পর্ব :: ৫৫
পূর্বে প্রকাশিতের পর
১৯১৯ সালে লেখা ইয়েটস্-এর ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’ তার বিখ্যাত কবিতাগুলোর একটি। আদি-খসড়ায় এর নাম রাখা হয়েছিল ‘দ্য সেকেন্ড বার্থ’- দ্বিতীয় জন্ম বা পুনর্জন্ম। কবিতাটির সাথে ১৯১৮-১৯ সালের স্পেনিশ ফ্লু-র সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। কবিতাটি লেখার কয়েক সপ্তাহে আগে ইয়েটস্-এর স্ত্রী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে উপনীত হন। তার স্ত্রী যখন জ্বরে কাঁপছিলেন, তখনই তার মাথায় ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’-এর আইডিয়াটা আসে। এর বিখ্যাত শুরুর চরণগুলি পাঠকদের কাছে অতি-পরিচিত-জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’ ইয়েটস্-এর এই কবিতার প্রতি গাঢ় অনুরাগ থেকেই নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল:
‘Turning and turning in the widening gyre
The falcon cannot hear the falconer;
Things fall apart; the centre cannot hold;
Mere anarchy is loosed upon the world,
The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere
The ceremony of innocence is drowned;
The best lack all conviction, while the worst
Are full of passionate intensity.’
এলিয়ট বা ইয়েটস্-এর কবিতায় মহামারী পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এর প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ে দুই মহাযুদ্ধের মাঝের দুই শক্তিশালী সাহিত্য-কর্মে। প্রথমটি হলো, ১৯৩৮ সালে লেখা বের্টোল্ট ব্রেখট-এর ‘লাইফ অব গ্যালিলিও’, আর ১৯৪১ সালে লিখতে শুরু করা আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’ (১৯৪৭ সালে প্রকাশিত) উপন্যাস। ‘গ্যালিলিও’ ব্রেখটের শ্রেষ্ঠ নাটক, আর ‘প্লেগ’-কে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ‘সেরা উপন্যাস’ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। দুটো সম্পর্কেই একটু বিস্তৃত ভাবে আলোচনা করতে চাই।
গ্যালিলিও নাটকের পটভূমি মোটামুটিভাবে সকলেরই জানা। গ্রিক জ্যোতির্বিদ টলেমির (১০০-১৭০) সময় থেকে এই বিশ্বাস চলে আসছিল যে, পৃথিবীই স্থির হয়ে আছে- মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু আসলে পৃথিবীই আর সূর্য পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করছে। শুধু টলেমি হলে তাকে বাধা দেওয়া অত শক্ত হতো না, কিন্তু অ্যারিস্টটল স্বয়ং এই ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন। টলেমির তত্ত্বের পেছনে অ্যারিস্টটলের মতো একজন ক্ষমতাধর ‘অথরিটি’র সমর্থন এই তত্ত্বকে ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। চার্চও এই তত্ত্বকে সর্বাংশে গ্রহণ করেছিল- রোমক সাল্ফ্রাজ্যের পতনের পরে যখন খ্রিষ্টধর্ম পরাক্রমশালী হয়ে দাঁড়ায় আদি মধ্যযুগে। তা ছাড়া, সূর্য যে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে- এটা তো প্রতিদিনের নিত্য অভিজ্ঞতার সাথে মেলে। আমরা কি প্রতিদিন এটাই দেখি না যে, সূর্য ‘ভোরে উঠছে’ আর সন্ধ্যাবেলায় ‘অস্ত যাচ্ছে’। বহুকাল পরে মার্কস এই সূর্য-প্রদক্ষিণের উদাহরণ টেনে অবশ্য বলবেন যে, যদি ‘অ্যাপিয়ারেন্স’ (প্রতীয়মানতা) আর ‘রিয়েলিটি’ (বাস্তবতা) একই হতো, তাহলে বিজ্ঞানের কোনো দরকারই থাকত না! ‘If appearance and reality were the same, the need for science would be superfluous। কিন্তু এ কথা গ্যালিলিওর সময়ে উচ্চারণ করা সহজ ছিল না। গ্যালিলিওর সময়কাল বলতে বোঝাচ্ছি, ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় ভাগ আর সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগ (তার জন্ম ১৫৬৫, আর মৃত্যু ১৬৪২ সাল)। ব্রেখটের নাটকের প্রথম দৃশ্যের শুরু হয় ১৬০৯ সালে। আর শেষ দৃশ্য জমে উঠেছে ১৬৪২ সালকে ঘিরে। ‘গ্যালিলিও গ্যালিলি’ তার পুরো নাম। তাকে যদিও আধুনিক পদার্থ বিদ্যার জনক হিসেবে মান্য করা হয়, কিন্তু পদার্থবিদ্যা তো সেভাবে ‘শাস্ত্র’ হিসেবে তখনও গড়ে ওঠেনি। ব্রেখট তাকে দেখিয়েছেন প্রথমে পাদুয়ার (পরে ফ্লোরেন্সের) বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের একজন অধ্যাপক হিসেবেই। নাটক থেকে আমরা জানতে পারি যে, সপ্তাহে দুটো লেকচার দিতে হয় তাকে- প্রতিটা লেকচার দু’ঘণ্টা করে। এই করে যা পান, তাতে তার সংসার চলে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ (Procurator)–এর অকাট্য পাল্টা যুক্তি, ‘আপনার যা খ্যাতি তাতে তো অনেক প্রাইভেট ছাত্র জোটার কথা।’ শুনে গ্যালিলিও যা বলেছিলেন তাতে করে বাংলাদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার সাথে এক জায়গায় বড্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায়:
‘Too many, sir, I teach and I teach and when am I supposed to learn?… I am stupid. I understand absolutely nothing. So I’m compelled to fill the gaps in my knowledge. And when am I supposed to do that? When am I to get on with any research? Sir, my branch of knowledge is still avid to know. The greatest problems still find us with nothing but hypotheses to go on’.
এহেন গ্যালিলিও একদিন দাবি করে বসলেন যে, টলেমির তত্ত্ব সঠিক নয়। দূরবীন ব্যবহার করে এবং অঙ্ক কষে তিনি দেখালেন যে আসলে সূর্য নয়, পৃথিবীই তার চারপাশ দিয়ে ঘরছে। সেই সাথে ঘুরছে আরও কিছু গ্রহ। এটি ছিল আদিতে কোপেরনিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) তত্ত্ব, তাকে সপ্রমাণিত করেছিলেন গ্যালিলিও একশ’ বছর পরে। এর জন্য পাদুয়া ছাড়তে হলো তাকে; কিন্তু ফ্লোরেন্সে গিয়েও তার তত্ত্ব নিরাপদ আশ্রয় পেল না। একপর্যায়ে রোমের ভ্যাটিকান চার্চে ডাক পড়ল তার। যখন কিছুতেই তাকে বাগ মানানো যাচ্ছিল না, তখন ভ্যাটিকানের পোপ বললেন, দৈহিক অত্যাচার কী করে করা হয় সেইসব যন্ত্রপাতি ওকে দেখান, তাহলেই সে বুঝতে পারবে। সংলাপটি ঐতিহাসিক :
‘The Pope: At the very most he can be shown the instruments.
The Inquisitor: That will be enough, your Holiness, Instruments are Mr. Galilei’s speciality.’
নাটকের শেষ অঙ্কের আগের অঙ্কে গ্যালিলিও তার শিষ্য অন্দ্রেয়ার সাথে কথা বলছেন। পোপের হুমকির মুখে তিনি শেষপর্যন্ত স্বীকার করে নেন যে তিনি ভুল ভেবেছেন- টলেমিই সঠিক। বিজ্ঞানকে এভাবে অস্বীকার করে ঠিক করেছিলেন কি গ্যালিলিও? এটাই এই নাটকের অন্যতম প্রধান প্রশ্ন। গ্যালিলিওর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা ছাত্ররা তার পিছু হটার মধ্যে কাপুরুষতা দেখেছিলেন। গ্যালিলিও আত্মসমর্পণ করেছেন ক্ষমতার কাছে- তিনি আপসকারী, Conformist। ফলে অন্দ্রেয়ার মতো অনেক শিষ্য গ্যালিলিওকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন নজরবন্দি (এমনকি গৃহবন্দিও বলা যায় তাকে); শুধু খাবার-দাবার, আর লেখার জন্য কালি-কলম-কাগজ দেওয়া হতো তাকে, অবশ্য সে সবও ‘সেন্সসরশিপের’ মধ্য দিয়ে যেত। যেমনটা হয়েছিল মুসোলিনির জেলে আবদ্ধ গ্রামসির বেলায়। যেটা কেউই ভাবেনি- তার শত্রুরা তো বটেই, মিত্ররাও ঘুণাক্ষরে কল্পনা করেনি গ্যালিলিও এরই মধ্যে সকলের অজ্ঞাতসার রচনা করে ফেলেছেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজ-Discorsi বা ‘ডিসকোর্সেস’। একটা খেলনা গোলকের ভেতরে এই রচনার পাতাগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি এতদিন। অন্দ্রেয়া তার সাথে বহু বছর বাদে দেখা করতে এলে তাকে এর পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে দেন, যাতে সে হল্যান্ডে গিয়ে এর প্রকাশনার ব্যবস্থা করতে পারে। উৎফুল্ল অন্দ্রেয়া বুঝতে পারল কেন গ্যালিলিও সেদিন আরেকজন গিওরদানো ব্রুনো (Bruno) (যাকে কোপেরনিকাসের তত্ত্ব প্রচারের জন্য আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল চার্চের আদেশে) তার মতো হতে চাননি। আপস করে যে সময় পেয়েছিলেন গ্যালিলিও, সেটি তিনি ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানের কাজে। সংলাপটি তাৎপর্য্যপূর্ণ:
‘Andrea: You gained the leisure to write a scientific work which could be written by nobody else. If you had ended up at the stake in a halo of flames the other side would have won.
Galileo: They did win…
Andrea: Why did you recant, then?
Galileo: I recanted because I was afraid of physical pain.
Andrea: No!
Galileo: They showed me the instruments.
Andrea: So it wasn’t, planned?
Galileo: It was not.’
মনে হয়, গ্যালিলিও নাটকটি লিখে এক ঢিলে তিন পাখি মারতে চেয়েছিলেন ব্রেখট। প্রথমত, বিশ্বাস ও যুক্তির লড়াই যেটা আদি-মধ্যযুগ থেকেই চলছিল- সেই সামন্তবাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞান-ভিত্তিক মানবতাবাদকে ক্ষত-বিক্ষত হতে দেখানো। দ্বিতীয়ত, এই নাটকটি যখন লেখা হয়েছিল, তখন মস্কোর শো-ট্রায়ালগুলো শুরু হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য সব স্বীকারোক্তি দিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুবরণ করেছেন লেনিনের পলিটব্যুরোর সহকর্মীরা- জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, রাদেক, বুখারিন, টমস্কি প্রমুখ। তাদের শুধু instruments দেখানো হয়নি, প্রচণ্ড দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছিল সেদিন। এটি ছিল ব্রেখটের তরফে স্তালিনবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পরবর্তী সময়ে পূর্ব জার্মানিতে বসবাস করলেও, স্তালিন-সম্পর্কে কোনো মতিভ্রম হয়নি তার ১৯৩৬-৩৮ সালের শো-ট্রায়াল গুলো দেখার পরে। আমার যুক্তির সপক্ষে এ-ও বলব যে, পূর্ব ইউরোপের সব দেশে ব্রেখটের সব নাটকের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল গ্যালিলিও নাটকটি। সেটা এমনি এমনি নয়। এর মধ্যে দর্শকরা স্তালিনবাদের সমালোচনা দেখতে পেতেন, যার প্রভাব স্তালিনের মৃত্যুর পরেও চলছিল পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। তৃতীয়ত, এই নাটকটির উদ্দেশ্য হলো ম্যাকার্থিবাদের হুমকি ও নজরদারির বিপদ সম্পর্কে দর্শক-পাঠকদের সজাগ করে দেওয়া। জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর বামপন্থি নাট্যকার ও কবি হিসেবে ব্রেখট প্রথমে স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর্বে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। যুদ্ধ চলাকালীন তার প্রতি কড়া নজর রাখত এফবিআই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছুদিন পরে যখন ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ শুরু হলো, এবং সিনেটর ম্যাকার্থির নেতৃত্বে বাম ও কমিউনিস্টদের খুঁজে খুঁজে বের করা হচ্ছিল, তখন ব্রেখটকেও মার্কিন কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়। আমেরিকার ন্যুয়র্কে প্রায় একই সময়ে ১৯৪৮ সালে মঞ্চস্থ হয়েছিল তার ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি। যে আমেরিকা Freedom of Trade-র কথা বলে বেড়ায় সেখানে Freedom of Research (thought) কোথায়- এটি পরোক্ষ ভাবে গ্যালিলিওর বরাত দিয়ে বলেছেন লেখক। ম্যাকার্থি কমিটির কাছে সাক্ষ্যদানের কিছুদিনের পরেই পূর্ব জার্মানিতে চলে যান ব্রেখট এবং গঠন করেন তার জগদ্বিখ্যাত ‘বার্লিনার এনসেম্বল’ (Berliner Ensemble) নাট্যগোষ্ঠী।
মহামারীর কথা বলতে গিয়ে এত সাতকাহন কেন করলাম ‘গ্যালিলিও’ নাটকের আখ্যানভাগ নিয়ে? কারণ, গ্যালিলিও নাটকের সময়কাল ১৬০৯ থেকে ১৬৪২ অবধি। কয়েক বছর পরপর প্লেগ দেখা দিয়েছে তার স্বদেশ-ভূমি ইতালিতে এই সময়ে। নাটকটির ৫ম অঙ্কটি পুরোটা প্লেগকে ঘিরে (ইতালিতে সবচেয়ে বিধ্বংসী প্লেগ হয়েছিল ১৬২৯ সালে; এই নাটকে প্লেগের দৃশ্যটি ১৬১০-১৬১৬ সালের মধ্যকার কোনো একটা সময়ের)। সেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্লোরেন্স ছেড়ে চলে যাচ্ছে বিত্তবান সবাই- রাজ কর্মচারী, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ সকলেই। গ্যালিলিও তার মেয়ে ভার্জিনিয়াকেও পাঠিয়ে দিয়েছেন, এমনকি তার গৃহকর্মীদেরও তিনি বাসায় রাখেননি। খালি গৃহে তিনি একা থেকে গিয়েছিলেন- তার গবেষণা-কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই অঙ্কটিতে অনেক মানবিক করুণা-শুশ্রূষার মুহূর্ত রয়েছে। মনে হয় ব্রেখট অবিচলিত অনমনীয় গ্যালিলিওকে ঝঃড়রপ-র মতো দৃঢ়তায় আঁকতে চেয়েছেন। কয়েকটি নির্বাচিত দৃশ্য তুলে ধরি।
– গ্যালিলিও তার দীর্ঘকালের গৃহপরিচারিকা মিসেস Sarti-কে ভর্ৎসনা করে বলেছেন কেন তাকে এই মুহূর্তেই ফ্লোরেন্স ছেড়ে চলে যেতে হবে:
Mrs. Sarti: But who’s going to see you get your meals?
Galileo: You’re crazy. Staying in this city in order to cook!
Picking up his notes:
Don’t think I’m a complete fool, Mrs. Sarti. I can’t abandon these observations. I have powerful enemies and I must collect proofs for certain hypotheses.
Mrs. Sarti: You don’t have to justify yourself. But it’s not exactly sensible.’
-পেস্নগের মধ্যে জনমানবহীন বাসা থেকে পাড়ার ভেতরেই বেরিয়েছেন গ্যালিলিও। উদ্দেশ্য- খাবারের খোঁজ করা। বিশেষত দুধের অভাব, আর এমনিতে খেতে গ্যালিলিও বড় ভালোবাসেন। দেখছেন, সামনের রাস্তা দিয়ে দু’জন মিশনারি নান যাচ্ছেন।
Galileo: Could you please tell me, sister, where I can buy some milk? The milk women didn’t come this morning, and my housekeeper has left.
One Nun: The only shops open are in the lower town.
[এমন সময়ে পাশের বাড়ির জানালা খুলে এক মহিলা গলা বাড়াল।]
Galileo: Have you heard anything about my housekeeper?
Women: Your housekeeper collapsed in the street up there. She must have realized….
[মহিলা এই বলে জানালা বন্ধ করতেই কোথা থেকে দু’জন সৈন্য সামনে উপস্থিত হলো। তারা তাদের লম্বা বল্লম দিয়ে গ্যালিলিওকে বাধ্য করল আবার ঘরের ভেতরে চলে যেতে। বাইরে থেকে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিল]
Soldiers: Get right back indoors!
-[ সৈন্যরা চলে যেতে আরেকটা ঘরের জানালা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো এক বৃদ্ধার মুখ]
Galileo: That must be a fire back there.
Old woman: They’ve stopped putting them out where there’s any risk of infection. All they can think about is the plague.
Galileo: Just like them. It’s their whole system of government. Chopping us off like the diseased branch of some barren figtree.
[ কোথায় যেন ঘটর ঘটর টিন পেটানোর শব্দ হচ্ছিল]
Galileo: What’s that?
Old woman: They’re trying to make noises to drive away the clouds with the plague seeds in them.
এ হলো ‘খারাপ বায়ু (বা ‘Miasma’) তত্ত্ব যার মাধ্যমে প্লেগের সংক্রমণ ছড়ায়। সেকালে লোকেরা বিশ্বাস করত আকাশের কিছু কিছু মেঘ ‘প্লেগের বীজ’ বহন করে দেশে-দেশান্তরে মহামারী ছড়িয়ে দেয়। এর কথা পাঠকদের এর আগেই বলেছি।
গ্যালিলিও নাটকে দীর্ঘ সময় ধরে প্লেগের দৃশ্যাবলি দেখানো হচ্ছিল তার সম্ভাব্য কারণ ছিল বোধকরি এই যে, গবেষণায় ব্রতী বিজ্ঞানী শত মহামারী দুর্যোগ সত্ত্বেও তার গবেষণাগার ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে রাজি ছিলেন না এটা তুলে ধরা। জীবনের শেষ ভাগে এসে তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল সত্যানুসন্ধান। নশ্বর দেহের সকল ঝুঁকি নিয়ে তিনি এরই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন প্লেগের মতো ভয়ংকর মহামারীর মধ্যে বসে। কিন্তু, আমার ধারণা, গোটা নাটকের পটভূমি হিসেবে প্লেগের ছায়াকে বেছে নেওয়ার পেছনে ব্রেখটের মনে অন্য উদ্দেশ্যও কাজ করছিল। বাইরের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত প্লেগের চেয়েও ভয়ংকর ছিল সেকালের অন্ধ অযৌক্তিক কর্ণপাতহীন বিশ্বাস ও সেই অন্ধ বিশ্বাসের নিরঙ্কুশ শাসনের প্লেগ। এই প্লেগের বীজকে সহজে চোখে দেখা যায় না, এই মহামারী মানুষকে জৈবিক অর্থে মারে না। অন্ধ বিশ্বাসের ক্ষমতা তিলে তিলে মারে মানুষকে মানসিক দিক থেকে। ‘এ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ারে’ ডানিয়েল ড্যাফো লিখেছেন- লন্ডনের ১৬৬৫ সালের প্লেগের বছরের আগে ও পরে গণক, ওঝা, হাতুড়ে ডাক্তার, তুকতাক্ জানা লোকের সংখ্যা ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে, ষোড়শ শতকের শেষ ভাগ থেকে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত একশ’-দেড়শ’ বছরে একের এক ছোট-বড় আকারের প্লেগ অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউরোপের দেশে দেশে। আর সেই সাথে চলেছে ‘উইচ হান্ট’: চারপাশে শয়তানের ভক্ত ডাকিনী-যোগিনীদের খুঁজে খুঁজে ফাঁসি দেওয়া বা পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। এলিজাবেথের মৃত্যুর পরে ১৬০৬ সালে ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন জেমস-প্রথম (এর আগে তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাজা মেরি স্টুয়ার্টের পুত্র)। এই জেমস-প্রথম একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম-‘ডেমনোলজি’। স্বয়ং ইংল্যান্ডের রাজা প্লেগের দুর্বিপাকের সময়ে ডাইনি পোড়ানোর আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই এটা ঘটেছিল, যেমন প্রসার পেয়েছিল ১৯৩০-র দশকে কঁ কষীঁ কষধহ আন্দোলন গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাবে। ব্রেখট তার নাটকে সেভাবে এদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেননি- শুধু টিনের ড্রাম পিটিয়ে দুষ্ট অশুভ প্লেগের বীজবাহী মেঘকে শহরের বুক থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থার কথা একটি চরিত্রের বরাত দিয়ে আমাদের শুনিয়েছেন। কিন্তু মধ্যযুগের চার্চ স্বয়ং যেভাবে সুযুক্তির চেয়ে মন্দ-যুক্তিকে, প্রায়শ অযৌক্তিককে প্রশ্রয় দিচ্ছিল- সেটি সমাজ-শরীরকে মহামারীর চেয়ে আরও বেশি বিপন্ন করে তুলেছিল।
এতে চার্চের যতটা ক্ষতি হচ্ছিল, তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার। গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিস্কার করেছিলেন, কিন্তু তার কালের দার্শনিক, গণিতবিদ, তাত্ত্বিকরা সেই যন্ত্রে চোখ রাখতে চাননি। গ্যালিলিও দুঃখ করে বলেছেন যে, তারা এমন ভাব করছে যেন অ্যারিস্টটলের কথাই শেষ কথা! ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, তাদেরকে:
‘Gentlemen, to believe in the authority of Aristotle is one thing, tangible facts are another…I offer any observations and everyone laughs: I offer my telescope so they can see for themselves, and everyone quotes Aristotle.’
এ-ই হচ্ছে ‘ডগমার’ প্রভাব যা প্লেগের প্রভাবের চেয়েও সুদূরপ্রসারী- যা কুরে কুরে খায় আমাদের মন ও মননের সজীব প্রবৃত্তিকে। গ্যালিলিওর উক্তি তাই এখনও আমাদের কানে বাজে: ‘সত্য ক্ষমতার বৃত্ত থেকে নয়- সময়ের বৃত্ত থেকে জন্ম নেয়’ (Truth is born of the times, not of authority)।
এবার আসি আলবেয়ার কাম্যুর ‘প্লেগ’ উপন্যাসের প্রসঙ্গে। নামেই বোঝা যাচ্ছে লেখাটি মহামারী নিয়ে। ১৯৪১ সালে যখন এই উপন্যাস লেখা শুরু করেন, তখন কাম্যুর বয়স মাত্র ২৮। ১৯৪৭ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়; অবশ্য তার আগেই বেরিয়ে গেছে তার ‘মিথ অব সিসিফাস’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ ও ‘আউটসাইডার উপন্যাস’। এই তিনটি লেখাই কাম্যু তার বিশেষ ঘরানার ‘অস্তিত্ববাদী’ দর্শন প্রকাশ করার জন্য লিখেছিলেন। প্রথম দুটি একই বছরে (১৯৪২) প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে। ১৯৭৬ সালে আউটসাইডার নিয়ে – ইমতিয়াজ আহমেদের সাথে যৌথ ভাবে- একটি দীর্ঘ লেখা লিখি। যার নাম ছিল “দ্য এসেন্স অব আলবেয়ার কাম্যু’স্ পেসিমিজম”- তৎকালীন হলিডে পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে তা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে আমরা বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, ‘কাম্যুর নৈরাশ্যবাদ এক বিশেষ ধরনের নৈরাশ্য থেকে জন্ম নিয়েছে- যার নাম Solar Pessimism এবং যার মোদ্দাকথা হচ্ছে- এই পৃথিবীটা সূর্যের ওপরে নির্ভর করে বেঁচে আছে। প্রতিদিন হাজার হাজার তারার জন্ম হচ্ছে, হাজার হাজার তারার মৃত্যু হচ্ছে। সেই অমোঘ নিয়মে সূর্য নামক নক্ষত্রটিরও মৃত্যু একদিন ঘটবেই- এমনই অর্থহীন নশ্বর মানবজীবন। একটা হ্যালির ধূমকেতুর মতো কোনো এস্টরয়েড যদি দৈবাৎ পতিত হয় পৃথিবীতে, তাহলে ডাইনোসররা যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, আমরাও সেভাবে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারি প্রজাতি হিসেবে। এই কথাগুলো যখন লিখি তখন মিথ অব সিসিফাস পড়া ছিল আমার, কিন্তু প্লেগ তখনো অপঠিত থেকে গিয়েছিল। আজ মনে হয়, প্লেগ পড়া থাকলে কাম্যুর দর্শনবোধকে শুধু ‘Solar Pessimism’-র মধ্যে আটকে রেখে দিতে পারতাম না। আমাদের সমসাময়িক কালে কাম্যুর দর্শনবোধকে খান মোহাম্মদ ফারাবী ঠিকই চিনে নিতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই মৃত্যুচিহ্নিত পৃথিবীতে জীবনের নিকটতম তুলনা শিল্প।’ এটা অবশ্য আদিতে নিটশেরই কথা। সুইজারল্যান্ডের বাসেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে নিটশে সুরকার ভাগনার (Wagner) ও তার অপেরার ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। জীবনে পরিত্রাণহীন দুঃখ-যন্ত্রণাই নিত্য-সঙ্গী- একে কেবল অতিক্রম করা যায় শিল্প-সংগীত দিয়ে। কাম্যুর ওপরে নিটশের গভীর প্রভাব ছিল।
প্লেগ উপন্যাসে লেখকের ভেতরের কথা তা-ই। আমাদের জীবন মোটামুটি ভাবে বলা যায় প্রায়-সবসময়ই একটি খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। এই খাদ হতে পারে যে কোনো ধরনের দুর্দৈব, দুর্বিপাক বা দুর্যোগ সংবলিত কোনো ঘটনা; এক অর্থে ঘটনাও নয়- পলকা কোনো সুতোর গ্রন্থি ছিঁড়ে যাওয়া কেবল। এটা হতে পারে আকস্মিক দাঙ্গা, অপ্রত্যাশিত কোনো বৈশ্বিক বা স্থানিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, কোনো অনির্দেশ্য করাল ব্যাধি, কোনো মহামারী, জানা-অজানা স্ট্রেইনের ভাইরাস, কোনো জলোচ্ছ্বাস, কোনো উমপুন, কোনো সর্বগ্রাসী বন্যা, পাহাড় থেকে হঠাৎ নেমে আসা ঢল, প্রখর খরা, আকস্মিক পঙ্গপালের আক্রমণে নেমে আসা খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ, কোনো চোরাগুপ্তা ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থানের অপারেশন সার্চলাইট হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাথার ওপরে বিদ্যুতের জীবন্ত তার ছিঁড়ে পড়া, অথবা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র মতো গাছের নিচে দাঁড়ানো লোকটির মতো বজ্রপাতে ভস্মীভূত হওয়া, গ্যাসের চুলা বা এসির মোটর ফেটে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ড অথবা এক তারা-ঝিলমিল রাতে গাড়িতে-বাসে ঢুলতে ঢুলতে সড়ক দুর্ঘটনা, ট্রেনের লাইন ভেঙে পড়া, আকাশ থেকে অজ্ঞাত কারণে প্লেন ভেঙে পড়া, অথবা রৌদ্র-ঝলমলে দিনে বিদেশি শহরের স্কোয়ারে বেড়ানোর সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ, অথবা ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের মতো হঠাৎ চর জেগে স্টিমারের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমরা ভুলে থাকি- হয়তো ভুলেই থাকতে চাই যে সবসময় যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ঘটনা,মারাত্মক অসুখ আমাদের নিত্যসঙ্গী। ছায়ার মতো দুর্বিপাক আমাদের পিছু পিছু হাঁটছে। আমাদের জীবন আসলে পদ্মপাতার জল। কাম্যু সেটিকে বলেছেন এভাবে- Our lives are fundamentally on the edge of what can be termed as `the absurd’।
উপরের যে-দুর্বিপাকগুলোর কথা বলা হলো তাতে যে কেউ কোনোদিন ব্যক্তিগত বা সমবেতভাবে ‘আক্রান্ত’ হবো, তা কেউ আমরা বিশ্বাস করি না। এ রকম ঘটে থাকে শুনেছি, দেখেছি বা জেনেছি, তবে কিনা এটা ‘আমার জন্য ঘটা সম্ভব নয়, বা ঘটার সম্ভাবনা এতই কম যাকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি। সে রকম ঘটনাকেই ‘অসম্ভব’ (absurd) ধরে নিয়ে আমরা জীবনের পথে চলি। ‘প্লেগ’ উপন্যাসের গল্প গড়ে উঠেছে আলজেরিয়ার সমুদ্র-উপকূলবর্তী শহর ওরান (Oran)-কে ঘিরে। এর অধিবাসীরা কখনো মনে করেনি তাদের শহরে প্লেগের মহামারীর মতো কোনো দুর্দৈব নেমে আসতে পারে। মহামারী সে তো পুরাকালের গল্পের মতো। প্লেগ তো আর দুনিয়াতে নেই- অন্তত পাশ্চাত্যে নেই। এখন প্লেন চলছে মাথার ওপরে, ফোন এসেছে, ট্রাম চলছে, সংবাদপত্র পাঠ হচ্ছে- নিশ্চয়ই সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপের মতো প্লেগের মহামারী দেখা দিতে পারে না এই ‘আধুনিক’ সময়ে? উপন্যাসের এক চরিত্র বলছে, ‘যা হচ্ছে তা প্লেগ হওয়া অসম্ভব- কেননা সবাই জানে পাশ্চাত্য থেকে মহামারী অবলুপ্ত হয়ে গেছে কবেই।’ তার পরপরই লেখক ন্যারেটরের কণ্ঠস্বরে বলছেন, ‘তা অবশ্য ঠিক- কেবল মৃতরাই সে কথা জানত না!’ অন্যত্র লেখক বলছেন (এই উপন্যাসে বর্ণনাকারী হিসেবে তাকে ঘন ঘন আসতে হয়েছে):
‘Pestilence is so common, there have been as many plagues in the world as there have been wars, yet plagues and wars always find people equally unprepared when war breaks out people say: ‘It won’t last, it’s too stupid’. And war is certainly too stupid, but that doesn’t prevent it from lasting.’
ওরান শহরের লোকেরা মনে করত এই মহামারী একটা দুঃস্বপ্নের মতো একদিন কেটে যাবে। তা ছাড়া তারা ভাবত, অন্য সব শহরের তুলনায় তারা এমন বেশি গোনাহ্-এর কাজ করেনি যে, তাদের ওপরেই ঈশ্বরের অভিশাপ বর্ষিত হতে হবে:
‘They continued with business, with making arrangements for travel and holding opinions. Why should they have thought about the plague, which negates the future, negates journeys and debate? They considered themselves free and no one will ever be free as long as there is plague, pestilence and famine.’
ওরান শহরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী ব্যুবনিক প্লেগে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এ বই লেখার জন্য কাম্যু প্লেগ-সংক্রান্ত প্রায় সব জরুরি বইই পড়ে ফেলেছিলেন। কালো মৃত্যু, ১৬২৯ সালের ইতালির প্লেগ, ১৬৬৫ সালের লন্ডন-প্লেগ, ১৮-১৯ শতকের চীনের প্লেগ সম্পর্কে তাকে পড়তে হয়েছিল। একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে যে, নাজি-অধিকৃত প্যারিস/ফ্রান্সকে কাম্যু একটি প্লেগ-কবলিত অবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন। ফরাসি মুক্তিযুদ্ধের পত্রিকা ‘কমবেট’-এর সম্পাদক হিসেবে- Ressistance Fighter হিসেবে তিনি প্লেগের মতো উপন্যাসে হাত দিয়েছিলেন রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণেই। পুতুল ঠরপযু-সরকার তখন ফ্রান্সে ক্ষমতায়, যার পেছনে কাঠখড়ি নাড়ছে নাজি জার্মানি। এরকম অবস্থায় একদল ফরাসি প্রায় উদ্যমই হারিয়ে বসে নাজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। কাম্যুর মতো তরুণ যুবশক্তি তবু মাথা নত করেনি। এই উপন্যাসের মূল নায়ক ডাক্তার রুয়ো (জরবীঁ) প্লেগের মহামারী দেখে পিছপা হননি। মহামারীকে বিধাতার অভিশাপ হিসেবে দেখেননি তিনি। এর মধ্যে দিয়ে কোন ‘নিখিল অভিপ্রায়’ ব্যক্ত হয়েছে- সেটা তিনি মনে করেননি। আজ করোনার কালেও আমরা দেখতে পাচ্ছি- যার-তার করোনার হচ্ছে। যেকোনো লোকই এতে মারা যেতে পারে- এর মধ্যে কোনো ‘ডিজাইন’ নেই, কোনো বাছবিচার নেই, ‘Suffering is randomly distributed’। এর মধ্যে কোনো নীতিনৈতিকতার উপাদান নেই, এর প্রাদুর্ভাব যেকোনো ভাবেই ঘটছে- is simply absurd and that is the kindest thing one can say of it. ডাক্তার তার পরও কাজ করে গেছেন: দিন নেই, রাত্রি নেই পরিশ্রম করেছেন আর্তের সেবার জন্য। রবীন্দ্রনাথের বাসবদত্তাকে মনে আছে? ডাক্তার রুয়ো কোন সন্ন্যাসী উপগুপ্তের মতো পুণ্যবান লোক নন। মারীগুটিকায় ভরে যাওয়া বাসবদত্তার কাছে কিনি কোন পুণ্যাত্মা হয়ে দাঁড়াননি। তিনি এ কাজ করেছেন নিছকই ‘ঔচিত্যবোধে’, তার সুরুচি তাকে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে থাকতে বাধ্য করেছে। কোনো জরা-ক্লিষ্ট রোগীকে ফেলে যাওয়া শোভন নয়। এই একান্ত শোভনীয়তাবোধ (যাকে আমি ঔচিত্যবোধ বলেছি) ডাক্তারকে চালিত করেছে। বইয়ের একটি কেন্দ্রীয় অংশে ন্যারেটর লিখছেন: ‘This whole thing is not about heroism. It’s about decency. It may seem a ridiculous idea, but the only way to fight the plague is with decency.’ আমি এ-ও মনে করি-এই decency নিছক আনুষ্ঠানিক বিধিমালা নির্দিষ্ট দায়িত্ববোধ বা হিপোক্রিট শপথের মধ্যে ব্যক্ত Responsibility থেকে কিছুটা ভিন্ন একটি বিষয়। ইউনাইটেড হসপিটালে সম্প্রতি আইসোলেশন বেডে ৫ জন করোনার রোগী অগ্নিকাণ্ডে মারা গেলেন। তখন সেখানে তাদের দেখাশোনা করার জন্য কোনো ডাক্তার বা নার্স ছিল না। এটা বিধিসম্মত দায়িত্ববোধের অভাব নাকি করোনার রোগী চিকিৎসার বিষয়ে প্রবল অনীহা সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১৬-১৭ বছরের যে-তরুণ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, তারও মনে ভয় ছিল মারা যাওয়ার। মৃত্যুভয় কার না থাকে? কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসতে তার মন সায় দেয়নি (আমার বড় ভাই এমন একটি উদাহরণ ছিলেন)। এ রকম অনেক উদাহরণ আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি। কেন তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে আসতে পারেনি, তার সম্যক কারণ অজ্ঞাত। কোনো জাতীয়তাবাদ বা আবেগ-উদ্বেলিত দেশপ্রেম নয়, হয়তো কাম্যুর কথিত ফবপবহপু বা ঔচিত্যবোধ তাদের সেদিন চালিত করে থাকবে। ওরান শহরের প্লেগ বা আমাদের করোনাকালের ডা. রুয়োর মতো অসংখ্য যোদ্ধার মাথাতেও হয়তো সে রকম কোনো বোধ আজ কাজ করছে।
মহামারীর আরও অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে আছে আধুনিক ইংরেজি, কন্টিনেন্টাল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে। জোসেফ কনরাডের নানা উপন্যাসে, কাফকার দর্শনে-রচনায়, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ এবং ‘হানেড্রড ইয়ার্স অব সলিচুড’, সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপাখ্যানে বড় ভাবে এসেছে জানা ও অজানা মহামারীর অশুভ ছায়া। নাট্যকার চেখভ মারা গিয়েছিলেন যক্ষ্ণা মহামারীতে; কবি গিয়ম আপলেনিয়র, চিত্রকর গুস্তাভ ক্লিমট্ ও সমাজতাত্ত্বিক ম্যাপ ওয়েবার মারা যান স্প্যানিশ ফ্লুতে; এপপ্রেশোনিস্ট ইগন শিয়েল তিনিও মারা যান একই কারণে। চিত্রকর মুনচ (Edvard Munch)-এর Self-Portrait with the Spanish Flu, Self-Portrait after the Spanish Flu I AviI ও আরও কিছু চিত্রকর্ম ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর প্রভাবেই তৈরি হয়েছিল। মহামারীর অসুখ দীর্ঘ ছায়া ফেলে ভার্জিনিয়া ওলফের জীবনে, বিশেষত তার প্রবন্ধে যার নাম অন বিইং ইল। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘গণশত্রু’ (ইবসেনের ‘এনিমি অব দ্য পিপল’-এর রূপান্তর) কলেরা মহামারীকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। অন্ধ বিশ্বাস, প্রচলিত ক্ষমতা, বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা এবং জনগণের প্রতিরোধ সব তর্কই চলে এসেছে তার ছবিতে। এসব রচনাই বিশদ পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে যা আপাতত মুলতবি রইল।
ভবিষ্যতই বলবে যে করোনা মহামারীর পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজ ইতিহাসের কোন ধারাকে শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত করবে। আমাদের দেশে করোনার সংকট কি বড় ধরনের সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক শক্তি হবে- যেমন এটা ঘটে ছিল ১৯১৮-১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ে রাশিয়ায় ও ইউরোপে? নাকি, এখানে নেমে আসবে অরাজক পরিস্থিতি ও চরমপন্থার রাজনীতি, অথবা এর বিপরীতে আসবে কোন স্বৈরতন্ত্রের উত্থান? পোস্ট-করোনা বিশ্বের অংশ হিসেবে আমরা কি মননে-সমাজে-রাষ্ট্রচিন্তায় বিজ্ঞান দ্বারা চালিত হবো নাকি অন্ধ বিশ্বাসের নিয়তিবাদে আস্থা রেখে আরও একটি প্রলয়ের দিকে এগিয়ে যাব? আমাদের নৈতিকতায় কি আরও স্খলন হবে নাকি আমরা সহমর্মী যূথবদ্ধতায় আরও সাহসী হয়ে উঠব- আগামী দিনের যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায়? আমরা কি অবাধ তথ্য-প্রবাহকে উৎসাহিত করব যাতে করে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো দক্ষ ও মানবিক হতে পারে? নাকি আমরা ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত কেন্দ্রীভবন করে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে চলব? ব্যক্তিজীবনে আমরা কি করোনার আগে যেমন, তেমনই আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী পরস্পর-বিচ্ছিন্ন পরমাণু-সদৃশ জীবন যাপন করে চলব, নাকি হবো সামাজিক দায়িত্ব পালনে যত্নশীল এবং ‘অপরের’ অভাব ও সমস্যার প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ? আমরা আসলেই একটা ইতিহাসের মধ্যে আছি।
[এই প্রসঙ্গ সমাপ্ত]