কর্নেল হামিদ এ রকম একটি নির্মম ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন ১৯৭৭ সালের বগুড়া সেনানিবাসের বিদ্রোহকে উপলক্ষ করে। আমি সেটি তুলে ধরছি- ”এবার শুরু হলো জিয়ার শুদ্ধি অভিযান। বিদ্রোহী বিমান ও সৈনিকদের পাকড়াও করে তাদের নির্মমভাবে ঢালাও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হলো। সংক্ষিপ্ত বিচারের সুবিধার্থে মার্শাল ল’ আইন করে বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হলো। এই সময় জেনারেল এরশাদ ছিলেন ডেপুটি চিফ। তারই তত্ত্বাবধানে এসব সংক্ষিপ্ত ট্রায়াল সুষ্ঠুভাবে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। শুরু হলো ত্বরিতগতিতে বিচারের নামে প্রহসনের পালা। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কয়েক শত সৈনিক ও বিমান সেনাদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। সেনা বা বিমানবাহিনীর কোনো প্রতিষ্ঠিত আইনকানুন এ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়নি। পাঁচটি কারাগারে একসঙ্গে ৮-১০ জন করে পর্যায়ক্রমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ফাঁসি ছাড়াও এলোপাতাড়ি ফায়ারিংয়ে মারা যায় শত শত। ফায়ারিং স্কোয়াডেও বহুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ঢালাওভাবে গ্রেপ্তারের পর বহু সৈনিকের মৃত্যু ঘটে অমানবিক নির্যাতনে। ৩ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি রাতে সেনা ও বিমানবাহিনী ব্যারাক থেকে সৈনিকদের ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নির্যাতন ক্যাম্পে, তারা আর ফিরে আসেনি। ক্যান্টনমেন্টজুড়ে হাহাকার। কান্নার রোল। কত সৈনিক, বিমান সেনা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলল, কতজন প্রাণ হারাল, ‘গুপ্তহত্যার’ শিকার হলো, এর কোনো হিসাব নেই। বিমানবাহিনীর কার্যক্রম ক্ষমতা নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়। সরকারি হিসাব মতেই শুধু দুই মাসে ফাঁসিতে লটকানো হয় ১১৪৩ জন সৈন্যকে, যার মধ্যে বিমান সেনাই ছিল ৫৫১ জন। হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া হয়নি। তারা আজও খুঁজে ফিরে তাদের প্রিয়জনকে। কোথায় যে এত লাশ গুম করা হলো, তাও এক রহস্য। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নাকি অভ্যুত্থান, তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। অনেকেরই ধারণা, এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এক নিধনযজ্ঞ। মধ্যরাতে সিগন্যাল লাইন্স ও কুর্মিটোলা এয়ারফোর্স ব্যারাকে কে বা কারা স্লোগান দিয়ে আহক্ষান জানিয়ে শুরু করে বিদ্রোহ, তা আজও রহস্য। পাক-ভারতের ইতিহাসে কোনো সামরিক অভ্যুত্থানে এত লোকের ফাঁসি, হত্যা, প্রাণহানি, জেল আর কখনও ঘটেনি। কী আশ্চর্য! এতবড় মর্মান্তিক ঘটনার কখনও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। কেউ দাবিও করেনি। কী বিচিত্র এই দেশ!”
আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু ও তার বাকশালের শত্রুদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। অতিদক্ষিণপন্থি স্বাধীনতাবিরোধী, অতিবামপন্থি নকশাল ধারার, জাসদ-গণবাহিনী, জাতীয়করণের ফলে ক্ষিপ্ত ধনিকগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত মধ্যবিত্ত, পাকিস্তানপন্থি, চীনপন্থি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী-বিশাল একটি স্পেকট্রাম বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এর মধ্যে সবার আগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ, যারা কোনোমতেই বাংলাদেশের সৃষ্টিকে মেনে নিতে পারে নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইসলামিক রিপাবলিকের বদলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ঘোষণা। এর গুরুত্ব শুধু দক্ষিণপন্থি পত্রিকা ইত্তেহাদ থেকেই উচ্চারিত হয়নি, এর সঙ্গে কোরাস মিলিয়েছিল বিলেত-আমেরিকার মেইনস্ট্রিম পত্রিকারাও। কর্নেল ফারুকের বয়ান দিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্টে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি ইসলামবিরোধী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল :’সবশেষে মুজিব তাহার ঈমান অর্থাৎ পবিত্র ইসলামের সাথে বেঈমানী করেন।’ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিয়্যুর ২৯ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় যা লেখা হয়েছে তার মানে দাঁড়ায় যে মুজিবের ‘সাম্প্রদায়িক’ কর্মকাণ্ডের জন্যই পাকিস্তান ভেঙে যায়। উদ্ধৃতিটির কুযুক্তিটি একটু শোনা যাক আবার :’পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের জন্য সূক্ষ্ণ পদক্ষেপ নিতে শেখ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন… তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, পাকিস্তানের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী ছিল। দেশের ভাঙনকে ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি ব্যর্থ হয়েছেন এমন কোনো সদিচ্ছা দেখাতে, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের আকস্মিক অভিযান নিবৃত্ত করতে পারত। এরপর যে ট্র্যাজেডি শুরু হলো তার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও ভুট্টো নিঃসন্দেহে দায়ী। তাহলেও বলতে হবে যে, শেখের বাগ্মিতার ফলেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও রক্তপাত শুরু হয় এবং তাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের একান্ত অনুগতরা নৃশংস অভিযান আরম্ভ করার অজুহাত পায়।’ দক্ষিণপন্থি সমালোচনার আরেকটি ধারা সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের অংশ করাকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাঁড় করায়। ১৭ আগস্ট ১৯৭৫-এর সানডে টাইমস পত্রিকায় এন্থনি মাসকারেনহাস এরকম যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন : ‘মুজিবের পতনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশ শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ইসলামের মর্যাদার এই অবমাননা অনিশ্চয়তাসূচক প্রমাণিত হয়েছে।…এই পটভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছিল। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাক আহমেদ বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করে রাতারাতি জনসমর্থন লাভ করেছেন।’ বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকা ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় একই অভিমত তুলে ধরেছিল। মার্টিন ওয়ালকট সেখানে লিখেছেন :”তাছাড়া আদর্শগত প্রশ্নও ছিল। মুজিব নতুন জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক মস্কোপন্থি রাজনীতিবিদকে স্থান দিয়েছিলেন, ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে প্রাচীনপন্থি মুসলমানগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, নতুন শাসকরা বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করেছেন।” বস্তুত, দলিল-পত্র ঘাটলে দেখা যায় যে দেশের ভেতরে ও বাইরের চরম দক্ষিণপন্থি ও চরম বামপন্থি শক্তি অবশেষে কৌশলগত একবিন্দুতে মিলিত হয়েছিল-সেটা হলো তীব্র ভারত ও রাশিয়ার বিরোধিতা। তাদের যুক্তি ছিল :বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্টে নিহত হয়েছেন তার কারণ তিনি নিজেই; তার সরকার এবং তার প্রস্তাবিত বাকশাল ব্যবস্থা ছিল ঘোরতরভাবে রুশ-ভারতপন্থি। এই ‘ডিসইনফরমেশন ওয়ার’ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এনায়েতুল্লাহ খান ‘শেখ মুজিবের উত্থান পতন’ প্রবন্ধে তার ভাষায় বাংলাদেশের ‘মধ্যবিত্ত মানসের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করেছেন নিল্ফেম্নাক্ত ভাবধারায়: ”বিগত সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের দুঃখী জনগণ এই অবাক প্রদর্শনীর মৌন দর্শক ছিলেন। তাদের নিঃশব্দ আর্তিতে ধ্বনিত হচ্ছিল কতিপয় লুটেরার অট্টরোল। আর তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র-যারা সমাজতন্ত্রের ছলে, মৈত্রীর ছদ্মবেশে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের আবডালে বাংলাদেশকে বৈদেশিক স্বার্থের অবারিত লীলাক্ষেত্রে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে বাঙালি বুর্জোয়ার নিকৃষ্টতম মেরুদণ্ডবিহীন মুৎসুদ্দীকুল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি ধ্বংসকল্পে পরদেশী বাণিজ্যিক পুঁজির সেবা-দানের ভূমিকায় নিয়োজিত ছিল। এরই সাংগঠনিক রূপ ছিল ‘দেশপ্রেমিক'(?)দের ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। এই ঐক্যজোটের নীলনকশা পরিশেষে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে রূপায়িত হয়। ফলতঃ বাংলাদেশ একদিকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাববলয়ে আবর্তিত হয় এবং অন্যদিকে পূর্ব ভারতের ধ্বংসোন্মুখ শিল্পকেন্দ্রের প্রায় ঔপনিবেশিক পশ্চাদভূমিতে পরিণত হয়। দেশের উৎপাদিকা শক্তিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করবার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীতে বিরল। অষ্টাদশ শতকের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের লুটেরা বাণিজ্যিক পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সাদৃশ্য লক্ষণীয়।” বাংলাদেশ সম্পর্কে এনায়েতুল্লাহ খানের উপসংহার ছিল যে এটি নিক্ষিপ্ত হয়েছে যুগপৎ ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের’ (অর্থাৎ রুশ প্রভাববলয়ের) এবং ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদের’ ফাঁদে। মার্কিনপন্থি লিবারেল ও চীনপন্থি অতিবাম মহলে সে সময়ে এটি চালু থিসিস ছিল। এই মূল্যায়ন সমর্থন করেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত চীনঘেঁষা বামপন্থি পত্রিকা ফ্রনটিয়ার। এর ১৯৭৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় দেখতে পাই অনুরূপ প্রচারণা :’…ভারতীয় হস্তক্ষেপের ফলে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসীন হলো তাদের মতো স্বার্থপর নেতৃত্ব কোনো দেশে সত্যিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পর আর দেখা যায়নি। দেশটি যে অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য-সহায়তা বাংলাদেশের কোনো কাজে আসেনি। আরামদায়ক বন্দিদশা থেকে শেখ মুজিব প্রত্যাবর্তনের পর দেশের অবস্থা মন্দ থেকে মন্দতর হয়েছে।’ ফ্রন্টিয়ার যে এরকম অভিমত রাখবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সমর সেন সম্পাদিত পত্রিকাটির মতাদর্শ ছিল তখনকার মাওবাদ তথা নকশালবাড়ির পথ। এজন্যেই ১৯৭৫ সালের বাকশাল প্রবর্তনকে তারা মনে করেছেন প্রকৃত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ বলে :’ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনীতি স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। এর প্রধান দিক হচ্ছে বাংলাদেশের বামপন্থি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম।’ অতিডানপন্থি ইত্তেহাদ গ্রুপ, এনায়েতুল্লাহ খানের লিবারেল সুরের হলিডে, আর অতিবামপন্থি ফ্রন্টিয়ার একই সুরে তখন কথা বলেছে। তিন ধারাই তখন মিলে যাচ্ছিল মুজিব-সরকার উৎখাতের যৌথ প্রযোজনায়। ১৯৭৪-৭৫ সালে পাশ্চাত্য থেকে প্রকাশিত মূলধারার পত্র-পত্রিকা ঘাঁটলে আজকের যুগে যেটা ‘হাইব্রিড ওয়ার’ বলে অভিহিত হচ্ছে (যেখানে প্রথাগত যুদ্ধের সঙ্গে অপপ্রচার ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ জড়িত থাকে) তার প্রাথমিক লক্ষণগুলো পাওয়া যায়। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানোর জন্য পূর্ণ সত্য বা পূর্ণ মিথ্যা কোনোটিই বলার দরকার নেই। এর জন্য ‘অর্ধ-সত্য’ বলাই যথেষ্ট-তাতে করে সত্য বলার ভানও করা যায়, আবার ডিসইনফরমেশন ক্যামপেইনও দিব্যি চালানো যায়। এনায়েতুল্লাহ খান-ফ্রন্টিয়ার বলছিলেন যে মুজিব বামপন্থি বিপ্লবীদের ধ্বংস করতে চাচ্ছেন। এবার আগস্ট অভ্যুত্থানের কারণ বলতে গিয়ে গার্ডিয়ান (১৬ আগস্ট ১৯৭৫) লিখল যে, বঙ্গবন্ধুকে আসলে হত্যা করা হয়েছে তার বামপন্থি বিপ্লবী আদর্শের কারণেই। উদ্ধৃতিটি মনোযোগের দাবি রাখে। প্রগতির পথে চলার একপর্যায়ে তিনি শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনীকে চটিয়ে দিয়েছিলেন-সেটাই তার নিহত হওয়ার কারণ। ‘মুজিব নিজেই দায়ী’-অন্য কাউকে এর জন্য দায়ী করা চলে না : ‘কিন্তু নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এবং দেশে কিছুটা প্রগতি আনার জন্য তার শেষ পদক্ষেপেই তার পতন ডেকে এনেছে। বামপন্থি আদর্শে তিনি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনী তার প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল। অথচ তাদের সমর্থনেই তিনি প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ অবস্থায় মুজিব নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুঁজছিলেন। তাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্য মস্কোপন্থি দলগুলোও উৎসাহ জুগিয়েছিল।’ যুক্তি হিসেবে বলা হলো যে, গ্রামে বহুমুখী সমবায় করার সমাজতান্ত্রিক নীতিই মুজিবের সর্বনাশ ডেকে এনেছে: ‘মে মাসে মুজিব ঘোষণা করলেন যে, গ্রামে গ্রামে বাধ্যতামূলকভাবে কৃষি সমবায় গঠন করা হবে, গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনিক পরিবর্তন করা হবে এবং জাতীয় দল গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। সংক্ষিপ্ত হলেও এ কর্মসূচি আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী, পেশাদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেককেই আতঙ্কিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।’ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বামপন্থি হয়ে ওঠাই শেষ পর্যন্ত তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। [ক্রমশ]
‘ব্রেকফাস্ট উইথ ইভিল’ বইতে আশিস নন্দী যে ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটির’ কথা বলেছিলেন তার মর্মার্থ ছিল রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক ভায়োলেন্স একপর্যায়ে সামাজিক ভায়োলেন্সের স্লুইসগেট খুলে দেয়। ‘প্রাগ-আধুনিক’ যুগে সহিংসতা প্রকাশ পেত লাঠিসোটা, রড-হকিস্টিক, ছুরি-কিরিচ এসব অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। কচিৎ-কদাচিৎ ব্যবহূত হতো বন্দুক-পিস্তল ধরনের মারণাস্ত্র। সাদত হাসান মান্টো তার অনুগল্পগুলোয় পার্টিশন-রায়টের যে রক্তশীতল করে দেওয়া বিবরণী রেখে গেছেন তাতে লাঠিসোটা ছুরি-কৃপাণের ব্যবহারই ছিল চোখে পড়ার মতো। ষাটের দশকের শেষে নকশাবাড়ী আন্দোলনে ‘জোতদার খতমের’ কাজে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার জন্য। চারু মজুমদারপন্থিরা শ্রেণিশত্রুর গলা কাটার জন্য গ্রাম-এলাকায় ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন- ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার পাতায় এমনটাই পরে শুনেছি। অবশ্য পরে শহর এলাকার ছাত্র-যুবকরা এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে পাইপগান ও হাতে বানানো বোমার প্রচলন ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। এই ‘টেকনিক’ আমাদের দেশেও অতি-বামপন্থিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২-৭৫ সালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে এসব ‘প্রাগ-আধুনিক’ অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ব্যবহূত কিছু ‘আধুনিক’ সমরাস্ত্র যেমন এসএলআর রাইফেল ও স্টেনগান এসবেরও আংশিক প্রয়োগ হয়েছিল কোথাও কোথাও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দূর থেকে নয়, একেবারে গলাকাটা দূরত্বে এসে শ্রেণিশত্রু খতমের ধারাই ছিল সহিংসতার মূল কালচার। পরবর্তী সময়ে অতি-বাম সহিংসতার সংস্কৃতি অতি-ডানপন্থিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার সময় ‘রগ কাটা’ পদ্ধতির প্রচলন হয়। পায়ের রগ কেটে প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করার পদ্ধতিকে দাবি করা হয় একই সঙ্গে আতঙ্ক লাগানো এবং এফেক্টিভ পদ্ধতি হিসেবে। টেকনিক একবার উদ্ভাবিত হলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং যে কোনো আইডিওলজি প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন হলে ব্যবহূত হতে পারে। তবে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিনির্ভর, গণ-আকারে সহিংসতার প্রথম ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই আমরা ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময়ে। বস্তি এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এর আগে শহরের বুকে কখনও ট্যাঙ্ক চলেনি। শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক’ ও সাঁজোয়া বাহিনী, আর গর্জে ওঠা ‘রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান’ সেদিন ‘খই ফুটিয়েছিল’ যত্রতত্র। শহরের বুকে ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান গুলি ছুড়ছে- এ দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘আধুনিক’ যুগে আমরা প্রবেশ করি। দ্বিতীয়বারের মতো এই আধুনিক সহিংসতার মুখোমুখি হই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। শহরের বুকে রাতের অন্ধকারে আবারও নামে ট্যাঙ্কের বহর (যদিও তখন জানা ছিল না যে সেগুলো গোলাবিহীন)। নামে মেশিনগান এবং ভারী মারণাস্ত্র সুসজ্জিত ঘাতক বাহিনী। প্রধান লক্ষ্য তাদের ৩২ নং সড়কের বাড়ি। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে সামরিক বাহিনী, ট্যাঙ্ক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে প্রাসাদকে লক্ষ্য করে। প্রাসাদের ভেতরে আত্মরক্ষার জন্য হাতে স্টেনগান নিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে, এবং যুদ্ধ করতে করতেই মারা গেছেন তিনি- এ কথা আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শুনেছি। সিআইএ এই অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল তা-ও জেনেছি। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় এ রকম আকছার ঘটে থাকে, এমনটাই ভেবেছি। শুধু আয়েন্দের মতো নির্বাচিত সিভিলিয়ান শাসকের বিরুদ্ধে নয়, অনির্বাচিত সামরিক শাসকের বিরুদ্ধেও মিলিটারি ক্যু ঘটে থাকে। গত শতকের ৫০-৬০-৭০-৮০-র দশকের লাতিন রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্যু ঘটবে, এটা অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ঘটনা। ঠান্ডা যুদ্ধের বাহানায় তখন পিরিয়ডিক সামরিক অভ্যুত্থানকে ‘নিউ নরমাল’ হিসেবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশেও এটা কী করে ঘটতে পারে?
প্রশ্নটা বোকার মতো করলাম, নাকি এর পেছনে কোনো যুক্তি আছে- সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি উদাহরণ দিই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ‘প্রাগ-আধুনিক’ সহিংসতার যুগে কেমন ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের একটি স্মৃতিচারণায়। ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখা’ একটি অনুষ্ঠানে (বিআইডিএস আয়োজিত) তিনি বলেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু নিয়মিতভাবে তার বিপদে পড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সাহায্য করতেন। মাসে কাদের কত সাহায্য দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, তার হিসাব রাখার জন্য একটি লগবুক রাখতেন তোফায়েল আহমেদ (সে সময়ে তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব)। একদিন বঙ্গবন্ধু খাতাটি দেখতে চান। সেখানে লেখা ছিল মওলানা ভাসানী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখের নাম। কারও নামের পাশে মাসিক ৫০০ টাকা, কারও নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা। শাহ আজিজ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ভুট্টোর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন (পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হন)। ১৯৭২-৭৫ পর্বে ভাসানী তার প্রকাশিত ‘হক-কথা’ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুজিব সরকারের সক্রিয় বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন। দেশে উগ্র ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব প্রচারে ‘হক-কথার’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শাহ আজিজ, ফজলুর কাদের চৌধুরী, সবুর খান সে সময়ে জেলে ছিলেন দালাল-আইনে। মোদ্দা কথা, এখনকার রাজনৈতিক কালচার অনুযায়ী এসব বিতর্কিত ও অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে নিন্দিত অনেক ‘বিরোধী’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদার সাহায্যের তালিকায়। ৫০ বা ৬০-র দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখা সরকারি দল-বিরোধী দল নির্বিশেষে- এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। একই আবহাওয়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন শেখ মুজিব। এখন তিনি রাষ্ট্রনায়ক, কিন্তু সেই রাজনৈতিক আচার-সহবত বা বৃহত্তর অর্থে নৈতিকতাবোধ তিনি ভুলে যেতে পারেন না। তোফায়েল আহমেদকে একপ্রকার তিরস্কারই করলেন লগবুকে লেখা নামগুলো দেখে। ‘এভাবে কেন এদের নামের পাশে টাকার অঙ্ক লিখে রেখেছ? পুরো নাম লিখবে না। মওলানা ভাসানী না লিখে, লিখবে এম. বি; শাহ আজিজ না লিখে লিখবে এস.এ’- সাংকেতিকভাবে নামের ও সাহায্যের রেকর্ড রাখতে বললেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নৈতিকতার এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। সিরাজুল আলম খান ও আ স ম রবের জাসদ তার সরকারের চরম বিরুদ্ধাচরণ করেছিল ১৯৭২-৭৫ পর্বে। কিন্তু এর পরও সস্নেহে তিনি তারই হাতে গড়া ছাত্রলীগের ‘বিদ্রোহী’ অংশকে নিশ্চিহ্ন করতে চাননি। সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব বা শাজাহান সিরাজকে কারাবন্দি করা হয়নি। হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা প্রকাশ্যে যেখানেই বিচরণ করতেন, সে খবর বঙ্গবন্ধু রাখতেন কিন্তু তাদের কারাবন্দি করার প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু যারা চরম বামপন্থি বা চরম ডানপন্থি দলের বা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বাধ্য হয়ে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নয়, সে আমলের বা প্রাগ-আধুনিক পলিটিক্সের যুগে প্রায় সব জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যেই ছিল। তারা অনেকটা এপিক মহাকাব্যের রথী-মহারথীদের মতো। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ, কিন্তু যুদ্ধের পরে (অর্থাৎ সূর্য অস্ত গেলে) পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ-সখ্যের সম্পর্ক থাকত। ‘মহাভারত’-এর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে কুরু-পাণ্ডবরা পরস্পরের সঙ্গে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কঠোর যুদ্ধ করেছেন। সূর্যাস্তের পরে পরস্পরের শিবিরে গিয়েছেন মৃতদের প্রতি শোক-সমবেদনা জানাতে। এই নৈতিকতা বঙ্গবন্ধু ও তার যুগের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল এবং যাদের মধ্যে সেটা দেখা যেত না, তারা রাজনৈতিক মহলে দল-নির্বিশেষে নিন্দিত হতেন।
কিন্তু এসবই প্রাগ-আধুনিক রাজনৈতিক যুগের কথা। ৭৫-এর আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও তাদের প্ররোচিত বা প্রেরিত ঘাতক বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের নৈতিকতাবোধের কোনো লেশমাত্র ছিল না। আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, যান্ত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর গণহত্যায় কুশলী ঘাতক দলের কাছে প্রতিপক্ষ মানে শত্রুপক্ষ, আর শত্রু মানেই নিধনযোগ্য ছলে-বলে-কৌশলে। আমাদের দেশে ঘাতকরা ‘কৌশলের’ সূক্ষ্ণ আশ্রয় নেওয়ারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা এর চমকপ্রদ উদাহরণ। ঘাতকদের মধ্যে পৌরাণিক নৈতিকতাবোধ না থাকলেও পুরাণের নিকৃষ্টতর উদাহরণকে তারা গ্রহণ করেছিল। ‘মহাভারতে’ মহারথী অশ্বত্থামা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও রাতের অন্ধকারে শত্রু শিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর পাঁচজন সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। যুদ্ধের ময়দানে নয়, যুদ্ধের বাইরে তা-ও নাবালক শিশুসন্তানদের হত্যা সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যা বা ‘ব্রহ্মহত্যার’ পর্যায়ে পড়ে। ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা অশ্বত্থামার পথকেই বেছে নিয়েছিল। শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, স্ত্রী-পরিজন শিশুসন্তানকেও হত্যা করেছিল, এমনকি ভ্রূণ হত্যা করতেও তাদের বাধেনি। সেরনিয়াবত বা শেখ মনির পরিবারের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এসব হত্যা শুধু নির্মমতাই নয়, এটা সমস্ত ন্যায়নীতি ও ঔচিত্যবোধের বাইরে। এর জন্য অশ্বত্থামাকে যেমন পুরাণ অনুযায়ী অনন্তকাল ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটাতে হবে, তেমনি বাংলাদেশেও ১৫ আগস্টের প্রতিফল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বয়ে বেড়াতে হবে আরও দীর্ঘকাল। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জেলহত্যার মতো পাশবিক হত্যাকাণ্ড। রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে সে রাতে যা ঘটেছিল তা অবিশ্বাস্য ও বর্ণনাতীত। মোসলেহউদ্দিনকে জেলগেটে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলেন না ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। কেননা সে উচ্চ স্বরে বলছিল যে জাতীয় ‘চার নেতাকে’ হত্যা করার জন্যই সে এসেছে জেলগেটে তার বাহিনীসহ এবং এসেছে প্রেসিডেন্টের আদেশেই! জেলার তখন বঙ্গভবনে যোগাযোগ করায় দাবির ন্যায্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ তার বইতে লিখেছেন এ বিষয়ে। তার বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামানের স্বহস্তে লিখিত জেলহত্যা রিপোর্টটি তুলে দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বরে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয় যে চারজন সেনাসদস্যসহ ক্যাপ্টেন মোসলেহ জেলগেট পৌঁছান এবং বলেন তিনি চার বন্দি জাতীয় নেতাকে ‘গুলি করবেন’। ‘এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই।’ এই ছিল জেলারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। পরে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করে প্রথমে মেজর রশিদ ও পরে প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়। কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ‘জেলগেট থেকে আইজি প্রিজন সরাসরি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে জেলগেটে মোসলেহউদ্দিনের আগমন ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। মোশতাক জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তাদের জেলে ঢোকার নির্দেশ দেন। হতবাক আইজি! খোদ প্রেসিডেন্ট বেআইনি নির্দেশ দিলে বেচারা আইজি-ডিআইজি কী করতে পারে? ঘটনার ২১ বছর পর বর্তমানে জেলহত্যার প্রামাণ্য দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে ছিল। এতে দেখা যায় খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশিদ চার জাতীয় নেতাকে হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন।’ ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা সহিংসতার সমস্ত নিয়মনীতি অতিক্রম করে আমাদের সমাজকে সহিংস করে তোলে। এ রকম সমাজে-রাষ্ট্রে সব ধরনের সহিংসতাকেই অনুমোদন দেওয়া সম্ভব (এরই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা করা সম্ভব হয়েছে)। এ ধরনের সহিংসতার সংস্কৃতি কোনো সমাজে একবার গেড়ে বসলে তার মূলোৎপাটন সহজ নয়। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর ঘটেছিল বলেই নির্মমতার একটি সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রজীবনেও এক দীর্ঘ অশুভ ছায়া ফেলেছিল। ১৯৭৬-৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনামলের শুরুর পর্যায়ে অনেকগুলো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়েছিল। সেগুলোর বিচার হয়েছিল লাতিন আমেরিকার কায়দায়- সামরিক শাসন নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেনি। [ক্রমশ]
স্বাধীনতার পরে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্যজোটের দরকার ছিল দেশকে প্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সেটি জানতেন। প্রথমে ত্রিদলীয় আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবি ঐক্যজোট ও পরে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তার স্বীকৃতি মেলে। অ-ধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রণী এমন অনেক দেশেই এটি দেখা গেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তি একত্র হয়েছে। যুগোস্লাভিয়ায় এটা ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্নভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের নানা পর্যায়ে এ ধরনের ঐক্যজোট হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ নানা ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্যের নানা অভিব্যক্তি দেশে দেশে দেখা যায়। জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্য-বিরোধের ‘ডায়ালেকটিক’ অবশ্য একটি পৃথক আলোচনার বিষয়বস্তু, যা এই লেখার পরিধির বাইরে। এখানে শুধু এটাই যোগ করার যে এ দেশেও একপর্যায়ে এরকম ‘ঐক্যজোট’ বাড়ার প্রয়োজনীয়তা ঐতিহাসিকভাবেই দেখা দিয়েছিল (যার সমসাময়িক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়)। তবে ঐক্যজোটে যোগ দেওয়া মানে নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ নয়। বাকশালের মতো ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও অন্যান্য দলের নিজস্ব ‘রাজনৈতিক সত্তা’ বিলোপ হয়ে যায় না। ন্যাপ-সিপিবির নির্দেশে যারা সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সবাই নিজ নিজ পার্টির নির্দেশেই সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন। সবাই যে সাগ্রহে যুক্ত ছিলেন এমনও নয়-কিন্তু কমিউনিস্ট শৃঙ্খলা মেনে সেদিন তাদের তা করতে হয়েছিল। আবার, কেউ কেউ বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি বলে আহতও বোধ করেছিলেন। এ বিষয়ে সিপিবির নীতি ছিল পরিস্কার। দলটি ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে সমন্বয় করার লেনিনীয় নীতিতে পূর্বাপর অটুট ছিল। বাকশাল গঠন করার পরপরই ‘গোপন ও প্রকাশ্য কাজের সমন্বয়’ এ বিষয়টি চিঠির আকারে তৎকালীন সিপিবির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়: ‘যারা প্রকাশ্যে কাজ করেন একটা কথা খেয়াল রাখা দরকার যে একমাত্র নিজেদের বিশ্বাসভাজন লোক ছাড়া তারা কারও নিকট পার্টিগত পরিচিতি প্রকাশ করিবেন না। প্রত্যেক পার্টি সভ্যকেই কোন না কোন ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত থাকিতে হয়। একমাত্র নিজেদের ইউনিটের সভ্য ছাড়া ও ঊধর্ক্ষতন কমিটির নির্দিষ্ট লোক ছাড়া এর অস্তিত্ব আর কারও নিকট প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। এতে বিপদের আশংকা বাড়ে। ইউনিটের সভা গোপনেই করিতে হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নেওয়া সত্ত্বেও বাইরে কাজ করার সময় তা আলাদাভাবে কার্যকরী করাই যুক্তিসঙ্গত। তা না হলে ইউনিটের অস্তিত্ব ও সভ্যদের পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ অবস্থায় ইউনিট সভ্যদেরকে একে অন্যের সংগে পরিচয় আছে তাও অস্বীকার করতে হয়। পার্টির গোপন ও প্রকাশ্য কাজগুলি নিয়মমাফিক সুষ্ঠুভাবে চললে এবং তার ভিতরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন ঠিকমত হলে পার্টির অগ্রগতি ঠিকমত চলা সম্ভব হয়।’ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির পরে কোনো একসময়ে সিপিবির উপরোক্ত চিঠিটি প্রমাণ করে বাকশালের ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলীয় রাজনৈতিক সত্তা ‘বিলোপ’ করেনি। নতুন পরিস্থিতিতে তারা শুধু তাদের কাজের ধারা বদলেছিল ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে নতুন ধারায় সমন্বয় সাধন করে। এ কথা সম্ভবত ন্যাপের সম্পর্কেও খাটে। নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখা সম্পর্কে সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও বাকশালের প্রগতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চরিত্র শনাক্ত করতে সিপিবি সেদিন ভুল করেনি- এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে বাকশাল সম্পর্কে পার্টির ইতিবাচক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে- সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে-সিপিবির হাতেলেখা একটি সার্কুলারে অভ্যুত্থান-উত্তর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল নিয়ে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রাখা হয়। এর থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিপিবির পূর্বাপর সমর্থনের দার্শনিক-রাজনৈতিক ভিত্তি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশে তখন ছিল অত্যন্ত জটিল ও বিপদসংকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সিপিবি তখন আন্ডাগ্রাউন্ডে। সে-রকম পরিস্থিতিতে বাকশালকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হলো:
‘৭ই নভেম্বর এক প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মূলগতভাবে এই সরকার দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল। ১. এই সরকার দেশে পূর্ণভাবে সামরিক শাসন এবং সামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসন কায়েম রাখিয়াছে।
২. এই সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল নীতিসমূহকে বাতিল করিয়া দেশে পুঁজিবাদ নীতি অনুসরণ করিয়া সাম্রাজ্যবাদী খপ্পরে পড়িতেছে। দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, মাওবাদী, পাকিস্তানপন্থি প্রভৃতিরা এই সরকারের সমর্থক। এরা প্রগতিশীলদের নির্মূল করিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অনুসরণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদী চীন এই সরকারের দৃঢ় সমর্থক। ভারত বিরোধিতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ইহাদের মূল আওয়াজ। সাম্রাজ্যবাদ নহে, ভারতই ইহাদের মূল শত্রু।
৩. জাসদের সরকার বিরোধিতাসহ দেশে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করিতেছে। জাসদ ও চার নীতি পরিবর্তনকারী উগ্র দক্ষিণপন্থিদের চাপ বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা রহিয়াছে।
৪. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়া যে সাম্রাজ্যবাদী মাওবাদী চক্রান্ত শুরু হইয়াছে তাহাকে পরাস্ত করিয়া বঙ্গবন্ধুর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অনুসারী একটি দেশপ্রেমিক সরকার কায়েম করা আমাদের লক্ষ্য।
৫. বঙ্গবন্ধুর নীতির অনুসারী একটি দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও দক্ষ দেশপ্রেমিক সরকার কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া ‘দক্ষিণ প্রতিক্রিয়া ও উগ্র বামকে জনগণের মধ্যে হইতে বিচ্ছিন্ন করা’ এই আওয়াজের ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শিবিরের শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইতে।
৬. বঙ্গবন্ধুর আমলে জনগণের মধ্যে নানারূপ বিভ্রান্তি বিরাজ করিতেছিল। একদলীয় শাসন যে উন্নত ধরনের গণতন্ত্র ইহা জনসাধারণ বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি জনগণকে হতাশ করিয়া তুলিয়াছিল। দেশের ব্যাপক অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়বাদী চেতনা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কূটকৌশল সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশবাসী ভারতের সাহায্য নিয়াছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদের চক্রান্ত প্রতিরোধে যে ভারত ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মৈত্রীর ও সাহায্যের প্রয়োজন আছে তারা তাহারা বুঝিয়া উঠে নাই। গণচেতনার এই দুর্বলতার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদ গ্রহণ করে।
৭. একমাত্র মুজিববাদী নয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকলকেই ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে।
৮. দেশপ্রেমিক শিবিরের রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্বন্ধে মোটামুটি সমঝোতা থাকিলেও কৌশল ও পদ্ধতির প্রশ্নে মতানৈক্য আছে। একটি ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়িয়া তুলিতে না পারিলে শত্রুরা লাভবান হইবে।
৯. ইদানীংকার ঘটনাবলী প্রমাণ করিয়াছে যে (৭ নভেম্বরের পরে) সরকার নিরপেক্ষতার যে নীতি ঘোষণা করিয়াছে ইহা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তাহারা দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা, মাওবাদ ও পাকিস্তানপন্থি শক্তিদের বিনা বাধায় কাজ করিতে দিতেছে, আর বামপন্থি প্রগতিশীল শক্তিকে দমন করিতেছে।
১০. সরকার জাতীয়করণ নীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করিয়া ব্যক্তিগত পুঁজিকে অবাধভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ করিয়া দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির উপরে পুরাপুরি নির্ভর করিবার পথ গ্রহণ করিয়াছে।
১১. রাজনৈতিকভাবে ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠন, সাম্প্রদায়িক নীতির অনুকরণ, সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির নজীরবিহীন প্রসার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম অবনতি যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোককে ভাবিত করিয়া তুলিতেছে।’
ওপরের দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে সিপিবি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিল। বাকশাল-ব্যবস্থাকে এমনকি ‘উন্নত ধরনের গণতন্ত্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। বাস্তবিকই ১৯৭৫ সালে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির এক এলায়েন্স গঠিত হয়েছিল, যা স্বাভাবিক নিয়মে অগ্রসর হলে দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারত। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিষ্ঠুর মৃত্যু সমাজের জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। সমাজ-মনোবিদ আশিস নন্দী যাকে বলেছিলেন ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটি’ সেটি ভিন্নতর মাত্রা পায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে। ‘শাকের আহমেদ’ এই ছদ্মনামে সিপিবির একজন নেতা ‘মহান একুশের আবেদন ও আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ’ প্রবন্ধে ৭৫-পরবর্তী সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ করে যা লিখেছিলেন তাতে করে ক্রমবর্ধমান নিষ্ঠুরতাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতাকে তীব্র আকারে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেখানে লেখক তার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে: আজ একদল বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ নিয়ে বিদ্রূপ করছেন, যেন দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ জন শোষিত নির্যাতিত সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী প্রমুখ মেহনতি মানুষ আর জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ জন শোষক ও নির্যাতকদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন যেন এই দুই অংশের মানুষের একই রকম অধিকারই হলো প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এ কথা কে না বোঝেন যে শোষক আর শোষিত, নির্যাতনকারী আর নির্যাতিত যদি সমান অধিকার ভোগ করে তা হলে দেশ হতে কোনদিনও শোষণ-নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। শোষক ও নিপীড়কদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ করা, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প গ্রহণ করা। গণতন্ত্রকে হত্যা করা তো নয়ই, বরং তাই হলো প্রকৃত গণতন্ত্র, ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠার পথ।
রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম থেকে আরম্ভ করে আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকরা প্রায় প্রতি দিনই ‘আইনের শাসন’ ‘ন্যায়ের শাসন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রব সেরনিয়াবাতের দুবছরের নাতিকে বা বঙ্গবন্ধুর দশ বছরের পুত্রকে যারা গুলি করে হত্যা করল কিংবা ঢাকা জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী দশায় দেশের চারজন বিশিষ্ট নেতাকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করল সেই নরপশুদের কী করা হচ্ছে? তারা শুধু বহাল তবিয়তেই নেই, তাদের নিরাপত্তা ও বিলাস-ব্যসনের জন্য এই সরকার পাহারাদার এবং খোরপোষেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীরা এই সম্পর্কে কোন প্রতিবাদ বা দাবী উত্থাপন করা তো দূরের কথা, তারা এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চুপও নন, বরং তারা নানাভাবে সরকারের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনই করছেন। নিজের অরক্ষিত বাসগৃহে ডাকাতের মত ঢুকে সরল বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, শেখ মুজিবের সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধূদের হত্যা, শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা, রব সেরনিয়াবাতের বাড়ীর অতিথি ও চাকরদের হত্যা, জেলে আবদ্ধ তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখকে হত্যা-এই সকল জঘন্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডকে এরা সমর্থন করেন এবং এতে আনন্দ উল্লাসও প্রকাশ করেন।’ [ক্রমশ]
এ রকমই ছিল বাকশাল গড়ার পটভূমি। এমনটাই আমি ভাবতে চাই। বাকশালের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর মধ্যে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই প্রতিশ্রুতির আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর যেটা ধূসরতম দিক সেটাও ৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনের অব্যাহত নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষিতে আজ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে মনে হয়। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে এমন কিছু প্রগতিশীল সংস্কার এটি আনতে চেয়েছিল, যা পরবর্তী সামরিক-বেসামরিক যে কোনো যুগের অবাধ বাজার অর্থনীতির অন্ধ অনুসরণের মানদণ্ডে আজ নিছক ঘোষণা হিসেবেও বিস্ময়কর ঠেকে বৈকি। বাহাত্তরের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষাকে বাকশালের কর্মসূচি শুধু ধারণই করেনি, একে বাস্তবায়ন করার কনক্রিট প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সামনে সত্যি বলতে গেলে আর কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পন্থা খোলাও ছিল না সেদিন। কী করতে পারতেন তিনি সেদিন? সিপিবি-ন্যাপের বক্তব্য ছিল দেশ বাঁচানোর জন্য একটি ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ গঠন, যেখানে এ দলগুলো আরও বেশি ‘স্বতন্ত্র’ সত্তায় বিচরণ করতে পারবে। মুজিব যে কোনো কারণেই হোক সেই পথে এগোতে চাননি। তিনি একটি নতুন দল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে কথিত জাতীয় ফ্রন্টের সবাই থাকবে। বিষয়টি সেদিক থেকে দেখলে একান্তভাবেই ‘ফর্মের’ বিষয়। দেশের স্বার্থে নিজেকে বা তার হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙচুর করে নতুন ‘ফর্মের’ সন্ধান করতে হয়েছিল তাকে। এ নিয়ে তার বেদনাবোধের পরিচয় পাই ২৫ জানুয়ারির (১৯৭৫) ভাষণের একাধিক মুহূর্তে। দেশের কঠিন অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বাকশালের সম্ভাব্য ভূমিকা একটি কেবল আপৎকালীন প্রয়োজনীয়তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এক গুচ্ছ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদাহরণ : ১. নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন সম্পর্কে বললেন :’সংবিধানের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, স্পিকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করছে, এ কথা যেন কেউ মনে না করে যে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে।’ ২. বিরাজমান রাজনৈতিক অরাজকতা নিয়ে মন্তব্য করলেন :’বিশৃঙ্খল জাতি কোনোদিন বড় হতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ফ্রি স্টাইল। এটা হবে না, ওটা হবে না। আজ যাকে arrest করব, বলবে যে, আমি অমুক পার্টির লোক। একে arrest করব, অমুক পার্টির লোক। ওকে arrest করব, অমুক পার্টির লোক।’ ৩. দেশে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে মুজিব বলেন, ‘বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, … এই সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে Constituent Assemblyর যারা সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেও কয়েক জনকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি, আমরা যা কোনোদিন দেশে শুনি নাই, ঈদের নামাজের জামাতে, এই সংসদের একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কাদের হত্যা করা হয়েছে? হত্যা করা হয়েছে তাদের, যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা।’ ৪. পাক-মার্কিন নীতির অনুসারী দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল এবং পাক-চীন নীতির অনুসারী উগ্র বামপন্থি শক্তির দিকে (এর মধ্যে জাসদকেও আগ বাড়িয়ে রাখতে হবে) ইঙ্গিত করে মুজিব বলেন, ‘কোন রাজনৈতিক দল, যাদেরকে আমরা অধিকার দিয়েছিলাম, একটা কোনোদিন condemn তারা করেছে এদের বিরুদ্ধে? না, তারা condemn করেনি। তারা মুখে বলেছে- অধিকার চাই। তারা মিটিং করেছে, সভা করেছে। পার্টি করতে তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী করেছে তারা? আমরা বলেছি, যা আমাদের সংবিধানে আছে যে, ভোটের মাধ্যমে তোমরা সরকারের পরিবর্তন করতে পার। সে ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম বাই-ইলেকশনের মাধ্যমে। বাই-ইলেকশনসমূহ আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি, জনগণ তাদের ভোট না দিলে আমরা কী করব? তখন তারা বলেছে, এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। মুখে তারা বলেছে- আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করি। তারা অস্ত্র জোগাড় করেছে, সেই অস্ত্র, যে অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছে।…আর, তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ঘরে ঢুকে শৃগাল-কুকুরের মতো মানুষকে হত্যা করেছে।’ ৫. বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন :’বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা hot bed of international clique হয়েছে। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেওয়া হয়, এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হয়।’ ৬. এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক দুর্গতি। এ নিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন বঙ্গবন্ধু :’আজ সত্যি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। কারণ, আমরা কী নিয়ে শুরু করেছিলাম?…আমাদের food কিনতে হয়। আমাদের food deficit কত? আমাদের এখন নানা রকম কাজ। মানুষ দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মারা যায়। আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তার পরে বাংলাদেশে হলো draught। তারপর হলো সারা দুনিয়াজুড়ে inflation।…শুধু আমরা না, সমস্ত দুনিয়ায় যারা অনুন্নত দেশ, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আসল ভয়াবহ বন্যা। এত বড় বন্যা আমার জীবনে আমি দেখেছি কিনা, সন্দেহ। না ছিল খাবার। ৫৭০০ লঙ্গরখানা করা হলো এবং relief operation চালানো হলো।…বাঁচাতে পারলাম না সকলকে।…এখনও মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। গায়ে তাদের কাপড় নাই।’ ৭. এই দুঃখী মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য সাময়িককালের জন্য হলেও কিছু নতুন পরিবর্তন আনতে হয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় :’আমি একদিন তো বলেছি এই হাউসে, স্পিকার সাহেব, যে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের, এবং সেজন্য আজকে আমাদের শাসনের পরিবর্তন করতে হয়েছে।’ ৮. এটা কোনো একনায়কের কথা নয়; দেশবাসীর কাছে আবেদন করছেন তিনি। ব্যাখ্যা করছেন কেন নিজের বিরুদ্ধে তাকে যেতে হচ্ছে :’আমি সকলের কাছে আবেদন করব, আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব। আজ আপনারা constitution সংশোধন করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তো ক্ষমতা কম ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন, আমার দুই-তৃতীয়াংশ majority দরকার। তা আমার আছে। মাত্র ৭ জন ছাড়া সমস্ত সদস্যই আমার। তবু আপনারা amendment করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সিটে আমি আর বসব না- এটা কম দুঃখ না আমার। আপনাদের সঙ্গে এই হাউসের মধ্যে থাকব না- এটা কম দুঃখ নয় আমার।’ ৯. এর পরে এলো ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রসঙ্গ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘প্রথম বিপ্লব’:’তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি সংবিধানকে। কারণ, একটা সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার, অবিচার হতে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন। আজ আমি বলতে চাই, This is our Second Revolution। এই Revolution আমাদের এই Revolution হবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এর অর্থ :অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’ ১০. সবশেষে সবাইকে আহ্বান জানালেন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে :’আমি এই হাউস থেকে, জনাব স্পিকার, আপনার মাধ্যমে দেশবাসীকে, দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলব, যারা দেশকে ভালোবাসেন, চারটি principleকে ভালোবাসেন- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা; এই চারটিকে, তারা আসুন, কাজ করুন। দরজা খোলা আছে। সকলকেই আহ্বান জানাচ্ছি, যারা এই মতে বিশ্বাস করেন।…দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।’ যদি তার এই ডাক শুনে কেউ না-ও আসে, তাহলে একলাই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে এবং স্রোতের বিপরীতে চলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এ জন্যই অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সামনে গুনগুন করে গাইছিলেন এই ভাষণের দুই সপ্তাহ আগে- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে….’। ৬-দফার সময়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র চলাকালীন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের পর্বে, ৭ মার্চের ঘোষণায়, ২৫ মার্চের কালরাতে রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন পর্বে আলটিমেটলি এ রকম সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একাই নিতে হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ তার সঙ্গে ছিলেন সে সময়ে। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ছিল কেবল তার একার। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের পর থেকেই এটা দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনো পথ তার সামনে খোলা ছিল না। আগেই বলেছি, বাকশাল বাস্তবায়ন করার সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অভিপ্রায়টি স্পষ্টই ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন। বাকশালের গঠনতন্ত্রের প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছিল সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার কথা। বাহাত্তরের সংবিধানের চেয়েও আরও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে মানবাধিকার, স্বাধীনতা, শোষণমুক্ত, সুষম বণ্টনের ‘সাম্যভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল সেখানে। এর সাম্প্রতিক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার নয়। ৭ জুন, ১৯৭৫ (শনিবার) বাংলাদেশ গেজেটের সংখ্যায় বিধৃত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’: ‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত একক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ- বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি বিধান, নর-নারী ও ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং মানব-সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের স্বীকৃতি, মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃস্টি, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন, কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতি ও অনগ্রসর জনগণের উপর শোষণ অবসানের জন্য পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও ক্রমিক যান্ত্রিকীকরণ এবং সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন, কৃষি ও শিল্পের প্রসার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণে কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান, মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও অধিকতর কর্মসংস্থান, বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রয়োজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ গণমুখী সার্বজনীন সুলভ গঠনাত্মক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-স্বাস্থ্য রক্ষাসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণের মৌলিক সমস্যাবলির সুসমাধান, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতির সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, বিচার-ব্যবস্থার কালোপযোগী জনকল্যাণকর পরিবর্তন সাধন এবং গণজীবনের সর্বস্তর হইতে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা- এ সকল নীতিসমূহ ও উদ্দেশ্যাবলী সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত উদ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে রূপায়িত করিতে…সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করিবে।’ মিথ্যে ইউটোপিয়ার কথা দেশবাসীকে সেদিন শোনাচ্ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজের একান্ত বিশ্বাসের কথাই বলছিলেন। আবারও বলছি, এটি কোনো তৃতীয় বিশ্বের একনায়কের কথা নয়। বরং সমাজ বদলের লড়াইয়ে যার সামনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন একজন ডেসপারেট মানুষের উপলব্ধি ছিল কথাগুলো : ‘আজকে আমাদের কথা কী? আমাদের শোষণহীন সামাজ গড়তে হবে। এটায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজকে থেকে নয়, আপনি মেম্বার ছিলেন প্রথম দিন থেকে, স্পিকার সাহেব। আপনি জানেন, এই দল এই সংজ্ঞা নিয়ে সংগ্রাম করেছে। কারও কাছে কোনোদিন আপস করে নাই, মাথা নত করে নাই। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি, নতুন পয়সাওয়ালা এদের কাছে আমার আত্মবিক্রয় করতে হবে? এদের অধিকারের নামে এদেরকে আমরা ফ্রি স্টাইলে ছেড়ে দিতে পারি না। কক্ষণও না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয় নাই, দিতে পারে না।’ বাকশাল এই একক জাতীয় রাজনৈতিক দল বা মঞ্চ কি পারত তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে? আয়েন্দে কি সফল হতে পারতেন? অ-ধনবাদী বিকাশের পথে চলতে আগ্রহী এমন অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এ প্রশ্ন আজ তোলা যায়। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাকশাল তার উদ্দেশ্য পূরণে অনেক দূর পর্যন্ত সফল হতো। উদেশ্য পূরণ হলে আবারও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পরিচিত ছকে ফিরে যেতেন তিনি। সামগ্রিক বিষয়গত ও বিষয়ীগত ফ্যাক্টর বিচার করেই এ রকম বলা যায়। প্রথমত, যে সময়ে বাকশালের গঠনতন্ত্র প্রণীত হয় (অর্থাৎ জুন, ১৯৭৫) সে সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শুভ পরিবর্তনের চিহ্ন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ১৯৭৩/৭৪ সালের ওপেক দেশভুক্ত জোটের সিদ্ধান্ত ও তার প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি-তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী যে মূল্যস্ম্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা ক্রমশ কমে আসতে থাকে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। বিদেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে থাকে। খাদ্যশস্যের দাম কমে আসতে থাকে এবং এর জোগানও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ ও ৭৪ পরপর দু’বছরের বিধ্বংসী বন্যা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ পার হয়ে দেশে প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ফলনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এটা ঠিক যে, উচ্চ ফলনশীল ধানের প্রযুক্তি, বিশেষত শুকনো মৌসুমের বোরো ধানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সাফল্য আসে আরেকটু পরে। উফশী ধানের অধিকাংশ জাতই উদ্ভাবিত হয় ১৯৭৫ সালের পরে। যেমন, বি.আর-১ (চান্দিনা) বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালে; বি.আর-২ (মালা) ১৯৭১ সালে; বি.আর-৩ (বিপ্লব) বেরোয় ১৯৭৩ সালে; বি.আর-৪ (ব্রিশাইল) বের হয় ১৯৭৫ সালে; বি.আর-৭ (ব্রি-বালাম) ১৯৭৭ সালে; বি.আর-৮ (আশা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-৯ (সুফলা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-১০ (প্রগতি) ও বি.আর-১১ (মুক্তা) ১৯৮০ সালে। অর্থাৎ ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উফশী ধানের প্রযুক্তিতে নতুন নতুন জাত সংযোজিত হতে থাকে, যার সূচনা কেবল বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পেরেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা চলে, দু-তিন বছরের মধ্যেই দেশের খাদ্য-পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন চলে আসত অবজেকটিভ নিয়মেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুফল দুঃখী মানুষের মধ্যে নিজের হাতে ছড়িয়ে দিতে পারেননি। এদেশের কৃষি গবেষণার ভিত্তি গড়ে ওঠা অবধি শুধু দেখে যেতে পেরেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, শুধু অর্থনৈতিক (বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটজনিত মূল্যস্ম্ফীতি বা দেশের ভেতরে কৃষিপ্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রসার) দিক নয়, সাংগঠনিক দিক থেকেও বাকশাল দু-তিন বছরের মধ্যে একটি সক্ষমতর রাজনৈতিক মঞ্চে রূপান্তরিত হতে পারত। আমার আশাবাদের কারণ, সে সময়ে বাকশালের ভেতরে সিপিবি-ন্যাপ এ দুই প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন থেকে এক ঝাঁক সাংগঠনিক প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে আগ্রহী হয়ে এই সমাবেশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এবং এ রকম আরও ঘটুক, তার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিকে গড়ে ওঠা স্বল্পস্থ্থায়ী আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবির ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’-এর মূল ব্যক্তিত্বরা বাকশালের এক মঞ্চে আবার একত্র হয়েছিলেন দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরের বৃহত্তর রাজনৈতিক তাগিদে। যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই দলীয় পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে এক মঞ্চে জড়ো হতে চাননি ঠিক (এ প্রসঙ্গে অচিরেই আসছি), কিন্তু এই একত্র-সমাবেশের সাংগঠনিক ফলাফল হতে পারত অভূতপূর্ব। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা আন্দোলনের মূল ভরকেন্দ্রগুলো বাকশালে ধারণ করা হয়েছিল। বাকশালের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ‘পরিচালনা কমিটি’ তথা নেতৃত্বে বামপন্থিদের লক্ষণীয় উপস্থিতি ছিল। কৃষক সংগঠন পরিচালনার জন্য ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মণি সিংহ, পীর হাবিবুর রহমান, জীতেন ঘোষ, বজলুর রহমান প্রমুখ। শ্রমিক সংগঠন পরিচালনার জন্য ৩২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মনজুরুল আহসান খান, আবদুস সালাম খান প্রমুখ। মহিলা সংগঠনের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মালেকা বেগম, আয়শা খানম, নূরজাহান বেগম প্রমুখ। যুব সংগঠনের ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন নূরুল ইসলাম, মতিউর রহমান প্রমুখ। ছাত্র সংগঠনের ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ-উল-আলম লেনিন, মাহবুব জামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া বাকশালের ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। মনে রাখতে হবে, শুধু দু’জনের অন্তর্ভুক্তি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা) ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য ‘ক্রিয়াশীল গণপরিষদ’কে মাতিয়ে রেখেছিল। বলা বাহুল্য, এতজন প্রতিভাবান বামপন্ িবুদ্ধিদীপ্ত সাংগঠনিক প্রতিভা বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-মহিলা অঙ্গ সংগঠন পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত হলে সংগঠনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে (ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে) একটি শুভ ও ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা অবাস্তব ছিল না। অধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রসর হওয়া এমন অনেক দেশেই এ রকম এক দল বা এক মঞ্চ গড়ার উদাহরণ ইতোপূর্বে (ও পরে) দেখা গেছে। অর্থাৎ সাংগঠনিক দিক থেকে নিতান্ত ‘হিউম্যান রিসোর্স’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও বাকশালের সাংগঠনিক রূপরেখা ও কর্মপদ্ধতি কালক্রমে যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারত। তৃতীয়ত, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও সংগঠন-প্রক্রিয়া বাকশালের গণভিত্তিকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করতে পারত। মহকুমা প্রশাসনকে জেলা প্রশাসনে রূপান্তর করে জেলা পর্যায়ে ক্ষমতা-কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীভবন ঘটার বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে বিচার-ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীভবনের প্রশ্নর আলোচিত হচ্ছিল। শুধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীভবন নয়, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নিজ নিজ এলাকায় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে ‘বহুমুখী সমবায়’ গড়ে তোলার জন্য। এর বস্তুগত ভিত্তি ছিল গোটা গ্রামের ‘সোশ্যাল মোবিলাইজেশন’। এর মধ্য দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে সমতামুখী সমাজের আদর্শ ও সংগঠন সম্প্রসারিত হওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনাও খুলে যায়। চতুর্থত, ভাবাদর্শগত লড়াইয়ের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল বাকশাল কাঠামোয়। এর গঠনতন্ত্রের ৮ম ধারায় ২য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, দলের সদস্য ‘নিজের রাজনৈতিক এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান ও সচেতনতার মান উন্নয়নে সদা সচেষ্ট থাকিবেন, দলের প্রচারিত পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য পাঠ করিবেন এবং প্রচার করিবেন।’ সেখানেও ‘গঠনমূলক আলোচনা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্য পরিচালনা পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধন’ করার কথাও বলা হয়েছিল। এসব বাক্যে বামপন্থি ভাষাভঙ্গির প্রভাব আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু বাস্তবিকই নতুন দল গড়ে নতুন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্যাডার’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে কথা তিনি ‘৭২ সাল থেকেই অনেক বার বলে এসেছেন। সমাজতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ছাড়া সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যায় না- এ উপলব্ধি তার বহুবার হয়ে থাকবে। পঞ্চমত, বাকশাল কর্মসূচি সফল হওয়ার বড় চাবিকাঠি ছিলেন মুজিব নিজেই। তিনি একাই ছিলেন এ কর্মসূচির রক্ষাকবচ। এটি বাস্তবায়নে তার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতিও ছিল না। পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধাচরণ করলেও তিনি প্রতিকূলতার সামনে নুয়ে পড়ার মানুষ নন। তদুপরি অনেক নেতার মধ্যেই যা দেখা যায়নি অতীতে, তার ছিল প্রচণ্ড কাণ্ডজ্ঞান। এ কথা বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জোরের সঙ্গে বলেছেন। রাজনৈতিক কলাকৌশল, সুবিবেচনাবোধ তার ও তার অগ্রজ প্রজন্মের ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাদের মধ্যে টানটান ছিল। অনেক বামপন্থি নেতার তুলনায় এ ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে ছিলেন। বাকশালের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হচ্ছে ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে। কিন্তু কার্যত এটি ছিল একটি জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম, যার মধ্যে উপদল বা গ্রুপ গড়ার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না থাকলেও এর উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু হিসাবের মধ্যে রেখেছিলেন। হায়দার আকবর খান রনো-রাশেদ খান মেনন এদেরকে দলে আকৃষ্ট করার জন্য বলেওছিলেন সেই সম্ভাবনার কথা- সে কথা কিছু আগে আমি উল্লেখ করেছি (বলশেভিক পার্টিতেও এমন আলাদা প্ল্যাটফর্ম ছিল)। এত তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যায় বামপন্থি ন্যাপ-সিপিবির তরুণ নেতৃত্বকে বাকশালের অঙ্গ সংগঠনে সম্পৃক্ত করলে সেসব প্রতিষ্ঠান আর আগের গতানুগতিক ধারায় চলতে পারবে না- এটিও তিনি হিসাবে নিয়েছিলেন। সাংগঠনিক, আদর্শিক ও মানসিকভাবে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি এ দুই ধারার একত্র-সমাবেশের মধ্য দিয়ে কালক্রমে একটি নতুন ‘রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি’র বিকাশ ঘটবে দলের ভেতরেই- এটা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত ছিল না। এর মধ্য দিয়ে তার নিজেরও সত্তার প্রগতিশীল রূপান্তর ঘটতে পারত; যেমনটা ঘটেছে কিউবার কাস্ত্রো বা যুগোশ্নাভিয়ার টিটোর বেলায়। আমার কল্পনায় এ রকম সম্ভাবনা অপার্থিব বলে মনে হয় না। আগেই বলেছি, বাকশালের গঠনতন্ত্র ও সংগঠন সম্পর্কিত উপরোক্ত বিবরণীটি নিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ জুন। এর প্রায় আড়াই মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বাকশাল গঠনের একান্ত প্রাথমিক ও অস্ম্ফুট পর্যায়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। অস্ম্ফুট বলছি এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাকশালের কোনো causal link নেই। যে জিনিস বাস্তবায়নই হয়নি, সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রশ্ন ওঠে না। বঙ্গবন্ধু বাকশাল না করলেও তাকে হত্যা করা হতো। হত্যা করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল তার হত্যাকারীরা বহুদিন থেকে। এখন যে প্রায়ই বলতে শুনি, সেনাবাহিনীর ‘কিছু বিপথগামী সদস্য’ ঘটনাটি ঘটিয়েছে- সেটি নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। হত্যাকারীরা বিপথগামীপাড়ার মস্তান নয় যে হুট করে এমন কাণ্ড ঘটাবে। এর পেছনে ছিল দক্ষিণপন্থি দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা। এই শক্তির অবয়ব জানা বা অন্তত অনুমান করা কঠিন নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান যারা ঘটিয়েছে, যাদের সমর্থনে বা প্রত্যক্ষ মদদে ঘটিয়েছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ বাহানায়; বাংলাদেশেও তারা সেভাবে ঘটিয়েছে। শুধু আমরা হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতায় অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি। পূর্বাপর বঙ্গবন্ধুর শত্রুর অভাব ছিল না। এই শত্রুদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাকশাল কর্মসূচির আগে ও পরে এরা দেশের ভেতরে-বাইরে সক্রিয় ছিল। নূহের নৌকার মতো সবাইকে ক্ষমাশীল উদারতায় জলে-ডোবা থেকে নৌকায় ওঠানোর উদারতা দেখালেও তার শত্রুদের চরিত্র-বদল হয়নি। বরং কালক্রমে তারা আরও জোটবদ্ধ হয়েছে। পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এক জায়গায় তারা ছিল একমত- যে করেই হোক শেখ মুজিবকে উৎখাত করতে হবে। এ জন্য মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার, গুজব ছড়ানো, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকারে রাজনীতিকদের খুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ কাউন্টার-রিভলিউশনের কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা থেকে শত্রুরা বিরত থাকেনি। অথচ এত ঝুঁকির কথা জেনেও বঙ্গবন্ধু নিজের সিকিউরিটি বিষয়ে ছিলেন একান্তভাবেই উদাসীন। মানুষ যে জন্তু হতে পারে- সেটা তিনি জানতেন। তাই বলে তার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ অস্ত্র উঁচিয়ে ধরতে পারে- এটি তার রাজনৈতিক কল্পনার বাইরে ছিল। যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃৃতির মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন; জেল-জুলুম অতীতে সয়েছেন; জেল থেকে বেরিয়েও এসেছেন; সে রকম মানস-আবহাওয়ায় ১৫ আগস্ট কল্পনাতীত ছিল। [ক্রমশ]