ড. বিনায়ক সেন, অর্থনীতিবিদ। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকে সিনিয়র ইকোনমিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনডিপিসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩।) বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (আইপিআরএসপি) প্রণয়নে অন্যদের সঙ্গে ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। উন্নয়ন গবেষণায় ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’, ‘জন ক্ষমতায়ন’, ‘নৈতিকতা ও উন্নয়ন’ ইত্যাদি বিষয় তাঁর আগ্রহ ও ভাবনার জায়গা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো : অর্থনীতির জন্য বড় বড় ঘটনা যেগুলো, যেমন পদ্মা সেতু প্রকল্প, জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত, হল-মার্ক, শেয়ার মার্কেটের মতো ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ এসব দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত।
বিনায়ক সেন : এই পরিপ্রেক্ষিতে কৌটিল্য বলেছিলেন, যাঁরা তত্ত্বজ্ঞানী হয়েছেন, তাঁদের সমদর্শী হওয়া চাই। গ্লাসটা যে অর্ধেকের বেশি ভর্তি, সেটাও দেখতে হবে। যে বড় বড় উপসর্গের কথা বললেন, সেগুলো এই সরকারের শাসনকালের নেতিবাচক দিক। কিন্তু কোনো শাসনামল বিচারের প্রচলিত রীতি হলো, সেই আমলে প্রবৃদ্ধির হার কেমন ছিল? দারিদ্র্য দূরীকরণ, আয়বৈষম্য কমানো, সামাজিক সেবা সম্পর্কেও বলতে হবে। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে পশ্চিমা জগৎসহ চীন ও ভারতের প্রবৃদ্ধির হারও কমে আসে। বাংলাদেশ এই সময়ে ৬ শতাংশের সামান্য ওপরে প্রবৃদ্ধিশীল ছিল। এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের ওপরে। বৈশ্বিক স্তরেও বাংলাদেশের সূচক ওপরে ছিল। এ সময়ে রেমিট্যান্সের অব্যাহত প্রবাহ অবকাঠামো নির্মাণে কাজে লেগেছে, রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বিশেষত গার্মেন্টসে যা কর্মসংস্থান করেছে, খাদ্য উৎপাদনে অগ্রগতির কারণে খাদ্য আমদানি কম করতে হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি শক্ত পর্যায়ে এসেছে। মজুরি অনেক বেড়েছে। শহরের ইনফরমাল ব্যবসা ও সেবা খাতও আগের থেকে শক্তিশালী। আর এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা গেছে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মাধ্যমে। প্রথম দুই বছরে মুদ্রানীতি সংকট সৃষ্টি করলেও গত এক বছরে সংযত নীতি নেওয়ার সুফলও সমাজে পড়েছে।
প্রথম আলো : কিন্তু প্রবৃদ্ধির চরিত্র নিয়েও কথা থাকে। বৈষম্য এবং সামাজিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় বেড়েছে। আমাদের সার্বিক অর্থনৈতিক ভিত্তিটাই তো দাঁড়িয়ে আছে সস্তা শ্রম ও বিল-নদী-বন তথা প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠনের মাধ্যমে।
বিনায়ক সেন : প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, একই সঙ্গে সমাজে তীব্রভাবে আয়বৈষম্যও বাড়ছে। এখন আয়বৈষম্যের জিনি সূচক ৪৮-৫০ শতাংশ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয়বৈষম্যের সূচকের চেয়েও বেশি। প্রবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও আয়বৈষম্য বাড়া কেন মানুষ মেনে নিচ্ছে? না মানলে এই প্রবৃদ্ধি তো টেকসই হতো না। দুটো কারণ কাজ করছে মনে হয়, আপেক্ষিক বৈষম্য বাড়লেও অ্যাবসলিউট বৈষম্য কমছে। দুই দশকে চরম দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর মাধ্যমে মানুষ কিছুটা সান্ত্বনা পাচ্ছে। আমাদের দেশ কিন্তু ভারত বা পাকিস্তানের মতো আদিতে অতি বৈষম্যপরায়ণ নয়। এখানে বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, জাতিসহ বিভিন্ন রকম বিভাজনের তীব্রতা অনেক কম। বৈষম্য কমার পাশাপাশি গত দুই দশকে সামাজিক গতিশীলতাও বেড়েছে। ১০ বছর আগে যারা চরম দরিদ্র ছিল, ২০১২ সালে তাদের ৫০ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে, ১০ বছর আগে যারা দরিদ্র ছিল, তাদের ৩৫ শতাংশ ছিল, তারা এখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে গিয়েছে, ১০ বছর আগে যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ছিল, তাদের ১০ শতাংশ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে গিয়েছে। সামগ্রিকভাবে শুধু দারিদ্র্য সূচক বা এমডিজি সূচকে নয়, সচলতার সূচকেও অর্জন হয়েছে। এসব অর্জনের কারণে আয়বৈষম্য বাড়া সত্ত্বেও আপাতত মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা বাড়ছে।
প্রথম আলো : এটা কি একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দুর্নীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে না? দুর্নীতির মাধ্যমে ভালো থাকার চেষ্টা করে পরিবর্তনের চেষ্টা থেকে সরে যাচ্ছে কি না?
বিনায়ক সেন : সম্প্রতি ভারতের সমাজবিজ্ঞানী আশীষ নন্দী এ ব্যাপারে একটা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি ইজ আ ইকুলাইজিং ফোর্স। দরিদ্রের কাছে নেটওয়ার্কিংয়ের অস্ত্র নেই, তার আছে দুর্নীতির অস্ত্র। যারা আমাদের মতো উচ্চ-মধ্যবিত্ত, যারা নেটওয়ার্কিং সোসাইটির মধ্যে বাস করে, তারা দুর্নীতি না করে ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়ানো যায়, ভালো চাকরি পাইয়ে দেওয়া যায়, ওমুক ক্লাব তমুক ক্লাবে জড়িত হওয়া যায়, ভালো থাকা যায়। দরিদ্রদের পক্ষে দুর্নীতিই হচ্ছে আয়-উপার্জনের বাইরে একমাত্র অবলম্বন। যাঁরা শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত সমাজের কথা বলেন, তাঁদের আমি ভয় পাই। একমাত্র স্ট্যালিনিজমের মাধ্যমেই শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া গিয়েছিল। সেখানে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করা হলেও দুর্নীতিকে লেশমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। বিদেশিরা আমাদের চাবুক মারার একটা অস্ত্র হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগকে ব্যবহার করে। অনেকে বলেন, দুর্নীতি না হলে বাংলাদেশে আরও প্রবৃদ্ধি হতো। এটা একটা মিথ। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতির সঙ্গে প্রবৃদ্ধির হারের কোনো সম্পর্ক নেই। যেটার সম্পর্ক আছে তা হলো মাথাপিছু আয়ের। অর্থাৎ আপনি যখন পর্তুগালের মতো স্তরে মাথাপিছু আয় তুলতে পারবেন, তখন আপনার সমাজ মোটামুটিভাবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজে পরিণত হবে। আমাদের উন্নয়ন বাড়ানোয়, অবকাঠামো প্রতিবন্ধক আছে, সেসব ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্নীতির ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিক হিসেবে আমাদের বলতেই হবে। আমি হার্টের অসুখে হাসপাতালে গিয়ে দেখি যন্ত্র কাজ করছে না, তার বিরুদ্ধে বলতেই হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দুর্নীতিকে জড়িয়ে বলা ঠিক নয়।
প্রথম আলো : প্রবৃদ্ধি বাড়লে তো বিনিয়োগও বাড়ার কথা। কিন্তু ভোগবিলাসে অথবা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে পুঁজি। এটা কেন?
বিনায়ক সেন : গত ৩০ বছরের বিনিয়োগ ঋণের সঙ্গে মধ্যমেয়াদি ঋণের সম্পর্ক বিচার করেন তাহলে দেখবেন, সেগুলো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োজিত হয়নি। এর পেছনে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিও কিছুটা দায়ী। এ কারণে পুঁজি চলে গেছে রিয়েল এস্টেটে বা ভোগবিলাসে। বিনিয়োগের ৩০ বছরের সিরিজ বিচার করলে দুটো উল্লম্ফন দেখতে পাব, আশির দশকে বিনিয়োগের হার জিডিপির অনুপাতে ছিল ১২-১৩ শতাংশ। নব্বই দশকে এটা লাফিয়ে ১৭-১৮ শতাংশে উঠে যায়। নব্বই দশকে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেশ কিছু স্থিতিশীলতার নীতি নেওয়া হয়। যমুনা সেতু নির্মাণও বিনিয়োগের হার বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় উল্লম্ফন হয় ২০০৩-০৪ দিকে। তখন ১৭-১৮ থেকে বেড়ে ২৩-২৪ শতাংশে চলে যায়। সেই অবস্থা এখনো বিরাজ করছে। যাঁরা বলছেন নীতিমালার কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে না, তা ঠিক নয়। এর জন্য চমৎকার অনুঘটক ছিল রেমিট্যান্সের প্রবাহ এবং রপ্তানিমুখী গার্মেন্টের বিকাশ। ২০০৫-এ কোটা উঠে যাওয়ার পরও এই শিল্প বিকশিত হয়। এখন আমাদের প্রয়োজন আরেকটা বড় কোনো চালকের উদ্ভব। সেটা হতে পারে রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টের মতো আরেকটা বড় কোনো ধাক্কা। সেটা ইলেকট্রনিকস অ্যাসেম্বলিং সেক্টরে হতে পারে, তথ্যপ্রযুক্তি হতে পারে। এখন আমাদের চাই আরেকটা নতুন খাত। এ রকম ঘটনা ছাড়া বিনিয়োগ ৩০-৪০ শতাংশে যেতে পারব ভারতের মতো। ভারতেও এভাবে বহুমুখী বিনিয়োগের মাধ্যমে বিনিয়োগ বেড়েছে। খেয়াল করার বিষয়, আমাদের অর্থনীতিবিদেরা কিন্তু গার্মেন্ট খাত কিংবা প্রবাসী শ্রম খাতে সাফল্যের কোনো অনুমান আগাম করতে পারেননি। আমার মনে হয়, এ রকম তৃতীয় একটি খাত হয়তো আমাদের অগোচরে বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করছে। সরকার ও পরিকল্পনাবিদদের উচিত সেই সম্ভাবনাটা খুঁজে বের করা।
প্রথম আলো : জ্বালানি ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক স্বার্থে দুর্নীতির পাশাপাশি পাবলিক সেক্টরকে প্রাইভেট মুনাফার জন্য সাজানোর ভুল নীতি আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। যেমন কুইক রেন্টালের কথা বলা যায়। দিনের পর দিন সংকটের সুরাহা না করে একটা যেনতেন সমাধান গিলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কী বলবেন?
বিনায়ক সেন : এসব সমস্যা গত দুই দশক ধরে জমে হয়েছে। কুইক রেন্টাল সমাধান নয়। কিন্তু আপৎকালীন এই ব্যবস্থারও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফল আছে। গার্মেন্ট শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতো কি না, মেপে মেপে বলা উচিত। তবে কুইক রেন্টালের পাশাপাশি অন্যান্য স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগও পাশাপাশি শুরু করা উচিত ছিল। বিকল্প নিয়ে উদ্যোগ অনেক দেরিতে আসছে বা আসেইনি। এর দায়ভাগ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা তার আগের বিএনপি সরকারও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সমাধান নিয়ে উদ্যোগী হননি। উচিত ছিল নাগরিক সমাজ, অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনেক আগেই বসা। তা করা হলে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে থাকত। এই খাতে ন্যূনতম পরিচালন ক্ষমতার প্রমাণ আমরা রাখতে পারিনি। অন্যদিকে দুর্নীতি হয় বলে বিশ্বব্যাংক-এডিবির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কখনো বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি। অন্যদিকে নিজেরাও গ্যাস ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারিনি। মধ্য আয়ের দেশের কাছাকাছি যেতে হলে বাস্তবোচিত জ্বালানি নীতি এখনই নিতে হবে।
প্রথম আলো : বিশ্বব্যাংক তো সরে গেল। আপনি বেশ আগে থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু কিসের ভরসায়?
বিনায়ক সেন : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার কথা, যেটি এক বছর আগে বলেছিলাম; তখন নেওয়া গেলে আরও ভালো হতো। সরকার উদ্যোগ নিয়েও পিছিয়ে যায়। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে আমরা একটা সেতু নির্মাণ করতে পারব না, তা নয়। আমাদের বিশেষজ্ঞ আছেন। আর অর্থ, যা প্রয়োজন, তা খুব বড় নয়। এক বিলিয়ন ডলার বা আট হাজার কোটি টাকা স্থানীয় মুদ্রায়, আর দুই বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রায়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কথাটি আজ থেকে সাত-আট মাস আগে বণিক বার্তাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলাম, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরবে না এবং নিজস্ব অর্থায়নেই এটি নির্মাণ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় এটি বড় কিছু নয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে পাঁচ বছরে, অর্থাৎ দুই বিলিয়ন ডলার আমাদের একসঙ্গে ব্যয় করতে হবে না। এই পরিমাণ অর্থ তিন মাসের আমদানি-ব্যয়েরও কম। প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রার জোগান দিতে হবে। বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ‘ডলার বন্ড’ ছেড়ে সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানে ৬ থেকে ৮ শতাংশ সুদ দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। বিদেশি মুদ্রার ৫০ শতাংশ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সহজেই জোগানো যায়। বতর্মানে আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ১৩-১৪ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স-প্রবাহও বেশ। এ বছরে আমদানি ব্যয়ও ছিল কম। ফলে রিজার্ভ থেকে ফিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা মোটেই কঠিন নয়। প্রবাসী অনেক বিশেষজ্ঞ ও বসবাসকারী আমাকে বলেছেন, ২-৩ শতাংশ সুদ দিলেই ডলার বন্ড বিক্রি করা যাবে। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি আমানতে সুদ পাওয়া যায় দশমিক ৭ শতাংশ। সেখানে ২-৩ শতাংশ সুদ ঘোষণা করলেই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানকার বাঙালিরাই দেবে। অনেকে বলছেন, বন্ডের অর্থ সুদসহ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপবে। আসলে প্রতি মাসে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি থেকে পাওয়া অর্থের সামান্য অংশই ব্যয় হবে বন্ডের সুদসহ আসল পরিশোধে। পরিশোধে অনেক বছর সময়ও পাওয়া যাবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে স্বচ্ছতা বজায় রাখায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রথম আলো : কিন্তু সামর্থ্যের চেয়েও বড় হয়ে উঠছে সরকারের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা।
বিনায়ক সেন : বড় বিষয় হলো ঝুঁকি নয়, সরকারের দোদুল্যমানতা বা মনস্থির করতে না পারা। এটা সুশাসনের পরিচয় নয়। বর্তমান সরকারের বাকি মেয়াদে হয়তো বড় ধাপ ফেলা যাবে না। তবে প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করা সম্ভব। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির চাকা গতিশীল করতে এর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পদ্মা সেতু থেকে হাই রিটার্নও মিলবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও স্বীকার করেছেন, এ সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, পদ্মা সেতু না হলে রাজনৈতিক মাশুলও সরকারের জন্য চড়া হয়ে যাবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সমর্থন হারানোর শঙ্কা রয়েছে। দুটি কারণ মিলিয়েই রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকেই যাওয়া উচিত। এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ইস্যু নয়, এটি জাতীয় বিষয়। এ ক্ষেত্রে বড় দুই রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামো নির্মাণ ও এর উন্নয়ন কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠাও জরুরি। বর্তমান সরকার সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলে আগামী সরকার সেটি চালিয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক সরকারের নেওয়া কর্মসূচি অন্য সরকার তো বন্ধ করছে না; বরং সম্প্রসারণ করছে। কাজ শুরুর পর বিশ্বব্যাংকও আবার পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত হতে পারে। যমুনা সেতুর বেলায়ও বিশ্বব্যাংক পরে যুক্ত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণ স্থগিত রাখলে অর্থনৈতিক তো বটে, রাজনৈতিক-সামাজিকভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।