পর্ব ::৬১
পূর্বে প্রকাশিতের পর
প্রথম মহাযুদ্ধের কালের ‘লড়াইয়ের মূল’ প্রবন্ধে তিনি প্রতীকী ভাবে লিখেছিলেন :’সম্প্রতি পৃথিবীতে বৈশ্যরাজক যুগের পত্তন হইয়াছে। বাণিজ্য এখন আর নিছক বাণিজ্য নহে, সাম্রাজ্যের সঙ্গে একদিন তার গান্ধর্ব বিবাহ ঘটিয়া গেছে।’ এই একই জিনিস দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও। এর কারণ- আমি যুক্তি দেখাবো যে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু দুজনেই এক্ষেত্রে ছিলেন একই পথের অনুসারী- গণতন্ত্রের হাত ধরে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলার মানুষ। এক্ষেত্রে দুজনেরই সামন্তবাদবিরোধী, উপনিবেশেবাদ বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্পষ্ট অবস্থান ছিল। বয়সের সাথে সাথে দু’জনেই অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের পথকে অপরিহার্য বলে মনে করেননি। জনকল্যাণের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মূল মূল দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্মৃত হননি এবং বলা বাহুল্য, দুজনেই এক শোষনমুক্ত ও সুষম বন্টনের ন্যায়পরায়ণ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান থেকেই জাতীয় অর্থনৈতিক সর্বোচ্চ স্বার্থ অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু ‘জোট-নিরপেক্ষ নীতিকে’ আঁকড়ে ধরেছিলেন। একটি উদাহরণ দেই। দেশের দুর্দিনে মানুষকে বাঁচানোর জন্যে বিদেশী সাহায্য চাওয়া যায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ এড়াতে বঙ্গবন্ধুর সরকার কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খাদ্য-সাহায্যের প্রত্যাশা করে নাই? কিন্তু সেই সাহায্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বে এসেছিল। তখন যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। তারপরও মুজিব কারো সাথে বৈরী সম্পর্ক চাননি। ১৯৭৫ সালে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, ‘কারো সঙ্গে দুশমনি নাই। চায়না রিকগনিশন দিলো না। কিন্তু আমরা চায়নার সাথে বন্ধুত্ব চাই। তারা একটা বিগ কান্ট্রি। আমরা এখনো বন্ধুত্ব চাই। আমাদের সাথে বন্ধুত্ব আছে রাশিয়ার, আমার বন্ধুত্ব আছে ভারতবর্ষের সাথে, আমার বন্ধুত্ব আমেরিকার সাথে। এ বন্ধুত্ব সকলের সাথে চাই। আমরা কারো সাথে গোলমাল করতে চাই না। কারণ, আমি আমার দেশকে গড়তে চাই।’ একথা বলার অর্থ এটা ছিল না যে বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিষয়ে নমনীয় ছিলেন। সেই একই বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন: ‘যেখানে কোন অপ্রেসড ইন্টারন্যাশনাল পিপল থাকবে, আমরা তাদের মরাল সমর্থন দিতে পারি এবং দেব। যেখানেই থাকুক না কেন, আমরা দেব। আমরাও অপ্রেসড পিপল। আমরাও যুগ যুগ ধরে এটার সাথে পরিচিত। আমরাও মার খেয়েছি। দুনিয়ার শোষক-গোষ্ঠী, ইম্পিরিয়ালিস্ট পাওয়ার- আমাদের সম্পদ লুট করে নিয়েছে।’ মার্কিন চাপকে অগ্রাহ্য করে তিনি সেদিনই বলেছিলেন, (যাতে তারা বুঝতে পারে সেজন্য ইংরেজিতেই বলেছিলেন) ‘আমি বিশ্বাস করি, ক্যাম্বোডিয়া, আই শুড রিকগনাইজ ইট। আই ডোন্ট কেয়ার এনিবডি ইন দি ওয়ার্ল্ড হোয়েদার এনিবডি ইজ স্যাটিসফায়েড অর এনিবডি ইজ আনহ্যাপি অর এনিবডি ইজ হ্যাপি। আই ফিল দ্যাট দে আর ফাইটিং ফর দেয়ার ওন লিবার্টি। আই অ্যাম ইউথ দেম। আই সাপোর্ট পিআরজি [গ্রানাডা]। আই গিভ দেম রিকগনিশন বিকজ আই অ্যাম এ সাফারার, আই অ্যাম এ সাফারার ফর জেনারেশন টু জেনারেশন ফর দিস বেঙ্গলি নেশন। যে যুদ্ধ করছে তার মাতৃভূমির জন্য, তাকে সমর্থন দেবো। তাই বলে অন্যকে গালাগালি করবো না।’
এর থেকে একটা দিক স্পষ্ট হয়ে আসে। কারো প্রতি বৈরীতা নয়- এ নীতির অর্থ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতির পক্ষ সমর্থন করা থেকে নিজেকে সংকুচিত করা নয়। শোষিত জনগণের Self determination-এর আন্দোলনকে সমর্থন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব- ইমানুয়েল কান্টের সর্বোচ্চ নৈতিক ‘ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভ’। অন্যের ন্যায্য সংগ্রামে নিশ্চুপ থাকাটা মুজিবের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রুচিতে বাঁধে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আই বিলিভ ইন পজিটিভ অ্যাপ্রোচ, নট এ নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ।’ তারপরেও ইকনমিক ইম্পিরিয়ালিজম সম্পর্কে বলতে ছাড়েননি। স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থবিরোধী এক জটিল আন্তর্জাতিক আবর্তে পড়ে দেশ তখন প্রবল সংকটের মুখে। ‘অবজেকটিভ পরিস্থিতি’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সচেতন ছিলেন :
‘টাকা ছাপিয়ে বাড়িয়ে দিলেই তো দেশের মুক্তি হবে না। ইনফ্লেশন হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে পারলে তারপরেই আপনাদের উন্নতি হবে। না হলে উন্নতি হবে না। … যেমন আমরা আজকে দেখেছি। কপাল। আমাদের কপাল। আমরা গরিব দেশ তো। আমাদের কপাল- আমাদের পাটের দাম নাই। আমার চায়ের দাম নাই। আমরা বেঁচতে গেলে অল্প পয়সায় আমাদের বিক্রি করতে হয়। আর আমি যখন কিনে আনি- যারা বড় বড় দেশ, তারা তাদের জিনিসের দাম অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা বাঁচতে পারি না। আমরা এই জন্য বলি, তোমরা মেহেরবানি করে যুদ্ধের মনোভাব বন্ধ করো। আরমানেন্ট রেস বন্ধ করো। তোমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করো। ওই সম্পদ দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যয় করো। তাহলে দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে। আজকে তোমরা মনে করছো আমরা গরিব… যে দামেই হোক আমাকে বিক্রি করতে হবে। এইদিন থাকবে না।… যদি ডেভেলপ করতে পারি, ইনশাল্লাহ এই দিন থাকবে না। … আমরা এখানে না খেয়ে মরি, আমাদের ইনফ্লেশন হয়, আমরা বাঁচতে পারি না। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাই, তোমরা কিছু খয়রাত দিয়ে একটু মিষ্টি হাসো। হাসো, হাসো। দুঃখে পড়েছি, বিক্রিতো হয়েছি। তোমাদের কাছে হাত পাততে হবে, হাসো। অনেকে হেসেছে- যুগ যুগ ধরে হেসেছে। হাসো।’ এত দুঃখ-বিলাপের মধ্যেও পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের উদ্দেশ্য করে বলতে ছাড়েননি : ‘আরব ভাইদের সাথে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করছি। প্যালেস্টাইনের আরব ভাইদের ন্যায্য দাবি সমর্থন করে বাংলার মানুষ। আরব ভাইদের পেছনে তারা থাকবে প্যালেস্টাইন উদ্ধার করার জন্য। এও আমাদের পলিসি। যেখানে নির্যাতিত দুঃখী মানুষ সেখানে আমরা থাকবো।’ এতে করে কেউ যদি তাকে সোভিয়েত শিবিরের সমর্থক ভাবে সেটা তাদের তাকে বোঝার সমস্যা- তিনি তাতে একটুকু বিচলিত নন। এই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘আন্তর্জাতিক নীতি’- একে নিছক জাতীয় স্বার্থরক্ষার বাস্তববাদী ‘Foreign Policy’ বললে তার দৃষ্টিভঙ্গীকে অত্যন্ত সংকীর্ন গণ্ডিতে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী- একথা ভুললে চলবে না।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে আরও একটি নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও প্রথাগত অর্থে বামপন্থি ছিলেন না। মন-মানসিকতার দিক থেকে তিনি ‘লিবারেলদের মধ্যে লিবারেল’- উদারনৈতিক চিন্তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি হচ্ছেন মনস্বী কাজী আবদুল ওদুদ। এক বৈদগ্ধ্যপূর্ণ পরিশীলিত মানবিকতা তার সমস্ত লেখার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। ওদুদের উদারনৈতিক চিন্তার নমুনা হিসেবে একটি উদাহরণ দেওয়া এখানে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ‘সংস্কৃতির কথা’ প্রবন্ধের শেষটায় তিনি এভাবে উত্থাপন করেছেন তার ৫ দফা। উদ্ৃব্দতিটি কৌতূহলোদ্দীপক।
‘আজকার অসার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তর থেকে সার্থক সংস্কৃতি-চিন্তার স্তরে উপনীত হতে হলে যে সব ধাপ আমাদের অতিক্রম করতে হবে, তার কিছু নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে এই ভাবে :
১. দেশে অভুক্ত ও কর্মহীন কেউ থাকবে না।
২. একান্ত বীভৎস না হলে কোনো সমাজেরই ধর্মাচার অশ্রদ্ধেয় বিবেচিত হবে না, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে, যা প্রাচীন তা প্রাচীন বলেই বরণীয় নয়, বরণীয় তার বর্তমান কার্যকারিতার জন্যে।
৩. হিন্দু-মুসলমানের পোশাক ও নামের ব্যবধান থাকবে না অথবা অস্বীকার হবে।
৪. সামাজিক আদান-প্রদান- বিবাহ-আদি সমেত- সর্বত্র সহজ হবে।
৫. আইন সমস্ত দেশের জন্য এক হবে।’
১৯৪১ সালের লেখায় কাজী আবদুল ওদুদের এরকম দৃষ্টিভঙ্গি সেকালে এবং একালেও সর্বত্র দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এ রকম বুদ্ধিবৃত্তিক মানসিকতার প্রাক-পটভূমি ছাড়া আওয়ামী মুসলিম লীগ অনায়াসে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হতে পারত না, বা বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িকতা ও সর্ব ধর্ম স্বীকারের সেক্যুলার আদর্শ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেত না, এ কথা হলফ করে বলা যায়। এটা ঠিক যে, যে পরিমাণে মনোযোগ ওদুদকে আমাদের দেওয়ার কথা তা তিনি সেভাবে কখনোই পাননি। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য বিষয়ে ১৯৩৫ সালে বিশ্বভারতীর ‘নিজাম বক্তৃতা’ দেওয়ার জন্য ওদুদ সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ দেশের সংবিধানে পরবর্তীকালে সংযোজিত সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ যুক্ত হওয়ার পেছনের সামাজিক চিন্তার ইতিহাস খুঁজতে গেলে ওদুদের দ্বারস্থ আমাদের হতে হবেই। যাই হোক, দেশভাগের এক বছর আগে তার ‘গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে’ প্রবন্ধে উদারনীতিবাদী কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন : ‘নাৎসী আদর্শের চাইতে বোলশেভিক আদর্শের বরং আমাদের দেশে বেশি কার্যকর হবার সম্ভাবনা। কেননা মানবতার দাবি বোলশেভিক আদর্শে স্বীকৃত হয়েছে, জগতের বঞ্চিতদের পক্ষ সমর্থন তাতে বেশি আছে বলে তা জগতের মানুষের হৃদয়ের উপরে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আমাদের ভাবা দরকার যে রুশ জাতি এই মতবাদ সার্থক করে তোলার ভার নিয়েছে তাদের দুর্ধর্ষতার কথা, তাদের অপূর্ব সাহিত্য-সম্পদের কথা।’ ওদুদ এখানে সমাজ পরিবর্তনের পেছনে প্রেরণা-যোগানো সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক ভিত্তি খুঁজছেন, এটা তাৎপর্যপূর্ণ। এবং সে কথা পার্টিশনের সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে তার সহযোদ্ধাদের স্মরণ করিয়েও দিতে চাচ্ছেন :’আমার জবরদস্ত বন্ধুদের কাছে আমাদের পরম বিনীত নিবেদন : ধীরে বন্ধু ধীরে। নগরকে আলোকমালায় উজ্জ্বল করা আর তাতে অগ্নিকাণ্ড ঘটানো এক কথা নয় কোনোদিন। অগ্নিকাণ্ড অল্পকালেই ঘটানো যায় সন্দেহ নেই, কিন্তু আলোকমালায় সজ্জিত করার জন্য চাই পর্যাপ্ত আয়োজন।’
সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি উদারনৈতিক চিন্তাবিদ কাজী আবদুল ওদুদের পক্ষপাতিত্ব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নাৎসিবাদের পরাজয়ের কারণে উচ্চারিত হয়েছিল এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। অসহযোগ আন্দোলনকে উপলক্ষ করে ১৯২০ সালে লেখা ‘নন-কো-অপারেশন বা অসহযোগিতা’ শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রবন্ধে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারায় কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ থিসিস উত্থাপন করেন ওদুদ। এটি মুজিবের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণা বোঝার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে আমাদের সাহায্য করবে। এ থেকে বোঝা যাবে যে, নিছক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছকে ওদুদের ‘গণশক্তি-ভিত্তিক’ গণতন্ত্র বা মুজিবের ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ কোনটিকেই আবদ্ধ বা সংকীর্ণ করা চলে না। দু’জনেই সমাজতন্ত্রের আদর্শ ও সংগ্রামের বিশ্বজোড়া অভিঘাত স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের ‘গণশক্তির’ জাগরণ ঘটেছে এটা প্রত্যক্ষ করেছেন। ওদুদের উদ্ৃব্দতিটি দীর্ঘ, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২০ সালের ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত উপরোক্ত প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদ বলছেন : ‘ … এ কথা নিশ্চয়ই সকলকে স্বীকার করিতে হইবে যে, যাহারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া সমস্ত উদ্ভাবনাকে সিদ্ধি দান করে তাহাদের জন্য উপযুক্ত অভাব মোচনের বন্দোবস্ত করাও সকলের কর্তব্য। এত যুগ-যুগের সভ্যতা সত্ত্বেও তাদের এই ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই। … আধুনিকগণ এই সমস্ত অভাব-অভিযোগের মর্ম হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছে। এবং সেইজন্য কী উপায়ে রাষ্ট্রের সাক্ষাৎ পরিচালনার উপরও প্রভাব বিস্তার করিয়া সে নিজের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করিতে পারে, সে সম্বন্ধে তাহার চেষ্টার অন্ত নাই। এই দিক দিয়া ইউরোপে শ্রমজীবীর ধর্মঘট, বোলশেভিকবাদ ইত্যাদি যে সমস্ত আন্দোলন চলিয়াছে, অবশ্য তাহার সবই যে মানবের সামাজিক আদর্শ ও সভ্যতার দিক দিয়া দেখিতে গেলে ভালো বোধ হইবে এমন নহে; তবু এই সমস্ত অতিরিক্ততার ভেতর দিয়া যে একটা সত্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যাইতেছে, তাহাকে তো কেহ অস্বীকার করিতে পারে না। … তবে ইহার ভেতরে একটি প্রচ্ছন্ন দুর্বলতাও আছে, সেটি হইতেছে ইহার অসহিষ্ণুতা। … গণ তো সবে মাত্র জাগিয়া উঠিয়াছে। ইহার এরূপ চেষ্টা, অসহিষ্ণুতা অতিরিক্ততা ইত্যাদির ভেতর দিয়াই গণ তাহার নির্দিষ্ট স্বচ্ছন্দ অবস্থা বুঝিয়া পাইবে। তখন আর ইহাকে এমন ব্যতিব্যস্ত হইয়া ফিরিতে হইবে না। সমাজ-মনই ইহার দাবি-দাওয়া জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে বুঝিয়া দিবে। সেটি হইতেছে ভবিষ্যতের আশা। তবে সেই অবস্থায় যতদিন সমাজ না পৌঁছায়, অথবা স্বাধীনতা যতদিন সকলের ভাগ্যে সমপরিমাণে না ঘটে ও বিজ্ঞানের চেষ্টা যত দিন নির্ভীক সর্বপ্রকার সংস্কার-বিমুক্ত পূর্ণ সত্যান্বেষণে পর্যবসিত না হয়, ততদিন ঘোর বিপ্লবই হইবে সমাজের রীতি।’
[ক্রমশ]
Monthly Archives: September 2020
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৬০
পূর্বে প্রকাশিতের পর
এই আগ্রহ বঙ্গবন্ধু এর আগেও দেখিয়েছেন। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে আনিসুর রহমানকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছেন। প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন :
– ‘আপনার গ্রামের কাজ কেমন চলছে।’
আনিসুর রহমান তা নিয়ে কিছু কথা বললেন; চলে এলো রংপুর স্বনির্ভর আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কিছুক্ষণ পর মুজিব আসল কথায় আসলেন :
– ‘ডাক্তার সাহেব আমার একটা আইডিয়া এসেছে।’
-‘কী আইডিয়া?’
-‘আমি একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকি। আমি সেখানে বসে থাকবো, আর আপনি আপনার এই সব আইডিয়া বলবেন। সবাই শুনবে।’
আনিসুর রহমান দ্বিধান্বিত। তিনি এখনই এতে ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজি নন। তিনি বললেন : আপনি তো জানেন এই কাজ নিয়ে অনেক রকম প্রশ্ন-বিতর্ক চলছে। এ সময় আপনি এরকম বড়ো কিছু করলে সেটা ব্যাক-ফায়ার করতে পারে, যারা এর বিপক্ষে, ছাত্রদের মধ্যেই হোক, আমলাদের মধ্যেই হোক, তারা এই কাজকে এতখানি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দেখে এর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে পারে। আমার মনে হয়, কাজটা আপনাআপনিই আরও এগোক? আরও পরে দেখা যাবে একে নিয়ে কী করা যায়।
আনিসুর রহমান সংশয়ে ছিলেন সেদিন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট উৎসাহিত হয়েছিলেন গ্রামের স্বনির্ভর আন্দোলন সম্পর্কে। চেয়েছিলেন একে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে আনিসুর রহমানের প্রেরণায় স্থানীয় মিঠাপুকুরের ছেলেরা ‘ধান কাটছে’ এ খবর শেখ মুজিবুরের কাছে পৌঁছেছিল। তিনি সেদিনও আনিসুর রহমানকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
– ‘শুনছি খুব গ্রামে যাচ্ছেন, কী করছেন বলেন।’
আনিসুর রহমান তাঁকে বললেন কী করছেন, কী দেখছেন- এসব। শুনে বঙ্গবন্ধুর চোখটা যেন চক চক করে উঠল। বললেন,
– “খুব ভালো কাজ। শোনেন, এটা আমার আর আপনার প্রোগ্রাম- আপনি আমার দফতরে একটা সেল খোলেন, ধরুন তার নাম হতে পারে ‘স্টুডেন্টস, মবিলাইজেশন সেল’। আপনার কিছু সাপোর্ট লাগবে- আমি আপনাকে কয়েক লাখ টাকা দেব, আর কয়েকটা জিপ ইত্যাদি। আর প্রত্যেক সপ্তাহে আমি নিজে আপনাকে দু’ঘণ্টা সময় দেব। আপনি আমাকে যে কোনো গ্রামে যেতে বলবেন আমি যাব, যেয়ে আপনার সঙ্গে কোদাল দিয়ে মাটি কাটবো। আপনাকে আর প্ল্যানিং কমিশনের অন্য কোনো কাজ করতে হবে না- এটাই হবে আপনার কাজ।”
যে কোনো কারণেই হোক, আনিসুর রহমান এত তাড়াতাড়ি এ কাজে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে জল ঢেলে তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় না ওপর থেকে এ রকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন করবার এখনি সময় এসেছে। ছাত্রদের খুব অল্প পার্সেন্টেজই এই উদ্যোগে নেমেছে, অন্যেরা নামেনি, এবং অনেকে এটা নিয়ে অনেক সমালোচনাও করছে। উদ্যোগটা নিজের গতিতে এগোক। কোনো পর্যায়ে যদি প্রক্রিয়াটা থেকেই কোনো রকম সাপোর্টিং কাঠামোর প্রয়োজন দেখা যায়, তাহলে আমি আপনাকে জানাবো।’ সেদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এতে নিরাশ হয়েছিলেন। খানিকটা হয়তো বিষণ্ণ : ‘প্রধানমন্ত্রী চুপ করে থাকলেন আর কিছু বললেন না।’ আমার ধারণা, গ্রামের কাজে তরুণ শিক্ষার্থীদের জড়ানো, গ্রামের মানুষদের স্বনির্ভর করা এবং এসব কাজে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে উৎসাহ দান- এসব ‘আইডিয়া’ বঙ্গবন্ধুর মাথায় স্থায়ীভাবে গেঁথে গিয়েছিল। এর অনেক কিছুই বাকশালের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় পরবর্তী সময়ে জায়গা করে নেবে।
গ্রাম-জীবনকে অর্থনীতি পলিসির ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এমনকি অর্থনীতি শিক্ষার ক্ষেত্রেও ‘পাঠ্যরূপে’ গণ্য করতে হয়, এ চিন্তা এদেশে রবীন্দ্রনাথের মনেই প্রথম এসেছিল। ১৯৩৯-এ প্রকাশিত হয় স্যার আজিজুল হকের (তিনি ছিলেন অখণ্ড বাংলার শিক্ষামন্ত্রী) বিখ্যাত বই ‘The Man behind the Plough’ । গ্রন্থটি হাতে পেয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখলেন :(ভূঁইয়া ইকবালের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করছি)
‘এখানে তোমার ইংরেজি বইখানা- লাঙলের পিছনকার মানুষটি আমার হাতে পড়ল। বাংলাদেশের এই উপেক্ষিত অকিঞ্চনদের জীবনযাত্রার সুবিস্তীর্ণ ভূমিকাটি তুমি যে রকম বিস্তারিতভাবে বিবৃত করেছ, এমন আমি আর কোনো বইয়ে দেখিনি। তোমার নিরলংকার বাস্তব বর্ণনার ভিতর দিয়ে বাঙালি কৃষিজীবীর দুর্ভাগ্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এই বইখানি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি শিক্ষা বিভাগে পাঠ্যরূপে গণ্য করা উচিত।’
রবীন্দ্রনাথের মতোই সমবায় ও কৃষি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং সে লক্ষ্যে প্রাথমিক আয়োজনও শুরু করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাবনায় এক ভাষণে সর্বপ্রথম তিনি ‘নন-মার্কেট’ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছেন- এর ফলে সরকারের কোষাগারে কম রাজস্ব জমা পড়বে। কিন্তু রাজস্ব না পেলে সরকার চলবে কী করে? পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে- ‘একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফল পায় না।’ আর ‘সাত কোটি মানুষের গাছ, যে গাছকে পথের ভিখারী করে দিয়ে গেছে।’ এই অবস্থা থেকে মুক্তির প্রয়োজনে কতগুলো ক্ষেত্রে ‘নন-মার্কেট’ ভিত্তিতে ব্যাপক Labour Mobilization করা দরকার হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু তার সোজা সহজ ভাষায় বললেন:
‘আমার কৃষক খাজনা দিবার পারে না। আমি বলে দিলাম, বকেয়া খাজনা সুদসহ সব মাফ। ২৫ বিঘা যাদের জমি আছে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত তাদের খাজনা… রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মাফ হয়ে যাবে। … অন্যান্য যে ট্যাক্স আছে তা দিতে হবে, না হয় সরকার চালানো যাবে না। … সেজন্য আপনাদের কাজ করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে এই যে কুড়ালি পয়সা যদি আমার থাকত, আমি বলতাম দিলাম পয়সা, কুড়াব কুড়াল। পয়সা নাই বলে আমি বলছি। আমিও কুড়াল মারি, তোমরাও মার। ইনভেস্টমেন্ট যত রাস্তা খাল এগুলো আপনাদের কাটতে হবে। … স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার ছেলেরা কাজ না পায়। কিন্তু সময়ের প্রয়োজন।… আপনাদের সহ্য করতে হবে। কাজ করতে হবে, খাটতে হবে। আর আমি বলেছি কৃষিবিপ্লব। আমার দুনিয়ার কাছ থেকে খালি খাবার কিনতে হবে- পারব না। খাবার তৈরি করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে খাবার উৎপাদন করতে হবে। আমি জানি বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু পয়সা কোথায়? চেষ্টা করতেছি। … সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রাখতে হবে। এই দায়িত্ব যেমন সরকারের, এই দায়িত্ব তেমনি জনসাধারণের।’
কৃষি বিপ্লবের চিন্তাটি বিস্তৃত জায়গা করে নেবে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিলে এবং গ্রাম-জীবনের পুনর্নির্মাণের বিষয়টিও আরও বড় পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে বাকশালের অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে। এটা ছিল বাঙালি সাম্য-চিন্তার ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতি। আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখের চিন্তার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ক্ষেত্রেও সাম্যবাদ-বিরোধী ও গ্রাম-সমবায় ভিত্তিক প্রকল্পের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন উপাদান সময়ের সাথে সাথে আরও বেশি স্পষ্ট আকার নিচ্ছিল।
৫. উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান
বাঙালির সাম্য-চিন্তা ও বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বোঝার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হয়ে দাঁড়ায় এর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবিস্তারকারী নীতিমালার বিরুদ্ধে বাংলার প্রাগ্রসর চিন্তাবিদ ও লেখকরা বরাবর একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। এর প্রভাব পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনাতেও। ১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে ডেভিড ফ্রস্টের সাথে বিখ্যাত সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনার চিন্তার ওপরে কোন কোন রাষ্ট্রনায়ক সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছেন?’ উত্তরে মুজিব যাদের নাম করেছিলেন, তাদের মধ্যে লিবারেল ও সমাজতন্ত্রী উভয় গ্রুপেরই বিশ্বনেতাদের উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে এক চার্চিলকে বাদ দিলে অধিকাংশই ছিলেন বর্ণবাদ, সাম্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তারা হলেন : ‘লিঙ্কন, মাও, লেনিন, চার্চিল, কেনেডি, গান্ধী, নেহেরু, এ কে ফজলুল হক, এইচ, এম সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, ড. সুকার্নো ও আতার্তুক।’ এই নামগুলো যেভাবে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারে এসেছিল, আমি সেভাবেই এখানে তুলে ধরেছি। এসব নামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের দিকটি যেমন উন্মোচিত হয়, তেমনি তার ‘মধ্য-পন্থার’ দিকটিও সমানভাবে ফুটে ওঠে। ‘লিবারেল ডেমোক্রেসি’র পথিকদের সাথে এক নিঃশ্বাসে তিনি ‘সমাজতন্ত্রী’ ব্যক্তিত্বদেরও স্মরণ করতে ভোলেননি। তখনও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, মাও তখনও বেঁচে ছিলেন, তার পরও লিঙ্কনের পর প্রথমেই তার মনে এলো চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর কথা। এবং এর পরপরই লেনিনের কথা। গান্ধী, নেহেরু, নেতাজী, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী সবার কথা মনে করলেন, কিন্তু একবারও জিন্নাহর কথা বলেননি তিনি। বলার কথাও নয় তার। আগেই বলেছি, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবনের অভিজ্ঞতা যেমন কাজ করেছে, তেমনি পুঁজিবাদের চিন্তা-ভাবনাও এখানে প্রভাব ফেলে থাকবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের কথা আলোচনার দাবি রাখে।
রবীন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চিন্তা নিয়ে ইতিপূর্বে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। নেপাল মজুমদার ও চিন্মোহন সেহানবীশ এ নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। প্রথাগত অর্থে বামপন্থি না হয়েও সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট না হয়েও রবীন্দ্রনাথ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অবস্থান নিয়েছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, গান ও উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘ইম্পিরিয়ালিজম’ প্রবন্ধটির প্রতি এখানে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেখানে অ-কমিউনিস্ট রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘বিলেতে ইম্পিরিয়ালিজমের একটা নেশা ধরিয়াছে। অধীন দেশ ও উপনিবেশ প্রভৃতি জড়াইয়া ইংরেজ সাম্রাজ্যকে একটি বৃহৎ উপসর্গ করিয়া তুলিবার ধ্যানে সে দেশে অনেকে নিযুক্ত আছেন। … এইরূপ বড় বড় মৎলব পৃথিবীতে অনেক সময় অনেক লোকে মনে মনে আঁটিয়াছে। এ সকল মতলব টেকে না; কিন্তু নষ্ট হইবার পূর্বে পৃথিবীতে কিছু অমঙ্গল না সাধিয়া যায় না।’
Black Lives Matter (BLM) আন্দোলন সম্প্রতি আমেরিকায় অনেক বর্ণবাদী নেতার মূর্তি অপসারণ করেছে। একইভাবে বিলেতেও বর্ণবাদী নেতা স্যার সেসিল রোডসের স্ট্যাচু অপসারণ করা হয়েছে। তার নামে বহু বছর ধরে ‘রোডস স্কলারশিপ’ দেওয়া হয়েছে দেশ-বিদেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের। অনেকে প্রশ্ন করেছেন- মূর্তি সরানোর এই ‘বাড়াবাড়ি’র দরকার ছিল কি? সেই রোডস সাহেব সম্পর্কে ১৯০৫ সালেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন :
‘যাঁহারা ইম্পিরিয়ালিজমের খেয়ালে আছেন, তাঁহারা দুর্বলের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে অকাতরে নির্মম হইতে পারেন এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। পৃথিবীর নানা দিকেই তাহার দৃষ্টান্ত দেখা যাইতেছে।…ব্রিটিশ এম্পায়ারের মধ্যে এক হইয়া যাওয়াই ভারতবর্ষের পক্ষে যখন পরমার্থ লাভ, তখন সেই মহদুদ্দেশ্যে ইহাকে জাঁতায় পিষিয়া বিশিষ্ট করাই ‘হিয়ুম্যানিটি’! … সেসিল রোডস্ একজন ইম্পিরিয়াল বায়ুগ্রস্ত লোক ছিলেন, সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকা হইতে বোয়ারদের স্বাতন্ত্র্যলোপ করিবার জন্য তাঁহাদের দলের লোকের কিরূপ আগ্রহ ছিল, তাহা সকলেই জানেন। ব্যক্তিগত ব্যবহারে যে সকল কাজকে চৌর্য্য মিথ্যাচার বলে, যাহাকে জাল খুন ডাকাতি নাম দেয়, একটা ইজম-প্রত্যয়যুক্ত শব্দে তাহাকে শোধন করিয়া কতদূর গৌরবের বিষয় করিয়া তোলে, বিলাতি ইতিহাসের মান্য ব্যক্তিদের চরিত্র হইতে তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়।’
রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে শাপ-শাপান্ত করছেন তীব্র শব্দাবলি উচ্চারণ করে- এটা ভাবা যায়? এটা কেবল ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যদি এ কথা মনে রাখি যে রবীন্দ্রনাথ নিছক লিবারেল গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না; তিনি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। তিনি গণতন্ত্রকে কমিউনিস্টদের মতো ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলেননি বটে, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষার গণতন্ত্রকে তিনি সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যবস্থা বলেই মনে করতেন। তার গণতন্ত্রের ধারণা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতাকে অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে ভেবে এসেছে। আর যতই দিন গড়িয়েছে- তার জীবনের শেষ তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে- রবীন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা সচেতনভাবে অবাধ ধনবাদ বিরোধিতার দিকে এগিয়ে গেছে। এই কথাটা আমি বিশেষ জোরের সাথে বলতে চাই।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৫৯
পূর্বে প্রকাশিতের পর
প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ ও ‘বাঙালি-পেট্রিয়াটিজম’ প্রবন্ধ দুটি পাঠে বোঝা যায় প্রথাগত সমাজতন্ত্রী না হয়েও কী করে সমাজতন্ত্রী হওয়া যায়। সাধারণ মানুষের গণতন্ত্রের কথা বলেও কী করে সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সুষম বণ্টনের পক্ষে দাঁড়ানো যায়। যেমনটা ছিলেন বঙ্গবন্ধু- তার সমাজতন্ত্র ছিল কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র, যাকে তিনি একপর্যায়ে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এটা তার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্যারাডাইমের একটি মৌলিক ধারণা। এটি স্পষ্টতই বিলেতের ‘লেবার পার্টির সমাজতন্ত্র’ থেকে মৌলিকভাবে পৃথক একটি নিজস্ব উদ্ভাবন। এ নিয়ে পরবর্তীকালে আরো কিছু কথা যোগ করব। কিন্তু আপাতত এটুকু বলব যে, পাকিস্তানের বৃহৎ ভূস্বামী-জমিদার-জায়গিরদারদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যেমন প্রকাশ্যেই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন- সেই সামন্তবাদবিরোধী অবস্থানটি বাঙালির সাম্যচিন্তায় পূর্বাপর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। বঙ্কিমের সাম্যচিন্তার প্রসঙ্গ এ ক্ষেত্রে পূর্বেই উল্লেখ করেছি। রমেশচন্দ্র দত্তের ‘দ্য পেজেন্ট্রি অব বেংগল’ বইটির কথাও বড় করে উল্লেখ করতে হয়। এর কিছুকাল আগে বঙ্কিম-ভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র ‘দ্য বেঙ্গল রায়তস’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন পল্লীসমাজ পুনর্গঠনবিষয়ক তার অসংখ্য রচনা ও চিঠিপত্র। ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী কৃষকের স্বার্থ-রক্ষার প্রশ্ন তোলাতেই তাকে ‘বলশেভিক জুজুর’ ভয় দেখানো হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী যেখানে ছিলেন Peasant Proprietorship-র পক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আরো এক ধাপ এগিয়ে। অর্থনৈতিক বিচারে সমবায়ী মালিকানার কার্যকারিতা নিয়ে অনেক তর্ক উঠতে পারে। কিন্তু এটা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একধরনের ‘যৌথ খামারের’ পক্ষে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ‘মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ’ চিন্তার মৌলিক মিল দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার নয়। বাকশালের সেন্ট্রাল কমিটির প্রথম বৈঠকে কৃষিতে দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্ক বলতে গিয়ে তিনি বললেন যে, অন্তত নিরীক্ষামূলকভাবে হলেও ৬০ থেকে ১০০টা কো-অপারেটিভ করে দেখা হবে যে এই সিস্টেম আদৌ কাজ করে কিনা :
‘আমি জাম্প করতে চাই না। আমি জাম্প করবার মানুষ নই …। আমি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট নই। … সেই জন্য আমি বলে দিয়েছি, ৬০টা ৭৫ কি ১০০টা কো-অপারেটিভ করবো। এই কো-অপারেটিভ যদি দরকার হয়, সেন্ট্রাল কমিটির এক একজন মেম্বার এক একটা চার্জে থাকবেন। … ওয়ান্স ইউ আর সাকসেসফুল অ্যাবাউট দিস মাল্টিপারপাস সোসাইটি, দেশের মানুষকে একতাবদ্ধ করা যাবে। বদমায়েশ একদল লোক, জমি সব শেখ সাহেব নিয়ে যাবে বলে তারা প্রপাগান্ডা করে। জমি নেবো না। তোমরা চেষ্টা করবে, একসঙ্গে ফসল উৎপাদন করবে, তোমার শেয়ার তুমি নেবে। … জমি নেবো না, জমি থাকবে। কিন্তু জমির একটা লিমিট আছে তোমাদের রাখার। আইন হয়েছে, ১০০ বিঘার বেশি রাখতে পারবে না। সেটা আমরা ফলো করবার চেষ্টা করবো এবং আস্তে আস্তে যদি ফ্লাড বন্ধ করতে পারি, সেচের ব্যবস্থা করতে পারি, ফার্টিলাইজার দিতে পারি, নিশ্চয়ই আমরা চিন্তা করবো, আরো কতদূর কী করতে পারি। কেননা, আমার দেশের জমির মধ্যে পার্থক্য আছে। এখন আমি যদি সুনামগঞ্জের জমি যেখানে তিনবার বছরে বন্যা হয়, এক বছর ফসল হয়- নর্থ বেঙ্গলের জমি আর বরিশালের জমি, চিটাগাং হিল ট্রাক্টের জমি। আর অন্য সব জমি এক পর্যায়ে দেখতে চাই তাহলে অসুবিধা হবে। আমার স্টাডির প্রয়োজন আছে। কোন জায়গায় কত পরিমাণে ফসল হতে পারে।’ এ ধরনের নিরীক্ষামূলক সমবায়ের চিন্তা রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও পাই। ১৯০৮ সালে পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীর সভাপতির ভাষণে তিনি যৌথ চাষাবাদের প্রস্তাব রেখেছিলেন এবং এই যৌথ পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য দেশের গ্রামাঞ্চলকে একেকটা অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছিলেন। প্রথমে দেবো যৌথ চাষাচাদের ভিত্তিতে সমবায় প্রতিষ্ঠার উদ্ৃব্দতি এবং পরে দেবো গ্রামকে ঘিরে অর্থনৈতিক জীবন সক্রিয় করার বিবরণী। যৌথতা ছাড়া যে সার্বিক গ্রামীণ পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্তি নেই এটা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ :
‘জোতদার ও চাষা রায়ত যতদিন প্রত্যেকে স্বতন্ত্র থাকিয়া চাষাবাস করিবে ততদিন তাহাদের অসচ্ছল অবস্থা কিছুতেই ঘুচিবে না। পৃথিবীতে চারিদিকে সকলেই জোট বাঁধিয়া প্রবল হইয়া উঠিতেছে; এমন অবস্থায় যাহারাই বিচ্ছিন্ন এককভাবে থাকিবে, তাহাদিগকে চিরদিনই অন্যের গোলামি ও মজুরি করিয়া মরিতেই হইবে। … অদ্যকার দিনে যাহার যতটুকু ক্ষমতা আছে সমস্ত একত্র মিলাইয়া বাঁধ বাঁধিবার সময় আসিয়াছে। এ না হইলে ঢালু পথ দিয়া আমাদের ছোটো ছোটো সামর্থ্য ও সম্বলের ধারা বাহির হইয়া গিয়া অন্যের জলাশয় পূর্ণ করিবে। … য়ুরোপে আমেরিকার কৃষির নানা প্রকার মিতশ্রমিক যন্ত্র বাহির হইয়াছে- নিতান্ত দারিদ্র্যবশত সে সমস্ত আমাদের কোনো কাজেই লাগিতেছে না- অল্প জমি ও অল্প শক্তি লইয়া সে সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব নহে। যদি এক-একটি মণ্ডলী অথবা এক-একটি গ্রামের সকলে সমবেত হইয়া নিজেদের সমস্ত জমি একত্র মিলাইয়া দিয়া কৃষিকার্যে প্রবৃত্ত হয়, তবে আধুনিক যন্ত্রাদির সাহায্যে অনেক খরচ বাঁচিয়া ও কাজের সুবিধা লইয়া তাহারা লাভবান হইতে পারে। … পাটের ক্ষেত সমস্ত এক করিয়া লইলে প্রেসের সাহায্যে তাহারা নিজেরাই পাট বাঁধাই করিয়া লইতে পারে। গোয়ালারা একত্র হইয়া জোট করিলে গো-পালন ও মাখন, ঘৃত প্রভৃতি প্রস্তুত করা সস্তায় ও ভালোমতো সম্পন্ন হয়।’
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি গোটা গ্রামজীবনের বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকে ঘিরে। সেখানে তিনি বলছেন যে, প্রতিটি গ্রাম বা কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা ‘মণ্ডলী’ হবে এক ধরনের Local State. মনে রাখতে হবে, ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ডের সংস্কারের অধীন প্রস্তাবিত ইউনিয়ন বোর্ডের ১১ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ এই প্রস্তাব রাখছেন। পাঠকই বিবেচনা করে দেখুন :
‘দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজন সাধনক্ষম করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। কতগুলো পল্লী লইয়া এক-একটি মণ্ডলী স্থাপিত হইবে। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের এবং অভাবমোচনের ব্যবস্থা করিয়া মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করিয়া তুলিতে পারে, তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা সর্বত্র সত্য হইয়া উঠিবে।’
একে Local Self Government না বলে Local Self Governance-এর মডেলই বলা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেননা, পরাধীন ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ চাননি গ্রামের স্ব-শাসনের ব্যবস্থার মধ্যে সরকার বাহাদুরের অনুপ্রবেশ ঘটুক। Governmentalization বা সর্বত্র সরকারীকরণের বিরুদ্ধে ছিলেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ Governmentalization-র বিরোধী ছিলেন : পঞ্চায়েতের মধ্যে সরকারের বেনো জল একবার ‘ঢুকিলে পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েতত্ব ঘুচিল’- এ রকম সতর্কবাণী তিনি একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন তার ‘স্বদেশী সমাজ’ ও অন্যান্য রচনায়। যা হোক, পাবনা সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন :
‘নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাংক স্থাপনের জন্য ইহাদিগকে শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হইবে। প্রত্যেক মণ্ডলীর একটি করিয়া সাধারণ মণ্ডপ থাকিবে, যেখানে কর্মে ও আমোদে সকলে একত্র হইবার স্থান পাইবে এবং সেইখানে ভারপ্রাপ্ত প্রধানেরা মিলিয়া সালিশের দ্বারা গ্রামের বিবাদ ও মামলা মিটাইয়া দিবে।’
দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে মণ্ডলীকে নিছক গ্রাম-সভার একটি প্রাতিষ্ঠানিক পাটাতন বলে ভাবেননি, এমনকি আজকের যুগের ‘ইউনিয়ন কাউন্সিল’ রূপেও ভাবেননি। তিনি প্রতিটি গ্রাম মণ্ডলীকেই একটি প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ স্ব-শাসিত ‘সর্বপ্রকার প্রয়োজন-সাধনক্ষম’ করে গড়ে উঠতে দেখতে চেয়েছিলেন। এসব প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন (Institutional development) ছাড়া গ্রামের কৃষকের জীবনের মৌলিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়- এই ছিল তার সুচিন্তিত মত। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পরের লেখাগুলোয় আরও বিস্তৃতভাবে রবীন্দ্রনাথ যৌথ-চাষাবাদ, বহুমুখী সমবায় ও স্বশাসিত গ্রাম-পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়ে লিখেছেন। দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের কবি-খ্যাতি তার এই গুরুত্বপূর্ণ সাম্যবাদী লেখাগুলোকে এতদিন প্রায় আড়াল করে রেখেছিল। ফলে বাঙালি নীতিপ্রণেতাদের এদিকে বিশেষ নজর পড়েনি। ১৯১৮ সালে লেখা তার ‘সমবায়’ প্রবন্ধটি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নিরীক্ষামূলক মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ব্যবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের উদ্দেশ করে বলছেন :
‘যাহা একজনে না পারে তাহা পঞ্চাশ জনে জোট বাঁধিলেই হইতে পারে। তোমরা যে পঞ্চাশ জনে চিরকাল পাশাপাশি পৃথক পৃথক চাষ করিয়া আসিতেছ, তোমরা তোমাদের সমস্ত জমি হাল-লাঙ্গল গোলাঘর পরিশ্রম একত্র করিতে পারিলেই গরিব হইয়াও বড়ো মূলধনের সুযোগ আপনিই পাইবে। যখন কল-আনাইয়া লওয়া, কলে কাজ করা- কিছুই কঠিন হইবে না। কোনো চাষীর গোয়ালে যদি তার নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক সের মাত্র দুধ বাড়তি থাকে, সে দুধ লইয়া সে ব্যবসা করিতে পারে না। কিন্তু একশো দেড়শো চাষী এমন বাড়তি দুধ একত্র করিলে মাখন-তোলা কল আনাইয়া ঘিয়ের ব্যবসা চালাইতে পারে। য়ুরোপে এই প্রণালীর ব্যবসা অনেক জায়গায় চলিতেছে। ডেনমার্ক প্রভৃতি ছোটো-ছোটো দেশে সাধারণ লোকে এইরূপে জোট বাঁধিয়া মাখন পনির ক্ষীর প্রভৃতির ব্যবসা খুলিয়া দেশ হইতে দারিদ্র্য একেবারে দূর করিয়া দিয়াছে। এই সকল ব্যবসায়ের যোগে সেখানকার সামান্য চাষী ও সামান্য গোয়ালা সমস্ত পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে আপন বৃহৎ সম্বন্ধ বুঝিতে পারিয়াছে। এমনি করিয়া শুধু টাকায় নয়, মনে ও শিক্ষায় সে বড়ো হইয়াছে। এমনি করিয়া অনেক গৃহস্থ অনেক মানুষ একজোট হইয়া জীবিকা নির্বাহ করিবার যে উপায় তাহাকেই য়ুরোপে আজকাল কো-অপারেটিভ-প্রণালী এবং বাংলায় ‘সমবায়’ নাম দেওয়া হইয়াছে। আমার কাছে মনে হয়, এই কো-অপারেটিভ প্রণালীই আমাদের দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার একমাত্র উপায়।’
এই সমবায়ী মালিকানাই বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানের ‘Fundamental Principles of State Policy’ অধ্যায়ের ১৩নং আর্টিকেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কথাটি ছিল এরূপ : ‘Co-operative Ownership, that is Ownership by Co-operatives on behalf of their members & within such limits as may be prescribed by law’। অর্থাৎ, সমবায়ী মালিকানার পরিধি ছিল ব্যাপক- তা যে কোনো খাতেই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। পরবর্তীকালে এই সমবায়ী মালিকানা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে ও বাকশালের মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ধারণার প্রয়োগে আরও সমৃদ্ধ করার প্রয়াস ছিল। সমবায় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর নিজের প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই গ্রামাঞ্চলে সমবায় নিয়ে নিরীক্ষামূলক কাজকর্ম নিয়ে তার মধ্যে গভীর আগ্রহ দেখা দেয়। এ রকমই একটি নিরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অর্থনীতিবিদ মো. আনিসুর রহমান। এটা ছিল গ্রামকে ‘স্বনির্ভর’ করার আন্দোলন সম্পর্কিত একটি নিরীক্ষামূলক উদ্যোগ। এ ধরনের উদ্যোগে শুধু গ্রামবাসীরাই উদ্যোগী হয়েছিলেন তাই নয়, গ্রামের স্বনির্ভর কর্মকাণ্ডে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে সম্পৃক্ত হতে পারেন, তারও নতুন উদাহরণ তৈরি হচ্ছিল। ফিরে যাই চুয়াত্তরের জানুয়ারিতে, যখন আনিসুর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথন হচ্ছে গ্রামের উন্নয়নকে ঘিরে, ততদিনে আনিসুর রহমান পরিকল্পনা কমিশনের কাজ ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় ফিরে গেছেন। দু’জনের কথোপকথনের বিষয়বস্তু গ্রাম। আনিসুর রহমানের ‘পথে যা পেয়েছি’ থেকে উদ্ধৃতি করছি। আনিসুর রহমানকে দেখে বঙ্গবন্ধু সস্নেহে তাকে তার পাশে বসালেন। বললেন, ‘এতদিন আসেননি কেন?
আনিসুর রহমান- ‘আপনি এত ব্যস্ত মানুষ, খামাখা এসে আপনাকে বিরক্ত করব কেন?’
বঙ্গবন্ধু- ‘আপনার গ্রামের কাজ কেমন চলছে?
আনিসুর রহমান-‘চলছে একরকম।’
বঙ্গবন্ধু- ‘জানেন, আমার একটা আইডিয়া আছে। আমার দুটা গ্রাম আছে, … এ দুটো আমার নিজের গ্রাম, আমি সেখানে যাই, গ্রামের লোকেরা আসে, আমার কথা শোনে। চলেন এক দিন গ্রাম দুটোতে আমি আর আপনি যাই, আপনি আপনার সব গ্রাম-উন্নয়নের আইডিয়া বলবেন, তারা শুনবে।’
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৫৮
পূর্বে প্রকাশিতের পর
১৯২০ সালেই প্রমথ চৌধুরী বলছেন যে স্বাতন্ত্র্য-চর্চা ফুটিয়ে তোলা গেলেই কেবল প্রদেশে-প্রদেশে, জাতিতে-জাতিতে ঐক্যের অন্যরকম সম্ভাবনা বা ভিত্তি তৈরি হবে :তখন ভারতবর্ষের নানা জাতি একাকার হবার চেষ্টা করবে না। পরস্পরের ভিতর ঐক্য স্থাপন করবার চেষ্টা করবে। আজকের দিনের কনগ্রেসি ঐক্যের সঙ্গে সে ঐক্যের আকাশপাতাল প্রভেদ হবে।… এক জেলে পাঁচজন কয়েদির মিলন আর এক সমাজের পাঁচজন স্বাধীন লোকের মিলনের ভিতর যে প্রভেদ আছে, আজকের ভারতের নানা জাতির কন্গ্রেসী মিলনের সঙ্গে কালকের স্বরাজ্যবাদী জাতিদের মিলনের সেই প্রভেদ থাকবে। তখন প্রাদেশিক পেট্রিয়টিজমের ভিত্তির ওপরেই বাক্যগত নয়, বস্তুগত ভারতবর্ষীয় পেট্রিয়টিজম গড়ে উঠবে।’ প্রমথের চিন্তা অনুসরণ করলে দেখা যায় যে, এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্র- এ রকম চিন্তাই হচ্ছে ‘সেলফডিটারমিনেশন-বিরোধী ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়ালিজম’। এই কৃত্রিম একত্ব থেকে বেরিয়ে এসে যার যার প্রাদেশিক ন্যাশনালিজমের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক-রাষ্ট্রিক বিকাশ কামনা করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। বেঁচে থাকলে শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের যুক্ত-বাংলাভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের পক্ষে সায় থাকত তার, এটাও অনুমান করা অসঙ্গত নয়। এজন্যই তিনি নিদ্র্বিধায় বলতে পেরেছেন, ‘বাঙালির ন্যাশনালিজমের আদর্শ যে কি, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সমগ্র ভারতবাসীকে ডোরকৌপীন পরানো আমাদের আদর্শ হতে পারে না।… আমার শেষ কথা এই যে, যে দেশকে আমি অন্তরের সহিত ভালোবাসি, সে বর্তমান বাংলাও নয়, অতীত বাংলাও নয়- ভবিষ্যৎ বাংলা, অর্থাৎ যে বাংলা আমাদের হাতে ও মনে গড়ে উঠেছে।’
যদিও দেশভাগের আগে ও পরের ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে গড়িয়ে গেল। ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের মূল ভার্সনে ‘states’ শব্দের বদলে ১৯৪৬ সালে প্রতিস্থাপিত হলো ‘state’ শব্দটি। জিন্নাহ বললেন যে, ১৯৪০-র states আসলে ছিল একটি মুদ্রণজনিত প্রমাদ- a typographical error! বাংলার কংগ্রেসি নেতারাও শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের যুক্তবঙ্গের প্রস্তাব সমর্থন করতে চাইলেন না। নেহেরু পূর্বাপর প্রাদেশিক সেলফ-ডিটারমিনেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। প্রমথ চৌধুরীর প্রদেশভিত্তিক স্বরাজ-রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শেখ মুজিব এই রাজনৈতিক পরিণতিকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন :”কাউন্সিল প্রস্তাব লেখা হল, সেই প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু মৌলিক একটা রদবদল করা হল। একমাত্র হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে ‘স্টেটস’ লেখা ছিল, সেখানে ‘স্টেট’ লেখা হয় তার প্রতিবাদ করলেন; তবুও তা পাস হয়ে গেল।” এর অর্থ হলো, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে একাধিক পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল, তা আর থাকল না। কলমের এক খোঁচায় ১৯৪৬ সালের দিল্লি কনভেনশনে কেবল মাত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু এ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি বললেন, ‘১৯৪০ সালে লাহোরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে, সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে পরিবর্তন করতে পারে কি না এবং সেটা করার অধিকার আছে কি না এটা চিন্তাবিদেরা ভেবে দেখবেন।’ পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালের ২১ দফায় এবং ১৯৬৬ সালের ৬ দফায় মূল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাওয়া হয়েছিল।
এত সাতকাহনের উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, শেখ মুজিব ও তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের সহকর্মীদের ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছুটা পিছিয়ে গিয়েই প্রমথ চৌধুরী কথিত ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজমের’ সাধনা করতে হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী যাকে বলেছিলেন ‘প্রাদেশিক স্বরাজ’, পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে তার রূপরেখা গোড়া থেকে দাঁড় করাতে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এই আন্দোলন ক্রমশ লাহোর প্রস্তাবের সংকীর্ণ মুসলিম জাতীয়তাবাদী গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বিকভাবে বাঙালির ন্যাশনালিজমের আদর্শকে এক রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদনের কালে সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এই জাতীয়তাবাদকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন :
“জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, অনেক মনীষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং, এ সম্বন্ধে আমি আমার নতুন সংজ্ঞা নাই বা দিলাম। আমি শুধু বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি। এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন- সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হল অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদও আসতে পারে না। অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক-জাতি হয়েছে। অনেক দেশই আছে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে- তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। সেজন্য আজ বাঙালী জাতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা নিয়েছি, যার উপর ভিত্তি করে আমরা সংগ্রাম করেছি, সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালী, আমার ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’। এর মধ্যে যদি কেউ আজকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন তুলতে চান, তাহলে তাকে আমি অনুরোধ করব, মেহেরবানি করে আগুন নিয়ে খেলবেন না।”
বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই সংজ্ঞায় প্রমথ চৌধুরীর কোনো আপত্তি থাকত না। রবীন্দ্রনাথও এ ক্ষেত্রে সহমত হতেন। কারণ এই জাতীয়তাবাদ (প্রমথের ভাষায়) ‘আমাদের হাতে ও মনে গড়ে উঠেছে।’ এই জাতীয়তাবাদ আমাদের ‘সেলফ-রিয়ালাইজেশনের’ ফসল। এ কথাটিও প্রমথ চৌধুরীর- ‘জাতির পক্ষে একমাত্র আদর্শ হচ্ছে সেলফ-রিয়ালাইজেশন।’ কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর চিন্তায় ‘প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বরাজ-গঠন’ এই নভেল আইডিয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণই এখানে আমার একমাত্র বা প্রধান লক্ষ্য নয়। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও মধ্যপন্থার মানুষ। অবাধ পুঁজিবাদও চান না, আবার একনায়কত্ব-ভিত্তিক সমাজতন্ত্রও চান না। তিনিও অন্য এক সমাজতন্ত্র খুঁজছেন। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের তিন বছরের মাথাতেই প্রমথ চৌধুরী রূপক অর্থে যা লিখলেন তার সমসাময়িক তুলনা মেলা ভার। অন্তত এই উদ্ধৃতিটি বড় করে দেওয়ার দাবি রাখে :
‘একটা কথার অর্থ পরিস্কার করা দরকার, সে কথাটা হচ্ছে স্বার্থ।… এ তো হবারই কথা। আমরা যখন প্রাণী, ও প্রাণের সর্বপ্রধান চেষ্টা যখন আত্মরক্ষা করা, তখন অন্ন আমাদের চাইই চাই। আর পলিটিক্সের যত বড়ো বড়ো কথা আছে তার আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক খোলস ছাড়িয়ে নিলে কি দেখা যায় না যে, তার ভিতরকার মোটা কথা হচ্ছে অন্ন? আজকের দিনে পৃথিবীতে পলিটিক্সের দুটি বড় কথা হচ্ছে ক্যাপিটালিজম এবং বলশেভিজম, বাদবাকি আর যতরকম ism আছে সে সবই হয় ক্যাপিটালিজম নয় বলশেভিজমের কোঠায় পড়ে। হাল পলিটিক্সের এই দুই ধর্ম এতই পরস্পরবিরোধী যে, উভয়ের মধ্যে অর্ধেক পৃথিবীজুড়ে আজ জীবনমরণের যুদ্ধ চলছে। অথচ এই উভয় পলিটিক্যাল ধর্মের ভিতর একই জিনিস আছে এবং সে জিনিস হচ্ছে অন্ন। তবে মানবজাতি যে দুভাগ হয়ে পড়েছে সে ঐ অন্নের ভাগ নিয়ে। ক্যাপিটালিজমের মূল সূত্র হচ্ছে অল্প লোকের বহু অন্ন, আর বলশেভিজমের মূল সূত্র হচ্ছে, বহু লোকের যথেষ্ট অন্ন। আমার বিশ্বাস এ দুয়ের কোনোটিই টিকবে না। কেননা, ক্যাপিটালিজম ভুলে গিয়েছে যে, রুটি সকলেরই চাই, আর বলশেভিজম মনে রাখেনি Man does not live by bread alone, অর্থাৎ, মানুষের মন বলেও একটা জিনিস আছে, অতএব, পেটের খোরাক ছাড়া মানুষের মনের খোরাকও চাই, নচেৎ মানুষ পশুর সঙ্গে নির্বিশেষ হয়ে পড়ে।’ কিছু আগেই আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধু নয়া চীনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন যে, অন্নের সাথে স্বাধীনতা না পেলে মানুষের মন ‘পাথরের মত’ শুস্ক হয়ে যায়।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে লেখা প্রবন্ধটিতে যখন পড়ি অবাধ পুঁজিবাদ ও একনায়কত্ব-ভিত্তিক সমাজতন্ত্র ‘কোনটিই টিকবে না’, তখন প্রমথের বিশ্নেষণকে প্রফেটিক মনে না হয়ে পারে না। তার মানে এই নয় যে, বলশেভিজমের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী কোনো প্রগতিশীল উপাদান খুঁজে পাননি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রায়ত বা কৃষককে জমির মালিকানা দেওয়ার প্রশ্ন উঠলেই বলশেভিজম বা সমাজতন্ত্রের হাত আবিস্কার করা হত তাতে। ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী এ বিষয়ে বলছেন :
‘দেখা গেল যে, রায়তদের শিক্ষার দাবি ও স্বাস্থ্যের দাবি সকলেই মঞ্জুর করেন, কিন্তু তাদের স্বত্বের দাবির কথা কানে ঢোকবামাত্র চমকে ওঠেন, এমন লোকের এ দেশে অভাব নেই। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে অনেকে আবার প্রজার পক্ষ যারা সমর্থন করতে উদ্যত হন তাদের বুদ্ধি ও চরিত্রের উপর নানারূপ দোষারোপ করতে ক্ষণমাত্র দ্বিধা করেন না। যে প্রজার অধিকারের কথা তোলে, কারো মতে সে বলশেভিক, কারো মতে সে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শত্রু, আবার কারো মতে-বা সে এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর-এক সম্প্রদায়ের মারামারি-কাটাকাটির পক্ষপাতী। এরা যদি একটু ভেবে দেখেন তা হলেই দেখতে পাবেন যে, এ সকল অপবাদ কতদূর অমূলক। প্রথমত, বলশেভিক জন্তুটি যে কি, তা তারাও জানেন না আমরাও জানি নে। জুজুর ভয় ভদ্রলোকের পক্ষে অপরকে দেখানোও যেমন অনুচিত, নিজে পাওয়াও তেমনি ছেলেমি।’
প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ লিখিত হয় ১৯১৯ সালে, আর রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসে ১৯১৭ সালে। দু’বছরের মধ্যেই ‘বলশেভিক জুজুর’ আলোচনা বাংলার শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে বিশেষ তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল, দেখা যাচ্ছে। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধেই সর্বপ্রথম বাংলার কৃষকের কাছে জমি হস্তান্তর করার দাবি জানানো হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ভূমি সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছিল। যেটা বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও ‘সাম্য’ প্রবন্ধে সরাসরিভাবে বলা হয়নি আগে। সেসব লেখায় মূলত রায়তদের দুঃখ-দুর্দশার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর ঋজু চিন্তায় এ গদ্যে স্পষ্ট করে দাবিটা তোলা হয়েছিল সেদিন। বাঙালির সাম্য-চিন্তায় তার অনন্যসাধারণ অবস্থান এতে করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে :
‘আমাদের জনসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে কিসের বিশেষ অভাব আছে জানেন?- স্বাধিকারের জ্ঞান। মনস্তত্ত্ববিদেরা জানেন যে, স্বত্বের জ্ঞান থেকেই মানুষের অধিকারের জ্ঞান জন্মায়।… এ দেশের কৃষকদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক লোকের জমি তার নিজস্ব সম্পত্তি। বাংলার প্রজা যদি জমি হস্তান্তর করবার, গাছ কাটবার, কোঠা বাড়ি করবার, কুয়ো খোঁড়বার অধিকার পায়, এবং সেই সঙ্গে তার জোত মৌরসী-মোকবরি হয়, তাহলে সে ইংরেজিতে যাকে বলে peasant proprietor তাই হয়ে উঠবে। প্রজা জমির মালিক হয়ে উঠলে জাতির শক্তি ও দেশের ঐশ্বর্য যে কতদূর বেড়ে যায় তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ বর্তমান ফ্রান্স। আর প্রজাকে স্বত্বহীন ও দরিদ্র করে রাখলে তার ফল যে কী হয়, তারও জাজ্বল্যমান উদাহরণ বর্তমান রাশিয়া।’ প্রমথ চৌধুরী প্রথাগত কোনো সমাজতন্ত্রী ছিলেন না (প্রবন্ধটি যখন লেখা হয়েছে ভারতে বা বাংলায় তখনো কমিউনিস্ট পার্টি গঠিতই হয়নি)। তিনি ছিলেন লিবারেল ডেমোক্রেসির পক্ষের লোক, কিন্তু ‘দ্য ল্যান্ড কোয়েশ্চনস’কে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সুতীব্র ভাষায় তিনি সামন্তবাদকে আক্রমণ করেছিলেন। খোদ কৃষকের হাতে জমির স্বত্ব দেওয়ার নীতিকে সমর্থন করেছিলেন সামাজিক ন্যায়ের তাগিদে। এজন্যে তাকে ‘বলশেভিক জুজুর’ ভয় দেখানো হলেও তিনি পিছু হটেননি। তিনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলার মতো মানুষ নন। রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলে তার অবস্থান (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদুষী কন্যা ইন্দিরা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন)। তার কাছে উচ্চকণ্ঠের স্লোগান-তোলা সমাজতন্ত্র আশাও করতে পারি না আমরা। তার পরও তাকে বলতে হয়েছিল :
‘যারা বলশেভিজমের ভয়ে কাতর তাদের অনুরোধ করি যে, তারা বাংলার রায়তকে বাংলার peasant proprietor করবার জন্য তৎপর হোন। যেরকম দিনকাল পড়েছে, তাতে করে মানুষকে আর দাস ও দরিদ্র করে রাখা চলবে না। প্রজাকে এসব অধিকার আমরা যদি আজ দিতে প্রস্তুত না হই তো কাল তারা তা নিতে প্রস্তুত হবে।’
[ক্রমশ]