বিনায়ক সেন
১. দেশভাগ ও গণহত্যা
কোনো কাকতালীয় কারণে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশই_ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় গণহত্যা এড়াতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ও অব্যবহিত পর সংঘটিত দাঙ্গাগুলোর বিস্তৃতি এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছিল যে, একে গবেষকদের এক বড় অংশ দেখেছিলেন ‘গণহত্যামূলক দেশভাগ’ (বা জেনোসাইডাল পার্টিশন) হিসেবে। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন_ শহীদ আমিন, বীণা দাস ও বোন পান্ডে স্বাধীনতার আনন্দকে মলিন হয়ে যেতে দেখেছিলেন পার্টিশন-দাঙ্গার বিষয় পরিণামে। আশিষ নন্দী, উর্বশী বুটালিয়া প্রমুখ যারা প্রথাগত অর্থে নিম্নবর্গের ইতিহাস-প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত নন তারাই প্রথম ‘গণহত্যামূলক দেশভাগ’-এর শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেন। একই ধারায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, গোয়ানিজ বংশোদ্ভূত খ্রিস্টান পাকিস্তানের সাংবাদিক নেভিল এন্থনি ম্যাসকারেনহাস তার ‘সানডে টাইমস’-এর ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রচ্ছদ নিবন্ধের শিরোনাম করেন ‘জেনোসাইড’। তবে তারও আগে আমাদের স্মরণ করতে হবে আদি-চিন্তক সাদত হাসান মান্টোকে, যিনি দেশভাগের সময়কালীন গণহত্যা নিয়ে তার অবিস্মরণীয় (কিন্তু সহজপাঠ্য নয়) ‘স্কেচগুলো’ রেখে গেছেন। এতই ব্যাপক ছিল গণহত্যামূলক দাঙ্গা যে, তার পরিণাম দেখে শিউরে উঠেছিলেন নেহরু ও জিন্নাহ উভয়েই। মান্টো তার অতি ক্ষুদ্র ‘বিনয়’ গল্পটি এভাবে বর্ণনা করেছেন:
‘দাঙ্গাকারীরা ট্রেনটাকে থামালো। যারা অন্য ধর্মের ছিল তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বার করল ও হত্যা করল। এসব কাজ যখন শেষ হলো তখন ট্রেনের বাদবাকি যাত্রীদের তারা আপ্যায়িত করল দুধ, কাস্টার্ড আর টাটকা ফল দিয়ে।’
ট্রেনটা ছাড়ার আগে আতিথেয়তা দানকারীদের নেতা সমবেত যাত্রীদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতা দিলেন : ‘ভায়েরা ও বোনেরা, যেহেতু আপনাদের ট্রেন আসার সংবাদটি আমরা দেরিতে পেয়েছি তাই আমাদের যা ইচ্ছে ছিল সে রকম কোনো আপ্যায়ন আপনাদেরকে প্রদান করতে পারিনি।’
যারা গোবিন্দ নিহালনীর সিনেমা ‘তামস’ দেখেছেন বা কুশওয়ান্ত সিংয়ের ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ পড়েছেন তাদের এ নিয়ে বাড়তি কিছু বলার নেই। ইয়াসমিন খান তার ‘দ্য গ্রেট পার্টিশন : দ্য মেকিং অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ বইয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এ রকম নির্মম দেশভাগই কি ছিল ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত ‘চূড়ান্ত মুহূর্ত’? একেই কি নেহরু তার ১৫ আগস্টের মধ্যরাতের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি’_ নিয়তির সঙ্গে আমাদের অচ্ছেদ্য বন্ধন?
পাঠক নিশ্চয়ই বলবেন, কথা হচ্ছে ২৫ মার্চের ও তার পরের ৯ মাসের গণহত্যা, যেটা বাংলাদেশে ঘটেছিল তা নিয়ে। এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের দেশভাগ (হোক তা গণহত্যামূলক দেশভাগ) টেনে আনা কেন? দুই কারণে। এক. বাংলাদেশেও ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছিল ২৫ মার্চের গণহত্যাময় ‘কালরাত্রির’ পরই, দুই. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে জাতীয়তাবাদী ঘরানার ইতিহাসবিদরা যত বই লিখেছেন, গণহত্যা নিয়ে লিখেছেন খুবই কম সে তুলনায়। একই কথা প্রযোজ্য ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের ক্ষেত্রে। তারাও জাতীয় আন্দোলন লিখতে গিয়ে দেশভাগের দাঙ্গাকে কার্যত এড়িয়ে গেছেন। ২৫ মার্চের গণহত্যার অভিজ্ঞতাই এক রাতের মধ্যে ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নাকি স্বাধীনতা’ এর মধ্যে যারা তখনও দোলাচলে ভুগছিলেন তাদের এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়। এরপর আর থাকা চলে না পাকিস্তানের সঙ্গে_ এ রকম একটি সর্বজনীন বোধে মিলিত হয় বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ। অভিজ্ঞতাটা চুন্নু ডোমের চোখে এ রকম:
‘আমরা ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ শাঁখারীবাজার থেকে প্রতিবারে একশত লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাকবোঝাই করে তিনশত লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দু’পাশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ী, রমনা কালীবাড়ি, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি। … আমাদের ইন্সপেক্টর পঞ্চম আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এরপর আমরা লাশঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-কিশোর ও শিশুর স্তূপ করা লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি। আর গণেশ, রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। লাশগুলো ঝাঁঝরা দেখেছি, মেয়েদের লাশের কারও স্তন পাইনি, যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পেছনের মাংস কাটা দেখেছি। … প্রত্যেক যুবতীর মাথায় খোঁপা খোঁপা চুল দেখলাম।’
হুমায়ূন আহমেদের মতো শক্তিশালী লেখক ২৫ মার্চের গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে তার ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইয়ে ন্যারেটিভ থামিয়ে দিয়ে গণহত্যার এসব প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাতার পর পাতাজুড়ে তুলে দিয়েছেন। মার্চের রাজনৈতিক সংলাপের এক পর্যায়ে এ রকম একটি গণহত্যা ঘটানোর পরিকল্পনা পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তি করল কী করে? এটা করলে অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক যারা এ দেশে তখন পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিলেন তারাও যে বিরুদ্ধ-পক্ষে চলে যাবেন এবং তার পরিণতি তো আরও অনিবার্য হয়ে উঠবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়_ কিছু আগে বা কিছু পরে সে সম্ভাবনাটুকু তারা কি আদৌ বিবেচনায় নিয়েছিলেন? ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে খ্যাত ২৫ মার্চের গণহত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন, ‘আমি আর্মির এ পদক্ষেপের বিরোধী ছিলাম। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলরা এর পক্ষে ছিলেন। তিন দিন ধরে আলোচনা চলছিল মুজিবকে নিয়ে কী করা হবে_ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হবে নাকি মেরে ফেলা হবে, তা নিয়ে। একাংশ চেয়েছিল তাঁকে মেরে ফেলতে। ২১ মার্চ পর্যন্ত আমরা জানতাম না আর্মি কোনো অ্যাকশনে যাবে কি-না। ২২ মার্চ টিক্কা (খান) আমাদের জানালেন_ তৈরি থাকতে।’ এই উদৃব্দতিটি যেখান থেকে নেওয়া সেটি হচ্ছে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তানের সিএসপি আমলা হাসান জাহিরের বই ‘দ্য সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান’। তার বইয়ে অনেক নেপথ্যে বলা ঘটনার উল্লেখ আছে, শুধু বর্ণনা নেই ২৫ মার্চের গণহত্যার। এক জায়গায় তিনি বলছেন, মে-জুন মাসের দিকে তিনি গেছেন তার কিছু বাঙালি বন্ধুর বাসায়। সেসব বাসায় ভীত, বিচলিত, আতঙ্কিত দেখেছেন তাদের পরিবারকে : ‘সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে, তাদের স্ত্রী-সন্তানদের মধ্যে ভীতি ও নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলার যে চিত্র আমি দেখেছি তা আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। এদের প্রতিটি পরিবার ভয়াবহ কাহিনী শুনিয়েছে আমাদের, এর মধ্যে ছিল মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা আর এসবের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছিল আর্মি অপারেশন।’ এর বেশি আর কিছু সেখানে পাওয়া যায় না। শুধু এক জায়গায়, তিনি বাঙালি নিধন-পরিকল্পনাকে চিহ্নিত করেছেন ‘ফাইনাল সল্যুশন’ হিসেবে। বলা বাহুল্য, এই শব্দবন্ধটি হিটলারের জার্মানিতে নাজিরা ব্যবহার করেছিল ইহুদিদের সমূলে সংহারের মাধ্যমে জাতি-নিধন পরিকল্পনাকে বোঝাতে গিয়ে। এই নীতি এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও নেওয়া হয়েছিল_ এটা হাসান জাহির হিসাবে নেননি। ২৫ মার্চের গণহত্যার শিকার হয়েছিল প্রথমে রেললাইনের ধারের বস্তিবাসী ও তার পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়_ এটিও তার নজর এড়িয়ে গেছে।
২. ইতিহাসের ‘উচ্চকণ্ঠ’ বনাম ইতিহাসের ‘নিস্তব্ধতা’
ইতিহাস অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলে, অনেক বেশি বলে, কিন্তু অনেক বিষয় নিয়ে আবার কোনো উচ্চবাচ্যই করে না, এড়িয়ে যায় বা ‘নিস্তব্ধ’ থাকে। ইতিহাস যেহেতু আমাদের কাছে ‘অতীত’কে বিনির্মাণ করে, উপস্থাপনা করে, সেহেতু কোন ঘটনাটা কতটা প্রাধান্য পায় তার ওপরে ভিত্তি করে আমাদের লিখিত-পড়িত ‘ইতিহাসবোধ’ (টেক্সট) তৈরি হয়। ইতিহাসের জন্য যা অস্বস্তিকর, সেসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার ফলে শেষাবধি আমরা যা পাই তা হলো সময়ের এক খণ্ডিত চিত্র কেবল। এই খণ্ডিত চিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে যে সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্র গড়ে ওঠে তাও খণ্ডিত হতে থাকে ‘ভেতর থেকে’। নিটশে একে বলেছিলেন, এ রকম ইতিহাসে ‘মৃতরা জীবিতদের মাটিচাপা দিয়ে কবর দেয়’।
বিসমার্ক জার্মানিতে একনায়ক হিসেবে ক্ষমতা নেওয়ার দু’বছর পরে, ১৮৭৩ সালে, জার্মান দার্শনিক নিটশে কিছু ‘অসময়ের ভাবনা’ লিখতে শুরু করেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি লেখেন_ ‘দ্য ইউজ অ্যান্ড এবিউস অব হিস্টরি ফর লাইফ’। এই ছোট্ট পুস্তিকাটি প্রথাগত
ইতিহাসবিদ্যার মৌলিক পদ্ধতিগত সমালোচনা হিসেবে আজ স্বীকৃত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিহাস চর্চার নানা খুঁটিনাটি তথ্য পেশ করে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে, অথচ অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই, বিচার-বিশ্লেষণ তো আরও পরের কথা। এই ছিল নিটশের মূল কথা। নিটশের এই কথার সূত্র ধরে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ তার একটি লেখায় বলেছেন, কোনো কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে ‘অতিরিক্ত ইতিহাসপনা_ অতিরিক্ত স্মৃতিশক্তির মতো_ কোনো দেশের সংস্কৃতির অবক্ষয়মান স্বাস্থ্যকে নির্দেশ করে’। এক্ষেত্রে তিনি বিখ্যাত স্নায়ু
মনস্তত্ত্ববিদ এআর লুবিয়ার একটি গল্প উদৃব্দত করেন। এই মনস্তত্ত্ববিদের কাছে সমস্যা নিয়ে এক রোগী এসেছেন। তার সমস্যা হলো_ তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি : সে কোনো কিছুই ভুলতে পারে না, সমস্ত খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ খণ্ড খণ্ড চিত্র হিসেবে তার মনের মধ্যে রয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এত অসংখ্য খুঁটিনাটির মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গিয়ে কোনো কিছুরই অর্থ উদ্ধার করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। রণজিৎ গুহ ঔপনিবেশিক ও জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চা উভয় ধারার মধ্যেই অনেক অনাবশ্যক খুঁটিনাটি তথ্যের জড়ো হওয়াকে একটি বড় মানসিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরেছেন।
আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও কোনো কোনো বিষয়ে আমাদের ‘প্রখর স্মৃতিশক্তির’ পরিচয় পাই। বস্তুত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ_ এই তিনটি দেশেই জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার একটি বড় অংশজুড়েই রয়েছে অনাবশ্যক নানা তথ্যের বিপুল আয়োজন, যা পাঠককে (ও নাগরিককে) ‘ক্লান্ত, ক্লান্ত’ করে। বাহান্না, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তরের ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ_ জাতীয় রাজনৈতিক জীবনের এসব গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগ-উচ্ছ্বাসে যেটা হারিয়ে যায় তা হলো সাধারণ জনচৈতন্যের ও জনজীবনের ক্রমবিবর্তনশীল নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা। আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের পুরো গল্পটা আবর্তিত হতে থাকে ‘আগে থেকে গল্পের সমাপ্তি কী জেনে নিয়ে’ গল্প বলার মধ্যে (অর্থাৎ ‘টেলিওলজিক্যাল’ চরিত্রসম্পন্ন) এবং সে গল্পও আবর্তিত হতে থাকে ‘নায়ককে’ ঘিরে_ সেটা হতে পারে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, ব্যক্তিনায়ক হিসেবে মুজিব, ২৬ মার্চ, ১৭ এপ্রিল ও ১৬ ডিসেম্বরের বীরগাথা আর এসবের ‘অতিরিক্ত’ আয়োজনে চাপা পড়ে যায় ২৫ মার্চ_ যার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা হচ্ছে কেবল ‘একটি কালরাত্রি’। এমনকি ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ যেন নয়-নয়টি মাসের বিবরণ নয়, এটি যেন পূর্ব-নির্মিত রাজনৈতিক ভাবাদর্শের একটি অধীনস্থ প্রত্যয়, যেন একটি দ্রুত ঘটে যাওয়া পর্ব, যার প্রতিটি দিনের কোনো বিবরণ নেই বা যা হারিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের সামরিক যুদ্ধের খাতওয়ারি দিনলিপির মধ্যে। যদি ইতিহাসকে ‘ক্রম-প্রকাশ্য’ (আগে থেকে অনুমান সম্ভব নয় এমন) কাহিনী হিসেবে বর্ণনা করা যেত তাহলে আমরা অন্যরকম ইতিহাসের বয়ান পেতাম। সে ক্ষেত্রে আরও বেশি জীবন্ত, সত্যাশ্রয়ী ও মানবিক দেখাত ওপরের বর্ণিত জাতীয় মাইলফলকগুলো। সেখানেও স্বাধীনতার ইচ্ছা কীভাবে দানা বেঁধে উঠছিল তাকে ধরার চেষ্টা থাকত; কিন্তু সেটা হতো সরলীকৃত জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের চেয়ে আরও জটিল, বহু-সম্ভাবনাময় এবং বহু-ইঙ্গিতময় বয়ান। সেখানে উত্থান-পতন, সংশয়-দোলাচল, অস্থিরতা ও গণজাগরণ থাকত সব মানবিক বাস্তবতা নিয়ে। সেটি হতো না কেবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা সমরকৌশলের বিবরণ মাত্র। এ কারণেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ (বা চেতনাগুলো) এসব কথাকে কখনোই আমরা ঘটনাপরম্পরায় শনাক্ত করতে পারিনি এবং এ জন্যই (আমার ধারণা) আমাদের মৌলিক সাংবিধানিক প্রত্যয়গুলোতে যেমন : বাঙালি জাতীয়তাবাদের ‘বাঙালিত্ব’, সমাজতন্ত্রের ‘অভিপ্রায়’, গণতন্ত্রের ‘বৈশিষ্ট্য’ বা ধর্মনিরপেক্ষতার ‘মানে কী’_ এ নিয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের ইতিহাসের ভেতর থেকে উঠে আসা কোনো ‘সংজ্ঞাকে’ আমরা আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ডিসকোর্সে তুলে ধরতে পারিনি বা তা নিয়ে সুস্থ বিতর্ক করতে পারিনি। এটা সম্ভব হতো যদি আমরা বাংলাদেশের ‘জনগণের ইতিহাসকে’ (পিপলস হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ) আমাদের ইতিহাস চর্চার প্রধান বিষয় হিসেবে শনাক্ত করতাম। তা না করে আমরা যা করেছি (কিছু স্মরণীয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যেমন বদরুদ্দীন উমরের ‘ভাষা আন্দোলন’ বিষয়ক গবেষণা) তা হলো একটি (নতুন) রাষ্ট্রের জন্মবৃত্তান্ত লেখার চেষ্টা। ‘রাষ্ট্র’ অবশ্যই জনগণের ইতিহাস লেখার একটি অংশ; কিন্তু সেটিই একমাত্র ও প্রধান অংশ নয়।
৩. গণহত্যা নিয়ে পাঠ ও অপাঠ
‘রাষ্ট্রীয় ইতিহাস’ বনাম ‘জনগণের ইতিহাস’ এই প্রতিস্থাপনাটি সবচেয়ে বেশি করে প্রকট হয়ে ওঠে যখন আমরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বা তার পরের ৯ মাসের ক্রমাগত গণহত্যা ও গণসন্ত্রাসের বিবরণী পাঠ করি। আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ড, যেখানে সংকলিত হয়েছে ‘গণহত্যা, শরণার্থী শিবির ও প্রাসঙ্গিক ঘটনা’। এর ভূমিকায় সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, ‘বর্তমানে আমাদের সংগ্রহে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার দলিল ও তথ্য জমা হয়েছে। এর ভেতর ১৫ হাজার পৃষ্ঠা ছাপা হচ্ছে। বাকি দলিল ও তথ্যাদি ছাপার বাইরে রয়ে যাবে’। দুঃখের বিষয়, বাদবাকি দলিল ও তথ্যাদি গ্রন্থিত আকারে আমরা এখনও পাইনি বা পেলেও হয়তো অত্যন্ত আংশিকভাবে পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, এ অষ্টম খণ্ডটির কোনো ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থও (আমার জানা মতে) এখন পর্যন্ত বাজারে আসেনি। অষ্টম খণ্ডটিতে ২৬২টি মূল্যবান সাক্ষাৎকার রয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই হলো সাধারণ মানুষের বয়ান। এ সাক্ষাৎকারগুলো সংগৃহীত আলাপের অতি সামান্য অংশ; কিন্তু এতে করেই একাত্তরের গণহত্যার যে চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তাতে করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক প্রায় বিস্মৃত অধ্যায়কে প্রামাণ্যতার ভিত্তিতে আমাদের নিজেদের ও বিশ্ববাসীর জন্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপন করা সম্ভব।
কী আছে এসব সাক্ষাৎকারে? প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে তা হলো, এক বৈরী রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে সংঘবদ্ধভাবে পরিচালিত সামরিক-রাজনৈতিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে অসহায় এক নিরপরাধ সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভয়ার্ত দিনযাপন। একাত্তরের ৯ মাসে কীভাবে আক্ষরিক অর্থেই পুরো দেশটা এক বন্দিশিবিরে পরিণত হয়েছিল তার প্রামাণ্যতা মেলে এখানে। আমি বলেছি, প্রথম অনুভূতিটা ছিল ‘ভয়ের’_ এক ভীতিবহ রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির গোড়াপত্তন হয়েছিল ওই নয় মাসে। একটি উদাহরণ নাজিমুদ্দিন মানিক বলছেন, ২৬ মার্চের ভোরবেলার কথা:
‘বায়তুল মোকাররমের মোড়ে রাস্তার ওপর আরও দুটি নাম না জানা বাঙালি বীরের নশ্বর দেহ চোখে পড়ল, চোখে পড়ল জিপিওর পেছনের গেটে এক ঝুড়ি রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড আর নাড়িভুঁড়ি। তবুও আমি হেঁটে চলেছি, হেঁটে চলেছেন আমার চারপাশের মানুষজন। কেননা আমি এবং আমার চারপাশের মানুষ_ আমরা সবাই তখন বাঁচতে চাই এবং সে জন্যই আমাদের কারও প্রতি কারও কোনো খেয়াল নেই, কারও সঙ্গে কারও কোনো কথা নেই। সবার চোখেই একটা সন্ত্রস্ত ভাব। সবাই ভীতি বিহ্বল’।
প্রাথমিকভাবে যেটা ছিল ভয়ের অনুভূতি, সেটা সময়ের সঙ্গে নীরব অসহযোগিতা ও ক্রমেই সক্রিয় প্রতিবাদ প্রতিরোধে রূপ নেয়। অনেকগুলো সাক্ষাৎকারে বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ ছাত্র, নারী, বৃদ্ধ, সাধারণ কৃষক, মেহনতি মানুষ, আলেম, ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, শারীরিক নির্যাতন, অগি্নসংযোগ ও হত্যার বিবরণ। বিশেষভাবে এসেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘জাতিগতভাবে’ ধ্বংস ও তাদের হত্যা করার বর্ণনা। এসব সাক্ষাৎকার একনাগাড়ে পড়াও সম্ভব নয়, এমনই সব নির্যাতনের বিবরণ দেয়া হয়েছে। যত ধরনের নারী-নির্যাতন সম্ভব, যত ধরনের হত্যা সম্ভব, যত ধরনের আক্রমণ ও লুণ্ঠন সম্ভব_ সব কিছুর নমুনা সংকলিত হয়েছে এসব গণহত্যা ও গণসন্ত্রাসের ডকুমেন্টেশনের মধ্যে।
এসব সাক্ষাৎকারে বেরিয়ে এসেছে যে, অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার বা জওয়ানদের চেয়েও পাশবিক ভূমিকা পালন করেছে এ দেশের একটি গোষ্ঠী_ যারা রাজাকার বাহিনী, শান্তি কমিটি প্রভৃতি সাংগঠনিক আয়োজনের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে মফস্বল শহরে ও গ্রামাঞ্চলে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। ব্যক্তিগতভাবে এদের মধ্যেও কেউ কেউ কদাচিৎ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন এমনও দৃষ্টান্ত মেলে এসব সাক্ষাৎকারে। তবে সাধারণ চিত্রটা ছিল এদের সম্পর্কে এটাই। অকাট্য সব প্রমাণ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপতৎপরতা ও সরাসরিভাবে নিরীহ-নির্দোষ মানবতার বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপরাধে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের জুন মাসের পরের সময়ের বিবরণ যেসব সাক্ষাৎকারে দেয়া হয়েছে তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে দখলদার বাহিনী ও তার সহযোগী শক্তিদের মধ্যে ক্রমাগত ভীতি সঞ্চারের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। সাধারণ অবাঙালিদের ওপর বাঙালির আক্রমণেরও কিন্তু সাক্ষ্য পাওয়া যায় এসব সাক্ষাৎকারে। এ সময়ের বেশিরভাগ অত্যাচার-নির্যাতনের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা। যারা অত্যাচারিত হয়েছে তারা খুব কম উদাহরণেই সেসব তথ্য দিয়েছেন শত অত্যাচার-নির্যাতনের মুখেও। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে তারা তথ্য গোপন করেছেন বা ভুল তথ্য দিয়েছেন। এদের অনেকেই বলেছেন যে, তারা এখন শারীরিকভাবে পঙ্গু বা চলৎশক্তিহীন বা ক্রনিক কোনো ব্যাধিতে ভুগছেন বা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দিন কাটাচ্ছেন কোনোভাবে। এসব বীরত্বময় ব্যক্তিরা প্রতিরোধের কাহিনী পড়তে গিয়ে আপনার মনে হবে_ এরাও তো ছিলেন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, তা তাদের সনদপত্র থাকুক বা না থাকুক। আমার প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কি এদেরকে অষ্টম খণ্ড থেকে শনাক্ত করে কোনো সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা কখনো নিয়েছে? বা কোনো নিতান্ত বৈষয়িক সহায়তার হাত বাড়িয়েছে রাষ্ট্রের তরফ থেকে? আছে কি এদের নামে প্রতিটি গ্রামে কোনো স্মৃতিফলক? এ জন্যই এই লেখার শুরুর দিকে উচ্চকণ্ঠ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ইতিহাসের বিপরীতে জন-ইতিহাসের নিস্তব্ধতার কথা বলেছি।
তবে এতসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ধারেকাছেও যাননি এখনো যারা দেশে-বিদেশে ১৯৭১-এর গণহত্যা অস্বীকার করেন_ তারা। হার্ভার্ড গবেষক শর্মিলা বোস এদের একজন। তিনি অনায়াসে তাই লিখতে পারেন যে, নারী নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন এ জাতীয় কাজ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী করেনি বা করলেও এসবে তাদের অংশগ্রহণ ছিল সামান্যই। এ দেশের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যারা ভেতর থেকে স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছিল নয় মাস ধরে, তারাই বেশিরভাগ আক্রমণ-নির্যাতন করে থাকবে। এ জন্যই তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ বলার পরিবর্তে ‘গৃহযুদ্ধ’ শব্দটি পছন্দ করেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে তা সঠিক হলেও সাধারণভাবে এটি একটি অতি অসত্য পর্যবেক্ষণ। শর্মিলা বোস তার ‘ফিল্ড-ওয়ার্ক’-এর ভিত্তিতে যে বইটি লিখেছেন তার নাম ‘দ্য ডেড রেকনিং’। সে বইয়ে তিনি
অষ্টম খণ্ডের একটি কেস স্টাডিকেও আবার নতুন করে বিচার করার প্রয়াস নেননি স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি ব্যাপক হারের গণহত্যাকে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু অষ্টম খণ্ডের যে কোনো সাক্ষাৎকারই তার মতের বিপক্ষে যায়। তিনি ব্যাপকভাবে ‘নারী ধর্ষণ’-এর বিষয়টিকেও ‘অতিরঞ্জিত’ বলে মনে করেছেন। আমার সামান্য হিসেবে আমি দেখতে পাচ্ছি যে, শতকরা ৭০ ভাগ সাক্ষাৎকারেই সরাসরিভাবে নারী ধর্ষণের উল্লেখ রয়েছে এবং বিশেষ করে যেখানে নারীরা নিজেরা বয়ান দিয়েছেন তার প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই পাশবিক নারী নির্যাতনের উল্লেখ রয়েছে। এসব নারীর কারো ঠিকানা সংগ্রহ করে মুখোমুখি হতে চেষ্টা করেননি শর্মিলা বোস। গণহত্যা অস্বীকারকারী হলোকাস্ট ডিনায়ার হিসেবে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন তার বইয়ের জন্য, বিশেষভাবে যা সমাদৃত হয়েছিল জেনারেল পারভেজ মোশাররফের পাকিস্তানে, যেখানে তিনি প্রায় সেলিব্রেটি। পারিবারিক সূত্রে তিনি নেতাজী সুভাষ বোসের ভাই শিশির কুমার বোসের মেয়ে_ ফলে তিনি বাড়তি কিছুটা মনোযোগও পেয়েছেন। আমি নির্মোহভাবে বিচার করেই এ সিদ্ধান্তে এসেছি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডটি অস্বীকার করে, বিশেষত একে তার গবেষণার নমুনা বয়ানে অন্তর্ভুক্ত না করে, তিনি মৌলিক অসাধুতার আশ্রয় নিয়েছেন।
২৫ মার্চের গণহত্যা বা সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস-নির্যাতন সম্পর্কে নিস্তব্ধতা রয়েছে পাকিস্তানের ইতিহাস চর্চায়। এই নিস্তব্ধতা এখনো চলছে। হামিদ মীরের মতো সাহসী সাংবাদিক এর ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই, কিন্তু তারপরও এই উদাসীন্য চলছে। সে দেশের জনগণকে একাত্তরের প্রকৃত ঘটনা জানতে দেয়া হয়নি কখনো। এখনো তারা একাত্তরের গণহত্যার অধ্যায়টি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। ২০০৭ থেকে ২০০৯ প্রায় তিন বছর বর্তমান লেখক বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ হিসেবে পাকিস্তানের ওপর কাজ করেছেন। পাকিস্তানের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রণালয়ে ও দফতরে তাকে যেতে হয়েছে কর্মোপলক্ষে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি লক্ষ্য করেছি যে, ২৫ মার্চের গণহত্যা বা নয় মাসের অত্যাচার-নির্যাতন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই সাধারণ পাকিস্তানিদের, এমনকি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ আমলাদেরও। বাংলাদেশ ‘বিযুক্ত হয়েছে’ সামরিক শাসকদের এবং ভুট্টোর ভুলের কারণে_ এ পর্যন্ত তারা কেউ কেউ স্বীকার করেন; কিন্তু গণহত্যার আলোচনা সম্পর্কে তারা অজ্ঞ, অথবা তা জ্ঞানত বা অজ্ঞানত এড়িয়ে গেছেন। এদের মধ্যে যারা কিছুটা অসহিষ্ণু_ তারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য ইন্দিরাকে দায়ী করেন এবং মুজিবকে সাধারণভাবে মনে করেন ‘বিশ্বাসঘাতক’। পাকিস্তানের নানা শহরে পূর্ব
পাকিস্তানের অনেক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদের নামে সড়ক রয়েছে (শেরে বাংলা ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীসহ)। কিন্তু একটিও সড়ক নেই শেখ মুজিবের নামে। অফিসিয়াল এস্টাবলিশমেন্টেরচোখে মুজিব এখনো ‘সবচেয়ে ঘৃণিত’ ব্যক্তি। ২০০৭ সালে লাহোরে সেন্সাস কার্যালয়ে নানা আপ্যায়নের মধ্যে আমার কাছে এ রকম একটি বক্তব্য জোরেশোরে তুলে ধরেছিলেন একজন উচ্চপদস্থ আমলা। আমি তাকে হাসান আসকারী রিজভীর লেখা ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘মিলিটারি, স্টেট অ্যান্ড সোসাইটি ইন পাকিস্তান’ বইটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। সেখানে এক জায়গায় রিজভী লিখছেন:
‘(মার্চের) সামরিক পদক্ষেপ প্রতিরোধ আন্দোলনকে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত করেছিল। আওয়ামী লীগের কট্টর অংশটি চেয়েছিল মার্চের শুরুতেই স্বাধীনতার ঘোষণা করতে; কিন্তু মুজিবুর রহমান তাদেরকে পিছু টেনে রেখেছিলেন। মার্চের আন্দোলনের পরে … পাকিস্তানের সাথে যেটুকু ভঙ্গুর যোগাযোগ ছিল দেশটির, যদিওবা তার অবশিষ্ট কিছু থেকে থাকে সেসময়ে, তাও সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে গেল যখন সেনারা শহরে ঢুকল শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে।’
২৫ মার্চের গণহত্যা ছিল আমাদের সাধারণ জনচৈতন্যে তদানীন্তন পাকিস্তানের সাথে অবশিষ্ট মানসিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করার মুহূর্ত। এই কথাটা আমি লাহোরে কেন্দ্রীয় সেন্সাস কার্যালয়ে বিনয়ের সাথে উল্লেখ করেছিলাম। এরপর সভাকক্ষে এক ধরনের বিষণ্ন ও অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এসেছিল। ইতিহাস শুধু ‘অনিবার্যতার’ মাধ্যমে অগ্রসর হয় না, এর মধ্যে ক্রান্তিলগ্নের ‘আকস্মিকতার’ অবদানও ক্রিয়াশীল থাকে, যা নাটকীয়ভাবে ভিন্ন যুগের ভেতরে আমাদেরকে টেনে নিয়ে যায়।
লেখক
অর্থনীতিবিদ
প্রাবন্ধিক