পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪১

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

এর কোনো কোনোটিতে পুত্র দেবেন্দ্রনাথকেও যুক্ত করেছিলেন দ্বারকানাথ, অর্থাৎ আত্মজীবনীতে এসব ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। তবু সেই স্বাভাবিক সুযোগটি নিতে চাননি দেবেন্দ্রনাথ। বিস্ময়ের কারণ এখানেই শেষ নয়। দেবেন্দ্রনাথ যা-ও বা কিছু উল্লেখ করেছেন পিতার (আপেক্ষিক নীরবতা সত্ত্বেও), কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলির বিপুলায়তন আত্মজৈবনিক অংশে (চিঠিপত্রসহ বলছি) একবারের জন্যে হলেও কোথাও কোনো উল্লেখ নেই দ্বারকানাথের। আমি কি ভুল বললাম, বা বাড়িয়ে বললাম? এই নিস্তব্ধতার কার্যকারণ সূত্র খুঁজে পাওয়া ভার। বা খুঁজে পাওয়া গেলেও- একটা তো প্রচলিত মত আছেই যে, দ্বারকানাথ অজস্র দায়-দেনার ভার ঠাকুরবাড়ির উত্তরাধিকারীদের ওপরে দিয়ে গেছেন- এর যৌক্তিকতার পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাময় বিকাশে যে বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিকতার ছায়া দেখতে পাই, সেই ছায়া বিশালদেহী দ্বারকানাথ ঠাকুরের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অবচেতন মনে তিনি অস্বীকৃত অন্যজন- তার সত্তার ‘অপর’; তার এত কাছের মানুষ হয়েও যিনি সারাজীবন দূরলোকের নক্ষত্রের মতো অজ্ঞেয় ও রহস্যময় থেকে গেলেন। কেনসাল গ্রিনের নির্জন কবরস্থানের নির্জনতম স্থানে তার মরণোত্তর ছাইভস্ম সমাহিত করে রাখা হয়েছে। সেই সমাধির পরিচয়পত্রে দ্বারকানাথের নামোল্লেখ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই, রাবীন্দ্রিক সূত্রের উল্লেখ তো নেই-ই। না কোনো গানের লাইন, বা কোনো কবিতার চরণ উৎকীর্ণ হয়ে রয়েছে দ্বারকানাথের সমাধিতে। তার মধ্যেই সেদিন চোখে পড়েছিল কে বা কারা যেন রেখে গেছে- ততক্ষণে বাসি হয়ে যাওয়া- দুটি নাম-না-জানা ফুল। বিচিত্র এ মানবজীবন ও তার পরিণতি।

৪. কুই ব্রানলি মিউজিয়াম :আফ্রিকা ও পিকাসো

গান্ধীকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আপনার মত কী?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্যাট উড বি এ গুড আইডিয়া।’ পাশ্চাত্যে সভ্যতা আসলে তো ভালোই হয়। আসলে ‘ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনে’র কথাটা এখনও পর্যন্ত কেবল ‘আইডিয়ার’ পর্যায়েই রয়ে গেছে। লুভর মিউজিয়াম দেখার পর কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে এসে এই কথাটাই বারবার মনে এলো। স্বাভাবিকভাবেই ‘মোনালিসার ছবি’ দেখার জন্যে লুভর মিউজিয়ামে পর্যটকদের হুড়াহুড়ি। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সবাইকে- একটা ছবি অতি দ্রুত সেলফিতে তুলেই বা ক্যামেরাবন্দি করেই লাইন ধরে এগিয়ে যেতে হবে পরের জনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্যে। লুভর-এ মোনালিসা ছাড়াও আরও অনেক কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে। বিশেষ করে গ্রিক রোমান আর্টের নিদর্শন ছড়ানো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার কোনো শিল্পকলা লুভর-এর মতো ‘মেইনস্ট্রিম’ মিউজিয়ামে নেই। একসময় ছিল সেগুলো- বেসমেন্টে- ‘মাইনাস-১’ ফ্লোরে। সে নিয়ে সমালোচনা ওঠায় শেষ পর্যন্ত যেসব শিল্পকলা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্যত্র। তার মধ্যে যেগুলো পাশ্চাত্যের চোখে ‘প্রিমিটিভ আর্ট’ রূপে অভিহিত, তাদের এক জায়গায় জড়ো করে তৈরি হয়েছে ‘কুই ব্রানলি’ মিউজিয়াম। প্রেসিডেন্ট জ্যাঁক শিরাকের নামে হয়েছে এই জাদুঘর- তিনি এসব ‘প্রিমিটিভ আর্টের’ সংগ্রাহক ও গুণগ্রাহী ছিলেন এ কথা মনে করে।

লুভর মিউজিয়ামের সামনে পাগল-করা যে ভিড়, তার লেশমাত্র নেই কুই ব্রানলিতে। সুনসান নিস্তব্ধতা সেখানে বিরাজ করছে। টিকিট কাটার সময় বললাম, ‘অনেক আশা নিয়ে এসেছি এখানে। অনেক গল্প শুনেছি এই মিউজিয়াম নিয়ে।’ বিক্রেতা এক ফরাসি তরুণ। হেসে বললেন, ‘আমরা যারা এখানে কাজ করি, তারাও খুব গর্বিত এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরে।’ আসলে এখানে না এলে ‘আধুনিক’ চিত্রকলার জন্মের ইতিহাস আড়ালেই থেকে যেত। পাশ্চাত্যের কিউবিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট এবং সুররিয়ালিস্ট চিত্রকলার সূতিকাগার হলো আফ্রিকা-পলিনেশিয়া-লাতিন আমেরিকার তথাকথিত ‘প্রিমিটিভ’ বা ‘আদিম’ চিত্রকলা। এ জিনিস এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না! বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, আফ্রিকার ‘ট্রাইবাল’ আর্টের কথা। এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পানেননি পিকাসো, মাতিস, ব্রাক, পল ক্লী, মডিলিয়ানি প্রমুখ। প্রকৃতপক্ষে কে নয়? তৃতীয় বিশ্বের ‘প্রিমিটিভ’ ও ‘ট্রাইবাল’ আর্টের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি কাজিমির মালেভিচ, মার্ক শাগাল, সালভাদর ডালি, এর্নস্ট কিরশ্‌নের (kirchner), এমিল নলডে (Nolde), ‘আর্ট ব্রুট’ আন্দোলনের জঁ দুবুফে (Dubuffet), এমনকি ভাসিলি কান্ডিনস্কী ও জোসেফ এলবার্স। এই প্রভাবের গভীরতা এত ব্যাপক, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে- এতসব প্রভাব বিস্তারের পরও আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার লোকশিল্পকে এখনও কেন ‘প্রিমিটিভ’ এবং ‘ট্রাইবাল’ আর্ট বা আর্ট-ফর্ম হিসেবে দেখা হচ্ছে? কেন এসব শিল্পকর্মকে ‘আধুনিক’ শিল্পকলার অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে না?

এর কারণ দার্শনিক ও রাজনৈতিক। পৌলমি সাহা তার ‘এন এমপায়ার অব টাচ্‌’ বইতে যোগ করেন এক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য। ১৯৩১ সালের মে মাসে মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। এই উপলক্ষে গিরীন্দ্রশেখর বোসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান সাইকোএনালাইটেকাল সোসাইটি হাতির দাঁতের করা একটি ৯ ইঞ্চির বিষ্ণুমূর্তি তাকে উপহার দেয়। এর আগে গিরীন্দ্রশেখর এবং ফ্রয়েডের মধ্যে বিশ বছর ধরে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। বিষ্ণুমূর্তিটি পেয়ে ফ্রয়েড গিরীন্দ্রশেখরকে লেখেন :

যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমি এই উপহারটিকে সানন্দে ‘উপভোগ’ করব। এটি আমাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মনঃসমীক্ষণ ছড়িয়ে পড়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে : ‘The statuette is charming. I gave it the place of honor on my desk. As long as I can enjoy life it will recall to my mind the progress of psychoanalysis, the proud conquest it has made in foreign countries and the kind of feelings for me it has aroused in some of my contemporaries at least.’ উদ্ধৃত অংশের মধ্যে উপহার প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতাপূর্ণ স্বীকৃতি আছে। কিন্তু আমার খটকা লেগেছিল ‘ঢ়ৎড়ঁফ পড়হয়ঁবংঃ’ শব্দবন্ধের ব্যবহারে। ফ্রয়েড-গিরিন্দ্রশেখরের পত্রালাপ থেকে এটা নিশ্চিত যে, বিনিময় হচ্ছিল শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে নয়। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণের বিপরীতে গিরীন্দ্রশেখর একটি ভিন্ন ধরনের মনোবীক্ষণের- তথাকথিত ‘ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি’র সম্ভাবনা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণ বিদ্যাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমীক্ষণ বিদ্যা, এটা গিরীন্দ্রশেখর মনে করতেন না। ফ্রয়েড-পরবর্তী মনঃসমীক্ষণ বিদ্যায় গিরীন্দ্রশেখরের যথাযথ স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল। সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী এ নিয়ে বেশকিছু কাল আগে একটি চমকপ্রদ শিরোনামে বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য স্যাভেজ ফ্রয়েড’। সেখানে ট্রাডিশন ও মডার্নিটিকে একই সত্তার মধ্যে বিচরণ করতে দেখা যায়। সত্যজিৎ রায় ট্রাডিশনটি প্রকাশ করেন তার সিনেমার মাধ্যমে; আর মডার্নিটিকে প্রকাশ করেন তার ‘ডিটেকটিভ’ গল্পের মাধ্যমে। কিন্তু ‘সত্তার বিভক্তি’ এখানে আমার আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে আমি শুধু লক্ষ্য করব যে, নন্দী দেখিয়েছেন, কীভাবে ফ্রয়েড পাশ্চাত্যের তথাকথিত মডার্নিটি বা সিভিলাইজেশনকে আক্রমণ করেছেন। মানবিক উদ্বেগ, অবসাদ, কামনা-বাসনা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রকারান্তরে আঘাত করেছেন বিশুদ্ধ যুক্তিবাদী এনলাইটেনমেন্টের ঐতিহ্যকে। ফ্রয়েড কখনও বেকন বা হবসের মতো মানুষকে ‘বৈজ্ঞানিক মানব’ হিসেবে দেখেননি। এ জন্যে তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে পাশ্চাত্যে। নন্দীর কথা হলো, এই একই যুক্তিতে তৃতীয় বিশ্বের বা ভারতবর্ষের ঐতিহ্য-সংলগ্নতা, কোমলচিত্ততা ও যুক্তি-রহিত মরমিবাদকে পাশ্চাত্যের চোখে ঠেকেছে বর্বর বা স্যাভেজ প্রথা বলে। এই একই যুক্তিতে গিরীন্দ্রশেখর ও তার মনোবিদ্যাকেও ‘স্যাভেজ’ বলা হবে। নন্দীর যুক্তি হচ্ছে, পাশ্চাত্যের অতিশয় বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রযুক্তি ও যুক্তির প্রভাব তার মানবিক চরিত্রে নানা উপসর্গের সৃষ্টি করেছে। ফ্রয়েড তার ‘সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ বইয়ে দেখিয়েছেন যে, মনোবিকলন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামাজিক উপসর্গে পরিণত হচ্ছে। প্রাচ্যের বিশ্বাস-নির্ভর ঐতিহ্যকে পাশ্চাত্যের যুক্তি-নির্ভর ঐতিহ্যের একটি সমালোচনা হিসেবে দেখেছেন নন্দী। অর্থাৎ, ‘স্যাভেজ ফ্রয়েড’ এই শিরোনামের মাধ্যমে নন্দী দেখাচ্ছেন যে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতাকেই একমাত্র ‘সভ্যতা’ বলে জ্ঞান করা যায় না। বিশ্বাসের ঐতিহ্যের মধ্যেও ‘সভ্যতা’ আবিস্কৃত হতে পারে। কে সভ্য, আর কে অসভ্য তা ঠিক করার ভার পাশ্চাত্যকে কেউ দেয়নি। উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল আফ্রিকার অধিবাসীদের ‘স্যাভেজ’ বলেছিলেন। তাই যদি হবে, তাহলে আফ্রিকার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট পিকাসোর মতো শিল্পীর আধুনিকতম চিত্রকলাকে প্রভাবিত করে কী করে? বা পলিনেশীয় আর্ট কীভাবে আচ্ছন্ন করে পল গগাঁকে? বা নর্থ আফ্রিকা ও মেডেটেরিয়ান অঞ্চলের সংস্কৃতি কী করে প্রভাব বিস্তার করে সেজান ও মাতিসের ওপরে? বা পল ক্লী-র জ্যামিতির মধ্যে কী করে আমরা খুঁজে পাই সাহারা অঞ্চলের ইন্ট্রিকেট আঁকিবুঁকি? ফ্রয়েড-গিরীন্দ্রশেখরের মনোবিকলন আধো-ঘুমে আধো-জাগরণে কী করে স্থান করে নেয় সুররিয়ালিস্ট চিত্রকর্মে? আন্দ্রে ব্রেতো, ডালি, মেক্সিকোর তামায়ো (Tamayo) বা কিউবার উইলফ্রেডো লাম (Wilfred lam) এরা সবাই ‘প্রিমিটিভ’-এর কাছে ঋণী। সে ক্ষেত্রে প্রিমিটিভই তো আধুনিক চিত্রকর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাই নয় কি?

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪০

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

ইউরোপ যা কিছু করে দেখিয়েছে তাকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, তাকে আমরা উচ্চ মূল্যায়ন করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ভারতবর্ষ যা তৈরি করেছে তাকে আমরা পরিত্যাজ্য বলে ভাবব। আমরা যেমন তোমাদের বিষয়ে করি, সেভাবে তোমরা যদি আমাদের সংগীতকলা নিয়ে পড়াশোনা করতে, তাহলে দেখতে তোমাদের সংগীতে যেমন, আমাদের সংগীতেও সুরের, ছন্দের, তালের কোনো কিছুরই কমতি নেই। আর তোমরা যদি আমাদের কবিতা, আমাদের ধর্ম, আমাদের দর্শন নিয়ে চর্চা করতে তাহলে দেখতে পেতে যে তোমরা যা ভাবছ সেরকম কোনো বর্বর বা তস্কর কোনোটাই আমরা নই। আমরা ততটুকুই জানি, আমাদের কাছে ততটুকুই অজ্ঞেয়, যতটুকু তোমরা জানো বা তোমাদের কাছে যা অজ্ঞেয়। হয়তো অজ্ঞেয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা তোমাদের চেয়ে আরেকটু গভীরতর।’

দ্বারকানাথের মর্মদাহ ম্যাক্সমুলার সম্ভবত শেষ বয়সে কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তা নইলে কথাগুলো এত সবিস্তারে তার স্মৃতিচারণায় তিনি উল্লেখ করার তাড়না অনুভব করবেন কেন? তার স্মৃতিচারণামূলক বইটি প্রকাশ পায় ১৮৯৯ সালে। এর পরের বছরই ম্যাক্সমুলারের মৃত্যু হয়। ততদিনে উপনিবেশের শাসন-শোষণ আরও বর্বরতর হয়েছে আফ্রিকায়, আর সূক্ষ্ণতর হয়েছে এশিয়ায় বা এই উপমহাদেশে। এক কথায়, ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন আরও নির্দয় হয়েছে বিশ্বব্যাপী। উপনিবেশ দখলের ও ভাগবাটোয়ারার লড়াই আরও তীব্র হয়েছে ১৯০০ সালের পরবর্তী পৃথিবীতে। এ সময়েই রবীন্দ্রনাথ লিখবেন ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের প্রফেটিক পঙ্‌ক্তিমালা : ‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে / অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে/ অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিণী/ ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতানাগিনী/ তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে/ গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।’ পদ্মাপাড়ের নির্জন ভুবনে ঢুকে পড়েছে ঔপনিবেশিক রূঢ় বাস্তবতা।

দ্বারকানাথের মুখ দিয়ে যদিও বলানো হচ্ছে কিন্তু কথাগুলো ততদিনে ম্যাক্সমুলারেরও বলার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং সেই কথাগুলো তিনি বলেছেন যুধ্যমান পাশ্চাত্যকে। শুধু নিজের জানাই জানা নয়, অপরের জানাও জানা। আধুনিকতার ঐতিহ্যের প্রতি সবারই অধিকার কি প্রাচ্যের, কি পাশ্চাত্যের। শুধু পাশ্চাত্য জ্ঞানের আহরণ করবে, আর আমরা কেবল তার ক্রমাগত ভোগ করে চিরস্থায়ীভাবে ঋণী থেকে যাব- এরকম অসম-সম্পর্কে দ্বারকানাথের আস্থা ছিল না। পাশ্চাত্যকে অস্বীকার যেমন করব না, তেমনি প্রাচ্যকেও অস্বীকৃতির অপমানে থাকতে দেব না। দ্বারকানাথের ক্ষোভমিশ্রিত তিরস্কার বাণী বহুকাল পর্যন্ত শেল হয়ে বেজেছে ম্যাক্সমুলারের বুকে। তিনি শেষাবধি স্বীকার করেছেন : ‘He was not far wrong’- দ্বারকানাথ সেদিন ১৮৪৪ সালের প্যারিসে বসে তাহলে খুব একটা ভুল বলেননি!

বিত্তবৈভবের মধ্যে দিন কাটালেও দ্বারকানাথের জীবনের শেষ বছরগুলো অর্থনৈতিকভাবে সুখের ছিল না। কিন্তু পতনের দিকটি তিনি যথাসম্ভব আড়ালেই রেখেছিলেন। শুধু ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ নন, ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গেও তার সখ্য হয়েছিল। ১৮৪২ সালে যখন তিনি নিজের জাহাজে করে লন্ডনে যান, ততদিনে ইংল্যান্ডের রানী হয়েছেন তরুণী ভিক্টোরিয়া। ১৮৩৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া রানী হিসেবে অভিষিক্ত হন। ইংল্যান্ডে পা রাখার পরপরই দ্বারকানাথের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হন রানী। ২৩ বছর বয়সী সম্রাজ্ঞীর মনে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আসা বিদেশি দ্বারকানাথকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। রানী তাকে তার ব্যক্তিগত প্রতিকৃতি সম্বলিত মোড়ক উপহার দেন। তবে দুর্ভাগ্য, ১৮৪৫ সালে দ্বারকানাথের ব্যবসায় এক দুর্বিপাক নেমে আসে। ১৮৪৭ সালের স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ের ফলে তার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। এই ১৮৪৫-৪৭ পর্বে বিশ্বজোড়াই মন্দা নেমে এসেছিল। তখনও ‘লিমিটেড কোম্পানি’ আইন প্রবর্তিত হয়নি ইউরোপে বা ভারতবর্ষে। এর ফলে অনেক উদ্যোক্তা, শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী দেউলিয়াত্ব বরণ করেন। হয়তো এই অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রভাবেই দ্বারকানাথ লন্ডনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং ১৮৪৬ সালে তার মৃত্যু হয়। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে দ্বারকানাথ তারা বন্ধু রাজা রামমোহন রায়ের স্মরণে ব্রিস্টল শহরে তার কবরের ওপরে একটি সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। তবে তিনি নিজেও যে ইংল্যান্ডের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন- এ কথা হয়তো কখনও ভাবেননি। আমি যখন ২০১২ সালে লন্ডনের ‘কেনসাল গ্রিন’ কবরস্থানে দ্বারকানাথের সমাধি দেখতে যাই, তখন বারবার এ কথা মনে হয়েছিল আমাদের দেশের আধুনিকতার দুই পথিকৃৎ বিদেশের মাটির নির্জনেই থেকে গেলেন।

দ্বারকানাথ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষে আধুনিক কয়লা খনির ব্যবসা তার হাত দিয়েই শুরু; আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবসায় তিনি সেকালের বাঙালি-ভারতীয়দের মধ্যে অগ্রগণ্য; দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাষ্পচালিত স্টিমার ও আন্তঃমহাদেশীয় জাহাজ খাতেও তার স্থান সবার ওপরে। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তার ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণা। সংগীতে তার অনন্যসাধারণ দখল ছিল। ভারতীয় রাগ-সংগীতের বিষয়ে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এমনও ইঙ্গিত করেছিলেন যে, গণিতের ক্ষেত্রে শূন্যের অবদান যেমন যুগান্তকারী, তেমনি ‘সংগীত-রত্নাকর’-এর মতো ‘ট্রেজারি অব সিম্ম্ফোনি’ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ইতিহাসেই এক অতি বিরল সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের সংগীতকলা হয়তো প্রাচ্যের সংগীতকলার কাছেই ঋণী। দ্বারকানাথের যুক্তি আমতা আমতা করে মেনে নিচ্ছেন বা অনেকটাই স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন জার্মানির এই তরুণ সংস্কৃতজ্ঞ। ম্যাক্সমুলার বলছেন, পাশ্চাত্যকে এ রকম ঋণ স্বীকার করতে হতেই পারে একদিন। সংগীতের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়াটাও আদৌ বিচিত্র নয় : ‘In itself such a borrowing has nothing incredible in it, for we know that our figures, not excluding the naught, traveled on the same road, from the Indian to the Persians, the Arabs, the Spaniards, and the Italians’, এবং এটুকু বলে তার দ্বিধার জায়গাটুকু স্পষ্ট করছেন : “ভারতীয় সংগীতের ‘সা রে গা মা পা ধা নি’- এই সাতটি ‘নোট’ যে কালক্রমে ইতালীয় সংগীতে এসে ‘দো রে মি ফা সল লা সি’ ধারার সাতটি ‘নোটে’ পর্যবসিত হয়েছে, তার জন্য আরও ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ দিতে হবে।” যেন দ্বারকানাথকে খণ্ডন করার জন্যই বলছেন : ‘শূন্যের আবিস্কারের জন্য ওই মহান দেশটির প্রতি গণিতবিদ মাত্রেরই অপার কৃতজ্ঞতা রয়ে গেছে। শূন্যের এই আবিস্কার গণিতশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় আবিস্কারের একটি। পাশ্চাত্যের প্রতি এটা প্রাচ্যের দান, সন্দেহ নেই। তবে বিঠোফেনের সিম্ম্ফোনির পেছনে ভারতীয় [সংগীত-রত্নাকরের] দান রয়েছে কি-না তার উত্তরের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

এই তর্কালাপের সত্য-মিথ্যা, তথ্য বা তত্ত্ব আলোচনা করা আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু কথাগুলো উঠেছে দ্বারকানাথের সঙ্গে ম্যাক্সমুলারের সংগীত নিয়ে বাহাসের সূত্রে, সেটাই আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া। ম্যাক্সমুলার যখন মারা যান, তখন তার কাছে তরুণ রবীন্দ্রনাথ প্রায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তিত্ব। তার স্মৃতিচারণায় রবীন্দ্রনাথের কোনো উল্লেখ নেই। অথচ তার মৃত্যুর ১৩ বছর পরেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবেন। দ্বারকানাথের সংগীত-প্রতিভা তার কনিষ্ঠতম নাতির মধ্যে বহুগুণে লালিত হয়ে বিকশিত হবে। ম্যাক্সমুলারের অবশ্য সেই পরিচয় পাওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু দ্বারকানাথ-ম্যাক্সমুলারের আলাপের অংশবিশেষ শোনার পর রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর উত্থান আর অতটা বিস্ময়কর ঠেকে না আমাদের কাছে।

তবে একটি কথা না বললেই নয়। যে প্রসঙ্গ আগেই তোলা উচিত ছিল সম্ভবত, সেই ‘রুমের ভেতরের বড় হাতিটার’ [বিগ এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম] কথাই বেমালুম ভুলে ছিলাম। দেবেন্দ্রনাথ আত্মজীবনীতে তার বাবা দ্বারকানাথের দুই-তিনবার উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনা থেকে পিতার প্রতি উচ্ছ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় না; তবে নিষ্ঠাবান বড় ছেলের দায়িত্ববোধের একটা ছবি ফুটে ওঠে। এর বেশি কিছু নয়। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। কোন কার্য্যোপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিবার জন্য আমাকেই বাড়ী বাড়ী যাইতে হইত।’ অথবা অন্যত্র বলেছেন, ‘শৈশবকাল অবধি আমার রামমোহন রায়ের সহিত সংশ্রব। আমি তাহার স্কুলে পড়িতাম। তখন আরও ভাল স্কুল ছিল… কিন্তু আমার পিতা রামমোহন রায়ের অনুরোধে আমাকে ঐ স্কুলে দেন।’ এসব বিবরণে কচিৎ-কদাচিৎ দ্বারকানাথের প্রসঙ্গ চলে এলেও তার সঙ্গে সম্পর্কের অতিরিক্ত কোনো ঘটনা, সংলাপ বা মানবিক আদান-প্রদানের মুহূর্ত দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীতে নেই। রামমোহন রায়কে নিয়ে একটি গোটা পরিচ্ছেদ লেখা হয়েছে। তার স্বর্গত দিদিমা অলকা সুন্দরীর সঙ্গে মধুর সম্পর্কের বিবরণী তার আত্মজীবনীর শুরু; তার আধ্যাত্মিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের চমৎকার উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু কোথাও দ্বারকানাথের সশরীরী উপস্থিতি নেই। যেন তার কোনো পারিবারিক জীবন ছিল না, যেন পুরোটাই তিনি ছিলেন ‘বাইরের জগতের মানুষ’।

অথচ বহির্বিশ্ব তাকে কী চোখে দেখত তার সামান্য পরিচয় আমি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা ‘দানবীর’, ‘দয়ার সাগর’ ইত্যাদি অভিধা প্রয়োগ করি হাজী মুহম্মদ মহসীন বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে। কিন্তু অন্য সব গুণের বা অর্জনের কথা বাদ দিলেও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা দানের প্রশ্নে দ্বারকানাথের তুলনা সেকালে (এবং একালেও) খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। দ্বারকানাথ অপব্যয়ী ছিলেন না- উদ্যোক্তা ছিলেন। কিন্তু উদ্যোক্তা হয়েও সামাজিক দায়বদ্ধতা সারাজীবন নীরবেই পালন করে এসেছেন। এ নিয়ে ঢাকঢোল পেটানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। ১৮৪২ সালে দ্বারকানাথের বিলাতযাত্রার সময়ে (যেবার তিনি তরুণী সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন) তার দানশীলতার প্রশংসা করে ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকাটি যা লিখেছিল, তা আমাদের সবার জানা প্রয়োজন। পত্রিকাটি ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থরক্ষা করত এবং ভারতীয়দের প্রতি সাধারণভাবে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ ও প্রচার করত। এহেন ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ যা লিখেছিল, তাতে করে দ্বারকানাথের একটি অনালোচিত দিক ফুটে ওঠে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি আমি তুলে ধরতে চাই :

‘To describe Dwarkanath’s public charities would be to enumerate every charitable institutions in Calcutta… Nor must we forget that he has taken lead in every institution, those to Christian Missionaries perhaps excepted, which has been established with a view to the improvement of the country; that he has been foremost in promoting education, more especially is fostering the Medical College, by the bestowal of prizes on the most successful students. He has not only therefore given largely but wisely.’ শেষের লাইনটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো।

কলকাতার পাবলিক লাইব্রেরি- যা এখন ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ রূপে পরিচিত- প্রতিষ্ঠায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন দ্বারকানাথ। ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের দু’জন ছাত্রকে প্রতি বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষায় পাঠানো ও পড়ানোর সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তিনি বহন করেন। ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটিকে ১৮৩৮ সালের মূল্যে এক লাখ টাকা [দশ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং] দান করেন তিনি; এর কাজ ছিল দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সব অন্ধ-আঁতুড়দের সাহায্য করা।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৩. কলোনিয়াল এনকাউন্টার

প্যারিসে যে-ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে এসেছিলাম তার সঙ্গে কীভাবে যেন জড়িয়ে আছে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম। ১৮৪৪ সালে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে এই প্যারিসেই দেখা হয়েছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের। ম্যাক্সমুলার তখন প্যারিসে অবস্থান করছিলেন ঋজ্ঞ্বেদের পাণ্ডুলিপি ‘প্রস্তুত করার’ কাজে। স্মর্তব্য, ঋজ্ঞ্বেদের কোনো প্রকাশিত লিপি ছিল না এর আগে। যদিও হস্তাক্ষরে লিপিবদ্ধ বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি ছিল লন্ডন, বার্লিন ও প্যারিসে। সেসব থেকে সায়নের টীকা-ভাষ্যসহ একটি গ্রহণযোগ্য প্রকাশনার উদ্যোগ নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরই ‘কনসালট্যান্ট’ হিসেবে নিয়োগ পান ম্যাক্সমুলার- প্রায় বিশ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি পুস্তকাকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ‘দ্য সেক্রেড বুকস্‌ অব দি ইস্ট’ শিরোনামে এই গ্রন্থমালা তারই পরিণতি। এর মধ্যে বেদের চার খণ্ড ও আঠাশটি উপনিষদ বিশেষভাবে ম্যাক্সমুলারের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত। এই কাজেরই সুবাদে তরুণ ম্যাক্সমুলার প্যারিসে গিয়েছিলেন ফরাসি প্রাচ্যবিদ অধ্যাপক বার্নফের (Burnof) বক্তৃতামালা শুনতে। কলেজ দ্য ফ্রান্স (College de France)-এ এই বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন বার্নফ। এই সেই কলেজ দ্য ফ্রান্স, যেখানে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পড়াবেন আলথুসার, ফুকো ও দেরিদা। এখানে শুধু যোগ করি যে, প্রফেসর বার্নফের সঙ্গে দেখা করার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও। এবং বার্নফের সূত্রেই দ্বারকানাথের সঙ্গে পরিচিত হন ম্যাক্সমুলার। এ প্রসঙ্গে ম্যাক্সমুলার লিখেছেন :

“I was then attending Professor Burnouf’s lectures at the college de France, and as the Indian visitor had brought letters of introduction to that great French savant, I too was introduced to the Indian stranger, and soon came to know him well. He was the representative of one of the greatest and richest families in India.”

এই দ্বারকানাথ-ম্যাক্সমুলারের মধ্যকার প্যারিস-সাক্ষাৎকেই আমি বলছি ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’। কথাটা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের একটি লেখা থেকে ধার করা। যেটা তিনি লিখেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদের বিয়োগান্ত প্রেমকাহিনির বিশ্নেষণ করতে গিয়ে। ১৮৪৪ সালের প্রায় সুদীর্ঘ ৫০ বছর পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথ সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তাকে উপনিবেশ শাসনের কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এক ধরনের ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’ ছাড়া অন্য কোনো অভিধায় অভিহিত করার কথা আমার মনে আসেনি। এই সাক্ষাৎকারে বাদ-প্রতিবাদ, যোগ-অভিযোগ, দ্বন্দ্ব-মধুরতা, ঐক্য ও অনৈক্য সব উপাদানকেই শনাক্ত করা যায়। উপরে যেখানে ইংরেজিতে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে এটা স্পষ্ট যে, দেখা হচ্ছে দুই স্বগোত্রীয় বা সতীর্থের মধ্যে নয়; সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে দ্বারকানাথের ‘বিদেশি’ ভাবমূর্তি- ‘দি ইন্ডিয়ান স্ট্রেঞ্জার’ উপাধি। একে বহিরাগত বা আউটসাইডার হিসেবেও অনুবাদ করা চলে। ‘আমারই মতো, কিন্তু আমাদের কেউ নয়’- এটাই হচ্ছে ম্যাক্সমুলারের চোখে দ্বারকানাথের প্রাথমিক পরিচয়। যে-ভারতবর্ষকে নিয়ে ম্যাক্সমুলার আজীবন গবেষণা করেছেন সেই ভারতবর্ষের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধির মধ্যে নিজেরই ‘অপর’ দেখছেন ম্যাক্সমুলার। দ্বারকানাথ তার কাছে একাধারে নিকটজন ও অন্যজন। এই ‘অপরায়নের’ কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, কেননা আমরা একটু পরেই দেখব, বুদ্ধিবৃত্তিতে পণ্ডিতপ্রবর ম্যাক্সমুলারের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই দ্বারকানাথ। এই ‘অপরায়নের’ মূল কারণ আসলে দুই ব্যক্তিসত্তার মধ্যে ‘ঔপনিবেশিক’ শাসক-শাসিতের ব্যবধান।

দ্বারকানাথ ঠাকুর যে কত বিষয়ে গুণান্বিত ছিলেন তা ম্যাক্সমুলারের সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকেও ফুটে ওঠে। তার ব্যবসা-বাণিজ্যে ঈর্ষণীয় সাফল্যের কথা অন্যত্র সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’-এর ২য় খণ্ডে ‘বাঙ্গালী শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণীর ইতিহাস’ প্রবন্ধে আমি দ্বারকানাথ ঠাকুরকে তার আমলের শীর্ষস্থানীয় ‘বুর্জোয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। তার নিয়ন্ত্রণাধীন বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠান, উত্থান ও পতনের কিছু বিশ্নেষণও সেখানে রয়েছে। এর একটি তাৎপর্য যে, রবীন্দ্রনাথকে যারা কেবল ‘জমিদার’ (সেই অর্থে সামন্তবাদী) রবীন্দ্রনাথ হিসেবে দেখতে চান, তারা ভুল করেন। রবীন্দ্রনাথের অভ্যুদয়ের পেছনে দ্বারকানাথের ‘বুর্জোয়া’ সত্তা সক্রিয় পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে। ঠাকুরবাড়ির মডার্নিটিকে বুঝতে গেলে দ্বারকানাথের জীবন ও চিন্তাভাবনাকে আমাদের সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করতে হবে। হয়তো নতুনভাবে তার মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু এখানে আমি দ্বারকানাথের অর্থনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত দিতে বসিনি। যারা উৎসাহী তারা কৃষ্ণ কৃপালিনীর ‘দ্বারকানাথ টেগোর : আ ফরগটেন পাইওনিয়ার’ এই প্রায়-বিস্মৃত বইটি দেখতে পারেন। প্যারিসে বসে ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথকে- তার কাছের কিন্তু দূরভুবনের ‘অপরকে’- কীভাবে দেখছেন তার প্রতিই আমি এখানে কেবল দৃষ্টি দেব।

পরস্পর মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে দু’জনের বয়সটাও আমলে আনা প্রয়োজন। ১৮৪৪ সালে দ্বারকানাথের বয়স ছিল ৫০, আর ম্যাক্সমুলারের ২৩। ফলে আলোচনাটি সমকক্ষ সমবয়সীদের মধ্যে হয়নি। তরুণ ম্যাক্সমুলারকে উপনিবেশের প্রতি পাশ্চাত্যের আচরণ বিষয়ে বেশ কিছু কথা- কিছুটা অনুযোগ, কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই- জানিয়েছেন দ্বারকানাথ। তার নিজের জীবনে ইউরোপকে যেমনভাবে চিনেছিলেন তারই নির্যাস ছিল সেসব তিরস্কারে। এই কথাবার্তার দু’বছরের মাথায় মৃত্যু হবে দ্বারকানাথের। ফলে শুধু কথার কথা নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে দ্বারকানাথের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার ‘সার-সংক্ষেপ’ হিসেবেও একে পড়া চলে।

প্রথমেই ম্যাক্সমুলার যেটা লক্ষ্য করছেন সেটা দ্বারকানাথের বিত্তবৈভব নয়- সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, সংগীত, সমসাময়িক ইউরোপীয় পত্রপত্রিকা ও রাজনীতির ওপরে তার বিস্ময়কর দখল। সংস্কৃতজ্ঞ ম্যাক্সমুলার বলেছেন, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ ছিলেন না ঠিক, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য-সম্ভার সম্পর্কে অপরিচিত ছিলেন না।’ প্যারিসের ইনস্টিটিউট দ্য ফ্রান্স (Institute de France)- যাদের আমন্ত্রণে প্যারিসে যাই এবারে- সেখানকার অধ্যাপক বার্নফ সংস্কৃত ভাগবৎ-পুরাণের একটি চমকপ্রদ ফরাসি অনুবাদ করেছিলেন। সে বইটি বার্নফ দ্বারকানাথকে উপহার দেন। বইটির একদিকে ছিল মূল সংস্কৃত পাঠ, অন্যদিকে ফরাসিতে অনুবাদ। এর ফরাসি পাতার অংশে হাত বুলাতে বুলাতে দ্বারকানাথ বলেছিলেন, ‘আহ্‌, যদি আমি ভাষাটা আরও ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারতাম।’ ম্যাক্সমুলার বলছেন যে সংস্কৃত ভাষা নয়, ‘আরও ভালোভাবে ফরাসি ভাষা জানার জন্য’ কতটা উৎসাহ ছিল তার। ম্যাক্সমুলার আরও লিখেছেন, তিনি প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে ‘স্কলার’ ছিলেন না বা ছিলেন না তার নিজের ধর্ম বা নিজের সাহিত্য যে-ভাষায় লেখা হয়েছে সে-সম্পর্কে মনোযোগী। কিন্তু যেইমাত্র অধ্যাপক বার্নফের থেকে তিনি শুনলেন যে ম্যাক্সমুলার বেদের পাণ্ডুলিপি সংকলন করছেন প্যারিসে বসেই, অমনি তার সব মনোযোগ গিয়ে পড়ল তরুণ গবেষকের প্রতি। প্যারিসে তিনি থাকতেন সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে। সেখানে তাকে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানাতেন দ্বারকানাথ। ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে ভারতবর্ষ সম্পর্কে, এর আচার-প্রথা সম্পর্কে গল্প করতেন তিনি। এতে ম্যাক্সমুলারেরও লাভ হতো। স্বয়ং ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপের সভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। সেই সভায় আমন্ত্রিত সব অতিথিকে রাজকীয় শাল উপহার দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। পরাধীন ভারতবর্ষের মান-সম্মান রাখার জন্যই তিনি এটা করেছিলেন। মাসে ২০০ পাউন্ডের বেতন নিয়ে কাজ করা ম্যাক্সমুলারের কাছে (যে-বেতনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীও কাজ করত না তখন) দ্বারকানাথের বৈভবপূর্ণ সাহচর্য নিশ্চয়ই অভাবনীয় ছিল। কিন্তু বিত্তবৈভব নয়, দ্বারকানাথের অন্যবিধ গুণের পর্যালোচনাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ম্যাক্সমুলারের স্মৃতিচারণায়। তবু দ্বারকানাথের অভিজাত শ্রেণিতে পদচারণার একটি উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ম্যাক্সমুলার লিখছেন :

‘Darkanath Tagore lived in a truly magnificent Oriental style while at Paris. The king, Louis Philippe, received him, nay, he honoured him, if I remember right, by his presence and that of his Court at a grand evening party. The room was hung with Indian shawls, then the height of ambition of every French lady. And what was their delight when the Indian Prince placed a shawl on the shoulders of each lady as she left the room!

দু’জনার মধ্যে আলোচনা ভালোই চলছিল ভারতীয় সাহিত্য, ধর্ম, কৃষ্টি ও সভ্যতা নিয়ে। গোল বাধল সংগীতের ক্ষেত্রে। দ্বারকানাথ পাশ্চাত্য কবিতা ও সংগীতের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। বিশেষ করে ইতালীয় ও ফরাসি সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছিল তার। ম্যাক্সমুলার লিখেছেন, ‘আমি পিয়ানো বাজাতাম, আর তিনি গান শোনাতেন। আমি দেখলাম, তার শুধু ভালো গানের গলা আছে তা-ই নয়, এ বিষয়ে তিনি খুব প্রশিক্ষিতও। গানের বিষয়ে আমাদের সম্পর্কটা খুব জমে উঠেছিল। একবার তার ইতালীয় গানের অনুরুক্তি নিয়ে প্রশংসা করার পর আমি তাকে অনুরোধ করলাম একটা খাঁটি ভারতীয় সংগীত শোনাতে। তিনি যেটা গাইলেন সেটা আসলে ভারতীয় নয়, ফার্সি একটি গান, যার মধ্যে না আছে স্টাইল, না আছে কোনো চরিত্র।’ সম্ভবত তাকে কোনো রাগপ্রধান উত্তর ভারতীয় (হিন্দুস্তানি) সংগীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তরুণ ম্যাক্সমুলার তাতে নিরস্ত হবার নন। “আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, অন্য কোনো ‘প্রকৃত’ ভারতীয় সংগীত তিনি জানেন কিনা। উত্তরে তিনি হাসলেন এবং পাশ কাটানোর মতো বললেন, ‘ও তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না।’ আমি তারপরও অনুরোধ করতে থাকলে তিনি পিয়ানোতে গিয়ে বসলেন, কিছুক্ষণ গুনগুন করার পর বাজাতে শুরু করলেন এবং গান করতে লাগলেন। সত্যি বলতে কি, আমি সেদিন কিছুটা হোঁচটই খেয়েছিলাম। যা শুনলাম তাতে আমি না- পেলাম কোনো সুর, না-কোনো তাল, না-কোনো ছন্দ। সে কথা তাকে বলাতে তিনি বারবার অস্বীকারমূলক মাথা নাড়তে লাগলেন।” প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার অনৈক্যের মূল কোথায় তা জানার জন্য ম্যাক্সমুলারকে দ্বারকানাথ ঠাকুর সেদিন যা বলেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। দ্বারকানাথ তরুণ সংস্কৃতজ্ঞ ও প্রাচ্যবিদ ম্যাক্সমুলারকে যা বলেছিলেন তা এডওয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইতে উদ্ধৃত হতে পারত। দ্বারকানাথের বক্তব্য ম্যাক্সমুলারের বয়ানেই শোনা যাক এবারে :

‘তোমরা সবাই একই রকম। কোনো কিছু ঠেকলে বা সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের প্রীত না করলে, তোমরা মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নাও। আমি যখন প্রথম ইতালীয় সংগীত শুনি, আমার কাছে সেটা কোনো সংগীত বলেই মনে হয়নি। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, চেষ্টা করে গেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা আমার ভালো লাগছে বা তোমরা যাকে বলো সমজদার হওয়া সেভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। এই যেটা বললাম সেটা অন্য সব কিছুর জন্যও খাটে। তোমরা বলো যে আমাদের ধর্ম কোনো ধর্মই নয়, আমাদের কবিতা কোনো কবিতাই নয়, আমাদের দর্শন কোনো দর্শনই নয়।

[ক্রমশ]