বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
১২. বাঙালি জাতীয়তাবাদ :কয়েকটি অবহেলিত প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের জনগণের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা আধুনিক যুগের, নেশন অর্থে ‘জাতি’- এই ধারণাটিও আধুনিক কালের। বাংলায় জাতির তিনটি অর্থ :একটি হচ্ছে বর্ণ, অন্যটি Race এবং আরেকটি হচ্ছে Nation। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “স্বীকার করিতে হইবে, বাংলায় ‘নেশন’ কথার প্রতিশব্দ নাই। চলিত ভাষায় সাধারণত জাতি বলিতে বর্ণ বুঝায়, এবং জাতি বলিতে ইংরাজিতে যাহাকে race বলে, তাহাও বুঝাইয়া থাকে। আমরা ‘জাতি’ শব্দ ইংরাজি ‘রেস’ শব্দের প্রতিশব্দের ব্যবহার করিব এবং নেশনকে নেশনই বলিব।” জাতি-রাষ্ট্র গঠন করার আগেও জাতি জেগে উঠতে পারে। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক সময়ে ‘জাতি’ জেগে ওঠার চেষ্টা করে। পাকিস্তান আমলে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ক্রমে দানা বেঁধে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত কাজ করে গেছে পাকিস্তানি ‘রাষ্ট্র’। এটাকে বলা যায়ু ‘স্টেট অ্যাগেইনস্ট নেশন’ (শব্দবন্ধটি ঐতিহাসিক আহমেদ কামালের)। যখন কোনো জাতি ভিনদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে ওঠে, তখন সে নিজেই জন্ম দেয় এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের (নেশন-স্টেটের)। বাঙালি জাতি যেমন পঁচিশ বছর ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের, যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র-জাতি হচ্ছে বাঙালি জাতি, বাঙালি জাতির গড়ে ওঠার প্রধান সময় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপর্বে। অর্থাৎ রাষ্ট্র-জাতি হিসেবে বাঙালি নেশন আধুনিকতম নেশন। এই কথাটায় কারও কারও মনে প্রশ্ন দেখা দেবেু তাহলে কি বাঙালি জাতি চর্যাপদ বা প্রাক-চর্যাপদকাল থেকে চলে আসা একটি আবহমান বাঙালি জাতির অংশ নয়? এ প্রশ্নটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, বাঙালি জাতির ‘হাজার বছরের’ ইতিহাস। সেটা হাজার বছরের কেন, আরও প্রাচীনতম সময়েরও বলে দাবি করা যেতে পারে। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে যেমন প্রাচীন যুগের বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে দাবিটা হবে বাঙালি ‘নেশনের’ ক্ষেত্রে নয়ু এই জনপদের ‘মানুষের’ ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য হবে। অভিন্ন ইতিহাস, অভিন্ন আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের স্মৃতিু এসব বৈশিষ্ট্যকে ‘নেশন’ হিসেবে দাবি করার পেছনে বড় লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলেন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নস্ট রেনাঁ। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি- এসব ঐতিহাসিক স্থানে পরিব্রাজক হিসেবে আমরা যখন জড়ো হই, আমরা তখন তার ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক কারুকার্য বা কীর্তিতে বিস্মিত হই। কিন্তু সেসব স্থানের সঙ্গে আমাদের আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের কোনো স্মৃতি আমরা নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাই না। ওই সব জনপদের স্মৃতি আমাদের ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক একসময়ের ধারক, কিন্তু তারা আমাদের সাম্প্রতিকতম জাতি-গঠনের ‘অংশ’ নয়। আমরা তাদের সম্পর্কে জেনেছি মূলত বইয়ের মাধ্যমে বা হয়তো কোনো সাংস্কৃতিক উপকরণের (গান, পালা, মৃৎশিল্প ইত্যাদি) মাধ্যমে। এদেরকে আমরা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান হিসেবে ধরব, কিন্তু বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞানের সূত্র এদের মধ্যে নিহিত নেই। সেই অর্থে শুধু বাঙালি জাতি বলে নয়, কোনো নেশন বা জাতিই ‘প্রাচীন’ নয়, কেননা নেশন অর্থে জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠার কালই শুরু হয়েছে কেবল ‘আধুনিক’ সময়ে। ‘আধুনিক’ বলতে ইউরোপের পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট ও শিল্পবিপ্লব-উত্তর সময়ে। ভারতের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে আরও অনেক পরেু উনিশ শতকের শেষের দিকে বা বিংশ শতকের শুরুর দশকে।
এ জন্যই রামমোহন রায়-দ্বারকানাথ ঠাকুর-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় জাতির বা নেশনের কোনো ‘স্বপ্ন’ দেখতে পাই না। এর কারণ, ‘নেশন’ এই বোধটাই তখন আমাদের মধ্যে জন্মায়নি। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যে বাঙালি নেশন ধারণ করে আছে, তার সূত্রপাত ভারতের চেয়েও আরেকটু পরেু গত শতকের চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে যার বিস্তৃতি। সেই অর্থে আমরা নবীন বা নবীনতম জাতি। এতে আমাদের সংকুচিত হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর কোনো জাতিই প্রাচীন নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চ্যাটার্জি তার নতুন বইতে (যার নাম The Truths and Lies of Nationalism as Narrated by Charvak) ) দেখিয়েছেন যে- ’no one, not even Indians, can claim to be part of an ancient nation’ সব জাতি-রাষ্ট্রই, সব নেশনই আধুনিককালের সৃষ্টিু কেউই প্রাচীন জাতি-রাষ্ট্র বা জাতি নয়। আমরা এই ভূখণ্ডের বাঙালিরা বহুকাল ধরে বহু সাম্রাজ্যের পালাবদলের সাক্ষী হয়ে এই জনপদে বাস করছি এবং সেই অর্থে আমাদের প্রাচীন বা প্রাচীনতম শিকড় রয়ে গেছে এই বাংলার ভূপ্রকৃতির মধ্যে; কিন্তু আমরা ‘প্রাচীন জাতি’ নই। আমরা আধুনিক পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট কালে, আধুনিকতম ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে, সৃষ্ট একটি নবীন জাতি যে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে তার নিজের জন্য একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পেরেছে। এতে আমাদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার কিছু নেই; বরং চলতি সময়ের উপাখ্যান হিসেবে আমাদের জাতীয় জাগরণের ইতিহাস, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সফলতা এবং তার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুু এই ন্যারেটিভের দিকে সমূহ দৃষ্টি দেওয়াই হচ্ছে সঠিক রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাহাত্তরের সংবিধানের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে মূল বক্তব্য সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে আহ্বান জানায়। একটু সবিস্তারে এ নিয়ে বলতে চাই।
কেন উনিশ-বিশ শতকের আগে এই উপমহাদেশের জনগণ কোনো ‘নেশন’ ছিল না, এই দাবি কারও কারও কাছে অসংগত বলে মনে হতে পারে। মৌর্য, গুপ্ত, সুলতানি আমল, মোগল, মারাঠা, নবাবি আমল এরা কি একেকটি সাম্রাজ্য, কীর্তিমান রাজ্য বা ‘ ’great state’-এর উদাহরণ নয়? নিশ্চিতভাবেই এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কেউ কেউ ‘বিশাল সাম্রাজ্য’ও স্থাপন করেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কিন্তু ‘নেশন’ ছিল না। এর কারণ, এই সাম্রাজ্যগুলো এই ভূখণ্ডের ও জনপদের অধিবাসীদের ওপরে শাসন করেছে সামরিক শক্তির জোরে এবং ‘খাজনা আদায়’ করে। এই সাম্রাজ্যগুলো ইতিহাসের নানা পর্বে যেসব রাষ্ট্রের পত্তন করেছিল, সেসব রাষ্ট্র কেবল বহিঃস্থ শক্তি হিসেবে আমাদের ওপরে প্রভুত্ব বা রাজত্ব করেছে। আমাদের ভূখণ্ডের সমাজের কাছে, সমাজের চোখে এসব রাষ্ট্র ছিল external force বহিঃস্থ শক্তি কেবল। এ জন্যই কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, রাজা যায়, রাজা আসে। এই পালাবদলে জনসমাজের কোনো দায় নেইু কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। জাতি নির্মাণ তখনই সফল হয়, যখন কিনা রাষ্ট্র তার শাসনকার্য নির্বাহ করে জনগণের ‘সম্মতিতে’। যখন জনগণ ‘উপর থেকে’ চাপিয়ে দেওয়া শাসনকে ‘নিচে থেকে’ সম্মতি (consent) দিয়ে স্বীকৃতি জানায়। নিচে থেকে সম্মতিদানের প্রক্রিয়ায় যে রাষ্ট্রের জন্ম, সেটিই কেবল সফল নেশন-স্টেটের জন্ম দিতে পারে। নিচে থেকে জেগে ওঠা জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তখন সফল জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়, যেমনটা হয়েছে আধুনিক যুগে উনিশ-বিশ শতক থেকে নানা মহাদেশে, নানা দেশের বেলায়। এককথায়, শাসনকার্য যখন জনগণের ‘সম্মতি’ ছাড়া পরিচালিত হয়ু যাকে ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘ডোমিন্যান্স উইদাউট হেজমনি’ু তখন অধীন জাতির জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় না।
এই ‘সম্মতির’ কথাটিই উচ্চারিত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের ‘সম্মতি’ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর জন্যই সংবিধানের শুরুতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে এই ‘প্রস্তাবনার’ সংযোজন। কেননা, জনগণের ‘সম্মতি’ (consent) ছাড়া সাম্রাজ্য হয়, কিন্তু জাতি-রাষ্ট্র হয় না। সেই অর্থে, জনসম্মতি পায়নি বলে ১৯৪৭-৭১ পর্বে ‘পাকিস্তান’ কোনো জাতি-রাষ্ট্র হতে পারেনি। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক ‘সাম্রাজ্য’ হিসেবে সে থেকে গেছেু অন্তত পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই প্রস্তাবনার মাধ্যমেই বাঙালি জাতির জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের ‘গণপ্রজাতান্ত্রিকতা’ ঘোষিত ও স্বীকৃত হয়। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা বা রুশ বিপ্লবের মতোই এ দেশের জনগণের ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান ঘোষণা হচ্ছে এই ‘প্রস্তাবনা’। যেখানে বলা ছিল স্বাধীনতা, মুক্তি, আদর্শ, মূলনীতিসংবলিত এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের কথা। সেই সংজ্ঞায় আবহমানকাল ধরে চলে আসা ‘হাজার বছরের’ বাঙালি জাতির কথা বলা ছিল না। বলা হয়েছিল নিকট অতীতের সংগ্রামরত পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতির কথা। পুরোটা পড়লে সন্দেহ থাকে না যে, কথা হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বে এই জনপদের অধিবাসীদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এবং তার মাধ্যমে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন :
“আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলু জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাু যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সংগতিরক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;
এতদ্দ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।”
উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটুকু ইঙ্গিত মেলে যে, বাঙালি জাতির ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামই’ এই নতুন জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ ও পরবর্তী ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল। কেউ যদি বলেন যে, এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন আসলে সূচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে বা তারও আগে ১৮৫৭ বা ১৭৫৭ সালে, তা হবে অতিকথন দোষে দুষ্ট। কেননা, ওই প্রস্তাবনাতেই দ্বিতীয় স্তবকে স্পষ্ট করা হয়েছে এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চালিকাশক্তির কথা। এই মুক্তিসংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করেছিল কতগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শু জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯০৫ সালে যারা বঙ্গভঙ্গ করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী) বা যারা বঙ্গভঙ্গ না করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী) এরা কেউই উপরোক্ত চার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল না। ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটাই তখন পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ করা বা না-করার দলের নেতা বা তাত্ত্বিকদের মধ্যে জন্ম হয়নি। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যা ছিল তা হলো বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম ‘সম্প্রদায়ের’ মধ্যে সম্প্রদায়গত স্বার্থের লড়াই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল (হিন্দু) জমিদার বনাম (মুসলিম) কৃষকের শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব, (হিন্দু) মধ্যবিত্ত বনাম (মুসলিম) মধ্যবিত্ত স্তরের অর্থনৈতিক স্বার্থ (ব্যবসা, চাকরি, জমি) সংক্রান্ত বিরোধ। এটা দুই ‘নেশনের’ মধ্যকার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল নাু তা জিন্নাহ সাহেব যাই বলুন না কেন। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি বিভক্তভাবে কোনো জাতি নির্মাণ করতে পারেনি ১৯৪৭-পূর্ব সময়ে। ১৯৪৭-এর পরে যে জাতি নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের বৈরী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তাতে বাঙালি মুসলিমের প্রধান অবদান ছিলু কেননা পূর্ববঙ্গের প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল তারা ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাগের সময়ে। কিন্তু ১৯৪৭-৭১ পর্বে বাঙালির মুসলিমের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অমুসলিম জনগোষ্ঠীও অবজেকটিভ কারণেই সহযোগী ভূমিকা পালন করেছিল। দেশভাগের পরে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিভিন্ন কারণে একটি অংশের দেশত্যাগের পরেও বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণ ছিল পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশ (১৯৬১ সালের সেন্সাস অনুসারে)। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পাকিস্তানের ‘মেজোরিটি’ অংশ পূর্ব বাংলার অধিবাসীু সংখ্যাগরিষ্ঠতার গাণিতিক যুক্তিটি অকাট্য বলে প্রমাণ করা গিয়েছিল কেবল এই জনপদের বাঙালি মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে একত্র করেই। জনসংখ্যার অনুপাতে অধিকতর সম্পদ বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর (কেননা তারা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ)ু এই যুক্তি কেবল তখনই খাটে, যখন ‘বাঙালি’ বলতে আমরা শুধু বাঙালি মুসলিম নয়, বাঙালি হিন্দু ও অপরাপর ধর্মাবলম্বী অংশকেও হিসেবে ধরি। এটাই হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বের ধর্ম-নির্বিশেষে সকল বাঙালি জাতিকে একত্র করার এবং পরস্পরের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করার ‘গাণিতিক ভিত্তি’।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এক অর্থে, মওলানা ভাসানীর মধ্যে ‘দ্বৈত-সত্ত্বা’ বিরাজ করছিল। একদিকে তিনি ছিলেন সামন্তবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ‘মজলুম জননেতা’। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন স্বভাবজ ধর্মগুরু- একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। এই ‘দ্বৈততা’ তাকে কৃষক-জীবনের সাথে অঙ্গীকৃত করেছিল। তিনি ছিলেন এই অর্থে (গ্রামসির ভাষ্যে) একজন ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল অব পেজেন্ট ক্লাস’। তবে দ্বৈততা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতা ও সর্ব ধর্মের মানুষকে সমানাধিকার দান এবং (সেই অর্থে) ধর্মনিরপেক্ষতাকে জোরেশোরে তুলে ধরার প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি। ‘রবুবিয়ত’ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য বা লেখা পড়লে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। রবুবিয়ত প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই এখানে। মওলানা ভাসানীর এই উপলব্ধির রাজনৈতিক তাৎপর্যের দিকে সাম্প্রতিককালে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আসল কথা হলো, ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শের ওপরে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রভাব পড়েছিল। মার্কসবাদী ও অমার্কসবাদী উভয় সূত্র থেকেই ‘শোষণমুক্ত সমাজ’ গড়ার স্বপ্ন তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। ন্যাপ গঠনের সময়ে ভাসানীর দর্শনে প্রগতি পন্থার ‘মার্কসবাদী’ প্রভাবের সূত্র আগেই উল্লেখ করেছি। এবার অমার্কসবাদী সূত্রের প্রভাবের কথা বলব।
আসামের বিপ্লবী দার্শনিক আল্লামা আজাদ সোবহানীর সাথে ১৯৪৬ সালের একটি সাক্ষাতের গভীর অভিঘাত পড়েছিল মওলানা ভাসানীর ভেতরে। আগেই বলেছি, ভাসানী মুসলিম লীগ ঘরানা থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশ করেননি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অসহযোগ আন্দোলনের নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা হাসরত মোহানী প্রমুখের চিন্তা ও চর্চা তার জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। ভাসানী এ নিয়ে লিখেছেন, আল্লামা আজাদ সোবহানী বলিলেন, ‘তবে আজ ওয়াদা কর তুমি রাজনৈতিক জীবনে যত কলাকৌশলই নাও না কেন মূলত হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের লক্ষ্যে সংগ্রাম করিয়া যাইবা। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়িল ১৯৩৫ সালে আমরুহাতে ১৭ জন আলেম রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্তের কথা। মনে পড়িল মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা ওবায়দুল্লা সিন্ধী প্রমুখের সাথে আমার যোগাযোগ ও ওয়াদার কথা। আমার মনে পড়িল খিলাফত আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর সাহচর্যের কথা। আমি দেখিলাম যৌবনের উচ্ছ্বাস শেষে যে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়াছিলাম আজ প্রৌঢ় জীবনে সেই রাজনৈতিক দর্শনের দাওয়াতই আসিয়াছে।’ এই দর্শনের বিবরণ দেওয়া সহজসাধ্য নয়। এখানে বাহাত্তরের সংবিধানের সমতাবাদী চিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আলোচনার প্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর ‘পালনবাদ’ (বা অন্যত্র যাকে বলেছি ‘caring state) সেটির সাযুজ্য স্থাপন করাই আমার মূল লক্ষ্য।
পালনবাদের মূল কথা হলো যে এই জগতের কোনো কিছুই অহেতুক সৃষ্টি হয়নি। ‘সকল কিছুর অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিষয় বিশেষে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘রব’ গুণে গুণান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না, সবকিছুকে বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন-পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই পালনবাদের আদর্শই হইল রবুবিয়ত। সকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় রবুবিয়তের আদর্শ যে-রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হইবে তাহাই হুকুমতে রাব্বানিয়া। সে-রাষ্ট্রে থাকিবে স্রষ্টার পালনবাদ- মানুষের শাসনবাদ নহে।’
এই পালনবাদের প্রয়োগ ও আদর্শ হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। এই বিষয়ে মওলানা ভাসানী লিখেছেন : ‘সকল সমস্যার সমাধান হইবে মানবজাতি যদি রবুবিয়তের অর্থাৎ স্রষ্টার পালনবাদের আদর্শে হুকমত কায়েম করিতে পারে। শিক্ষা-দীক্ষা, খাওয়াপরা, ইত্যাদির প্রশ্নে স্রষ্টার নিকট যেমন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি পরিচয়ের কোনো বালাই নাই- মানুষের দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার ক্ষেত্রে যেমন ভেদাভেদ নাই ঠিক তেমনি হুকুমতে রব্বানিয়ায় সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার দেওয়া হইবে। আজ আর কোনো সন্দেহ নাই। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে শাসন, শোষণ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া মানবজাতিকে সুখী করিতে পারে।’
এখানে দ্রষ্টব্য যে ভাসানী রবুবিয়তের আদর্শ বলতে গিয়ে যেমন পবিত্র গ্রন্থের সাক্ষ্য টেনে আনছেন, তেমনি স্মরণ করছেন ফরাসী বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের’ বাণী। ভাসানী এরপরে বলবেন ‘ব্যক্তিগত মালিকানা’ উচ্ছেদের কথাও। যেটি এমনকি প্রথাগত বামপন্থিরাও (সংগত কারণেই) উচ্চারণ করেননি। মার্কস বা লেনিন কেউ সবধরনের ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ চাননি। কিন্তু ভাসানী এখানে অনেক বেশি ‘চরমপন্থি’- অন্তত ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের প্রশ্নে। তার বয়ানেই শোনা যাক :
‘আমি যখন হুকুমতে রব্বানিয়ার কথা বলি তখন শুধু কমিউনিস্ট ও বামপন্থি রাজনীতিবিদরাই বিরোধিতা করেন না, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থি একশ্রেণির আলেম-ওলামা এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদও প্রচণ্ড আপত্তি উত্থাপন করেন। আমি বলিয়া থাকি, সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ উহার আমানতদার মাত্র। তাই আল্লাহর নামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে বণ্টন করিয়া ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করিতে হইবে। কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন বটে কিন্তু তাহাদের মতে উহা আল্লাহর নামে না হইয়া রাষ্ট্রের নামে হইতে হইবে। আলেম-ওলামারা সবকিছুতে আল্লাহর মালিকানা মানিয়া লইয়া থাকেন বটে কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন না। এইভাবে হুকুমতে রব্বানিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী দুইটি মতবাদ রহিয়াছে ইহা আমার অনুসারীদিগকে বুঝিয়া লইতে হইবে।’
মওলানা ভাসানীর এই নিজস্ব দর্শনে বামপন্থি চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে সরলীকৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে কিছুটা ভুল তথ্যের প্রকাশ দেখা যায়। মার্কসীয় দর্শনে- অন্তত সমাজতন্ত্রের পর্যায়ে- ‘প্রাইভেট প্রপার্টি’ বা পুুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানা অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পূর্ণ উচ্ছেদ আবশ্যিক নয়। আর ‘পার্সোনাল প্রপার্টি’ অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের তো প্রশ্নই ওঠেনি কোনদিন। প্রাইভেট প্রপার্টি অর্থে ব্যক্তিগত মালিকানা লেনিনের নিউ ইকনমিক পলিসি, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের নানা পর্বে, দেং শিয়াও পিং উত্তর চীনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতায় ভালোভাবেই স্বীকৃত ছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে কালক্ষেপণ করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, ‘রবুবিয়তের’ কথা বলতে গিয়ে ভাসানী শুধু একটি বিশেষ ধর্মের কথাই বলেননি। তিনি বারবার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে অনুসৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সংজ্ঞা অনুসারী- তিনি সকল ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখছেন। আমার বক্তব্যের সপক্ষে আমি ভাসানীর এপ্রিল ১৯৭৪ সালের ভাষণ থেকে নিল্ফেম্নাক্ত উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই :
‘আমি চাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েম করিয়া হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব চাহিদা পূরণ করিতে। ইহার সাথে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নাই। তাই সকল ধর্মাবলম্বী উহার উপকারিতা ভোগ করিতে পারিবে। নিজ নিজ ধর্মীয় দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটিবে ইহাই আমার কামনা। যে-কেউ প্রশ্ন করিতে পারেন হুকুমতে রব্বানিয়া কীভাবে অমুসলমানদেরকে আপন করিয়া লইবে? যাহারা রবুবিয়তের মর্ম বুঝেন না তাহাদের এই প্রশ্ন করা খুবই স্বাভাবিক। রবুবিয়ত কোনো ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল মানুষের জন্য হুকুমতে রব্বানিয়া অর্থাৎ যে-দেশে রবুবিয়তের আদর্শ রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে কায়েম হইয়াছে, কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। মুসলমানদের জন্য যিনি রব বা পালনকর্তা, বিবর্তনকারী প্রভু, হিন্দুর জন্য তিনি একই বিধানে আলো-হাওয়া, ফল, পানি, বস্ত্র, খাদ্য সবই জোগাইতেছেন। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারে।’
যদি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা- যেভাবে সংবিধানে তা দেওয়া আছে- আমরা বিবেচনা করি, অর্থাৎ যেখানে সকল ধর্মের সমান অধিকার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মের অপব্যবহার রোধ এসবকে তুলে ধরা হয়েছে- সেটি মানার জন্য নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাস রেখেই সমতাবাদী সমাজ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হওয়া চলে। এর সাথে ধর্মহীনতা, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। মওলানা ভাসানীর বিশেষ ধরনের সমতাবাদী চিন্তা (তার ‘রবুবিয়তের’ তত্ত্ব সহ) এই চলার পথে সহজেই অঙ্গীকৃত হতে পারে। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ভাসানী এই তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর সর্বমানববোধের সাথে ইসলামী মরমি দর্শন, মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সুফিদর্শন, পরবর্তী কালের নদীয়াকেন্দ্রিক শ্রীচৈতন্য ও তৎপরবর্তী বাংলার বৃহত্তর বাউল-ফকিরি ঘরানার মূল কথা- অর্থাৎ ‘সবাইকে সমভাবে দেখা’- এর মৌলিক ঐক্যসূত্র রয়েছে। তবে ভাসানী অহিংসা-নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে গান্ধীর থেকে তিনি সুভাষ বসু, খ্রুশেভের থেকে তিনি মাওকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আজীবন বিপ্লবীদের অনুগামী। বিনা কারণে টাইম তাকে অভিহিত করেনি ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বলে।
পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথমত ও প্রধানত একজন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। মূলধারার রাজনীতিকে পুনর্গঠন করে ধাপে ধাপে তিনি প্রথমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং পরবর্তীতে একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভাসানীর ইসলাম বা রবুবিয়তের দর্শনের মূল সর্বমানববাদী বক্তব্যে তার আপত্তি থাকার কথা ছিল না। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সবল সমাজ গঠনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সব ধারা ও উপধারাকেই যৌক্তিক স্থান দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এইসব ধারা ও উপধারার মূল কথা হচ্ছে- সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করে সেকথা বললেন :
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’ তারপরে আরো কিছু কথা বলার পরে তিনি বললেন :
‘আমি সর্বশেষ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করব, যেন এই দায়িত্ব আমরা সুচারুরূপে পালন করতে পারি। যে শহীদেরা আত্মাহুতি দিয়েছেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য, তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত সমাজের, আজকের বাংলাদেশের জনগণ আশা করে, যে সংবিধান-কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার মাধ্যমেই হবে তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন। আমি আল্লাহর নিকট আবার প্রার্থনা করি, যেন বাংলাদেশের জনগণের আশা পূর্ণ হয়।…জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মওলানা তর্কবাগীশ সাহেব মোনাজাত করে দোয়া করবেন।’
এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সমাপনী বক্তব্যের শেষ ক’টি লাইন। ধর্মনিরপেক্ষতার এই সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার পরও এ নিয়ে যারা অপপ্রচার চালিয়েছেন, তারা অবুদ্ধির বশবর্তী হয়ে সেটা করেছেন অতীতে (এবং এখনো ইউটিউবে-ফেসবুকে সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ জুড়ে করে যাচ্ছেন)। তারা ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা এই মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন দিবারাত্রি। তাদেরকে বোঝানো শক্ত। জ্ঞানমার্গ বা যুক্তি দিয়ে সবাইকে সবকিছু বোঝানো যায় না। না বুঝতে চাওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ, শ্রেণিগত স্বার্থ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ থাকে। ‘আইডিওলজি’ মোহমুক্তভাবে অনেক সময় সত্যকে দেখতে দেয় না। পারস্য-যাত্রীর শেষে রবীন্দ্রনাথ এদের উদ্দেশ্য করেই একটি গদ্য-কবিতায় বলেছিলেন :
‘হায় মানুষ! এই জগৎটা শুধু দৈহিক অহং-এর পুষ্টির জন্য নয়;
যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাওয়া বড়োই কঠিন;
ভোরের পাখির সুরলহরী নিদ্রিত মানুষ জানে না
মানুষের জগৎটা যে কী, তা পশু কেমন করে জানবে।’
[ক্রমশ]