Binayak sees no step to cope with prices

Dhaka, June 10: Terming the budget for the next fiscal realistic renowned economist Dr Binayak Sen felt that though there are concrete measures in the budget for internal revenue mobilization, mobilising external resources would be a major challenge for the government. He also said many new taxes were imposed to achieve the internal revenue target. Talking to The Independent on Friday Dr Sen also noted that the budget lacked emphasis on decentralization of the public expenditure which he felt was crucial to address the challenges of budget implementation.

‘At least 10 per cent of the budget should be devolved to the local government” he said.
Focusing on the revenue mobilization measures, he said, many new taxes have been imposed to achieve the internal revenue target.

“Once upon a time the revenue mobilization capacity of the country was poor but the government has made significant development in this sector,” Dr. Sen told The Independent. He felt that though the role of foreign aid was going down with the passage of time, concessional foreign loans played a crucial role in the economy during periods of uncertainty.

In this connection he mentioned that during the fiscal uncertainty in 2007-08, the then government had managed to get concessional foreign loans from the World Bank which helped it to face the crisis.

“FDI is a major source of external resources but one cannot attract FDI overnight as it requires a long time strategy. The governments needs to concentrate on it,” he added.

He also felt that the budget lacked guidelines to cope with the rising prices of commodities. The government needs to formulate a strategy to absorb the shock of the high prices of food, oil and instability in the foreign exchange sector.

Dr. Sen, however, observed that lack of preparedness resulted in the recent crash in the capital market. In this connection he mentioned that former finance minister late Shah ASMA Kibria had an advisory council which used to advise him on economic management on a regular basis but the present government does not have any such council.

‘The government should use the expertise of the economists on a regular basis through such a council,” he suggested adding that such institutional mechanism helped a lot during crisis periods.

Sen proposed an alternative outlook to expedite project implementation by prioritizing seven to eight sectors identifying a few projects under these sectors instead of the present culture of identifying over 800 projects in the budget and then facing non-implementation over 40 percent of these projects.

He further offered a formula to implement at a faster pace by decentralizing the annual development project and allocate Tk 1 crore performance incentive to the newly-elected union parishads which perform well in revenue generation and project implementation.

He proposed that the government should introduce health insurance at the mass level like in neighbouring India where the government contributes the funding but implements it by private companies.

“The government could solve many of the acute problems like nutrition and family planning if it set cross conditionality for the people who are already served by the government under the social safety net,” he suggested.

Explaining his satisfaction over the fast pace in reducing poverty he said, ‘This is our economic strength. If the global shocks like high commodity and high fuel prices, low external assistance were not there, the GDP growth rate could be over 7 to 8 per cent in the current fiscal year.”

প্রবৃদ্ধি নিয়ে একটি সাম্প্রতিক বিতর্ক

তারিখ: ১০-০৬-২০১১

বিশেষভাবে এ বছরের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাড়তি সংশয় জানানোর কোনো কারণ নেই। এ নিয়ে অবশ্য সিপিডিসহ প্রকাশ্যে সংশয় ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। সবকিছুই বলা হচ্ছে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে। বাস্তবতা হলো, যাঁরা বলছেন প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭, আর যাঁরা বলছেন ৬ দশমিক ৩ বা তারও কম—উভয়ের কাছেই পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত নেই। সে উপাত্ত আসবে আরও কয়েক মাস পর, তখন পূর্ণ অর্থবছরের হিসাব পাওয়া যাবে। প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব বর্তমানের প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে তখন বাড়তেও পারে, একই থাকতে পারে, আবার কমতেও পারে। যেমন, ২০০৯-১০-এর প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার বেশি ছিল। তা ছাড়া কেবল এ বছরেই ৬-এর অধিক প্রবৃদ্ধির হার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা তো নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫-০৬-এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৬, ২০০৬-০৭-এ ৬ দশমিক ৪, এমনকি ২০০৭-০৮-এ বিশ্বমন্দার মুখেও প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২। সে হিসাবে যে বছরে রপ্তানি বেড়েছে ৪১ শতাংশ, আমদানির বড় অংশ হচ্ছে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি, কৃষিতে বোরো ধানে বাম্পার ফলন, আমনও খারাপ হয়নি, ক্ষুদ্র ঋণ ও বাণিজ্য ঋণের সম্প্রসারণশীল প্রবাহ ব্যক্তি খাতে গিয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাক্কলিত হয়ে থাকলে এত সংশয়াপন্ন হওয়ার কোনো কারণ ঘটে কি? যা-ই হোক, আবারও বলছি, প্রবৃদ্ধির হার প্রসঙ্গে চূড়ান্ত মীমাংসা করার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমরা বৃক্ষকে দেখতে চেয়ে অরণ্যকে যেন দেখতে ভুলে না যাই। আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের অর্থনীতিতে, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি খাতে গত এক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, বরং তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে ‘রাজনীতি হচ্ছে’ (যা কেউ কেউ বলছেন) এ রকম অভিযোগ তাই ব্যক্ত করা আমার বিচারে সংগত নয়। এতে করে বিবিএসকেও খাটো করা হয়। অথচ ভারতে সিএসও বা পাকিস্তানের এফবিএসের তুলনায় বিবিএস কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই, যাঁরাই ভারতের বা পাকিস্তানের স্টেট জিডিপি বা প্রভিন্সিয়াল জিডিপি উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা জানেন। সর্বোপরি পূর্ববর্তী বছরগুলোয় (বিশেষত সুতীব্র বিশ্বমন্দার ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০-এ) অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল শ্লথতর, অর্থনীতিতে তখন অব্যবহূত ক্যাপাসিটির সৃষ্টি হয়েছিল, এ বছরে এসে তা ব্যবহূত হয়েছে (যে জন্য কাঁচামাল আমদানিও বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে ২০১০-১১তে) সে কারণেও প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে কেন যেখানে বিনিয়োগের অনুপাত তেমন একটা বাড়েনি, সেটা শুধু এ বছরের জন্যই ‘বিশেষভাবে’ বাধা হতে যাবে কেন? বিনিয়োগের অনুপাত তো ২০০২-০৩ সাল থেকেই ২৪ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। সুতরাং এই ধাঁধার রহস্য উন্মোচন করতে গেলে কার্যত ২০০২-০৩ সাল থেকেই প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যে উপাত্ত আমরা পাই, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে এবং সম্যক আলোচনা করতে হবে। শুধু সংশয় প্রকাশ করে ছেড়ে দিলে চলবে না। তা ছাড়া বিনিয়োগের হিসাবও অবমূল্যায়িত হতে পারে, কেননা, এক দশক আগের তুলনায় এখন বিনিয়োগের সিংহভাগ হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এবং এই খাতে বিনিয়োগে গত এক দশকে যে পরিমাণগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে, তা এখনো পরিসংখ্যানে যথাযথভাবে ধরা পড়ছে না।
বিনিয়োগ মোটামুটি একই পর্যায়ে থাকার পরও প্রবৃদ্ধি কেন ২০০২-০৩ সালের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ২০১০-১১ সালের ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে, তার অনেকগুলো ব্যাখ্যা হতে পারে। যদি আমরা হ্যারড-ডোমার সরলীকৃত দুনিয়ার মধ্যেই থাকি (যেখানে সঞ্চয় ও ভৌত বিনিয়োগই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালক), সেই নিরিখেও বলা যেতে পারে যে বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা ২০০২-২০১১ কালপর্বে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়ে থাকবে। বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার প্রধান উৎস ছিল দুটি। প্রথমত, গ্রাম থেকে শহরে দ্রুত হারে স্থানান্তরিত হয়েছে শ্রমশক্তি (২০০১ সালের ২৫ শতাংশের তুলনায় বর্তমানে নগর জনসংখ্যা ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে)। এই রি-লোকেশন অ্যাফেক্টের কারণে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃ িদ্ধ পাওয়ার কথা। গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয়বৈষম্য বৃদ্ধির পেছনে একটা বড় কারণ হলো, গ্রামের তুলনায় শহরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি। শুধু মাত্রায় বেশি নয়, আমার অনুমান, শহরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা গ্রামের তুলনায় আরও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। না হলে এক উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী গত এক দশকে শহরে পাড়ি জমানো সত্ত্বেও নগর-দারিদ্র্য দ্রুত হারে কমে যেত না। কেউ কেউ বলতে পারেন যে গ্রাম থেকে যারা শহরে জড়ো হয়েছে, তারা অধিকাংশই এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, সুতরাং এখানে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে সেই ধারণা কতটা যুক্তিযুক্ত? এ পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শহরে কর্মকাণ্ডে আগের চেয়ে অনেক গতিশীলতা এসেছে, আয় বেড়েছে এবং লক্ষণীয়ভাবে দারিদ্র্য কমেছে। নগর অর্থনীতির ‘আকর্ষণীয় ক্ষমতা’ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো।
দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ অর্থনীতির ভেতরেও বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। আরও উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সেটা যেমন ঘটেছে কৃষি অর্থনীতির ভেতরে (যেমন, বাণিজ্যিক কৃষির বিস্তারে), তেমনি ঘটেছে গ্রামীণ অকৃষি অর্থনীতির ভেতরেও। এই শেষোক্ত ধারার বড় প্রমাণ হচ্ছে, গ্রামীণ অকৃষি অর্থনীতিতে পুঁজির চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। এর পরোক্ষ সমর্থন মেলে মাইক্রো-ফাইন্যান্স খাতে পুঁজির বর্ধিত জোগানের জন্য একই ব্যক্তির নানা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ (মাল্টিপল লোন) নেওয়ার প্রবণতায়। এ ধরনের ঋণের ৮০ শতাংশই নেওয়া হয়েছে আরও বেশি করে পুঁজি সংগ্রহের জন্য। তার মানে, গ্রামে মাথাপিছু পুঁজির পরিমাণ বেড়েছে এবং তা বেড়েছে আরও বেশি করে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যাওয়ার কারণে। গ্রামে এখন মজুরি-শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে এবং এক হিসাবে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত মজুরি-শ্রমিকের সংখ্যা গ্রামের মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। পারিবারিক শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে মজুরি-শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কারণে গ্রামের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। এতে করে প্রবৃদ্ধিও বাড়ার কথা বিনিয়োগের সামগ্রিক অনুপাত একরূপ থাকা সত্ত্বেও।
২০০২-২০১১ কালপর্বে প্রবৃদ্ধির উত্তরোত্তর বাড়ার পেছনে শ্রমশক্তির বর্ধিত নিয়োজনও অনেকাংশে কাজ করে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। যেসব নারী আগে ‘ঘর-গৃহস্থালির’ অর্থনীতিতে আটকে থাকতেন, তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন সরাসরি শ্রমের বাজারে অংশ নিচ্ছেন। এক দশক আগেও শ্রমের বাজারে নারীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ১৫-২০ শতাংশ, এ হার এখন ৩০-৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কৃষিতে ও অকৃষিতে, ক্ষুদ্র ঋণের (ও কিছুটা বাণিজ্যিক ঋণের) সম্প্রসারণে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে এটা হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশই শ্রমঘন কাজে নিয়োজিত, ফলে বিনিয়োগের অনুপাত একই থাকলেও শুধু নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের কারণেই প্রবৃদ্ধি বেশ কিছুটা বাড়ার কথা। এ ধারা আরও বেগবান করা গেলে (পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় এ হার ৭০-৮০ শতাংশ) এ দেশের প্রবৃদ্ধির হার ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজি সঞ্চয়ের বর্ধমান প্রবণতা, শ্রমবাজারে নারীর উত্তরোত্তর অংশগ্রহণ এসব প্রবৃদ্ধির ‘সরবরাহগত’ দিককে নির্দেশ করে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়ার ক্ষেত্রে ‘চাহিদাগত’ দিকও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আলোচনায় প্রায়ই আসে না সেটা হলো, এক দশক ধরে দ্রুত হারে দারিদ্র্য কমে যাওয়ার ধারা এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হারকেও বাড়িয়ে থাকবে। গোড়ার পর্বের দারিদ্র্য অবস্থা নিরসনের সঙ্গে পরবর্তী প্রবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে, সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে এটা সুস্পষ্ট। আমাদের দেশে দুই দশক ধরেই দারিদ্র্য কমছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় আমলেই কমেছে। কিন্তু দারিদ্র্য বিশেষভাবে কমেছে ২০০০-২০১০ কালপর্বে (সেটা ২০০০, ২০০৫, ২০১০ সালের দারিদ্র্য-উপাত্ত বিচার করলেই দেখা যায়)। দারিদ্র্য অব্যাহতভাবে কমার অর্থ গ্রামীণ বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্রয়ক্ষমতা এসেছে। এই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে কৃষি, কৃষিজাত শিল্প, অকৃষি পণ্য ও সেবা খাতগুলোর সম্প্রসারণ ঘটেছে সুদূর গ্রামাঞ্চলেও। ফলে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় উত্তরোত্তর বর্ধমান ‘অভ্যন্তরীণ ভোগ’ (ডমেস্টিক কনসাম্পশন) প্রবৃদ্ধির এক নতুন নিয়ামকে পরিণত হচ্ছে। এ কথা এক দশক আগেও অতটা খাটত না। অর্থাৎ এই নিরিখেও আমরা দেখছি যে বিনিয়োগের অনুপাত একই থাকলেও বর্ধিত ভোগের কারণেও প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে রপ্তানি ও প্রবাসী-আয়ের পাশাপাশি ‘স্থানীয় বাজার’-এর সম্প্রসারণ আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
কিন্তু আমরা কেবল হ্যারড-ডোমার দুনিয়াতেই আবদ্ধ নেই এবং শুধু সরলীকৃত হ্যারড-ডোমার সমীকরণের নিরিখেই প্রবৃদ্ধিকে বিচার করলে চলবে কেন। ভৌত বিনিয়োগ ছাড়াও প্রবৃদ্ধির আরও দুটো প্রধান নিয়ামক হলো মানব-পুঁজির (হিউম্যান ক্যাপিটাল) গঠন ও প্রযুক্তিগত বিকাশ। মানব-পুঁজি গঠনে (শিক্ষার বিস্তারে যেমন) ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যে বিনিয়োগ হয়েছে, তার সুফল আমাদের এখন পেতে শুরু করার কথা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেসরকারি খাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। দুই দশক আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার যেখানে ছিল ৪০-৫০ শতাংশ, এখন তা ৭০-৮০ শতাংশ। গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের পাসের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও গুণগত মানকে আগের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই শ্রমশক্তির শিক্ষাগত মাত্রা বেড়েছে, আধাদক্ষ ও দক্ষ শ্রমশক্তির অনুপাত বেড়েছে, যার শুভ প্রভাব পড়তে বাধ্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সেই সূত্রে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির ওপরও।
ধীরলয়ে হলেও প্রযুক্তিগত উন্নতির বিশিষ্ট অবদান (যা ধরা পড়ে ‘টোটাল ফ্যাক্টর প্রডাক্টিভিটির পরিসংখ্যানে) বিভিন্ন খাতওয়ারি প্রবৃদ্ধির মধ্যে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। কৃষকেরা উন্নত বীজ ব্যবহার করছেন (শুধু উফশী ধান নয়, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও); শিল্প ও নির্মাণ খাতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে; সুদূর গ্রামেও মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে তথা বিনিয়োগ সহজতর হচ্ছে। সুতরাং প্রবৃদ্ধির হার বিচারের ক্ষেত্রে একপেশেভাবে শুধু বিনিয়োগের অনুপাতের দিকে তাকানো অসংগত।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করছে। এর প্রস্তুতি কয়েক বছর ধরেই (২০০৪-০৫ সালের পর থেকেই) চলছিল। এই কৃতিত্ব যেমন বিএনপির, তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বর্তমান সরকারের অংশেও কিছুটা বর্তায়। প্রবৃদ্ধির হার বেগবান হলে দারিদ্র্য আরও দ্রুত হারে কমে আসবে, এ নিয়েও বিতর্ক নেই। কিন্তু যে প্রশ্ন এখানে তোলা যায় সেটা হলো, প্রবৃদ্ধির চরিত্র নিয়ে। যেকোনো প্রবৃদ্ধিই সমান হারে দারিদ্র্য কমায় না। না হলে গ্রোথ কমিশনের মতো এত র্যাডিক্যাল নয় এমন কমিশনও ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ আর ‘কনভেনশনাল গ্রোথ’-এর মধ্যে পার্থক্য টানত না। বাংলাদেশের জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধির কৌশল রচনায় একটা বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করছে কি না। আমাদের আয় বাড়ছে, কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে কি না পরিবেশদূষণ, পাবলিক স্পেসের (যেমন—নদী, জলাশয়, পার্ক, উন্মুক্ত ময়দান) ক্রমবিলুপ্তি এবং তীব্র যানজটের কারণে। তাই আমাদের জন্য শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয়, আরও জানা প্রয়োজন ‘গ্রিন জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি কতটা হচ্ছে। পরিবেশ-বিধ্বংসী প্রবৃদ্ধি কেবল পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর তা নয়, অর্থনৈতিক সাম্যের জন্যও ক্ষতিকর। পরিবেশ ধ্বংস করে যাঁরা নতুন প্রবৃদ্ধির জন্ম দিচ্ছেন (তুরাগ নদ বা বুড়িগঙ্গা ভরাট করে নির্মাণ প্রকল্প করলে তা এক হিসেবে ‘নতুন প্রবৃদ্ধি’, অন্য হিসেবে পরিবেশের সর্বনাশ), এসব বিনিয়োগকারীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সুশাসনের দুর্বলতার জন্য। এসব বিনিয়োগকারীর মুনাফার একটা বড় অংশ কর ফাঁকি দেওয়া অর্থ, যা সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। এসব বিনিয়োগকারীর ওপর পরিবেশের ক্ষতি করার জন্য নিদেনপক্ষে বাড়তি কর (এনভায়রনমেন্টাল ট্যাক্স) আরোপ করা উচিত। কেননা, পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির ভুক্তভোগী সবাই—ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব-নির্বিশেষে। পরিবেশ-সহনশীল বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রয়োজন। বর্তমান বাজেটের ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করব ‘জনগণতান্ত্রিক’ সমন্বিত পাবলিক র্যাপিড ও মাস ট্রানজিটের গুরুত্বের কথা। আমাদের বিদ্যমান রেলপথ, জলপথ ও সড়কপথ (যা আছে তাকে ব্যবহার করে বা এর কিছুটা পরিমার্জনা করে) আমাদের নতুন করে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। যেসব ভাবনা ইতিমধ্যেই পরিবহন-অর্থনীতিবিদেরা করেছেন বৃহৎ ও মাঝারি আকারের শহরগুলোর জন্য, তা এখনই বাস্তবায়নে নিয়ে আসতে হবে। এদিকে বাজেট কিছুটা হলেও দৃষ্টি দেবে, এ আশা করছি।
ড. বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

নাজিম হিকমতের কবিতা: পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব, ঝরাপাতা

তারিখ: ০৩-০৬-২০১১

পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব
তুমি মাকড়সার মতো, ভাই আমার,
অন্ধকারের আড়ালে বেঁচে আছো
ভীতু মাকড়সার মতো।
তুমি চড়ুইয়ের মতো, ভাই আমার,
ছোট্ট ডানা মেলে এদিক-ওদিক
অস্থির চড়ুইয়ের মতো।
তুমি শামুকের মতো, ভাই আমার,
নিজের মধ্যে তৃপ্ত
গুটানো শামুকের মতো।
তুমি সব সময় এক অজানা আশঙ্কায়, ভাই আমার,
যেন কোনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে
তোমার নিত্য বসবাস।

তুমি একা নও এমন, তোমার মতন যারা
সংখ্যায় তারা পাঁচ-দশ নয়—লাখ লাখ
দুঃখজনক, কিন্তু সত্যি।
তুমি ভেড়ার মতো, ভাই আমার,
কেউ তোমাকে লাঠি দেখালে
দ্রুত দলের মধ্যে ভিড়ে যাও
আর যখন ছুটতে থাকো কসাইখানার দিকে
তখনো মুখে বেশ একটা গর্বের ভাব।
এ জন্যেই বলছি, তুমি হলে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব
মাছেদের চেয়েও অদ্ভুত
যারা জলের বাইরের সমুদ্রকে দেখতে পায় না।
জগ জোড়া যে-অত্যাচার চলছে
তা আসলে হচ্ছে তোমারই কারণে।
আমরা যদি এখনো অভুক্ত থাকি, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ি,
রক্তে ভেসে যাই,
আমাদের যদি এরপরও আঙুলের মতো পিষে-দলে
ওরা মদিরা বানায়
তাহলে এর জন্যে দায়ী হচ্ছো
তুমি—
এ কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে ঠিকই,
কিন্তু এসবের অধিকাংশ দায়, ভাই আমার,
কেবল তোমার একার।

ঝরাপাতা
আমি পাতা ঝরার কথা পেয়েছি পঞ্চাশ হাজার কবিতায়
উপন্যাসে লেখায়
আমি পাতা ঝরার ছবি দেখেছি পঞ্চাশ হাজার সিনেমার দৃশ্যে
পাতা ঝরতেও দেখেছি পঞ্চাশ হাজার বার
এলোমেলো উড়তে ফিরতে পচে যেতে
আমার পায়ের তলায় করতলে আঙুলে মচমচ শব্দ তুলে
পঞ্চাশ হাজার বার ওদের মৃত্যু আমাকে দেখতে হয়েছে
তার পরও পাতা ঝরার দৃশ্যে আমি আলোড়িত না হয়ে পারি না
বিশেষ করে ওরা যখন ঝরতে থাকে বুলেভার্দে
বিশেষ করে যখন ঝরতে থাকে চেস্টনাট গাছের পাতারা
তার ওপর যদি শিশুরা ভিড় জমায় চারপাশে
তার ওপর যদি রোদ ওঠে সেদিন
কোনো বন্ধুর ভালো খবর পাই
আর সেদিন যদি বুকের অসুখটা দেখা না দ্যায়
যদি বুঝতে পারি আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে যায়নি
বিশেষ করে আমার চারপাশের মানুষকে ভালো থাকতে দেখি
ঝরা পাতার দৃশ্যে আমি আলোড়িত না হয়ে পারি না
বিশেষ করে ওরা যখন ঝরে পড়তে থাকে বুলেভার্দে
বিশেষ করে যখন ঝরতে থাকে
চেস্টনাট গাছের পাতারা
অনুবাদ: বিনায়ক সেন

নাজিম হিকমতের পৃথিবী

বিনায়ক সেন | তারিখ: ০৩-০৬-২০১১
আরো দেখুন: নাজিম হিকমতের কবিতা

নির্বাসিত নাজিম
‘নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়’ এমন একটি লাইন আমাদের যৌবনের আকাশে তারকাখচিত হয়ে গিয়েছিল। অনুবাদক ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫২ সালে বেরুনো বইয়ের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, যদিও বেশিরভাগ কবিতাই ইংরেজি পাঠ থেকে নেওয়া, কিছু কিছু কবিতা ফরাসি থেকেও অনূদিত। ফরাসি থেকে অনুবাদের কাজে তিনি গীতা মুখোপাধ্যায় ও (পরবর্তীতে নিম্নবর্গের ইতিহাস-খ্যাত) রণজিৎ গুহের সাহায্য নিয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিচারণায় পড়েছি, (১৯৫১ কি ’৫২ সালে কলকাতায়, জানি না কী করে, আমাদের বন্ধু ডেভিড কোহেনের হাতে এসেছিল নাজিম হিকমতের একগুচ্ছ কবিতার ইংরেজি তর্জমা। ইংরেজি খুব উচ্চাঙ্গের নয়। তবু পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন জানা যাচ্ছে ইংরেজিতে নাজিম হিকমতের কবিতার প্রথম সংকলন বের হয় কলকাতা থেকেই—পরিচয় প্রকাশনী থেকে ১৯৫২ সালে। ইংরেজিতে এর আগে নাজিম হিকমতের কোনো কাব্য-সংকলন প্রকাশ পায়নি। কেন এ রকম একটি সংকলন আর সব জায়গা থাকতে কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতে হবে সেটাও খানিকটা রহস্যজনক। এর পেছনের কার্য-কারণ সূত্র এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।

গত শতকে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল ম্যাকার্থিবাদের দাপট। সর্বত্র কমিউনিজমের চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সিনেটর ম্যাকার্থি—‘আন-আমেরিকান’ কর্মকাণ্ডের জন্য হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন একের পর এক কবি-নাট্যকার-শিল্পী-বিজ্ঞানীরা। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও বাদ যাচ্ছেন না। এদের মধ্যে ছিলেন লেখক আর্থার মিলার, এলিয়া কাজান, লিলিয়ান হেলম্যান, হাওয়ার্ড ফাস্ট, ডরোথি পার্কার, ইরউইন শ, ল্যাংস্টন হিউজ, সাংবাদিক উইলিয়াম শীরার, গায়ক পিট সিগার, নোবেল-জয়ী বিজ্ঞানী লাইনাস পাওলিং প্রমুখ। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মুক্তচিন্তার নামে দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এসবের মধ্য দিয়ে কার্যত তাঁরা পরিণত হয়েছেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমর্থকে। এ রকম বৈরী পরিবেশে কমিউনিস্ট কবি নাজিম হিকমতের অনুবাদ আমেরিকায় প্রকাশ করা সহজ ছিল না। নাজিমের অনুবাদ যাঁরা সেদিন করেছিলেন (তাঁদের নাম যথাক্রমে নিলুফার ও রোসেট) তাঁদেরকেও ছদ্মনামের আশ্রয় নিতে হয়। ফলে অনুবাদক হিসেবে ছাপা হয় আলি ইউনূসের নাম। ‘আলি’ খুবই প্রচলিত নাম, আর ‘ইউনূস’ এসেছিল ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ইউনূস এমরে-র থেকে। অনুবাদকেরা জানতেন, দরবেশ কবিকুলের মধ্যে রুমি ছাড়া এমরের কবিতা নাজিমের খুব প্রিয় ছিল। যা হোক, অনুবাদ তো হলো, কিন্তু ছাপানো নিয়ে সমস্যা গেল না। এই সময়ে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভারত থেকে আসা কিছু শিক্ষার্থী’ (ওদের নাম এখনো জানা যায়নি এবং ওদের অধিকাংশ বাঙালি হলে বিস্ময়ের কিছু নেই) নাজিমের এই অনুবাদ হাতে পান। পড়ে তাঁরা এতই বিমোহিত হয়ে পড়েন যে, এই মহার্ঘ বস্তু দ্রুত জনসমক্ষে আনার জন্য পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। এভাবেই ‘পরিচয়’ প্রকাশনী থেকে (হয়তো ডেভিড কোহেনের হাত ঘুরেই) ১৯৫২ সালে ৩৫টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে ‘নাজিম হিকমতের নির্বাচিত কবিতা’র প্রথম সংকলন।

যেহেতু নাজিম আজীবন কবিতা লিখেছেন তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে, তাঁর কবিতার অনুবাদ কিছুটা দেরিতে হলেও পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে রুশ ভাষায়, তার পরে ফরাসিতে এবং গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি হারে ইংরেজিতে। তাঁর কবিতার পাঠকের সংখ্যা ইংরেজি-জানা বৃত্তে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, তাঁর স্বদেশীয় মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমীর মতো নাজিম হিকমতও আধুনিক ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যের ভুবনে এখন একটি অতি প্রিয় নাম। অন্তত দশটি কাব্য-সংকলন, একাধিক জীবনী গ্রন্থ, স্মৃতিচারণা ও চিঠিপত্র নিয়ে নাজিমিয়ানা এখন ইংরেজিতে অনুবাদের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়েছে। নিজের কবিতার অনুবাদ নিয়ে ১৯৬১ সালের দিকে লেখা একটি কবিতায় নাজিম লিখেছিলেন, ‘তিরিশটি-চল্লিশটি ভাষায় আমার লেখা প্রকাশিত, কিন্তু আমার তুরস্কে, আমার তুর্কি ভাষায় আমার লেখা নিষিদ্ধ।’ ১৯৫১ সালের ২৫ জুলাই তুরস্কের সরকার তাঁর নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে মৃত্যুর ৪৬ বছর পর সেই নাগরিকত্ব ফিরে পান তিনি। এখন ইস্তাম্বুলের এশিয়া অংশে চালু হয়েছে নাজিমের প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে ‘পিরাইয়ে কাফ্যে’, খোলা হয়েছে নাজিম হিকমত আকাদেমি, সেখানে প্রতিদিন ভিড় করে সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষ।

এক নিঃসঙ্গ বিপ্লবী
১৯০২ সালে তাঁর জন্ম তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয়। যেখানে জন্ম সেখানে কখনো আর ফিরে যাননি। বলতেন, ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না আমি।’ তারপরও ফিরে গিয়েছিলেন মস্কোতে—একবার নয়, বার তিনেক। প্রথমবার ১৯২১ সালে—মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। দ্বিতীয়বার ১৯২৮ সালে—তুরস্কের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে। তৃতীয়বার ১৯৫১ সালে—জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৬৩ সালে মস্কোতেই তাঁর মৃত্যু। ঘর থেকে প্রতিদিনের মতো বের হয়েছেন সকালের পত্রিকা আনতে, পত্রিকাটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়েন আকস্মিকভাবে। অনেক দিনের বুকের অসুখ নিয়ে এর বছর কয়েক আগেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা—‘এঞ্জাইনা প্যাক্টোরিস’। ১৯২১ সালে যখন মস্কোয় পড়তে যান তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর। ১৪ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘কেউ কেউ জানে উদ্ভিদ জগতের রহস্য, কেউ কেউ জানে মাছেদের ভুবন, কেউ বা জানে তারাদের নাম, আর আমি জানি সব ধরনের নিঃসঙ্গতার ভাষা।’

রেজিস দেব্রে এক সময়ে চে গুয়েভারার বলিভিয়ার অভিযানের সঙ্গী ছিলেন (এবং পরবর্তীতে হয়েছিলেন ফ্রান্সের সোশ্যালিস্ত প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর উপদেষ্টা)। তিনি নাজিমের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্যারিসে। বিশ্ব জনমতের চাপে তুরস্কের জেল থেকে তিনি সবে ছাড়া পেয়েছেন। ‘কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন কীভাবে’—এই প্রশ্নের উত্তরে নাজিম বলেছিলেন: ‘পার্টি করে মানুষ সাধারণত দুই কারণে। এক, তারা আসে মেহনতি শ্রেণীর থেকে। মেহনতি শ্রেণীর পার্টিতে খেটে-খাওয়া মানুষেরা আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। আমার পরিবার ছিল আমলাদের পরিবার (নাজিমের নানা ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর “পাশা”—সুলতানদের দরবারে এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী)। দুই, আর পার্টিতে যারা আসে, তারা আসে বুদ্ধির তাড়নায়—বই পড়ে, চিন্তা করে, মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। কিন্তু আমি এসেছিলাম হূদয়ের টানে। ১৯ বছর বয়সে যখন মস্কোয় যাই আমার একমাত্র ইচ্ছে ছিল লেনিনের সঙ্গে দেখা করব, দেখা করে বলা, “আপনার সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি আমাকে বলে দিন। আপনি কী করে বিপ্লব সমাধা করলেন তার রহস্য আমাকে বলুন।” আসলে আমার ইচ্ছে ছিল, লেনিনের কাছ থেকে এরকম কোনো গোপন চাবিকাঠি পকেটে নিয়ে আমি নিজ দেশ তুরস্কে ফিরে যাব। তারপর “বিপ্লব করে” গরিবী ঘুচাব দেশের মানুষের।’ লেনিনের সঙ্গে অবশ্য সরাসরি কখনো দেখা হয়নি নাজিমের। কিন্তু ১৯২৪ সালে লেনিন যখন মারা গেলেন তখন সেই অগণন শোক মিছিলের মধ্যে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন।

মস্কোয় থাকতেই কমিনটার্নের সংস্পর্শে গড়ে ওঠা তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নাজিমও জড়িয়ে পড়েন। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মুস্তফা সুফির মৃত্যু ঘটে কিছুটা রহস্যজনকভাবে দেশে ফেরার পথে সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়ে। লেনিনের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নাজিম ফিরে যান তুরস্কে। এরই মধ্যে তুরস্কে খেলাফতের অবসান হয়েছে, রিপাবলিক ঘোষিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মোস্তফা কামাল (পরে আতাতুর্ক অভিধা পেয়েছেন)। কমিউনিস্টদের সঙ্গে প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি নিয়ে চলছিল আতাতুর্কের রিপাবলিকান পার্টি। কিন্তু সে অবস্থা অল্প দিনেই বদলে যায়। নিষিদ্ধ হয় ‘প্রগ্রেসিভ রিপাবলিকান পার্টি’ (প্রকাশ্য সংগঠন ছিল এটি বামপন্থীদের)। কমিউনিস্ট পার্টি চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। তুরস্কে ফিরে গিয়ে নাজিম প্রকাশ্যে কাজ করেছেন প্রথমে বিভিন্ন পত্রিকায়, উদ্দেশ্য—লেখালেখি। আবার গোপনে যুক্ত থেকেছেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে—ইস্তাম্বুলে পার্টির গোপন কংগ্রেসেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে গোপন ইশতেহার বিলির দায়ে তুরস্কের আদালত তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আত্মগোপনরত অবস্থায়। নাজিমকে আবারও দেশ ছেড়ে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দিয়ে চলে আসতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে প্রবাসে থাকাকালীনই সাধারণ ক্ষমতায় রাজবন্দীদের মামলা তুলে নেওয়া হলে এর আগেকার ১৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করা হয় নাজিমের ওপর থেকে। ১৯২৮ সালে নাজিম তুরস্কে ঢুকতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন, তিন মাস জেল খেটে আবার বেরিয়ে আসেন। এর পর থেকে তুরস্কেই ছিলেন তিনি কিন্তু বিরতিহীনভাবে ‘আজ গ্রেপ্তার, কাল ছাড়া আবার পরশু গ্রেপ্তার’ এরকম চক্রের মধ্য দিয়ে। এ সময়ের আতাতুর্ক শাসনের লক্ষণীয় দিক ছিল বামপন্থীদের কোণঠাসা করার পাশাপাশি আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা। য়ুরোপের অনেক দেশের আগেই ১৯৩০ সালে তুরস্কের মহিলারা পায় ভোটাধিকার, স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগও পায় তারা। শরিয়াপন্থীদের সঙ্গে রিপাবলিকপন্থীদের রাজনৈতিক লড়াইও চলতে থাকে। কিন্তু নাজিমকে ক্রমাগত বিব্রত হতে হয় একের পর এক মামলায়। নাজিম নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন কি-না সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয় ছিল না। গোপন বনাম প্রকাশ্যে কাজ নিয়ে পার্টি মধ্যে মতদ্বৈততা ছিল। নাজিম ছিলেন প্রকাশ্যে কাজের পক্ষে এবং এ কারণে ১৯৩২ সালে পার্টি থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু নাজিম নিজেই ছিলেন মার্কসবাদী পার্টির জীবন্ত প্রতীক। ফলে পার্টির সদস্যপদ হারালেও তাঁর বিরুদ্ধে হয়রানি মামলা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এখন জানা যাচ্ছে যে, স্বয়ং আতাতুর্ক এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুক্রু কায়া নাজিমের কবিতা গোপনে ভালোবাসতেন বলে বামপন্থী সত্ত্বেও তাঁকে দীর্ঘদিনের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখতে চায়নি তুরস্কের সরকার। ছোট ছোট মামলায় জড়িয়ে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত রাখাই ছিল দমন-পীড়নের উদ্দেশ্য। একটি উদাহরণ দিলে রাষ্ট্রের এই কূটকৌশলটি পরিষ্কার হবে।

১৯৩১ সালের ৬ মে নাজিম গ্রেপ্তার হন লেখার জন্য; ছাড়া পান ওই বছরের ১০ মে। ১৯৩৩ সালে ১৮ মার্চ আবার গ্রেপ্তার হন লেখার কারণে। এবার রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলী সরকারকে উৎখাত করার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দাবি করে। ওই বছরের ২৯ জুলাই ছয় মাসের কারাদণ্ড পান। ওই একই বছরের ২৭ আগস্ট তাঁকে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় ব্যঙ্গ কবিতা লেখার জন্য। ১৯৩৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তাঁকে দেওয়া হয় আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড সম্পূর্ণ অন্য একটি মামলায়, যদিও সেটাও লেখারই জন্য। ১৯৩৪ সালের ৪ আগস্ট রিপবালিকের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে নাজিম আবারও সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পান। এসব ডামাডোলের মধ্যেই আবার তাঁর কয়েকটি কবিতা সরকারি অনুমোদনে কলেজের পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়। ইতিমধ্যে স্পেনে শুরু হয়ে গেছে ফ্রাঙ্কোবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন। এই অবস্থায় ১৯৩৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নাজিম আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামিনে ছাড়া পান। এসবের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কবিতা ছড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সীমানার বাইরে। সুররিয়ালিস্তরা প্যারিসে তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেছে এরই মধ্যে। কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি তাঁর কবিতার ওপরে গানের রেকর্ড বের করেছে। নাজিম নিজে বিভিন্ন নাটক লিখে মঞ্চস্থ করাচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে লিখছেন চিত্রনাট্য এমনকি ১৯৩৭ সালে নিজেই নির্মাণ করেছেন এক শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র ‘সূর্যের দিকে’ (এর আগে ইস্তাম্বুল সিম্ফনি ও বুর্মা সিম্ফনি নামে আরও দুটি তথ্যচিত্রও তাঁর পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে।) রাশিয়ায় তখন চলছে কুখ্যাত মস্কো শো-ট্রায়াল—লেনিনের সহকর্মী বুখারিন রাদেক, জিনোভিয়েভ কামেনেভদের বিরুদ্ধে। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে প্রায় একইভাবে সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য কারণ দেখিয়ে মায়াকোভস্কি-মেইয়ের হোল্ডের সহকর্মী নাজিমের বিরুদ্ধে তুরস্কেও চলছে প্রহসন-বিচার। ১৯৩৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেষবারের মতো গ্রেপ্তার হলেন নাজিম হিকমত। এবার তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে ২৮ বছর চার মাসের দীর্ঘ কারাদণ্ড। হয়তো আতাতুর্ক বেঁচে থাকলে এমনটা হতো না। কিন্তু আতাতুর্ক মারা যান ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর। ফলে ওই দণ্ডের আর রদবদল হয়নি।

নাজিমের মতো আর কোনো কবিকে বিংশ শতাব্দীতে এতো ক্ষান্তিহীন ভাবে আইনি মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয়নি, এতবার গ্রেপ্তারও করা হয়নি, সম্ভবত আর কাউকে। যদি সব কারাদণ্ডের আদেশ বহাল থাকত— ইলিয়া এরেনবুর্গ হিসাব করে বের করেছেন—তাহলে তাঁকে জেলের মধ্যে কাটাতে হতো এক দুটো বছর নয়, এক দুই দশকও নয়—মোট ৫৬ বছর। এতটাই বিপজ্জনক ছিলেন ‘সিস্টেমের জন্য’ নীলচক্ষু সোনালী চুলের কবি নাজিম হিকমত!

মায়াকোভস্কি, বোদলেয়ার ও রুমি
কবিতায় যে নন্দনতত্ত্ব নাজিম প্রবর্তন করেছিলেন তার জন্য তিনি অকুণ্ঠ ঋণ-স্বীকার করেছেন তিনজনের কাছে। একজন রুশ কবি (কারো কারো মতে, ‘অক্টোবর বিপ্লবের কণ্ঠস্বর’) ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। দ্বিতীয় জন, আধুনিক ফরাসী কবিতা যার হাতে জন্ম সেই কিংবদন্তীসম শার্ল বোদলেয়ার। আর তৃতীয় জন, নিজ দেশের—‘মরমী কবি’ জালালুদ্দিন রুমি। মায়াকোভস্কির প্রভাব পড়েছিল তার প্রথম দিকের কবিতায়। এ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন যে, সিঁড়ি-ভাঙা মাত্রায় মুক্ত ছন্দে নাজিমও তার কবিতার লাইন সাজিয়েছেন। মায়াকোভস্কির মতই তার কবিতায় দেখা দিত নানা অপ্রত্যাশিত বাঁক, তার কবিতার তীর্যক সুরও একই উৎস থেকে প্রাপ্ত। নাজিমের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল মায়াকোভস্কির। উভয়ে একই মঞ্চ থেকে কতবার কবিতা-পাঠ করেছেন উদাত্ত গলায়। বিশের দশকের শুরুতে মস্কো তখন হয়ে উঠছে নব-নিরীক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্র। কবিতা, নাটক, সিনেমা, উপন্যাস-সর্বত্র চলছে নতুন প্রলেতারীয় কালচারকে চিনে-নেওয়ার পালা। ১৯২১-২৪ ও পরে ১৯২৫-২৮ কালপর্বে নাজিমের কবি-জীবন এই নব-নিরীক্ষা আন্দোলনৈর পরিবেশে অগ্রসর হয়েছে।

একবার মায়াকোভস্কি ও নাজিম একই মঞ্চে কবিতা পড়বেন। হাত-পা নেড়ে মায়াকোভস্কি তাঁর কবিতা উচ্চগ্রামে পড়ে গেলেন। এরপর নাজিমের পালা। স্বভাবতই কিছুটা স্নায়ুর চাপে ছিলেন। মায়াকোভস্কি তাঁকে বললেন, ‘দ্যাখো বাপু, তুমি তো পড়বে কবিতা তুর্কি ভাষায়, এখানকার রুমী দর্শকেরা সেসবের বিন্দু-বিসর্গ জানে না। সুতরাং মনের সুখে তুমি পড়ে যাও। দেখবে প্রচুর হাত তালি পাবে।’

এরেনবুর্গ তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, মায়াকোভস্কি নয় বরং নাজিমের কবিতার নিকটতম তুলনা হতে পারে কেবল পল এলুয়ারের কবিতা। সেটা সম্ভবত এলুয়ারের ওলগার সাথে নাজিমের কবিতায় পিরাইয়ের বহুল উল্লেখের কথা ভেবে লেখা। এলুয়ার ও নাজিম উভয়েই অবিশ্রান্তভাবে নিজেদের প্রিয়তমাসুদের প্রসঙ্গ এনেছেন কবিতায়। নাজিম নিজে অবশ্য বলেছেন অন্য কথা। মায়াকোভস্কির মত কংক্রিট কিছুটা কর্কশ গদ্য-ছন্দের চেয়ে আরো অনেক মৃদু-স্বরের কবিতা তার। জেলপর্বের কবিতায় আসলেই নাজিমের স্বর অনেক খাদে নেমে গিয়েছিল—যেন নিজের কথা অন্য কারো জন্যে নয়, কেবল তার নিজের জন্যে লেখা অথবা তার প্রিয়তমার মুখোমুখি বসে স্বাগত উচ্চারণে শোনানোর জন্যে লেখা।

দেব্রে তাঁর সাক্ষাৎকারে নাজিমকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কার জন্যে কবিতা লেখেন, নাজিমের উত্তর ছিল সোজাসাপ্টা: ‘কবিতাকে আগে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। একজন বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক, বামপন্থী, দায়বদ্ধ কবি (যে-নামেই তাকে চিহ্নিত করুন না কেন) তিনি হবেন এক সদা-সক্রিয় কবি: তিনি শুধু মানুষের হূদয়ের কথাই বলবেন না, হূদয়কে তিনি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত করবেন।.. লেনিন যখন বেঁচে ছিলেন, সেই সময়ের মস্কোয় মায়াকোভস্কি ও ইয়েসেনিনের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সেসময় বড় বড় জমায়েতে কবিতা পড়া হত। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমার দেশেও তো কবিরা যুগ যুগ ধরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে ঘুরে জনগণের সামনে কবিতা পাঠ করেছেন। জেলে যাওয়ার আগে আমিও কবিতা লিখতাম বহু শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ব বলে। পরে যখন জেলে থাকতে হল অনেক দিন ধরে, তখন থেকে আমার স্বরও নেমে যেতে থাকল। আমার শ্রোতা বলতে কেউ ছিল না, বা থাকলেও এক-দুজন মাত্র। একজনকে শোনাতে পারলেও আমার মনে হত তখন এর মধ্য দিয়েই আমি পৃথিবীর সব মানুষের কাছে যেতে পারছি’।

নাজিম তার এক কবিতায় একবার নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বলো, হিকমত-পুত্র, কোন শহরে তুমি মরতে চাও’? উত্তর দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আমি মারা যেতে চাই ইস্তাম্বুলে, মস্কোয় এবং প্যারিসেও।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমার মৃত্যুগুলোকে আমি পৃথিবীর উপরে বীজের মত ছড়িয়ে দিয়েছি, এর কিছু পড়েছে ওদেসায়, কিছু ইস্তাম্বুলে, আর কিছু প্রাগে। সবচেয়ে যে-দেশকে আমি ভালোবাসি সেটি হচ্ছে পৃথিবী। যখন আমার সময় আসবে, আমাকে পৃথিবী দিয়ে মুড়ে দিও’। অনেক শহরের মধ্যে প্যারিস যে মাঝে-মাঝেই ঘুরে-ফিরে আসে তার কবিতায় তার একটা প্রধান কারণ ছিলেন বোদলেয়ার। ‘প্যারিস স্প্লীন’ থেকে গদ্য-ছন্দের এক নতুন সুষমা তিনি আহরণ করেছিলেন। ফরাসি ভাষায় দখল থাকায় মূলের স্বাদ নিতে বাধা হয়নি তারা নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনের নানা খুঁটিনাটি কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছিল তার কবিতায় বোদলেয়ারের প্রেরণাতেই। অন্যত্র তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমি কবিতা লিখতে শুরু করি পনেরো বছর বয়সে। ঐ সময়ে ভালোবাসা ও মৃত্যু কবিতাকে আচ্ছন্ন করে থাকে। বাবার দিক থেকে আমি একেবারেই প্রাচ্যপন্থী, আর মা’র দিক থেকে পুরোপুরি য়ুরোপীয়। আমি বোদলেয়ার দ্বারা পুরোপুরি আচ্ছন্ন দিলাম, কিন্তু আমার দেশের দরবেশ কবিকুলও আমার চৈতন্যে প্রভাব ফেলেছিলেন। আমি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণে তৈরি’।

প্যারিসের কোন জিনিসটি সবচেয়ে ভালো লাগে? সে হচ্ছে প্যারিসই। এখানে কি তোমার দেখা হয়েছে তোমার কমরেডদের সঙ্গে? হ্যাঁ, আমি দেখেছি নামিক কামাল, জিয়া পাশা, মুস্তফা সুফি ওদের। আমি দেখেছি আমার তরুণী বয়সের মাকে—তিনি ছবি আঁঁকছেন, ফরাসিতে কথা বলছেন অনর্গল— পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী তিনি। বলো তো. প্যারিসকে কেমন দেখায়? তাকে দেখায় প্যারিস বাসীর মতো। বলো, আদমের পুত্র, এবারে বলো—তুমি কি প্যারিসকে বিশ্বাস করো, হ্যাঁ, আমি প্যারিসকে বিশ্বাস করি।’ তাঁর প্রিয় বন্ধু লুই আরাগঁ, পল এ লুয়ার, ত্রিস্তান জারা, পাবলো পিকাসো—এদের স্মৃতি প্যারিসকে ঘিরেই। এ কারণেই অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি বেঁচে থাকব আরাগঁ-র কবিতায়, আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আমি বেঁচে থাকব মার্সাইয়ের ডক শ্রমিকদের মধ্যে।’ শহর নিয়ে এরকম অনর্গল প্রশস্তি-গাঁথা আর কোথাও নেই: নেরুদা করেননি তার মান্টিয়াগো নিয়ে, কার্দেনাল করেননি তাঁর মানাগুয়া নিয়ে, পুশকিন করেননি তার সেই পিটার্সবাগ নিয়ে। নাজিম নিজেও আর কোনো শহরকে নিয়ে এতটা প্রেমময় কাব্য লেখেননি।