বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদগুলোর আলোচনার মূল বার্তা ছিল তিনটি। প্রথমত, প্রথাগত সমাজতন্ত্র ও প্রথাগত (পুঁজিবাদী) গণতন্ত্রের বাইরে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ একটি নিজস্ব অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রয়ে গেছে। মার্কসীয় ও অ-মার্কসীয় উভয় ধারার মধ্য থেকেই এটি যুক্তিতর্ক-রসদ আহরণ করেছে। বার্নস্টাইন থেকে বার্নি স্যান্ডার্স, রবীন্দ্রনাথ থেকে বঙ্গবন্ধু নানাভাবে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ প্যারাডাইম দাঁড় করাতে সাহায্য করেছেন। দ্বিতীয়ত, এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র নানা দেশে নানা রূপ ধারণ করতে পারে দেশ-জাতি-ভূগোল এসব অবস্থা ভেদে। তবে বিভিন্ন সম্ভাব্য রূপ সত্ত্বেও আমরা মোটা দাগে দুটি ‘টাইপ’ আবিষ্কার করতে পারি। প্রথম ‘টাইপটি’ হচ্ছে, উন্নত ধনবাদী দেশের ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’, যার সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষে জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসডিপি)-এর দ্বারা। এই ধারার মূলে ছিল ১৮৯১ সালের ‘এরফুর্ট প্রোগ্রাম’। এই কর্মসূচি ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’-এর অন্তর্ভুক্ত ইউরোপীয় পার্টিসমূহের প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে, ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে বের হয়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিসমূহ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারাকে আরও বলিষ্ঠ ও জনপ্রিয় করে তোলে, এবং এসব দেশে রাষ্ট্রক্ষমতাতেও আসতে সক্ষম হয়। এর প্রভাব পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে এই পারস্পরিক প্রভাবের কারণে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ব্যাপক চর্চার পাশাপাশি গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ প্রতিষ্ঠা পায়। পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের এসব দেশে কথিত সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক ধারণা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ দুইয়ের মধ্যে অন্তিম লক্ষ্যে‒ অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্যও ছিল। যা হোক, যেটা বিশেষভাবে বলা দরকার, প্রথম টাইপের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মডেল তৃতীয় বিশ্বের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক ছিল না। এর মূল কারণ, ইউরোপ ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে অবস্থার মৌলিক পার্থক্য। যেন দুই পৃথিবী দুই ‘ভিন্ন সময়ে’ বাস করছিল: একটি ছিল ‘আধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেমোক্রেসি’ আর আরেকটি ছিল প্রাগ-আধুনিক পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান ‘দুর্বল গণতন্ত্র’। দুই জায়গাতেই শোষণ-বঞ্চনা, শ্রেণিভেদ-জাতিভেদ ছিল, কিন্তু সোশ্যাল কনটেস্ট, জনগণের মূল্যবোধ এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল ভিন্ন। এই শেষোক্ত পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদল কীরূপ দাঁড়াতে পারে তা নির্ধারণের দায়িত্ব এসে পড়ে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের ওপরে। তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কারণে প্রথম থেকেই পুঁজিবাদ-বিরোধিতা ও সমাজতন্ত্র-অভিমুখীনতা একটি স্পষ্ট ধারা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখানে চলছিল রণজিৎ গুহ যাকে বলেছেন‒ Dominance without hegemony, কোনো প্রকার ‘সম্মতি’ আদায় করা ছাড়াই প্রত্যক্ষ নিবিড় শোষণ বা প্রভুত্ব-আরোপ। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বেগম রোকেয়া, প্রমথ চৌধুরী, নজরুল, কাজী আব্দুল ওদুদ, এমনকি পরবর্তীকালে এ দেশের প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক সমাজতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁরা সকলেই গণতন্ত্রও চেয়েছেন, আবার সমাজতন্ত্রও চেয়েছেন– একটির জন্য অন্যটিকে বিসর্জন দিতে রাজি হননি। বঙ্কিম লিখেছেন ‘সাম্য’; রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন (উগ্র) জাতীয়তাবাদ বিরোধী ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধত্রয়ী, ‘রাশিয়ার চিঠি’ এবং ‘সভ্যতার সংকট’; বিবেকানন্দ লিখেছেন ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্র’; নজরুল সম্পাদনা করেছেন বামপন্থি পত্রিকা ‘লাঙল’, লিখেছেন ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ এবং ‘মৃত্যুক্ষুধা’ শীর্ষক রাজনৈতিক উপন্যাস, যেখানে সরাসরিভাবে সর্বহারা, রুশ বিপ্লব ও শ্রমিকশ্রেণির কথা এসেছে; প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন ‘রায়তের কথা’; আবুল হুসেন লিখেছেন ‘বাংলার বলশী’; এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। রাজনীতিবিদেরাও– মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ সবাই বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই আদর্শকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উন্নত ধনবাদী দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বলা চলে না। তারা অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিচার করে বুঝেছিলেন, পশ্চিম ইউরোপের স্টাইলে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, এমনকি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ গঠন করা এ দেশের কোনো সরকারের পক্ষে আর্থিক সামর্থ্যের অভাবের কারণেই প্রায়-অসম্ভব। আবার, তারা এ-ও বুঝেছিলেন যে ভিন্নতর সামাজিক-শ্রেণি কাঠামো, রক্ষণশীল মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি মনোযোগ এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এসবের কারণে বাংলাদেশের মতো সমাজ-পটভূমিতে চীন-সোভিয়েত স্টাইলের অথরেটিরিয়ান সোশ্যালিজমের প্রতিষ্ঠা করাও প্রায়-অসম্ভব প্রস্তাব। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নিকটবৃত্তের সহকর্মীদের জন্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র যেমন একটি সম্ভাবনার আলো দেখিয়েছিল, তেমনি ছুড়ে দিয়েছিল এক বিশাল তাত্ত্বিক ও পলিসি চ্যালেঞ্জ। এসবের প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে স্বাধীনতার আগে ও পরে শেখ মুজিবের বিভিন্ন স্টেটমেন্ট ও ভাষণ; তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ডকুমেন্টস্; ১৯৬৬ সালের ৬-দফা, ১৯৬৯ সালের ১১-দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ও ১৯৭২ সালের সংবিধান; প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিল; স্বাধীনতার পরে স্বল্প সময়ের মধ্যে হাতে নেওয়া প্রতিকূল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বিশ্ব-পরিস্থিতিতে গৃহীত বিভিন্ন নীতি-পদক্ষেপ। এসবের বিচারের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি ‘অবয়ব’ আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। যার তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক ও আদর্শিক প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনেও সুপ্রচুরভাবেই রয়ে গেছে। এর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা অবশ্য বর্তমান প্রবন্ধের আয়ত্তের বাইরে। আমরা প্রবন্ধের এই অংশে শুধু বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রধান সাতটি বৈশিষ্ট্যের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করব। ১৬.১। মিশ্র অর্থনীতি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো এর ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ চরিত্র। যদিও ‘মিশ্র অর্থনীতি’ (mixed economy) শব্দটি তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ডিসকোর্সের ‘লেঙ্কিনে’ প্রবেশ করেনি– বাহাত্তর সালের গণপরিষদ বিতর্কে কদাচিৎ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে– তাহলেও পরিকল্পনাবিদদের ‘অ্যাপ্রোচ’ ছিল এটাই। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা ছিল ‘রাষ্ট্রীয়’, ‘সমবায়ী’ ও ‘ব্যক্তিমালিকানার’ কথা। একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশকে আধুনিক শিল্পোন্নত স্তরে উন্নীত করতে গেলে সচেতনভাবে বহু-গাঠনিকতাকে (multistructuralism) লালন করতে হবে। পশ্চাৎপদ অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ শুধু দীর্ঘই হবে না, এটি হবে বহু-গাঠনিক কাঠামোসম্পন্ন। অর্থাৎ, এখানে যেমন থাকবে খুদে উৎপাদকদের খাত, তেমনি থাকবে সমবায়ী খাত; এর পাশাপাশি থাকবে পুঁজিবাদী খাত নানা টাইপের; আর থাকবে শক্তিশালী ও দক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত। এ সম্পর্কে লেনিন ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ নীতিমালা আলোচনার সূত্রে পথিকৃত আলোচনা করেছিলেন সেখানে থাকতে হবে শক্তিশালী ও দক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত– যেটি পরিকল্পনামতো স্ট্র্যাটেজিক খাতসমূহে বিনিয়োগ করবে এবং জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় আয়/সম্পদ পুনর্বণ্টনমূলক পদক্ষেপও নেবে। স্বাধীনতার উষালগ্নে অবাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল, তাদেরকে জাতীয়করণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। বাংলাদেশে ‘জাতীয়করণ’ নীতি যথেষ্ট কড়াকড়ি করে করা হয়; এজন্যে সংবিধানে ৪৭নং ধারা যুক্ত করা হয় যার বলে যে কোনো শিল্পকে জাতীয় স্বার্থে ‘ন্যাশনালাইজ’ করার এখতিয়ার সংসদকে দেওয়া হয়। কোনো কোর্ট বা বিচার ব্যবস্থা এই জাতীয়করণের উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করতে পারত না। বঙ্গবন্ধু এই কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন। কারণ, তার যৌক্তিক ভয় ছিল যে বিদেশ থেকে কলকারখানার অবাঙালি মালিকরা উচ্চ আদালতে জাতীয়করণের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন। ঠিক একই কারণে বাঙালি মালিকানাধীন ইপিআইডিসি-সমর্থিত মুষ্টিমেয় কলকারখানাকেও জাতীয়করণ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। কেননা, একে তো এদের একটি অংশ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন; তদুপরি যারা করেননি, তাদেরকে তাদের পাকিস্তান আমলের কলকারখানা রাখতে দিলে অবাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানাকে জাতীয়করণ করা যেত না, বা সেটা উচ্চ আদালতে অবধারিতভাবে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। যেহেতু ১৯৭২ সালে এ দেশের বৃহদায়তন কলকারখানার সিংহভাগই (প্রায় ৮০ শতাংশ শিল্প-পরিসম্পদ) ছিল অবাঙালি মালিকানাধীন, এই প্রশ্নে কোনো ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ ছিল না সদ্য-স্বাধীন দেশের সরকারের পক্ষে। এটি বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের মনে ‘হাই-প্রায়োরিটি’ ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত ছিল সেদিন। সংবিধানের খসড়া লেখার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যে দুটো বিষয়ের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেগুলো হলো জাতীয়করণ ও জাতীয়করণকৃত শিল্পের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঝুঁকির বিষয়টি (অন্যটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা দমন ও ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব)। অন্য আরেকটি বিষয়ও বঙ্গবন্ধুর তৎকালের উদ্বেগের কারণ ছিল। সেটি হচ্ছে Floor Crossing নিবারণের জন্য ৭০ নম্বর ধারা। বিষয়টি জটিল। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলের তিক্ত স্মৃতি মুজিবের মনে জাগরূক ছিল। ১৯৫০-র দশকে ‘ফ্লোর ক্রসিং’-এর কারণে প্রায়ই মন্ত্রিসভা ভেঙে যেত এবং সরকারের পতন হতো। সরাসরি সম্পর্কিত নয় বলে সেটি এখানে আলোচনা করা হলো না। আনিসুজ্জামান (২০১৫) লিখেছেন: ‘১৯৭২ সালে বাজেট-বক্তৃতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ বিশেষ শিল্প ও বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাছাড়া ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় এবং তার আগে-পরে নানা দলের ইশতেহারে কিংবা নানারকম সম্মেলনের প্রস্তাবে ব্যাংক, বীমা, চা ও পাটশিল্প প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি ছিল। এ নিয়ে বড় একটা আপত্তিও শোনা যায়নি। কিন্তু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন প্রধান প্রধান শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হলো, তখন ‘গেল, গেল’ রব পড়ে গেল এবং এই ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্যে ভারতের স্বার্থ বা ইঙ্গিত আবিষ্কৃত হলো। সমালোচনা প্রবল হয় বাঙালি মালিকানাধীন শিল্প অধিগ্রহণ করায়। কিন্তু ব্যাংক-ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি পরিচালনাধীন ব্যাংক তার থেকে বাদ দেওয়া কিংবা পাটশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি মালিকানাধীন পাটশিল্প তার আয়ত্তের বাইরে রাখা তো সম্ভবপর ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান আমলের সরকারি উদ্যোগ এবং পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি …।’ ‘গেল, গেল’ রব সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের বক্তব্য আরও খতিয়ে দেখা দরকার। সেসময়ের দৈনিক পত্রপত্রিকা (‘হলিডে’, ‘হককথা’ সহ) ঘেঁটে আমি এর সপক্ষে কোনো ‘প্রকাশিত প্রমাণ’ পাইনি। বরং ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি জাতীয়করণ কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে অতি অল্পই ‘বিরুদ্ধতা’ শনাক্ত করা যায়। জাতীয়করণ করার কারণে রাতারাতি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের চৌহদ্দি বেড়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত শক্তিশালী করা হলেও এই মডেলের সাথে ‘স্টেট-সোশ্যালিজম’ ধারার এক মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্রের ছকে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত বৃহদায়তন কলকারখানার প্রায় ১০০ শতাংশ জাতীয়করণ করে নেয়। কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ– যথা সোভিয়েত ইউনিয়নে– মাঝারি শিল্পের পুরোটাই রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পকে প্রায় পুরোপুরিভাবে ব্যক্তি খাতে রাখা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রমশ ‘সিলিং বাড়িয়ে’ বৃহদায়তন শিল্প-বাণিজ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন উদ্যোক্তা শ্রেণির পলিসি গ্রহণের মাত্রা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার মাত্রাকেও (level of entrepreneurship) বিবেচনায় নিতে হবে। রুশ গবেষক সের্গেই বারানভের মতে, পাকিস্তান আমলের শেষে বৃহদায়তন শিল্প খাতে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা একেবারেই হাতে-গোনা ছিল নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মাত্র ১৬টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপ। বাদবাকি যারা বাঙালি উদ্যোক্তা ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী বা ইন্ডেন্টার, যাদের আধুনিক কলকারখানা চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ১৯৭২ সালে। এটি বিশিষ্ট শিল্পপতি সালমান এফ রহমানও একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন। এই ধারার ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কাছে ইচ্ছে করলেই চটজলদি বৃহদায়তন শিল্প– তা সে একদা অবাঙালি মালিকানাধীন ‘পরিত্যক্ত’ কারখানাই হোক, আর নতুন করে সরকারি ব্যাংক-অর্থায়িত শিল্পই হোক– নিঃশর্তে ছেড়ে দেওয়া যেত না। এটাই প্রধান কারণ কেন ১৯৭৬-১৯৮১ পর্বে অ-সমাজতান্ত্রিক জেনারেল জিয়ার আমলে কোনো কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়কৃত করা হয়নি– এমনকি পাকিস্তান আমলের বাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানাগুলোও ঐ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। জিয়া চেষ্টা করেছিলেন সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ ঢেলে নতুন শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণি সৃষ্টি করার, যারা ভবিষ্যতে আধুনিক কলকারখানা চালাতে সক্ষম হবেন। এই নীতি সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৭৬-৮১ পর্বে প্রদত্ত ১০০০ কোটি টাকা শিল্পঋণের ৯০ শতাংশই আর কখনোই ব্যাংকে ফেরত আসেনি এবং সেদিনের ঋণগ্রহীতাদের ৯৬ শতাংশই ছিলেন আউটরাইট ডিফল্টার। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, ১৯৭২-৭৫ পর্বে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণির ‘বিকাশের মাত্রা’ বিবেচনায় বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রদত্ত ‘সিলিং’ যথোপযুক্তই ছিল অর্থাৎ বেশিও ইনসেনটিভ দেওয়া হয়নি, কমও ইনসেনটিভ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাখ্যাই যথার্থ: ‘ব্যক্তিগত মালিকানা দিয়েছে দেখে সেটার জন্য সমাজতন্ত্রের দাবিদার একটা দল বলেছে যে, এটা সমাজতন্ত্র হয়নি, আবার আর একটা দল বলেছে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যা দেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি, খুব কম দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত মালিকরা বড় ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, দুই দলের কথায় যখন তাঁরা ভয় পেয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁদের কারও কথায় কর্ণপাত না করে আমরা যেটা দিয়েছি, সেটাই তাঁদের গ্রহণ করা উচিত। কারণ, এটা সুসামঞ্জস্য হয়েছে এবং সুসমন্বিত হয়েছে।’ ১৬.২। ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম প্রথাগত সমাজতন্ত্রের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো এটি রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অর্থনৈতিক উদ্যোগকে পূর্বনির্ধারিত আদর্শের বা আইডিওলজির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে একটি প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছে। এই প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মতো ১০০% বা ৮০-৯০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার’ অর্থনীতি না করে মালিকানা-সম্পর্কের (property relations) বিষয়টিকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত করা। কৃষিপ্রধান ও বন্যা/দুর্যোগপ্রবণ অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির অপরিসীম গুরুত্ব বঙ্গবন্ধুর নানা বক্তৃতায় সেসময়ে উঠে এসেছে। এর জন্য সবধরনের মালিকানা-সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছিল মুজিব সরকার। দ্বিতীয় কথা হলো, বিভিন্ন ধরনের মালিকানার মধ্যে ‘অনুপাত’ কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। কোনটা কখন কোন খাতে প্রাধান্য পাবে, সেই প্রশ্নটিকে কালক্রমে পরিবর্তনযোগ্য বলে ভাবা হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে সরকারি-বেসরকারি-সমবায়ী খাতের মধ্যে তুলনামূলক গুরুত্ব পরিবর্তিত হবে এটাই ছিল উপলব্ধি। গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য– উদাহরণস্বরূপ বলছি– ব্যক্তিমালিকানাধীন স্ব-উদ্যোগের পাশাপাশি সমবায়ী-উদ্যোগ বা গ্রুপ-উদ্যোগ বা যৌথ-উদ্যোগের ভূমিকা সময়ের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মোট কথা, বিভিন্ন মালিকানা সম্পর্কের মধ্যে রেশিও (Ratio) কী দাঁড়াবে, ‘পরিকল্পনা’ ও ‘বাজার’-এর মধ্যে তুলনামূলক ঝোঁক কীরূপ হবে, তা খাতভেদে এবং সময়ের সাথে বদলাবে। দেশের মানুষের পছন্দ-অপছন্দও এখানে বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি বারবার এনেছেন ‘মাল্টিপারপাস’ কো-অপারেটিভের ওপরে নিরীক্ষামূলক কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে: কোনোক্রমেই জবরদস্তি করা যাবে না; ব্যাপারটা পরীক্ষামূলকভাবে সফল হলে তবেই ছড়িয়ে দেওয়া হবে; যার যার কৃষিজমি তারই মালিকানায় থাকবে। প্রথাগত সমাজতন্ত্রে এই বিষয়গুলো মানা হয় না। জবরদস্তিমূলক সমবায়ীকরণ এ কারণেই ঘটেছে নানা সমাজতান্ত্রিক দেশে, আর এর প্রতিফল উৎপাদন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হয়েছে মারাত্মক। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে মালিকানা-সম্পর্কের বিষয়টিকে উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা ও জনকল্যাণের অধীন পলিসি-ডিসিশন হিসেবে দেখা হয়েছে। এ জন্যই আমরা বলেছি যে, ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের এই ‘বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান’ সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিদেশি অর্থনীতিবিদ-বিশেষজ্ঞদেরও নজর পড়েছিল। শেখ মুজিবের প্রায়োগিক ও বাস্তবজ্ঞানমণ্ডিত মনের কথা যখন উঠলই, তখন আরও একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চাই। পাকিস্তানের অপশাসনের দিনগুলোর কথা মনে করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তার ‘ক্রমান্বয়ে চলার নীতি’: ‘আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৭ বৎসর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি জানি এদের সঙ্গে মানুষ থাকতে পারে না। আমি ইম্পেশেন্ট হই না, আমি অ্যাডভেনচারিস্ট নই। আমি খোদাকে হাজের নাজের জেনে করি, চুপি চুপি, আস্তে আস্তে মুভ করি সবকিছু নিয়ে।’ এদিক থেকে দেখলে শেখ মুজিব ও দেং শিয়াও পিং-এর মধ্যে একটি প্রচণ্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরা দু’জনেই ছিলেন (রবিনসনের ভাষায়) ‘প্র্যাকটিক্যাল ও প্র্যাগমেটিক’ মনের মানুষ। দেং শিয়াও পিং-এর মতো মুজিবও বলতে পারতেন যে বিড়াল কালো না সাদা সেটা বড় কথা নয়, এটি ইঁদুর ধরতে পারে কিনা সেটাই চূড়ান্তভাবে বিচার্য। মুজিবও এ রকম উদাহরণ দিয়ে তার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেছেন। ‘লার্নিং বাই ডুয়িং’-এর কথা বলেছেন তিনি: ‘কেউ করে শেখে, কেউ দেখে শেখে, আর কেউ বই পড়ে শেখে। আর সবচেয়ে যে বেশি শেখে সে করে শেখে।’ যারা আইডিওলজির চশমা পরে পৃথিবীটাকে দেখে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন মাটির কাছাকাছি থাকার কথা: ‘এদের আমি বলতাম, জনসাধারণ চলেছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলেছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।’ প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, জনকল্যাণের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া, অথবা স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য পূরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থেকে সরে আসা। সেটি স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুর পূর্বাপর ‘একচেটিয়া পুঁজি’বিরোধী অবস্থানের মধ্য দিয়ে। ১৬.৩। একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে অবস্থান পুঁজিবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ সমার্থক ধারণা নয়, যদিও পুঁজিবাদী বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে ‘মনোপলি ক্যাপিটালিজম’-এর আবির্ভাব হয়। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের তৃতীয় বৈশিষ্ট ছিল একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত ও অনমনীয় অবস্থান। কোনোভাবেই পাকিস্তান আমলের মতো ‘বাইশ পরিবারের’ হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত হতে দেওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্যারাডাইমের জন্য একটি মৌলিক ডাইলেমা। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হলো ক্রমশ পুঁজির ‘কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবন’ (centralizaation and concentration of capital)। এর ফলে প্রতিটি খাতেই কমবেশি আগে-পরে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ ঘটতে থাকে। বিংশ শতকের গোড়া থেকে উন্নত ধনবাদী প্রতিটি দেশে (সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ) কার্টেল, সিন্ডিকেট, করপোরেশন প্রভৃতি ‘মনোপলি ফরমেশন’ ঘটতে থাকে। এখনকার দুনিয়ায় ট্রান্সন্যাশনাল, মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশন এবং ‘বিগ বিজনেস হাউস’ ছাড়া আধুনিক পুঁজিবাদকে কল্পনাই করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব বৃহৎ করপোরেট পুঁজির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের (technological leadership) কারণে। এর প্রচলিত উদাহরণ হেনরি ফোর্ড থেকে বিল গেটস অবধি বিস্তৃত। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাড়তি মুনাফা লাভ এবং দ্রুত পুঁজি সঞ্চয়ন অবধারিত হওয়ায় বা করপোরেট পুঁজির বিষয়টাকে আর ক্রিটিক্যালি দেখা যাবে না, ব্যাপারটা এমন নয়। এখানে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের অবস্থান থেকে মূল অভিযোগ তিনটি। প্রথমত, একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশের কারণে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে সমাজে। উন্নত ধনবাদী দেশসমূহে এই লক্ষণ গত তিরিশ বছরে আরও প্রকট হয়েছে। এ সম্পর্কে বিশদভাবে লিখেছেন এবং লিখছেন টমাস পিকেটি (২০১৪), ইমানুয়েল সায়েজ ও গাব্রিয়েল জুকম্যান (সায়েজ ও জুকম্যান, ২০১৯)। এদের নিজস্ব রচনা এবং যৌথভাবে লেখা ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট’ (দেখুন, আলভারেডো ও অন্যান্য, ২০১৮) এ বিষয়ে তথ্য-পরিসংখ্যান জড়ো করেছে। অর্থনীতিবিদরা এ ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী বিজনেস গ্রুপ ও করপোরেশনসমূহের মেজর শেয়ারহোল্ডার এবং ‘ম্যানেজেরিয়াল ক্লাস’-এর জন্য বর্ধিত হারে ক্যাপিট্যাল ও ইনকাম ট্যাক্সের প্রস্তাব করেছেন। আমাদের দেশেও বহুদিন ধরে সম্পদ করের (wealth tax) বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, যদিও এখনও পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে যেতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বিষয়টা শুধু আয়বৈষম্যের নিরিখেও বিচার করলে চলবে না। উন্নত ধনবাদী দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেসব খাতে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশের মাত্রা বেশি, সেসব খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ‘মার্কেট শেয়ার’ তত কম, এবং শেষোক্ত শিল্পে ‘মর্টালিটি রেটও’ তত বেশি। এর কারণ, বৃহৎ করপোরেট পুঁজি আইনি ও বেআইনি যে কোনোভাবেই হোক প্রভাব খাটিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে দেয় না। বৃহৎ পুঁজির হাউসগুলো অনেক সময় নিজেদের মধ্যে এমন কিছু প্রযুক্তিগত ও প্রোডাক্টের ফিচারগত ‘অ্যালায়েন্স’ তৈরি করে নেয়, যার ফলে ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদনকারীরা স্বাধীনভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। সমুদ্রে বড় মাছের পেছনে পেছনে যেমন কিছু ছোট মাছের দল ঘুরে বেড়ায়, বৃহৎ পুঁজির কাছে আনুগত্য স্বীকার করেই কেবল ক্ষুদ্র-মাঝারি পুঁজি ‘মার্কেটে টিকে থাকার’ চেষ্টা করে। এ কারণে প্রতিটি উন্নত ধনবাদী দেশেই শক্ত ধরনের ‘এন্টি-ট্রাস্ট’ আইনের প্রবর্তন করা হয়েছিল গত শতকের ৫০-৬০-এর দশকেই, কিন্তু তারপরও একচেটিয়া পুঁজির ঘনীভবনকে ঠেকানো যায়নি বেশির ভাগ দেশেই। এই সমস্যাটিকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র দৃঢ়ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করবে।
কথাটা প্রথম বলেছিলেন কবি, সমালোচক ও নজরুল-বিশেষজ্ঞ আবদুল কাদির। ১৯৬৪ সালের দিকে কেন্দ্রীয় বাংলা-উন্নয়ন-বোর্ড নজরুলের সমগ্র রচনাবলী প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তার দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় কবি আবদুল কাদির লিখলেন: ‘নজরুল তাঁর সাহিত্য-জীবনের দ্বিতীয় যুগের সূচনায় যে মতবাদের প্রবক্তা হন, তা প্রত্যক্ষত: গণতান্ত্রিক সমাজবাদ (ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজম)। তাঁর পরিচালিত ‘লাঙলে’ হয়েছিল তারই কালোপযোগী কর্ষণা। ‘লাঙল’ছিল ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের’ সাপ্তাহিক মুখপত্র; ১লা পৌষ ১৩৩২ মুতাবিক ১৬ই ডিসেম্বর ১৯২৫ তারিখে প্রথম (বিশেষ) সংখ্যাতেই সে সম্প্রদায়ের ‘উদ্দেশ্য’ও ‘চরম দাবি’ বিবৃত করে নজরুল এক ইশতেহারে বলেন: ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ-স্বাধীনতা-সূচক স্বরাজ লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।’
কবি আবদুল কাদির আরো বললেন যে ‘ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজমের প্রতি নজরুলের মনের প্রগাঢ় অনুরাগ তাঁর ‘সাম্যবাদী’ ‘সর্বহারা’ ও ফনি-মনসা’র বহু কবিতা ও গানে সুপরিস্ফুট। তাঁর ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের ‘আনসার’- চরিত্র এই আদর্শবাদের আলোকে বিকশিত।’ এই ভূমিকাটি লিখিত হয় ১৯৬৭ সালে। অথচ ঠিক তার এক বছর আগে লিখিত ভূমিকাতে কাদির সাহেব এক দ্বিধান্বিত নজরুলের স্বরূপ তুলে ধরতে প্রয়াসী হন। যেন নজরুল এটাও হতে পারেন, ওটাও হতে পারেন। এমনকি নজরুলকে জাতীয়তাবাদী তুর্কী নেতা ‘কামালপন্থী’ বলতেও তার বাধেনি । কাদির সাহেবের দোলাচলের পুরো উদ্ধৃতিটি শোনা যাক । প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তিনি নজরুলের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না এবং শেষাবধি তার নজরুল-বিচারের কম্পাস স্থির হচ্ছে কামাল আতাতুর্কের নামে:
‘নজরুলের দেশাত্মবোধের স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা নানাজনে নানাভাবে করেছেন। রাজনীতিক পরাধীনতা ও আর্থনীতিক পরবশতা থেকে তিনি দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীন মুক্তি চেয়েছিলেন। তার পথও তিনি নির্দেশ করেছিলেন। সেদিনের তাঁর সেই পথকে কেউ ভেবেছেন সন্ত্রাসবাদ-কারণ তিনি ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের উদাহরণ দিয়ে তরুণদের অগ্নিমন্ত্রে আহবান করেছিলেন; কেউ ভেবেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নিয়মতান্ত্রিকতা—কারণ তিনি ‘চিত্তনামা’ লিখেছিলেন; কেউ ভেবেছেন প্যানইস্লামিজম-কারণ তিনি আনোয়ার পাশার প্রশস্তি গেয়েছিলেন; আবার কেউ ভেবেছেন মহাত্মা গান্ধীর চরকা-তত্ত্ব—কারণ তিনি গান্ধীজিকে তাঁর রচিত ‘চরকার গান’ শুনিয়ে আনন্দ দিয়েছিলেন । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, এসব ভাবনার কোনোটাই সত্যের সম্পূর্ণ স্বরূপ উদ্ঘাটনের সহায় নয়। প্রকৃত পক্ষে নজরুল তাঁর সাহিত্য-জীবনের প্রথম যুগে ছিলেন কামাল-পন্থী, কামাল আতাতুর্কের সুশৃঙ্খল সংগ্রামের পথই তিনি ভেবেছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য সর্বাপেক্ষা সমীচীন পথ ৷’
১৯৬৬ সালে নজরুলকে মনে করেছেন ‘কামালপন্থী’ বলে, আবার ১৯৬৭ সালে তাকে চিহ্নিত করেছেন ‘ডেমোক্রেটিক সোস্যালিষ্ট’ বলে। ১৯৭৭ সালে চতুর্থ খণ্ডের ভূমিকায় কবি আবদুল কাদির নজরুলকে সনাক্ত করছেন সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদী বলে। রাজনৈতিক নজরুলকে তিনি চিহ্নিত করছেন এভাবে: নজরুলের ‘সচেতন মনে দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও সমাজতান্ত্রিক মানবিকতা (Socialistic Humanism) রাজনৈতিক চিন্তাদর্শরূপে প্রবলতম প্রেরণার সঞ্চার করেছে।’
কাদির সাহেব কেন এতবার নজরুল সম্পর্কে মত পাল্টালেন সেটি একটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু নজরুলের রাষ্ট্রনৈতিক মত চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রধান ঝোঁকটি বোঝা যায়। আর সেটি হচ্ছে সমাজতন্ত্রের প্রতি নজরুলের ঝোঁক। সাধারণ জনমনে বা এমনকি শিক্ষিত পাঠক সমাজে নজরুল সম্পর্কে যে-‘বিদ্রোহী’ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে সেটি বেঠিক নয়। কিন্তু তাতে করে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শের প্রধান ঝোঁককে চেনা যায় না। ‘বিদ্রোহী’ তিনি তো বটেই, কিন্তু সেই বিদ্রোহ কি ছিল শুধু রাজনৈতিক স্বরাজ বা পূর্ণ-স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ কেবল? এই বিদ্রোহের শত্রু-মিত্র কারা? এটি কি কেবল ব্যক্তি-সত্ত্বারই রুদ্র আত্মপ্রকাশ— যেমনটা পাই তার ‘অগ্নিবীণায়’? নাকি, এটি ছিল সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের পক্ষ থেকে বিদ্রোহ— কৃষক-শ্রমিক-জেলে-ছাত্র জনতার লড়াই? এককথায়, আরো বৃহত্তর সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নজরুল তার ‘বিদ্রোহ’ ও তার ‘সাম্যবাদকে’ দেখেছেন কিনা। অনেক সময় নজরুলকে ‘সাম্যবাদী’ হিসেবে অভিহিত করা হয় ঐ নামের একটি কবিতা-গুচ্ছকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ‘বিদ্রোহী কবি’র মত ‘সাম্যবাদী কবি’ এই অভিধাও নজরুলের রাজনৈতিক স্বরূপকে যথেষ্ট ভাবে প্রকাশ করে না। ‘সাম্যবাদী’কবিতাগুচ্ছের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমতামুখী (egalitarian) চিন্তার শিল্পিত প্রকাশ আছে। কিন্তু এ থেকে আমরা আঁচ করতে পারি না নজরুলের মতাদর্শগত সংশ্লিষ্টতা, সংগঠন-চর্চার ধরণ ও সচেতন রাজনৈতিক-আদর্শিক কর্মকাণ্ডের কোন আদল ৷
আমরা কতজন সবসময় মনে রাখি যে (১) তিনিই বাংলায় প্রথম লিখিত আকারে ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবী উচ্চারণ করেছিলেন; (২) তিনিই বাংলার প্রথম কবি যিনি শুধুমাত্র কবিতা লেখার জন্য এক বছর বৃটিশের জেলে কারাবন্দী ছিলেন; (৩) তিনিই প্রথম বেঙ্গল পেজেন্টস্-ওয়ার্কাস পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যা কমিনটার্ণের পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং যা ছিল ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নিকটতম পূর্বসূরী; (৪) তিনিই প্রথম বৃহৎ শিল্প-কারখানা ও পরিবহন-ব্যবস্থা ‘জাতীয়করণের’ এবং কৃষিতে ‘সমবায়ীকরণের দাবী তুলেছিলেন; (৫) তিনিই ১৯২৫ সালে কানপুরে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় সদস্যদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাদের লেখা নিয়মিত ছাপাতেন ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’ পত্রিকায়, তার মধ্যে ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, মৌলানা হসরৎ মোহানী, আবদুল হালীম, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ । এই শেষোক্ত দলে নজরুলকে প্রকাশ্যে রাখা হয়নি শুধুমাত্র একটি কারণে: একমাত্র নজরুলই সারা বাংলায় পরিচিত ছিলেন কবি, সম্পাদক ও গায়ক হিসেবে। এবং কম্যুনিস্ট পার্টি তার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বৃটিশ-বিরোধী সংগ্রামে। প্রতিষ্ঠা-পর্বের কম্যুনিস্ট সদস্যরা পরবর্তীতে হয় জেলে, অথবা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে বা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন বৃটিশ আমলে ।
তারপরও যেটা এখানে লক্ষ্যনীয়, কমিউনিস্ট বা বলশেভিক মতবাদের প্রচারে, আন্দোলন-সংগঠনের কাজে নজরুল সবসময়ই সক্রিয় সাহায্য-সহায়তা যুগিয়েছেন। সেটা শুধু দূর থেকে ‘মরাল সাপোর্ট’ জানানোর ব্যাপার ছিল না। সাংগঠনিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কাজে মুজফ্ফর আহমদ তাকে নিয়ে চলতেন ও তার সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতেন। তারা দুজনেই আরো কিছু কমরেড সহ থাকতেন কলকাতার ৩৭ হ্যারিসন রোডের বাসায় যেটি একাধারে ‘ধূমকেতু’ ও লাঙলের অফিসও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতিপূর্বে অন্যান্য বাসাতেও তারা একত্রে থেকেছেন। এ ব্যাপারে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন:
‘… ১৯২০ সাল আসতেই আমি স্থির করে ফেলেছিলেম, আমার জীবনের পেশা হবে রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা নয়। উনপঞ্চাশের ব্যাটালিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা অনুসারে কলকাতায় আমার সঙ্গে থাকতে আসে। ফৌজে সে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার ছিল । কথা হয়েছিল যে নজরুল ইসলাম কলকাতায় কাব্য ও সাহিত্য চর্চা করবে এবং রাজনীতিতেও যোগ দিবে।’
এরপর একের পর এক পত্রিকা বের হতে থাকে নজরুল-মুজফ্ফর এদের দ্বৈত-প্রচেষ্টায়-যদিও অগ্রণী ও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন নজরুলই। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৯২০ সালের দিকে প্রকাশিত ‘নবযুগ’ পত্রিকাটি; যদিও সেটি সম্পাদনা করতেন নজরুল ও মুজফ্ফর, ‘প্রধান পরিচালক’ হিসেবে কেবল এ.কে. ফজলুল হকের নাম ছাপা হত । এ.কে ফজলুল হকের আর্থিক সাহায্যে পত্রিকাটি বেরুতো (তখনো তিনি ‘শেরে বাংলা’হননি)। এছাড়াও ১৯২২ সালের দিকে বেরিয়েছে ‘ধূমকেতু’, এবং ১৯২৫ সালের দিকে ‘লাঙল’ । প্রথম দুটিতে প্রধান ‘সম্পাদক’ও প্রধান লেখক ছিলেন নজরুল স্বয়ং; শেষেরটিতে সম্পাদক প্রতিকী অর্থে অন্যরা থাকলেও ‘প্রধান পরিচালক’ ও প্রধান লেখক ছিলেন নজরুলই। অর্থাৎ নজরুলকে সামনে রেখেই মুজফ্ফররা বামপন্থী ও কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
২. ‘ধূমকেতু’রনজরুল
ধূমকেতু প্রথম প্রকাশ পায় ১৯২২ সালের ১১ই আগষ্ট। সপ্তাহে দু’বার করে বার হত ধূমকেতু। তার প্রচ্ছদ- পত্রে কখনো নজরুল থাকতেন ‘সারথী’ রূপে; কখনো ‘প্রতিষ্ঠাতা’ রূপে; কখনো ‘সম্পাদক’ হিসেবে ; কখনো ‘স্বত্বাধিকারী’ হিসেবে। ধূমকেতুর সবগুলো সংখ্যা এখনো গ্রন্থবদ্ধ হয় নি। কিন্তু যেগুলো পাওয়া যায় তার থেকে কয়েকটি প্রবণতা চোখে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে— (ক) ক্রমাগত ভারতে বৃটিশ শাসনের বিরোধীতা; (খ) বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা; (গ) অসহযোগ আন্দোলনের ক্রিটিক্যাল পর্যালোচনা; (ঘ) মুসলিম জাহানের সংবাদ, বিশেষত: কামাল আতাতুর্ক ও তার শাসিত নব-তুরস্কের গল্প; (ঙ) প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই নারীমুক্তি সংক্রান্ত হিন্দু- মুসলিম লেখক-লেখিকার প্রবন্ধ; (চ) লেনিন, রুশ বিপ্লব ও বলশেভিকদের কথা ও কাহিনী; (ছ) দেশের ভেতরে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আন্দোলন-সংগ্রামের রিপোর্ট ও ফিচার প্রবন্ধ; এবং (জ) বিভিন্ন চলতি প্রসংগের ওপরে ধূমকেতুর ‘খাট্টামিঠা টিপ্পনী’ । এই শেষের ধারাটি ‘লাঙলে’ও চালু ছিল এবং পরবর্তী কালে এই বিশেষ ফর্মটি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকাকে প্রভাবিত করেছিল। ধূমকেতুর প্রায় সবগুলো সংখ্যা আমি খুঁটিয়ে পড়েছি। সংখ্যা ধরে ধরে এর বিস্তৃত আলোচনা এই প্রবন্ধের সামর্থ্যের বাইরে। আমি শুধু চুম্বক অংশগুলো উত্থাপন করছি ।
১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯২২ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন ধূমকেতু পত্রিকায় ‘ধূমকেতুর পথ’ সম্পাদকীয়তে নজরুল বৃটিশ শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা চাইলেন । আমার জানা মতে, তার আগে আর কেউ এই বাংলায় সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেশের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ চায় নি। ‘অস্পষ্ট স্বরাজ’ নয়, স্বায়ত্তশাসন নয়, ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস নয়, একেবারে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উঠল নজরুলের কাছ থেকে। তিনি সেই ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করে লিখলেন:
“সর্বপ্রথম, “ধূমকেতু” ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী ক’রে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো।… পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’
শুধু এটুকু লেখার জন্যই রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে ধূমকেতু বাজেয়াপ্ত হতে পারত এবং কবি নজরুলও জেলে যেতে পারতেন । কিন্তু জেলে তিনি গেলেন ধূমকেতুর ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২০-এর লেখাটার জন্য-তাও কবিতা লেখার জন্য। কবিতাটির নাম— ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। আপাত: দৃষ্টিতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার তুলনায় নিরীহ হলেও কড়া কড়া লাইন ছিল তাতে। ‘বিদ্রোহী’কে ব্যাখ্যা করা যেত কবির ‘ব্যক্তিগত বিদ্রোহ’ বলে। সে তুলনায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’কবিতাটি রাজনৈতিক লাইনে ভরপুর। একটি উদাহরণ:
‘বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি’—এই লাইনটি একালের তরুণ পাঠকদের জন্য কিছুটা ব্যাখ্যার দাবী রাখে হয়ত। ১৯১০ থেকে ১৯৩০ পর্বটি ছিল বাংলায় তথা ভারতে বিপ্লবী ‘সন্ত্রাসবাদী’ আন্দোলনের যুগ। ধূমকেতুতে অর্ধেক পাতা জুড়ে ছাপা হত বারীন্দ্র ঘোষ (আলীপুর বোমা মামলার অভিযুক্ত বিপ্লবী ও পণ্ডিচেরীর অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই), ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, উল্লাসকর দত্ত, প্রফুল্ল চাকি, যতীন মুখুয্যে প্রমুখ বিপ্লবীদের ছবি। বারীন্দ্র ঘোষকে নজরুল তার ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন: ‘অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে/ তাই তো তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে।’ ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যার পঞ্চম পাতাতেই বারীন্দ্র ঘোষের আবক্ষ ছবি ছাপা হয়েছিল, তাতে ক্যাপশন ছিল ‘বাঙ্গার প্রথম ধূমকেতু— ফাঁসির বারীন্দ্র।’ তাছাড়া ধূমকেতুর প্রতি সংখ্যাতেই প্রায় অর্ধেক পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন থাকত যা পড়লে সন্দেহ থাকে না কবির পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে । বিজ্ঞাপনে বড় বড় করে লেখা থাকত: ‘বোমার যুগের বারীন্দ্র উপেন্দ্র এবং নলিনী গুপ্ত ও সুরেশ চক্রবর্ত্তীর সব বই আমাদের নিকট পাওয়া যায়।’
এসব থেকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে কবি নজরুল সন্ত্রাসবাদীদের তীব্র দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারপরও তিনি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না এবং সন্ত্রাসবাদকে আদর্শ হিসেবেও কখনো গ্রহণ করেননি । এই একই নিরিখে তাকে কামাল-পন্থীও বলা চলে না । তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সম্পর্কে প্রবল উচ্ছাস ছিল তার। ধূমকেতুর পাতায় নানা জায়গায় তার প্রমাণও রয়েছে। ধূমকেতুর ৮ম সংখ্যায় প্রথম ছাপা হলো সংবাদ যার শুরুতে ছিল ‘কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই’। সংবাদটা ছিল এরকম: ‘গাজী মোস্তফা কামালপাশার জয় হোক । তিনি আজ কদিন হলো বর্ঝর গ্রীসের প্রধান সেনাপতি টিকুপিসকে দশ হাজার গ্রীক সৈন্যসহ বন্দী করেছেন। ‘কামাল- বন্দনা’ নামে কবিতা বেরিয়েছে-লেখিকা সরসীবালা বসু। কামাল পাশা নিয়ে ছোট বড় নানা ধরণের সংবাদ বেরিয়েছে, প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। এই ধূমকেতুতেই ৮ম সংখ্যাতে বেরিয়েছে আবারো-মোসলেম ভারতে’ প্রথম প্রকাশের পর নজরুলের বিখ্যাত কবিতা কামাল পাশা । আমার ধারণা কামালপন্থার প্রশস্তির পেছনে নিছক জাতীয়তাবাদ নয়, আসলে কাজ করছিল এক প্রচ্ছন্ন কাউন্টার-ডিসকোর্স। কামাল আতাতুর্কের সাম্রাজ্যবিরোধী জাতীয়তাবাদ ও লেনিনের বলশেভিজম— এ দুইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক জোট চেয়েছিলেন তিনি । নজরুল আসলে খেলাফতপন্থীদের আর চরকাপন্থী অসহযোগীদের প্রকারান্তরে সমালোচনা করছিলেন কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের প্রশংসা করে । এজন্যই নন-ভায়োলেন্স ভিত্তিক অস্পষ্ট স্বরাজ-আন্দোলনকে সমালোচনা করেছেন নজরুল । ধূমকেতুর একটি সংখ্যায় তিনি লিখেছেন: ‘তোমার হাতে-পায়ে-গৰ্দ্দানে-বাঁধা শিকলে প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে বল দেখি বীর—
“মোরা সবাই স্বাধীন সবাই রাজা।”
দেখবে, অমনি তোমার সকল শিকল সকল বাঁধন টুটে খান খান হয়ে গেছে।’ এ সম্পাদকীয় যেখানে বেরিয়েছে তারই পাশে নজরুল লিখেছেন তীব্র-তীক্ষ্ণ কবিতা: ‘রক্তাম্বর পর মা এবার/জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন।/দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন/বাজে তরবারি ঝনন্-ঝন্ ।’ স্পষ্টতঃই চরকা কাটার ধ্বনির থেকে এটি অন্য সুরের সাধনা করেছে। চরকার বা অহিংসাভিত্তিক অসহযোগের সমালোচনা শুধু নজরুল একাই করেন নি, অন্যদের দিয়ে ও সমালোচনা করিয়েছেন। যেমন, ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতেই বীরেন্দ্রকুমার সেন লিখছেন: ‘আজ কেবল চরকা ও অহিংসার ধূয়া ধ’রে বসে থাকলে যদি ব্যক্তি ও জাতির জীবনের সকল সমস্যার সমাধান না হয়, আমরা যদি জ্ঞান, শক্তি, ঋদ্ধি ও কল্যাণে পরিপূর্ণ হয়ে না উঠতে পারি, তাহলে যে আমাদের হাত-পা গুটিয়েই ব’সে থাকতে হবে তা বলা চলে না। অসত্যের ধ্বংসেই জগতে সত্যের ও শান্তির প্রতিষ্ঠা হ’য়ে থাকে ।’
ধূমকেতুর অধ্যায় ছিল চরকা-বিরোধী মারকুটে র্যাডিকেল জাতীয়তাবাদের ধারায় গড়া। সেখানে নজরুলের পদ্য ও গদ্য অস্বীকারের প্রেরণায় লেখা। সেখানে তার আবেগ বাধা-বন্ধনহীন, ক্রোধ প্রায় পৌরাণিক। আলবেয়ার কাম্যুর মত সেখানে বিদ্রোহেই মানবসত্ত্বার মুক্তি: ‘শিবকে জাগাও, শিবকে জাগাও। আপনাকে চেন। বিদ্রোহের মত বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার, তবে নিদ্রিত শিব জাগবেই। মেরে জাগাও শিবকে। লাথির মত যদি লাথি মারতে পার, তা হ’লে ভগবানও তা বুকে করে রাখে।’ কিন্তু এই র্যাডিকেল জাতীয়তাবাদের মধ্যেও একটি অধিকতর স্থায়ী নিরাবেগ সামষ্টিক সমাজবাদী আদর্শের প্রতি ঝোঁক ক্রমশ: দেখা যাচ্ছে। ধূমকেতুর পাতাতেই তা ক্রমশ: স্পষ্ট হচ্ছে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি, যার থেকে নতুন সমাজ বদলের আদর্শ, বলশেভিজম ও সাম্যবাদের প্রতি অঙ্গীকার দেখা দিচ্ছে। ‘লক্ষীছাড়ার দল’ যারা নিজেদের বলছে তারা এখন বৃহত্তর সাম্যবাদী আদর্শের পাটাতন খুঁজে ফিরছে। শুধু দেশের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার জন্যও আকুতি নানা ভাবে ফুটে উঠছে। ক্রমেই ধূমকেতুর পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে নতুন আদর্শের আলোচনা। ধূমকেতুর ভাষ্যকার এক
জায়গায় ব্যঙ্গ করে বলছেন:
“সেদিন স্বরাজ-পার্কের এক সভায় এক নামজাদা অসহযোগ-পন্থী একটা জীবন্ত সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন । তাঁর মতে বলশেভিজমের ধূমকেতুটা আজ বিষবাষ্পের মতো সমগ্র রুশ মুল্লকটাকে ছারখার করে দিয়েছে। ভাগ্যে সময় থাকতে আমরা এই অহিংস অসহযোগের সুদৃঢ় কেল্লায় আশ্রয় নিয়েছিলুম-নয়ত এর ল্যাজের আগুনে গোটা আৰ্য্যাবৰ্ত্তটাই এতদিনে জ্বলে পুড়ে নাকি ভস্মপিণ্ডি হয়ে যেত!’ অন্যত্র, নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হেমন্তকুমার সরকার এমন একটি শাসনতন্ত্র চাইছেন যেখানে ‘কার্ল মার্কসের সোসিয়ালিজমের শ্রমজাত অর্থনীতিক সাম্য, মিখাইল বাকুনিনের এনার্কিজমের বাহ্যকর্তৃত্ব অপীড়িত মানবাত্মার স্বাধীন সম্মিলন, লেনিনের বলশেভিজমের ধরিত্রীভোগে সমানাধিকার-সে শাসনতন্ত্রে সমস্তই থাকবে। কলা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন মানুষের মনের খোরাক যোগাবে-কৃষক, মজুর দেহের খোরাক উৎপাদন করবে। মধ্যসত্ত্বভোগীর স্থান সে সমাজে নাই। মাথা ও হাত পা খাটিয়ে যারা খাবে তারাই বাঁচবার অধিকারী—অবশিষ্ট সকলের ধ্বংশ অবশ্যম্ভাবী।’ এই হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল ইসলাম দু’বছর বাদে পেজেন্টস-ওয়ার্কাস পার্টির দুই প্রধান কর্ণধার হয়েছিলেন। অনেক সময় পক্ষপাতিত্বের ঝোঁকটি কোনদিকে তা ছোট ছোট সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়েও বোঝা যায় । যেমন, একটি সংবাদে ৩০ শে আশ্বিন ১৩২৯ সালের ধূমকেতু লিখছে:
‘তুর্কীর সাহায্যের জন্য পেট্রোগ্রাডে জোর স্বেচ্ছাসৈনিক সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং গত সপ্তাহে ওদেসা বন্দর থেকে একদল স্বেচ্ছাসৈনিককে তুর্কীর দিকে রওনা করে দেওয়া হয়েছে। এইবার দেখছি, সত্যি সত্যিই গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম হ’য়ে দাঁড়াবে। আমাদের দেশের ছেলেরা কখন যাবে এ গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গমে স্নান ক’রে পবিত্র হ’তে?’
লেনিনের সংবাদও বেরিয়েছে মন্তব্য সহ । ‘আগুণের ফুলকি’ কলামে ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতেই লেখা হয়েছে: ‘মস্কো থেকে খবর এসেছে যে কমিউনিস্ট দলের বৈঠকে মসিয়ঁ কামেনেভ বলেছেন যে, লেনিন খোস্ মেজাজে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী!’ যেসময়ের কথা হচ্ছে (১৯২২ সাল) তখন লেনিনের বা বলশেভিজমের প্রচার একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল ভারতবর্ষে। তবু ঝুঁকি নিয়ে নজরুল এসব সংবাদ ছাপাতে দ্বিধা করেন নি । যেমন, মঙ্গোলিয়া বলশেভিক রাশিয়ার সাহায্য পেয়ে ‘স্বাধীন’ হয়েছে এই সংবাদটি দেয়া হয়েছে এভাবে:
‘পরাধীন জাতির পরম বন্ধু বলশেভিক গবর্ণমেন্টের টাকা-কড়ি লোক-লশকরের সাহায্য পেয়ে মঙ্গোলিয়া এত দিনে দাসত্বের শৃঙ্খল খান্ খান্ ক’রে ভেঙে ফেলেছে।‘
সবচেয়ে অবাক হয়েছি ধূমকেতুর ২য় সংখ্যায় বিখ্যাত বিপ্লবী কমিউনিস্ট রোজা লুকসেমবার্গের সম্পর্কে দেড় কলাম জুড়ে শোকগাথাঁর প্রকাশ দেখে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে কাউটস্কি, লিবকনেট, লেনিন প্রমুখের সহকর্মী রোজাকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রচারের জন্য ১৯১৯ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বার্লিন শহরে। ‘বিদ্রোহী বীরাঙ্গনা’ শিরোনামে তার সম্পর্কে ‘ধূমকেতু’ এভাবে লিখেছে:
‘রোজা জাতিতে পোল। তাঁর বয়স যখন আঠার তখন তিনি [ জার শাসিত ] রুসিয়া থেকে পালিয়ে আসেন। তার পিছনে ছেনালী পুলিশের ফেউ লেগেছিল। ইটালীতে থেকে এই নারী বিপ্লববাদ প্রচার শুরু করেন কিন্তু ইটালীর গভর্ণমেন্ট তাঁর উপর খাপপা হয়ে উঠেন। তখন তিনি সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স হয়ে জার্মেনীতে আশ্রয় ল’ন। জার্মেন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্র ও অর্থনীতির আলোচনা করে তিনি উচ্চতর উপাধি পান।… রুসিয়ায় যখন বিদ্রোহের সূচনা হয় রোজা তখন তাতে যোগদান করেন। বলা বাহুল্য যে রুস গভর্ণমেন্ট তাঁকে জেলে আবদ্ধ করেন। কিন্তু পুলিশের চোখে ধুলি দিয়ে রোজা জার্মেনীতে ফিরে আসেন ৷
জার্মানীতে এসে রোজা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নানাস্থানে ধর্মঘট ঘটিয়ে কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলাই ছিল তাঁর কাজ। জেলে থেকেই তিনি জার্মান গভর্ণমেন্টের যুদ্ধ নীতির প্রতিবাদ করে বই লেখেন । Crisis of Socialism নামক বইও জেলেই লেখা হয়েছিল।… জার্মেনীর রাজতন্ত্রের বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে রোজা মুক্তিলাভ করেন, ইনি তখন সঙ্ঘবাদ (communist) প্রচার উদ্দেশ্যে একখানি সংবাদপত্র প্রচার করেন। এই কাগজে ইনি যে সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতেন তা যেমন অকাট্য যুক্তিপূর্ণ তেমনিই কার্যকরী হ’ত। জার্মেনীতে একদল লোক আছে যারা এখনও রাজ-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি। এরাই প্রতিহিংসা পরবশ হ’য়ে এই মহিলাকে গুপ্ত ভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার ইতিহাসে এই নারীর নাম চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে ।
এ দেশে কি এমনি কেউ বীরাঙ্গনা আসবে না, যাঁর চরণ-কমল স্পর্শে এই মাদীদের দেশ আবার পুরুষ হয়ে জেগে উঠবে?”
সংবাদ এসেছে মধ্য-এশিয়ায় রুশ-বিপ্লবের ঢেউ লাগা নিয়ে । এনিয়ে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ‘রাশিয়ার চিঠি’তে বিস্তৃত লিখবেন। কিন্তু এর পূর্বলেখ পাই নজরুলের ধূমকেতুতে। ‘আরবী কাগজ’ থেকে ‘বোখরা বিপ্লব’ শিরোনামে লেখা হয়েছে:
‘পূর্ব্ব-বোখরার উজবেগ নামে পরিচিত পাহাড়ীয়া জাতি আমিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা ক’রে ব’ল । এতে অবশ্য আশ্চর্য্য হবার কিছুই নেই । আমীর দেখলেন, অবস্থা তো বড় সঙ্গীন, রুশিয়ার জার ও বিদ্রোহী নেতাদেরে ঘুষ দিয়ে আপনার প্রভূত্ব ও সিংহাসন নিরাপদ করলেন, হতভাগ্য পাহাড়ীরা তাদের নেতাদের বোকামীতে দুর্দ্দশার চরম সীমায় যেয়ে পড়ল । দেশের অজ্ঞান অন্ধকার দূর করবার জন্য শাসকসম্প্রদায় মোটেই চেষ্টা করত না কারণ লেখাপড়া শিখলে প্রজারা কর্তৃপক্ষের যথেচ্ছাচারে বাধা দিবে এ ভয়ও যে তাদের ছিল না এমন নয় ।
কিন্তু ১৯১৭ সনে যখন রুশিয়ার শ্রমজীবী ও কৃষক সম্প্রদায়ের ভিতর বিপ্লব দেখা দিল, তখন আমীর আপনার ধ্বংসোন্মুখ সিংহাসন রক্ষার জন্যে ইংরেজের শরণাপন্ন হলেন। সোভিয়েট রুশিয়ার বিদ্রোহের স্রোত যাতে করে এসে ভারতের বিপ্লবপন্থীদের সঙ্গে মিশতে না পারে এই উদ্দেশ্যে সুচতুর ইংরেজ সরকার আমীরকে মাঝখানে দাঁড় করালেন। কিন্তু লোকের ধৈর্য্যের বাঁধ আর কতদিন টিকে? ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিম বোখরায় আবার বিদ্রোহের ভেরী বেজে উঠল। সপারিষদ আমীর পূর্ব্ব বোখারায়, পরে আফগানিস্থানে পলায়ন করতে বাধ্য হলেন। ফলে দেশের সমস্ত ক্ষমতা জনসাধারণের হাতে এসে পড়ল ।
নতুন শাসন প্রণালী প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাতে জনসাধারণের প্রতিনিধিরাই প্রাধান্য লাভ করলে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তারা রুশিয়ার শ্রমজীবী ও কৃষক সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রার্থনা করল। জনাসাধারণের ইচ্ছায় বোখারায় সোভিয়েট সাধারণ-তন্ত্র রক্ষার জন্যে যে-কোন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তারা দৃঢ় সংকল্প হ’ল। প্ৰাচীন শাসনে যে সকল অন্যায় প্রথা প্রচলিত ছিল সেগুলি সমূলে ধ্বংস হ’ল। বৰ্ত্তমান সময়ে বোখারার শাসন-প্রণালী বোখারাবাসীদেরই হাতে এসে প’ড়েছে, তারা নিজেদের সুবিধা অসুবিধা অনুযায়ী আইন কানুন গ’ড়ে তুলেছে, রাজ্য পরিচালনার জন্যে তারা নিজেরাই কর্ম্মচারী নিয়োগ করে, স্বাধীনভাবে শান্তিতে জীবন যাপন করাই এখন বোখরাবাসীদের একমাত্র অভিপ্রায়।’
কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের সাথে লেনিনের রাশিয়ার মিত্রতার খবরে উল্লসিত হয়েছে ধূমকেতু। ‘কামালের বলশেভিক দোস্তী’ শিরোনাম দিয়ে বলা হয়েছে:
‘গাজী মোস্তফা কামাল পাশাকে সাহায্য করবার জন্যে বলশেভিক গবর্ণমেন্ট ইটালী থেকে বহু মেশিন-গান, মটরকার, ল্যরি ও অন্যান্য যুদ্ধোপযোগী অস্ত্র-শস্ত্র কিনে আঙ্গোরাতে [আংকারা] পাঠাচ্ছেন। একেই বলে দোস্তি ।
তোমরা দুই মিতায় এইবার দুনিয়া থেকে রাজার নাম নেস্তনাবুদ করে ফেল ত একবার ভাই । আমিন!’
কোথায় ইরানের সাথে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার চুক্তি হচ্ছে, সেনিয়ে সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রচ্ছন্নে রয়েছে কংগ্রেস-খেলাফত প্রস্তাবিত স্বরাজ-অসহযোগের ক্রিটিক । ধূমকেতু লিখছে, ‘কংগ্রেস যে-স্বরাজ চায় সে যে নিতান্তই লজ্জাস্কর স্বরাজ। ইংলন্ডের অধীনে স্বায়ত্ত-শাসন লাভ করার জন্যই কি দেশে এত আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে।… দেশ বৃটিশ সাম্রাজ্যধীনে স্বায়ত্ব-শাসন কিংবা দেশের অত্যাচারী অভিজাত শ্রেণীর শাসন চায় না-দেশ চায় দেশ-জনসাধারণের শাসন।’ আর এই সংগ্রামে ধূমকেতুর চোখে ন্যাচারাল মিত্রশক্তি হলো রুশ-বিপ্লবোত্তর রাশিয়া। এর ১৪তম সংখ্যায় এরকম সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে যে মস্কো শহরে রাশিয়ার মুসলিম জনগণ এক বিরাট মিছিল নিয়ে ইংলন্ডের দূতাবাসে গিয়ে প্রতিবাদ করেছে। উদ্দেশ্য, ইংলন্ড মুসলমান রাজ্যগুলির সম্বন্ধে যে রাজনীতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন তার তীব্র প্রতিবাদ জানানো । অন্যত্র, বলশেভিক পুস্তিকা ঘেঁটে তত্ত্ব-পরিবেশনা করা হচ্ছে সাধারণ পাঠকদের কাছে। তারই একটি নমুনা নীচে তুলে ধরলাম:
“বলসেবীর বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়
একি গো বিস্ময় ।”
‘সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের সাথে গণ-তান্ত্রিক বলশেভিক গবর্ণমেন্টের ব্যবসা-সম্পর্কীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়াতে বলশেভিকগণ পৃথিবীর সর্ব্বত্র সাম্রাজ্যবাদীগণের বিরুদ্ধে যে-প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছিলেন তা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখেছিলেন, কিন্তু এখন তাঁরা নববলে বলীয়ান হয়ে প্রচার কার্য্য শুরু করে দিয়েছেন।
বলশেভিক পররাষ্ট্র প্রচার বিতরণ থেকে সম্প্রতি দুটা বই প্রকাশিত হয়েছে, একটীর আকার বৃহৎ-৭০০ শত পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। রুষের ভূতপূর্ব্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ফ্রান্স প্রভৃতি রাজ্যের সাথে যে টেলিগ্রাম, গুপ্ত রিপোর্ট ও পত্রালাপ ব্যবহার হয়েছিল তার নকল এখানে সন্নিহিত হয়েছে। আর একটা হচ্ছে ভারতবর্ষে সম্বন্ধে পুস্তক। এই পুস্তকে প্রচ্ছদপটে লেখা রয়েছে -“ভারত ভারতবাসীর জন্য।”এতেও বহু চিঠিপত্র ও রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এই সব বই জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের বলশেভিক পূস্তকালয়ে বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে ও রাশিয়ান খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এই পুস্তকের এক জায়গায় লেখা আছে :
“আমরা-রাশিয়ান বিদ্রোহীগণ ও আর্ন্তজাতিক সোশিয়ালিষ্টগণ ভারত বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করলে কেবল যে তাকে সাদরে অভিনন্দন জানাব তা নয় বরং পরোক্ষ ও অপরোক্ষভাবে সাধ্যমত ভারতের বিদ্রোহকে সাহায্য করব; এবং ঘৃণিত ব্রিটিশের পরাধীনতা থেকে মুক্ত আজাদ করবার জন্যে ভারত বাসীকে সাহায্য করব। বহুদিনের উৎপীড়িত নির্যাতিত প্রাচ্যে বন্ধুগণের প্রতি সহানুভূতির নিদর্শন স্বরূপ (গুপ্ত) দলিল পত্র সম্বলিত এই পুস্তক সাদরে গ্রহণ করুন। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বিদ্রোহমূলক পন্থা কেবলমাত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে সহায়তা করে ক্ষান্ত হবে না, এর অতিরিক্ত কিছু করবে।”
খুড়োর সাথে সাথে আমরাও ভাছি, “অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোনখানে?” কৃষকের ঐ লাঙলই যে হল বলরাম হয়ে বিশ্ব উপড়ে ফেলতে পারে, তা জানতুম না-দাদা। জানলেও বিশ্বাস করতুম না। এক কামালেই কামাল করলে আর তোমরা আর এক কামাল করলে।’
প্রথম সংখ্যাতেও লেনিনের স্বাস্থ্য নিয়ে সংবাদ এসেছিল, ১৯তম সংখ্যাতেও তাঁর সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছে। সম্ভবত ১৯২০ সালের কমিনটার্ণের দ্বিতীয় কংগ্রেসকে উদ্ধৃত করে কথাগুলো বলা: ‘লেনিন বেশ ভালোই আছেন। তিনি বলেন প্রাচ্যের সভায় রাশিয়ার থাকা একান্ত আবশ্যক। তিনি আগেও বলেন যে তুরস্কের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা… রাশিয়ার উদ্দেশ্য। জাতিসঙ্ঘকে তার খবরদারী করতে দেওয়া যেতে পারে না।’ এরই পাশাপাশি এ সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে ইতালীতে ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে-‘একে একে নিবিছে দেউটী’ । এরকম উদাহরণ আরো অনেক দেওয়া যায় ।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, বলশেভিজম বা রাশিয়ার সমাজতন্ত্র নিয়ে এই কৌতূহুল এটা কি কোন বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে কিনা? এর উত্তর পরবর্তী অধ্যায়ে দেব। কিন্তু তার আগে এটা জানিয়ে রাখি যে ধূমকেতুতে নজরুল একটি ব্যাপক লেখক সমাবেশ করতে পেরেছিলেন। শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, শৈলজারঞ্জন, প্রেমাংকুর আতর্থী, শিবরাম চক্রবর্তী, মুজফ্ফর আমদ, হেমন্ত কুমার সরকার প্রমুখকে দিয়ে নানাবিধ ‘রাজনৈতিক’ বিষয়ে প্রবন্ধ গুচ্ছ লিখিয়েছেন। এবং সবগুলো লেখাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, প্রগতিপন্থী, এবং অনেকাংশে বামপন্থী চেতনায় সমৃদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, আমি ধূমকেতুর নারীমুক্তি সম্পর্কীত লেখাগুলির কথা স্মরণ করব। ১৮তম সংখ্যায় মহামায়া দেবী লিখছেন:
‘আজ এই আন্দোলনের যুগে অন্যান্য আন্দোলনের মধ্যে নারীর স্থান কোথায়; এ এক প্রধানতম আন্দোলন । আর সত্য সত্যই নারীর স্থান কোথায় আজ তা নিরুপণ করা এক মহা ব্যাপার। আর স্থান নিরুপণ করা কার দ্বারাই যে সম্ভব তাও ভাববার কথা। নারীর জীবন দিন দিনই যে সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠছে তা কোন এক নিদর্শন দেখিয়ে প্রমাণ করবার আবশ্যকই করে না। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ চোখের উপর নিয়তই খাড়া রয়েছে। কিন্তু এই সমস্যা মীমাংসার উপায় কি?… নারীর স্থান নির্ব্বাচন নারীকেই করতে হবে, নারীর জীবন সমস্যা নারীকেই মেটাতে হবে, নারীর সত্যকারের অধিকার নারীরই নিতে হবেঃ সত্যবস্তু প্রতিজনের নিজস্ব তা কেউ কা’কে দিতে পারে না এবং কারো কাছে দাবী করবারও নয় । হাল আমলের নারীর ‘এজেন্সি’ এবং ‘এমপাওয়ারমেন্ট’ ডিসকোর্সের সূচনা ধূমকেতুতে ।’
৩. লাঙলেরনজরুল
লাঙল প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর । এর ‘প্রধান পরিচালক’ নজরুল ইসলাম । সম্পাদক ছিলেন মনিভূষণ মুখোপাধ্যায়— পল্টনে থাকতে নজরুলের সহকর্মী কমরেড। ‘লাঙল’ পর্বটি তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই পর্বে নজরুল আরো বেশি করে রুশ বিপ্লব, মার্কসীয় সমাজতন্ত্র ও সাধারণ ভাবে সচেতন বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। দ্বিতীয়ত, এই পর্বে শুধু আদর্শগত ঝোঁক নয়, সাংগঠনিক ভাবেও বামপন্থী সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন নজরুল। সাধারণ সদস্য বা সমর্থক হিসেবে নয়— শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সম্প্রদায়ের’ অন্যতম মূল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। লাঙলের প্রথম সংখ্যাতে এই নামই ছিল সংগঠনটির। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে নামকরণ হয়— ‘শ্রমিক-প্ৰজা- স্বরাজ দল’ । ইংরেজিতে ওয়াকার্স পেজেন্টস পার্টি । এই দলেরই বক্তব্য প্রচারের জন্য লাঙল বের করা। যেরকম লেনিন এক সময় বলশেভিক পার্টির মুখপাত্র হিসেবে বের করেছিলেন ইসক্রা। এ নিয়ে কোন রাখ ঢাক ছিল না নজরুলের।
লাঙল পত্রিকার শিরোনামের নীচেই লেখা ছিল-শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের মুখপাত্র । তৃতীয়ত, নজরুল শুধু লাঙলের জন্য কবিতা-গান-প্রবন্ধই রচনা করেননি, তিনি বাংলার শহর-গ্রাম চষে বেরিয়েছেন ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ’ দলের কাজে। আগেই বলেছি, এই দলটি ছিল ১৯২৫ সালে কানপুরে গঠিত ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির নিকটতম পূর্বসূরী, অনেক ক্ষেত্রে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাজ করবার জন্য ‘প্রকাশ্য ফ্রন্ট’। পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগ’, ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ প্রভৃতি দলের মধ্যে যেমন করে কম্যুনিষ্ট-বামপন্থীরা কাজ করতেন। লাঙলের পুস্তক-বিভাগ ছিল কলকাতার ৩৭ হ্যারিসন রোডে, যেখানে আগেই বলেছি নজরুল, মুজফ্ফর আমদ, আবদুল হালীম প্রমুখেরা একসাথে থাকতেন। সেখানে শুধু সমাজতন্ত্রী সাহিত্যই থাকত না, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী সাহিত্যও থাকত, এমনকি নারীমুক্তির সাহিত্যও থাকত। উদাহরণত, বেগম রোকেয়ার সব বই সেখানে পাওয়া যেত। লাঙলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত— ‘সুলেখিকা মিসেস আর এস হোসেন প্রণীত পদ্মরাগ (উপন্যাস); মতিচুর-১ম খণ্ড; মতিচুর-২য় খণ্ড’। এককথায়, বিশের দশকের মাঝামাঝি লাঙল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রগতিশীল চিন্তা-
বই পুস্তক, তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রমূল। সামগ্রিক আলোচনা বর্তমান প্রবন্ধের সাধ্যের বাইরে, আমি শুধু প্রধান ভাবনা, প্রধান মুহুর্তের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি। লাঙল পত্রিকাটি ব্রিটিশ সেন্সরশীপ বা রাজরোষে পরে খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। প্রথম সংখ্যাটি বার হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫, আর শেষ সংখ্যা বার হয় ১৫ এপ্রিল ১৯২৬ । লাঙল বন্ধ হওয়ার পর ‘বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল’-এর মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ায় ‘গণবাণী’। ‘লাঙল’-এর প্রথম সংখ্যাতেই র্যাডিকেল সব দাবী উচ্চারিত হয়েছিল। লাঙল যাদের মুখপাত্র সেই শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের উদ্দেশ্য, নিয়মাবলী ও গঠনপ্রণালী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছিল:
‘আমেরিকা, ইংলন্ড প্রভৃতি দেশে এখন বৈশ্যের রাজত্ব। এবার শূদ্রের পালা। এবার শূদ্রের প্রয়োজনে সমাজ চলবে। হিন্দু-মুসলমান-সমস্যা, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সমস্যা সব লাঙলের ফলার মুখে লোপ পাবে। তাই আমরা লাঙলের জয়গান আরম্ভ করলাম। লাঙল নবযুগের নব দেবতা। জয় লাঙলের জয় লাঙলের দেবতার জয়!’
এই দলের উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ:
১। উদ্দেশ্য: ‘নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাসূচক স্বরাজ্য লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।’
৩। কর্মনীতি ও সংকল্প: যেহেতু দেখা গিয়াছে যে গলাবাজি অথবা ত্রাস-নীতিতে অনিচ্ছুক আমলা-তন্ত্রের হাত হইতে স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইবার চেষ্টা অতীতে কেবলই বিফল হইয়াছে; আমলা-তন্ত্রের নিকট খোসামুদি দ্বারা ভারতবর্ষের লোকের অবস্থার প্রকৃত উন্নতি আনয়ন সম্ভব নয়, কিংবা সহস্র বন্ধনে আবদ্ধ স্বদেশীয়গণের সাহায্যেই নিরস্ত্রীকৃত জনসাধারণের স্বাধীনতা গুপ্ত হত্যার সাহায্যে আসিতে পারে না; বোমা এবং পিস্তলের শক্তি অপেক্ষা বহগুণে শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের চলমান শক্তির প্রয়োগ দ্বারাই নিরস্ত্র জাতির পক্ষে স্বাধীনতা লাভের একমাত্র উপায় বলিয়া বোধ হইতেছে।
যেহেতু শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ যেমন বলিয়াছেন যে শ্রেণীগত স্বার্থত্যাগী ভদ্র যুবক, শ্রমিক ও কৃষকের সংযোগ না হইলে ভারতের মুক্তি আসিবে না ।
অতএব ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায় এই ঘোষণা করিতেছেন যে, ভারতের জাতীয় দাবী পূরণের এখনও একমাত্র অবশিষ্ট উপায় এই যে, দেশের শতকরা আশি জন যাহারা— সেই শ্রমিক ও কৃষকগণকে সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং তাহাদিগের জন্মগত অধিকার লাভে সাহায্য করা, যাহাতে তাহারা রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে আরও সচেতন হইয়া নিজের ক্ষমতায় এবং নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাশীল স্বার্থপর ব্যক্তিগণের হাত হইতে স্বাধীনতা আনিতে পারে । এবং এতদর্থে উপরোক্ত উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায় নিম্নলিখিত কর্ম সংকল্পের অবতারণা করিতেছেন ।
এই দল শ্রমিক ও কৃষকগণের স্বার্থের জন্য লড়িবেন (ভদ্র এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের যে কোনও ব্যক্তি নিজের হাত-পা বা মাথা খাটাইয়া নিজের জীবিকা অর্জন করে, তাহাকেই শ্রমিক বলিয়া গণ্য করা হইবে)।’
৪। চরম দাবী:
(ক) আধুনিক কলকারখানা, খনি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, ট্রামওয়ে, স্টীমার প্রভৃতি সাধারণের হিতকারী
জিনিস, লাভের জন্য ব্যবহৃত না হইয়া দেশের উপকারের জন্য ব্যবহৃত হইবে এবং এতদ সংক্রান্ত কর্মীগণের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সম্পত্তি রূপে পরিচালিত হইবে।
(খ) ভূমির চরম স্বত্ত্ব আত্ম-অভাব-পূরণ-ক্ষম স্বায়ত্ব-শাসন-বিশিষ্ট পল্লীতন্ত্রের উপর বর্ত্তিবে— এই পল্লী-তন্ত্র
ভদ্র শূদ্র সকল শ্রেণীর শ্রমজীবীর হাতে থাকিবে ।
৫। এখনকার দাবী:
শ্রমিকদের জন্য দাবী
ক) জীবন-যাত্রার পক্ষে যথোপযুক্ত মুজরির একটা নিম্নতম হার আইনের দ্বারা বাঁধিয়া দেওয়া।
(খ) প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকের পক্ষে সপ্তাহে সাড়ে পাঁচদিন খাটুনি চরম বলিয়া আইন করা; নারী এবং অল্প
বয়স্ক ছেলেপিলের জন্য বিশেষ শর্ত নির্দ্ধারণ করা ।
(গ) শ্রমিকগণের আবাস, কাজের শর্ত, চিকিৎসার বন্দোবস্ত প্রভৃতি বিষয়ে কতকগুলি দাবী মালিকগণকে
আইন দ্বারা বাধ্য করিয়া পূরণ করানো।
(ঘ) অসুখ, বিসুখ, দূর্ঘটনা, বেকার অবস্থা এবং বৃদ্ধ অবস্থায় শ্রমিকগণকে রক্ষা করিবার জন্য আইন প্ৰণয়ন
ঙ) সমস্ত বড় কলকারখানায় লাভের ভাগে শ্রমিকগণকে অধিকারী করা।
চ) মালিকগণের খরচায় শ্রমজীবীগণের বাধ্যতা মূলক শিক্ষা ।
ছ) কলকারখানার নিকট হইতে বেশ্যালয়, নেশার দোকান উঠাইয়া দেওয়া ।
জ) শ্রমিকগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কো-অপারেটিভ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ।
(ঝ) শ্রমিক-সঙ্ঘ-গুলিকে আইনত মানিয়া লওয়া এবং শ্রমিকদের দাবী পূরণের জন্য ধর্মঘট করিবার অধিকার স্বীকার করা।
কৃষকদের জন্য দাবী
(ক) ভূমি-কর সম্বন্ধে একটা ঊর্দ্ধতম হার বাঁধিয়া দেওয়া এবং বাকি খাজনার সুদ ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের
সুদের হারের সহিত সমান নির্দ্ধারণ করা;
(খ) জমিতে কায়েমী স্বত্ত্ব প্রতিষ্ঠা; উচ্ছেদ নিরোধ; অন্যায় এবং বে-আইনি বাজে আদায় বন্ধ; স্বেচ্ছায় বিনা সেলামিতে হস্তান্তর করার অধিকার; গাছ কাটা, কূয়ো খোঁড়া, পুকুর কাটা, পাকা বাড়ী করার ক্ষেত্রে বিনা সেলামিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা।
(গ) জল-করে মাছ ধরিবার নির্দ্ধারিত শর্ত।
ঘ) মহাজনের সুদের চরম হার নির্দ্ধারণ;
(ঙ) কো-অপারেটিভ কৃষি-ব্যাঙ্ক স্থাপনের দ্বারা কৃষককে ঋণদান এবং মহাজন ও লোভী ব্যবসাদারগণের
হাত হইতে কৃষককে উদ্ধার ।
(চ) চাষে জন্য যন্ত্রপাতি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের মারফৎ কৃষকের নিকট বিক্রয় অথবা ব্যবহারের জন্য
ভাড়া দেওয়া। মূল্য অথবা ভাড়ার টাকা কিস্তীবন্দী হিসাবে অল্প অল্প করিয়া লওয়ার বন্দোবস্ত ।
ছ) পাটের চাষের কৃষকের উপযুক্ত লাভের বন্দোবস্ত ।
এই দলে যোগ দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ নিম্নলিখিত ঠিকানায় পত্র দিবেন:-
নজরুল ইসলাম, ৩৭ নং হ্যারিসন রোড, কলিকাতা ৷’
দলের উদ্দেশ্য ও দাবীনামা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে শ্রমিক-প্রজা পার্টির উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বা আধুনিক পরিভাষায়-জনগনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা (যেটা বিপ্লবোত্তর চীনে বা ভিয়েতনামে দেখতে পাই)। তার চাইতে লক্ষ্য করার পয়েন্ট হল যে এরকম দলে যোগ দেওয়ার জন্য সর্বাগ্রে নজরুলের সাথে যোগাযোগ করার কথা বলা হচ্ছে।
অর্থাৎ নজরুল এখানে ‘সংগঠকের’ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন ।
লাঙলের পাতায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল কার্ল মার্কসের জীবনী (লেখক-দেবব্রত বসু); গোর্কির ‘মা’ (অনুবাদক- নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়); কার্ল মার্কসের শিক্ষা (লেখক-মৌলবী কুদ্দীন আহ্মদ)। এছাড়াও ছিল সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের “হিন্দু-মুসলমান’; নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ ও ‘কৃষাণের গান’। এই শেষের কবিতাটিতে মার্কসবাদের প্রভাব অতি-প্রত্যক্ষ:
‘চারদিক হতে ধণিক বণিক শোষণকারীর জাত
জোঁকের মতন শুছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত
বুকের কাছে মরছে খোকা, নাইক আমার হাত,
সতী মেয়ের বসন কেড়ে খেলছে খেলা খল ।’
অথবা কবিতাটির শেষের স্তবকটি যেখানে লাঙলের তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করা হচ্ছে:
‘জাগ্ রে কৃষাণ সব ত গেছে কিসের বা আর ভয়
ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়
বল্ সবে ভাই, বল্ কৃষাণের বল্ লাঙলের জয়,
দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল ।’
স্পষ্টতই নজরুল বাংলায় বা ভারতবর্ষে কৃষিবিপ্লব বা কৃষকের অভ্যূত্থান কামনা করছিলেন, কেননা শিল্প
শ্রমিকের সংখ্যা তখনো নগণ্য ছিল দেশে। যদিও তাই বলে শিল্প শ্রমিককে হাতছাড়া করতে রাজী নন তিনি। তার জন্য তো ‘কুলি-মজুর’ কবিতাটি এর আগেই লেখা হয়েছিল ‘লাঙল’ পত্রিকায়।
এই সূত্রে একটা প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নটা ১৯২৬ সালেই উঠেছিল। এই যে কৃষক-শ্রমিক নিয়ে এত লেখালেখি তা কি মেহনতী মানুষেরা বুঝতে পারবে? এটা ক্লাসিক লেনিনীয় ‘What is to be done’-র প্রশ্ন। কীভাবে মধ্যবিত্তের সাথে, বুদ্ধিজীবির সাথে শ্রমিক-কৃষকের ভাষা-বিনিময় হবে? এমনই একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন তারানাথ রায় বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের সমালোচনা করে। গায়ত্রী স্পিভাকও বহুপরে এজাতীয় একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন— ‘Can the Subalterns Speak’? ততদিনে লাঙল বন্ধ করে দিয়েছে বৃটিশ সরকার; এর পরিবর্তে বার হচ্ছে ‘গণবাণী’। তার পাতাতে নজরুল তারানাথ রায়ের লেখার জবাব দিলেন। তারানাথ রায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, কৃষক- শ্রমিকরা এসব মতবাদ বুঝবে কেমন করে? তার উত্তরে নজরুল লিখছেন : ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকেরা লেখাপড়ার সঙ্গে গোটা কয়েক মতবাদ শিখলে ওগুলো শিগগিরই বুঝতে পারবেন?’- তাঁর ইঙ্গিতটা এবং রসিকতাটা দুটোই বুঝলাম
না, বুঝলাম শুধু তাঁর জানাশোনা কতটুকু— অন্তত সেই সম্বন্ধে, যে সম্বন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি কি জানেন না যে, কোনো দেশের কোনো শ্রমিক কার্ল মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ পড়ে বুঝতে পারবে না। ঐ মতবাদটা যারা পড়বে, তারা কৃষক-শ্রমিক নয়, তারা লেনিন ল্যান্সব্যারির নমুনার লোক। কার্ল ম্যার্ক্সের মতবাদ সাধারণ শ্রমিক বুঝতে না পারলেও তা দিয়ে তাদের মঙ্গল সাধিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এ মতবাদ দিয়ে এমন কতকগুলি লোকের সৃষ্টি হয়েছে যারা জগৎটাকে উল্টে দিয়ে নতুন করে গড়তে চাচ্ছেন বা গড়ছেন। মতবাদ কোনোকালেই জনসাধারণ বুঝবে না, মতবাদ তৈরি করে তুলবে সেই রকম লোক যারা বোঝাবেন এ মতবাদের মর্ম জনসাধারণকে। ইন্জিন চালাবে ড্রাইভার কিন্তু গাড়িতে চড়বে সর্বসাধারণ। ‘গণবাণী’ও কৃষক শ্রমিকের পড়ার জন্য নয়, কৃষক-শ্রমিকদের গড়ে তুলবেন যাঁরা— ‘গণবাণী’ তাঁদেরই জন্য। কৃষক-শ্রমিক দলের মুখপাত্র, মানে তাদের বেদনাতুর হৃদয়ের মূক মুখের বাণী ‘গণবাণী’ ও তাদের বইতে না পারা ব্যথা কথায় ফুটিয়ে তুলবে ‘গণবাণী’ ।’
একথা নজরুল লিখতে পেরেছেন একারণে যে তিনি গভীর ভাবে বামপন্থাকে বুঝে ছিলেন। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সাথে সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সংযোগ ঘটাতে হবে—এই ডায়ালেকটিকস্ তিনি বুঝতেন। ধূমকেতু – লাঙল-গণবাণী পর্বের নজরুলের লেখা ও কর্মতৎপরতা অনুসরণ করলে বোঝা যায় কেন এদেশের বামপন্থী আন্দোলনের আদি পুরুষদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তাকে শুধু ‘বিদ্রোহী’ বললে, বা দরদী ‘সাম্যবাদী’ বললে তার রাজনৈতিক ভিশনকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয় না। এমনকি ১৯৪১ সালে যখন নজরুল ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লিখছেন তখনো তার দৃষ্টি স্বচ্ছ পরিপার্শ্বের পট পরিবর্তনে ম্লান হয় নি এতটুকু। পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপনের পর তিনি বলছেন: ‘লীগ” কেন, ‘কংগ্রেস’কেও আমি কোনোদিন স্বীকার করিনি। আমার ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা তার প্রমাণ। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কোনোদিন লিখিনি— কিন্তু তার নেতাদের বিরুদ্ধে লিখেছি। যে কোনো আন্দোলনেরই হোক, নেতারা যদি নির্লোভ, নিরহংকার ও নির্ভয় না হন, সে আন্দোলনকে একদিন না একদিন ব্যর্থ হতেই হবে।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন:
‘আত্মত্যাগী সাধকেরাই আনিবেন বদ্ধ জীবনে প্রাণশক্তির দুর্জয় প্রবাহ। যাঁহারা নবযুগের ছেলেমেয়ে, তাঁহারা এই প্রবাহে যুক্ত হইয়া এই প্রবাহ-তরঙ্গকে গগনস্পর্শী করিয়া তুলুন— ইহাই নিপীড়িত মানবাত্মার প্ৰাৰ্থনা।‘
যতদূর বুঝতে পারি, সাপ্তাহিক লাঙলকে আপাত: দৃষ্টিতে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদলের মুখপত্র বলা হলেও (১৯২৬ সালের দিকে এসে এই নামই নেয় এটি) আসলে তা ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরই ‘প্রকাশ্য ফ্রন্ট’। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হত। ১৯২৬ সালের ৬-৭ ফেব্রুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে নিখিল-বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ‘কবি নজরুল ইসলাম পরিচালিত “লাঙল” পত্রিকাকে কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপাত্ররূপে আপাতত গ্রহণ করা হউক।’ তাসত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই সেখানে কমিউনিষ্ট পার্টির নানা সংবাদ। যেমন, ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারী লাঙলের চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশিত হল কানপুরে ভারতীয় প্রথম কম্যুনিস্ট কনফারেন্সে গৃহীত ‘পার্টির গঠন নীতি’ বা কানপুর সম্মেলনের সভাপতির দীর্ঘ ভাষণ যার বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় ‘সাম্যবাদ কি’; । এসব হুবহু ছাপা হয়েছে লাঙলে । উদ্ধৃতিটি বড়, কিন্তু বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসংগিক:
‘যেহেতু দেশীয় ও বৈদেশিক ধনিকগণের দ্বারা এবং ভারতীয় জমীদারগণের শোষণ-বৃত্তির দ্বারা ভারতবর্ষের শ্রমিক ও কৃষকগণ মানুষের মত জীবন যাপন করিতে পারিতেছে না, যেহেতু ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রীয় দলসমূহে বর্জুয়া (অভিজাত)-দেরই সমধিক প্রভুত্ব বিদ্যমান রহিয়াছে আর এই প্রভুত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় কৃষক ও শ্রমিকগণের উন্নতির পরিপন্থী, সেই হেতু ভারতীয় কম্যুনিষ্টগণের এই সম্মিলন প্রস্তাব করিতেছে যে ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মুক্তির জন্য একটি দল গঠিত হউক। এই দল ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টি (Communist Party of India) নামে অভিহিত হইবে। এই দলের চরম উদ্দেশ্য হইবে ভারতে কৃষক ও শ্রমিকগণের সাধারণ তন্ত্র (স্বরাজ) প্রতিষ্ঠিত করা।— ভূমি, খনি, গৃহ, টেলিগ্রাফ ও রেলওয়ে ইত্যাদি যে সমস্ত জন-সম্পদের উপর জন-সাধারণের অধিকার স্থাপিত হওয়া উচিত সেই সমস্ত সম্পদকে সর্ব্বাধিকারভুক্ত ও সর্ব্বনাগরিকের আয়ত্ব করিয়া ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মানুষের মত জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করার ব্যবস্থা করা কম্যুনিষ্ট পার্টির সাক্ষাৎ উদ্দেশ্য হইবে।
এই সমস্ত উদ্দেশ্য-সাধনে সাফল্য লাভের জন্য এই পার্টিকে সহরে ও মফস্বলে শ্রমিক ও কৃষকসম্ভব গঠিত করিতে হইবে, ডিষ্ট্রীক্ট ও তালুক বোর্ড মানুসিপালিটি ব্যবস্থাপক সভা সমূহে লোক প্রেরণ করিতে হইবে এবং এইরূপ অন্যান্য উপায় ও প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে। কোনো সাম্প্রদায়িক সভা বা সংগঠনের সভ্য এই পার্টির সভ্য হইতে পারিবেন না। ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির কংগ্রেস বা সম্মিলনের অধিবেশন বৎসরে একবার করিয়া ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হইবে ।
ইংল্যান্ডে যে সকল কম্যুনিষ্ট সম্প্রতি কারাবদ্ধ হইয়াছেন, সম্মিলন তাঁহাদিগকে সমবেদনা জানাইতেছেন এবং ইংল্যান্ডের সরকারের এরূপ ব্যবহারের প্রতি বিরক্তি প্রদর্শন করা হইয়াছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের কম্যুনিষ্ট ও ভারতীয় সদস্য মিঃ সাকলাওয়ালাকে যে আমেরিকাতে যাইতে দেওয়া হয় নাই তৎপ্রতিও সম্মিলন বিরক্তি প্রদর্শন করিয়াছে।
নিম্নলিখিত ভারতীয় কম্যুনিষ্টগণের কারাবরণেও সম্মিলন সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছে:-
১. মোহাম্মদ আকবার খান (১০ বৎসর, এখনো কারাগারে)
২. গওহর রহমান (২ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৩. মিঞা আকবর শাহ্ (২ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৪. সৈয়দ মোহাম্মদ হাবীব (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন
৫. আব্দুল মজীদ (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৬. রফিক আমদ (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৭. ফিরোজ দীন (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৮. মোহাম্মদ সুলতান (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
১২. মুজফ্ফর আদ (৪ বৎসর, যক্ষ্মারোগাক্রান্ত হওয়ায় ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে)
১৩. মোহম্মদ শফীক্ (৩ বৎসর, এখনো কারাগারে)’
লক্ষ্যণীয়, এই তালিকা অনুযায়ী গোড়ার পর্বে যারা কারাবাস করেছিলেন তাদের বেশির ভাগই মুসলিম।
বামপন্থীরা সেসময়ে অসম্ভব সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। প্রকাশ্যে মুজফ্ফর আহমদ লাঙলের পাতায় লিখছেন ‘শ্ৰেণী সংগ্রাম’ এবং ‘কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন’; নজরুল লিখছেন শ্রমিকের গান’; দেব্রত বসু লিখছেন ধারাবাহিক রচনা‘লেনিন ও সোভিয়েট রুশিয়া; হৃষিকেশ সেন লিখছেন ‘বাংলার প্রজাসত্ব বিষয়ক বিধি’; সুমার চক্রবর্তী লিখেছেন ‘চীনের নবজন্ম’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। ১০ম সংখ্যায় প্রচ্ছদ নিবন্ধ হচ্ছে ছোট কিন্তু তাৎপর্য্যপূর্ণ শিরোনামের লেখা—
‘সোস্যালিজম কাকে বলে?’। অন্যদিকে, প্রায়-অপ্রত্যাশিত ভাবে বেরুচ্ছে ১৮৫৩ সালে লেখা মার্কসের প্রবন্ধের অনুবাদ— ‘ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষের একটি চিত্র’। তাছাড়া থাকছে পাতায় পাতায় বিভিন্ন জেলার প্রজা-সম্মিলনের সাংগঠনিক খবরাখবর, যার মধ্যে সক্রিয় অংশ নিচ্ছেন কবি নজরুল ইসলাম নিজে, কখনো প্রধান বক্তা, কখনো সভাপতি হিসেবে। এই সবই হচ্ছে নজরুলের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় ।
ধূমকেতু আর লাঙল বাংলায় র্যাডিকেল কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের দুই বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়। ধূমকেতু আধা- জাতীয়তাবাদী আধা-বামপন্থী; লাঙল সে তুলনায় পুরোপুরি সমাজবাদে আচ্ছন্ন। নজরুল সেখানে কেবল গান করছেন না, বক্তৃতাও দিচ্ছেন, সংগঠন নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছেন; আজ এখানে, কাল ওখানে; এবং এসব করতে গিয়ে তার শরীর মাঝে মাঝেই বাগড়া দিচ্ছে। সে খবরও লাঙলে বেরুচ্ছে— কবি অসুস্থ, তিনি দুর্ভাগ্যবশত সভায় যেতে পারছেন না। তিনি সবার কাছে তার পত্রখানি পাঠিয়েছেন। যেমন, ময়মনসিংহের প্রজা সম্মিলনীতে তার যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু শরীরের অসহযোগে যেতে পারেননি সেখানে। পরিবর্তে একটি পত্র পাঠালেন— সেখান থেকেও তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে তা বোঝা যায়:
‘আমার প্রিয় ময়মনসিংহের প্রজা ও শ্রমিক ভ্রাতৃবৃন্দ !
আপনারা আমার অন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, আপনাদের এই নবজাগরিত প্রাণের স্পর্শে নিজেকে পবিত্র করিয়া লইব, ধন্য হইব। কিন্তু দৈব প্রতিকূল হওয়ায় আমার সে আশা পূর্ণ হইল না । আমার শরীর আজও রীতিমত দুৰ্ব্বল, একস্থান হইতে অন্যস্থানে যাইবার মত শক্তি আমার একেবারেই নাই । আশা করি আমার এই অনিচ্ছাস্বত্ত অক্ষমতা সকলে ক্ষমা করিবেন। এই ময়মনসিংহ আমার কাছে নূতন নহে। এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ভাবে ঋণী । আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে। এইখানে থাকিয়া আমি কিছুদিন লেখাপড়া করিয়া গিয়াছি। আজও আমার মনে সেই সব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্কর হইয়া জ্বলিতেছে। বড় আশা করিয়াছিলাম, আমার সেই শৈশব-চেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদার- হৃদয় ময়মনসিংহ জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার লৌহ-প্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব, কিন্তু তাহা হইল না, দুরদৃষ্ট আমাদের। যদি সর্ব্বশক্তিমান আল্লাহ্ দিন দেন, আমার স্বাস্থ্য ফিরিয়া পাই, তাহা হইলে আপনাদের গফরগাঁওয়ের নিখিল বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনীতে যোগদান করিয়া ও আপনাদের দর্শন লাভ করিয়া ধন্য হইব। আপনারাই দেশের প্রাণ, দেশের আশা, দেশের ভবিষ্যৎ। মাটির মায়ায় আপনাদেরই হৃদয় কাণায় কাণায় ভরপুর। মাটির খাঁটি ছেলে আপনারাই। রৌদ্রে পুড়িয়া বৃষ্টির জলে ভিজিয়া-দিন নাই রাত নাই— সৃষ্টির প্রথম দিন হইতে আপনারাই ত এই মাটির পৃথিবীকে প্রিয় সন্তানের মত লালন পালন করিয়াছেন, করিতেছেন, ও করিবেন,- আপনাদের মাঠের এক কোদাল মাটি লইলে আপনারা… শির লেন কিবা তাকে শির দেন, এত ভালবাসায় ভেজা যাদের মাটি, এক বুকের খুনে উর্ব্বর যে শস্যশ্যামল মাঠ, আপনারা আমার কৃষাণ ভাইরা ছাড়া তাহার অন্য অধিকারী কেহ নাই। আমার এই কৃষাণ ভাইদের ডাকে বর্ষায় আকাশ ভরিয়া বাদল নামে, দেব বুকের স্নেহ ধারার মতই মাঠ ঘাট পানিতে বন্যায় সয়লাব হইয়া যায়, আমার এই কৃষাণ ভাইদের আদরে সোহাগে মাঠঘাট ফুলে ফলে ফসলে শ্যাম সবুজ হইয়া উঠে,-আমার কৃষাণ ভাইদের বধূদের প্রার্থনায় কাঁচা ধান সোনার রঙে রাঙিয়া উঠে,এই মাঠকে জিজ্ঞাসা কর, মাঠে ইহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইবে,– এ মাঠ চাষার এ মাটি চাষার, এর ফুল ফল কৃষক-বধূর ।
৪. বিবিধপ্ৰসংগ
নজরুলের নিজের লেখায় সমাজতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বামপন্থা নিয়ে সুপ্রচুর উল্লেখ ও ইংগিত আছে । এর পুরো বিবরণ দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। একে শুধু বিদ্রোহী মানবতাবাদ বললে সত্যের অপলাপ করা হয় । ধূমকেতু, লাঙল ও গণবাণীর নজরুল কখনো কোমল মানবতাবাদের দ্বারস্থ হননি। সেভাবে তাকে দেখাও অন্যায় ৷ তিনি ছিলেন রুদ্রমঙ্গলের কবি। রবীন্দ্রনাথ এটা জানতেন। ধূমকেতু-র প্রথম সংখ্যা থেকেই রবীন্দ্রনাথের স্বাগতবাণী নিয়মিত ভাবে ছাপা হতো। রবীন্দ্রনাথ সত্য সত্যই বিশ্বাস করতেন যে নজরুলের ধূমকেতু অর্ধচেতনদের আঘাত করে জাগাতে পারবে :
“অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে
আছে যারা অর্ধ্বচেতন।”
তারপর যখন ধূমকেতু বন্ধ হয়ে লাঙল প্রকাশিত হলো তখনো রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে নজরুল আসলে
লাঙলকে চরকার কাউন্টার-পয়েন্ট হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মুজফ্ফর আমদের সংগী— ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির আরেক জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য । নজরুল, মুজফ্ফর ও সৌমেন্দ্রনাথ মিলে যখন লাঙল বের করলেন— তাদের আসল উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের বুঝতে দেরী হয় নি। লাঙলের প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই থাকত রবীন্দ্রনাথের একটি করে উদ্ধৃতি। যেমন, একটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অন্ধকারে !
সবারে না যদি ডাক’,
এখনো সরিয়া থাক’,
আপনারে বেঁধে রাখত চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান
মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান ।‘
উল্লেখ্য, লাঙলের প্রতিটি সংখ্যাতেই পত্রিকার টাইটেলের পরেই থাকত চণ্ডীদাসের চরণ:
“শুনহ মানুষ ভাই—/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’
নজরুল তার বামপন্থাকে শুধু প্রবন্ধে নয়, চিঠিপত্রে নয়, কবিতায় বা গানে নয়, গল্প-উপন্যাসেও ধারণ
করেছেন। আবারো বলছি, এর বিশ্লেষণ গভীর মনোযোগ ও বৃহত্তর পরিসর দাবী করে। উদাহরণ এত অসংখ্য এবং এত স্পষ্ট যে এনিয়ে সামান্য ইংগিতই যথেষ্ট । ১৯২৭ সালে লেখা ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের মূল চরিত্র আনসারকেই ধরা যাক। সে ছিল র্যাডিক্যাল মতের প্রবক্তা নজরুলের মতই । তার শেষ কথা ছিল এমন:
‘পরদিন সকাল না হতেই কৃষ্ণনগরে একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল! দলে দলে পুলিশ এসে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বাড়িতে খানাতল্লাশ করতে লাগল। বহু ছাত্র ও তরুণকে হাজতে পুরল ।
আনসারকে ধরবার জন্যে সশস্ত্র রিজার্ভ পুলিশ সারা রাত ধরে বাগানের গাছে, নাজির সাহেবের বাড়ির আনাচে-কানাচে পাহারা দিচ্ছিল, ভোর না হতেই তারা ঘুমন্ত আনসারকে বন্দি করল। শহরময় রাষ্ট্র হয়ে গেল, নাজির সাহেবের শালা আনসার রাশিয়ার বলশেভিক চর ও বিপ্লবী নেতা। সে ছেলেমেয়ের মধ্যে কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচার করছিল এবং তাদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করছিল।’…পুলিশ যখন তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন জনগণের দিকে তাকিয়ে আনসার বলতে লাগল, ‘বন্ধুগণ ! আমার বিদায়কালে তোমাদের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, তোমরা তোমাদের অধিকারের দাবি কিছুতেই ছেড়ো না ! তোমাদেরও হয়তো আমার মতো করেই শিকল পরে জেলে যেতে হবে, গুলি খেয়ে মরতে হবে, তোমারই দেশের লোক তোমার পথ আগলে দাঁড়াবে, সকল রকমে কষ্ট দেবে, তবু তোমরা তোমাদের পথ ছেড়ো না, এগিয়ে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত হয়ো না। আগের দল মরবে বা পথ ছাড়বে, পিছনের দল তাদের শূন্যস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। তোমাদের মৃতদেহের ওপর দিয়েই আসবে তোমাদের মুক্তি।’
এরকম কথা নজরুলের মনে বহুদিন ধরেই বাজছিল । তিনি ধূমকেতুর পর্বেই বলেছিলেন:
‘জাগো জনশক্তি! হে আমার অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক, আমার মুটে-মজুর ভাইরে ! তোমার হাতের এ-লাঙল আজ বলরাম-স্কন্ধে হলের মতো ক্ষিপ্ত তেজে গগনের মাঝে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক, এই অত্যাচারীর বিশ্ব উপড়ে ফেলুক—উলটে ফেলুক! আন তোমার হাতুড়ি, ভাঙ ঐ উৎপীড়কের প্রাসাদ-ধুলায় লুটাও অর্থ-পিশাচ বল-দর্পীর শির । ছোড়ো হাতুড়ি, চালাও লাঙল, উচ্চে তুলে ধর তোমার বুকের রক্ত-মাখা লালে-লাল ঝাণ্ডা! যারা তোমাদের পায়ের তলায় এনেছে, তাদের তোমরা পায়ের তলায় আন। সকল অহঙ্কার তাদের চোখের জলে ডুবাও। নামিয়ে নিয়ে এস ঝুঁটি ধরে ঐ অর্থ-পিশাচ যক্ষগুলোকে। তোমাদের পিতৃ-পুরুষের রক্ত-মাংস-অস্থি দিয়ে ঐ যক্ষের দেউল গড়া, তোমাদের গৃহলক্ষ্মীর চোখের জল আর দুধের ছেলের হৃৎপিণ্ড নিঙড়ে তাদের ঐ লাবণ্য, ঐ কান্তি । তোমাদের অভিশাপ- তিক্ত মারি-বিষ-জ্বালা লাগিয়ে তাদের সে-কান্তি, সে-লাবণ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দাও ! ’
অনেকে মনে করতে পারেন যে বামপন্থার প্রতি নজরুলের আকর্ষণ একটি কাকতালীয় ঘটনা, সাময়িক উপসর্গ কেবল, যা কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাথে বন্ধুত্বের কারনে একটা প্রভাব বিস্তার করেছিল পরবর্তী জীবনে । আসলে অন্য সব আইডিওলজির মত বামপন্থী ভাবদর্শের প্রতি আকর্ষণ হওয়ারও একটি পূর্ব-ইতিহাস থাকে। রানীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুল সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। বার্ষিক পরীক্ষার পরে ডবল প্রমোশন পেয়ে তিনি নবম শ্রেণীতে উঠে যান। সেখানে তার সহযোগী ছিলেন পরবর্তী যুগের সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। যা হোক, সেই স্কুলে নিবারণচন্দ্র ঘটক নামে নজরুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। নিবারণচন্দ্রের আদর্শের দ্বারা কিশোর নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন বিপ্লবী আদর্শের প্রতি। এটি কবি নজরুল নিজে মুজফ্ফর আদকে পল্টন থেকে ফেরার পরে বলেছিলেন । ১৯১৭ সাথে নিবারণচন্দ্র ঘটক ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা বেআইনী অস্ত্র-শস্ত্র সমেত গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। নিবারণচন্দ্রের প্রভাব ছিল সশস্ত বিপ্লবী জীবনের প্রতি নজরুলের আকর্ষণ সৃষ্টি করার মধ্যে সীমিত। কিন্তু আদর্শবাদী বামপন্থার প্রতি টানের পেছনে ছিল রুশ বিপ্লবের প্রভাব। নজরুল তখন পল্টন জীবনে। করাচিতে যে ব্যারাকে তারা থাকতেন সেখানে যেকোনো রকমের রাজনৈতিক সাহিত্যের প্রবেশ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও ‘গোপন সুড়ঙ্গের’ মধ্য দিয়ে সেই ব্যারাকে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক বই-পত্র ঢুকত। এসম্পর্কে নজরুলের পল্টনজীবনের সহকর্মী জমাদার শম্ভু রায়ের লেখা থেকে জানতে পারি যে নজরুল বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই রাজনৈতিক সাহিত্য বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। সেরকম এক সন্ধ্যার বিবরণ দিয়েছেন তিনি। তখন সদ্য সদ্য রুশ বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছে রাশিয়ার পেট্টোগ্রাড়ে। বিষয়টি এই রকম:
‘…নজরুল সেই দিন যে-সব গান গাইল ও প্রবন্ধ পড়ল তা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গান বাজনা প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লালফৌজের দেশপ্রেম নিয়ে নজরুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে এবং ঠিক নাম মনে নেই সে গোপনে আমাদের একটি পত্রিকা দেখায়। ঐ পত্রিকাতে আমরাও বিশদভাবে সংবাদটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। সে দিন সারা রাতই প্রায় হৈ হুলুড়ে আমাদের কেটে গিয়েছিল।’
১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে নজরুলের ‘ব্যথার দান’ গল্পটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। এই নামে তাঁর একটি গল্প-সংগ্রহও বার হয়। বাংলা সাহিত্য এই ‘ব্যথার দান’ গল্পেই সর্বপ্রথম ‘রেড আর্মির’(লালফৌজ) প্রসঙ্গ আসে। ১৯২০ সালে যখন এই গল্পটি প্রকাশিত হয় তখনো গৃহযুদ্ধ চলছিল বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। এই যুদ্ধ চলছিল ‘হোয়াইট আর্মি’ আর ‘রেড আর্মি’-এর মধ্যে। হোয়াইট আর্মিকে মদদ দিচ্ছিল পশ্চিমা দেশগুলো— যারা চাইছিল রাশিয়ায় পাশ্চাত্যঘেঁষা জারতন্ত্রের পুন:প্রতিষ্ঠা । রেড আর্মি বা লাল ফৌজের প্রধান সংগঠক বা অধিনায়ক ছিলেন লেনিন-সহচর লিওন ট্রটস্কী। ট্রটস্কীর নেতৃত্বে রেড আর্মি একের পর এক জয় ছিনিয়ে নিচ্ছিল। এসব ঘটনা যুবক নজরুলকে প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত করে থাকবে। এরই ফলে বেদৌরা, দারা ও সয়ফুল মুল্কের মধ্যকার ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ‘ব্যথার দানে’ চলে আসে রেড আর্মির প্রসংগ। বাস্তবেও রেড আর্মিতে—বিশেষত মধ্য-এশিয়ার অভিযানে — অনেক ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ আর্মি ছেড়ে রুশ সেনাদলে যোগ দিতে চলে গিয়েছিল । গল্পের দুটি চরিত্র দারা ও সয়ফুল মুল্ক বেলুচিন্তান থেকে আফগান্তিানের দুর্গম এলাকা পার হয়ে তুর্কিস্তান অথবা ককেশাসে গিয়ে রেড আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং কাউন্টার-রিভোলিউশনারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। রেড আর্মিতে যোগ দেওয়ার অনুভূতিটি সয়ফুল মুল্ক এভাবে প্রকাশ করেছে:
‘ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই লালফৌজে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছে। মনে করেছে, এদের এই মহান নি:স্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নি:স্বার্থপরতা প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তি সঙ্গের একজন।’
এখানে বলে রাখা দরকার মূল গল্পের আদি-পাঠে ‘লাল ফৌজ’ কথাটা থাকলেও প্রকাশিত পাঠে ‘লালফৌজ’ কেটে দিয়ে ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’ বসানো হয়েছিল। এ কাজটি করেছিলেন মুজফ্ফর আহমদ স্বয়ং। ব্রিটিশ সেন্সরশীপে শুধুমাত্র ‘রেড আর্মি’ শব্দটি ব্যবহারের জন্যই যেকোন লেখক বা প্রকাশককে জেলে যেতে হত। এমনই ছিল সেদিনের চন্ডনীতি ।
রুশ-বিপ্লব ও আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে নজরুলের সাংবাদিক কর্মতৎপরতা, তার সাংগঠনিক কাজ ও সবার উপরে তার সৃষ্টিশীল কবিতা-গান-উপন্যাস-প্রবন্ধমালা যেমন বৃটিশের রুদ্র-রোষ ডেকে এনেছিল, তেমনি বিশ্বের প্রগতিশীল বৃত্তের দৃষ্টি কেড়েছিল। কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্ণের মনোযোগ গিয়ে পড়েছিল নজরুলের লেখনীর প্রতি । তাঁর লাঙল ও ওয়াকার্স-পেজেন্টস পার্টির কর্মকান্ড কমিন্টার্ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঘনিষ্ঠ ভাবে অনুসরণ করতেন। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন যে, লাঙল পত্রিকা রুশ দেশে যেত। লেনিনগ্যান্ড ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউটের পারস্য ও ভারতীয় ভাষা সমূহের অধ্যাপক ‘দাউদ আলী দত্ত’ লাঙলের সম্পাদককে ১৯২৬ সালের চিঠিতে লিখছেন, ‘আমার মনে হয়, ‘লাঙল’ই সর্বপ্রথম পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছে, অর্থাৎ, আমি বলতে চাই যে ভারতের আত্মোৎপন্ন সম্পদে বঞ্চিত সম্প্রদায়ের (proletariat) জাগরণশীল শ্রেণী চৈতন্যের ‘লাঙল’ প্রথম মুখপত্র। এর উদ্দেশ্যসমূহের সহিত আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে এবং ইহা সাফল্যমন্ডিত হোক্ সর্বান্ত: করণে এই কামনা আমি করছি।’
লেনিনগ্রাদ ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট সরাসরি ভাবে কমিন্টার্ণের সেক্রেটারিয়েটের জন্য কাজ করত । পরবর্তীতে এর সাথে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখার্জী, এই পূর্ববঙ্গের গোলাম আম্বিয়া খান লোহানী প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। লোহানীর একাধিক লেখা রয়েছে নজরুলের ওয়াকার্স-পেজেন্টস্ পার্টির কর্মকান্ড সম্পর্কে ।
মুজফ্ফর-নজরুল প্রতিষ্ঠিত ১৯২৮ সালের অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস্ পার্টিকে ছোট করে দেখবার উপায় নেই। এর পুর্বসূরী ছিল ১৯২৫ সালের লাঙল ও বঙ্গীয় শ্রমিক-প্রজা দল। লাঙল নিষিদ্ধ করার পর খড়গ নেমে আসে ওয়াকার্স এন্ড পেজেন্টস্ পার্টির ওপরেও। ১৯২৯ সালের মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ওয়ার্কার্স এণ্ড পেজেন্টস পার্টি আসলে ‘ছদ্মাবরণে কমিউনিস্ট পার্টি’। ব্রিটিশের এই মূল্যায়নটি সঠিক
আগেই বলেছি, ধূমকেতু ও লাঙলের পর নজরুল ‘গণবাণী’ পত্রিকার সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হন । ঐ পত্রিকার অফিসে বসেই ১৯২৬ সালে আন্তর্জাতিক সাম্যের গান ‘ইন্টারন্যাশনাল’-এর অতুলনীয় বাংলা অনুবাদ করেন ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’ যেখানে লেখা ছিল:
‘শোন্ অত্যাচারী! শোনরে সঞ্চয়ী!
ছিনু সর্ব হারা, হব সর্বজয়ী ॥
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ।
এই “অন্তর-ন্যাশনাল সংগতি”রে
হবে নিখিল-মানব জাতি সমুদ্ধত” ॥
কমিনটার্ণের পক্ষ থেকে একাধিকবার নিমন্ত্রণও এসেছিল নজরুলের কাছে স্বাস্থ্য-পুনরুদ্ধারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে যেতে। মুজফ্ফর স্বয়ং এটি নজরুলকে বলেছিলেন। যেকোন কারণেই হোক, নজরুলের আর মস্কো যাওয়া হয় নি । সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের grand-nephew) মীরাট ষড়যন্ত্রের মামলার আগেই মস্কো চলে যান। তিনি ছিলেন সাম্যবাদী ও বামপন্থী নজরুলের একান্ত অনুরাগী। তাঁর স্মৃতিকথা ‘যাত্রী’-তে লিখেছেন:
‘[নজরুলের] প্রাণ ছিল তার ঐ হাসির মতই সরল প্রবল ও দরাজ! এই অসহ্য-মুখ-মেরে দেওয়া মিঠে ভাব নজরুলের আদবেই ছিলো না। প্রবল হোতে সে ভয় পেতো না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাংলাদেশে।‘
লাঙলের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনি। বঙ্গীয় শ্রমিক-প্রজা দলেরও তিনিই ছিলেন প্রধান পুরুষ । পরবর্তীতে ওয়ার্কার্স-পেজেন্টস পার্টিরও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্ব । লাঙলের জন্য আশীর্বচনে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে হলধর বলরামের সাথে তুলনা করেছিলেন:
‘জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরুভাঙ্গা হল
প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল ।’
শুধু নজরুলের গান-কবিতা নয়, আমরা যেন তার সাম্যবাদী আদর্শ ও জীবনের পরম অভিপ্রায় সাধারণ
মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করা—সেটাকেও যেন মনে রাখি।