[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৬] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৬

পূর্ব প্রকাশের পর

এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছিল হাজারের এককে। তারপর মৃত্যু এত বেড়ে গেল- এই পরিসংখ্যানের প্রকাশ এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেল। তবু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের টনক নড়েনি। বাংলার কৃষককে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করাই তার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। ‘চার্চিল’স সিক্রেট ওয়ার’ গ্রন্থে সে কথা মধুশ্রী মুখার্জি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। বাংলার কৃষককূল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তার নীতির কারণে- এ কথা শোনার পর চার্চিল বলেছিলেন, ‘গান্ধী কি বেঁচে আছে এখনও? সে মারা যায় না কেন?’

তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের শিকার তিরিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পেছনে চার্চিলের পরোক্ষ ভূমিকায় অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়বে। অনেকেই ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের’ সীমা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়বেন। এদের কারো কারো কাছে চার্চিল অবাধ পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের মানসপুত্রের মত। তার সুস্বাদু ইতিহাস রচনা (যার জন্য সাহিত্যে নোবেলও পেয়েছিলেন তিনি) অস্বীকার করার নয়। যেমন নয় যুদ্ধকালীন সময়ে ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অনুপ্রাণিত ভাষণ ও নেতৃত্ব। যুদ্ধ জয়ের পর রক্ষণশীল সরকারের পতন হল এবং তিনি আর প্রধানমন্ত্রী রইলেন না। এতেও দুঃখ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার নয় যে, চার্চিলের মত ‘লিবারেল’ রাজনীতিকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অমানবিক নীতি প্রয়োগের ধারাবাহিকতা। ইংলন্ডকে বাঁচানোর জন্য তিনি ভারতবর্ষ বা অন্যান্য উপনিবেশকে দুর্ভিক্ষের গ্রাসে ফেলে দিতে দ্বিধা করেননি। যখন তিনি যুদ্ধোত্তরকালে একনাগাড়ে ছবি এঁকেছেন (এ কাজে দক্ষতা ছিল তার); একবারও আঁকেননি জয়নুলের মত কোন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবি। সেসব নিরন্ন মানুষের চিৎকার তার স্বপ্নের মধ্যে কখনো শোনা যেত কি-না এ বিবরণ জানা যায় না। ইউরোপের জন্য এক নিয়ম, আর উপনিবেশের মানুষদের বিচার করার ক্ষেত্রে অন্য নিরম- পার্থ চ্যাটার্জী যাকে বলেছেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’- তা চার্চিলের দুর্ভিক্ষ-সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড বিশ্নেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক হিসেবে, এটিকেও ‘সত্তার বিভক্তি’ বলা যায়, যা ইতিপূর্বে আরেক জন ‘লিবারেল’ চিন্তক জন স্টুয়ার্ট মিলের আলোচনায় আমরা দেখেছি।

মধুশ্রী মুখার্জীর কাজকে অস্বীকার করা উপায় নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন নোবেল পদার্থ বিজ্ঞানী ইউইসিরো নাম্বুর অধীনে। পরে ক্যালটেক থেকে পোস্ট-ডক্টরেট করে বিখ্যাত ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ সাময়িকীর অন্যতম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বিজ্ঞান-বিষয়ক সাংবাদিকতা ও বই লেখাই তার প্রধান অভিনিবেশ। প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদ নন ঠিকই, তাই বলে তিনি দুর্ভিক্ষের অঙ্ক কষতে জানেন না, একথা বলা যাবে না। ২০০২ সালে ব্রিটেনবাসীদের মধ্যে বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত জরিপে চার্চিল হয়েছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ ইংরেজ’। এহেন ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে গেলে সাহস ও দম উভয়ই থাকা চাই। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ভারত থেকে যখন প্রস্তাব গেল যে, বাংলাকে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করার জন্য মাসে অন্তত ৮০,০০০ টন খাদ্যশস্য জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করা চাই; চার্চিল সেই অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছিলেন। এই তথ্য প্রাথমিক উপাত্ত ঘেঁটে মধুশ্রী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন তার বইয়ে। চার্চিলের এই সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন না ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তারাও। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো যেমন মনে করেছিলেন যে, ‘খাদ্যশস্য আমদানি হতে যাচ্ছে বাংলায়’- শুধুমাত্র এই খবরটি ছড়িয়ে দিলেও ‘মজুতদারির প্রবণতা কমে যেত ও চালের দাম নেমে আসত।’ অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা খাদ্যশস্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল পণ্যবাহী জাহাজের স্বল্পতা নিয়ে। কেননা, জাহাজগুলোকে তখন ব্রিটিশ উপকূলের আশে-পাশে জড়ো করে রাখা হয়েছিল। মধুশ্রী বলেছেন যে, জাহাজের স্বল্পতার ‘টেকনিক্যাল আর্গুমেন্ট’ অনেকটাই কষ্ট কল্পিত। কেননা, ততদিনে মার্কিন প্রশাসন সাহায্য হিসেবে অনেক মালবাহী জাহাজ ব্রিটেনের কাছে স্থানান্তর করেছিল। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার খবরে এমনকি ইংরেজের শত্রুপক্ষে যুদ্ধরত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি পর্যন্ত অধিকৃত বার্মা থেকে কিছু চাল বাংলাতে পাঠাতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সেন্সরশিপ সে তথ্যও পুরোপুরি চেপে যায়।

এবার আসি মূল্যস্ম্ফীতির প্রসঙ্গে। শুধু যে খাদ্য-সরবরাহে অপ্রতুলতার কারণে প্রতি মাসে মূল্যস্ম্ফীতির হার বাড়ছিল, তাই নয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সচেতনভাবে গৃহীত ম্যাক্রো-ইকোনমিক পদক্ষেপও। ২০১৮ সালের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির ২০ অক্টোবর সংখ্যায় প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ ও জওহরলাল বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক ঊষা পাটনায়েক অভিযোগ করেছেন যে, বাংলার দুর্ভিক্ষ এমনিতেই হয়নি। বাংলায় দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থায়নের যোগাড়-যন্ত্র করা হয়েছিল। মানুষের ভোগের পরিমাণ কমিয়ে যুদ্ধের রসদ যোগানোর জন্য বিনিয়োগের তহবিল বাড়ানো হয়েছিল। এই ম্যাক্রো-ইকোনমিক যুক্তিটি এসেছিল অগ্রগণ্য অর্থনীতিবিদ কেইনসের লেখা থেকে। ‘ট্রিটিস অন মানি :দ্য এপ্লাইড থিওরি অব মানি’ (১৯৩০) এবং ‘হাউ টু পে ফর দ্য ওয়ার :এ রাডিকেল প্ল্যান ফর দ্য চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকার’ (১৯৪০); এই দুটি লেখায় কেইনস এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কীভাবে জনগণের আয় (ভোগ) কমিয়ে তা থেকে উদ্বৃত্ত আহরণ করা যায় যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থায়নের জন্য, সেটা কেইনসের আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্রিটেনবাসীর ক্ষেত্রে এই মহৌষধির প্রয়োগ না করে তা ব্যবহার করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সাধারণ অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। বাংলার গ্রামাঞ্চলের নিরীহ জনগণের ভোগ কমিয়ে তাদেরকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ তুলে নিয়েছিল চার্চিলের ইংরেজ সরকার। মধুশ্রী মুখার্জীর বইটি ও ঊষা পাটনায়েকের লেখাটিকে আমরা এই অর্থে সম্পূরক রচনা হিসেবে পাঠ করতে পারি।

মুখার্জী ও পাটনায়েকের লেখার মুখ্য প্রতিপাদ্যের সাথে অমর্ত্য সেন অপরিচিত নন। তার ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ বইয়ে পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি সাতটি কারণের কথা বলেছেন। তার মধ্যে একটি কারণ ছিল চার্চিলের নিস্পৃহতাও। যেমন, তিনি বলছেন, ‘The refusal of the British Government to permit move food imports into India throngh reallocation of shipping as an emergency measure to tackle the famine was severely criticized. Lord wavell, who became the new Viceroy at the last stage of the famine and who had to battle hard for increasing food imports into India, went on record in this context that he felt that ‘the vital problems of India are being treated by his Majesty’s Government with neglect, even sometimes with hostility and contempt’- এই শেষোক্ত উদ্ৃব্দতিটির উৎস হচ্ছে লর্ড ওয়াভেলের চিঠি, ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবরে লেখা উইনস্টন চার্চিলকে উদ্দেশ করে। অন্যদিকে, ঊষা পাটনায়েকের যুক্তি- ‘ইচ্ছে করে মূল্যস্ম্ফীতি ঘটানো হয়েছিল যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহের জন্য’- সেটিও পরোক্ষভাবে অমর্ত্য সেনের চোখে পড়েছিল। তিনি লিখছেন ::’The 1943 famine can indeed be described as a ‘boom famine’ related to powerful inflationary pressures initiated by public expenditure expansion’. তবে সব কার্যকারণের মধ্যে সেনের প্রধান গুরুত্ব এসে পড়েছিল ‘বীপযধহমব বহঃরঃষবসবহঃ’র দ্রুত অবনতির ওপরে- সামগ্রিকভাবে খাদ্যের যোগানের সাংবৎসরিক বাড়া-কমার ওপরে নয়। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রাম-বাংলা, বিশেষত মজুরি-শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল কৃষি শ্রমিক ও অসচ্ছল প্রান্তিক জোতের পরিবারেরা। এখানে সেনের মূল তর্কটা দুর্ভিক্ষের Causality বা বা মূল কার্যকারণসূত্র নিয়ে যখন দুর্ভিক্ষবিরোধী ‘পলিসির’ প্রসঙ্গ এসেছে তখন তিনিও খাদ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি, ফুড রেশনিং ব্যবস্থা, পাবলিক ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, খাদ্যশস্যের মূল্য-পরিস্থিতিকে সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আনা ইত্যাদি ‘সাপ্লাই-সাইড’ কর্মসূচির ওপরে জোর দিয়েছেন তার বইতে যথাযথভাবেই। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে শুধু সরকারি প্রশাসক, ইতিহাসবিদ, পরিসংখ্যানবিদ বা অর্থনীতিবিদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট নয়। সমসাময়িক সাহিত্য-কর্মের মধ্য দিয়ে এই দুর্ভিক্ষের চালচিত্র বিশ্বস্ততার সাথে ফুটে উঠেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ মন্ব্বন্তরের প্রাক-কথন থেকে এর ট্র্যাজিক পরিণতি অবধি পাত্র-পাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করেছিল। জাপানি আক্রমণের মুখে ১৯৪২ সালের মে মাসে ইংরেজরা বার্মা থেকে যখন পিছু হটল, তখন বার্মা থেকে চাল আমদানিও আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এ নিয়ে দুর্গাপণ্ডিত আর গঙ্গাচরণের মধ্যে কথা হচ্ছে :

“- জাপানিরা সিঙ্গাপুর নিয়ে নিয়েছে? যুদ্ধের খবর কী?

– শুধু সিঙ্গাপুর কেন, ব্রহ্মদেশও নিয়ে নিয়েচে। জানো না সে খবর?

– না-ইয়ে-শুনি নি তো? ব্রহ্মদেশ? সে তো-

– যেখান থেকে রেঙ্গুন চাল আসে রে ভায়া। ওই যে সস্তা, মোটা মোটা আলো চাল …”

যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের জন্য খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে চাল কেনার ধারা তো পূর্বাপর ছিলই, জাপানি আক্রমণের মুখে এই কেনার গতিবেগ আরো বেড়ে গেল। কোনভাবেই যেন জাপানিদের কাছে চালের বাজার না চলে যায় সে জন্যে ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরকে চাল কেনার অনুমতি দেয়। চাল বিক্রি করতে না চাইলে জবরদস্তিও হচ্ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির যুক্তি দেখিয়ে। এর ফলে কিছুটা অবস্থাপন্ন মানুষ যারা টাকা দিয়ে চাল কেনার সামর্থ্য রাখে, তারাও হাটে-দোকানে গিয়ে চাল পায়নি। যারা আরো অবস্থাপন্ন তাদর কাছে চাল থাকলেও চালের দাম আরো বাড়তে পারে- এই আশঙ্কায় তারাও চালের সংগ্রহ লুকিয়ে ফেলেছিল। এতে করে গঙ্গাচরণের মত ক্রয়-নির্ভর পরিবারদের অনাহারে-উপবাসের ঝুঁকিতে দিন কাটাতে হয়েছিল। বিভূতিভূষণ লিখছেন একের পর এক ঘনায়মান দুর্যোগের দৃশ্য :

১. ‘অনঙ্গ-বৌ বললে- আর দুটো ভাত মেখে নাও, ডাল দিয়ে পেট ভরে খাও-
-এ চাল দুটো ছিল বুঝি আগের দরুণ?
-হুঁ।
-কাল হবে?
-কাল হবে না। সকালে উঠেই চাল যোগাড় করো। রাতটা টেনেটুনে হয়ে গেল।
-সেই বিশ্বাস মশায়ের দরুণ ধানের চাল?
-হুঁ।

অনঙ্গ-বৌ স্বামী-পুত্রকে পেট ভরে খাইয়ে সে-রাতে এক ঘটি জল আর একটু গুড় খেয়ে উপোস করে রইলো।’

২. [পরের দিন গঙ্গাচরণ গেছে চালের খোঁজে। এক জায়গায় দেখল চাল বিক্রি হচ্ছে। একটু ক্ষণ আগেই গঙ্গাচরণ এক জেলে নবীন পাড়ূইকে বলেছে, ‘কখনো কি কেউ শুনেচে যে চালের মণ ষোল টাকা হবে।’ অথচ, আশ্চর্যের বিষয়, এরই মধ্যে চালের দাম বেড়ে ‘কুড়ি টাকা মণ’ হয়ে গেছে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৫] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৫

পূর্ব প্রকাশের পর

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের প্রসঙ্গ যেভাবে সমসাময়িক কথা-সাহিত্যে প্রায়-অনুপস্থিত, ১৮৬০-১৯০০ সাল অবধি বাংলার চরম খাদ্যাভাব, মৌসুমী ক্ষুধা ও সময় সময় প্রায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি নিয়ে অনুরূপ নীরবতা দৃশ্যমান। সমসাময়িক পত্র-সাহিত্যেও ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তিরিশ পেরুনো রবীন্দ্রনাথ যখন অবিস্মরণীয় ‘ছিন্নপত্র’ লিখছেন তার মধ্যে বাংলার মায়াময় প্রকৃতির ছবি ফুটে ওঠে, ক্ষুধা ও অনাহারের বিস্তৃতি কোথাও দেখি না। কিন্তু সম-সাময়িক পত্রিকা-সাময়িকী- বিশেষত স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশিত বাংলার নানা পত্র-পত্রিকা- নিজেদের সাধ্যমত দুর্ভিক্ষের আশংকার কথা জোরে-সোরে তুলে ধরেছে। তাতে প্রেরণা এসেছে নানা সূত্র থেকে। ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ উপন্যাসটির উদাহরণ এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। ১৮৫২ সালে প্রকাশিত দাস-প্রথা বিরোধী এই উপন্যাসটি পঞ্চাশের দশকের প্রাগ্রসর বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল। দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট-র বরাত দিয়ে নরহরি কবিরাজ জানাচ্ছেন যে, এরা মনে করতেন আমেরিকার দাসদের মতই মানবেতর জীবনের পর্যায়ে নেমে গেছে বাংলার চাষীদের জীবন। এরা তাই ঠিক করলেন যে, ‘বাংলার রায়তদের সামাজিক অবস্থা’ নিয়ে রচনা-প্রতিযোগিতার আয়োজন করবেন। এতে যিনি সেরা রচনাটি লিখবেন তিনি পাবেন পাঁচশত টাকা পুরস্কার। এর বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন সেকালের উদারনৈতিক তিন ব্যক্তিত্ব : ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিশোরী চাঁদ মিত্র এবং রেভারেন্ড জেমস লং’। ১৮৫৫ সালে প্যাট্রিয়ট আরো আশা করেছিল যে, রায়তদের অবস্থা নিয়ে ‘যদি কোন উপন্যাস অদূর ভবিষ্যতে লিখিত হয়, সে লেখার মান ডিকেন্স অবধি না গড়ালেও’ তা একটি বড় কাজ হবে এবং এর মধ্য দিয়ে জমিদারী ব্যবস্থার সাথে চলতে থাকা ‘নানা জঘন্য কাজ জনসাধারণ্যে পৌঁছাবে।’ নীলদর্পণ বা জমিদার-দর্পণ-এর মধ্য দিয়ে প্যাট্রিয়ট-এর সেই আশা সেভাবে পূর্ণ হয়নি।

১৮৭০ দশকের উপোসি বাংলার দুঃখ-দুর্দশা ১৮৮০-৯০ দশক জুড়েই অব্যাহত ছিল। ১৮৯২ সালের ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ গ্রন্থে ভূদেব মুখোপাধ্যায় পরিসংখ্যান-সারণী ব্যবহার করে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। পারিবারিক ও ধর্মীয় বিষয়ে ভূদের যতটাই প্রাচীনপন্থী ছিলেন, অর্থনৈতিক বিষয়ে তিনি ছিলেন ততটাই আধুনিক-পন্থী। যারা তার ‘আর্থিক অবস্থা বিষয়ক’ ভবিষ্যবিচার পড়বেন, তারাই বিস্মিত হবেন তার অর্থনৈতিক চিন্তার প্রাজ্ঞতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় পেয়ে। ভূদেবের চিন্তার এই দিকটি পৃথক অভিনিবেশের দাবী রাখে। আপাতত, এটা দেখানো জরুরী যে, ১৮৯০ দশকের পটভূমিতে- অর্থাৎ উনিশ শতক যখন শেষ হয়ে আসছে- ভূদেব দুর্ভিক্ষ বিষয়ে কী বলছেন :

‘পণ্ডিতেরা গণনা করিয়াছেন যে, ৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষে পর্যাপ্ত অন্ন দুই সন্ধ্যা জুটে না! কেহ কেহ বলিয়াছেন যে, অনাহার, অল্পাহার এবং কদাহার দোষে ভারতবাসী ক্ষীণবীর্য্য এবং স্বল্পায়ু হইতেছে। একপ্রকার নিশ্চয় হইয়াই গিয়াছে যে, প্রতি দশ এগার বৎসর অন্তর ভারতবর্ষে একটি করিয়া বৃহৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, এবং তাহার পরেই একটী করিয়া মহামারী আসিয়া উপস্থিত হয়। তদ্ভিন্ন, স্থানে স্থানে অন্নকষ্ট এবং মারীভয় প্রায় প্রতিবর্ষেই দৃষ্ট হইয়া থাকে। প্রভূত ধনশালী ইউরোপের কথা ছাড়িয়া দিলেও পৃথিবীর অপর কোন দেশের অবস্থা এরূপ হইয়াছে বলিয়া শুনা যায় না।’

ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতকে হাল্ক্কা করে দেখার উপায় নেই। তার ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ প্রকাশের পর এশিয়াটিক সোসাইটির আলোচনা সভায় স্যার চার্লস এলিয়ট এরকম মন্তব্য করেছিলেন যে, ভূদেবের মত ‘এত বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ভারতে আর কেউ নেই।’ এ কথা ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী তার ‘ইউরোপ পুনর্দর্শন’ গ্রন্থে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

উপোসি বাংলা বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকার উদাহরণ টেনে আমি এ পর্যন্ত দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, উনিশ শতকের বাংলার বৃহত্তর গ্রামীণ কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী তথা রায়তদের মধ্যে ক্ষুধার ব্যাপক বিস্তৃতি হয়েছিল। এর প্রভাব থেকে অপেক্ষাকৃত খাদ্যে-উদ্বৃত্ত জেলাগুলোও বাদ ছিল না। পূর্ব বঙ্গের নানা জেলাতেই কখনো বন্যার কারণে, কখনো অনাবৃষ্টির কারণে ফসল হানি হয়েছে, কিন্তু জমিদারের শোষণের মাত্র কমে নি- ১৮৫৯ সালের বর্গা-স্বত্ব আইনের সংস্কার প্রচেষ্টার পরেও। গ্রামাঞ্চলে রায়তী অধিকারবিহীন (যাদেরকে টহফবৎ-জুড়ঃ বলা হয়েছে) এক নিম্নতম বর্গের সৃষ্টি হয়েছিল, যারা নেমে গিয়েছিল দারিদ্র্য-সীমার অনেক নীচে, দারিদ্র্য আর ক্ষুধার মধ্যবর্তী পর্যায়ে। এরাই ছিল উনিশ শতকের বাংলার প্রান্তিক মানুষ। ফসলহানির বছরে এরাই চলে যেত দুর্ভিক্ষাবস্থায় বা রইত দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে। আমি মাঝে মাঝে সন্দেহ করি যে এক নীরব ক্ষুধা-অনাহারের বেদনা মিশে আছে উনিশ শতকীয় বাংলার ‘বাউলা’ গানে-কবিতায়। এই পৃথিবীবিমুখতা, জগৎ-সংসার ছেড়ে অচিনপুরের চিন্তা, এর পেছনে হয়ত গ্রামের নিম্নতম বর্গের সামাজিক-অর্থনৈতিক কষ্ট-বঞ্চনার অগ্রন্থিত অভিজ্ঞতা কাজ করে থাকবে। অথবা, গ্রাম-বাংলার বুক থেকে উঠে আসা এই বেদনার্ত লোকজ গানগুলো ছিল ক্ষুধাপীড়িত গ্রামীণ জন-জীবনেরই শুদ্ধতম শিল্পরূপ। এ নিয়ে বারান্তরে আলোচনা করা যাবে।

৫. পঞ্চাশের মন্বন্তর

এলা সেনের ছোটগল্প সংকলন ‘ডার্কেনিং ডেইস’ (উধৎশবহরহম উধুং) বেরিয়েছিল ১৯৪৪ সালের মে মাসে। ইংরেজিতে লেখা নয়টি গল্প ছিল তাতে। বইটির দুটি বিশেষত্ব প্রথমেই চোখে পড়বে। প্রথমত, গল্পগুলো লেখা ‘নারীর দৃষ্টিকোণ’ থেকে। কথাটা আজকের দিনে আর তেমন নতুন মনে হবে না। কিন্তু গ্রন্থ রচনার কাল ১৯৪৩-৪৪ সালে সেটা মনে রাখলে কিছুটা বিস্মিত হতেই হয়। গ্রন্থকার বলছেন : ্তুঃযরং নড়ড়শ রং ধফসরঃঃবফষু ৎিরঃঃবহ ভৎড়স ধ ড়িসধহ্থং ঢ়ড়রহঃ ড়ভ ারব,ি রভ ড়হ :যরং ধপপড়ঁহঃ ড়াবৎ-বসঢ়যধংরং রং ষধরফ ড়হ :যব ারপরংংরঃঁফবং ড়ভ ড়িসবহ ফঁৎরহম :যব ফৎবধফভঁষ ফধুং ড়ভ ষধংঃ ুবধৎ রঃ রং হড়ঃ ভড়ৎ ধিহঃ ড়ভ ধঢ়ঢ়ৎবপরধঃরড়হ ড়ভ :যব ংঁভভবৎরহমং ড়ভ সবহ্থ ইংরেজি ১৯৪৩ সালের (বাংলায় যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত) এক বছর বাদে প্রকাশিত বইটির ভূমিকার লেখিকা বলছেন : ‘দুর্ভিক্ষ এখনও কেটে যায়নি।… মহামারী এখন গ্রামের পর গ্রামে মাথা তুলছে এবং এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে চিকিৎসা সাহায্য পৌঁছায়নি। অধিকাংশই বোঝে না পুনর্বাসনের মানে কী… উটপাখির মতো মাথা গুঁজে বসে থাকলে সমাধান মিলবে না… এই বইতে আমি বলার চেষ্টা করেছি যে বড় আকারের ত্রাণ তৎপরতা হাতে নেওয়া প্রয়োজন, যদি বাংলাকে পুনর্জীবিত করতে হয়।… সরকার কি করবে বা করবে না, বা করতে পারবে না, তার জন্য বসে না থেকে অ-সরকারি ত্রাণকার্য চালিয়ে যেতে হবে।… লক্ষ্মী, যূথিকা বা সুখীর দুঃখ-যন্ত্রণাকে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।’

এলা সেনের বইটির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জয়নুল আবেদিন। দুর্ভিক্ষের যে-চিত্রকর্মগুলোর জন্য তরুণ জয়নুল (তার তখন উনত্রিশ বছর বয়স) রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সেই ছবিগুলো দিয়ে সাজানো বইটি। হলদে কাগজের ওপরে কালো (চাইনিজ ইংক) কালিতে আঁকা সেসব, প্রতিটিতে ১৯৪৩ সালের উল্লেখ রয়েছে। এলা সেন বইয়ের পরিচিতিপত্রে যোগ করেছেন, ‘উইথ ড্রইং ফ্রম লাইফ বাই জয়নুল আবেদিন’। তেরোটি ছবি, এদের বেশিরভাগই এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। আমার জানা মতে, এলা সেনের বইটিতে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো প্রথম প্রকাশিত হয়। কী করে জয়নুলের সঙ্গে এলা সেনের যোগাযোগ হলো সেটাও আমাদের আগ্রহ জাগায়। কে ছিলেন এই এলা সেন?

এলা সেনের বইটি প্রকাশিত হয়েছিল সুশীল গুপ্ত’র প্রকাশনালয় দ্বারা। তার মেয়ে লীলা দাস গুপ্ত জানাচ্ছেন, “এলা সেন ছিলেন সাংবাদিক। তার স্বামী আলেক রেইড কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকায় কাজ করতেন। খুশওয়ান্ত সিং-এর ‘সাহিবস্‌ হু লাভড্‌ ইন্ডিয়া’ বইটিতে আলেক রেইডের উল্লেখ আছে।” পরবর্তীতে এলা সেন ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্দিরার প্রথম জীবনীকার ছিলেন তিনিই। নারী অধিকার কর্মী ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মনিকুন্তলা সেনের বরাত দিয়ে ‘ক্যালকাটা : দ্য স্টর্মি ডেকেডস্‌’ গ্রন্থে ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার জানাচ্ছেন যে, এলা সেনের কলকাতার বাসায় বামধারার ও প্রগতিশীল মতের নারীরা প্রায়ই মিলিত হতেন। তরুণ জয়নুল আবেদিনও প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এ সময়ে। মকবুল ফিদা হুসেন ও সৈয়দ হাশিম রাজার মতো শিল্পীরা যেমন করে উন্মেষ পর্বেই প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, জয়নুলও তেমনিভাবে প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই আন্দোলন ও গোষ্ঠী গড়ে তোলার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল। পার্টির প্রেরণাতেই জয়নুল কলম-তুলি ধরেছিলেন দুর্ভিক্ষের ডকু-বিবরণী রঙে-রেখায় প্রকাশের জন্য। এ কাজে তিনি অবশ্য একা ছিলেন না। তার সঙ্গে ছিলেন শোভা সিং, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোর প্রমুখ শিল্পী। এন্ড্রু হোয়াইটহেড মন্তব্য করেছেন, ‘স্পষ্টতই জয়নুল ছিলেন বামধারার পক্ষে’। পরবর্তীতে এই ‘বামপন্থি’ জয়নুল আবেদিন ‘বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার জনক হয়ে ওঠেন’।

কিন্তু এলা সেনের বইটি গল্পগ্রন্থ হলেও সেখানে একটা পরিশিষ্ট ছিল, যাতে পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে চলতি তথ্যের বিরল বিচার বিশ্নেষণ চিহ্নিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনথ্রোপলজি বিভাগের দ্বারা পরিচালিত জরিপের উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে : ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে মহামারীতে ‘স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পঁয়ত্রিশ লাখের বেশি।’ (ঃযব ঢ়ৎড়নধনষব :ড়ঃধষ হঁসনবৎ ড়ভ ফবধঃযং ধনড়াব :যব হড়ৎসধষ পড়সবং :ড় বিষষ ড়াবৎ :যৎবব ধহফ ধ যধষভ সরষষড়হং)। ১৯৪৩ সালের মুভমেন্টে মৃত্যুর সংখ্যা ১৯ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। পরিসংখ্যানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যই বোধকরি দুই মিলিয়ন নয়, একেবারে গুণে গুণে ১.৯ মিলিয়নের মৃত্যু সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বে উল্লিখিত জরিপের মতে, ‘এই মৃত্যুর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। অমর্ত্য সেনের মতোই লেখিকা এখানে যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, খাদ্যের উৎপাদনে স্বল্পতা নয়, খাদ্যের বণ্টনে বৈষম্য ও অব্যবস্থার কারণেই এই দুর্ভিক্ষ হয়েছে। আমেরিকার ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের বরাত দিয়ে জানানো হয় যে, ‘প্রকৃত পক্ষে [১৯৪৩ সালে] ভারতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১৯৪২ অথবা ১৯৪১ সালের চেয়েও বেশি হয়েছিল। স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও ঘাটতি অনুভূত হলেও সেটা বড় কারণ ছিল না। মূল কারণ ছিল দুটো। একটি হচ্ছে কেন্দ্রের ব্রিটিশ সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে দায়িত্বশীল সম্পর্কের আংশিক ভেঙ্গে-পড়া। আরেকটি হচ্ছে, (প্রবল) মূল্যস্ম্ফীতি।’

সম্প্রতিকালে দুটো প্রকাশনা পঞ্চাশের মন্বন্তরের কার্যকারণের ব্যাখ্যায় উল্লেখযোগ্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মধুশ্রী মুখার্জি তার দীর্ঘকালের গবেষণা দিয়ে দেখিয়েছেন যে, জাপানি আক্রমণের ঝুঁকির মুখে ব্রিটিশ সরকার বাংলার সব উদ্বৃত্ত চাল মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের জন্য মজুদ করে রেখেছিল। তার ওপরে যাতে করে কোনো চাল বাজার-ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্য কারও হাতে চলে না যায় বা বাংলার বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি অধিকৃত অঞ্চলে চলে না যায় সে জন্য পূর্ববঙ্গের থেকে চাল রফতানিতে ব্যবহূত পণ্যবাহী ছোট ছোট নৌযানগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। সমগ্র ১৯৪৩ সাল জুড়েই কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় তিনটি পরিসংখ্যান বড় করে প্রকাশ করত- ‘গতকাল মৃত্যুর সংখ্যা’, ‘গত সপ্তাহের মৃত্যুর সংখ্যা’ এবং ‘গত মাসের মৃত্যুর সংখ্যা’।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৪] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৪

পূর্ব প্রকাশের পর

মাইক ডেভিস জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষকে নাম দিয়েছেন ‘ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্ট’ বলে। কৃষির ঔপনিবেশিক কাঠামোগত সংকটের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ অনিশ্চয়তা মিশে গিয়ে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষকে প্রায় অনিবার্য করে তুলেছিল। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রকে এই সময়ে বিশেষভাবে ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখা যায় সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ-নিবারণী কর্মকাণ্ডের আলোচনায়। রমেশচন্দ্র দত্তের দ্য পেজেন্ট্রি অব বেঙ্গল প্রকাশের পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালের ‘রিপোর্ট অব দ্য ইন্ডিয়ান ফেমিন কমিশন’। ঔপনিবেশিক শাসনের অফিসিয়াল ডিসকোর্সের অংশ হয়ে দাঁড়ায় দুর্ভিক্ষ-বিষয়ক ডিসকোর্স।

বাংলার প্রকট খাদ্যঘাটতি ও গণ-ক্ষুধার প্রভাব পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোয় আদৌ পড়েছিল কি-না এ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ একথা দাবি করেছেন যে, বিশ শতকের আগে এখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জেলাগুলোতে ‘দুর্ভিক্ষ’ দেখা দেয়নি। উনিশ শতকের দুর্ভিক্ষগুলো হয়েছে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি মহাফেজখানার তথ্য-উপাত্ত বিচার করে আমার মনে হয়েছে যে, বড় আকারের দুর্ভিক্ষ উনিশ শতকের পূর্ব বাংলায় সংঘটিত না হলেও বিস্তৃত ক্ষুধার (স্টারভেশনের) দীর্ঘমেয়াদি অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোতেও। অর্থাৎ, শুধু চরম দারিদ্র্য নয়, ব্যাপক অনাহার বিরাজ করছিল এসব জেলায়, এমনকি অপেক্ষাকৃত খাদ্যে-উদ্বৃত্ত এলাকাগুলোতেও। ১৮৭০-৮০-এর দশকের স্থানীয় পত্র-পত্রিকাতে সেসব ক্ষুধা-অনাহারের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে ক্ষুধায় বা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে অসুখে প্রাণহানির সংবাদও। সেগুলো জাতীয় পর্যায়ে হেডলাইন করা সংবাদ ছিল না ঠিকই, কিন্তু এর মধ্য থেকে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা খাদ্য-নিরাপত্তার স্বস্তিকর চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সব বিবরণ পড়লে মনে হয় শুধু দারিদ্র্যে নয়, সময় সময় ক্ষুধায় কাটাতে হতো বৃহত্তর কৃষি-নির্ভর জনগোষ্ঠীকে এবং একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ‘দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে’ থাকতেন বছরের অধিকাংশ সময়। এই গবেষণার কাজে আমাকে সাহায্য করেছিলেন ইতিহাসের তরুণ গবেষক ইফাত আরা বিথী ও নবেন্দু সরকার। তাদের সহায়তায় আর্কাইভ থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, তারই অংশবিশেষ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে এখানে তুলে ধরছি।

১. ১৮৭৮ সালে ‘হিন্দু হিতৈষিণী’ পত্রিকার ২০ জুলাই সংখ্যায় বলা হচ্ছে :’পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে’ মধ্যবিত্তের মধ্যে খাদ্যশস্যের ক্রমান্বয়ে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দুরবস্থা দেখা দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের সংবাদদাতারা এ তথ্য জানাচ্ছে। … অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে; অনেকেই কয়েক দিন ধরে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।’

২. ১৮৭৮ সালের ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার ২১ জুলাই সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ঢাকার কমিশনার সাহেব গত দুর্ভিক্ষের সময়ের উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে খাদ্যশস্য কিনে তা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীদের জন্য স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করার প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রথমত, আউশ ধান ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করা সমীচীন হবে না, কেননা এ বছরের আউশ ধানের ফলন ভালো হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়, ফলন যদি মোটামুটিও হয় তাহলেও সহসা এই শস্যের মূল্য নামতে শুরু করবে না। ততদিনে বর্তমানের দুর্গতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে, অনাহারে মৃত্যুর ঘটতে পারে কারো কারো, যা এখন আর বিরল ঘটনা নয় এই অঞ্চলে। গত সাত-আট মাস ধরে খুবই চড়া দামে চাল বিক্রি হচ্ছে; খাদ্য কিনতেই মানুষের সব টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। ১৮৭৪ সালের পরিস্থিতির তুলনায় এ বছর অবস্থা আরো খারাপ এ কথা বিবেচনা করে ঢাকাবাসীর জন্য সত্বর খাদ্যশস্য নির্ভর, ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’

৩. ১৮৭৮ সালের ভারত-মিহির পত্রিকার ২৭ জুলাই সংখ্যায় বলা হচ্ছে :’দুর্ভিক্ষের চিরস্থায়িত্ব আমাদের বিচলিত না করে পারে না। কীভাবে এটি নিবারণ করা যায় এই প্রশ্নটি জনমনে রয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষ নিবারণে যে ব্যয় হবে, সরকারের পক্ষে তা কতদিন বহন করা সম্ভব? … সরকারী সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও [১৮৭৭ সালের] মাদ্রাজের দুর্ভিক্ষ তো এড়ানো গেল না- তিরিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হলো সেখানে। মানুষের মনে ক্রমশ এই ভুল ধারণাই জমাচ্ছে যে, [১৮৭৬ সালের ১লা মে] রানী ভিক্টোরিয়া যখন থেকে ভারত-সম্রাজ্ঞীর শিরোপা পরলেন তখন থেকেই ভারতবর্ষে একের পর এক বিপর্যয় নেমে আসছে।’

৪. ১৮৭৮ সালের ‘হিন্দু রঞ্জিকা’ পত্রিকার ১৪ আগস্ট সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘এদেশের ইতিহাসে এত ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ আর কখনো হয়নি… বন্যার ফলে বাংলার শস্য-ভাণ্ডাররূপে পরিচিত সিরাজগঞ্জ এবং পাবনার আউশ ও আমন ধান নষ্ট হয়ে গেছে; এর ফলে পুরো প্রদেশেই দুর্ভিক্ষের আশংকা দেখা দিয়েছে। … বিহারে দুর্ভিক্ষের সময় যেমন সরকারী সিদ্ধান্ত এসেছিল যে যেখানেই চালের দাম মণ প্রতি ৬ টাকায় চলে যাবে, সেখানেই দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এলাকা ঘোষণা করা হবে। একই ধরনের ঘোষণা এখন বাংলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’

৫. ১৮৭৮ সালের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার ৩০ আগস্ট সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘চালের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে করে ধারণা হয় যে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। এমন কোন গ্রাম পাওয়া যাবে না যেখানে মণ প্রতি ৪ বা ৫ টাকার নীচে চাল বিক্রি হচ্ছে। এ রকম অবস্থায় ইউরোপে চাল রপ্তানী করা হচ্ছে। চাল রপ্তানীতে আমাদের আপত্তি থাকত না যদি দেশের ভেতরে চালের যথেষ্ট মজুদ থাকত।’

৬. ১৮৭৮ সালের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার ২০ নভেম্বর সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘কলেরা মারাত্মক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে চন্দননগর শহর ও তার আশে-পাশের গ্রামগুলোয়। একদিনেই মারা গেছে সত্তর জনের মত। … হুগলি নদীর দু’ধারের গ্রামগুলোতে নানা ধরনের মহামারী প্রকট। প্রতি দিন সেখানে কত জন মারা যাচ্ছে তার কোন হিসাব আমাদের কাছে নেই।’ এই ঘটনা চন্দননগর সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল নিয়ে হলেও পূর্ব বঙ্গের গ্রাম এলাকাতেও এটা ঘটেছে।

৭. ১৮৭৮ সালের ঢাকা প্রকাশ ৩রা নভেম্বর সংখ্যায় লিখেছে ‘পূর্ব বঙ্গে দুর্ভিক্ষের আশংকার’ কথা : ‘লর্ড নর্থব্রুক বলেছেন যে-স্থানে চালের দাম মণ প্রতি চার টাকায় পৌঁছাবে সেই এলাকাকেই দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা। এ রকম অবস্থা দীর্ঘ দিন ধরেই পূর্ব বঙ্গের প্রায় সমগ্র অঞ্চল জুড়েই বিরাজ করছে। ময়মনসিংহে চালের দাম মণ প্রতি ৬-৭ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। … আমরা অনেক দিন ধরে এসব এলাকার জন-দুর্দশা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছি। এক বেলা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে কাউকে, কেউ বা কিছুই খেতে পাচ্ছে না। সরকারী কর্মকর্তারা অবশ্য তারপরও ভাবছেন যে জরুরী ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর কোন দরকার নেই। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, এত চড়া দামে যারা চাল কিনতে পারছে তারা নিশ্চয়ই সম্পন্ন অবস্থাশালী। আসলে অভাবের কারণে চড়া দরে খাবার কিনতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই তাদের সর্বস্ব হারাতে বসেছে। অন্যদিকে, যারা মৃত্যুর পথে ধুঁকে ধুঁকে চলেছে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের কোন মনোযোগ নেই।’ মনে হচ্ছে, এই বর্ণনায় উনিশ শতকের ‘মরা কার্তিককে’ দেখছি।

৮. ১৮৭৮ সালের ভারত মিহির ৫ই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় এমনটা লিখেছে : ‘পূর্ব বঙ্গের মফস্বল থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ আসছে যে, বন্যার কারণে আমন ধান নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বত্র চালের দাম মণ প্রতি পাঁচ টাকায় চড়ে গেছে। কেবল মাত্র যারা পাটচাষী তাদের অবস্থা কিছুটা ভাল। তারপরও সামগ্রিক ভাবে দুর্দশার পরিমাণ কম নয়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিলাসবহুল জীবনে থেকে হয় তারা জনগণের কষ্ট বুঝতে পারছেন না, অথবা তারা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে চাইছেন না এবং সরকারের কাছে ‘অবস্থা সন্তোষজনক’ ধরনের প্রতিবেদন পাঠাচ্ছেন। স্যার এশলি এডেন গরীব মানুষের বান্ধব রূপে পরিচিত, কিন্তু তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো সে কথা বলছে না। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট আর কমিশনারদের প্রতিবেদন পেয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকছেন। কিন্তু তাকেই বা দোষারোপ করি কেন? এত ঘন ঘন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করা কোন সরকারের পক্ষে সম্ভব? স্থায়ী ভাবে রিলিফের কাজ সর্বত্র করানো যাচ্ছে না, এর সহজ ব্যাখ্যা হলো- এর জন্যে সরকারী তহবিল অপ্রতুল।’ কেননা, সরকারী ব্যয়ের বড় অংশই চলে যাচ্ছে অন্যান্য খাতে, যেমন কাবুল-যুদ্ধে। উদাহরণত, ১৮৭৮-৮০ সাল পর্বে ২য় ‘এংলো-আফগান ওয়ার’ চলছিল, যার বাবদ অনেক খরচ বেড়ে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক সরকারের। এই খরচের সিংহভাগ যুগিয়েছিল ঘন ঘন দুর্ভিক্ষের শিকার ভারতবর্ষের তথা বাংলার কৃষক-সম্প্রদায়।

৯. ১৮৭৮ সালের ২২শে নভেম্বরের ঢাকা প্রকাশ জানাচ্ছে : ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে চালের দাম কমা শুরু করলেও ঢাকা ও তার আশে-পাশের এলাকায় চাল মণ প্রতি ৭-৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার আমন ধান বন্যার কারণে সম্পূর্ণ বিনষ্ট। মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার ধানে পোকার কামড় দেখা দিয়েছে, ফলে সেখানেও ভাল ফসল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এসব বলে ঢাকা প্রকাশ যোগ করেছে, ‘আমরা এমনকি অনাহারে মৃত্যুর খবরও পেয়েছি’ (‘We have heard even of deaths from starvation’)।

১০. ১৮৭৮ সালের ১৮ই নভেম্বর সোমপ্রকাশ পত্রিকা খবর দেয় যে, বাগেরহাটের লোকজন স্থানীয় বোরো ধানের ফলন নষ্ট হওয়ায় ‘দুর্ভিক্ষের অবস্থায় উপনীত’ হয়েছে। তারপরও তাদের ওপরে বকেয়া দায়-দেনা পরিশোধের জন্য মহাজনদের কাছ থেকে নানারকমের অত্যাচার নেমে এসেছে। সোমপ্রকাশ আরো জানিয়েছে যে, ‘নিম্নবর্ণের একটি নারী ক্ষুধার জ্বালায় স্থানীয় হাটবাজারে গিয়ে তার শিশুকন্যাকে ১২ আনার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে চেয়েছে।’

১১. ১৮৭৮ সালের যে-দশটি বিবরণী উপরে পেশ করা হলো তাতে করে মনে হতে পারে, বুঝি ঐ বছরেই দুর্ভিক্ষের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। এর প্রায় এক বছর পরেও দেখি, অবস্থার কোন উন্নতি তো হয়ই নি, বরং লক্ষণীয় অবনতি ঘটেছে। যেমন, ১৮৭৯ সালের ৩০শে জুলাই মাসের হিন্দু রঞ্জিকা পত্রিকা সিরাজগঞ্জ-শাজাদপুর এলাকায় দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে আসতে দেখেছেন : ‘অনেক মানুষ সেখানে গাছের পাতা খেয়ে থাকছে। বাকিরা ভিক্ষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে।’ ঐ একই বছরের ২২শে আগস্টের প্রভাতী পত্রিকা লিখেছে, ‘চালের দাম যে-হারে বাড়ছে তাতে করে দুর্দশা বাড়ছে এবং সেটা যদি চলতে থাকে অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। এটা থামানো যেতে পারে কেবল মাত্র মুক্ত বাণিজ্য নীতির বিষয়ে কিছুটা হস্তক্ষেপ করেই। এদেশ থেকে যাতে চাল বাইরে রপ্তানী না হয়ে যায় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।’ পরবর্তীতে, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর আলোচনার সময়েও দেখতে পাব যে চালের রপ্তানী-বন্ধের দাবি নতুন করে উঠেছিল।

উপোসি বাংলা তথা পূর্ব বাংলার ‘নীরব অনাহারের’ যে চিত্র আমি দেখাতে সচেষ্ট হয়েছি তা ১৮৭০-৮০র দশকের কোন কথা-সাহিত্যে লিপিবদ্ধ হয়নি। রমেশচন্দ্র দত্ত বা বঙ্কিমের প্রবন্ধ-সাহিত্যে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ এসেছে কৃষক-জমিদার বৈরী সম্পর্কের আলোচনার অনুষঙ্গ হিসেবে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল