বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
জবাবে শেখ মুজিব বললেন: শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক্ষায় তোমরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে চাও, করো। কিন্তু আমি সে পথেই যাব না। যে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং কৃষকের সংগঠন ও চেতনার স্তর নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, সে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশায় কালক্ষেপ করতে আমি রাজি নই। এক, প্রথমে পাকিস্তান থেকে সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করব। দুই, এ দেশে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। তিন, সভ্য জগতে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। চার, এমন কতকগুলো অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া উত্থাপন করতে যাচ্ছি যাতে শ্রমিক, কৃষক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মেহনতি মানুষ সকল সম্পদের মালিক হয়; রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বে সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলাম: উপরিউক্ত চারটি দফা যদি আদায়ই হয়, তবে সে তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে না, হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ধরনের একটা কিছু। কিন্তু মেহনতি মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য ও কর্মসূচি দিতে হবে। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত জনগণের অবস্থান কীরূপ দাঁড়াবে সে প্রশ্নেরও বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট জবাব থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচিতে। জবাবে মুজিব বললেন: ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত মানুষের জন্যই তো আমাদের সংগ্রাম। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন এবং তার কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এ দেশে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে যে পারা যাবে না সে সম্পর্কে আমি সজাগ, আমি নিশ্চিত।’ এই ম্যানিফেস্টো-ধারার বিবৃতিকে নিছক ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম’-এর অনুবর্তী বললে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণাটিকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করা হবে। আবার একে প্রথাগত সোভিয়েত-চীনের ধারার সমাজতন্ত্র বললেও অন্যায় করা হবে। উভয় বিচারই তথ্যনিষ্ঠ হবে না। এখানেই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ বিশেষত্ব। কতিপয় গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে যাক এটা যেমন তিনি চান না, তেমনি চান না কোনো একনায়কত্বের শাসন। বর্তমান নিবন্ধ থেকে কয়েকটি প্রবণতা বেরিয়ে এসেছে– যা নিয়ে আরও কাজ করা দরকার– তা এই পর্যায়ে দাখিল করব। ১. উন্নত ধনতন্ত্রের বেশ কিছু দেশে যে ধরনের ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ পাই, বা প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে অতীতে (এবং বর্তমানে কোন কোন দেশে) যে ধরনের ‘স্টেট সোশ্যালিজম’ দেখতে হয়েছে, তার বাইরে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের প্রগতিশীল সহকর্মীদের। এ দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতাই তাঁদেরকে নতুন পথ খুঁজতে বাধ্য করেছিল। ২. এই নতুন পথের নাম ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’। বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশেই একে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের’ পথ হিসেবে। এই সংজ্ঞা বাহাত্তরের গণপরিষদের সংবিধান আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকট সহকর্মীরা বহুবার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘প্রস্তাবনা’ অংশে উল্লিখিত উদ্ধৃতি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে সবচেয়ে যথাযথ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে ধারণ করে: ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা‒ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ ৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহুদিন থেকে। এ বিষয়ে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন কমিটমেন্ট ছিল। এ নিয়ে প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচির’ ঘোষণায় সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট সুষ্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়। এই পূর্ব-ইতিহাস জানলে বুঝতে কষ্ট হয় না কেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের দাবি সাহসের সাথে উল্লিখিত হয়েছিল। নির্বাচনের মুখে কিছুটা বাড়তি ঝুঁকি নিয়েই শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সমাজতন্ত্রের ধারায় সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি তোলার জন্য অসম্ভব সৎসাহস থাকা দরকার। বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রতিকূল ও বিরূপ পরিস্থিতিতে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পরোক্ষভাবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছিল: ‘আমাদের বিশ্বাস শাসনতান্ত্রিক এ কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব। অন্যান্য অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ এই নির্বাচনী ইশতেহারেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল ‘জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলিসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা,’ তবে এ ক্ষেত্রে ‘বেসরকারি পর্যায়ে নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুবিধে’ রাখা হয়েছিল ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য। এ ছাড়া বলা হয়েছিল ‘জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার বিলুপ্তি সাধনের কথা’। পরিষ্কারভাবে অঙ্গীকার দেওয়া হয়েছিল ‘সব প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করার কথা’ এবং সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকের মতোই যাতে ‘সমান অধিকার ভোগ’ করে এই প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ ছিল। অনেকের চোখেই এটি ছিল পাকিস্তানের দুই অংশ জুড়ে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তরফে প্রায় নিশ্চিতভাবেই অতিরিক্ত নির্বাচনী ঝুঁকি নেওয়া, বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে। কিন্তু সমানাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পূর্বাপর অবিচল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের প্রতি এই অঙ্গীকার আরও গভীর হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশ পরিষদের সদস্যবর্গের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহুপূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারও মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।’ ৪. এই পর্যায়ে অবশ্য এটাও বলা দরকার যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণাটির ‘দুই অংশই’ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৭ জুনের ভাষণে স্পষ্ট করে এ কথা বলেছিলেন, ‘আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।’ এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুসারী–যিনি ‘লিবার্টি প্রিন্সিপালকে’ প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং যিনি ভেবেছিলেন ব্যক্তিস্বার্থকে বাদ দিলে প্রগতির চাকা রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। মোট কথা, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার স্বাধীনতার পরে হঠাৎ করে বা কেবল বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালে গড়ে ওঠেনি। দেশি-বিদেশি পারিপার্শ্বিক শক্তির চাপে বা প্রভাবে এটি উদ্ভূত হয়নি। সংবিধানের চার স্তম্ভও তেমনি নিছক স্বাধীনতা পরবর্তীকালের উদ্ভাবন নয়। এর পেছনে ছিল দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরম্পরা, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৫. ধারাবাহিকভাবে গড়ে ওঠা এবং ক্রমাগতভাবে উচ্চারিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পেছনে প্রেরণা এসেছিল বিভিন্ন সূত্র থেকে। নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট একটি পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল ইউরোপের– বিশেষত উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের– ‘সোশ্যাল স্টেট’, ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ প্রভৃতি ধারণার বিকাশের ক্ষেত্রে। পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশের তখনকার দিনের অগ্রগতিও। ১৯১৭ সালের পর থেকেই সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের তরফে কম্পিটিটিভ ‘সোশ্যাল পলিসি’ গ্রহণের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত ধনবাদী নানা দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারা এবং রাশিয়া, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের নানা সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রাথমিক উন্নয়ন সাফল্য এই দুটি দিকই তৃতীয় বিশ্বের সদ্য-স্বাধীন নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারেনি। সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন মুজিবের এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেক আগে থাকতেই। এ ক্ষেত্রে পঠন-পাঠনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা তো ছিলই; কাজে এসেছিল প্রত্যক্ষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও। প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ১৯৫২ সালে তরুণ শেখ মুজিবের নয়াচীন ভ্রমণ, যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকলে কত অনায়াসে সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘সুযোগের সমতা’ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনকে নিশ্চিত করা যায়। যদিও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে মুজিব প্রশংসার পাশাপাশি নয়াচীনের সমালোচনাও করেছেন‒ বিশেষত মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্রের অভাব ঘটছে এই আশঙ্কা করে। যে রকম করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্ট্যালিনের রাশিয়ায় একনায়কের ছায়া দেখতে পেয়ে। ৬. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ওপরে পরোক্ষ প্রভাব এসেছিল বাঙালির ‘সমাজতান্ত্রিক’ ঐতিহ্য ও সাম্যচিন্তার সূত্রেও। রাজনীতি-সচেতন ও সংস্কৃতিমনা শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা বাঙালির ‘প্রগতিশীল’ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিলেন এই ঐতিহ্যের দুটি প্রধান স্তম্ভ। ‘সাম্যের’ বঙ্কিম থেকে ‘লাঙলের’ সাম্যবাদী নজরুল; ‘রাশিয়ার চিঠি’ ও ‘সভ্যতার সংকটের’ রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘সুলতানার স্বপ্নের’ বেগম রোকেয়া; ‘রায়তের কথার’ প্রমথ চৌধুরী থেকে ‘শাশ্বত বঙ্গের’ কাজী আব্দুল ওদুদ বাঙালির প্রগতিশীল চিন্তার প্রবাহে একেকটি মাইলস্টোন। এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। এদের যাপিত জীবন ও লেখনীর মধ্য থেকে একটি সমৃদ্ধ উদারনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচারমুখীন ‘সমাজতান্ত্রিক’ সমাজের আদর্শ ক্রমশ স্পষ্ট অবয়ব নিয়েছিল, যা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের মানসভুবনকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে থাকবে। বিশেষত এদের প্রায় সকলের লেখনীর মধ্যেই ছিল চোখে পড়ার মতো সামন্তবিরোধী ভাবধারা, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। এর ফলে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা এবং সক্রিয় জোট নিরপেক্ষতার নীতি স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সম্মুখসারির ইস্যু হিসেবে চলে আসে। এর সাথে যুক্ত করতে হয় চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। সেসব দেশ-কাঁপানো ঘটনাবলি যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অতিক্রম করতে হয়েছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ; সাতচল্লিশের দেশভাগ; পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক নীতি; পঞ্চাশের দশকের নিরস্ত্রীকরণ ও বিশ্ব-শান্তি আন্দোলন; ‘বাইশ পরিবারের’ সৃষ্টি; রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণ; পূর্ব বাংলার দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন; জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্য; অগণতান্ত্রিক আচরণ ও গণবিরোধী নীতি-পদক্ষেপ ইত্যাদি ছিল জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া তত্ত্বের কিছু জরুরি উপকরণ। এসবই মুজিবকে সমৃদ্ধ করেছে– পূর্বনির্ধারিতভাবে নির্দিষ্ট করেছে বাহাত্তর সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ। এসব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপাদানের বিবরণ ছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ বা আদলকে শুধু অর্থনৈতিক যুক্তির নিরিখে ঠিক স্পষ্ট করে চেনা যায় না। ৭. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কয়েকটি মৌল বৈশিষ্ট্যকে বর্তমান প্রবন্ধে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: (ক) বিভিন্ন ধরনের মালিকানার সহাবস্থান বা ‘মিশ্র অর্থনীতি’; (খ) অর্থনৈতিক বাস্তবতাবাদ বা ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম; (গ) একচেটিয়া (মনোপলি) পুঁজির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান; (ঘ) ‘সুযোগের সমতা (ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি) ও ‘ফলাফলের সমতা’ (‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’); (ঙ) নানামাত্রিক শোষণের অবসান; (চ) তীক্ষ্ণ জোটনিরপেক্ষতা বা ‘র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’; এবং (ছ) ক্রমান্বয়বাদীতা বা গ্র্যাজুয়ালিজম। প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই বিশদ বিচার-বিশ্লেষণের দাবি করে। সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায় এরা এমন কতগুলো দিক তুলে ধরেছে; যা প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মধ্যে নেই, অথবা থাকলেও নিতান্ত অসম্পূর্ণভাবে উপস্থিত। ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে বিভিন্ন মালিকানা-সম্পর্কের একত্রে উপস্থিতি ও তার গুরুত্ব। এর অর্থ, যা কিছু সামাজিক কল্যাণ, কর্মসংস্থান ও গরিবমুখী বণ্টনের জন্য ফলদায়ী হবে সেই মালিকানা-সম্পর্ককেই জনকল্যাণের স্বার্থে স্বীকার করে নেওয়া হবে ‘পরিকল্পনা’ গ্রহণের সময়ে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে বা মালিকানায় থাকবে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত সকল খাত; যা সরাসরিভাবে সামষ্টিক কল্যাণের বা ‘পাবলিক গুড’-এর বণ্টনের সাথে জড়িত। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিপণন-নির্ভর ‘সমবায়ী মালিকানাকে’ উৎসাহিত করা হবে। ব্যক্তিমালিকানাকে যথাবিহিতভাবে বিকশিত হতে দেওয়া হবে, অনেক ক্ষেত্রে তাকে অগ্রাধিকারও দেওয়া যাবে, কিন্তু ব্যক্তিগত পুঁজিপতি শ্রেণিকে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বা প্রভাব-বিস্তার করার মতো অবস্থানে যেতে দেওয়া হবে না। ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজমের নীতি বলছে যা কিছু জনকল্যাণের জন্য উপকারী, সেই নীতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ‘পরিকল্পনা’, ‘বাজার’ এবং ‘সামাজিক উদ্যোগের’ মধ্যে তুলনামূলক ঝোঁক কেমন দাঁড়াবে সেটি ঠিক করবে অর্থনৈতিক প্রয়োজন, প্রশাসনিক সামর্থ্য এবং সেই সময়ের অর্থনৈতিক বিশ্ববাস্তবতা। অর্থাৎ কোনো পূর্বনির্ধারিত ডগমা বা আইডিওলজি নয়, বাস্তবে কোন নীতি কতটা ফলপ্রসূ সেই নিরিখে নীতিমালা নেওয়া হবে বা বদলানো হবে। দারিদ্র্য নির্মূল করা এবং সব পেশার ও জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত মানব-উন্নয়ন নিশ্চিত করাই হবে প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়া যথাসম্ভব গরিববান্ধব প্রবৃদ্ধি ও অপেক্ষাকৃত সুষম বণ্টনের জন্য বাস্তবোচিত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্ত-বিরোধিতা হবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনোমতেই অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাতে কতিপয় ব্যবসা-গোষ্ঠীর একচেটিয়া রাজ বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন/কেন্দ্রীভবন হতে দেওয়া যাবে না। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র তার জাতীয়করণ নীতি, কর-রাজস্ব নীতি, মুদ্রা ও আর্থিক নীতি পরিচালিত করবে। বৃহৎ শিল্প-বাণিজ্য খাতে অনাদায়ী মন্দ ও খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ জড়ো হয়ে থাকলে সেসব উদ্যোগকে ‘মিশ্র মালিকানায়’ নিয়ে আসা সম্ভব। খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ মূল্যের শেয়ার সরকারি মালিকানায় ন্যস্ত করা যায়। প্রযুক্তিগত উন্নতিতে সকল প্রকার প্রণোদনা ও উৎসাহ দেওয়া হবে সকল শ্রেণির উদ্যোক্তাদের জন্য। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু ‘সুযোগের সমতার’ বিধান করলেই চলবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আরও সমতামুখীন হচ্ছে কিনা সমাজ-অর্থনীতি, সেটিও দেখতে হবে। এর জন্য উপযুক্ত আয়-বণ্টন নীতি গ্রহণ করতে হবে; সামাজিক নিরাপত্তা সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে; সবার জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বাস্তবায়ন করতে হবে; সকলের জন্য ‘গ্রহণযোগ্য’ পেনশন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে; সবার জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; মানবপুঁজি বিকাশের মাধ্যমে উন্নত পেশা বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সুবাদে আয়-বৈষম্য বিশেষত ইন্টার-জেনারেশনাল ইনইকুয়ালিটি কমিয়ে আনতে হবে। একই সাথে সমাজের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে কালক্রমে উচ্চ আয়ের মানুষের সাথে এবং অগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমপর্যায়ে যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নেবে রাষ্ট্র। এর জন্য চাই প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পদকর এবং ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ঋণ’ পাওয়ার ব্যবস্থা– সর্বস্তরের পেশা ও শ্রেণির মানুষের জন্য। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে নারীদের ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষের মধ্যে নানাবিধ বৈষম্য দূরীভূত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ছকে কোনো ছাড় নেই। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্র ও তার বিদেশ নীতি পরিচালিত হবে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে। এই নীতি সবার সাথে বন্ধুত্বের নীতিতে বিশ্বাসী, তবে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী। এটি কোনো বহিঃশক্তির অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। এক কথায়, বিদেশ নীতি র্যাডিক্যাল ধারার জোটনিরপেক্ষতার অবস্থানকে অনুসরণ করবে, যেমনটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সময়ে। সবশেষে, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কাছের ও দূরের লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় বিধান করবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কৌশলে কোনো পূর্বনির্ধারিত ছক বা মডেল নেই। এ ক্ষেত্রে কাছের লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নের আশু চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা আর দূরের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, যেখানে প্রাথমিক ও মৌলিক প্রয়োজনই শুধু পূরণ হবে না, জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ বৈষয়িক ও আত্মিক উভয়বিধ বিকাশকে লালন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, সে লক্ষ্যের দিকে রাতারাতি যাওয়া সম্ভব হবে না। যেতে হবে পর্যায়ক্রমে, স্টেপ-বাই-স্টেপ, প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে অতিক্রম করে, অর্থাৎ গ্র্যাজুয়ালি। কেউ বলবেন, নিও-লিবারেল গভর্নমেন্টালিটি বা বাজার অর্থনীতির যুগে এসবই স্বপ্ন, কিন্তু এটি একটি সুন্দর ও সাহসী স্বপ্ন, যার পেছনে ছোটা চলে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা ১৯৭১ সালে এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। আজকের বাংলাদেশেও এর তাৎপর্য অস্বীকার করার নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
১৬.৬। র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রগতিশীল বিদেশনীতি। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি তুলনামূলকভাবে অনালোচিত দিক। এ পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী অবস্থান আরও মনোযোগের দাবি রাখে। ‘এ ক্ষেত্রে কারও সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’ বললে পুরোটা বলা হয় না। এ জন্য বোঝা দরকার বঙ্গবন্ধুর ‘র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর মতো প্রাগ্রসর অবস্থানকে। এটিকে শুধু স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তবতায় গৃহীত এক কুশলী বৈদেশিক নীতি-পদক্ষেপ হিসেবে দেখলে খাটো করা হবে। এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান বঙ্গবন্ধুর মনে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছিল। এর স্পষ্ট প্রতিফলন প্রথম লক্ষ্য করা যায় ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। সেখানে শেখ মুজিব গিয়েছিলেন ‘পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ শীর্ষক শান্তি-সম্মেলনে অংশ নিতে। তরুণ মুজিব তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন? আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, ‘আমরা শান্তি চাই’। কারণ, যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে– যে দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়। যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লক্ষ লোক শৃগাল কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে।” ১৯৫২ সালে লেখা এটি, অথচ ২০২২-২৩ সালের ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে এর প্রাসঙ্গিকতা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়ে গেছে। কয়েকটি উদাহরণ:
১। ১৯৪৯ সালের ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ বলা হয়েছিল: ‘পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ হইতে পৃথিবীকে মুক্ত করার সমস্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানকে অংশীদার হইতে হইবে এবং শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সর্বব্যাপী বিজয় অভিযানকে জয়যুক্ত করিবার জন্য অন্যান্য জনগণতান্ত্রিক ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সর্বপ্রকার প্রগতিশীল ও জনকল্যাণকর আন্দোলন ও কর্মধারায় সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতা করিতে হইবে। দুনিয়ার সমস্ত জালিমদের সহিত সংগ্রাম করিয়া মজলুমদিগকে মুক্ত করাই হইবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য।’
২। নয়াচীন ভ্রমণের এক বছর পরে ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ (শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত) বলা হয়েছিল: ‘তাই আওয়ামী লীগ … সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করিয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নীতির অনুকূলে শান্তি আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। … শান্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়া আওয়ামী মুসলিম লীগ যুগ যুগব্যাপী মানুষের প্রতিভা ও সাধনার প্রতিভূ মানবসভ্যতা রক্ষার জন্য বিশ্বধ্বংসী রণপাগল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ আজ নীতিগতভাবে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির মহান নেতা।’
৩। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে প্রথমবারের মতো শেখ মুজিব উচ্চারণ করেন দলের বিদেশনীতি: ‘সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব, হিংসা কারও বিরুদ্ধে নহে (Friendship to all, Malice to none) আওয়ামী লীগ বৈদেশিক সম্পর্কে এই নীতিতে বিশ্বাস করে। বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযোগিতা প্রদান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড় (static) থাকিতে পারে না। উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষ (Dynamic) এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী। তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীননীতি গ্রহণে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসী।’
৪। ১৯৬৭ সালে গৃহীত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা অর্থাৎ (ম্যানিফেস্টো)’তে বলা হয়েছিল: ‘আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাস করে। সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং একনায়কত্বমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থন থাকিবে।’
৫। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল: “পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোনোমতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না এজন্য আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হয়। আমরা ইতোমধ্যে ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ ও অন্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে, সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।”
৬। বাহাত্তরের সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল: রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায়-অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’ এ-ই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য ‘র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।
১৬.৭। গ্র্যাজুয়ালিজম বঙ্গবন্ধু তাঁর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আরেকটি মৌল বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। সেটির এককথায় নাম– ধাপে ধাপে চলা, পর্যায়ক্রমতা (ইংরেজিতে Gradualism)। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠার পথ এক দীর্ঘ অভিযাত্রার পথ। এখানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে নানামুখী কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। কখনও বাঁয়ে, কখনও ডানে সরে এসে; কখনও দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে, কখনও দ্রুত পথ অতিক্রম করে চলতে হয়। এজন্য ‘বিশুদ্ধপন্থি’ হলে চলে না। একেই মাইকেল হ্যারিংটন (১৯৮৯) অভিহিত করেছিলেন ‘ভিশনারি গ্র্যাজুয়ালিজম’ বলে। এজন্যই খোন্দকার মো. ইলিয়াসকে (পূর্বে-উদ্ধৃত কথোপকথনে) মুজিব বলেছিলেন, ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে’ এ দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দিকে। এই যাত্রাপথে পরিকল্পনা ও বাজার-অর্থনীতি উভয়কেই আশ্রয় করতে হয়; ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সামষ্টিক জমায়েত উভয়কেই উৎসাহিত করতে হয়; স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হয়। সমাজের aspiration এবং custom-culture কে হিসেবে নিতে হয়। এর বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের প্রথম অধ্যায়ে। যেখানে দেশের উন্নয়নের ধারা বেগবান করার জন্য ‘দূরের’ সাম্যবাদী লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ‘কাছের’ উন্নয়ন-সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিটি আমি এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে ধরছি। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য কতগুলো পূর্বশর্ত আলোচিত হয়েছিল। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিলে যথার্থই বলা হয়েছিল যে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দরকার বিদ্যমান পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন: ‘Without this assessment a country may adopt a programme which is unrealistic, either too ambitious or too modest’। বলা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পূর্বশর্তগুলোকে আগে শনাক্ত করতে হবে। যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বা প্রাগ-পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের উচ্ছেদ, সেটা একলহমায় করা যাবে না: ‘Depending upon the objective conditions of the society, this may have to be done in stages’। দলিলে যথার্থই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল উৎপাদন-বৃদ্ধির ওপরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কৃষি উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করাই হচ্ছে আশু কর্তব্য: ‘In an underdeveloped economy such as Bangladesh, the socialist transformation of the economy must accompany the growth of productive forces. It has to be clearly understood that anything which hampers increase in productivity or growth of productive forces and dissipates the meagre resources of the country in unproductive activities and unnecessary consumption is in contradiction with the basic principles of socialism.’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে বেগবান করে ‘productive forces’ কে আগে বিকশিত করে এবং পরে ‘production relations’-এর পরিবর্তনের কাজে হাত দেওয়া সম্ভবত এই ছিল পরিকল্পনাবিদদের মত। পরিকল্পনা দলিলে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আরও যে ফ্যাক্টরের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটি হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র গড়ার ক্যাডার’ গড়ে তোলা। পরবর্তীকালে বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু এই দিকটির প্রতি বিশেষ জোর দেন। পরিকল্পনা দলিলে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছিল, সমাজের মূল্যবোধ সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পক্ষে ব্যাপকভাবে না দাঁড়ালে কখনোই উত্তরণ সফল হবে না: ‘As long as the broad masses are unable to accept the norms of behaviour necessary for a radical transformation of society, no amount of socialist policy adopted by the government can usher in socialism.’ আর সমাজের মূল্যবোধ শুধু সরকারি আমলাদের কাজের মাধ্যমে পরিবর্তন হয় না। এখানে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রশিক্ষিত আত্মনিবেদিত ‘ক্যাডার’ হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এনজিও লিটারেচারের পরিভাষায় এই ক্যাডাররা সমাজ-পরিবর্তনের ‘এনিমেটার’ বা ‘catalytic agent’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা বলে পরিকল্পনা দলিলে মন্তব্য করা হয় যে, কাজটা সহজ নয় আদৌ: ‘Before socialism becomes a reality, the task is to educate the public about the need for social change. The cadres are the instruments through which the task is carried out. We must, however, be aware of the fact that a cadre is as likely to degenerate as any one else.’ কেন এসব সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছিল পরিকল্পনা দলিলে সেদিন? স্পষ্টতই, দলিল-প্রণেতারা কোনো কল্পলোকে বিচরণ করতে চাননি এবং মাঠ-পর্যায়ের বাস্তবতাকে পরিকল্পনার মধ্যে বিবেচনা করতে চেয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘আত্মোৎসর্গ’ করার আহ্বান শুধু সাময়িক কালের জন্য কাজ করে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতকে আগেই উদ্ধৃত করেছি যেখানে তিনি বলছেন স্বার্থকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলে অর্থনীতির চাকা একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মানব-চরিত্রের স্বার্থপরতার দিক এবং সমাজ-কল্যাণে ব্রতী পরার্থপরতার দিক উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন করেই ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যে-কথা দিয়ে তাঁর পরিকল্পনা দলিলের ভূমিকা শেষ করেছিলেন তা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে: ‘Development is a slow and painful process. It means present sacrifice for future gains. It is specially painful for a country at a very low level of living such as Bangladesh where an increasing and significant reliance is to be placed on domestic resources for development. We can make the sacrifice, which is so essential for development, socially tolerable only if it is equitably shared by all.’ এটা বলেই তিনি সতর্ক করলেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের: ‘The room for flexibility is so small, the ability of the socio-economic system to withstand the effects of mistakes and waste is so severely limited that in the use of scarce resources as well as in experimenting with new institutions, great caution and extreme care need to be exercised.’ কৃষিপ্রধান দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার সমস্যা বঙ্গবন্ধু গভীরভাবেই জানতেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কী ধরনের অর্থনীতি সে সম্পর্কে বিদ্বজ্জনের ভেতরেই নানা মত চালু ছিল। সেই অস্পষ্ট আদলের সমাজতন্ত্রে কীভাবে পৌঁছানো যাবে সেটারও কোনো রেডিমেড ব্লুপ্রিন্ট তার হাতে ছিল না সেদিন। তার চারপাশের বুদ্ধিজীবীরাও সেটা স্পষ্ট জানতেন না, যেমন জানতেন না (এবং এখনও বলতে গেলে প্রায় জানেন না) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীরা। শুধু জানতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করে গতিশীল উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর জানা ছিল যে, শোষণমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবেই, এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে আটকে থাকাটাই মানব-ইতিহাসের চূড়ান্ত বিধিলিপি নয়। এখানে ‘চ্যালেঞ্জটা’ এত বড় যে বারবার ‘চেষ্টা’ করা ছাড়া অন্য কোনো সহজ পথ খোলা নেই। ৪ নভেম্বরের গণপরিষদ বিতর্কের সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে তাঁর মনের কথাটি বলেছিলেন: ‘সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েট রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না– অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়। … সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাই– সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পার্শ্বে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান– ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্যদিকে চলেছে। সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখে step by step এগিয়ে যেতে হয়। এক দিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা ৯ মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই– আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
১৭। শেষের কথা এবার বোধ হয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। প্রথমে আসি বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মতাদর্শ প্রসঙ্গে। আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছিল একটি অসাধারণ ‘পলিটিক্যাল টেস্টামেন্ট’, যা থেকে তাঁর অর্থনৈতিক মতাদর্শের স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে-কথাগুলো এখানে তুলে ধরব তা ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের বিশ্বাসের কথা, তাঁর মনের অন্তস্তলের কথা, কাউকে শোনাবার জন্য নয়, এসব তো আদৌ প্রকাশিতব্য ছিল না। এটি নিজের চিন্তাকে কেবল একটি স্থায়ী উপলব্ধির কাঠামো দেওয়ার প্রয়াস, যেটি কখনোই তাঁর মন থেকে মুছে যায়নি, আমৃত্যু যাকে তিনি লালন করেছেন। এখানে তাঁর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। প্রথমে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি: “চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদী সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।” এটিকে কাকতালীয় বিবৃতি বলে মনে করার দরকার নেই। পরবর্তীকালে, ১৯৬৪ সালের কোনো এক সময়ে শেখ মুজিবের সাথে তার কলকাতা জীবনের সতীর্থ ‘মুজিববাদ’ বইয়ের লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের বৈঠক হয়। সে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘পুনরুজ্জীবিত’ আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই এখানে। ‘শেখ মুজিব আমাকে বললেন : তোমরা বামপন্থিরা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু করেছ, সে সংগ্রাম সম্পাদন করতে হবে আমাকেই। তাঁর মুখে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি। আমিও হেসে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম : কীভাবে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধতা করার তৃতীয় কারণটি রাজনৈতিক। ব্যক্তি-উদ্যোগের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে উৎসাহিত করতে হবে জনকল্যাণের স্বার্থে। কিন্তু দেখতে হবে এটি করতে গিয়ে ব্যক্তি-পুঁজি যেন ‘রাষ্ট্রের পলিসি’ নিয়ন্ত্রণ করার মতো রাজনৈতিক অবস্থানে যেতে না পারে। রাজনীতি ও পলিসির রথের ঘোড়ার লাগাম থাকতে হবে রাজনীতিবিদ ও রাজ-কর্মচারীদেরই হাতে–সেখানে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়া চাই। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা এক্ষেত্রে যেমন সজাগ ছিলেন, তেমনি চিন্তিতও ছিলেন এনিয়ে। সেজন্যেই ইতোমধ্যে উদ্ধৃত অংশে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকুই দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না।’ স্বাভাবিকভাবেই একচেটিয়া পুঁজি বা বৃহৎ শিল্প-মালিকদের পক্ষে এই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ আরও বেশি। একথা শুধু বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন আহমদই বলেননি, বলেছেন অন্য সাংসদরাও। মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নিয়ে (১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর) বলেছিলেন, ‘সাবেক পাকিস্তানে যে সমস্যা ছিল, তা দূর করার জন্য যদি মহানবীর বাণীর শত ভাগের এক ভাগও মেনে নিত, তাহলে কুখ্যাত আদমজী, দাউদ, ইস্পাহানীর মতো লোক এদেশে জন্মলাভ করতে পারত না।’ দেখা যাচ্ছে যে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই সেদিনের গণপরিষদে ‘একচেটিয়া পুঁজির’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের পক্ষে সমর্থন জানানো হচ্ছিল। এজন্যেই সংবিধানের ১৩নং ধারায় বলা হয়েছিল যে, কেবল ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যেই’ ব্যক্তি মালিকানাকে অপারেট করতে দেওয়া হবে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু সমাজতন্ত্রই (প্রচলিত মডেলের তুলনায়) অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত হবে তা-ই নয়, এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকেও ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হতে হবে। সেদিনই পুঁজির অন্যায় রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করে তিনি প্রথম উচ্চারণ করলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি। অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণা আছে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাকশাল প্রবর্তনের সময় বুঝি বঙ্গবন্ধু প্রথম ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। বস্তুত এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭২ সালেই। সেদিন তিনি বলেছিলেন: ‘মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলছে দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যেসব provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে– ঐ শোষকরা যাতে protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক schedule-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন। অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারও সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয়ই আমরা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইনসিওরেন্স-কোম্পানি, কাপড়ের কল, জুট-মিল, সুগার ইন্ডাস্ট্রি– সব কিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষক-গোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’ ১৬.৪। ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’ বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এসে পড়েছিল। অন্তত সেগুলোকে বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। তারপরও এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘স্বকীয়তা’ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের গণপরিষদে একটি সার্বিক সচেতনতা বিরাজ করছিল। এই স্বকীয়তাকে ঢাকা থেকে নির্বাচিত আবু মো. সুবেদ আলী প্রকাশ করেছিলেন এভাবে: ‘‘আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিপলস ক্যাপিটালিজম’ গ্রহণ করি নি। আমরা যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটে’ও বিশ্বাস রাখিনি। একটি মাত্র দলের কর্তৃত্বে চীন ও রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র, তাও আমরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করি নি।’’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রেরণা এসেছে। এরকম একটি প্রেরণা হচ্ছে ‘সুযোগের সমতা’। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজের সকল নাগরিকের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ সৃষ্টি করার পাশাপাশি বাস্তবে জীবনযাত্রার মানেও যতটুকু সম্ভব সমতা আনা (যাকে বলা হয়ে থাকে– ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’)। জাতিসংঘের এমডিজি ও এসডিজি-এর কল্যাণে ‘equality of opportunity’ কথাটি এখন বহুল প্রচলিত একটি ধারণা। কিন্তু এদেশে এটির প্রথম সচেতন ব্যবহার হয় ১৯৭২ সালেই। বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় প্রথম উচ্চারিত হয় ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি বা সুযোগের সমতার কথা। সেখানে বলা হয়েছিল: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’। এবং এর আগে ১৫নং ধারায় এই ‘সুযোগের সমতাকে’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল: ‘(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; (খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; (গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং (ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার।’ ১৮(১) ধারায় আলাদা করে পাবলিক হেলথ্ এবং নিউট্রিশন (পুষ্টির) কথাও বলা হয়েছিল: ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ‘পুষ্টির’ এই সংযোজন ছিল একটি বিরল দৃষ্টান্ত। দেখা যাচ্ছে, আজকের ‘সোশ্যাল প্রটেকশনের’ অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের’ কথা বলেছিল। লক্ষণীয় যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলা হচ্ছে‒ এই রাইটস্ বেইজড্ অ্যাপ্রোচের জন্ম হবে আরও বহু পরে। একটি কথা এখানে যোগ করা দরকার। এই যে মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ‘অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-চিকিৎসার’ ধারা বা নির্দিষ্ট করে ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ ১৫ ধারায় বলা হলো এগুলো এলো কোন উৎস থেকে? মার্কসের লেখাটিতে বলা ছিল যে সাম্যবাদী বিকাশের প্রথম বা নিচু পর্যায়ে বণ্টননীতি হবে নিম্নরূপ: ‘From each according to his abilities, to each according to his work’। এখানে প্রত্যেকে যেন তার সামর্থ্যের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারে, এবং কাজের পরিমাণ/গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেতে পারে–এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। মনে হতে পারে, এগুলো বুঝি ইউরোপীয় ‘সোশ্যাল স্টেট’ বা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর ধারণা থেকে উঠে এসেছে। হয়তো পশ্চিম ইউরোপের বা উত্তর ইউরোপের ‘সামাজিক গণতন্ত্রীরা’ এর পেছনে বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ জুগিয়েছেন। আসলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু থেকে এসব দাবি ‘প্রাণের দাবি, বাঁচার দাবি’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছিল। বিশ্বজোড়া সমাজবদলের ডাকও এতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। এই প্রশ্নের একটি মীমাংসা পাই ড. কামাল হোসেনের ব্যাখ্যায়। ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর মৌলিক প্রয়োজন ও অধিকারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন: ‘১৯, ২০, ২১ [ধারা]–এগুলোর ব্যাপারে কারও কোন আপত্তি নেই। কারণ, এগুলো বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধান থেকে সন্নিবেশিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে কর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়। সে সম্পর্কে ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে পাওয়া যায়। এটা সোভিয়েত সংবিধানে রয়েছে।’ এই ৩টি অনুচ্ছেদ (১৫, ১৯ ও ২০) সংবিধানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘সমাজতান্ত্রিক ধারা’। বলে রাখি, ১৯(১) ধারায় ‘সুযোগের সমতা’ এবং ১৯(২) ধারায় ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ এবং ‘নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। যদি ১৯(১) ধারায় বলা হয়ে থাকে সুযোগের সমতা (Equality of Opportunity)-এর কথা, ১৯(২) এবং ২০(১) ধারায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘Equality of Outcome’-এর প্রতি। ২০(১) ধারায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল মার্কসের ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ লেখাটির সূত্র ধরে ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ বণ্টনের নীতি। মোদ্দা কথা, ‘সুযোগের সমতা’ যার উল্লেখ আমরা পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক দর্শনে সুপ্রচুরভাবে পাই (যেমন, জন রাউলস-এর লেখায়) বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সেখান থেকে শুরু করলেও সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেখানে দুর্ভাবনা ছিল জন্মসূত্রে সমাজের বিভিন্ন নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির দুস্তর ফারাক নিয়ে। Initial conditions- এর মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকলে শুধু বর্তমান সময়ে ‘সুযোগের সমতার’ দাওয়াই দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য এবং সামর্থ্যের (capability) বৈষম্য দূর করা যায় না। জন্মসূত্রে ফারাকের সাথে যুক্ত করতে হয় ‘কপালের লিখন’-এর কথাও। অনেকেই আছেন, যারা বিশুদ্ধ দুর্ভাগ্যজনিত কারণে ব্যবসায় সফল হন না, অথবা আকস্মিক ট্রমার কারণে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারেন না– এককথায়, ‘সুযোগের সমতার’ সদ্ব্যবহার করতে পারেন না এক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি, শুধু ‘সুযোগের সমতা’ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। একারণেই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা Equality of Opportunity-এর পাশাপাশি ‘Equality of Outcome’-এর সাংবিধানিক বিধান রেখে গেছেন। এজন্যে তারা ১৯(২) ধারায় ‘সম্পদের সুষম বণ্টন’ নীতি এবং ২০(১) ধারায় মার্কসের ‘শ্রম অনুযায়ী বণ্টন’ নীতি–এ দুই নীতিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আবার পাশাপাশি ১৫(ঘ) ধারায় আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা লাভের গ্যারান্টি দিয়ে গেছেন ‘অধিকারের ভাষা’ ব্যবহার করে। ১৬.৫। নানামাত্রিক শোষণের অবসান বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজের পঞ্চম বৈশিষ্ট্যের রাজনৈতিক ও মানবিক গুরুত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না। এই বৈশিষ্ট্যের মূল কথা নিহিত ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার অঙ্গীকারের মধ্যে। ১৯৭২ সালের ৭ই জুনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের সরলতম সংজ্ঞা দিয়েছিলেন (যেটা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি): ‘এ সমাজতন্ত্র হলো বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।’ এর পূর্বলেখ (geneological trail) অনুসরণ করলে বহু পেছনে চলে যাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালের ‘পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছিল: ‘আওয়ামী লীগের আদর্শ শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।’ ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ছিল ‘শোষণের অবসান অবশ্যই করতে হবে’ এবং তাতে বলা ছিল– ‘বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৪ নং ধারায় উল্লেখ আছে– এটি ড. আম্বেদকরের ভারতীয় সংবিধানেও নেই– ‘‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে–কৃষক ও শ্রমিককে–এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ সবশেষে উদ্ধৃতি দিতে চাই প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিল থেকে। সেখানে প্রথম পরিচ্ছেদের ১.১২ অধ্যায়ের শিরোনামই ছিল– শোষণের হ্রাসকরণ (reducing exploitation)। ব্যাখ্যায় বলা ছিল: ‘Under the prevailing objective conditions elements of exploitation can only be reduced in phases if the productive process is not to be disrupted।’ এখানে বিভিন্ন দলিল থেকে ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার যে অঙ্গীকার তুলে ধরা হলো তা শুধু কথার কথা ছিল না। এই অঙ্গীকার ছিল গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, ‘শোষণ’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে (সংগত কারণেই) ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামের কৃষক জনগোষ্ঠীর ওপরে সামন্তবাদী জমিদারি-জোতদারি-জায়গিরদারি শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও সকল প্রকার ‘অন-অর্থনৈতিক শোষণ’ (extra-economic exploitation) শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। অর্থাৎ শুধু উৎপাদনকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক শ্রেণিসমূহ– যথা, শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ– তাদের ক্ষেত্রেই দৃষ্টি সীমিত থাকেনি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সকল প্রকার ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে অর্থনৈতিক ও অন-অর্থনৈতিক (সামাজিক, সাংস্কৃতিক) শোষণের অবসান অর্থে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে নারীর প্রতি শোষণমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির অবসানের কল্পে। আজকের যুগে সামাজিক-ধর্মীয়-ভাষাগত-জাতিগত-লিঙ্গগত শোষণ-বঞ্চনার–বৃহত্তর অর্থে, আইডেনটিটি-পলিটিক্সের ডিসকোর্সের–অন্তর্গত ন্যারেটিভ হিসেবে পড়তে হবে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘শোষণহীন সমাজ’ ধারণাটিকে। একে শুধু অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা ভাবা ভুল। সংবিধানের ১৪নং ধারায় কৃষক-শ্রমিকের পাশাপাশি ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের’ কথা উল্লেখ ছিল এবং তাদের ওপরে ‘সকল প্রকার শোষণের’ অবসানের সাংবিধানিক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদে বেশ বিতর্কও হয়েছিল সেদিন সাংসদদের মধ্যে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। লারমা চেয়েছিলেন ১৪নং ধারার ‘অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান’ করার প্রতিশ্রুতিকে আরও সুনির্দিষ্ট রূপ দিতে। ১৪নং ধারার পর ১৪ক শীর্ষক একটি নতুন অনুচ্ছেদ তিনি সংযোগ করতে চেয়েছিলেন। তার প্রস্তাবে ছিল নিম্নোক্ত সংযোজনী: ‘১৪ অনুচ্ছেদের পর নিম্নরূপ নতুন অনুচ্ছেদটি সংযোজন করা হোক: ১৪ক। সংখ্যালঘু জাতিসমূহ ও অনগ্রসর জাতিসমূহের (ক) ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণ করা হইবে; (খ) শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ-অধিকার দেওয়া হইবে; এবং (গ) অগ্রসর জাতিসমূহের সহিত সমান পর্যায়ে উন্নত হইবার পরিপূর্ণ সুযোগ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা বিধান করিবেন।’ শেষ পর্যন্ত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংশোধনী-প্রস্তাব গণপরিষদে গৃহীত হলো না। অথচ ভুল শব্দের ব্যবহার (‘সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর জাতি’) সত্ত্বেও একথা তো পরিষ্কার, তিনি শুধু চেয়েছিলেন যে শুধু ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে শোষণের অবসানের প্রতিশ্রুতিই নয়, সেটাকে আরও সাংবিধানিক ভাবে দৃঢ় করা হোক কংক্রিট পদক্ষেপের মাধ্যমে। সেকারণেই তিনি বলেছিলেন, (ক) অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিসংক্রান্ত ‘বিশেষ অধিকার’ সংরক্ষণ করতে হবে; এবং (খ) রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে করে কালক্রমে তারা ‘অগ্রসর’ অংশসমূহের সাথে ‘সমান পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরিপূর্ণ সুযোগ পায়’। সেদিনের আনীত সংশোধনী প্রস্তাবে ‘জাতিসমূহ’ কথাটি বাদ দিয়ে লারমার প্রস্তাবিত মূল কথাগুলো ১৪নং অনুচ্ছেদে বাড়তি অনুচ্ছেদ হিসেবে রাখলে কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না। সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদে এসব কথা তো এমনিতেই ছিল (যেমন ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে)। বরং এটা করা হলে পরবর্তীকালে সৃষ্ট জাতিগত বা নৃগোষ্ঠীগত মনঃকষ্ট তৈরি হওয়ার কোনো যৌক্তিক অবকাশই হয়তো আর থাকত না। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য ‘শোষণহীন’ সমাজ প্রতিষ্ঠার আরেকটি অর্থ হচ্ছে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা বিধান। এটি নানা অনুচ্ছেদেই এসেছে গুরুত্বের সাথে। সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকারের’ অংশে ২৮(১) ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে: (১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ (২) ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টিকে শিক্ষা লাভ, বিনোদন, ‘সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা’ প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকারের বিষয়টি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেসম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-উপলব্ধি ছিল। এজন্যেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নিতে কালবিলম্ব করেননি বঙ্গবন্ধু। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তরুণ মুজিব লিখছেন: “পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট” এই পুরানো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে, তাহা আর নয়াচীনে নাই। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। প্রমাণ করে দিতেছে পুরুষ ও মেয়েদের খোদা সমান শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছে। সুযোগ পেলে তারাও বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ডাক্তার, যোদ্ধা সকল কিছুই হতে পারে।…নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলে-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে।…যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়াছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের ওপরে। নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়াছে জাতিগঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোন কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদগুলোর আলোচনার মূল বার্তা ছিল তিনটি। প্রথমত, প্রথাগত সমাজতন্ত্র ও প্রথাগত (পুঁজিবাদী) গণতন্ত্রের বাইরে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ একটি নিজস্ব অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রয়ে গেছে। মার্কসীয় ও অ-মার্কসীয় উভয় ধারার মধ্য থেকেই এটি যুক্তিতর্ক-রসদ আহরণ করেছে। বার্নস্টাইন থেকে বার্নি স্যান্ডার্স, রবীন্দ্রনাথ থেকে বঙ্গবন্ধু নানাভাবে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ প্যারাডাইম দাঁড় করাতে সাহায্য করেছেন। দ্বিতীয়ত, এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র নানা দেশে নানা রূপ ধারণ করতে পারে দেশ-জাতি-ভূগোল এসব অবস্থা ভেদে। তবে বিভিন্ন সম্ভাব্য রূপ সত্ত্বেও আমরা মোটা দাগে দুটি ‘টাইপ’ আবিষ্কার করতে পারি। প্রথম ‘টাইপটি’ হচ্ছে, উন্নত ধনবাদী দেশের ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’, যার সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষে জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসডিপি)-এর দ্বারা। এই ধারার মূলে ছিল ১৮৯১ সালের ‘এরফুর্ট প্রোগ্রাম’। এই কর্মসূচি ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’-এর অন্তর্ভুক্ত ইউরোপীয় পার্টিসমূহের প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে, ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে বের হয়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিসমূহ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারাকে আরও বলিষ্ঠ ও জনপ্রিয় করে তোলে, এবং এসব দেশে রাষ্ট্রক্ষমতাতেও আসতে সক্ষম হয়। এর প্রভাব পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে এই পারস্পরিক প্রভাবের কারণে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ব্যাপক চর্চার পাশাপাশি গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ প্রতিষ্ঠা পায়। পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের এসব দেশে কথিত সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক ধারণা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ দুইয়ের মধ্যে অন্তিম লক্ষ্যে‒ অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্যও ছিল। যা হোক, যেটা বিশেষভাবে বলা দরকার, প্রথম টাইপের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মডেল তৃতীয় বিশ্বের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক ছিল না। এর মূল কারণ, ইউরোপ ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে অবস্থার মৌলিক পার্থক্য। যেন দুই পৃথিবী দুই ‘ভিন্ন সময়ে’ বাস করছিল: একটি ছিল ‘আধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেমোক্রেসি’ আর আরেকটি ছিল প্রাগ-আধুনিক পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান ‘দুর্বল গণতন্ত্র’। দুই জায়গাতেই শোষণ-বঞ্চনা, শ্রেণিভেদ-জাতিভেদ ছিল, কিন্তু সোশ্যাল কনটেস্ট, জনগণের মূল্যবোধ এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল ভিন্ন। এই শেষোক্ত পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদল কীরূপ দাঁড়াতে পারে তা নির্ধারণের দায়িত্ব এসে পড়ে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের ওপরে। তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কারণে প্রথম থেকেই পুঁজিবাদ-বিরোধিতা ও সমাজতন্ত্র-অভিমুখীনতা একটি স্পষ্ট ধারা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখানে চলছিল রণজিৎ গুহ যাকে বলেছেন‒ Dominance without hegemony, কোনো প্রকার ‘সম্মতি’ আদায় করা ছাড়াই প্রত্যক্ষ নিবিড় শোষণ বা প্রভুত্ব-আরোপ। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বেগম রোকেয়া, প্রমথ চৌধুরী, নজরুল, কাজী আব্দুল ওদুদ, এমনকি পরবর্তীকালে এ দেশের প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক সমাজতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁরা সকলেই গণতন্ত্রও চেয়েছেন, আবার সমাজতন্ত্রও চেয়েছেন– একটির জন্য অন্যটিকে বিসর্জন দিতে রাজি হননি। বঙ্কিম লিখেছেন ‘সাম্য’; রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন (উগ্র) জাতীয়তাবাদ বিরোধী ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধত্রয়ী, ‘রাশিয়ার চিঠি’ এবং ‘সভ্যতার সংকট’; বিবেকানন্দ লিখেছেন ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্র’; নজরুল সম্পাদনা করেছেন বামপন্থি পত্রিকা ‘লাঙল’, লিখেছেন ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ এবং ‘মৃত্যুক্ষুধা’ শীর্ষক রাজনৈতিক উপন্যাস, যেখানে সরাসরিভাবে সর্বহারা, রুশ বিপ্লব ও শ্রমিকশ্রেণির কথা এসেছে; প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন ‘রায়তের কথা’; আবুল হুসেন লিখেছেন ‘বাংলার বলশী’; এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। রাজনীতিবিদেরাও– মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ সবাই বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই আদর্শকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উন্নত ধনবাদী দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বলা চলে না। তারা অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিচার করে বুঝেছিলেন, পশ্চিম ইউরোপের স্টাইলে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, এমনকি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ গঠন করা এ দেশের কোনো সরকারের পক্ষে আর্থিক সামর্থ্যের অভাবের কারণেই প্রায়-অসম্ভব। আবার, তারা এ-ও বুঝেছিলেন যে ভিন্নতর সামাজিক-শ্রেণি কাঠামো, রক্ষণশীল মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি মনোযোগ এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এসবের কারণে বাংলাদেশের মতো সমাজ-পটভূমিতে চীন-সোভিয়েত স্টাইলের অথরেটিরিয়ান সোশ্যালিজমের প্রতিষ্ঠা করাও প্রায়-অসম্ভব প্রস্তাব। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নিকটবৃত্তের সহকর্মীদের জন্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র যেমন একটি সম্ভাবনার আলো দেখিয়েছিল, তেমনি ছুড়ে দিয়েছিল এক বিশাল তাত্ত্বিক ও পলিসি চ্যালেঞ্জ। এসবের প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে স্বাধীনতার আগে ও পরে শেখ মুজিবের বিভিন্ন স্টেটমেন্ট ও ভাষণ; তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ডকুমেন্টস্; ১৯৬৬ সালের ৬-দফা, ১৯৬৯ সালের ১১-দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ও ১৯৭২ সালের সংবিধান; প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিল; স্বাধীনতার পরে স্বল্প সময়ের মধ্যে হাতে নেওয়া প্রতিকূল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বিশ্ব-পরিস্থিতিতে গৃহীত বিভিন্ন নীতি-পদক্ষেপ। এসবের বিচারের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি ‘অবয়ব’ আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। যার তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক ও আদর্শিক প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনেও সুপ্রচুরভাবেই রয়ে গেছে। এর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা অবশ্য বর্তমান প্রবন্ধের আয়ত্তের বাইরে। আমরা প্রবন্ধের এই অংশে শুধু বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রধান সাতটি বৈশিষ্ট্যের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করব। ১৬.১। মিশ্র অর্থনীতি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো এর ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ চরিত্র। যদিও ‘মিশ্র অর্থনীতি’ (mixed economy) শব্দটি তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ডিসকোর্সের ‘লেঙ্কিনে’ প্রবেশ করেনি– বাহাত্তর সালের গণপরিষদ বিতর্কে কদাচিৎ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে– তাহলেও পরিকল্পনাবিদদের ‘অ্যাপ্রোচ’ ছিল এটাই। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা ছিল ‘রাষ্ট্রীয়’, ‘সমবায়ী’ ও ‘ব্যক্তিমালিকানার’ কথা। একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশকে আধুনিক শিল্পোন্নত স্তরে উন্নীত করতে গেলে সচেতনভাবে বহু-গাঠনিকতাকে (multistructuralism) লালন করতে হবে। পশ্চাৎপদ অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ শুধু দীর্ঘই হবে না, এটি হবে বহু-গাঠনিক কাঠামোসম্পন্ন। অর্থাৎ, এখানে যেমন থাকবে খুদে উৎপাদকদের খাত, তেমনি থাকবে সমবায়ী খাত; এর পাশাপাশি থাকবে পুঁজিবাদী খাত নানা টাইপের; আর থাকবে শক্তিশালী ও দক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত। এ সম্পর্কে লেনিন ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ নীতিমালা আলোচনার সূত্রে পথিকৃত আলোচনা করেছিলেন সেখানে থাকতে হবে শক্তিশালী ও দক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত– যেটি পরিকল্পনামতো স্ট্র্যাটেজিক খাতসমূহে বিনিয়োগ করবে এবং জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় আয়/সম্পদ পুনর্বণ্টনমূলক পদক্ষেপও নেবে। স্বাধীনতার উষালগ্নে অবাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল, তাদেরকে জাতীয়করণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। বাংলাদেশে ‘জাতীয়করণ’ নীতি যথেষ্ট কড়াকড়ি করে করা হয়; এজন্যে সংবিধানে ৪৭নং ধারা যুক্ত করা হয় যার বলে যে কোনো শিল্পকে জাতীয় স্বার্থে ‘ন্যাশনালাইজ’ করার এখতিয়ার সংসদকে দেওয়া হয়। কোনো কোর্ট বা বিচার ব্যবস্থা এই জাতীয়করণের উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করতে পারত না। বঙ্গবন্ধু এই কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন। কারণ, তার যৌক্তিক ভয় ছিল যে বিদেশ থেকে কলকারখানার অবাঙালি মালিকরা উচ্চ আদালতে জাতীয়করণের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন। ঠিক একই কারণে বাঙালি মালিকানাধীন ইপিআইডিসি-সমর্থিত মুষ্টিমেয় কলকারখানাকেও জাতীয়করণ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। কেননা, একে তো এদের একটি অংশ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন; তদুপরি যারা করেননি, তাদেরকে তাদের পাকিস্তান আমলের কলকারখানা রাখতে দিলে অবাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানাকে জাতীয়করণ করা যেত না, বা সেটা উচ্চ আদালতে অবধারিতভাবে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। যেহেতু ১৯৭২ সালে এ দেশের বৃহদায়তন কলকারখানার সিংহভাগই (প্রায় ৮০ শতাংশ শিল্প-পরিসম্পদ) ছিল অবাঙালি মালিকানাধীন, এই প্রশ্নে কোনো ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ ছিল না সদ্য-স্বাধীন দেশের সরকারের পক্ষে। এটি বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের মনে ‘হাই-প্রায়োরিটি’ ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত ছিল সেদিন। সংবিধানের খসড়া লেখার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যে দুটো বিষয়ের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেগুলো হলো জাতীয়করণ ও জাতীয়করণকৃত শিল্পের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঝুঁকির বিষয়টি (অন্যটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা দমন ও ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব)। অন্য আরেকটি বিষয়ও বঙ্গবন্ধুর তৎকালের উদ্বেগের কারণ ছিল। সেটি হচ্ছে Floor Crossing নিবারণের জন্য ৭০ নম্বর ধারা। বিষয়টি জটিল। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলের তিক্ত স্মৃতি মুজিবের মনে জাগরূক ছিল। ১৯৫০-র দশকে ‘ফ্লোর ক্রসিং’-এর কারণে প্রায়ই মন্ত্রিসভা ভেঙে যেত এবং সরকারের পতন হতো। সরাসরি সম্পর্কিত নয় বলে সেটি এখানে আলোচনা করা হলো না। আনিসুজ্জামান (২০১৫) লিখেছেন: ‘১৯৭২ সালে বাজেট-বক্তৃতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ বিশেষ শিল্প ও বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাছাড়া ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় এবং তার আগে-পরে নানা দলের ইশতেহারে কিংবা নানারকম সম্মেলনের প্রস্তাবে ব্যাংক, বীমা, চা ও পাটশিল্প প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি ছিল। এ নিয়ে বড় একটা আপত্তিও শোনা যায়নি। কিন্তু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন প্রধান প্রধান শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হলো, তখন ‘গেল, গেল’ রব পড়ে গেল এবং এই ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্যে ভারতের স্বার্থ বা ইঙ্গিত আবিষ্কৃত হলো। সমালোচনা প্রবল হয় বাঙালি মালিকানাধীন শিল্প অধিগ্রহণ করায়। কিন্তু ব্যাংক-ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি পরিচালনাধীন ব্যাংক তার থেকে বাদ দেওয়া কিংবা পাটশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি মালিকানাধীন পাটশিল্প তার আয়ত্তের বাইরে রাখা তো সম্ভবপর ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান আমলের সরকারি উদ্যোগ এবং পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি …।’ ‘গেল, গেল’ রব সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের বক্তব্য আরও খতিয়ে দেখা দরকার। সেসময়ের দৈনিক পত্রপত্রিকা (‘হলিডে’, ‘হককথা’ সহ) ঘেঁটে আমি এর সপক্ষে কোনো ‘প্রকাশিত প্রমাণ’ পাইনি। বরং ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি জাতীয়করণ কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে অতি অল্পই ‘বিরুদ্ধতা’ শনাক্ত করা যায়। জাতীয়করণ করার কারণে রাতারাতি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের চৌহদ্দি বেড়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত শক্তিশালী করা হলেও এই মডেলের সাথে ‘স্টেট-সোশ্যালিজম’ ধারার এক মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্রের ছকে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত বৃহদায়তন কলকারখানার প্রায় ১০০ শতাংশ জাতীয়করণ করে নেয়। কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ– যথা সোভিয়েত ইউনিয়নে– মাঝারি শিল্পের পুরোটাই রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পকে প্রায় পুরোপুরিভাবে ব্যক্তি খাতে রাখা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রমশ ‘সিলিং বাড়িয়ে’ বৃহদায়তন শিল্প-বাণিজ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন উদ্যোক্তা শ্রেণির পলিসি গ্রহণের মাত্রা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার মাত্রাকেও (level of entrepreneurship) বিবেচনায় নিতে হবে। রুশ গবেষক সের্গেই বারানভের মতে, পাকিস্তান আমলের শেষে বৃহদায়তন শিল্প খাতে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা একেবারেই হাতে-গোনা ছিল নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মাত্র ১৬টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপ। বাদবাকি যারা বাঙালি উদ্যোক্তা ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী বা ইন্ডেন্টার, যাদের আধুনিক কলকারখানা চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ১৯৭২ সালে। এটি বিশিষ্ট শিল্পপতি সালমান এফ রহমানও একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন। এই ধারার ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কাছে ইচ্ছে করলেই চটজলদি বৃহদায়তন শিল্প– তা সে একদা অবাঙালি মালিকানাধীন ‘পরিত্যক্ত’ কারখানাই হোক, আর নতুন করে সরকারি ব্যাংক-অর্থায়িত শিল্পই হোক– নিঃশর্তে ছেড়ে দেওয়া যেত না। এটাই প্রধান কারণ কেন ১৯৭৬-১৯৮১ পর্বে অ-সমাজতান্ত্রিক জেনারেল জিয়ার আমলে কোনো কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়কৃত করা হয়নি– এমনকি পাকিস্তান আমলের বাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানাগুলোও ঐ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। জিয়া চেষ্টা করেছিলেন সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ ঢেলে নতুন শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণি সৃষ্টি করার, যারা ভবিষ্যতে আধুনিক কলকারখানা চালাতে সক্ষম হবেন। এই নীতি সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৭৬-৮১ পর্বে প্রদত্ত ১০০০ কোটি টাকা শিল্পঋণের ৯০ শতাংশই আর কখনোই ব্যাংকে ফেরত আসেনি এবং সেদিনের ঋণগ্রহীতাদের ৯৬ শতাংশই ছিলেন আউটরাইট ডিফল্টার। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, ১৯৭২-৭৫ পর্বে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণির ‘বিকাশের মাত্রা’ বিবেচনায় বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রদত্ত ‘সিলিং’ যথোপযুক্তই ছিল অর্থাৎ বেশিও ইনসেনটিভ দেওয়া হয়নি, কমও ইনসেনটিভ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাখ্যাই যথার্থ: ‘ব্যক্তিগত মালিকানা দিয়েছে দেখে সেটার জন্য সমাজতন্ত্রের দাবিদার একটা দল বলেছে যে, এটা সমাজতন্ত্র হয়নি, আবার আর একটা দল বলেছে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যা দেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি, খুব কম দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত মালিকরা বড় ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, দুই দলের কথায় যখন তাঁরা ভয় পেয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁদের কারও কথায় কর্ণপাত না করে আমরা যেটা দিয়েছি, সেটাই তাঁদের গ্রহণ করা উচিত। কারণ, এটা সুসামঞ্জস্য হয়েছে এবং সুসমন্বিত হয়েছে।’ ১৬.২। ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম প্রথাগত সমাজতন্ত্রের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো এটি রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অর্থনৈতিক উদ্যোগকে পূর্বনির্ধারিত আদর্শের বা আইডিওলজির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে একটি প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছে। এই প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মতো ১০০% বা ৮০-৯০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার’ অর্থনীতি না করে মালিকানা-সম্পর্কের (property relations) বিষয়টিকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত করা। কৃষিপ্রধান ও বন্যা/দুর্যোগপ্রবণ অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির অপরিসীম গুরুত্ব বঙ্গবন্ধুর নানা বক্তৃতায় সেসময়ে উঠে এসেছে। এর জন্য সবধরনের মালিকানা-সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছিল মুজিব সরকার। দ্বিতীয় কথা হলো, বিভিন্ন ধরনের মালিকানার মধ্যে ‘অনুপাত’ কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। কোনটা কখন কোন খাতে প্রাধান্য পাবে, সেই প্রশ্নটিকে কালক্রমে পরিবর্তনযোগ্য বলে ভাবা হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে সরকারি-বেসরকারি-সমবায়ী খাতের মধ্যে তুলনামূলক গুরুত্ব পরিবর্তিত হবে এটাই ছিল উপলব্ধি। গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য– উদাহরণস্বরূপ বলছি– ব্যক্তিমালিকানাধীন স্ব-উদ্যোগের পাশাপাশি সমবায়ী-উদ্যোগ বা গ্রুপ-উদ্যোগ বা যৌথ-উদ্যোগের ভূমিকা সময়ের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মোট কথা, বিভিন্ন মালিকানা সম্পর্কের মধ্যে রেশিও (Ratio) কী দাঁড়াবে, ‘পরিকল্পনা’ ও ‘বাজার’-এর মধ্যে তুলনামূলক ঝোঁক কীরূপ হবে, তা খাতভেদে এবং সময়ের সাথে বদলাবে। দেশের মানুষের পছন্দ-অপছন্দও এখানে বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি বারবার এনেছেন ‘মাল্টিপারপাস’ কো-অপারেটিভের ওপরে নিরীক্ষামূলক কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে: কোনোক্রমেই জবরদস্তি করা যাবে না; ব্যাপারটা পরীক্ষামূলকভাবে সফল হলে তবেই ছড়িয়ে দেওয়া হবে; যার যার কৃষিজমি তারই মালিকানায় থাকবে। প্রথাগত সমাজতন্ত্রে এই বিষয়গুলো মানা হয় না। জবরদস্তিমূলক সমবায়ীকরণ এ কারণেই ঘটেছে নানা সমাজতান্ত্রিক দেশে, আর এর প্রতিফল উৎপাদন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হয়েছে মারাত্মক। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে মালিকানা-সম্পর্কের বিষয়টিকে উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা ও জনকল্যাণের অধীন পলিসি-ডিসিশন হিসেবে দেখা হয়েছে। এ জন্যই আমরা বলেছি যে, ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের এই ‘বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান’ সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিদেশি অর্থনীতিবিদ-বিশেষজ্ঞদেরও নজর পড়েছিল। শেখ মুজিবের প্রায়োগিক ও বাস্তবজ্ঞানমণ্ডিত মনের কথা যখন উঠলই, তখন আরও একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চাই। পাকিস্তানের অপশাসনের দিনগুলোর কথা মনে করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তার ‘ক্রমান্বয়ে চলার নীতি’: ‘আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৭ বৎসর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি জানি এদের সঙ্গে মানুষ থাকতে পারে না। আমি ইম্পেশেন্ট হই না, আমি অ্যাডভেনচারিস্ট নই। আমি খোদাকে হাজের নাজের জেনে করি, চুপি চুপি, আস্তে আস্তে মুভ করি সবকিছু নিয়ে।’ এদিক থেকে দেখলে শেখ মুজিব ও দেং শিয়াও পিং-এর মধ্যে একটি প্রচণ্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরা দু’জনেই ছিলেন (রবিনসনের ভাষায়) ‘প্র্যাকটিক্যাল ও প্র্যাগমেটিক’ মনের মানুষ। দেং শিয়াও পিং-এর মতো মুজিবও বলতে পারতেন যে বিড়াল কালো না সাদা সেটা বড় কথা নয়, এটি ইঁদুর ধরতে পারে কিনা সেটাই চূড়ান্তভাবে বিচার্য। মুজিবও এ রকম উদাহরণ দিয়ে তার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেছেন। ‘লার্নিং বাই ডুয়িং’-এর কথা বলেছেন তিনি: ‘কেউ করে শেখে, কেউ দেখে শেখে, আর কেউ বই পড়ে শেখে। আর সবচেয়ে যে বেশি শেখে সে করে শেখে।’ যারা আইডিওলজির চশমা পরে পৃথিবীটাকে দেখে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন মাটির কাছাকাছি থাকার কথা: ‘এদের আমি বলতাম, জনসাধারণ চলেছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলেছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।’ প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, জনকল্যাণের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া, অথবা স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য পূরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থেকে সরে আসা। সেটি স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুর পূর্বাপর ‘একচেটিয়া পুঁজি’বিরোধী অবস্থানের মধ্য দিয়ে। ১৬.৩। একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে অবস্থান পুঁজিবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ সমার্থক ধারণা নয়, যদিও পুঁজিবাদী বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে ‘মনোপলি ক্যাপিটালিজম’-এর আবির্ভাব হয়। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের তৃতীয় বৈশিষ্ট ছিল একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত ও অনমনীয় অবস্থান। কোনোভাবেই পাকিস্তান আমলের মতো ‘বাইশ পরিবারের’ হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত হতে দেওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্যারাডাইমের জন্য একটি মৌলিক ডাইলেমা। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হলো ক্রমশ পুঁজির ‘কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবন’ (centralizaation and concentration of capital)। এর ফলে প্রতিটি খাতেই কমবেশি আগে-পরে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ ঘটতে থাকে। বিংশ শতকের গোড়া থেকে উন্নত ধনবাদী প্রতিটি দেশে (সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ) কার্টেল, সিন্ডিকেট, করপোরেশন প্রভৃতি ‘মনোপলি ফরমেশন’ ঘটতে থাকে। এখনকার দুনিয়ায় ট্রান্সন্যাশনাল, মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশন এবং ‘বিগ বিজনেস হাউস’ ছাড়া আধুনিক পুঁজিবাদকে কল্পনাই করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব বৃহৎ করপোরেট পুঁজির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের (technological leadership) কারণে। এর প্রচলিত উদাহরণ হেনরি ফোর্ড থেকে বিল গেটস অবধি বিস্তৃত। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাড়তি মুনাফা লাভ এবং দ্রুত পুঁজি সঞ্চয়ন অবধারিত হওয়ায় বা করপোরেট পুঁজির বিষয়টাকে আর ক্রিটিক্যালি দেখা যাবে না, ব্যাপারটা এমন নয়। এখানে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের অবস্থান থেকে মূল অভিযোগ তিনটি। প্রথমত, একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশের কারণে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে সমাজে। উন্নত ধনবাদী দেশসমূহে এই লক্ষণ গত তিরিশ বছরে আরও প্রকট হয়েছে। এ সম্পর্কে বিশদভাবে লিখেছেন এবং লিখছেন টমাস পিকেটি (২০১৪), ইমানুয়েল সায়েজ ও গাব্রিয়েল জুকম্যান (সায়েজ ও জুকম্যান, ২০১৯)। এদের নিজস্ব রচনা এবং যৌথভাবে লেখা ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট’ (দেখুন, আলভারেডো ও অন্যান্য, ২০১৮) এ বিষয়ে তথ্য-পরিসংখ্যান জড়ো করেছে। অর্থনীতিবিদরা এ ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী বিজনেস গ্রুপ ও করপোরেশনসমূহের মেজর শেয়ারহোল্ডার এবং ‘ম্যানেজেরিয়াল ক্লাস’-এর জন্য বর্ধিত হারে ক্যাপিট্যাল ও ইনকাম ট্যাক্সের প্রস্তাব করেছেন। আমাদের দেশেও বহুদিন ধরে সম্পদ করের (wealth tax) বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, যদিও এখনও পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে যেতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বিষয়টা শুধু আয়বৈষম্যের নিরিখেও বিচার করলে চলবে না। উন্নত ধনবাদী দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেসব খাতে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশের মাত্রা বেশি, সেসব খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ‘মার্কেট শেয়ার’ তত কম, এবং শেষোক্ত শিল্পে ‘মর্টালিটি রেটও’ তত বেশি। এর কারণ, বৃহৎ করপোরেট পুঁজি আইনি ও বেআইনি যে কোনোভাবেই হোক প্রভাব খাটিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে দেয় না। বৃহৎ পুঁজির হাউসগুলো অনেক সময় নিজেদের মধ্যে এমন কিছু প্রযুক্তিগত ও প্রোডাক্টের ফিচারগত ‘অ্যালায়েন্স’ তৈরি করে নেয়, যার ফলে ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদনকারীরা স্বাধীনভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। সমুদ্রে বড় মাছের পেছনে পেছনে যেমন কিছু ছোট মাছের দল ঘুরে বেড়ায়, বৃহৎ পুঁজির কাছে আনুগত্য স্বীকার করেই কেবল ক্ষুদ্র-মাঝারি পুঁজি ‘মার্কেটে টিকে থাকার’ চেষ্টা করে। এ কারণে প্রতিটি উন্নত ধনবাদী দেশেই শক্ত ধরনের ‘এন্টি-ট্রাস্ট’ আইনের প্রবর্তন করা হয়েছিল গত শতকের ৫০-৬০-এর দশকেই, কিন্তু তারপরও একচেটিয়া পুঁজির ঘনীভবনকে ঠেকানো যায়নি বেশির ভাগ দেশেই। এই সমস্যাটিকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র দৃঢ়ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করবে।
কথাটা প্রথম বলেছিলেন কবি, সমালোচক ও নজরুল-বিশেষজ্ঞ আবদুল কাদির। ১৯৬৪ সালের দিকে কেন্দ্রীয় বাংলা-উন্নয়ন-বোর্ড নজরুলের সমগ্র রচনাবলী প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তার দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় কবি আবদুল কাদির লিখলেন: ‘নজরুল তাঁর সাহিত্য-জীবনের দ্বিতীয় যুগের সূচনায় যে মতবাদের প্রবক্তা হন, তা প্রত্যক্ষত: গণতান্ত্রিক সমাজবাদ (ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজম)। তাঁর পরিচালিত ‘লাঙলে’ হয়েছিল তারই কালোপযোগী কর্ষণা। ‘লাঙল’ছিল ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের’ সাপ্তাহিক মুখপত্র; ১লা পৌষ ১৩৩২ মুতাবিক ১৬ই ডিসেম্বর ১৯২৫ তারিখে প্রথম (বিশেষ) সংখ্যাতেই সে সম্প্রদায়ের ‘উদ্দেশ্য’ও ‘চরম দাবি’ বিবৃত করে নজরুল এক ইশতেহারে বলেন: ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ-স্বাধীনতা-সূচক স্বরাজ লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।’
কবি আবদুল কাদির আরো বললেন যে ‘ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজমের প্রতি নজরুলের মনের প্রগাঢ় অনুরাগ তাঁর ‘সাম্যবাদী’ ‘সর্বহারা’ ও ফনি-মনসা’র বহু কবিতা ও গানে সুপরিস্ফুট। তাঁর ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের ‘আনসার’- চরিত্র এই আদর্শবাদের আলোকে বিকশিত।’ এই ভূমিকাটি লিখিত হয় ১৯৬৭ সালে। অথচ ঠিক তার এক বছর আগে লিখিত ভূমিকাতে কাদির সাহেব এক দ্বিধান্বিত নজরুলের স্বরূপ তুলে ধরতে প্রয়াসী হন। যেন নজরুল এটাও হতে পারেন, ওটাও হতে পারেন। এমনকি নজরুলকে জাতীয়তাবাদী তুর্কী নেতা ‘কামালপন্থী’ বলতেও তার বাধেনি । কাদির সাহেবের দোলাচলের পুরো উদ্ধৃতিটি শোনা যাক । প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তিনি নজরুলের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না এবং শেষাবধি তার নজরুল-বিচারের কম্পাস স্থির হচ্ছে কামাল আতাতুর্কের নামে:
‘নজরুলের দেশাত্মবোধের স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা নানাজনে নানাভাবে করেছেন। রাজনীতিক পরাধীনতা ও আর্থনীতিক পরবশতা থেকে তিনি দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীন মুক্তি চেয়েছিলেন। তার পথও তিনি নির্দেশ করেছিলেন। সেদিনের তাঁর সেই পথকে কেউ ভেবেছেন সন্ত্রাসবাদ-কারণ তিনি ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের উদাহরণ দিয়ে তরুণদের অগ্নিমন্ত্রে আহবান করেছিলেন; কেউ ভেবেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নিয়মতান্ত্রিকতা—কারণ তিনি ‘চিত্তনামা’ লিখেছিলেন; কেউ ভেবেছেন প্যানইস্লামিজম-কারণ তিনি আনোয়ার পাশার প্রশস্তি গেয়েছিলেন; আবার কেউ ভেবেছেন মহাত্মা গান্ধীর চরকা-তত্ত্ব—কারণ তিনি গান্ধীজিকে তাঁর রচিত ‘চরকার গান’ শুনিয়ে আনন্দ দিয়েছিলেন । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, এসব ভাবনার কোনোটাই সত্যের সম্পূর্ণ স্বরূপ উদ্ঘাটনের সহায় নয়। প্রকৃত পক্ষে নজরুল তাঁর সাহিত্য-জীবনের প্রথম যুগে ছিলেন কামাল-পন্থী, কামাল আতাতুর্কের সুশৃঙ্খল সংগ্রামের পথই তিনি ভেবেছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য সর্বাপেক্ষা সমীচীন পথ ৷’
১৯৬৬ সালে নজরুলকে মনে করেছেন ‘কামালপন্থী’ বলে, আবার ১৯৬৭ সালে তাকে চিহ্নিত করেছেন ‘ডেমোক্রেটিক সোস্যালিষ্ট’ বলে। ১৯৭৭ সালে চতুর্থ খণ্ডের ভূমিকায় কবি আবদুল কাদির নজরুলকে সনাক্ত করছেন সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদী বলে। রাজনৈতিক নজরুলকে তিনি চিহ্নিত করছেন এভাবে: নজরুলের ‘সচেতন মনে দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও সমাজতান্ত্রিক মানবিকতা (Socialistic Humanism) রাজনৈতিক চিন্তাদর্শরূপে প্রবলতম প্রেরণার সঞ্চার করেছে।’
কাদির সাহেব কেন এতবার নজরুল সম্পর্কে মত পাল্টালেন সেটি একটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু নজরুলের রাষ্ট্রনৈতিক মত চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রধান ঝোঁকটি বোঝা যায়। আর সেটি হচ্ছে সমাজতন্ত্রের প্রতি নজরুলের ঝোঁক। সাধারণ জনমনে বা এমনকি শিক্ষিত পাঠক সমাজে নজরুল সম্পর্কে যে-‘বিদ্রোহী’ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে সেটি বেঠিক নয়। কিন্তু তাতে করে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শের প্রধান ঝোঁককে চেনা যায় না। ‘বিদ্রোহী’ তিনি তো বটেই, কিন্তু সেই বিদ্রোহ কি ছিল শুধু রাজনৈতিক স্বরাজ বা পূর্ণ-স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ কেবল? এই বিদ্রোহের শত্রু-মিত্র কারা? এটি কি কেবল ব্যক্তি-সত্ত্বারই রুদ্র আত্মপ্রকাশ— যেমনটা পাই তার ‘অগ্নিবীণায়’? নাকি, এটি ছিল সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের পক্ষ থেকে বিদ্রোহ— কৃষক-শ্রমিক-জেলে-ছাত্র জনতার লড়াই? এককথায়, আরো বৃহত্তর সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নজরুল তার ‘বিদ্রোহ’ ও তার ‘সাম্যবাদকে’ দেখেছেন কিনা। অনেক সময় নজরুলকে ‘সাম্যবাদী’ হিসেবে অভিহিত করা হয় ঐ নামের একটি কবিতা-গুচ্ছকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ‘বিদ্রোহী কবি’র মত ‘সাম্যবাদী কবি’ এই অভিধাও নজরুলের রাজনৈতিক স্বরূপকে যথেষ্ট ভাবে প্রকাশ করে না। ‘সাম্যবাদী’কবিতাগুচ্ছের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমতামুখী (egalitarian) চিন্তার শিল্পিত প্রকাশ আছে। কিন্তু এ থেকে আমরা আঁচ করতে পারি না নজরুলের মতাদর্শগত সংশ্লিষ্টতা, সংগঠন-চর্চার ধরণ ও সচেতন রাজনৈতিক-আদর্শিক কর্মকাণ্ডের কোন আদল ৷
আমরা কতজন সবসময় মনে রাখি যে (১) তিনিই বাংলায় প্রথম লিখিত আকারে ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবী উচ্চারণ করেছিলেন; (২) তিনিই বাংলার প্রথম কবি যিনি শুধুমাত্র কবিতা লেখার জন্য এক বছর বৃটিশের জেলে কারাবন্দী ছিলেন; (৩) তিনিই প্রথম বেঙ্গল পেজেন্টস্-ওয়ার্কাস পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যা কমিনটার্ণের পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং যা ছিল ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নিকটতম পূর্বসূরী; (৪) তিনিই প্রথম বৃহৎ শিল্প-কারখানা ও পরিবহন-ব্যবস্থা ‘জাতীয়করণের’ এবং কৃষিতে ‘সমবায়ীকরণের দাবী তুলেছিলেন; (৫) তিনিই ১৯২৫ সালে কানপুরে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় সদস্যদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাদের লেখা নিয়মিত ছাপাতেন ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’ পত্রিকায়, তার মধ্যে ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, মৌলানা হসরৎ মোহানী, আবদুল হালীম, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ । এই শেষোক্ত দলে নজরুলকে প্রকাশ্যে রাখা হয়নি শুধুমাত্র একটি কারণে: একমাত্র নজরুলই সারা বাংলায় পরিচিত ছিলেন কবি, সম্পাদক ও গায়ক হিসেবে। এবং কম্যুনিস্ট পার্টি তার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বৃটিশ-বিরোধী সংগ্রামে। প্রতিষ্ঠা-পর্বের কম্যুনিস্ট সদস্যরা পরবর্তীতে হয় জেলে, অথবা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে বা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন বৃটিশ আমলে ।
তারপরও যেটা এখানে লক্ষ্যনীয়, কমিউনিস্ট বা বলশেভিক মতবাদের প্রচারে, আন্দোলন-সংগঠনের কাজে নজরুল সবসময়ই সক্রিয় সাহায্য-সহায়তা যুগিয়েছেন। সেটা শুধু দূর থেকে ‘মরাল সাপোর্ট’ জানানোর ব্যাপার ছিল না। সাংগঠনিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কাজে মুজফ্ফর আহমদ তাকে নিয়ে চলতেন ও তার সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতেন। তারা দুজনেই আরো কিছু কমরেড সহ থাকতেন কলকাতার ৩৭ হ্যারিসন রোডের বাসায় যেটি একাধারে ‘ধূমকেতু’ ও লাঙলের অফিসও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতিপূর্বে অন্যান্য বাসাতেও তারা একত্রে থেকেছেন। এ ব্যাপারে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন:
‘… ১৯২০ সাল আসতেই আমি স্থির করে ফেলেছিলেম, আমার জীবনের পেশা হবে রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা নয়। উনপঞ্চাশের ব্যাটালিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা অনুসারে কলকাতায় আমার সঙ্গে থাকতে আসে। ফৌজে সে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার ছিল । কথা হয়েছিল যে নজরুল ইসলাম কলকাতায় কাব্য ও সাহিত্য চর্চা করবে এবং রাজনীতিতেও যোগ দিবে।’
এরপর একের পর এক পত্রিকা বের হতে থাকে নজরুল-মুজফ্ফর এদের দ্বৈত-প্রচেষ্টায়-যদিও অগ্রণী ও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন নজরুলই। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৯২০ সালের দিকে প্রকাশিত ‘নবযুগ’ পত্রিকাটি; যদিও সেটি সম্পাদনা করতেন নজরুল ও মুজফ্ফর, ‘প্রধান পরিচালক’ হিসেবে কেবল এ.কে. ফজলুল হকের নাম ছাপা হত । এ.কে ফজলুল হকের আর্থিক সাহায্যে পত্রিকাটি বেরুতো (তখনো তিনি ‘শেরে বাংলা’হননি)। এছাড়াও ১৯২২ সালের দিকে বেরিয়েছে ‘ধূমকেতু’, এবং ১৯২৫ সালের দিকে ‘লাঙল’ । প্রথম দুটিতে প্রধান ‘সম্পাদক’ও প্রধান লেখক ছিলেন নজরুল স্বয়ং; শেষেরটিতে সম্পাদক প্রতিকী অর্থে অন্যরা থাকলেও ‘প্রধান পরিচালক’ ও প্রধান লেখক ছিলেন নজরুলই। অর্থাৎ নজরুলকে সামনে রেখেই মুজফ্ফররা বামপন্থী ও কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
২. ‘ধূমকেতু’রনজরুল
ধূমকেতু প্রথম প্রকাশ পায় ১৯২২ সালের ১১ই আগষ্ট। সপ্তাহে দু’বার করে বার হত ধূমকেতু। তার প্রচ্ছদ- পত্রে কখনো নজরুল থাকতেন ‘সারথী’ রূপে; কখনো ‘প্রতিষ্ঠাতা’ রূপে; কখনো ‘সম্পাদক’ হিসেবে ; কখনো ‘স্বত্বাধিকারী’ হিসেবে। ধূমকেতুর সবগুলো সংখ্যা এখনো গ্রন্থবদ্ধ হয় নি। কিন্তু যেগুলো পাওয়া যায় তার থেকে কয়েকটি প্রবণতা চোখে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে— (ক) ক্রমাগত ভারতে বৃটিশ শাসনের বিরোধীতা; (খ) বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা; (গ) অসহযোগ আন্দোলনের ক্রিটিক্যাল পর্যালোচনা; (ঘ) মুসলিম জাহানের সংবাদ, বিশেষত: কামাল আতাতুর্ক ও তার শাসিত নব-তুরস্কের গল্প; (ঙ) প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই নারীমুক্তি সংক্রান্ত হিন্দু- মুসলিম লেখক-লেখিকার প্রবন্ধ; (চ) লেনিন, রুশ বিপ্লব ও বলশেভিকদের কথা ও কাহিনী; (ছ) দেশের ভেতরে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আন্দোলন-সংগ্রামের রিপোর্ট ও ফিচার প্রবন্ধ; এবং (জ) বিভিন্ন চলতি প্রসংগের ওপরে ধূমকেতুর ‘খাট্টামিঠা টিপ্পনী’ । এই শেষের ধারাটি ‘লাঙলে’ও চালু ছিল এবং পরবর্তী কালে এই বিশেষ ফর্মটি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকাকে প্রভাবিত করেছিল। ধূমকেতুর প্রায় সবগুলো সংখ্যা আমি খুঁটিয়ে পড়েছি। সংখ্যা ধরে ধরে এর বিস্তৃত আলোচনা এই প্রবন্ধের সামর্থ্যের বাইরে। আমি শুধু চুম্বক অংশগুলো উত্থাপন করছি ।
১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯২২ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন ধূমকেতু পত্রিকায় ‘ধূমকেতুর পথ’ সম্পাদকীয়তে নজরুল বৃটিশ শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা চাইলেন । আমার জানা মতে, তার আগে আর কেউ এই বাংলায় সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেশের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ চায় নি। ‘অস্পষ্ট স্বরাজ’ নয়, স্বায়ত্তশাসন নয়, ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস নয়, একেবারে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উঠল নজরুলের কাছ থেকে। তিনি সেই ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করে লিখলেন:
“সর্বপ্রথম, “ধূমকেতু” ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী ক’রে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো।… পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’
শুধু এটুকু লেখার জন্যই রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে ধূমকেতু বাজেয়াপ্ত হতে পারত এবং কবি নজরুলও জেলে যেতে পারতেন । কিন্তু জেলে তিনি গেলেন ধূমকেতুর ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২০-এর লেখাটার জন্য-তাও কবিতা লেখার জন্য। কবিতাটির নাম— ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। আপাত: দৃষ্টিতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার তুলনায় নিরীহ হলেও কড়া কড়া লাইন ছিল তাতে। ‘বিদ্রোহী’কে ব্যাখ্যা করা যেত কবির ‘ব্যক্তিগত বিদ্রোহ’ বলে। সে তুলনায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’কবিতাটি রাজনৈতিক লাইনে ভরপুর। একটি উদাহরণ:
‘বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি’—এই লাইনটি একালের তরুণ পাঠকদের জন্য কিছুটা ব্যাখ্যার দাবী রাখে হয়ত। ১৯১০ থেকে ১৯৩০ পর্বটি ছিল বাংলায় তথা ভারতে বিপ্লবী ‘সন্ত্রাসবাদী’ আন্দোলনের যুগ। ধূমকেতুতে অর্ধেক পাতা জুড়ে ছাপা হত বারীন্দ্র ঘোষ (আলীপুর বোমা মামলার অভিযুক্ত বিপ্লবী ও পণ্ডিচেরীর অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই), ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, উল্লাসকর দত্ত, প্রফুল্ল চাকি, যতীন মুখুয্যে প্রমুখ বিপ্লবীদের ছবি। বারীন্দ্র ঘোষকে নজরুল তার ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন: ‘অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে/ তাই তো তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে।’ ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যার পঞ্চম পাতাতেই বারীন্দ্র ঘোষের আবক্ষ ছবি ছাপা হয়েছিল, তাতে ক্যাপশন ছিল ‘বাঙ্গার প্রথম ধূমকেতু— ফাঁসির বারীন্দ্র।’ তাছাড়া ধূমকেতুর প্রতি সংখ্যাতেই প্রায় অর্ধেক পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন থাকত যা পড়লে সন্দেহ থাকে না কবির পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে । বিজ্ঞাপনে বড় বড় করে লেখা থাকত: ‘বোমার যুগের বারীন্দ্র উপেন্দ্র এবং নলিনী গুপ্ত ও সুরেশ চক্রবর্ত্তীর সব বই আমাদের নিকট পাওয়া যায়।’
এসব থেকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে কবি নজরুল সন্ত্রাসবাদীদের তীব্র দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারপরও তিনি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না এবং সন্ত্রাসবাদকে আদর্শ হিসেবেও কখনো গ্রহণ করেননি । এই একই নিরিখে তাকে কামাল-পন্থীও বলা চলে না । তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সম্পর্কে প্রবল উচ্ছাস ছিল তার। ধূমকেতুর পাতায় নানা জায়গায় তার প্রমাণও রয়েছে। ধূমকেতুর ৮ম সংখ্যায় প্রথম ছাপা হলো সংবাদ যার শুরুতে ছিল ‘কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই’। সংবাদটা ছিল এরকম: ‘গাজী মোস্তফা কামালপাশার জয় হোক । তিনি আজ কদিন হলো বর্ঝর গ্রীসের প্রধান সেনাপতি টিকুপিসকে দশ হাজার গ্রীক সৈন্যসহ বন্দী করেছেন। ‘কামাল- বন্দনা’ নামে কবিতা বেরিয়েছে-লেখিকা সরসীবালা বসু। কামাল পাশা নিয়ে ছোট বড় নানা ধরণের সংবাদ বেরিয়েছে, প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। এই ধূমকেতুতেই ৮ম সংখ্যাতে বেরিয়েছে আবারো-মোসলেম ভারতে’ প্রথম প্রকাশের পর নজরুলের বিখ্যাত কবিতা কামাল পাশা । আমার ধারণা কামালপন্থার প্রশস্তির পেছনে নিছক জাতীয়তাবাদ নয়, আসলে কাজ করছিল এক প্রচ্ছন্ন কাউন্টার-ডিসকোর্স। কামাল আতাতুর্কের সাম্রাজ্যবিরোধী জাতীয়তাবাদ ও লেনিনের বলশেভিজম— এ দুইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক জোট চেয়েছিলেন তিনি । নজরুল আসলে খেলাফতপন্থীদের আর চরকাপন্থী অসহযোগীদের প্রকারান্তরে সমালোচনা করছিলেন কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের প্রশংসা করে । এজন্যই নন-ভায়োলেন্স ভিত্তিক অস্পষ্ট স্বরাজ-আন্দোলনকে সমালোচনা করেছেন নজরুল । ধূমকেতুর একটি সংখ্যায় তিনি লিখেছেন: ‘তোমার হাতে-পায়ে-গৰ্দ্দানে-বাঁধা শিকলে প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে বল দেখি বীর—
“মোরা সবাই স্বাধীন সবাই রাজা।”
দেখবে, অমনি তোমার সকল শিকল সকল বাঁধন টুটে খান খান হয়ে গেছে।’ এ সম্পাদকীয় যেখানে বেরিয়েছে তারই পাশে নজরুল লিখেছেন তীব্র-তীক্ষ্ণ কবিতা: ‘রক্তাম্বর পর মা এবার/জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন।/দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন/বাজে তরবারি ঝনন্-ঝন্ ।’ স্পষ্টতঃই চরকা কাটার ধ্বনির থেকে এটি অন্য সুরের সাধনা করেছে। চরকার বা অহিংসাভিত্তিক অসহযোগের সমালোচনা শুধু নজরুল একাই করেন নি, অন্যদের দিয়ে ও সমালোচনা করিয়েছেন। যেমন, ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতেই বীরেন্দ্রকুমার সেন লিখছেন: ‘আজ কেবল চরকা ও অহিংসার ধূয়া ধ’রে বসে থাকলে যদি ব্যক্তি ও জাতির জীবনের সকল সমস্যার সমাধান না হয়, আমরা যদি জ্ঞান, শক্তি, ঋদ্ধি ও কল্যাণে পরিপূর্ণ হয়ে না উঠতে পারি, তাহলে যে আমাদের হাত-পা গুটিয়েই ব’সে থাকতে হবে তা বলা চলে না। অসত্যের ধ্বংসেই জগতে সত্যের ও শান্তির প্রতিষ্ঠা হ’য়ে থাকে ।’
ধূমকেতুর অধ্যায় ছিল চরকা-বিরোধী মারকুটে র্যাডিকেল জাতীয়তাবাদের ধারায় গড়া। সেখানে নজরুলের পদ্য ও গদ্য অস্বীকারের প্রেরণায় লেখা। সেখানে তার আবেগ বাধা-বন্ধনহীন, ক্রোধ প্রায় পৌরাণিক। আলবেয়ার কাম্যুর মত সেখানে বিদ্রোহেই মানবসত্ত্বার মুক্তি: ‘শিবকে জাগাও, শিবকে জাগাও। আপনাকে চেন। বিদ্রোহের মত বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার, তবে নিদ্রিত শিব জাগবেই। মেরে জাগাও শিবকে। লাথির মত যদি লাথি মারতে পার, তা হ’লে ভগবানও তা বুকে করে রাখে।’ কিন্তু এই র্যাডিকেল জাতীয়তাবাদের মধ্যেও একটি অধিকতর স্থায়ী নিরাবেগ সামষ্টিক সমাজবাদী আদর্শের প্রতি ঝোঁক ক্রমশ: দেখা যাচ্ছে। ধূমকেতুর পাতাতেই তা ক্রমশ: স্পষ্ট হচ্ছে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি, যার থেকে নতুন সমাজ বদলের আদর্শ, বলশেভিজম ও সাম্যবাদের প্রতি অঙ্গীকার দেখা দিচ্ছে। ‘লক্ষীছাড়ার দল’ যারা নিজেদের বলছে তারা এখন বৃহত্তর সাম্যবাদী আদর্শের পাটাতন খুঁজে ফিরছে। শুধু দেশের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার জন্যও আকুতি নানা ভাবে ফুটে উঠছে। ক্রমেই ধূমকেতুর পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে নতুন আদর্শের আলোচনা। ধূমকেতুর ভাষ্যকার এক
জায়গায় ব্যঙ্গ করে বলছেন:
“সেদিন স্বরাজ-পার্কের এক সভায় এক নামজাদা অসহযোগ-পন্থী একটা জীবন্ত সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন । তাঁর মতে বলশেভিজমের ধূমকেতুটা আজ বিষবাষ্পের মতো সমগ্র রুশ মুল্লকটাকে ছারখার করে দিয়েছে। ভাগ্যে সময় থাকতে আমরা এই অহিংস অসহযোগের সুদৃঢ় কেল্লায় আশ্রয় নিয়েছিলুম-নয়ত এর ল্যাজের আগুনে গোটা আৰ্য্যাবৰ্ত্তটাই এতদিনে জ্বলে পুড়ে নাকি ভস্মপিণ্ডি হয়ে যেত!’ অন্যত্র, নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হেমন্তকুমার সরকার এমন একটি শাসনতন্ত্র চাইছেন যেখানে ‘কার্ল মার্কসের সোসিয়ালিজমের শ্রমজাত অর্থনীতিক সাম্য, মিখাইল বাকুনিনের এনার্কিজমের বাহ্যকর্তৃত্ব অপীড়িত মানবাত্মার স্বাধীন সম্মিলন, লেনিনের বলশেভিজমের ধরিত্রীভোগে সমানাধিকার-সে শাসনতন্ত্রে সমস্তই থাকবে। কলা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন মানুষের মনের খোরাক যোগাবে-কৃষক, মজুর দেহের খোরাক উৎপাদন করবে। মধ্যসত্ত্বভোগীর স্থান সে সমাজে নাই। মাথা ও হাত পা খাটিয়ে যারা খাবে তারাই বাঁচবার অধিকারী—অবশিষ্ট সকলের ধ্বংশ অবশ্যম্ভাবী।’ এই হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল ইসলাম দু’বছর বাদে পেজেন্টস-ওয়ার্কাস পার্টির দুই প্রধান কর্ণধার হয়েছিলেন। অনেক সময় পক্ষপাতিত্বের ঝোঁকটি কোনদিকে তা ছোট ছোট সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়েও বোঝা যায় । যেমন, একটি সংবাদে ৩০ শে আশ্বিন ১৩২৯ সালের ধূমকেতু লিখছে:
‘তুর্কীর সাহায্যের জন্য পেট্রোগ্রাডে জোর স্বেচ্ছাসৈনিক সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং গত সপ্তাহে ওদেসা বন্দর থেকে একদল স্বেচ্ছাসৈনিককে তুর্কীর দিকে রওনা করে দেওয়া হয়েছে। এইবার দেখছি, সত্যি সত্যিই গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম হ’য়ে দাঁড়াবে। আমাদের দেশের ছেলেরা কখন যাবে এ গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গমে স্নান ক’রে পবিত্র হ’তে?’
লেনিনের সংবাদও বেরিয়েছে মন্তব্য সহ । ‘আগুণের ফুলকি’ কলামে ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতেই লেখা হয়েছে: ‘মস্কো থেকে খবর এসেছে যে কমিউনিস্ট দলের বৈঠকে মসিয়ঁ কামেনেভ বলেছেন যে, লেনিন খোস্ মেজাজে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী!’ যেসময়ের কথা হচ্ছে (১৯২২ সাল) তখন লেনিনের বা বলশেভিজমের প্রচার একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল ভারতবর্ষে। তবু ঝুঁকি নিয়ে নজরুল এসব সংবাদ ছাপাতে দ্বিধা করেন নি । যেমন, মঙ্গোলিয়া বলশেভিক রাশিয়ার সাহায্য পেয়ে ‘স্বাধীন’ হয়েছে এই সংবাদটি দেয়া হয়েছে এভাবে:
‘পরাধীন জাতির পরম বন্ধু বলশেভিক গবর্ণমেন্টের টাকা-কড়ি লোক-লশকরের সাহায্য পেয়ে মঙ্গোলিয়া এত দিনে দাসত্বের শৃঙ্খল খান্ খান্ ক’রে ভেঙে ফেলেছে।‘
সবচেয়ে অবাক হয়েছি ধূমকেতুর ২য় সংখ্যায় বিখ্যাত বিপ্লবী কমিউনিস্ট রোজা লুকসেমবার্গের সম্পর্কে দেড় কলাম জুড়ে শোকগাথাঁর প্রকাশ দেখে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে কাউটস্কি, লিবকনেট, লেনিন প্রমুখের সহকর্মী রোজাকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রচারের জন্য ১৯১৯ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বার্লিন শহরে। ‘বিদ্রোহী বীরাঙ্গনা’ শিরোনামে তার সম্পর্কে ‘ধূমকেতু’ এভাবে লিখেছে:
‘রোজা জাতিতে পোল। তাঁর বয়স যখন আঠার তখন তিনি [ জার শাসিত ] রুসিয়া থেকে পালিয়ে আসেন। তার পিছনে ছেনালী পুলিশের ফেউ লেগেছিল। ইটালীতে থেকে এই নারী বিপ্লববাদ প্রচার শুরু করেন কিন্তু ইটালীর গভর্ণমেন্ট তাঁর উপর খাপপা হয়ে উঠেন। তখন তিনি সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স হয়ে জার্মেনীতে আশ্রয় ল’ন। জার্মেন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্র ও অর্থনীতির আলোচনা করে তিনি উচ্চতর উপাধি পান।… রুসিয়ায় যখন বিদ্রোহের সূচনা হয় রোজা তখন তাতে যোগদান করেন। বলা বাহুল্য যে রুস গভর্ণমেন্ট তাঁকে জেলে আবদ্ধ করেন। কিন্তু পুলিশের চোখে ধুলি দিয়ে রোজা জার্মেনীতে ফিরে আসেন ৷
জার্মানীতে এসে রোজা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নানাস্থানে ধর্মঘট ঘটিয়ে কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলাই ছিল তাঁর কাজ। জেলে থেকেই তিনি জার্মান গভর্ণমেন্টের যুদ্ধ নীতির প্রতিবাদ করে বই লেখেন । Crisis of Socialism নামক বইও জেলেই লেখা হয়েছিল।… জার্মেনীর রাজতন্ত্রের বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে রোজা মুক্তিলাভ করেন, ইনি তখন সঙ্ঘবাদ (communist) প্রচার উদ্দেশ্যে একখানি সংবাদপত্র প্রচার করেন। এই কাগজে ইনি যে সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতেন তা যেমন অকাট্য যুক্তিপূর্ণ তেমনিই কার্যকরী হ’ত। জার্মেনীতে একদল লোক আছে যারা এখনও রাজ-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি। এরাই প্রতিহিংসা পরবশ হ’য়ে এই মহিলাকে গুপ্ত ভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার ইতিহাসে এই নারীর নাম চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে ।
এ দেশে কি এমনি কেউ বীরাঙ্গনা আসবে না, যাঁর চরণ-কমল স্পর্শে এই মাদীদের দেশ আবার পুরুষ হয়ে জেগে উঠবে?”
সংবাদ এসেছে মধ্য-এশিয়ায় রুশ-বিপ্লবের ঢেউ লাগা নিয়ে । এনিয়ে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ‘রাশিয়ার চিঠি’তে বিস্তৃত লিখবেন। কিন্তু এর পূর্বলেখ পাই নজরুলের ধূমকেতুতে। ‘আরবী কাগজ’ থেকে ‘বোখরা বিপ্লব’ শিরোনামে লেখা হয়েছে:
‘পূর্ব্ব-বোখরার উজবেগ নামে পরিচিত পাহাড়ীয়া জাতি আমিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা ক’রে ব’ল । এতে অবশ্য আশ্চর্য্য হবার কিছুই নেই । আমীর দেখলেন, অবস্থা তো বড় সঙ্গীন, রুশিয়ার জার ও বিদ্রোহী নেতাদেরে ঘুষ দিয়ে আপনার প্রভূত্ব ও সিংহাসন নিরাপদ করলেন, হতভাগ্য পাহাড়ীরা তাদের নেতাদের বোকামীতে দুর্দ্দশার চরম সীমায় যেয়ে পড়ল । দেশের অজ্ঞান অন্ধকার দূর করবার জন্য শাসকসম্প্রদায় মোটেই চেষ্টা করত না কারণ লেখাপড়া শিখলে প্রজারা কর্তৃপক্ষের যথেচ্ছাচারে বাধা দিবে এ ভয়ও যে তাদের ছিল না এমন নয় ।
কিন্তু ১৯১৭ সনে যখন রুশিয়ার শ্রমজীবী ও কৃষক সম্প্রদায়ের ভিতর বিপ্লব দেখা দিল, তখন আমীর আপনার ধ্বংসোন্মুখ সিংহাসন রক্ষার জন্যে ইংরেজের শরণাপন্ন হলেন। সোভিয়েট রুশিয়ার বিদ্রোহের স্রোত যাতে করে এসে ভারতের বিপ্লবপন্থীদের সঙ্গে মিশতে না পারে এই উদ্দেশ্যে সুচতুর ইংরেজ সরকার আমীরকে মাঝখানে দাঁড় করালেন। কিন্তু লোকের ধৈর্য্যের বাঁধ আর কতদিন টিকে? ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিম বোখরায় আবার বিদ্রোহের ভেরী বেজে উঠল। সপারিষদ আমীর পূর্ব্ব বোখারায়, পরে আফগানিস্থানে পলায়ন করতে বাধ্য হলেন। ফলে দেশের সমস্ত ক্ষমতা জনসাধারণের হাতে এসে পড়ল ।
নতুন শাসন প্রণালী প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাতে জনসাধারণের প্রতিনিধিরাই প্রাধান্য লাভ করলে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তারা রুশিয়ার শ্রমজীবী ও কৃষক সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রার্থনা করল। জনাসাধারণের ইচ্ছায় বোখারায় সোভিয়েট সাধারণ-তন্ত্র রক্ষার জন্যে যে-কোন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তারা দৃঢ় সংকল্প হ’ল। প্ৰাচীন শাসনে যে সকল অন্যায় প্রথা প্রচলিত ছিল সেগুলি সমূলে ধ্বংস হ’ল। বৰ্ত্তমান সময়ে বোখারার শাসন-প্রণালী বোখারাবাসীদেরই হাতে এসে প’ড়েছে, তারা নিজেদের সুবিধা অসুবিধা অনুযায়ী আইন কানুন গ’ড়ে তুলেছে, রাজ্য পরিচালনার জন্যে তারা নিজেরাই কর্ম্মচারী নিয়োগ করে, স্বাধীনভাবে শান্তিতে জীবন যাপন করাই এখন বোখরাবাসীদের একমাত্র অভিপ্রায়।’
কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের সাথে লেনিনের রাশিয়ার মিত্রতার খবরে উল্লসিত হয়েছে ধূমকেতু। ‘কামালের বলশেভিক দোস্তী’ শিরোনাম দিয়ে বলা হয়েছে:
‘গাজী মোস্তফা কামাল পাশাকে সাহায্য করবার জন্যে বলশেভিক গবর্ণমেন্ট ইটালী থেকে বহু মেশিন-গান, মটরকার, ল্যরি ও অন্যান্য যুদ্ধোপযোগী অস্ত্র-শস্ত্র কিনে আঙ্গোরাতে [আংকারা] পাঠাচ্ছেন। একেই বলে দোস্তি ।
তোমরা দুই মিতায় এইবার দুনিয়া থেকে রাজার নাম নেস্তনাবুদ করে ফেল ত একবার ভাই । আমিন!’
কোথায় ইরানের সাথে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার চুক্তি হচ্ছে, সেনিয়ে সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রচ্ছন্নে রয়েছে কংগ্রেস-খেলাফত প্রস্তাবিত স্বরাজ-অসহযোগের ক্রিটিক । ধূমকেতু লিখছে, ‘কংগ্রেস যে-স্বরাজ চায় সে যে নিতান্তই লজ্জাস্কর স্বরাজ। ইংলন্ডের অধীনে স্বায়ত্ত-শাসন লাভ করার জন্যই কি দেশে এত আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে।… দেশ বৃটিশ সাম্রাজ্যধীনে স্বায়ত্ব-শাসন কিংবা দেশের অত্যাচারী অভিজাত শ্রেণীর শাসন চায় না-দেশ চায় দেশ-জনসাধারণের শাসন।’ আর এই সংগ্রামে ধূমকেতুর চোখে ন্যাচারাল মিত্রশক্তি হলো রুশ-বিপ্লবোত্তর রাশিয়া। এর ১৪তম সংখ্যায় এরকম সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে যে মস্কো শহরে রাশিয়ার মুসলিম জনগণ এক বিরাট মিছিল নিয়ে ইংলন্ডের দূতাবাসে গিয়ে প্রতিবাদ করেছে। উদ্দেশ্য, ইংলন্ড মুসলমান রাজ্যগুলির সম্বন্ধে যে রাজনীতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন তার তীব্র প্রতিবাদ জানানো । অন্যত্র, বলশেভিক পুস্তিকা ঘেঁটে তত্ত্ব-পরিবেশনা করা হচ্ছে সাধারণ পাঠকদের কাছে। তারই একটি নমুনা নীচে তুলে ধরলাম:
“বলসেবীর বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়
একি গো বিস্ময় ।”
‘সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের সাথে গণ-তান্ত্রিক বলশেভিক গবর্ণমেন্টের ব্যবসা-সম্পর্কীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়াতে বলশেভিকগণ পৃথিবীর সর্ব্বত্র সাম্রাজ্যবাদীগণের বিরুদ্ধে যে-প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছিলেন তা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখেছিলেন, কিন্তু এখন তাঁরা নববলে বলীয়ান হয়ে প্রচার কার্য্য শুরু করে দিয়েছেন।
বলশেভিক পররাষ্ট্র প্রচার বিতরণ থেকে সম্প্রতি দুটা বই প্রকাশিত হয়েছে, একটীর আকার বৃহৎ-৭০০ শত পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। রুষের ভূতপূর্ব্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ফ্রান্স প্রভৃতি রাজ্যের সাথে যে টেলিগ্রাম, গুপ্ত রিপোর্ট ও পত্রালাপ ব্যবহার হয়েছিল তার নকল এখানে সন্নিহিত হয়েছে। আর একটা হচ্ছে ভারতবর্ষে সম্বন্ধে পুস্তক। এই পুস্তকে প্রচ্ছদপটে লেখা রয়েছে -“ভারত ভারতবাসীর জন্য।”এতেও বহু চিঠিপত্র ও রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এই সব বই জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের বলশেভিক পূস্তকালয়ে বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে ও রাশিয়ান খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এই পুস্তকের এক জায়গায় লেখা আছে :
“আমরা-রাশিয়ান বিদ্রোহীগণ ও আর্ন্তজাতিক সোশিয়ালিষ্টগণ ভারত বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করলে কেবল যে তাকে সাদরে অভিনন্দন জানাব তা নয় বরং পরোক্ষ ও অপরোক্ষভাবে সাধ্যমত ভারতের বিদ্রোহকে সাহায্য করব; এবং ঘৃণিত ব্রিটিশের পরাধীনতা থেকে মুক্ত আজাদ করবার জন্যে ভারত বাসীকে সাহায্য করব। বহুদিনের উৎপীড়িত নির্যাতিত প্রাচ্যে বন্ধুগণের প্রতি সহানুভূতির নিদর্শন স্বরূপ (গুপ্ত) দলিল পত্র সম্বলিত এই পুস্তক সাদরে গ্রহণ করুন। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বিদ্রোহমূলক পন্থা কেবলমাত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে সহায়তা করে ক্ষান্ত হবে না, এর অতিরিক্ত কিছু করবে।”
খুড়োর সাথে সাথে আমরাও ভাছি, “অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোনখানে?” কৃষকের ঐ লাঙলই যে হল বলরাম হয়ে বিশ্ব উপড়ে ফেলতে পারে, তা জানতুম না-দাদা। জানলেও বিশ্বাস করতুম না। এক কামালেই কামাল করলে আর তোমরা আর এক কামাল করলে।’
প্রথম সংখ্যাতেও লেনিনের স্বাস্থ্য নিয়ে সংবাদ এসেছিল, ১৯তম সংখ্যাতেও তাঁর সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছে। সম্ভবত ১৯২০ সালের কমিনটার্ণের দ্বিতীয় কংগ্রেসকে উদ্ধৃত করে কথাগুলো বলা: ‘লেনিন বেশ ভালোই আছেন। তিনি বলেন প্রাচ্যের সভায় রাশিয়ার থাকা একান্ত আবশ্যক। তিনি আগেও বলেন যে তুরস্কের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা… রাশিয়ার উদ্দেশ্য। জাতিসঙ্ঘকে তার খবরদারী করতে দেওয়া যেতে পারে না।’ এরই পাশাপাশি এ সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে ইতালীতে ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে-‘একে একে নিবিছে দেউটী’ । এরকম উদাহরণ আরো অনেক দেওয়া যায় ।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, বলশেভিজম বা রাশিয়ার সমাজতন্ত্র নিয়ে এই কৌতূহুল এটা কি কোন বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে কিনা? এর উত্তর পরবর্তী অধ্যায়ে দেব। কিন্তু তার আগে এটা জানিয়ে রাখি যে ধূমকেতুতে নজরুল একটি ব্যাপক লেখক সমাবেশ করতে পেরেছিলেন। শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, শৈলজারঞ্জন, প্রেমাংকুর আতর্থী, শিবরাম চক্রবর্তী, মুজফ্ফর আমদ, হেমন্ত কুমার সরকার প্রমুখকে দিয়ে নানাবিধ ‘রাজনৈতিক’ বিষয়ে প্রবন্ধ গুচ্ছ লিখিয়েছেন। এবং সবগুলো লেখাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, প্রগতিপন্থী, এবং অনেকাংশে বামপন্থী চেতনায় সমৃদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, আমি ধূমকেতুর নারীমুক্তি সম্পর্কীত লেখাগুলির কথা স্মরণ করব। ১৮তম সংখ্যায় মহামায়া দেবী লিখছেন:
‘আজ এই আন্দোলনের যুগে অন্যান্য আন্দোলনের মধ্যে নারীর স্থান কোথায়; এ এক প্রধানতম আন্দোলন । আর সত্য সত্যই নারীর স্থান কোথায় আজ তা নিরুপণ করা এক মহা ব্যাপার। আর স্থান নিরুপণ করা কার দ্বারাই যে সম্ভব তাও ভাববার কথা। নারীর জীবন দিন দিনই যে সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠছে তা কোন এক নিদর্শন দেখিয়ে প্রমাণ করবার আবশ্যকই করে না। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ চোখের উপর নিয়তই খাড়া রয়েছে। কিন্তু এই সমস্যা মীমাংসার উপায় কি?… নারীর স্থান নির্ব্বাচন নারীকেই করতে হবে, নারীর জীবন সমস্যা নারীকেই মেটাতে হবে, নারীর সত্যকারের অধিকার নারীরই নিতে হবেঃ সত্যবস্তু প্রতিজনের নিজস্ব তা কেউ কা’কে দিতে পারে না এবং কারো কাছে দাবী করবারও নয় । হাল আমলের নারীর ‘এজেন্সি’ এবং ‘এমপাওয়ারমেন্ট’ ডিসকোর্সের সূচনা ধূমকেতুতে ।’
৩. লাঙলেরনজরুল
লাঙল প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর । এর ‘প্রধান পরিচালক’ নজরুল ইসলাম । সম্পাদক ছিলেন মনিভূষণ মুখোপাধ্যায়— পল্টনে থাকতে নজরুলের সহকর্মী কমরেড। ‘লাঙল’ পর্বটি তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই পর্বে নজরুল আরো বেশি করে রুশ বিপ্লব, মার্কসীয় সমাজতন্ত্র ও সাধারণ ভাবে সচেতন বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। দ্বিতীয়ত, এই পর্বে শুধু আদর্শগত ঝোঁক নয়, সাংগঠনিক ভাবেও বামপন্থী সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন নজরুল। সাধারণ সদস্য বা সমর্থক হিসেবে নয়— শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সম্প্রদায়ের’ অন্যতম মূল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। লাঙলের প্রথম সংখ্যাতে এই নামই ছিল সংগঠনটির। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে নামকরণ হয়— ‘শ্রমিক-প্ৰজা- স্বরাজ দল’ । ইংরেজিতে ওয়াকার্স পেজেন্টস পার্টি । এই দলেরই বক্তব্য প্রচারের জন্য লাঙল বের করা। যেরকম লেনিন এক সময় বলশেভিক পার্টির মুখপাত্র হিসেবে বের করেছিলেন ইসক্রা। এ নিয়ে কোন রাখ ঢাক ছিল না নজরুলের।
লাঙল পত্রিকার শিরোনামের নীচেই লেখা ছিল-শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের মুখপাত্র । তৃতীয়ত, নজরুল শুধু লাঙলের জন্য কবিতা-গান-প্রবন্ধই রচনা করেননি, তিনি বাংলার শহর-গ্রাম চষে বেরিয়েছেন ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ’ দলের কাজে। আগেই বলেছি, এই দলটি ছিল ১৯২৫ সালে কানপুরে গঠিত ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির নিকটতম পূর্বসূরী, অনেক ক্ষেত্রে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাজ করবার জন্য ‘প্রকাশ্য ফ্রন্ট’। পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগ’, ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ প্রভৃতি দলের মধ্যে যেমন করে কম্যুনিষ্ট-বামপন্থীরা কাজ করতেন। লাঙলের পুস্তক-বিভাগ ছিল কলকাতার ৩৭ হ্যারিসন রোডে, যেখানে আগেই বলেছি নজরুল, মুজফ্ফর আমদ, আবদুল হালীম প্রমুখেরা একসাথে থাকতেন। সেখানে শুধু সমাজতন্ত্রী সাহিত্যই থাকত না, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী সাহিত্যও থাকত, এমনকি নারীমুক্তির সাহিত্যও থাকত। উদাহরণত, বেগম রোকেয়ার সব বই সেখানে পাওয়া যেত। লাঙলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত— ‘সুলেখিকা মিসেস আর এস হোসেন প্রণীত পদ্মরাগ (উপন্যাস); মতিচুর-১ম খণ্ড; মতিচুর-২য় খণ্ড’। এককথায়, বিশের দশকের মাঝামাঝি লাঙল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রগতিশীল চিন্তা-
বই পুস্তক, তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রমূল। সামগ্রিক আলোচনা বর্তমান প্রবন্ধের সাধ্যের বাইরে, আমি শুধু প্রধান ভাবনা, প্রধান মুহুর্তের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি। লাঙল পত্রিকাটি ব্রিটিশ সেন্সরশীপ বা রাজরোষে পরে খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। প্রথম সংখ্যাটি বার হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫, আর শেষ সংখ্যা বার হয় ১৫ এপ্রিল ১৯২৬ । লাঙল বন্ধ হওয়ার পর ‘বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল’-এর মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ায় ‘গণবাণী’। ‘লাঙল’-এর প্রথম সংখ্যাতেই র্যাডিকেল সব দাবী উচ্চারিত হয়েছিল। লাঙল যাদের মুখপাত্র সেই শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের উদ্দেশ্য, নিয়মাবলী ও গঠনপ্রণালী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছিল:
‘আমেরিকা, ইংলন্ড প্রভৃতি দেশে এখন বৈশ্যের রাজত্ব। এবার শূদ্রের পালা। এবার শূদ্রের প্রয়োজনে সমাজ চলবে। হিন্দু-মুসলমান-সমস্যা, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সমস্যা সব লাঙলের ফলার মুখে লোপ পাবে। তাই আমরা লাঙলের জয়গান আরম্ভ করলাম। লাঙল নবযুগের নব দেবতা। জয় লাঙলের জয় লাঙলের দেবতার জয়!’
এই দলের উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ:
১। উদ্দেশ্য: ‘নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাসূচক স্বরাজ্য লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।’
৩। কর্মনীতি ও সংকল্প: যেহেতু দেখা গিয়াছে যে গলাবাজি অথবা ত্রাস-নীতিতে অনিচ্ছুক আমলা-তন্ত্রের হাত হইতে স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইবার চেষ্টা অতীতে কেবলই বিফল হইয়াছে; আমলা-তন্ত্রের নিকট খোসামুদি দ্বারা ভারতবর্ষের লোকের অবস্থার প্রকৃত উন্নতি আনয়ন সম্ভব নয়, কিংবা সহস্র বন্ধনে আবদ্ধ স্বদেশীয়গণের সাহায্যেই নিরস্ত্রীকৃত জনসাধারণের স্বাধীনতা গুপ্ত হত্যার সাহায্যে আসিতে পারে না; বোমা এবং পিস্তলের শক্তি অপেক্ষা বহগুণে শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের চলমান শক্তির প্রয়োগ দ্বারাই নিরস্ত্র জাতির পক্ষে স্বাধীনতা লাভের একমাত্র উপায় বলিয়া বোধ হইতেছে।
যেহেতু শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ যেমন বলিয়াছেন যে শ্রেণীগত স্বার্থত্যাগী ভদ্র যুবক, শ্রমিক ও কৃষকের সংযোগ না হইলে ভারতের মুক্তি আসিবে না ।
অতএব ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায় এই ঘোষণা করিতেছেন যে, ভারতের জাতীয় দাবী পূরণের এখনও একমাত্র অবশিষ্ট উপায় এই যে, দেশের শতকরা আশি জন যাহারা— সেই শ্রমিক ও কৃষকগণকে সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং তাহাদিগের জন্মগত অধিকার লাভে সাহায্য করা, যাহাতে তাহারা রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে আরও সচেতন হইয়া নিজের ক্ষমতায় এবং নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাশীল স্বার্থপর ব্যক্তিগণের হাত হইতে স্বাধীনতা আনিতে পারে । এবং এতদর্থে উপরোক্ত উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায় নিম্নলিখিত কর্ম সংকল্পের অবতারণা করিতেছেন ।
এই দল শ্রমিক ও কৃষকগণের স্বার্থের জন্য লড়িবেন (ভদ্র এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের যে কোনও ব্যক্তি নিজের হাত-পা বা মাথা খাটাইয়া নিজের জীবিকা অর্জন করে, তাহাকেই শ্রমিক বলিয়া গণ্য করা হইবে)।’
৪। চরম দাবী:
(ক) আধুনিক কলকারখানা, খনি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, ট্রামওয়ে, স্টীমার প্রভৃতি সাধারণের হিতকারী
জিনিস, লাভের জন্য ব্যবহৃত না হইয়া দেশের উপকারের জন্য ব্যবহৃত হইবে এবং এতদ সংক্রান্ত কর্মীগণের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সম্পত্তি রূপে পরিচালিত হইবে।
(খ) ভূমির চরম স্বত্ত্ব আত্ম-অভাব-পূরণ-ক্ষম স্বায়ত্ব-শাসন-বিশিষ্ট পল্লীতন্ত্রের উপর বর্ত্তিবে— এই পল্লী-তন্ত্র
ভদ্র শূদ্র সকল শ্রেণীর শ্রমজীবীর হাতে থাকিবে ।
৫। এখনকার দাবী:
শ্রমিকদের জন্য দাবী
ক) জীবন-যাত্রার পক্ষে যথোপযুক্ত মুজরির একটা নিম্নতম হার আইনের দ্বারা বাঁধিয়া দেওয়া।
(খ) প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকের পক্ষে সপ্তাহে সাড়ে পাঁচদিন খাটুনি চরম বলিয়া আইন করা; নারী এবং অল্প
বয়স্ক ছেলেপিলের জন্য বিশেষ শর্ত নির্দ্ধারণ করা ।
(গ) শ্রমিকগণের আবাস, কাজের শর্ত, চিকিৎসার বন্দোবস্ত প্রভৃতি বিষয়ে কতকগুলি দাবী মালিকগণকে
আইন দ্বারা বাধ্য করিয়া পূরণ করানো।
(ঘ) অসুখ, বিসুখ, দূর্ঘটনা, বেকার অবস্থা এবং বৃদ্ধ অবস্থায় শ্রমিকগণকে রক্ষা করিবার জন্য আইন প্ৰণয়ন
ঙ) সমস্ত বড় কলকারখানায় লাভের ভাগে শ্রমিকগণকে অধিকারী করা।
চ) মালিকগণের খরচায় শ্রমজীবীগণের বাধ্যতা মূলক শিক্ষা ।
ছ) কলকারখানার নিকট হইতে বেশ্যালয়, নেশার দোকান উঠাইয়া দেওয়া ।
জ) শ্রমিকগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কো-অপারেটিভ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ।
(ঝ) শ্রমিক-সঙ্ঘ-গুলিকে আইনত মানিয়া লওয়া এবং শ্রমিকদের দাবী পূরণের জন্য ধর্মঘট করিবার অধিকার স্বীকার করা।
কৃষকদের জন্য দাবী
(ক) ভূমি-কর সম্বন্ধে একটা ঊর্দ্ধতম হার বাঁধিয়া দেওয়া এবং বাকি খাজনার সুদ ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের
সুদের হারের সহিত সমান নির্দ্ধারণ করা;
(খ) জমিতে কায়েমী স্বত্ত্ব প্রতিষ্ঠা; উচ্ছেদ নিরোধ; অন্যায় এবং বে-আইনি বাজে আদায় বন্ধ; স্বেচ্ছায় বিনা সেলামিতে হস্তান্তর করার অধিকার; গাছ কাটা, কূয়ো খোঁড়া, পুকুর কাটা, পাকা বাড়ী করার ক্ষেত্রে বিনা সেলামিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা।
(গ) জল-করে মাছ ধরিবার নির্দ্ধারিত শর্ত।
ঘ) মহাজনের সুদের চরম হার নির্দ্ধারণ;
(ঙ) কো-অপারেটিভ কৃষি-ব্যাঙ্ক স্থাপনের দ্বারা কৃষককে ঋণদান এবং মহাজন ও লোভী ব্যবসাদারগণের
হাত হইতে কৃষককে উদ্ধার ।
(চ) চাষে জন্য যন্ত্রপাতি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের মারফৎ কৃষকের নিকট বিক্রয় অথবা ব্যবহারের জন্য
ভাড়া দেওয়া। মূল্য অথবা ভাড়ার টাকা কিস্তীবন্দী হিসাবে অল্প অল্প করিয়া লওয়ার বন্দোবস্ত ।
ছ) পাটের চাষের কৃষকের উপযুক্ত লাভের বন্দোবস্ত ।
এই দলে যোগ দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ নিম্নলিখিত ঠিকানায় পত্র দিবেন:-
নজরুল ইসলাম, ৩৭ নং হ্যারিসন রোড, কলিকাতা ৷’
দলের উদ্দেশ্য ও দাবীনামা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে শ্রমিক-প্রজা পার্টির উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বা আধুনিক পরিভাষায়-জনগনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা (যেটা বিপ্লবোত্তর চীনে বা ভিয়েতনামে দেখতে পাই)। তার চাইতে লক্ষ্য করার পয়েন্ট হল যে এরকম দলে যোগ দেওয়ার জন্য সর্বাগ্রে নজরুলের সাথে যোগাযোগ করার কথা বলা হচ্ছে।
অর্থাৎ নজরুল এখানে ‘সংগঠকের’ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন ।
লাঙলের পাতায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল কার্ল মার্কসের জীবনী (লেখক-দেবব্রত বসু); গোর্কির ‘মা’ (অনুবাদক- নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়); কার্ল মার্কসের শিক্ষা (লেখক-মৌলবী কুদ্দীন আহ্মদ)। এছাড়াও ছিল সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের “হিন্দু-মুসলমান’; নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ ও ‘কৃষাণের গান’। এই শেষের কবিতাটিতে মার্কসবাদের প্রভাব অতি-প্রত্যক্ষ:
‘চারদিক হতে ধণিক বণিক শোষণকারীর জাত
জোঁকের মতন শুছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত
বুকের কাছে মরছে খোকা, নাইক আমার হাত,
সতী মেয়ের বসন কেড়ে খেলছে খেলা খল ।’
অথবা কবিতাটির শেষের স্তবকটি যেখানে লাঙলের তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করা হচ্ছে:
‘জাগ্ রে কৃষাণ সব ত গেছে কিসের বা আর ভয়
ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়
বল্ সবে ভাই, বল্ কৃষাণের বল্ লাঙলের জয়,
দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল ।’
স্পষ্টতই নজরুল বাংলায় বা ভারতবর্ষে কৃষিবিপ্লব বা কৃষকের অভ্যূত্থান কামনা করছিলেন, কেননা শিল্প
শ্রমিকের সংখ্যা তখনো নগণ্য ছিল দেশে। যদিও তাই বলে শিল্প শ্রমিককে হাতছাড়া করতে রাজী নন তিনি। তার জন্য তো ‘কুলি-মজুর’ কবিতাটি এর আগেই লেখা হয়েছিল ‘লাঙল’ পত্রিকায়।
এই সূত্রে একটা প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নটা ১৯২৬ সালেই উঠেছিল। এই যে কৃষক-শ্রমিক নিয়ে এত লেখালেখি তা কি মেহনতী মানুষেরা বুঝতে পারবে? এটা ক্লাসিক লেনিনীয় ‘What is to be done’-র প্রশ্ন। কীভাবে মধ্যবিত্তের সাথে, বুদ্ধিজীবির সাথে শ্রমিক-কৃষকের ভাষা-বিনিময় হবে? এমনই একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন তারানাথ রায় বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের সমালোচনা করে। গায়ত্রী স্পিভাকও বহুপরে এজাতীয় একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন— ‘Can the Subalterns Speak’? ততদিনে লাঙল বন্ধ করে দিয়েছে বৃটিশ সরকার; এর পরিবর্তে বার হচ্ছে ‘গণবাণী’। তার পাতাতে নজরুল তারানাথ রায়ের লেখার জবাব দিলেন। তারানাথ রায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, কৃষক- শ্রমিকরা এসব মতবাদ বুঝবে কেমন করে? তার উত্তরে নজরুল লিখছেন : ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকেরা লেখাপড়ার সঙ্গে গোটা কয়েক মতবাদ শিখলে ওগুলো শিগগিরই বুঝতে পারবেন?’- তাঁর ইঙ্গিতটা এবং রসিকতাটা দুটোই বুঝলাম
না, বুঝলাম শুধু তাঁর জানাশোনা কতটুকু— অন্তত সেই সম্বন্ধে, যে সম্বন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি কি জানেন না যে, কোনো দেশের কোনো শ্রমিক কার্ল মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ পড়ে বুঝতে পারবে না। ঐ মতবাদটা যারা পড়বে, তারা কৃষক-শ্রমিক নয়, তারা লেনিন ল্যান্সব্যারির নমুনার লোক। কার্ল ম্যার্ক্সের মতবাদ সাধারণ শ্রমিক বুঝতে না পারলেও তা দিয়ে তাদের মঙ্গল সাধিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এ মতবাদ দিয়ে এমন কতকগুলি লোকের সৃষ্টি হয়েছে যারা জগৎটাকে উল্টে দিয়ে নতুন করে গড়তে চাচ্ছেন বা গড়ছেন। মতবাদ কোনোকালেই জনসাধারণ বুঝবে না, মতবাদ তৈরি করে তুলবে সেই রকম লোক যারা বোঝাবেন এ মতবাদের মর্ম জনসাধারণকে। ইন্জিন চালাবে ড্রাইভার কিন্তু গাড়িতে চড়বে সর্বসাধারণ। ‘গণবাণী’ও কৃষক শ্রমিকের পড়ার জন্য নয়, কৃষক-শ্রমিকদের গড়ে তুলবেন যাঁরা— ‘গণবাণী’ তাঁদেরই জন্য। কৃষক-শ্রমিক দলের মুখপাত্র, মানে তাদের বেদনাতুর হৃদয়ের মূক মুখের বাণী ‘গণবাণী’ ও তাদের বইতে না পারা ব্যথা কথায় ফুটিয়ে তুলবে ‘গণবাণী’ ।’
একথা নজরুল লিখতে পেরেছেন একারণে যে তিনি গভীর ভাবে বামপন্থাকে বুঝে ছিলেন। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সাথে সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সংযোগ ঘটাতে হবে—এই ডায়ালেকটিকস্ তিনি বুঝতেন। ধূমকেতু – লাঙল-গণবাণী পর্বের নজরুলের লেখা ও কর্মতৎপরতা অনুসরণ করলে বোঝা যায় কেন এদেশের বামপন্থী আন্দোলনের আদি পুরুষদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তাকে শুধু ‘বিদ্রোহী’ বললে, বা দরদী ‘সাম্যবাদী’ বললে তার রাজনৈতিক ভিশনকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয় না। এমনকি ১৯৪১ সালে যখন নজরুল ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লিখছেন তখনো তার দৃষ্টি স্বচ্ছ পরিপার্শ্বের পট পরিবর্তনে ম্লান হয় নি এতটুকু। পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপনের পর তিনি বলছেন: ‘লীগ” কেন, ‘কংগ্রেস’কেও আমি কোনোদিন স্বীকার করিনি। আমার ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা তার প্রমাণ। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কোনোদিন লিখিনি— কিন্তু তার নেতাদের বিরুদ্ধে লিখেছি। যে কোনো আন্দোলনেরই হোক, নেতারা যদি নির্লোভ, নিরহংকার ও নির্ভয় না হন, সে আন্দোলনকে একদিন না একদিন ব্যর্থ হতেই হবে।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন:
‘আত্মত্যাগী সাধকেরাই আনিবেন বদ্ধ জীবনে প্রাণশক্তির দুর্জয় প্রবাহ। যাঁহারা নবযুগের ছেলেমেয়ে, তাঁহারা এই প্রবাহে যুক্ত হইয়া এই প্রবাহ-তরঙ্গকে গগনস্পর্শী করিয়া তুলুন— ইহাই নিপীড়িত মানবাত্মার প্ৰাৰ্থনা।‘
যতদূর বুঝতে পারি, সাপ্তাহিক লাঙলকে আপাত: দৃষ্টিতে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদলের মুখপত্র বলা হলেও (১৯২৬ সালের দিকে এসে এই নামই নেয় এটি) আসলে তা ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরই ‘প্রকাশ্য ফ্রন্ট’। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হত। ১৯২৬ সালের ৬-৭ ফেব্রুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে নিখিল-বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ‘কবি নজরুল ইসলাম পরিচালিত “লাঙল” পত্রিকাকে কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপাত্ররূপে আপাতত গ্রহণ করা হউক।’ তাসত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই সেখানে কমিউনিষ্ট পার্টির নানা সংবাদ। যেমন, ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারী লাঙলের চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশিত হল কানপুরে ভারতীয় প্রথম কম্যুনিস্ট কনফারেন্সে গৃহীত ‘পার্টির গঠন নীতি’ বা কানপুর সম্মেলনের সভাপতির দীর্ঘ ভাষণ যার বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় ‘সাম্যবাদ কি’; । এসব হুবহু ছাপা হয়েছে লাঙলে । উদ্ধৃতিটি বড়, কিন্তু বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসংগিক:
‘যেহেতু দেশীয় ও বৈদেশিক ধনিকগণের দ্বারা এবং ভারতীয় জমীদারগণের শোষণ-বৃত্তির দ্বারা ভারতবর্ষের শ্রমিক ও কৃষকগণ মানুষের মত জীবন যাপন করিতে পারিতেছে না, যেহেতু ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রীয় দলসমূহে বর্জুয়া (অভিজাত)-দেরই সমধিক প্রভুত্ব বিদ্যমান রহিয়াছে আর এই প্রভুত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় কৃষক ও শ্রমিকগণের উন্নতির পরিপন্থী, সেই হেতু ভারতীয় কম্যুনিষ্টগণের এই সম্মিলন প্রস্তাব করিতেছে যে ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মুক্তির জন্য একটি দল গঠিত হউক। এই দল ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টি (Communist Party of India) নামে অভিহিত হইবে। এই দলের চরম উদ্দেশ্য হইবে ভারতে কৃষক ও শ্রমিকগণের সাধারণ তন্ত্র (স্বরাজ) প্রতিষ্ঠিত করা।— ভূমি, খনি, গৃহ, টেলিগ্রাফ ও রেলওয়ে ইত্যাদি যে সমস্ত জন-সম্পদের উপর জন-সাধারণের অধিকার স্থাপিত হওয়া উচিত সেই সমস্ত সম্পদকে সর্ব্বাধিকারভুক্ত ও সর্ব্বনাগরিকের আয়ত্ব করিয়া ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মানুষের মত জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করার ব্যবস্থা করা কম্যুনিষ্ট পার্টির সাক্ষাৎ উদ্দেশ্য হইবে।
এই সমস্ত উদ্দেশ্য-সাধনে সাফল্য লাভের জন্য এই পার্টিকে সহরে ও মফস্বলে শ্রমিক ও কৃষকসম্ভব গঠিত করিতে হইবে, ডিষ্ট্রীক্ট ও তালুক বোর্ড মানুসিপালিটি ব্যবস্থাপক সভা সমূহে লোক প্রেরণ করিতে হইবে এবং এইরূপ অন্যান্য উপায় ও প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে। কোনো সাম্প্রদায়িক সভা বা সংগঠনের সভ্য এই পার্টির সভ্য হইতে পারিবেন না। ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির কংগ্রেস বা সম্মিলনের অধিবেশন বৎসরে একবার করিয়া ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হইবে ।
ইংল্যান্ডে যে সকল কম্যুনিষ্ট সম্প্রতি কারাবদ্ধ হইয়াছেন, সম্মিলন তাঁহাদিগকে সমবেদনা জানাইতেছেন এবং ইংল্যান্ডের সরকারের এরূপ ব্যবহারের প্রতি বিরক্তি প্রদর্শন করা হইয়াছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের কম্যুনিষ্ট ও ভারতীয় সদস্য মিঃ সাকলাওয়ালাকে যে আমেরিকাতে যাইতে দেওয়া হয় নাই তৎপ্রতিও সম্মিলন বিরক্তি প্রদর্শন করিয়াছে।
নিম্নলিখিত ভারতীয় কম্যুনিষ্টগণের কারাবরণেও সম্মিলন সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছে:-
১. মোহাম্মদ আকবার খান (১০ বৎসর, এখনো কারাগারে)
২. গওহর রহমান (২ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৩. মিঞা আকবর শাহ্ (২ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৪. সৈয়দ মোহাম্মদ হাবীব (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন
৫. আব্দুল মজীদ (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৬. রফিক আমদ (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৭. ফিরোজ দীন (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৮. মোহাম্মদ সুলতান (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
১২. মুজফ্ফর আদ (৪ বৎসর, যক্ষ্মারোগাক্রান্ত হওয়ায় ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে)
১৩. মোহম্মদ শফীক্ (৩ বৎসর, এখনো কারাগারে)’
লক্ষ্যণীয়, এই তালিকা অনুযায়ী গোড়ার পর্বে যারা কারাবাস করেছিলেন তাদের বেশির ভাগই মুসলিম।
বামপন্থীরা সেসময়ে অসম্ভব সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। প্রকাশ্যে মুজফ্ফর আহমদ লাঙলের পাতায় লিখছেন ‘শ্ৰেণী সংগ্রাম’ এবং ‘কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন’; নজরুল লিখছেন শ্রমিকের গান’; দেব্রত বসু লিখছেন ধারাবাহিক রচনা‘লেনিন ও সোভিয়েট রুশিয়া; হৃষিকেশ সেন লিখছেন ‘বাংলার প্রজাসত্ব বিষয়ক বিধি’; সুমার চক্রবর্তী লিখেছেন ‘চীনের নবজন্ম’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। ১০ম সংখ্যায় প্রচ্ছদ নিবন্ধ হচ্ছে ছোট কিন্তু তাৎপর্য্যপূর্ণ শিরোনামের লেখা—
‘সোস্যালিজম কাকে বলে?’। অন্যদিকে, প্রায়-অপ্রত্যাশিত ভাবে বেরুচ্ছে ১৮৫৩ সালে লেখা মার্কসের প্রবন্ধের অনুবাদ— ‘ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষের একটি চিত্র’। তাছাড়া থাকছে পাতায় পাতায় বিভিন্ন জেলার প্রজা-সম্মিলনের সাংগঠনিক খবরাখবর, যার মধ্যে সক্রিয় অংশ নিচ্ছেন কবি নজরুল ইসলাম নিজে, কখনো প্রধান বক্তা, কখনো সভাপতি হিসেবে। এই সবই হচ্ছে নজরুলের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় ।
ধূমকেতু আর লাঙল বাংলায় র্যাডিকেল কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের দুই বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়। ধূমকেতু আধা- জাতীয়তাবাদী আধা-বামপন্থী; লাঙল সে তুলনায় পুরোপুরি সমাজবাদে আচ্ছন্ন। নজরুল সেখানে কেবল গান করছেন না, বক্তৃতাও দিচ্ছেন, সংগঠন নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছেন; আজ এখানে, কাল ওখানে; এবং এসব করতে গিয়ে তার শরীর মাঝে মাঝেই বাগড়া দিচ্ছে। সে খবরও লাঙলে বেরুচ্ছে— কবি অসুস্থ, তিনি দুর্ভাগ্যবশত সভায় যেতে পারছেন না। তিনি সবার কাছে তার পত্রখানি পাঠিয়েছেন। যেমন, ময়মনসিংহের প্রজা সম্মিলনীতে তার যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু শরীরের অসহযোগে যেতে পারেননি সেখানে। পরিবর্তে একটি পত্র পাঠালেন— সেখান থেকেও তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে তা বোঝা যায়:
‘আমার প্রিয় ময়মনসিংহের প্রজা ও শ্রমিক ভ্রাতৃবৃন্দ !
আপনারা আমার অন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, আপনাদের এই নবজাগরিত প্রাণের স্পর্শে নিজেকে পবিত্র করিয়া লইব, ধন্য হইব। কিন্তু দৈব প্রতিকূল হওয়ায় আমার সে আশা পূর্ণ হইল না । আমার শরীর আজও রীতিমত দুৰ্ব্বল, একস্থান হইতে অন্যস্থানে যাইবার মত শক্তি আমার একেবারেই নাই । আশা করি আমার এই অনিচ্ছাস্বত্ত অক্ষমতা সকলে ক্ষমা করিবেন। এই ময়মনসিংহ আমার কাছে নূতন নহে। এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ভাবে ঋণী । আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে। এইখানে থাকিয়া আমি কিছুদিন লেখাপড়া করিয়া গিয়াছি। আজও আমার মনে সেই সব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্কর হইয়া জ্বলিতেছে। বড় আশা করিয়াছিলাম, আমার সেই শৈশব-চেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদার- হৃদয় ময়মনসিংহ জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার লৌহ-প্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব, কিন্তু তাহা হইল না, দুরদৃষ্ট আমাদের। যদি সর্ব্বশক্তিমান আল্লাহ্ দিন দেন, আমার স্বাস্থ্য ফিরিয়া পাই, তাহা হইলে আপনাদের গফরগাঁওয়ের নিখিল বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনীতে যোগদান করিয়া ও আপনাদের দর্শন লাভ করিয়া ধন্য হইব। আপনারাই দেশের প্রাণ, দেশের আশা, দেশের ভবিষ্যৎ। মাটির মায়ায় আপনাদেরই হৃদয় কাণায় কাণায় ভরপুর। মাটির খাঁটি ছেলে আপনারাই। রৌদ্রে পুড়িয়া বৃষ্টির জলে ভিজিয়া-দিন নাই রাত নাই— সৃষ্টির প্রথম দিন হইতে আপনারাই ত এই মাটির পৃথিবীকে প্রিয় সন্তানের মত লালন পালন করিয়াছেন, করিতেছেন, ও করিবেন,- আপনাদের মাঠের এক কোদাল মাটি লইলে আপনারা… শির লেন কিবা তাকে শির দেন, এত ভালবাসায় ভেজা যাদের মাটি, এক বুকের খুনে উর্ব্বর যে শস্যশ্যামল মাঠ, আপনারা আমার কৃষাণ ভাইরা ছাড়া তাহার অন্য অধিকারী কেহ নাই। আমার এই কৃষাণ ভাইদের ডাকে বর্ষায় আকাশ ভরিয়া বাদল নামে, দেব বুকের স্নেহ ধারার মতই মাঠ ঘাট পানিতে বন্যায় সয়লাব হইয়া যায়, আমার এই কৃষাণ ভাইদের আদরে সোহাগে মাঠঘাট ফুলে ফলে ফসলে শ্যাম সবুজ হইয়া উঠে,-আমার কৃষাণ ভাইদের বধূদের প্রার্থনায় কাঁচা ধান সোনার রঙে রাঙিয়া উঠে,এই মাঠকে জিজ্ঞাসা কর, মাঠে ইহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইবে,– এ মাঠ চাষার এ মাটি চাষার, এর ফুল ফল কৃষক-বধূর ।
৪. বিবিধপ্ৰসংগ
নজরুলের নিজের লেখায় সমাজতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বামপন্থা নিয়ে সুপ্রচুর উল্লেখ ও ইংগিত আছে । এর পুরো বিবরণ দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। একে শুধু বিদ্রোহী মানবতাবাদ বললে সত্যের অপলাপ করা হয় । ধূমকেতু, লাঙল ও গণবাণীর নজরুল কখনো কোমল মানবতাবাদের দ্বারস্থ হননি। সেভাবে তাকে দেখাও অন্যায় ৷ তিনি ছিলেন রুদ্রমঙ্গলের কবি। রবীন্দ্রনাথ এটা জানতেন। ধূমকেতু-র প্রথম সংখ্যা থেকেই রবীন্দ্রনাথের স্বাগতবাণী নিয়মিত ভাবে ছাপা হতো। রবীন্দ্রনাথ সত্য সত্যই বিশ্বাস করতেন যে নজরুলের ধূমকেতু অর্ধচেতনদের আঘাত করে জাগাতে পারবে :
“অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে
আছে যারা অর্ধ্বচেতন।”
তারপর যখন ধূমকেতু বন্ধ হয়ে লাঙল প্রকাশিত হলো তখনো রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে নজরুল আসলে
লাঙলকে চরকার কাউন্টার-পয়েন্ট হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মুজফ্ফর আমদের সংগী— ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির আরেক জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য । নজরুল, মুজফ্ফর ও সৌমেন্দ্রনাথ মিলে যখন লাঙল বের করলেন— তাদের আসল উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের বুঝতে দেরী হয় নি। লাঙলের প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই থাকত রবীন্দ্রনাথের একটি করে উদ্ধৃতি। যেমন, একটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অন্ধকারে !
সবারে না যদি ডাক’,
এখনো সরিয়া থাক’,
আপনারে বেঁধে রাখত চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান
মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান ।‘
উল্লেখ্য, লাঙলের প্রতিটি সংখ্যাতেই পত্রিকার টাইটেলের পরেই থাকত চণ্ডীদাসের চরণ:
“শুনহ মানুষ ভাই—/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’
নজরুল তার বামপন্থাকে শুধু প্রবন্ধে নয়, চিঠিপত্রে নয়, কবিতায় বা গানে নয়, গল্প-উপন্যাসেও ধারণ
করেছেন। আবারো বলছি, এর বিশ্লেষণ গভীর মনোযোগ ও বৃহত্তর পরিসর দাবী করে। উদাহরণ এত অসংখ্য এবং এত স্পষ্ট যে এনিয়ে সামান্য ইংগিতই যথেষ্ট । ১৯২৭ সালে লেখা ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের মূল চরিত্র আনসারকেই ধরা যাক। সে ছিল র্যাডিক্যাল মতের প্রবক্তা নজরুলের মতই । তার শেষ কথা ছিল এমন:
‘পরদিন সকাল না হতেই কৃষ্ণনগরে একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল! দলে দলে পুলিশ এসে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বাড়িতে খানাতল্লাশ করতে লাগল। বহু ছাত্র ও তরুণকে হাজতে পুরল ।
আনসারকে ধরবার জন্যে সশস্ত্র রিজার্ভ পুলিশ সারা রাত ধরে বাগানের গাছে, নাজির সাহেবের বাড়ির আনাচে-কানাচে পাহারা দিচ্ছিল, ভোর না হতেই তারা ঘুমন্ত আনসারকে বন্দি করল। শহরময় রাষ্ট্র হয়ে গেল, নাজির সাহেবের শালা আনসার রাশিয়ার বলশেভিক চর ও বিপ্লবী নেতা। সে ছেলেমেয়ের মধ্যে কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচার করছিল এবং তাদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করছিল।’…পুলিশ যখন তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন জনগণের দিকে তাকিয়ে আনসার বলতে লাগল, ‘বন্ধুগণ ! আমার বিদায়কালে তোমাদের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, তোমরা তোমাদের অধিকারের দাবি কিছুতেই ছেড়ো না ! তোমাদেরও হয়তো আমার মতো করেই শিকল পরে জেলে যেতে হবে, গুলি খেয়ে মরতে হবে, তোমারই দেশের লোক তোমার পথ আগলে দাঁড়াবে, সকল রকমে কষ্ট দেবে, তবু তোমরা তোমাদের পথ ছেড়ো না, এগিয়ে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত হয়ো না। আগের দল মরবে বা পথ ছাড়বে, পিছনের দল তাদের শূন্যস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। তোমাদের মৃতদেহের ওপর দিয়েই আসবে তোমাদের মুক্তি।’
এরকম কথা নজরুলের মনে বহুদিন ধরেই বাজছিল । তিনি ধূমকেতুর পর্বেই বলেছিলেন:
‘জাগো জনশক্তি! হে আমার অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক, আমার মুটে-মজুর ভাইরে ! তোমার হাতের এ-লাঙল আজ বলরাম-স্কন্ধে হলের মতো ক্ষিপ্ত তেজে গগনের মাঝে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক, এই অত্যাচারীর বিশ্ব উপড়ে ফেলুক—উলটে ফেলুক! আন তোমার হাতুড়ি, ভাঙ ঐ উৎপীড়কের প্রাসাদ-ধুলায় লুটাও অর্থ-পিশাচ বল-দর্পীর শির । ছোড়ো হাতুড়ি, চালাও লাঙল, উচ্চে তুলে ধর তোমার বুকের রক্ত-মাখা লালে-লাল ঝাণ্ডা! যারা তোমাদের পায়ের তলায় এনেছে, তাদের তোমরা পায়ের তলায় আন। সকল অহঙ্কার তাদের চোখের জলে ডুবাও। নামিয়ে নিয়ে এস ঝুঁটি ধরে ঐ অর্থ-পিশাচ যক্ষগুলোকে। তোমাদের পিতৃ-পুরুষের রক্ত-মাংস-অস্থি দিয়ে ঐ যক্ষের দেউল গড়া, তোমাদের গৃহলক্ষ্মীর চোখের জল আর দুধের ছেলের হৃৎপিণ্ড নিঙড়ে তাদের ঐ লাবণ্য, ঐ কান্তি । তোমাদের অভিশাপ- তিক্ত মারি-বিষ-জ্বালা লাগিয়ে তাদের সে-কান্তি, সে-লাবণ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দাও ! ’
অনেকে মনে করতে পারেন যে বামপন্থার প্রতি নজরুলের আকর্ষণ একটি কাকতালীয় ঘটনা, সাময়িক উপসর্গ কেবল, যা কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাথে বন্ধুত্বের কারনে একটা প্রভাব বিস্তার করেছিল পরবর্তী জীবনে । আসলে অন্য সব আইডিওলজির মত বামপন্থী ভাবদর্শের প্রতি আকর্ষণ হওয়ারও একটি পূর্ব-ইতিহাস থাকে। রানীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুল সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। বার্ষিক পরীক্ষার পরে ডবল প্রমোশন পেয়ে তিনি নবম শ্রেণীতে উঠে যান। সেখানে তার সহযোগী ছিলেন পরবর্তী যুগের সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। যা হোক, সেই স্কুলে নিবারণচন্দ্র ঘটক নামে নজরুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। নিবারণচন্দ্রের আদর্শের দ্বারা কিশোর নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন বিপ্লবী আদর্শের প্রতি। এটি কবি নজরুল নিজে মুজফ্ফর আদকে পল্টন থেকে ফেরার পরে বলেছিলেন । ১৯১৭ সাথে নিবারণচন্দ্র ঘটক ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা বেআইনী অস্ত্র-শস্ত্র সমেত গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। নিবারণচন্দ্রের প্রভাব ছিল সশস্ত বিপ্লবী জীবনের প্রতি নজরুলের আকর্ষণ সৃষ্টি করার মধ্যে সীমিত। কিন্তু আদর্শবাদী বামপন্থার প্রতি টানের পেছনে ছিল রুশ বিপ্লবের প্রভাব। নজরুল তখন পল্টন জীবনে। করাচিতে যে ব্যারাকে তারা থাকতেন সেখানে যেকোনো রকমের রাজনৈতিক সাহিত্যের প্রবেশ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও ‘গোপন সুড়ঙ্গের’ মধ্য দিয়ে সেই ব্যারাকে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক বই-পত্র ঢুকত। এসম্পর্কে নজরুলের পল্টনজীবনের সহকর্মী জমাদার শম্ভু রায়ের লেখা থেকে জানতে পারি যে নজরুল বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই রাজনৈতিক সাহিত্য বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। সেরকম এক সন্ধ্যার বিবরণ দিয়েছেন তিনি। তখন সদ্য সদ্য রুশ বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছে রাশিয়ার পেট্টোগ্রাড়ে। বিষয়টি এই রকম:
‘…নজরুল সেই দিন যে-সব গান গাইল ও প্রবন্ধ পড়ল তা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গান বাজনা প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লালফৌজের দেশপ্রেম নিয়ে নজরুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে এবং ঠিক নাম মনে নেই সে গোপনে আমাদের একটি পত্রিকা দেখায়। ঐ পত্রিকাতে আমরাও বিশদভাবে সংবাদটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। সে দিন সারা রাতই প্রায় হৈ হুলুড়ে আমাদের কেটে গিয়েছিল।’
১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে নজরুলের ‘ব্যথার দান’ গল্পটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। এই নামে তাঁর একটি গল্প-সংগ্রহও বার হয়। বাংলা সাহিত্য এই ‘ব্যথার দান’ গল্পেই সর্বপ্রথম ‘রেড আর্মির’(লালফৌজ) প্রসঙ্গ আসে। ১৯২০ সালে যখন এই গল্পটি প্রকাশিত হয় তখনো গৃহযুদ্ধ চলছিল বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। এই যুদ্ধ চলছিল ‘হোয়াইট আর্মি’ আর ‘রেড আর্মি’-এর মধ্যে। হোয়াইট আর্মিকে মদদ দিচ্ছিল পশ্চিমা দেশগুলো— যারা চাইছিল রাশিয়ায় পাশ্চাত্যঘেঁষা জারতন্ত্রের পুন:প্রতিষ্ঠা । রেড আর্মি বা লাল ফৌজের প্রধান সংগঠক বা অধিনায়ক ছিলেন লেনিন-সহচর লিওন ট্রটস্কী। ট্রটস্কীর নেতৃত্বে রেড আর্মি একের পর এক জয় ছিনিয়ে নিচ্ছিল। এসব ঘটনা যুবক নজরুলকে প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত করে থাকবে। এরই ফলে বেদৌরা, দারা ও সয়ফুল মুল্কের মধ্যকার ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ‘ব্যথার দানে’ চলে আসে রেড আর্মির প্রসংগ। বাস্তবেও রেড আর্মিতে—বিশেষত মধ্য-এশিয়ার অভিযানে — অনেক ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ আর্মি ছেড়ে রুশ সেনাদলে যোগ দিতে চলে গিয়েছিল । গল্পের দুটি চরিত্র দারা ও সয়ফুল মুল্ক বেলুচিন্তান থেকে আফগান্তিানের দুর্গম এলাকা পার হয়ে তুর্কিস্তান অথবা ককেশাসে গিয়ে রেড আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং কাউন্টার-রিভোলিউশনারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। রেড আর্মিতে যোগ দেওয়ার অনুভূতিটি সয়ফুল মুল্ক এভাবে প্রকাশ করেছে:
‘ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই লালফৌজে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছে। মনে করেছে, এদের এই মহান নি:স্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নি:স্বার্থপরতা প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তি সঙ্গের একজন।’
এখানে বলে রাখা দরকার মূল গল্পের আদি-পাঠে ‘লাল ফৌজ’ কথাটা থাকলেও প্রকাশিত পাঠে ‘লালফৌজ’ কেটে দিয়ে ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’ বসানো হয়েছিল। এ কাজটি করেছিলেন মুজফ্ফর আহমদ স্বয়ং। ব্রিটিশ সেন্সরশীপে শুধুমাত্র ‘রেড আর্মি’ শব্দটি ব্যবহারের জন্যই যেকোন লেখক বা প্রকাশককে জেলে যেতে হত। এমনই ছিল সেদিনের চন্ডনীতি ।
রুশ-বিপ্লব ও আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে নজরুলের সাংবাদিক কর্মতৎপরতা, তার সাংগঠনিক কাজ ও সবার উপরে তার সৃষ্টিশীল কবিতা-গান-উপন্যাস-প্রবন্ধমালা যেমন বৃটিশের রুদ্র-রোষ ডেকে এনেছিল, তেমনি বিশ্বের প্রগতিশীল বৃত্তের দৃষ্টি কেড়েছিল। কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্ণের মনোযোগ গিয়ে পড়েছিল নজরুলের লেখনীর প্রতি । তাঁর লাঙল ও ওয়াকার্স-পেজেন্টস পার্টির কর্মকান্ড কমিন্টার্ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঘনিষ্ঠ ভাবে অনুসরণ করতেন। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন যে, লাঙল পত্রিকা রুশ দেশে যেত। লেনিনগ্যান্ড ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউটের পারস্য ও ভারতীয় ভাষা সমূহের অধ্যাপক ‘দাউদ আলী দত্ত’ লাঙলের সম্পাদককে ১৯২৬ সালের চিঠিতে লিখছেন, ‘আমার মনে হয়, ‘লাঙল’ই সর্বপ্রথম পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছে, অর্থাৎ, আমি বলতে চাই যে ভারতের আত্মোৎপন্ন সম্পদে বঞ্চিত সম্প্রদায়ের (proletariat) জাগরণশীল শ্রেণী চৈতন্যের ‘লাঙল’ প্রথম মুখপত্র। এর উদ্দেশ্যসমূহের সহিত আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে এবং ইহা সাফল্যমন্ডিত হোক্ সর্বান্ত: করণে এই কামনা আমি করছি।’
লেনিনগ্রাদ ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট সরাসরি ভাবে কমিন্টার্ণের সেক্রেটারিয়েটের জন্য কাজ করত । পরবর্তীতে এর সাথে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখার্জী, এই পূর্ববঙ্গের গোলাম আম্বিয়া খান লোহানী প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। লোহানীর একাধিক লেখা রয়েছে নজরুলের ওয়াকার্স-পেজেন্টস্ পার্টির কর্মকান্ড সম্পর্কে ।
মুজফ্ফর-নজরুল প্রতিষ্ঠিত ১৯২৮ সালের অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস্ পার্টিকে ছোট করে দেখবার উপায় নেই। এর পুর্বসূরী ছিল ১৯২৫ সালের লাঙল ও বঙ্গীয় শ্রমিক-প্রজা দল। লাঙল নিষিদ্ধ করার পর খড়গ নেমে আসে ওয়াকার্স এন্ড পেজেন্টস্ পার্টির ওপরেও। ১৯২৯ সালের মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ওয়ার্কার্স এণ্ড পেজেন্টস পার্টি আসলে ‘ছদ্মাবরণে কমিউনিস্ট পার্টি’। ব্রিটিশের এই মূল্যায়নটি সঠিক
আগেই বলেছি, ধূমকেতু ও লাঙলের পর নজরুল ‘গণবাণী’ পত্রিকার সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হন । ঐ পত্রিকার অফিসে বসেই ১৯২৬ সালে আন্তর্জাতিক সাম্যের গান ‘ইন্টারন্যাশনাল’-এর অতুলনীয় বাংলা অনুবাদ করেন ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’ যেখানে লেখা ছিল:
‘শোন্ অত্যাচারী! শোনরে সঞ্চয়ী!
ছিনু সর্ব হারা, হব সর্বজয়ী ॥
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ।
এই “অন্তর-ন্যাশনাল সংগতি”রে
হবে নিখিল-মানব জাতি সমুদ্ধত” ॥
কমিনটার্ণের পক্ষ থেকে একাধিকবার নিমন্ত্রণও এসেছিল নজরুলের কাছে স্বাস্থ্য-পুনরুদ্ধারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে যেতে। মুজফ্ফর স্বয়ং এটি নজরুলকে বলেছিলেন। যেকোন কারণেই হোক, নজরুলের আর মস্কো যাওয়া হয় নি । সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের grand-nephew) মীরাট ষড়যন্ত্রের মামলার আগেই মস্কো চলে যান। তিনি ছিলেন সাম্যবাদী ও বামপন্থী নজরুলের একান্ত অনুরাগী। তাঁর স্মৃতিকথা ‘যাত্রী’-তে লিখেছেন:
‘[নজরুলের] প্রাণ ছিল তার ঐ হাসির মতই সরল প্রবল ও দরাজ! এই অসহ্য-মুখ-মেরে দেওয়া মিঠে ভাব নজরুলের আদবেই ছিলো না। প্রবল হোতে সে ভয় পেতো না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাংলাদেশে।‘
লাঙলের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনি। বঙ্গীয় শ্রমিক-প্রজা দলেরও তিনিই ছিলেন প্রধান পুরুষ । পরবর্তীতে ওয়ার্কার্স-পেজেন্টস পার্টিরও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্ব । লাঙলের জন্য আশীর্বচনে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে হলধর বলরামের সাথে তুলনা করেছিলেন:
‘জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরুভাঙ্গা হল
প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল ।’
শুধু নজরুলের গান-কবিতা নয়, আমরা যেন তার সাম্যবাদী আদর্শ ও জীবনের পরম অভিপ্রায় সাধারণ
মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করা—সেটাকেও যেন মনে রাখি।
দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু ১৯৬৯-’৭০ সালের দিকে এ চিত্র পুরোপুরি উল্টে যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা নাই–বা বললাম। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান বা অধিবাসীরা ১৮৭২ সালের শুমারি থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এক শতাব্দী ধরেই সমকক্ষতার লড়াইয়ের প্যারাডাইমের মধ্যে ছিল; প্রথমে বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে, পরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে।
বাংলাদেশ নিয়ে আমার আশাবাদের উৎসের কথা বলতে চাই। ১৯৭২ সালেও আমরা মনে করেছি, অনেক বড় কিছু অর্জনের জন্যই বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, ’৭৬ থেকে ’৮১ সালের মাৎস্যন্যায়, পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো এত সব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও আমাদের কখনো মনে হয়নি যে আমরা বড় কিছু অর্জন করতে পারব না। এ আশার উৎস মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের আগের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের চর্চা।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বা আমাদের সংবিধানের মূল আদর্শগুলো রাতারাতি আসেনি। আমার দেখা নয়া চীন বইয়ে তরুণ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ সর্বস্তরে চীনের মতো না হলে তো দেশ-জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা কেন অবাক হব? সমকক্ষতার লড়াইয়ের পরে আসে আদর্শের নির্মাণের বিষয়টি। আদর্শের নির্মাণের পেছনেও একটি বড় ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা ছিল। এর পেছনে অর্থনীতিবিদ, কবি, রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতির সংগঠকদের ধারাবাহিক অবদান ছিল। আদর্শ নির্মাণের দীর্ঘ পরম্পরায় আমাদের সংবিধানের চারটি স্তম্ভ এসেছে।
সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার ধারণা এ দেশে রাতারাতি আসেনি। আদর্শের নির্মাণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আগের এবং পরবর্তী ইতিহাসের বড় অর্জন। সেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের একটা প্যারাডাইম খুব সচেতনভাবে বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই এটা বলেছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের ১৯৪৯ সালের ঘোষণা ও কর্মসূচিতে প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বার্তা আছে। ’৬৪ সালের পুনরজ্জীবিত আওয়ামী লীগে, ’৬৭ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় ঘোষণা কর্মসূচিতে, ’৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে,’৭১ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের একাধিক ভাষণে এর উল্লেখ আছে।
তবে বাস্তবতা এভাবে এগোয় না। আমরা শুধু পরিকল্পনার জগতে বাস করি না, বরং আমরা সত্যিকার অর্থেই সামাজিক এবং শ্রেণিস্বার্থতাড়িত। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের জাতীয়তাবাদেও আমরা দুটি প্রবণতা দেখতে পাব—একটি রক্ষণশীল, আরেকটি প্রগতিশীল। রক্ষণশীল প্রবণতাটি এলিট বা ধনিক শ্রেণির ব্যবসা-শিল্প ও ব্যক্তিগত স্বার্থের বিকাশের সঙ্গে জড়িত। ব্যক্তিগত স্বার্থ অনেক সময় জাতিগত স্বার্থের সঙ্গে মিলে যায়। অন্যটি কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র, মেহনতি মানুষের আন্দোলনের ধারা। ভাষা আন্দোলনের পর থেকে একাত্তর পর্যন্ত এই ধারারই প্রাধান্য ছিল। ১৯৬০-এর দশক থেকে আইয়ুব খানের সময়ে একটা শিল্প-বুর্জোয়া, আমলা ও ধনিক শ্রেণি তৈরি করার প্রবণতা দেখা যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদেরও আমলে নিয়েছিল। ঘোষণা ও কর্মসূচিগুলো অনুসরণ করলে মনে হবে, কোথাও কোথাও এটা বামপন্থার দিকে চলে যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো জায়গায় মধ্যপন্থার দিকে থাকার চেষ্টা হচ্ছে। রাজনৈতিক অবস্থা আর বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপের ওপর ভিত্তি করে এ দুইয়ের মধ্যে সচেতন একটা সমন্বয়ের চেষ্টা দেখা যায়।
জাতীয়তাবাদের এই দুই প্রবণতাকেই আওয়ামী লীগ ধারণ করেছিল। একটা সময়, বিশেষ করে ছয় দফা ভালো করে পড়ে দেখলে দেখা যাবে যে এর মধ্যে পরিষ্কারভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিসক্যাল ফেডারেলিজমের কথা আছে। বোঝা যায়, একটা প্রাগ্রসর চেতনা থেকে এটা লেখা হয়েছে। ’৭২ সালের সংবিধান বিতর্কে জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল প্রবণতাটি জয়ী হয় এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণা চলে আসে। ধনিক শ্রেণি যাতে কোনোভাবেই প্রভাবশালী হয়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, এই মর্মে স্পষ্ট একটা অবস্থান ছিল।
প্রশ্ন হলো, ১৯৬০-এর দশকে মাত্র ৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত যত বড় বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারল, এখনকার মধ্যবিত্ত ৩০ শতাংশ হয়েও কেন সাম্য বা স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলো প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সুবিধাবাদিতার প্রবণতা থাকে। আবার সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পরার্থপরতারও প্রবণতা থাকে। ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত পরার্থপর হওয়ার বড় কারণ হলো সেটা কেবল অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল না, এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও ছিল। আমাদের ৩০ শতাংশ অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত বৈশ্বিক বা অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বুদ্ধিজীবিতার উপাদান অনুপস্থিত। জ্ঞানমনস্কতার পেছনে এরা ছুটছে না, ব্যক্তিগত স্বার্থের তৎপরতাই এদের মুখ্য। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতসহ বহু দেশেই আমরা এটি দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের কাছের সমস্যা উন্নয়নের; দূরের সমস্যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার। অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, দূরের লক্ষ্য এখনই অর্জন করা যাবে না বলে তাকে ভুলে গেলে চলবে না। তাকে মনে রেখেই কাছের লক্ষ্যগুলোকে অর্জন করতে হবে। আমরা আগে সব ব্যর্থতার জন্য শ্রেণিস্বার্থকে দায়ী করতাম, এখন রাজনীতিকে করছি। কিন্তু রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার পেছনে বৃহত্তর কারণ আছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি বা সংবিধানের সমতামুখী আদর্শগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার একটা কারণ হলো আমরা এখন টাকার পেছনে ছোটা একটি সমাজে পর্যবসিত হয়েছি। এ ধরনের সমাজ কোনো রীতিনীতি-নিয়ম-রুচি মেনে চলে না। কেন আমরা একটি জ্ঞানমনস্ক সমাজে পরিণত হতে পারলাম না, সেটি গভীরভাবে ভাবা দরকার। এ জন্য হয়তো আমাদের আরও বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। এমন কিছু বেশি সময় তো পার হয়নি।
— বিনায়ক সেন: মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
আকবর আলি খান বহুমাত্রিক সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। সাধারণত দুই ধরনের সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ দেখা যায়। একদল নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডিতেই বিচরণ করতে ভালোবাসেন, তাঁদের আমরা স্পেশালিস্ট বলি। আরেক দল আছেন, তাঁরা নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে আরও বহুবিধ ক্ষেত্রে উৎসাহ দেখান, বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। আকবর আলি খান ছিলেন দ্বিতীয় ধারার সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসাহ প্রসারিত হয়েছিল বনলতা সেন থেকে দারিদ্র্য বিশ্নেষণ অবধি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশিষ্টতা খোঁজার পাশাপাশি পরার্থপরতার অর্থনীতি অনুসন্ধান, সুশাসন সম্পর্কিত ফ্রেন্ডলি ফায়ার বইটি থেকে আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। তবে বহুবিধ বিষয়ে বিচরণ করলেও, তিনি প্রথমত ও প্রধানত ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। ইতিহাসচিন্তা তাঁর সমাজচিন্তাকে ধারণ করেছে। তাঁর অর্থনৈতিক বিশ্নেষণকে সমৃদ্ধ করেছে। এসবই জানা কথা। আমি এখানে কয়েকটি বইয়ের সূত্রে, যে সুবাদে আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা করার, সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলব। ১. নেশনের প্রাক-ইতিহাস প্রথমেই আসি তাঁর সবচেয়ে মৌলিক ও সুবিদিত কারণে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ডিসকভারি অব বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বইটির শিরোনাম শুনে পাঠকমাত্রেরই মনে পড়তে পারে ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া শীর্ষক জওহরলাল নেহরুর বইটির কথা। জওহরলাল নেহরু লিখিত বইটি ছিল মূলত বর্ণনামূলক এবং সময়ের ধারাবাহিকতাকে ধরার চেষ্টা। পক্ষান্তরে আকবর আলি খানের ডিসকভারি অব বাংলাদেশ মূলত বিশ্নেষণাত্মক এবং তাঁর অভিনিবেশ ছিল- কী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণ করা যায়। বাংলাদেশ বা পূর্ববঙ্গকে ঘিরে যে ভূখণ্ড বা তার অধিবাসী যারা, তাদের যে বৈশিষ্ট্য, তা তাদেরকে ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা করে। শুধু তাই নয়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড-ভূগোলের অধিবাসীদের থেকেও তাদের বিশিষ্ট করে। সেই বিশিষ্টকরণের সূত্র খুঁজছিলেন আকবর আলি খান। সেদিক থেকে এটি একটি চমৎকার পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণজাত গবেষণা গ্রন্থ। এখানে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল কয়েকটি। একটি হচ্ছে- এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতার দিক কী কী। তিনি সেই ক্ষেত্রে দেখেছিলেন- এই ভূখণ্ড লেস রেজিমেন্টেড, কম শৃঙ্খলাবদ্ধ। তিনি যেটা বলেছেন, বাংলাদেশের গ্রাম হচ্ছে ওপেন জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। এর বিপরীতে উত্তর ভারতীয় গ্রামগুলোকে বলেছেন ক্লোজড জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। সেই সমস্ত গ্রামে ঢুকতে গেলে একটা সীমানা প্রাচীর পেরোতে হয়। বাউন্ডারি দেওয়া। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের তুলনাতেও বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে মনে হয়েছে, সেগুলো অনেক ছড়ানো ছিটানো। সেখানে অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে, ফাটল রয়ে গেছে। তিনি বলছেন, এর কারণ বোধকরি এই যে, এই গ্রামগুলো কোনো সবল ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর কখনও ছিল না বা মাথা নত করেনি। বরং অন্যান্য জায়গা থেকে অত্যাচারিত বা এক্সক্লুডেড হয়ে যারা এই ভূখণ্ডে এসেছে, তারা সহজে আশ্রয় নিতে পেরেছে। জিওগ্রাফির সঙ্গে সোশ্যাল এক্সক্লুশন এবংপলিটিক্যাল ইসলামের একটি আন্তঃসংযোগ তিনি স্থাপন করেছেন। এই সূত্রে তিনি আরও লক্ষ্য করেন, ইসলাম যে এই পূর্ববঙ্গে একাদশ শতক থেকে বিস্তার লাভ করেছিল, তার পেছনে মূলত কোন কোন উপাদান কাজ করেছে। এ নিয়ে আলাদা করে তাঁর আরেকটি বই বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। যার নাম ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য :একটি ঐতিহাসিক বিশ্নেষণ’। সেখানে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য ছিল- অসির বলে ইসলাম প্রচারিত হয়নি। তখনকার যুগে বাংলার, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনপদ বলে কিছু ছিল না। এটি ছিল মূলত প্রত্যন্ত এলাকা, যেটিকে এগ্রারিয়ান ফ্রন্টিয়ার বলেছেন তিনি। এক কথায়- জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের শুরুতে আমরা যে রকম বর্ণনা পাই :জঙ্গলাকীর্ণ একটি ভূখণ্ড এবং সেখানে মূলত যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বা নির্যাতিত অথবা সহায়সম্বলহীন, মরিয়া- ডেসপারেট, সেই জনগোষ্ঠীই কেবল বাস করতে উৎসাহী হবে। এই ডেসপারেট জনগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গের তুলনামূলক অনগ্রসর, বিপৎসংকুুুল, জঙ্গলাকীর্ণ, নদীপরিকীর্ণ, শ্বাপদসংকুুল এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের জীবনধারণের জন্য বসবাসের স্বার্থে সেই জঙ্গল কেটে জনপদ গড়েছে। এই বন কেটে বসত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন একাধারে ধর্মীয় ও কৃষক নেতা। এই কৃষকদের জন্য যাঁরা বাঁচার লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের মধ্যে পুরোভাগে ধর্মীয় নেতারা ছিলেন। সেই সুবাদে ইসলাম এখানে সহজে বঞ্চিত, অন্ত্যজ, এক্সক্লুডেড মানুষের মাঝে আসন গাড়তে সক্ষম হয়। এই ব্যাখ্যাটি রিচার্ড ইটন আদিতে দিয়েছিলেন তাঁর দ্য রাইজ অব ইসলাম-এ দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার গ্রন্থে। কিন্তু এখানে আকবর আলি খান কিছু কারেক্টিভ এনেছেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় মাজারের কনসেনট্রেশন সম্পর্কিত ম্যাপ তৈরি করে দেখিয়ে বলেছেন- সর্বত্র কিন্তু পীর-আউলিয়ার সমাবেশ এক রকম ছিল না। তারপরও ইসলামের ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে। সুতরাং এটা শুধু পেজেন্ট কাম রিলিজিয়াস লিডারশিপের ব্যাপার ছিল না। এটার আরেকটা কারণ ছিল- ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে যাঁরা এই ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে নতুন ধর্ম ও রীতি অভ্যাসের ভলান্টারি অ্যাডাপটেশন। অনেকটা পুশ-পুল ইফেক্টের মতো দুটি দিকই এখানে কাজ করেছে। ওই বইতে আকবর আলি খান আরেকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, কেন আমাদের দেশে বৃহৎ অর্গানাইজেশন, সোশ্যাল অর্গানাইজেশনগুলো সফল হয় না। কেন আমাদের দেশে স্তালিনীয় কায়দার সুশৃঙ্খল দল দাঁড়ায় না। কেন আমাদের দেশে বড় যেসব উদ্যোগ আমরা নিতে চাই, সেগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাঁর ধারণা, যে কারণে আমরা অপেক্ষাকৃত মুক্তগ্রাম, মুক্তসমাজ এবং অন্যকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী (যার একটি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গাকে আমরা অতি স্বল্প সময়ে আশ্রয় দিতে পেরেছি); এসব যেমন আমাদের শক্তির দিক, তেমনি আমাদের দুর্বলতার দিক হচ্ছে- আমরা কারও একক নেতৃত্ব বা লিডারশিপের ধার ধারি না। এর ফলে আমাদের ভেতর একটি সেন্ট্রিফিউগাল টেন্ডেন্সি (কেন্দ্রবিমুখী প্রবণতা) সৃষ্টি হয়। আমাদের সমাজ সংগঠনে একটি অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তাঁর উত্তর হচ্ছে, এই ধরনের সমাজ-মানসিক কাঠামোয় সেই ধরনের অর্থনৈতিক সংগঠন বেশি কার্যকর হবে, যেখানে ইন্ডিভিজুয়ালিজম, ব্যক্তি উদ্যোগ বা স্বল্প পরিসরের গ্রুপ-উদ্যোগগুলো কাজ করবে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি দেখালেন, আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে দ্রুততম সময়ে ব্যক্তিখাত গড়ে উঠল, বিকাশপ্রাপ্ত হলো। এক কথায় বলতে গেলে মার্কেট লিবারেলিজমের পক্ষে একটা সোশিওলজিকাল আর্গুমেন্ট তিনি উপস্থাপন করলেন। আরেকটি উদাহরণ তিনি দিলেন, কেন গ্রামীণ ব্যাংক বা ব্র্যাকের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো এখানে সফল হলো। কেননা এগুলোর দল সংখ্যা মূলত পাঁচ থেকে দশ, ঊর্ধ্বে ত্রিশ। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরের অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো এই অঞ্চলে কাজ করতে বেশি সক্ষম বা কাজে বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা। তিনি আরও একটি যুক্তি সেখানে দিলেন, সেটি হচ্ছে- অ্যাগ্রো ইকোলজিকাল আর্গুমেন্ট। তিনি বললেন, দক্ষিণ ভারত বা পশ্চিম ভারতে যেখানে অপেক্ষাকৃত শুস্ক মৌসুমি এলাকা, যেখানে মূলত সারফেস ওয়াটার-নির্ভর সেচ ব্যবস্থা করতে হয় কৃষিকাজের জন্য, সে ক্ষেত্রে কৃষকদের রাষ্ট্রের ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভর করতে হয়। এই কারণে ওইসব এলাকায় আমরা ক্যানাল ইরিগেশন (খাল খনন) সিস্টেম পাই, আমরা হাইড্রোলিক সভ্যতার (জলকেন্দ্রিক সভ্যতা) নিদর্শন পাই। এর বিপরীতে আমরা যখন পূর্ব বাংলায় আসি, দেখি যে নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে এখানে গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশন অপেক্ষাকৃত সফলতা পায় এবং গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশনের মধ্যেও সেখানে ডিপ টিউবওয়েলের চাইতে দেখতে পাই শ্যালো টিউবওয়েল উদ্যোগের ছড়াছড়ি। এক কথায় বলতে গেলে, আকবর আলি খানের ইতিহাসচর্চার মধ্যে পূর্ববঙ্গের বৈশিষ্ট্য খোঁজার ক্ষেত্রে তিনি অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, ইকোলজি, প্রযুক্তি, মানুষের মনস্তত্ত্বসহ বিভিন্ন ছড়ানো ছিটানো ফ্যাক্টটরকে একত্রে সন্নিবেশিত করতে পেরেছেন। এজন্য তাঁর বিচার-বিশ্নেষণগুলো অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে বলে রাখি, তিনি ভূমিকাতে আরও একটি কথা বলেছিলেন। তাঁর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করা। পরবর্তী সময়ে তিনি আমাকে একান্তেও বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মাল্টিপল থিয়েটারে হয়েছিল। মঞ্চের এক অংশের ওপর যদি কেবল আলোকপাত করা হয়, তাহলে ভুল হবে। একই সময়ে অন্য থিয়েটারগুলোতেও সেই নাটকের অন্যান্য অংশ অভিনীত হচ্ছিল। সে কারণে ওই ধরনের কম্প্রিহেনসিভ হিস্ট্রি লেখার জন্য যে ধরনের পরিশ্রম, যে ধরনের কালেক্টিভের সমবেত সাধনার প্রয়োজন, সেটি নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব হবে বলে তিনি দেখছেন না। বিশেষত সমসাময়িক রাজনীতির বাদানুবাদের কারণে; তাঁর ভাষায়- ডিউ টু কনটেম্পরারি পলিটিকাল স্কোয়াবলস। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি বসে না থেকে যেটি করতে পারেন সেটি হচ্ছে- এই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ইতিহাসের একটি প্রাক-ইতিহাস রচনা করা। ডিসকভারি অব বাংলাদেশের যে উন্মোচন, সেটি প্রাক-ঐতিহাসিক ন্যারেটিভের একটি নিদর্শন। বইটি আমাকে এত বেশি আকৃষ্ট করেছিল যে আমি বইটির শুধু একটি বুক রিভিউ নয়, একটি রিভিউ আর্টিকেল রচনা করি। সেটি একটি গবেষণাধর্মী জার্নাল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। সেখানে আকবর আলি খানের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আমি কিছুটা বাহাস করার চেষ্টা করি। কিছু কিছু অভিযোগ আমি সেখানে এনেছিলাম। যেমন আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম- তিনিও বঙ্কিমের মতো আমাদের বলছেন- বাঙালির ইতিহাস নাই, এই ইতিহাস কে লিখিবে, আমি লিখিব তুমি লিখিবে; সেই রকম একটি জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার উৎসাহে তিনি এই বইটি লিখলেন কিনা? কেননা আমরা যদি দুইশ-তিনশ বছর আগে যাই, সেখানে তো ন্যাশনালিজমের- এজ আ পলিটিকাল কনসেপ্ট- কোনো স্ম্ফুরণ দেখি না। এটি তো অনেক পরের ঘটনা। রেনাঁ এবং তাঁর পরবর্তী যাঁরা পলিটিকাল ন্যাশনালিজমের প্রবক্তা, তাঁদের সময়ের ঘটনা। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে। আমার আপত্তি ছিল এই বইয়ের সাবটাইটেলে। সাবটাইটেল ছিল- এক্সপ্লরেশনস ইনটু ডাইনামিকস অব এ অব হিডেন নেশন। উনি যেটাকে হিডেন ন্যাশনালিজম বলছেন, সেটাকে ফর্মুলা হিসেবে নিলে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তা হলো, আমরা এই রকম হিডেন ন্যাশনালিজমের উৎস সন্ধানে চর্যাপদ বা তারও আগে পিছিয়ে যেতে পারি। আর এতে করে ইতিহাসের নিয়মের বরখেলাপ হয় কিনা? তদুপরি আমি কিছুটা রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম গ্রন্থের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের সমস্যাটাকে বড় করে দেখেছিলাম। জাতীয়তাবাদকে এজ এ কনসেপ্ট- স্বয়ম্ভু, অ্যাবসোলুট, অবশ্যপালনীয় কনসেপ্ট হিসেবে অন্তত তখন পর্যন্ত মনে করিনি। জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে তাঁর একটি প্রধান বক্তব্য ছিল- জাতীয়তাবাদ শুধু একটি মাত্রায় গড়ে ওঠে না। সেখানে ভৌগোলিক এবং আদর্শিক- এই দুটো মাত্রাতেই প্রভাব আসে। এবং আকবর আলি খান পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে দেখেছেন- এখানে ফেইথ মূলত ইসলাম হলেও, নানা ধরনের সংকর বিশ্বাসের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে ফেইথের মধ্যেও অনেক রকমের বৈচিত্র্য এসেছে। অন্যদিকে আবার আমাদের ভৌগোলিক কিছু অভিন্নতার কারণে, নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে, বন্যা-ঝড় এসব প্রাত্যহিক উপদ্রবের কারণে আমাদের কতগুলো জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। কতগুলো সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এখানে আমরা দেখতে পাই, যেগুলো আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের যে পিউরিটি, তার পাশাপাশি ভৌগোলিক ইমপিউরিটির সঙ্গে মিলেমিশে মিথস্ট্ক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশ্বাস ও বসতি- এই দুই উপাদান মিলে এমন একটি জাতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পূর্ববঙ্গে, যেটি অন্য কোনো ভূখণ্ডের সঙ্গে মেলে না। কারণ তারা এ দেশের মতো এতটা পরিমাণে নদীনির্ভর দেশ নয়, যতটা পরিমাণে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা ঝড়-বাদল ও নদীর ওপরে নির্ভরশীল। এটিও জাতীয়তাবাদের বিচার-বিশ্নেষণের ক্ষেত্রে তাঁর একটি অনন্য অ্যাপ্রোচ। এক অর্থে, যদিও এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক পুরোপুরি নয়, তবু না মনে করে পারছি না, আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও যখন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিতে সংসদে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন- আমার চোখে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাংলার মাটি, জল, নদী, আকাশ। এর বেশি আপনারা আর সংজ্ঞায়িত করতে যাবেন না। গেলেই বিপদ বাধবে। আরও বেশি ঠোকাঠুকি হবে। বঙ্গবন্ধু একটা পর্যায়ে বুঝেছিলেন যে, জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করতে গেলেই বিপদের সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে একটু এমবিগু্যয়াস এবং ইকোলজিকাল ফ্রেমে দেখলে অনেক বেশি নিরাপদ উপস্থাপনা হয়। আকবর আলি খানও অনেকটা এই আলোকেই বারবার জোর দিয়েছেন ফেইথ ও হ্যাবিট্যাটের মিথস্ট্ক্রিয়ার ওপরে। বিশ্বাস ও বসতির পারস্পরিক প্রভাব সমুচয়ের ওপরে। ২. স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতার অর্থনীতি আকবর আলি খানের দ্বিতীয় বইটি ছিল পরার্থপরতার অর্থনীতি নিয়ে এবং নামেই এর বৈচিত্র্যের পরিচয়। আমরা জানি, আমাদের সনাতন অর্থনীতি মূলত স্বার্থপরতার অর্থনীতি। কেননা তার প্রথম সবকই হলো- এডাম স্মিথের অনুসরণে- মানুষ যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে, সেটি তার নিজস্ব স্বার্থ দ্বারা প্ররোচিত হয়েই করে। কিন্তু বাজার অর্থনীতির অদৃশ্য হাতের কল্যাণে বিভিন্ন স্বার্থমুখী উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনে। কিন্তু স্বার্থপরতার অর্থনীতি বা ইন্ডিভিজুয়াল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিপরীতে আকবর আলি খানের বইয়ের নামটি ছিল- পরার্থপরতার অর্থনীতি। পরার্থপরতা, যেখানে স্বার্থের কোনো বালাই নেই, পরোপকার করছি নিঃস্বার্থভাবে; সেটির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা। এর মানে এই নয় যে, লেখক বলছেন, স্বার্থপরতার অর্থনীতির কোনো জায়গা নেই আমাদের জীবনে এবং আমাদেরকে সব সময় বা বেশিরভাগ সময় পরোপকার, নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে আর পুরো দেশ-সমাজটা এভাবে পরিচালিত হবে। এ ধরনের কোনো ইউটোপীয় ধারণায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি শুধু বলছেন, সমাজ, রাষ্ট্র বা অর্থনীতি যদি কেবল ব্যক্তিস্বার্থনির্ভর নীতিতে পরিচালিত হয়, তাতে সমাজে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না এবং এ ক্ষেত্রে তিনি কেনেথ এরোর এই উক্তি মনে করিয়ে দিয়েছেন- পুঁজিবাদকে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি চালাতে হলেও, তাকে একটা পর্যায়ে নিঃস্বার্থ, জনস্বার্থমুখিন, ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিস্ট, ওয়েলফেয়ার স্টেটমূলক নীতিমালা গ্রহণ করতে হয়। এভাবে স্বার্থপরতাকে টিকিয়ে রাখতে হলেও পরার্থপরতা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা দৈনন্দিন জীবনযাপনে যে ধরনের পণ্যসেবা ভোগ করে থাকি, তার সবটাই বাজার থেকে প্রাপ্ত না। যেমন আইনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য, টিকাদান, জনশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা। এসব বিষয় বাজারদরে যাচাই করা যায় না। এগুলো সর্বমানুষের মৌলিক অধিকার। যেটা আমাদের সংবিধানেও আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য- এগুলো হচ্ছে মৌলিক প্রয়োজন। এই বেসিক নিডস সব সময় বাজার দ্বারা প্রাপ্ত হয় না। বাজারমুখিন কর্মকাণ্ড এগুলোর প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে পারে, সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে কিন্তু শুধু বাজারনির্ভর ব্যবস্থায় কোনো দেশই ১০০ শতাংশ নিরক্ষরতা দূর করতে পারেনি, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা-মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তৃত করতে পারেনি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বেসিক নিরাপত্তা বিধান করতে পারেনি। এই বইটি লেখার পেছনে স্পষ্টতই দেখা যায়, সেই সময় আকবর আলি খান ভাবছিলেন কোন ধরনের সমাজ হবে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী। সেটি কি কেবলই অবাধ বাজারমুখিন অর্থনীতি হবে, সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি হবে, নাকি পাশাপাশি সামাজিক দায়দায়িত্ব বহনকারী প্রতিষ্ঠানাদি সংগঠন আয়োজন গড়ে তুলবে। নিজে তিনি দীর্ঘকাল সরকারের অর্থ সচিব ছিলেন, পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। তিনি খুব কাছ থেকে সরকার ও রাষ্ট্রের কার্যাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও হয়তোবা তাঁর মনে হয়েছে, বই লিখে জানান দেওয়া উচিত- আমরা বাজার অর্থনীতির দিকে সদর্পে হাঁটছি বটে কিন্তু তার রশিটা থাকতে হবে পরার্থপর জনকল্যাণের অর্থনীতির কেন্দ্রে। এবং এ দুটোরই সম্মিলন তিনি চেয়েছেন : বাজার ও রাষ্ট্র, স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা, মানুষের ব্যক্তি প্রয়োজন ও সামষ্টিক প্রয়োজন। এক পর্যায়ে তিনি সামাজিক পুঁজি এবং এর মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়েছেন অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশের জন্য। এই বইটিরও আমি একটি সমালোচনা লিখি ২০০১ সালে। এটি বিআইডিএস কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক ‘উন্নয়ন সমীক্ষা’-তে বেরোয়। সেখানে আমি এই বইটির মূল প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে বলি, বাংলাদেশের মতো দেশে যদি আমরা ওয়েলফেয়ার স্টেট বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে আমাদের নীতিমালার মধ্যে কত শতাংশ আমরা ব্যক্তি উদ্যোগের অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি আর কত শতাংশ পরার্থপরতার অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি, সেগুলোর চুলচেরা বিশ্নেষণ হওয়া উচিত। প্রতি বছর বাজেট এলে যে কথা আমরা প্রায়ই মনে রাখি না। ৩. তার আগে চাই গণতন্ত্র ২০১০-এর দশকে এসে আকবর আলি খানের রচনায় আমরা বিষয়াদির একটা বিপুল বৈচিত্র্য দেখতে পাই। ক্রমে তিনি অর্থনৈতিক ইতিহাস, ইকোনমিক হিস্টোরিয়ান অথবা অর্থনীতিবিদের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচরণ করতে থাকেন। সেখানে তিনি যা কিছু তাঁর কাছে উৎসাহজনক মনে হয়েছে, কৌতূহলকে উস্কে দিয়েছে, তা তিনি অনুসন্ধান করতে পিছপা হননি। অনেক সময় এ ক্ষেত্রে বিতর্কেরও জন্ম নিয়েছে। যেমন বনলতা সেন আলোচনায় তাঁর একটি মত হচ্ছে- বনলতা সেন বলে সত্যিই একজন ছিলেন এবং বাস্তব জীবনেই তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল। হয়তো প্রেম বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল- এ রকমও তিনি স্পষ্ট করে ইঙ্গিত দিয়েছেন। থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার- এটির তিনি একটি ফ্রয়েডীয় বিশ্নেষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে তিনি ভূমেন্দ্র গুহর ‘জীবনানন্দ দাশের ডায়রি’ ব্যবহার করেছেন, যেটি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। জীবনানন্দের কবিতা বিশ্নেষণে তথ্য বিচারের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন আকবর আলি খান। সুশাসনের বিষয়টি তাঁকে বিভিন্ন সময় ভাবিয়েছে। একটা বড় কারণ, তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। স্বল্পকালীন হলেও তিনি রাষ্ট্রের উচ্চতর মহল, উচ্চতর স্তর থেকে সুশাসনের সমস্যা আমাদের মতো দেশে প্রত্যক্ষ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান হন। সেই কমিশনের অস্তিত্ব এখন নেই। সেখান থেকেও তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমাদের দেশে কত ধরনের রেগুলেশনের সমস্যা। রেগুলেশন বাস্তবায়নের সমস্যা। যানবাহন, রাস্তার ট্রাফিক, বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংকের ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে ওয়াসার জলের কোয়ালিটি, জনস্বাস্থ্য থেকে জনশিক্ষা- সব জায়গায়ই আমরা দেখতে পাচ্ছি গুণগত মান নির্ণয়ের সমস্যা। একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, একটা প্রমিতীকরণ, একটা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ধরে গুণমানকে বজায় রাখার সমস্যা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সুশাসন নিয়ে তিনি একাধিক বই বাংলা ও ইংরেজিতে রচনা করেছেন এবং সেখানে তাঁর মূল বক্তব্য হচ্ছে- একেবারে যে রাতারাতি একটি দুঃশাসনের থেকে আমরা সুশাসনের উচ্চতম স্তরে পৌঁছে যাব, ব্যাপারটা এমন নয়। মানুষের মধ্যে সুশাসনের চাহিদা গড়ে উঠতে হয় এবং সুশাসনের চাহিদাটি গড়ে ওঠে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষা বৃদ্ধি- সেগুলোর সাপেক্ষে। কিন্তু এর মানে এ-ও নয়, আমরা নিষ্ফ্ক্রিয় বসে থাকব বা একটা দীর্ঘ সময়ের দিকে মুখ রেখে চলব এবং অজানা সুশাসনের ভবিষ্যতের দিকে এগোব। সময় লাগলেও কতিপয় ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অবিলম্বে জরুরি। যেখানে আমরা কোনোভাবে ছাড় দিতে প্রস্তুত নই। যেমন- আপনি যদি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন এক্স-রে মেশিনটি ঠিকমতো কাজ করছে না, ইসিজি মেশিনটি সঠিক ফল দিচ্ছে না বা সময়মতো সেখানে জরুরি বিভাগে ডাক্তার বা নার্সকে পাচ্ছেন না, যেখানে আপনি আপনার রোগী নিয়ে এসেছেন জরুরি চিকিৎসার জন্য, সেই ধরনের সুশাসনের অভাব কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না বা সাময়িক অসুখ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একইভাবে আমরা যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে সুশাসনের কথা বলি, ধরা যাক বেসিক এডুকেশনের ক্ষেত্রে যদি শিক্ষকের অনুপস্থিতি থাকে, যদি শিক্ষক স্কুলে না পড়িয়ে কোচিং সেন্টারে পড়াতে বেশি আগ্রহী হন, যদি কোচিং সেন্টারই স্কুলের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়- এ ধরনের সুশাসনের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বিশৃঙ্খলা এবং সর্বোত্তম সুশাসনের মাঝখানে আমাদের যে কোনো চয়েস নেই, তা বলা যাবে না। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবিলম্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যদিও আরও বৃহত্তর বলয়ে রেগুলেশন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সময় লাগবে। তিনি এ নিয়ে অনেক উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার’ বইতে। এ ক্ষেত্রে বলে রাখি, আকবর আলি খানের রচনার প্রসাদগুণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তিনি সরসভাবে জটিল তত্ত্বের কথা বলতে পারেন। সেজন্য প্রয়োজনে তিনি অনেক সময় নাসিরউদ্দিন হোজ্জার বিভিন্ন গল্প বলে বিষয়টাকে প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর লেখাতে প্রায়ই স্কিট, চুটকি নানা ধরনের এনিকডোটাল রম্য কাহিনি বা বিবরণ থাকে এবং সেটি এত বেশি প্রাসঙ্গিকভাবে আসে যে তা বিশ্নেষণেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর এ রকম একটি বই বোধ করি ২০১৩-এর দিকে বেরিয়েছিল। তার নাম আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। যেটার রিভিউ হয়েছিল কলকাতার দেশ পত্রিকায়। দেশ পত্রিকার সমালোচক লিখেছেন, বইটি পড়ে এটুকুন অন্তত বলতে পারা যায় যে লেখক কষে বাংলা লিখতে জানেন! তাঁর লেখার যে ধারা এবং লেখার যে সরস রচনাশৈলী, তা দেখে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। সেটি মিথ্যা নয়, কারণ তাঁর অত্যন্ত সুলিখিত সাবলীল ইংরেজিতে নির্মিত রচনা এবং পরবর্তীকালে তাঁর বাংলা লেখাগুলোতেও দেখেছি হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে, সহজ যুক্তির মাধ্যমে, কখনও কোনো সামান্য উদ্ধৃতির মাধ্যমে তিনি গুরুগম্ভীর বিষয়টির অবতারণা করেছেন এবং সাধারণ পাঠকের মধ্যে সহজেই তাঁর বিষয়বস্তুটি গেঁথে যাচ্ছে। এটি তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। শেষ পর্যায়ে আকবর আলি খান অনেক লেখা লিখেছেন। এর মধ্যে একটি-দুটি বলে আমি শেষ করব। একটি হচ্ছে, দারিদ্র্য নিয়ে তিনি একটি সুবিশাল গ্রন্থ লিখেছেন এবং সেখানে তিনি দারিদ্র্যের উৎপত্তি, ইতিহাস, তার মূল্যায়ন পদ্ধতি, দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতিমালা- এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি নিয়ে আমি বিশদ আলোচনা এখানে করতে চাই না কিন্তু যেটি আমার বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, শেষের কয়েক বছরে তিনি বারবার গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ এনেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায় এবং আগে যদি তাঁর যুক্তি ছিল- আমাদের দেশের অধিবাসীরা অর্থনৈতিক কারণেই মার্কেট লিবারেল বা বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে পারে, কারণ তারা অনেক বেশি অসামষ্টিক বা অনেক বেশি ইন্ডিভিজুয়াল, ব্যক্তিকেন্দ্রিক; পরবর্তী সময়ে সেটাকে তিনি কাউন্টার পয়েন্ট ধরে লিখলেন, শুধু মার্কেট লিবারেল ক্যাপিটালিজমের পথে হাঁটলেই চলবে না, পরার্থপরতা বা জনকল্যাণের কথাও ভাবতে হবে। সেজন্য পরার্থপরতার অর্থনীতি লেখা হয়েছিল। কিন্তু মার্কেটই করি আর নন-মার্কেটই করি, উভয়টাতেই আমাদের লাগবে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, প্রমিতীকরণ, রেগুলেশন, তার বাস্তবায়ন, সুশাসনের বাস্তবায়ন। সেজন্য তিনি সুশাসনকেন্দ্রিক রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু এই সুশাসনকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে গণতন্ত্র না এলে আমাদের মতো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এই কনক্লুশনটির আগে থেকে পূর্বাভাস মেলেনি। মার্কেট লিবারেলিজমের পাশাপাশি ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম, আবার এ দুইকে বাস্তবায়ন করার জন্য সুশাসনের অর্থনীতি আর সুশাসনের অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন বা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা- এটি যে প্রবলতর পূর্বশর্ত, সেটি আগে তিনি অনুধাবন করেননি। কিন্তু ২০০০ দশকের শেষের দিকে এসে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে সেটির উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সর্বশেষ যে রচনা প্রকাশিত হয়েছে সমকালে, কালের খেয়াতে গত ৯ সেপ্টেম্বর সেখানেও এর প্রমাণ মেলে। আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নিয়ে আলোচনা উপলক্ষে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ছিল না বলে পাকিস্তানে ফেডারেলিজমটা টেকেনি এবং ফেডারেলিজম ভেঙে টু ইউনিটের প্রস্তাবনা করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধানে যেসব অধিকার থাকতে পারত, সেগুলো আসেনি। দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠে এবং দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বৈষম্য, বিশেষ করে আঞ্চলিক বৈষম্য আরও গেড়ে বসে। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’। আকবর আলি খান লিখতে পারতেন- ‘তার আগে চাই গণতন্ত্র’। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আবুল মনসুর আহমেদের যুক্তি মেনেই বলতে হয়- গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের ধারা টিকিয়ে রাখা কঠিন। অন্য অনেক দেশে হয়তো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র ছাড়াই এবং দীর্ঘকাল সেভাবে চলতে চলতে একসময় গণতন্ত্র আঙুর ফলের মতো জনগণের পাত্রে এসে পড়ে যায়, সে রকম অবস্থা আমাদের নয়। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের মতো মডেল নিয়ে আমরা চলতে পারব না। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’-এর মডেলটিকে আকবর আলি খান কার্যত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান। এ ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে- অন্তত আমাদের মতো দেশের যে মনস্তত্ত্ব, অস্থিরতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর কাউকে স্ট্যালিনীয় কায়দার এককেন্দ্রিক শাসনের কেন্দ্রে না মানার প্রবণতা- এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের পৃথক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় যেখানে দীর্ঘকাল, ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে চলেছে একদলীয় এককেন্দ্রিক শাসন, তার সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা তাই যথাযথ হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁর কনক্লুশন মূলত দাঁড়ায় এই যে- আমাদের দেশের মুক্তি মিলবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়েই এবং এক দলের দীর্ঘকাল শাসনে না থাকার মধ্য দিয়েই এটার সফল পরিণতি হয়তো দেখা যাবে। আকবর আলি খানের এই বক্তব্যও আমাদের সচকিত করে, কেননা এখানে তিনটি কথা বলেছেন। একটি বলেছেন যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভবন দরকার। ডিসেন্ট্রালাইজেশন দরকার। আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে এই ডিসেন্ট্রালাইজেশন সহসা সম্ভব নয়, সেটি পাঁচ-দশ বছরের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে হয়। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি কোনোভাবেই ছাড় দিতে নারাজ, সেটি হচ্ছে সময়মতো কারচুপিহীন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা। সেটি তাঁর দিক থেকে নূ্যনতম পূর্বশর্ত ওই ধরনের সুশাসনসমৃদ্ধ পরার্থপরতার মূল্যবোধে ঋদ্ধ একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির সফল বিকাশের জন্য এবং সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কিছু সংস্কার আনতে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার সাপেক্ষে সংসদ সদস্য বণ্টনের কথা। উইনারস টেক ইট অল- সেই ধরনের প্রচলিত নির্বাচনের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি বলেছেন, আমরা কি নিউজিল্যান্ডের মতো বা অন্য যেসব দেশ আনুপাতিক ভোটপ্রাপ্তির বিচারে সংসদে প্রার্থী সংখ্যা নির্ধারণ করবে, সেই দিকে যেতে পারি কিনা। অর্থাৎ প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশনের সিস্টেমে যেতে পারি কিনা। এতে তিনি বলেছেন, প্রতিযোগী দলের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে এবং অনেক বেশি স্ট্যাবল গণতন্ত্রের জন্ম হবে। তবে লেখক এ নিয়ে তাঁর শেষ কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে আরও গবেষণা করা উচিত। এ বিষয়টি নজরুল ইসলাম বা অন্যদের লেখায় আগেও এসেছিল, কিন্তু এটি দেখলাম আকবর আলি খানেও খুব বিশদভাবে এসেছে। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আরও গবেষণা জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ তিনি চান অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি, সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি পলিটিকাল উন্নয়ন হোক। সমানতালেই হোক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন না এলে যে অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং সামাজিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে- এ কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ৪. সংক্ষিপ্তসার এক কথায় বলতে গেলে আকবর আলি খান ছিলেন একজন বহুমাত্রিক মননের মানুষ। আটাত্তর বছরের জীবনে তিনি একাধিক ভূমিকা পালন করেছেন- কখনও সরকারি আমলা হিসেবে, কখনও শিক্ষক হিসেবে, কখনও সাহসী প্রাবন্ধিক হিসেবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি আঁচড়ও তাঁর মধ্যে থেকে গিয়েছিল এবং এর ফলে তাঁকে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, সেটি তিনি কখনও প্রকাশ্যে বলেননি। যেমন বলেননি শেষের দিকে তাঁর স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর কত কষ্ট হতো লিখতে এবং এক পর্যায়ে তিনি লিখতেই পারতেন না, যেহেতু তাঁর ডান হাতটাই তখন কাজ করত না। তখন তিনি মুখে বলে যেতেন এবং অন্যরা লিখতেন এবং তিনি সেটাকে সেভাবেই কারেকশন করে বা কম কারেকশন করে প্রকাশের জন্য তৈরি করতেন। এটি যে কোনো লেখকের পক্ষেই যন্ত্রণা এবং তাঁর মতো এত খুঁতখুঁতে লেখক, এত পুর্ণাঙ্গ লেখকের পক্ষে তো এ যন্ত্রণা আরও বেশি। তা সত্ত্বেও তিনি একপ্রকার নিজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেই এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তার ফলে আমরা অনেক রচনা পেয়েছি। এটি আমাদেরকে তাঁকে সব সময় মনে করিয়ে দেবে। আকবর আলি খানের রচনা, তাঁর সব লেখাপত্র সবাই আরও মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, বিতর্ক করবেন, আলোচনা করবেন এবং আরও উন্নত গবেষণার দিকে অগ্রসর হবেন- এই আশা রাখছি। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্যই তাঁর রচনাবলির সংগ্রহ অবিলম্বে প্রকাশ হওয়া এখন জরুরি।
কেন ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসটি লিখতে হলো তাঁকে- এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সময়কে’ ধারণ করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। সচরাচর যেসব বিষয় নিয়ে তাঁর চরিত্ররা মাথা ঘামায় না- রাজনীতি, কাল, সমাজ- সে সবকিছুকে আর গল্পের বাইরে রাখা গেল না। কেননা, গল্পটাই কতদূর এগোলো মানুষ- তা নিয়ে। ১৯০৫ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের সমাজ কীভাবে বদলে যেতে থাকল এ রকম কোনো ইতিহাসবোধে তাঁকে পেয়ে বসেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি-প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরীফকে জানিয়েছিলেন যে, নিজের জীবন ভাঙিয়ে আর কত উপন্যাস লেখা যায়! সে জন্যেই নাকি তাঁকে ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’র মতো ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। তিনি খুব সচেতন প্রয়োজনেই এই ইতিহাস-প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন বোধ করি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ব্যাখ্যাটা এরকম :’আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই নি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তো বা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি, সময়টাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগোতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তার পরেও।’ এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘তারপরেও’ বলতে গল্প ছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন সচেতনতার প্রতি কি তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন? আর ইতিহাস-গল্প মিলিয়ে যদি কিছু লিখবেন তাহলে ১৯০৫ সাল থেকেই তা শুরু করবেন কেন? সময় ধরার ইচ্ছের কথা বলছেন, কিন্তু কোন কালপর্বে শুরু করে কোথায় তার যতি টানবেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে যে-সময়কে অনুভব করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ অবধি। কেন এই বিশেষ সময়ের টানাপোড়েনের মধ্যে তাঁকে প্রবেশ করতে হলো- সেটা একটা প্রশ্ন। তার চেয়েও গুরুত্বপূূর্ণ প্রশ্ন হলো, উপন্যাসটিতে যে সমাজকে তিনি এঁকেছেন, সেই সমাজচিত্র সে সমাজকল্পিত, না বাস্তব, সে প্রশ্নে পরে আসা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্রটাকে তিনি কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে আঁকলেন? আজকের যুগের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিচালিত সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যাহ্নের সমাজকে মনে হবে কোন অচিনপুরের গল্প- এক আধুনিক ইউটোপিয়া। এই উপন্যাস ভর করে আছে আদর্শস্থানীয় দুই চরিত্রের ওপরে, যাঁর একজন হরিচরণ সাহা এবং অন্যজন মওলানা ইদ্রিস। এই দুই শুভবোধসম্পন্ন মানুষ- বস্তুত নিয়ত এবাদতে রত সূফী-সন্তই বলা চলে তাদের- যাঁরা সবসময়েই কী করে মানুষের উপকার করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত, তাঁরাই উপন্যাসের ঘটনাবলির ওপরে বৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন শুরুর লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের শুরু হয় যে-পুকুরঘাটে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ হয় একই পুকুরঘাটে; কেবল শুরুর দৃশ্যে ছিলেন হরিচরণ, শেষের দৃশ্যে মওলানা ইদ্রিস। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র- ভালো স্বভাবের ও মন্দ স্বভাবের চরিত্ররা সবাই এদের নিয়েই, এদের পাশে রেখেই যার যার জীবন কাটায়, যার যার মতো করে মৃত্যুবরণ করে। মধ্যাহ্নের সমাজের বড় শক্তি তার অন্তর্নিহিত নৈতিক শ্রেয়বোধ। এর প্রধান উৎস হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিসের মতো মানুষেরা হলেও অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষ যাঁরা, তাঁরাও প্রবল মানবিকতায় আক্রান্ত। তাঁরা পারতপক্ষে অন্যায় করেন না, বা করলেও পরিহার্য বলে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। জুলেখা, শরীফা, মনিশংকর, শিবশংকর, আতর- তাঁরা সবাই পৃথিবীতে ভালোমানুষের পাল্লা ভারী করেছেন। আর লাবুস তো জুলেখার পুত্রসন্তান হলেও আসলে হরিচরণ-মওলানা ইদ্রিসের আধ্যাত্মিক সন্তান। লাবুস শহরে এলে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটত, খুবই স্বাভাবিক হতো তার হিমু-হওয়া! তার মানে এই নয় যে, এই সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত ছিল না। সংঘাত-দ্বন্দ্ব-অনাচার ছিল যদিও, কিন্তু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। হরিচরণের নিজের পাটের আড়ত রয়েছে, ‘সাহা’ যেহেতু সেহেতু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা তার উপার্জনের স্বাভাবিক উৎস। সুতরাং বাণিজ্যবিরোধী ছিল না ওই সমাজ। যে অঞ্চল নিয়ে এই উপন্যাস তার হাওরেই সওদাগররা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় তাদের নৌবাণিজ্যের নাও ভাসিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ধারা থাকলেও এ ধরনের সমাজে টাকার শক্তিতে মানুষের ক্ষমতাকে মাপা হয়নি। শশাংক পালের মতো জমিদার বা ধনু শেখের মতো কুটিল ব্যবসায়ী মানুষও সমীহ করে চলেছে হরিচরণকে- সেটা তার অর্থের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি তার নৈতিক স্বভাবের কারণে। আরেকটি দিক হচ্ছে, মধ্যাহ্নের সমাজে স্বার্থপরতাই ব্যক্তির একমাত্র প্রণোদনা নয়; এখানে পরার্থপরতার বোধ সহজাতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বিভিন্ন স্তরে। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের আজকের এই অপরাহেপ্তর সমাজ বাণিজ্যিক বোধের সমাজ। উনিশ-বিশ শতকের [অন্তত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ও মোটা দাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত] অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর মূল্যবোধের থেকে আজকের এই সমাজ মৌলিকভাবেই আলাদা। মধ্যাহ্নে অনায়াসে সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে। এখানে বৃক্ষের অসুখ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, জুলেখা গায় উকিল মুন্সি ও রাধারমণের গান, রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদের হাহাকার, হাওরের ঢেউয়ে বেজে ওঠে। সেটা যে কেবল নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য, তা মনে করেননি লেখক। ব্যাপক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আদান-প্রদানকে ধারণ করেছিল এই মধ্যাহ্নের সমাজ। সেখানে কোন চিহ্নটা কার, বা কোন গানের লাইনটা কোন সম্প্রদায়ের জীবনবোধ থেকে উঠে এসেছে- সেটা হিন্দুর নাকি মুসলমানের, মজুরের নাকি অবস্থাপন্ন কৃষকের- সেটা বের করাটা দুরূহ। ওই সমাজের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি। এ রকম সমাজের কাহিনি কি ইউটোপিয়ার মতো শোনাচ্ছে? হোক ইউটোপিয়া, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই কল্পকথা নির্মাণে [নাকি বাস্তবেই গল্পটা এভাবেই তিনি শুনেছিলেন] এত শ্রম ও মেধা ঢালবেন কেন? আমার ধারণা, মধ্যাহ্নের ভূমিকায় পুরো কারণটা হুমায়ূন আহমেদ বলেননি। শুধু ‘সময়’কে ধরার জন্য ওই বিশেষ কালপর্বের প্রতি চোখ ফেরাননি তিনি; আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল আমাদের মন ও মননকে নাড়া দেওয়ার জন্যে। হয়তো উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সমাজের অন্তরাল প্রাণশক্তির উৎস কোথায়, তা দেখানো চোখে আঙ্গুল দিয়ে। ২. রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিস্কৃতি নাই।’ মধ্যাহ্ন উপন্যাসে সেই পাপকে অবলীলাক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পাপের মধ্যে সহাবস্থানকেই চূড়ান্ত মানেনি। শশাংক পালের মতো অত্যাচারী জমিদারেরা এতকাল নিরীহ রায়তের পেছনে লেগেছে। তার মৃত্যুর পরে ধনু শেখের মতো ব্যবসায়ীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। শশাংক পালের যোগাযোগ ছিল কলকাতার প্রশাসনের সাথে, ধনু শেখ নিয়েছে মুসলিম লীগের আশ্রয়। স্বদেশি আন্দোলনের তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর হাতে আহত হতে হয় তাকে; শেষ পর্যন্ত এলাকার মানুষই দাঙ্গা ঘটানোর ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাকে দায়ী করে এবং তার ক্ষমতার ভিত দুর্বল করে দেয়। আর শশাংক পালের মৃত্যু হয় কোনো অব্যাখ্যাত ব্যাধিতে। শশাংক পাল, ধনু শেখের প্ররোচনার কারণে হোক, আর দুই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমে বেড়ে যাওয়া ভেদবুদ্ধির কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মধ্যাহ্নের সমাজেও ঢুকতে থাকে। রাতের অন্ধকারে একদল আরেক দলের লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়, একপক্ষ আরেক পক্ষের জাতিনাশ, ধর্মনাশ করে, বাড়িতে আগুন লাগায়, পুলিশের কাছে মিথ্যে মামলা দিয়ে, হুমকি দিয়ে এলাকা পরিত্যাগে বাধ্য করে, নষ্ট মেয়ের অপবাদ দেয়, হাওরের নির্জনে এনে ধর্ষণ করে, জায়গা-জমি বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এসবই হয়, কিন্তু এটা মধ্যাহ্নের সমাজের অন্দরমহলকে ছুঁতে পারে না। কোনো লৌকিক বা অলৌকিক কারণে এর মানুষগুলো পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে। পরস্পরের পাশে সহায়-সমর্থনের উদাহরণ অনেক এই উপন্যাসে। আমি এখানে দু’একটি উদাহরণ দেব। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে মওলানা ইদ্রিস রওনা হয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দিকে। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বগুড়ার পরিবর্তে রংপুরে চলে গেছেন। এক পর্যায়ে রাত হলে তাঁকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে একটি হিন্দু পরিবার। লক্ষণ দাসের পরিবার কাছেরই এক মন্দিরের সেবায়েত। ওই বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। খাবারেরও ব্যবস্থা হয়েছে- অবশ্য রাখা হয়েছে উঠানেই। লোকটা তাকে বলেছে, ‘মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।’ মওলানা তাতেই খুশি। তিনি নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে দোয়া চাইলেন, যাতে এই পরোপকারী পরিবারটির প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। এ সময়ে কপালে চওড়া করে সিঁদুর দেয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মওলানার সামনে এসে দাঁড়াল প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকে। মওলানার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল চলে যেতে : ‘দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকাপয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন’। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে পাপ আছে তা অস্বীকার না করে স্বীকার করাই ভালো, স্বীকার করলে যদি আমরা পরিত্রাণের পথ পাই। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেও, করার মাঝেই, থমকে দাঁড়িয়েছে অথবা স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ধনু শেখ এলাকার মসজিদের ইমাম নিয়ামত হোসেনকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ‘জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?’ আপাতত সম্মতি দিলেও চে’ গুয়েভারার চেয়ে কোনো অংশে কম যান না ইমাম নিয়ামত হোসেন। রাতের অন্ধকারে মনিশংকরের কাছে গিয়ে বলে দিয়েছেন, কাল জুমার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। শুধু তা-ই নয়, পরদিন জুমার নামাজ শেষে ইমাম নিয়ামত মওলানা ইদ্রিসকে আমন্ত্রণ জানালেন কিছু বলার জন্যে। ইদ্রিসকে বহুদিন ধরে হরিচরণ সাহার বাসায় আশ্রয়ের পর থেকেই হিন্দুদের সঙ্গে উঠা-বসা করার জন্যে একঘরে করে রেখেছে ধনু শেখ। মওলানা ইদ্রিস দাঙ্গা ঘটানোর পরিস্থিতি বদলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সুরা হুজুরাত এর তেরো নম্বর আয়াতের স্মরণ করলেন, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করে পরে বিভক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে, যাতে তারা ‘একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে’। দোয়া পাঠের সময় ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে এক উদারনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এলাকায়। অত্যাচারী শশাংক পাল মারা যাওয়ার পর তার মুখাগ্নি করতে তাঁর স্বধর্মের কেউ রাজি হলো না। হয়তো তিনি সারাজীবন অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলেন বলে, হয়তো অত্যাচারী ছিলেন বলে। মুসলমান হয়ে মওলানা ইদ্রিস এগিয়ে এলেন এক্ষেত্রে। সমস্যা হলো পুরোহিতের সাথে তাঁকেও কিছু মন্ত্র পড়তে হলো শেষকৃত্যের প্রয়োজনে। এর জন্যে কাফের বলে ফতোয়া দেওয়া হলো তাঁর বিরুদ্ধে। লাবুস এসে প্রতিবাদ করে বলল, ‘লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু মুসলমান কী? লাশ নামাজ কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না’। অন্যত্র, লাবুস ও ইদ্রিসের মধ্যে অন্য একটি ধর্মীয় আলাপের বিনিময় হয়। ইদ্রিসের শিশুবয়সী মেয়ে পুষ্পরানীকে দুধ খাওয়ানোর কেউ নেই। তার স্ত্রী জুলেখা তাকে পরিত্যাগ করে গেছেন। এদিকে গ্রামের বাগাদিপাড়ার মেয়ে ষোলো-সতেরো বয়সী কালী গতকালই তার মেয়েকে হারিয়েছে। পুষ্পরানীকে পেয়ে সাগ্রহে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে সে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠেই শোনা যাক : ‘মাওলানা ইদ্রিস লাবুসের কাছে হিন্দু-মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দু-মুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই। লাবুসের কথায় মাওলানা হকচকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেননি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।’ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাত্যহিকের সাংস্কৃতিক ব্যবহারিক বিনিময়ের এ রকম অনেক উদাহরণ আরও ছড়িয়ে আছে। আজকের এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যুগে ধর্ম-ধর্ম করে আমাদের নগর ও গ্রামের জীবন এখন ব্যতিব্যস্ত। লাবুস-মওলানা ইদ্রিস হরিচরণের মতো চরিত্ররা কি আছে এখনও আমাদের আশেপাশে কোথাও? ৩. তাহলে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানে মিলে একটা যে অভিন্ন সংস্কৃতি, তলার দিকে গড়ে উঠেছিল, শত কংগ্রেসী লীগ রাজনীতির ডামাডোলেও যেটা পুরোপুরি ধসে যায়নি, সে রকম কোনো শুভনীতিবোধসম্পন্ন অস্তিত্বকেই আমাদের ‘মধ্যাহ্ন’ অর্থাৎ ‘স্বর্ণযুগ’ বলছেন লেখক? আজ সেই মধ্যাহ্ন গড়িয়ে এই সমাজ- এই তিমিরবিলাসী সমাজ উপনীত হয়েছে তার অপরাহেপ্ত। ‘অপরাহপ্ত’ কথাটা আমি ‘লেইট ক্যাপিটলিজম’-এর তাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচক ফ্রেডেরিক জেমসনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। বাণিজ্যনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে, শিল্পকেও মানবসত্ত্বাকে ক্রমাগত ‘ব্যবহূত-ব্যবহূত’ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বর্জ্যের মতো পাগলার লেগুনের মতো অন্ধকার কোণে। হুমায়ূন আহমেদ এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর সমাজকে মন থেকে কখনও মেনে নিতে পারেননি। হিমুকে দিয়েছেন এই বাণিজ্যিক সমাজকে বিদ্রূপ করার মনোমুগ্ধকর ক্ষমতা। ‘অয়োময়’-এর মির্জা হেরে যাচ্ছে উঠতি বণিক শ্রেণির কাছে, যেভাবে ধনু শেখের কাছে হেরে গিয়েছিলেন শশাংক পাল। তবু স্রষ্টার পক্ষপাতিত্ব পরাজিতের দিকেই। সত্যজিতের ‘জলসাঘর’-এর শেষ দৃশ্যে বিশ্বাম্ভর কোথায় মিলিয়ে যান সে খবর আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমাদের মনে থেকে যায় শেষ সংগীতসভার নৃত্যগীতের রেশ। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষে আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ আসন্ন, ভিটেমাটি ছাড়ছে দু’তরফেই, নতুন রাষ্ট্রজীবনের শুরু হবে সীমান্তের দু’দিকেই। পাকিস্তান হচ্ছে ‘কৃষকের ইউটোপিয়া’ গবেষকরা রায় দিয়েছেন, শুধু কিছু মানুষের মনে শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। হরিচরণ সাহা মারা গেছেন, লাবুস মৃত্যুশয্যায়, মওলানা ইদ্রিস সবচেয়ে বেশি নিরাশ্রয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।’ হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিস ছিলেন এই পাপবিদ্ধ সমাজের রক্ষাকবচ- তাঁরা আঁকড়ে ছিলেন সমাজের ভালোত্বকে শুভবোধকে, মঙ্গল কামনাকে। তাঁরা সমাজকে অন্ধকার খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে দেননি। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষটা এ রকম। লাবুস, যে কিনা আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎকে নায়কের মতো লালন করেছে, সে মারা যাচ্ছে। কোনো অব্যাখ্যাত অসুখে তাকে আক্রান্ত করেছে। অসুখ নিয়েই সে এসেছে নির্জন পুকুরের ঘাটে এবং সেখানে হঠাৎই সে তার মৃত মাকে দেখতে পাচ্ছে কাছে। একপর্যায়ে মার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার এই মৃত মার নাম জুলেখা। যিনি জীবিত থাকাকালে স্বয়ং উকিল মুন্সীকে গান শুনিয়েছেন এবং নজরুল যাঁকে দিয়ে কলকাতায় গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি এবারে গুনগুন করে গান ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বইটির শেষ দুটি লাইন, যা পড়তে থাকলে এখনও আমি এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করি : ‘মওলানা ইদ্রিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে। পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনোখানে।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোসেন মিয়া ময়নাদ্বীপের সমতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের বান্ধবপুর তেমনি একটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র, সেখানে সব গোত্রের ও বর্ণের মানুষেরা মানবিক মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরবে। তবে এই অপরাহেপ্তর সমাজের কাছে হুমায়ূনের এই ইতিহাসপাঠ কল্পজগতের ভাষ্য বলে মনে হতে পারে।
পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক আমাদের ঋণ দেবে কী দেবে না, কিংবা অন্য কোনো পক্ষের কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাব কী পাব না; অথবা কারও সাহায্য ছাড়া আমরা নিজেরাই সেতুটা নির্মাণ করতে পারব কিনা- এমন নানা প্রশ্নমুখর বাস্তবতার দিনে ২০১২ সালে আমি বলেছিলাম, আমাদের অসাধারণ কিছু করতে হবে। আমাদের জানান দেওয়া উচিত যে, আমরা বাঙালি জাতি- আমাদের ইচ্ছে মতো নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর অভ্যাসটা তোমাদের বদল করতে হবে। আমরা আর সেই আগের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাসের পাত্র হওয়া জাতি নেই। বিশ্বকে জানান দেওয়ার জন্যই হোক বা নিজেদের উন্নতির জন্যই হোক, নিজেদের শক্তি দিয়ে সেই স্বপ্টেম্নর পদ্মা সেতুটা একদিন সত্যিই বানানো সম্ভব হতে পারে- বলা যায়, এ নিয়ে আমার এক ধরনের আস্থা ছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মোটা দাগে যে হিসাবগুলো সেদিন আমাদের সামনে ছিল, সেই হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে খুব সাধারণভাবেই আমার ভাবনা হয়েছিল এবং এখনও হয় যে, যাঁরা সন্দেহপ্রবণ, তাঁরা সেদিন কেন ভেবেছিলেন যে এটা আমাদের নিজেদের টাকায় করা সম্ভব নয়? আজকে আমাদের জিডিপি ৪১০ বিলিয়ন ডলার- পদ্মা সেতুর সেতু অংশের খরচ দিয়ে তাকে ভাগ করলে আসে ১ শতাংশেরও কিছুটা কম। অর্থাৎ আমরা আজকে আমাদের জিডিপি’র ১ শতাংশ খরচ করেই একটা পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারি। ২০১২ সালে এই পরিসংখ্যানগুলো হয়তো আরেকটু দুর্বল ছিল। তখনও আমাদের রপ্তানি অত বেগবান হয়নি, আমাদের রেমিট্যান্সও ততটা বেগবান ছিল না তখন, আমাদের সক্ষমতাটাও অতটা পরিস্কার হয়নি হয়তো। হয়তো সে জন্যেই আমাদের অনেকের মনে সন্দেহটা ছিল। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাতো একটা সেতু মাত্র- এত বড় একটা দেশ, তার বৈদেশিক আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে নিজের টাকায় এমন একটা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না? আমরা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক সাহায্যের ছায়ায় ছিলাম। একটা বড় গাছের ছায়ার নিচে থাকলে যেমন অন্য চারাগাছগুলো বেড়ে উঠতে পারে না, তেমনি আমাদের আত্মবিশ্বাসের চারাগুলোও এতদিন বেড়ে উঠতে পারেনি। ছায়াটা সরে যেতেই আমরা দেখতে পারলাম যে আমাদের মাথার ওপরে তো দিব্যি রোদ আছে- আমরা এখন নিজেদের মতো করেই বড় হতে পারব। ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক সাহায্য ছিল আমাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। সেটা কমতে কমতে আজকের দিনে এসে ১ শতাংশে পরিণত হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনটা পরিসংখ্যানে ঘটলেও মনের মধ্যেতো ঘটেনি এর আগে। মনে মনে হয়তো এখনও আমরা ভাবছি যে, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আমরা বোধ হয় চলতে পারব না, কেউ না করে দিলে কিংবা কেউ হাতে ধরে না শিখিয়ে দিলে আমরা হয়তো পারব না। কিন্তু দিন একটু একটু করে বদলে গেছে- আমাদের তরুণ প্রকৌশলী, যাঁরা পদ্মা সেতুর কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটাও দেখার মতো। তাঁরা অনেকেই এখন বলছেন যে, তাঁরা ভবিষ্যতে যেকোনো জটিল প্রকল্প সামাল দিতে পারবেন। এই আত্মনির্ভরতাগুলো একেকটা জাতি ধাপে ধাপে অর্জন করে থাকে। একের পর এক ধাপ পার হয়ে হয়ে কিংবা কিছু কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে আবিস্কার করতে শেখে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের আত্মবিশ্বাসের একটা বৃহত্তম ধাপ। তার আগে যেমন ৬-দফার মাধ্যমে দুই অর্থনীতি শীর্ষক একটা যুক্তির ধাপ আমরা পার হয়ে এসেছি, যার মাধ্যমে আমাদের ভেতর স্বাধিকার আন্দোলন করার জন্য একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। এগুলোই আমাদের জাতি গঠনের একেকটা মাইলফলক। আমি মনে করি আমাদের সংবিধান আমাদের জন্য যেমন একটি মাইলফলক, পদ্মা সেতুও তেমনি একটি মাইলফলক। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আসলে এত বড় রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলাম- মূলত তখনই আমরা এলডিসি অতিক্রম করে গিয়েছিলাম। হিসাবে আমাদের এলডিসি অতিক্রম হয়তো আরও পরে হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে এলডিসিস্তর থেকে আমরা তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম, যখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন আমরা নিজেদের টাকাতেই এটা করতে পারব। সেতুর অর্থনৈতিক অভিঘাত এবং অন্যান্য অনেক বিশ্নেষণের চেয়েও এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি ঘটনারই যেমন একটা ব্যবহারিক মূল্য থাকে, তেমনি তার একটা আত্মন্তিক মূল্যও থাকে। পদ্মা সেতুর সেই আত্মন্তিক গুরুত্বটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। একটা কঠিন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর থেকে যার মাধ্যমে আমরা একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে, নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম একটা জাতি হিসেবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি। সেখানে অনেক ঝুঁকি ছিল; এবং অনেকেই বলেছেনও যে, এই ঝুঁকি আমরা সামলাতে পারব না; কিংবা আমাদের রয়েসয়ে চলা উচিত। কেননা বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থা যদি আমাদের থেকে সরে যায়, তাহলে আমাদের উন্নয়ন ধসে পড়বে, আমরা না খেয়ে মারা যাব, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, আমরা নৈরাজ্যের মধ্যে গিয়ে পড়ব ইত্যাদি। কিন্তু তেমন পরিস্থিতিতেই আমরা আশার আলো দেখেছিলাম- আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ছিল, আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল, রেমিট্যান্স বাড়ছিল। এ সমস্ত আরও অনেক কারণেই তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা ভাবতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে কিন্তু অতটাতো দুর্বল আমরা নই। আমি সেদিন বলেছিলাম পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থানের জন্য আমাদের বাজেটে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, সেতুর প্রস্তাবিত ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় মুদ্রা এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমেই সংস্থান করা সম্ভব ছিল। আজকেও বলছি, স্থানীয় মুদ্রায় পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থান করা আমাদের পক্ষে তখনও কঠিন ছিল না, এখনও কঠিন নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ সংস্থান নিয়ে খানিকটা প্রশ্নবোধকতা ছিল, এখন তা একেবারেই নেই। এখন আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের যে প্রবাহ, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের যে স্ট্রেংথ, আমাদের খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা- এ অবস্থায় দাঁড়িয়েই আমরা আজ জিডিপির মাত্র ২-৩ শতাংশ খরচ করে পদ্মা সেতুর মতো আরও দুইটা সেতু তৈরি করতে সক্ষম।
আমি মনে করি আমাদের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের একটা নির্দেশক হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। আমরা বলছি না যে, অন্যদের সাহায্য ছাড়া কিংবা বিদেশি প্রযুক্তি ছাড়া, বিদেশের সঙ্গে মেলবন্ধন ছাড়া আমরা সবকিছুই করে ফেলব- কিন্তু আমরা এটা বলছি যে, যদি কেউ নাও আসে তবুও এখন একলা চলার শক্তি আমাদের আছে। এটাতো আগে বলতে পারতাম না। এখন আমরা বলতে পারি। কেবল বলতেই পারি তা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তাকে সমর্থনও করে; আমাদের বুদ্ধিমত্তার সামর্থ্য তাকে সমর্থন করে, আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি বা কৃৎকৌশলগত সামর্থ্য সেটাকে সমর্থন করে, আমাদের প্রকৌশলীরা সেটাকে সমর্থন করেন, অর্থনীতিবিদরা সেটাকে নিয়ে ভাবতে পারেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটা নিয়ে আরও দূরদর্শীভাবে পথরেখা আঁকতে পারেন। এ সমস্ত বিষয়ই হচ্ছে আমাদের উন্নতির জন্য মূল্যবান উপাদান, যার মাধ্যমে মূলত একটা জাতি পরিপকস্ফ হয়ে ওঠে এবং আমি মনে করি বাংলাদেশের ৫০ বছরে সংবিধান থেকে শুরু করে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ- এই যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, এটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইতিহাস। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের যে পর্যায়ে আছে, এটা হচ্ছে মেগা প্রকল্পের পর্যায়। পৃথিবীর উন্নত সব দেশেরই এসব বড় ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাছাড়া আমাদের জনকল্পনাতেও আজ উন্নত যোগাযোগের চাহিদা ও স্বপ্টম্ন তৈরি হয়েছে। বলা যায়, যার একটা রূপান্তর হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের একটা নতুন জোয়ার তৈরিতে নিঃসন্দেহে এই সেতু অবদান রাখতে সক্ষম হবে। যে জোয়ার স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক শিল্পক্ষেত্রগুলোর একটা অংশ খুলনা শহরের দিকে স্থানান্তরিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা শহরটি আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম শহরে পরিণত হবার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিরই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের নতুন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ একত্র হয়ে একটা বড় ধরনের ফলাফল এনে দেবে। সব মিলিয়ে আমি যেটা বলতে চাই তা হলো, এই সেতু নির্মাণের একটা ব্যবহারিক উপকারিতা আছে- সেটা আমরা ভোগ করব; সেটা আগামীতে আরও বাড়বে, সেটা আরও বাড়ানোর জন্য আমাদের স্থানীয়ভাবে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে সেতুর প্রতীকী তাৎপর্য- এর আত্মন্তিক তাৎপর্য। তা হচ্ছে যে, আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। একটা বৃহৎ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের টাকায় নিজেদের সেতু নির্মাণ করেছি। এটা যখন করতে পেরেছি, তাহলে আগামীতে অবশ্যই আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পারব।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. বিনায়ক সেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক। তাঁর মৌলিক গবেষণার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, বৈষম্য, শ্রমবাজার, সামাজিক সুরক্ষা, মানব উন্নয়ন, সুশাসন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ইত্যাদি। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৩০টির বেশি গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গত তিন দশকে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন। দেশের গত তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ‘অর্থনীতিবিদ প্যানেল’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। বিনায়ক সেন ১৯৮২ সালে রাশিয়ার মস্কো লমনসভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে এমএসসি এবং ১৯৮৫ সালে ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সমকাল: এবারের জাতীয় বাজেটকে মোটাদাগে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিনায়ক সেন: বর্তমান বিশ্ব এবং অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো কোনো বাজেট হয়তো দেওয়া যেত। তবে যেটি দেওয়া হয়েছে, তা একেবারে খারাপ হয়নি। গত কয়েক মাস দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান ওঠানামার কারণে আশঙ্কা করা হয়েছিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল এ বছর অর্জিত হবে না। আমার মনে হয়, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেখার কোনো কারণ নেই।
এর পেছনে আমি দুটো কারণ বলছি। গত কয়েক বছরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার একই রকম আছে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বিনিয়োগের হার ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বিনিয়োগের হার মোটামুটি একই হওয়ার পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কখনও ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, কখনও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, কখনও ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, কখনও ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং এবার বাজেটে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ বেশ ওঠানামা ছিল। এর মানে শুধু বিনিয়োগের হার দ্বারাই প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত হয় না। বাহ্যিক অভিঘাত এলে প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বিনিয়োগ একই থাকলে যদি উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং অন্যান্য সামাজিক সূচক শক্তিশালী থাকে, অর্থাৎ আমরা যাকে রেজিলিয়েন্স বা ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বলি, সেটি থাকলে প্রবৃদ্ধির হার ভালো থাকে। তা ছাড়া এ বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে প্রবৃদ্ধির ওপর কিছুটা বাড়তি সুফল আমরা দেখতে পাব। তবে কৃচ্ছ্র সাধনের এ বছরে চাহিদা ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, এখন তো একটা অভিঘাত এসেছে। তবে এটি কভিডের মতো অভিঘাত কিনা দেখতে হবে। আমার মতে, অবশ্যই নয়। কভিডের অভিঘাতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। এখনকার যে অভিঘাত, তা সুনির্দিষ্ট অর্থাৎ তেল, গ্যাস এবং খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা আমদানিনির্ভর। কিন্তু খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর নই। চালের ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। গম কিছুটা আমদানি করতে হয়। সেটারও একটা রাস্তা আমরা বের করেছি। ভারত থেকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অনেক গম আমদানি করছি। এ কারণে খাদ্যশস্যের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল। চালের দাম তিন থেকে চার টাকার মতো কেজিতে বেড়েছে। যদি আমরা চালের সরকারি সংগ্রহ বা ক্রয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারি, তাহলে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অনেকটা সহজ হবে। তবে আমাদের মজুত করার ক্ষমতা সীমিত। ২০ লাখ টনের মতো চাল মজুত করার সামর্থ্য আছে। বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, এ বছর ২০ লাখ থেকে ৩১ লাখ টন মজুত করার সামর্থ্য অর্জন করা হবে। এটি আগেই করা উচিত ছিল। ১০ বছর ধরে আটটি সাইলো নির্মাণাধীন। আশুগঞ্জ এবং আরও দুয়েকটা হয়তো দ্রুত হয়ে যাবে। বাকিগুলোর কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে। সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সমগ্র উৎপাদনের ৬ শতাংশের মতো ক্রয় করে। আমাদের অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক ঝুঁকি বিবেচনায় এটি অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। তাহলে খাদ্যশস্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকবে না। তবে এ বছর উপর্যুপরি বন্যা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে আমন উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে।
আমার মতে, এবারের বাজেট ভারসাম্যপূর্ণ। আমদানির রাশ টানা এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের উৎপাদনকে সহায়তা করার পদক্ষেপ রয়েছে। দেশীয় শিল্পের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ।
সমকাল: আপনি কি মনে করেন, বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?
বিনায়ক সেন: বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বছর যত না প্রবৃদ্ধির বছর, তার চাইতে বেশি হলো সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষার বছর। দুর্গতির বছরে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার প্রধান সূচক তিনটি- মূল্যস্ম্ফীতির হার, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্য এবং বাজেট ঘাটতি সহনীয় রাখা। তিনটি ক্ষেত্রেই আমরা যথাসময়ে উদ্যোগ নিয়েছি। খাদ্যশস্যের মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ভালো। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই। সরকার বলেছে, ধাপে ধাপে অল্প করে দাম সমন্বয় করা হবে। বাজেট ঘাটতি মোটামুটি একটা সীমার মধ্যে (জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ) রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারি ব্যয়ের হার কমিয়ে আনা হয়েছে, যা অস্বস্তির বছরে বাজেটের একটা ভালো দিক। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আগামী অর্থবছরে যা কমিয়ে ১৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর মানে, সচেতনভাবে সরকারি ব্যয়ের অনুপাত কমানো হয়েছে। এর পেছনে কারণ হলো, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত আকাঙ্ক্ষা করতেন, সরকারি ব্যয় জিডিপির ২০ শতাংশে উন্নীত হোক। ভারতে যেখানে এটি ২৪ শতাংশ। বেশি ব্যয় করলে সরকার জনগণের জন্য অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু এ বছর সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ব্যয় বাড়ানোর চাইতে ব্যবহারের ওপর এবং অসমাপ্ত অগ্রাধিকার প্রকল্পে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমদানিনির্ভর নয় এমন খাত, বিশেষ করে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন উৎসাহিত করা হয়েছে এবং পোশাক ও পোশাকবহির্ভূত রপ্তানি খাতের মধ্যে আয়করের হারে সমতা আনা হয়েছে। এর ফলে রপ্তানি একদিকে বাড়বে, অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রেমিট্যান্স বাড়বে। সেই সঙ্গে আমদানির চাহিদা, যা গত বছরে সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৬০ শতাংশের মতো বেড়েছিল, সেখানে রাশ টানা হয়েছে বাজেটের আগেই। এখন হয়তো এটি ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে। এর ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমদানি প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের মধ্যে নেমে যাবে বলে মনে হয়। এসব উদ্যোগ না নিলে চলতি হিসাবে ঘাটতি জিডিপির ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ হয়ে যেত। এখন মনে হচ্ছে, ঘাটতি ২ থেকে আড়াই শতাংশের মধ্যে থাকবে। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়ে, বিনিময় হার বাড়িয়ে এবং বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এলসি মার্জিনের হার বাড়ানো হয়েছে। তবে এগুলো দুর্বল ‘পলিসি ইনস্ট্রুমেন্ট’। এ কারণে টাকার বাজার নির্ধারিত মূল্যমানের দিকেই যেতে হয়েছে।
বাজেট ঘাটতির ক্ষেত্রেও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে মূল্যস্ম্ফীতির হার আগামী অর্থবছরে বড় কোনো মাথাব্যথার কারণ হবে বলে মনে হয় না, যদি বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ না করে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হলো মূল্যস্ম্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা। যদি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যেও থাকে তাহলে দুর্গতির বছরে তা খারাপ নয়। ২০১০-এর দশকের প্রথমার্ধে মূল্যস্ফীতির হার ৭ থেকে ৮ শতাংশ ছিল। এর কারণ ছিল, ২০০৭-০৮ এর অর্থনৈতিক সংকটের রেশ চলছিল। এর পরে কিছুটা কমে আসে। এখন আবার বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশে একটু বাড়বে, এটা স্বাভাবিক।
সব মিলিয়ে বলব, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে বাজেট দেওয়া হয়েছে। এখন বুঝতে হবে, স্থিতিশীলতা না হয় অর্জিত হলো; প্রবৃদ্ধি কি সাড়ে ৭ শতাংশ অর্জিত হবে? প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। দুর্গতির বছরে যদি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশও হয় এবং সেই প্রবৃদ্ধি যদি কম বৈষম্যপূর্ণ থাকে, তাহলে বৈষম্যযুক্ত সাড়ে ৭ শতাংশের চেয়েও তা ভালো।
সমকাল: বাজেট কি বৈষম্য কমানোর দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে বলে মনে হয়?
বিনায়ক সেন: বৈষম্য কমানোর প্রবৃদ্ধির দিকে যদি আমরা যেতে চাই তাহলে যেগুলো বৈষম্য বাড়ায়, এমন পদক্ষেপ বাদ দিতে হবে। পুরো বাজেট বক্তৃতায় সম্পদ করের কোনো আলাপ দেখলাম না। দ্বিতীয় কথা হলো, আর্থিক খাত নিয়ে তেমন কোনো আলাপ নেই। মন্দ ঋণ নিয়ে কিছু বলা হয়নি। যদিও এটি বাজেটের বিষয় নয়। তবে বাজেটের ওপর পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। মাঝে মাঝে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মন্দ ঋণ মওকুফ করে দিতে হয়। অন্যদিকে যদি খেলাপি ঋণ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায় অথবা দেশের ভেতর থেকে ফেরত না আসে, তাহলে উৎপাদনশীল ঋণগ্রহীতারা ঠিকমতো ঋণ পান না। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং কর প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অর্থমন্ত্রী যদি বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার পরিকল্পনা করেন, তাহলে দেশের ভেতরে যাঁরা টাকা নিয়ে ফেরত না দিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন, তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারছেন না কেন?
আমার মতে, বৈষম্য কমাতে যাঁদের সুবাদে জিডিপি বাড়ছে, তাঁদের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখনও ১০০ টাকা। কিছু সুবিধা মিলিয়ে বড়জোর ২০০ টাকা হতে পারে। এটা তো হতে পারে না। শিল্প শ্রমিক বিশেষত পোশাক শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৫ বছর কর্মক্ষম থাকে। যে সময়টা তারা কর্মক্ষেত্রে ঢোকে, তখন হলো পড়ার সময়। আমার ধারণা, একটা সময়ে তাদের মোবিলিটি আটকে যায়। তারা গ্রামে চলে যায় কিংবা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে অন্য খাতে কাজ করে। সুতরাং তাদের জন্য শুধু সামাজিক সুরক্ষা নয়; নৈশকালীন শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দেশ গঠনের জন্য জার্মানি এবং ব্রিটেনে এটি ব্যাপকভাবে করা হয়েছে। সুতরাং শিল্পায়নের পাশাপাশি শ্রমিক পরিবারের জন্য নৈশকালীন সাধারণ শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষার জন্য সার্বিক একটি পরিকল্পনা নিতে হবে। তাদের জন্য বহু কিছু করার বাকি।
সমকাল: সামাজিক নিরাপত্তা খাত তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে অনেকে বলছেন। আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
বিনায়ক সেন: সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হবে। সবার জন্য একটা পেনশন স্কিমের দিকে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। আগামী অর্থবছরে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, তা দেখার বিষয়। তবে অভিপ্রায়টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা নিঃসন্দেহে অনেক বড় উদ্যোগ।
আমার মতে, প্রবৃদ্ধি সুষম করতে হলে এত সম্পদ, এত প্রবৃদ্ধি যাদের জন্য, সেই শিল্প শ্রমিকদের জন্য বাড়তি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে শিল্প খাত। ১৯৯১-৯২ সালে ম্যানুফাকচারিং বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১০ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে তা হয়েছে ২০ শতাংশ। শিল্প খাতে শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে, জিডিপিতে অবদানও বেড়েছে। উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সামাজিক অভিঘাতের দিক থেকে শিল্প খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শ্রমিক পরিবার কমবেশি বঞ্চিত। মূলত সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গ্রাম ঘিরে এবং শহরের কিছু বস্তিবাসী এর মধ্যে রয়েছে। আমার প্রস্তাব, ৫০ লাখ পোশাক শ্রমিক এবং এর বাইরের ৩০ লাখ শ্রমিকের জন্য অন্তত চাল-ডাল-ভোজ্যতেলের রেশন ব্যবস্থা চালু করা হোক। এটি করা সহজ। আমরা নগর দরিদ্রদের তালিকা নেই বলে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করছি। টার্গেটিং কীভাবে করব, কখন হবে টার্গেটিং- এভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। এ জন্য নির্দিষ্টভাবে আশুলিয়া, টঙ্গী, ডেমরা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার আশপাশে গড়ে ওঠা বৃহৎ শিল্পকারখানা এলাকায় যেখানে প্রচুর শ্রমিক পরিবার বাস করে, সেখানে রেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ জন্য নতুন করে কোনো টার্গেটিং লাগবে না। এতেশিল্প মালিকদেরও লাভ হবে। কারণ, মজুরি না বাড়লেও রেশন চালু হলে শ্রমিকদের জন্য মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়া সহজ হবে। এ জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটলে হবে না। একটি সুসমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে করতে হবে।
সমকাল: বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর পরিশোধের মাধ্যমে বৈধতা দানের উদ্যোগকে কীভাবে দেখেন?
বিনায়ক সেন: পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ এখনকার সময়ের জন্য মোটামুটি ভালো এই বিবেচনায় যে, এতে যদি কিছু টাকা ফেরত আসে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি একটি মরিয়া চেষ্টা। পানামা পেপারসে যাঁদের নাম আছে, বিদেশে যাঁরা ব্যাংকে টাকা রেখেছেন, তাঁরা ফেরত আনবেন বলে মনে হয় না। নিয়ে আসার ইচ্ছা থাকলে তো তাঁরা এখনই পারেন। ওই টাকা তাঁরা বিদেশ থেকে নিয়ে এসে কালো টাকা সাদা করার বিধানের সুযোগ নিতে পারেন। আমার মনে হয়, দেশের ভেতরে যে টাকা কালো হয়ে আছে এবং সাদা করা হয়নি, সেই টাকা হুন্ডি হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে এবং সাদা হয়ে সগর্বে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে আবার দেশে ঢুকবে। কিছু লোক হয়তো আসলেই বিদেশে থাকা সম্পদ দেশে এনে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি ঘটবে বেশি।
সমকাল: শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা আরেকটু অগ্রাধিকার পেতে পারত কিনা?
বিনায়ক সেন: বাজেটের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়েনি। শিক্ষায় সামান্য বেড়েছে, তবে প্রাথমিক শিক্ষায়। সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমেছে। এ রকম একটি সংকোচনের বছরে কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি কাটছাঁট করা উচিত হয়নি। অসহায় মানুষের জন্য ৫০০ টাকা কিংবা ৭০০ টাকা করে ভাতা অনেক বছর ধরে চলছে। এটি অবশ্যই বাড়ানো উচিত। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের যে বাজেট, তা তো অর্ধেকের মতো খরচই হয় না। বাজেটে যে ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানো অর্থাৎ তাদের ব্যয় করার সামর্থ্য বাড়ানো। সরকার যদি তা করতে পারে তাহলে অন্তত যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা খরচ হবে। সরকার শহর এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক চালুর চিন্তা করতে পারে। কভিডের সময় দেখা গেছে, শহরের মানুষের জন্য কোনো কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক নেই। অন্যদিকে পুষ্টির ক্ষেত্রে অনেক বেশি বৈষম্য বিদ্যমান। শহর এলাকায় সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবার এবং সবচেয়ে গরিব ২০ শতাংশ পরিবারের মধ্যে খর্বকায় শিশু থাকার পার্থক্য তিন গুণ। ধনী-গরিবের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে এত!
আমি একটি বিশেষ প্রস্তাব করতে চাই এবং তা হলো শিক্ষাকেন্দ্রিক একটি ২৪ ঘণ্টার টেলিভিশন চ্যানেল চালু করা। ভারত এবারের বাজেটে উন্নয়নকেন্দ্রিক একটি টিভি চ্যানেল চালুর ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষার জন্য টিভি চ্যানেল চালু করলে এ খাতে ঘাটতি কমানো এবং ধনী ও গরিবের বৈষম্য অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।