বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত বাধা অপসারণের জন্য তারা বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্র বা লিবারেল ডেমোক্রেসির গণ্ডি ছাড়িয়ে এক র‌্যাডিকেল ধারার গণতন্ত্রের (Radical Democracy) জন্ম দিচ্ছেন। একেই বঙ্গবন্ধু অভিহিত করেছিলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলে। পরবর্তী অধ্যায়ে- বাকশালের আলোচনায়, এ নিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে উৎক্রমণের আরও কিছু উদাহরণ ও সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে।
যে যুক্তির বলে ভারতে ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনকে নাকচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যাকে তিক্ত অভিজ্ঞতা বলেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম- সেটি ৪৭নং অনুচ্ছেদের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারত। বিদেশে বসে পরিত্যক্ত শিল্পকারখানার অবাঙালি মালিকেরা দিন গুনছিলেন কবে তারা বাংলাদেশে এসে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর্জি পেশ করবেন ভারতীয় রায়ের যুক্তি দেখিয়ে। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা এই বিপদের সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই বিপদ শুধু অবাঙালি মালিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দেশি শিল্প-মালিকদের নিয়েও উৎকণ্ঠার কারণ ছিল। এর একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাই ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণায়। তিনি লিখেছেন:’১৯৭৩ সালের শেষের দিকে মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা করি। তখন জাতীয়করণকৃত জুটমিলগুলোতে সাবেক মালিকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সাবেক মালিকরা ১৮টি মিলের যাবতীয় অর্থ একই দিনে উঠিয়ে মিলগুলো দেউলিয়া করার উদ্যোগ নেন। পূর্ব রাতে এ সংবাদ নিয়ে ফরাসউদ্দিন (বঙ্গবন্ধুর পিএস এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর)-এর সাথে দেখা করে তাকে ঘটনা খুলে বলি। তিনি ডিসিকে টেলিফোন করে, ঐ সকল জুটমিলের অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ব্যবস্থা করেন।’ এতে করে অ্যান্টি-ন্যাশনালাইজেশন লবির অপতৎপরতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সন্দেহ কী, এসব ঝুঁকি এড়াতেই সেদিন ৪৭নং অনুচ্ছেদের সংযোজন করতে হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে।
ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন সম্পর্কিত ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ নিয়ে আরও কিছু তথ্য যোগ করা দরকার এখানে। জাস্টিস হেদায়েতুল্লাহর ভূমিকা সম্পর্কে সৈয়দ নজরুল সেদিন যা বলেছিলেন তার সবটাই সত্য নয়। আসলে যা হয়েছিল তা ঘটনা প্রবাহের কাছাকাছি- কিন্তু খানিকটা অন্যরকম। ১৯৬৯ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ইস্তফা দিলেন। এর দু’দিনের মাথায় ঘোষিত হলো ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনের নীতি। এই নীতির ঘোষণা পেয়ে তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জাস্টিস মো. হেদায়েতুল্লাহ (তিনি ততদিনে প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন) পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরুর ঠিক দু’দিন আগে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করলেন। এই অর্ডিন্যান্সে জাতীয়করণের ফলে গৃহীত ব্যাংকসমূহের মালিকদের ‘পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার প্রভিশন রাখা ছিল না। এই অধ্যাদেশকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বলে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ব্যাংক অব বরোদার মেজরিটি শেয়ারহোল্ডার রুস্তম কুপার সাহেব সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন করেন। এর ওপরে ১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘কুপার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া :ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন কেইস’ মর্মে এক ঐতিহাসিক রায় হয়। ১১ জন বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় প্রদানে অংশগ্রহণ করেন এবং ১০ :১ রায়ে তারা অধ্যাদেশটি বহাল রাখেন। কিন্তু বহাল রাখলেও তারা কতকগুলো মন্তব্য করেন, যার ফলে পরবর্তী সময়ে কিছু জরুরি পরিবর্তন আনতে হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানে। যেমন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কুপারের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি এ কথা বলা হলেও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল যে সাধারণভাবে ‘ ‘It was not binding upon the Supreme court to reject the claim for enforcement of a shareholder’s fundamental rights, if in the process of violaton of his rights, the rights of his company were also being violated.’ ভারতীয় সংবিধানে বহুদিন পর্যন্ত জরমযঃ : Right to Property-কে 19(1)(F) ) ধারা অনুসারে ‘মৌলিক অধিকার-র অন্তর্ভুক্ত করা ছিল। পরবর্তীকালে বিশেষ করে ‘কেশবানন্দ ভারতীর’ রায়ের পরে- এই ধারাটিকে বাদ দিতে হয় ভারতীয় সংবিধান থেকে। একইভাবে আগে Article 31 অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির বাধ্যতামূলক অধিগ্রহণের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তা করতে গেলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হতো যার কাছ থেকে সম্পদ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তাকে। সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করেন যে, যার সম্পত্তি গ্রহণ করা হচ্ছে তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। এখানে ‘কোম্পানিকে’ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, আর ভারতীয় সম্পত্তি আইন বলে ‘কোম্পানি’ কোনো নাগরিক নয়, এবং সেহেতু কোম্পানির কোনো প্রচলিত নাগরিক অধিকার এ ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়নি। এর অর্থ- অন্য কোনো ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি জাতীয়করণ করার প্রশ্ন দেখা দেয়, তবে তা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি কাজ বলে পরিগণিত হবে। এসব আশঙ্কা এড়ানোর জন্য ভারতীয় সংবিধানে সম্পত্তির ওপরে ব্যক্তিগত অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘মৌলিক অধিকার’-এর অধ্যায় থেকে 19(1)(F) ধারা বাদ দেওয়া হয়। এরকম আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয় সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে। এটাকেই ড. কামাল হোসেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ বলেছেন, এবং এ লক্ষ্যে বাহাত্তরের সংবিধানে শুরু থেকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৪২(১) ধারা রেখেও ৪২(২) ধারা সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং আলাদা করে গুরুত্ব সহকারে ৪৭নং অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়।
ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন রায়ের সময় ভারতের সরকার পক্ষ থেকে এ যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, এ রকম জাতীয়করণ চাইলে রাষ্ট্র করতেই পারে, কেননা ‘There was an obligation upon the state to achieve a socialistic society with principles of egelitarianism’। যদিও ভারতীয় সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটি যুক্ত হয় ১৯৭৬ সালে, এর পরিস্কার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের ভুবনেশ্বর কংগ্রেসে। সেই কংগ্রেসে ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সোশ্যালিজম’ নামে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তৎকালীন কংগ্রেস পার্টি। তার পর থেকেই এর পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্তি দেখা দিতে শুরু করে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার যুক্তিটি তেমন গুরুত্ব পায়নি, বরং যুক্তি দেওয়া হয়েছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্তে সম্পত্তির অধিকারকে সংরক্ষণ করার প্রতি। ‘উদ্দেশ্য’ (Objective)-র বদলে জোর দেওয়া হয়েছিল ‘পরিণাম’  (Effect)-র প্রতি : ‘The court struck down the ‘object’ test and laid down the ‘effect’ test. The effect test would now look into the effect of any particular legislative Act, rather than looking at the objective with which it had been formulated. Thes, if any Act of the legislature, even at a remote stage, violated the Fundamental Rights of the citizens, then, it was liable to be struck down.’ বাংলাদেশেও বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাগণ এ রকমটাই ভেবেছেন- শুধু একটি মাত্র ক্ষেত্রকে তারা ব্যতিক্রমের তালিকায় রেখেছেন। সমাজতন্ত্রের নির্মাণের জন্য তারা প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এরকম বিষয়টি ‘মৌলিক অধিকারের’ অধ্যায়ে ৪২(২) এবং ৪৭ অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে, ভারতীয় সংবিধানও 19(1)(F) এবং Article 31 বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পথই অনুসরণ করেছে। এই প্রেক্ষিতেই ড. কামাল হোসেন তার ৩০ অক্টোবরের ভাষণে বলেছিলেন ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা :
‘মাননীয় স্পিকার সাহেব, আপনি নিশ্চয় জানেন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের ইতিহাস। যখন তারা জমিদারি আইন সংশোধন করতে যান, তখন সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট সেটাকে নাকচ করে দেন। তারপর, তাদের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বলবৎ করতে হয়। … যখন ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছিল, তখনও সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দেন। … তারপর ২৬ নম্বর সংশোধনীতে এসে তারা মোটামুটি বলে দিয়েছেন যে, সংসদ আইন করে সেখানে মূলনীতি ঘোষণা করে দিতে পারবেন। মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্য এটা করা হয়েছে। এটা আদালতের বিবেচনার বাইরে। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের একটা সুবিধা হয়েছে এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পঁচিশ বছর পরে ভারতকে যেটা সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে করতে হয়েছে, আমরা সেটা এখনই সঙ্গে সঙ্গে করে নিতে পেরেছি।’
এখানে বলা দরকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-র কথা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের সংবিধানে রয়েছে। ভারতে ১৯৬৩ সালের ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘reasonable restrictions on the exercise of the right’  বিষয়টিকে আরও জোরদার করা হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটাকে আরও বেশি করে মূলনীতি সমতাবাদী লক্ষ্যের অধীনস্থ করা হয়। এই সংশোধনী বলে কোন কিছু যদি ‘egalitarian social order’ -এর মূলনীতির পরিপন্থী হয় তবে তা বাতিলযোগ্য হবে। দেশজ রাজ্যসমূহের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকে যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে এই বলে যে, এ ধরনের স্বাধীন রাজ্য ব্যবস্থা- : the concept of rulershi-সমতাবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় :’The concept of rulership, with privy purses and special privileges unrelated to any current functions and social purposes, is incompatible with an egalitarian social order’, এবং সে কারণে এসব বাড়তি সুবিধাভোগের অধিকার- তা ‘ব্যক্তিগত অধিকার’ বলে আগে ভাবা হলেও এখন থেকে প্রত্যাহূত হলো। ভারতীয় সংবিধানের এই অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল সংবিধান প্রণেতাদের কাছে। বোঝাই যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা কোনো অ্যাবস্ট্রাক্ট ব্যক্তি স্বাধীনতার ডিসকোর্সের ভেতরে আবদ্ধ ছিলেন না বা থাকতে চাননি। তারা গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা সমাজতান্ত্রিক তথা সমতাবাদী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। এ দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তাদের পক্ষপাতিত্ব ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতিই। তাজউদ্দীন আহমদও ড. কামালের মতোই- এমনকি আরও এগিয়ে গিয়ে ভেবেছেন। এজন্যই তার ৩০ অক্টোবরের বক্তৃতাতে উঠে এসেছে ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা :
‘আওয়ামী লীগ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্কারভাবে সমাজতন্ত্র কী, তা বলে দিয়েছে … সেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি আমরা করতে যাচ্ছি, যা এই সংবিধানে রয়েছে। … সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এই রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিকে আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা, যাতে … মৌলিক অধিকার … এতে অন্তরায় সৃষ্টি না করে। যারা প্রগতিবাদী বলে দাবি করেন, তারা সমালোচনা করছেন এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক সংবিধান নয় বলে। আমি জানি না, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান কীভাবে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে, সে পরিকল্পনা কেউ যদি দিতে পারতেন, তাহলে এই পরিষদ তা অত্যন্ত সতর্কতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতেন।’
এই চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেন সংবিধানের লিবার্টি প্রিন্সিপাল ও সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে একত্রিত করে ছুড়ে দিয়েছেন আরও একটি চ্যালেঞ্জ। তবে সেটা গণতন্ত্রীদের প্রতি :
‘সমাজতন্ত্রের পথে যাতে কোনোরূপ অন্তরায় সৃষ্টি না হয়, তার ব্যবস্থা আমরা ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে করেছি। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ করে মৌলিক অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর চেয়ে কম সীমাবদ্ধতা পৃথিবীর আর কোনো দেশের সংবিধানে আছে বলে আমি জানি না। যদি কেউ আমাদের দেখাতে পারেন, তাহলে আমরা উপকৃত হব। কেবল দুই-একটা ক্ষেত্রে দাঁড়ি-কমার কমবেশি হতে পারে। বাধানিষেধ ছাড়া কোনো দেশে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়নি, হতে পারে না।’
এ-ই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ এ দুই মৌলিক মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্যতা অর্জনের ও তা গতিশীলভাবে রক্ষা করে অগ্রসর হওয়ার প্রতিশ্রুতি। বাহাত্তরের সংবিধানের ঠিক এক বছর আগে দার্শনিক জন রাউলস ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন তার দিকনির্দেশকারী বই- ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’। ন্যায়ানুগ ও গরিবমুখিন সমাজের ন্যায়বাদী তত্ত্ব রচনার সময় তিনি লিবার্টি প্রিন্সিপালকে সোশ্যাল জাস্টিস তথা বণ্টনগত ন্যায় (Distributive Justice)-র প্রিন্সিপলের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য যদি দরকার হয়, গণভোটে যারা প্রতিনিধি হয়ে আসবেন, তারা আইন করে ব্যক্তি সম্পত্তি সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে পারবেন। কেনো বাধা নাই। এ জন্য রক্তক্ষয়ের দরকার নাই। বিপ্লবের দরকার নাই।… বিভিন্ন দেশে সেই সব দেশের লোকদের নিজস্ব চিন্তাধারার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, জিডিআর, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা বলছিলাম। যে কোনো সম্পত্তি, যে কোনো পদার্থ-স্থাবর অস্থাবর যাই হোক না কেন, নেওয়া যাবে। এর চেয়ে বেশি কী করা যেতে পারে? যা চীন করেনি, রাশিয়া করেনি, কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ করেনি, আমরা তা করেছি। কাজেই জনাব স্পিকার সাহেব, সমাজতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, এ কথা অত্যন্ত অমূলক। বিচার করলে সে কথা মেনে নিতে পারি না। আগেও আবেদন করেছি, আপনার মাধ্যমে আবার আবেদন করব যে, তারা [বামপন্থিরা] অযথা মানুষের মনে আশা জাগিয়ে তুলবেন না। যেটা দিতে পারবেন না, যেটা সম্ভব নয়, সেটা নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। তাতে লাভ নাই।’
আছাদুজ্জামান খানের বক্তব্যে ৪২ নং অনুচ্ছেদের কথা এসেছিল ৪৭ নং অনুচ্ছেদের পাশাপাশি। ৪২নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে ৪৭ নং অনুচ্ছেদের আংশিক বিরোধ আছে। ৪২ নং অনুচ্ছেদে যে অধিকার প্রদত্ত হয়েছে, ৪৭নং অনুচ্ছেদে সেই অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এমনকি ৪২ নং অনুচ্ছেদের ১ নং দফায় যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, এর ২ নং দফায় তাকে আবার যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের মোড়কে বাঁধা হয়েছে। যেমন ৪২ (১) ধারায় নাগরিককে ‘সম্পত্তির অধিকার’ দেওয়া হয়েছে এভাবে :’আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।’ এর পরপরই বলা হয়েছে যে, ৪২ (১) দফার অধীনে প্রণীত আইনে দেশের স্বার্থে ‘ক্ষতিপূরণসহ বা বিনা ক্ষতিপূরণে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখলের বিধান করা হইবে।’ কিন্তু ‘অনুরূপ কোন আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান করা হয় নাই বলিয়া কিংবা ক্ষতিপূরণের বিধান অপর্যাপ্ত হইয়াছে বলিয়া সেই আইন সম্পর্কে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
এই র‌্যাডিকেল সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, যদিও শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লবের কথা বলেছেন আছাদুজ্জামান খান, ৪২ (২) ধারায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না এই বিধান রেখে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির অধিগ্রহণের বিষয়টিকে অত্যন্ত র‌্যাডিকেল এক চেহারা দেওয়া হয়েছে। এরকম অধিগ্রহণ অক্টোবর বিপ্লবোত্তর রাশিয়া বা চীনে পুঁজিবাদী সম্পত্তির বিনা শর্তে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা  expropriation-র সঙ্গে তুলনীয়। এই আইনের পেছনে প্রচ্ছন্ন পলিটিক্যাল ইকনোমি কারণ ছিল। যেসব অবাঙালি মালিক ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর তাদের কল-কারখানা ফেলে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যাওয়ার আগে তারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সব টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিদেশে থেকে তারা পাঁয়তারা করছিলেন সময়-সুযোগ বুঝে দেশের আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার, যাতে করে তারা তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন কল-কারখানাগুলো ফেরত পেতে পারেন, অথবা তারা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। সদ্য-স্বাধীন সরকারকে এই আশঙ্কা বিচলিত করেছিল। সেজন্যেই ৪২ (২) ধারার র‌্যাডিকেল অবতারণা এবং ৪৭ অনুচ্ছেদের সংযুক্তি বেশি করে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সেদিন।
আগেই বলেছি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে অধিকার দেওয়া হয়েছে ৪২(১) অনুচ্ছেদে। কিন্তু সেখানে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ শর্তটি আরোপিত হয়েছিল। এই শব্দবন্ধের আরোপ করা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল সেদিনের গণপরিষদে। যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে এতে করে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের গণতন্ত্রের অংশটুকু ক্ষুণ্ণ হতে পারে। যেমন মো. আবদুল আজিজ চৌধুরী (সিলেট-২১) একটি সার্বিক মন্তব্য রাখেন এ প্রেক্ষিতে :
‘জনাব স্পিকার, এই সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ হতে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বিধানগুলোতে মানবিক মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে; কিন্তু সেই সঙ্গে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ-সংক্রান্ত শর্তাবলি সংযোজনের ফলে ভয় হয় যে, যে কোনো কথার বিরুদ্ধে, যে কোনো বক্তব্যের বিরুদ্ধে সরকার যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’
এই সাধারণ আশঙ্কার প্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন তার ৩০ শে অক্টোবর, ১৯৭২-এর ভাষণে যা বলেছিলেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং পূর্ণ উদ্ধৃতি দেওয়ার দাবি করে :
‘[বিভিন্ন] দেশের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত বিধান পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্তে এসেছি, সেটা হল, কোন কোন দেশে দুইটা ‘অ্যাপ্রোচ’ লক্ষ্য করা যায়। একটা হল, আইন-সাপেক্ষ মৌলিক অধিকার-যেমন পূর্ব জার্মানি এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে রয়েছে যে, এ ব্যাপারে সংসদের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। সেখানে আইনের দ্বারা সবকিছু নির্ধারিত হতে পারবে। কোনো কিছুর ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ করা যাবে আইনের দ্বারা।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানবাধিকারের ঘোষণা। যেসব দেশে এই ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব দেশেও আইন-পরিষদের ক্ষমতা আছে আইন করার। কিন্তু কোন রকম যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করার এখতিয়ার একমাত্র আদালতের। কোন বাধানিষেধ যুক্তিসংগত হল কিনা, সেটা বিচার করবেন আদালত। এটার দ্বারা কিন্তু মৌলিক অধিকারের পূর্ণ রক্ষা হয়।’
এই দুটো ধারার মধ্যে ২য় ধারাটি বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে, কেননা ২য় ধারার মধ্যেই গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রক্ষাকবচ নিহিত। ১ম ধারাটিতে সংসদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়- যার ফলে ইচ্ছে করলে সংসদ অধিকার ও স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে, যেটাকে আদালতেও চ্যালেঞ্জ করা যায় না। পক্ষান্তরে ২য় ধারাটিতে সংসদ ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করে’ ঠিকই, কিন্তু সেটা ‘যুক্তিসংগত হল কি হল না, সেটা বিচার করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। এই অধিকার সুস্পষ্ট, সুনিশ্চিত। সংসদ এটা খর্ব করতে পারবেন না।’
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য ড. কামাল সেদিন সংবিধান শাস্ত্র থেকে ইংরেজিতে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলেন। সেটি শুনে নেওয়া দরকার।
‘The power to impose limitations may be looked at from another angle, which presents two possibilities. The first is that the legislature is given general, unrestricted Power to limit rights and freedom : they are simply made subject to the laws.  Such a formula depicts the right and freedoms of any higher safeguard, and renders them valueless.
The second possibility is that the legislature is empowered to limit the rights and freedoms only for certain clearly defined purposes : they are made subject to the laws in certain specified respects only. The universal declaration uses this formula; it permits limitations on rights and freedoms for the protection of four community interests. These interests are : (1) due recognition and respect for the rights and freedoms of others; (2) meeting the just requirements of (a) morality, (b) public order, and (c) the general welfare in a democratic society.’

এই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি অনুসরণ করলে- ড. কামালের মতে- ‘মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি রক্ষাব্যবস্থা দেওয়া সম্ভব হয় না।’ আর বাংলাদেশ তথা বাহাত্তরের সংবিধান সেই দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করেছে :সংসদ মৌলিক অধিকার দেওয়ার বেলায়-কোনো কোনো ক্ষেত্রে- ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করার বিধান রেখেছে বটে, কিন্তু তা যুক্তিসংগত হল কি হল না, সেটা বিচার করার এখতিয়ার কেবল সুপ্রীম কোর্টের।’ সেই এখতিয়ারে হাত দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই সংসদের। প্রায় প্রত্যেক অধিকারের ক্ষেত্রে এই বিধান করা হয়েছে (অবশ্য এ ক্ষেত্রে ড. কামালের একটি প্রধান অনুমান ছিল যে, সুপ্রীম কোর্ট হবে সংসদ ও সরকারী প্রশাসনের থেকে সম্পূর্ণ মাত্রায় হস্তক্ষেপমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান)। প্রত্যেক অধিকারের ক্ষেত্রে করা হয়েছে কেবল মাত্র ৪৭নং অনুচ্ছেদ ছাড়া। এই ৪৭নং অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে ড. কামাল বললেন :
“একটি মাত্র যে ব্যতিক্রম করেছি, সেটি হলো সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে। ‘আইন-সাপেক্ষে’ এবং ‘যুক্তিসংগত’ কথাটা সেখানে নেই। অন্য সবগুলির ব্যাপারে আমরা ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ রেখেছি। এটা করা হয়েছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সামনে রেখে। যাতে একটা ফর্মুলা বের করা যায়, তার একটা রূপরেখা আমরা দিয়েছি এই সংবিধানে। প্রত্যেক মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ থাকল কি থাকল না, তা নিয়ে তর্ক করার কোনই অবকাশ নেই। কারণ, সেটা আদালত দেখবেন। তবে সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে সংসদকে সার্বভৌম অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনসভা যা নির্ধারণ করে দেবেন, সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে আদালতের কোন এখতিয়ার থাকবে না। জাতীয়করণের প্রয়োজনে সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে এটা করতে হয়েছে। অন্যান্য দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করেছি।”
কী সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা যার জন্য ৪৭নং অনুচ্ছেদের মতো রক্ষাকবচ করতে হল? এ বিষয়ে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১৯ অক্টোবরের ভাষণে। ১৯৬৯ সালে জাতীয়করণ করতে গিয়ে ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন : ‘যেদিন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ব্যাংক, ইনসিওরেন্স জাতীয়করণ করার জন্য আইন পাস করেছিল, সেদিন ভারতের সুপ্রীম কোর্টের চিফ জাস্টিস জনাব হেদায়েতুল্লাহ তাকে নাকচ করেছিলেন এই বলে যে, সম্পত্তির মৌলিক অধিকারের প্রশ্নের এটা বিরোধী। সেজন্য আমাদের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ অত্যন্ত সজাগ এবং সচেতন ছিলেন বলে এই শাসনতন্ত্রের তৃতীয়ভাগে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রযোজিত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং মৌলিক আদর্শের প্রয়োজনে রাষ্ট্রায়ত্ত করার আদর্শকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৪টি প্রাইভেট ব্যাংকের ‘জাতীয়করণ’ করেছিলেন। এই ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে সমগ্র ব্যাংক খাতের ৮০-৮৫ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করত। এ নিয়ে মনোজ্ঞ বিবরণ পাওয়া যায় জয়রাম রমেশের  ‘Intertwined lives : P.N. Haksar and Indira Gandhi’
বইতে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম পূর্বে উল্লেখিত ৪৭ অনুচ্ছেদের উপ-দফাগুলো কেন সংযোজিত হয়েছে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেদিন :
‘রাষ্ট্রের মূলনীতির একটা হল সমাজতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হয় এবং মৌলিক অধিকার যাতে এর পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য অত্যন্ত দূরদৃষ্টি নিয়ে খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ ৪৭ অনুচ্ছেদের (১) দফার সঙ্গে (ক), (খ), (গ), (ঙ) ও (চ) উপ-দফাগুলোকে এখানে সংযোজিত করছেন।’
অর্থাৎ, ‘লিবার্টি প্রিন্সিপল’ এবং ‘সোশ্যাল জাস্টিস প্রিন্সিপলের’ সঙ্গে কখনও সংঘর্ষ বাধলে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে জাস্টিস প্রিন্সিপলকে। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণার মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’ দুটি ধারণাই প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এ দুইয়ের মধ্যে-যেমন বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে-কখনও বিরোধ দেখা দিলে প্রায়োরিটি পাবে সমাজতন্ত্রই। যেমন পেয়েছিল ৪৭ অনুচ্ছেদ-ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপরে মালিকানার মৌলিক অধিকারের গণ্ডিকে বা দাবিকে প্রয়োজনে অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই ‘র‌্যাডিকেল’ দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা করে উল্লেখ করার মতো। বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান প্রণেতাগণ সাধারণ নির্বাচনী ‘বুর্জোয়া’ গণতন্ত্রের কথা বলছেন না।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৭৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


নিজস্ব উদ্যোগে বা শ্রমে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ওপরে ব্যক্তিগত অধিকারের স্বীকৃতি এবং সাধারণভাবে সম্পত্তির অধিকারে স্বীকৃতি লিবারেটারিয়ান ও অন্যবিধ ‘বুর্জোয়া’ গণতান্ত্রিক ধারার চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি মৌলিক ও সার্বিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রত্যক্ষ করা যায়। এই ধারা পুঁজিবাদের উন্মেষ পর্ব থেকে আজ পর্যন্ত চলছে। এ জন্যই পুঁজিবাদকে ব্যক্তিমালিকানানির্ভর বাজার-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। সম্পত্তির অধিকার শুধু উৎপাদনের উপায় (Means of Production)-এর ক্ষেত্রেই প্রসারিত হয়নি, কোনো কোনো দেশে ও কালে তা ব্যক্তি ও সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রেই প্রসারের চেষ্টা চলেছে। মার্কিন সংবিধানের সেকেন্ড এমেন্ডমেন্ট অনুসারে  ‘Right to carry guns’ একটি স্বীকৃত ধারণা, যদিও বিতর্কিত ধারণা ও মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত। মিশিগান প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে ডানপন্থি লিবারটারিয়ানরা সম্পত্তির ওপরে অধিকারের যুক্তিতে ইচ্ছেমতো প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরার অধিকার রক্ষায় সাংঘাতিকভাবে সোচ্চার (এই বিশেষ ক্ষেত্রে তালিবানদের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো)। সন্দেহ কী আমাদের দেশেও সেই সুদূর বাহাত্তর সালেই ‘সম্পত্তির অধিকার’কে একপ্রকার ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে অবশ্য পালনীয় এক নীতি হিসেবেই দেখা হবে। অন্তত এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। স্বাধীন প্রকাশভঙ্গি, বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, পেশা-বৃত্তি বা বাছাইয়ের ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ স্বাধীনতা যেমন গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করা তেমনি গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনীতি পরিচালনা করার জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ- এরকম যুক্তি দেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না, বাস্তবে বাহাত্তরের সংবিধান সে পথে এগোলো না। সম্পত্তির পূর্ণ অধিকারে বাদ সাধল ৪৭নং অনুচ্ছেদ। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বা ব্যক্তিমালিকানা সম্পর্কিত ‘বুর্জোয়া’ বা লিবারটারিয়ান অধিকার সে যে নামেই তাকে অভিহিত করি না কেন, সেখানে নিরঙ্কুশ থাকল না। ৪৭নং অনুচ্ছেদ নিয়ে সে জন্যই তুলকালাম বিতর্ক হলো বাহাত্তরের গণপরিষদে (এটি এবং পরবর্তীতে আলোচ্য ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়েই সবচেয়ে বেশি তীব্র বিতর্ক হয়েছিল সেদিন)।
কী বলেছিল ৪৭নং অনুচ্ছেদ? এতে লেখা ছিল যে, রাষ্ট্রের চার মূলনীতি কার্যকর করার জন্য সংসদ প্রয়োজন হলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারেও হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এই হস্তক্ষেপের ধারাটি সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদ ‘মৌলিক অধিকার’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। অর্থাৎ এটিকে কেবল সংসদেই পরিবর্তন করা যাবে- কোনো সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে এই বিধান চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। লিবারটারিয়ানরা যদি ‘মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে’ এই যুক্তিতে সম্পত্তির স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করতে চান- আর দশটা ‘হিউম্যান রাইটস’ জাতীয় বিষয়ের মতো সেটি আইনত গ্রাহ্য করা হবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা বা অন্য কোনো ব্যক্তি অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহের কোনো একটিকে (অর্থাৎ সমাজতন্ত্রকে) সমুন্নত করার স্বার্থে রাষ্ট্র যদি সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ করাকে আবশ্যিক মনে করে, তবে তাকে কোনো বিচারালয়ের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। এ জন্যেই ৪৭নং অনুচ্ছেদের শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনে জারিকৃত কোনো আইন ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে বর্ণিত কোনো গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে বলেই তা বাতিলযোগ্য বলে গণ্য করা হবে না। আইনি ভাষায় বক্তব্যটি এভাবে পেশ করা হয়েছে : ‘সংসদ যদি স্পষ্টরূপে ঘোষণা করেন যে, এই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতিসমূহের কোনো একটিকে কার্যকর করিবার জন্য অনুরূপ বিধান করা হইল, তাহা হইলে অনুরূপ আইন এইভাগে নিশ্চয়কৃত কোনো অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য কিংবা অনুরূপ অধিকার পূরণ বা খর্ব করিতেছে, এই কারণে বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে না।’
অর্থাৎ চার মূলনীতিকে রক্ষা করার জন্য সংসদ দেশের প্রচলিত আইনে যে কোনো সংশোধনী আনতে পারবে এবং সেই সংশোধনকৃত আইনকে কতকগুলো বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য বিচার বিভাগে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সেটা যদি গণতান্ত্রিক অধিকার বা বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ও, তাহলেও সেটা চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে থাকবে। কী সেই বিশেষ ক্ষেত্র যেখানে লিবার্টি প্রিন্সিপলকে মান্য করা হবে না দেশের চার মূল স্তম্ভকে কার্যকর করার জন্য? এর মধ্যে রয়েছে মূলত শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারবার প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিগত মালিকানার ((Private Property) ক্ষেত্রে প্রয়োজনে রাষ্ট্রের তরফে হস্তক্ষেপের অধিকার। ৪৭নং ধারায় ক্ষেত্রগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্র তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে। গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আমি নিচে উপধারাগুলোকে হুবহু তুলে দিচ্ছি :
‘(ক) কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখল কিংবা সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে কোন সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা;
(খ) বাণিজ্যিক ও অন্যবিধ উদ্যোগসম্পন্ন একাধিক প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলক সংযুক্তকরণ;
(গ) অনুরূপ যে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ব্যবস্থাপক, এজেন্ট ও কর্মচারীদের অধিকার এবং (যে কোনো প্রকারের) শেয়ার ও স্টকের মালিকদের ভোটাধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ;
(ঘ) খনিজদ্রব্য বা খনিজ তৈল-অনুসন্ধান বা লাভের অধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ;
(ঙ) অন্যান্য ব্যক্তিকে অংশত বা সম্পূর্ণত পরিহার করিয়া সরকার কর্তৃক বা সরকারের নিজস্ব, নিয়ন্ত্রণাধীন বা ব্যবস্থাপনাধীন কোন সংস্থা কর্তৃক যে কোন কারবার, ব্যবসায়, শিল্প বা কর্মবিভাগ-চালনা, অথবা
(চ) যে কোন সম্পত্তির স্বত্ব কিংবা পেশা, বৃত্তি, কারবার বা ব্যবসায়-সংক্রান্ত যে কোনো অধিকার কিংবা কোন সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোন বাণিজ্যিক বা শিল্পগত উদ্যোগের মালিক বা কর্মচারীদের অধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ।’
এসব খাতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য আরও বলা হয়েছে যে, এসব বিধান (বা তার সংশোধনী) ‘পূর্ণভাবে বলবৎ ও কার্যকর হইতে থাকিবে এবং অনুরূপ যে কোনো আইনের কোনো বিধান কিংবা অনুরূপ কোনো আইনের কর্তৃত্বে যাহা করা হইয়াছে বা করা হয় নাই, তাহা এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না।’ অবশ্য সংসদ আগামীতে ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের এসব বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে- এই বিধানও সেখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছিল যে, সম্পত্তির অধিকারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের আইনে বিধি অথবা বিধানে কোনো সংশোধনী আনতে হলে ‘সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূ্যন দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে গৃহীত না হইলে সম্মতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।’ অর্থাৎ সেটা বিল আকারে আইনি অনুমোদনের পর্যায়ে যেতে পারবে না। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) সম্পত্তির ওপরে মালিকানা-অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে এবং হস্তক্ষেপ করার এই রাষ্ট্রীয় অধিকারকে আইনি ও সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছিল। এক কথায় বললে, ‘লিবার্টি প্রিন্সিপলের’ ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল ‘সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে’। রাষ্ট্রের মূলনীতি রক্ষার প্রয়োজনে ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকারের ‘বুর্জোয়া-গণ্ডি’কে সংকুচিত করা হয়েছিল ইচ্ছে করেই। লিবারটারিয়ানদের মানব-স্বাধীনতার (Human Freedom) বা ব্যক্তিস্বাধীনতার (ersonal Freedom) যুক্তিকে সেদিন শিরোধার্য করা হয়নি মালিকানা সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে মালিকানা সম্পর্কে রদবদল করা যাবে- এই মৌলিক সমতাবাদী চিন্তা থেকে (কোনো কোনো মহলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও) টলানো যায়নি বঙ্গবন্ধুকে এবং তার নিকটতম সহকর্মীদের, যারা সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত ছিলেন পূর্বাপর। লিবারটারিয়ান মানব স্বাধীনতার যুক্তিকেই শুধু অগ্রাহ্য করা হয়নি, যারা সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সামষ্টিক ইউটিলিটির সম্প্রসারণ দেখেন, সেইসব উপযোগিতাবাদী বা ইউটিলিটারিয়ান আর্গুমেন্টকেও চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা। এ জন্যই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসংবলিত সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১০ম অনুচ্ছেদে শ্রীবৃদ্ধি (Affluence, Opulence বা Growth) নয়, শ্রীবৃদ্ধির ‘পরিণামের’ ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। এবং প্রবৃদ্ধি নয়, সাম্যবাদী সমাজলাভ করাকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই চাই, কিন্তু সেরকমের প্রবৃদ্ধি চাই, যা সামাজিক ন্যায় ও শোষণমুক্তির লক্ষ্যকে ত্বরান্বিত করবে। যে কোনো প্রকারের, যেনতেন প্রকারের প্রবৃদ্ধি অর্জন বাহাত্তরের সংবিধানের মূল লক্ষ্য ছিল না। উপযোগিতাবাদী ইউটিলিটারিয়ানরা অনেক সময়ে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, ধনীদের ওপরে করারোপ করে গরিবদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাওয়া ঠিক হবে না। কেননা এতে করে উৎপাদনে বা ব্যবসায় ধনী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমে যাবে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, উৎপাদনশীলতা কমবে, বেকারত্ব বাড়বে, এতে করে আখেরে ক্ষতি হবে গরিবদেরই। উপযোগিতাবাদীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের করারোপ স্পষ্টতই বিকৃতি-উৎপন্নকারী (distortionary) পদক্ষেপ। ‘বিকৃতি’-র মানে হচ্ছে- কোনো কর বসানো না হলে বিভিন্ন খাতে সম্পদ যেভাবে বিনিয়োজিত হতো, তা থেকে করারোপের কারণে এতটাই সরে আসতে হচ্ছে যে, এর ফলে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। লক্ষ্য করুন, ইউটিলিটারিয়ানরা যখন এ যুক্তি রাখছেন তারা incentive-এর ওপরে করের সম্ভাব্য কুপ্রভাবকে জোরেশোরে তুলে ধরছেন। তারা লিবের্টারিয়ানদের মতো মানব স্বাধীনতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এরকম নীতিবাদী যুক্তি প্রদর্শন করছেন না। বঙ্গবন্ধু ও বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাগণ লিবের্টারিয়ানদের ‘ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের’ ফলে বেইনসাফের যুক্তি যেমন মানেননি, উপযোগিতাবাদীদের ‘বিকৃতি-উৎপন্নকারী’ যুক্তিও মানতে রাজি ছিলেন না। উৎপাদনের উপায়ের ওপরে ব্যক্তিমালিকানার স্বভাবজ ‘বুর্জোয়া’ অধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে ৪৭নং অনুচ্ছেদে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে গিয়ে  Freedom বা Distortion কোনো যুক্তিকেই প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না। এটা তো তাদের জানাই ছিল যে করারোপের মতোই মালিকানা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে অবাধ অনুমোদন দেওয়ার অর্থ হচ্ছে হয় পুঁজিপতিদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার শামিল (যেটা লিবের্টারিয়ানদের সওয়াল জবাব ছিল), অথবা তা ছিল বাজার অর্থনীতির ‘স্বাভাবিক’ ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে বিকৃতি সৃষ্টির নামান্তর (যেটা উপযোগিতাবাদীদের সওয়াল জবাব ছিল)। এসব জেনেও তারা ৪৭ অনুচ্ছেদ রাখতে পিছু পা হননি, তার কারণ- রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি প্রধান নীতি সমাজতন্ত্র তথা সামাজিক ন্যায় ও শোষণমুক্তির প্রতিশ্রুতিকে তারা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন ও বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে সেদিনের সংসদে যে আত্ম-সমর্থনমূলক বিবৃতি তারা দিয়েছিলেন, তা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে বোঝার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তাফসির। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এখানে শুধু তুলে ধরছি।
মধ্যপন্থি রাজনৈতিক নেতা ময়মনসিংহের আছাদুজ্জামান খান ৪৭নং অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ণ সমাজতন্ত্রের দিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যাওয়ার রাস্তা দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন :’আমরা রক্তের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র চাই না। বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেছেন এবং তার চার মূলনীতির মধ্যে এ কথা রয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। … এখানে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আসবে। … যারা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে চান, তাদের বলব, সংবিধানের অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সেটা আসতে পারে। ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান আছে। সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেওয়া চলবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি রয়েছে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৮

পূর্বে প্রকাশিতের পর
সংবিধানের ১০নং ধারামতে ‘শোষণমুক্ত’ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হলেও এর অর্থ উক্ত ধারায় বা অন্য কোনো ধারাতেও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা হয়নি। এটা সংবিধান প্রণেতাদের বা বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা নয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে ধ্রুপদি সমাজতন্ত্রীদের মধ্যেই ঐকমত্য আগেও ছিল না, পরেও দেখা যায় না। কালক্রমে বিশেষত সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের মাধ্যমে এটুকু অন্তত প্রতীয়মান হয়েছে যে, সমাজতন্ত্র মানে কেবল উৎপাদনের সব খাতে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা’ প্রতিষ্ঠা করা নয়। আমি বরং বলব যে, সুদূর ১৯৭২ সালে বসেই বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা সমাজতন্ত্রের প্রথাগত সংজ্ঞা থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য আমরা এর আগেই উদ্ৃব্দত করেছি, যেখানে তিনি বলেছেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা নয়, ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) মালিকানাও থাকতে পারে, অবশ্যই নিয়ম-নীতির চৌহদ্দি মেনে চলাসাপেক্ষে। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা ও ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) মালিকানার মধ্যে সুসামঞ্জস্য থাকতে হবে এবং এ দুইয়ের পারস্পরিক অনুপাতে কালের বিচারে হ্রাসবৃদ্ধি হতে পারে। যেটাই হোক না কেন, একদিকে পুঁজিপতিদের যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে দেওয়া হবে না, আবার অন্যদিকে তাদের অন্যায় প্রভাব খাটানোর সুযোগও দেওয়া হবে না। এক ভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্রের রূপকল্প নির্মাণের জন্য তাজউদ্দীনের বক্তব্যটি পদ্ধতিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পুনরায় স্মরণযোগ্য:
‘আজকে ব্যক্তিগত মালিকানা, ব্যক্তিগত পুঁজিতে যে সংশয়ভাব দেখা দিয়েছে, তাতে শুধু এটাই আমরা বলতে পারি, আইনের বিধান মোতাবেক ব্যক্তিগত মালিককে যেটা দেওয়া হবে সেটার মালিকানা সে নিশ্চয়ই আইনের বিধান অনুযায়ী নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবে। ….কিন্তু পুঁজিপতিদের তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। … ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকু দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত শোষণ, ব্যক্তিগত বঞ্চনা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না। এটা পরিস্কার থাকা ভালো।’
পরবর্তীকালে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার নানা কারণের মধ্যে একটি ছিল বাজার-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে চালু না করতে পারার ব্যর্থতা। অর্থনীতির সবকিছু সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা Central Planning-র নামে ‘এক কেন্দ্র’ থেকে প্রশাসনিকভাবে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত এক পর্যায়ে সোভিয়েত ধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধানের রূপকারেরা এই ভুল গোড়া থেকেই পরিহার করতে পেরেছিলেন। এবং পেরেছিলেন বলেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ের ১৩নং ধারায় রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী এবং ব্যক্তিগত মালিকানাকে যুগপৎ সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে রেখে ছিলেন। এই তিনটিই ছিল সংবিধান অনুযায়ী জনগণের মালিকানার তিনটি ধরন।  Social Ownership of means of production বলতে বাহাত্তরে সংবিধানের রূপকারেরা শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাকে বোঝাননি, রাষ্ট্রের মালিকানার পাশাপাশি সমবায়ী ও ব্যক্তি-মালিকানাকেও বুঝিয়েছেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের  Principles of Ownership বলতে গিয়ে ১৩নং ধারায় বলা হয়েছে, সমাজতন্ত্রের মালিকানা হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ’ : The People shall own or control the instruments and means of production and distribution, and with this end in view, ownership shall assume the following forms’- যথাক্রমে state ownership, ‘co-opertive ownership’, এবং‘private ownership’ (within such limits as may be prescribed by law) । এরকম সংজ্ঞা নিউ ইকোনমিক পলিসির লেনিনের বা সংস্কারপন্থী নিকোলাই বুখারিনের অথবা পোলিশ অর্থনীতিবিদ অস্কার ল্যাঙ্গের পছন্দ হতো তাতে আমার অন্তত সন্দেহ নেই।
সমাজতন্ত্র ও তার মধ্যে তিন ধরনের মালিকানা নিয়ে সেদিনের সংসদীয় বিতর্কে দুটি স্পষ্ট প্রবণতা দেখা যায়। একটি হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতে পারে কিনা এ নিয়ে তত্ত্বগত বিতর্ক। অন্যটি হচ্ছে, এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক। প্রথম দল চাইছেন যে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তি খাত থাকুক এবং শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই নয়, একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে ব্যক্তি খাত কালক্রমে বিকাশও লাভ করুক। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও আছাদুজ্জামান খান অনেকটা এই লক্ষ্যে যুক্তির জাল বিস্তার করছিলেন। তাদের আলোচনার তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল বামধারার দল ও ভাবাদর্শের প্রতি। সংসদে যার কনক্রিট লক্ষ্যবিন্দু ছিলেন ন্যাপের সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত। সংখ্যায় এরা অবশ্য ছিলেন মাইনোরিটি। অন্যদিকে, যারা বিশেষভাবে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অসম্ভব- এদের মধ্যে ছিলেন মেজোরিটি গণপরিষদ সদস্য। তারা বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ ও প্রতিতুলনা টেনে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকেই ‘অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে’ বিচরণ করতে হবে এবং ‘গতিশীল ভূমিকা’ পালন করতে হবে। প্রয়োজনে এর জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এরা সে লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদের মৌলিক গুরুত্বকে জোরেশোরে তুলে ধরেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ থেকে ড. কামাল হোসেন প্রাগ্রসর সব রাজনৈতিক নেতাই- যারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন দীর্ঘকালের লড়াই-সংগ্রামে- এই ৪৭নং ধারার প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলার দাবি রাখে।
বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হয়েছে তার পরিধি বিপুল। Liberty Principle-এর ক্ষেত্রে কোনো আপস না করে জোরেশোরে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। ৩৯(১) ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, এর ‘ক’ ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং এর ‘খ’ ধারায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ২৯(১) ধারায় সরকারি নিয়োগ লাভে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ এবং ৪০ অনুচ্ছেদে যে কোনো আইনসংগত পেশা, বৃত্তিগ্রহণ, কারবার বা ব্যবসা-পরিচালনার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক নাগরিককে। সেই সঙ্গে ৪২(১) ধারায় দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক নাগরিককে সম্পত্তির অধিকার- ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’- প্রত্যেক নাগরিককে ‘সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা’ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পত্তির ওপর অধিকারের সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজার-অর্থনৈতিক ধারায় বিকাশের জন্যও সম্পত্তির অধিকার বা property rights একটি মৌলিক ধারণা। প্রপার্টি রাইটস-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত হচ্ছে : transaction costs-এর ধারণা। কোনো সম্পত্তির ওপরে মালিকানা প্রতিষ্ঠা, মালিকানার হাতবদল এবং মালিকানা রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত খরচকে :transaction costs বলে। যে সমাজে এই সম্পত্তি সংক্রান্ত :transaction costs  কম সেই সমাজ উৎপাদন নৈপুণ্যে আরও বেশি এগিয়ে। তবে নিকোলাস স্টার্ন দেখিয়েছেন যে,  property rights শুধু ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প, কারবার বা ব্যবসা পরিচালনার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও সমবায়ী মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-কর্মকাণ্ডের সফল পরিচালনার জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রপার্টি রাইটস বলতে স্টার্ন মূলত তিনটি অধিকারকে বুঝিয়েছেন- এর মধ্যে রয়েছে ‘Right to Manage’, ‘Right to Income’ এবং ‘Right to Protect’। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এসব অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সেই প্রতিষ্ঠানটি ঠিক মতো চলতে পারে না। সেক্ষেত্রেই আমি ৪২(১) ধারায় প্রদত্ত সম্পত্তির অধিকারকে ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের’ মধ্যে গণ্য করেছি- শুধু পুঁজিবাদী সম্পত্তি-অধিকারের অংশ হিসেবে দেখিনি।
উপরোক্ত গণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ৪১ নং অনুচ্ছেদের ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ ধারাও। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা মনে রেখে এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের ‘যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের’ অধিকারের কথা। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী ‘কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না’- এ কথাও ৪১(২) ধারায় আলাদা করে সংযোজিত হয়েছিল। এছাড়াও সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকার’-এর অধ্যায়ের ২৭নং ধারায় আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ২৮নং ধারায় ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যরোধ এবং ধর্ম-বর্ণ নারীপুরুষ নির্বিশেষে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা স্পষ্ট করে উল্লেখিত ছিল এই সংবিধানে। এসব কিছুকেই আমরা একদিক থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার, অন্যদিক থেকে ‘সেক্যুলার’ (ধর্ম-নির্বিশেষ) অধিকার হিসেবে পাঠ করতে পারি।
উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদানের প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে Libertarian ও Economic Egalitarian (তথা মার্কসবাদীরা) এক জোটে জড়ো হবেন, তা যতই এই নৈতিক সহাবস্থান তাদের রাজনীতির পক্ষে অস্বস্তিজনক হোক না কেন। কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি দেখান তাদের বক্তব্যেও সপক্ষে। যেমন, মানুষ নিজে যা উৎপাদন করে তার ওপরে তার মৌলিক অধিকার রয়েছে বা মালিকানাস্বত্ব রয়েছে- এ কথা লিবারটারিয়ানরা জোরেশোরে বলে থাকেন। এজন্যই তারা মনে করে থাকেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি-অধিকারে হস্তক্ষেপ করা মানে হচ্ছে ব্যক্তিগত মৌলিক অধিকারেই (ব্যক্তিগত স্বাধীনতা) হস্তক্ষেপ করার শামিল। অন্যদিকে, ‘আমার উৎপাদনের ওপরে কেবল আমার অধিকার’- একথাটা কট্টর বামপন্থিরা বুঝে না-বুঝে বলে থাকেন।  Right to one’s labour- এটা এই ধারার প্রগতিশীলদের এক পুরোনা দাবি। (অবশ্য উৎপাদনের ফল যদি কেবল শ্রমের ফসল না হয়ে বিভিন্ন উপাদানের সমবেত অবদানের কারণে অর্জিত হয়- যেমন, Entrepreneourship, প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনী প্রতিভার কারণে- তাহলে উৎপাদনের সবটুকু ফল কেবল আমার একথা আর বলা চলে না নিঃসংশয়ভাবে।) এরকম এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন ফার্দিনান্দ লাসাল (Lassalle)। শেষ জীবনের একটি লেখা ‘ক্রিটিক অব দ্য গথা প্রোগ্রামে’ মার্কস তৎকালীন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ফার্দিনান্দ লাসাল-এর Rights to Labour তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিলেন। ‘শ্রমিক হিসেবে আমি যা উৎপাদন করছি তার পুরোটাই কি আমার প্রাপ্য’- এ প্রশ্ন রেখে মার্কস দেখিয়েছিলেন বাস্তবে সেই উৎপাদনের কিছু অংশ যাবে পুঁজির ক্ষয়-ক্ষতি পূরণে বা নবায়নে, কিছু অংশ যাবে নতুন বিনিয়োগে, কিছু অংশ সামাজিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অবকাঠামো প্রভৃতি Social Consumption খাতে, কিছু অংশ আপৎকালীন দুর্যোগ মোকাবিলায়- মোট কথা  National Accounts-এর যাবতীয় বণ্টনের নিয়ম-নীতি নিষ্ঠার সাথে পালনের পরই কেবল যা অবশিষ্ট থাকবে তা শ্রমিকদের ‘বেতন তহবিলে’ ঢুকতে পারে (অবশ্য সেই বেতন তহবিল থেকেও একটা অংশ পেনশন জাতীয় ভবিষ্য-তহবিলের বাবদ কেটে রাখতে হবে বৈকি, শ্রমিকদেরই সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনে)। দেখা যাচ্ছে, মার্কস বণ্টনের ব্যাপারটাকে সম্যকভাবে এবং সূক্ষ্ণভাবে বিচার করেছিলেন। কিন্তু সেই সূক্ষ্ণতা অনেক সময়ই পরবর্তীকালের মার্কসবাদী আলোচনায় রক্ষিত হয়নি। এ কারণেই অমর্ত্য সেন তার ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইয়ে লিখতে পেরেছেন যে, The idea of the right to the fruits of one’s labour can unite right-wing libertarians and left-wing Marxists (no matter how uncomfortable each might be in the company of the other) এবং এটা লেখার পরপরই ফুটনোটে যোগ করেছেন যে, মার্কস এরকম কোনো মতে শামিল ছিলেন না : “As, it happens, Karl Marx himself became rather sceptical of the ‘right to one’s labour’ which he came to see as a ‘bourgeois right’, to be ultimately rejected in favour of ‘distribution according to needs’, a point of view he developed with some force in his last substantial work, The Critique of the Gotha Program.”

[ক্রমশ]