বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
ধর্ম নিরপেক্ষতার আরো একটি মানে ‘ইহজাগতিকতা’, কিন্তু ইহজাগতিকতার পরিধি সীমিত থেকেছে রাজনীতিতে ধর্মকে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শের মধ্যে এবং এটি এসেছে কেবল পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বা সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্যের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অনেক সময় ধর্মকে যুক্তির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধর্ম-নির্বিশেষে সমতার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছে বাহাত্তরের সংবিধান। ধর্মনিরপেক্ষতার আরেকটি অর্থ হচ্ছেু সকল ধর্মের মানুষকে সমান অধিকার দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বা নন-ডিসক্রিমিনেশন প্রিন্সিপাল। সব মিলিয়ে আমরা পাচ্ছি ধর্মনিরপেক্ষতার তিনটি দিক: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো; ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করার ইহজাগতিক বোধ; এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্মপালনের এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান অধিকার। এই তিনটি দিক মেলালে আমরা আমাদের দেশের মতো করে সেক্যুলারিজমের একটি আদল খুঁজে পাই। এরই প্রতিফলন হয়েছে সংবিধানের ১২ নং ধারায়:
‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’
ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারাটিকে এর আগের ১১ নং ধারার অধীনে দেখতে হবে, যেখানে রয়েছে ‘মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তার’, এবং ‘মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ’ নিশ্চিত করার কথা।
সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ধর্মকে রাজনীতির সাথে যুক্ত না করা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান নেওয়া এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে (এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও) সমান অধিকার- ধর্মনিরপেক্ষতার এই তিনটি দিক রক্ষার জন্য নাস্তিক হওয়ারও দরকার নেই। ধর্মহীন বা ধর্মচ্যুত হওয়ারও আশঙ্কা নেই। একজন প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তার বিশ্বাসে অনড় থেকেও এই তিনটি দিকই রাষ্ট্রের কাছে মনে-প্রাণে প্রত্যাশা করতে পারেন। আমাদের মা-নানীরা ধর্মবিশ্বাসী হয়েও আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সকল ধর্মের মানুষের যার যার ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা স্বীকার করে গেছেন। যারা রাজনীতিতে নেমে কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের বা সম্প্রদায়ের মানুষকে অধিকারহীন করতে চায়, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাধাতে চায়, তাদের প্রতি আমাদের পিতৃপুরুষেরা সশঙ্কিত মনোভাব প্রকাশ করতেন এবং তাদের সংস্পর্শ পরিত্যাজ্য জ্ঞান করতেন। সেকালে অনেক স্থানে যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা পাশাপাশি বাস করতেন, তাদের অনেকেরই মধ্যে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সাথে সাথে এক ধরনের ‘মিশ্র’ সামাজিক-ধর্মীয় আচার গড়ে উঠেছিল। ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে বলি, আমি যে-আবহাওয়ায় বড় হয়েছি, তাতে করে পাড়ায় মিলাদ হলে বা শবেবরাতের সময়, ঈদের পরবে নিত্যই দাওয়াত মিলত প্রতিবেশী মুসলিম পরিবারদের থেকে। তাদের কাউকে ডাকতাম খালাম্মা, কাউকে পিসিমা বলে, তারা আবার আমার মা-বাবাকে ডাকতেন মাসিমা-মামাবাবু বলে। বাবার এমনি একজন বোন ছিলেন। যাদের সাথে পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেই সুদূর ১৯৪৩ সাল থেকে। এই ধর্মবোন-ধর্মভাই শুধু স্বধর্মের অনাত্মীয় লোকদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল না; ভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যেই দেখা যেত। আমাদের জীবন-চর্চা ছিল আত্যন্তিকভাবেই ধর্মাশ্রিত এবং তা কখনও কখনও নিজ ধর্ম ছাপিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাসকেও স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে প্রকাশ পেত। গভীর ধর্ম-বিশ্বাসের পাশাপাশি এক ধরনের মিশ্র-আচার বা ‘সংকট’ মনোবৃত্তি হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেই ছিল। এটা শুধু তথাকথিত ‘নীচু’ জাতের মানুষদের মধ্যেই ছিল তা নয়; মধ্যবিত্ত ‘ভদ্র’ জাতের মানুষদের মধ্যেও ছিল। আমার মা প্রতিটি পারিবারিক সংকটে-উৎসবে মিরপুরের ‘ঠান্ডা পীরের’ মাজারে বা হাইকোর্টের ‘গরম পীরের’ মাজারে মানত রাখতেন এবং ছোটবেলা থেকেই এই দুই জায়গায় যাওয়া আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কীভাবে মা তার প্রতি-মঙ্গলবারের মঙ্গলচণ্ডী পূজার সাথে পীর-মাজার সংস্কৃতিকে মেলাতেন তা একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, তিনি কোনো ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিলেন না। এর বড় প্রমাণ বাংলার পুথি-সাহিত্য। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ‘সংকর’ সামাজিক-ধর্মীয় বিশ্বাস-আচারের দৃষ্টান্ত ধারণ করে আছে মধ্য যুগের বাংলা (ও অন্য ভাষার) পুঁথিসমূহ। ক্ষিতিমোহন সেনের ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানদের যুক্ত সাধনা’; রবীন্দ্রনাথের নিজের করা ‘হান্ড্রেড সংস অব কবীর’ অনুবাদ; দুই বাংলার বাউল-ফকির ঘরানার গান বড় নিদর্শন। যেমন, দাদূ ও কবীর ছিলেন ‘সংকর’ ঐতিহ্যের প্রতীক। এক জায়গায় কবীর বলছেন, ‘আমি সংস্কৃত ভাষা শিখেছি যাতে করে সবাই আমাকে জ্ঞানী বলতে পারে, কিন্তু এই ভাষা শিখে কী লাভ যখন আমি দিকশূন্য হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি?’ এর কয়েক শতাব্দী পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আত্মজীবনী’ লিখতে গিয়ে শুধু উপনিষদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তৃপ্ত হবেন না; তিনি পরে পরেই ফিরে যাবেন হাফিজের বাণীর কাছে। এক জায়গায় দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন কী করে তিনি সিমলার শীতের রাত্রিতে আরাধনার কালে ব্রহ্মসংগীত ও হাফিজের গান একই সাথে করতেন। উদ্ৃব্দতিটি বড়, কিন্তু ‘সংকর ঐতিহ্যের’ স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে তাতে :
‘আমি কম্বল জড়াইয়া বিছানায় বসিয়া সকল ভুলিয়া অর্ধেক রাত্রি পর্যন্ত ব্রহ্মসংগীত ও হাফেজের কবিতা গান করিতাম-
য়া রব, আঁ শমে শব্‌-আফ্‌রোজ কে কাশানা-এ-কীস্ত্‌?
জানে-মা গোখ্‌ৎ বে-পুর্সীদ কে জানানা-এ-কীস্ত্‌?
[অর্থাৎ] যে দীপ রাত্রিকে দিন করে, সে দীপ কাহার ঘরে?
আমার তো তাতে প্রাণ দগ্ধ হলো, জিজ্ঞাসা করি তাহা প্রিয় হলো কার?’
হাফিজের প্রতি মুগ্ধতা দেবেন্দ্রনাথের লেখার ছত্রে ছত্রে ঝরে পড়েছে (আমি শুধু স্থানাভাবে দেবেন্দ্রনাথের অনুবাদে হাফিজের বাংলাটাই তুলে ধরছি) :
‘আজ আমার ও সভাতে দীপ আনিও না।
আজিকার রাত্রিতে সেই পূর্ণচন্দ্র আমার বন্ধু এখানে বিরাজমান।’
তারপর দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন :
‘অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, যাহা মূলতত্ত্ব, তাহার উল্টা ভাবনা মনেতেও স্থান পাইতে পারে না; তাহা কোনো মনুষ্যের ব্যক্তিগত সংস্কার নহে, তাহা সকল কালে নির্বিশেষে সর্ববাদী-সম্মত; মূলতত্ত্বের প্রামাণিকতা আর কাহারো উপর নির্ভর করে না। তাহা আপনি আপনার প্রমাণ। তাহা স্বতঃসিদ্ধ, যেহেতু ইহা আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাতে প্রতিষ্ঠিত।’
একই লেখাতে/স্তবকে দেবেন্দ্রনাথ উপনিষদ ও হাফিজের গানকে সাক্ষী মানছেন এটাও তাৎপর্য্যপূর্ণ :
‘আমার প্রতি উপনিষদের উপদেশ এই :
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং। ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন কর। আমি ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন করিলাম। আমি এই তিমিরাতীত আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষকে জানিয়াছি।’
এটা বলেই তিনি আবারও হাফিজের শরণাপন্ন হলেন :
‘বাদ্‌ অজ্‌-ঈ র্নূ‌ ব-আফাক দেহেম অজ্‌ দিলে খেশ্‌,
কে ব-খুর্শীদ্‌ রসীদেম্‌ ও গোর্রা‌ আর্খি‌ শুদ্‌।
[অর্থাৎ] এখন অবধি জ্যোতি আমার হৃদয় হইতে পৃথিবীতে ছড়াইব, যেহেতুক আমি সূর্য্যেতে পঁহুছিয়াছি ও অন্ধকার বিনাশ হইয়াছে।’
মধ্যযুগের কবীর বা ঊনবিংশ শতকের দেবেন্দ্রনাথ কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন হিন্দু-মুসলিম যুক্ত সাধনার ও ‘সংকর’ সামাজিক ধর্মীয় বিশ্বাসের ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে। দীনেশচন্দ্র সেন ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্য মুসলমানদের অবদান’ গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন :
‘আমরা শিক্ষিত-সম্প্রদায় বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের মালিক। খনির মধ্যে খনির ন্যায় আমাদের পল্লীতে পল্লীতে বঙ্গ-ভারতীয় যে অজস্র দান পড়িয়া আছে তাহা আমরা দেখি নাই, শুনি নাই … এইরূপ শত শত গীতিকা ও কথা আছে। তাহাদের অনেকগুলি নবম দশম শতাব্দীর; হিন্দু-মুসলমানের পৃথক ছাপমারা তাহারা নয়- তাহারা উভয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব। এই বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক বাঙালী। আমি শুধু মুসলমান কবিদের কয়েকটি রচনার নমুনা দিলাম, তাহাও অতি অল্প সংখ্যক। অপ্রকাশিত বহু গীতিকা আমার কাছেই আছে- বাঙালার পল্লী-দরদী লোক যদি খুঁজিয়া বেড়ান, তবে এখনও বৃদ্ধ গায়েন অনেকে আছেন- যাহাদের নিকট হইতে এখনও শত শত কাহিনি ও গীতিকার উদ্ধার হইতে পারে। … হিন্দুদের রচিত মহুয়া, কাজলরেখা, চন্দ্রাবতী, কমলা, কেনারাম, মালঞ্চমালা প্রভৃতি অনেক গীতিকা ও রূপকথা আছে- মূলত তাহাদের সঙ্গে মুসলমানগণের রচিত কাব্যগুলোর প্রভেদ অল্প- একই ধাঁচের লেখা, একই সুর, একই আদর্শ।’ এই যে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত-সাধনা- এই অভিন্ন ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও নন্দনতাত্ত্বিক ঐতিহ্য- এটিও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটি দিক। ধর্মনিরপেক্ষতার এই মিলিত চর্চার সাংস্কৃতিক পটভূমিটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এজন্যেই ‘হাসিনা’ তথ্যচিত্রে যখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান বেজে ওঠে (পান্নালালের গাওয়া) ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা’, তখন সুরেই আবিষ্ট হয়ে থাকি আমরা। এটা যে শ্যামা-সংগীত কে তার ধার ধারতে এসেছে? বঙ্গবন্ধুর মানস-গঠনে এই হিন্দু-মুসলিম একত্র-সংস্কৃতির আবহাওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছে। এটা না বুঝলে শুধু সংস্কৃতি-বিরহিত শুস্ক তত্ত্ব-আদর্শের নিরিখে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির গূঢ় অর্থটি বোঝা যাবে না।
কেন অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ এত বড় করে দেখা দিয়েছিল তা একজন রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখছেন গোপালগঞ্জের জনৈক চন্দ্র ঘোষের কথা, যিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী :’জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হতো না। জুতা পরতেন না, খরম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন।’ এহেন ব্যক্তিকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তান আমলে। একসময় তাকে, শেখ মুজিবকে এবং ফণী মজুমদারকে একই সেলে রাখা হয়। সেবার বঙ্গবন্ধুর প্রচণ্ড জ্বর এলো জেলে :
“রাতভর চন্দ্র বাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুঁশ হয়েছে, দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফণী বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিন দিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢালছেন। কখনও ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। কখনও পথ্য খেতে অনুরোধ করছেন। না খেতে চাইলে ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরোধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন ‘জীবনভরই তো এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না।’ ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্র বাবু ও ফণী বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে?”
এই চন্দ্র বাবুকে আরেকবার ফরিদপুর জেলে পেলেন মুজিব। ততদিনে চন্দ্র বাবুর শরীরের চরম অবনতি হয়েছে। সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতালে নিতে অনুমতি দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাকে বললেন, ‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নেই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই। সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’ চন্দ্র ঘোষ তরুণ মুজিবুরকে বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনো দিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।”
এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এর সারার্থ :বাজেটের যত ভর্তুকি, যত সহায়তা তার লক্ষ্য হবে সর্বপ্রথমে অতিদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাওয়া। স্পষ্টতই এটি প্রথাগত পুঁজিবাদের ধারণার বাইরে, যেখানে ধনী ক্রমেই ধনী হচ্ছে আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে বা গরিবী যেখানে সেভাবে হটছে না। রাউলসের বণ্টননীতি মানলে সমাজে আয়-বৈষম্য, সম্পদ-বৈষম্য এবং সুযোগ-বৈষম্য ক্রমান্বয়ে কমে আসার কথা। সেজন্যই তাকে যথার্থভাবে পুঁজিবাদের উদারনৈতিক সমালোচক বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাউলসের Maximin প্রিন্সিপালের ছায়াপাত দেখি বাহাত্তরের সংবিধানের মধ্যেও, যেমন এর ১৪নং ধারায়। এটি সরাসরিভাবে ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ‘ঘোষণা ও কর্মসূচি’ এবং ১৯৭০ সালের ‘নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো’ থেকে নেওয়া :’রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’
এখানে Maximin প্রিন্সিপালের সাথে মিল এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এটা আরও স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার মতো করে রাউলসের লিবার্টি ও ইক্যুইটি প্রিন্সিপালকে সমন্বয় সাধন করলেন। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের সাথে আমাদের সমাজের গণতন্ত্রের পার্থক্য কোথায় তা নির্দেশ করলেন এবং সেই গণতন্ত্রে যেন দেশের সবচেয়ে বঞ্চিত দুঃখী মানুষ সর্বাগ্রে রাষ্ট্রের তরফে সুরক্ষা পায় সেদিকটি তুলে ধরলেন। সেই প্রথম যেখানে তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রকল্পটি তত্ত্বগত দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুলে ধরেছিলেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে দেওয়ার মতো- পাঠকই রাউলসের তত্ত্বের আলোকে তা বিচার করুন:
‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র; যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে দেখা যায়, সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিবাদীদের Protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে যেসব  Provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ Protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে- ওই শোষকরা যাতে Protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের [গণতন্ত্রের] পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক ঝপযবফঁষব-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে… শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’
বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ ধারণাটি বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার তিন বছর পূর্বেই তার চিন্তার মধ্যে প্রবেশ করেছিল। ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ যেমন ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের’ থেকে আলাদা, তেমনি প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের ‘প্রলেতারীয় গণতন্ত্র’ থেকেও আলাদা। শেষের বিচারে, মানুষের সবকিছুই চাই। শুধু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-কর্মসংস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য পেলেই তার চলে না, তার চাই ইচ্ছেমতো লেখার কবিতার খাতা, দেশ-পরিচালনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, কারখানা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের অধিকার, তার চাই স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার। যেটি না থাকলেু বঙ্গবন্ধু নয়াচীন ভ্রমণের কালে বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের মন ‘পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়’। সেজন্যই সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের ব্যবস্থাপত্রকে তিনি ছক বা ‘মডেল’ হিসেবে অনুসরণ করতে চাননি। তার শোষিতের গণতন্ত্র যে ধরনের অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে সেটাও একান্ত ভাবেই বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব রাজনৈতিক উপলব্ধিজাত। সেদিনের সমাপনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশে সমতাবাদী বিকাশের পথ অন্য সব দেশের অনুসরণে নির্মিত হবে না : গণতন্ত্রের মতোই ‘সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ, এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজ স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাইু সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পাশে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। …বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না, তা যাঁরা করেছেন, তাঁরা কোনোদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেন নাই। …সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখেstep by step  এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা নয় মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাইু আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-র মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
এই যে দেশের মানুষের মনোভাব, পরিবেশ, প্রকৃতি, ‘কাস্টম’, অর্থনৈতিক অবস্থা, ‘কালচার’ এসব শুধু সমাজতন্ত্রের আদি রূপকল্পকেই প্রভাব করবে তা-ই নয়, এটি দেশের মানদণ্ডে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ কী, এদেশের মতো করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, এবং এদেশের সাথে মানানসই ‘জাতীয়তাবাদ’ নির্মাণেও অভিঘাত ফেলবে। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, রূপান্তরবাদী দল ও রাজনৈতিক মতাদর্শের কাজ হবে বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে step by step এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সব কিছু বিবেচনা করে। ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা পদ্ধতিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সমতামুখী সমাজের চিন্তার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাহাত্তরের সংবিধানেই প্রথম আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় অনেকবারই এই শব্দটি ব্যবহূত হয়েছে। কিন্তু কথাটির উৎপত্তি মুক্তিযুদ্ধেরও আগে। সেক্যুলারিজমের বাংলা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি চালু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কালেই, তবে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি প্রবেশ করেছিল ষাটের দশকেই। একটি উদাহরণ দিই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস জয়ের পর আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭০ সালে ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় ২৫শে ডিসেম্বর সংখ্যায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এর নাম ছিলু ‘সাধারণ নির্বাচনে সেক্যুলারিজমের জয়’। তার বিশ্নেষণের সমস্ত দিকের সাথে একমত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু স্বঘোষিত ‘ইসলাম পছন্দ’ দলগুলোর বিপরীতে আওয়ামী লীগের জয়কে তিনি দেখছেন সেক্যুলারিজমের বিজয় হিসেবেু এটাই এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দুই মূল ধারার লড়াইয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিজয়কে তিনি সমগ্র পাকিস্তানের জন্যই আধুনিক প্রগতিবাদের বিজয় হিসেবে দেখছেন। এমনকি দেশভাগ-উত্তর জিন্নাহকেও তিনি সেক্যুলারিজমের পথিকৃৎ বা স্থপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটি প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে দিচ্ছি :
‘সাম্প্রতিক নির্বাচন ছিল একাধিক দিক হইতে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলাফল পাকিস্তানের জাতীয় জীবনে তাই একাধিক শুভ সূচনা করিয়াছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান এই যে, এই নির্বাচনে সেক্যুলারিজমের জয় হইয়াছে। সেক্যুলারিজমই ছিল জাতির পিতার নসিহত ও ওসিয়ত। কাজেই এই নির্বাচনে কায়েদের জয় হইয়াছে। জনমতের দিক হইতে আধুনিক প্রগতিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান টিকিয়া গিয়াছে।’
এই আশ্চর্যজনক দাবির সপক্ষে আবুল মনসুর আহমদ যুক্তি দিচ্ছেন এভাবে:
‘এই নির্বাচনের ফলাফল আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবন দর্শনের শুভ সূচনার যে তাৎপর্য বহন করিতেছে, সে কথাই আজ আমি বলিতেছি। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ও পশ্চিম পাকিস্তানের পিপল্‌স পার্টির বিরুদ্ধে যাঁরা নির্বাচনে লড়াই করিয়াছেন, তাঁদের মধ্যে এই একটি বাদে আর সবাই ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবিকেই নির্বাচনের ইস্যু করিয়াছিলেন। নিজেদের তাঁরা ‘ইসলাম পছন্দ’ আখ্যা দিয়াছেন। …আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পিপলস পার্টি, জাতীয় লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক দল রাজনীতিতে ধর্মের আমদানী সমর্থন করে না বলিয়াই ‘ইসলাম-পছন্দেরা’ ইহাদিগকে ইসলামবিরোধী আখ্যায়িত করিয়াছেন। এই সব দলকে ভোট দিলে পাকিস্তানে ইসলাম থাকিবে না, পাকিস্তান কুফরের মুল্লুক হইয়া যাইবে, এই ধরনের সাংঘাতিক সাংঘাতিক কথা বলিয়া ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করিয়াছেন। এইভাবে তাঁরা দেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি করিয়াছিলেন যে, নির্বাচনটা যেন ইসলাম ও কুফরের মধ্যে একটা জেহাদ। একটা ধর্মযুদ্ধ। …’ইসলাম-পছন্দরা’ সত্যই হারিয়া গিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা কার্যত নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও তাঁরা নগণ্য হইয়া পড়িয়াছেন।’
এরপর আবুল মনসুর আহমদ সেক্যুলারিজমের বঙ্গানুবাদ হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। আবারও তার লেখাটিতে ফিরে যেতে হয় :
‘কিন্তু আসল সত্য কথা কি? পাকিস্তানে ইসলাম সগৌরবে বহাল আছে। মুসলিম দেশবাসী সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগকে এবং বিপুলভাবে পিপলস পার্টিকে ভোট দিয়াও ধর্ম হিসাবেও ঈমান আমানে সহিসালামতে আগের মতো ঈমানদার মুসলমান রহিয়াছেন। আওয়ামী লীগসহ সকল ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী রাজনৈতিক দলই বলিয়াছেন, তাঁরা ধর্ম বিরোধী নন, তাঁরাও পাক্কা ঈমানদার মুসলমান। তাঁরা নির্বাচিত হইয়া ক্ষমতায় গেলে ধর্মবিরোধী কোনো আইন রচনা ও কাজ সম্পাদন করিবেন না। ‘ইসলাম পছন্দ’রা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবাদীদের এসব কথা বিশ্বাস না করিবার জন্য মুসলমান ভোটারদের তাগিদ দিয়াছেন। মুসলিম ভোটাররা তাদের নির্দেশ অমান্য করিয়াছেন। তাঁদের কথিত ইসলামবিরোধীদের জিতিয়াই দিয়াছেন। তাতেও ইসলাম খতম হয় নাই, হইবার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যায় নাই। বরঞ্চ এটাই প্রমাণিত হইল যে, ‘ইসলাম পছন্দরাই’ মুসলিম ভোটারদের ধোঁকা দিয়াছিলেন, আর আওয়ামীসহ অন্যান্য সেক্যুলারিস্ট পার্টিরাই সত্য কথা বলিয়াছিলেন। ফলে এই দাঁড়াইল যে, নির্বাচনে ইসলামকে ইস্যু খাড়া করিয়াও ধর্মীয় রাজনীতিবিদদের কোনো লাভ হয় নাই। খামাখা তাঁরা পবিত্র ধর্মের অমর্যাদা করিলেন।’
এটাই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির একটি ব্যাখ্যা। এ কথাটাই প্রথমে এসেছে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সমাপনী ভাষণে:
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবেু তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবেু কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবেু তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রীস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবেু কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরী, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচারু এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’
ধর্মকে সংকীর্ণ স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজনীতির সাথে জড়িত না করা এটি ধর্মনিরপেক্ষতার একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করা এবং তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এটি পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বড় আকারে বলা ছিল।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
আর সকল ধারাই- রাউলস্‌ের যুক্তি অনুসারে ;Freestanding’ -দেশ-কাল-শ্রেণি-জাতি-গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত: its content is set out independently of the comprehensive doctrines that citizens affirm.
তার মানে কি আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের বাহাত্তরের সংবিধান জন রাউলস্‌ের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? এটা ঠিক যে, জন রাউলস বিশ শতকের সেরা রাজনৈতিক দার্শনিক (পলিটিক্যাল ফিলোসফার) – এ কথা অমর্ত্য সেন বহু আগেই স্বীকার করে গেছেন। তার ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইটি রাউলস্‌কেই উৎসর্গ করা। রাউলস্‌ের ক্লাসিক গ্রন্থ ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ এর শিরোনামের সঙ্গে সেনের বইটির নামকরণে সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। রাউলস্‌ের বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭১ সালে, আমাদের সংবিধান প্রণয়নের ঠিক আগের বছরে। সরাসরিভাবে জন রাউলস্‌ের রাজনৈতিক দর্শন-পলিটিক্যাল লিবেরালিজম-সংবিধানকে প্রভাবিত করেছিল এমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি এবং সেই দাবিও আমি তুলছি না এখানে। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, বাহাত্তরের সংবিধানের কাঠামো, তার ধারা-উপধারার নির্মাণ, তার সমতাবাদী স্বাধীন ন্যায়ানুগ সমাজের ধারণা জন রাউলস্‌ের পলিটিক্যাল ফিলোসফির সঙ্গে খুব বেশি সংগতিপূর্ণ। এই মৌলিক দিকটি দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। রাউলস্‌ যে লিবারেল মতবাদের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, তা ভারতসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংবিধানেরই তলদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে। সেসব অভিজ্ঞতাকে রাউলস্‌ কেবল আরও যুক্তিনিষ্ঠ, সমন্বিত ও প্রসারিত করে ব্যক্ত করেছিলেন তার লেখায়। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সেকালের লিগ্যাল জুরিস্টদের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলে থাকবে। যেমন, রাউলস্‌ ‘স্বাধীনতার’ ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন যে, সকল নাগরিকেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, পেশা বাছাইয়ের স্বাধীনতা থাকবে। বাহাত্তরের সংবিধানের ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১ ধারাসমূহে যথাক্রমে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য রোধ, সরকারি নিয়োগ লাভে সমতা, আইনের আশ্রয়লাভের সমতা, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ, জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধকরণ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এদের প্রায় প্রতিটিতেই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ আরোপিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু তাকে পড়তে হচ্ছে রাউলস্‌ের ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের’ আলোকেই। স্বাধীনতা মানে অবাধ স্বাধীনতা নয়- যুক্তিসংগত স্বাধীনতা। যাতে স্বাধীনতার সীমা চরমপন্থার দিকে না গড়ায়। এটি স্পষ্টতই রাউলস্‌-ধারার লিবারেল রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাবসঞ্জাত। বস্তুত, বাহাত্তরের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ের (২৬ থেকে ৪৭ ধারা পর্যন্ত) মোট ২১টি ধারার ৫টি বাদে ( অর্থাৎ ৪, ২৯, ৩০, ৪২ ও ৪৭ ধারা বাদে) ১৬টি ধারাই সিভিল ও পলিটিক্যাল লিবার্টির সঙ্গে সরাসরিভাবে সংযুক্ত। এটাও সংবিধানের চরিত্রের ‘লিবারেল’ দিকটির প্রতি নির্দেশ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান কেবল রাউলসের পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের সাথে তুলনীয় করে দেখলে চলবে না, এর অর্থনৈতিক-সামাজিক কমিটমেন্ট আরও বেশি গভীর। সেটা আমরা ইতোপূর্বেই ১০নং ধারার ‘জাস্ট অ্যান্ড ইগালিটারিয়ান সোসাইটির আলোচনায় প্রত্যক্ষ করেছি। এ ছাড়া ১৫নং ধারার নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ প্রতিশ্রুতির মধ্যে বিবৃত হতে দেখেছি। তার মধ্যে বিশেষভাবে আলাদা করে উল্লেখিত হয়েছে, সাধারণ মানুষের ‘পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের কথা, যা রাষ্ট্রের ‘অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য’ হিসেবে নির্দেশিত হয়েছে ১৮নং ধারায়। সেই সঙ্গে ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ (১৫নং ধারা); ‘সুযোগের সমতা এবং ‘সম্পদের বণ্টন’ (১৯নং ধারা) প্রভৃতি দিকের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছি। এই চিন্তাগুলো যেমন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার তলদেশ থেকে উঠে এসেছে, তেমনি এদের পূর্ব চিহ্নসমূহ পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের আদি উচ্চারণেও পাওয়া যায়। এক অর্থে মার্কসের চিন্তা ও পরবর্তীকালের রাউলসের মতন উদারনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তাধারার মধ্যে মৌলিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে একটি বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জন রাউলস বা আজকের যুগের মাইকেল স্যান্ডেল যেসব কথা বলছেন বৈষম্যের প্রশ্নে এসে, তাতে মার্কসবাদীদের অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। যেমন- রাউলস তার লেখায় পরিস্কার করে ‘সুযোগের সমতার’ কথা বলেছেন, ‘সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের’ দাবি তুলেছেন; বিশেষ করে সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার অধিকারের কথা বলেছেন। এবং এটা করতে গিয়ে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিতদের। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে গরিব অগ্রাধিকার পাবে, সেটা রাউলসের সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত চিন্তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ১৯৭১ সালের ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ বইটিতে এবং পরবর্তীতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে তার ‘জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস’ বইয়ে তিনি তার সোশ্যাল জাস্টিস তত্ত্বের ‘দুই নীতিমালা’ ব্যক্ত করেন। এই দুটি প্রিন্সিপালের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে সকলের জন্য ‘সমান মৌলিক স্বাধীনতা’ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘সকলের জন্য সুযোগে ন্যায্য সমতাবিধান’, অর্থাৎ ‘ফেয়ার ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি’ নিশ্চিত করা এবং ‘সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত অংশের কাছে সবচেয়ে বেশি সুবিধে পৌঁছে দেওয়া।’ ইংরেজিতে দাঁড়ায় নিম্নরূপ :
‘First Principle’: Each person has the same indivisible claim to a fully adequate scheme of equal basic liberties, which scheme is compatible with the same scheme of liberties for all
Second Principle : Social and economic inequalities are to satisfy two conditions:
a. They are to be attached to offices and positions open to all under conditions of fair equality of opportunity;
b. They are to be to the greatest benefit of the least-advantaged members of society (the difference principle)’

প্রথম ও দ্বিতীয় নীতিমালার মধ্যে সংঘর্ষ লাগলে প্রথম নীতিমালাটি অগ্রাধিকার পাবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকার রক্ষা করার কথা বলে রাজনৈতিক মৌলিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। এটা পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের ধারার একটি মৌলিক দাবি- যেটি বাংলাদেশের সংবিধানেও ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই। সেখানে বিধৃত মৌলিক অধিকারসমূহের অধিকাংশই সিভিল ও পলিটিক্যাল লিবার্টি সম্পর্কিত (অবশ্যই ইতোপূর্বে আলোচিত ‘যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ’ সাপেক্ষে)। অর্থনৈতিক অধিকারের তুলনায় রাজনৈতিক-নাগরিক অধিকারকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার এই ধারা অবশ্যই অনেক কট্টর মার্কসবাদীরা (লেনিনবাদীরা সমর্থন করবেন না। কোনো বিশেষ অবস্থার চাপে, একটা নির্দিষ্ট আপৎকালীন সময়ের জন্যে নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে (যেমন- অতিমাত্রায় করারোপ করা হতে পারে, বা অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রসাধন করতে হতে পারে)। এ রকমটা দেখা গেছে শিল্পায়নের সময়ে ১৯২৫-১৯৩৬ কালপর্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নে, অথবা মহাযুদ্ধকালীন সময়ে পুঁজিবাদী ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষ অবস্থার চাপে পড়ে, যুদ্ধোত্তরকালে বা কোনো একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আপৎকালীন সময়ের জন্য নাগরিক মৌলিক স্বাধীনতার কোনো কোনো দিক থেকে সরে আসতে হতে পারে। ৯-১১ পরবর্তীকালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ও ইরাক-যুদ্ধ এসব পর্বে খোদ যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপে নাগরিকদের মৌলিক সিভিল পলিটিক্যাল লিবার্টিসমূহ সাধারণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। নাগরিকদের পত্রালাপ, ফোনালাপ, ইন্টারনেট ব্যবহার, চলাফেরা ইত্যাদির ওপরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি করা হয়েছে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। পুঁজিবাদের এই নজরদারি প্রবণতাকে এখন এর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। একে ‘সারভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। কেউ কেউ এই প্রবণতার মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা অসুখের ছায়াপাত দেখছেন। দার্শনিক মিশেল ফুকো এসব ঘটার ৩০-৪০ বছর পূর্বেই তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে ‘আই অব পাওয়ার’ বা চবহড়ঢ়ঃরপড়হ-এর সম্ভাব্যতা আধুনিক পুঁজিবাদের জেনেটিক কোডে আবিস্কার করেছিলেন। কিন্তু সেটা ঘটলেও- আকছার এ রকম ঘটছে বলেই- রাউলস মৌলিক স্বাধীনতার নীতিমালাকে অপরাপর নীতিমালার সঙ্গে এক কাতারে দেখার পক্ষপাতী নন। স্বাধীনতা বনাম উন্নয়ন প্রশ্নে কোনো বাস্তবিক ট্রেড অফ দেখতে নারাজ রাউলস (এবং অমর্ত্য সেনের মতো লিবারেল দার্শনিকেরা)। এর বিপরীতে হবস, মার্কস, লেনিন, ফুকো প্রমুখ দার্শনিকেরা স্বাধীনতাকে অতটা শীর্ষস্থানে তুলতে রাজি নন, যদি না অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলো আগে প্রতিষ্ঠিত হয় বা করা যায়।
রাউলস অর্থনৈতিক সাম্যের আগে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাম্য নিশ্চিত করতে চান এবং এ দুইয়ের মাঝে কোনো ক্ষেত্রেই ‘ট্রেড-অফ’ করা যাবে না- এই হচ্ছে তার সুচিন্তিত মত। কিন্তু এর বিপরীতে মার্কস থেকে ফুকো অবধি দার্শনিকেরা ভিন্ন মত রেখেছেন। তাদের মোটা দাগের বক্তব্য হলো, সবার জন্য সমান মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আগে- হয়তো নিশ্চিত করার জন্যই-প্রয়োজন সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক অধিকার। ভাত, কাপড়, জমি, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রভৃতি অধিকারকে আগে প্রতিষ্ঠা করা। কবি নির্মলেন্দু গুণ যেমন বলেছিলেন, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।’ ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’- এই স্লোগান উঠেছিল দেশভাগের পরপরই। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের পটভূমিতে এই স্লোগান ওঠা তখন অস্বাভাবিক ছিল না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনের একপর্যায়ে অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিকে স্বয়ং শেখ মুজিব আন্দোলনের সম্মুখভাগে নিয়ে এসেছিলেন। ‘দুই অর্থনীতি’ শীর্ষক ন্যারেটিভ ছয় দফার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার মৌলিক যুক্তিভিত্তি জুগিয়েছিল। সেদিনের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল অর্থনৈতিক দাবি রক্ষার মোড়কেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আওয়ামী লীগ কেবল রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন বা অটোনমির স্লোগান তুলেছিল; আর বামপন্থিরা কেবল অর্থনৈতিক অধিকারের কথায় সরব হয়েছিল। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রাজনৈতিক স্বাধিকার-স্বাধীনতার পদক্ষেপই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের যুক্তির জরিসুতো দিয়ে বোনা। এমনকি ছয় দফার দলিলটিরও শিরোনাম ছিল : ‘ছয় দফা- আমাদের বাঁচার লড়াই’, যেখানে দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বর্ণনা ছিল। আমি বলতে চাইছি, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষত ষাটের উত্তাল দশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার উভয়ই দাপটের সঙ্গে উপস্থিত ছিল : এ দুইয়ের মধ্যে কোনো ‘ট্রেড-অফ’ করা হয়নি। এখানে মার্কসও ছিলেন, রাউলসও ছিলেন। এই দুটো ধারাকে ধারণ করেছিলেন মুজিব ও তার নিকটতম আদর্শিক সহকর্মীরা।
তবে একটি প্রশ্নে রাউলসের সাথে মার্কসের কোনো বিরোধ হতো না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রাউলস সমাজের সকল নাগরিকের মধ্যে সুযোগের ন্যায্য সমতা এবং সম্পদ বণ্টনে ন্যায্য সমতা চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি এই ন্যায্য সমতা বাস্তবায়নের পথে সর্বাগ্রে অতিদরিদ্র এবং সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক দিকটি রাউলসের পূর্বে কথিত ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপাল’ (যাকে আজকের পরিভাষায় প্রায়োরিটি প্রিন্সিপাল বা টার্গেটিং প্রিন্সিপালও বলা যায়) থেকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রের কাছে যদি সম্পদ কম থাকে, তবে সংকটের সময়ে কাকে সে সর্বাগ্রে সাহায্য করবে? এ প্রশ্নে রাউলসের উত্তরে কোনো অস্পষ্টতা নেই : দরিদ্রদের এবং অতিদরিদ্রদের প্রতি রাষ্ট্র সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়াবে। এজন্যেই এই রাষ্ট্র শুধু ‘ইগালিটারিয়ান’ নয়, এটি ‘জাস্ট’ও- হতদরিদ্রদের স্বার্থে রাষ্ট্র ইনসাফের বা সামাজিক ন্যায়-নীতি পরিচালনা করবে। এর থেকেই জন্ম হয়েছে রাউলসের বিখ্যাত আপ্তবাক্য-‘Maximum benefits to the minimum advantaged’  (Maximin) প্রিন্সিপালও বলা হয় একে)।
[ক্রমশ]

বাজেট, রাষ্ট্র ও নাগরিক অর্থনীতি

বাজেট নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি; আমরা আসলে বাজেট নিয়ে আলোচনা করি না। অর্থনীতি, সমাজ, গোটা রাষ্ট্রই কেমন চলছে- সবকিছু নিয়েই আমরা আমাদের নাগরিক মতামত রাখি, উদ্বিগ্ন হই; সাফল্যে-অর্জনে উদ্বেলিত হই। এ বছরের বাজেট নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তির সময়ে এ বাজেট এসেছে। করোনার বিশ্বব্যাপী অভিঘাতের দ্বিতীয় বছরের কালে এ বাজেট ঘোষিত হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের দশম ধারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন- ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করার।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতক উদযাপনের বছরে এসেছে এই বাজেট। তলাবিহীন ঝুড়ি, উন্নয়নের পরীক্ষা-ক্ষেত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ-ঝুঁকির প্রতীক, দুর্নীতির দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন ইত্যাদি অভিযোগের পর অভিযোগে আক্রান্ত ছিল একদা বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি। সেখান থেকে আমরা কয়েক বছর আগেই বেরিয়ে এসেছি। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। অতি সম্প্রতি আমাদের উত্তরণ ঘটেছে স্বল্পোন্নত এলডিসিভুক্ত গ্রুপ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মূল স্রোতধারায়। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির বিচারে আমরা বহুদিন ধরে বিশ্বের প্রথম ২০টি দেশের ভেতরে। কভিডের আগের অবস্থায় আমরা ছিলাম দশকে দশকে ক্রমাগতভাবে বেড়ে ওঠা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আমরা বেড়ে উঠেছি চার/সাড়ে চার শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার থেকে বিশ্বস্তভাবে ছয়/সাড়ে ছয়, সাত/সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারে (শেষের দিকে আট শতাংশ লক্ষ্যমাত্রাও ছুঁয়েছি আমরা)। ২০০০ সালে আমরা ছিলাম পাকিস্তানের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অনেক নিচে; এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়
পাকিস্তানের দ্বিগুণ। ২০১৬ সালে আমাদের চরম দারিদ্র্যের হার (১.৯০ পিপিপি ডলারের মানদণ্ডে) ছিল ১৫ শতাংশ; সে সময়ে ভারতের চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। আয়-প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য ছাড়াও মেয়েদের স্কুলগামিতার হার, শিশু-অপুষ্টির হার, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার প্রভৃতি সামাজিক সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ায় (শ্রীলঙ্কাকে বাদ দিলে) আমরা এগিয়ে আছি। আর আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় তো যোজন যোজন এগিয়ে। তারপরও জাতি হিসেবে প্রতি বছর বাজেট এলেই বাংলাদেশের জনসমাজ- শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আলোড়িত হয়- এটা শুধু আমাদের তর্কপ্রিয় স্বভাবকেই ইঙ্গিত করে না। দার্শনিকরা যাকে বলেছেন ‘পাবলিক রিজন’- সেই নাগরিক-বোধ আমাদের দেশে অন্য অনেক সমাজের চেয়ে অনেক বেশি প্রাগ্রসর। শানিত ও তীক্ষষ্ট। আমাদের দেখভালের দায়-দায়িত্ব সরকারের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত বোধ করি না। ‘গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে’; আমরা সেই সাহসী উদ্দাম জাতির বংশধর। নিজেদের বিষয়-আশয় আমরা নিজেরাই বুঝে নিতে প্রস্তুত। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় সরকারের সাহায্য এলে ভালো। কিন্তুযদি না-ও আসে, তাতে আমরা বসে নেই। আমরা শৃঙ্খলভাঙা দ্রাবিড় তিমিরবিনাশী জাতি। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন জনবসতির দেশ; তাও তেমন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া। কিন্তু এই স্বল্প-সম্পদ ও উচ্চ-ঝুঁকির ঘন জনবসতির দেশে বাস করেও- হয়তো বাস করি বলেই আমরা ডেসপারেটভাবে নির্ভীক, উদ্যমপরায়ণ জাতি। এ জন্যই করোনার বছরেও আমরা নুয়ে পড়ি না; আমাদের শ্রমিকদের বিদেশ থেকে পাঠানো রক্ত জল করা অর্থ সমস্ত পরিসংখ্যানগত প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়; আমাদের কৃষকরা নিত্যনতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে নতুনতর প্রযুক্তি আশ্রয় করে সৃষ্টি করে দেন কৃষি ও খাদ্য-নিরাপত্তার এক বিশাল মজবুত সামাজিক সুরক্ষার পাটাতন। আমাদের পোশাকশিল্পের তরুণ প্রজন্মের নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা করোনাকে উপেক্ষা করে হাসিমুখে টিকিয়ে রাখেন রপ্তানিমুখী উন্নয়নের ধারা। আরভিন আদিগার উপন্যাসে একটি ‘হোয়াইট টাইগার’-এর বর্ণনা ছিল। এদেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিজনকেই আমার মনে হয় একেকটি হোয়াইট টাইগার। উদ্যমী, ভ্রূক্ষেপহীন, সুযোগ সন্ধানে তৎপর, কষ্টসহিষ্ণু, আশা ও উচ্চাশায় বুক বেঁধে থাকা প্রাণ। এদেশকে পিছু টেনে রাখা অসম্ভব। এই অন্তর্নিহিত ‘সামাজিক পুঁজি’ সচরাচর বাজেট আলোচনায় ধরা পড়ে না।
২.
কভিড-১৯ বাংলাদেশকে (ও বিশ্বকে) আঘাত করার একটি বছর পেরিয়েছে। এরই মধ্যে আমরা করোনার একটি বড় ঢেউ প্রত্যক্ষ করেছি। ২০২১-২২ সালের বাজেট দেওয়ার দু’মাস আগেই আমরা করোনার আরেকটি ঢেউকে আসতে দেখেছি। এটি সহসাই আমাদের করোনায় মৃত্যুসংখ্যাকে ১০০-এর ওপরে নিয়ে গিয়েছিল; সংক্রমণের হারকেও উন্নীত করছিল ২০ শতাংশের ওপরে। সার্বিকভাবে পরবর্তী আংশিক লকডাউনের (এবং বর্ডার বন্ধ করে দেওয়ায়) কারণে করোনার মাত্রা এখন অনেক কমে এসেছে। এটা স্বস্তিদায়ক সংবাদ, যদিও নীতিনির্ধারকরা নজর রাখছেন বর্ডার এলাকার জেলাগুলোর দিকে; পাছে সেখানে করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ করোনা এখনও আমাদের দুর্ভাবনার প্রধানতম বিষয় হয়ে থাকছে। এই বাজেটেও সেটা থেকেছে। অর্থমন্ত্রী নিজেই তার বক্তৃতায় এটি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের গত ১২ বছরের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে আমরা দারিদ্র্য দূর করে ও স্বল্প-উন্নত দেশের তালিকা হতে বেরিয়ে এসে একটি উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে যাত্রা করেছি। কিন্তু জাতীয় জীবনের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে করোনাভাইরাসজনিত সংকট আমাদের অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্যান্য আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’ করোনার দ্বিতীয় বছরের মধ্যে আমরা আছি, এবং পরিস্থিতির বিচারে মনে হয় যে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। যতদিন দেশের অধিকাংশ জনগণকে আমরা টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে না পারব এবং যতদিন বিশ্বজুড়ে কভিডের ছায়া অপসৃত না হবে, ততদিনই এই অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। এটাই বাস্তবতা। এ জন্যই গত বছরের বাজেটের মতো এ বছরের বাজেটকেও আমি বলতে চাই ‘ঝুঁকি মোকাবিলা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বাজেট’। অর্থাৎ এখানে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ানো মূল লক্ষ্য না- যদি বাড়ে তো ভালোই, তবে পরিকল্পনাবিদ বা রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশামতো না বাড়লেও ক্ষতি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত জনকল্যাণের দিকে চোখ রেখে সামগ্রিকভাবে করোনার ঝুঁকি সামাল দেওয়া যাচ্ছে ও অর্থনীতির ওপরে সেই করোনার ঝুঁকির অভিঘাতকে প্রশমিত করা যাচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে, টিকাদানের ব্যবস্থা না থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে সম্মানজনক মাত্রায়- বিশ্বব্যাংকের মতে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ; এডিবির মতে ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ; সরকারি তথ্যমতে আনুমানিক ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বিপরীতে, ভারতের অর্থনীতিতে কোনো পজিটিভ প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, বরং সংকোচন (নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি) ঘটেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ বা ৫ প্রবৃদ্ধি হার যা-ই হোক না কেন, এটা অর্জিত হয়েছে তিনটি প্রধান ফ্যাক্টরের কারণে। এই তিনটি ফ্যাক্টর হলো- যথাক্রমে কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি। এই তিনটি আয়ের উৎসই গ্রামীণ দারিদ্র্য কমায় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে। এবং সেটাই ঘটেছে বাংলাদেশে। ২০২০ সালের প্রতি ত্রৈমাসিকের জন্য আমরা দারিদ্র্যের প্রাক্কলন করেছিলাম। তাতে প্রথম প্রান্তিকে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল ২০ শতাংশ। কভিডের প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা এক লাফে চলে যায় ২৯ শতাংশে। তৃতীয় প্রান্তিকে তা নেমে আসে ২৭ শতাংশে, এবং চতুর্থ প্রান্তিকে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। চারটি প্রান্তিক মিলিয়ে সারা বছরের গড় দারিদ্র্য দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ২৪ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। একইভাবে ২০২০ সালে চরম দারিদ্র্যের হার চার প্রান্তিক মিলিয়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালের ১৩ শতাংশের সঙ্গে তুলনীয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কভিড আমাদের পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। ২০১৬ এবং ২০২০-এর মধ্যে দারিদ্র্য-পরিস্থিতিতে কোনো সামগ্রিক অগ্রগতি হয়নি। বরং চরম দারিদ্র্য কিছুটা বেড়েছে।
আমাদের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই যে পাঁচ বছরের জন্য পিছিয়ে যাওয়া- এটি হচ্ছে কর্কশ বাস্তবতা। এর ফলে অন্য সব লক্ষ্যমাত্রা থেকেও আমরা পিছিয়ে পড়ব। কভিডের আগে যেভাবে উন্নয়নের ধারা চলছিল, তাতে ২০৩০ সালের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-১ (জিরো পভার্টি) অর্জন করা কঠিন ছিল না আমাদের। আগামী ১০ বছর গড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন করলেই তা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন তা এত সহজ হবে না। যদি আগামী ১০ বছর গড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করি (এ বছরের বাজেটে যেটা ধরা হয়েছে) তাহলেও ২০৩০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে যাবে। একই কথা খাটে অন্যান্য নন-ইনকাম সূচক তথা শিশুপুষ্টি ও মাতৃপুষ্টির ক্ষেত্রেও। তাহলে এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে? প্রথমত, শুধু প্রবৃদ্ধির সড়কের ওপরে নির্ভর না করে সরাসরি আঘাত হানতে হবে, যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন ডাইরেক্ট ইনকাম ট্রান্সফার। এটা হতে পারে প্রত্যক্ষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অথবা ঋণ ও অন্যান্য প্রণোদনার মাধ্যমে স্ব-নিয়োজিত কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করে। এতে হয়তো বাজেট-ঘাটতি জিডিপির স্বাভাবিক ৪-৫ শতাংশের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। যেমনটা হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে বা প্রস্তাবিত হচ্ছে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের ক্ষেত্রে। এই দুটো বছরেই বাজেট ঘাটতি থাকছে জিডিপির ৬ শতাংশের কিছুটা ওপরে। কিন্তু এই বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বেয়াড়া রকমের বেশি নয়। ভারতের ক্ষেত্রে সংকটের বছরে এই ঘাটতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের প্রধান স্বয়ং বলেছেন, এই ঘাটতি সংকট মোকাবিলায় এমনকি ১০ শতাংশ হলেও দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। দেখা যাচ্ছে, মনিটারিস্ট আর কেইনসীয়দের মধ্যে যুদ্ধে আপাতত কেইনসীয়দের পক্ষেই পাল্লা ভারি। সেটা খোদ বিশ্বজুড়েই। আশার কথা, আমরা বহুকাল পরে সাহস করে ওয়াশিংটন কনসেন্সাস থেকে বেরিয়ে ঘাটতি অর্থায়নের কথা বলতে পারছি এবং স্বয়ং অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় এটি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, শুধু ঘাটতি-অর্থায়ন করাই যথেষ্ট নয়। অর্থের সদ্ব্যবহারও করা চাই। এ ব্যাপারে সবাই কম-বেশি একমত- মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত অর্থ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে খামতি আছে। কভিডের বছরে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যয় সক্ষমতার অভাব চোখে পড়ার মতো। সবাই চাচ্ছে, এই কভিডের সুবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য দপ্তর ও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত বাস্তবিকই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মতো পারঙ্গম জনস্বাস্থ্য খাত হয়ে উঠুক। এই একটি বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মনোযোগ জনগণ আশা করে। এই খাতকে শক্তিশালী করার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টরের স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করা প্রয়োজন। এনজিওগুলোরও মাস্ক ইত্যাদি কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
৩.
আসলে অনেকেই চাইছেন করোনাকে উপলক্ষ করে পুরো অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক সিস্টেমকেই সংস্কার করতে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক অর্থে এরা পুঁজিবাদের মধ্যে দুটি ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রথমটি রক্ষণশীল পুঁজিবাদের ধারা, দ্বিতীয়টি প্রগতিশীল পুঁজিবাদের ধারা। একাংশ চাইছেন পুরোনো ধারাই অব্যাহত রাখতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, নিকট অতীতের ধারা অনুসরণ করে যেহেতু ভালো অর্জন করা গেছে- মধ্যম আয়ের স্তরে প্রবেশ করা গেছে, দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বেগবান হয়েছে, অবকাঠামোর চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে- সেহেতু এই স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনার দরকার কী? এরা প্রবৃদ্ধির মূল কাঠামোটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে কভিডের বছরে কিছু নতুন উপাদান সংযোজন করতে চান। যেমন, স্টিমুলাস কর্মসূচি, অতিদরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও রিলিফ কর্মসূচি ইত্যাদি। স্বাস্থ্য খাতেও এরা ‘সংস্কার’ চান, তবে সেটা ‘যুগান্তকারী’ কিছু নয়। দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেলে যেমন সংস্কার করতে হয় সেরকমই কিছু করতে অভিলাষী তারা।
দ্বিতীয় ধারার নীতি-আলোচকরা করোনার সংকটকে সিস্টেম পরিবর্তন করার একটা ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন। তারা চান গতিশীল নেতৃত্বে জনস্বাস্থ্য খাতকে ওয়েলফেয়ার স্টেট মডেলে ঢেলে সাজাতে, নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র করতে কম্যুনিটি হেলথ ক্লিনিকের কায়দায়। প্রতিটি জেলা শহরে ভালো করোনা চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে এবং পর্যাপ্ত টেস্টের ব্যবস্থা করতে। ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনিশিয়ানেরও যথেষ্ট সরবরাহ বাড়াতে। বেসরকারি খাতকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কাজে আরও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে। অনিশ্চয়তার কভিডের ওপরে দেশে গবেষণাচর্চাকে উৎসাহিত করতে। দেশের ভেতরেই করোনার টিকা উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য যাবতীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে। প্রণোদনা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে এরা বৈষম্য, দুর্নীতি ও বঞ্চনা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ। এদের কথাটাও অর্থমন্ত্রীর শোনা দরকার। আমরা শুধু ‘ওয়েলফেয়ার’ বিতরণ করতে চাই না; উন্নত দেশের মতো ওয়েলফেয়ার স্টেটও হতে চাই।

অর্থনীতিবিদ, মহাপরিচালক, বিআইডিএস

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
যেমন লিবার্টি প্রিন্সিপাল যেসব ধারাতে প্রতিফলিত হয়েছে, তার প্রতিটিতেই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষ’-এর শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতা নিঃশর্ত নয়। এটা দেখা যায় চলাফেরার স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৬), সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৭), সংগঠনের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৮), বাক্‌-স্বাধীনতা ও সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৯), পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৪০), সম্পত্তির অধিকার (অনুচ্ছেদ-৪২), গৃহে নিরাপত্তা এবং চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৪৩) প্রভৃতি ধারাসমূহের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ একদিকে যেমন নাগরিক অধিকার আছে, তেমনি অন্যদিকে জনকল্যাণের স্বার্থে, রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের কাছে দাবিও আছে। সেজন্য নাগরিকদের অধিকার কতখানি খর্ব করা যাবে, তা আদালত বলে দেবেন, ঠিক করবেন। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো উৎসের উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল। যেমন- পূর্ব জার্মানির উদাহরণ টেনে বলা হয়েছিল যে, অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বলে কিছু থাকতে পারে না, গ্রহণীয় হতে পারে না। পূর্ব জার্মানির সংবিধানের-১১ অনুচ্ছেদের (১) নং দফায় আছে : ‘All Germans enjoy freedom of movement throughout the fedual tertiary.’ এটা বলেই ঐ অনুচ্ছেদের (২) নং দফায় বলা হয়েছে : ‘Whatever abuses freedom of expression, freedom of opinion, freedom of teaching, freedom of assembly, freedom of association… forfeits these basic rights’। শুধু প্রথাগত সমাজতন্ত্রের দেশ নয়, এ ক্ষেত্রে পুুঁজিবাদী দেশেরও উদাহরণ টানা হয়েছে যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ ব্যাখা করার জন্য। জাপানের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদাহরণ টেনে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের পেছনের যুক্তিটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে মূল জোরটা হয়েছে ‘যুক্তিসংগত’ শব্দটার প্রতি : ‘The fundamental text applied by the supreme Court is that any restriction is valid unless it exceeds the limit of reasonableness or the necessities of public welfare. The Supreme Court has consistently held that restrictions may be imposed to protect the public welfare.’
এখানে মূল বিতর্কটা হচ্ছে ‘reasonableness’ শব্দটা নিয়ে। কে নির্ধারণ করবে কোনটা এবং কত দূর পর্যন্ত যুক্তিসংগত?
আসলে ‘যুক্তিসংগত’ কথাটার মধ্যেই একটি মৌলিক ইনডিটারমিনেসি রয়ে গেছে। যেমন, জন রাউলস্‌ তার ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ বইতে ‘রিজোনেবল প্লুরালিজম’কে স্বীকার করে গেছেন। অর্থাৎ একটি উদারনৈতিক সমাজে একটি নির্দিষ্ট ‘যুক্তিসংগত’ চৌহদ্দির মধ্যে সকল মতাদর্শকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। এর চৌহদ্দিই কীভাবে নির্ণীত হবে? আমরা সবাই জানি যে সমাজের প্রতিটি যুক্তিবাদী ব্যক্তিরই নিজস্ব ধর্ম-বিশ্বাস, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মত, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি- এক কথায় নিজস্ব ওয়ার্ল্ড আউটলুক বা বিশ্ববীক্ষা রয়ে গেছে। প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষেরই জীবন, ঈশ্বর, ভাল-মন্দ জ্ঞান, জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পর্কে একটি ‘নিজস্ব’ ধ্যান-ধারণা রয়েছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। এ রকম মত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত বিভিন্নতা নিয়ে- তাও আবার শ্রেণিবিভক্ত-সমাজে কোনো অভিন্ন ‘পাবলিক গুড’ বা জনস্বার্থের দর্শন কী করে ব্যক্ত করা সম্ভব? তার চেয়েও বড় কথা হলো, এ রকম একটি বিভক্ত সমাজে কী করে একটি অভিন্ন সংবিধান বা রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতি প্রণয়ন করা সম্ভব? এ ক্ষেত্রে রাউলস যুক্তি দিচ্ছেন যে, বিভক্তি সত্ত্বেও একটি সামাজিক ঐকমত্যে মেলা সম্ভব, কেননা যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করেন এমন কেউই নিজের সকল মতকে অন্যের ওপরে চাপিয়ে দিতে চাইতে পারেন না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন মতের যৌক্তিক বিরুদ্ধতা বা বিভিন্নতা স্বীকার করে নিতে হবে, তবে সেই বিরুদ্ধতা বা মতভিন্নতা ‘যৌক্তিক দাবি’ হতে হবে।
এর মাধ্যমে রাউলস আশা করছেন যে, ‘The religious, moral and philosophical doctrines that citizens accept will themselves endorse toleration and accept the essentials of a democratic regime.’ ‘পরমত সহিষ্ণুতা’ ছাড়া কোনো উদারনৈতিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে না- এই লিবারেল মত রাউলসের চিন্তার কর্নার-স্টোন। সেজন্যই তিনি চাইছেন যাতে ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে’ সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বস্তরে স্বীকৃতি দিতে। যেমন- ধর্ম-মতবাদের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের মানে হবে ‘reasonable Catholicism, a reasonable interpretation of Islam, a reasonable atheism’ ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। তবে তার পরও সমস্যা থেকে যায় এই ব্যাখ্যায়। যুক্তিসংগতভাবে চিন্তাভাবনা করেন এমন একজন ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী কী করে যুক্তিসংগত চিন্তা করেন এমন অন্য ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিক্য-দর্শনে বিশ্বাসীর আদর্শে আস্থা স্থাপন করবেন? যতই যুক্তিসংগতভাবে পেশ করা হোক না কেন, কোনো বিশেষ ধর্মমত বা আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি করা আইন-আদালত, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে কী করে এক ভিন্ন ধর্মের বা ভিন্ন আদর্শের লোক (যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করেন এমন লোকের কথাই বলছি) মেনে নিতে পারেন বা নেবেন? কোন বিশেষ ধর্ম, মতাদর্শ বা মতবাদ প্রকারান্তরে আসলে একেকটি ভিন্ন ভিন্ন ধ্যান-ধারণার ভুবন বা বিশ্ববীক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এরা সবাই নিজেকে একেকটি ‘Comprehensive doctrine’ বলে দাবি করেন। যা সকলের কাছে ১০০ শতাংশ গ্রহণযোগ্য হবে না কখনোই : ‘No comprehensive doctrine can be accepted by all reasonable citizens, and so no comprehensive doctrine can serve as the basis for the legitimate use of coercive political power.’

রাউলস বলছেন যে, কোনো একটি বিশেষ ধর্মমতের ভিত্তিতে যদি রাষ্ট্রের ন্যায্যতা বা সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, সেটা অন্য ধর্মের বিশ্বাসীরা মানতে না-ও চাইতে পারেন। যদি নাস্তিক্য মতবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, তবে আস্তিক্যবাদীরা তা মানতে না-ও চাইতে পারেন। যদি ফ্যাসিবাদ, স্তালিনবাদ বা মাওবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, তবে বিরুদ্ধ-মতাদর্শের ব্যক্তিরা তা মানতে না-ও চাইতে পারেন। কেননা, ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা বিশেষ নৃতাত্ত্বিক জাতি বা বর্ণ-সম্প্রদায়ের মতবাদ বা আদর্শ এতটাই বিশিষ্ট এবং (comprehensive অর্থে) বিস্তৃত/স্বয়ংসম্পূর্ণ যে, সেখানে অন্য মতের/আদর্শের লোকদের শামিল করানো কঠিন। তাহলে সমাজের সব মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো যাবে কিসের ভিত্তিতে, আর সেই ভিত্তিটাই যে ন্যায্য ভিত্তি হবে তা প্রতিপন্ন করা যাবে কীভাবে?
এর কোনো সহজ উত্তর রাউলস্‌ দিতে পারেননি। তার উত্তর হচ্ছে- রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরি হবে ‘পাবলিক পলিটিক্যাল কালচার’ দ্বারা, যার ভিত্তি নিহিত সমাজের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, প্রতিষ্ঠানাদির ঐতিহ্য, দর্শন, অনুশীলন ইত্যাদি বিচিত্রবিধ উপাদানের চর্চার মধ্যে। যত বিভিন্নই হোক এসব ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক উপাদান দেশে দেশে, কোনো সমাজে পাবলিক কালচার যথাযথ কাজ করছে কিনা তা জানার উপায় হলো ইনসাফ বা ন্যায়বিচার সম্পর্কে সেই দেশে বা সমাজে কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। এই ইনসাফের বোধ- যাকে রাউলস বলেছেন ‘পলিটিক্যল কনসেপশন অব জাস্টিস’- তার তিনটি প্রধান উপাদান :নাগরিকেরা নানা দিক থেকে কতটা স্বাধীন (Free); কতটা সমান (Equal); এবং পরস্পরের প্রতি আচরণে কতটা ন্যায়ানুগ (Fair)। এই ফ্রিডম, ইকুয়ালিটি ও ফেয়ারনেস তিনটি মৌল ধারণার ওপরে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ‘পাবলিক পলিটিক্যাল কালচার’ দাঁড়িয়ে আছে/থাকে।
আসলে রাউলস্‌ যখন তার লিবারেল সোসাইটির প্রকল্প তুলে ধরেছেন, তিনি নাগরিকদের কল্পনা করছেন এক যুক্তিবাদী মনের নিজস্ব ‘ধ্যান-ধারণা-নিরপেক্ষ’ ব্যক্তি হিসেবে। সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে নাগরিকেরা একটি অভিন্ন বিবেচনায় উপনীত হচ্ছেন তাদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস, নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবাদর্শ, নিজস্ব অভিরুচি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বাদ দিয়ে নয়, কিন্তু এসবকে তিনি সচেতনভাবেই আমলে নিচ্ছেন না সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমি কোনো বিশেষ ধর্মের লোক হতে পারি, অথবা কোনো বিশেষ মতাদর্শের সমর্থক হতে পারি, কিন্তু রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি রচনা করতে গিয়ে আমি আমার একান্ত ধর্মবিশ্বাস বা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শকে ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর করতে চাচ্ছি না সচেতনভাবেই। কেননা, আমি যদি তা করি, তাহলে অন্যরাও তাই করবে এবং এর ফলে সমবেতভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো ‘সামাজিক চুক্তি’ বা সংবিধানে পৌঁছানোই যাবে না। এ জন্যেই আমাকে পরমতসহিষ্ণু হতে হচ্ছে, ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে’ আশ্রয় করতে হচ্ছে, নিজের মতবাদকে প্রতিনিধিত্বশীল দাবি করা থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। এ জন্যেই রাউলস্‌ের মতে সামাজিক ন্যায়ের যে ধারণাকে গণতান্ত্রিক সংবিধান তুলে ধরে তা বিশেষ ধর্ম-রাজনৈতিক মতাদর্শ-দল-মত-কেন্দ্রিক নয়, তা বিভিন্ন বিরুদ্ধ মতের মধ্যে কোনো মধ্যপন্থার আপস-মীমাংসাও নয়; পূর্বে-উল্লেখিত ‘স্বাধীনতা’, ‘সমতা’ ও ‘ন্যায্যতা’ সম্পর্কে তা একটি ‘নূ্যনতম অভিন্ন উপলব্ধিকে’ ব্যক্ত করে মাত্র। যাকে রাউলস্‌ বলেছেন বিভিন্ন পরমত-সহিষ্ণু মতের মধ্যে ‘Overlapping consensus” বলে। এবং এটা করতে গিয়ে নাগরিকদের (বা নাগরিকদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের) নিজেদেরকে চিন্তা করতে হয় Reasonable Citizens হিসেবে- দল-মতের ঊর্ধ্বে ওঠা একেকজন Abstract thinker হিসেবে। এ জন্যেই রাউলস্‌ের সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে এভাবে :
‘Rawls’s Political conception of justice is not derived from any comprehensive doctrine, nor is it a compromise among the world views that happen to exist in society at the moment. Rather,  a Political conception of justice is freestanding: its content is set out independently of the comprehensive doctrines that citizens affirm. Reasonable citizens, who want to cooperate with one another  on mutually acceptable terms, will see that a freestanding political conception generated from ideas in the public political culture is the only basis for cooperation that all citizens can reasonably be expected to endorse. The use of coercive political power guided by the principles of a political conception of justice will therefore be legitimate.’

এর মানে এই নয় যে, সামাজিক ন্যায়ের ধারণার মধ্যে স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায্যতা এই তিনটি ভাবের দেশগত-কালগত প্রকাশে সেই জনগোষ্ঠী, ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি প্রভৃতি দেশজ, সামাজিক বা ব্যক্তিগত ফ্যাক্টরের কোনো প্রভাব পড়বে না। রাউলস্‌ সেটা স্বীকার করে নিয়েও বলছেন যে, দেশ-কাল-সমাজের প্রভাব পড়লেও তার চৌহদ্দি নির্ধারিত হবে ওই ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের’ দ্বারাই; কেউ যদি চরমপন্থি কোনো ভাবধারা প্রকাশ করে তাকে কোনোভাবেই আমল দেওয়া হবে না সামাজিক চুক্তি বা সংবিধান নির্মাণের সময়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রস্তুতের কালেও ১৯৭২ সালে এমনি যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে আশ্রয় করা হয়েছিল। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে যেখানে মৌলিক অধিকারগুলো বিধৃত হয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘যুক্তিসংগত’ আবরণের বেড়া দিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে ঐ চরমপন্থা থেকে রক্ষা করার জন্যই। ‘মৌলিক অধিকারের’ ও ‘মৌলিক নীতিমালা’ ব্যক্ত করার সময়ে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী, ধর্মমত, রাজনৈতিক আদর্শ বা অভিরুচিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়েছে কেবলমাত্র ‘প্রস্তাবনা’ অংশে। সংবিধানের ‘প্রথম ভাগে’ যেখানে প্রজাতন্ত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানেই কেবল ‘বাংলাদেশ’ ধারণাটিকে ইতিহাস-ভূগোলের দ্বারা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংবিধানের ‘দ্বিতীয় ভাগের’ ৮ থেকে ২৫ ধারার মধ্যে কেবল ৯নং ধারায় জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাঙালি জাতির’ উল্লেখ রয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ দাবী অতটুকুতেই সীমিত রাখা হয়েছে।
[ক্রমশ]