পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৫. ১৯৩০ : রবীন্দ্রনাথ ও প্যারিস

একথা এখন সকলেরই জানা যে, রবীন্দ্রনাথই ছিলেন এই উপমহাদেশের চিত্রকলার জগতে প্রথম ‘আধুনিক ধারার’ চিত্রশিল্পী। আর প্যারিসেই তার চিত্রকর্মের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৩০ সালের মে মাসে। এর আগের এক দশকে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। শুধু নিজেই যে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তা-ই নয়, ১৯২২ সালে (জার্মানী থেকে প্রত্যাবর্তনের এক বছর বাদে) কলকাতায় ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট (ISOA)-এর উদ্যোগে জার্মানির অত্যাধুনিক Bauhaus ধারার চিত্রকর্মের এক অভিনব প্রদর্শনীরও আয়োজন হয় তারই উদ্যোগে (যদিও এ নিয়ে প্রশান্ত কুমার পাল evidence-র দুর্বলতার প্রশ্ন তুলেছেন)। ‘বাউ হাউস’ শব্দটি জার্মান-এর আক্ষরিক অর্থ ‘বিল্ডিং হাউস’; অন্যভাবে বললে ‘স্থাপত্য-ভবন’। এই আন্দোলনের সাথে পল ক্লী Klee বা ক্লে), কান্ডিনস্কি, রুশ ‘কনস্ট্রাকটিভিস্ট’ আর্টিস্ট লিসিৎস্কি (Lissitzky),De Stijl (মানে ‘স্টাইল’) আন্দোলনের ডাচ পেইন্টার Thea van Doesburg, অস্ট্রিয়ার ককশকা (Osker Kokoschka) প্রমুখ জড়িত ছিলেন। ক্লী-কান্ডিনস্কির চিত্রকর্ম রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে (এবং প্রত্যক্ষ প্ররোচনায়) প্রদর্শিত হলো ১৯২২ সালে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে কলকাতায়- ভাবা যায়? আজ যদি ঢাকায় কেউ ফ্রাঙ্ক স্টেলা (frank stella), রিচার্ড ডিবেনকর্ন (Diebonkorn), পিটার ব্লেইক (Blake), গেরহার্ড রিখটার (Richter), ডেভিড হকনি (Hockney), হাওয়ার্ড হচকিন (Hodgkin), বাংক্‌সি (Banksy), ইয়োশিটমো নারা (Yoshitomo Nara), কুসামা (Yayai Kusama), জুলিয়ান ওপি (opie), বারবারা রে (Rae) প্রমুখের চিত্রকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের সেদিনের আয়োজনের তাৎপর্য কিছুটা হলেও বোঝা যেতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে এই তাগিদ দেখা দিয়েছিল কেন? মানুষের মধ্যকার নানা সত্ত্বার মতো রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও নানা রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। সেখানে যেমন গীতাঞ্জলির জীবনদেবতা ছিল; লালনের মনের মানুষ ছিল; তেমনি ছিল পদ্মাপাড়ের বৃত্তান্ত, তার ছোট ছোট দুঃখ-কথা। সেভাবেই ছিল স্বদেশি যুগের গোরা; ঘরে-বাইরের বিমলা-নিখিলেশ-সন্দ্বীপ। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের পক্ষে এক সময় অবস্থান নিলেও পরে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধমালায়। Nation-র Mythology নির্মাণ করতে চাননি তিনি। যেটা বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট সচেতন বা অসচেতনভাবে করে চলেছিল। যে দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি গান্ধীর চরকা ও অসহযোগ আন্দোলনকে ‘ক্রিটিক’ করেছিলেন, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বেঙ্গল স্কুলের Neo-traditionalism কে আঘাত করলেন সর্বাধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার আফ্রিকা-প্রভাবিত প্রিমিটিভিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের প্রদর্শনীর আয়োজন করে। কেবল তার নিজের দেশের ও কাছের ভুবনের চিত্রশিল্পীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। তাতেও যখন কাজ হলো না, তখন রং-তুলি ধরলেন তিনি নিজেই। ১৯৩০ সালে ফ্রান্সে তার চিত্র-প্রদর্শনীতে এসে কবি ও শিল্প-সমালোচক পল ভালেরী রবীন্দ্রনাথের এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলা দেখে হতবাক হয়েছিলেন। জার্মানিতেও যেসব শহরে প্রদর্শনী হয়েছে, সেখানেই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক কৌতূহলের গণ্ডি ছাড়িয়ে যারপরনাই বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। এই ভূভাগের আধুনিক ও সাম্প্রতিক চিত্রকলার জনক আসলে আর কেউ নন- রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। আধুনিক চিত্রকলার চারিত্র নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। যেমন, প্রশান্ত কুমার পাল তার রবিজীবনীর ৮ম খণ্ডে জানিয়েছেন যে, কবি শিল্প-কলায় সহজ-সরল রিয়ালিস্ট ধারার অনুকৃতিকে পছন্দ করতেন না। তার বরং আগ্রহ ছিল আকৃতি ও গঠনের ভাঙচুর, অর্থাৎ ফর্মের ডি-কনস্ট্রাকশনের প্রতি। যেটি সেজান-পরবর্তী আধুনিক চিত্রকলার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি গুরুদাস মল্লিক লিপিবদ্ধ করেছেন ও প্রশান্ত কুমার পাল তা হুবহু তুলে ধরেছেন। শিল্পকলা বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের আলোচনায় কবি বললেন : ‘আর্ট অসীমের প্রকাশ; রূপ অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেইটিই যেন শেষ লক্ষ্য না হয়। নিরাকারের আভাস দেবে সে, তার ব্যতিক্রম প্রতারণা মাত্র।’- ‘Was art an expression,- accurate or artistic,- only of pleasure or pain, of an happening, historical or otherwise? No, it should ever express the infinite, revealed through either of these elements. A realistic portrayal of these could be called skill or decoration, but not art.’ এর থেকেই বোঝা যায় যে, অবনীন্দ্রনাথ নন্দলালের সনাতনী রিপ্রেজেন্টেশনাল আর্ট-কেন্দ্রিক শিল্প-চিন্তার বিপরীতে ১৯২২ সালেই রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলা নিয়ে কতটা প্রাগ্রসর চিন্তা-ভাবনা করতেন। আবারও বলছি, রবীন্দ্রনাথই এই ভূভাগ থেকে উত্থিত প্রথম সচেতনভাবে ইউরোপীয় অর্থে ‘আধুনিক’ ধারার চিত্রকর। প্রিমিটিভ ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৮২ সালে টেট গ্যালারিতে যে ৬ জন উপমহাদেশের চিত্রশিল্পী নিয়ে পুরোধা ব্রিটিশ চিত্রকর ও শিল্পী ভূপেন খাকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাওয়ার্ড হচকিন চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন তার মধ্যে প্রথমেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের নাম। সেটা তার কবিখ্যাতির জন্যে নয়, প্রধানত তার মৌলিক চিত্রকর্মের স্বীকৃতিদানের তাগিদে।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে এখানে নতুন করে কিছু যোগ করার নেই। এ নিয়ে নানা গুণীজন ইতোপূর্বে আলোচনা করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী, রামকিংকর, যামিনী রায় এরা রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে লিখেছেন, মন্তব্য করেছেন- তার কোনোটি হয়তো চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের কোনো বিশেষ দিক তুলে ধরে, কোনোটি হয়তো তর্কসাপেক্ষ পর্যালোচনা। চলচ্চিত্রকার ও চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রায় যেমন আগেই বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথের ছবির মৌলিকত্বের কথা। তিনি বলেছেন, ‘It is important to stress that he was uninfluenced by any painter, eastern or western.’ এটা কিছুটা বাড়িয়েই বলা। কেননা, আমরা একটু পরেই দেখব যে প্রভাব এসে পড়েছিল নানা সূত্র থেকেই।

আমি বিশেষ করে উল্লেখ করব গণেশ পাইন-এর ‘শিল্পীর দৃষ্টিতে রবীন্দ্র-চিত্রকলা’, সত্যজিৎ চৌধুরীর ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’, কাইয়ুম চৌধুরীর ‘রবিতীর্থে’, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিত্রী রবীন্দ্রনাথ :অনাগত কালের আগামবার্তা’, আবুল মনসুরের ‘রবীন্দ্রনাথ-চিত্রশিল্পী-কলাভবন পরম্পরার সম্পর্কসূত্র’, আলী আনোয়ারের ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রমালার ল্যাবিরিন্‌থ’, আনা ইসলামের ‘প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ’, সুশোভন অধিকারীর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাউহাউস :কিছু চেনা, কিছু অচেনা খবর’ শীর্ষক প্রবন্ধ এবং অতি-আবশ্যিকভাবে কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারীর ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’-এর মতো মৌলিক গবেষণা-গ্রন্থ। শেষোক্ত গ্রন্থের বিতর্কিত মন্তব্য (‘লাল রংটা রবীন্দ্রনাথের চোখে ঠিকমতো ধরা দিত না’) সত্ত্বেও এর উল্লেখ করেছি, কেননা এটি তথ্যে ঠাসা একটি গবেষণা কাজ। আমি শুধু বর্তমান আলোচনার মূল বিষয়বস্তু- আধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার ওপরে প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রভাব-এর সঙ্গে সংগতি রেখে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রতিফলন নিয়ে কিছু মন্তব্য করব। প্যারিসের কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার এই অজানা দিকটির প্রতি আমি সজাগ হয়ে উঠি।

রবীন্দ্রনাথ যে জার্মান শিল্পী এমিল নোল্ডে (Nolde)-এর এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলায় বিমোহিত হয়েছিলেন এবং তার অনেক চিত্রকর্মের মধ্যে নোল্ডের প্রভাব অনুভব করা যায়- এটি নানাজনের সাক্ষ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু নোল্ডে নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কার থেকে বা কোন উৎস থেকে? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে তা হলো নোল্ডে (বা নোল্‌দে)-এর ছবিতে মুখ ও মুখোশের প্রবল উপস্থিতি, যা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মেও দেখা যায়। এ নিয়ে ডাইসন-অধিকারী তাদের বইতে লিখেছেন :’নোল্‌দের ছবির সঙ্গে [রবীন্দ্রনাথের] যে কিছু পরিচয় ছিল- অন্তত বইপত্রে প্রতিলিপির মাধ্যমে- তা সন্দেহাতীত। জার্মানিতে ভ্রমণকালে [রবীন্দ্রনাথ] কিছু মূল ছবি দেখেছিলেন এমন অনুমান করাও অসংগত নয়। ফর্মে ও থিমে নোল্‌দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এমন কিছু চমকপ্রদ মিল লক্ষ্য করা যায়, যা থেকে মনে হয় নোল্‌দের কিছু ছবি তিনি রীতিমতো স্টাডি করেছিলেন।’ কিন্তু নোল্‌দে কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? ডাইসন-অধিকারী ইঙ্গিত করেছেন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের প্রতি। সেটা যেমন মুখের (বা Head-স্টাডি করার) ক্ষেত্রে, তেমনি মুখের সম্প্রসারণে মুখোশের (বা Mask-স্টাডি করার) ক্ষেত্রে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি এখানে তুলে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে :

“মুখের প্রসঙ্গে আরও দেখতে পাই, নোল্‌দের প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণ থেকে এমন কতগুলি মনোক্রোমধর্মী স্কেচ জন্ম নেয়, যাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিকের কালি-তুলির স্কেচের সাদৃশ্য লক্ষ্য করবার মতো। …তাঁর [১৯১৩/১৪ সালের] ‘একজন স্থানীয় আদিবাসীর মাথা’ বা ‘স্থানীয় আদিবাসী’-এর পাশাপাশি রাখা যায় রবীন্দ্রভবনের ১৯৩৬, ২৯৬৪, বা ৩৪৫০-র মতো ছবিকে। …মুখোশও দুই শিল্পীর মধ্যে একটা সাধারণ এলাকা। …রবীন্দ্রভবনের রেখাঙ্কনধর্মী ২৭৯৮, ২৮৫৪, বা ২৯২৫-সংখ্যক [ছবির] সঙ্গে তুলনীয় নোল্‌দের ১৯১১-র মুখোশভিত্তিক স্টিল লাইফগুলি।” নোল্‌দে-রবীন্দ্রনাথের মুখোশভিত্তিক ছবিগুলোও প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের সুবাদেই অনুপ্রাণিত :’পিকাসোর ছবিতে যেমন আফ্রিকান মুখোশের একটা স্টাইলাইজেশন ঘটে …নোল্‌দের এই ছবিগুলিতে তেমনটি হয় না। এই ছবিগুলিতে মুখোশগুলি প্রথমতঃ বর্ণোজ্জ্বল গ্রোটেস্ক নৃতাত্ত্বিক সামগ্রী হিসাবেই চিহ্নিত, যেন সংগ্রহশালার শো-কেসে সাজানো রয়েছে। আবার তাদের মধ্যে মানুষের মুখের ভাবের অতিরিক্ত অভিব্যক্তিও সঞ্চারিত করা হয়েছে, নাটকের মুখোশে যেমন।’ নোল্‌দের মুখোশগুলো রবীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করেছিল :নোল্‌দের ১৯১২ সালে করা ‘মানুষের মাথা’ ছবিটিতে তিনটি মাথা আঁকা হয়েছে। ‘তিন মুখে তিন রকমের রঙের প্রাধান্য’। রবীন্দ্রনাথের ২১৭৮-সংখ্যক ছবিতেও ঠিক তেমনি পাশাপাশি সাজানো তিনটি মুখোশ :’রবীন্দ্রনাথের মুখোশ-ছবিতে নোল্‌দের মতো বর্ণৌজ্জ্বল্য না পাওয়া গেলেও সারি-বাঁধা মুখোশের উপস্থিতি ভারতীয় চিত্রকলায় অভিনব। এইসব মুখোশের ঠোঁট কোথাও চাপা, কোথাও ফাঁক-করা, কোথাও বা তাদের চোখের তারা বিস্ম্ফারিত। কার্টুনঘেঁষা ভাবভঙ্গিতে এরা রবীন্দ্রচিত্রবিশ্বে এক নতুন, অদ্ভুত জগৎ রচনা করে।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট (ও আর্ট-ফর্ম) শুধু যে ব্র্যাক, মাতিস, পিকাসো, ক্লি, কিরশনের, নোল্‌দে প্রমুখকেই প্রভাবিত করেছে তা-ই নয়, এদের ছবির সুবাদে বা প্রত্যক্ষভাবে প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাব এসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার ক্ষেত্রেও। এই প্রভাব রবীন্দ্রনাথকে তার নিজের মতো করে ‘এক্সপ্রেশনিস্ট’ হতে সাহায্য করেছে। আমরা শুধু পাশ্চাত্যের কাছ থেকে হাত পেতে গ্রহণই করিনি, আমরাও পাশ্চাত্যকে দান করতে কার্পণ্য করিনি। এই ‘আমরা’ আসলে কারা? এই ‘আমরা’ এ যুগের (বা সে যুগের) পাশ্চাত্যের অন্ধ-অনুকরণপ্রিয় বাঙালি মধ্যবিত্ত সত্ত্বা নয়। দান এসেছিল আমাদের দেশের নিম্নবর্গ অন্ত্যজ শ্রেণির কাছ থেকেই। কিরশ্‌নের যেমন করে প্রভাবিত হয়েছিলেন অজন্তার গুহাচিত্রের নাম-না-জানা নিম্নবর্গের শিল্পীদের দ্বারা।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৩

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

আগেই বলেছি, মাতিসের কাছে আফ্রিকার প্রিমিটিভ ভাস্কর্যের ‘ফর্মাল’ দিকটি বেশি করে ধরা দিয়েছিল। সামঞ্জস্যহীনতা, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে স্বাভাবিক অনুপাতের ভারসাম্যকে ইচ্ছাকৃত ভেঙে ফেলা, ‘ভয়ংকর সুন্দর’কে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা- এসব শৈল্পিক প্রয়োগকে এক স্বাধীন স্বরাট শিল্পীসত্তার প্রকাশ হিসেবে দেখেছিলেন মাতিস। ‘ফর্মের স্বাধীনতা’ সব সময়ই মাতিসের কাছে একটি মুখ্য বিবেচনা ছিল। কিন্তু ট্রকাদেরো মিউজিয়াম হঠাৎই চোখে-পড়া আফ্রিকার ভাস্কর্য পিকাসোর কাছে মনে হয়েছিল রহস্যময় এক জাদুকরী শক্তির আধার হিসেবে। ভাস্কর্য ছাড়াও মুখোশও তাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। সম্ভবত সেখানে আইভরি কোস্ট বা লাইবেরিয়ার কোনো Grebo mask দেখে থাকবেন তিনি। যদিও ট্রাইবাল আর্টকে ‘কালো-কুচ্ছিৎ’ বলে কখনও কখনও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন পিকাসো, কিন্তু সব ছাপিয়ে তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে এসব ভাস্কর্য ও মুখোশের ‘ম্যাজিক্যাল পাওয়ার’। জাদুকরী ক্ষমতা, মায়াবী আকর্ষণ, সম্মোহিত করার মতো শক্তি- এমন সব উচ্চারণই বেরিয়েছে পিকাসোর মুখ থেকে। এদিক থেকে মাতিসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পিকাসোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্রাঁসোয়া জিলোটের সঙ্গে কথোপকথনের আড়ালে স্বীকারোক্তিতে পিকাসো সেদিন যা বলেছিলেন, তা এতই তীক্ষষ্ট ও তলদর্শী, যা আমার অক্ষম অনুবাদে নিশ্চিতভাবে হারিয়ে যাবে। ইংরেজি ভাষ্যেই পিকাসোর কথাটা প্রথমে শোনা যাক (জিলোট তার ‘লাইফ উইথ পিকাসো’ বইতে এ নিয়ে লিখেছেন) :

‘Men had made those masks and other subjects for a sacred purpose, a magic purpose, as a king of mediation between themselves and the unknown hostile forces that surrounded them, in order to overcome their fear and horror by giving it a form and an image. At that moment I realized that this was what painting was all about. Painting isn’t an aesthetic operation; it’s a form of magic designed as mediation between this strange, hostile world and us, a way of seizing power by giving form to our terrors as well as our desires. When I came to that realization, I knew I had found my way.’

ট্রাইবাল আর্টের মুখোমুখি হওয়ার পর পিকাসোর মনে হলো যে চিত্রকর্মের মূল উদ্দেশ্য নান্দনিক আনন্দের বিতরণ নয়। চারপাশের তৈরি জগৎ ও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের মধ্যে কোনো এক রহস্যময় উপায়ে- প্রায় জাদু-বাস্তবতার কথাই এটা- ‘সেতু স্থাপন করা’ এর লক্ষ্য। যাতে করে মানুষ তার নিঃসঙ্গতার ভয়-ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারে। আবশ্যিকভাবেই, এই সেতু অলৌকিক; এই যোগাযোগ ও বিনিময় মায়াবী, সব রকম ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু ব্যাখ্যাতীত এই বাস্তবতা বা জাদু-বাস্তবতায় পৌঁছানোই শিল্পকলার আসল লক্ষ্য। গত শতকের আশির দশকে মার্কেজের উচ্চারণে এই জাদু-বাস্তবতার অন্য এক রাজনৈতিক রূপও আমরা দেখতে পাই। এবারে শুধু আফ্রিকার সঙ্গে পাশ্চাত্যের যোগসূত্র স্থাপিত হবে তা-ই নয়, গোটা লাতিন মহাদেশের শিল্প-সাহিত্য কলম্বিয়ার মার্কেজের ও পেরুর ইয়োসার গদ্যে, চিলির নেরুদা ও আর্জেন্টিনার বোর্হেসের কবিতায়, ইকুয়েডরের গুইসামিন (Guayasamin), মেস্কিকোর তামায়ো (Rutins Tamayo) ও কিউবার লামের (Wilfredo Lam) চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে শত শত বছরের সন্ত্রাস, ভয়, জড়তা ও নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠে পাদপ্রদীপের আলোয় ঝলমল করে উঠবে সাহসের সঙ্গে।

জিলোটের সঙ্গে আলাপে সেদিন পিকাসো তার সৃষ্টিশীল পথের একটি ‘মেজর টার্নিং পয়েন্ট’-এর কথা বলেছিলেন আফ্রিকান প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের আলোচনা-সূত্রে। আফ্রিকান শিল্পীরা ইউরোপের তুলনায় ভিন্ন চোখে শিল্পমাধ্যমকে দেখেন। নিছক আনন্দ-উপভোগের জন্য নয়। ‘আর্ট ফর আর্টস সেইক’ এ ধরনের মিথ্যা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ‘প্রিমিটিভ’ আর্টিস্টরা নেই। এটাই পিকাসোর সজাগ দৃষ্টি কেড়েছিল ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে সেদিন। পিকাসোর এই চিন্তা সমসাময়িক ফ্রান্সের স্ট্রাকচারালিস্ট এনথ্রোপলজিস্ট অন্দ্রে মালরোঁ, ক্লদ লেভি-স্ট্রস প্রমুখের নৃতাত্ত্বিক চিন্তার অনুবর্তী।

কিন্তু শুধু পিকাসো নন বিশিষ্ট এ ক্ষেত্রে। আরও অনেক সহযাত্রী রয়েছেন তার সঙ্গে। রোমানিয়ান ভাস্কর কনস্তানটিন ব্রানকুসি (Brancusi), রাশান ভদ্মামিলি কান্ডিনস্কি ও মার্ক শাগালের মতো বড় একটা সময় কাটিয়ে ছিলেন প্যারিসে। তার হাতে করা বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘এডাম ও ইভ’-এর সঙ্গে আইভরি কোস্টের কুলানগো (Kulango) ট্রাইবের কোনো নাম-না-জানা শিল্পীর হাতে গড়া মূর্তির প্রচণ্ড সাদৃশ্য। অকালমৃত আমাদেও মডিলিয়ানি চিত্রকর্মের জন্যই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তার করা অল্প কয়েকটি ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে ‘স্ট্যান্ডিং ন্যুড’; এর সঙ্গে পূর্বে উল্লেখকৃত গ্যাবন দেশের Fang মূর্তিটির বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জার্মান পল ক্লি-এর কথাও এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য।

পল ক্লী-র চিত্রকর্মে বিশেষ করে নর্থ আফ্রিকার লোকজ শিল্পের প্রভাব প্রবলভাবে অনুভূত হয়। উত্তর আফ্রিকা বলতে ‘মাগরেব অঞ্চল’কে বোঝানো হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া। যারাই পল ক্লীর চিত্রকর্মে প্রাচীন নৃগোষ্ঠীর মতো করে হাতে আঁকা ‘প্রিমিটিভ’, চিহ্ন, জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি ও নকশা দেখে ভেবেছেন এর রহস্য কী, তারা অন্তত এটুকু বুঝেছেন যে, এ জিনিস ‘ইউরোপ’ থেকে আসেনি। রেনেসাঁ-উত্তর চিত্রকলার কোনো শিল্পগত ঐতিহ্যেই এ রকম চিহ্ন বা প্রতীকের চর্চা হয়নি। এটা উঠে এসেছে আফ্রিকার লোক-শিল্পের গভীর তলদেশ থেকে। এর ‘সর্বাধুনিক পাঠের’ মিথস্ট্ক্রিয়া থেকে। ‘দ্য ম্যাজিক অব সাইনস্‌ অ্যান্ড প্যাটার্নস্‌ ইন নর্থ আফ্রিকান আর্ট’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট লিখেছে : ‘Many of (these) shapes and symbols have a marked resemblance to Neolithic Pottery found in the region. By combining signs with magical numbers or stylizing traditional symbols, contemporary artists top the unconscious to create abstract work that references the past and Present.’
এবং এ কথা বলেই তাদের মনে পড়ে যায় পল ক্লী-র কথা :’On several visits to North Africa, German artist Paul Klee was inspired by these mystical shapes and incorporated signs, number and letters into his work.’ অবশ্যই পল ক্লী-র চিত্রকর্ম আধুনিক উত্তর আফ্রিকার চিত্রশিল্পীদের প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালে, এ কথা স্বীকার করতেই হবে আমাদের। একটা সৃষ্টিকর্মের ওপরে নানা স্থান ও উৎস থেকে আলো এসে পড়তেই পারে, কিন্তু প্রভাব-সমুচয়ের বিষয়টি কেবল একতরফাভাবে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশে এসে পড়েছে বা পড়বে, বিষয়টা এমন নয়। আফ্রিকাও পিকাসো বা ক্লীর পর্যায়ের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃতদের প্রভাবিত করতে পারে। তাদেরকে শুধু বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে নয়, ‘ফর্মের’ ভাঙচুরের ক্ষেত্রে প্ররোচিত করতে পারে, এমনকি জন্ম দিতে পারে পিকাসোর কিউবিজম বা (পল ক্লী-র বেলায়) ‘মিস্টিক্যাল এবস্ট্রাকট’ পর্বের। সেই দ্বিমুখী সম্ভাবনার কথাই আবার মনে করিয়ে দেওয়া।

কুই ব্রানলি জাদুঘরে গেলে এ রকম অনেক সদৃশ্যতার কথা মনে পড়বে। ‘1906 Blast of Negro Art in Modern Art’ নামে একটি বই লিখেছেন আর্ট হিস্টোরিয়ান ণাবং ঈৎব্থযধষবঃ. আধুনিক শিল্পকর্মে কালো আফ্রিকার শিল্পকলার বিস্ম্ফোরণ। ১৯০৬ সালটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন এ ক্ষেত্রে, কেননা ওই বছরেই মার্সাইতে ‘কলোনিয়াল এক্সিবিশনের’ আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রদর্শনীর প্রভাব এসে পড়েছিল ব্র্যাক, মাতিস, পিকাসো, মদিলিয়ানি, পল-ক্লী প্রমুখের শিল্পকর্মে বিশেষত চিত্রকলায়। কবি গীয়ম আপোলেনিয়র আইভরি কোস্টের একটি Dan মাস্ক (Dan Tankagle) কিনেছেন সেটা আবার চিরিকোর (Giorgio de Chirico) করা আপোলেনিয়রের প্রতিকৃতির ওপরে প্রভাব ফেলেছে। তানজানিয়ার মাকন্দে (Makonde) মাস্ক। নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা (Yaruba) মাস্ক, মালির দগন (Dogon) মাস্ক, কঙ্গোর কুন্ডু-গাতা (N’kundu-Ngata) নারী-মূর্তি, কদ্ধান (Kran) মাস্ক, গ্যাবনের ফ্যাং (Fang) মাস্ক, মালির বাম্বারা (Bambara) মাস্ক, লাইবেরিয়ার গ্রেব্রো (Grebo-Kron) মাস্ক, এঙ্গোলার Tschokwe মাস্ক, আঁরি রুসো থেকে শুরু করে পিকাসো দেরাঁ থেকে লেজে (Fernand Leger), ক্লী থেকে ম্যাক্স আর্নস্ট, সবাইকে বিমোহিত করেছিল। এদিক থেকে দেখলে এই ভোগের চিত্রকলায় ও ভাস্কর্যে আফ্রিকার তুলনামূলক অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আমাদের শিল্পকলায় ‘লোকজ’ শব্দটি জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে বন্দি। যামিনী রায়কে কালীঘাটের পটশিল্পের প্রভাবে দেখতে পারি বা কামরুল হাসানকে ‘পটুয়া’ বলতে আগ্রহী হয়ে উঠি- প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রতি আমাদের উৎসাহের চৌহদ্দি ঐ পর্যন্তই। আধুনিক ভারতের বা বাংলাদেশের চিত্রকলায় ‘আফ্রিকার’ কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের দেশে আমাদের মতো করে ট্রাইবাল জীবনের ‘আধুনিক রূপায়ণ’ আছে, কিন্তু আধুনিক জীবনের ‘প্রিমিটিভ রূপায়ণ’ দুর্লভ। একজন হাল আমলের শিল্পী যখন সাঁওতাল, ম্র অথবা চকমা রমণীকে আঁকেন তখন তার লক্ষ্য থাকে আদিবাসী জীবনযাত্রার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি, পরিধানের বিশিষ্ট পোশাক বা দেহ গঠনের ভিন্নতার প্রতি। তাতে করে আধুনিক চিত্রকলার ওপরে আদিবাসী মনোজগতের, বিশ্বাসের বা সিম্বলিজমের কোনো আঁচড় পড়ে না, কোনো আলোড়ন সৃষ্টি হয় না, বা এর থেকে বলতে পারি না যে, দক্ষিণ এশিয় চিত্রকলায় ট্রাইবাল আর্টের ‘blast’ বা বিস্ম্ফোরণ হয়েছে। একজন সাঁওতাল বা মারমা রমণী হয়তো আমাদের কাছে এনথ্রোপলজিক্যাল আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু শিল্পকর্মে কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো নতুন আদর্শ বা নতুন ভাষার প্ররোচনা এতে করে সৃষ্টি হয় না। আমি যামিনী রায়ের এক্সপেরিমেন্ট অথবা ফ্রান্সিস নিউটন সুজা-র প্রিমিটিভ-প্রভাবিত চিত্রকলার কথা ভুলে যাইনি। একজন J.M.S. mari বা একজন এস. এম. সুলতান এ ভূভাগেও আছে। তারপরও বলতে হয়, যেভাবে ব্রাক-মাতিস-পিকাসো-ক্লীর কাছে ট্রাইবাল ও প্রিমিটিভ আর্ট নতুন আন্দোলন ও নতুন অভিব্যক্তির জন্ম দিল, সেভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলায় কেন প্রিমিটিভিজম ও মডার্নিজমের মধ্যে ভাবের, ভাষার এবং শুভদৃষ্টির বিনিময় হলো না, সেটা একটা ধাঁধার মতোই হয়ে থাকল।

নতুন আন্দোলন ও নতুন অভিব্যক্তি যে ট্রাইবাল ও প্রিমিটিভের গভীর তলদেশ থেকে জন্ম নিতে পারে তার জন্য ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি তাকানোর দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথেই আবার ফিরে যেতে হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু ও গগনেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ‘বেঙ্গল পেইন্টার্স’ গ্রুপকে রবীন্দ্রনাথের খুব বেশি পছন্দ হয়নি। বেঙ্গল স্কুল খুব বেশি ‘জাতীয়তাবাদী’ ধারার শিল্পকলা বলে ঠেকেছিল তার কাছে। যেমন তিনি নৃত্যকলার জন্য খুঁজে এনেছিলেন মণিপুরি নৃত্যের ‘ফর্ম’, তেমনিভাবে চিত্রকলায় নতুন অভিব্যক্তির নিরন্তর সন্ধানে ছিলেন। তিনি মুকুল দে-কে জাপানে চিত্রকলা শেখানোর একটি উদ্দেশ্য ছিল নতুন আর্ট-ফর্মের সন্ধান। কিন্তু তাতে তার মন সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এরপর নিজেই লেগে গেলেন রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে। দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে কোনোই মিল নেই, কিন্তু জার্মান প্রিমিটিভিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্টদের সাথে তার মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে মিলে গেল। ফিগারেটিভ, ল্যান্ডস্কেপ অথবা বিমূর্ত যে কোনো বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় দেখা গেল এক ভিন্ন ধরনের প্রভা, যার নিকটতম তুলনা কেবল পাওয়া যায় প্রিমিটিভ ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টে। [ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪২

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

পিকাসোর ‘আফ্রিকা’ দিয়েই আমি শুরু করতে চাই। যদিও পিকাসোর আগে ‘শুরুটা’ হয়েছিল। কে সূচনা করেছিলেন, সে নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে- মরিস ভদ্মামিঙ্ক (Maurice Vlamnck) এবং অন্দ্রে দেরাঁ (Andre Derain) দিয়েই। ১৯০৬ সালের শুরুর দিকে প্যারিসের একটি প্রদর্শনী থেকে দেরাঁ আফ্রিকার গ্যাবন দেশের একটি ‘ফ্যাং মুখোশ’ (Fang Mask) কেনেন। এরা দু’জনেই ছিলেন ইম্প্রেশনিজমের পরের উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ‘ফভ মুভমেন্টে’র সদস্য (Fauve painters নামে প্রসিদ্ধ)। ফরাসি ‘Fauve’
শব্দের অর্থ বন্য পশু, শিল্পকলার জগৎকে এক দানবিক শক্তি দিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে চেয়েছিলেন তারা; এই আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল- ১৯০৪ থেকে শুরু হয়ে ১৯১০ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত কুশীলবরা পরবর্তীকালে সেজান-পরবর্তী আধুনিক চিত্রকলার নানান দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। কে নেই এর মধ্যে? মাতিস, ব্রাক, রুয়ো (Roualt), এমনকি সামান্য কালের জন্য ‘নীল পর্বের’ পিকাসো স্বয়ং। এদের কিছু মৌলিক (অ-স্বাক্ষরিত) ‘লিথোগ্রাফ’ আমার সংগ্রহে রয়েছে। এই ফভ পর্ব যখন তুঙ্গে, তখনই আফ্রিকার ‘প্রিমিটিভ’ আর্টের প্রভাব এসে পড়ে প্যারিসের তরুণ শিল্পীদের মধ্যে। ফ্যাং মুখোশ কেনার কিছুদিনের মধ্যে মাতিস বেড়াতে যান আলজেরিয়ায়। সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন ভাস্কর্য (এবং ‘মুখোশ’) তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বস্তুত আমরা পিকাসোর ‘আফ্রিকা-পর্বের’ কথা আগে শুনেছি, কিন্তু মাতিসের আফ্রিকা-আবিস্কার প্রায় অজানা বা অচর্চিতই থেকে গেছে। ১৯০৬ সালের আলজেরিয়া ভ্রমণের পর মাতিসের আঁকার ধরনই বদলে গেল। উদ্ৃব্দতিটি তুলে দিচ্ছি : ‘Exposure to north African art, with its wealth of decorative patterns, helped him to simplify his drawing and I berate liberate color from its descriptive function. The trip also focused his attention on the arabesque an elegant, harmonies, S-shaped linear motif that plays a prominent part both in Islamic art and in the European academic tradition.’ এই প্রভাব এসে পড়েছিল মাতিসের Nude by the sea (১৯০৯) চিত্রকর্মে, যেখানে মোটা বলিষ্ঠ তুলিতে কালো রঙে দেহের অবয়ব স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এই ছবিতে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি কাঠের স্থির ভাস্কর্যের মতো- অবিকল পশ্চিম আফ্রিকার দণ্ডায়মান কালো কাঠের নারী মূর্তি। কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে এ রকম অনেক নিদর্শন ছড়ানো। তবে আলজেরিয়া ভ্রমণের তুলনায় আরও বেশি স্পষ্ট করে আফ্রিকার প্রভাব অনুভূত হয় ১৯০৭ সালের চিত্রকর্মে, যার নাম ‘স্ট্যান্ডিং নুড’। এখানে ট্রাইবাল আর্ট, যেটা ছিল কাঠের বা প্রস্তর মূর্তি আবক্ষ, তাকে অনুবাদ করা হয়েছে রংতুলির ভাষায়- অয়েল পেইন্টিংয়ের ক্যানভাসে। ভাস্কর্য ও মুখোশ থেকে ক্যানভাসে স্থানান্তর- সংক্ষেপে এভাবেই হয় ট্রাইবাল প্রিমিটিভ আর্টের ইউরোপীয় আধুনিক চিত্রকলায় ‘আত্তীকরণ’। এর পেছনে একটি ছোট ইতিহাস রয়েছে। শিল্প সংগ্রাহক ও সমালোচক গেরট্রুড স্টেইন ছিলেন পিকাসো ও মাতিস দু’জনেরই বন্ধু। প্যারিসে অবস্থানকালে মার্কিন এই রমণী সমসাময়িক তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার আসরে মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন- তার আতিথেয়তা, বুদ্ধিমত্তা ও উষ্ণ সহায়-সমর্থনের জন্য। পিকাসো তাকে নিয়ে প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তার বিখ্যাত জ্যামিতিক ধারার ভাঙচুর ও ডি-কনস্ট্রাকশনের কিউবিক পদ্ধতিতে। মাতিস একবার গেরট্রুডের বাসায় যাওয়ার পথে এন্টিক শপ থেকে আফ্রিকার ছোট একটি স্ট্যাচু সংগ্রহ করেন। সেদিন গেরট্রুডের বাসায় উপস্থিত ছিলেন পিকাসোও। আফ্রিকার ট্রাইবাল ভাস্কর্য নিয়ে মাতিস-পিকাসোর আলাপ একটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করে। মাতিস বলেন, ইউরোপীয় ভাস্কর্যে খুব বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, যাকে আঁকা হয়েছে তার বর্ণনার প্রতি, বিশেষত তার শরীরের গঠন-মাংসপেশি ইত্যাদি অনুষঙ্গের ওপরে। কিন্তু, দ্যাখো, আফ্রিকার ট্রাইবাল মূর্তিগুলোকে- মনে হচ্ছে কাঠ, পাথর বা মাটির ‘ম্যাটেরিয়াল’ যা-ই হোক না কেন, সেখান থেকে সরাসরিভাবে যেন কেটে তোলা হয়েছে এদের। শিল্পীর মেজাজ অনুযায়ী জ্যামিতিক ফর্ম, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে তুলনামূলক অনুপাত বেশ-কম করার ক্ষেত্রে বেশ স্বাধীনতা দেখতে পাই। ইউরোপীয় ভাস্কর্যে শরীর যেখানে ফিজিওলজির আঁটোসাঁটো গড়নের মধ্যে বন্দি, আফ্রিকার ভাস্কর্য সে তুলনায় অনেকটাই স্বাধীন। এই স্বাধীনতার দিকটি পিকাসো ও মাতিস উভয়েরই খুব মনে ধরেছিল। ভাস্কর্য শিল্পীর মনের ইচ্ছেকে প্রকাশ করছে- যাকে উপলক্ষ করে ভাস্কর্য গড়ে তোলা হচ্ছে, তা আর তার মুখ্য আগ্রহের বিষয়বস্তু থাকছে না। এটা দু’জনের কাছেই বিস্ময়কর আবিস্কার মনে হয়েছিল। পরবর্তীকালে Die Brucke (মানে, ‘সেতু’) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এরিখ হেকেল, এমিল নলডে, এর্নস্ট কিরশ্‌নের প্রমুখেরা আফ্রিকার প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাবে ইউরোপীয় চিত্রকলার মধ্যে ‘এক্সপ্রেশনিজমে’র ধারা সূচনা করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা মাতিসের বিরল ভাস্কর্য (তিনি খুব বেশি ভাস্কর্যের কাজ করেননি) ‘দ্য সারপেন্টাইন’ ও কিরশনের-এর ‘দ্য ড্যান্সিং ওমেন’-এর উল্লেখ করতে পারি।

প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাব মাতিসের শিল্পকলায় আমৃত্যু সঞ্চারিত হয়েছিল। এখন যাকে বলে ‘টেক্সটাইল আর্ট’, তারও মূল প্রেরণা এসেছিল আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকা ছাড়াও পাপুয়া নিউগিনি এবং পলিনেশীয় কাপড়ের ‘ইন্ট্রিকেট’ জ্যামিতিক ডিজাইন আধুনিক শিল্পকলাকে নাড়া দিয়ে গেছে। মাতিসের শোবার ঘরের একটা দেয়ালজুড়ে ছিল এসব দেশ থেকে সংগ্রহ করা ‘টেক্সটাইল’ শিল্পকর্ম। কাপড়ের বাহারি প্যাটার্নের নকশা মাতিস তার ক্যানভাসের চিত্রকর্মের মধ্যে প্রায়ই ব্যবহার করেছেন- অবশ্যই নিজস্ব উজ্জ্বল রঙের ফোয়ারা তুলে। ‘মাতিস ঈশ্বরের পরেই সবচেয়ে ভালো রঙের ব্যবহার করতে জানেন’- এই কথাটা পিকাসো সংগত কারণেই বলেছিলেন। সেই মাতিস আফ্রিকার ‘কুবা’ (Kuba) কাপড়ের জ্যামিতিক নকশা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, ‘I never fire of looking at even the simplest of them, and waiting for something to come to me from the mystery of their instinctive geometry… I can’t wait to sea what the tapa will reveal to meÑ for its perfection’. সাম্প্রতিক কালের উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, রতন মজুমদারের আশির দশকের সাদা-কালো ছাপচিত্রে এই প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল ‘টেক্সটাইল আর্টের’ মনোমুগ্ধকর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। অন্যবিধ প্রভাবও মাতিস নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। পল গগাঁর তাহিতি-সিরিজের চিত্রকর্মের মতো মাতিসেরও নিজস্ব স্মৃতি ছিল তাহিতি নিয়ে। ১৯৩১ সালে ষাট বছরের মাতিস তাহিতিতে বেড়াতে যান। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ‘পলিনেশিয়া’ অঞ্চল (French Polynesia হিসেবে চিহ্নিত)। সেখান থেকে মাতিস নিয়ে আসেন নানা ধরনের পোশাক (Tapa Cloths), স্থানীয় রমণীদের পরনের স্কার্ট (Pareos) এবং অ্যাপ্লিকের কাজ করা কাপড় (স্থানীয় ভাষায় Tifaifai নামে পরিচিত)। সেইসঙ্গে এসেছিল যত রাজ্যের শঙ্খ, ঝিনুক ও প্রবাল পাথর। পলিনেশিয়া মাতিসের চিত্রকর্মকে জল ও আকাশের গন্ধ ও বর্ণ ধার দিয়েছিল- তার ট্রেডমার্ক নীল পটভূমিতে আঁকা সাদা জল, মাছ, ঝিনুক, কোরাল ও শঙ্খমালা। পরবর্তীকালে এই চিত্রকর্মগুলো রূপান্তর হবে তার মৃত্যুর আগের মাসগুলোয় করা বিখ্যাত ‘কাটআউট’ সিরিজে। নানা রঙের কাগজ কেটে মিলিয়ে মিলিয়ে বানানো একান্তভাবে তারই উদ্ভাবিত অশ্রুতপূর্ব শিল্পকর্ম। এ নিয়ে আমি সাক্ষী-সাবুদ উপস্থাপন করতে পারি এখানে। কবি ও ঔপন্যাসিক লুই আরাগঁ ‘মাতিসের তাহিতি’ প্রসঙ্গে এভাবে বলেছেন :
‘Whoever knows Matisse is constantly aware of the influence of that distant island on his thoughts… he tells of the light of Tahiti, the lagoon, the transparent water, the fish and the Corals in that undersea light which is like a second sky.’ তার ওশেনিয়া (Oceania) ও পলিনেশিয়া (Polynesia) সিরিজ এভাবেই গড়ে উঠেছিল। তাহিতি মাতিসকে দিয়েছিল শুদ্ধতম চিত্রকর হয়ে ওঠার সিঁড়ি। পলিনেশিয়ার এক দ্বীপে মাত্র তিন সপ্তাহ থেকেই তার মনে হলো তিনি যেন সেই সিঁড়ির ধাপগুলো দেখতে পাচ্ছেন। সহকর্মী চিত্রকর পিয়ের বনার্ডকে (Bonnard)
তিনি লিখলেন, ‘Just 20 days on a coral island: pure light, pure air, pure colour: diamond sapphire emerald turquoise. Fabulous fish.’ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, (এক বিষ্ণু দে-কে বাদ দিলে) পরবর্তীকালে শামসুর রাহমানের কবিতার যতিচিহ্নের মতো ক্রমাগত উল্লেখ করা হবে সেজান, মাতিস, ব্রাক ও পিকাসোর কথা। তার বিশ্বকে লাল-নীল-সবুজ নানা রঙে বর্ণিল করবেন এই Fauve চিত্রশিল্পীরা। শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিক চিত্রকলা একটি আগ্রহের থিম। সেখানে আরও যুক্ত হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পীরা :যামিনী রায় থেকে জয়নুল; শাগাল ও কান্ডিনস্কি থেকে শুরু করে মিরো ও ডালি। সেটি নিজস্ব মূল্যেই একটি পৃথক ও একান্ত মনোযোগের বিষয়, যা বর্তমান আলোচনার বাইরে থাকল।

অনাবিস্কৃত মাতিসে এশিয়া-আফ্রিকার প্রসঙ্গ প্রচ্ছন্নে থাকলেও ‘পিকাসোর আফ্রিকা’ বহুদিন ধরেই একটি চর্চিত বিষয়। সমালোচক ও সহচিত্রশিল্পীরা সবাই বলেছেন যে, কিউবিজমের পেছনে একটি প্রেরণা যেমন- বিজ্ঞান (বিশ্বের ‘ত্রিমাত্রিক’ ভিউ, যা দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসের তলদেশ থেকে ত্রিমাত্রিক অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা), তেমনি অন্য একটি উৎসাহ এসেছিল আফ্রিকার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট-ফর্ম থেকে। আদিবাসীদের ভাস্কর্যের মধ্যে শারীরিক উপস্থাপনায় সচেতনভাবে বৈসাদৃশ্য, সামঞ্জস্যহীনতা, প্রতিতুলনা ও কর্কশতাকে (কুৎসিত নয়) প্রাধান্য দিয়ে ফর্মের সচেতন ভাঙচুর করা হয়েছে। অথচ তাতে করে নান্দনিক রসে ব্যাঘাত ঘটেনি :খাপছাড়া, কিন্তু সুন্দর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাঙচুর করে পুনর্নির্মাণ, একটি প্রচলিত শিল্পপদ্ধতিকে ভেঙে দেখার নতুন চোখ তৈরি করা (পাঠকের মনে পড়বে ‘Eye of Picasso’ গ্রন্থটি)- এটি আফ্রিকার তথাকথিত ‘প্রিমিটিভ’ আর্ট তাকে শিখিয়েছিল। কিন্তু পিকাসো নিজে এই ঋণ স্বীকার করতে আগ্রহী ছিলেন না। আফ্রিকার টোটেম তার সর্বাধুনিক কিউবিজমকে প্রেরণা জুগিয়েছে- এ কথা তিনি থিসিস আকারে বলতে পারতেন। কিন্তু বলেননি। এ নিয়ে তার স্ত্রী (যিনি নিজেও একজন উল্লেখ করার মতো শিল্পী) ফ্রাঁসোয়া জিলোট (Gilot) রাখঢাক না করেই প্রায় এভাবে বলেছেন, ‘যারা পিকাসোকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তারাই বুঝবেন কেন পিকাসোর মুখ দিয়ে ওই স্বীকারোক্তিটি বেরোয়নি। আসলে তিনি এ ব্যাপারে কেন, কোনো কিছুর জন্যই কারও কাছেই জীবনে কোনো ঋণ স্বীকার করতে চাননি।’ জিলোটের সঙ্গে পিকাসোর পরবর্তীকালে অবশ্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় (তার বৈষয়িক জীবনে এ রকম ছাড়াছাড়ির ঘটনা পৌনপুনিক)। ফলে এই ব্যাখ্যাকে পিকাসোর প্রতি সংবেদনশীল বলে গ্রহণ করা শক্ত।

আফ্রিকার ‘কোটা’ (Kota) ভাস্কর্যের প্রভাবে আঁকা হয়েছিল পিকাসোর বিভিন্ন চিত্রকর্ম। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘ড্যান্সার অব আভিগনন্‌’ ও ‘থ্রি উইমেন’ চিত্রকর্ম দুটি। কিউবিস্ট মোটিফে করা ‘গিটার’ও আরেকটি উদাহরণ। কীভাবে আফ্রিকার শিল্পকলার প্রতি পিকাসো আকৃষ্ট হন, সে গল্প জিলোটকে শুনিয়েছিলেন শিল্পী নিজেই। ১৯০৭ সালের শুরুতে প্যারিসের ‘ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে’ (যেটি এথনোগ্রাফি মিউজিয়াম নামেও পরিচিত) হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ে যায় আফ্রিকা থেকে সংগৃহীত একটি মূর্তি।

[ক্রমশ]