পর্ব ::৯৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
১২. বাঙালি জাতীয়তাবাদ :কয়েকটি অবহেলিত প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের জনগণের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা আধুনিক যুগের, নেশন অর্থে ‘জাতি’- এই ধারণাটিও আধুনিক কালের। বাংলায় জাতির তিনটি অর্থ :একটি হচ্ছে বর্ণ, অন্যটি Race এবং আরেকটি হচ্ছে Nation। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “স্বীকার করিতে হইবে, বাংলায় ‘নেশন’ কথার প্রতিশব্দ নাই। চলিত ভাষায় সাধারণত জাতি বলিতে বর্ণ বুঝায়, এবং জাতি বলিতে ইংরাজিতে যাহাকে race বলে, তাহাও বুঝাইয়া থাকে। আমরা ‘জাতি’ শব্দ ইংরাজি ‘রেস’ শব্দের প্রতিশব্দের ব্যবহার করিব এবং নেশনকে নেশনই বলিব।” জাতি-রাষ্ট্র গঠন করার আগেও জাতি জেগে উঠতে পারে। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক সময়ে ‘জাতি’ জেগে ওঠার চেষ্টা করে। পাকিস্তান আমলে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ক্রমে দানা বেঁধে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত কাজ করে গেছে পাকিস্তানি ‘রাষ্ট্র’। এটাকে বলা যায়ু ‘স্টেট অ্যাগেইনস্ট নেশন’ (শব্দবন্ধটি ঐতিহাসিক আহমেদ কামালের)। যখন কোনো জাতি ভিনদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে ওঠে, তখন সে নিজেই জন্ম দেয় এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের (নেশন-স্টেটের)। বাঙালি জাতি যেমন পঁচিশ বছর ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের, যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র-জাতি হচ্ছে বাঙালি জাতি, বাঙালি জাতির গড়ে ওঠার প্রধান সময় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপর্বে। অর্থাৎ রাষ্ট্র-জাতি হিসেবে বাঙালি নেশন আধুনিকতম নেশন। এই কথাটায় কারও কারও মনে প্রশ্ন দেখা দেবেু তাহলে কি বাঙালি জাতি চর্যাপদ বা প্রাক-চর্যাপদকাল থেকে চলে আসা একটি আবহমান বাঙালি জাতির অংশ নয়? এ প্রশ্নটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, বাঙালি জাতির ‘হাজার বছরের’ ইতিহাস। সেটা হাজার বছরের কেন, আরও প্রাচীনতম সময়েরও বলে দাবি করা যেতে পারে। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে যেমন প্রাচীন যুগের বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে দাবিটা হবে বাঙালি ‘নেশনের’ ক্ষেত্রে নয়ু এই জনপদের ‘মানুষের’ ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য হবে। অভিন্ন ইতিহাস, অভিন্ন আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের স্মৃতিু এসব বৈশিষ্ট্যকে ‘নেশন’ হিসেবে দাবি করার পেছনে বড় লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলেন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নস্ট রেনাঁ। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি- এসব ঐতিহাসিক স্থানে পরিব্রাজক হিসেবে আমরা যখন জড়ো হই, আমরা তখন তার ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক কারুকার্য বা কীর্তিতে বিস্মিত হই। কিন্তু সেসব স্থানের সঙ্গে আমাদের আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের কোনো স্মৃতি আমরা নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাই না। ওই সব জনপদের স্মৃতি আমাদের ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক একসময়ের ধারক, কিন্তু তারা আমাদের সাম্প্রতিকতম জাতি-গঠনের ‘অংশ’ নয়। আমরা তাদের সম্পর্কে জেনেছি মূলত বইয়ের মাধ্যমে বা হয়তো কোনো সাংস্কৃতিক উপকরণের (গান, পালা, মৃৎশিল্প ইত্যাদি) মাধ্যমে। এদেরকে আমরা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান হিসেবে ধরব, কিন্তু বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞানের সূত্র এদের মধ্যে নিহিত নেই। সেই অর্থে শুধু বাঙালি জাতি বলে নয়, কোনো নেশন বা জাতিই ‘প্রাচীন’ নয়, কেননা নেশন অর্থে জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠার কালই শুরু হয়েছে কেবল ‘আধুনিক’ সময়ে। ‘আধুনিক’ বলতে ইউরোপের পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট ও শিল্পবিপ্লব-উত্তর সময়ে। ভারতের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে আরও অনেক পরেু উনিশ শতকের শেষের দিকে বা বিংশ শতকের শুরুর দশকে।
এ জন্যই রামমোহন রায়-দ্বারকানাথ ঠাকুর-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় জাতির বা নেশনের কোনো ‘স্বপ্ন’ দেখতে পাই না। এর কারণ, ‘নেশন’ এই বোধটাই তখন আমাদের মধ্যে জন্মায়নি। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যে বাঙালি নেশন ধারণ করে আছে, তার সূত্রপাত ভারতের চেয়েও আরেকটু পরেু গত শতকের চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে যার বিস্তৃতি। সেই অর্থে আমরা নবীন বা নবীনতম জাতি। এতে আমাদের সংকুচিত হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর কোনো জাতিই প্রাচীন নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চ্যাটার্জি তার নতুন বইতে (যার নাম The Truths and Lies of Nationalism as Narrated by Charvak) ) দেখিয়েছেন যে- ’no one, not even Indians, can claim to be part of an ancient nation’ সব জাতি-রাষ্ট্রই, সব নেশনই আধুনিককালের সৃষ্টিু কেউই প্রাচীন জাতি-রাষ্ট্র বা জাতি নয়। আমরা এই ভূখণ্ডের বাঙালিরা বহুকাল ধরে বহু সাম্রাজ্যের পালাবদলের সাক্ষী হয়ে এই জনপদে বাস করছি এবং সেই অর্থে আমাদের প্রাচীন বা প্রাচীনতম শিকড় রয়ে গেছে এই বাংলার ভূপ্রকৃতির মধ্যে; কিন্তু আমরা ‘প্রাচীন জাতি’ নই। আমরা আধুনিক পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট কালে, আধুনিকতম ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে, সৃষ্ট একটি নবীন জাতি যে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে তার নিজের জন্য একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পেরেছে। এতে আমাদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার কিছু নেই; বরং চলতি সময়ের উপাখ্যান হিসেবে আমাদের জাতীয় জাগরণের ইতিহাস, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সফলতা এবং তার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুু এই ন্যারেটিভের দিকে সমূহ দৃষ্টি দেওয়াই হচ্ছে সঠিক রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাহাত্তরের সংবিধানের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে মূল বক্তব্য সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে আহ্বান জানায়। একটু সবিস্তারে এ নিয়ে বলতে চাই।
কেন উনিশ-বিশ শতকের আগে এই উপমহাদেশের জনগণ কোনো ‘নেশন’ ছিল না, এই দাবি কারও কারও কাছে অসংগত বলে মনে হতে পারে। মৌর্য, গুপ্ত, সুলতানি আমল, মোগল, মারাঠা, নবাবি আমল এরা কি একেকটি সাম্রাজ্য, কীর্তিমান রাজ্য বা ‘ ’great state’-এর উদাহরণ নয়? নিশ্চিতভাবেই এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কেউ কেউ ‘বিশাল সাম্রাজ্য’ও স্থাপন করেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কিন্তু ‘নেশন’ ছিল না। এর কারণ, এই সাম্রাজ্যগুলো এই ভূখণ্ডের ও জনপদের অধিবাসীদের ওপরে শাসন করেছে সামরিক শক্তির জোরে এবং ‘খাজনা আদায়’ করে। এই সাম্রাজ্যগুলো ইতিহাসের নানা পর্বে যেসব রাষ্ট্রের পত্তন করেছিল, সেসব রাষ্ট্র কেবল বহিঃস্থ শক্তি হিসেবে আমাদের ওপরে প্রভুত্ব বা রাজত্ব করেছে। আমাদের ভূখণ্ডের সমাজের কাছে, সমাজের চোখে এসব রাষ্ট্র ছিল external force বহিঃস্থ শক্তি কেবল। এ জন্যই কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, রাজা যায়, রাজা আসে। এই পালাবদলে জনসমাজের কোনো দায় নেইু কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। জাতি নির্মাণ তখনই সফল হয়, যখন কিনা রাষ্ট্র তার শাসনকার্য নির্বাহ করে জনগণের ‘সম্মতিতে’। যখন জনগণ ‘উপর থেকে’ চাপিয়ে দেওয়া শাসনকে ‘নিচে থেকে’ সম্মতি (consent) দিয়ে স্বীকৃতি জানায়। নিচে থেকে সম্মতিদানের প্রক্রিয়ায় যে রাষ্ট্রের জন্ম, সেটিই কেবল সফল নেশন-স্টেটের জন্ম দিতে পারে। নিচে থেকে জেগে ওঠা জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তখন সফল জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়, যেমনটা হয়েছে আধুনিক যুগে উনিশ-বিশ শতক থেকে নানা মহাদেশে, নানা দেশের বেলায়। এককথায়, শাসনকার্য যখন জনগণের ‘সম্মতি’ ছাড়া পরিচালিত হয়ু যাকে ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘ডোমিন্যান্স উইদাউট হেজমনি’ু তখন অধীন জাতির জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় না।
এই ‘সম্মতির’ কথাটিই উচ্চারিত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের ‘সম্মতি’ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর জন্যই সংবিধানের শুরুতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে এই ‘প্রস্তাবনার’ সংযোজন। কেননা, জনগণের ‘সম্মতি’ (consent) ছাড়া সাম্রাজ্য হয়, কিন্তু জাতি-রাষ্ট্র হয় না। সেই অর্থে, জনসম্মতি পায়নি বলে ১৯৪৭-৭১ পর্বে ‘পাকিস্তান’ কোনো জাতি-রাষ্ট্র হতে পারেনি। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক ‘সাম্রাজ্য’ হিসেবে সে থেকে গেছেু অন্তত পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই প্রস্তাবনার মাধ্যমেই বাঙালি জাতির জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের ‘গণপ্রজাতান্ত্রিকতা’ ঘোষিত ও স্বীকৃত হয়। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা বা রুশ বিপ্লবের মতোই এ দেশের জনগণের ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান ঘোষণা হচ্ছে এই ‘প্রস্তাবনা’। যেখানে বলা ছিল স্বাধীনতা, মুক্তি, আদর্শ, মূলনীতিসংবলিত এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের কথা। সেই সংজ্ঞায় আবহমানকাল ধরে চলে আসা ‘হাজার বছরের’ বাঙালি জাতির কথা বলা ছিল না। বলা হয়েছিল নিকট অতীতের সংগ্রামরত পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতির কথা। পুরোটা পড়লে সন্দেহ থাকে না যে, কথা হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বে এই জনপদের অধিবাসীদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এবং তার মাধ্যমে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন :
“আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলু জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাু যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সংগতিরক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;
এতদ্দ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।”
উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটুকু ইঙ্গিত মেলে যে, বাঙালি জাতির ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামই’ এই নতুন জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ ও পরবর্তী ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল। কেউ যদি বলেন যে, এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন আসলে সূচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে বা তারও আগে ১৮৫৭ বা ১৭৫৭ সালে, তা হবে অতিকথন দোষে দুষ্ট। কেননা, ওই প্রস্তাবনাতেই দ্বিতীয় স্তবকে স্পষ্ট করা হয়েছে এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চালিকাশক্তির কথা। এই মুক্তিসংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করেছিল কতগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শু জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯০৫ সালে যারা বঙ্গভঙ্গ করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী) বা যারা বঙ্গভঙ্গ না করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী) এরা কেউই উপরোক্ত চার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল না। ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটাই তখন পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ করা বা না-করার দলের নেতা বা তাত্ত্বিকদের মধ্যে জন্ম হয়নি। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যা ছিল তা হলো বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম ‘সম্প্রদায়ের’ মধ্যে সম্প্রদায়গত স্বার্থের লড়াই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল (হিন্দু) জমিদার বনাম (মুসলিম) কৃষকের শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব, (হিন্দু) মধ্যবিত্ত বনাম (মুসলিম) মধ্যবিত্ত স্তরের অর্থনৈতিক স্বার্থ (ব্যবসা, চাকরি, জমি) সংক্রান্ত বিরোধ। এটা দুই ‘নেশনের’ মধ্যকার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল নাু তা জিন্নাহ সাহেব যাই বলুন না কেন। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি বিভক্তভাবে কোনো জাতি নির্মাণ করতে পারেনি ১৯৪৭-পূর্ব সময়ে। ১৯৪৭-এর পরে যে জাতি নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের বৈরী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তাতে বাঙালি মুসলিমের প্রধান অবদান ছিলু কেননা পূর্ববঙ্গের প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল তারা ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাগের সময়ে। কিন্তু ১৯৪৭-৭১ পর্বে বাঙালির মুসলিমের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অমুসলিম জনগোষ্ঠীও অবজেকটিভ কারণেই সহযোগী ভূমিকা পালন করেছিল। দেশভাগের পরে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিভিন্ন কারণে একটি অংশের দেশত্যাগের পরেও বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণ ছিল পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশ (১৯৬১ সালের সেন্সাস অনুসারে)। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পাকিস্তানের ‘মেজোরিটি’ অংশ পূর্ব বাংলার অধিবাসীু সংখ্যাগরিষ্ঠতার গাণিতিক যুক্তিটি অকাট্য বলে প্রমাণ করা গিয়েছিল কেবল এই জনপদের বাঙালি মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে একত্র করেই। জনসংখ্যার অনুপাতে অধিকতর সম্পদ বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর (কেননা তারা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ)ু এই যুক্তি কেবল তখনই খাটে, যখন ‘বাঙালি’ বলতে আমরা শুধু বাঙালি মুসলিম নয়, বাঙালি হিন্দু ও অপরাপর ধর্মাবলম্বী অংশকেও হিসেবে ধরি। এটাই হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বের ধর্ম-নির্বিশেষে সকল বাঙালি জাতিকে একত্র করার এবং পরস্পরের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করার ‘গাণিতিক ভিত্তি’।
[ক্রমশ]