বিনায়ক সেন | তারিখ: ০১-০১-২০১১
দারিদ্র্যের নানা বিড়ম্বনা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্ষুধার কষ্ট, চিকিৎসা ও শিক্ষার অভাবের কষ্ট, নিরাশ্রয়ের কষ্ট, ক্রমাগত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার, জাত-পাতের অপমানের ও ক্ষমতাহীনতার প্রকাশ্য-গোপন লাঞ্ছনার কষ্ট। দেখা যাচ্ছে, ক্ষুধার নিরিখই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয় কে দরিদ্র তা বিচারের ক্ষেত্রে। তার পরও পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। বেদের উপাখ্যানে ঋষি বামদেব বলছেন, ‘অভাবের জন্য আমি কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছি, দেবতাদের মধ্যেও কোনো সাহায্যকারী পাইনি। নিজের স্ত্রীকে অপমানিত হতে দেখেছি।’ মানুষ শুধু নয়, পশুরাও ক্ষুধার্ত ছিল সময় সময়। ছান্দোগ্য উপনিষদে কুকুরেরা বলছে, ‘আমরা যাতে খাদ্য পাই সে জন্য সামগান করুন। আমরা ক্ষুধার্ত।’
প্রাক-ব্রিটিশ যুগে দারিদ্র্য যেমন ছিল, দুর্ভিক্ষও দেখা দিত মাঝেমধ্যেই। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘দুর্ভিক্ষের সময় রাজা শস্যবীজ ও অন্ন দিয়ে প্রজাদের অনুগ্রহ করবেন। অন্নের বিনিময়ে দুর্গ বা সেতু নির্মাণ করাবেন বা কর্ম ছাড়াই অন্নদান করবেন।’ উপনিবেশ আমলের গোড়ার দিকে এ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এ এগারো শ ছিয়াত্তরের (১৭৭০) মন্বন্তরের ক্লাসিক বর্ণনা মেলে—সেখানে দস্যুদল যখন ক্ষুধার জ্বালায় শীর্ণ দলপতির মাংস খেতে শুরু করে, তা নরমাংস ভোজের কষ্ট-কল্পিত অনুমান নয়—এ নিয়ে জন শোরের সাক্ষ্যও রয়েছে। যে রাজ্যে সুশাসন নেই অথবা গণতন্ত্র নেই, সেখানে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পরপর ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষগুলো—যাকে মাইক ডেভিস বলেছেন ‘লেইট ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্ট’—শুধু এল নিনোর (খরার) কারণে হয়নি। এর জন্য দায়ী উপনিবেশের শাসন। জন স্টুয়ার্ট মিল মনে করতেন, এটি ছিল কোম্পানির ‘পরোক্ষ’ শাসন উঠে গিয়ে ইংরেজ রাজশক্তির ‘প্রত্যক্ষ’ শাসন গেড়ে বসার প্রতিফল।
কিছুটা অবাক করার মতো যে ‘নব জাগরণের’ বাংলার তাবড় তাবড় রেনেসাঁ-চিন্তকেরা রায়তদের বিদ্রোহ ও ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ নিয়ে যেমন, উনিশ শতকের দুর্ভিক্ষগুলো নিয়েও উচ্চকিত ছিলেন না। হয়তো তা সিডিশনের ভয়ে, অথবা বিষয়-আশয় নিয়ে ভাবিত হয়ে, কেননা এঁদের অনেকেই ছিলেন উঁচু মাইনের সরকারি চাকুরে। রমেশ চন্দ্র দত্তের মতো কেউ কেউ ছিলেন অবশ্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম—ইংরেজি ও বাংলায় একের পর এক বই লিখে গেছেন রায়তের অবস্থা ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে। মহারানি ভিক্টোরিয়ার কাছে দুর্ভিক্ষ নিবারণের উপায় নিয়ে সুবিখ্যাত ‘খোলা চিঠি’ লিখেছেন। তবে আর সবাই সে পথ মাড়াননি। এটি নিশ্চিতই রেনেসাঁর অন্ধকার দিক। আর দারিদ্র্য নিয়ে রেনেসাঁ ছিল একপ্রকার নির্বিকার—কখনো কদাচিৎ বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ‘হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত্তের’ জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া। তবে শুধু রেনেসাঁর তত্ত্বে তালাশ করে লাভ কি, পরবর্তী সময়ে যাঁরা ক্ষমতাসীন ছিলেন, তাঁদের ঘাটতি আরও প্রকট।বাংলায় লিগ মিনিস্ট্রির শাসন সত্ত্বেও ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ এড়ানো যায়নি—যতই সীমিত হোক সে শাসনের চৌহদ্দি। দুর্ভিক্ষ আধুনিক উত্তর-উপনিবেশিক রাষ্ট্রেও ঘটেছে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিভিন্ন লেখা-পত্র থেকে এটুকু স্পষ্ট যে এর জন্য শুধু বিদেশি শক্তিকে দায়ী করা চলে না। যেমনটা সাতচল্লিশের পর খাদ্য-দাঙ্গাগুলো সেদিনের মুসলিম লীগ সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দেয়, সেভাবেই চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ সরকারের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে থাকবে। কেউ একদিন কখনো নিশ্চয় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ইতিহাস—বিশেষত, এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব, যা আমরা এখনো সম্ভবত বহন করে চলেছি, তা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ লিখবেন।
এসব বিচারে, স্বাধীনতার ৪০ বছরে বলতেই হবে, অন্তত তিনটি দিক দিয়ে আমরা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছি। এ কথা তথ্য-পরিসংখ্যানসহ জোরের সঙ্গেই বলা যায় আজ। এক. দুর্ভিক্ষের ছায়া থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। দুই. দারিদ্র্যের মাত্রা অনেকখানি কমে গেছে। তিন. চরম দারিদ্র্যের মাত্রা আরও বেশি করে কমে এসেছে। যদিও এসব অর্জন কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও পরিবেশদূষণের কারণে, যার কারণে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে এসব অর্জনের স্থায়িত্বশীলতা নিয়ে। তার পরও যা অর্জন তা অর্জনই। এবং তা কীভাবে এল, সে কথা আমলে আনা দরকার।
দুর্ভিক্ষ এখন ইতিহাস। এমনকি ‘মরা কার্ত্তিক’ও ইতিহাস হতে চলেছে। নব্বইয়ের দশকে মরা কার্ত্তিক নিয়ে সংবাদ থাকত পত্রিকার পাতায়। মরা কার্ত্তিক ‘নীরব দুর্ভিক্ষ’ কি না এ নিয়ে তর্ক হতো। এর প্রাদুর্ভাবও কালক্রমে কমে এসেছে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের পত্রিকার রিপোর্টাজে মরা কার্ত্তিক অনুপস্থিত। উত্তরাঞ্চলের নদীভাঙনের জেলাগুলোতে একদা দুর্ভিক্ষের গ্রাম ঘুরলে দেখা যাবে, এক দশক আগের তুলনায় কাজের সুযোগ বেড়েছে, আগের তুলনায় গ্রামগুলো থেকে অনেক বেশি হারে কাজের খোঁজে বাইরে যাচ্ছে মানুষ, সরকারি ও এনজিও সংস্থার উপস্থিতিও অনেক বেশি চোখে পড়ে। এমনকি চর এলাকায়ও যাচ্ছে উন্নয়ন-প্রকল্প। কিন্তু নদী এখনো ভাঙে। দুর্ভিক্ষ নেই যদিও, দারিদ্র্যের মাত্রা এসব এলাকায়ই এখনো বেশি।
চার দশক আগে দারিদ্র্যের হার যা ছিল, আজ তা কমে অর্ধেক হয়ে গেছে—যেভাবেই তার পরিমাপ করা হোক না কেন। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই সফলতা স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় অর্জনের একটি। এক হিসাবে, ‘দারিদ্র্যসীমা’র নিচে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর হার ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিল ৮৩ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৪০ শতাংশে। চলতি প্রবণতার ধারণা পেতে হলে বিআইডিএসের ক্রনিক পভার্টি গবেষণার আওতায় ২০০৫-২০১০ সালে জরিপকৃত ৬৪টি গ্রামের এক প্যানেল ডেটার দিকে তাকাতে পারি। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে, ‘সাবজেক্টিভ পভার্টি’র সূচকে গ্রামের দারিদ্র্য গত পাঁচ বছরে আরও ৭ শতাংশ কমে গেছে। মোট কথা, ২০০০-এর দশকে ২০০৭-২০০৯ সালের বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের হার দ্রুত হারে কমে গেছে। দৈনিক কৃষি মজুরি এখন দাঁড়িয়েছে ১৫০ টাকায়—প্রায় পাঁচ সের মোটা চালের সমতুল্য। এই নিরিখে ১৯৮৩-৮৪ সালে দৈনিক কৃষি মজুরি ছিল কেবল আড়াই সের চালের সমতুল্য। এতে করে শুধু মজুরির ওপর নির্ভরশীল এমন জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের মাত্রাও আরও কমে গেছে। অর্থাৎ, ২০০০-এর দশকে শুধু সার্বিক দারিদ্র্য নয়, চরম দারিদ্র্যও কমেছে।
এ কথা বলতেই হবে, স্বাধীনতার ৪০ বছরে দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি হারে কমেছে গণতন্ত্রের গত দুই দশকে। এই কমার সফলতা যেমন বিএনপি দাবি করতে পারে, আওয়ামী লীগেরও সমান দাবি তাতে। কেননা পাঁচ বছর পরপর সরকার বদলেছে—এক দলের সরকারের বিনিয়োগের সুফল আরেক দলের সরকার পেয়েছে। অন্তত এ বিষয়ে এই দুই দলের মধ্যে মতের মিল হবে, এটা আশা করা অসংগত নয়। দারিদ্র্য দূরীকরণে দলীয় সফলতার চুলচেরা সংখ্যাতাত্ত্বিক নিরূপণ সহজ নয়। যেমন সহজ নয় এ ক্ষেত্রে কতটা সরকারের, আর কতটা অসরকারের অবদান তা বের করা। অসরকারি খাতের এনজিও, বেসরকারি খাত, সাধারণ নাগরিক, নারীশক্তি—সবাই এতে ভূমিকা পালন করেছে। দারিদ্র্য কমে যাওয়ার এই সফলতায় নানা ধারা ক্রিয়াশীল—এর মধ্যে রয়েছে দ্রুত নগরায়ণ, তৈরি পোশাকশিল্পের মতো রপ্তানি খাত, বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স, কৃষি খাত, সড়ক অবকাঠামো এবং ক্ষুদ্রঋণ। এসব খাত কেবল দেশজ বিকাশের কাজেই আসেনি, দারিদ্র্য দূরীকরণেও ভূমিকা রেখেছে।
দারিদ্র্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের নীরব অবদানের কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে, যখন ক্ষুদ্রঋণ আবারও কাঠগড়ায়। ক্ষুদ্রঋণ এ দেশের দরিদ্র মানুষের সব সমস্যার সমাধান নয়। কোনো একক পলিসি বা প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্যের সব সমস্যার সমাধান দিচ্ছে—এ দাবি কেউ করেনি। তার পরও ক্ষুদ্রঋণের বিপক্ষে কিছু অন্যায় অভিযোগ মাঝেমধ্যে শোনা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণে দরিদ্র মানুষের কোনো লাভ হয়নি। আমাদের হিসাবে, গত দুই দশকে গ্রামের দারিদ্র্য যতটা কমেছে, তার অন্তত এক-চতুর্থাংশ কমেছে কেবল ক্ষুদ্রঋণের কারণে। চরম দরিদ্র ব্যক্তিরাও এতে লাভবান হয়েছে পরোক্ষভাবে। যে এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ গেছে, সেখানে কৃষি মজুরির হার বেড়েছে আরও বেশি হারে। চরম দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা ক্ষুদ্র ঋণ পেয়েছেন, তাঁদের এক বড় অংশ বর্গা বাজারে প্রবেশ করেছেন—জমি রাখছেন বর্গায় বা বন্ধকে। বস্তুত এক হিসাবে, গত এক দশকে গ্রামে বর্গা বা বন্ধকের অধীন জমির পরিমাণ ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। কৃষি কাঠামোয় এটা একটা নীরব সামাজিক বিপ্লব বলা যায়। এর সুফল পেয়েছে দরিদ্র মানুষ, আর এর পরোক্ষ অর্থায়ন করেছে ক্ষুদ্রঋণ।
তবে সবার দারিদ্র্য যে সমান তালে কমছে, তা কিন্তু নয়। এই বদ্বীপের দেশে এখন দারিদ্র্যের সমস্যা সবচেয়ে বেশি সেসব এলাকায়ই, যেখানে পরিবেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। যেমনটা সমুদ্রবর্তী উপদ্রুত উপকূলে বা বেগবান নদীর পাড়, যেখানে ক্রমাগত ভাঙছে বা হাওর এলাকায়, যেখানে হঠাৎ বন্যায় গ্রাম নিমগ্ন জলপুরী, অথবা আদিবাসী-অধ্যুষিত দুর্গম পাহাড়ে, যেখানে নেই সহজ কাজের সংস্থান। এসব এলাকায় দরিদ্র ব্যক্তিরা সংখ্যায় কম হতে পারে, কিন্তু চরম দারিদ্র্যের মাত্রা এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এদের জন্য আলাদা করে ভাবা প্রয়োজন। এখন আমরা প্রতীক্ষায় আছি—কবে এ দেশে দারিদ্র্য ‘ইতিহাস’ হবে।
বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক।