পর্ব ::৪১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এর কোনো কোনোটিতে পুত্র দেবেন্দ্রনাথকেও যুক্ত করেছিলেন দ্বারকানাথ, অর্থাৎ আত্মজীবনীতে এসব ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। তবু সেই স্বাভাবিক সুযোগটি নিতে চাননি দেবেন্দ্রনাথ। বিস্ময়ের কারণ এখানেই শেষ নয়। দেবেন্দ্রনাথ যা-ও বা কিছু উল্লেখ করেছেন পিতার (আপেক্ষিক নীরবতা সত্ত্বেও), কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলির বিপুলায়তন আত্মজৈবনিক অংশে (চিঠিপত্রসহ বলছি) একবারের জন্যে হলেও কোথাও কোনো উল্লেখ নেই দ্বারকানাথের। আমি কি ভুল বললাম, বা বাড়িয়ে বললাম? এই নিস্তব্ধতার কার্যকারণ সূত্র খুঁজে পাওয়া ভার। বা খুঁজে পাওয়া গেলেও- একটা তো প্রচলিত মত আছেই যে, দ্বারকানাথ অজস্র দায়-দেনার ভার ঠাকুরবাড়ির উত্তরাধিকারীদের ওপরে দিয়ে গেছেন- এর যৌক্তিকতার পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাময় বিকাশে যে বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিকতার ছায়া দেখতে পাই, সেই ছায়া বিশালদেহী দ্বারকানাথ ঠাকুরের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অবচেতন মনে তিনি অস্বীকৃত অন্যজন- তার সত্তার ‘অপর’; তার এত কাছের মানুষ হয়েও যিনি সারাজীবন দূরলোকের নক্ষত্রের মতো অজ্ঞেয় ও রহস্যময় থেকে গেলেন। কেনসাল গ্রিনের নির্জন কবরস্থানের নির্জনতম স্থানে তার মরণোত্তর ছাইভস্ম সমাহিত করে রাখা হয়েছে। সেই সমাধির পরিচয়পত্রে দ্বারকানাথের নামোল্লেখ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই, রাবীন্দ্রিক সূত্রের উল্লেখ তো নেই-ই। না কোনো গানের লাইন, বা কোনো কবিতার চরণ উৎকীর্ণ হয়ে রয়েছে দ্বারকানাথের সমাধিতে। তার মধ্যেই সেদিন চোখে পড়েছিল কে বা কারা যেন রেখে গেছে- ততক্ষণে বাসি হয়ে যাওয়া- দুটি নাম-না-জানা ফুল। বিচিত্র এ মানবজীবন ও তার পরিণতি।
৪. কুই ব্রানলি মিউজিয়াম :আফ্রিকা ও পিকাসো
গান্ধীকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আপনার মত কী?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্যাট উড বি এ গুড আইডিয়া।’ পাশ্চাত্যে সভ্যতা আসলে তো ভালোই হয়। আসলে ‘ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনে’র কথাটা এখনও পর্যন্ত কেবল ‘আইডিয়ার’ পর্যায়েই রয়ে গেছে। লুভর মিউজিয়াম দেখার পর কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে এসে এই কথাটাই বারবার মনে এলো। স্বাভাবিকভাবেই ‘মোনালিসার ছবি’ দেখার জন্যে লুভর মিউজিয়ামে পর্যটকদের হুড়াহুড়ি। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সবাইকে- একটা ছবি অতি দ্রুত সেলফিতে তুলেই বা ক্যামেরাবন্দি করেই লাইন ধরে এগিয়ে যেতে হবে পরের জনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্যে। লুভর-এ মোনালিসা ছাড়াও আরও অনেক কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে। বিশেষ করে গ্রিক রোমান আর্টের নিদর্শন ছড়ানো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার কোনো শিল্পকলা লুভর-এর মতো ‘মেইনস্ট্রিম’ মিউজিয়ামে নেই। একসময় ছিল সেগুলো- বেসমেন্টে- ‘মাইনাস-১’ ফ্লোরে। সে নিয়ে সমালোচনা ওঠায় শেষ পর্যন্ত যেসব শিল্পকলা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্যত্র। তার মধ্যে যেগুলো পাশ্চাত্যের চোখে ‘প্রিমিটিভ আর্ট’ রূপে অভিহিত, তাদের এক জায়গায় জড়ো করে তৈরি হয়েছে ‘কুই ব্রানলি’ মিউজিয়াম। প্রেসিডেন্ট জ্যাঁক শিরাকের নামে হয়েছে এই জাদুঘর- তিনি এসব ‘প্রিমিটিভ আর্টের’ সংগ্রাহক ও গুণগ্রাহী ছিলেন এ কথা মনে করে।
লুভর মিউজিয়ামের সামনে পাগল-করা যে ভিড়, তার লেশমাত্র নেই কুই ব্রানলিতে। সুনসান নিস্তব্ধতা সেখানে বিরাজ করছে। টিকিট কাটার সময় বললাম, ‘অনেক আশা নিয়ে এসেছি এখানে। অনেক গল্প শুনেছি এই মিউজিয়াম নিয়ে।’ বিক্রেতা এক ফরাসি তরুণ। হেসে বললেন, ‘আমরা যারা এখানে কাজ করি, তারাও খুব গর্বিত এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরে।’ আসলে এখানে না এলে ‘আধুনিক’ চিত্রকলার জন্মের ইতিহাস আড়ালেই থেকে যেত। পাশ্চাত্যের কিউবিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট এবং সুররিয়ালিস্ট চিত্রকলার সূতিকাগার হলো আফ্রিকা-পলিনেশিয়া-লাতিন আমেরিকার তথাকথিত ‘প্রিমিটিভ’ বা ‘আদিম’ চিত্রকলা। এ জিনিস এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না! বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, আফ্রিকার ‘ট্রাইবাল’ আর্টের কথা। এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পানেননি পিকাসো, মাতিস, ব্রাক, পল ক্লী, মডিলিয়ানি প্রমুখ। প্রকৃতপক্ষে কে নয়? তৃতীয় বিশ্বের ‘প্রিমিটিভ’ ও ‘ট্রাইবাল’ আর্টের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি কাজিমির মালেভিচ, মার্ক শাগাল, সালভাদর ডালি, এর্নস্ট কিরশ্নের (kirchner), এমিল নলডে (Nolde), ‘আর্ট ব্রুট’ আন্দোলনের জঁ দুবুফে (Dubuffet), এমনকি ভাসিলি কান্ডিনস্কী ও জোসেফ এলবার্স। এই প্রভাবের গভীরতা এত ব্যাপক, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে- এতসব প্রভাব বিস্তারের পরও আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার লোকশিল্পকে এখনও কেন ‘প্রিমিটিভ’ এবং ‘ট্রাইবাল’ আর্ট বা আর্ট-ফর্ম হিসেবে দেখা হচ্ছে? কেন এসব শিল্পকর্মকে ‘আধুনিক’ শিল্পকলার অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে না?
এর কারণ দার্শনিক ও রাজনৈতিক। পৌলমি সাহা তার ‘এন এমপায়ার অব টাচ্’ বইতে যোগ করেন এক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য। ১৯৩১ সালের মে মাসে মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। এই উপলক্ষে গিরীন্দ্রশেখর বোসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান সাইকোএনালাইটেকাল সোসাইটি হাতির দাঁতের করা একটি ৯ ইঞ্চির বিষ্ণুমূর্তি তাকে উপহার দেয়। এর আগে গিরীন্দ্রশেখর এবং ফ্রয়েডের মধ্যে বিশ বছর ধরে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। বিষ্ণুমূর্তিটি পেয়ে ফ্রয়েড গিরীন্দ্রশেখরকে লেখেন :
যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমি এই উপহারটিকে সানন্দে ‘উপভোগ’ করব। এটি আমাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মনঃসমীক্ষণ ছড়িয়ে পড়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে : ‘The statuette is charming. I gave it the place of honor on my desk. As long as I can enjoy life it will recall to my mind the progress of psychoanalysis, the proud conquest it has made in foreign countries and the kind of feelings for me it has aroused in some of my contemporaries at least.’ উদ্ধৃত অংশের মধ্যে উপহার প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতাপূর্ণ স্বীকৃতি আছে। কিন্তু আমার খটকা লেগেছিল ‘ঢ়ৎড়ঁফ পড়হয়ঁবংঃ’ শব্দবন্ধের ব্যবহারে। ফ্রয়েড-গিরিন্দ্রশেখরের পত্রালাপ থেকে এটা নিশ্চিত যে, বিনিময় হচ্ছিল শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে নয়। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণের বিপরীতে গিরীন্দ্রশেখর একটি ভিন্ন ধরনের মনোবীক্ষণের- তথাকথিত ‘ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি’র সম্ভাবনা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণ বিদ্যাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমীক্ষণ বিদ্যা, এটা গিরীন্দ্রশেখর মনে করতেন না। ফ্রয়েড-পরবর্তী মনঃসমীক্ষণ বিদ্যায় গিরীন্দ্রশেখরের যথাযথ স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল। সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী এ নিয়ে বেশকিছু কাল আগে একটি চমকপ্রদ শিরোনামে বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য স্যাভেজ ফ্রয়েড’। সেখানে ট্রাডিশন ও মডার্নিটিকে একই সত্তার মধ্যে বিচরণ করতে দেখা যায়। সত্যজিৎ রায় ট্রাডিশনটি প্রকাশ করেন তার সিনেমার মাধ্যমে; আর মডার্নিটিকে প্রকাশ করেন তার ‘ডিটেকটিভ’ গল্পের মাধ্যমে। কিন্তু ‘সত্তার বিভক্তি’ এখানে আমার আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে আমি শুধু লক্ষ্য করব যে, নন্দী দেখিয়েছেন, কীভাবে ফ্রয়েড পাশ্চাত্যের তথাকথিত মডার্নিটি বা সিভিলাইজেশনকে আক্রমণ করেছেন। মানবিক উদ্বেগ, অবসাদ, কামনা-বাসনা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রকারান্তরে আঘাত করেছেন বিশুদ্ধ যুক্তিবাদী এনলাইটেনমেন্টের ঐতিহ্যকে। ফ্রয়েড কখনও বেকন বা হবসের মতো মানুষকে ‘বৈজ্ঞানিক মানব’ হিসেবে দেখেননি। এ জন্যে তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে পাশ্চাত্যে। নন্দীর কথা হলো, এই একই যুক্তিতে তৃতীয় বিশ্বের বা ভারতবর্ষের ঐতিহ্য-সংলগ্নতা, কোমলচিত্ততা ও যুক্তি-রহিত মরমিবাদকে পাশ্চাত্যের চোখে ঠেকেছে বর্বর বা স্যাভেজ প্রথা বলে। এই একই যুক্তিতে গিরীন্দ্রশেখর ও তার মনোবিদ্যাকেও ‘স্যাভেজ’ বলা হবে। নন্দীর যুক্তি হচ্ছে, পাশ্চাত্যের অতিশয় বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রযুক্তি ও যুক্তির প্রভাব তার মানবিক চরিত্রে নানা উপসর্গের সৃষ্টি করেছে। ফ্রয়েড তার ‘সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ বইয়ে দেখিয়েছেন যে, মনোবিকলন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামাজিক উপসর্গে পরিণত হচ্ছে। প্রাচ্যের বিশ্বাস-নির্ভর ঐতিহ্যকে পাশ্চাত্যের যুক্তি-নির্ভর ঐতিহ্যের একটি সমালোচনা হিসেবে দেখেছেন নন্দী। অর্থাৎ, ‘স্যাভেজ ফ্রয়েড’ এই শিরোনামের মাধ্যমে নন্দী দেখাচ্ছেন যে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতাকেই একমাত্র ‘সভ্যতা’ বলে জ্ঞান করা যায় না। বিশ্বাসের ঐতিহ্যের মধ্যেও ‘সভ্যতা’ আবিস্কৃত হতে পারে। কে সভ্য, আর কে অসভ্য তা ঠিক করার ভার পাশ্চাত্যকে কেউ দেয়নি। উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল আফ্রিকার অধিবাসীদের ‘স্যাভেজ’ বলেছিলেন। তাই যদি হবে, তাহলে আফ্রিকার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট পিকাসোর মতো শিল্পীর আধুনিকতম চিত্রকলাকে প্রভাবিত করে কী করে? বা পলিনেশীয় আর্ট কীভাবে আচ্ছন্ন করে পল গগাঁকে? বা নর্থ আফ্রিকা ও মেডেটেরিয়ান অঞ্চলের সংস্কৃতি কী করে প্রভাব বিস্তার করে সেজান ও মাতিসের ওপরে? বা পল ক্লী-র জ্যামিতির মধ্যে কী করে আমরা খুঁজে পাই সাহারা অঞ্চলের ইন্ট্রিকেট আঁকিবুঁকি? ফ্রয়েড-গিরীন্দ্রশেখরের মনোবিকলন আধো-ঘুমে আধো-জাগরণে কী করে স্থান করে নেয় সুররিয়ালিস্ট চিত্রকর্মে? আন্দ্রে ব্রেতো, ডালি, মেক্সিকোর তামায়ো (Tamayo) বা কিউবার উইলফ্রেডো লাম (Wilfred lam) এরা সবাই ‘প্রিমিটিভ’-এর কাছে ঋণী। সে ক্ষেত্রে প্রিমিটিভই তো আধুনিক চিত্রকর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাই নয় কি?
[ক্রমশ]