ইশতেহার কি আমাদের জন্য (What is our manifest?)

আমরা ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে সময়ের গ্রন্থিগুলো পার হচ্ছি। অনেকটা যেন রজ্জুপথে চলা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই মহাপতনের দিকে। একটা জাতি এত দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম চাপের মধ্যে থেকে সুস্থ থাকতে পারে না। তাই সামগ্রিকভাবে এবারের নির্বাচনটা আর দশটা নির্বাচনের মতো গতানুগতিক নির্বাচন নয়। তার দুটি কারণ। একটি কারণ হচ্ছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অচিরেই পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার যে সরকার নির্বাচিত হবে, সে সরকারই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। কেবল উৎসব উদযাপনই নয়, এর সঙ্গে আরও কিছু দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জও তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন- পঞ্চাশ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলাম, পঞ্চাশ বছর পরে এসে আমাদের অর্জনটাই বা কী হলো, আর আমরা সামনের পথটাই বা কীভাবে পাড়ি দেব? এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সময় এসে গেছে।

যেভাবে গত দশটি বছর পার করেছি, সামনের দশটি বছর ততটা নির্বিঘ্নে কাটবে না। সেই অর্থে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এবং এতে যে দলগুলো অংশগ্রহণ করছে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সেই তাগিদটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে এমডিজির পরে এখন এসডিজি এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজিগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা; আরেকটি হচ্ছে ২০৩০ সালে অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিটা গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশি হয়। আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। অঙ্কের হিসাবে বললেও সেটি ১১ বছর। এই ১১ বছরের মধ্যেই আমাদের দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্য হ্রাসকারী দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে হবে। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কিন্তু আলাদাভাবে কিছু লক্ষ্য গ্রহণ করেছি। যেমন এর একটি হচ্ছে, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো।

১. আদি প্রতিশ্রুতি ও তার আজকের অর্থ

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ইশতেহারে কী থাকা উচিত, তা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হতে পারে। আমি যে আলোচনাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, সেটা হচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও অস্তিত্বগতভাবে মানুষের মতোই। তারও সত্তার পরিবর্তন হয়। মানুষের সত্তা যেমন একই রূপ থাকে না; শৈশবে-কৈশোরে, যৌবনে বা বার্ধক্যে তার রূপ বদল হয়। তেমনি রাজনৈতিক দলেরও কিন্তু সত্তার বিবর্তন হয়। এর অর্থ হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও তার মূল নীতিমালাগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল নীতিমালার মধ্যে যেটা মৌলিক, যেটা আমাদের সংবিধানে রয়েছে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এ চারটি নীতি ১৯৭২ সালে যে অর্থ নিয়ে এসেছিল, সে অর্থ আজও তারা সমানভাবে বহন করে কি-না এবং বহন করে থাকলে এর নতুনতর অর্থ কী, সেটা খোঁজার জায়গা হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। নির্বাচনী ইশতেহারে সে সম্পর্কে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং সুচিন্তিত বক্তব্য থাকা উচিত। যেমন ধরা যাক, আগে সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝানো হতো এবং অনেকেই বুঝতেন জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানা, উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা এবং এ জাতীয় পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে যেটা এসেছিল। ধারণাটা যখন এসেছে তখনও কিন্তু বিতর্কটা হয়েছিল, এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী? এবং আমাদের গণপরিষদে একটা দীর্ঘ বিতর্কও হয়েছিল এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় সে অর্থটা কেমন, তা নিয়ে। মার্ক্স কখনও চিন্তা করেননি যে, বৈষম্য বাড়লে সমাজতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হবে আর বৈষম্য কমলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। সেভাবে তিনি সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়ন করেননি। তিনি সমাজতন্ত্রকে একটি নতুন মৌলিক সভ্যতার ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে একদিকে বাজার পুঁজিবাদকে আশ্রয় করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার আমরা সমাজতন্ত্রের কথাও বলছি। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদও থাকছে, আবার সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাও থাকছে। দুটো মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের চেহারাটা কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি সুইডেন বা জার্মানির মতো একটা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি! না কানাডার মতো সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি, নাকি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতে চাচ্ছি, যেখানে ট্রাম্পচালিত সরকার আসে এবং প্রধানত নানা ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে স্বাস্থ্য খাতের নিশ্চয়তা নেই, হাই স্কুলের পরে শিক্ষার খরচ চালানো নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার কানাডা, সুইডেন বা জার্মানির মতো দেশে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের অধিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী ধারার হলেও জনগণকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মৌলিক সুবিধাদি কতটা পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কত গভীরে দেওয়া হবে- সেটার ওপরে ভিত্তি করে এক দেশ কিন্তু আরেক দেশ থেকে আলাদা। আমরাও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারি। বাংলাদেশ যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, তার অর্থটা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিজে মনে করি যে, আমাদের দেশে নিজস্ব ধরনের একটা সামাজিক গণতন্ত্র গড়ে ওঠার বস্তুগত অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আজকের অবস্থাটা থেকে আমরা যদি একটা সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চাই, তাহলে লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট করে বলা দরকার; এবং সেটাকে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

ঠিক তেমনিভাবে আসে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বোঝানো হতো, ধর্ম এবং রাষ্ট্র পরস্পর বিযুক্ত। ধর্ম হচ্ছে প্রাইভেট স্ম্ফিয়ারের আর রাষ্ট্রকার্য হচ্ছে পাবলিক স্ম্ফিয়ারের। সেই বিযুক্তির ধারণা থেকে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞাটা আমরা পেয়েছি বা নানাভাবে এসেছে, তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধর্ম পালনের সমান অধিকার। এ ক্ষেত্রে যেমন একটা স্লোগান প্রচলিত আছে- ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।

কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আরেকটু চিন্তা করার সুযোগ আছে। দার্শনিক হাবেরমাস যেমন বলেছেন, ‘উই হ্যাভ এনটার্ড ইনটু এ পোস্টসেকুলার এজ’। অর্থাৎ আমরা এখন এক ধর্মনিরপেক্ষতা-উত্তর সমাজে বাস করছি। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ যে শক্তি, তাকে এখন নতুন করে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে যেতে হচ্ছে। এই যে সংলাপে নতুন করে যেতে হচ্ছে, ধর্মীয় শক্তিকে সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্বীকার করতে হচ্ছে- এটা কিন্তু নতুন উপলব্ধি। সেটা ইউরোপে বসে ২০০৪ সালে তিনি লিখেছিলেন। কথাটা আমাদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও সত্য এবং বাংলাদেশের জন্যও সত্য। আমরা এখন শুধু অসাম্প্রদায়িকতা এবং শুধু ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই সংজ্ঞাতে আটকে না থেকে একটু বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে পারি- কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য শক্তিকে আমরা সামাজিক রূপান্তরের কাজে ও উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে পারি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমরা যে স্বীকৃতি দিয়েছি, সেটাকে কেউ কেউ বলতে পারেন, এই স্বীকৃতিটা এসেছে ওই ধরনের উপলব্ধি থেকে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে তারা মূলধারার শিক্ষাস্তরের সঙ্গে কতটুকু পরিমাণে সমান, সেটা নিরূপণের দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তায়। এই নিরূপণে যদি দেখা যায়, দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়ে গেছে, ঘাটতি রয়ে গেছে- তাহলে সেই ঘাটতিগুলো পূরণে আরও যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। সেটাকেই মূলত প্রকৃত স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্রের মতো এ বিষয়টিকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা যারা ভাবেন, তারা এখন নতুন করে বলুক- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তারা এখন কীভাবে দেখছেন? সেটা কি মুসলিম লীগের সেই মুসলিম বেঙ্গলের পুরনো ধারণার মধ্যেই আটকে আছে, নাকি তাকে আরও সম্প্রসারিত করে নতুনভাবে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দেখছেন; যে জাতীয়তাবাদের অংশ আদিবাসী থেকে শুরু করে সমতল ও পাহাড়ের সবাই; নাকি যেখানেই বাঙালি আছে, তাদের সবাই এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত? এককথায় প্রতিটি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের মূল চারটি আদর্শের বা প্রতিশ্রুতির সমসাময়িক অর্থবহতা সম্পর্কে একটা প্রতিফলন দরকার এই নির্বাচনী ইশতেহারগুলোয়।

২. দারিদ্র্য কমছে, বৈষম্য বাড়ছে

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইশতেহারে আমাদের জন্য প্রত্যাশিত কী কী প্রসঙ্গ আসতে পারে? একটা হচ্ছে, যে অর্থনীতিতে গত এক দশকে কিছু কিছু ইতিবাচক প্রবণতা জন্ম নিয়েছে, তার মধ্যে মোটামুটি স্বীকৃত একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই যে আজকে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬-সাড়ে ৬ শতাংশ করে বাড়ছে; কোনো কোনো বছর ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এটি ভালো দিক। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা, দারিদ্র্যও ধীরে ধীরে কমে আসার কথা। বাস্তবে দারিদ্র্য কমছেও। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত করতে পারি, মেয়েদের স্কুলগামিতার হার বাড়ছে, শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। এই যে প্রবৃদ্ধি বাড়া, দারিদ্র্য কমে আসা, মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়া- এর কারণে কতগুলো সামাজিক সূচকেও পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের সূচকে, বিশেষ করে প্রিভেনটিভ হেলথ কেয়ারে এবং শিক্ষাসূচকে আমরা অনেকগুলো ধাপ পার হচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গেই আবার জড়িত হয়ে পড়ছে কতগুলো নেতিবাচক দিক; যেগুলোকে ইতিবাচক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাচ্ছে না। অ্যাঙ্গেলসের একটা কথা ছিল যে, বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়তে থাকলে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রভুত্ব করার সামর্থ্য কমে যায়। আমাদের দেশেও বোধকরি এটা ঘটেছে। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’-এর শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্র যেমন লিখেছিলেন, ‘আজিকালি শোনা যায় দেশের খুব শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।’ এই শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্যও সত্য। কিন্তু তারপরই বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে, ‘কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? আমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, আমি তুমি কি দেশ! হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত- তাহাদের কি শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে?’ এই প্রশ্নটা তিনি রেখেছিলেন। এই প্রশ্নটাতে আমাদের টুইস্টটা হচ্ছে, হ্যাঁ এই শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দারিদ্র্য কমছে। তবে সবার কমছে না, এখনও কিছু চরম দরিদ্র পরিবার রয়ে গেছে হাওর অঞ্চলে বা বিভিন্ন উপদ্রুত উপকূলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কমছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি যেটা হচ্ছে, বৈষম্য বল্কগ্দাহীনভাবে বাড়ছে। সেটা বাড়ছে সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানেই। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, বৈষম্য ৪৪ শতাংশ থেকে এখন ৪৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সাধারণত বলা হয় যে, যখন জিনি কোইফিশিয়েন্ট ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা অতি উচ্চ বৈষম্যের স্তরে প্রবেশ করি, যাতে শুধু লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ও চীন প্রবেশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৈষম্যের হার ৪৫ শতাংশের মতো। ইউরোপিয়ান অনেক দেশে বৈষম্যের হার আরও কম। সুতরাং যদিও আমরা নিল্ফেম্নান্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছি- তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের প্রবৃদ্ধির অর্জনটা অনেকখানি ম্লান হয়ে যাচ্ছে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে। সে জন্যই ইশতেহারে একটা সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, প্রবৃদ্ধি বাড়াব, দারিদ্র্য কমাব; কিন্তু বৈষম্যকে বেশিদূর বাড়তে না দিয়েই। অর্থাৎ বৈষম্যের লাগাম ধরে রেখেই আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াব। এটা একটা মৌলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যদি বৈষম্যকে এভাবে বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দুটো কুফল দেখা দেবে। প্রথমত, প্রবৃদ্ধি একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক জিনি সূচকের বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে সামাজিক বৈষম্য। একশ্রেণির সঙ্গে আরেক শ্রেণির বৈষম্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। আমি সন্দেহ করি, সাম্প্রতিককালে যে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- আগামীতে হয়তো আমরা এমন আরও তরুণের আন্দোলন দেখতে পাব- যার পেছনে কাজ করেছে বা করবে এই বৈষম্যের উস্কানি। তার কারণ হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখছি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির সুফলগুলো সবার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। কর্মসংস্থানগুলো গুণগত মানের হয়ে, উপযুক্ত হয়ে তার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন একটা সামান্য ধরনের সামাজিক অস্থিরতা বা নড়াচড়াই বড় ধরনের দুর্বিপাকের আশঙ্কা বয়ে নিয়ে আসছে- এটার মূল কারণ হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান যথাযথ মানের হতে পারছে না। এবং সেইসঙ্গে মানুষে মানুষে যে আয়বৈষম্য, সম্পদে বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য, যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্য- এসব মানুষকে আহত করছে। সেটা নানাভাবে, নানা উপায়ে বহিঃপ্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আমাদের মতো দেশে এখনও পর্যন্ত যথার্থ অর্থে একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দাঁড়ায়নি। যেটা উন্নত বিশ্বে তো বটেই, মাঝারি উন্নত দেশেও আছে। যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই একই ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন। মূলত তারা একই র‌্যাপিড ম্যাস ট্রান্সপোর্টে চড়ে কাজে যাচ্ছেন। এর ফলে একে অপরের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যাতায়াত করতে করতে একটা অভিন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠছে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিটি ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা একেকটি নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য বাঁধা। উচ্চবিত্তরা নিজস্ব গাড়িতে চড়ছেন, মধ্যবিত্ত বাস-রিকশায় চড়ছেন, নিম্নবিত্ত হেঁটে যাচ্ছেন।

সুতরাং বৈষম্যের ব্যাপারে যে কোনো সময়ের নির্বাচনের তুলনায় এবার আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করি। তাদের ইশতেহারে চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকায় সর্বশীর্ষে এই বৈষম্য দূর করার কথা রাখা উচিত। শুধু একটি নীতি নিয়ে এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সকলের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ বৃদ্ধি করা- উন্নত বাসস্থান, উন্নত শিক্ষা, উন্নত কর্মসংস্থান, উন্নত ঋণপ্রাপ্তি প্রভৃতি সুযোগ যাতে কেবল ধনীদেরই মধ্যে সীমিত না থাকে। রাষ্ট্রের পুনর্বণ্টনমূলক নীতিমালাকে, যথা- রাজস্ব-ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে ফলপ্রসূ সম্পত্তি-করের প্রবর্তন করতে হবে।

৩. ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ?

বৈষম্যের পরে আমি যে দ্বিতীয় নেতিবাচক প্রবণতার কথাটি বলছি সেটি হচ্ছে, ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদের আশঙ্কা। আমার ধারণা, আমাদের দেশে ক্রমশ একটা ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ ব্যবস্থা গেড়ে বসছে। মূলত পুঁজিবাদের যে স্বাভাবিক শক্তি, নিজেকে নিজে শোধন করার যে প্রক্রিয়া- সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় এই ঝুঁকির মাধ্যমে। পুঁজিবাদ সব সময়ই পুঁজিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ঝুঁকির সামনে ঠেলে দিয়ে। আবার বাজারের বাইরের অনেক বিষয়ও পুঁজিবাদের বিকাশে কাজ করে। যেমন আমি চাইলেই আমার পাশের জমিটা দখল করতে পারি না। আমি চাইলেই ব্যাংকের টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত না দিয়ে দিনের পর দিন চলতে পারি না। চাইলেই মুনাফা থেকে যে কর-রাজস্ব দেওয়ার কথা, তা পরিশোধ না করে বড় ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারি না। অনেক উন্নত দেশের জন্যই এসব কথা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বে তো বটেই, গত এক দশকেও দেখছি এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের জন্য এই ঝুঁকিগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে বাজারের যে ঝুঁকি, সেটা থাকলেও বাজারবহির্ভূত যে ঝুঁকি- অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য তাকে যে ঝুঁকিগুলো বহন করতে হবে, সেগুলো কমে গেছে। তার মানে পুঁজিপতিরা এসব নিয়ম না পালন করে উল্টো এসবকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। এটাকেই আমরা বলছি ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ। এই ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদেই ক্রনি পুঁজিবাদের জন্ম হয়। এবং ক্রনি পুঁজিবাদের কারণেই তারা এটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছে। কারণ তারা ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে। যার সুবাদে প্রচুর ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করেও অনেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন বিনিয়োগগুলোর ওপর নানাভাবে এসবের প্রভাব পড়ছে। নতুন ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, নতুন ঋণের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, আইন না মানার একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। আর এই সবকিছুকেই আমি সামগ্রিকভাবে ‘ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ’ নামে আখ্যায়িত করছি। এই টার্মটি ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে, পুঁজিবাদের ভেতরে থেকেই পুঁজিবাদের যে অবনতি হচ্ছে, এর মাধ্যমে সেটাকে প্রশ্ন করা সম্ভব। এ রকম ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ যদি চলে, তাহলে সেই ঝুঁকিটা আসলে সমাজকেই বহন করতে হয়। পুঁজিপতি শ্রেণি সেই ঝুঁকি বহন করছে না। অথচ কথা ছিল উল্টোটা হওয়ার, যে পুঁজিপতি শ্রেণি ঝুঁকি নেবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে- এর মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে উল্টো। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে চাই শক্ত মেরুদণ্ডের নিয়মনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জোট। এটা শুধু একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। আবার এটা না হলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিকাশের পরবর্তী ধাপে যেতে পারব না।

৪. রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব

এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা কোনো বায়বীয় বিষয় নিয়ে হবে না, এটা হবে সেই নির্বাচনী দর্শনের যে পুনঃসংজ্ঞায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছিলাম, সেটাকে কেন্দ্র করে। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা হতে হবে এই যে, নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেটাকে মোকাবেলা করার জন্যই। আমাদের নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। এর জন্য নতুনভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আগে আমরা ভাবতাম, পুঁজিবাদী দেশ হওয়ার অর্থই হচ্ছে আমরা পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সুফলগুলো লাভ করব। কিন্তু এখন দেখা গেছে, এখানে পদে পদে রাষ্ট্রের একটা সহায়ক ভূমিকা রয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে সে দায়িত্ব পালন করবে, তার জন্য দরকার তার তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসন। সে যাদের ওপর খবরদারি করবে, সে তাদের বন্ধু হতে পারবে না। রাষ্ট্রকে তাই একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা একটা প্রাথমিক ধাপ, যাতে করে তারা সহসাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে না পারেন। এ ছাড়া মেধাবী তরুণদের সরকারি কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থেই মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে। এবং এ আমলাতন্ত্র হতে হবে উন্নয়ন আমলাতন্ত্র। শুধু সরকারি দপ্তর বা রাষ্ট্রযন্ত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাসপাতাল- সর্বত্রই। সবখানেই আমরা দেখতে চাই সবচেয়ে যোগ্য মেধাবী নেতৃত্ব। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো উপায়েই এসব করতে হবে। আমরা যদি ছোট মাপের স্বপ্নও দেখে থাকি, বড় মাপের কিছু মানুষকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের সম্মানিত করতে হবে। সেটা না করলে আমাদের ছোট মাপের স্বপ্নও দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।

নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই দায়িত্ব আছে পরস্পরের কাছাকাছি আসার। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণির এই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে। এখানে কেবল পার্টির যারা বুদ্ধিজীবী তাদেরকেই নয়, ননপার্টিজান বুদ্ধিজীবীদেরও জায়গা করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেভাবেই হোক, এই দূরত্ব বেশি দিন থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। তাই আমাদের এমন একটা সামাজিক অঙ্গীকার দরকার, যেখানে সব পক্ষের প্রাজ্ঞজনের স্থান আছে। সবাই যাতে বুঝতে পারে, আমি যে রাজনৈতিক মতেরই হই না কেন, আমার একটা আলাদা আদরণীয় স্থান আছে রাষ্ট্রসভায়। এটাই ভারতবর্ষীয় রীতি :রাজন্যবর্গ সব সময়েই পণ্ডিতদের সম্মান করে এসেছেন।

৫. বহুবার বলা তবু অসমাপ্ত যে কাজগুলো

সর্বশেষ যে কথাগুলো বলতে চাই, সে কথাগুলো বহু মানুষ বহুবার বলেছেন; কিন্তু কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তা বাস্তবায়িত হতে হতে হয়নি। সেখান থেকে তিনটা কাজের কথা আমি বলতে চাই, যা অসমাপ্ত থেকে গেছে। অথচ এর ব্যাপারে করণীয়গুলো সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই একমত। সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের জন্য অবশ্যপালনীয় একটা কাজ। কারণ, জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের দেশ হচ্ছে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। অষ্টম দেশ রাশিয়া! আর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মোট জনসংখ্যার আকারটাই আসলে প্রধান বিবেচ্য। এমনকি আমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারও হই, তা সত্ত্বেও সীমিত আকারে হলেও এক-তৃতীয়াংশ বাজেট নিচের দিকের সরকারগুলোকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি। এখন সেটা পুরনো ১৯ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, নাকি ৬৪ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, সেই যৌক্তিক বিভাজনটাও করা উচিত।

দ্বিতীয়ত, এই বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে প্যারাডক্সটি হচ্ছে, যে সরকারকে আমরা স্থানীয় সরকারে নির্বাচন করছি, তাকে আমরা ক্ষমতায়ন করছি না। যেমন উপজেলা সরকার- নির্বাচন করেছি, ক্ষমতায়ন করিনি। অন্যদিকে যেটি নির্বাচিত এবং ক্ষমতায়িত, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ সরকার- তার ক্ষমতা অতিসংকুচিত। সে সামান্যই অর্জন করতে পারে, কারণ তার হাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু এটা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বইও লিখেছেন, অনেক সভা-সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব একটা এগোয়নি। ভারত তাদের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীতে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে যে, সেখানে তিন স্তরের সরকার হবে। আর সেই তিন স্তরের সবচেয়ে নিচের স্তর হলো গ্রাম পঞ্চায়েত। দু-একটা রাজ্য বাদ দিলে এখন সেখানে সর্বত্রই এই তিন স্তরের সরকার চলছে। এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নিয়মিতভাবেই অর্থনৈতিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। স্থানীয় স্বশাসনের এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজস্ব আহরণের পরিমাণও বেড়ে গেছে।

এর পরের যে চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে, আমাদের গুণগত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের ধনী-গরিবে বৈষম্য শুধু অর্থে নয়, সম্পদে নয়, শিক্ষার গুণেও। কেউ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়ছে, কেউ আবার একেবারে নিম্নমানের স্কুলে পড়ছে। কেউ আবার এ দুই ধারার বাইরে মাদ্রাসায় পড়ছে। কেউ আবার একটা পাঁচমিশালির মধ্যে আছে। দেশের আগামীর সন্তানদের এ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা থাকা উচিত নির্বাচনী ইশতেহারে। যে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে কেমন দেশ চাই? আমরা কি সার্ভিস সেক্টর নেশন হবো নাকি আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং নেশন হবো? এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার যে চিন্তা- তার একটা প্রতিফলন ইশতেহারে থাকবে না, তা তো হয় না। তা ছাড়া যেখানে প্রচলিত শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ, সেখানে অপ্রথাগত বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রভূত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে, চীনের অভিজ্ঞতাও হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। আর শুধু বর্তমানে আটকে না থেকে, ২০৩০ সালে আমাদের কী ধরনের দক্ষতা লাগবে, সেই দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা এখন থেকেই তো করতে হবে।

তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সবকিছুর মূলে থাকে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে যেমন একজন ব্যক্তিমানুষের জীবনে বিঘ্ন ঘটে, তেমনি জাতীয় জীবনেও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় সব সময়ই যে কোনো আলোচনায় অবকাঠামো, আইন, উন্নয়ন এসব নানা বিষয়ের আড়ালে পড়ে যায় স্বাস্থ্যসেবা। তাই স্বাস্থ্য খাত নিয়েও অবশ্যই ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকা চাই। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু সময়ের দাবি অনুযায়ী যেন সে অগ্রগতি খুবই নগণ্য। গরিব-মধ্যবিত্ত নাগরিকের সুচিকিৎসা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে পরিকল্পনার উপস্থিতি ইশতেহারে থাকা উচিত।

সবশেষে বলতে চাই, গত পাঁচ বছরের ম্যাক্রো পরিসংখ্যানেও আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়া সত্ত্বেও এবং দারিদ্র্য কমার পরও কিছু কিছু সূচকে একটা নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন ধরুন, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহকে আমরা যদি জিডিপির অনুপাতে প্রকাশ করি, তাহলে দেখা যাবে এটা কমে গেছে। যদি আমরা রফতানি প্রবৃদ্ধি হার দেখি, সেটাও কমে গেছে। এই অবনতিশীল প্রবণতাকে ফেরাতে হবে। একই সঙ্গে বরাবরই আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছিলাম, বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ২০১০-এর দশকে খুব একটা বাড়েনি। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা মেটানো গেলেও তার আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ দিকগুলোর প্রতি নতুন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রসঙ্গ থাকলে বলা যাবে যে ইশতেহার আমাদের জন্য। তবে সবকিছুই কালের এবং শ্রেণিস্বার্থের অধীন।

Original in সমকাল

The middle class is growing

Abdul Bayes, Mahabub Hossain and ANM Mahfuzur Rahman

Binayak Sen, an eminent economist and a Research Director of the Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS), recently completed a research work on ‘Middle Class’ (henceforth MC) in Bangladesh, especially relating to growth trends, drivers and policy implications. He deserves special thanks for invoking an interest in a topic hitherto untouched by Bangladeshi economists. At the moment, Middle Income Country (MIC) is the coin in circulation, not Middle Class population. We all know that Binayak has been a very powerful, if not the pioneer, researcher in poverty-related research in Bangladesh. His motivation in taking up MC reportedly springs from the emerging shift of focus on the ‘Middle Segment of Income Distribution’. According to his views, there are two main arguments for which MC should occupy the front seat in the days to come. The first one relates mostly to growth and employment. MC is considered to be good for inclusive growth – the larger the size or density of MC, the better it is for economic growth. The growth of MC (a) injects more stability into growth process due to less volatility associated with regular (salaried) jobs, (b) helps to accelerate the aggregate growth rate by releasing the domestic demand constraints to growth, and by fostering higher labour productivity, managerial skills and entrepreneurship; and (c) enables reduction of poverty faster than in countries with lower class density. On the other hand, the second arguments mostly apply to governance and risks.

MC has beneficial institutional externalities such as (a) larger size associated with higher institutional quality via demand-driven economic governance channel, (b) improved quality of democracy through better and concerted articulation of democratic aspirations in areas of ‘core governance’. Again, ignoring the role of MC invites significant downside risks. Widespread discontent of middle class – especially among youth -with respect to deteriorating income distribution or mobility could cause political instability and social strife.

To start with, Sen attempted to draw a MC line that embraces economic definition of MC (income-based). Although no unique definition of MC- even of income-based – exists around the world, he adapted various versions in national context to use for estimating the size and growth of the MC. The data for the analysis came from Household Income and Expenditure (HIES) over 1991-2010 when identified four groups (expressed as per person per day in PPP dollar using 2005 PPP) as follows: (a) Poor (below $1.25, (b) Vulnerable non-poor ($1.25-2.00); (c) Middle Class ($2.00-3.00), (d) Upper middle class ($3.00-4.00) and (e) Rich ( $4.00).

The researcher observed a few interesting trends. There has been a significant rise in the share of national MC over the period between 1992 and 2000. Only 9 per cent of the national population belonged to this cohort; the matched figure went up to 20 per cent in 2010. The comparable figures for other regions are as follows: India 24 per cent; China 62 per cent, South Asia (including India) 17 per cent, Sub-Sahara Africa 26 per cent, and East Asia (including China) 59 per cent.

From a static view, Bangladesh falls behind others in terms of the proportion of MC people but ‘doubling the size of middle class is a dramatic success by any measure. If the present trend continues, middle class will comprise 25 per cent of national population in 2025 and 33 per cent in 2030’. Second, as the size of national MC grew bigger, the poverty reduction rate became faster. The author provides no explanation of how it happened although we expect it in detailed discussions. Third, there is a considerable bulge around $1.25 and $2.00 line. This indicates that the potential vulnerability to downward mobility (descent) pressures reign high. Fourth, these estimates need to be re-visited for robustness check in the light of US$ 1.90 line in 2011 PPP adopted by the World Bank for global poverty analysis very recently. “However, there is little doubt that expanding middle class has been good for stability of growth and accelerated poverty reduction in the 2000s…” Again, the process awaits explanations.

Policy implications? The graduation to MC from poor is adducible to post-secondary education (especially English education), salaried jobs in the service sector, ‘digital divide’, access to financial saving institution etc. The growth of MC has been driven by property price appreciation and unequal spread of human capital (post-secondary education). Universalising social protection and health care will help overcome bulging around poverty and middle class lines. Balancing between ‘pro-poor growth’ and ‘pro-middle class growth policies’ is the most pressing policy challenges in defining inclusiveness etc.

In an apparently ‘ambitious’ attempt, we have adapted Binayak Sen’s methodology to determine the growth and size of middle class in rural Bangladesh. The basis of our data is MH Data Base (Mahabub Hossain Data Base) comprising the repeat sample survey of households of 62 villages in 1988, 2000 and 2014. A la Binayak Sen, we wanted to have a glimpse into the growth of rural MC over time. We observe that roughly 7 per cent of rural population was in MC category in 1988. This compares with about 14 per cent in 2000 and 21 per cent in 2014. The rich segment, on the other hand, shot up from 3 per cent to about 18 and 37 per cent respectively during same periods of time. Our findings thus seem to corroborate Sen’s observations about MC growth in Bangladesh.

The growth in rural areas has mostly been greased by remittances – accounting for one-fourths of household income from 6.0 per cent and business – claiming one-fifths from one-tenths of household income. The growth of commercial agriculture in tandem with expansion of non-farm activities – as supported by expanded road communication – could have contributed to the growth of middle class in rural areas. The mundane message is that in the days to come, research on ascent and descent centring MC line would replace that of poverty line.

Abdul Bayes is Professor of Economics at Jahangirnagar University, (late) Mahabub Hossain was Distinguished Professor, BRAC University and Mahfuzur Rahman is Coordinator, Data Management Unit, RED/BRAC.

Source: Financial Express

বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ (Bangladesh’s expanding middle-class)

middle_class_info

Prothom-Alo: সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যবিত্ত
বাংলাদেশে দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হচ্ছে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশাল অংশ চাকরি করে। তারা এখন ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা জমির মালিক। তারা ইন্টারনেটও ব্যবহার করে। টাকাপয়সা রাখে ব্যাংক হিসাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন মধ্যবিত্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মধ্যবিত্ত হবে। এ তথ্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)। গবেষণাটি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। গতকাল বৃহস্পতিবার গবেষণার এ ফল প্রকাশ করা হয়। যাঁরা দৈনিক দুই থেকে তিন ডলার (পিপিপি হিসাবে) আয় করেন, তাঁদের মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ হিসাবটি স্বীকৃত। বিআইডিএস এ গবেষণাটি করেছে ঢাকা শহরের ১২টি এলাকায়। গবেষণার নমুনার সংখ্যা ৮০৯। গবেষণাটি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্তের সেই হিসাবটি ২০১০ সাল ধরে করা হয়েছে। অতীতের একই প্রবণতা ধরে নেওয়া হলে ২০১৫ সালে এসে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী মোট জনগোষ্ঠীর সাড়ে ২২ শতাংশ হবে। বিস্তারিত ->

সমকাল (Samakal): ২০৩০ সালে মধ্যবিত্ত হবে ৩৩ শতাংশ
দেশে মধ্যবিত্তের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত দুই দশকে মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৩ সালে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএসের এক বছরের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে ‘বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের আকার ও প্রবৃদ্ধি’ বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন। বিস্তারিত ->

Financial Express: BIDS study reveals growing middle class BD’s dramatic success
There has been a significant rise in the share of middle class group in the country over the last one decade (1992-2000). If the trend continues, the middle income class will comprise about 25 per cent of the country’s total population in 2025 and 33 per cent in 2030. Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) Researcher Director Dr Binayak Sen revealed the information while presenting a keynote paper on “Size and Growth of Middle Class in Bangladesh” at BIDS Research ALMANAC, 2014-2015. Read more ->

Daily Star: Bangladesh’s middle-class expanding
One-fourth, or 25 percent, of the total population will belong to the middle-class income category by 2025, thanks to greater access to education, finance and IT services, and private sector employment, a recent study found. At present, 20 percent of the population belongs to the middle-income category in Bangladesh in contrast to 24.1 percent in neighbouring India. Read more ->

Dhaka Tribune: BIDS: Middle-class people to reach 33% by 2030
The middle-class group is expected to stand at 33% of the country’s total population by 2030, says Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS). Over the last two decades, the country witnessed a remarkable rise in middle class group, it said, adding that if the trend continues, the country is expected to add 25% of its total population by 2025. It said only 9% of the population belonged to this category decades back and in 2010, this group accounted for 20%. BIDS Research Director Binayak Sen revealed the information in his keynote paper on “Size and Growth of Middle Class in Bangladesh” at the BIDS dissemination event on presentations from the BIDS Research Almanac 2014-2015, at BIDS yesterday. Read more ->

One-third population to be middle-class by ’33
The size of middle class population in the country may soar to one-third of the total population by the year 2033, which is now 20 percent, says a latest BIDS study. The study entitled: ‘Size and Growth of Middle Class in Bangladesh: Trends, Drivers and Policy Implications,’ published on Thursday, considered those in the segment whose per day income is 2 to 3 US dollars. Research Director at the Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) Dr Binayak Sen, who conducted the study, said the middle-class size now more than doubled to 20 percent from 1990 level of 9 percent and it could soar to 25 percent by 2025 and to 33 percent by 2033, according to their assessment. Read more ->

আমি আশাবাদী (I am optimistic)

অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন বছরটা ভালোই যাবে মনে হচ্ছে। এর বড় দিক হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য এখন অনেক কম। সরকার যেহেতু তেলের মূল্য পুরোপুরি সমন্বয় করেনি, সেহেতু এ খাত থেকে আয় জমা হচ্ছে। স্থানীয় অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধিজনিত অর্থ সরবরাহে এই অর্থ কাজে লাগবে। অন্যদিকে রফতানি বাজারে অশুভ কোনো ছায়া দেখতে পাচ্ছি না। মধ্যপ্রাচ্যে সামান্য যে আঞ্চলিক গোলযোগ হচ্ছে, তা অভিবাসনের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা সৃষ্টি করবে না।

দ্বিতীয়ত, গত দুই বছরের সঙ্গে তুলনা করলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগে আস্থা ফিরতে সহায়ক হবে। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আর্থিক খাতে অনিয়মের মূলে আঘাত হানা যাবে কি-না! অনিয়মের রাশ টেনে ধরতে না পারলে অর্থায়নের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়ে যাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কার্যকর অর্থায়নের খুবই দরকার। এ খাতের উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী করা গেলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে তারা নতুনভাবে অবদান রাখতে পারবেন।

অর্থনীতিতে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটা পালাবদল আসে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল একভাবে গেছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল অন্যভাবে যাবে। আমার মনে হয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি হবে আগামী কয়েক বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি বড় উৎস। এতদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন হয়েছে তুলনামূলক বেশি। পদ্মা সেতু এবং একে ঘিরে রাস্তাঘাট, রেলপথসহ অবকাঠামোর যে উন্নয়ন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হবে, তা নতুন এক ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করবে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের অনেক সম্ভাবনা এখনও কাজে লাগানো হয়নি। বেসরকারি বড় উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ সেখানে যাচ্ছে। ওই এলাকা দিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি সমুদ্রকেন্দ্রিক ব্লু ইকোনমির নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সুতরাং ওই অঞ্চলে যে গুণগত পরিবর্তন আসছে, তা অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।

অর্থনীতির সম্ভাবনা বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসুর সঙ্গে একমত। আমি মনে করি, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি চীনের কাছাকাছি চলে যাবে। কারণ চীনের গতি শ্লথ হচ্ছে, আর আমাদের বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য এখন দরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ সেরে ফেলা এবং সম্ভাবনাময় বিশেষ এলাকার দিকে নজর দেওয়া। তা করতে পারলে খুব সহজেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি আট শতাংশে নিয়ে যাওয়া যাবে।

আরেকটি বিষয় বলা দরকার এবং তা হলো, মানব উন্নয়নের সাফল্য ধরে রাখতে হবে। বিশেষত শ্রমশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির কাজে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। যুবশক্তিকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে দেশের ভেতরে ও বিদেশে কর্মসংস্থানে গুণগত পরিবর্তন আসবে। এটা যে কতটা ফলদায়ক তার লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের জনশক্তি বিশেষত নারীরা বিদেশে কাজ পাচ্ছেন।
আমাদের মধ্যবিত্তের আকার গত দুই দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। মধ্যবিত্তের আরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এটা করতে হলে গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের মধ্যবিত্তের সমপর্যায়ে উন্নত শিক্ষা দিতে হবে। ইংরেজি মাধ্যমের বাইরে শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। গরিবের সন্তান দুর্বল মানের শিক্ষায় আটকে যাচ্ছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। মধ্যবিত্ত হতে গেলে গরিবদের সেবা খাতে আসতে হবে। কৃষি শ্রমিক হিসেবে থাকলে হবে না। সুতরাং কীভাবে গরিবকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত করা যায়, তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে। আমি প্রত্যাশা করি, ‘দারিদ্র্য’ শব্দটি একদিন ইতিহাসে পরিণত হবে।

এমডিজির গতানুগতিক পন্থায় এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়

বিনায়ক সেনসহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের সাফল্য এবং এসডিজিতে (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) প্রবেশ উপলক্ষে প্রথম আলোর সঙ্গে উন্নয়নের পথযাত্রা নিয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সমতামুখী প্রবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন তিনি। এর আগে ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল ও বইপত্রে তাঁর ৫০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম আলো : যাকে বলা হয় বাংলাদেশ প্যারাডক্স বা ধাঁধা—দুর্নীতি ও দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের উন্নতি বিস্ময়কর। এমডিজির সাফল্যে জাতিসংঘের স্বীকৃতির লগ্নে এই ধাঁধাটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বিনায়ক সেন : এই স্বীকৃতির শুরুটা ২০০০–এর দশকে। আমি কিন্তু আরেকটু পেছনে থেকে আসতে চাই। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজির অগ্রগতি পরিমাপ করা হয় নব্বই সালের অবস্থার নিরিখে। অথচ নব্বই পর্যন্ত বহির্বিশ্বে ধারণা ছিল, বাংলাদেশ খুব একটা এগোচ্ছে না। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রথম যে ব্যক্তি এ ধারণাকে জোরের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করেন, তিনি আবু আবদুল্লাহ। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ২৫ বছর, একটি ইতিবাচক প্রেক্ষিত’ প্রবন্ধে তিনি দেখান, ওই ধারণা বেঠিক। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনার ভিত্তিতে তিনি দেখান সামগ্রিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাথমিকে ভর্তি, শিশুমৃত্যুর হারসহ আরও কিছু সূচকে মাথাপিছু আয়ের সাপেক্ষে বাংলাদেশ সম্ভাব্য অর্জনের তুলনায় বেশি আগুয়ান। এরপর ২০০৪ সালে ফরাসি অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ লিখলেন: বাংলাদেশ শোজ দ্য ওয়ে। তাঁর দাবি, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে, বিশেষ করে মৌলিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসূচকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ও অমর্ত্য সেনের যৌথ গ্রন্থ অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশন-এ আরও পরিসংখ্যান দিয়ে দাবিটাকে তিনি জোরালো ভিত্তি দেন। সুতরাং ধারাবাহিক উন্নতির সমান্তরালে ধারাবাহিক স্বীকৃতিও আসছিল। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হলেন। এতে আমি অন্তত বিস্মিত হইনি। ২০০১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের শুরুতেই আমরা কিন্তু এই সাফল্যের পূর্বাভাস দেখিয়েছিলাম। সুতরাং তিন দশক ধরেই বাংলাদেশের সাফল্যের পাণ্ডুলিপি রচিত হয়ে আসছে।
প্রথম আলো : এই তিন দশকের প্রচেষ্টা ও সাফল্যের ইতিহাসে অনেকগুলো সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিভেদ সত্ত্বেও তার মানে প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা ছিল?
বিনায়ক সেন : তার মানে এমডিজি রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। যে-ই সরকারে থাকুক, তারা মনে করেছে এমডিজিতে আরও সাফল্য মানে জনগণের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা, আরও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। এভাবে উন্নয়নের ফলাফল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠল। শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে এক সরকারের কর্মসূচি পরের সরকার বাতিল না করে বরং আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছে এবং সেটার বাহবা নেওয়ারও চেষ্টা করেছে। নব্বইয়ের পর কয়েকবার সরকার পরিবর্তন হলেও এই প্রতিযোগিতা বহাল থেকেছে। তবে সত্য যে, এই প্রচেষ্টার সূত্রপাত সত্তরের দশকে। বিশেষ করে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পরে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এই উপলব্ধিতে আসেন যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য উৎপাদন ও নারীশিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। খাদ্য উৎপাদন না বাড়ালে খাদ্য-দারিদ্র্য কমবে না। আবার নারীশিক্ষার প্রসার না ঘটলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হবে না। সুতরাং এমডিজি প্রবর্তনের আগেই নব্বইয়ের দশকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কতগুলো কর্মসূচি চালু হয়েছিল। যেমন আশির দশকে টিকাদান কর্মসূচি, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা নব্বই দশকে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের অবৈতনিক শিক্ষা চালু হয় আশির দশকের শেষে। এসবই প্রমাণ করে, অঘোষিতভাবে হলেও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা সামাজিক চুক্তি হয়ে ছিল যে কিছু বিষয়ে আমরা অগ্রগতি ঘটাব। এটাই আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের অর্থনৈতিক মূল্যবোধ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই মূল্যবোধ আরও দৃঢ় হয়েছে।
প্রথম আলো : নব্বইয়ের দশকে একগুচ্ছ নতুন অর্থনৈতিক চালক, যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মসূচি, বাজার, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ ইত্যাদির কী ভূমিকা?
বিনায়ক সেন : এ অর্জন একক চালিকাশক্তি দিয়েও হয়নি, এক পথেও হয়নি। সরকারি খাতের পাশাপাশি এনজিও খাতেরও সমান্তরাল অবদান ছিল। এনজিও-জিও সহযোগিতার যুক্তি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। অমর্ত্য সেন যে পাবলিক অ্যাকশনের কথা বলেন, তার মধ্যে সরকারের পাশাপাশি এনজিও, বৃহত্তর অর্থে স্থানীয় জনগণ ও সামাজিক উদ্যোগও আছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় পাবলিক অ্যাকশনের ধারণা আরও প্রসারিত হয়েছে। এখন সবার হাতে মুঠোফোন, গণযোগাযোগ নিবিড়। এই সুবাদে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়টা একজন স্বাস্থ্যকর্মীর যাওয়া না যাওয়ার ওপর এখন আর পুরোটা নির্ভরশীল নয়। জনবসতির ঘনত্ব বেশি থাকায় তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি, নারীশিক্ষা, ছোট পরিবার, পরিচ্ছন্নতার স্লোগান—এখন বাস-স্কুটারের পেছনে লেখা থাকতে দেখা যায়। একে বলা যায় দেখা থেকে শেখা।
প্রথম আলো : এমডিজি পূরণের পর কী কী ঘাটতি রয়ে গেল?
বিনায়ক সেন : তিনটি ক্ষেত্রে ঘাটতি চিহ্নিত করতে চাই। প্রধান হচ্ছে, পরিমাণে এগোলেও গুণগত মান অর্জিত হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ভালো, কিন্তু সমাপ্তির হার ভালো না। শিক্ষার মানও ভালো না। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অষ্টম শ্রেণি পাস করলে ছেলেমেয়েরা পঞ্চম শ্রেণির জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। তার মানে যারা পঞ্চম শ্রেণির আগে ঝরে যাচ্ছে, কিংবা যারা শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যাচ্ছে, তারা তৃতীয় শ্রেণির পর্যায়ে পড়ে থাকছে। এটা গুণগত মানের প্রশ্ন। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিষেধকে সাফল্য অর্জন করেছি, কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা চালু করতে পারিনি। এটা বেশি প্রযোজ্য গরিবদের বেলায়। এরপর আসে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সামাজিক অসাম্য। ডিএইচএস দেখাচ্ছে, তলার ১০ শতাংশের সঙ্গে উচ্চের ১০ শতাংশের মধ্যে এখনো প্রচণ্ড বৈষম্য বিদ্যমান। হাওর ও পার্বত্য দুর্গম এলাকায় সেবাগুলো যায়নি। সুশাসনগত সমস্যা, তথা দুর্নীতি ও দলীয়পনা রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ স্তরেই কর্মসূচিগুলো থেমে গেছে।
প্রথম আলো : এমডিজির পর এসডিজি ঠিক করা হলো ১৫ বছরের জন্য। দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, এসডিজিতে লক্ষ্যমাত্রা বিমূর্ত ও কর্মপন্থা অবাস্তব।
বিনায়ক সেন : এমডিজির এই ঘাটতিগুলো এসডিজিতে অর্জনের লক্ষ্য হিসেবে রাখা আছে। এমডিজির আটটি লক্ষ্য ছিল, এসডিজিতে ১৭টি। এমডিজিতে দারিদ্র্য নিয়ে কথা ছিল, কিন্তু বৈষম্য নিয়ে কথা ছিল না। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে তিনটা দিকে আমি বিশেষভাবে উৎসাহী: যেমন ১০ নম্বর লক্ষ্যে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশের আয়বৃদ্ধির হার জাতীয় আয়বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হতে হবে। অর্থাৎ দরিদ্রতম ৪০ শতাংশের আয়বৃদ্ধি জাতীয় আয়বৃদ্ধির চেয়ে বেশি হওয়া দরকার। এই লক্ষ্যটা তাৎপর্যপূর্ণ। এর পাশাপাশি বলা হয়েছে টেকসই উন্নয়নের কথা। টেকসই উন্নয়ন বলতে সামাজিক সংহতিমূলক সামগ্রিক উন্নয়ন বোঝায়। আমরা অনেকেই এই চ্যালেঞ্জটাকে লক্ষ্য হিসেবে নেওয়ার জন্য পাঁচ-সাত বছর ধরে বলে আসছি। আমরা চাইছি আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য, ভোগবৈষম্য কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তার পথনির্দেশ।
প্রথম আলো : আমরা এখন নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ, এ পর্যায়ে জনগণ তো জীবনযাপনের সংগতিপূর্ণভাবে উচ্চমান ও অধিকার দাবি করবে?
বিনায়ক সেন : বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৩০-এর মধ্যে দারিদ্র্য ৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে পারলেই ধরে নেওয়া হবে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ৩ শতাংশ জনসংখ্যাও কিন্তু বিরাট আকারের। এসডিজির ৪ নম্বরে বলা হয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা। তার মানে এমডিজির যে অসম্পূর্ণতা ছিল, এখানে সেটাকে লক্ষ্য ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান আন্তর্জাতিকভাবে যাচাইয়ের পদ্ধতি নেই। এখন পৃথিবীর প্রায় ৭০টির মতো দেশ আন্তর্জাতিক মান যাচাইয়ের অংশ। ভারতের দুটি রাজ্য এর অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষার মানের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এ ধরনের আন্তর্জাতিক যাচাইব্যবস্থার অংশ করতে হবে। যখন বলছি যে আমরা নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরিত হয়েছি, তখন তো এসব মান অর্জন জরুরি। আবারও বলছি, মানের দিকটা অর্জিত হবে না, যদি এক নম্বর লক্ষ্য দারিদ্র্য নির্মূল এবং ১০ নম্বর লক্ষ্য আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা না যায়।
প্রথম আলো : এমডিজি পূরণ হয়েছে, কারণ বিশ্বের দারিদ্র্যের বিপুল অংশের যেখানে বাস ছিল, সেই চীন একাই তা দূর করেছে। দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশের বেলায়ও ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরিত হয়েছে। তাই এমডিজি ও এসডিজির পুরোনো পদ্ধতি কতটা কার্যকর?
বিনায়ক সেন : পুরোনো পদ্ধতির কিছু কিছু কাজে লাগবে যেমন এনজিওগুলোর অংশগ্রহণ বা বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ। মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলেও খরচ বাড়াতে হবে। তেমনি দারিদ্র্য হ্রাস থেকে সম্পূর্ণ দূরীকরণ করতে চাইলেও বিপুল ব্যয় চাই। পুরোটাই শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে সম্পদের যথাযথ সমাবেশের ওপর। আগের তুলনায় অনেক বেশি দরিদ্র মানুষের প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে বা তাদের সব সহায়তা দিতে হবে।
প্রথম আলো : পশ্চিমা সরকারগুলোর তরফে এমডিজিতে তাদের জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এসেছে প্রতিশ্রুতির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। দারিদ্র্য নিরসনে বৈশ্বিকভাবে বছরে যে ৬৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, তা কোথা থেকে আসবে?
বিনায়ক সেন : দেশীয় স্তরে বলতে পারি যে আমাদের ট্যাক্স-জিডিপির বর্তমান ১২ থেকে ১৩ শতাংশ দিয়ে এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়। ন্যূনতম সুশাসন বজায় রেখে কীভাবে আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারি এবং আয়বৃদ্ধিকে যথাযথ করারোপ করে দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয় করতে পারি। অর্থাৎ মোটামুটি আইনশৃঙ্খলা, মোটামুটি সুশাসনের মাধ্যমে উন্নতির মাধ্যমে যে আয় সৃষ্টি হবে, তার ওপর আগের চেয়ে আরও বড় আকারে করারোপ করতে হবে। আর তা ব্যয় করতে হবে সামাজিক শিক্ষা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ খাতে। সুতরাং ধনীদের ওপর আগের ছেয়ে বেশি করারোপ করতে হবে। পাশাপাশি চেষ্টা করতে হবে ন্যূনতম সুশাসন থেকে পূর্ণ সুশাসন ও ন্যূনতম গণতন্ত্র থেকে পূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণের। উন্নয়নের ধারা ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রেখেই তা করতে হবে। এভাবে গণতন্ত্র ও সুশাসনের চাহিদা যত বাড়বে, গণতন্ত্র ও সুশাসনের দাবিও তত বাড়বে। যেমন আমি আশা করছি আগামী ১৫ বছরে এসডিজি যখন বাস্তবায়িত হবে, তার মধ্যে তরুণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আকার ও চাহিদা বাড়তে থাকবে। এই বর্ধিত চাপের কারণেই আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি গতিশীল, জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক হতে বাধ্য হবে। এই বাস্তবতাকে আমাদের রাজনৈতিক কর্তারা আমলে নেবেন আশা করি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।

প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হওয়া অবাস্তব নয়

Dr. Binayak Sen photoপ্রস্তাবিত বাজেট, দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক খাত, দুর্নীতি, সুশাসন, রাজস্ব সংগ্রহসহ ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সমতামুখী প্রবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন তিনি। বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের এই সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল ও বইপত্রে ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

প্রথম আলো : প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো?
বিনায়ক সেন : বাজেট নিয়ে আশির দশকে, এমনকি ষাটের দশকেও সমালোচনা থাকত। এখন তা ছিদ্রান্বেষী নিন্দা ও লাগামছাড়া স্তাবকতা—এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, যেখানে যতটুকু ভালো হয়েছে, তা বলা উচিত। আর মন্দ হলে মন্দ বলতে হবে। একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, শক্তিশালী দিককেও দুর্বলতম বলা হচ্ছে। এই প্রবণতা আমার কাছে পরিহার্য। যেমন ধরুন, আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরাটা খুবই বাস্তবোচিত হয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাভাবিক বছর পেলে ৭ শতাংশ অর্জন করা অবাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, ঘাটতি বাজেট ১৫ বছর ধরেই ৪-৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে। তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতিও ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে আশা করা যায় দেশে ভালো ফলন ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার কারণে।
প্রথম আলো : তিনটি কারণকে বিবেচনায় নিয়েই আপনার এত বড় আশাবাদ? সার্বিকভাবে দেশের মৌলিক বাজেট–শৃঙ্খলা কি ঠিক আছে?
বিনায়ক সেন : আমি বলব সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট–শৃঙ্খলা একরকম ঠিকই আছে। এখন যদি দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারল না, তখন ব্যয়ের কাঠামো কাটছাঁট করতে হবে। আর এই কাটছাঁটের পরও যদি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে, প্রবৃদ্ধির হার যদি ৭ শতাংশ অর্জন করা যায়, মূল্যস্ফীতি যদি ৬ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকে, তাহলে আমি এটাকে সময়োচিত ও বাস্তবোচিত বাজেটই বলব। এটা বলার পরই আমি মূল কথাটি বলতে চাইছি।
প্রথম আলো : সেটা কী?
বিনায়ক সেন : মূল কথাটা হচ্ছে আমরা এখনো আলোচনাটা সাধারণ মানের প্রবৃদ্ধির মধ্যেই আটকে রাখছি। সমতামুখী প্রবৃদ্ধি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলছি না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির তিনটি মাত্রা রয়েছে। একটা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা। প্রবৃদ্ধিকে ওঠা–নামা থেকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধিকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, অর্থাৎ এতে সমাজের সবার ও দেশের সব অঞ্চলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে আয়বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ যত দিন যাচ্ছে, তত আমরা অধিক বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হতে পারছি কি না। ২০১০ সালের আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, আয়বৈষম্যের সূচক বেশ উঁচু পর্যায়ে চলে গেছে।
প্রথম আলো : সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা কতটুকু কী করতে পারছি?
বিনায়ক সেন : প্রথমটি মোটামুটি অর্জিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা অর্জনে ধারাবাহিকতা রয়েছে আমাদের। অনেকেই একে ৬ শতাংশের ফাঁদ বলছেন, কিন্তু আমি ‘ফাঁদ’ বলতে রাজি নই। একনাগাড়ে প্রায় এক দশক ধরে ৬ শতাংশ হার অর্জনের দেশ খুব বেশি নেই। এক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সংকটও তৈরি হয়েছে। সবকিছুর পরও স্থায়িত্বশীলতার নিক্তিতে আমাদের অর্জন বেশ ভালোই বলা যায়।
প্রথম আলো : বাকি দুটির অবস্থা তাহলে ভালো নয়?
বিনায়ক সেন : না, সেটা না। যেমন অংশগ্রহণমূলক দিক থেকে আমি বলব আংশিক সাফল্য এসেছে। দুই দশক আগেও শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ১৫ শতাংশ। এখন ৩৩-৩৪ শতাংশ। এটা ৬০ শতাংশে উন্নীত করা গেলে প্রবৃদ্ধি যেমন ত্বরান্বিত হবে, আয়ও বাড়বে। আবার যুবশক্তির মধ্যে পোশাক ও কৃষি খাতের অদক্ষ-আধা দক্ষ শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান যথেষ্ট। কিন্তু স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ থেকে সাফল্য পাইনি। কারণ, আমাদের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সব কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে চালিত। এবারের বাজেট বক্তব্যে অবশ্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে বণ্টনবৈষম্য দূর করার ইঙ্গিত রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অর্থায়নে একটা আলাদা কৌশলপত্র হওয়ার কথা। সেটা যদি সত্যি হয়, এবার থেকেই যেন বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের জন্য রাখা হয়। ভারতের কেরালায় যা আছে এক-তৃতীয়াংশ।
প্রথম আলো : সে হিসাবে বাজেটের মোট আকার থেকে স্থানীয় সরকারের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিচ্ছেন?
বিনায়ক সেন : হ্যাঁ। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য থাকতে পারে। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা থাকতে পারে নগরাঞ্চলের জন্য। এতে লাভ যেটা হবে, প্রতিবছর বাজেট বাস্তবায়ন করতে না পারার যে সমালোচনা আছে, সেটা দূর হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে না, ততটুকু বরাদ্দ দিলেও একটা কাজ হবে। আর তাতে দরিদ্র অঞ্চল, বিশেষ করে হাওর, লবণাক্তপ্রবণ, বন ও পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষও সমানভাবে উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে।
প্রথম আলো : বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কিছু বললেন না?
বিনায়ক সেন : বাজেট বক্তব্যে এটি প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে সম্পদবৈষম্য। সম্পদবৈষম্যকে যদি আঘাত করতে হয়, তাহলে সম্পদের ওপর আয়কর সারচার্জ সংগ্রহের বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করতে হবে। বড় দুর্বলতা হলো সম্পদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না। ভিত্তি ধরা হচ্ছে সম্পদ ক্রয়মূল্যকে, ন্যায্য বাজারমূল্যকে নয়। ফলে মাত্র ১০ হাজার লোক এই আয়কর সারচার্জ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদের মালিক মাত্র ১০ হাজার লোক—এটা অবিশ্বাস্য।
প্রথম আলো : সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন থেকে সরকার কীভাবে লাভবান হতে পারে?
বিনায়ক সেন : এতে রাজস্ব আয় বাড়বে, যা বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি কয়েক বছরে দেশে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। বিশেষ করে নগরাঞ্চলে। তাঁদের কাছ থেকে আয়কর সারচার্জ এবং/অথবা প্রত্যক্ষ সম্পদ-করের মাধ্যমে (যা এখনো বাজেটে নেই) অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করা সম্ভব। তবে দুই বছর ধরেই একটি ভালো দিক লক্ষ করছি। এখন প্রত্যক্ষ বা আয়করকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগ সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনেরই উদ্যোগ। পোশাকশিল্পসহ প্রতিষ্ঠিত রপ্তানি খাতগুলো থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর ১ শতাংশ হারে কর বসানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা প্রবৃদ্ধিকে সমতামুখী করবে। আর শিশু-শিল্প হলে কর-রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যারা ভালো প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তাদের থেকে কিছুটা আয়কর আদায় করা জরুরি।
প্রথম আলো : কিন্তু মানুষের প্রথম চাওয়া হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও যানজট নিরসন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
বিনায়ক সেন : প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে—আমাদের এখন সে ধরনের অবকাঠামো দরকার। আবার প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাও বড় কথা। মানুষ নগরমুখী হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ হয়ে যাবে। তাদের সমস্যার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আগে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ছিল কৃষি অর্থনীতি ও রপ্তানি, এখন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে হবে নগর অর্থনীতি ও রপ্তানি। ফলে নগরে ও নগরবাসীর জন্য এখন বেশি হারে বিনিয়োগ করতে হবে। যানজট নগরবাসীর কর্মজীবনের বড় একটা সময় খেয়ে ফেলছে। বাজেটে যানজট নিরসনে বা নগর অর্থনীতি উন্নয়নে তেমন কোনো কৌশলগত নির্দেশনা নেই। ঢাকার বাইরে শহরগুলোর অবকাঠামোগত পরিবেশ আরও খারাপ, অথচ শহরেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি করে জড়ো হচ্ছে। আর অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতির একটা উদ্যোগ সরকার নিলেও এর কোনো ফল দেখা যায়নি। পিপিপিতে ৪৩টি প্রকল্প নিয়ে অর্থমন্ত্রী আর জানালেন না কোনটির কী হাল? বিদ্যুৎ যেমন জাতীয় তাগিদ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, অবকাঠামো খাতেরও একই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
প্রথম আলো : তাহলেই কি সমতামুখী প্রবৃদ্ধি আসবে?
বিনায়ক সেন : না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির জন্য আরও দরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভালো বরাদ্দ। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রয়োজনের ধারে-কাছেই তিনি যেতে পারেননি। স্বাস্থ্য খাতেরও একই অবস্থা। এ দুই খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতায় বিস্মিত না হয়ে পারি না। পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা মাসে ৩০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে রাজি থাকলেও তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা পলিসি চালু করা যায়নি।
শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিও রয়েছে। যেমন মাদ্রাসাশিক্ষা থেকে সবচেয়ে কম ফল (রিটার্ন) পাওয়া যায়। অথচ মাদ্রাসাশিক্ষা-ব্যবস্থায় যদি কারিগরি শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যায়, ভালো ফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় আমাদের বুয়েট ভালো, ঢাকা মেডিকেল কলেজও (ডিএমসি) ভালো। দরকার ছিল বুয়েটের মতো আরও পাঁচটা ‘বুয়েট’ করা, ডিএমসির মতো পাঁচটা ‘ডিএমসি’ করা। ভারতে যেমন করে প্রথম সারির বেশ কিছু আইআইএম, আইআইটি ও মেডিকেল কলেজ আছে। সেদিকে আমরা গুরুত্বই দিচ্ছি না। মোটের ওপর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আগামী ১০ বছরে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রিকার্ডো হাউসম্যান সম্প্রতি হিসাব করে বলেছেন, শ্রমশক্তির মান গড়ে তিন বছর স্কুলশিক্ষা থেকে আট বছর স্কুলশিক্ষার মানে উত্তীর্ণ করতে পারলে জিডিপির আকার শুধু এ কারণেই দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
প্রথম আলো : আমাদের আর্থিক খাত কি ঠিকভাবে চলছে? দুর্নীতি কী করে কমবে, সুশাসনের কী হলো?
বিনায়ক সেন : খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কর-রেয়াত এবং ব্যাংকঋণ—এ দুই বিকল্পের ক্ষেত্রে একজন শিল্পপতি যদি দেখেন ব্যাংকঋণ ফেরত দিতে হচ্ছে না, তখন কর-প্রণোদনা কাজ করবে না। কর-প্রণোদনার নীতি আর্থিক-প্রণোদনার নীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আর্থিক খাতে এখনো শৃঙ্খলার অভাব। উচ্চ খেলাপি ঋণের হার থেকে আমরা বের হতে পারছি না। উচিত হবে সোনালী ব্যাংককে হাতে রেখে বাকিগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া। কেননা, সরকারি খাতেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ বেশি। অন্যদিকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, বেসরকারীকরণের পর তা যেন গুটি কয়েক মুখচেনা শিল্প-ব্যাংক পরিবারের কাছে চলে না যায়।
দুর্নীতি হ্রাস বা সুশাসন চালু সরকার চাইলে অনেকখানিই পারবে। বলছি না যে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খাতভিত্তিক সুশাসন তো আমরা চাইতেই পারি; অন্তত কয়েকটি খাতে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে যারা টাকা কামাচ্ছে, তাদেরও ধরা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর যৌথভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে নজরদারি করলে অবৈধ উপায়ে টাকা কামানো, কর ফাঁকি দেওয়া ও খেলাপি হওয়া—এসব রোধ করা অনেকখানিই সম্ভব।
প্রথম আলো : করদাতার সংখ্যা সরকার তেমন বাড়াতে পারছে না। কোনো পরামর্শ?
বিনায়ক সেন : ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। আরও চার কোটি মানুষ আছে দারিদ্র্যঝুঁকিতে। বাকি থাকল আট কোটি মানুষ, তথা ১ কোটি ৬০ লাখ পরিবার (পরিবারপ্রতি পাঁচজন হিসাবে)। পরিবারে যদি একজন আয় করেন, তাহলেও আয়করের আওতায় আসতে পারেন ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যক্তি। এর মধ্যে শহরবাসী ৫০ লাখ। অথচ বর্তমানে আয়কর দেন কেবল ১০ লাখ লোক। শুধু নগরমুখী করেও প্রায় পাঁচ গুণ আয়করদাতা বাড়ানো সম্ভব। তাই বলব যে উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস সম্প্রসারিত না করে শহর পর্যায়ে এর কার্যক্রম আরও জোরদার করা হোক।
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কীভাবে দেখছেন?
বিনায়ক সেন : নদী আমাদের প্রাণ, ট্রানজিট তাঁদের প্রাণ। কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকে আমরা তাঁদের পানির বিনিময়ে ট্রানজিট দিতে পারি।
প্রথম আলো : আপনাকে বাজেট প্রণয়নের দায়িত্ব দিলে কোন খাতে অগ্রাধিকার দিতেন?
বিনায়ক সেন : অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে। অবকাঠামো উন্নয়নের গুরুত্বের কথা যদি বলি, দেখুন, এক যমুনা সেতুর কারণে আশির দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ থেকে আমরা ২০০০ সালের পর ৫-এর ওপরে উঠেছি। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হলে নিশ্চয়ই ৭-এর ওপরে ওঠা সহজ হবে। আর নীল (সমুদ্র) অর্থনীতি চাঙা করতে পারলে তো কথাই নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।