বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

ধারাবাহিক

পর্ব ::৭০

পূর্বে প্রকাশিতের পর
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অভিজ্ঞতা জনচৈতন্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। যার প্রতিফলন এসে পড়েছিল রাজনৈতিক মতাদর্শেও। এরই যৌক্তিক আদর্শিক পরিণতি ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সেক্যুলারিজম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন আহমদ রফিক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন মতিন আহমদ চৌধুরী। এর প্রায় প্রতিটি সংখ্যা আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। ‘কনটেন্ট-এনালাইসিস’ করে দেখা যায় যে নিয়মিতভাবে তাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট সংখ্যায় অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক এক দিন আগে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ ছাপা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল :’বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়িকতা বা ‘সেক্যুলারিজমের’ মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি। … গণতন্ত্র অর্থই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। যেখানে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সেখানে গণতন্ত্র কোনো দিন কার্যকরী হতে পারে না। আজ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলে অসাম্প্রদায়িকতা বা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতিটি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যারা আছেন তাদের মধ্যে এ প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবাই বন্ধু। আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখের সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।’
এই একত্র-বোধের চেতনা জন্ম ত্বরান্বিত হয়েছে ১৯৭১ সালের সামষ্টিক প্রতিরোধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘জয় বাংলার’ ১৫ অক্টোবর সংখ্যায়। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও নতুন বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পরস্পর-সম্পর্কিত করে দেখা হয়েছিল :
‘মাত্র চব্বিশ বছর আগে সাম্প্রদায়িক জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে কাতারবন্দি হয়েছে। শুধু মাঠে ময়দানে স্ল্নোগান দেয়া নয়, একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতিয়ার হাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে হত্যা করছে, প্রাণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ, বাঙালি জাতি হিসেবে প্রাণ নেয়া ও দেয়ার মিলিত রক্তধারায় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে, এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা অনন্য। সাম্প্রদায়িকতাবাদের কবর রচনায় ইতিহাসের এই অনন্য অধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। … অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও শুধু বাঙালী জাতীয়তাবাদের এই অভ্যুদয়কে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক অগ্রগতি হিসেবে স্বাগত জানাতে হয়।’
দেখা যাচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘গণতন্ত্র’ অংশটিতে মূল্যবান সংযোজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের ধারায় এটি ছিল একটি মৌলিক অর্জন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘সমাজতন্ত্র’ অংশটিতেও মৌলিক উপলব্ধি এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই উচ্চারিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি। ১১ মে ১৯৭১-এর ‘জয় বাংলার’ প্রথম সংখ্যায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে লেখা :’স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী, সমৃদ্ধ সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’
১৯ মে ১৯৭১-র ‘জয় বাংলার’ দ্বিতীয় সংখ্যায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বললেন যে, ‘নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল তার প্রতিটি তারা পালন করবে। তিনি জানান যে, তার সরকার ভূমিহীনকে ভূমিদান, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বড় বড় শিল্প জাতীয়করণ করে দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’ আবারও দেখা যাচ্ছে ১৯৭২ সালের আগেই মুক্তিসংগ্রামের মধ্যেও ভূমিবণ্টন, জাতীয়করণ ও সমাজতন্ত্রের কথা এসেছে।
‘জয় বাংলার’ ২ জুন ১৯৭১ সংখ্যা থেকে একটি ধারাবাহিক শুরু করা হয়। যার নাম ছিল- ‘আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর কয়েকটি দিক’। ৯ জুলাই পর্যন্ত তা চলতে থাকে। এতে আরেকবার দলের অর্থনৈতিক নীতিমালা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দলের প্রধান মুখপত্রটিতে আবারও বলা হয় সমতামুখীন সমাজের প্রতি আওয়ামী লীগ ও মুজিবনগর সরকারের অব্যাহত কমিটমেন্টের কথা :’শোষণমুক্ত একটা ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই এই অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প- যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথ বণ্টনের বিধান থাকবে।’
এই কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন ২৩ নভেম্বর। বিজয়ের প্রায় এক মাস আগের এই ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে :’আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে সকলের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।’
এই সমাজতন্ত্র ছিল ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে’ সমাজতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা- যেটি আওয়ামী লীগের ঘোষণা ও কর্মসূচিতে ইতিপূর্বে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই সমাজতন্ত্রের উদ্ভবস্থল বাংলাদেশেই। এটি এমনকি সংগ্রাম চলাকালীন অন্যান্য দলের নেতারাও অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়’, এবং যোগ করেছিলেন যে, ‘এ বিপ্লব বাইরের কোনো দেশ থেকে আমদানি করা হয়নি, কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে তো নয়ই।’ তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে, ‘বাংলাদেশের এ বিপ্লবের গুরুত্ব কোনো অংশেই চীন ও রাশিয়ার বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষের সর্বাত্মক বিপ্লব।’ সবাই এই ব্যাখ্যার সাথে একমত ছিলেন তা অবশ্য নয়। পার্থক্যটা ছিল সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তার মাত্রায় ও গভীরতায়। ১৮ নভেম্বর সল্টলেকে শরণার্থীদের এক জনসভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মীজানুর রহমান চৌধুরী যেমন বিকল্প ফর্মুলেশন হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র না বলে একে অভিহিত করেছিল ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ রূপে। কিন্তু পার্থক্যটা ছিল প্রবণতায় ও ঝোঁকে। কেউ ‘গণতান্ত্রিক’ উপাদানের ওপরে বেশি করে জোর দিয়েছিলেন (যেমন, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি), আবার কেউ দৃষ্টি দিচ্ছিলেন এর ‘সমাজতান্ত্রিক’ উপাদানের প্রতি। কিন্তু দুটো উপাদানই অর্থনৈতিক মতাদর্শে থাকতে হবে যা নিয়ে নেতৃত্বের মধ্যে কোনো সংশয় বা বিতর্ক ছিল না। সেদিন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালেই তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ‘আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর’ আলোকে ‘আমরা ইতিমধ্যেই মুক্ত এলাকায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ কায়েমের কাজ শুরু করে দিয়েছি।’ এ বিষয়ে প্রায়-সর্বস্তরে ব্যাপক ঐকমত্য বিরাজ করছিল এটা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাও একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক উদারমনা ব্যবস্থা কামনা করতেন। একজন গেরিলা নেতা আবদুল মান্নানের উদ্ৃব্দতি দিয়েছিল ‘নিউজ উইকের’ ২২ নভেম্বর সংখ্যায়। রচনাটির শিরোনাম ছিল- ‘বাংলা :প্রতিশোধের মুহূর্ত’। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মান্নান বলছেন : ‘আমরা জয়ী হলে সত্যিকারের গণতন্ত্রই আমরা লাভ করব। অন্যান্য উন্নতিশীল রাষ্ট্রের মতো স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরও সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থাকবে, কিন্তু সাম্যবাদী নয়। আমরা একটি নতুন জাতি, বাংলাদেশের জন্যই এ লড়াই করছি।’ প্রথাগত সোভিয়েত বা চীনের সমাজতন্ত্রের মডেলের চেয়ে আলাদা করে ভাবার চেষ্টাটা এখানে লক্ষণীয়। এক কথায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র-এর সমাজবাদ নিয়ে বিভিন্নমুখী ঝোঁক বা উপলব্ধি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এবং সাধারণভাবে মুক্তিযোদ্ধা জনগণের মধ্যে বিরাজ করছিল। কিন্তু তার মধ্যে সমতাবাদী আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে ‘নূ্যনতম ঐক্যের’ জায়গাটিতে কখনও ফাটল ধরেনি, আর সেটি হচ্ছে এক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমতামুখীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এর দু’দিন আগেই বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে ভারত ও ভুটানের পক্ষ থেকে। বিজয় তখনও অর্জিত হয়নি। এই প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের পটভূমিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করলেন : ‘নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ শান্তিপূর্ণ অবস্থান, জোটনিরপেক্ষতা এবং সকল প্রকার ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী জীবন গঠনে অভিলাষী।’
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তখন ঢাকার দ্বারপ্রান্তে। বিজয় সমাগত- রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন এটা জেনে গেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে একটি দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের বহু প্রতীক্ষিত অভ্যুদয়, কিন্তু তাজউদ্দীনের মনে বিষাদের ছায়া। কেননা, মুজিব তখনও কারাগারের নির্জন সেলে বন্দি। তার ওপর থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের ঝুঁকি চলে যায়নি। অপ্রকৃতিস্থ ইয়াহিয়া কী করে বসেন তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। এই বিষাদের মধ্যেও তাজউদ্দীন নবজাত রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা আবারও স্মরণ করতে ভুললেন না। এই নতুন রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত থাকলেও চার আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সেদিনের নেতৃত্ব ছিলেন বদ্ধপরিকর। পুরো উদ্ধৃতিটি নেহরুর Tryst with Destiny বক্তৃতার চেয়ে (যেটি ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত্রিতে দেওয়া হয়েছিল) কোনো অংশে কম তাৎপর্যপূর্ণ নয় :’বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু ম্লান হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায়। বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হলো, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক, শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দি হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে, যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক; যে রূপকাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে যোগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।’
এ কথা বলে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর এতদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শকে দুটি বাক্যে তুলে ধরলেন :’আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট-নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরোধিতা করা। আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।’
বঙ্গবন্ধু কারামুক্তির জন্য আরও কিছু সময় প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার মধ্যে অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসবেন ১০ই জানুয়ারি। ঘোষিত হবে তার চার মূলনীতি- যাকে তিনি অন্যত্র ‘চার দফা’ বলেছেন : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার আদর্শের ওপরে তিনি নির্দেশ দেবেন যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরি করার জন্য। এবং মাত্র ৮ মাসের মধ্যে খসড়া প্রস্তুত হয়ে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লিতে তার উপরে বিশদ আলোচনা এবং উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের পর গৃহীত হবে সেটি। প্রচুর শ্রম, অনেক ভাবনাচিন্তা, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা বিবেচনা, অপ্রত্যাশিত ও প্রত্যাশিত উৎস থেকে অনুপ্রাণিত তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি, অনুশীলন ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হবে এই অনন্য দলিলে। বাঙালির সাম্যচিন্তার ক্ষেত্রে এই সংবিধান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে রয়েছে আজ অব্দি। আমরা এখন সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

জনগণের কাছে দীর্ঘকাল ধরে করা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির জন্য অর্থনীতিবিদেরা কেন জবাবদিহি করবেন? এবং তাও সময় সময় রাজনীতিবিদদের সমর্থন ছাড়া? এ রকম ধারা চলতে থাকলে ইতিহাসকে বিস্মৃতির গর্ভে ঠেলে দেওয়া হবে। হয়তো এমন সময় এক দিন আসবে যে, অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে আওয়ামী লীগ যে একদা এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখেছিল ‘স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা’ কায়েম করার কথা, সেটিকে কেউ বাহাত্তর-পরবর্তী Invention বা কষ্টকল্পনা বলে চালিয়ে দিতে পারে। অবমূল্যায়িত করা হতে পারে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সমাজ প্রতিষ্ঠা করার চূড়ান্ত লক্ষ্যকে। চাই কি, এর জন্য রাজনৈতিক Scapegoat খোঁজাটাও বিচিত্র নয়।
আমি হয়তো কথাটা এখানে বাড়িয়ে বললাম। জাতীয়করণের দাবি পঞ্চাশের দশক থেকেই জানানো হচ্ছিল- বিশেষত পাটশিল্প ও পাট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। ষাটের দশকে এসে জাতীয়করণের চিন্তাটি আরও মূর্ত ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করে যখন এর প্রয়োগের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা হয় ‘মূল, ভারী ও বৃহৎ শিল্পের’ ক্ষেত্রে (তা সে বাঙালি বা অবাঙালি যার অধীনেই থাকুক না কেন)। আজকের পরিভাষায় যাকে বলে MSME- ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে এর আওতা থেকে মুক্ত রাখা হয়। এই ইতিহাসকে না জানলে বা অস্বীকার করলে মনে হতেই পারে যে, জাতীয়করণের শব্দটি হচ্ছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের পদক্ষেপ মাত্র। কেবল একটি After-Thought : অবাঙালী বৃহৎ শিল্প মালিকেরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন (আর বাঙালি বৃহৎ শিল্প মালিকেরা কেউ কেউ ‘দালালি করেছেন’), সেজন্যেই বুঝি বাধ্য হয়ে Nationalise করতে হয়েছে বাহাত্তরের সরকারকে। এরকম ভাবার পেছনে কোনো যুক্তি নেই যদি আওয়ামী লীগের দলিলপত্রে জাতীয়করণের আইডিয়ার বিকাশকে দালিলিকভাবে অনুসরণ করি। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
‘১৯৭২ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু প্রথম যে কাজটি করলেন তা হলো [বৃহৎ] শিল্পের জাতীয়করণ। কারণ, এটা তার এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতিশ্রুতির অংশ ছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং ১৯৬৯ সালের এগারো দফার সময় থেকেই এই প্রতিশ্রুতি ছিল। ষাটের দশকজুড়ে তাঁর দলের এবং দেশের অন্যান্য অংশের বিবৃতি ও ঘোষণায় অসংখ্যবার বলা হয়েছিল যে, ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি কিছু পরিবারের হাতে থাকবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করা দরকার, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন অথবা বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অন্যান্য বিশ্নেষণ বা সুপারিশের আগেই শিল্পের জাতীয়করণ করা হয়েছিল। যদিও জনমনে এমন এক ধরনের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, জাতীয়করণের নীতি নেওয়া হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী। ১৯৭২-৭৫ এবং পরবর্তীকালে প্রায়ই আমি এ রকম একটি ভুল ধারণা মানুষকে সাধারণভাবে পোষণ করতে দেখেছি।’ এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন হলেও বেদনার আভাস দেখতে পাই।
স্বাধীনতার আগে ও পরে জাতীয়করণের প্রশ্নে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন হতেই পারে, জন-মনস্তত্ত্বেও পরিবর্তন আসতে পারে। এই সদা পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে কোনো কিছুই পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে নয়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে যা বোঝানো হতো, আজকের সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা তার থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। কিন্তু ইতিহাসকে ইতিহাস হিসেবেই দেখা উচিত। অর্থাৎ, অতীতের কোনো  event-কে যদি ব্যাখ্যা করতে হয় (এলান বাদিউ  event-কে যে-অর্থে ব্যবহার করেছেন আমি সেই অর্থেই বলছি) তাকে ইতিহাসের ধারাতেই ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করা উচিত সেদিনের মাপকাঠিতে, কেবল এ যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। এভাবে দেখলে সন্দেহ থাকে না যে, ৭২-পরবর্তী ন্যাশনালাইজেশন কর্মসূচি পঞ্চাশ-ষাটের দশকের আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সমমনা গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনের এক long-standing প্রতিশ্রুতির স্বাভাবিক ও অনিবার্য ফসল।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি মেনে- এক লোক এক ভোট-এর ভিত্তিতে- অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার ১৬৪টি সাধারণ আসনের মধ্যে ১৬২টি আসনে জয়লাভ করে। এর সঙ্গে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৫টি আসন যোগ করতে হবে। এই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ১৯৭০ সালের ৬ জুন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনকে সামনে রেখে আদর্শ ও লক্ষ্যকে কীভাবে আওয়ামী লীগ সেদিন দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছিল, সেটি বিচার করা দরকার।
কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত কর্মসূচিতে আবারও ফিরে এলো সমতামুখী সমাজ গড়ার কথা। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বোঝার জন্য এটি জরুরি। ১৯৭০ সালের ৭ জুন ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকা লিখল :
‘একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, জমিদারী, জায়গীরদারী, সরদারীর বিলোপ সাধন করিয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাম্যবাদী অর্থনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় সমুন্নত করার কল্যাণময় প্রতিশ্রুতি বিধৃত করিয়া নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গতকাল (শনিবার) উহার কর্মসূচি ঘোষণা করে।’
ইত্তেফাকের রিপোর্টিং থেকে দেখা যায় যে, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আদর্শ হলেও এই ব্যবস্থায় ‘প্রাণবন্ত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি সমান গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ : ‘দলীয় কর্মসূচিতে ঘোষণা করা হইয়াছে যে, দেশে ‘প্রাণবন্ত গণতন্ত্র’ কায়েমের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হইবে এবং এমন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা হইবে, যেখানে ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্যবাদ হইবে বিঘোষিত ও আচরিত নীতি।’ সাম্যবাদের পাশাপাশি এবার ন্যায়পরায়ণতাকে (Justice) একটি আলাদা মানদণ্ড হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে এটাও লক্ষণীয়। এই যুক্ততার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ধারার তুলনায় একটা ভিন্ন মাত্রা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও ন্যায়পরায়ণতা বলতে কী বা কোনো ধরনের Social Justice কে ইঙ্গিত দেওয়া হলো তা এখনও স্পষ্ট করা হয়নি। উল্লেখ্য, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার মধ্যে ইউটিলিটারিয়ান, লিবারটেরিয়ান, Kant বাদী, মার্ক্সের শ্রম-অনুযায়ী বন্টনবাদী, Rawls বাদী, অমর্ত্য সেনের চিন্তাধারার অনুসারী বিভিন্ন (অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী) ধারা-উপধারা রয়ে গেছে। বাহাত্তরের সংবিধানের আলোচনার সময়ে আমরা এদিকটায় দৃষ্টি দেব বিশেষ করে। আপাতত যেটা বলার তাহলো, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান জোর পড়েছে ‘প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের’ প্রতিষ্ঠার ওপরে। সরাসরিভাবে সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র একবার। সমতামুখীন সমাজের কথা এসেছে পরোক্ষভাবে- অনুমিত প্রসঙ্গ হিসেবে। ‘ঘোষণা ও কর্মসূচিতে’ যেভাবে এর আগে অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম’ করার কথা বলা হয়েছিল, সে রকম প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে রয়েছে। তবে প্রচুর Aesopian ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো।
১. ‘দেশে প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই গণতন্ত্রে মানুষের সকল মৌলিক স্বাধীনতা শাসনতান্ত্রিকভাবে নিশ্চিত করা হবে।’
২. ‘শোষণের অবসান অবশ্যই করতে হবে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। জাতীয় শিল্প সম্পদের শতকরা ৬০ ভাগের অধিক আজ মাত্র দু’ডজন পরিবার করায়ত্ত করেছে। ব্যাংকিং সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগ এবং বীমা সম্পদের শতকরা ৭৫ ভাগ এ দু’ডজন পরিবারের কুক্ষিগত।’
৩. ‘৬ দফাতেই রয়েছে সমাধান। … আমাদের বিশ্বাস শাসনতান্ত্রিক এ কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব। অন্যান্য অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’
৪. সরাসরিভাবে আগের মতো ‘মূল, বৃহৎ ও ভারী শিল্প’ জাতীয়করণের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি যদিও, কিন্তু এই সম্পর্কে পর্যাপ্ত ইঙ্গিত ছিল। ‘জাতীয়তকরণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলোসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। অর্থনীতির এসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সাধিত হতে হবে সরকারি অর্থাৎ জনগণের মালিকানায়। নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিকগণ শিল্প ব্যবস্থাপনায় ও মূলধন পর্যায়ে অংশীদার হবেন। বেসরকারি পর্যায়ে এর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুবিধা রয়েছে। একচেটিয়াবাদ … সম্পূর্ণরূপে বিলোপ সাধন করতে হবে।’ আলাদা করে পাট ও তুলা ব্যবসা ‘জাতীয়করণের’ কথাও বলা হয়েছিল ইশতেহারে।
৫. কৃষি খাত সম্পর্কে বলা হয়েছিল:’প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। … ভূমির সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে’, এবং ‘নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।’ শুধু ভূমি বণ্টনই নয়, ‘অবিলম্বে চাষিদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’
৬. বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বলা ছিল যে, ‘আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে। আমরা ইতিপূর্বে ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ ও অন্যান্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছি।
ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে, সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।’
সামগ্রিক বিচারে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল এক ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের’ প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সমাজ গড়ার বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন উপাদান ছিল। সেসব উপাদান আরও স্পষ্ট ও ঘনীভূত রূপ নিয়ে দেখা দেবে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। বাঙালির সাম্যচিন্তার এক মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকট সহকর্মীদের তৈরি করা বাহাত্তরের সংবিধান।

৭. মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ও সমতামুখীন প্রতিশ্রুতি
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার তেমন অবকাশ ছিল না। ঘটনাপ্রবাহ অতিদ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। পুরো বাংলাদেশ ছিল একটি বন্দিশিবির। বন্দিশিবিরের ভেতরে ও বাইরে সবাই বিজয়ের দিন গুনছিল। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরেও অনেকটা ধাপ অতিক্রম করেছিল বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য এসেছিল এই পর্বেই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে। প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষতা (সেক্যুলারিজম)-এর ধারণা নয় মাস অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে একটি মূল আদর্শে পরিণত হয় এবং গণতন্ত্রের জন্য এর সবিশেষ গুরুত্ব উপলব্ধ হয়। এর আগে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি’ শীর্ষক দলিলে বা ১৯৭০ সালের ‘নির্বাচনী ইশতেহারে’ কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম শব্দটি সরাসরিভাবে ব্যবহূত হয়নি। যে ধরনের বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে তখন কাজ করতে হয়েছিল, এ ধরনের শব্দ ব্যবহার আশা করা সম্ভবও ছিল না। তৎকালীন আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ দলিলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও সকল ধর্মের সমানাধিকারের পক্ষে স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক lexicon-এ আসেনি। সেখানে বলা হয়েছিল : ‘আওয়ামী লীগ হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক বিভেদ ও বিদ্বেষের সম্পূর্ণ বিরোধী। আওয়ামী লীগ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও মত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাসী- ইহা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাথমিক বার্তা।’
১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে কথাটা আরও পরোক্ষভাবে বলা হয়েছিল : ‘সকল নাগরিকের সমান অধিকারে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, আমরা সব সময়ই সব প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে আসছি। সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকের মতোই সমান অধিকার ভোগ করবে। আইনের সমান রক্ষাকবচ সকল ক্ষেত্রেই পাবে।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৬৮


বঙ্গবন্ধু ঠিকই জানতেন যে, ইতিহাস এবং সমসাময়িক আন্তর্জাতিক উদাহরণ দিয়ে তিনি যত যুক্তিজালই বিস্তার করুন না কেন ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ পূর্ব বাংলাকে দেওয়া হবে না। আইয়ুব খান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি ছয় দফা বা সিক্স পয়েন্টের দাবির মুখোমুখি হবেন ওয়ান পয়েন্টের মাধ্যমে। আর সেটা হবে ‘গান পয়েন্ট’। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মুজিবকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছিল। তার পরও তিনি ৬ দফা কর্মসূচিকে সামনে তুলে ধরেছিলেন সেটা কেবলমাত্র পূর্ব বাংলার মুক্তির সংগ্রামে ‘পুনরুজ্জীবিত’ আওয়ামী লীগের পেছনে ব্যাপক জনসমর্থন জড়ো করার জন্যে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী যে সহজে ৬ দফার দাবি মানবে না তা তিনি জানতেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এ-ও জানতেন যে, ৬ দফা কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। সহজে পাকিস্তানি শাসকচক্র ঝেড়ে ফেলতে পারবে না। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুযায়ী ভারতকে অখণ্ড রেখে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় ছিল অপেক্ষাকৃত ভারমুক্ত ‘কেন্দ্র’ (ইউনিয়ন) এবং বিকেন্দ্রীভূত শক্তিশালী ‘স্টেটস’ সমবায়ে একটি ফেডারেশন গঠন। সেদিন কংগ্রেস এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ভেস্তে যায়। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখারও একমাত্র উপায় ছিল তেমনি একটি ভারমুক্ত কেন্দ্র (ফেডারেশন) রেখে এর প্রদেশগুলোকে ৬ দফার আলোকে শক্তিশালী বিকেন্দ্রীভূত ‘স্টেটসে’ পরিণত করা। পাকিস্তানের জন্য এটা আরও বেশি জরুরি ছিল। কেননা এর দুই অংশের মধ্যে বিরাজ করছিল দেড় হাজার মাইলের ভৌগোলিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক- মানসিক দূরত্ব। এক-অর্থনীতির অধীনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকে ইতিমধ্যে সৃষ্ট আয়-বৈষম্য দূরীকৃত করা দুরূহ ছিল। অর্থনীতির একটি স্বীকৃত সূত্র হচ্ছে যে, অনগ্রসর ও অগ্রসর অঞ্চলের মধ্যে আয়-বৈষম্য দূর করা সম্ভব যদি দুই অঞ্চলের মধ্যে শ্রমের অবাধ সচলতা বা  Labour Mobility থাকে। বিশাল ভৌগলিক ব্যবধানের কারণে সেটা সম্ভব ছিল না। এত বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আর কোথাও দুই ভূগোলের দুই জনগোষ্ঠী একত্রে এক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি। সুতরাং ৬ দফা মেনে না নিলে পাকিস্তান ভাঙার দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপরে না পড়ে তা পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠীরই ওপরে পড়ে যায় বা তার ওপরে বর্তাবে (ঠিক যেমনটা ভারত বিভাগের মূল দায়ভার এসে পড়েছিল কংগ্রেস তথা তৎকালীন নেহরু-প্যাটেলের নেতৃত্বের ওপরে)- এটা পূর্বাহ্নেই অনুমান করা কষ্টসাধ্য ছিল বা মুজিবের পক্ষে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পাকিস্তান যেন ভেঙে যাবে এটা জেনে-বুঝেই কি বঙ্গবন্ধু তাহলে ৬ দফা দিয়েছিলেন? আমার বিশ্বাস, এ রকমটাই ভেবেছিলেন মুজিব। কিছু কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এমন ইঙ্গিত মেলে যে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা-প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই এমনকি তাকে ত্বরান্বিত করার জন্যই ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনীতির দাবা খেলায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাস্তবিকই মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট এক। একটি প্রমাণ এখানে উল্লেখ করব। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও তার কয়েকজন পেশাজীবী সহকর্মী মিলে তখন সত্তরের নির্বাচনে জয়ের পরে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। ৬ দফা দলিল যদিও মুজিবের মাথা থেকেই বের হয়েছিল, কিন্তু তারই দেওয়া ডিকটেশন ও গাইডলাইন অনুসরণ কওে দলিলটি লেখার কাজে সাহায্য করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্মাণের টিমেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। যা হোক, এক পর্যায়ে তারা অনুভব করলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রূপরেখা দাঁড় করানো গেলেও অর্থনৈতিক মানদণ্ডে সেরকম একটি ফেডারেশন আখেরে ‘সাসটেইনেবল’ হবে না। অর্থনৈতিক কার্যকারণ সূত্রেই সে ধরনের প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কিছুকালের মধ্যেই ভেঙে যেতে বাধ্য। তার অর্থ দাঁড়ায় যে, ৬ দফা আপাতদৃষ্টিতে ‘বাঁচার কর্মসূচি’ হিসেবে অধিকার আদায়ের জন্য পেশ হলেও এর আসল অর্থ ছিল পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত করা। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি সচেতন ছিলেন। রেহমান সোবহান তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, টেকনিক্যালি ৬ দফাকে ফেডারেল শাসনতন্ত্রের কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত এবং কার্যকর করা যেত, তবে তার জন্য পিন্ডির শাসকদের তরফ থেকে সদিচ্ছার দরকার ছিল :: ‘Our arguments indicated that a valid Constitution, which accommodated the 6-point demands, could be made operational, provided that the military, were sincere about seeking a constitutional solution to the political crisis. Our affirmation contributed to strengthening Bangabandhu’s resolve to stand firm on 6 points as a credible negotiating option. This awareness did not prejudice Bangabandhu’s scepticism over whether the realization of 6 points would be peacefully conceded by the Pakistan junta.’
কিন্তু পিন্ডির শাসকচক্রের সমর্থন পেলেও ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানকে এক রাখা যেত না। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম-যিনি ৬ দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে ১৯৬৯ সাল থেকেই সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন-তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন যে, শাসনতন্ত্রে ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও বা বাস্তবে বেশিদিন কার্যকর রাখা যেত না। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানের ভৌগোলিক রাষ্ট্রীয় ফেডারেল কাঠামো ‘দীর্ঘমেয়াদে’ টিকে থাকতে পারত না। কথাটা তিনি পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার অবগতির জন্য পেড়েছিলেন। উত্তরে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ এই যে, ‘আপনাদেরকে শাসনতন্ত্রের রূপরেখায় ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বলা হয়েছে। সেই কাজটা আপনারা করে দিন। তাতে করে পাকিস্তান আখেরে টিকবে কি টিকবে না, সে চিন্তাটা আমার উপরে ছেড়ে দিন।’ পরবর্তীকালে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ‘ঝরী- ‘Six-Point Programme or Independence?” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানের ফেডারেল কাঠামোর ভাঙন অনিবার্য ছিল। অর্থনৈতিক যুক্তি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কেন ওই ধরনের ফেডারেল কাঠামো টিকতো না। ২০২০ সালে প্রকাশিত তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : কাছে থেকে দেখা’ বইতে উপরোক্ত অর্থনৈতিক যুক্তির ভিত্তিতে তিনি এই বলে মন্তব্য করেছেন যে, ৬ দফা কর্মসূচি হচ্ছে প্রকারান্তরে এবং ‘বাস্তবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে- একটা বিরাট পদক্ষেপ।’ পুরো উদ্ধৃতিটি মনোযোগের দাবি রাখে :
‘বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ১৯৭১-পরবর্তী পাকিস্তানের সংবিধানে [৬ দফার] এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ৬ দফা কর্মসূচির মূল বিষয়গুলো সম্প্রসারণ করার কাজ তিনি দিয়েছিলেন আমার কিছু সহকর্মী এবং আমাকে। … এই বিষয়গুলোর সঙ্গে তার নিজের যে লক্ষ্য বা আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা মিলে গিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য ছিল, সহজেই ভেঙে দেওয়া যায় এমন একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত জোট বা সংঘ তৈরি করা। … আলোচনার এক পর্যায়ে আমার মধ্যেই প্রশ্ন জাগে যে পরিচালনা কমিটির সবাই ছয় দফা দাবি পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন কিনা। আমরা তাদের ছয় দফা বাস্তবায়নের সুদূরপ্রবাসী ফলাফলের বিষয়ে অবগত করানোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করি। যখন আমাদের অনুশীলন শেষ হলো, তখন জানা গেল যে ইতিমধ্যে তারা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে এবং তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু সবার আগে এবং খুব দ্রুত বিষয়টি বুঝতে পারেন। এর কারণ এই যে, তিনি এ বিষয়ে অন্যদের চেয়ে বেশি ভেবেছেন এবং বেশি সময় ব্যয় করেছেন।’
স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে ৬ দফা স্বাধীনতা অর্জনের একটি মোক্ষম এবং শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর আশু নির্বাচনী Tactical তাৎপর্যও আমাদের মনে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়ন করে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি নির্ভরযোগ্য দর কষাকষির প্ল্যাটফর্ম হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও জাতীয়তাবাদী বোধে উদ্বুদ্ধ করে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করতে হয়েছিলেন। তার এই চালে পাকিস্তান পড়েছিল ফাঁপরে। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তান এক পর্যায়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে ভেঙে যাবে- এটা জেনে তিনি ভেতরে ভেতরে আশ্বস্তবোধ করে থাকবেন। আর ৬ দফা অস্বীকার করে যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দলের তথা জাতির ওপরে জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে পূর্ব বাংলা অনিবার্যভাবেই স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে। বস্তুত ৬ দফা কর্মসূচির একটি রাজনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানের সমগ্র সামরিক শাসকগোষ্ঠীকে কোণঠাসা অবস্থানে নিয়ে গিয়ে আবদ্ধ করেন শেখ মুজিব। উপরোক্ত যে কোনো  variant বাস্তবায়িত হলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকে- কিছু আগে বা পরে হলেও-ঠেকানো যেত না। এদিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে একজন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। এ জন্যেই ইতিপূর্বে তাকে অভিহিত করেছি একজন ‘মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট’ বলে।
৬ দফার কর্মসূচি-সংক্রান্ত দলিল উত্থাপনের পরে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অতিদ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা’ (ম্যানিফেস্টো)-এর তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। সেখানে ইতিপূর্বে উল্লেখিত সকল গুরুত্বপূর্ণ সমতামুখীন নীতিমালাই স্থান পায়। ‘ছয় দফাভিত্তিক’ ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’কে শাসনতান্ত্রিক আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। লিবার্টি প্রিন্সিপলকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলা হয় যে, দলটি ‘নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি-ব্যবস্থায় বিশ্বাসী’। ‘অর্থনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে পুনরায় ঘোষিত হয় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা। ১৯৬৭ সালের দলিলে এ সম্পর্কে লেখা হয় :
‘আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানে শোষণ, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্দশার হাত হইতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’
পাঠক লক্ষ্য করুন, এটি কোনো ‘খসড়া ম্যানিফেস্টো’ থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে না। এটি দলের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ সংবলিত প্রকাশিত দলিল থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। অবশ্য ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ’ বলতে কী ধরনের অর্থনীতির সমাজ তার সংজ্ঞা এখানে নেই। কিন্তু অভিপ্রায়টা তো স্পষ্ট- ‘স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা’ কায়েম করা। পাঠক আরও লক্ষ্য করুন, রাতারাতি সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে যে, এ ধরনের শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই দলের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’। এটাও লক্ষণীয় যে, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন শব্দবন্ধের পাশে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘স্বাধীন’ শব্দটিও। ফ্রিডম বা লিবার্টি প্রিন্সিপল ছাড়া সোশ্যালিস্ট বা সোশ্যাল জাস্টিস প্রিন্সিপল অচল- এই রাজনৈতিক বিশ্বাসকে বঙ্গবন্ধু সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এটিই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ অন্যতম মূলনীতি।
১৯৬৭ সালের নীতি ও কর্মসূচির প্রকাশিত দলিলে যথারীতি এসেছিল ‘মূল, ভারী ও বৃহৎ শিল্পের’ জাতীয়করণের কথা। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ১৯৬৯ সালের ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণের আগেই আওয়ামী লীগ ব্যাংক-বীমা ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণের কথা বলেছিল এই দলিলে। এর পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বিকাশকেও উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছিল : ব্যক্তি খাতের ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মূলধন সরবরাহ ও অন্য সকল ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানের’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের জন্য যেসব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল, তার সবটাই পূর্ব নির্ধারিত ছিল। যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ১৯৬৭ সালে মুদ্রিত আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ দলিলেই রাখঢাক না করেই আগেভাগে বলে দেওয়া হয়েছিল। তার পরও কেন জাতীয়করণ নিয়ে সিভিল সোসাইটিতে এত উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল পরবর্তীকালে, তার কারণ বোঝা ভার। এর জন্যে  ‘Nationalisation and All that’ শীর্ষক রচনা লিখতে হয়েছিল অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানকে বিষয়টা পরিস্কার করার জন্যে। এ প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই না উঠে পারে না। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অর্থনীতিবিদদের কেন ন্যাশনালাইজেশনের প্রশ্নে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে (বা এখনও করতে হয়) সেটার কারণ বোঝা আরও দুরূহ। যদি বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করার প্রস্তাব আওয়ামী লীগের পূর্বাপর বিঘোষিত ও প্রতিশ্রুত ঘোষণা ও কর্মসূচিরই অংশ হয়ে থাকে, তবে তার জন্যে রাজনীতিবিদেরাই জবাবদিহি করবেন- এটাই প্রত্যাশিত।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৬৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


১৯৬৪ সালের দলিলে কৃষি-ব্যবস্থা নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার টানা হয়েছিল। কৃষকরা ‘দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে জর্জরিত’ এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় Model Firm গড়ে তুলে তাদের ‘কৃষি উন্নয়নের আধুনিক পন্থা’ দেখাতে হবে- এসব বলার পর যেটা লেখা হয়েছিল, তা বর্তমান আলোচনার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ :

‘সমবায় পদ্ধতিতে আমাদের দেশে চাষাবাদের  (Co-operative Cultivation) প্রচলন করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি কৃষকের জমি গড়ে এত ক্ষুদ্র এবং তাহাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে দু’ভাগ যে, সমবায় পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যতীত এখানে কৃষি উন্নয়নের অন্য কোনো উপায় নেই। কৃষি ব্যাংকের, কো-অপারেটিভ ব্যাংকের এবং অন্যান্য কৃষি ঋণের টাকা কৃষকদিগকে ব্যক্তিগতভাবে বিতরণ না করিয়া সমবায় পদ্ধতির কৃষির জন্য উহা ব্যয় করা উচিত। ইহার ফলে কৃষকদের প্রধান সমস্যা- মূলধন সমস্যার সমাধান সম্ভব হইবে। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি ব্যবস্থার ফলে আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি ক্রয়, উন্নত বীজ ক্রয় এবং উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা সহজ হইবে।’

এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইতিপূর্বে (১৯৪৯-৫৩ পর্বে) আলোচিত সমবায়-চিন্তা আবারও পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ফিরে এসেছে। ‘Co-operative Cultivation’-এর প্রাথমিক ভাবনার বীজ তাহলে এখানেই রোপণ করা হয়েছিল, যা কালক্রমে বাহাত্তরের সংবিধানে ‘সমবায়ী মালিকানা’ রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায় এবং পরবর্তীকালে বাকশালের ‘মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ’-এর ধারণার মধ্যে আরও স্পষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক আকার লাভ করে। কৃষকদের করের ক্ষেত্রেও এই দলিলে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল যে, ‘যেসব কৃষকের জমি ২৫ বিঘা বা তার নিল্ফেম্ন, তাহাদের জমির ওপর অন্তত ২৫ বৎসরকাল কোনো কর ধার্য করা হইবে না।’ এটিও স্বাধীনতার পরে করনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

তবে আন্তর্জাতিক নীতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ১৯৬৪ সালের দলিলে সরাসরি কোথাও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়নি। অবশ্য জোটনিরপেক্ষতার নীতি  ‘Friendship to all, Malice to none’- পূর্বাপর বজায় ছিল। কিন্তু কৌশলগত বিবেচনা থেকে পূর্বেকার দলিলপত্রের মত কোথাও ইং-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব থেকে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়নি। পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের মতো ভাবমূর্তি দাঁড় করানোর পর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ছিল শেখ মুজিব ও তার নিকট সহকর্মীদের। সেজন্যেই বোধকরি বিদেশনীতির ক্ষেত্রে পাই অপেক্ষাকৃত সংযত ও সতর্ক শব্দপ্রযোগ : ‘বিশ্ব শান্তি প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযোগিতা দান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড়  (Static) থাকিতে পারে না। উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষে (Dynamic)- এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী।’ বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষেই একাধারে বাস্তববাদী ও জোটনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন। সেটা ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে তার বিভিন্ন উক্তিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। ‘কারও সাথে দুশমনি’ চাই না, দেশের উন্নয়নের জন্যে সকলকেই তার দরকার- এই বাস্তববাদী মনোভাব বঙ্গবন্ধুর মধ্যে পূর্বাপর অটুট ছিল। এমনকি যেসব দেশ তার জীবদ্দশায় স্বীকৃতি দেয়নি- যেমন, চীন ও সৌদি আরব- তাদের কাছেও তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলি উপরোক্ত খসড়া ম্যানিফেস্টোর মূল প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে। ইত্তেফাক পত্রিকা ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ এই প্রস্তাবগুলোর একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। তা থেকে দেখা যায় যে, ১১নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ‘একমাত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধন করিতে সক্ষম বলিয়া ধীরে ধীরে উহা প্রবর্তন’ করা প্রয়োজন। ‘ধীরে ধীরে’ শব্দের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এটাও লক্ষণীয়।

আগেই বলেছি, ১৯৬৬ সালে উত্থাপিত হয় ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি। লেখক-শেখ মুজিবুর রহমান। এই দলিলের দফা ওয়ারী আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। যেটা প্রাসঙ্গিক সেটা হলো সমতামুখীন আকাঙ্ক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার। ৬ দফা কর্মসূচির ৬নং দফা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলছেন :

‘আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না।… যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তাহার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে।’

এর থেকে বোঝা যায়, শেখ মুজিব ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে কী চোখে দেখতেন। প্রথমে ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’, এবং ক্রমান্বয়ে অতিমাত্রার ‘ব্যক্তিগত বৈষম্য’ (আয়, সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য) দূর করার অভিপ্রায় ছিল তার। এখানেই ৬ দফা কর্মসূচির মধ্যে সমতামুখীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। ৬ দফার মতো জাতীয় জাগরণের কর্মসূচি উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি সেই সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার কথা তুলতে ভোলেননি। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ- বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের আদর্শ বোঝার ক্ষেত্রে।

৬ দফার প্রসঙ্গ ছেড়ে যাওয়ার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার। যদিও ৬ দফা কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধু ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ হিসেবে পেশ করেছেন, কিন্তু এটি আসলে ছিল আমাদের স্বাধীনতারই দাবি। অর্থাৎ, বাহ্যত ‘অটোনমির’ কথা বলা হলেও তা আসলে ‘স্বাধীনতা’ অর্জনের দিকেই অনিবার্যভাবে গড়াতো এ-ই হচ্ছে যুক্তি। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম লিখেছেন যে, ‘৬ দফা কর্মসূচি পেয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, এর ফলে নামেই কেবল পাকিস্তান এক দেশ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে এটা হবে একটা বিরাট পদক্ষেপ’। আমি একটু এগিয়ে বলতে চাই। ৬ দফা বাহ্যত যা-ই হোক, কার্যত ছিল স্বাধীনতারই দাবি। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তান অপ্রতিরোধ্যভাবে ভেঙে যেত। এই কথাটা কিছু ব্যাখ্যার দাবি করে। সরাসরি মুজিব ১৯৬৬ সালে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি করতে পারতেন না এটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। পূর্ব বাংলার মানুষ তখনও লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের’ বাইরে গিয়ে ‘স্বাধীনতা’ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মনের দিক থেকে প্রস্তুত ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব গোড়া থেকেই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধতা করে আসছিল। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : ‘আমরা আওয়ামী লীগ গঠন করার সাথে সাথে যে ড্রাফট পার্টি ম্যানিফেস্টো বের করেছিলাম [১৯৪৯ সালের এই ম্যানিফেস্টো সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে বিস্তৃত আলোচনা করেছি- লেখক] তাতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা থাকায় লিয়াকত আলী খান আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন।’ ১৯৫৩ সালের ‘সাংগঠনিক রিপোর্ট’ পেশ করার সময় মুজিব পুনরায় প্রসঙ্গটি স্মরণ করেন : “জেল-জুলুমের পরেও আওয়ামী লীগের অপ্রতিহত গতিতে ব্যাকুল হইয়া জনাব লিয়াকত আলীর মতো লোকও আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘শির কচাল দেঙ্গে’ ধ্বনি করিয়াও আওয়ামী লীগকে ভেস্তে দিতে পারেন নাই।” ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে মুজিব একই কথা বলেছেন : ‘নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান সভায় ঘোষণা করলেন : ‘যো আওয়ামী লীগ করে গা, উচকো শির হাম কুচাল দে গা।’ আর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অধীনে স্বাধীনতা দূরে থাক, ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের’ দাবি তোলাও ছিল দেশদ্রোহের শামিল। তাই ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি’ দলিলে সচেতনভাবেই ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনে’র শব্দবন্ধ পর্যন্ত পরিহার করে বঙ্গবন্ধু কথাটা ঘুরিয়ে বলেছেন। তার একমাত্র Tactical দাবি ছিল- ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে।’ ফেডারেটিং ইউনিটের জন্য যেসব আর্থিক-প্রশাসনিক ক্ষমতা চেয়েছিলেন এবং তার সমর্থনে মুজিব যেসব ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক উদাহরণ টেনেছিলেন তা সত্যিই উপলব্ধির বিষয়। ইতিহাস ও যুক্তির ডায়ালেকটিক্যাল অ্যাপ্রোচের এটি ছিল একটি অনন্য উদাহরণ। প্রথমত, তিনি দেখালেন যে, ৬ দফা কোনো নতুন দাবি নয়। এটি লাহোর প্রস্তাবের আলোকে তৈরি। আর লাহোর প্রস্তাব ছিল ‘কায়েদে আজমসহ সকল নেতাদের দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা’ : ‘১৯৪৬ সালের নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়েছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি।’ দ্বিতীয়, লাহোর প্রস্তাবের অরিজিনাল ভার্সনে ‘একাধিক স্টেটের সমন্বয়ে’ পাকিস্তান গঠনের কথা বলা হয়েছিল- সেখানে ‘কেন্দ্রের’ কাছে কিছু দায়িত্ব রেখে বাদবাকি দায়িত্ব ‘স্টেটসমূহের’ কাছে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাতেও কেন্দ্রের কাছে তিনটি বিষয়- প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, ও মুদ্রানীতি রেখে বাদবাকি বিষয়ে প্রদেশগুলোকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। তবে ৬ দফায় আরও ব্যাপক ক্ষমতা চাওয়া হয়েছিল :কেন্দ্রের কাছে বা ফেডারেশন সরকারে এখতিয়ারের কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার রেখে বাদবাকি সব বিষয় (আর্থিক নীতিসহ) স্টেটসমূহের কাছে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ৩নং দফায় আলাদা মুদ্রানীতি ও ৪নং দফায় আলাদা রাজস্ব নীতির কথা বলা হয়েছিল। যেটা লক্ষণীয় যে, এই দুটির পক্ষেই যুক্তি হিসেবে মুজিব সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের সমসাময়িক উদাহরণ টেনে এনেছিলেন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের ঐতিহাসিক উদাহরণ দেখানোর পাশাপাশি। যেমন, আলাদা মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলছেন :১৯৪৬ সালের ‘ক্যাবিনেট প্ল্যানে নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল, তাহাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। ঐ প্রস্তাব পেশ করিয়া বৃটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়াও কেন্দ্র চালিতে পারে। কথাটি সত্য। … অত যে শক্তিশালী দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাহাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর নাই। শুধু প্রাদেশিক সরকারের অর্থাৎ স্টেট রিপাবলিকসমূহেরই অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মন্ত্রী দফতর দিয়াই মিটিয়া থাকে।’

৪নং দফার নিজস্ব রাজস্ব নীতি গ্রহণের পক্ষে একইভাবে ঐতিহাসিক (অর্থাৎ, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান) এবং সমসাময়িক (অর্থাৎ, সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের) যুক্তি দিলেন মুজিব। ৬ দফায় দলিলে পরিস্কারভাবে লেখা আছে :

‘কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিধানে স্বীকৃত। তাহারা এ খবরও রাখেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান ব্রিটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল; কেন্দ্রকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই।

৩নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তাহার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েট ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর বলিয়া কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নাই। তাহাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে? তার দেশরক্ষা বাহিনী ও পররাষ্ট্র দফতর কি সেজন্য দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই।’

৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপনের সময় মুজিব পাকিস্তানের ফেডারেশন কাঠামোয় পূর্ব বাংলাকে ‘প্রদেশ’ হিসেবে না দেখে ‘স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন দলিলের সর্বত্র। এটাও কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। মুজিব জানতেন, ‘ইহাতে কায়েমি স্বার্থ শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছেন যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তাহা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস’ বলা হইয়া থাকে। … মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানি, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাহাদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা ‘প্রদেশ’ নয় ‘স্টেট’। এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া ‘স্টেট’ হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেইবা কর্তারা এত অ্যালার্জিক কেন?’

[ক্রমশ]