পর্ব ::১০৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
[নুরুল ইসলামের স্মৃতিচারণ] … এক-অর্থে সেটা ‘স্বীকারোক্তি’র মতো শোনাবে আজ :
“দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে তিনি ইতিমধ্যেই জনগণের উদ্দেশে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনুধাবন করতে আমাদের ব্যর্থতা বা অনাগ্রহ তাঁকে ক্ষুুব্ধ করেছিল। তাঁর মত অনুযায়ী দেশ তখন বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে চরম পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, দেশে সে সময় বিরাজমান গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত পদ্ধতিই একমাত্র কার্যকর পথ। তিনি আমাদের এটা স্পষ্ট করেই বললেন যে দেশের বিদ্যমান সমস্যা এবং এর সমাধান সম্পর্কে আমাদের যথাযথ চিন্তাভাবনা নেই।
১৯৭৫ সালের ৮ জানুয়ারি আমাদের উপরিউক্ত ছুটিতে যাওয়ার আগে আমি তাঁর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেছিলাম। পার্লামেন্টে নতুন সংবিধান (বাকশাল) পাস হওয়ার সামান্য কয়েক দিন আগে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন তাঁকে বেশ বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। আমি কিছু বিদায়ী কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম। তিনি রুমের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানটি তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…।’
তিনি বললেন, বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক বিভক্তি এবং অস্থিরতা থেকে মুক্ত করতে তিনি চূড়ান্ত উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করার কাজটি অন্ধকার ঝোড়ো রাতে ঘন ঘন বজ্রপাতের মধ্য দিয়ে একটি গভীর বন অতিক্রম করার সঙ্গে তুলনীয়। এখানে বিপদ আছে, আছে অনিশ্চয়তা। তবে একই সঙ্গে একটি নতুন সকাল ও সূর্যের আলোয় ভরা নতুন গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছানোর আশাও আছে। এই কঠিন যাত্রাকে বেছে নেওয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন পথ ছিল না।”
এই কঠিন যাত্রা শুরু করাই কঠিন-এর জন্য ঝুঁকি নিতে হয়, সাহস লাগে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। অনেক সময় অনেক দূর গিয়ে দেখা যায় রাস্তাটা বন্ধ-আর এগুলো যাচ্ছে না। তখন পিছু হঠতে হয়। যারা বিপ্লবী তারা অগ্রযাত্রার অগ্রগতিতেও বিমোহিত হন না, আবার সাময়িক পরাজয়েও ভেঙে পড়েন না। তবে বাকশালের মৌলিক অর্থনৈতিক দিকগুলো যে শুধু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল তা নয়। ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ কথাটি ১৯৭২ সালেই বলা হয়েছিল; একইভাবে ‘মাল্টিপারপাস সমবায়ের’ কথা ওই বছরেই একাধিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছিলেন। এখন আমরা সেদিকটির প্রতি নজর দেব।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি আট-দশটা দেশের মতো সাধারণ গণতন্ত্রের পথ ধরে হাঁটতে চান না। স্বাধীনতার সেই প্রথম লগ্নেই তিনি বলেছিলেন যে, গতানুগতিক ধারায় বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বদলানো যাবে না:
‘আমার সরকার আভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী, পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচির শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।’
সে সময়ে বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণের পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা হলেও তার চিন্তায় তখনই নতুন পথে যাত্রার অভিপ্রায় সুস্পষ্ট। ‘পুরাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলা’; ‘সম্পদের সামাজিকীকরণ’; সমতামুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সমাজতান্ত্রিক’ অর্থনৈতিক দর্শন; ‘শোষণ ও অবিচারমুক্ত সমাজ’ গড়ার আকাঙ্ক্ষা; সামাজিকীকরণের বিষয়টিকে ‘পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি’ হিসেবে দেখার চেষ্টা; এবং এক্ষেত্রে ‘অবাস্তব তাত্ত্বিকতা’ পরিহার করে বাস্তবানুগ হওয়ার তাগিদ। বঙ্গবন্ধুর চিন্তার এই মৌলিক উপাদানগুলো তখনই জন্ম নিচ্ছিল, যা কালক্রমে আরও পরিণতি লাভ করে। বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে তার ছাপ সুস্পষ্ট।
কো-অপারেটিভ করার কথা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই স্পষ্ট করে বলেছিলেণ-বাকশালের পূর্বসূরী ছিল তার এই চিন্তা। ওই বছরের ৫ এপ্রিলের বক্তৃতায় তিনি বলেন:’কিন্তু একটা কথা, এই দেশ নতুনভাবে সাজাতে হবে। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল কইরেন না। আপনাদের জমি আমি নেব না। ভয় পাইয়েন না, জমি নিয়ে যাব তা নয়। বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটা করে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে। এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার আওতায় থাকবে বেকার প্রত্যেকটি মানুষ। যে মানুষ কাজ করতে পারে। তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে এবং বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। আলটিমেটলি প্রত্যেকটি ভিলেজে একটা করে কো-অপারেটিভ করা হবে। তাদের কাছে পয়সা যাবে। কাছে বেতন যাবে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল…। তা না হলে দেশ এগুনো যাবে না। এজন্যই ভিলেজে কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে, পাঁচ বৎসর মেয়াদি প্রত্যেকটি গ্রামে কয়েক হাজার থেকে পাঁচশ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত কম্পলসারি কমিউনিটি হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নিবেন। একটি অংশ যাবে কো-অপারেটিভে, ঐ অংশ গভর্নমেন্টের হবে। দ্বিতীয় অংশ থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে।’
উদ্ধৃত অংশ থেকে পুরো অর্থটি স্পষ্ট হয় না। তবে এর থেকে মূল ধারণাটি অনেকখানি আঁচ করা যায়। উৎপাদনমুখী সমবায় করা হবে, জমির মালিক তার জমির পরিমাণ অনুযায়ী ফসল পাবেন, একটি অংশ যাবে কো-অপারেটিভের তহবিলে, অপর একটি অংশ যাবে থানাভিত্তিক কাউন্সিলে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু গোড়া থেকেই সমবায়ীকরণের সঙ্গে বিকেন্দ্রীভূত শাসন-ব্যবস্থার একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে এই যোগসূত্রকে আরও যুক্তিসিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমবায়ের ধারণা বঙ্গবন্ধুর মনে স্বাধীনতার পূর্বাপর সময় থেকে একটি মৌলিক অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে বিরাজ করছিল। ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশে রেডিও-টিভি ভাষণে মুজিব প্রথমবারের মতো ‘বহুমুখী সমবায়ের’ কথা উল্লেখ করেন। উদ্ধৃতিটি তার চিন্তারাশিকে সংক্ষেপে তুলে ধরে:
‘একটি স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষি পর্যায়ে অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জায়গিরদারী, জমিদারী, সরকারী প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত করে অবশ্যই নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষীদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকার এজন্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’
দেখা যাচ্ছে, ‘বহুমুখী সমবায়’ গঠনের বিষয়টিকে গোড়া থেকেই বঙ্গবন্ধু কৃষির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি, উৎপাদনের অপেক্ষাকৃত সুষম বণ্টন, সামন্তবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বিলোপ, ভূমিহীনদের জীবন-মান উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করে ভেবেছিলেন। সমবায়ের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করা এবং সুষম বণ্টন অর্জন- এই দুই লক্ষ্যকেই তিনি করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তার এই চিন্তা আরও বিকশিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চের ভাষণে, বঙ্গবন্ধু তার ‘সমবায়-চিন্তা’ ও ‘বিকেন্দ্রীকরণের’ চিন্তাকে এভাবে প্রকাশ করলেন:’এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই-যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে কিন্তু একটা কথা, এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না, ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাবো। তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যান-এই বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার অংশ- যে বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে কো-অপারেটিভ-এর সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কার্স প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেওয়া হবে, তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে। আপনাদের জমির ফসল আপনি নেবেন। অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে। দ্বিতীয়, থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারী যেই হয়-একজন তার চেয়ারম্যান হবেন। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারী। তার মধ্যে আমাদের কৃষক, শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুবক প্রতিনিধি থাকবে, কৃষক প্রতিনিধি থাকবে-তারাই থানাকে চালাবে। আর মহকুমা থাকবে না, সমস্ত মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমার একটি করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল থাকবে। সব কর্মচারী এক সাথে তার মধ্যে থাকবে। এরমধ্যে পিপলস রিপ্রেজেন্টেশন হবে, তার চেয়ারম্যান থাকবে। সেখানে তারা সরকার চালাবেন-এইভাবে আমি একটি সিস্টেমের চিন্তা করছি এবং করবো বলে ইনশাআল্লাহ আমি ঠিক করেছি। আপনাদের সাহায্য ও সহানুভূতি চাই।’
বাকশালের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশকে সংকটের খাদ থেকে স্বাভাবিক অগ্রযাত্রার পথে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি বিশেষভাবে জোর দেন দুটি উপাদানের ওপরে। গ্রামজীবনের বিকাশের ক্ষেত্রে যৌথ-চাষাবাদের ওপরে গুরুত্ব আরোপ এবং বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন। জমির মালিকানা-সম্পর্কে হাত না দিয়েই তিনি যৌথ-আবাদের মডেলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন প্রশাসনের ও বিচার-ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। তিনি মনে করতেন যে, দুর্ভিক্ষ-উত্তর পরিস্থিতিতে গ্রামবাংলাকে বাঁচানোর ও ধরে তুলে দাঁড়ানোর জন্যে এটাই একমাত্র উপায়। সেরকম ‘আর্জেন্সি’ নিয়েই তিনি বলেছিলেন:
“আমার যুবক ভাইরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে এর উপর বাংলার মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পায়জামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার জন্য কাজ করে যেতে হবে। যুবক চাই, ছাত্র চাই, সকলকে চাই।
আর একটা কথা বলতে চাই, বিচার। বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার। আল্লাহর মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে সেই মামলা শেষ হতে লাগে প্রায় ২০ বছর। আমি যদি উকিল হই, আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে কেস নিয়ে যাই। ঐ মামলার ফয়সালা হয় না। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়-তিন বা চার বছরের আগে শেষ হয় না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে এমন করতে হবে, যে থানায় ট্রাইব্যুনাল করার চেষ্টা করছি সেখানে মানুষ এক বছর বা দেড় বছরের মধ্যে বিচার পাবে-তার বন্দোবস্ত করছি। আশা করি সেটা হবে।
তাই আমি একথা জানতে চাই আপনাদের কাছে, জানতে চাই একটি কথা। এই যে চারটি প্রোগ্রাম দিলাম, এই যে আমি কো-অপারেটিভ করবো, থানা কাউন্সিল করবো, সাবডিভিশনাল কাউন্সিল হবে, আর আমি যে আপনাদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ফসল চেয়েছি, জমিতে যে ফসল হয় তার ডবল। কল-কারখানায় কাজ-সরকারি কর্মচারী ভাইরা একটু ইনডিসিপ্লিনে এসে গেছে। অফিসে যান, কাজ করেন। আপনাদের কষ্ট আছে, আমি জানি। দুঃখী মানুষ আপনারা। আপনারা কাজ করেন। যাদের পেটে খাবার নাই, তাদের উপর ট্যাক্স বসিয়ে আমি আপনাদের পোষতে পারবো না। প্রোডাকশন বাড়লে আপনাদেরও এদের সাথে উন্নতি হবে।”
আজকাল কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর সমবায়-চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। এই সমবায়-চিন্তা ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি-খামার বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কিনা সে প্রশ্ন তাদের মনে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে তিনটি দিক আমাদের বিচার করতে হবে। প্রথমত, কৃষিতে বা গ্রাম-জীবনে যৌথতার চর্চা বা সমবায়ের চর্চা ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই বাংলায় একটি প্রতিষ্ঠিত ঘরানা। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তার ‘সমবায়’ গ্রন্থে বহুবার তার যুক্তি পেশ করেছেন। প্রমথ চৌধুরী থেকে শুরু করে স্যার আজিজুল হক সকলেই বাংলার রায়ত-কৃষকের দুর্দশার কথা আলোচনা করে কোনো-না-কোন প্রকারের সমবায়-ব্যবস্থার বা যৌথ অঙ্গীকারের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ-বেকারত্ব সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। এ কারণেই সমবায়ের ধারণাকে বঙ্গবন্ধু বা তার সমসাময়িক নেতৃত্বের কাছে অপ্রত্যাশিত কোনো ‘বিদেশী’ (ইমপোর্টেড) ধারণা বলে মনে হয়নি। দ্বিতীয়ত, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বা পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সালে চীনের বিপ্লব সমবায়ের ধারণাটিকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বের কাছে। বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে চীন, ভিয়েতনাম ও পূর্ব ইউরোপের অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তৃতীয়ত, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের প্রায় সকল অর্থনীতিবিদই যৌথ চাষপ্রথা প্রবর্তনের ব্যাপারে প্রায় নিঃসংশয় ছিলেন। অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা ইতোপূর্বে করে গেছেন। আমি তার লেখার সূত্র ধরে তিনটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরছি।
প্রথমেই আসে বিশ্বব্যাংকে কর্মরত ফাল্যান্ড ও পারকিনসন দুই খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদের কথা। “বাংলাদেশ-এ টেস্ট কেইস অফ ডেভেলপমেন্ট” বইতে তারা শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারে পৌঁছান:
“সুতরাং প্রতীয়মান হয়, যদি আয় বিতরণ এবং নিয়োজনের সুযোগের সমস্যার সমাধান করতে হবে, তাহলে যৌথ চাষ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। …এ ধরনের স্পষ্টতই সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত নাও হতে পারে। কিন্তু এই উপসংহার কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে নিঃসৃত নয়; এই উপসংহারে উপনীত হতে হয় কেননা জমি-স্বল্পতার পরিস্থিতিতে ভূমিহীনদের জীবিকা নিশ্চিত করার জন্য কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া দুরূহ।”
এর পরে আসে অধ্যাপক নূরুল ইসলামের কথা, যিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি গোড়াতে অর্থনীতিবিদ মো. আনিসুর রহমানের মতো অতটা ‘সমবায়পন্থি’ ছিলেন না। কিন্তু আলোচনার এক পর্যায়ে তিনিও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ‘যতোই জনসংখ্যা এবং তার সঙ্গে ভূমিহীন মজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং ক্ষুদ্রাকার জোতসমূহ আরও বিভক্ত হতে থাকবে, ততোই কোনো-না-কোনো ধরনের যৌথ ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য চাপ ও যুক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা, কেননা, এরূপ ব্যবস্থাপনা দৃশ্যমান বেকারত্বকে অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছানো থেকে রক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির এরূপ ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে জমির কোনো-না-কোনো ধরনের যৌথ মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা আয় ও শ্রম নিয়োজন ভাগাভাগি করে নেওয়ার একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে কাজ করতে পারে”।
গ্রামের ‘উদ্বৃত্ত শ্রমকে’ কীভাবে উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করা যায় এটাই ছিল তাদের প্রাথমিক দুর্ভাবনা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষক আবু আবদুল্লাহ মনে করেছিলেন যে,
“ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে জমির পুনর্বিতরণ বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাবলীর সমাধান দিতে পারবে না; বরং কতক ক্ষেত্রে তা এসব সমস্যাকে আরও সংগীন করে তুলতে পারে। সুতরাং, আমাদের কৃষি সমস্যার সমাধান কোনো-না-কোনো ধরনের যৌথতামূলক ব্যবস্থার মধ্যেই খুঁজতে হবে।”
আমি বলতে চাইছি যে, বাকশালে বিধৃত বহুমুখী কো-অপারেটিভ বা সঞ্চয়ের মৌলিক চিন্তাটির পেছনে নানা সূত্র থেকেই যুক্তি-সমর্থন এসেছিল। এটা ঠিক যে সেকালের বাংলাদেশে শহরের মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ গ্রামের সনাতনি কৃষি-ব্যবস্থার সরাসরি সুবিধাভোগী ছিলেন এবং প্রস্তাবিত সমবায় ব্যবস্থায় তাদের স্বার্থহানি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাছাড়া, গ্রামীণ এলিট-শ্রেণি সমবায়-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ রোধে শহরের মধ্যবিত্তকে পূর্বাপর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। নগরের ‘মধ্যবিত্ত’ ও গ্রামের ‘এলিট’ এদের যৌথ-প্রভাবকে প্রতিহত করে নতুন ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কাছে তখন তিনটি পথ খোলা ছিল- (ক) ক্রমশ নৈরাজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করা, যেটা তার ও তার প্রজন্মের নেতৃত্বের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না; (খ) ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগের ধরন মেনে মার্কিন-চীন-পাকিস্তান এই অক্ষ-শক্তির কাছে নতিস্বীকার করা এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা, যেটা বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা কখনোই মেনে নিতে পারতেন না; (গ) নৈরাজ্য ও প্রতিক্রিয়ার মুখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা, যেটা বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সফল হলে দেশ আবার সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসত, আর বিফল হলে অনিবার্য ছিল চিলির কায়দায় নিষ্ঠুর ও দীর্ঘ সামরিক শাসন। বাস্তবেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে সুদীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেশে নিষ্ঠুর সামরিক শাসন চলেছিল।
[ক্রমশ]