তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়
পর্ব ::৫
[গত সংখ্যার পর]
বলেওছিলাম তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে, এ নিয়ে লিখতে। তিনি আগ্রহের সাথে তার অনন্যসাধারণ উচ্চারণে গাঢ় কণ্ঠে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন তার ‘আপনারা জানেন’ কবিতাটি। এর ফর্ম নিয়ে মৌলিকত্বের দাবি ছিল তার :
আপনারা জানেন
মহামতি প্লেটো কী বলেছেন…
দার্শনিক কান্ট কী বলেছেন…
হেগেল কী বলেছেন…
মহামতি বুদ্ধ কী বলেছেন…
দেকার্তে কিংবা
বেগর্স কী বলেছেন…
বার্ট্রান্ড রাসেল কী বলেছেন…
হোয়াইটহেড কী বলেছেন…
জীবনানন্দ দাশ কী বলেছেন…
বুদ্ধদেব বসু কিংবা বিষ্ণু দে কী বলেছেন…
কী বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ!
কী বলেছেন কবিকুল চূড়ামণি মাইকেল!
আপনারা জানেন
ঈশ্বরের পুত্র যিশু কী বলেছেন…
ইউরিপিডিস কিংবা সফোক্লিস কী বলেছেন…
মিশেল ফুকো কী বলেছেন,
দেরিদ্দা কী বলেছেন
কী বলেছেন পিকাসো
কিংবা পল এলুয়ার!
এই গ্রন্থের মহাপুরুষেরা কে কী বলেছেন
আপনার সবাই জানেন। এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য
নয়, আমি এক নগণ্য মানুষ, আমি
শুধু বলি :জলে পড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন
আমি যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, একদিন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কবিতার আলোচনা করার সময় আমাদের শহীদ কাদরী পড়তে বলেছিলেন। বাংলা কবিতায় আবেগের প্রবল উত্তাপ ও আতিশয্য, এখানে তির্যক ভঙ্গিতে বলার মতো শক্তি, স্যাটায়ার-এর সংহত ক্ষমতা প্রায় দুর্লক্ষ্য। শহীদ কাদরী সেই দুর্লভতমদের একজন। এটাই ছিল স্যারের বক্তব্য। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র তির্যক কবিতাগুলোকে মনে রেখেই তিনি এ কথা বলেছিলেন। তখন আমার মনে হতো যে, বহিরঙ্গে স্যাটায়ার থাকলেও ভেতরে ভেতরে শহীদ কাদরী সময়ের সাথে আরও বেশি নিঃসঙ্গ বেদনাহত সমাজের ক্ষত সারিয়ে তোলা যায় এমন পঙ্ক্তিমালায় সংহতি খুঁজছিলেন। হয়তো জাগরণের পরেই আসে মোহভঙ্গের পর্ব, আমাদের জাতীয় জীবনেও এটা পর্বান্তর ঘটেছিল। যে-বই থেকে নিজের প্রিয় কবিতাটি বেছে সেদিন পড়েছিলেন তার পাতায় কিছু লিখে দিতে অনুরোধ করায় শহীদ কাদরী লিখেছিলেন- ‘এই নশ্বর গ্রহ থেকে একদিন সব স্বাক্ষরই মুছে যাবে- মনে রেখো।’
৪.
আলোচনার বাইরে থেকে গেল আরও অনেক কবি-সাহিত্যিকের রচনা- মহাদেব সাহা, মোহাম্মদ রফিক, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, অরুণাভ সরকার, হায়াৎ মামুদ প্রমুখ। যেমন বাইরে থেকে গেল ষাটের দশকের চলতি সাময়িকীর প্রসঙ্গ। একুশে উপলক্ষে যেসব পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বার হতো তার মধ্যে সমাজ-বদলের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অনেক কবিতা ও গদ্য-রচনা থাকত। সেসব লেখাও পরোক্ষভাবে ষাটের দশকের নব-জাগরণে সাহায্য করেছিল। এই দশকের স্বল্পায়ু কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ‘লিটল ম্যাগাজিন’গুলোর মধ্যে ছিল সাম্প্রতিক, স্বাক্ষর, না, কালবেলা ও বক্তব্য। সংক্ষিপ্ত অথচ সংকেতবাহী নাম-সংবলিত এসব উদ্যোগ এখন পর্যন্ত ইতিহাস-গবেষকদের বা বর্তমানকালের সাহিত্য-পাঠকদের কাছ থেকে যথাযথ মনোযোগ লাভ করেনি। এসব পত্রপত্রিকা থেকে শ্রমে-নিষ্ঠায় সেরা লেখাগুলো বাছাই করে খণ্ডে খণ্ডে এক সময় সংকলন বের হবে- এটা আশা করা অন্যায় নয়। একই রকমের প্রত্যাশা ছিল ‘একতা’ পত্রিকার বিষয়েও। এই পত্রিকার পাতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ও প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে সত্তর ও আশির দশকে, পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগে যার সংকলন হওয়া জরুরি। এসব সংকলনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের নব-জাগরণের ‘প্রগতিবাদী’ ধারার একটি সমৃদ্ধ ছবি ফুটে উঠবে। আগামী দিনে বাম-প্রগতিশীল ধারার বিকাশের জন্যও এটি জরুরি।
ষাটের দশকে এই ভূখণ্ডে একজন ‘কমিটেড’ সমর সেন, দীনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কেউ ছিলেন না। এরা সবাই জীবনের বড় সময়জুড়ে বামধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, এ দেশের গদ্যের ভুবনে একজন শহীদুল্লা কায়সার সৃষ্টিশীল ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জেলে বসে লেখা তার ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসটি ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত হয়। শ্রেণি-সংগ্রাম, অসাম্প্রদায়িকতা, সামন্ততান্ত্রিক প্রথার বিরুদ্ধে নারীর বিদ্রোহ- সব মিলিয়ে সংশপ্তক উপন্যাসটি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক পটভূমি অলক্ষ্যে নির্মাণ করে দেয়। শহীদুল্লা কায়সার সরাসরিভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার ভাই জহির রায়হানও একই আদর্শে প্রাণিত হয়েছিলেন এবং সাহিত্য রচনা করেছিলেন, যদিও তার প্রতিভা পূর্ণতা পেয়েছিল শিল্পকলার সেলুলয়েড মাধ্যমেই। তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শানিত করতে সাহায্য করেছিল চলচ্চিত্রের মতো জনপ্রিয় মাধ্যমে। অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ-চেতনার ধারায় প্রেরণা এসেছিল প্রথাগত বাম-গণতান্ত্রিক ধারার বাইরের অস্তিত্ববাদ থেকেও। আমি এই সূত্রে বিশেষ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনাবলির কথা উল্লেখ করতে চাই। অস্তিত্ববাদের ভেতরের এক বিশেষ ধারা- আলবেয়ার কাম্যুর থিওরি অব অ্যাবসার্ড ওয়ালীউল্লাহকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করেছিল। ওয়ালীউল্লাহর লেখায় গদ্যকে সামনে এগিয়ে দিয়ে পিছু পিছু হাঁটে কবিতা এবং এক মোহাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করে। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র সূচনা-পর্বেই আলবেয়ার কাম্যু ভর করেন এ দেশের নব-জাগরণের নিঃশব্দ উত্থানের ওপরে। ‘যুবক শিক্ষক’ (যার নাম পুরো উপন্যাসে জানা যায় না) বাঁশঝাড়ের মধ্যে রাতের আলো-অন্ধকারে একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায় এবং দৃশ্যটি দেখে সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে :’যুবক শিক্ষক জ্যান্ত মুরগি-মুখে হাল্ক্কা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে। বুনো বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট মহামারী-হাহাকার দেখেছে, কিন্তু কখনও বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই। সে ছুটতেই থাকে।’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চল্লিশের দশকে সিপিআই-এর ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। সংশপ্তকের মার্কসীয় শ্রেণি-সংগ্রামের সাথে চাঁদের অমাবস্যার ফ্রয়েডীয় সাইকো-অ্যানালাইসিস মিলেমিশে গিয়ে পূর্ব বাংলার গদ্য-সাহিত্যের দৃষ্টিশক্তিকে প্রসারিত করে দিয়েছিল। যার ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে নির্মিত হতে পেরেছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ অথবা হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’র মতো উপন্যাস।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বা শহীদুল্লা কায়সার উভয়েরই প্রগতিশীল মার্কসবাদী ভাবাদর্শের নিরিখে মানস-জমিন আগে থেকে তৈরি করা ছিল। তারা যেটা গদ্যে পেরেছিলেন, সেভাবে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে ষাটের কবিতার ভুবনে সমাজ বদলের কাব্য লিখতে খুব বেশি কেউ সক্রিয় ছিলেন না। রণেশ দাশগুপ্ত তার ‘আধুনিক বাংলা কবিতার প্রগতিতে বাংলাদেশের ধারা’ নিবন্ধে হুমায়ুন কবির ও নিয়ামত হোসেনের উল্লেখ করেছেন। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র যুবতীর মৃতদেহের মতোই হুমায়ুন কবির ‘করালী বেহুলা’ কবিতার লখিন্দরের মৃতদেহকে পড়ে থাকতে দেখেন :
‘নিথর চাঁদের রাত হরিদ্রাভ চাঁপার আকাশ
বণিক বণিতা ঘুমে জাগে একা কল্লোলিনী প্রেম
সোনার বরণ তনু ক্ষয়ে যায় বিষের ছোঁয়ায়
তখন হঠাৎ হায়! হায়, প্রাকৃত নারী কতবার হতভাগ্য হবে।!’
ষাটের দশকেই ‘কুসমিত ইস্পাত’-এর কবি হুমায়ুন কবির অনায়াসে বলে ওঠেন :
‘কলার মান্দাসে আজ বেহুলা ভাসে না বুঝি
শরীরী আগুন তার দেহ; করাল রূপালী নারী
আগুনের তরঙ্গে ফোঁপায়, বুঝি ঝড় উঠে আসে।
চম্মক নগরে থাকি বৃদ্ধ চাঁদ বণিক আমরা
বেহুলা বলয়ে শোন- খোঁজ সেই কুটিল নাগিনী
ছিন্নভিন্ন হত্যা করো, দগ্ধ করো, বিষময় দেহ।’
রণেশ দাশগুপ্ত সঙ্গত কারণেই তার নিবন্ধে উপ-শিরোনাম দিয়েছেন- ‘একটি অসমাপ্ত পর্যালোচনা’। এর কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলাদেশের নব-জাগরণে প্রগতিবাদী ধারার সম্যক মূল্যায়ন করতে হলে প্রথমে চাই এর সংকলন। তিনি ১৯৮৯ সালে এ প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন তা এখনও প্রাসঙ্গিক :
‘বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের আধুনিক প্রগতির কবিতার ধারাটাকে বোঝার জন্য চাই সমস্ত কবিতার সমাবেশ বা সমারোহ। চাই অন্ততপক্ষে সংকলন। … বাংলাদেশের কবিদের বই একটি-দুটি করে বেরোতে শুরু করে সাধারণত ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এর আগে এবং পরে প্রথিতযশা কবিদের লেখাও বেরিয়েছে প্রধানত ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায় অথবা সাধারণভাবে অনিয়মিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় কিংবা বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাব্যপত্রে অথবা একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর শহীদ স্মরণিকায়। … বাংলাদেশের কবিতার জগতে রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রাম একটি আবহ গড়ে দিয়েছে, যাতে প্রথিতযশারা এবং উদীয়মানেরা হাতে হাত রাখতে ভ্রূক্ষেপ করেন না।’
রণেশ দাশগুপ্ত এর পর গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছিলেন ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘আধুনিক কবিতা’, সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিষ্ণু দে সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের কবিতা এক স্তবক’ এবং জুলাই ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দুর্গাদাস সরকার ও সনাতন কবিয়াল সম্পাদিত ‘গ্রাম থেকে সংগ্রাম’ সংকলন গ্রন্থের। এই শেষোক্ত সংকলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এ দেশের ‘মহিলা-কবিদের কবিতা-সংগ্রহ’। এর থেকে অবশ্য ষাটের দশকের কবিতার প্রগতিবাদী ধারা সম্পর্কে সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় না, কেবল আমাদের ঔৎসুক্য আরও বেড়ে যায়।
[ক্রমশ]
Original in সমকাল