বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৩

৩. গণতন্ত্রের হাত ধরে এই সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করা শক্ত- এটা স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে : ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ দীর্ঘকাল ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশায় রয়েছেন। সংবিধানে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছে।’ কিন্তু ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা’ আর ‘গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা’ এ দুটো লক্ষ্য পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠবে না তো? এই সম্ভাবনা স্বীকার করে বলা হচ্ছে : ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করতে গিয়ে আমরা যে নতুন পথে চলেছি, সে বিষয়ে আমরা সচেতন। সমাজতন্ত্রের দিকে পরিকল্পিত অগ্রগতির পথে যাতে কোনো বাধা সৃষ্টি হতে না পারে, সেজন্য সংবিধানে কয়েকটি বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে।’ এর মধ্যে একটি হলো, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে ‘সম্পত্তির অধিকারকে’ সীমাবদ্ধ করা। উদ্ৃব্দতিটি তাৎপর্যপূর্ণ :

‘সম্পত্তির অধিকার বা ব্যবসা ও বাণিজ্যের অধিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, ভূমি-সংস্কার ও অন্যান্য ব্যবস্থার পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। এই জন্যে আমরা বলেছি যে, আইন সাপেক্ষে এইসব অধিকার ভোগ করা হবে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন মনে করলে সংসদ এই সব অধিকার হরণ করতে বা সীমাবদ্ধ করতে পারবেন। সংসদ যদি সেরকম কোনো আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে আদালত তা নাকচ করতে পারবেন না। নাগরিকদের অধিকার রক্ষার পূর্ণ ক্ষমতা আদালতকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করে সম্পত্তি ও ব্যবসা সংক্রান্ত যেসব আইন সংসদ তৈরি করবেন, আদালত সেগুলো নাকচ করতে পারবেন না।’

অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে এমন ধুয়া তুলে কালক্ষেপণ করা যাবে না। এখানে লিবারেল প্রিন্সিপলকে অতিক্রম করে সোস্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এক হিসাবে, মিলকে ছাড়িয়ে এখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মার্কসের উত্তরাধিকার। এই সমাজতন্ত্র উন্নত পুঁজিবাদী দেশের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ ধারণার চেয়ে স্পষ্টতই আরও বেশি কিছু। এ কথা স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১৯ অক্টোবরের ভাষণে। সেই ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, তা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমার দালিলিক আলোচনাকে সমর্থন করে :

‘আমার বন্ধু যারা অনেক সময় ইতিহাসের বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করেন, তারা পর্যালোচনা করে অনেক সময় দেখতে চান না যে, যেদিন সমাজতন্ত্রের প্রোগ্রাম আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছিল, সেদিন আজকের অনেক দল শুধুমাত্র welfare state-এর প্রোগ্রাম নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে যখন আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রাম করতে করতে মানুষের অধিকার এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের পন্থাকে চিন্তা করে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম, তার পূর্ব হতেই আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম করে আসছিল।’

তারপরও গণতন্ত্রের পথ ধরে সমাজতন্ত্রে পৌঁছনো যাবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় ছিল অনেকের মনেই। ওই একই বক্তৃতায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন : ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব কি সম্ভব নয়, সেই বিতর্কে আমি যাব না। তবে আমরা বিশ্বাস এবং আস্থার সঙ্গে সেই পথ বেছে নিয়েছি। বেছে নিয়েছে সারা জাতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, একনায়কত্ব নয়।’ সমাজতন্ত্রের দিকে চলার পথে গণতন্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কিনা সে সম্পর্কে সাংবিধানিক ধারা সংযোজন করা দরকার এই মর্মে ড. কামাল হোসেন যে কথা ইতোপূর্বে বলেছিলেন, এবার তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি। গণতান্ত্রিক সব অধিকারই থাকবে, শুধু একটি জায়গায় ছাড়া। সেটি হলো শাসনতন্ত্রের তৃতীয় ভাগের ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ। সৈয়দ নজরুল বললেন :

‘যারা মনে করেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়, তারা যে প্রশ্নটি করেন সেটা হলো এই যে, সম্পত্তির মৌলিক অধিকার যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত করা অথবা সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য রাষ্ট্রের যদি যে কোনো সময় সম্পত্তির অধিকার করা অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তার প্রতি সেটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিনা… আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এই প্রশ্ন এসেছিল। যেদিন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ব্যাংক, ইনসিওরেন্স জাতীয়করণ করার জন্য আইন পাস করেছিল, সেদিন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস জনাব হেদায়েতুল্লাহ তাকে নাকচ করেছিলেন এই বলে যে, সম্পত্তির মৌলিক অধিকারের প্রশ্নের এটা বিরোধী। সেজন্য আমাদের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন ছিলেন বলে এই শাসনতন্ত্রের তৃতীয় ভাগে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রযোজিত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং মৌলিক আদর্শের প্রয়োজনে রাষ্ট্রায়ত্ত করার আদর্শকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।’

গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্টের পূর্ব ইতিহাস রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের- এ কথা সেদিনের গণপরিষদের বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করেছেন তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তার বক্তব্য পরিস্কার- গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার যেমন দীর্ঘদিনের, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার প্রতিও দলটির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বহু বছর আগে থেকেই চলে আসছে। সেটা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সংগ্রামে আরও বেশি করে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু এর উৎপত্তি আরও আগে। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ঘোষণা ও কর্মসূচির আলোচনায় আমি কিছুটা আলোচনা করেছি। কিন্তু তার একটি সাক্ষ্য পাচ্ছি স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদের সেদিনের ভাষণেও। সেটি এবার শুনে নেওয়া যাক। ৩০ শে অক্টোবরের এই ভাষণে তাজউদ্দীন সংসদে বলেছিলেন :

‘অর্থনৈতিক অধিকারের কথা বলতে গেলে আজকে গর্বের সঙ্গে এই পরিষদে ঘোষণা করতে চাই, আমার দল আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের ৬, ৭, ৮ তারিখে ঢাকার গ্রিন রোডের আমবাগানে যে কাউন্সিল অধিবেশন করেছিলেন, তাতে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে পরিস্কার ভাষায় এ দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন ধাপে জাতীয়করণের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার বিধান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে গৃহীত হয়। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে এ দেশে সমাজতন্ত্রের কথা বলে এসেছেন। আগে সমাজতন্ত্রের কথা মানুষ পরিস্কারভাবে বুঝত না। যারা সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল তারা মানুষের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করত। সমাজতন্ত্রের কথা বললে সমাজতন্ত্রকে ধর্মের সঙ্গে জড়িত করে তাকে ধর্মবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হতো এবং মানুষের এক অংশকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যেত। আজকে আওয়ামী লীগ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্কারভাবে সমাজতন্ত্র কী, তা বলে দিয়েছে।’

এরপর তাজউদ্দীন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেব সমাজতন্ত্রের কথা তুললেন : ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা।’ এরপর ‘প্রগতিবাদী’ সমালোচকদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন : ‘যারা প্রগতিবাদী বলে দাবি করেন, তারা সমালোচনা করছেন এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক সংবিধান নয় বলে। আমি জানি না, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান কীভাবে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে, সে পরিকল্পনা কেউ যদি দিতে পারতেন, তাহলে এই পরিষদ তা অত্যন্ত সতর্কতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতেন। আমি সমাজতান্ত্রিক দেশের বিভিন্ন সংবিধান- ২৫ বছর আগের, ৩০ বা ৫০ বছর আগের সংবিধান দেখেছি। তাতে যে বিধান রয়েছে সে বিধান আজকে বাংলাদেশের সংবিধানের চাইতে যে উন্নত, সে কথা বলা চলে না … তবে বাস্তব ভিত্তিতে এই অবস্থায় এ দেশে সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্র করা যাবে কিনা, সেটা দেখতে হবে।’

এটা বলেই তাজউদ্দীন লক্ষ্য করেন যে, সেদিনের বাংলাদেশে সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্র দূরে থাক, পূর্ণ গণতন্ত্রও বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন : ‘আজকে আমাদের সামনে সবচাইতে বড় যে কর্তব্য রয়েছে, সেটা হচ্ছে আমাদের সমাজের অবস্থা লক্ষ্য করা। … আজকে আমাদের সমাজের যে অবস্থা, তাতে সমাজতন্ত্র দূরের কথা- পূর্ণ গণতন্ত্রের অবস্থাও আসতে পারে না।’ তাজউদ্দীনের গোটা ভাষণে তার স্বভাবসুলভ বিশ্নেষণী মনের ছাপ আগাগোড়া ফুটে উঠেছে। প্রথমত, ‘কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে’ এবং এই লক্ষ্যে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতীকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য’ রাষ্ট্রের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার- এ কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে তিনি যোগ করলেন ‘সমবায় ভিত্তিতে যৌথ কৃষি খামার’ করার কথাও, কেননা এ ব্যাপারে (সমবায়ী মালিকানা স্বীকার করে নেওয়ার পর) ‘এই সংবিধানে (আর) কোনো বাধা নেই।’

তাজউদ্দীনের সেদিনের ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ব্যক্তি-পুঁজির প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার আবশ্যকতা নিয়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিখাতের মধ্যে সুসামঞ্জস্য অনুপাত থাকা দরকার এটা ব্যাখ্যা করে তিনি যা বললেন তার সরলার্থ হলো বাস্তবের নিরিখে ও কালক্রমে এই অনুপাত পরিবর্তিত হতে পারে। প্রথমত, ‘উঠতি পুঁজিবাদ সম্পর্কে আমরা ব্যবস্থা করেছি’; এই উঠতি পুঁজিবাদ যাতে বিধ্বংসী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে পারে সেদিকে রাষ্ট্রের সজাগ দৃষ্টি থাকবে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি প্রণিধানযোগ্য :’আজকে ব্যক্তিগত মালিকানা, ব্যক্তিগত পুঁজিতে যে সংশয়ভাব দেখা দিয়েছে, তাতে শুধু এটাই আমরা বলতে পারি, আইনের বিধান মোতাবেক ব্যক্তিগত মালিককে যেটা দেওয়া হবে, সেটার মালিকানা সে নিশ্চয়ই আইনের বিধান-অনুযায়ী নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবে। আইনের বিধান-অনুযায়ী কোনো অবস্থাতেই অর্থনৈতিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু পুঁজিপতিদেরকে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। কাজেই, … আজকে ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকুই দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত শোষণ, ব্যক্তিগত বঞ্চনা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না। এটা পরিস্কার থাকা ভালো।’

দ্বিতীয়, ব্যক্তিগত পুঁজিকে যদি নিয়ন্ত্রণে রেখেই বিকাশ করতে দেওয়া হয়, তাহলে সংবিধানে এর নিম্নসীমা-ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হলো না কেন? কেন ব্যাপারটাকে অনংঃৎধপঃ রাখা হলো কেবল ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদের ত্রিবিধ মালিকানার কথা বলে? এ বিষয়ে তাজউদ্দীনের সুচিন্তিত উত্তর হচ্ছে, পরিবর্তনশীল বাস্তবতাকে মাথায় রাখতে হবে :

“ব্যক্তিগত মালিকানা অবশ্য আইনের বিধান মোতাবেক হবে এবং ব্যক্তিগত মালিক যাতে করে সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, মুনাফা বৃদ্ধি করে, সম্পদ বৃদ্ধি করে তার ‘প্রফিট’ দিয়ে আমার সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থাকে বানচাল করতে না পারে, তার ব্যবস্থা আইন অবশ্যই করবে। বলা হয়েছে, তা হলো সেই বিধান সংবিধানে কেন করা হলো না? আমি আগেই বলেছি, সংবিধানে সব আইন, চুলচেরা আইন বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করা যায় না, করা বাঞ্ছনীয় নয়। কতটুকু করা হবে, সেটার উচ্চসীমা, নিম্নসীমা কতটুকু থাকবে, সেগুলি সংবিধানে বেঁধে দেওয়া যায় না। ভবিষ্যৎ সংসদ সে উচ্চসীমা বা নিম্নসীমা, কোন সময় তার কতটুকু সীমা নির্ধারণ করা উচিত, তা বিবেচনা করে দেখতে পারবেন।”

অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সংসদে যারা আসবেন, তারা সে সময়ের পরিস্থিতি বিচার করে ব্যক্তিগত পুঁজির চৌহদ্দি নির্ধারণ করবেন। তবে পাকিস্তানের বাইশ পরিবারের মতো একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ যে স্বাধীন বাংলাদেশে করতে দেওয়া হবে না, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই সংবিধান প্রণেতাদের মনে।

তৃতীয়ত, অনেকে বলেছেন যে, ব্যক্তিগত মালিকানা রয়েছে বলে সমাজতন্ত্র আর থাকে না। এরও উত্তর দিলেন তাজউদ্দীন। তিনি দেখালেন যে, সমাজতান্ত্রিক এমন অনেক দেশ, রয়ে গেছে যেখানে ব্যক্তিমালিকানা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। যেমন- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানের ৯১ অনুচ্ছেদে দেখতে পাবেন সেখানে তারা ৪ প্রকারের মালিকানা দিয়েছে।’

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭২

পূর্বে প্রকাশিতের পর

তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আমীর-উল ইসলাম, আছাদুজ্জামান খান, আবু সাইয়িদ প্রমুখ। সংবিধান রচনা কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। কয়েক মাসের কাজের পর ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ খসড়াটি সংসদে ‘বিল আকারে’ উত্থাপন করেন ড. কামাল হোসেন। উল্লেখ্য, ১৭ এপ্রিল থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ড্রাফটিং কমিটির ‘৭৪টি বৈঠক’ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ৮ মে’র মধ্যে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে ‘৯৮টি প্রস্তাব’ জমা পড়ে ড্রাফটিং কমিটির কাছে। অবশ্য এই ৯৮টি প্রস্তাব ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়নি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। এমনকি ড্রাফটিং কমিটির সভার বিবরণীও পরবর্তীকালে পাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ৭৪টি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার তথ্যে ধারণা করা যায় যে, ড্রাফটিং কমিটিতে বিভিন্ন ধারা ও উপধারার সংযোজন-বিয়োজন নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যবহার নিয়ে মতানৈক্য ঘটেছিল। শেষ পর্যন্ত যে খসড়াটি উত্থাপিত হয় তাতে ৩৪ জনের সবাই একমত হননি। খসড়াতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আপত্তি জানিয়েছিলেন মোট ৬ জন সদস্য। ১২ অক্টোবরে সংসদে উত্থাপনের পর খসড়া সংবিধানের ওপরে গণপরিষদ সদস্যদের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। এটাও জানানো দরকার যে, সংবিধানটি প্রথমে ইংরেজিতে রচনা করা হয়, এবং পরে তা বাংলায় অনুবাদ করা হয়। বস্তুত ইংরেজিতে লেখা এবং বাংলায় অনুবাদ-কর্ম পাশাপাশি চলছিলো। খসড়া সংবিধানটি সংসদে উত্থাপিত হয় বাংলা ভাষায়। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি থেকে ভাষান্তরের জন্য গঠিত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান ও কমিটির অন্য দু’জন সদস্য ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ড. মজহারুল ইসলাম। ইংরেজি থেকে অনূদিত হলেও এটা পরিস্কার হয়েছিল যে, যদি কখনও ইংরেজি পাঠের অর্থ-উদ্ধার বা ব্যাখ্যা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, তবে সে ক্ষেত্রে ‘বাংলা পাঠকেই’ চূড়ান্ত পাঠ বা মানদণ্ড হিসেবে ধরা হবে। এজন্য সংবিধানের ‘বাংলা পাঠ’-এর গুরুত্ব অপরিসীম।

উত্থাপিত খসড়ার প্রতিটি ধারা-উপধারার শব্দগত, ব্যুৎপত্তিগত ও তাৎপর্যগত বিচার-বিশ্নেষণ করা হয়। বলা যায়, দীর্ঘ এক মাসব্যাপী উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই কেবল সংবিধানটি সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সৌভাগ্য ক্রমে, এই সংসদীয় বিতর্কের প্রসেডিংস পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। ভারতের সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক চলেছিল ১১৪ দিন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা চলেছিল ২৪ দিন। আপাতদৃষ্টিতে ওই তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে বিতর্ক সমাপ্ত হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল, রাষ্ট্রের মূল মূল পরামর্শ ও নীতিমালার বিষয়ে সেদিনের গণপরিষদে ব্যাপক ঐকমত্যের উপস্থিতি। এই সীমিত বিভেদের পেছনে প্রধান কারণ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জিত সার্বিক রাজনৈতিক উপলব্ধি যা নিয়ে সেদিন গভীর ঐকমত্য বিরাজ করছিল (যার ওপরে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিস্তৃত দালিলিক আলোচনা করা হয়েছে)।

যেহেতু আমাদের আলোচনার মূল সূত্র আবর্তিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ও সংবিধানের সমতামুখীন আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে, সেহেতু আমরা এখানে বিশেষভাবে নজর দেব কয়েকটি বিশিষ্ট সাংবিধানিক ধারার প্রতি। অর্থাৎ সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা না করে এর অর্থনৈতিক রূপকল্পের মধ্যে আমাদের মনোযোগ সীমিত থাকবে। এই অর্থনৈতিক ধারাগুলোর রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে অতীতে সেভাবে আলোচনা হয়নি। এসব ধারার বিচার-বিশ্নেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে অনেক কাছে থেকে অনুধাবন করা যায়। এক্ষেত্রে আপাতত আমার হাতের কাছে তথ্য-উৎস চারটি : ক. ড্রাফটিং কমিটির রিপোর্ট (যেটি, ১০ জুন ‘খসড়া সংবিধান’ তৈরি হওয়ার সময় একটি আলাদা ডকুমেন্ট হিসেবে প্রস্তুত করা হয়); খ. কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত খসড়া সংবিধান; গ. এই খসড়া সংবিধানের ওপরে বাহাত্তরের গণপরিষদে আলোচনার প্রসেডিংস, এবং ঘ. সংসদে অনুমোদিত চূড়ান্ত সংবিধান। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় সংবিধান সম্পর্কিত অনেক বিচার-বিশ্নেষণ নিশ্চয়ই প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়ে। কিন্তু সেসব খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ আমার এখনও হয়নি। তাছাড়া সেদিনের অনেক ব্যক্তিই আর জীবিত নেই। ফলে অনেক প্রাসঙ্গিক ‘ইন্টারভিউ’ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপরোক্ত তথ্য-উৎসসমূহের ঘনিষ্ঠ পাঠে বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে কয়েকটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসে।

আমার কাছে প্রথমেই যেটা চোখে পড়েছে তা হলো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য ও আদর্শে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ। সংবিধানের কাঠামোয় গণতন্ত্রের উদারনৈতিকতার নীতি (যাকে আমি বলছি- ‘লিবার্টি প্রিন্সিপল’), আর শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার নীতি (যাকে আমি বলছি- ‘সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপল’)- এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করার দুরূহ কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল সেদিন। এই চ্যালেঞ্জটাই বঙ্গবন্ধু সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের কাছে তুলে ধরেছিলেন। ড্রাফটিং কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল :

‘The Committee has also been conscious that at least in one major aspect it would be breaking new ground in making promises which would fulfill the pledge embodied in the preamble that ‘It shall be a fundamental aim of the state to realise through the democratic proces a socialist society, free from exploitation.’

অর্থাৎ শুধু চার মূলস্তম্ভকে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- সংবিধানের বিভিন্ন দফা-উপদফার মধ্যে প্রতিফলিত করাই নয় ড্রাফটিং কমিটির কাজ (সেটা তো একটা প্রাথমিক কর্তব্য বটেই)। এর সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত সাংবিধানিক নিরাপত্তা-কবচ (safe-guards) তৈরি করা। কেননা, তৃতীয় বিশ্বের পটভূমিতে এরকম গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সাংবিধানিক রূপ- অন্তত আগে থাকতেই ঠিক করে নিয়ে বা পূর্ব-নির্ধারিতভাবে-এর আগে কখনও রচিত হয়নি। এমন এক সংবিধান হতে হবে যেখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এ দুইয়ের মধ্যে কোনোটিকেই ভারসাম্যহীনভাবে ভারী করে তোলা হবে না। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করা হবে সচেতনভাবে- যাতে করে কোনো একটি আদর্শের প্রতি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের গতিমুখ একপেশেভাবে ঝুঁকে না যায়।

এরকম সমন্বয়ের সমাজ তথা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারা সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াই বাস্তবে অব্যাহত রাখা যাবে কিনা আগামী দিনগুলোয়- বাহাত্তর সালেই সে প্রশ্ন উঠেছিল। অবস্থার দুর্বিপাকে, দেশি-বিদেশি শত্রুর চাপে, লিডারশিপের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কারণে, বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির কারণে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে- এ বিষয়ে সংবিধান প্রণেতারা (এবং বঙ্গবন্ধু) অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তারপরও একটাকে বিসর্জন দিয়ে অন্যটিকে আঁকড়ে ধরতে চাননি তারা। কয়েকটি উদাহরণ।

খসড়া সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে আলোচনা করতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তার সূচনা বক্তব্যে বললেন, ‘শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ- তার অর্থ মালিকবিহীন নৌকা, হালবিহীন নৌকা। শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কতর্ব্যও থাকবে।’ এখানে বলা দরকার, গান্ধী Universal Declaration of Human Rights-এর পাশাপাশি Universal Declaration of Human Duties-এর ঘোষণা চেয়েছিলেন। অধিকার ও কর্তব্য-এ দুইয়ের অন্তর্লীন যোগাযোগ স্মরণ করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সংবিধানের মূল আদর্শকে আবারও তুলে ধরলেন সংসদ সদস্যদের সামনে:

‘এবং যতদূর সম্ভব, যে শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়েছে, সেটা যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে, তা সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের আদর্শ পরিস্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিস্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে এদেশ চলবে। জাতীয়তাবাদ- বাঙালি জাতীয়তাবাদ- এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশে। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালির রক্ত দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদ। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকারকে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে। যেখানে শোষণহীন সমাজ থাকবে। শোষক শ্রেণি আর কোনোদিন দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। এবং সমাজতন্ত্র না হলে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৫৪,০০০ বর্গমাইলের মধ্যে বাঁচতে পারবে না। সে জন্য অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক। আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। … কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। … এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে বাংলার শাসনতন্ত্র তৈরি হবে। এটা জনগণ চায়, জনগণ এটা বিশ্বাস করে। জনগণ এজন্য সংগ্রাম করেছে। লক্ষ লক্ষ লোক এই জন্য জীবন দিয়েছে। এই আদর্শ নিয়েই বাংলার নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।’

এর পরে ভাষণ দিতে উঠলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। সেখানে তিনি প্রথমে সমাজতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করলেন এবং পরে গণতন্ত্রকে রেখে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যা সম্পর্কে ইঙ্গিত করলেন। উদ্ৃব্দতিটি বড়, কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সেদিনের সংসদের Pulse বোঝার জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর বিশেষ বিশেষ দিকটি নিচে তুলে ধরা হলো।

১. অনুন্নত দেশের পটভূমিতে ‘সমাজতন্ত্র’ আর উন্নত পুঁজিবাদী দেশের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর মধ্যে পার্থক্য আছে : ‘আমাদের কাছে সমাজতন্ত্র বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা বুঝি এমন এক সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে জাতিকে এবং জাতীয় অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে আত্মত্যাগের প্রয়োজন, সকলে তা ভাগ করে নেবে। আবার সকলের প্রচেষ্টায় যে সম্পদ গড়ে উঠবে, তাও সকলে সুষমভাবে ভাগ করে নেবে। আমাদের সংবিধানে তাই সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্র পরিচালনার একটা মূলনীতি বলে ঘোষিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মালিকানার নীতিতে বলা হয়েছে যে, প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে। আর আইন যে সীমা নির্ধারণ করবে, সেই সীমার মধ্যে সমবায়গত বা ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে।’ অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির চরিত্র হবে মালিকানা-সম্পর্কের দিক থেকে ‘মিশ্র চরিত্রের’, যদিও Mixed Economy শব্দটি সেদিন ব্যবহূত হয়নি।

২. শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানা নয়, এই সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য মানুষকে শোষণ থেকে মুক্তি দেওয়া এবং তাকে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ ও সুযোগের অধিকার দেওয়া : ‘সর্বপ্রকার শোষণ থেকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশকে মুক্তিদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ যাতে সকল নাগরিক লাভ করতে পারেন, সেই দায়িত্বও রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। সকল নাগরিক যাতে সমান সুযোগ পেতে পারেন এবং রাষ্ট্রের সর্বত্র যাতে সমান স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন লাভ করা যায়, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবেন।’ অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে নাগরিকেরা দার্শনিক জন রাউলস (Rawls) এর ভাষায় শুধু Formal Equality of Opportunity নয়, তারা Substantive Equality of Opportunity-রও অধিকারী হবেন। এর অর্থ, এটা শুধু যেনতেনভাবে পাওয়া মৌলিক সুযোগের সমতা বিধান নয়। এখানে গুণে-মানের সমতারও (Equality of Standards) কথাও থাকছে। দ্বিতীয়ত, এখানে শুধু  Equality of Opportunity বা সুযোগের সমতার মধ্যেই আলোচনা সীমিত রাখা হয়নি। Equality of Outcomes-র কথাও অনুমিত থাকছে। সুযোগের সমতার পাশাপাশি নাগরিকেরা যাতে করে সর্বত্র ‘সমান স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ লাভ করেন, রাষ্ট্র তা ‘নিশ্চিত করবে’- এটার ওপরে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭১

পূর্বে প্রকাশিতের পর
৮. বাহাত্তরের সংবিধানের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র
বঙ্গবন্ধু মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের অনুসারী ছিলেন না। তবে সত্যের ওপরে কেবল তো ‘মার্কসবাদীদেরই’ মনোপলি নেই। পুঁজিবাদী সমাজের তুলনায় সমতাবাদী সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মতো বঙ্গবন্ধুর এই বিষয়ে চিন্তা স্বচ্ছ ছিল। যদিও তার লক্ষ্য ছিল শোষণমুক্ত সমাজ গড়া, কিন্তু লক্ষ্যটা যে অনেক দূরের স্টেশন, এ রকম একটা কৃষিপ্রধান পশ্চাৎপদ সমাজের পটভূমিতে সহজে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেটা তিনি পঞ্চাশের দশকেই বুঝতে পেরেছিলেন। সুতরাং সমাজতন্ত্র তার কাছে কোন  End-State নয় বরং একটি Process বা দীর্ঘকালীন অভিযাত্রার মতো বিষয় বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। অর্থাৎ এটি কোনো তিন বা পাঁচ বছরে সমাধা করার মতো চ্যালেঞ্জ নয়। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ১৯৭২-৭৫ পর্বে তিনি সমাজতন্ত্র অর্জনের অনিবার্যতার পাশাপাশি এর দীর্ঘ পথযাত্রার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মার্কস বা লেনিনের মতো তত্ত্বচর্চা করেননি তিনি, কিন্তু বাস্তব কাণ্ডজ্ঞানের জোরে ‘আদর্শ’ ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য এক সুদীর্ঘ ‘প্রস্তুতি-পর্বের’ মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে পেরেছিলেন। সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১৯৭৪ সালের ৪ ডিসেম্বরের ভাষণে আবারও ফিরে যেতে হয়। সেখানে তিনি বারবার বলছেন যে গণতন্ত্রের কাঠামোয় সমাজতন্ত্রের পথে যাত্রা করা সহজ নয়। এমনকি যারা দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য গণতন্ত্রের হাত ছেড়ে দিয়েছিল, তারাও এখনও সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে পারেনি:
‘সোশ্যালিজম যেখানে শুরু হয়েছে সে সোভিয়েত ইউনিয়নে আজ ৫১ বৎসর হয়ে গেছে সোশ্যালিজম করতে পারে নাই। এখনও ঘাত-প্রতিঘাতে অগ্রসর হচ্ছে, নতুন নতুন পথ তাদের জানতে হচ্ছে। এ রাস্তা সোজা রাস্তা নয়, এ রাস্তা কঠিন রাস্তা।’
যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যই এটা প্রযোজ্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান এবং প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করা কতটা কঠিন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কোনো রাখঢাক করেননি :
‘পরিস্কার কথা … সোশ্যালিজম এত সোজা না। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। সে পদক্ষেপ নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। বাধা আমাদের আসবেই। যাদের কাছ থেকে আমরা সম্পদ নিয়েছি, যারা এখানে সম্পদ ফেলে গেছে, তাদের দালালরা, বিদেশি শক্তিরা তারা আজকে চেষ্টা করছে আমাদের এই সমাজতান্ত্রিক ইকোনমি বানচাল করার জন্য। যাতে প্রডাকশন কম হয়, যাতে দুশমনরা খুশি হয়, মানুষের কষ্ট হয়। … এত তাড়াতাড়ি কিছু দিবার ক্ষমতা আমাদের নেই। … আমরা একটা সিস্টেম নিয়েছি। যে সিস্টেমে আমাদের কোনো অসুবিধা হতো না যদি সোশ্যালিজম না নিতাম। … যখন আমাকে আঘাত করতে হয়েছে, বুঝে শুনে আঘাত করেছি। … ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, কোম্পানি, মিল-ইন্ডাস্ট্রিজ, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট যদ্দুর পারা যায় হাতে নিয়ে নেও। কষ্ট হবে, বুঝতে হবে এক্সপিরিয়েন্স নাই। ভবিষ্যতে, অদূর ভবিষ্যতে সোশ্যালিজম [হবে বলে] আজকে লেট করা যায় না। ১০ বৎসর, ২০ বৎসর, ২৫ বৎসর পর লেট করা যায়। এইটা মানুষকে বুঝতে হবে, যারা সোশ্যালিজমে বিশ্বাস করে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা না বুঝলে উপায় নাই। সোজা রাস্তায় হয় না। সে জন্যে সে পথ আমাদের ছাড়তে হবে।’
দেখা যাচ্ছে যে, দুটো চিন্তাই বঙ্গবন্ধুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। একদিকে রাতারাতি যেমন সমাজতন্ত্র গড়া যাবে না, অন্যদিকে, সমাজতন্ত্র দূরের স্টেশন বলে প্রগতিশীল পদক্ষেপ নেওয়া থেকে আজকে বিরত থাকা যাবে না। ‘দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য’ এবং ‘আসন্ন কর্তব্য’ উভয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে হবে। এবং সেই ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হবে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেই। তা-ও আবার কৃষিপ্রধান পশ্চাৎপদ সমাজের পটভূমিতেই। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় কেন মুজিবের পক্ষে সমাজতন্ত্রকে একটি  ‘end-state’ হিসেবে দেখা সম্ভব ছিল না, এবং কেন সমাজতন্ত্রকে তিনি একটি ‘চলমান প্রক্রিয়া’ হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। এর অর্থ হলো, পুঁজিবাদের ‘প্রগতিশীল’ অর্জন ও বিকাশের ধারার মধ্যেই তিনি ‘সমাজতান্ত্রিক’ উপাদানগুলোকে লালন ও বৃদ্ধিশীল করতে চেয়েছিলেন। এই বিষয়টি তিনি মার্কস চর্চা করে বোঝেননি, বুঝেছিলেন ইনটুয়েটিভলি। তবে এ ধরনের ভাবনার আলো-হাওয়ার মধ্যেই তিনি বাস করছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে, এটা অনুমান করা শক্ত নয়। ১৯৭৪ সালেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন-এর উদ্যোগে কনফারেন্স ‘দ্য ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ উইদিন এ সোশ্যালিস্ট ফেমওয়ার্ক’ (পরে এটি বই আকারেও প্রকাশিত হয়)। অনুন্নত কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে ‘সমাজতান্ত্রিক রূপরেখা’ কীভাবে দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদেরা। দূরের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র এবং কাছের লক্ষ্য অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও তার প্রগতিশীল রূপান্তর- এই দুটো বিষয়ই সেই সম্মেলনে স্থান পেয়েছিল। সুতরাং দূর এবং আশু কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নানা উৎস থেকেই তথ্য ও প্রেরণা পাচ্ছিলেন। তবে এটি শুধু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্রের সার্বিক ধারণার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মার্কস-এঙ্গেলস, এমনকি লেনিন শেষ পর্যন্ত এটা মেনে নিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র বিনির্মাণকে ‘End-State’ হিসেবে না দেখে বরং ‘Process’ হিসেবেই দেখা শ্রেয়তর। তার অর্থ, পুঁজিবাদের উপাদানগুলোর পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলো অবস্থান করবে, জন্ম নেবে এবং আর্থসামাজিক রূপান্তরের ধারায় সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলো ক্রমশই জয়যুক্ত হয়ে সমাজতন্ত্রকে আখেরে বিজয়ী করবে। সমাজতন্ত্রের আদর্শকে যদি Socialism-as-an-end-state হিসেবে না দেখে Socialism-as-a-process হিসেবে দেখা যায় তাহলে বৃহৎ-উল্লম্ম্ফনমূলক হঠকারী কর্মসূচিকে যেমন পাশ কাটানো যায়, আবার পুঁজিবাদের স্বয়ংক্রিয় ও স্বতঃস্ম্ফূর্ত বিকাশের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করার নিষ্ফ্ক্রিয় অবস্থানকেও এড়ানো সম্ভব। নিউ ইকোনমিক পলিসি (NEP) নিয়ে লেনিনের নানা বক্তব্যের মধ্যে Socialism-as-a-process এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন স্পষ্ট হয়।
সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে হলে যে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে তার ইঙ্গিত লেনিনের লেখাতেই পাওয়া যায়। ইনট্রোডিউসিং নিউ ইকোনমিক পলিসি শীর্ষক ভাষণে লেনিন বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র জোতের কৃষিব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনতে কয়েকটা প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। তার মানে এটা বলছি না যে, শতাব্দী লেগে যাবে। কিন্তু আমাদের মতো এতো বড় দেশে সবাইকে ট্রাক্টর যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সুবিধা এবং বিদ্যুৎ দিতে হলে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। এটাই অবজেকটিভ পরিস্থিতি।’ তার মানে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পর্ব সম্পন্ন করার বিষয়টি এক-দুই বছরের নয়, কয়েক দশকের ও প্রজন্মের ব্যাপার এটি। সেরকম সময়ে গ্রামীন অর্থনীতিতে সমবায়ী খাতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র কৃষকেরাও থেকে যাবে এক সুদীর্ঘ কাল।
পুঁজিবাদের পাশাপাশি সমাজতন্ত্র অনেক দিন পর্যন্ত অবস্থান করে চলতে পারে- পুঁজিবাদের ‘ভেতর থেকেই’ যে সমাজতন্ত্রের অনেক ‘বস্তুগত ভিত্তির’ জন্ম হয় বা হতে পারে- এ কথা লেনিন অনেকবারই বলেছেন। একটি উদাহরণ কেবল এখানে দেব। অক্টোবর বিপ্লবের পরও যে নারীরা ‘স্বাধীন’ হতে পারছে না, তার কারণ বাসার কাজের বোঝা তাদের ওপরে পূর্বাপর থেকেই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ করে তাকাতে বললেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশের বেশ কিছু প্রগতিশীল উদ্ভাবনের প্রতি। পুরো উদ্ৃব্দতিটি বর্তমান আলোচনার জন্য প্রণিধানযোগ্য। লেনিন লিখেছেন :
‘Do we take proper care of the shoots of communism which already exist in this sphere? Again the answer is no. Public catering establishments, nurseries, kindergartens- here we have examples of these shoots which can really emancipate women. These means are not new, they (like all the material prerequisites for socialism) were created by large-scale capitalism.’

পুঁজিবাদী দেশগুলোয় সর্বজনীন নির্বাচনী ব্যবস্থায় উত্তরণ, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা, সর্বজনীন ও মৌলিক শিক্ষাবিধির প্রচলন, বেকার ভাতা ইত্যাদি ধারণাগুলো এমনিতেই অর্জন হয়নি। এর পেছনে ছিল শ্রমিক শ্রেণির নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রাম, অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকট, বিপ্লব ও বিপ্লবপ্রচেষ্টা, যুদ্ধ ও যুদ্ধের কারণে বদলে যাওয়া সামাজিক-শ্রেণি শক্তির পুনর্বিন্যাস প্রভৃতি উপাদানের চাপ। প্যারি কমিউন না হলে বিসমার্কের জার্মানিতে (সামাজিক গণতন্ত্রীদের ক্ষমতায় আসারও ঢের আগে) ‘Social State’-এর জন্ম হতো না। ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ ধারণার পেছনে বিসমার্ক থেকে শুরু করে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সোশ্যাল ডেমোক্রেটসরা, লিবারেল কান্ট-মিল থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মার্কস-এঙ্গেলস সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে’ মার্কস-এঙ্গেলস যেসব ‘গণতান্ত্রিক দাবি’ তুলেছিলেন তা কোনো দূর-ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্য বিশিষ্ট দাবি নয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে, যাকে আমরা আজকে ‘Social democracy’ বলি, তার অধিকাংশ দাবিই উদারনৈতিক গণতন্ত্রী আর কট্টর সমাজতন্ত্রী মতের অনুসারীদের কখনও বিচ্ছিন্ন, কখনও সমবেত, আন্দোলন-সংগ্রামেরই ফসল। এসব Social Democratic দাবি-দাওয়ার কোনটি লিবারেলদের সংগ্রামের অর্জন, কোনটি সামাজিক গণতন্ত্রীদের বা কোনটি কমিউনিস্টদের সংগ্রামের প্রভাব সেটি চুলচেরা বিশ্নেষণ করে বলা সত্যই কঠিন কাজ। মিল, বার্নস্টাইন এবং লেনিন যথাক্রমে লিবারেল, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ও কমিউনিস্ট ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। এই ত্রিধারার মধ্য থেকেই যার যার মতো করে অতীতে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধ্যান-ধারণা বলার চেষ্টা করা হয়েছে এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে। এটুকু বলা যায়, বঙ্গবন্ধু ও তার নিকট সহযাত্রীরা মোটা দাগে এসব ধারা ও উপধারা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি এসব আন্দোলনের জল-হাওয়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে পরিপকস্ফ হয়েছেন। এ কথা তিনি জানতেন যে, সব ধারার মধ্যেই শিক্ষণীয় ও বর্জনীয় দিক রয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রূপান্তরের জন্য তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে ধ্যান-ধারণা ও অভিজ্ঞতা আহরণের পক্ষপাতী ছিলেন। এই ‘প্রাগম্যাটিক’ চিন্তাই লেনিনের ভাষায় ‘প্র্যাকটিক্যাল ইকোনমিকস’- তাকে সংবিধানের ‘৪টি স্তম্ভ’ নির্বাচনে সাহায্য করেছে। তিনি গণতন্ত্রও চান, সমাজতন্ত্রও চান। ধর্মনিরপেক্ষতাও চান, আবার বিশেষ চিহ্ন সম্বলিত জাতীয়তাবাদও অবলম্বন করতে চান। কোনোটিকেই তিনি অন্যটির চেয়ে বেশি ‘গুরুত্ব’ দিতে চান না। এই মূল আদর্শের মধ্যে আবার রয়ে গেছে নানা ধারা ও উপধারা। সেসব মিলিয়ে একটি দূরদর্শী কিন্তু বাস্তবোচিত ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ তিনি গড়তে চেয়েছিলেন। বলেও ছিলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য সব উৎসের দিকে তিনি হাত বাড়াতে প্রস্তুত। তারই প্রতিফলন ঘটে বাহাত্তরের সংবিধানে।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে (যে ভাষণে জাতীয়করণের নীতি ঘোষিত হয়) বঙ্গবন্ধু জানালেন যে, তিনি সংবিধান তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। এ নিয়ে অযথা কালক্ষেপণ করতে চান না তিনি। এ নিয়ে বিলম্ব করায় পাকিস্তান রাষ্ট্র যথাযথভাবে পরিচালিত হতে পারেনি, সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র ক্ষমতায় জেঁকে বসেছিল এবং শেষ পর্যন্ত ৬-দফার ভিত্তিতে সাংবিধানিক প্রশ্নের অনিষ্পত্তির কারণে পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছিল। সে জন্যেই স্বাধীন দেশে তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়ায় একটি আধুনিক, প্রগতিশীল, কার্যকর ও ভবিষ্যৎমুখীন সংবিধান নির্মাণ। উপরোক্ত ভাষণে তিনি জানালেন : ‘বিশেষজ্ঞরা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং খসড়া শাসনতন্ত্র গণপরিষদের সামনে পেশ করা হবে। এই শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’।
এই ভাষণের দুই সপ্তাহ পরে (১০ এপ্রিল, ১৯৭২) গণপরিষদের অধিবেশনে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ সম্পর্কিত প্রস্তাব পাস হয়। এই ঘোষণার পরের দিন (১১ এপ্রিল, ১৯৭২) সংবিধান তৈরির জন্য একটি ‘ড্রাফটিং কমিটি’ (Constitution Drafting Committee) গঠিত হয়। যার নেতৃত্ব দেন কমিটির সভাপতি হিসেবে ড. কামাল হোসেন। এ কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৪ জন; সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়া বাদবাকি সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের থেকে।

[ক্রমশ]