ধারাবাহিক
পর্ব ::৭০
পূর্বে প্রকাশিতের পর
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অভিজ্ঞতা জনচৈতন্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। যার প্রতিফলন এসে পড়েছিল রাজনৈতিক মতাদর্শেও। এরই যৌক্তিক আদর্শিক পরিণতি ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সেক্যুলারিজম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন আহমদ রফিক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন মতিন আহমদ চৌধুরী। এর প্রায় প্রতিটি সংখ্যা আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। ‘কনটেন্ট-এনালাইসিস’ করে দেখা যায় যে নিয়মিতভাবে তাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট সংখ্যায় অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক এক দিন আগে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ ছাপা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল :’বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়িকতা বা ‘সেক্যুলারিজমের’ মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি। … গণতন্ত্র অর্থই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। যেখানে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সেখানে গণতন্ত্র কোনো দিন কার্যকরী হতে পারে না। আজ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলে অসাম্প্রদায়িকতা বা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতিটি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যারা আছেন তাদের মধ্যে এ প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবাই বন্ধু। আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখের সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।’
এই একত্র-বোধের চেতনা জন্ম ত্বরান্বিত হয়েছে ১৯৭১ সালের সামষ্টিক প্রতিরোধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘জয় বাংলার’ ১৫ অক্টোবর সংখ্যায়। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও নতুন বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পরস্পর-সম্পর্কিত করে দেখা হয়েছিল :
‘মাত্র চব্বিশ বছর আগে সাম্প্রদায়িক জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে কাতারবন্দি হয়েছে। শুধু মাঠে ময়দানে স্ল্নোগান দেয়া নয়, একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতিয়ার হাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে হত্যা করছে, প্রাণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ, বাঙালি জাতি হিসেবে প্রাণ নেয়া ও দেয়ার মিলিত রক্তধারায় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে, এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা অনন্য। সাম্প্রদায়িকতাবাদের কবর রচনায় ইতিহাসের এই অনন্য অধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। … অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও শুধু বাঙালী জাতীয়তাবাদের এই অভ্যুদয়কে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক অগ্রগতি হিসেবে স্বাগত জানাতে হয়।’
দেখা যাচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘গণতন্ত্র’ অংশটিতে মূল্যবান সংযোজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের ধারায় এটি ছিল একটি মৌলিক অর্জন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘সমাজতন্ত্র’ অংশটিতেও মৌলিক উপলব্ধি এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই উচ্চারিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি। ১১ মে ১৯৭১-এর ‘জয় বাংলার’ প্রথম সংখ্যায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে লেখা :’স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী, সমৃদ্ধ সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’
১৯ মে ১৯৭১-র ‘জয় বাংলার’ দ্বিতীয় সংখ্যায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বললেন যে, ‘নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল তার প্রতিটি তারা পালন করবে। তিনি জানান যে, তার সরকার ভূমিহীনকে ভূমিদান, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বড় বড় শিল্প জাতীয়করণ করে দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’ আবারও দেখা যাচ্ছে ১৯৭২ সালের আগেই মুক্তিসংগ্রামের মধ্যেও ভূমিবণ্টন, জাতীয়করণ ও সমাজতন্ত্রের কথা এসেছে।
‘জয় বাংলার’ ২ জুন ১৯৭১ সংখ্যা থেকে একটি ধারাবাহিক শুরু করা হয়। যার নাম ছিল- ‘আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর কয়েকটি দিক’। ৯ জুলাই পর্যন্ত তা চলতে থাকে। এতে আরেকবার দলের অর্থনৈতিক নীতিমালা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দলের প্রধান মুখপত্রটিতে আবারও বলা হয় সমতামুখীন সমাজের প্রতি আওয়ামী লীগ ও মুজিবনগর সরকারের অব্যাহত কমিটমেন্টের কথা :’শোষণমুক্ত একটা ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই এই অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প- যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথ বণ্টনের বিধান থাকবে।’
এই কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন ২৩ নভেম্বর। বিজয়ের প্রায় এক মাস আগের এই ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে :’আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে সকলের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।’
এই সমাজতন্ত্র ছিল ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে’ সমাজতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা- যেটি আওয়ামী লীগের ঘোষণা ও কর্মসূচিতে ইতিপূর্বে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই সমাজতন্ত্রের উদ্ভবস্থল বাংলাদেশেই। এটি এমনকি সংগ্রাম চলাকালীন অন্যান্য দলের নেতারাও অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়’, এবং যোগ করেছিলেন যে, ‘এ বিপ্লব বাইরের কোনো দেশ থেকে আমদানি করা হয়নি, কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে তো নয়ই।’ তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে, ‘বাংলাদেশের এ বিপ্লবের গুরুত্ব কোনো অংশেই চীন ও রাশিয়ার বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষের সর্বাত্মক বিপ্লব।’ সবাই এই ব্যাখ্যার সাথে একমত ছিলেন তা অবশ্য নয়। পার্থক্যটা ছিল সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তার মাত্রায় ও গভীরতায়। ১৮ নভেম্বর সল্টলেকে শরণার্থীদের এক জনসভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মীজানুর রহমান চৌধুরী যেমন বিকল্প ফর্মুলেশন হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র না বলে একে অভিহিত করেছিল ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ রূপে। কিন্তু পার্থক্যটা ছিল প্রবণতায় ও ঝোঁকে। কেউ ‘গণতান্ত্রিক’ উপাদানের ওপরে বেশি করে জোর দিয়েছিলেন (যেমন, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি), আবার কেউ দৃষ্টি দিচ্ছিলেন এর ‘সমাজতান্ত্রিক’ উপাদানের প্রতি। কিন্তু দুটো উপাদানই অর্থনৈতিক মতাদর্শে থাকতে হবে যা নিয়ে নেতৃত্বের মধ্যে কোনো সংশয় বা বিতর্ক ছিল না। সেদিন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালেই তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ‘আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর’ আলোকে ‘আমরা ইতিমধ্যেই মুক্ত এলাকায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ কায়েমের কাজ শুরু করে দিয়েছি।’ এ বিষয়ে প্রায়-সর্বস্তরে ব্যাপক ঐকমত্য বিরাজ করছিল এটা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাও একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক উদারমনা ব্যবস্থা কামনা করতেন। একজন গেরিলা নেতা আবদুল মান্নানের উদ্ৃব্দতি দিয়েছিল ‘নিউজ উইকের’ ২২ নভেম্বর সংখ্যায়। রচনাটির শিরোনাম ছিল- ‘বাংলা :প্রতিশোধের মুহূর্ত’। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মান্নান বলছেন : ‘আমরা জয়ী হলে সত্যিকারের গণতন্ত্রই আমরা লাভ করব। অন্যান্য উন্নতিশীল রাষ্ট্রের মতো স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরও সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থাকবে, কিন্তু সাম্যবাদী নয়। আমরা একটি নতুন জাতি, বাংলাদেশের জন্যই এ লড়াই করছি।’ প্রথাগত সোভিয়েত বা চীনের সমাজতন্ত্রের মডেলের চেয়ে আলাদা করে ভাবার চেষ্টাটা এখানে লক্ষণীয়। এক কথায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র-এর সমাজবাদ নিয়ে বিভিন্নমুখী ঝোঁক বা উপলব্ধি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এবং সাধারণভাবে মুক্তিযোদ্ধা জনগণের মধ্যে বিরাজ করছিল। কিন্তু তার মধ্যে সমতাবাদী আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে ‘নূ্যনতম ঐক্যের’ জায়গাটিতে কখনও ফাটল ধরেনি, আর সেটি হচ্ছে এক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমতামুখীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এর দু’দিন আগেই বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে ভারত ও ভুটানের পক্ষ থেকে। বিজয় তখনও অর্জিত হয়নি। এই প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের পটভূমিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করলেন : ‘নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ শান্তিপূর্ণ অবস্থান, জোটনিরপেক্ষতা এবং সকল প্রকার ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী জীবন গঠনে অভিলাষী।’
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তখন ঢাকার দ্বারপ্রান্তে। বিজয় সমাগত- রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন এটা জেনে গেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে একটি দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের বহু প্রতীক্ষিত অভ্যুদয়, কিন্তু তাজউদ্দীনের মনে বিষাদের ছায়া। কেননা, মুজিব তখনও কারাগারের নির্জন সেলে বন্দি। তার ওপর থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের ঝুঁকি চলে যায়নি। অপ্রকৃতিস্থ ইয়াহিয়া কী করে বসেন তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। এই বিষাদের মধ্যেও তাজউদ্দীন নবজাত রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা আবারও স্মরণ করতে ভুললেন না। এই নতুন রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত থাকলেও চার আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সেদিনের নেতৃত্ব ছিলেন বদ্ধপরিকর। পুরো উদ্ধৃতিটি নেহরুর Tryst with Destiny বক্তৃতার চেয়ে (যেটি ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত্রিতে দেওয়া হয়েছিল) কোনো অংশে কম তাৎপর্যপূর্ণ নয় :’বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু ম্লান হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায়। বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হলো, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক, শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দি হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে, যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক; যে রূপকাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে যোগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।’
এ কথা বলে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর এতদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শকে দুটি বাক্যে তুলে ধরলেন :’আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট-নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরোধিতা করা। আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।’
বঙ্গবন্ধু কারামুক্তির জন্য আরও কিছু সময় প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার মধ্যে অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসবেন ১০ই জানুয়ারি। ঘোষিত হবে তার চার মূলনীতি- যাকে তিনি অন্যত্র ‘চার দফা’ বলেছেন : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার আদর্শের ওপরে তিনি নির্দেশ দেবেন যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরি করার জন্য। এবং মাত্র ৮ মাসের মধ্যে খসড়া প্রস্তুত হয়ে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লিতে তার উপরে বিশদ আলোচনা এবং উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের পর গৃহীত হবে সেটি। প্রচুর শ্রম, অনেক ভাবনাচিন্তা, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা বিবেচনা, অপ্রত্যাশিত ও প্রত্যাশিত উৎস থেকে অনুপ্রাণিত তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি, অনুশীলন ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হবে এই অনন্য দলিলে। বাঙালির সাম্যচিন্তার ক্ষেত্রে এই সংবিধান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে রয়েছে আজ অব্দি। আমরা এখন সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।
[ক্রমশ]