা প্রদীপ্ত শিখা, জিন্দাবাদ ধার করা এক মৃত বুলি। গ্রাম বাংলার শতকরা নব্বইজন যার অর্থই বুঝে না। এ যুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালী মুসলমান শেখ মুজিব- এ কথা বল্লে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয় না। হিন্দু বাঙালীয়ানা আর মুসলমান বাঙালীয়ানায় কিছুটা পার্থক্য আছে। তাই মুসলমান কথাটা যোগ করলাম। তবে এ পার্থক্য সবসময় বিরোধমূলক নয়। শেখ মুজিবের বেলায় যেমন তা ছিল না। তাঁর সমগ্র মুসলমানিত্ব নিয়েই তিনি এক পরিপূর্ণ বাঙালী ছিলেন। এমন বাঙালী বিরল। এ বিরল বাঙালীটিকেই কি না হত্যা করা হয়েছে। আমরা নিজেরাই করেছি। এ যেন নিজের অঙ্গ নিজে ছেদন করা।’
এই অনুশোচনা ও পিতৃহত্যার গ্লানি জাতির বিবেককে প্রতি মুহূর্ত দংশন করছে এটা বারবার ওই পুস্তকে উচ্চারিত হয়েছে। এটা কাকতালীয় নয় যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানীর নাম ‘মুজিব নগর’ করা হয়েছিল- সেটা আর কারও নামে নয়, শেখ মুজিবের নামেই। অন্যত্র আবুল ফজল লিখেছেন: ‘এ স্বাধীনতার জন্য আমরা শেখ মুজিবের কাছে ঋণী। তিনি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর নাম যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছে। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্যতিরেকে এবং অনুপস্থিতিতে যে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল তাঁকেই করা হয়েছিল সে সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সে সরকারই নিয়ন্ত্রণ করেছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে, সে সরকারের বাস্তব বা কাল্পনিক রাজধানীর নাম ‘মুজিব নগর’ হয়েছিল। অন্য নাম কারো মাথায় আসেনি।’ ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবরের রোজনামচায় তিনি আরও লিখেছেন:
‘সাম্প্রতিক ঘটনায় শেখ সাহেবের হত্যা সম্পর্কে আমি অনবরত বিবেকের একটা দংশন অনুভব করছি। এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল দেশে, নির্মমতায় যে ঘটনার জুড়ি নেই ইতিহাসে। সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করছেন না, এ ভাবা যায় ন। আশ্চর্য, মননশীল লেখক-শিল্পীদের মধ্যেও তেমন একটা সাড়া দেখা যায়নি এ নিয়ে।… এত বড় একক ট্র্যাজিক ঘটনা তাঁরা আর কোথায় খুঁজে পাবেন লেখার জন্য?’
আবুল ফজল বারে বারে এটাই বলতে চেয়েছেন, বাঙালিদের জন্য একটি নিজস্ব স্বাধীন আবাসভূমি শেখ মুজিবই দিয়ে গেছেন, অথচ তাকেই আমরা কী অবহেলাই না করেছি তার মৃত্যুর পর- অনেক অনেক দিন পর্যন্ত! প্রশ্ন উঠতে পারে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গড়া ‘বাঙালিদের’ জন্য এক স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি তার মধ্যে কি ‘অন্য জাতি-উপজাতি’ও পড়েন? এ নিয়ে কিছুটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে গত তিন দশকে। সে বিষয়ে দ্রুত আলোকপাত করতে চাই।
এর আগে এ বিষয়ে ইংগিত দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে বঙ্গবন্ধুর ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলার মানুষ’ এই শব্দযুগলের মধ্যে বৃহত্তর পরিচিতির আভাস পাই। এই পরিচিতিকে (আইডেনটিটি) কেবল নিছক ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ (মেজোরিটারিয়ান) জনগোষ্ঠীর পরিচয় হিসেবে নির্দিষ্ট করা চলে না। এর মধ্যে প্রথাগত-অর্থে যারা বাঙালি তারাও আছেন, আবার যারা মাতৃভাষা হিসেবে বাঙালি নন, তারাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যে ধরনের ‘মহাজাতি’ গঠনের কল্পনা করেছিলেন, শেখ মুজিবের কাছে ‘বাঙালি’ ছিল তেমনি এক মহাজাতিক প্রকল্প। যার মধ্যে বাঙালি হিন্দুরাও পড়েন, বাঙালি মুসলিমও পড়েন। কারও কারও কানে এটা কষ্টকল্পিত দাবি বলে মনে হতে পারে, সে জন্যে বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নেওয়া এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেবের বক্তব্যের একটি অংশ তুলে ধরছি। এই ভাষণের প্রেক্ষাপটটি বলি। এর একদিন আগেই নির্দলীয় সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার ‘ডিসেন্ট’ ব্যক্ত করেছেন। তিনি গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন:
‘এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। এই খসড়া সংবিধানে আমাদের অবহেলিত অঞ্চলের কোন কথা নাই।… পার্বত্য চট্টগ্রাম হল বিভিন্ন জাতি-সত্তার ইতিহাস। কেমন করে সেই ইতিহাস আমাদের সংবিধানের পাতায় স্থান পেল না, তা আমি ভাবতে পারি না। সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে-পড়া, নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে। বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।’ এর কিছু পরে লারমা যোগ করলেন- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা ইতিহাস আছে এবং সেই ইতিহাসকে কেন এই সংবিধানে সংযোজিত করা হল না?… এই সংবিধানে মানুষের মনের কথা লেখা হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, মেথর, কামার, কুমার, মাঝি-মাল্লার জন্য কোন অধিকার রাখা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের অধিকারের কথাও সংবিধানে লেখা হয়নি।’ এর পর সভা পরদিন সকাল পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায়।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেদিনের বক্তব্য পুনরুক্তিমূলক ও আবেগ-আক্রান্ত ছিল। কিন্তু আবেগের আতিশয্যের কারণেই এই কথাগুলোকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো হেতু নেই। রাজনীতিতে ‘পার্সেপশন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এটা ভেবেই তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান এর পরের দিন একটি পরিশীলিত প্রত্যুত্তর দিলেন লারমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথমেই তিনি লক্ষ্য করলেন যে, ‘সংবিধানে সবকিছু লেখা থাকে না এবং সব কথা লিখেই শুধু মানুষের কল্যাণ সাধন করা যায় না। সংবিধানের পরে আসে আইন, আসে আরও অনেক কর্তব্য।’ দ্বিতীয়ত, তিনি লারমাকে ‘আঞ্চলিকতার’ কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। লারমাকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন যে, ‘আমার বন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সদস্য গণপরিষদে তাঁর অঞ্চলের কথা বলেছেন। তাতে আপত্তি নাই। কথা বলা খারাপ নয়। তবে আঞ্চলিকতা পরিহার করা অত্যন্ত প্রয়োজন, যে আঞ্চলিকতা মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।’
তৃতীয়ত, কামারুজ্জামান বললেন যে, জাতীয় পরিকল্পনার চৌহদ্দি গোটা বাংলাদেশ জুড়েই। সেই পরিকল্পনা পার্বত্যবাসীদের বাদ দিয়ে নয়। তাদের উন্নতির রাস্তা ঐ জাতীয় পরিকল্পনার নির্দেশিত পথেই নিহিত। তিনি বললেন, ‘কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, এই সমাজের কোনো অংশ অবহেলিত ও উপেক্ষিত হলে ক্ষমতাসীন সরকার যদি সেই অবহেলিত, উপেক্ষিত মানুষের জন্য কোন কিছু না করে, তাহলে তা হবে অন্যায়। আমরা কল্পনা করেছি সমস্ত অঞ্চলকে একটা অঞ্চল হিসাবে। তাই আগামী দিনে আমাদের [পার্বত্য] বন্ধুদের পরিস্কার নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, এই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন আঞ্চলিকতা থাকবে না। এই বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলকে একটি অঞ্চল হিসাবে পরিকল্পনা করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটি সামাজিক জীব হিসেবে কল্পনা করে উন্নত করা হবে।’
চতুর্থত, লারমাকে আশ্বস্ত করে তিনি বললেন যে, ‘ইতিহাস আমরা জানি, ইতিহাস আমরা অস্বীকার করি না।’ এদিকে ‘আমাদের সুতীক্ষষ্ট দৃষ্টি আছে’ এবং এটাও ঠিক যে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন অঞ্চলের প্রতি যদি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়, তাহলে অন্যায় করা হবে’। কেননা, তাতে করে ‘সেই ব্যাধি শুধু সেই অঞ্চলেই থাকবে না- সেই ব্যাধি বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরে, সারা বাংলাদেশেই ছাড়িয়ে পড়বে।’
সবশেষ, তিনি মহাজাতির মধ্যে বিভিন্ন জাতির সহাবস্থানের ইনোভেটিভ যুক্তিটি পেশ করলেন। এটি হচ্ছে ‘সেলিব্রেটিং ডাইভার্সিটির’ যুক্তি :’আমার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাইরাও অধিকার পাবেন। কোন অংশ হতেই তাঁরা বঞ্চিত হবেন না। বাঙালী হিসাবে আমরা বেঁচে থাকব। একটা জাতির অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বৈচিত্র্য অনেক বেশী, মাধুর্য অনেক বেশী। এই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে শুধু এক জাতি, এক কৃষ্টি, এক সংস্কৃতি- তা নয়। বহু অঞ্চলের বহু মানুষ আছে, তাদের নিজস্ব অনেক কিছু আছে। শত বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকব। কিন্তু সর্বোপরি থাকবে আমাদের বাঙালী জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদ অক্ষুণ্ণ রেখে সেই জাতির অভ্যন্তরের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমরা সম-দৃষ্টি রেখে আমাদের জাতীয়তাবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করব।’
এর থেকে কি কোনোভাবে এই অনুমান করা চলে যে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা পার্বত্যবাসীকে সমতলবাসী হয়ে যেতে বলেছেন, বা পাহাড়ি জনগণকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছেন? অথচ এরকমই অবাস্তব অভিযোগ তোলা হয়েছে পরবর্তীকালে কোনো কোনো মহল থেকে। এমনকি শেখ মুজিবকেও এ পরিপ্রেক্ষিতে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হননি। সেটা করা যেতেই পারে যদি তার পেছনে জোরালো যুক্তি থাকে। দুঃখের বিষয়, অতীতে এই বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দেওয়া হয়নি। যেমন, পার্বত্য ইস্যুতে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত লেখিকা তার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পন্ন পি,এইচ,ডি অভিসন্দর্ভে এই মর্মে অভিযোগ তুলেছেন যে শেখ মুজিব পাহাড়ি জনগণকে তাদের পৃথক পরিচিতি/আত্মসত্তা (আইডেনটিটি) ‘ভুলে গিয়ে বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছেন। মূল ইংরেজিতে বিবরণটি এই রকম: ‘He therefore asked the Hill people to forget about their separate identity and to become Bengalis’ এর সপক্ষে লেখিকা আমেনা মোহসীন সমর্থন হিসেবে দেখিয়েছেন একটি মাত্র তথ্যসূত্রের উৎস। সেটি হচ্ছে, অনন্ত বিহারী খীসার সঙ্গে সাক্ষাৎকার (যেটি ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে নেওয়া)। লেখিকা আমাদের জানিয়েছেন যে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা। স্বাধীনতার আগে ও পরে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য বক্তৃতা-বিবৃতি বিচার করেও অনন্ত বিহারী খীসার বক্তব্যের সমর্থনে কোনো লাইন আমি অদ্যাবধি খুঁজে পাইনি। এমনকি এই মর্মে কোনো ইংগিতও পাইনি। এটি যদি শেখ মুজিবের চিন্তার একটি ‘স্তম্ভ’ হতো তাহলে কোথাও না কোথাও এর চিহ্ন (ঃৎধপব) থাকত। বরং এর বিপরীতেই তথ্য-প্রমাণের পাল্লা ভারী। শেখ মুজিব পূর্বাপর দেশের অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী ও নৃগোষ্ঠী নিয়ে তার উন্নয়ন-বাসনা ব্যক্ত করেছেন, এবং আন্তরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ।
প্রথমত, যে সভার বরাত দিয়ে কথিত ‘বাঙালি হয়ে যেতে’ বলা হয়েছে তা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার এক মাস পরে। এর পরে ১১ এপ্রিল ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। কয়েক মাস কাজের পরে কমিটি তৎকালীন বাংলাদেশ গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধানটি উত্থাপন করে এবং অনেক আলাপ-আলোচনার পর সেটি ৪ নভেম্বর সংশোধিত হয়ে গৃহীত হয়। এখন দেখা যাক যে খসড়া সংবিধানে, গণপরিষদ বিতর্কে বা চূড়ান্তভাবে গৃহীত সংবিধানের পাঠে কোথাও পাহাড়ি জনগণকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলা হয়েছিল কিনা বা সেরকম ইংগিত দেওয়া হয়েছিল কিনা। বা কেউ সেরকম ইংগিত দিয়ে থাকলেও তা গণপরিষদের অনুমোদন পেয়েছিল কিনা। সেরকম কিছু সংবিধানে থাকলে বা গণপরিষদ বিতর্কের প্রধান সুর হয়ে দাঁড়ালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কথায় ও কাজে তা প্রতিফলিত হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু তা কি আমরা দেখতে পাই? মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাহাত্তর সালের সংবিধানের গৃহীত চূড়ান্ত পাঠে সই করেছিলেন। শুধু সই করা নয়, এই সংবিধানের বিভিন্ন অধ্যায়ের সঙ্গে তিনি সহমতও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে গভীর বোঝাবুঝির কারণে তিনি আস্থা রাখতে পেরেছিলেন যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে সংবিধান তৈরি হয়েছে তারই পথরেখা ধরে লারমার স্বপ্নেরও বাস্তবায়ন ঘটবে তথা পাহাড়ি জনগণের জীবনের আমূল উন্নয়নও ঘটবে।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৯৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


এ জন্যই ‘আমার সোনার বাংলা’ হয়েছে তার প্রিয় গান, যেখানে রয়েছে প্রকৃতি আর প্রকৃতি : আকাশ, বাতাস, বাঁশি, বটমূল, খেলাধুলা, মায়ের কোল প্রভৃতি শব্দাবলি। অন্যান্য দেশের জাতীয় সংগীতে যেমন বাজে রণ-দুন্দুভি, জাতীয় শৌর্য-বীর্যের কথা, এখানে তেমনটা নয়। আমাদের জাতীয় সংগীত যে জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে আছে, তাতে রয়েছে স্বদেশ-জননী তথা ভূ-প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি। বঙ্গবন্ধু বলছেন যে, এই অনুভূতিটাই জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান প্রেরণা।

ইকোলজিক্যাল এই অনুভূতির পাশাপাশি রয়েছে পূর্ববাংলার জনগণের একত্র-সংগ্রামের ইতিহাস, যার কথা আমি পূর্বেই বলেছি। এই সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির অংশগ্রহণের স্মৃতি। তার একটি মর্মন্তুদ বিবরণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবরের বক্তৃতায় :

‘জনাব স্পিকার সাহেব, সত্য আজ বলতে গিয়ে দুইটা জিনিস আমার সামনে আসে। একদিকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন, আর একদিকে আমার মনে আনন্দের বান বয়ে যায়। দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন এইজন্য বলি যে, আপনারা জানেন- জনাব স্পিকার সাহেব, আপনি আমার সঙ্গে বিশ বছর থেকে রাজনীতি করছেন, অন্তত বিশ বছরের ইতিহাস আপনি জানেন যে, দীর্ঘ বিশ বছর পর্যন্ত এদেশের জনসাধারণ শাসনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে, অনেক রক্তের খেলা হয়েছে বাংলার মাটিতে। বাংলার ঘরে-ঘরে আজ মাতৃহারা, পুত্রহারার আর্তনাদ। লক্ষ লক্ষ বোন আজ বিধবা। হাজার হাজার গৃহ আজ ধূলিসাৎ। কত রক্ত বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে, স্পিকার সাহেব, সে কথা চিন্তা করলে বক্তৃতা করতে আমি পারি না।’

আমি জানি না, আমাদের  memory short  কিনা! বাংলার মানুষ ভুলে যায় কিনা! কিন্তু এমন ইতিহাস আমরা পেয়েছি। একটা ঘটনা মনে আছে। এক ছেলেু সে আমার কর্মী। মিলিটারি তাকে ধরে বলল : ‘জয় বাংলা’ বলতে পারবি না। সে বলল : “জয় বাংলা!” তখন তার একটা হাত কেটে দেওয়া হলো। বলল : আর ‘জয় বাংলা’ বলবি? সে বলল: “জয় বাংলা!” তখন তার বাম হাতটি কেটে দেওয়া হলো। তার দুইখানা হাত কেটে দেওয়া হলেও সে বলল : “জয় বাংলা!” তার একখানা কান কেটে দিল। বলল : আর বলবি ‘জয় বাংলা’? সে বলল : “জয় বাংলা!” তার আর একখানা কান কেটে দিল। বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? ছেলেটি বলল : “জয় বাংলা!” তারপর তার একখানা পা কেটে দিল। বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? ছেলেটি বলল : “জয় বাংলা!” তার বাম পা কেটে ফেলে দিল। তখন তার জ্ঞান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাকে বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে করতে বলল : “জয় বাংলা! জয় বাংলা!”

‘আমার সোনার বাংলা’ গানে প্রতিফলিত নিসর্গ-স্বদেশ-জননী নিয়ে সংবেদনবোধ বা ওপরে বর্ণিত অংশে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার কাহিনি উভয়েই ‘দেশপ্রেম’-এর অনুভূতির দৃষ্টান্ত। সূক্ষ্ণভাবে দেখলে এ কথাও বলতে হয় যে, ‘দেশপ্রেম’ আর ‘জাতীয়তাবাদ’ এক নয়, কাছাকাছিও নয়। নেশন, ন্যাশনালিটি, নেশন-স্টেট ও ন্যাশনালিজমু এই চারটি ধ্যান-ধারণা একই পরিবারভুক্ত। উনিশ শতকের ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসেু নেশন-স্টেট গড়ার পর্বেু আমরা এসব ধারণার উত্থান দেখতে পাই। যখন নেশন-স্টেট ধারণার জন্মই হয়নি, তখনও দেশের মানুষের মধ্যে ‘দেশপ্রেম’ ছিল। দেশচিন্তা করার জন্য কাউকে কোনো-না-কোনো জাতীয়তাবাদের আশ্রিত হতে হবে- ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। রবীন্দ্রনাথ কখনোই ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাননি। যখনই এর মুখোমুখি হয়েছেন, তখনই তিনি ন্যাশনালিজম বা নেশন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি মনে করতেন এই উপমহাদেশ কখনোই ‘নেশন’ ছিল নাুন্যাশনালিজমের পথে হাঁটেনি। প্রাচীন বা মধ্যযুগে অনেকবারই এই ভূভাগ বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং সেটা প্রতিহত করতে দেশের মানুষেরা সেকালের রাজাদের পেছনে সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সেটা কোনো ন্যাশনালিজমের কারণে নয়ু নিখাদ দেশপ্রেমের কারণে। প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য ‘বাইরের শক্তি’ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশপ্রেমিকদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, কিন্তু দেশপ্রেম আরও বড় জাগতিক বোধ যাকে শুধু প্রতিরোধ বা যুদ্ধের ভাষায় সীমাবদ্ধ করা চলে না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় যেমন ‘গুরুমশাই, দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে’, যেখানে নৈশ পাঠশালায় মাস্টারমশাই দেশের মানচিত্র ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাচ্ছেন। দেশের মানচিত্র হচ্ছে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ, আর মানচিত্রের ভেতরের অদৃশ্য মানুষেরা হচ্ছে দেশপ্রেম। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ যেমন নিত্যদিনের এবং চিরকালের পরিবেশ-প্রকৃতি, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলার’ সনেটগুচ্ছ, তেমনি বাংলার নিসর্গ, নদী ও ইতিহাস। কিন্তু কোনো চিহ্ন নেই তাতে জাতীয়তাবাদের, অন্তত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ-এর অর্থে। ‘রূপসী বাংলা’ কোনো নেশন-স্টেট গড়ে তুলতে চায়নিু তবে এটা পড়তে থাকলে আমরা আবহমান বাংলা ও তার নিসর্গে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। এবং এ কারণেই কবি বলতে পারেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর মুখ খুঁজিতে চাই না আর।’ এটা দেশপ্রেমু কোনো জাতীয়তাবাদী স্টম্ফুরণ নয়। তারপরও মুজিবকে বাঙালি ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়েছে। কেননা তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে বিচরণ করছেন এবং অন্য কোনো শব্দবন্ধ তার ও তার পরিপার্শ্বের রাজনীতিকদের জানা নেই বলে। কিন্তু শব্দটি ব্যবহার করলেও তার অভিপ্রায় ভিন্ন। সে জন্যই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন জাতীয়তাবাদ মানে ‘আমার বাংলা’, ‘বাংলার মাটি’, বাংলার মানুষ’। এর বেশি কিছু তিনি দাবি করেননি। তার কাছে বাংলার মানুষই সব; এমনকি ‘বাঙালি’ এই আত্মপরিচয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘বাংলা’ শব্দটি, এবং এই বাংলায় বসবাসরত মানুষেরা। সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশ এই আবহমান বাংলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট টাইম-লাইন বেঁধে দিয়েছেু বলেছে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম’ রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার কথা ও তার মৌলিক চারটি আদর্শের কথা। কিন্তু জাতীয়তাবাদ এসেছে ‘জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম’-এর অধীনস্থ ধারণা হিসেবেইু কোনো আলাদা রাজনৈতিক ‘আইডিওলজি’ হিসেবে নয়।  ‘National liberation struggle’ শব্দবন্ধটি জাতীয়তাবাদের আগে স্বীকৃত হয়েছে সংবিধানের Preamble-র প্রথম স্তবকেই; জাতীয়তাবাদ এসেছে কেবল এর দ্বিতীয় স্তবকে। অন্য তিনটি আদর্শু সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে গিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ এসেছে, এবং জাতীয়তাবাদের চৌহদ্দিও বেঁধে দেওয়া হয়েছে ওই তিনটি আদর্শের দ্বারা। অর্থাৎ ইচ্ছা করলেই উগ্র-জাতীয়তাবাদ বা কেবল বুলি-কপচানো বাঙালি/বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হওয়ার উপায় আর থাকছে না। কেননা, এদেশের জাতীয়তাবাদের যে-নামকরণই হোক না কেন, তাকে শেষ পর্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে অন্য তিনটি আদর্শের সাথে। স্পষ্টতই উনিশ শতকের ইউরোপীয় নেশন-স্টেট ধারণা থেকে এই জাতীয়তাবাদের পরিসর মৌলিকভাবে ভিন্নতর। ইউরোপে যখন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন সর্বজনীন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা এসব ধ্যান-ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এসব ধারণা ইউরোপে এসেছে আরও অনেক পরে। কিন্তু বাংলাদেশে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নেই সর্বাধুনিক আদর্শসমূহ স্বীকৃত হয়েছিল এবং সেসব আদর্শ উঠে এসেছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নানা পর্যায়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক দর্শন-গ্রন্থের পাতা থেকে সেসব কপি করা হয়নি- এটাই এখানে বলার কথা।

‘ইকোলজিক্যাল ন্যাশনালিজম’ অর্থাৎ বাংলার ভূ-প্রকৃতির নৈসর্গিক অনুভূতিসঞ্জাত জাতীয়তাবাদ বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। বাঙলা-বাঙালি এই শব্দযুগলকে ঘিরে ‘অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ’ বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ ধারণার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু এর বাইরেও জাতীয়তাবাদ ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু। সেটি হচ্ছে ‘শোষিতের জাতীয়তাবাদ’। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে খোন্দকার মো. ইলিয়াসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু এর সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে আমি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তুলে দিতে চাই। ইলিয়াস তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন :

‘জাতীয়তাবাদ আপনার মতবাদের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আপনি তো জানেন জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়? তা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদের প্রতি আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?’

বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন : ‘আপনি ঠিক বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনির ইতালি, ডক্টর ভেরউর্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা, পাঞ্জাবি খানদের পাকিস্তান বা ইসরায়েলের ইহুদিবাদের মতো অতি জঘন্যরূপ ধারণ করতে পারে। সে জাতীয়তাবাদ দক্ষিণপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদ বামপন্থি ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিবাদী পাঞ্জাব, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদের মতো উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও তার বিকাশ ধারা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ এবং আমলাতন্ত্রবাদ ও জঙ্গিবাদ উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মূলশক্তি। তারা গণতন্ত্রের শত্রু, সমাজতন্ত্রেরও শত্রু। তাদের জাতীয়তাবাদ শোষকদের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ শোষিতের জাতীয়তাবাদ। কারণ আমার জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ। কাজেই যে জাতীয়তাবাদ আমার মতবাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সেই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হবার কোনো ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক সামাজিক ও বাস্তব কারণ নেই।’

ইলিয়াসের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল : ‘বিশ্ব সমাজকে একটি সমাজ এবং বিশ্ব মানবকে যদি একটি গোষ্ঠী ধরে নিই, তবে কি জাতীয়তাবাদের চেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ উন্নতির পর্যায়ে নয়?’

বঙ্গবন্ধু এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দিলেন : ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ এদেশের মাটিতে গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে। তাকে নির্মূল করে তবেই এদেশের শ্রেণি চেতনার বিকাশ সাধন সম্ভবপর। আর একমাত্র শ্রেণি চেতনাই আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পূর্বশর্ত। এ দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, শ্রেণি চেতনা বিকাশের পথে সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রধান অন্তরায়। আর সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার রণকৌশল হিসেবেই আমি জাতীয়তাবাদী দর্শন অনুসরণ করেছি। এই মতবাদ কার্যকরী হলে, আমার বিশ্বাস, এ দেশের ভাবীকালের মানুষ ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পার হয়ে উত্তীর্ণ হবে বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে।’

এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মুজিব জাতীয়তাবাদকে অবিমিশ্র মঙ্গল হিসেবে দেখছেন না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরাধীন জাতি একসময় জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেয়। সেই অধস্তন জনগোষ্ঠীর লড়াকু জাতীয়তাবাদকেই ‘শোষিতের জাতীয়তাবাদ’ বলছেন তিনি। কিন্তু বিকাশের ধারা সেখানেই থেমে থাকছে না। যখন শ্রেণিচেতনার বিকাশ হবে, তখন শোষিতের জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের রূপ নেবে। কিন্তু শ্রেণিচেতনার বিকাশ অতটা সহজসাধ্য নয় যখন কিনা ‘আইডেনটিটি পলিটিক্স’ প্রাধান্যে চলে আসে। আইডেনটিটি তথা জাত-পাত, রেস, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা যখন আবেগের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়, তখন শ্রেণিচেতনা পিছু হটতে থাকে রাজনীতির মাঠ থেকে। সে অবস্থায় ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার’ একটি রণকৌশল হতে পারে শোষিতের জাতীয়তাবাদ।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এজন্যেই সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ অংশে বাংলাদেশের যে-জনগণের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে ধর্ম-নির্বিশেষে আপামর মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলকেই অংগীকৃত করা হয়েছে। তাদের পরিচয় তারা সবাই বাঙালি জাতির অংশ, যারা এক নতুন পৃথিবীর রচনা করতে চলেছে, যারা জন্ম দিয়েছে এক নতুন বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের। এই জাতি-রাষ্ট্রের একটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে- ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা’। ১৯০৫ সালের ‘বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ বা ১৯৪৭ সালের জিন্নাহ্‌র ‘টু নেশন’ভিত্তিক ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’- এই দুই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনোটারই লক্ষ্য ছিল না পূর্ববঙ্গের জনপদের সমগ্র বাঙালিকে এক পতাকা তলে একত্র করা। অথবা এর লক্ষ্য ছিল না গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা। এটি যুক্ত হয়েছে পরে- পাকিস্তান সৃষ্টির পরে প্রতিবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে- নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি হিন্দু একত্র হয়েছে। এবং এমনভাবে একত্র হয়েছে যেটি বাঙালির বিগত ‘হাজার বছরের’ জীবনযাত্রায় দেখা যায়নি। ধর্ম-জাতি-ভাষা এসব নিয়ে বিভেদ-বোধ জিইয়ে রেখে সফল জাতি-নির্মাণ করা যায় না। এসব বিভেদ-বোধ রেখে সমাজতন্ত্রের দিকে তথা সমতামুখীন সমাজের দিকেও অগ্রসর হওয়া যায় না। এখানেই সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাসংগিকতা।
এক হিসেবে ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ শব্দ দুটো সাংকেতিক শব্দ :’অসাম্প্রদায়িক’ সমাজ গড়ার কোড ওয়ার্ড। সাম্প্রদায়িকতার দিকে যখন সামাজিক দাঁড়িপাল্লার এক প্রান্ত ঝুঁকে পড়ে, তাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আনার জন্য ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ এই দুটি শব্দই যথেষ্ট। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু নানা বক্তৃতায় বাংলা, বাঙালি, বাংলার নদী, বাংলার মানুষ, বাংলার গ্রাম, বাংলার ভূপ্রকৃতি এসব অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পেছনে জাতি-নির্মাণের চিন্তা তার মধ্যে কাজ করেছিল, কিন্তু তারও চেয়ে বেশি কাজ করেছিল অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা বিকাশের রাজনৈতিক তাগিদ। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ১৯৭২ সালে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলন। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বক্তৃতা শেষে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (ডাকসুর তৎকালীন ভিপি) যখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও শোষণহীন সমাজের পক্ষে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু তার কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘একটু জয় বাংলা স্লোগানটাও দিও সেলিম, অসাম্প্রদায়িকতার জন্য এটা দরকার।’ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানের বিরোধী ছিলেন না মুজিব, কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মন-মানসিকতা তিনি বুঝতেন। তাই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এবং ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত থাক’ এসব ‘বামপন্থি’ স্লোগানের পাশাপাশি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটাও দিতে বলেছিলেন। কেননা এতে করে শ্রেণিচেতনার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনারও বিকাশ ঘটবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু শোষিত জাতির জাতীয়তাবাদ ছিল না তার জন্য, এটা ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি।
বাংলা ও বাঙালি নিয়ে শেখ মুজিব গভীরভাবে ভেবেছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম চালাতে গিয়ে। এই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে আবিস্কার করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথও নতুনভাবে প্রতিভাত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের কাছে। ১৯৫০ দশক থেকে শুরু করে ১৯৭১ অবধি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গান নানাভাবে ব্যবহূত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে। এই গানগুলো প্রথমে যে-প্রেক্ষিতেই রচিত হোক না কেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকের নতুনতর প্রেক্ষিতে তা অন্য অর্থ ও মাত্রা পেয়েছে এটিও লক্ষ্য করার মতো। এখানে ‘প্রেক্ষিতের’ তাৎপর্য ‘পাঠকে’ পুনর্নির্মিত করেছে: context এসে :  text-র অর্থ ও ব্যবহার দুইই বদলে দিচ্ছে। একটি উদাহরণ দেব এখানে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র মঞ্চ থেকে ‘গণতন্ত্র বাঁচাও আন্দোলন’ করা হয়েছিল, যার থিম সং ছিলু’উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’। রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে পটভূমিতে রেখে বোঝানো হচ্ছিল এই বুঝি মোদি আসছেন রথে চড়ে! এর থেকে কেউ বলতে পারেন যে গানটির মধ্যে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদের প্রতি অনুরক্তি ছিল কবির, নইলে বিজেপির মঞ্চ থেকে তা ব্যবহার হলো কী করে? এরকম অদ্ভুত ও অযৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় গানটি অন্য প্রেক্ষিতেও আগে গাওয়া হয়েছে। সন্‌জীদা খাতুন লিখেছেন :”একাত্তরের জানুয়ারি থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত চলছিল। মুজিব-ইয়াহিয়া সংলাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক আর দ্রোহের গান চলছে। শান্ত-স্বভাবের ছাত্রী সেলিনা মালেকও গাইছে, ‘ওরে আগুন আমার ভাই’; ইফ্‌ফাত গাইছে, ‘যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না’; ইকবাল গাইছে, ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’। সাবিনা-শাহনাজরাও দেশপ্রেমের গান গাইছে। আজাদ রহমান দৃপ্ত সুরের সম্মেলক গান করাচ্ছেন। রেডিওতে চলছে সমর দাসদের রক্ত গরম করা গান। রেডিওর ওই সব টেপ নিয়েই তাহের সুলতান-আশফাকুর রহমানরা সীমান্ত পার হয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারে সেই সব গান চালান।” ইকবাল আহমেদ যখন ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে, ওই যে তিনি ওই যে বাহির পথে’ বলে গান করছেন, তখন দর্শক-শ্রোতারা সত্যি সত্যি যেন দেখতে পাচ্ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলা এক মহানায়কের মহাযাত্রা। যেন মহাভারতের রথের চাকা নয়, এই বাংলাদেশেই রচিত হতে যাচ্ছে অন্য এক আসন্ন যুদ্ধের মহাকাব্য।
Context ভেদে কী করে : text-র অর্থ বদলে যায় সেটির আরেকটি নমুনা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। ষাটের দশকে ও ১৯৭১ সালে গানটি অনেক বারই গাওয়া হয়েছে। কেউ তখন প্রশ্ন তোলেনি যে এসব গান ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে রচিত। বাংলা যাতে বিভক্ত না হয় তার জন্যেই এই গানগুলো আদিতে রচিত হয়েছিল। সেই যুক্তিতে এই গানগুলোকে পূর্ব বাংলার মুসলিম শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সমর্থন দেওয়ার কথা নয়। কেননা তারা তো তখন বঙ্গভঙ্গ করার পক্ষে ছিলেন। অথচ কী অনায়াসে ১৯০৫ সালের সেসব গানগুলোকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৯৫০-১৯৬০ দশকের আন্দোলন সংগ্রামে। এসব গানের ব্যবহারের প্রতিবাদ করে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরও তখন শোনা যায়নি প্রগতিবাদী জাতীয়তাবাদী শিবিরে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সবাই এই গানগুলো গেয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথকে আমরা কীভাবে সেদিন দেখেছি, তার গানকে ব্যাখ্যা করেছি বা যাকে বলে নিজেদের করে নিয়েছি (appropriate করেছি)-সেটি ছিল আমাদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেখানে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, দ্বিজেন্দ্রলালও গাওয়া হয়েছে, নজরুল তো ছিলেনই পূর্বাপর। যেমন, ১৯৬৯ সালে ছায়ানট পাঁচ দিন ধরে ‘গীতোৎসব’ করেছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। এতে শেষ গান ছিল যথাক্রমে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা,’ ‘আমার সোনার বাংলা’, আর ‘দুর্গমগিরি-কান্তার-মরু’। শ্রোতাদর্শক সুদ্ধ সবাই দাঁড়িয়ে সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছিল বোধকরি সেই প্রথম।
এই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহ ও প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছিল। এমনকি যে-ভার্শানটি এখন জাতীয় সংগীত হিসেবে গীত হয় সেটিও অনুমোদিত হয়েছিল তাঁরই সিদ্ধান্তে! সন্‌জীদা খাতুনের বর্ণনায় সেই ইতিহাস শুনব আমরা:
”১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ একগুচ্ছ বাউল সুরের দেশাত্মবোধক গান লেখেন। এখন বঙ্গভঙ্গের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ রচনার প্রসঙ্গ। গানটির উৎস এবং সাংগীতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় না গিয়ে, সংশ্নিষ্ট কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করব। ১৯৫৭ সালের প্রথমার্ধে ঢাকায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাসুদ্ধ প্রাদেশিক নেতাদের এক বৈঠক হয়েছিল। সংশ্নিষ্ট সবার জন্য কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সে সভায় আমার গান গাওয়ার কথা ছিল। সেই সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে অনুরোধ পাঠান। এর তাৎপর্য তখন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের কাছে ‘সোনার বাংলা’ বিষয়ে বাঙালির আবেগ-অনুভূতি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এ দেশের নেতা। এর কিছুদিন আগে ২৩ মার্চ পূর্ববঙ্গের নাম পূর্ব পাকিস্তান করে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়েছিল। আঞ্চলিক স্বাধীনতার জন্য উত্তাল আন্দোলনের সময়ে বঙ্গবন্ধু সব সময় জাহিদুর রহিমকে এই গান গাওয়ার জন্য খবর পাঠাতেন। রেসকোর্সের ময়দানে তাঁর সভায় জাহিদ যে কতবার ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছে! এ গানের আবেগ বাঙালিকে আমূল নাড়া দিয়েছে। পাকিস্তানি বিরূপ প্রচারণা রবীন্দ্রসংগীত আর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রেখেছিল। জনপ্রিয় নেতার বাঙালি স্বার্থ সংরক্ষণমূলক বক্তৃতার সঙ্গে এই বাংলাপ্রীতির গান সব মানুষকে অনেকভাবে আকর্ষণ করল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাই মাঠের রাখালও স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে উঠেছে। দেশের সর্বজনের অন্তর থেকে উৎসারিত এই গান তাই হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা বাঙালির যাবতীয় আন্দোলনের শিল্পীরা ওই গান গেয়েছেন বারবার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর আর স্বরলিপি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। তখন ক্যাবিনেট ডিভিশনের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু রায় দেন, যে সুর গেয়ে দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে, তা-ই আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর। ঘটনা এই যে সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ড থেকে যে সুর শুনে শিল্পীরা গানটি তুলেছিলেন, সে সুর থেকে নিজেরাই খানিকটা সরে যান।
বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আমাদের ভুলের অপরাধকে মুছে দিয়েছিল। আজও সেই সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে চলেছি আমরা।”
বাংলা ভাষা, বাঙালির সাধারণ সুখ-দুঃখের অনুভূতি, বাংলার গান, বাংলার প্রকৃতি-এই নিয়ে গড়ে উঠেছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদের মধ্যে একদিকে আছে স্বদেশবোধ-যাকে আমরা দেশপ্রেম বলি, অন্যদিকে আছে বাংলার নদী-মাঠ ভূপ্রকৃতি-যাকে আমরা ইকোলজি বা পরিবেশ-প্রকৃতি বলি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ আসলে এক-অর্থে ইকোলজিক্যাল ন্যাশনালিজম, পরিবেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। বাংলার পরিবেশ সম্পর্কে বিশেষ নৈসর্গিক অনুভূতি আছে বলেই আমরা বিশিষ্ট জাতি। এর বাইরে গিয়ে তত্ত্ব-রচনা করতে চাননি তিনি। বলেছিলেনও সেকথা :’জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, মনীষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং, এ সম্বন্ধে আমি আমার নতুন সংজ্ঞা না-ই বা দিলাম।’ কিন্তু সংজ্ঞা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতি-সম্পর্কে আসলে একটি নতুন বোধের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন-সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না।’ কিসের সেই অনুভূতি? একটি হচ্ছে বাংলার নদী-নালা মাঠ-ঘাট বিল-হাওর বাংলার গ্রাম এসব নিয়ে অভিন্ন অনুভূতি।
[ক্রমশ]