ইস্তাম্বুল সিম্ফোনি: নাজিম হিকমতের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ :বিনায়ক সেন
“তুমি বলেছিলে :’যদি ওরা তোমাকে মেরে ফেলে আমি বাঁচব না!’ কিন্তু তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা আমার, বাতাসে কালো ধোঁয়ার মতো মুছে যাবে আমার স্মৃতিগুলো। [কেননা] বিংশ শতকে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।” এই লাইন ক’টি যার লেখা তিনিই তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত।

বেট্রল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, জর্জি আমাদু, পাবলো পিকাসো, ইলিয়া এরেনবুর্গ, পল রোবসন, ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর প্রিয় কবির সারিতে ছিল নাজিম হিকমতের নাম। নাজিমের একটি কবিতা এভাবে আশা প্রকাশ করেছে :’আমি মরতে চাই না, কিন্তু যদি মৃত্যু আসে, তবু আমি বেঁচে থাকব তোমাদের মাঝে, আমি বেঁচে থাকব আরাগঁর কবিতায়, তার ঠিক সেই লাইনটিতে যেখানে সে আসন্ন সুখের দিনগুলোর কথা লিখেছে। আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আর রোবসনের গানে’। ১৯৫০ সালে নেরুদা এই বলে তাকে সম্মানিত করেছিলেন :’নাজিমের কবিতায় সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে’।

চিরটা কাল বামপন্থার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু ভিন্ন ধরনের বামপন্থি ছিলেন তিনি। স্তালিনকে ঘিরে ব্যক্তি-পূজার নিন্দা করেছিলেন স্তালিনের জীবদ্দশাতেই খোদ মস্কোতে বসেই। স্তালিনের গোয়েন্দা দফতরের প্রধান বেরিয়ার গুপ্তচরেরা তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকত_ এ কথা ইয়েভতুশেঙ্কো জানিয়েছেন ‘রোমান্টিক কম্যুনিস্ট’ বইয়ের ভূমিকায়। পূর্ব-পশ্চিম সব মহাদেশ থেকে কবিতার উপকরণ আহরণ করেছেন তিনি। তার প্রিয় তিনজন কবি ছিলেন তিন ভিন্ন ভুবনের। তুরস্কের সূফী-সন্ত জালালুদ্দিন রুমি, ফরাসি আধুনিকতার শার্ল বোদলেয়ার, আর রুশ বিপ্লবের ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। যদিও নাজিম বলবেন, এরা আসলে এক ভূগোলেরই অধিবাসী_ তিনজনই তাদের কালের মানবচিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘মানবের মানচিত্র’ নামে পরবর্তীতে নাজিম নিজেই লিখেন একটি মহাকাব্য যা এখনও বাংলায় অনূদিত হতে বাকি।

বামপন্থার আদর্শের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে নাজিমকে তুরস্কের সরকার বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৫৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। পুরো মেয়াদ অবশ্য কারাবাসে থাকতে হয়নি কবিকে। প্রকৃতপক্ষে ১৭ বছর জেলে ছিলেন তিনি। এর আবার ১৩ বছর ছিল বিরতিহীন_ ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫১ সাল অব্দি। জেল পর্ব ছিল তার লেখার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্ব। ১৯৩৮ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সামরিক একাডেমীর ক্যাডেটদের উস্কে দিয়েছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সেসব ক্যাডেট নাকি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল! জ্যাঁ পল সার্ত্রে, পাবলো পিকাসো, ত্রিস্তান জারা তার মুক্তির জন্য বিশ্ব-জনমত গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জনমতের চাপে ছাড়া পেলেন ঠিকই, কিন্তু দেশে থাকতে পারলেন না বাদবাকি জীবন। ১৯৫১ সালেই তাকে যেতে হলো নির্বাসনে। সেই কারণটা জানা গেল ২০০৬ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তুরস্কের ওরহান পামুকের সুবাদে।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে পামুক শুধু একদিনের জন্য ইস্তাম্বুলের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের সম্পাদক হলেন। জার্নালিজমের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু এর আগে কখনও সরাসরি সাংবাদিকতায় আসেননি। সম্পাদক হয়ে রোববারের প্রথম পাতাজুড়ে প্রকাশ করলেন একজনের ছবি। ছবির নিচে লেখা_ ‘থুথু ফেলো এতে’। ছবিটা কবি নাজিম হিকমতের। ১৯৫১ সালে তুরস্কের সরকারি কাগজগুলো এভাবেই নাজিমের ছবি ছাপিয়ে জনগণকে উস্কানি দিয়েছিল ছবিটাকে ঘৃণা করতে। দৃশ্যত নাজিমের অপরাধ ছিল দুটি। প্রথম অপরাধ, ১৯১৫ সালে আরমেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য [যার দায় তুরস্কের সরকার এখনও স্বীকার করেনি] তিনি জনগণের হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় অপরাধ, কুর্দিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। পামুক তার সম্পাদকীয়তে আরও লিখলেন, ‘সেই ১৯৫১ সাল থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিকের সম্পর্কটা [নাজিমের বিরুদ্ধে ৫০ বছর আগে যেমন ছিল] তেমনই রয়ে গেছে।’

নাজিমের কবিতায় রাষ্ট্রের কাছে ঘা-খাওয়া এক শান্ত, গর্বিত এবং লড়াকু মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার কথা পাওয়া যায়। কিন্তু তার কবিতার প্রধান সুর বিষণ্ন। তিনি অপেক্ষা করে থাকেন সেই দিনের মুখ চেয়ে, যেখানে প্রতিটা মানুষ বেড়ে উঠবে ‘বৃক্ষের মতো একা স্বাধীন সত্তা নিয়ে, কিন্তু থাকবে অরণ্যের যৌথ চেতনায়।’ ১৯০২ সালে তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয় নাজিম হিকমতের জন্ম। যেখানে জন্ম সেখানে আর ফেরা হয়নি কোনদিন। বলতেনও_ ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না’। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন জেলে থাকতেই। কিন্তু বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন আরও অনেক বছর। তার জেল পর্বের একটি কবিতা বলেছিল :’আমরা ভেঙে পড়ব না, শত্রুদের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্যে হলেও অতিরিক্ত একটি দিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।’ ১৯৬৩ সালে মস্কোয় এক রোদেলা সকালে বেরিয়েছেন প্রতিদিনের মতো দৈনিক খবরের কাগজ আনতে। বাসার সামনেই চিঠিপত্র রাখার বাক্স। কাগজটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়লেন।

এর বছর দুই আগে, ১৯৬১ সালে নিজের এক সংক্ষিপ্ত জীবনী বলে গিয়েছিলেন তিনি কবিতার আকারে। কন্সতান্তিন সিমোনভ থেকে এডোয়ার্ড হির্শ_ সবাই বলবেন, এটিও নাজিমের বিস্ময়কর রচনাশৈলীর একটি উদাহরণ। পাবলো নেরুদার মতো নাজিম হিকমত কোনো বিশদ আত্মস্মৃতি রেখে যাননি তার ঘটনাবহুল জীবনের ওপর। অবশ্য অন্যরা পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে লিখবেন। যেমন বের হবে ঔপন্যাসিক ওরহান কেমালের ‘নাজিম হিকমতের সাথে জেলে’ বা তার পত্নী পিরাইয়ের সঙ্গে পত্রালাপ। তারপরও নাজিমের কবিতাই হবে তার সবচেয়ে অনুপ্রাণিত জীবনী, এবং একই সঙ্গে তার সময়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্মৃতিকথা।

এ রকম কিছু কবিতা এখানে [যার কয়েকটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি] রুশ ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে নতুনভাবে ভাষান্তর করা হলো বাংলায়।

কাঁটাতারের দেয়াল

বিনায়ক সেন | তারিখ: ০৭-০৯-২০১১

ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা বিষয়ে গোড়া থেকেই বাংলাদেশের জনমনে তিনটি মূল অভিযোগ ক্রিয়াশীল ছিল। প্রথমত, দুই বন্ধুসুলভ প্রতিবেশীর মধ্যে ভৌগোলিক কাঁটাতারের বেড়া থাকা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, দূর ঐতিহাসিক কাল থেকেই যারা প্রতিবেশী, তাদের মধ্যে মানসিক কাঁটাতারও থাকা উচিত নয়। এই কাঁটাতার যে আছে, তার বড় প্রমাণ বাংলাদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতবর্ষে প্রচারিত হতে না দেওয়া। এটা দেওয়া হয় না ওপরের নির্দেশেই। তৃতীয়ত, এর আগে পানি চুক্তি, দক্ষিণ বেরুবাড়ীর বিনিময়ে তিনবিঘা করিডর দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা-ও রক্ষিত হয়নি। এমনকি সাম্প্রতিক কালে সীমান্ত হত্যা বন্ধে রাবার বুলেটের প্রতিশ্রুতিও তারা রক্ষা করেনি।

ফলে এবারও যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি পালন করবে, তার ভরসা কী? ’৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর (র‌্যাটিফাই) করলেও ভারতীয় পার্লামেন্ট অদ্যাবধি তা অনুস্বাক্ষর করেনি। তিনবিঘা করিডরের অধিকারের বদলে তারা দিচ্ছে কেবল ২৪ ঘণ্টা ব্যবহারের সুযোগ। এ রকম উদাহরণ অজস্র।

বাংলাদেশ সরকারের তরফে বলা হচ্ছিল, ট্রানজিট ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত ভারতের চাহিদা বাংলাদেশ মেনে নিলে ভারতীয় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে আমাদের পণ্যের ওপরে আরোপিত অশুল্ক সব বাধা দূর করা হবে, অথবা অভিন্ন নদীতে ন্যায্য পানির হিস্যা পাব। অতীতের অভিজ্ঞতা মনে রাখলে এ ব্যাপারে আশঙ্কা রয়েই যায়। সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিটি ভেস্তে গেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের জনগণ মোটেই বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হয় না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেন্দ্র-রাজ্য সরকার মিলিয়ে জটিলতার অজুহাত তুলে যেভাবে আসন্ন চুক্তিস্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গেল, তাতে কার্যত তাদের সদিচ্ছার অভাবই প্রকাশ পেয়েছে। সেই তুলনায় আমাদের সরকারি পক্ষের উপদেষ্টা ও মন্ত্রীসহ যাঁরা এ ব্যাপারে অতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন, তাঁদের আচরণ বাড়াবাড়িই ঠেকেছে।

কলকাতা বন্দর বাঁচানোর অজুহাতে ফারাক্কা বাঁধ করা হলেও বাঁচেনি কলকাতা বন্দর। অথচ আমাদের অনেক নদ-নদী এই বাঁধের কারণে মরে গেছে এবং আরও নদী মৃতপ্রায়। তিস্তা নদীর উজানে ব্যারাজ করা হয়েছে আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই। এখন শেষ মুহূর্তে কেন্দ্র-রাজ্যের বিরোধের কথা তুলে পানি চুক্তি না হতে পারাটা আমাদের চরমভাবে হতাশ করবে বৈকি। এই হতাশার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতেই হয়, আমরা তড়িঘড়ি করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে তাদের প্রবেশাধিকার দিতে চাই না। এ-সংক্রান্ত বিশদ কারিগরি পর্যালোচনাও করা হয়নি। বাংলাদেশের রপ্তানি ৪০ শতাংশ বাড়ায় ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতার ওপর যথেষ্ট চাপ বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এই অবস্থায় মনমোহন সিংয়ের সফর উপলক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে আমাদের প্রয়োজন হিসাব না করেই, বন্দরগুলোর ধারণক্ষমতা আমলে না নিয়েই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। বরং উপযুক্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের পর মংলা বন্দরকেই ট্রানজিটের নৌ-কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

খেয়াল করা দরকার, সড়ক-রেল ও নৌ-ট্রানজিট আলোচনার মধ্যে ভারত শেষ মুহূর্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে, কিন্তু তিস্তা ও তিনবিঘা করিডরের সুষ্ঠু মীমাংসা থেকে তারা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বর্তমান অবস্থায়, ট্রানজিট থেকেও বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ কম। কারণ, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর অর্থনীতি এখনো নাজুক এবং খারাপ রাস্তার কারণে তাদের দিক থেকে বড় আকারের মালামাল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পরিবহনের সুযোগও কম।

অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। মান নিয়ন্ত্রণের নামে কড়াকড়ির জন্য বাংলাদেশের শুকনো খাদ্য, হিমায়িত খাদ্য এবং তৈরি পোশাক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আমাদের ওষুধ ও চামড়াজাত পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারে নানা বাধা সৃষ্টি করেও রেখেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এটাও দেখতে হবে যে ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেল দেখতে দেওয়া এবং সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে, ভারতের দিক থেকে ভৌগোলিক ও মানসিক কাঁটাতার অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত ট্রানজিট দেওয়া হবে চরম বোকামি।

বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ।