বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৭

পূর্বে প্রকাশিতের পর
কেননা, ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি’ আইন, দর্শন ও রাজনীতি বিজ্ঞানের একটি বহুল-অধীত ধারণা। সুযোগ কী ও কত প্রকারের, কোন সুযোগগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সে কারণেই (সম্পদ কম থাকলে) কোন সুযোগগুলোর ক্ষেত্রে সমতা বিধান সর্বাগ্রে করা উচিত এ নিয়ে পলিটিক্যাল ও মরাল ফিলোসফারদের মধ্যে বেশ খানিকটা মতানৈক্য রয়েছে। আইনী বা আনুষ্ঠানিক সমতা  (Formal equality of opportunity) বনাম বাস্তবিক সমতা  (Substantive equality of opportunity) বা ন্যায়সঙ্গত সমতা  (Fair equality of opportunity), সুযোগের সমতা (equality of opportunity) বনাম সামর্থ্যের সমতা (capability) ইত্যাদি ভেদজ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। নৈয়ায়িক বা ন্যায়বাদী দর্শনে এসব মতপার্থক্যের ব্যবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সেসব আলোচনার বা টেক্সটের পূর্ব-ঐতিহ্য বাংলায় ইতোপূর্বে না থাকায় শুধু ‘সুযোগের সমতা’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের মাধ্যমে সাংবিধানিক (বা আইনি) লক্ষ্য পূরিত হবার নয়। এ জন্যেই আলোচনার জন্য ইংরেজি ও বাংলা পাঠ উভয়ের ওপরেই নির্ভর করেছি। কোন কনসেপ্টের গুরুত্ব মীমাংসা করার জন্য ইংরেজি পাঠের আশ্রয় নিয়েছি, যদিও উদ্ৃব্দতিগুলো থাকছে মূলত বাংলা পাঠ থেকে। আমার আশা যে, এই দ্বি-ভাষিক পাঠের মধ্য দিয়ে ভাবনার অনুবাদ-কর্ম সহজতর হবে।
রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূল নীতি’ (Fundamental Principles of State Policy) অধ্যায়ে সমাজতন্ত্রকে শুধু একটি মৌলিক আদর্শ হিসেবেই গ্রহণ করা হয়নি। এর সংজ্ঞা সরাসরি কোনো ‘মার্কসীয় টেক্সট’ থেকেই গেছে বলে মনে হয়। নতুন সমাজের লক্ষ্য হচ্ছে ‘শোষণমুক্তি’ এবং এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজন ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’। সংবিধানের ১০নং ধারায় লেখা ছিল : ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ এখানে ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ বলতে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বোঝানো হয়নি। তবে রাষ্ট্রীয় খাতের যে বড় একটি অর্থনৈতিক ভূমিকা থাকবে, সেটা ছিল স্পষ্ট। উন্নয়নের পথে রাষ্ট্রের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একথা একমাত্র চরম খোলা-বাজার অনুসারী Libertarianরা ছাড়া সকলেই কমবেশি স্বীকার করে থাকেন। অনগ্রসর এলাকা, পিছিয়ে পড়া মানুষ ও জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্য রাষ্ট্রের হাত-বাড়ানো প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থার ব্যর্থতা, দুর্বলতা ও অনুপস্থিতি যে যে ক্ষেত্রে প্রকট- যেমন জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে- সেখানে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হয়। বাজারমুখীন বিনিয়োগ কর্মকাণ্ড, যেখানে ঋণাত্মক উপচেপড়া প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে (negative externalities and spillovers) সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়। পরিবেশ-দূষণ এবং পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে জনস্বার্থের রক্ষাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, যা কোনো একক বা সমবেত ব্যক্তি খাতের পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু উদ্যোগ ও নেতৃত্ব আসতে হবে রাষ্ট্রের তরফ থেকেই। এসবের বাইরেও ১৯৭২ সালের পটভূমিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকে আরও কিছু বাড়তি দায়িত্ব ও চাপ নিতে হয়েছিল।
প্রথমত, বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিকাশ চেয়েছিলেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ১৯৭২ সালে সংসদে সংবিধান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’র কল্পনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বড় কথা হলো জনকল্যাণ। এই রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র রূপে যাতে গড়তে পারি, সেই লক্ষ্য স্থির রেখে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।’ জনকল্যাণের জন্য ব্যয় নির্বাহের জন্য দরকার প্রয়োজনীয় তহবিলের সংকুলান। একটি অবিকশিত কর-রাজস্ব সিস্টেমের মাধ্যমে তা সেদিন অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এর জন্য যেমন দরকার হয়ে পড়েছিল ‘নন-মার্কেট’ পন্থায় সম্পদের আহরণ, তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দক্ষ ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ‘বাণিজ্যিক’ ভিত্তিতে গড়ে তোলা ও সেসব কর্মকাণ্ডকে সম্প্রসারিত করা। নন-মার্কেট পন্থায় সম্পদ আহরণের উদাহরণ হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম-ভিত্তিক নদী-পুকুর-খাল খনন, রাস্তা-ঘাট মেরামত ও নির্মাণ প্রভৃতি স্থানীয় উদ্যোগের কথা এখানে স্মরণ করা যায়। এই ডাক ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন বিভিন্ন জনসভায়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে ‘বাণিজ্যিক ভিত্তিতে’ পরিচালনা করার গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধ হয়েছিল সেদিন। এর পূর্বাপর ঐতিহাসিক উদাহরণ তৎকালীন নেতৃত্বের সামনেই ছিল। ‘মৌলিক ও ভারী শিল্পে’ তুলনামূলকভাবে পুঁজির পরিমাণ লাগে বেশি। আর এসব খাতে টার্নওভার রেট কম- মুনাফা আসে অনেক দেরি করে- ফলে এসব খাতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের পুঁজিপতিরা উৎসাহিত হয় না। এক্ষেত্রে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশের উদাহরণ তারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাছাড়া সোভিয়েতসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ‘সংস্কারও’ তারা দেখেছিলেন (কোসিগিনের রিফর্মের কথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংসদে তুলেছিলেন)।
দ্বিতীয়ত, ‘মৌলিক ও ভারী শিল্পের’ কারণ ছাড়াও সেকালের ব্যক্তি-পুঁজিবাদী খাতের দুর্বলতাও তারা বিবেচনায় নিয়েছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে পেছনে থেকে আর্থিক বা নৈতিক সহায়তা দানে সক্ষম বাঙালি পুঁজিবাদীদের সংখ্যা ষাটের দশকে ছিল অত্যন্ত নগণ্য। যারা ছিলেন, তাদের বেশির ভাগেরই মিল-কলকারখানা চালানোর মতো অভিজ্ঞতা বা অবিসংবাদিত দক্ষতা ছিল না। আর যাদের কিছুটা দক্ষতা ছিল, তাদের মধ্যে হিন্দু-বাঙালি পুঁজিবাদীদের অংশটি (যেমন ঢাকেশ্বরী কটন মিলের সুনীল কুমার বোস) প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের বৈরী পরিবেশে। বিশেষত ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের কারণে এদের অনেকেই অন্যত্র পুঁজি স্থানান্তরিত করতে থাকেন। সুনীল বোসকে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর গ্রেপ্তার করা হয় এবং কেবল ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরই তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পান। এভাবে পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে ধনিক বাঙালি ‘শিল্প বুর্জোয়া’ বসু-পরিবার স্বাধীনতার পরে শিল্প খাত থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন ও কপর্দকশূন্য হয়ে যায়। আর.পি. সাহার মতো যারা মাঝারিমানের ব্যবসায়ী পূর্ব বাংলায় রয়ে গিয়েছিলেন, তারা পূর্বাপর শিল্প খাতের সঙ্গে তেমনভাবে জড়িত ছিলেন না। ফলে, চাইলেও ১৯৭২ সালে বড় কোনো শিল্পোদ্যোগে এগিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। অন্যদিকে ১৯৩৭-৪৬ পর্বে বাংলার শাসনভার মুসলিম লীগ সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও বাঙালি মুসলিম শিল্প-পুঁজির তেমন কোনো বিকাশ ঘটেনি। বস্তুত ১৯৪৭-৭১ সময় পর্বে পাকিস্তান হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলায় তেমনভাবে বাঙালি মুসলিম শিল্প পুঁজির বিকাশ হয়নি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এসে রাজনৈতিক আনুকূল্যে ও ইপিআইডিসির সহায়তায়- বিশেষ করে পাট ও বস্ত্র খাতে- কিছু বাঙালি মুসলিম মালিকানাধীন কল-কারখানা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। রুশ গবেষক সের্গেই বারানভ ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় থেকে এই ধারার শিল্পোদ্যোক্তাদের ওপরে একটি সমীক্ষা চালান। তার হিসেবে মাঝারি বৃহৎ শিল্প খাতে বাঙালি মুসলিম মালিকানাধীন বিজনেস গ্রুপের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬। চট্টগ্রামের একে খান গ্রুপ ছাড়া সারা পাকিস্তানের পর্যায়ে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা এদের কারোরই ছিল না। এদের অধিকাংশই সেভাবে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামে প্রবলভাবে দাঁড়াননি বা দাঁড়াতে পারেননি (কেউ কেউ সরাসরি বিরোধিতাও করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কালে)। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রস্তুতের সময় আওয়ামী লীগের ভেতরে বাঙালি শিল্পপতির সমর্থক কোনো লবির প্রবল অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মূলত ‘মধ্যস্তরের’ দল হিসেবেই পরিচিত ছিল। ক্ষমতায় আসতে পারে ভেবে যেসব (উঠতি) ধনিকেরা জাতীয়তাবাদী ধারাকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে তাদের ভূমিকা আরও প্রশ্নকীর্ণ হয়ে পড়ে। অবাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা গোষ্ঠীর প্রায় সবাই এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এদের অনেকেরই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় এলাকাতেই কল-কারখানা ছিল। তাদের ফেলে যাওয়া সেই মিলগুলোই ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। এক হিসেবে, তা ছিল ১৯৭২ সালের মোট রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের ৬০ শতাংশ পরিসম্পদের সমান।
তৃতীয়ত, অবাঙালি মালিকানাধীন ‘পরিত্যক্ত শিল্প খাত’ ও বাঙালি মালিকানাধীন ‘দুর্বল’ শিল্প খাত- এ দুটিই একমাত্র বা প্রধান কারণ ছিল না বাহাত্তরের সংবিধানের প্রতিশ্রুত শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত গড়ে তোলার পেছনে। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা পাকিস্তানের তুলনায় এক ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের বাইশ পরিবারের মতো বাংলাদেশেও বৃহৎ শিল্প-বুর্জোয়া বা কার্টেল-মনোপলি গড়ে উঠুক তা তারা কখনোই মনে-প্রাণে চাননি। এরকম মনোপলি পুঁজির প্রভাব বাড়তে থাকায় পূর্ব বাংলার উন্নয়ন কীভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল তা তারা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রাজনীতিতে সামরিক স্বৈরশাসন ও গণতন্ত্রের পৌনঃপুনিক লঙ্ঘনের পেছনে এই বাইশ পরিবারের পরোক্ষ প্রভাব কার্যকর ছিল পূর্বাপর। এসবও তারা তাদের অভিজ্ঞতার বলেই জানতেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সে পথেই আবার গড়াক সেটি তারা চাননি। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্য বিরাজ করেছিল সেদিন। অর্থাৎ উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের প্রধান প্রধান খাতে রাষ্ট্রের ভূমিকার ওপরে বিশেষ জোর দেওয়ার পেছনে ‘বাইশ পরিবার বিরোধিতা’ ছিল একটি প্রধান মনস্তাত্ত্বিক কারণ। আমার মতে, প্রধানতম কারণ। বঙ্গবন্ধু তার নানা বক্তৃতায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন- কী স্বাধীনতার আগে, কী স্বাধীনতার পরে। ১৯৭০ সালের ৭ জুন ঢাকায় এক ভাষণে শেখ মুজিব বলেন :’২২ বছরের ইতিহাস, খুনের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস মীর জাফরের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস, খুবই করুণ ইতিহাস। ইতিহাস গৃহহারা সর্বহারার আর্তনাদের ইতিহাস… ২২ বছর কেটে গেল আমরা জীবন যৌবন ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি কিন্তু পেলাম কি আজ আমরা। আজকে দেশের মধ্যে গ্রামে গ্রামে হাহাকার। … আজকে ২২টি পরিবার পাকিস্তানের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়েছে। গরিব দিন দিন গরিব হয়ে গেছে। বড়লোক দিন দিন বড়লোক হয়ে যাচ্ছে।’ এর ঠিক দুই বছর পরে ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ‘জাতীয়করণ’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবধারিতভাবে উঠে এলো বাইশ পরিবারের কথা :
‘শ্রমিকেরা সারা জীবন শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, ইন্সিওরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছেন। এগুলো জাতীয়তকরণের অর্থ হলো শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দেওয়া। আমরা শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, পশ্চিমাদের হাতে যে সমস্ত কল-কারখানা ছিল তার সব টাকা তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। … আমি এখানে আজ আর একটা কথা ঘোষণা করেছি। সরকার যেসব কারখানা জাতীয়করণ করেছেন, এখন থেকে সেগুলোর প্রত্যেকটির ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে দুইজন করে সদস্য থাকবেন এবং শ্রমিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে এই সদস্যদের বোর্ডে পাঠাবেন। এ ছাড়া বোর্ডে সরকারের এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনজন সদস্য থাকবেন এবং এই পাঁচজন বসে কারখানা চালাবেন। যাই আর হোক না কেন, আদমজী, দাউদ বা আমিনের পকেটে যাবে না।’ শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, বাইশ পরিবারের মতো একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিকাশ রুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের শক্ত ভূমিকা এবং বৃহৎ শিল্প খাতে প্রতিযোগিতা পূর্ণভাবে টিকে থাকতে সক্ষম এমন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কথা নানা প্রান্ত থেকেই বলা হচ্ছিল। কেউ বলছিলেন ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, যেমন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ যুক্তি দিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে :’আজ আমাদের দেশে, অর্থাৎ সাবেক পাকিস্তানে যে সমস্যা ছিল, তা দূর করার জন্য যদি মহানবীর বাণীর শত ভাগের এক ভাগও মেনে নিত, তাহলে কুখ্যাত আদমজি, দাউদ, ইস্পাহানির মতো লোক এ দেশে জন্মলাভ করতে পারত না।’ কেউ আবার যুক্তি দিয়েছেন ইতিহাসের নিকট অভিজ্ঞতা থেকে। ড. কামাল হোসেন পরবর্তীকালে লিখেছেন এ প্রসঙ্গে :’The vision of an independent Bangladesh which had inspirad the freedon fighter, was of a society which would be free from exploitation. They were quite clear that having freed themselves from the infamous ‘22 families’ of Pakistan, they were not going to create ‘22 families’ to take their place in Bangladesh.’

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৬
পূর্বে প্রকাশিতের পর
এই কথাগুলো কিছুটা নির্দয় বিচারই বলে ঠেকবে- বিশেষত যদি আমরা সংবিধান নিয়ে ১৯৭২ সালের গণপরিষদেও নানা আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ককে সামগ্রিকভাবে মাথায় রাখি। কোনো প্রকার আন্তরিকতা বা আত্যন্তিক তাগিদ ছাড়াই শুধু নির্বাচনী জনসমর্থন আদায়ের জন্য গণতন্ত্রের হাত ধরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছিল, এটা বিশ্বাস করা শক্ত। প্রথমত, জনসমর্থন আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রচার করা দোষের কিছু নয়। মানুষ এরকম আদর্শ সমর্থন করে কিনা তা যাচাই করার একটা বড় মাধ্যমই হচ্ছে নির্বাচন। দ্বিতীয়ত, সেদিনের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাদের অভিপ্রায় প্রকাশে আন্তরিক ছিলেন না- একে নিছক লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত বলে মনে হতে পারে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃত্বে বিশেষত বঙ্গবন্ধুর মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছিল। যার চিহ্ন বিভিন্ন দলিলপত্রের আলোচনার মধ্য দিয়ে ইতোপূর্বেই আমরা দেখেছি। ‘সত্তরের নির্বাচনের সময়েই আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো সমাজতন্ত্রের কথা বলে’- লেখকের এই বিচারটিও তথ্যগতভাবে সঠিক নয়। এবং সবশেষে, একটা রক্ষণশীল সমাজে- যেখানে ধর্মের আড়ালে সংস্কারের প্রভাব প্রবল, সেখানে সমাজতন্ত্রের কথা বললে কৃষক-মধ্যবিত্ত সমাজের ভোট বেশি করে পাওয়া যাবে, এটাও তর্কসাপেক্ষ অনুমান। রক্ষণশীলতার এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সমাজে এখনও কাটেনি, তখনও ছিল। তার পরও জনগণের সামনে এনলাইটেনমেন্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন ‘সমাজতন্ত্র’ তথা সামাজিক ন্যায়ের আইডিয়া তুলে ধরতে গিয়ে ষাটের দশকের আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দ্বিধাগ্রস্ত হননি। আধুনিক রাষ্ট্রের সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকে তাঁরা কোনো প্রাগ-আধুনিক ঐতিহ্যগত চিন্তার সাথে জোর করে মেলাতে বা মেশাতে চাননি। সেরকম চেষ্টা তাদের চোখের সামনেই ছিল- ‘গান্ধীবাদী’ সমাজতন্ত্র, ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’, ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র’ বিভিন্ন ধারা ষাটের দশকে চলমান ছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনচেতনা ও ঐতিহ্যের প্রতি অত্যন্ত সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু ঐতিহ্য-রক্ষার নামে সমাজতন্ত্রের ঐতিহ্য-নিরপেক্ষ প্রগতিবাদী ধারণাকে তাঁরা অবমূল্যায়িত করতে চাননি। দুধে জল মিশিয়ে তাকে গ্রহণযোগ্য মোড়কে বিক্রি করতে চাননি- নির্বাচনে জয়লাভের জন্য হলেও। তাঁদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। ফলে, পাকিস্তানের পরিবেশে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জনগণকে কাছে টানার জন্য আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের কথা বলে থাকবে, নইলে তারা বামপন্থি দলগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যেতে পারত, অধ্যাপক চৌধুরীর এই মীমাংসাও যুক্তিসিদ্ধ ঠেকে না। প্রথমত, যেখানে সমাজতন্ত্রের কথা বলে ‘নাস্তিক’ বলে অভিহিত হওয়ার বরং আশঙ্কা আছে, সে রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কেবল জনসমর্থনের তাগিদে শব্দটি প্রচার করেছিল- এই যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। দ্বিতীয়ত, ১৯৭০ সালের প্রেক্ষিতে জনতুষ্টিবাদের যুক্তিও দুর্বল, কেননা সমাজতন্ত্র তখনও গণদাবি হয়ে ওঠেনি। আর বামপন্থি দলের তরফ থেকে প্রতিযোগিতার ভয়? সেটাও আজ কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়। বিশেষত যদি মনে রাখি যে, সত্তরের নির্বাচন বয়কট করেছিল বামপন্থি বলে দাবিদার পিকিংপন্থি ভাসানী ন্যাপ। এটি ছিল মাওলানা ভাসানীর সবচেয়ে বড় এক রাজনৈতিক ভুল- ‘স্ট্রাটেজিক ব্লান্ডার’। যদিও কমরেড হায়দার আকবর খান রনো তাঁর ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে একে ভাসানীর ‘ওয়াক অভার’ দেওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। এমনও হতে পারে যে, পরবর্তী সময়ে (নব্বই বা তৎপরবর্তী) আওয়ামী লীগের ‘বুর্জোয়া’ রূপান্তর দেখে লেখক তার বিরুদ্ধ সমালোচনাকে প্রোথিত করেছেন অতীতে- ১৯৭২ সালের আওয়ামী লীগকে বিচার করার ক্ষেত্রে বা সংবিধানে বিধৃত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের Authenticity যাচাই করার ক্ষেত্রে। এই সূত্রে বলে রাখি, সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমাকে একাধিকবার আশ্বস্ত করেছেন যে, বাহাত্তরের সংবিধানের বেশকিছু ন্যায়সংগত বামপন্থি সমালোচনা সত্ত্বেও- এবং ১৯৭২-৭৫ পর্বে বাস্তবে গৃহীত কর্মসূচির তর্কাতীত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও- সমাজতন্ত্র তথা চার আদর্শ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের আন্তরিক অভিপ্রায় নিয়ে অন্তত তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তাঁর মনে এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কমরেড সেলিম ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে স্বীকার করেন, তবে ব্যক্তিকে তার দল থেকে খুব বেশি বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না- সেটিও বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, তৃতীয় বিশ্বের একটি অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর পথ নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য সাময়িক কালের জন্য ‘একদল’ করতেই হবে, সব সমাজতন্ত্র-অভিমুখীন দেশকেই গণতন্ত্রের প্রচলিত পথ ছাড়তেই হবে- এটা আদৌ আবশ্যক নয়। আবার একদল করলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে- ব্যাপারটা তেমনও নয়। ১৯৭২-৭৫ সালে সিপিবির অভিমতও ছিল তাই। সোভিয়েত ও অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিও সেই বার্তাই দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে- তিনি এটাও আমাকে জানিয়েছেন। মোট কথা, সমাজতন্ত্র অভিমুখে দীর্ঘ পথ চলায় বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক অভিপ্রায় ও আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় ছিল না সেদিনের বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে বা বামপন্থি ন্যাপ-সিপিবি মহলে (সেদিনের গণচীন, যেটি তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি বা তার স্থানীয় সমর্থক গোষ্ঠীদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র)। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের সমতামুখী সমাজের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বিশেষ ধারার প্রতি মনোযোগ দেব। এই ধারাগুলোর ঘনিষ্ঠ বিচার করলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সমৃদ্ধ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ধারা সম্পর্কে তাত্ত্বিক সংশয়ের আর কোনো অবকাশ থাকে না। আজকের বাংলাদেশ যদি বঙ্গবন্ধুর সেদিনের তাত্ত্বিক উপলব্ধিতে ফিরে যেতে পারে, তবে সেটা হবে একটি বড় পাওয়া।
৯. গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারা ও উপধারা
Lost in Translation বলে একটা কথা ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত আছে। তর্জমায় অনেক ক্ষেত্রে মূল পাঠের অর্থই হারিয়ে যায়। যারা বিদেশি ভাষা থেকে কবিতা অনুবাদের কাজে জড়িত, তারা ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেন। তারপরও আমরা অনুবাদের কাজে ব্যাপৃত হই। সেটা শুধু কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত আমরা ‘অনুবাদ’ করে চলেছি- কখনও নিজের কথা অন্যকে বোঝানোর জন্যে, কখনও অন্যের কথা নিজের বোধের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য। সাম্রাজ্যবাদ যখন উপনিবেশে আসে, তখন সে তার ভাষা-সংস্কৃতিকে যথাসাধ্য ‘অনুবাদ’ করে স্থানীয় অধিবাসীকে তার শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে তৎপর হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখনও এই অনুবাদ প্রক্রিয়ার ভেতরে আছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈঠকে, এইড গ্রুপ কনসালটেশনে, প্রবাসে কর্মসংস্থানের দেন-দরবারে প্রতিপক্ষ বুঝে আমাদের ‘অনুবাদ’ করে যেতে হয়, যাতে করে দাতা ও গৃহীতা পরস্পরকে বুঝতে পারে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমরা একেকজন জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনুবাদ-কর্মে নিয়োজিত। আমরা পারস্পরিক ‘সম্পর্কের অনুবাদ’ করে চলি নিজস্ব মূল্যবোধের কাঠামোয়। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য যেটা প্রাসঙ্গিক তা হলো বাহাত্তরের সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক। সুবিদিত যে, সংবিধানটির বাংলা পাঠই আদর্শ পাঠ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং বাংলা সংস্করণই ‘খসড়া’ হিসেবে গণপরিষদে অনুমোদনের জন্য উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানটি আদিতে আসলে বাংলায় লিখিত হয়নি। এটি প্রথমে ইংরেজিতে লিখিত হয় এবং তারপরেই কেবল বাংলায় তর্জমা করা হয়। তর্জমার পর বাংলা পাঠকেই ‘আদর্শ পাঠ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং এ সিদ্ধান্ত হয় যে, যদি কোনো ধারা বা উপধারা বোঝার বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, বিভ্রান্তি বা ‘কনফিউশন’ দেখা দেয়, তবে বাংলা পাঠকেই চূড়ান্ত মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হবে। এ নিয়ে ড. আনিসুজ্জামান তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন :
‘ড. কামাল হোসেন এজেন্ডা পাঠালেন :বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি খসড়া তৈরি করবেন ইংরেজিতে, আমাকে তার বাংলা করে দিতে হবে, শেষ পর্যন্ত বাংলাটাই গৃহীত হবে প্রামাণ্য ভাষ্য বলে। বললাম, একা পারব না, একটা দল চাই। তিনি বললেন, আপনি লোক বেছে নিন।’
আগেই বলেছি তর্জমার দলে আরও ছিলেন কবি ও অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান এবং ড. মযহারুল ইসলাম। সংবিধান তর্জমা করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আনিসুজ্জামান বর্ণনা করেছেন এভাবে :’মনে পড়ে, আইনমন্ত্রীর দপ্তরে এক দুপুরে কামাল আর আমি মুখোমুখি বসে। প্যাডের কাগজে খসখস করে কামাল লিখতে শুরু করলেন সংবিধানের প্রস্তাবনা। এক স্লিপ লেখা হলে সাদা কাগজের সঙ্গে সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি অনুবাদ করতে শুরু করলাম। একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগল দেহে-মনে :এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান-রচনার কাজে হাত দিয়েছি। কামালকে বললাম, অনুবাদটা মাজাঘষা করতে হবে, বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি বললেন, মূলটারও কিছু উন্নতি ঘটাতে হবে, কাল আবার বসব একসঙ্গে। …সংবিধানের কাজে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে পনেরো দিন আমি ঢাকায় থেকেছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে… গণপরিষদ-ভবনে- পরে যা রূপান্তরিত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে- আমাকে একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেটেছে। কখনও বেশি রাত হয়ে গেলে কামালের বাড়ির বসার ঘরে শুয়ে বাকি রাত যাপন করেছি। সকালে সে বাড়িতেই নাশতা করে দ্রুত চলে এসেছি গণপরিষদে।’
এক অর্থে, সংবিধানের খসড়া দুটো ভিন্ন ভাষায় সমান্তরালভাবে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু, সন্দেহ নেই, আগে ইংরেজি টেক্সট তৈরি হয়েছিল, পরে এর বাংলা তর্জমা হচ্ছিল। এ জন্যেই বাংলা পাঠকে আইনত শিরোধার্য করলেও মূল কনসেপ্ট এবং বর্ণনাগুলো যেহেতু ইংরেজিতে হচ্ছিল, এর ইংরেজি পাঠের ওপরেই সাংবিধানিক-আইনি ও দার্শনিক ‘মর্মার্থ’ অনুধাবনের জন্য জোর দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। আমার বলার কথা হলো, সংবিধানের বাংলা পাঠ তখনই সারগর্ভ পাঠ হয়ে ওঠে, যখন আমরা এর মূল ইংরেজি আদি-পাঠকে পাশাপাশি রাখি। যেন বাংলা সংবিধানের প্রতিটি লাইনের ব্যবধানে অদৃশ্য কালিতে লেখা রয়েছে এর ইংরেজি পাঠ। যেন এই ইংরেজি পাঠকে পড়ে এর শব্দগত, প্রত্যয়গত ও গঠনগত অর্থ যথাযথ অনুধাবন করার পরই বাংলা পাঠের দিকে তাকাব কেবল- ইংরেজি পাঠকে চোখের সামনে থেকে মুছে দিয়ে। একই সঙ্গে পড়া এবং মুছে দেওয়া- দেরিদীয় এই ‘Eraser’ প্রকরণ ব্যবহার করেই কেবল সংবিধানের ধারা-উপধারার মর্মার্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে। একটি উদাহরণ এই সূত্রে মনে পড়ছে। বহু বছর আগে যখন অমর্ত্য সেনের ‘জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি’ বইটি হাতে এসে পড়ল, তখন সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম যে, বইটির শেষে অমর্ত্য সেনের নিজের করা একটি পরিভাষার তালিকা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই জানেন যে, বইটি অনূদিত হয়েছিল মূলের ইংরেজি থেকে বাংলায়। কিন্তু অমর্ত্য সেন অনূদিত পাঠটি মনোযোগ দিয়ে দেখে দিয়েছিলেন এবং দেখতে দেখতে বেশকিছু পরিভাষা নির্দেশ করেছিলেন। এর মধ্যে একটির কেবল উল্লেখ করি। ‘পণ্যমোহবদ্ধতা’ টার্মটি তিনি প্রস্তাব করেন মার্কসের ‘Commodity Fetishism’ ধারণাটি অনুবাদের ক্ষেত্রে। যেটা বলতে চাইছি, শুধু পণ্যমোহবদ্ধতা শুনলে আমরা বুঝতে পারব না শব্দটির দ্বারা কী বোঝানো হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের একটি বিশিষ্ট কনসেপ্ট ‘Commodity Fetishism’-এর রূপরেখা ফুটে উঠবে না। পণ্যমোহবদ্ধতা ভালো, কিন্তু ঋবঃরংযরংস ছাড়া সে অচল। এজন্যেই বলেছি- অনুবাদে মূলের চেহারা ঢাকা পড়ে যায় :Lost in Translation।
বাহাত্তরের সংবিধান থেকে একটি উদাহরণ এই সূত্রে মনে আসছে। শাসনতন্ত্রের ১৯(১) ধারায় বলা হয়েছে- ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ কিন্তু ‘সুযোগের সমতা’ উচ্চারণে এর অর্থ সুস্পষ্ট হয় না। কেননা, ইতোপূর্বে বাংলায় ‘সুযোগের সমতা’ ধারণাটিকে কোথাও ব্যাখ্যা করা হয়নি। এর অর্থ জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে এর আদি ইংরেজি পাঠে, যেখানে বলা আছে :’The state shall endeavor to ensure equality of opportunity to all citizens.’ বাংলা পাঠের অর্থ বোঝার জন্য এখানে ইংরেজি পাঠের অবশ্যই অনুগামী হতে হচ্ছে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৫

পূর্বে প্রকাশিতের পর
মোট কথা, সমাজতন্ত্রের মধ্যে গণতন্ত্রের ‘কনটেন্ট’ আরো বাড়াতে হয়, সেটা কি বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার বিচারে, কি বাংলার মানুষের মন-মানসিকতা বিচার করে।
এসবের থেকে কিছুটা ভিন্ন যুক্তি দিয়েছিলেন ময়মনসিংহের আছাদুজ্জামান খান। তার মতে, সংবিধানে যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রস্তাব করা হয়েছে তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো- এর গণতান্ত্রিক ধারাসমূহকে (যথা ব্যক্তি-স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদি যাকে এক কথায় বলা হয়  civil liberty) রাখা হয়েছে ‘মৌলিক অধিকারের’ অধ্যায়ে, আর সমাজতান্ত্রিক ধারাসমূহকে (যথা প্রত্যেকের ‘অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা, মজুরির নিশ্চয়তা, শিক্ষালাভের নিশ্চয়তা, চাকরির সংস্থানের নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়কে) রাখা হয়েছে ‘মূলনীতির’ অধ্যায়ে। ইচ্ছাকৃতভাবেই এগুলোকে মৌলিক অধিকারভুক্ত করা হয় নাই। কেন করা হয় নাই, তার কারণ হচ্ছে যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে এ সমস্ত অর্থনৈতিক অধিকার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে থাকলেও এর বাস্তবায়ন হবে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের সংগতি-সামর্থ্যের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতা প্রভৃতি civil liberty তথা গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ অবিলম্বে দেওয়া সম্ভব হলে সেগুলো মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করাই অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ, এখানে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নযোগ্য বা Gradualist মতবাদ হিসেবে দেখার চেষ্টা হয়েছে। এর ‘গণতান্ত্রিক’ কনটেন্টকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘সমাজতান্ত্রিক’ কনটেন্টকে সংরক্ষণ করার দৃষ্টিকোণ যেটা বিধৃত হয়েছে সেটা দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ। গণতন্ত্রকে এখনই নিশ্চিত করতে হবে, সমাজতন্ত্র আসবে ধীরে ধীরে। এই  Gradualist অ্যাপ্রোচ মালিকানা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদিও সংবিধানে রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানা রাখা হয়েছে, তারপরও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে দীর্ঘকালের জন্য ব্যক্তিগত মালিকানার প্রয়োজনীয়তা থেকে যাবে। চীনের সংবিধানের (অধ্যায়-২ সাধারণ নীতিমালা, ধারা-৫) উদ্ৃব্দতি দিয়ে আছাদুজ্জামান খান দেখালেন যে, সেখানে চার ধরনের মালিকানার অস্তিত্ব আছে- রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী যৌথ মালিকানা, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের একান্ত নিজস্ব মালিকানা এবং পুঁজিবাদী মালিকানা। এই শেষোক্ত মালিকানা সম্পর্কে বেশ দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। তাতে বলা ছিল :
‘The policy of the state towards capitalist industry and commerce is to use, restrict and transform them. Through control exercised by organs of state administration, leadership by the state sector of the economy, and supervision by the masses of the workers, the state makes use of the positive aspects of capitalist industry and commerce which are beneficial to national welfare and the people’s livelihood, restricts their negative aspects which are detrimental to national welfare and the people’s livelihood, and encourages and guides their transformation of state-capitalist economy, gradually replacing capitalist ownership by the whole people.’

এসবের উদ্ধৃতি দিয়ে আছাদুজ্জামান খান এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন :’আমাদের এখানেও পুঁজিবাদী শিল্প ও ব্যবসাকে প্রথমে  protect করে পর্যায়ক্রমে সেগুলোর বিলোপ সাধন করা হবে। আমরাও সেই নীতিই গ্রহণ করেছি। একেবারে তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান :’সমাজতন্ত্র পর্যায়ক্রমে করতে হবে।’ কেননা, ‘আমাদের নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা আছে।’ তা ছাড়া ‘কার্ল মার্কস যা বলেছেন, তা চিরকাল সত্য হবে- তেমন কথা আর স্বীকৃত নয়।’ এবং সে কারণেই ‘মার্কসকে সর্বত্র কপি করা হয়নি।’ এই শেষোক্ত পয়েন্টটা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :’বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ব্যবস্থার অধীনে বিভিন্ন চিন্তাধারা নিয়ে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে।’ এখানে মূল প্রশ্ন হলো, ‘আমরা সমাজতন্ত্রের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করেছি কি না?’ আছাদুজ্জামান মনে করেন, কোনো বাধার সৃষ্টি করা হয়নি। কেননা, রাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলে ‘কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই’ এবং ‘গণস্বার্থে’ কোনো সম্পত্তি ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত (বা সমবায়ী) মালিকানায় নিয়ে আসতে পারেন :’সে জন্যেই আমি বলেছি যে, চীন বা অন্য কোনো দেশের চাইতে বেশি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা আমরা রেখেছি।’ বামপন্থি সমালোচকেরা (সংসদের ভেতরে ও বাইরে) খামোখাই এ নিয়ে মাঠ গরম করা বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন!
সুবিদিত যে, বাহাত্তরের সংবিধানের সবচেয়ে তীব্র ‘বামপন্থি’ সমালোচনা এসেছিল গণপরিষদ সদস্য ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর কাছ থেকে। তবে সংসদের বাইরে থেকেও Dissent এসেছিল। তাতে একটি প্রবল মত ছিল, ‘সমাজতন্ত্রের ধারা’ সংবিধানে রাখার দরকারটাই বা কী? শুধুমাত্র গণতন্ত্র থাকলেই হলো। যুক্তিটা হলো, সত্যিকারের গণতন্ত্র কোনো সমাজে কার্যকর থাকলে সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা এসব কোনোটারই আলাদাভাবে রাখা দরকার হয় না। এ রকম একটি লিবারেল যুক্তি দিয়েছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ। ‘সত্যিকারের গণতন্ত্র’ বলতে কোন ধরনের গণতন্ত্র দরকার তা অবশ্য তিনি স্পষ্ট করেননি তার লেখায়। কিন্তু চার-স্তম্ভের বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক আদর্শকে তিনি অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন এবং উক্ত চার দফাকে সংবিধানে সংযোজন করাকে সরাসরিভাবে ভুল পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন। ‘শেখ মুজিব-নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ পার্টির সর্বাপেক্ষা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ ত্বরিত গতিতে দেশের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা’ এ কথা বলার পর এর ‘বিধানিক ত্রুটি’ কোথায় তা তিনি নির্দেশ করলেন। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থের লেখকের স্বভাবসুলভ ambiguous অবস্থান এখানেও পাওয়া যায়। একদিকে তিনি যা বলতেন, পরের মুহূর্তেই তিনি তার বিপরীতার্থক সম্ভাবনা দেখতে পেতেন। সংবিধান প্রশ্নে এসেও তার এই প্রবণতা চোখে পড়ে। একদিকে আবুল মনসুর আহমদ স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘ডেমোক্র্যাসি, সোশিয়ালিজম, ন্যাশনালিজম, সেকিউলারিজম :এই চারটিকে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হইয়াছে। এর সব কয়টির আমি ঘোরতর সমর্থক। শুধু এমনি সমর্থক না, মূলনীতি হিসেবেও সমর্থক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আধুনিক যুগের সব রাষ্ট্রকেই সেকিউলার ডেমোক্র্যাটিক নেশন-স্টেট হইতে হইবে।’ তার পরের বাক্যেই তিনি মত ঘুরিয়ে ফেললেন :’কিন্তু আমার মত এই যে, এর কোনোটাই সংবিধানে মূলনীতিরূপে উল্লিখিত হইবার বিষয় নয়। গণতন্ত্র ছাড়া আর বাকি সব কটিই সরকারি নীতি; রাষ্ট্রীয় নীতি নয়। দেশে ঠিকমতো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলেই আর সব ভালো কাজ নিশ্চিত হইয়া যায়।’ এই ‘ঠিকমত গণতন্ত্র’-এর স্বরূপ অবশ্য লেখক এখানেও প্রকাশ করেননি। তবে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেই আর সমাজবাদের আলাদা উল্লেখের আবশ্যিকতা থাকে না- এ যুক্তি আজ পাশ্চাত্যের কোনো লিবারেল তাত্ত্বিকই জোর গলায় বলার সাহস পান না। দার্শনিক জন রাউলস বা অমর্ত্য সেনরা তাহলে ন্যায়পরায়ণ সমাজের কথা কেন আলাদা করে আলোচনা করবেন, বা গণতন্ত্রের পাশাপাশি ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’-এর কথা তুলবেন কেন?
যা হোক, আবুল মনসুর আহমদ সে ধরনের যুক্তি-চর্চায় গেলেন না। তিনি ‘অকাট্য প্রমাণ’ হাজির করলেন তার পরিবর্তে (পাঠক লক্ষ্য করুন যে তিনি সচেতনভাবে সমাজতন্ত্র শব্দটি এড়িয়ে ‘সমাজবাদ’ শব্দটিকে ব্যবহার করছেন) :’এই ধরনের একটি বিচ্যুতির কথা বলিয়াই আমি আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের ত্রুটির প্রমাণ দিতেছি। এটা সমাজবাদের বিধান। সমাজবাদ একটা অর্থনীতি। এটাকে সংবিধানের মূলনীতি করার কোনো দরকার ছিল না। যে কোনো গণতন্ত্রী পার্টি যদি সমাজবাদ প্রতিষ্ঠাকে তাদের পার্টি-প্রোগ্রাম রূপে গ্রহণ করেন, তবে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশের জনগণের বিপুল সমর্থন তারা পাইবেনই। তবু আওয়ামী লীগ পার্টি অনাবশ্যকভাবে সমাজবাদকে সংবিধানের মূলনীতি রূপে গ্রহণ করিয়াছেন।’ এবং এ জন্যে তিনি সাক্ষী মেনেছেন ভারতের নেতা নেহরুকে। কথাটা আংশিক সত্যি। নেহরু-আম্বেদকরের ১৯৫১ সালের সংবিধানে সরাসরি সমাজতন্ত্রের কথা মূলনীতি হিসেবে ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও ছিল না। আমরা আগেই দেখেছি, এই দুটি শব্দ ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ১৯৭৬ সালে সংযোজিত হয় মূলনীতি হিসেবে ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ অন্তত এটুকু যোগ করতে পারতেন যে, নেহরু-আম্বেদকরের মূল সংবিধানেই চৎবধসনষব-এ যুক্ত হয়েছিল ৪টি মূলনীতি :
Preamble- :
Justice (social, economic and political), (Liberty of thought, expression, belief, faith and worship), Equality (of status and of opportunity), and Fraternity (assuring  the dignity of individual)। এর মধ্যে  Liberty এবং Fraternity বাদ দিলে Justice এবং Equality সংক্রান্ত ঘোষণা দুটি ছিল সরাসরি ‘সমাজবাদ’ তথা সমতামুখীন সমাজের আকাঙ্ক্ষার সাথে সরাসরিভাবে সম্পর্কিত।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদের কিছু ত্রুটিও হয়েছে বঙ্গবন্ধুর চার-আদর্শকে নিয়ে। তার লেখায় তিনি প্রকারান্তরে দাবি করেছেন- সংবিধানে সংযোজনের আগে আওয়ামী লীগের আর কোনো মেনিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ ছিল না। ইতোপূর্বে আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি, ‘অর্থনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে আওয়ামী লীগের দলিলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা সরাসরিভাবে সন্নিবেশিত হয়েছিল বেশ আগে থাকতেই। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি অবশ্য রাজনৈতিক vocabularyতে আসে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বক্তব্য-বিবৃতি-ভাষণে (এর আগে শুধু অসাম্প্রদায়িকতা ও কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে বৈষম্য না করার কথা ছিল)। লেখক এই মতে পৌঁছাচ্ছেন যে, বঙ্গবন্ধুর চার-আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং সংবিধানের প্রণেতারা এই দাবি করে বরং সত্যের অপলাপ করেছেন। লেখকের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমাদের সংবিধান রচয়িতারা নিজেরা ওই মহান আদর্শকে সংবিধানভুক্ত করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। তাই জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ওই ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন।’ এটা পড়লে লেখকের তথ্যনিষ্ঠা সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ না জেগে পারে না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বঙ্গবন্ধুর চার আদর্শের অবয়ব কালক্রমে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল।
আবুল মনসুর আহমদের সংবিধানের ওপর উপরোক্ত সমালোচনা এসেছিল ‘ডান দিক’ থেকে। অর্থাৎ লিবারেল বা উদারনৈতিক গণতন্ত্রী দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে, ‘বাম দিক’ থেকেও সেদিন সংবিধানের ওপরে অনেক সমালোচনা এসেছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদের ভেতরে থেকে সেসব সমালোচনার অনেকটাই উত্থাপন করেছিলেন। সংসদের বাইরে থেকে বামপন্থি দলগুলোও যার যার মতো করে সেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। কোনটা রাষ্ট্রের মূলনীতি আর কোন কোন দাবি রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হবার দাবি রাখে- এ নিয়ে সেদিন জোর তর্ক-বিতর্ক উঠেছিল। তবে বামধারার অধিকাংশ সমালোচকই (আমি ন্যাপ-সিপিবি ঘরানার কথা বলছি) সেদিনের গণপরিষদের অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিবর্তন বা প্রাতিষ্ঠানিক evolution-এর সাথে সাথে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গিও বদল হতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদ’ বইতে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার সংশয় ব্যক্ত করেছেন এভাবে :’রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তিতে আওয়ামী লীগের যে অত্যন্ত উৎসাহ ছিল, তা মোটেই নয়।… সত্তরের নির্বাচনের সময়েই আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো সমাজতন্ত্রের কথা বলে; সমাজে শোষণ থাকবে না এবং অর্থনীতির লক্ষ্য হবে সমাজতন্ত্র অভিমুখী- এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ওই লক্ষ্যে ব্যাংক-বীমা-বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীনদের কাছে জমি পৌঁছে দেওয়া, কর ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী ঘোষণাতে ছিল। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি আন্তরিক ছিল- এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। এগুলো দেওয়া হয়েছিল নিতান্ত বাধ্য হয়ে। নির্বাচনে জনগণের সমর্থন পেতে হলে জনগণের পক্ষে না বলে উপায় থাকে না। তা ছাড়া বামপন্থি দলগুলো সমাজতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে নিজেদের দিকে টেনে নেবে- এমন আশঙ্কাও ছিল।’
[ক্রমশ]https://googleads.g.doubleclick.net/pagead/ads?client=ca-pub-9442091006829624&output=html&h=250&slotname=9443271832&adk=1331586746&adf=832419000&pi=t.ma~as.9443271832&w=300&lmt=1628144762&psa=1&format=300×250&url=https%3A%2F%2Fwww.samakal.com%2Fnational-election-2018%2Farticle%2F210149669%2F%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%2599%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A7%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25A3%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%2595-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25B0%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25A7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8-%25E0%25A6%2593-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%2596%25E0%25A7%2580-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259C%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2599%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE&flash=0&wgl=1&adsid=ChAI8PWoiAYQhMehqNPvj6IvEjwAD2iaZOefh47pms1-Z9eHrb6_E-7agz-dJRdprKBDHvePmXdx3PSW_dboDZyJ9AptOOxy35t6YCGZlGI&uach=WyJXaW5kb3dzIiwiMTAuMCIsIng4NiIsIiIsIjkyLjAuNDUxNS4xMDciLFtdLG51bGwsbnVsbCxudWxsXQ..&tt_state=W3siaXNzdWVyT3JpZ2luIjoiaHR0cHM6Ly9hdHRlc3RhdGlvbi5hbmRyb2lkLmNvbSIsInN0YXRlIjo3fV0.&dt=1628144726881&bpp=1&bdt=1182&idt=403&shv=r20210802&mjsv=m202108040201&ptt=9&saldr=aa&abxe=1&cookie=ID%3D41f465110656505a-22353dcdafca0002%3AT%3D1628144727%3ART%3D1628144727%3AS%3DALNI_MYweFHM8DCHnzhgcM7jCgXB3R4IKw&prev_fmts=0x0%2C300x250%2C300x250%2C304x250%2C300x250&nras=1&correlator=2247964085113&frm=20&pv=1&ga_vid=1203111009.1628143455&ga_sid=1628144727&ga_hid=1291477603&ga_fc=0&u_tz=360&u_his=1&u_java=0&u_h=1080&u_w=1920&u_ah=1040&u_aw=1920&u_cd=24&u_nplug=3&u_nmime=4&adx=643&ady=4476&biw=1903&bih=937&scr_x=0&scr_y=745&eid=20211866%2C21067496&oid=3&pvsid=418908138783655&pem=873&ref=https%3A%2F%2Fsamakal.com%2F&eae=0&fc=1920&brdim=0%2C0%2C0%2C0%2C1920%2C0%2C1920%2C1040%2C1920%2C937&vis=1&rsz=%7Co%7CoeEbr%7C&abl=NS&pfx=0&fu=0&bc=31&ifi=4&uci=a!4&btvi=3&fsb=1&xpc=9c8dTasLvk&p=https%3A//www.samakal.com&dtd=35549

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৪

পূর্বে প্রকাশিতের পর
চীনের ১৯৪৯ সালের সংবিধানে ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্পষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের অবস্থা চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো নয়। এ জন্যই তাজউদ্দীন বলেছেন, ‘৫০ বছর আগে সোভিয়েট ইউনিয়নের মানুষ যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থার সঙ্গে আমাদের এখনকার অবস্থার তুলনা করতে হবে। ২৫ বছর আগের পূর্ব জার্মানির সঙ্গে আমাদের তুলনা করতে হবে।’ এখানকার সোভিয়েত, চীন বা পূর্ব জার্মানির সঙ্গে তুলনা করে সংবিধান তৈরি করলে চলবে না। বিপ্লবের পরপর যে বিধান ছিল এসব দেশে সেখানে তো ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল- এই হচ্ছে তাজউদ্দীনের যুক্তি। বামপন্থি দলগুলোর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি  historicism-র অনুবর্তী; শুধু যুক্তির খাতিরে না, বিশ্বাস করেন বলেই। যে সমাজ বা দেশের সঙ্গে সাংবিধানিক প্রতিতুলনা করা হবে, তাদের সঙ্গে তুলনীয় পর্যায়ে আমরা আছি কিনা, সেটাই প্রথমে দেখা দরকার :
‘কেউ যদি সোভিয়েট ইউনিয়নের ১৯৪৭ সালের সংবিধানের সঙ্গে তুলনা করে সেই পর্যায়ে আমাদের সমাজতন্ত্রের বিধান করার দাবি জানান, তাহলে আমি বলব যে, সেই সমাজের সেই পর্যায়ে আমরা আছি কিনা, আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের মানসিকতা সেই পর্যায়ে আছে কিনা, সেটা বিবেচনা করতে হবে।’
এ থেকে স্পষ্ট করে বোঝা যায় কেন বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে এক চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন, কেন বলেছিলেন যে, চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেক দূরের পথ, এর জন্যে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
চতুর্থত, সবশেষে তাজউদ্দীন এ-ও বললেন, ‘সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্রের’ কথা যাঁরা বলেন, তিনি তাদের দলে পড়েন না। কেননা, ‘সম্পূর্ণ’ বলা মানে সে আদর্শের বিকাশের গতি অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। দর্শন সম্পর্কে তার অবধানতার পরিচয় পাই এই স্তবকে :
‘সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝা যায়? আমি এটুকু জানি, সমাজতান্ত্রিক দর্শন সম্বন্ধে যে-কেউ যদি বলে, এই জিনিস করলে পরে পূর্ণ সমাজতন্ত্র হয়ে যাবে, তা হলে বলতে হবে যে, ভবিষ্যতে সভ্যতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।’
অর্থাৎ পূর্ণ সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের প্রস্তাবনা হচ্ছে হেগেলীয় End of Histroy প্রকল্পের মতোই সমার্থক চিন্তা। ‘পূর্ণতার’ দিকে আমরা কেবল পৌঁছানোর চেষ্টাই করে যেতে পারি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে- এর বেশি কিছু নয়। স্পষ্টতই, তাজউদ্দীন সমাজতন্ত্রের Idealized version-এ বিশ্বাসী ছিলেন না। সে জন্যেই তার সিদ্ধান্ত হলো, সংবিধানে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন মিশ্র মালিকানা সমন্বিত অর্থনীতির প্রস্তাবনাই সঠিক হয়েছে :
‘ব্যক্তিগত মালিকানা দিয়েছি দেখে সেটার জন্য সমাজতন্ত্র দাবিদার একটা দল বলেছেন যে, এটা সমাজতন্ত্র হয়নি, আবার আর একটা দল বলছেন যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যা দেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি, খুব কম দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত মালিকরা বড় ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, দুই দলের কথায় যখন তারা ভয় পেয়ে যাচ্ছেন, তখন তাদের কারও কথায় কর্ণপাত না করে আমরা যেটা দিয়েছি, সেটাই তাদের গ্রহণ করা উচিত। কারণ, এটা সুসামঞ্জস্য হয়েছে এবং সুসমন্বিত হয়েছে।’
সবশেষে, তাজউদ্দীন হঠকারী ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ দলে দাবিদার বলে গোষ্ঠীর প্রতি দৃষ্টি দিলেন (এই গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালীনই জাসদের জন্ম হবে)। কেন মালিকানা-প্রশ্নে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রাধান্য রেখেই ব্যক্তি খাতের নিয়ন্ত্রিত বিকাশকে উৎসাহ দিতে হবে- এর পেছনে ‘প্র্যাকটিক্যাল নেসেসিটি’ ছাড়াও জনগণের ‘পশ্চাৎপদ মানসিকতার’ দিকেও সচেতন থাকার কথা বললেন তিনি। বিপ্লব ডি-রেইলড হয়ে যেতে পারে এই হঠকারী অতি বামপন্থি শক্তি ও দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির যুগপৎ সাঁড়াশি আক্রমণে। তাজউদ্দীন বললেন :
‘জনাব স্পিকার সাহেব, আপনি জানেন, আমার সমাজের শিক্ষিত এবং তরুণ এবং অত্যন্ত আদর্শবাদী বলে পরিচিত কিছু কিছু লোক- তাদের সংখ্যা বেশি কি কম, তা নির্ণয় করা আমার পক্ষে খুব কঠিন- যে কার্যকলাপ দেখাচ্ছে, সেটা খুবই দুঃখজনক। যেখানে একটা সমাজতান্ত্রিক বিধানে স্বাভাবিকভাবে বলা যায় যে, যৌথ মালিকানা থাকবে, সেই জায়গায় একদিকে তারা প্রগতির কথা বলছে, আর একদিকে অপরের পকেট থেকে কেড়ে পর্যন্ত সম্পদ নিতে, পয়সা নিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এই যে মনোবৃত্তি, এতে আর যাই হোক, সমাজতন্ত্র যে হবে না, তাতে কোনো সন্দেহ নাই।’
এ রকম হতাশার কথা বঙ্গবন্ধুও তার ১৯৭২-৭৫ পর্বের নানা ভাষণে ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ক্ষেদোক্তি করেছিলেন। প্রথমে তিনি চিহ্নিত করলেন পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি ও সমমনা অন্যান্য হঠকারী অতি বামদের :
‘এক রাতের অন্ধকারে গুলি করে মারে, আর বলে রাজনীতি করে। রাতে একজন লোক শুয়ে আছে, তাকে জানালা দিয়ে গুলি করে মারল। বলে আমি বিপ্লবী। তুমি বিপ্লবী, না দাগী চোর? এদের কোনো নীতি নাই, এদের কোনো আদর্শ নাই, এদের কিছুই নাই। এরা বড় বড় কথা বলে।… হাটবাজার, চিনির দোকানে, মুরগির দোকানে, সবজির দোকানে ডাকাতি করে বিপ্লব হয় না। ঐ রণদিভের থিওরি ইট মারো, সেপাইয়ের আস্তানায় ইট মারো, ওয়ালে একটা পাথর মারো, এতে বিপ্লব হয় না।’
এই হটকারী অতি বামপন্থি শক্তির মধ্যে দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক শক্তিও প্রথম থেকেই বা একপর্যায়ে এসে মিশে গিয়েছিল। মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলে আসলে তারা সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে লিপ্ত ছিল। তাদের উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে বলেছিলেন :
‘যারা মনে করেন রাতের অন্ধকারে গুলি করে কিংবা রেললাইন তুলে দিয়ে টেররিজম করে বিপ্লব হয়, তারা কোথায় আছেন তারা জানেন না। … এই টেররিজম দিয়ে দেশের বিপ্লব হয় না, হয় নাই, হতে পারে না। … দুঃখের বিষয়, অনেকে এখনও টেররিজম-এ বিশ্বাস করেন। যাই হোক, ভবিষ্যতে তাদের ভুল ভাঙবে। … আর একটা জিনিস। রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক- তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। … সেই জন্যেই এক মুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আর এক মুখে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পূর্ব আর একটা হচ্ছে পশ্চিম।’
এ ছাড়াও দলের ভেতরে সুবিধালিপ্সু শক্তির অনুপ্রবেশ, দুর্নীতির প্রসার, শৃঙ্খলার স্খলন প্রভৃতি সমস্যার কথা বলেছিলেন সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু। এর থেকে বোঝা যায়, সমাজতন্ত্র গড়ার পথে বাধা কত প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত দিক থেকে আসতে পারে। এর জন্য নতুন মানুষ ও নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। নতুন মানুষ প্রয়োজন- এটা বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীনের জন্য শুধু কথার কথা নয়। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কেন রাতারাতি বা স্বল্পতম সময়ে করা যাবে না সে সম্পর্কে তাজউদ্দীনের সর্বশেষ যুক্তির দিকে এটা আবারও আমাদের ধাবিত করে। ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবরের সেই ভাষণে তাজউদ্দীন তাই স্বীকারোক্তি সুরে বলে উঠেছিলেন :
‘মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত, প্রত্যেকটি মানুষ সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত কেবল আইন লিখে সুষ্ঠুভাবে আমরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। তাই আমি আবার বলছি, বারবার বলতে চাচ্ছি যে, যে সমস্ত প্রগতিশীল দল এবং দেশপ্রেমিক দল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থায় বিশ্বাসী, তাদের কর্তব্য হবে আজকে সেই মানুষ গড়ে তোলা, যে মানুষ সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হবেন, যে মানুষ যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী হবেন। যে মানুষ অপরের থেকে কেড়ে নিয়ে মালিক বনে সমাজতন্ত্রবাদী হওয়ার দাবি করবেন না। ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেই হোন আর যাই হোন, তিনি সেই ব্যক্তিগত পুঁজিবাদী থেকে কোনো অংশে কম দোষী হবেন না, তার চাইতে কোনো অংশেই ভালো মানুষ বলে পরিচিত হবেন না। কাজেই আজকে সেই মানুষ আমাদের সৃষ্টি করতে হবে।’
নতুন মানুষ আগে সৃষ্টি হবে, নাকি নতুন উৎপাদন সম্পর্ক আগে সৃষ্টি হবে, নাকি দুই-ই ‘দ্বান্দ্বিকভাবে’ একত্রে সৃষ্টি হবে- এটি মার্কসীয় সমাজ বদলের তত্ত্বের একটি অতি পুরাতন সমস্যা। সম্ভবত তাজউদ্দীন জানতেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন কতকগুলি বিষয়ীগত (সাবজেকটিভ) ও বস্তুগত (অবজেকটিভ) অবস্থার ওপরে নির্ভরশীল। সাধারণভাবে সমাজতন্ত্রের পূর্বশর্ত সম্পর্কে মার্কস যা বলেছিলেন তা ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। A Contribution to the Critique of Political Economy গ্রন্থের বিখ্যাত ‘ভূমিকায়’ মার্কস লিখেছিলেন :
‘No social order is ever developed before all the productive forces for wihch it is sufficient have been developed, and new superior relations of production never replace older ones before the material conditions for their existence have matured within the framework of the old society.’

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটিও তাই শুধু ইচ্ছাপূরণের বিষয় না হয়ে বিষয়ীগত এবং বস্তুগত পরিস্থিতির বিকাশের ওপরে নির্ভর করে গড়ে উঠবে। এমনটাই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকট সহকর্মীদের দ্বারা প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের সার্বিক আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে। তবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণার মধ্যে কতটুকু গণতন্ত্রের ওপরে জোর দেওয়া হবে, আর কতটুকু সমাজন্ত্রের ওপরে গুরুত্ব দেওয়া হবে, এ নিয়ে সেদিনের গণপরিষদের ভেতরে এবং বাইরে বেশ কিছুটা ভিন্ন মত ছিল। গণপরিষদের ভেতরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন এই বলে যে, প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশের একটা বড় ত্রুটি তার মধ্যে গণতন্ত্রকে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। যদিও সেসব দেশের সাম্প্রতিক ঝোঁক হলো রাষ্ট্রের আরও গণতন্ত্রায়নের প্রতি। এ জন্যে এসব দেশে নানা ধরনের সাংবিধানিক সংশোধনী আসছে। স্ট্যালিন আমলের সঙ্গে ক্রুশ্চেভের আমলে তুলনা করে তিনি বললেন যে, ‘কে ভুল ছিল, কে শুদ্ধ ছিল, বলব না। তবে ক্রুশ্চেভের সময় থেকে মৌলিক মানবিক অধিকার ও গণতন্ত্রকে দেওয়ার জন্য মানুষের একটা প্রচেষ্টা সোভিয়েট রাশিয়ায় চলছে এবং যা আজকে কোসিগিনকে পর্যন্ত করতে হচ্ছে। তাতে বোঝা যায় রাশিয়ায় আজ গণতন্ত্রকে গ্রহণ করার প্রচেষ্টা চলছে এবং কালের উত্তরণে এই প্রবণতা যদি এগিয়ে যায়, তাহলে এমন সময় আসতে পারে, যখন গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব।’ অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মডেল সোভিয়েতের জন্যও প্রযোজ্য। গণতন্ত্র ছাড়া সমাজতন্ত্র আখেরে কার্যকর হয় না এবং সে কারণে এসব দেশের জন্যও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রই চূড়ান্ত পরিণাম হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। তার মানে ধ্রুপদি সমাজতন্ত্রের মডেলে বেশি করে গণতন্ত্রের প্রতি জোর দিতে হবে। এটাই হচ্ছে মূল যুক্তি :’সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নতুন নতুন কর্মপন্থা যারা দেবে, জনগণ তাদেরকেই ভোট দেবে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র হবে- এই আদর্শকে অবলম্বন করে যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারে।’ এম মনসুর আলীও একইভাবে মনে করেছেন যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ‘সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি অবস্থান’। শুধু তাই নয়, সংবিধানে এর সংযোজন সারা বিশ্বেই একটি অনন্য উদাহরণ :’একমাত্র বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে এই যে গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি অবস্থান এবং অগ্রসর হওয়া এটা সম্ভব। কেননা, অস্বীকার করার উপায় নাই যে, যে সমাজতন্ত্র জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটা সত্যিকারের সমাজতন্ত্র হতে পারে না। মানুষের মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, বিকাশ লাভ করে, সেই সমাজতন্ত্রই প্রকৃত সমাজতন্ত্র।’
[ক্রমশ]