[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৩] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৩

পূর্ব প্রকাশের পর

সুবিদিত যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেপাইদের জন্য ১৭৬৪ সালেই একটি ‘মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৭৮৫ সালে সরকারিভাবে বেঙ্গল, মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে আলাদা ‘মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’-এর প্রবর্তন হয়। কিন্তু তার কার্যপরিধি সীমিত ছিল প্রশাসনিক কর্মচারী ও সামরিক বাহিনীর মধ্যেই। এদেশবাসীর জন্য জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব তখন পর্যন্ত ছিল না। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর যখন কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে, তখন (১৮৬৯ সালে) সর্বপ্রথম ‘পাবলিক হেলথ্‌ কমিশনার’ পদের প্রবর্তন হয়। এর ফলে জনস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও জনসংখ্যার ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স’ সংগ্রহ হওয়া শুরু হতে থাকে, যদিও এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠা হয় কেবল ১৯১৯ সালের পরেই। মন্টেগু-চেমসফোর্ডের সাংবিধানিক সংস্কারের অধীনে প্রদেশগুলোর হাতে জনস্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনের দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। আমি বলতে চাইছি, শুধু ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নয়; উনিশ শতকজুড়েই পর্যায়ক্রমে যে দুর্ভিক্ষগুলো ভারতবর্ষে (ও বাংলাদেশে) সংঘটিত হচ্ছিল, তাতে জনস্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা বা বিধিমালা কার্যত ছিল না। বাংলার গ্রাম এলাকা এসব স্বাস্থ্যবিধির সম্পূর্ণ বাইরে থেকে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে রোগ-মহামারী প্রভৃতি উপসর্গে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বঙ্কিম প্রকারান্তরে জনস্বাস্থ্যের নিদারুণ অভাব বা অনুপস্থিতির কথাই পাঠককে (ও শাসকশ্রেণি) স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

তৃতীয়ত, হান্টারের বিবরণী থেকেও জানা যায়, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মারাত্মক। ক্যানিবালিজমের উল্লেখ রয়েছে তার লেখায়। হান্টার লিখেছেন, ্তুঅষষ :যৎড়ঁময :যব ংঃরভষরহম ংঁসসবৎ ড়ভ ১৭৭০ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব বিহঃ ড়হ ফুরহম. ঞযব যঁংনধহফ-সবহ ংড়ষফ :যবরৎ পধঃঃষব; :যবু ংড়ষফ :যবরৎ রসঢ়ষবসবহঃং ড়ভ ধমৎরপঁষঃঁৎব; :যবু ফবাড়ঁৎবফ :যবরৎ ংববফ-মৎধরহ; :যবু ংড়ষফ :যবরৎ ংড়হং ধহফ ফধঁমযঃবৎং, :রষষ হড় নুঁবৎ ড়ভ পযরষফৎবহ পড়ঁষফ নব ভড়ঁহফ;… রহ ঔঁহব ১৭৭০, :যব ৎবংরফবহঃ ধঃ :যব উঁৎনধৎ ধভভরৎসবফ :যধঃ :যব ষরারহম বিৎব ভববফরহম ড়হ :যব ফববফ.

বঙ্কিম এক পর্যায়ে হান্টারের অনুসরণ করে জন-দুর্গতির মর্মস্পশী বিবরণ দিয়েছেন! ‘লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়! উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপর রোগাক্রান্ত হইতে লাগল, গরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কিনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়।’

আনন্দমঠের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে তিনি সরসারি নর-মাংস ভক্ষণের দৃশ্যও প্রোথিত করেছেন। ধনী লোক মহেন্দ্র। কিন্তু তখন ‘ধনী নির্ধনের এক দর।’ মহেন্দ্র তার স্ত্রী কল্যাণীকে গৃহে রেখে তার শিশুকন্যার জন্য দুধ আনতে গেছেন। এরই মধ্যে তার গৃহে ঢুকে পড়েছে দস্যুর দল। ‘মনুষ্যাকৃতি বোধ হয়। কিন্তু মনুষ্যও বোধ হয় না। অতিশয় শুস্ক। শীর্ণ, অতিশয় কৃষ্ণবর্ণ, উলঙ্গ, বিকটাকার মনুষ্যের মত কি আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল।’ তারা কল্যাণী ও তার শিশুকন্যাকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর বঙ্কিমের প্রায় চাক্ষুষ বর্ণনাতেই শুনুন :

“তখন আর একজন বলিল, ‘রাখ, রও। রও যদি মহামাংস খাইয়াই আজ প্রাণ রাখিতে হইবে। তবে এই বুড়ার শুক্‌ন মাংস কেন খাই? আজ যাহা লুঠিয়া আনিয়াছি, তাহাই খাইব। এসো, ঐ কচি মেয়েটাকে পোড়াইয়া খাই।’ আর একজন বলিল, ‘যাহা হয় পোড়া বাপু। আর ক্ষুধা সয় না।’ … অবস্থাবিশেষে মনুষ্য হিংস্র জন্তু মাত্র।”

চতুর্থত, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে শুধু অর্ধেক কৃষিজীবী জনগণের প্রাণনাশ ঘটে, তাই নয়। এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সারা বাংলায়। ডি-পপুলেশনের কারণে কৃষি-ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। হালচাষ করার মতো জনবলও ছিল না। বঙ্কিম লিখেছেন- ‘গ্রামে গ্রামে শত শত উর্ব্বরা ভূমিখণ্ড সকল অকর্ষিত, অনুৎপাদক হইয়া পড়িয়া রহিল অথবা জঙ্গলে পুড়িয়া গেল। দেশ জঙ্গলময় হইল।… চাষায় চাষ করিয়া টাকা পায় না, জমিদারের খাজনা দিতে পারে না, জমিদারেরা রাজার খাজনা দিতে পারে না। … কাহারও ঘরে ধন নাই। যে যাহার পায় কাড়িয়া খায়।’

এ রকম অরাজক পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য লর্ড কর্নওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ব্যবস্থার পত্তন হয় ১৭৯৩ সালে। তার এক বছর আগে, ১৭৯২ সালে দারোগা ব্যবস্থার পত্তন হয় গ্রাম-এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এ দেশের কৃষিতে ‘পুঁজিবাদী’ আদলের খামার-ব্যবস্থা নয়, ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ-উত্তর অরাজক রাজস্ব পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে একটি স্থিতিশীল ঔপনিবেশিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত করাই ছিল এর আশু লক্ষ্য।

৪. ১৮৭০-৮০ দশকের ‘উপোসি’ বাংলা

আগেই বলেছি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রতিক্রিয়ায় ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এসেছিল। তাতে করে সাময়িকভাবে হলেও কৃষিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছিল। মন্বন্তরের ফলে লোকশূন্য হয়ে জঙ্গলে পরিণত হওয়া জমি আবার ধীরে ধীরে আবাদযোগ্য জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। কিন্তু ১৭৯৩ থেকে ১৮৯৩ এই একশো বছরে সাময়িকভাবে কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত জমিদারি ব্যবস্থায় বাংলার কৃষকের আর্থিক আস্থার খুব সামান্যই উন্নতি হতে পেরে ছিল বস্তুত ১৮৫০ সালের পর থেকে কৃষকের অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটতে থাকে। ১৮৬৮ সালের হান্টারের এনালস অব রুরাল বেঙ্গল-এর দুটি লেখা পরপর প্রকাশিত হয় যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একটি হচ্ছে, ১৮৭২ সালে লেখা বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’; এবং আরেকটি হচ্ছে ১৮৭৫ সালের প্রকাশিত রমেশচন্দ্র দত্তের প্রথম বই ‘দ্য পেজেন্ট্রি অব বেঙ্গল’। [অবশ্য সত্যের খাতিরে বলা দরকার যে, এই তিনটি বইয়ের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বেঙ্গল রায়তস দেয়ার রাইটস অ্যান্ড লায়াবিলিটিস’ শীর্ষক ১৮৬৪ সালের ‘ট্রিটিস’টি। অর্থনৈতিক চিন্তার ধ্রুপদী গ্রন্থ এটি।] কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত জমিদারি ব্যবস্থায় আপাতদৃষ্টিতে দেশের অবকাঠামোগত উন্নতি হচ্ছিল বটে, কিন্তু রায়ত বা চাষিদের জীবনে কোনো শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি। অথচ বাংলার কৃষককুলই তো ছিল জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ ভাগ। আজকের যুগে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের সময়ে ‘শতকরা ১ ভাগ বনাম শতকরা ৯৯ ভাগের’ বৈষম্য নিয়ে যে কথা আমরা শুনেছি, তারই পূর্বলেখ যেন পাই বঙ্কিম-রমেশচন্দ্র দত্তের লেখায়। বঙ্কিম প্রবন্ধটিতে স্মরণীয় করে বলছেন : ‘ইংরাজের শাসন কৌশলে আমরা সভ্য হইতেছি। আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে। … দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ-দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।’ দেশের গড় শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু কৃষকের কাছে সেই শ্রীবৃদ্ধির সুফল পৌঁছায়নি। এরপর বঙ্কিম আসল কথাটা পাড়লেন: ‘আমরা দেখিলাম যে, দেশের অত্যন্ত শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে। অসাধারণ কৃষিলক্ষ্মী দেশের প্রতি সুপ্রসন্না। তাঁহার কৃপায় অর্থবর্ষণ হইতেছে। সেই অর্থ রাজা, ভূস্বামী, বণিক, মহাজন সকলেই কুড়াইতেছে। অতএব সেই শ্রীবৃদ্ধিতে রাজা, ভূস্বামী, বণিক, মহাজন সকলেরই শ্রীবৃদ্ধি। কেবল কৃষকের শ্রীবৃদ্ধি নাই। সহস্র লোকের মধ্যে কেবল নয় শত নিরানব্বই জনের তাহাতে শ্রীবৃদ্ধি নাই। এমত শ্রীবৃদ্ধির জন্য যে জয়ধ্বনি তুলিতে চাহে, তুলুক; আমি তুলিব না। এই নয় শত নিরানব্বই জনের শ্রীবৃদ্ধি না দেখিলে আমি কাহারও জয়গান করিব না।’ অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারীরা জানলে খুশি হতেন যে তাহাদের আন্দোলনের দেড়শো বছর আগেই বাঙালি এক লেখক ৯৯ শতাংশের শ্রীবৃদ্ধি না ঘটলে সেই জাতীয় ‘উন্নয়নকে’ প্রগতি বলে সাধুবাদ জানাতে অস্বীকার করেছিলেন।

বঙ্কিম যখন থেকে বঙ্গদর্শন পত্রিকাটি প্রকাশ করছেন তার সঙ্গে অর্থনীতিবিদ-ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। বিকেলে আড্ডা দিতে দিতে তারা দু’জনে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। বিশেষত তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন বাংলার কৃষকের ক্রম-অবনতিশীল অবস্থা নিয়ে। এ কারণেই সম্ভবত বঙ্কিমচন্দ্র ও রমেশচন্দ্র দত্তের উভয়েরই কৃষকবিষয়ক লেখায় জমিদারবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে অদ্ভুত মিল দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের লেখার ওপরে সমসাময়িক ঘটনাবলিও প্রভাব ফেলেছিল। ১৮৬৬ সালের উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষ, ১৮৭৩ সালে পাবনা ও রংপুরের কৃষকদের বিদ্রোহ নতুন করে কৃষকদের প্রশ্নটিকে সামনে এনে দিয়েছিল। বঙ্কিম লিখেছিলেন, ‘জীবের শত্রু জীব; মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য, বাঙালি কৃষকের শত্রু বাঙালি ভূস্বামী। ব্যাঘ্রাদি বৃহজন্তু ছাগাদি ক্ষুদ্র জন্তুগণকে ভক্ষণ করে; রোহিতাদি বৃহৎ মৎস্য, সফরীদিগকে ভক্ষণ করে; জমিদার নামক, বড় মানুষ, কৃষক নামক ছোট মানুষকে ভক্ষণ করে।’ সঞ্জীবচন্দ্র তার ‘বেঙ্গল রায়তস্‌’ গ্রন্থে রায়তের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : ‘লর্ড বেন্টিক বলেছেন রায়ত শব্দটির দ্বারা সমগ্র কৃষি জনগোষ্ঠীকেই বোঝানো হয়ে থাকে। … তবে সাধারণ মতে ‘রায়ত’ এক নির্দিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীকেই নির্দেশ করে।’ যেমন জমিদার সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়েছে; তালুকদার জমিদারের কাছ থেকে বড় আকারের জমি পেয়েছে; আর রায়ত জমিদারের কাছ থেকে ছোট আকারের জমি পেয়েছে। রমেশচন্দ্র দত্ত তার বইটিতে দেখালেন যে, ১৮৫৯ সালের জমিদারি ব্যবস্থা সংস্কার-আইনে তিন ধরনের রায়তের অস্তিত্ব রেখে দেওয়া হয়েছে : (ক) যারা স্থায়ীভাবে জমিদারের জমি চাষাবাদের অধিকার পেয়েছে, অর্থাৎ যাদের জমিদাররা ইচ্ছা করলেই উচ্ছেদ করতে পারবে না; (খ) যারা কেবল ১২ বছরের জন্য চাষাবাদের অধিকার পেয়েছে (এর পরে তারা ওই জমি চাষ করতে পারবে কিনা তা জমিদারের ইচ্ছাধীন) এবং (গ) যাদের জন্য চাষাবাদের ক্ষেত্রে রায়তী অধিকার নির্দিষ্ট করা নেই। এই শেষোক্ত ‘আন্ডার-রায়তরাই’ ছিল সংখ্যাধিক্যে; এদের যখন-তখন জমি থেকে উচ্ছেদ করা যেতে পারত এবং এদের থেকে ইচ্ছামতো খাজনাও আদায় করা যেত। রমেশচন্দ্রের ‘দ্য পেজেন্ট্রি অব বেঙ্গল’ লেখার প্রধান প্রেরণা ছিল এই তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত অধিকারবিহীন রায়ত বা কৃষকদের জন্য ‘চিরস্থায়ী আবাদের’ অধিকার আদায় করা। অর্থাৎ, এদেরও প্রথম গ্রুপের তালিকাভুক্ত করায়। এর জন্যই তিনি নানাবিধ তর্কের জাল বিস্তার করেছিলেন বইটিতে। এক্ষেত্রে তার অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল যে, এই অধিকারহীন তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত রায়তেরাই বাংলার কৃষিতে পূর্বাপার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাচ্ছে, এরাই পর্বান্তরে দুর্ভিক্ষের শিকার হচ্ছে বা দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছে।

১৮৭০-র দশকে শুধু যে পাবনা-রংপুরের কৃষকরা স্থানীয়ভাবে বিদ্রোহ করছিল তাই নয়, সে সময় এলাকা বিশেষ খাদ্যাভাবও দেখা দিচ্ছিল। এমনকি বাংলার ‘শস্যভাণ্ডার’ বলে পরিচিত পূর্ববঙ্গের খাদ্য-উৎপাদনে ‘উদ্বৃত্ত’ জেলাগুলোতেও ক্ষুধার প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছিল। ১৮৭০-র পর থেকেই বাংলা সামগ্রিকভাবে হয়ে ওঠে ‘উপোসি বাংলা’। বঙ্কিম-রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখের লেখার কৃষকদের দুর্দশার যে বর্ণনা রয়েছে, তাতে অবশ্য খাদ্যাভাব, মৌসুমি খাদ্য ঘাটতি ও অনাহারের থাকার বিশদ উল্লেখ নেই। ক্ষুধার বিস্তৃতির পেছনে যেমন ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজনিত ‘কাঠামোগত’ কারণ, তেমনি এর মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি জলবায়ু-পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা ও অনাবৃষ্টির প্রাদুর্ভাব। শেষোক্ত প্রবণতাটি শুধু বাংলায় নয়, ভারতবর্ষ ও তার বাইরের বৃহত্তর এশিয়া-আফ্রিকার উপনিবেশগুলোতেই পরিদৃষ্ট হয়।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১২] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১২

পূর্ব প্রকাশের পর

অর্থনীতি ও সাহিত্যের অন্তর্লীন সম্পর্ক বিশেষ করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের আলোচনায়। ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের ওপরে বিশেষজ্ঞ অমিয় কুমার বাগচী অমর্ত্য সেনের লেখার এদিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির ১৯৯৮ সালের একটি রচনায় সেন তার ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ বইয়ে নাট্যকার বার্নার্ড শ-এর ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ নাটকটির একটি দৃশ্যের সবিস্তার উল্লেখ করেছিলেন। সেখানে আইরিশ-আমেরিকান একটি চরিত্র মেলোন এবং তার পুত্রবধূ ভায়োলেট-এর মধ্যে কথা হচ্ছে ১৮৪৭ সালের আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। কথাগুলো লক্ষ্য করার মতো।

‘মেলোন :আমার বাবা সেই কালো সাতচল্লিশের ক্ষুধার জ্বালায় মারা গিয়েছিলেন। হয়তো তুমি এর আগে এ নিয়ে শুনে থাকবে।

ভায়োলেট :সেই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন?

মেলোন :না, আমি ক্ষুধার কথা বলছি। যখন কোনো দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে এবং সে দেশ থেকে খাদ্যের রফতানি চলতে থাকে, তখন কোনো দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। আমার বাবা ক্ষুধার কষ্টে মারা গেছেন, আর আমি ক্ষুধার কষ্টে আমার মায়ের হাত ধরে আমেরিকায় চলে এসেছি।’

ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু পার্থক্যটাকে বড় করে দেখার উপায় নেই। ক্ষুধার কষ্ট এক পর্যায়ে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী আকার ধারণ করলে তা দুর্ভিক্ষের রূপ নিতে পারে। অমর্ত্য সেন তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কোনো দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকলেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। মেলোন সাহেব যেটা ভেবেছেন সেটা ভুল। খাদ্য সরবরাহে ঘাটতিকেন্দ্রিক চিন্তা দিয়ে দুর্ভিক্ষের প্রকৃতিকে ঠিক বোঝা যাবে না।

ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে জর্জ বার্নার্ড শ পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষের কথা এখানে আমরা টেনে আনতে পারি, যার প্রতিফলন ঘটেছিল সাহিত্য ও সংবাদপত্রে। সাহিত্যের এসব বিবরণী থেকে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে এক বিশ্বস্ত চিত্র উঠে আসে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে :(ক) ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ (যা ১১৭৬ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষ বা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ হিসেবে পরিচিত; (খ) ১৮৭০ দশকের খাদ্যাভাব বা গণমানুষের মধ্যে ক্ষুধার বিস্মৃতি; (গ) ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ (যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ হিসেবে পরিচিত); (ঘ) ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ (যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মন্বন্তর শুধু ঔপনিবেশিক পটভূমিতেই সংঘটিত হয়নি। উপনিবেশ-উত্তর ‘আধুনিক’ যুগেও একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ হিসেবে এটি থেকে গেছে; এবং (ঙ) ২০০৭-০৮ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আকস্মিক খাদ্য ঘাটতি ও চালের মূল্য বৃদ্ধি (যার ফল-পরিণামে সামরিক বাহিনী চালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনসমর্থনের ভিত প্রবলভাবে নড়ে গিয়েছিল এবং নির্বাচনের দিকে ঝুঁকে পড়তে রাজশক্তি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল)। অবশ্যই এসব ‘এপিসোড’-এ ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের প্রকৃতি এক রূপ নয় এবং এদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত বা কনটেক্সটও ভিন্ন। তবে প্রকৃতি ও প্রেক্ষিতের ভিন্নতা আমাদের অভিনিবেশের মূল বিষয়বস্তু নয়। এসব ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে, কীভাবে সাহিত্যের পাতায় সেসব বিবরণী উঠে এসেছে এবং এর থেকে সেদিনের অর্থনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে কিছু বিরল উন্মোচন হতে দেখি, যার সঙ্গে আর্কাইভে দলিলপত্র এবং সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানের সাক্ষ্যও সময় সময় নিষ্প্রভ ঠেকে।

৩. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

বাংলা সন ১১৭৬-এর (বা ইংরেজি ১৭৭০ সাল) মন্বন্তরের কারণে বাংলাদেশ ‘শ্মশানে’ পরিণত হয়। আমি সন্দেহ করি, এই ‘শ্মশান’ শব্দটির পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবহারের পেছনে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকা রয়ে গেছে গোচরে-অগোচরে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিমালা অনুসরণের পরিপ্রেক্ষিতে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ প্রকাশিত হয় এবং অচিরেই তা জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। এই স্লোগানে বর্ণিত ‘শ্মশান’ হওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরেই প্রথম। এই দুর্ভিক্ষের একশ’ বছর পরে উইলিয়াম হান্টারের ‘দ্য এনালস্‌ অব রুরাল বেঙ্গল’ (১৮৬৮) থেকে জানা যায় :১৭৭০ সালের মে মাসের পূর্বেই বাংলার ‘এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।’ হান্টারের এই বিবরণীটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসের মূল তথ্যভিত্তি জুগিয়েছিল। সম্প্রদায়গত বিভেদবাদী চিন্তার জন্য ‘আনন্দমঠ’ দুর্নাম কুড়িয়েছিল সঙ্গত কারণেই। কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে জানার জন্য এবং সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের দুর্ভিক্ষকেন্দ্রিক পটভূমি বোঝার জন্য বঙ্কিমের আনন্দমঠ উপন্যাসকে আজও পাঠ করা যেতে পারে।

কীভাবে দুর্ভিক্ষ নেমে এলো বাংলায়, বঙ্কিম তার বিবরণ পেশ করছেন এভাবে- আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদেই। উদ্ৃব্দতিটি দীর্ঘ। কিন্তু দুর্ভিক্ষের ঘটনা-পরম্পরার কার্য-কারণ সূত্র বোঝার জন্য তা বিশেষ সহায়ক :

‘১১৭৬ সালে গ্রীষ্ফ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃণ্ময় গৃহ। মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পালাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে। দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে। অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না। বৃক্ষে পক্ষী দেখি না। গোচারণে গরু দেখি না। কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর।’

শুধু স্বল্প-বিত্ত জনগোষ্ঠী নয়, অনেক বিত্তবান পরিবারও ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। বঙ্কিমের লেখায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় :’এক বৃহৎ অট্টালিকা- তাহার বড় বড় ছড়ওয়ালা থাম দূর হইতে দেখা যায়- সেই গৃহারণ্যমধ্যে শৈলশিখরবৎ শোভা পাইতেছিল। … তাহার অভ্যন্তরে ঘরের ভিতর মধ্যাহ্নে অন্ধকার। অন্ধকারে নিশীথফুল্লকুসুমযুগলবৎ এক দম্পতি বসিয়া ভাবিতেছে। তাহাদের সম্মুখে মন্বন্তর।’

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নিয়ে ‘কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচিত হয়নি’- এ রকম মন্তব্য করেছেন সুব্রত রায়চৌধুরী তার ‘কথাসাহিত্য মন্বন্তরের দিনগুলিতে’। যেটুকু বিবরণ পাই তা হান্টার সাহেবের লেখা থেকে। ‘দ্য এনালস্‌ অব রুরাল বেঙ্গল’ গ্রন্থে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের (খরা/অনাবৃষ্টিতে ফসলহানি) কারণে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। হান্টার লিখেছেন, ‘The famine of 1770 was therefore a one year’s famine, caused by the general failure of the December harverst in 1769, and intensified by a partial failure of the crops of the previous year and the following spring’. এই ঘটনার আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষক-অর্থনীতিতে প্রবল ধস নেমে আসার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। হান্টার আরও জানিয়েছেন যে, দুর্ভিক্ষের পরের বছর প্রকৃতি মুখ তুলে তাকালেন। বর্ষা হয়ে মাটি আবারও উর্বর হওয়ার সুযোগ পেল। কিন্তু মানুষের দুর্গতি গেল না। কেননা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরস পর্যন্ত উপলব্ধি করলেন যে, চাষাবাদ করার মতো যথেষ্ট লোকবল বাংলায় আর অবশিষ্ট নেই। হান্টারের গণনামতে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে ‘কৃষকদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগের’ প্রাণহানি হয়েছিল। শহর এলাকার ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের পাশাপাশি গ্রাম-এলাকার ডি-পপুলেশনের অভিঘাত এসে পড়েছিল বাংলাদেশে। ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট মোগল সম্রাট শাহ-আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ‘দেওয়ানি’ লাভ করার অধিকার পায়। দেওয়ানি অর্থাৎ খাজনার টাকা আদায় করার অধিকার লাভ। যেটা লক্ষণীয়, দেওয়ানি লাভ করার পাঁচ বছরের মাথাতেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো এক অদৃষ্টপূর্ব সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ বাংলায় নেমে আসে। এতে ইংরেজ শাসকবর্গের সুশাসনের গুণাবলির পরিচয় পাওয়া যায় না। যে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়, সে দেশে রাজ্য শাসনের নৈতিক অধিকার থাকে না- সে কথা বঙ্কিম জানতেন। সেটা ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই তিনি আনন্দমঠ লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন- এমনটা ভাবাও অবাস্তব নয়। মুখে যদিও তিন বলেছেন, ‘ইংরেজকে রাজা করিব’। কিন্তু আমার ধারণা, তার উদ্দেশ্য অন্তর্ঘাতমূলক। তিনি আসলে দেখাতে চান, কোম্পানির হাতে শাসনভার চলে যাওয়ার কারণেই ছিয়াত্তরের মতো এত বড় মন্বন্তর হতে পেরেছিল। ১৭০০ থেকে ১৭৬৫ পর্যন্ত নবাবি আমলে কৃষি ব্যবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতির চিহ্ন পরিলক্ষ্য হলেও সে সময়ে বাংলায় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। তখন চরম দারিদ্র্যের প্রকোপ ছিল; সময় সময় বাংলাদেশ উপোসী থাকত, কিন্তু মন্বন্তর ছিল না। হান্টারের বর্ণনা অনুসরণ করেই তিনি ইংরেজ শাসনকে পরোক্ষে সমালোচনা করেছেন। বঙ্কিম লিখেছেন- ‘১১৭৪ সালে ফসল ভালো হয় নাই। সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ্য হইল- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল… অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল। রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল। তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল। তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।’

এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, বঙ্কিমের বর্ণনায় শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা ছিল না। সাধারণ মানুষ যখন উপবাসে কষ্ট পাচ্ছে, তখন রাজশক্তি (প্রকারান্তরে ব্রিটিশ শাসন) ‘রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায়’ বুঝে নিচ্ছে; যখন অনাবৃষ্টিতে সামান্যই ফলন হয়েছে, তখন রাজশক্তি সিপাহিদের তথা সামরিক বাহিনীর জন্য সেই ফসল কিনে রাখছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে; এমনকি যখন লোকজন দুই বেলা করে উপবাস করছে, তখনও ‘রাজস্ব আদায়’ বন্ধ হয়নি। যাতে কোম্পানির মোট রাজস্ব আদায়ে টান না পড়ে তাই উপবাসের বছরে রাজস্বের মাত্রা ‘শতকরা দশ টাকা’ হারে বৃদ্ধি করা হলো। স্পষ্টতই এখানে জোর দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও অপশাসনের ওপরে, যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত দুঃখভোগকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এটা প্রথমত।

দ্বিতীয়ত, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের বছরে অন্যায় রাজস্ব-আদায়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ছাড়াও বঙ্কিম দুর্ভিক্ষের আরও একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষের ছায়াসঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সেটি হচ্ছে জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গ। বঙ্কিম লিখছেন :

‘খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। রোগ সমর পাইল, জ্বর, ওলাওঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত :বসন্তের প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না, মরিলেও কেহ ফেলে না।’

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১১] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১১


নতুন প্রসঙ্গ

১. ঋণং কৃত্বা

কথাটা এর আগেও কেউ কেউ বলেছিলেন, কিন্তু কৌশিক বসু যেভাবে বলেছিলেন, তাতে অর্থনীতি ও সাহিত্যের সম্পর্কের বিষয়টা অনেকের মনেই গেঁথে গিয়েছিল। তার ‘অ্যানালাইটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স :দ্য লেস ডেভেলপড্‌ ইকোনমি রিভিজিটেড’ গ্রন্থে তিনি এক পর্যায়ে আকস্মিকভাবেই শিবরাম চক্রবর্তীর ‘ঋণং কৃত্বা’ গল্পটির সবিস্তার বর্ণনা দেন। গল্পটা এমন :শিবরামের পাঁচশত টাকার জরুরি দরকার হয়ে পড়েছে মাসের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য। এ নিয়ে বাড়িওয়ালার কাছে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। কোনো উপায় না দেখে তিনি তার বন্ধু হর্ষবর্ধনের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ধার নিতে গেলে ধার ফেরত দেওয়ারও নিশ্চয়তা থাকা চাই। অত-শত না ভেবে হর্ষবর্ধনকে তিনি বললেন, ‘বেশি নয় শ-পাঁচেক। আজ তো বুধবার, শনিবার দিনই টাকাটা আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেবো।’ ধার পেলেন বটে, কিন্তু টাকা ফেরত দেবেন কী করে অত তাড়াতাড়ি? এ রকম ভাবছেন যখন, হঠাৎ রাস্তায় তার দেখা হয়ে গেল হর্ষবর্ধনের ছোট ভাই গোবর্ধনের সাথে। ‘গোবর্ধন ভায়া, যদি কথা দাও যে তোমার দাদাকে বলবে না তাহলে একটা কথা বলি।’ গোবর্ধন তাকে আশ্বস্ত করল। ‘অন্য কিছু নয়, কথাটা হচ্ছে এই, আমাকে শ-পাঁচেক টাকা ধার দিতে পার- দিন কয়েকের জন্য? আজ তো শনিবার? এই বুধবার সন্ধ্যের মধ্যেই টাকাটা আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব।’ গোবর্ধনের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে শিবরাম এবার হর্ষবর্ধনকে তার ধারটা ফেরত দিয়ে দিলেন। এতে ‘ভালো ঋণ গ্রহীতা’ হিসাবে শিবরামের ওপরে আস্থা আরও বেড়ে গেল। পরের সপ্তাহে বুধবার দিনই অবশ্য আবার হর্ষবর্ধনের দ্বারস্থ হতে হলো তাকে, গোবর্ধনকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। টাকা পেয়ে গোবর্ধনও সন্তুষ্ট, তবে বুধবার টাকা ফেরত দেওয়ার কিছু পরেই আবারও ধার করতে হলো শিবরামকে- এবার শনিবার হর্ষবর্ধনকে তার ধার শোধ দেওয়ার জন্য। এইভাবে ‘হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, গোবর্ধন আর হর্ষবর্ধন- শনিবার আর বুধবারের দু-ধারের টানাপড়েন’ চলতে থাকল। অনেক দিন পর্যন্‌ত এটা চলছিল। কিন্তু এভাবে কতদিন আর চালানো যায়! অর্থনীতির পরিভাষায়, এ রকম দায়দেনার চক্র ‘সাসটেইনেবল’ হয় না। এর পরের অংশ শিবরামের অননুকরণীয় ভাষায় তুলে ধরছি :

‘হর্ষবর্ধন বাবু ভাই গোবর্ধন, একটা কথা আমি বলবো, কিছু মনে করো না-‘ বলে আমি শুরু করি :’ভাই গোবর্ধন, তুমি প্রত্যেক বুধবার হর্ষবর্ধন বাবুকে পাঁচশো টাকা দেবে। আর হর্ষবর্ধন বাবু, আপনি প্রত্যেক শনিবার পাঁচশো টাকা আপনার ভাই গোবর্ধনকে দেবেন। হর্ষবর্ধন বাবু, আপনি বুধবার, আর গোবর্ধন, তুমি শনিবার মনে থাকবে তো?’

‘ব্যাপার কি!’ হর্ষবর্ধন তো হতভম্ব :’কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘ব্যাপার এই যে, ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।’

কৌশিক বসু এই গল্পটি প্রোথিত করেছেন তার বইয়ের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট’ পরিচ্ছেদে। কিন্তু আমাদের দেশের সাম্প্রতিককালের একটি বহুল আলোচিত বিষয় খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রেও শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পটি শিক্ষণীয় হতে পারে। একাধিক ঋণদাতার কাছে যারা একই সময়ে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন, তারা অনেক দিন পর্যন্ত ‘শনিবার-বুধবার’ জাতীয় ঋণ-চালাচালি (Credit Juggling) করতে পারেন এবং এতে সাময়িকভাবে ‘ভালো’ ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তাদের সুখ্যাতি বেড়েও যেতে পারে। এর ফলে যিনি কোনো ব্যাংকের কাছ থেকে শুধু সীমিত আকারের ঋণই প্রত্যাশা করতে পারতেন, ঋণ-চালাচালির মাধ্যমে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধের মাধ্যমে তিনি বৃহদাকার ঋণ পাওয়ার পর্যায়ে নিজেকে উন্নীত করতে পারেন। ব্যাংকের জন্য এর মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হতে পারে মারাত্মক। কেননা, যখন এক উৎস থেকে ধার নিয়ে আরেক উৎসের ধার ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটি ধরা পড়ে তখন হয়তো বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। এই অশুভ ঋণ-চালাচালির ব্যবস্থার ফলে বড় আকারের ঋণ মন্দ ঋণে বা খেলাপি ঋণে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়। এদিকটা শিবরাম চক্রবর্তীর দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রথমবার হর্ষবর্ধনকে তার ধার ফেরত দেওয়ার পর তিনি বলছেন :

‘ভাবছেন এই যে, এই পাঁচশো টাকা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ক্রেডিট খাটিয়ে এর পরে আমি ফের হাজার টাকা ধার নেবো। তারপর সেটা ফেরত দিয়ে আবার দু হাজার চাইবো। আর এমনি করে ধারটা দশ-হাজারে দাঁড় করিয়ে তারপরে আর এ-ধারই মাড়াবো না? এই তো ভাবছেন আপনি?’

এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো যেতে পারে, মাল্টিপল লেন্ডারদের মধ্যে ঋণ-চালাচালির মাধ্যমে একজন মন্দ ঋণ গ্রহীতা শুধু সাময়িক সময়ের জন্যই পার পেতে পারে। এক সময় তাকে ধরা পড়তেই হয়, যেমনটা একদিন শিবরামকে হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন উভয়েরই মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কেননা, একজনের থেকে ধার-কর্জ করে ধার শোধ করার ‘শনিবার-বুধবার’ জাতীয় ব্যবস্থা টিকে আছে একটা শর্তের ওপরে, যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন, ‘ইনফর্মেশন এসিমেট্রি’। গোবর্ধনকে শিবরাম বারবার বলে দিয়েছিলেন, তার ধার করার ব্যাপারটি যেন হর্ষবর্ধনকে জানানো না হয়। আধুনিক ব্যবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাউকে বড় আকারের ঋণ দেওয়ার আগে নিজেদের মধ্যে তথ্য-বিনিময় করতে পারে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফর্মেশন ব্যুরোর সাহায্য নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিবরামের ‘শনিবার-বুধবার’ ব্যবস্থা কাজ করতে পারত না। যা হোক, ওপরে যে সম্ভাবনার কথা লিখলাম তা শুধু আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নয়; গ্রামাঞ্চলের মাইক্রো ক্রেডিট সেক্টরেও প্রযোজ্য। ‘শনিবার-বুধবার’ ব্যবস্থায় এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিওর কিস্তি পরিশোধ করা খুবই সম্ভব। যদিও বিভিন্ন এনজিও উৎস থেকে একই সঙ্গে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ রয়েছে, তারপরও দেখা যায় এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি ঋণ গ্রহীতা বিভিন্ন সূত্রের কাছে ঋণী থাকছে। তার ন্যায়সঙ্গত কারণও রয়েছে :একজন ঋণ গ্রহীতা হয়তো তার ব্যবসা অবিলম্বে বাড়াতে চান। সে জন্য তাকে নানা উৎসের কাছে হাত বাড়াতে হয়। কিন্তু সবাই হয়তো সে কারণেই শুধু বহুবিধ উৎসের কাছে ঋণ খোঁজেন না। এক শ্রেণির ঋণ গ্রহীতা এই আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাতেও বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ লাভ করেন এবং নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে সেসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে দীর্ঘ সময় নিরাপদে কাটিয়ে দিতে পারেন। এবং এক পর্যায়ে ধরা পড়ে গেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিব্যি বলে দিতে পারেন, ‘ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনারা কে কত ঋণ মওকুফ করবেন সেটা নিজেরাই ঠিক করে নিন। আপনাদের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।’ ততদিনে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এতটাই দায়দেনা জমেছে তার নামে; কোনো একক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাধ্য কী তাকে ধরে!

২. অমর্ত্য সেনের উদাহরণ

অর্থশাস্ত্র ও সাহিত্যের অন্তর্লীন সম্পর্ক অনুধাবন করার জন্য কৌশিক বসুর শিক্ষক অমর্ত্য সেনের মানব-উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়, বৈষম্য ও দুর্ভিক্ষবিষয়ক লেখাগুলোকে ‘প্রতিনিধিত্বশীল রচনা’ হিসেবে পাঠ করা যায়। কয়েকটি উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করছি। প্রথমেই মনে পড়বে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট তথা মানব-উন্নয়ন ধারণার কথা। ইউএনডিপি কর্তৃক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স বা মানব-উন্নয়ন সূচকের পেছনে মৌলিক দার্শনিক প্রেরণা এসেছিল দ্বিবিধ উৎস থেকে। একটি হচ্ছে, অ্যারিস্টটলের নীতিশাস্ত্র, বিশেষত ‘নিকোমেখিয়ান এথিকস’। অন্যটি হচ্ছে, বৃহদারণ্যক উপনিষদ। প্রথম সূত্রটি অপেক্ষাকৃত আলোচিত, কিন্তু শেষের সূত্রটির প্রতি সেনই প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। গল্পটি এমন :বানপ্রস্থে যাওয়ার আগে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্ক্য তার স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে ডেকে ধন-সম্পদের বরদানের ইচ্ছা পোষণ করলেন। ‘যদি সসাগরা পৃথিবী সম্পদে-বৈভবে পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং কেবল আমারই করায়ত্ত হয়, তবে কি আমি অমরত্বপ্রাপ্ত হবো?’ মৈত্রেয়ী বরদানের পূর্বে ঋষিকে প্রশ্ন করলেন। যাজ্ঞবল্ক্ক্য বললেন, ‘না, তোমার জীবনও অন্য যে কোনো ধনী ব্যক্তির মতোই হবে সে ক্ষেত্রে। ধন-সম্পদের মাধ্যমে অমরত্ব লাভের কোনোই আশা নেই।’ সে কথা শুনে মৈত্রেয়ী তখন বলেছিলেন, ‘যে নাহং নামৃতা স্যাম তে মোহং কিম কুর্যাম? যা আমাকে অমরত্ব পেতে সাহায্য করবে না তা দিয়ে আমি কী করব?’ এ কথা উল্লেখ করার পর সেন তার ‘দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে লিখছেন, ‘মৈত্রেয়ীর কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি আমাকে জিএনপি বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন বিচার করার পদ্ধতির বাইরে উন্নয়নের অন্য ধারণাকে খুঁজে বের করতে ও ব্যাখ্যা করতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করছিল।’ যার প্রমাণ মেলে তার ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’ বইয়ে।

অন্যত্র, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে সেন ব্যালটকেন্দ্রিক ধারণার বাইরে গিয়ে যুক্তিবাদী চর্চা, নাগরিক অধিকার, নির্ভয়ে মতপ্রকাশের ব্যক্তিস্বাধীনতা, জাত-পাত ভেদ-বুদ্ধির বাইরে সহনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা, তর্কপ্রিয়তা প্রভৃতি গুণের ওপরে জোর দিয়েছেন। পাবলিক চয়েস স্কুলের স্রষ্টা জেমস বুকাননের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে ‘গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাসন’। এসব প্রতিটি বিষয়ে সেনের নানা লেখায় দর্শন, কবিতা, ইতিহাস, পুরাণ- এক কথায় বৃহত্তর অর্থে সাহিত্য-প্রসঙ্‌েগর উল্লেখ রয়েছে। মৃত্যু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রামমোহন রায়ের বরাত দিয়ে সেন লক্ষ্য করেন, মৃত্যু ভয়াবহ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ভয়াবহতা এ কারণে নয় যে, সত্তার বিলয় হচ্ছে। ‘ভাবুন একবার, আপনার মৃত্যুর দিনে চারপাশের মানুষজন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, আর আপনি সেসব কথা ও তর্কের কোনো উত্তর বা প্রত্যুত্তর দিতে পারছেন না।’ কেন মতের ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা বা অ-সমসত্তার প্রতি জোর দেওয়া দরকার, এটা বোঝাতে তিনি আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালের একটি বিরল দৃষ্টান্তের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন সম্রাট আলেকজান্ডার। এমনিতে অ্যারিস্টটলের কাছে শিক্ষা লাভ করেছেন, তার ওপরে মহাযোদ্ধা। বীরদর্পে তিনি ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এখানে-ওখানে অভিযান করে বেড়াচ্ছেন। এক জায়গায় গিয়ে তিনি দেখলেন, কয়েকজন জৈন ধর্মাবলম্বী দার্শনিক নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে ব্যস্ত। বিশ্ববিজয়ী গ্রিক সম্রাটের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই তাদের নেই। এ রকম মনোভাবের কী কারণ তা জানতে চাইলে তাদের একজন বললেন, ‘হে সম্রাট আলেকজান্ডার [বিশেষ করে তোমার দিকেই আমাদের তাকাতে হবে কেন তা বুঝতে পারছি না।] তুমি যতটা পৃথিবীর জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছ, প্রতিটি মানুষ ততটাই জায়গার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মতোই তুমি মানুষ; পার্থক্য কেবল যে তুমি সব সময় নিজেকে অকাজে ব্যস্ত রাখছ- কোনো কাজেই আসছ না। নিজ দেশ থেকে খামোখাই কত শত মাইল দূরে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছ এখানে। এতে তোমার যেমন বিরক্তি হচ্ছে, অন্যদেরও বিরক্তি উৎপাদন করছ… অচিরেই তোমার মৃত্যু হবে, এবং তখন এই পৃথিবীর ততটাই তোমার অধীনে থাকবে যতটা দরকার কেবল তোমাকে কবরস্থ করতে।’ কথাগুলো আলেকজান্ডারের পছন্দ হয়েছিল, যদিও বাস্তবে তার পদক্ষেপগুলো ছিল জৈন দার্শনিকদের মতের সম্পূর্ণ বিপরীতে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। শাসকগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিরা এ রকমই হয়ে থাকেন :যে মতকে তার শ্রেষ্ঠ ও অনুকরণীয় মনে করেন, তাকে তারা কখনও অনুসরণ করেন না।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::১০

[গত সংখ্যার পর]
এটা ঠিক যে, বঙ্কিম অন্যত্র বলেছেন, ‘আকবর শাসিত ভারতবর্ষকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বলি।’ এতে রাজশক্তির সুশাসনের গুণাবলির ওপরেই গুরুত্ব বেশি করে পড়ে; তার ধর্মপরিচয় নির্ণয়ের ওপরে নয়। তবু ধর্মপরিচয় নিয়ে বঙ্কিমের নিজের ভেতরে টানাপড়েন ছিল, পাছে নিরপেক্ষ পাঠক তাকে একদেশদর্শী ভাবেন, তা নিয়ে। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের উপসংহারে তাই বঙ্কিম আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি দিচ্ছেন এভাবে :’গ্রন্থকারের বিনীত নিবেদন এই যে, কোনো পাঠক না মনে করেন যে, হিন্দু মুসলমানের কোনো প্রকার তারতম্য নির্দেশ করা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। হিন্দু হইলেই ভালো হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না, অথবা হিন্দু হইলেই মন্দ হয় না, মুসলমান হইলেই ভালো হয় না। ভালো-মন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।’ কিন্তু এর থেকে বঙ্কিম ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের ‘যুক্ত সাধনা’র কোনো আদর্শ স্থাপনে এগিয়ে এলেন না। এর পরবর্তী লাইনগুলো ব্যয়িত হলো তুলনামূলক বাহুবল ও রাজকীয় গুণের তত্ত্বে, যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শতাব্দীব্যাপী এক দ্বন্দ্বাত্মক ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আচরণের কথাই কেবল তুলে ধরে। হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত যে একই সুখ-দুঃখের জীবন অতিবাহিত করে এসেছে- সে কথা রাজকীয় ইতিহাসের তুলনামূলক ভূমিকার পর্যালোচনায় চাপা পড়ে গেল। যখন হিন্দু-মুসলমানকে ইতিহাসের বলয়ে সমদর্শী চোখে দেখার চেষ্টা করেছেন তখনও বঙ্কিম রাজশক্তি লাভে ইচ্ছুক পরস্পর যুধ্যমান দুই পরাশক্তি হিসেবেই তাদেরকে চিহ্নিত করেছেন :’বরং ইহাতে স্বীকার করিতে হয় যে, যখন মুসলমান এত শতাব্দী ভারতবর্ষের প্রভু ছিল, তখন রাজকীয় গুণে মুসলমান সমসাময়িক হিন্দুদিগের অপেক্ষা অবশ্য শ্রেষ্ঠ ছিল। কিন্তু ইহাও সত্য নহে যে, সকল মুসলমান রাজা সকল হিন্দু রাজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অনেক স্থলে মুসলমানরাই হিন্দুর অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অনেক স্থলে হিন্দু রাজা মুসলমান অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণের সহিত যাহার ধর্ম আছে- হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, সেই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণ থাকিতেও যাহার ধর্ম নাই-হিন্দু হউক, মুসলমান হউক-সেই নিকৃষ্ট।’ এখানে তিনি স্পষ্টতই মিল-বর্ণিত লিবার্টি ও ইকুয়ালিটির সাম্য-চিন্তা থেকে সরে এসে ধর্মকেন্দ্রিক আত্মপরিচয়ের ওপরে বিশেষ করে জোর দিচ্ছেন। যিনি ধর্মানুরাগী তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি ধর্মশূন্য তিনিই নিকৃষ্ট বললে হিন্দু-মুসলিম চলমান সমস্যার কোনো সুরাহা হয় না, বরং সমস্যার সূত্রপাত হয় কেবল, যার পরিচয় পাই পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্রনৈতিক সেক্যুলারিজমের ব্যর্থতায়।

তারপরও বঙ্কিমের জীবনের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’-এ মুসলমান ফকির চাঁদশাহের মুখ দিয়ে সীতারামের উদ্দেশে যে কথা বলা হয়, তার থেকে ভিন্ন এক রাজনৈতিক-সামাজিক সম্ভাবনা যেন উঁকি দিয়ে ওঠে :’ফকির বলিল, বাবা। শুনিতে পাই, তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছো, কিন্তু অত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু-মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু-মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে। সেই এক জনই হিন্দু-মুসলমানকে সৃষ্টি করিয়াছেন; যাহাকে হিন্দু করিয়াছেন, তিনিই করিয়াছেন, যাহাকে মুসলমান করিয়াছেন, সেও তিনিই করিয়াছেন। উভয়েই তাঁহার সন্তান; উভয়েই তোমার প্রজা হইবে। অতএব দেশাচারের বশীভূত হইয়া প্রভেদ করিও না। প্রজায় প্রজায় প্রভেদ পাপ। পাপের রাজ্য থাকে না।’

এ উক্তি সাতচল্লিশের পার্টিশনের কালে নেহরু, প্যাটেল ও জিন্নাহ্‌র প্রতিও বলা যেতে পারত। এই উক্তিকে যদি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকৃত সত্তা বলে মেনে নিই, তাহলে অন্য সব অসংবেদনশীল রূঢ় উক্তি সকলকে ব্যাখ্যা করি কী করে? আনন্দমঠ-এর অরাজক পরিবেশে ভবানন্দ কি বলেনি, ‘সকল দেশে রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের সম্বন্ধ। আমাদের রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ তারপর রয়েছে দাঙ্গার বিভীষিকাময় বর্ণনা, তা-ও আবার পল্লীগ্রামের পটভূমিতে :”সকলে বলিল, ‘ইংরেজ মুসলমান একত্রে পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্ত কণ্ঠে হরি হরি বল।’ গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুটিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, ‘মুই হেঁদু’।” বাংলায় পর্যায়ক্রমিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয় বিশ শতকে। কিন্তু তার আগেই বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের পাতায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন জাগে- আনন্দমঠ থেকে উপরোক্ত সন্ন্যাসী ভবানন্দ-নিঃসৃত উদ্ধৃতির বঙ্কিম আর সীতারাম থেকে পূর্বে উল্লিখিত ফকির চাঁদশাহ-নিঃসৃত উদ্ৃব্দতির বঙ্কিম কি একই ব্যক্তি, একই লেখক, একই সত্তার দুই বিপরীত বহিঃপ্রকাশ? বিশ্বাস হতে চায় না এই বিভাজন-রেখা একই সৃষ্টিশীল প্রতিভার মধ্য দিয়ে চলেছে। উনিশ শতকের বাংলায় একাধারে আধুনিকতাবাদী রেনেসাঁ ও হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের যে বিকাশ ঘটে, তার মৌলিক দ্বিত্বতার প্রকাশ পাই বঙ্কিম-মানসে। এই দ্বিখণ্ডন অমোচনীয়, অপরিত্রাণযোগ্য, যা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে একটি প্রধান ধারায় পরিণত করবে তার মৃত্যুর দুই দশকের মধ্যেই। এর ত্র্যহস্পর্শ থেকে কংগ্রেস-লীগ ধারার রাজনীতিক প্রায় কেউই বাদ যাবেন না। মিল-বঙ্কিমের সত্তার বিভক্তির সূত্রেই; উদার ও অনুদার চিন্তারাজিকে একত্রে সহাবস্থানে অনুপ্রাণিত প্রদর্শিত পথেই অগ্রসর হবেন অনেক প্রাগ্রসর মুসলিম বুদ্ধিজীবীও।

৩. শেষের কথা

ফ্রয়েডের শেষ জীবনের লেখা ‘আউটলাইন অব সাইকো-অ্যানালাইসিস’-এ ‘বিভক্ত সত্তা’ বিষয়ে উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। সেখানে ফ্রয়েড দেখান কী করে সত্তা ‘নিজের ভেতরে ফাটল অথবা বিভক্তির দেয়াল তুলে দিয়ে’ ক্রমাগত দ্বৈরথের দোটানার ফলে ‘সম্ভাব্য বিনাশ থেকে নিজেকে রক্ষা করে’। এই লেখাটিকে জাক লাকাঁ ফ্রয়েডের সেরা লেখাগুলোর একটি বলে চিহ্নিত করেন। আমাদের আলোচনার জন্য ফ্রয়েডের এই ধারণাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্টের এক প্রধান ব্যক্তিত্ব জন স্টুয়ার্ট মিল কী করে ভারতবর্ষীয় উপনিবেশ প্রশ্নে এসে অবলীলায় ‘ভিন্ন রীতি’ অবলম্বনের পথে ওকালতি করেন। ইউরোপের জন্য ‘লিবারেল’ চিন্তা, আর ভারতবর্ষের জন্য ‘ইল-লিবারেল’ চিন্তার অনুমোদন উপনিবেশে আধুনিকতার চৌহদ্দি নিয়ন্ত্রণ করে দিয়েছিল। এই আধুনিকতা, যাকে ‘ঔপনিবেশিক আধুনিকতা’ বলা যায়- শব্দ-উপমা ব্যবহারে ইউরোপের ঝুলি থেকে নানা বুলি ধার করেছে। কিন্তু সেই সাথে তাকে এই সীমানাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে যে, ইউরোপীয় আধুনিকতার সবকিছু তার জন্য প্রযোজ্য নয়। কেন প্রযোজ্য হবে না, এ জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণ হাজির করেননি মিল। মিলের দুই সত্তা। একদিকে ইউরোপীয় উদারনৈতিক চিন্তকের ভাবমূর্তি, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুদার নীতিমালা নির্ধারণে প্রশাসনিক ভূমিকা পাশাপাশি বিরাজ করছিল কোনো দৃশ্যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি না করেই। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সত্তার ভেতরে যাতে প্রচন্ড দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি না হয় সে জন্যই সত্তা বিভক্ত হয়ে যায় দুই অচেনা প্রদেশে। এতে যুক্তিবাদিতা ও অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দুই-ই অনায়াসে মুখ দেখাদেখি না করে অনায়াসে চলতে পারে।

আমরা দেখেছি মিল-শিষ্য বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিভক্তির অনুবৃত্তি। ভারতবর্ষীয় জাতি-গঠন প্রকল্পে এসে আপাদমস্তক যুক্তিবাদী ‘র‌্যাশনাল’ বঙ্কিম শেষ পর্যন্ত এক দ্বিখণ্ডিত সত্তায় বিভক্ত হয়ে গেলেন। সেখানে শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠীকেই জাতি গঠনের মধ্যে স্বীকার করে নেওয়া হলো; অন্যদিকে, মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ঠেলে দেওয়া হলো জাতির বাইরে, ইতিহাসের বাইরে, আধুনিকতার বাইরে ‘অপর-বর্গ’ হিসেবে। এই কাজটি করা হলো কোনো যুক্তি-তর্ক-ফয়সালার মাধ্যমে নয়; সম্পূূর্ণ একপেশে যুক্তিরহিত পদক্ষেপের মাধ্যমে। ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ নির্মাণে বঙ্কিম যতটা তার্কিক শক্তি ব্যবহার করেছেন, তার সামান্যতম নমুনাও আমরা কোথাও দেখতে পাই না মুসলমান জনগোষ্ঠীকে অপাঙ্‌ক্তেয় করার ক্ষেত্রে কোনো যুক্তি প্রদর্শনে। কেন তিনি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ভারতবর্ষীয় কমিউনিটির বাইরে দূরে সরিয়ে রাখলেন; ভারত-ইতিহাসের অন্দরমহলে স্থান দিলেন না- এ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা নেই তার।

আমি সন্দেহ করি যে, সাইকো-অ্যানালাইসিসে যদিও রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত ছিল না, তবুও তার কোনো কোনো লেখাকে ‘বিভক্ত সত্তা’র ওপরে ক্রিটিক্যাল কমেন্টারি হিসেবে দিব্যি পাঠ করা যায়। বঙ্কিম যেখানে ইউরোপীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতি গড়ার প্রকল্পে এগোবেন এবং মাতৃরূপিণী দেবী শক্তির কাছে উৎসর্গীকৃত হিন্দু জাতির আদর্শকে শেষ পর্যন্ত শ্রেয়োজ্ঞান করবেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে (স্বদেশী সমাজ পর্বের মোহভঙ্গের পর) পুনর্বিবেচনা করবেন সমগ্র জাতি গঠন প্রকল্পকেই। জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ অভিহিত করবেন ‘ভৌগোলিক অপদেবতা’ বলে; বঙ্কিম রচিত ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত যে কোনোভাবেই ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসেবে গীত হতে পার না- এ মর্মে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে চিঠি লিখবেন। আমার এ রকমও মনে হয় যে, তার লেখায় ‘ছোট ইংরেজ’ বনাম ‘বড় ইংরেজ’ বিভাজন শুধু ইংরেজ রাজ-কর্মচারী যারা ভারত শাসন করেছেন, আর ইংরেজ সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী যাদের লেখা পড়ে ভারতবর্ষীয়রা আধুনিক সাহিত্য-দর্শনে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠেছেন, এই দুই বলয়ের বৈপরীত্য বোঝাবার জন্যই কেবল লেখা হয়নি। একই সত্তার মধ্যেই ‘ছোট ইংরেজ’ ও ‘বড় ইংরেজ’ ঢুকে যেতে পারে, বাইরের বিভক্তি তখন লিবারেল আধুনিকতার অন্তরের বিভক্তিতে পরিণত হতে পারে- এমন একটি সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি।

আমি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে সত্তার এই বিভক্তিকে কোনো সাধারণ মাপের দোলাচল, দ্বৈরথ, নিছক ‘নেতিবাচক ও ইতিবাচক’ প্রবণতার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা যায় না। ইউরোপের আধুনিকতার জন্য ‘এক নিয়ম’, আর ভারতবর্ষীয় ঔপনিবেশিক আধুনিকতার জন্য ‘অন্য নিয়ম’- মিলের এই কল্পনাকে নিছক ‘প্রগতিশীল’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ প্রবণতার দ্বন্দ্ব বললে আধুনিকতার শাসন-সংকটের গভীরে যাওয়া যায় না। ঠিক একইভাবে যুক্তিবাদী বঙ্কিম-মানসে হিন্দুদের জন্য ‘এক নিয়ম’, আর মুসলমানদের জন্য ‘অন্য নিয়ম’- এ রকম কল্পনাকেও ইতি এবং নেতির দ্বন্দ্ব বলে লঘু করা যায় না। সাধারণ মাপের মানুষ হলে যা-ও বা দেখা যেত, তাদের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তীক্ষষ্টধী মনন, ইউরোপীয় ও ভারতবর্ষীয় জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের পথিকৃৎ ভূমিকার কথা মনে রাখলে তাদের ব্যক্তিগত সত্তার ফাটল আর ‘ব্যক্তিগত’ থাকে না। পরবর্তীকালের ঔপনিবেশিক শাসন ও তার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্রমশ বিভেদমুখী বিকাশের জন্য এই সত্তার বিভক্তি এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারতবর্ষে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল