জনজীবনের অর্থনীতি

বিনায়ক সেন

১. মিল ও অমিল

প্রতিটি শাস্ত্রই তার নিজের চারদিকে একটা সীমারেখা এঁকে দেয় বা বেড়া তুলে দেয়, যাতে করে বেড়ার ভেতর থেকে কেউ বাইরে যেতে না পারে, বা বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। রামায়ণে সীতার দেবর লক্ষ্মণ সীতার ভিটের চারদিকে একটি রেখা টেনে দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত যে-ই আসুক না কেন, সীতা যেন ঐ রেখার বাইরে পা না রাখেন। তাহলেই তিনি বিপদমুক্ত থাকবেন। বাংলা প্রবচনে একেই বলা হয়েছে_ লক্ষ্মণরেখা। শাস্ত্রগুলোও তেমনি তার চতুর্দিকে লক্ষ্মণরেখা এঁকে নিজেকে অন্য শাস্ত্রের প্রভাবমুক্ত বা ‘বিপদমুক্ত’ রাখতে চেয়েছে। বিশেষত এটা ঘটে এনলাইটেনমেন্ট-পরবর্তী ইউরোপে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে যখন শাস্ত্রগুলো ক্রমান্বয়ে একাডেমিক সনদ দানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ‘ফ্যাকাল্টি’ হতে থাকে। বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রতিটি শাস্ত্রকেই তার নিজস্ব গণ্ডী দাঁড় করাতে হয়েছিল, সন্দেহ নেই। তবে সমাজে অত্যধিক শ্রম-বিভাজনের কারণে অতিমাত্রায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে কোথাও কোনো সার্বিক দার্শনিক (নৈতিক) ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে কি-না_ এ প্রশ্ন এডাম স্মিথ তার ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ বইতেই তুলেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে নীতিশাস্ত্র (ও অন্যান্য শাস্ত্রের) বিচ্ছিন্নতার কারণে ক্ষতি হয়েছে যেমন অর্থশাস্ত্রের, তেমনি নীতিশাস্ত্রেরও। এরকম একটি মত জোরে-শোরে উত্থাপন করেছিলেন অমর্ত্য সেন তার ‘এথিকস্ অ্যান্ড ইকোনমিক্স’ গ্রন্থে। আমি এসব সূত্র ধরে এই লেখায় মোটের উপর বলতে চেয়েছি যে, সাহিত্যের সঙ্গে অর্থশাস্ত্রের বিচ্ছিন্নতার কারণে অর্থনীতি নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনাও বেশ কিছুটা পরিমাণে ‘সংকীর্ণ’ হয়ে পড়েছে। এতে করে ক্ষতি হয়েছে দুই পক্ষেই। সাহিত্যে সর্বাধিুনিক অর্থনৈতিক চিন্তাগুলো সেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। আবার অর্থশাস্ত্রেও সাহিত্যে বিবৃত জনজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো যথাযথ স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে শাস্ত্রটির জনবিচ্ছিন্ন বিদ্যায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটাকে এক ধরনের ‘একাডেমিক প্রটেকশনিজম’-এর ফলপরিণাম হিসেবে দেখা যেতে পারে।

অথচ সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্রের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও এ দুই মানবিক বিদ্যার (হিউম্যানিটিক) মধ্যে ‘নাড়ির বন্ধনকে’ অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘সাহিত্য’ বলতে আমি মহাকাব্য, পুঁথি, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ সবকিছুকেই এক জায়গায় জড়ো করছি। বাংলায় ইকোনমিক্স শব্দটার ভাষান্তরে অর্থনীতি ও অর্থশাস্ত্র দুই-ই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দ্বিত্বতা এড়ানোর জন্য আমি এখানে ইকোনমিক্স অর্থে অর্থশাস্ত্র আর ইকোনমি অর্থে অর্থনীতি ব্যবহার করছি। সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল দেখতে পাওয়া যায় বিষয়বস্তুর অভিন্ন ঝোঁকের মধ্যেই। উন্নয়ন ও সাম্যের ধারণা দুই বিদ্যার ক্ষেত্রেই অভিনিবেশের বিষয়। কোন নীতি জনহিতৈষী বা কোন নীতিই বা জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর_ এসব আলাপ উভয়বিধ বিদ্যারই চর্চার বিষয়। এটা ঠিক যে, জনজীবনের যেসব ধারণা সাহিত্যে অনায়াসে চলে আসে, তাকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করে বিচারের প্রয়াস চলে অর্থশাস্ত্রে। শুধু বিশেষভাবে সংজ্ঞার ঝোঁক নয়, বিচার-পদ্ধতিতেও গাণিতিক ও ইকোনমেট্রিক মডেল নির্মাণ ও পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ যোগ করা হয় আধুনিক অর্থশাস্ত্রে। তারপরও সমাজ-প্রগতির বা অধোগতির তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি কার্য-কারণ বোঝার তাগিদ পাওয়া যায় সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্র উভয়ের মধ্যেই। একই ভাষার রকমফের সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যেমন দুই ভিন্ন জাতি, ঠিক তেমনভাবেই একই ঝোঁক ও মূল্যবোধ ধারণ করা সত্ত্বেও সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্র দুই ভিন্ন বিদ্যার আদল পায়। এই মৌলিক মিলের জায়গাটিকে ধরে রাখতে পারলে দুই বিদ্যারই বিকাশে তা আরো পুষ্টি জোগাবে সেটি এখানে আরো একবার মনে করিয়ে দেওয়া। এই মৌলিক মিলের অনেক উদাহরণ রয়ে গেছে বাঙালির অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে। বাংলা সাহিত্যের নানা উদাহরণের মধ্যে পাওয়া যাবে প্রাগ্রসর অর্থনৈতিক চিন্তার পদচ্ছাপ (ফুটপ্রিন্টস)। আবার সাহিত্যের অভিজ্ঞতার মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক অর্থনৈতিক কূটভাষের সরল সূত্র। এমনকি অনেক অর্থনৈতিক নীতিমালার সম্ভাব্য ধারণা-অভিজ্ঞান। এ রকম দুটো উদাহরণ হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস। এ দুটি লেখার সূত্র ধরে আমি পরবর্তী দুই অধ্যায়ে সাহিত্যে অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে কিছু বাড়তি প্রসঙ্গের উল্লেখ করব।

২. স্মিথ, ডিকেন্স, মিল ও বঙ্কিম

খোলা বাজার বা অবাধ বাজার-অর্থনীতি নিয়ে আমাদের জনমনে কম-বেশি ভুল-শুদ্ধ একটা ধারণা চালু আছে। বিশেষ কতগুলো শর্তসাপেক্ষে এ অবাধ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার অর্থনীতি হচ্ছে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সমাধানের পথ_ এরকম একটি বক্তব্যের শাস্ত্রীয় সূচনা হয় স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ বইয়ে। এই বাজার-অর্থনীতি কোনো সর্বজ্ঞ পরিকল্পনাকারীর হাত ধরে কাজ করে না। বস্তুত কেউই এর পরিচালনার দায়িত্বে নেই। সমাজের সব ইকোনমিক এজেন্টেই স্বীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে যুক্ত হন। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তির স্বপ্রণোদিত উদ্যমের ফল হয় সামগ্রিকভাবে সবার জন্য শুভ। এই চমৎকার পরিণতির পেছনে কোনো নিখিল প্রজ্ঞার হাত নেই_ যা আছে তা হলো বাজারের অদৃশ্য হাতের জাদু। সেই থেকে স্মিথের ইনভিজিবল হ্যান্ড-এর তত্ত্ব অর্থশাস্ত্রে চালু হয়ে রয়েছে। বাজারের এই ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্ব অনেকগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে এ পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার নজর কেড়েছে দার্শনিক মিশেল ফুকোর একটি বিশ্লেষণ। তিনি এক জায়গায় বলছেন যে, অদৃশ্য হাত-এর তত্ত্বে রাজা বা সার্বভৌম ক্ষমতা পুরোপুরি অস্বীকৃত। রাজা রাষ্ট্রের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা বা রাষ্ট্রক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অপ্রয়োজনীয় সত্তা। অর্থাৎ ফুকোর ব্যাখ্যায়, সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে যাওয়ার এক পর্যায়ে রাজার অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংকুচিত করার জন্য ১৬৮৮ সালের ‘গ্গ্নোরিয়াস রিভুল্যুশন’ যেসব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিল তারই সর্বোচ্চ তাত্তি্বক স্বীকৃতি মেলে ১৭৭৬ সালে স্মিথের লেখায় বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্বে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাজার যদি কোনো আবশ্যিক ভূমিকা না-ই থাকে, তাহলে তার অস্তিত্বের একটি বড় অংশই মহিমা হারিয়ে ফেলে। এদিক থেকে দেখলে ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্ব আসলে একটি অন্তর্ঘাতমূলক রাজদ্রোহী তাত্তি্বক তৎপরতা_ সর্বময় ক্ষমতার মালিক রাজা বা সার্বভৌমের বিরুদ্ধে। ফুকো তাই লিখেছেন, ‘ইকোনমিক্স ইজ আ ডিসিপ্লিন উইদাউট টোটালিটি।’ আমার নড়বড়ে অনুবাদে তা দাঁড়ায় এমন :’অর্থশাস্ত্র হচ্ছে এমন একটি বিদ্যা যা রাজার পক্ষে গোটা রাষ্ট্রকে শাসন করা সম্ভব এ রকম সার্বভৌম-কেন্দ্রিক ধারণাকে সরাসরি নাকচ করে।… উদারনৈতিকতাবাদের জন্মই এই সূত্রে। এক দিকে আইনের যুক্তিতে গোটা সমাজের উপরে সার্বভৌম ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, আর অন্যদিকে আধিপত্যের হাত গলে যাওয়া অসংখ্য নাগরিকের/প্রজার বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক স্বার্থের (স্বাধীন) অন্বেষণ। এ দুই প্রবণতার মধ্যে মৌলিক বিরোধ রয়ে গেছে।’

বাজারের অদৃশ্য হাতের তত্ত্বকে এভাবে র‌্যাডিক্যাল ধারায় মহিমান্বিত করার চেষ্টা সবাইকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে টমাস কার্লাইল এই অদৃশ্য হাতের তত্ত্বকে নির্ভর করা শাস্ত্রটিকেই অভিহিত করলেন ‘এক বিষণ্ন বিজ্ঞান’ (ডিসমাল সায়েন্স) হিসেবে। অন্যদিকে অলিভার টুইস্ট, ব্রিক হাউস, হার্ড টাইমস প্রভৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে চার্লস ডিকেন্স ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রকে অস্বীকার করে দেখালেন যে, সমাজের কল্যাণসাধন এই অর্থশাস্ত্রের অভিপ্রায় নয়। শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র্য, বৈষম্য এসব অভিজ্ঞতা মূর্ত হয়ে উঠল তার উপন্যাসে। পরিবেশ দূষণ, অনগ্রসর নগর পরিকল্পনা, কারখানায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধিমালার অনুপস্থিতি, জনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা_ এসব বিতর্ক জন্মে উঠেছিল ইউরোপে আরও পরে; কিন্তু ডিকেন্সের লেখায় এসব বিতর্কের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ডিকেন্সের এই লেখাগুলো যখন প্রকাশিক হচ্ছে, ততদিনে আত্মপ্রকাশ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কার্লাইল ও ডিকেন্সের সমালোচনার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। কার্লাইল ১৮৪৯ সালে অর্থশাস্ত্রকে বলেছেন, ‘বিষণ্ন বিজ্ঞান’; এর ঠিক এক বছর আগে, ১৮৪৮ সালে বেরিয়েছে জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’। বইটি মৌলিক গোত্রের না হলেও স্মিথ-রিকাভো-ম্যালথাসের ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রকে সুপাঠ্যবই হিসেবে বিন্যস্ত করেছিলেন মিল। পরবর্তী প্রায় একশ’ বছর ধরে বাংলার (ও ভারতের) জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতিকরা যেমন, উচ্চপর্যায়ের সরকারি চাকরি-প্রার্থী এদেশের ভদ্র সম্প্রদায়ের প্রায় সবাইকেই মিলের বইটির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল অর্থশাস্ত্রের পরীক্ষায় পাসের জন্য। বঙ্কিমের অর্থনৈতিক চিন্তাতেও এ বইয়ের গভীর প্রভাব ছিল। তবে বঙ্কিম তার বিভিন্ন লেখায় ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণে আরও কিছু প্রসঙ্গের সূত্রপাত করেন, যা তার চিন্তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

অন্যত্র আমি বঙ্কিমচন্দ্রের ১৮৭২ সালের লেখা ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ এবং সে লেখায় অর্থশাস্ত্রীয় বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে আমি তিনটি প্রসঙ্গের পুনরুক্তি করা প্রয়োজন মনে করছি। প্রথমত, দেশের শ্রীবৃদ্ধির (এখনকার পরিভাষায়_ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) প্রশ্নটিকে তিনি সরাসরিভাবে সম্পদ-বণ্টন তথা ভূমি-বণ্টন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করেছিলেন। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বললেন, ‘আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, আমাদের দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে… আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে।’ কী মঙ্গল, তা-ও বললেন। চাষের অধীনে জমি বাড়ছে, রেললাইন বসেছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে, বাণিজ্য দ্রব্য নিয়ে স্টিমার চলছে নদীবক্ষে, শহরে সন্ধ্যার পরে গ্রামের আলো জ্বলছে, ‘ফুলিস্কেপ কাগজে বঙ্গদর্শনের জন্য সমাজতত্ত্ব’ লেখা হচ্ছে, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হচ্ছে, সাহেবদের আসবাবপত্র আসছে, সেই সাথে তাদের আদব-কায়দাও আসছে। এসব বলার পরই এল তার পয়লা সওয়াল : ‘এরই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞসার আছে, কাহার এত মঙ্গল? হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাথায় খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্ম্ম বিশিষ্ট বলছে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে, উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?… দেশের মঙ্গল? দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন?… যেখানে তাহাদের মঙ্গল নাই সেখানে দেশের কোন মঙ্গল নাই।’ অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কোনো সামগ্রিক সূচকই উন্নয়নের সূচক নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কতটা গরিবমুখিন হচ্ছে সেটিই প্রধান বিচার্য।

দ্বিতীয়ত, ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নতুন জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন করেছিল তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন বঙ্কিম। আজকের ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা সে যুগেও ছিল রক্ষণশীল ও জমিদারি ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সমর্থক। এদের সমালোচনা করে বঙ্কিম প্রজাওয়ারী (রায়তওয়ারী) ব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তি দিলেন। তার ভাষায়, লর্ড কর্নওয়ালিস ‘মহাভ্রমে পতিত হইয়া প্রজাদিগের আরও গুরুতর সর্বনাশ করিলেন’_ তিনি ‘রাজস্বের কন্ট্রাক্টরদিগকে ভূস্বামী করিলেন’। অথচ, ”প্রজারাই চিরকালের ভূস্বামী; জমিদারেরা কস্মিনকালে কেহ নহেন_ কেবল সরকারি তহশীলদার। কর্নওয়ালিশ যথার্থ ভূস্বামীর নিকট হইতে ভূমি কাড়িয়া লইয়া তহশীলদারকে দিলেন… এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বঙ্গদেশের অধঃপাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মাত্র কস্মিনকালে ফিরিবে না।” সম্পত্তির উপর মালিকানার ধরন যে অর্থশাস্ত্রের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা, এখানে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, এই অবস্থার যে দ্রুত নিরসন করা যাচ্ছে না, তার কারণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগী শুধু জমিদারেরা নন, উচ্চ শ্রেণীর কৃতবিদ্য লোকেরাও অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্র সম্প্রদায় তথা বাবুরা (এ ‘বাবুদের’ নিয়ে তার একটি স্বতন্ত্র তীক্ষষ্ট ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধও রয়েছে)। বঙ্গদর্শন পত্রিকার শুরুতে ‘পত্রসূচনা’য় বঙ্কিমচন্দ্র স্পষ্ট করে জানালেন যে, বাঙালির উন্নতি বলতে তিনি কখনোই কেবল সুশিক্ষিতের উন্নতি বোঝাচ্ছেন না। তার ভাষ্যে, ‘সমগ্র বাঙালির উন্নতি না হইলে দেশের কোন মঙ্গল নাই। সমস্ত দেশের লোক ইংরেজি বুঝে না, কস্মিনকালে বুঝিবে, এ মত প্রত্যাশা করা যায় না।… সুতরাং বাঙ্গালায় যে কথা উক্ত না হইবে, তাহা তিন কোটি বাঙ্গালী কখন বুঝিবে না, বা শুনিবে না। এখনও শুনে না, ভবিষ্যতে কোন কালেও শুনিবে না। যে কথা দেশের সকল লোকে বুঝে না, বা শুনে না, সে কথায় সামাজিক বিশেষ কোন উন্নতির সম্ভাবনা নাই’। দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিম বাংলা ভাষার জনভিত্তিক প্রসারকে উন্নতির আরম্ভ-বিন্দু হিসেবে দেখেছেন এমনকি অধস্তন ও কৃতবিদ্য শ্রেণীর মধ্যে। ‘সমকক্ষতা’ স্থাপনের একটি পাটাতন হিসেবে দেখেছেন। ভূমি-বণ্টনের অনাব্যতার প্রতিক্রিয়া দেখানোর পাশাপাশি ভাষায় সমকক্ষতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে তিনি শুধু অর্থনৈতিক সমতা-অর্জনের উপায় হিসেবে নয়, দেশের উন্নতির ভিত্তি হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। এভাবে তিনি কার্লাইল-ডিকেন্সের ‘বিষণ্ন বিজ্ঞান’ সমালোচনার উত্তর খুঁজছেন উপনিবেশিক পরিস্থিতিতে। বেন্থাম-মিলের উপযোগীবাদী তত্ত্বকে তিনি সজোরে নাড়া দিচ্ছেন গুরু-শিষ্যের মধ্যকার সমীহ ভাবকে বজায় রেখেই। মিলের ইউটিলিটারিয়ান দর্শন নিয়ে তিনি কমলাকান্তের দফতরেও পরিহাস করেছেন। তার ভাষ্যে আবারও ফিরে যাই ‘এরূপ কখন কোন দেশে হয় নাই যে, ইতর লোক চিরকাল এক অবস্থায় রহিল, ভদ্রলোকদিগের অবিরত শ্রীবৃদ্ধি হইতে লাগিল। বরং যে যে সমাজের বিশেষ উন্নতি হইয়াছে, সেই সেই সমাজে উভয় সম্প্রদায় সমকক্ষ, বিমিশ্রিত এবং সহৃদয়তাসম্পন্ন। যতদিন এই ভাব ঘটে নাই_ যতদিন উভয়ে পার্থক্য ছিল, ততদিন উন্নতি ঘটে নাই। যখন উভয় সম্প্রদায়ের সামঞ্জস্য হইল, সেই দিন হইতে শ্রীবৃদ্ধি আরম্ভ।’ এক অর্থে ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রের যে-উদ্বোধন ঘটেছিল স্মিথ-রিকার্ডো-মিলের হাত ধরে, তার মধ্যে উন্নয়ন অর্থশাস্ত্র ছিল না। এবারে উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রের কিছু মৌলিক উপাদানের প্রতি ইঙ্গিত দিলেন বাংলার প্রথম অর্থশাস্ত্রবিশারদ বঙ্কিমচন্দ্র। তার কথিত সহৃদয়তাসম্পন্ন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকেও হাল আমলের ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ তত্ত্বের পূর্বলেখ বলে মনে হয়।

দুর্ভাগ্য যেটা, তা হলো বাঙালি বলতে বঙ্কিমচন্দ্র বর্ণ-নির্বিশেষে ধর্ম-নির্বিশেষে অভিন্ন জাতিসত্তা বোঝাননি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এই অন্ধত্ব বিশেষ করে দেখা দিয়েছিল বাংলার মুসলমান সমাজকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে। দেশের শ্রীবৃদ্ধির অসঙ্গতির আলোচনায় পরান মণ্ডল, হাসিম শেখ ও রাজা কৈবর্ত্তের উল্লেখ তবু পাই, কিন্তু জাতি-নির্মাণের প্রকল্পে কোথাও ‘হাসিম শেখ’কে দেখতে পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক চিন্তায় বঙ্কিমচন্দ্র সমতাবাদী, কিন্তু রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় তিনি যে নেশনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেখানে মুসলমানদের স্থান করে দেননি। ১৯৬৪ সালে আবুজাফর শামসুদ্দীন এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র ফরাসি বিপ্লব নিয়ে পড়েছেন। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কেও জানতেন, সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি নিয়েও কখনও কখনও প্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে হিন্দুর ধর্মীয় পুনরুত্থান ছাড়া আর কিছুই যে বুঝতে পারেননি এটি একটি ঐতিহাসিক আশ্চর্য! এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রথমবারের মতো উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রে যে বাঙালি চিন্তকের মধ্যে মৌলিকত্ত্ব কিছুটা লক্ষ্য করা যায়, সেই চিন্তকের মধ্যেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে সুগভীর ফাটল থেকে গিয়েছিল। ফলে কার্লাইল-ডিকেন্সের বিষণ্নতার কলঙ্ক থেকে অর্থশাস্ত্রকে মুক্ত করা বঙ্কিমের মতো তীক্ষষ্টধীর পক্ষেও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এক অর্থে এটি একটি ব্যর্থতার মডেল হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তী বছরগুলোয়। অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে প্রাগ্রসর ধারণার আশ্রয়ের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে অনগ্রসর ধারণাকে লালন করার এই পরস্পরবিরোধী ধারা উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথমার্ধের অনেক বাঙালির তত্ত্ব চর্চার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মোরশেদ শফিউল হাসানের অধুনাকালের গবেষণা ‘পূর্ব বাঙলায় চিন্তাচর্চা ১৯৪৭-১৯৭০ : দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়া’ গ্রন্থে যেসব আকর-উপাদান জড়ো করা হয়েছে, তাতে করে পাকিস্তান-উত্তর পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাঙালি মুসলিম ‘রেনেসাঁ’ পর্বের বিভিন্ন মুসলমান চিন্তাবিদের মধ্যেও বঙ্কিম-প্রদর্শিত ফাটলের পথ ধরে চলবার প্রবণতা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। আকরম খাঁ থেকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবুল হাশিম, আবুল মনসুর আহমদ থেকে আবুল ফজল কেউই বঙ্কিম-প্রদর্শিত স্ববিরোধিতার পথ থেকে নিজেদেরকে আড়াল করতে পারেননি।

৩. দুর্ভিক্ষের অর্থনীতি

অমর্ত্য সেন যেসব কারণে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল দুর্ভিক্ষের কার্যকারণ নিয়ে তাঁর মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিনস্’। যেটা লক্ষ্য করার তাহলো দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যেসব রচনা পাওয়া যায় তার মধ্যে সেন-উলি্লখিত কার্যকারণের একটি পূর্ব অনুমান মেলে। ১৭৭০-এর মহামন্বন্তর (যার ফলে, সরকারি হিসাবেই অবিভক্ত বাংলার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী মৃত্যুবরণ করেছিলেন) অমর্ত্য সেনের গ্রন্থের আলোচনায় আসেনি। যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়নি উনিশ শতকের অন্তত ৫টি দুর্ভিক্ষ, যথাক্রমে ১৮৬৫/৬৬, ১৮৭৩/৭৪, ১৮৮৪, ১৮৯১/৯২ ও ১৮৯৫/৯৭। তিনি তার গ্রন্থে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর ও বাংলাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কার্যকারণ ও সংঘটন।

তবে সাহিত্যের আকর-উপাদান খুঁজলে বাংলার বিভিন্ন দুর্ভিক্ষের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়, যাতে শুধু সেনের এনটাইটেলমেন্ট তত্ত্বের প্রমাণ্যতাই মেলে না, পাওয়া যায় আরও বাড়তি কিছু উপাদানের অস্তিত্ব। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি মুসলমান-বিদ্বেষী উপাদানের কারণে এখন অনেকটাই অর্থনৈতিক ডিসকোর্সের বাইরে। এমনকি অর্থশাস্ত্রের ছাত্রছাত্রীরাও দুর্ভিক্ষের অর্থনীতি বোঝার প্রয়োজনে কদাচিৎ ‘আনন্দমঠ’ পড়ে দেখতে চান। বঙ্কিম অবশ্য ‘আনন্দমঠ’ লিখেছিলেন ১৭৭০-এর মহামন্বন্তর ঘটে যাওয়ার একশো বছর পরে (১৮৮০ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত)। এই দুর্ভিক্ষের আকর-উপাদান তিনি জড়ো করেছিলেন হান্টার সাহেবের লেখা ‘দ্য এনালস্ অব রুরাল বেঙ্গল’ পড়ে। দুর্ভিক্ষ বোঝার দৃষ্টিকোন থেকে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি পড়লে কয়েকটি সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে।

প্রথমত, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষের পেছনে প্রকৃতিসৃষ্ট কিছু উপাদান (যেমন দুর্ভিক্ষের আগের পরপর তিনটি বছরেই ভালো ফসল না হওয়া) ক্রিয়াশীল থাকলেও একে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষই বলতে চেয়েছেন লেখক। সামগ্রিকভাবে সুশাসনের অভাব একটি বড় কারণ ছিল এই দুর্ভিক্ষের পেছনে। মনে রাখতে হবে যে এই সময়ে কোম্পানির শাসনের গোড়া পত্তন হচ্ছিল। ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের পর, বিশেষত ১৭৬৫ সালের পর থেকে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসন গেড়ে বসতে থাকে। ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ হয় এমনই একটি উত্তরণকালীন পর্যায়ে_ যখন না কোম্পানি না দেশীয় নবাবেরা (যেমন রেজা খাঁ) পূর্ণ শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম হচ্ছিলেন। আর উত্তরণকালীন পর্যায়ের সুযোগ নিয়ে শাসনব্যবস্থায় অরাজকতা নেমে এসেছিল। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা সরাসরিভাবে মহাজনী কারবারে যেমন, তেমনি প্রত্যক্ষভাবে লুণ্ঠনকার্যেও জড়িত হয়ে পড়েন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট-এর কালে এডমন্ড বার্কের উত্থাপিত অভিযোগে এটি ছিল একটি বড় বিষয়। দ্বিতীয়ত, প্রচণ্ড খরার মুখে বাংলার ‘চৈতালি’ শস্যের বিনষ্ট হওয়ার পরিস্থিতিতে সরকার বছরের গোড়াতেই কোম্পানির সেনাবাহিনীর জন্য ‘৮০ হাজার মণ চাল মজুদ করার’ নীতি নেয়। ফলে বাজারে দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো চালের সরবরাহ আরও কমে যায়। তৃতীয়ত, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসে ব্যাপকভাবে কুটিরশিল্পের ধ্বংসের কারণে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, সে সময়ে রাজস্ব-সংগ্রহের ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আসে। মোগল আমলে গোটা গ্রাম সমষ্টিগতভাবে রাজস্ব দিত। গ্রামপ্রধান সে রাজস্ব সংগ্রহ করে মোগল সরকারের ঘরে পাঠিয়ে দিতেন। উত্তরণশীল এই পর্বে গ্রামভিত্তিক রাজস্ব সংগ্রহের পরিবর্তে ব্যক্তি বা পরিবারভিত্তিক রাজস্ব-ব্যবস্থা চালু হলো এবং সেটাও করা হলো ভিন্ন উপায়ে। আগে যেখানে উৎপাদিত শস্যের হিসাবে খাজনা দেওয়া হতো, এখন সেটা হতে থাকল নগদ অর্থে। দুর্ভিক্ষের আলামত সত্ত্বেও রাজস্ব-সংগ্রহের মোট পরিমাণ কমল না। আকাড়ার সময়ের সুযোগ নিয়ে মজুদদারি করে চালের ব্যবসায় এ সময়ে বিনিয়োগ করেছিলেন রাজকর্মচারীরা। সুপ্রকাশ রায় তার ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইতে জানিয়েছেন যে, ‘বাংলা ও বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক, তাহাদের সকল আমলা-গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান, চাউল ক্রয় করিতে লাগিল’। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রশাসনিক নির্দেশে আন্তঃজেলা খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্র নিজেই যেখানে মজুদদারি, ব্যবসায় নিয়োজিত সেখানে শুধু বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’কে এখানে দোষ দেওয়া চলে না। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল আন্তঃজেলা খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানি অবাধ করে দেওয়ার পক্ষে জোরালো অভিমত রেখেছিলেন।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এসব উপাদান ছাড়াও আরও রয়েছে দুর্ভিক্ষের ক্রমবিস্তৃতির বিবরণ, এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের মাংস মানুষে খাওয়ার আতঙ্ক উদ্রেককারী উল্লেখ। দীর্ঘ উদ্ধৃতির এখানে সুযোগ নেই, তারপরও একটি ছোট্ট বিবরণ দিচ্ছি যার থেকে দুর্ভিক্ষের বিস্তৃতির বিভিন্ন পর্যায়কে বিশ্লেষণাত্মক উপায়ে শনাক্ত করা সম্ভব:

‘অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল। রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল। তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল। তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না, [ওদিকে সরকার] একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয় দিল।… লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিত আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়! উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল, গোরু বেচিল, লাঙল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কেনে! খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাষ খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল।… অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’

১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষের যে বিবরণ ‘আনন্দমঠ’-এ পাই তার সঙ্গে বিভূতিভূষণের ‘অশনিসংকেত’-এর তুলনা করলে আধুনিক দুর্ভিক্ষের সঙ্গে অষ্টাদশ-উনিশ শতকের দুর্ভিক্ষের বেশ কিছু মিল ও অমিল চোখে পড়বে। যারা চরম দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে অর্থশাস্ত্রীয় গবেষণায় উৎসাহী তাদের জন্য। এরকম সাহিত্যিক তুলনা-প্রতিতুলনা বিরল অন্তর্দৃষ্টি জোগাতে পারে। ‘অশনিসংকেত’ উপন্যাসে (দুর্ভিক্ষ যখন দানা বাঁধছে) গঙ্গাচরণ চালের ব্যবসায়ী কুণ্ডু মশায়কে জিজ্ঞেস করলেন_ ‘ধান চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?’ উত্তরে কুণ্ডু মশায় বললেন, ‘কি করবো বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুঠ হবার পর কি করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন। সবারই সে দশা। তারপর শুনচি পুলিসে নিয়ে যাবে চাল কম দমে মিলিটারির জন্যে’। জাপানের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে রেঙ্গুন থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেল, জাপানের সঙ্গে আরও বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ইচ্ছে করেই ভেঙে দেওয়া হলো। মজুদদারি ব্যবসা তো ছিলই। সাধারণ ব্যবসায়ী ও কিছুটা অবস্থাপন্ন গৃহস্থেরাও যাকে বলে ‘প্যানিক হোর্ডিং’ করা শুরু করল। সরকার বাহাদুর নিজেই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আমদানিকৃত চালের একটা বড় অংশ পাঠিয়ে দিলেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধরত সেনাদের কাছে। এই নীতির জন্য সাম্প্রতিক এক গবেষণায় চার্চিলকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। আর দেশের ভেতরে বড় বড় আড়তদারকে বাধ্য করা হলো সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে। এই ধান ক্রয় করা হতো কন্ট্রাক্টরদের মাধ্যমে_ এর মধ্যে সে সময় বড় ভূমিকা পালন করেছিল পরবর্তীকালের শিল্পপতি ইস্পাহানির মতো ব্যবসায়ী গ্রুপেরা। অর্থনীতিবিদ আবদুল্লাহ্ ফারুক তার ‘কয়েকজন বাঙালী শিল্পোদ্যোক্তার জীবনী’ বইতে জানিয়েছেন যে, এ সময় মজুদদারি ও ফাটকাবাজি ব্যবসায় লগি্ন করে লাভবান হয়েছিলেন ‘দানবীর’ রণদাপ্রসাদ সাহারাও। তাই উপন্যাসে কুণ্ডু মশাইকে গঙ্গাচরণ বলছেন, ‘বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক। নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে’। উত্তরে কুণ্ডু মশাই বললেন, ‘বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কন্ট্রাক্টরদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি।’

তারাশংকরের ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসে পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম থেকে বিজয় নীলাকে লিখেছে, ‘এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি_ ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজমা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত ধান টেনে নিচ্ছে।’ সরবরাহে ঘাটতির কারণে বাজারে চালের দামও বাড়ছিল দ্রুত হারে। সুব্রত রায় চৌধুরী তার ‘কথাসাহিত্য মন্বন্তরের দিনগুলিতে’ বইতে বিভূতিভূষণের ‘অশনিসংকেত’ থেকে চালের দামবৃদ্ধি সম্পর্কে একটি সারণি উপস্থাপন করেছেন। তাতে দেখা যায়, সে বছর ফাল্গুনে চালের দর মণপ্রতি ছিল ৬ টাকা, সেটা চৈত্রের শেষে দাঁড়ায় ২০ টাকা। আশ্বিন মাসে অনঙ্গ বৌ মতিকে বলছে যে, চালের দাম দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকায়। অন্যদিকে, উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের পারিশ্রমিক ছিল নিম্নরূপ_ গঙ্গাচরণের ক্ষেত্রে মাসিক আয় ১২ টাকা, দুর্গা পণ্ডিত পেতেন মাসে ৬ টাকা ৪৫ পয়া, নবীন বাড়ূই পেতেন দৈনিক ১৬ আনা করে, আর জেলে বৌ আরও কম_ দৈনিক ১০-১২ আনা করে। চালের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এদের সকলেরই প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছিল কয়েক মাসের মধ্যেই। এক পর্যায়ে নবীন বাড়ূই, জেলে বৌ বা মতি মুচিনীর হাতে কোনো কাজও ছিল না। মতি তো মারাই গেল। অর্থাৎ সাহিত্যেও অমর্ত্য সেন-ব্যাখ্যাত এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্ট তত্ত্বের ন্যারেটিভ বিশ্বস্ততার সঙ্গে রূপায়িত হচ্ছিল।

দুঃখের বিষয়, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজটি বঙ্কিমচন্দ্র ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজটি বিভূতিভূষণ (বা তারাশংকর) করেছিলেন ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে বা অন্যত্র কোনো বিশ্বস্ত সাহিত্যিকে বিবরণী আমরা পাইনি এখনো। সত্তর-আশি দশকের বাংলাদেশের অব্যাহত সুশাসনহীনতা, রাজনৈতিক খুন ও গুমখুন, সামরিক শাসনের অভ্যুদয়, লুটপাটের অর্থনীতি এরকম নানা উপসর্গের পেছনে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও দুর্ভিক্ষজনিত মূল্যবোধের ক্ষয় একটি মৌলিক বিনাশের সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। অন্তত এমনটাই আমার কাছে মনে হয়েছে। ১৯৭৪ নিয়ে নীরবতা এদেশের সাহিত্য ও অর্থনীতি চর্চা উভয়ের ক্ষেত্রেই ফলদায়ী হয়নি। কবিরা স্পষ্টভাষী বলে সে সময়ে কিছুটা পরিমাণে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। রফিক আজাদ যেমন লিখেছিলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’। শহীদ কাদরীও তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম দেন_ ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’। শামসুর রাহমানও লিখেছেন, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ বা ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’র মতো কাব্য-শিরোনাম। তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। সাধারণভাবে আমাদের সুবাধ্য সুশীল সমাজ ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ও তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো অব্যাখ্যাত কারণে নীরব থাকাটাকেই শ্রেয়তর অবস্থান বলে মনে করেছে।

লেখক
গবেষক
প্রাবন্ধিক