পর্ব ::৫২
পূর্বে প্রকাশিতের পর
নিম্নবর্গের দেব-দেবীর পূজা-অর্চনাকে পাছে কেউ ‘এশিয়াটিক বারবারিজম’-এর উদাহরণ হিসেবে খাটো করেন সে জন্য বলে রাখি যে, প্লেগ-তাড়িত ক্যাথলিক ইউরোপে খ্রিষ্টের অনুসারীদের মধ্যে রোগ-নিরাময়ের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মহাত্মাদের কাছে ‘প্রার্থনা করার’ রীতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকার ১৯ মার্চ ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এক চিত্তাকর্ষক নিবন্ধ- ‘দ্য বেস্ট সেইন্টস্ টু প্রে ডিউরিং আ পেনডেমিক’। তাতে বলা হয় যে প্লেগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য সেইন্ট হলেন সেইন্ট সিবাসটিয়ান। খ্রিষ্টীয় তৃতীয়য় শতকের এই পুণ্যাত্মাকে প্লেগ মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে মনে করা হতো। সিবাসটিয়ানের অর্চনার প্রমাণ মেলে রোমে ৬৮০ সালে, মিলানে ১৫৭৫ সালে, লিসবোঁয়াতে ১৫৯৯ সালের প্লেগের দিনগুলোতে। প্লেগের মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এমন আরেকজন ছিলেন সেইন্ট রোস (St Roch)। ইতালির এই পুণ্যাত্মার কাছে বিশ্বাসীরা আজও দুর্দৈবে পড়লে প্রার্থনা করে থাকে :
“O Blessed St. Roch,
Patron of the Sick,
Have pity on those
Who lie upon a bed of suffering.
Your Power Was so great
When you were in this world,
That by the sign of the Cross,
Many were healed of their diseases.
Now that you were in heaven,
Your power is not less.
Offer, then, to God
Our sighs and tears.
And obtain for us that health we seek
Through Christ Our Lord
Amen.”
এই তালিকায় নারী সেইন্টারাও রয়েছেন। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সেইন্ট রোজালিয়ার নাম। যারা গসপেল অব মেরির খ্রিষ্ট-সহকর্মী মেরি মাগদালেনার কথা মনে রাখেন, তারাই জেনেছেন যে এই পুণ্যাত্মা নারীর নাম নিলে মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অন্তত এই ধারার বিশ্বাসীদের তাই অভিমত।
মুসলিম ঐতিহ্যেও আধ্যাত্মিক গুণাবলিসম্পন্ন অনেক পুণ্যাত্মা মহাপুরুষ পীর-আউলিয়া ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসেছেন যাদের আশ্চর্যজনক ‘নিরাময় ক্ষমতা’ (হিলিং পাওয়ার) ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নিত্যদিনের অসুখে-বিসুখে পড়লে এসব পুণ্যাত্মাগণের সমাধিস্থল বা মাজারশরিফে গিয়ে মানত করার লোক-ঐতিহ্য ছিল বা এখনও আছে। পূর্ব বাংলায় এই পরম্পরা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। ‘মুসলিম সেইন্টস্ অব সাউথ এশিয়া : দ্য ইলেভেনথ্ টু ফিফটিনথ্ সেনচুরিস্’ গ্রন্থে আনা সুভরভা লিখেছেন, মধ্যযুগে ‘প্লেগের মহামারীতে দিল্লির লোকজন একত্রিত হয়ে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি-র মাজারে জিয়ারত করতে গিয়েছিল।’ সাধারণ মানুষের কাছে এসব পুণ্যাত্মা ব্যক্তিবর্গের আবেদন ছিল ভরসা-প্রার্থনার একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে। রিচার্ড ইটন তার সুবিখ্যাত বইতে (‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’) পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় (বিশেষত দক্ষিণ বঙ্গে), মাজারের তুলনামূলক অধিক সমাবেশ দেখিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জঙ্গল কেটে বসত গড়ার ক্ষেত্রে তারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এবং মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকার কারণে এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার সহজতর হয়েছিল। কিষণ চন্দর হয়তো অতিশয়োক্তি করেছেন, কিন্তু দুর্দৈবের মুখে তার মা’র বিভিন্নমুখী ধর্মবিশ্বাস একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সাধারণ মানুষই বিপদ থেকে বাঁচতে সব উৎসের দিকেই হাত বাড়াতেন। এখন হয়তো ‘শিক্ষিতের’ হার বাড়ার সাথে সাথে বহুত্ববাদী প্রবণতা অনেকখানি কমে এসেছে, তার পরেও তা পরিদৃষ্ট হয়। পুরো উদ্ধৃতিটি দেওয়া প্রয়োজন। কিষণ চন্দর তার মা সম্পর্কে লিখেছেন :
‘Creating for sacred places ran in my mummy’s blood. She did not read books on national unity, did not hear speeches on religious tolerance and did not know words like humanism and equality of people….To make up for it she visited Hindu temple as well as Sikh gurdwara, prayed to Hindu gods and made offerings at the mazars of Muslim saints—and all this also ran in her blood. Thus, like her, lived whole generation in old, illiterate, undivided India and by their efforts in the course of many centuries was the composite national culture was created’.
উপরের আলোচনা থেকে মনে হতে পারে, মানুষজন মহামারীর প্রভাবে আরও বেশি করে নিয়তিবাদের তাদের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, বাহ্যিক ধর্মাচরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, লোকজ দেব-দেবীর প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যেতে পারে। তারা মনে করতে পারে যে মহামারী হচ্ছে পাপবিদ্ধ মানুষের ওপরে নেমে আসা অভিশাপ (যেমন করে গান্ধী ১৯৩২ সালের বিহারের ভূমিকম্পকে অতিরিক্ত জাত-পাত মানার জন্য বিধাতার ক্রুদ্ধ অভিশাপ বলে ভেবেছিলেন এবং এই মর্মে রবীন্দ্রনাথের তিরস্কারও কুড়িয়েছিলেন) যেন এক অদৃশ্য অনিয়ন্ত্রণক্ষম শক্তি আমাদের জীবন ও ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে- বিজ্ঞান যার কাছে অসহায়, রাষ্ট্র যার কাছে পরাস্ত, ব্যক্তিস্বরূপ যার কাছে অগ্রাহ্য। চারদিকের অসুখ-বিসুখে ক্লান্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা’ এমন ধারণা করাও অযৌক্তিক নয়। মহামারীর ইতিহাস অবশ্য দু’ধরনের প্রবণতাই দেখায়। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুই ধারাকেই সামনে মেলে ধরে।
যেমন, ১৩৪৬-৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথ অভিহিত প্লেগের ফলে বিশ্বাসের বন্ধন অনেকখানি আলগা হয়ে এসেছিল। মধ্যযুগকে যে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়ে থাকে তার বড় একটি কারণ ছিল ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব। এই অন্ধকার যুগের পরেই রেনেসাঁ-পর্বের শুরু। প্লেগের কালো মহামারীর ৫০ বছরের মধ্যেই কতকগুলো পরিবর্তন দেখা দেয়। প্রথমত, জনসংখ্যা হঠাৎ করে কমে যাওয়ায় সামন্ত-ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয়। ইংল্যান্ডের কৃষিতে দাসপ্রথার ব্যবস্থা (তথাকথিত Villianage System) উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। এর একটা বড় কারণ মহামারী-পরিস্থিতিতে শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মজুরির হার বেড়ে যায়, কৃষিতে ‘মুক্ত শ্রমের’ চলাচল অবাধ হতে থাকে, কৃষিকাজ আর সামন্তদের জন্য আগের মতো লাভজনক হতে পারে না। কৃষিতে ভাগ বা বর্গা-ব্যবস্থার বিকাশ হতে থাকে। এর ফলে, যারা মহামারীর পরে বেঁচে রইল, তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়তে থাকে। দ্বিতীয়ত, সামন্তবাদের একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ছিল প্রাত্যহিক জীবনে (ক্যাথলিক) চার্চের প্রবল প্রভাব। মধ্যযুগের ‘পাপ-পুণ্যের থিওরি’ দিয়ে মহামারীর আক্রমণকে আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। অসুখ হলে এটা বিধাতার অভিশাপ, এবং এজন্য অনুতাপ ও ক্ষমা চাওয়ার যে প্রথা মধ্যযুগে সূচিত হয়েছিল, তা অনেকটাই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। চার্চের সাথে জড়িত অনেক ধর্মযাজকই তখন প্লেগের কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্লেগ পুণ্যাত্মা-পাপাত্মা কাউকেই নিস্তার দেয়নি। সাধারণ ধর্মবিশ্বাসের জন্য এটি ছিল একটি বড় আঘাত। এর মানে এই নয় যে, ধর্মবিশ্বাস মহামারী-পরবর্তী যুগে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মধ্যযুগে জনজীবনের ওপরে ধর্মের যে-প্রবল সর্বগ্রাসী প্রভাব ছিল তা আর মহামারী-পরবর্তী যুগে সেভাবে থাকেনি। এক্ষেত্রে ১৩৪৬-৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথকে যেমন বিবেচনায় নিতে হবে, তেমনি হিসাবে নিতে হবে ১৬৬৫ সালের লন্ডনের গ্রেট প্লেগকে। এ দুইয়ের মধ্যকার তিনশ’ বছরে ছোট-বড় আরও অনেক প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে ইউরোপে। তা ছাড়া, প্লেগ ছাড়া জল-বসন্তও হুমকি হিসেবে ছিল, এটাও মনে রাখতে হয়। মোট কথা, মহামারীর প্রভাবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালিতে জেগে ওঠা রেনেসাঁর ধারা (লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির যুগ) বা ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে রেনেসাঁর ধারা (শেক্সপিয়রের যুগ) ‘মানবতাবাদকে’ শিরোধার্য করেছিল- দেবত্ববাদকে নয়। ঈশ্বরের পাশাপাশি মানুষের গল্পকথা তাই এই পর্বের চিত্রকর্মে, কবিতায়, নাটকে ও গল্পে উঠে এসেছে। একেই সমালোচকরা ‘Renaissance Humanism’ বলেছেন। এর প্রভাবেই আমরা পেয়েছি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও বতিচেল্লির চিত্রকর্ম, বোকাচিও (Bocaccio)-র অমর সৃষ্টি ‘ডেকামরন, চসারের ‘ক্যান্টরবিউরি টেলস্’, আর শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়র’ (যা লেখা হয়েছিল ১৬০৬ সালের প্লেগের সময়ে যখন লন্ডনের গ্লোব থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায় এবং যেখানে শেক্সসপিয়রের নাটক মঞ্চন্থ হতো) ও তার অন্যান্য ট্র্যাজেডিতে বিধৃত মানবতাবাদ। তৃতীয়ত, কালো মৃত্যু শুধু মানবতাবাদের পথই প্রশস্ত করেনি বা চার্চের ওপরে সর্বজনীন আস্থায় চিড় ধরায়নি, রাষ্ট্র বা রাজশক্তির ন্যায্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল। মহামারীর কালে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি ঘটল, অনেক ধর্মযাজক আর্তের সেবা দিয়ে মারা গেলেন, শহর জনশূন্য হয়ে গেল, গ্রাম উজাড় হলো, আর রাজন্য বর্গ লোকালয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে আশ্রয় নিলেন। অন্ধকার যুগের মহামারী হিসেবে প্লেগ যেভাবে রাজশক্তির ন্যায্যতাকে নাড়া দিয়েছে, তা থেকে সামলে উঠতে বহু বছর/শতাব্দী লেগেছিল ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহকে।
উপরের কথাগুলোর সমর্থন পাওয়া যায় প্লেগের সামাজিক ইতিহাসের বিশ্নেষক ফিলিপ জিগলার (Ziegler)-এর বইয়ের মাধ্যমে। আমি তিনটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি তার লেখা থেকে তুলে দিতে চাই। মহামারী যে কীভাবে নৈতিক অবস্থার অধঃপতন ঘটায় সে সম্পর্কে জিগলার বলছেন :
‘The plague not only depopulates and kills; it gnaws the moral stamina and frequently destroys it entirely; thus the sudden demoralization of Roman society from the period of Mark Anthony may be explained by the Oriental plague… In such epidemics the best were invariably carried off and the survivors deteriorated morally. Times of plague are always those in which the bestial and diabolical side of human nature gains the upper hand.’
১৩৪৬-৪৮ সালের প্লেগের পরের কয়েক দশকে অবক্ষয়, অধঃপতন, এমনকি ভোগবাদের দিকে প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল বলে জিগলার মনে করেছেন। উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযোগ্য :
‘Contemporary chronicles abound in accusations that the years which followed the Black Death were stamped with decadence and rich in every kind of vice. The crime rate soared; blasphemy and sacrilege were a commonplace; the rules of sexual morality were floated; the pursuit of money became the be-all and end-all of people’s lives…Who could doubt that humanity was slipping towards perdition when women appeared in public wearing artificial hair and low-necked blouses and with their breasts laced so high ‘that a candlestick could actually be put on them’.
আবারও বলছি, তার মানে এই যে, ধর্ম-কর্ম সমাজজীবন থেকে মহামারীর কারণে উঠে গেল। চার্চের ভাবমূর্তি ও আধ্যাত্মিক প্রভাবে চিড় ধরলেও চার্চের সংখ্যা আগে বেড়ে গিয়েছিল। জিগলার এই মুহূর্তকে শনাক্ত করেছেন এভাবে: ‘Paradoxically, the decades that followed the plague saw not only a decline in the prestige and spiritual authority of the Church but also a growth of religious fervor. One example of this was the large number of chantry Chapels which were opened all over England…. In Italy, nearly, fifty new religious holidays were created’, পাছে ঈশ্বরের কোপানল আরেকবার এসে পড়ে মর্ত্যবাসীর ওপরে! এই প্যারাডক্সের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জিগলার বলেছেন যে, মহামারীর কারণে ধনী ব্যক্তিরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তারা ভাবতে শুরু করেছিলেন নানা বৈধ ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদের মধ্যে বুঝি ‘পাপের গ্লানি’ লেগে আছে। চার্চকে সেই অর্থের কিয়দংশ যদি দান করা যায়, তাতে বুঝি তাদের অপরাধের বোঝা কিছুটা হাল্ক্কা হয়! অবশ্য জিগলার এর পেছনে আরও নিগূঢ় অভিপ্রায় দেখেছেন।
[ক্রমশ]