[তুমুল গাঢ় সমাচার ১০] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::১০

[গত সংখ্যার পর]
মিল সর্বত্রই এই সমস্যাটা এড়িয়ে গেছেন এই বলে যে, বল প্রয়োগ না করার নীতি বা ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল হওয়ার নীতি ‘কেবলমাত্র সভ্য জাতিগণের’ জন্যই প্রয়োজ্য। বল প্রয়োগ বা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো উচিত কেবল অন্ধকারে আটকে থাকা বর্বর অসভ্য জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই। এ নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি। এখানে যেটা নতুন করে তোলা দরকার তা হলো, কে বর্বর ও অসভ্য- এটা নির্ধারণ করবে কে? নিশ্চয় সভ্য জাতিরই মহাত্মনেরা যারা আলোকিত মানুষ, বিদ্যা-বুদ্ধিতে এগিয়ে? এ ধরনের নিয়ম করার ক্ষেত্রে মিল অবশ্য কোনো নৈতিক সমস্যা দেখেননি। অন্যত্র এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, অপরিণত শিশু বা অপ্রকৃতিস্থ লোকের ক্ষেত্রে কিসে তাদের ভালো, সেটা তাদের কাছে ছেড়ে দেওয়া চলে না। সে জন্য কিছুটা জবরদস্তি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে বৈকি। একই কথা খাটে বন্য জাতি বা স্যাভেজ, আধা-বর্বর ও বর্বর জাতি এবং জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। আফ্রিকার বেশির ভাগই প্রথমোক্ত গ্রুপে পড়ে। ভারতবর্ষ পড়ে মূলত বর্বর জাতির গ্রুপে (দু’একবার অবশ্য মিল আধা-বর্বর বা সেমি-বারবারাস অভিধাও ব্যবহার করেছেন ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে)। সভ্য ও বর্বর এবং বর্বরের মধ্যে বন্য, আধা-বর্বর ও বর্বর- এ রকম জনমিতিক শ্রেণিবিন্যাস করে একই ক্ষেত্রে ইউরোপ ও উপনিবেশের ক্ষেত্রে দুই ধরনের নীতির প্রয়োগকে মিল যুক্তিসিদ্ধ করে তুলেছেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে নিয়মের কল্পনা যেমন তাকে করতে হয়েছে, তেমনি তাকে নিয়মের ব্যত্যয়ের কল্পনাও তাকে করতে হয়েছে উপনিবেশ-সমস্যা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে। যা আদিতে সৃষ্ট হয়েছিল ব্যত্যয়ের নীতি হিসেবে (‘ইউরোপে যা চলবে উপনিবেশে তা চলবে না’) উনিশ শতকের হিতবাদী লিবারেলদের লেখায়। তা-ই পরবর্তীকালে পুনর্জন্ম পেয়ে চলেছে তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে হালের লিবারেলদের উৎকণ্ঠাময় আলোচনায় (‘ইউরোপে যা চলবে বৈরী তৃতীয় বিশ্বে তা চলবে না’)।

মিলের অবস্থানে এই দ্বিত্বতা বঙ্কিমের চোখ এড়ায়নি। প্রবন্ধের শেষটায় তিনি মন্তব্য করেছেন- ‘পরিণামে একটি কথা বলা আবশ্যক যে, মিল স্বস্বভাবানুবর্তিতা বিষয়ে যে কোন বিধানের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা কেবল সভ্যতম জাতিগণেরই উপযোগী, এই কথা বলিয়াছেন। আমরা সেই শ্রেণীর মধ্যে গণ্য কিনা, তদ্বিষয়ে অনেক মতভেদ হইতে পারে। আর মিলের মতই যে সর্ববাদী সম্মত, এ কথাও বলা যায় না; অন্য কি, লেখক নিজেই এই প্রবন্ধের সকল কথা আন্তরিক অবলম্বন করেন না। কিন্তু মিল অতি প্রধান ব্যক্তি, তাহার মত সর্বসাধারণের গোচর হইলে কোন প্রকার অমঙ্গল হইবার সম্ভাবনা নাই।’ গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মধ্যে ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’জনিত কারণে বেশ কিছুটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছিল, তা এর থেকে আঁচ করা যায়। তারপরও বলতে হয় যে, মিলের অসভ্য জাতির ক্ষেত্রে বল প্রয়োগের তত্ত্বটি বঙ্কিম সুবিধামত কাজে লাগিয়েছিলেন। প্রথমত, আর্যজাতি উত্থানের জন্য বাহুবলের (ও বাক্যবল) ব্যবহার দরকার হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, বাহুবলের জন্য উপযুক্ত সংগঠন গড়ে তোলার প্রেরণাও তিনি লাভ করেছিলেন মিল থেকে। সংগঠনের জন্য দরকার চরিত্র, আর চরিত্রের জন্য চাই উন্নত প্রশিক্ষণ, যার বিবরণী পাই ‘দেবী চৌধুরানী’তে।

বিবরণীটি চমকপ্রদ। ভবানী পাঠক প্রফুল্লের চরিত্র নির্মাণের জন্য প্রশিক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। জাতীয়তাবাদী বাহুবল-তত্ত্বের জন্য সংগঠন ও চরিত্র নির্মাণকে বঙ্কিম এভাবে দেখেছিলেন :’প্রথম বৎসরে তুলার তোষকে বালিশে প্রফুল্ল শুইল। দ্বিতীয় বৎসরে বিচালির বালিশ, বিচালির বিছানা। তৃতীয় বৎসরে ভূমি-শয্যা। চতুর্থ বৎসরে কোমল দুগ্ধফেননিভ শয্যা। পঞ্চম বৎসরে স্বেচ্ছাচার। পঞ্চম বৎসরে প্রফুল্ল যেখানে পাইত, সেখানে শুইত। প্রথম বৎসরে ত্রিযাম নিদ্রা। দ্বিতীয় বৎসরে দ্বিযাম। তৃতীয় বৎসরে দুই দিন অন্তর রাত্রিজাগরণ। চতুর্থ বৎসরে তন্দ্রা আসিলেই নিদ্রা। পঞ্চম বৎসরে স্বেচ্ছাচার। প্রফুল্ল রাত জাগিয়া পড়িত ও পুঁথি নকল করিত।…প্রফুল্ল চারি বৎসর ধরিয়া মল্লযুদ্ধ শিখিল।…এই মত নানারূপ পরীক্ষা ও অভ্যাসের দ্বারা অতুল সম্পত্তির অধিকারিণী প্রফুল্লকে ভবানী ঠাকুর ঐশ্বর্য্যভোগের যোগ্য পাত্রী করিতে চেষ্টা করিলেন। পাঁচ বৎসরে সকল শিক্ষা শেষ হইল।’

মিলের সাম্যচিন্তা বঙ্কিমকে প্রভাবিত করেছিল। ‘সাম্য’ প্রবন্ধে বঙ্কিম প্রাকৃতিক বৈষম্য ও অপ্রাকৃত বৈষম্যের মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন। প্রাকৃতিক নিয়মে কেউ অধিকতর বলশালী, কেউ বেশি বুদ্ধিমান, কেউ অধিক সৌন্দর্যমণ্ডিত, এসব সাম্যের ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। এখানে প্রধান বিবেচনা হচ্ছে ‘অপ্রাকৃত বৈষম্য’, যার মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণে-শূদ্রে বর্ণজনিত বৈষম্য, দেশি-বিদেশি শক্তির মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য, অথবা ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার সম্পদজনিত বৈষম্য। এই শেষোক্ত অর্থগত বৈষম্যই সবচেয়ে গুরুতর। বঙ্কিম বলেছেন, ‘সমাজের উন্নতিরোধ বা অবনতির যে সকল কারণ আছে, অপ্রাকৃত বৈষম্যের আধিক্যই তাহার প্রধান। ভারতবর্ষের যে এতদিন হইতে এত দুর্দশা, সামাজিক বৈষম্যের আধিক্যই তাহার বিশিষ্ট কারণ।’ পৃথিবীর যে দেশেই এই বৈষম্যের আধিক্য ঘটেছে সে দেশেই শ্রীবৃদ্ধির গতি শ্নথ হয়ে এসেছে। ফ্রান্সের প্রসঙ্গ টেনে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন যে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার কারণেই সেখানে সাম্যবাদী চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল :’পঞ্চদশ লুইর রাজ্যকালে ফ্রান্সের দেশে এইরূপ গুরুতর বৈষম্য। এই বৈষম্য কদর্য, অপরিশুদ্ধ রাজশাসন-প্রণালীজনিত। রুশোর গুরুতর প্রহারে সেই রাজ্য ও রাজশাসন প্রণালী ভগ্নমূল হইল। তাঁহার মানসশিষ্যরা তাহা চূর্ণীকৃত করিল।’

‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে দেশের কৃষি ব্যবস্থার যে চিত্র বঙ্কিম এঁকেছিলেন, সেখানেও কদর্য বৈষম্যের নিদারুণ ছাপ পাওয়া যায়। তিনিও কি নিজেকে সাম্যের প্রচারক হিসেবে, রুশোর মতোই সাম্যবাদী চিন্তক হিসেবে দেখেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের পটভূমিতে? সেই জন্যই কি ‘ভূসম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব’ সম্পর্কে মিলের মতের উল্লেখ করেছিলেন এবং বলেছিলেন :’যিনি ন্যায়বিরুদ্ধ আইনের দোষে পিতৃ সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়াছেন বলিয়া, দোর্দণ্ড প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত মহারাজাধিরাজ প্রভৃতি উপাধি ধারণ করেন, তাঁহারও যেন স্মরণ থাকে যে, বঙ্গদেশের কৃষক পরাণ মণ্ডল তাঁহার সমকক্ষ, এবং তাঁহার ভ্রাতা। জন্ম, দোষগুণের অধীন নহে। তাহার জন্য কোনো দোষ নাই। যে সম্পত্তি তিনি একা ভোগ করিয়াছেন, পরাণ মণ্ডলও তাহার ন্যায়সঙ্গত অধিকারী।’

প্রশ্ন হচ্ছে, এ কথা যিনি বলতে পারেন, তিনি মুসলমান-বিদ্বেষী কী করে হতে পারলেন? পরাণ মণ্ডল বলার সাথে সাথে তার কি হাসিম শেখ-এর কথাও মনে পড়ল না? অপ্রাকৃত বৈষম্য নিয়ে বলতে গিয়ে যখন ব্রাহ্মণ-শূদ্র বা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের প্রসঙ্গ তুললেন, তখন কি একবার তার মনে পড়ল না হিন্দু ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সাথে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্যের কথা? শ্রেণি-প্রশ্নে যিনি এত তীক্ষষ্ট ও উদার অবস্থান গ্রহণ করেন (যার পরিচয় আমরা পেয়েছি ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও ‘সাম্য’ রচনায়) তার মন কেন আত্মসত্তার পরিচয় প্রশ্নে তথা আইডেনটিটির প্রশ্নে এসে এতটা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে? ভারতবর্ষের জাতি বা মহাজাতি গড়ার প্রকল্পে নিয়োজিত হয়ে তিনি কেন বারবার হিন্দু-ইতিহাসের থেকেই প্রেরণা নিতে তৎপর হন? শুধু তা-ই নয়; ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টিকটূ রকমের অসহিষ্ণু মনে হয় তাকে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের প্রতিক্রিয়া আলোচনা করার ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক ও শ্রেণি-সমস্যা আলোচনার ক্ষেত্রে যিনি এত উদারনৈতিক, নারী-সমস্যা ও হিন্দু-সমাজের ভেতরকার জাত-পাতের সমস্যার আলোচনায় যিনি এতটাই মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির; মুসলমান প্রসঙ্গ এলে তিনি ততটাই অনমনীয়, অশোধনযোগ্যভাবে অসংবেদনশীল; তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। শ্রেণি-রাজনীতিকে তাই ছাপিয়ে উঠে আইডেনটিটির রাজনীতি- বঙ্কিমের সত্তার দ্বিত্বতা বা দ্বিখণ্ডন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফাটল বা দ্বিখণ্ডিত সত্তাকেই তুলে ধরে। এর ফল পরিণাম তো বঙ্কিমের মতো তীক্ষষ্টধী মানুষের কাছে অধরা থাকার কথা নয়। এর কিছু আভাস পাই বঙ্কিমের নিজের লেখাতেই। তাতে আমাদের মনোকষ্ট আরও বেড়ে যায়।

‘সীতারাম’ উপন্যাসকেই আমি এই সূত্রে বেছে নিতে চাই। তার আগে ‘আনন্দমঠ’ নিয়ে দু’একটি কথা বলা দরকার। আনন্দমঠে মুসলমান শাসনের অবসানের পর ইংরেজরাই ভারতবর্ষের শাসনভার হাতে তুলে নিয়েছিল। অর্থাৎ আনন্দমঠে হিন্দুর জয় হলো বটে, কিন্তু দেশে হিন্দুর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পেল না। এর থেকে বঙ্কিম-জীবনীকার অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের সন্তানেরা অত্যাচারী মুসলমান রাজশক্তিকে পরাভূত করেছে ঠিক- কিন্তু সেই হিন্দু সন্তান সম্প্রদায়কে দেশ শাসনের অধিকার’ দেওয়া হয়নি। ইংরেজ রাজত্বকে আবশ্যক বলে ভেবেছেন বঙ্কিম। কেননা, প্রচলিত হিন্দু সমাজে নানা অনাচার ঢুকে পড়েছে, যা তাড়ানোর জন্য হলেও ইংরেজকে মিত্র হিসাবে চাই তার :’ইংরেজ আগে রাজা না হইলে আর্য ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। …তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা আর্য ধর্ম নহে, সে একটা লৌকিক অপকৃষ্ট ধর্ম; তাহার প্রভাবে প্রকৃত আর্য ধর্ম- ম্লেচ্ছেরা যাহাকে হিন্দু ধর্ম বলে, তাহা লোপ পাইয়াছে।’ এ জন্যই বঙ্কিম আনন্দমঠ রচনার প্রারম্ভেই ঠিক করে নিয়েছেন- ‘ইংরেজকে রাজা করিব।’ এই ব্যাখ্যা ঠিক হলে বলতে হয়, বঙ্কিম মিলের পূর্ব-কথিত ‘অপরিণত শৈশব’-এর কালতত্ত্ব এবং ভারতবর্ষের জন্য ইংরেজের অধীনে থাকার ‘আবশ্যকীয় শিক্ষানবিশী পর্ব’র যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছিলেন। এর একটি সম্ভাব্য কারণ, শেষ জীবনে বঙ্কিম ক্রমশ হিন্দু ধর্মাশ্রিত আদর্শকে বড় করে দেখেছিলেন। ‘ধর্মতত্ত্ব’তে তিনি দেশপ্রেমকে ‘শ্রেষ্ঠ ধর্ম’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ‘ইউরোপ পুনঃদর্শন’ বইয়ে তপন রায় চৌধুরী বলেছেন. ‘তাঁর ব্যক্তিগত আদর্শবাদে পরিবর্তনে-কোনও অজ্ঞাত কারণে তাঁর আস্তিক্যবাদে উত্তরণ এবং পুরুষাণুক্রমিক ধর্মমতে প্রত্যাবর্তনের ফলে’ তিনি অন্তত একটি বিষয়ে ইউরোপের থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তাকে মুসলমান সম্প্রদায়কে আরও দূরে সরিয়ে দিতে হয়েছিল।

অমিত্রসূদন আরও যুক্তি দেখিয়েছেন, যেহেতু মন্বন্তরের পটভূমিতে আনন্দমঠ রচিত এবং যেহেতু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে (১১৭৬-৭৮ বঙ্গাব্দকালে) অরাজক শাসন বিরাজ করছিল, এবং যেহেতু রাজকার্যে তখন পর্যন্ত মুসলমান শাসকদেরই ‘প্রধান’ দায়-দায়িত্ব ছিল, তাই সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল এবং সে কারণেই উপন্যাসটিতে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য স্থানে স্থানে বর্ণিত হয়েছে। এই ব্যাখ্যা সঠিক বলে গ্রহণ করা যায় না। পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলায় মুসলিম শাসন অব্যাহত ছিল- কল্পনা করা দুরূহ। বস্তুত বাংলায় তখন কোম্পানির অরাজক শাসনের বিস্তার হয়েছিল, যার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলমান রাজশক্তির একাংশের সাহায্য (বাংলার সুবেদার তখন রেজা খাঁ) নিয়েছিল কোম্পানির স্থানীয় প্রভুরা। বঙ্কিম লিখেছেন, ‘মীরজাফর গুলি খায় ও ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেসপাচ লেখে।’ এখানে ঐতিহাসিক ত্রুটি আছে। মীরজাফর ১৭৬৫ সালেই মারা যান। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য হেস্টিংসকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। মীর কাশিমের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে বঙ্কিম প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরেছেন :’এই সময়ে যে সকল ইংরেজ বাঙ্গালায় বাস করিতেন তাঁহারা দুইটি মাত্র কার্যে অক্ষম ছিলেন। তাঁহারা লোভ সম্বরণে অক্ষম এবং পরাভব স্বীকারে অক্ষম। …তখন বাঙ্গালার বাতাসে ইংরেজদিগের অর্থাপহরণ রোগ জন্মিত…বঙ্গীয় ইংরেজদিগের মধ্যে তখন ধর্ম শব্দ লুপ্ত হইয়াছিল।’ আসল ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতে, মুসলমান রাজন্যবর্গের হাতে নয়, আর দুর্ভিক্ষে এক-তৃতীয়াংশ বাংলার মানুষ যারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন তার অন্তত :অর্ধেক ভাগই ছিল বাংলার দরিদ্র মুসলমান চাষিরা। বিদ্রোহীদের মধ্যে সন্ন্যাসী ও ফকির উভয় সম্প্রদায়েরই লোক ছিলেন।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৯] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::৯

[গত সংখ্যার পর]

লিবারেল মিলের আলোচনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছন্দপতন ঘটেছে যখন উপনিবেশ শাসনের ক্ষেত্রে ‘প্রতিনিধিত্বশীল’ সরকার-ব্যবস্থার বিপরীতে সরাসরি ‘স্বৈরাচারী’ (ডেসপটিজম) শাসনের সপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনে বা ইউরোপে চলবে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার-ব্যবস্থা, কিন্তু ভারতবর্ষে বা অন্যান্য উপনিবেশগুলোয় চলবে অ-প্রতিনিধিত্বশীল ‘স্বৈরাচারী’ ব্যবস্থা- এই দ্বিত্বতা মিলের রাষ্ট্রচিন্তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ‘স্বৈরাচারী’ শাসনের যুক্তি নির্মাণের জন্য মিলকে এক সময় ওরিয়েন্টাল ডেসপটিজমের তত্ত্বকেও আশ্রয় করতে হয়েছে। এখানে মিলের যুক্তি ছিল অনেকটা পিতা জেমস মিলের (এবং হেগেলের) অনুগামী। মিল যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন যে, যেহেতু ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশপূর্ব যুগে ‘স্বৈরাচারী’ শাসন-ব্যবস্থার অধীনে ছিল, সেহেতু ইংরেজরা নতুন করে কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম করেনি সেখানে, বরং আলোকিত এক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতবর্ষীয়দের ‘সভ্য করাই’ এই শাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই যুক্তি-তর্কের একটি আশু রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। রাজকর্ম পরিচালনায় জবরদস্তি বা শাসিতের জন্য অনিষ্টকর কোনো নীতিমালা (যাকে মিল বলেছেন ‘হার্ম প্রিন্সিপল’) প্রয়োগের সম্ভাব্যতা নিয়ে নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব এতে করে এড়িয়ে যাওয়া হলো। সাধারণভাবে মিলের নৈয়ায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, কোনো সভ্য জাতি বা জনগণের ওপরে অনিষ্টকর বা জবরদস্তির নীতি প্রয়োগ করা যাবে না। তবে যেসব জাতি বা জনগোষ্ঠী এখনও উন্নয়নের শৈশব-স্তরে রয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে-তাদের সম্মতি বা অসম্মতির অপেক্ষা না করেই জবরদস্তির নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশেষত যদি ইতিমধ্যেই তাদের স্বৈরাচারী শাসনে থাকার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে থাকে প্রাগ-উপনিবেশ পর্বে। মিলের এই চতুর নীতিটি সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের পক্ষে একটি জোরালো যুক্তি হিসেবে এখনও ব্যবহূত হয়ে থাকে। উদাহরণত, ১৮৫৯ সালের ‘এ ফিউ রিমার্কস অন নন-ইন্টারভেনশন’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, সভ্য জাতির ক্ষেত্রে ‘আমাদের ধ্যান-ধারণা আদর্শ অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে সামান্যই যুক্তি রয়েছে’, কিন্তু এ কথা খাটে না ‘সভ্যতার নিম্নতর স্তরে থাকা জনগোষ্ঠীর বেলায়’। ওদের ক্ষেত্রে ‘প্রথাগত আন্তর্জাতিক ন্যায়-নীতি খাটে না’; কেননা এসব ন্যায়-নীতির প্রয়োগ তো পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে হবার কথা, কিন্তু ‘বর্বর জনগোষ্ঠী কখনও সমান ন্যায়-নীতির প্রয়োগের রীতিতে বিশ্বাস করে না বা করবে বলে এমনটা আস্থা করা যায় না। তাদের মন-মানসিকতা সে রকম প্রচেষ্টা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল নয়।’ ফলে তাদের নিজেদের স্বার্থেই ‘তাদেরকে পরাভূত করতে হবে এবং বিদেশি শক্তির অধীনে রেখে দিতে হবে।’ এর মধ্যে সাম্প্রতিক কালের আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরানে হস্তক্ষেপের একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক যুক্তির খসড়া তৈরি হতে দেখি। মিল অবশ্য এ ধরনের হস্তক্ষেপকে এক ধরনের ‘পেডাগজিক্যাল হস্তক্ষেপ’ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, যেমনটা হয় গুরুকুলে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কে। ছাত্রের ভালোর জন্যই তাকে নিয়ন্ত্রণের কড়া শাসনে ও শৃঙ্খলায় বাঁধতে হয়। একই যুক্তির বলেই মিল ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকোনমিতে’ দেখিয়েছেন যে, কেবলমাত্র সভ্য জাতির ক্ষেত্রেই ফ্রি-মার্কেট ইকোনমি ও রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট প্রযোজ্য; অসভ্য জাতির ক্ষেত্রে অর্থনীতিতেও চলতে পারে ফ্রি-মার্কেট ইকোনমির ব্যত্যয় এবং রাজনৈতিকভাবে স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন।

তবে উপনিবেশের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের প্রয়োগ করতে গিয়ে মিল কিছুটা নমনীয় ছিলেন নেটিভদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার নিজস্বতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে। দার্শনিক কোম্‌তের সঙ্গে চিঠিপত্রে তিনি একদিকে সমালোচনা করেছেন ভারতবর্ষের রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রথা সমূহের, যার মধ্যে রয়েছে শিশু হত্যা, ঠগি-বৃত্তি, সতীদাহ প্রথা, তুকতাক বিদ্যা, পর্দা প্রথা ইত্যাদি। অন্যদিকে মিল বুঝেছিলেন যে, এসব প্রথা বিলয়ের জন্য শুধু সহায়ক আইন জারি করাই যথেষ্ট নয়; এর জন্য ক্রমান্বয়ে সংস্কার আনতে হবে নেটিভ সমাজবলয়ে। এ ক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথম উদাহরণটি হচ্ছে, পূর্ব উল্লিখিত এংলিসিস্ট বনাম ওরিয়েন্টলিস্ট বিতর্ক। এই বিতর্কে যদিও মিল শেষ পর্যন্ত ম্যাকলে সাহেবের সঙ্গে সুর মেলান ‘বাদামি সাহেব’ তৈরি করার প্রকল্পে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু সংযোজন ছিল তার। ১৮৩৬ সালের ‘রিসেন্ট চেইঞ্জেস ইন নেটিভ এডুকেশন’ ডিসপ্যাচের খসড়ায় মিল প্রস্তাব করেন যে, (ক) এই নেটিভ সাহেবদের প্রাচ্য ভাষা ও প্রাচ্যবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হতে হবে; (খ) ভারতবর্ষের ক্লাসিক্যাল ভাষাসমূহ যথা সংস্কৃত, ফার্সি ও আরবি ভাষা জানা এবং হিন্দু-মুসলমান আইন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকাটা সঠিক বিচারকার্য পরিচালনার জন্যও অত্যাবশ্যক। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে, ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করা নিয়ে। এখানে কান্টের অনুগামী হয়েছেন মিল। কান্ট বলেছিলেন, ‘আমি যুক্তি থেকে পিছু হটে বিশ্বাসকে কিছুটা জায়গা করে দিতে বাধ্য হলাম’। যুক্তিবাদ সর্বত্র খাটে না, যুক্তিবাদেরও সীমা রয়েছে, এবং যদিও অযৌক্তিক অনেক ক্ষতিকর সামাজিক বিশ্বাস-সংস্কার রয়ে গেছে যার মূল উৎপাটন করা জরুরি, তবুও এসব বিশ্বাসের একটা গুরুত্ব রয়ে গেছে সাধারণ জনজীবনে। ১৮৫৮ সালের পিটিশনে তাই মিল জোরেশোরে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে নানাবিধ ‘ধর্মীয় চর্চার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করার যে সিদ্ধান্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অদ্যাবধি নিয়ে এসেছে’ (অবশ্যই কতিপয় ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিয়ে- যেগুলো মানবতার জন্য স্পষ্টত অত্যন্ত গর্হিতকর) তা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত রাখা দরকার।

মিলের কিছু কিছু লেখায় প্রকাশ্য বর্ণবাদেরও ছায়াপাত ঘটেছে। নেটিভ আমেরিকানদের তিনি কুঁড়ে বলেছেন; চীনাদের মধ্যে তিনি পেয়েছেন দূরদর্শিতার অভাব; ভারতবর্ষীয় ও চীনাদের মধ্যে সম্পদ-আহরণের কোনো তাগিদ দেখেননি। তবে এ ক্ষেত্রেও বলতে হয় যে, আপাতদৃষ্টিতে বর্ণবাদী কথাবার্তা সত্ত্বেও মিল স্বীকার করে গেছেন যে, এসব জাতিগত পার্থক্য মূলত উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে না ওঠার কারণেই সৃষ্ট হয়েছে। এসব পার্থক্য কোনো নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যজনিত নয়। উদাহরণত তিনি দেখিয়েছেন, নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে চীনে, ভারতবর্ষে, এমনকি য়ুরোপের অপেক্ষাকৃত স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় (যথা রাশিয়া, তুরস্ক, স্পেন, আয়ারল্যান্ড) বিরাজ করছে এমন ধরনের ভূমিসত্ত্ব আইন যার মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- ফলে তাদের মধ্যে সম্পদ-আহরণের স্পৃহা আসবে কোথা থেকে? ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তিনি কর্নওয়ালিশের জমিদারি আইনের সমালোচক ছিলেন এবং সরাসরি প্রজার কাছে রায়তওয়ারি স্বত্ব দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মিল ও বঙ্কিমের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যাশিত সদৃশতা ছিল।

তারপরও সব ছাপিয়ে মিলের দ্বিত্ব-অবস্থানের দিকটিই বড় হয়ে ওঠে। সভ্য ইংরেজ জাতি স্বৈরাচারী পদ্ধতি অবলম্বন করে পদানত করে হলেও অসভ্য ভারতবর্ষকে উন্নত (নেটিভদের ভালোর জন্যই) করবে- এর সপক্ষে মিল আমৃত্যু অবিচল থেকে গেছেন। ভারতবর্ষের লোকেরা নিজেরা নিজেদের মতো করে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার-ব্যবস্থা দাঁড় করাবে ব্রিটিশ রাজশক্তির সহায়তা ছাড়াই, এটি মিলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য কোনো দিন-ক্ষণের আভাস দিতে রাজি হননি মিল। বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘প্রত্যক্ষ শাসন’ আরও দীর্ঘকালের জন্য অব্যাহত থাকুক, এর পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন তিনি। য়ুরোপের প্রাগ্রসর চিন্তাবিদের মধ্যে এই যে দ্বিত্বতা আমরা দেখতে পাই তা কোনো সাধারণ মাপের দ্বিধা, দোলাচল বা দ্বন্দ্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। একেই আমরা প্রবন্ধের শুরুতে ‘সত্তার বিভক্তি’ বলেছি যখন সত্তা উদার ও অনুদার চিন্তার বলয়ে বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। শাসক ও শাসিতের জন্য তৈরি হয় আলাদা নিয়ম-কানুন। যে রীতি ইংল্যান্ডে চলে সে যুক্তি ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে চলে না। মিলের সত্তার এই দ্বৈততা ইউরোপীয় আধুনিকতারই অন্তর্গত দ্বৈততার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই দ্বৈততা ‘আমাদের ও তাদের’ এ দুই সাংস্কৃতিক ভুবনের মধ্যে একাধারে আধুনিক উদার ও ঔপনিবেশিক অনুদার নির্ভরশীলতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি করে।

২. বঙ্কিমচন্দ্রের মিল

মিলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বঙ্কিম যথার্থই শোকাভিভূত হয়েছিলেন : ‘মিলের মৃত্যু হইয়াছে! আমরা কখন তাঁহাকে চক্ষে দেখি নাই; তিনি কখন বঙ্গদর্শনের পরিচয় গ্রহণ করেন নাই। তথাপি আমাদিগের মনে হইতেছে যেন আমাদিগের কোন পরম আত্মীয়ের সহিত চির বিচ্ছেদ হইয়াছে।’ মিলের কীর্তির উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি জোর দিয়েছেন এথিকস ও ইকোনমিক্স বিষয়ে তার অবদানের ওপরে : ‘মিল অতি সূক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন নৈয়ায়িক ছিলেন। তাঁহার কৃত ইংরেজি ন্যায়শাস্ত্র এবং অর্থব্যবহারশাস্ত্র তাহার প্রধানকীর্তি। ইহাতে তিনি যে কোন নূতন কথার উদ্ভাবন করিয়াছেন তাহা নহে কিন্তু এতৎসংক্রান্ত সমুদয় কথা এমন সুশৃঙ্খল করিয়া লিখিয়াছেন এবং প্রত্যেক বিষয় এত পরিস্কার করিয়া বুঝাইয়াছেন যে তাঁহার গ্রন্থ পাঠ না করিলে কাহারই উক্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হইবেক না।’ এই প্রবন্ধেরই এক জায়গায় মিল (যিনি ব্যক্তিপ্রাধান্য-বাদী) ও কোম্‌তের (যিনি সমষ্টির স্বার্থবাদী) মধ্যে প্রতিতুলনা করে তিনি বলেছেন, ‘মতদ্বয় মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ এবং কোনটি নিকৃষ্ট তদ্বিষয়ে আমরা কোন কথা বলতে পারি না।’ অনত্র তিনি বলেছেন, ‘অর্ধেক বেন্থাম অর্ধেক কোম্‌তের’ মধ্যে ‘সমুচিত সামঞ্জস্য বিধানের কথা।’ কেননা, ‘চিত্তমধ্যে এই দুই মতের সমুচিত সামঞ্জস্যই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা।’ যা হোক, সমষ্টির স্বার্থ (কোম্‌ত) ও ব্যক্তিস্বার্থানুরাগ (বেন্থাম বা মিল) এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য করা যে ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না সে ক্ষেত্রে কী করা তা নিয়ে বঙ্কিমের দ্বিধা ছিল সে সময়ে। এই লেখার এক দশকের মধ্যেই লেখা হবে আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী ও সীতারাম উপন্যাস ত্রয়ী। তখন এসব দ্বিধা কেটে যাবে। সমষ্টির কল্যাণের জন্য ব্যক্তিস্বার্থকে প্রয়োজনে তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে- এই দাঁড়াবে তার অভিমত। ভক্তি ও বাহুবল সেখানে লিবারেল ইনডিভিজুয়ালিটির বদলে জায়গা করে নেবে। ব্যক্তির ইউটিলিটির বদলে সামষ্টিক ইউটিলিটির ওপরে জোর দেবেন তিনি, যার অন্য নাম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ।

শুধু আনন্দমঠ নয়। ইউটিলিটির সামষ্টিক ব্যাখ্যা কমলাকান্তর দপ্তরেও আছে। যেমন কমলাকান্তের দপ্তরে তৃতীয় সংখ্যার শিরোনাম ছিল ‘ইউটিলিটি বা উদর-দর্শন’। বঙ্কিম যেখানে ইউটিলিটারিয়ান দর্শনের সার-সংক্ষেপ টানছেন এভাবে : ‘এই মতের সার কথা এই যে যাহা হিতকর, তাহাই অনুষ্ঠেয় ও কর্তব্য। যাহা অহিতকর, তাহা বর্জনীয় এবং অকর্তব্য। হিতাহিত ফলোৎপাদকতা ভিন্ন কর্তব্যাকর্তব্যের অর্থাৎ পুণ্য পাপের- অন্য লক্ষণ নাই।’ এই দর্শনকে অস্ত্র করেই তিনি ‘কৃষ্ণ-চরিত্রে’ বললেন, ‘যাহা লোকহিতকর তাহাই ধর্ম’, অর্থাৎ ধর্মের বিচার কেবল শাস্ত্র-অনুযায়ী করা উচিত নয়। এভাবে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র স্থাপিত হলো।

১২৭৯ ভাদ্র সংখ্যায় ছাপা হয় ‘স্বস্বভাবানুবর্তিতা’ মানে ইনডিভিজুয়ালিটি নিয়ে বঙ্কিমের প্রবন্ধ। সেখানে মিলের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে বঙ্কিম লিখলেন, ‘মিল বলেন যে, যাহাতে অন্য কাহার সুখের ব্যাঘাত হয়, অথবা সমাজস্থ অধিকাংশ লোকের অসুখ জন্মে, অথবা যেখানে প্রত্যেকের কিছু কিছু কষ্ট বা ক্ষতি সহ্য না করিলে সমাজ রক্ষা হয় না, এরূপ স্থলে স্বেচ্ছাচার এবং স্বস্বভাবানুবর্তিতা নিবারণের জন্য বলপ্রয়োগ করা অন্যায় নহে।’ প্রশ্ন উঠে, বলপ্রয়োগের এ নিয়মটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কি-না, নাকি সে ক্ষেত্রে মিলের অন্য নিয়মটিই কেবল খাটবে যেখানে তিনি বলছেন, ‘সকল স্ব স্ব জ্ঞান ও বিবেচনানুসারে যে মত ইচ্ছা তাহাই অবলম্বন করিবে, তাহাতে প্রচলিত মতের বিরোধীদিগের প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার করা অন্যায়’? কোন নিয়মটা প্রয়োগ করা হবে নীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে যথার্থ?

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৮] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::৮

দীপেশ চক্রবর্তীর জন্য
এটি অনেকেই এর আগে লক্ষ্য করেছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র যেন এক ব্যক্তি নন। দুই বঙ্কিম একই সত্তার মধ্যে বিচরণ করছেন। যিনি লিখেছেন ‘বঙ্গদেশের কৃষক’, ‘সাম্য’ ও ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর মতো প্রগতিশীল রচনা; তিনিই লিখেছেন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী তথা হিন্দুত্ববাদী ‘আনন্দমঠ’ ও ‘ধর্মতত্ত্ব’- ভাবা যায়! কেন এই বৈপরীত্য? এ যেন সত্তারই বিভক্তি। ড. জেকিল ও মি. হাইডের বাংলা কী, আমি জানি না। দুই বিখণ্ডিত সত্তা, যেখানে যুক্তি ও অযৌক্তিক দাবি এবং নির্মাণ পাশাপাশি চলছে কোনো রাখঢাক না করেই; কোনো স্ববিরোধিতা সম্পর্কে অবগত না হয়েই। এই লেখাটিতে আমি বলবার চেষ্টা করেছি যে, বঙ্কিমচন্দ্রের সত্তার এই বিভক্তি গোটা য়ুরোপীয় আধুনিকতা ও তৎসূত্রে প্রাপ্ত জাতীয়তাবাদী সত্তারই বিভক্তি। য়ুরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট এই বিভক্তিকে ধারণ করেছিল। বঙ্কিমের মন্ত্রগুরু জন স্টুয়ার্ট মিলের মধ্যেও দেখি একই বিভাজন- যেখানে যুক্তি ও অযৌক্তিক, মানবিক ইনক্লুশন ও ঔপনিবেশিক এক্সক্লুশন, সভ্য আর অ-সভ্য জাতি ও জনগণের জন্য ভিন্ন নিয়ম-রীতি প্রয়োগের যুক্তি-তর্ক পাশাপাশি চলেছে। গুরু-শিষ্যের মধ্যকার এই মৌলিক মিল সম্পর্কে আলোকপাত করাই এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। একই সত্তার মধ্যে এই স্ববিরোধী আয়োজন এক সময় সৃষ্টি করে সত্তার ফাটল বা বিভক্তি, যা শেষ পর্যন্ত সংক্রমিত হয় পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্র-সংবিধান-রাজনীতিতে।

১. মিলের ভারতবর্ষ

লর্ড মেঘনাদ দেশাইকে আমি একবার প্রশ্ন করেছিলাম, লিবারেল চিন্তক জন স্টুয়ার্ট মিল কী করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো জায়গায় বছরের পর বছর ধরে কাজ করে গেলেন? শুধু কাজ করা নয়, ১৮২৩ সালে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট একজামিনার’ হিসেবে ঢোকার পর থেকে মিল পদোন্নতি পেয়ে এক পর্যায়ে কোম্পানির সর্বোচ্চ পদে ‘চিফ একজামিনার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশাইকে আমি আরও জিজ্ঞেস করেছিলাম, মিলের ভারতবর্ষ সম্পর্কিত রচনাবলি তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন কি-না এবং সে সম্পর্কে তার অভিমতই বা কী? দেশাই শুধু আমাকে বলেছিলেন, ‘চিফ একজামিনার’ হিসেবে কোম্পানি শাসনের নীতিমালা ঠিক করার ক্ষেত্রে মিলের একটি প্রধান নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা ছিল, যা মোটেই হেলাফেলা করার ব্যাপার নয়। তবে এ সম্পর্কে তার বিশেষ কিছু জানা নেই।

মিল যেসব ‘প্রগতিশীল’ ও ‘লিবারেল’ চিন্তারাজির স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তা বিষয়-বৈচিত্র্য ও আয়তনে সত্যই বিস্ময়কর। ১৮৪৩ সালের ‘এ সিস্টেম অব লজিক’, ১৮৪৮ সালের ‘প্রিন্সিপল্‌স অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’, ১৮৫৯ সালের ‘অন লিবার্টি’, ১৮৬১ সালের ‘কনসিডারেশনস অন রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট’, ‘ইউটিলিটারিয়ানিজম’, ১৮৬৯ সালের ‘দ্য সাবজেকশন অব উইমেন’, ‘সোশ্যালিজম’ এবং ১৮৭৩ সালের ‘অটোবায়োগ্রাফি’ বিবেচনায় নিলে সন্দেহ থাকে না যে, মিলকে কেন উনিশ শতকের য়ুরোপীয় লিবারেল চিন্তার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা হয়ে থাকে। এতে মিলের প্রচলিত রচনাকর্মের প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য একাধিক কূটাভাস বা প্যারাডক্সের আভাস পাই। কূটাভাস অন্তত দুটো। প্রথমত, এত উদার চিন্তা যার, তিনি তার কর্মজীবন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃত্তে কাটালেন কী করে? সেকালের ইউরোপের সূক্ষ্ণ নৈয়ায়িকদের মধ্যে যিনি অগ্রগণ্য তাকে এটা করতে গিয়ে কি নিত্যনতুন নৈতিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়নি? দ্বিতীয়ত, যদি যুক্তির খাতিরে ধরেই নিই, মাসিক স্থিতিশীল আয়-উপার্জনের পথ খোলা রাখার জন্য তাকে বেছে নিতে হয়েছিল কোম্পানির ‘চাকরি’, তাহলেও বাড়তি প্রশ্ন থেকে যায়। সেই বাড়তি প্রশ্নটি হচ্ছে, ভারতবর্ষ নিয়ে মিলের রচনাগুলোর মূল ঝোঁক নিয়ে। ঔপনিবেশিক শাসনে আবদ্ধ ভারতবর্ষেও দুঃখ-যন্ত্রণা লাঘব করার ক্ষেত্রে সেসব লেখা কাজ করেছিল কি-না? মিলের পক্ষ থেকে সেদিকে কোনো বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছিল কি-না? নাকি তিনিও ছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের হাতিয়ার কেবল?

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে লিখতে গিয়ে মিল সব সময় ভাবতে চাইতেন, শাসক জনগোষ্ঠী যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-অর্থনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতা ও সমরকুশলে অপেক্ষাকৃত পরিণত ও দক্ষ জাতি, এবং এই অর্থে ‘সভ্য জাতি’, সেহেতু তাদের ওপরে নৈতিক দায়িত্ব এসে পড়ে বৈকি শাসিত ‘অসভ্য জনগোষ্ঠী’কে অন্ধকার যুগ থেকে টেনে তোলার। সাম্রাজ্যবাদ বলতে লুণ্ঠন-যুদ্ধ-শোষণের যে ক্ল্যাসিক চিত্র আমরা পাই, তা মিলের প্রকল্পের জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যে উপনিবেশ এখনও সভ্য হয়নি, তাকে তার ভালোর জন্যই উন্নত জাতি কর্তৃক শাসিত হতে হবে, এবং শাসিত থেকেই ক্রমশ তাকে ‘উন্নতির উচ্চতর স্তরে উত্তরণ’-এর চেষ্টা করা হবে। মিল বলেছেন, ‘আমরা বলতে পারি না যে এই আদর্শ নীতি ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করা গেছে। কিন্তু এ রকম নীতি না গ্রহণ করলে সর্বোচ্চ নৈতিক আস্থাটুকু শাসক শ্রেণির ওপর থেকে উঠে যাবে।’ কোম্পানি শাসন থেকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের শাসনের অধীনে ক্ষমতা-স্থানান্তরের প্রাক্কালে মিলকে অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। সেখানে মিল ভারতবর্ষের ওপর কোম্পানি শাসনের সপক্ষে জোরালো ওকালতি করেন। কোম্পানির প্রত্যক্ষ ও নিবিড় শাসনের চেয়ে অপ্রত্যক্ষ ও ‘দূরত্ব থেকে’ শাসনের ফলাফল শাসক ও শাসিত উভয়ের জন্যই ভালো হবে না- এমনটাই ছিল তার অভিমত। ভারতবর্ষ শাসন করা সাধারণ আমলাতন্ত্রের দ্বারা সহজসাধ্য হবে না। কেননা, মিলের মতে, ভারত-বিদ্যা দর্শন, অর্থশাস্ত্র, বিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানকাণ্ডের মতোই একটি ‘বিশেষ বিদ্যা’, বিশেষ অভিনিবেশের দাবি করে, যা প্রথাগত ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের আয়ত্তে নেই, এবং যেটা শুধু আয়ত্ত করা সম্ভব ভারতবর্ষ বিষয়ে বিশেষভাবে উৎসর্গীকৃত একটি পরিচালনামণ্ডলীর মাধ্যমেই। আর সেটা কোম্পানি-শাসনের মাধ্যমেই শুধু অর্জন সম্ভব। মিলকে তখন এ প্রশ্নও করা হয়েছিল- রাজকার্যে নেটিভদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তার মত কী? নেটিভরা কি ঔপনিবেশিক সরকারের উচ্চতর বা উচ্চতম পর্যায়ে কখনো যেতে পারবে, বা সেটা হলে ইংরেজ রাজশক্তির ওপর ‘নির্ভরশীলতার’ অবস্থা তখন কোথায় দাঁড়াবে? এ ক্ষেত্রে তার স্পষ্ট উত্তর ছিল, প্রথমত, নেটিভদের যোগ্য করে তুলতে যাবতীয় প্রচেষ্টা নিতে হবে, এবং নেটিভদের মধ্যে যোগ্য লোক পাওয়া গেলে উচ্চতর পর্যায়েও তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, ‘এখনও যদিও ভারতবর্ষ সে’ অবস্থায় পৌঁছায়নি, কিন্তু একদিন যাতে সে অবস্থায় পৌঁছায় সে চেষ্টা শাসকদের তরফ থেকে থাকতে হবে।’ নইলে তাদের বর্তমান (ঔপনিবেশিক) শাসনের পক্ষে ‘নৈতিক কোনো যুক্তি’ থাকে না। অবশ্য মিল এ ক্ষেত্রে উচ্চতর পর্যায়ে ‘সামরিক’ ও ‘বেসামরিক’ নিযুক্তির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন :’সামরিক বাহিনী পরিচালনার ক্ষেত্রে নেটিভদের বিজড়িত করা যায় না। কেননা, সে ক্ষেত্রে ব্র্রিটিশ রাজত্ব বজায় রাখা সম্ভবপর হবে না। তবে সিভিল প্রশাসনের এক বড় অংশ নেটিভদের জন্য খুলে দেওয়া খুবই সম্ভব; কোনোরূপ ঝুঁকি ছাড়াই।’ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য করা যায় কি-না- এ প্রশ্নের উত্তরে মিল বলেছিলেন, ‘নেটিভদের থেকে গভর্নর জেনারেল হয়তো কাউকে বানানো যাবে না, তবে সময়ের সাথে সাথে অনেক উচ্চতর পদেই তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আশা করা যায়, ততদিনে তারা এসব পদে যাওয়ার জন্য যোগ্য ও বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে। এ রকম একটি পরিবর্তন আনা শুধু সম্ভবই না; আমাদের ওপরে দায়িত্বও এসে বর্তায় এ রকম কিছু করার।’ সে প্রেক্ষিতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে- এ প্রশ্নের জবাবে মিলের উত্তর ছিল- ‘এ রকম অবস্থাতেও ভারতে ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত থাকবে যদি আমরা সতর্কতার সাথে বিষয়টা পরিচালনা করতে পারি, অন্তত ততদিন পর্যন্ত, যতদিন-না নেটিভরা আমাদের সাহায্য ছাড়াই অনুরূপ সরকার ব্যবস্থা চালানোর ক্ষেত্রে উপযুক্ত হয়ে উঠছে।’

এখানে এসে মিলের প্রতিদ্বন্দ্বী মেকলে সাহেবের ‘দ্য প্রাউডেস্ট ডে’ তত্ত্বের অনুবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। একে ‘নমনীয় সাম্রাজ্যবাদ’-এর অবস্থান হিসেবে ভাবতে পারেন কেউ কেউ। বা হাল আমলের ‘সফট পাওয়ার’ তত্ত্বের পূর্বলেখও পাওয়া যেতে পারে এতে। নামকরণ যা-ই হোক, লিবারেল মিল-এর কুশলী যুক্তির জাল বিস্তারের উদ্দেশ্য পরিস্কার :সাম্রাজ্যবাদকে বাদ দিয়ে নয়, বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে সতর্কতার সাথে নমনীয় ও সূক্ষ্ণভাবে পরিচালনা করতে হবে।

সভ্য জাতির ‘সভ্যতার’ সংজ্ঞা কী ছিল, মিলের চিন্তায় এ প্রশ্ন এখানে ওঠা স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের ওপরে ব্রিটিশ জীবনযাত্রা চাপিয়ে দেওয়াকে মিল সভ্য হয়ে ওঠার মাপকাঠি ভাবতেন না। ভারত আরেকটা ইংল্যান্ড হয়ে উঠুক- সেটা তার কাম্য ছিল না। মেকলে সাহেবের মতো তিনি কখনো (অন্তত স্পষ্ট করে) বলেননি কোথাও যে, ভারতবর্ষীয়রা কালক্রমে ‘বাদামি সাহেবে’ পরিণত হলে ব্রিটিশ শাসনের নৈতিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে। মিলের মতে, ইংরেজ প্রোটেস্টান্টরা যেমন তাদের সন্তানদের রোমান ক্যাথলিক সেমিনারিতে পাঠাতে চান না, ভারতবর্ষীয়রাও তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে খ্রিষ্টান বানাতে চাইবে না; এটাই স্বাভাবিক। ১৮৩০-এর দশকে অ্যাংলিসিস্ট বনাম ওরিয়েন্টালিস্ট বিতর্কের কালে তরুণ মিল কলম ধরেছিলেন ওরিয়েন্টালিস্টদের পক্ষে; বাবা জেমস মিলের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে। মিলের কাঙ্ক্ষিত আদর্শ ‘সভ্য জাতির’ গুণাবলির তালিকায় ছিল সর্বজনমান্য সব বৈশিষ্ট্য- রুল অব ল, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, অপরাধের অবসান, অন্যায়ের প্রতিকার, পরমতসহিষ্ণুতা, অসুখ, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সমবায়ী উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি। ফুকোর লেখা থেকে এখন আমরা জানি- নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা এটা বিভিন্নভাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন- এসব আপাত নিরীহ সুশাসনমূলক ও উন্নয়ন-উদ্যোগ সভ্যতা প্রতিষ্ঠার নামে আধুনিক রাষ্ট্রক্ষমতার কাছে বশ্যতা বা নতি স্বীকার করাকেই জায়েজ করেছে। মিল এখানে ফুকো-কথিত গভর্নমেন্টালিটিকেই ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এর পরিণতি সাধারণ মানুষের জন্য সুখকর হয়নি।

এমনকি মিল-শিষ্য বঙ্কিমের তা দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমরা দেখাইলাম যে, ব্রিটিশ রাজ্যকালে ভূমিসংক্রান্ত যে সকল আইন হইয়াছে, তাহাতে পদে পদে প্রজার অনিষ্ট হইয়াছে। প্রতি বারে দুর্বল প্রজার বল হরণ করিয়া আইনকারক বলবান জমীদারের বলবৃদ্ধি করিয়াছেন। তবে জমীদার প্রজাপীড়ন না করিবেন কেন?’ এমনকি রুল অব লর প্রবল প্রবক্তা মিলের বিরুদ্ধে গিয়ে সবিস্তারে জানাচ্ছেন, ‘কেন আইন আদালতে কৃষকের উপকার’ হয় নাই। প্রথমত, মোকদ্দমা অতিশয় ব্যয়সাধ্য। দ্বিতীয়ত, আদালত প্রায় দূরস্থিত, আর ‘যাহা দূরস্থ, তাহা কৃষকের পক্ষে উপকারী হইতে পারে না।’ তৃতীয়ত, বিলম্ব- ‘সকল আদালতেই মোকদ্দমা নিষ্পন্ন হইতে বিলম্ব হয়’, আর ‘বিলম্বে যে প্রতিকার, সে প্রতিকারকে প্রতিকার বলিয়া বোধ হয় না।’ চতুর্থত, ঔপনিবেশিক আইনের ‘অযৌক্তিকতা ও জটিলতা’। পঞ্চমত, বিচারকবর্গের অযোগ্যতা, যাহার মধ্যে অধিকাংশই ইংরেজ।”

এসব উল্লেখ করার পর বঙ্কিম যুক্তি দিচ্ছেন, এর পরও আমরা যদি ভাবি, ‘আমরা বড় সন্তুষ্ট হইলাম- কেননা, জুরির বিচার হইয়াছে- বিলাতি প্রথানুসারে বিচার হইয়াছে- আমরা বড় সভ্য হইয়া উঠিয়াছি’; তাহলে এর চেয়ে ভ্রমাত্মক আর কিছুই হতে পারে না।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৭] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৭

[গত সংখ্যার পর]
দ্বিতীয়ত, এই সাংস্কৃতিক নব-জাগরণের ওপরে বিশ্ব-সভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধরেরা অন্তরীক্ষ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন। এর পেছনে বোদলেরীয় ক্লেদজ কুসুমের অবক্ষয়ের ছায়া যেমন ছিল, তেমনি ছিল শানিত সমাজ-মনস্কতা। সার্ত্রে ও কাম্যুর অস্তিত্ববাদ, ফ্রয়েডের মনোবিকলন ও মার্কসের সমাজ-ইতিহাস সচেতনতা একই সাথে ক্রিয়াশীল ছিল ষাটের দশকের কবিতায়। লালনও ছায়া হয়েছিলেন। ফুলের মৃত্যু না হলে দুঃখে-বিরহে যেমন কবিতার জন্ম হয় না; কবির মৃত্যু না হলে তেমনি কষ্টে-শোকে ফুলের জন্ম হয় না- এ রকম সম্ভাবনার কথা কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার একটি প্রবন্ধে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ষাটের কবিকুলের জন্য অবক্ষয়বোধ ও সমাজ-বদলের নিগূঢ় অভিপ্রায় তেমনি পরস্পর-বিরোধী না হয়ে সম্পূরক সত্তার মতো কাজ করেছিল। পূর্বাপর অনিবার্য ঋতুবদল বা ভাবান্তর হিসেবেই তা চিহ্নিত হয়েছিল। যদিও নানাবিধ উৎস থেকে আলো এসে পড়েছিল এই কবিদের ওপরে, কিন্তু তারা ছিলেন নিজ নিজ ভুবনের সপ্রতিষ্ঠ কারিগর। প্রেরণা-তাড়িত হয়ে তারা তাদের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোকে লিখেছিলেন, যার সাথে পাকিস্তানের রাষ্ট্র, ইতিহাস, দর্শন ও রাজনীতির আমূল বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তৃতীয়ত, যে-অর্থে এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড ও জয়েসের ইউলিসিস বিশের দশকে পাশ্চাত্য আধুনিকতার জন্ম দিয়েছে, ষাটের দশকের বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার ধারাও তেমনিভাবে পাকিস্তানি ভাবধারার বিরুদ্ধে এক অনাস্বাদিত আধুনিকতার, শিল্পরুচির ও বোধের জন্ম দিয়েছিল, যার পরিণতিতে সম্ভাব্য মনে হয়, বা সম্ভবতার হয়ে উঠেছিল বাহাত্তরের রাষ্ট্র, সংবিধান ও আজকের বাংলাদেশ।

ষাটের দশকের গোটা জীবন-যাপনকেই যেন একটি মায়াবী আয়নার মধ্যে- তার সমস্ত অমঙ্গলবোধ ও শুভত্বের বাসনা নিয়ে- প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেদিনের কবি-সাহিত্যিকেরা। অবাস্তব অমার্জনীয় মনে হয়েছিল সেদিনের পাকিস্তানি রাষ্ট্র-ব্যবস্থার আইন-টাইন, কানুন-কালাকানুন, বেশ-পরিবেশ। অলক্ষ্যেই ধসে পড়েছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের যুক্তি। সে জন্যই তারা অনায়াসে কখনও এলিয়টকে আঁকড়ে ধরে, কখনও ভায়েহোকে জড়িয়ে, কখনও রবীন্দ্রনাথের গানে উজ্জীবিত হয়ে, আবার কখনও বোদলেয়ারের কাছে ঋণস্বীকার করে নতুন একটি দেশ-সমাজ প্রার্থনা করেছেন, যেখানে প্রতিটি মানুষ বাধাবন্ধনহীন মুক্ত, সৃষ্টিশীল, রহস্যময়, আপন ভুবনের সম্রাট। বিচ্ছিন্ন, একক, বহিরাগত, অচেনা বলেই এই কবিকুল বৃত্তের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র-সমাজের শাসন ও অনুশাসনকে দেখতে পেরেছিলেন। যা সম্ভব ও বাস্তব তাকে তাদের কাঙ্ক্ষিত বলে মনে হয়নি; আর যা অসম্ভব ও অবাস্তব তাকে তারা শ্রেয়োজ্ঞান করেছেন। প্রতিটি রেনেসাঁই অসম্ভব ও অবাস্তবকে পৃথিবীর মাটিতে ফলদায়ী বৃক্ষের মত লালনের স্বপ্ন দেখেছে। রফিক আজাদের মত ‘অসম্ভবের পায়ে’ নিজেকে উৎসর্গ করেছে। বোদলেয়ার যেমন বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বলেছেন :

‘বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ… ঐ উঁচুতে… ঐ উঁচুতে
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল।’

না ভ্রাতা, না ভগ্নি, না পিতা, না জননী, আমি বা আমরা যে রাষ্ট্রে বাস করতে চাই, তা লালনের রিপাবলিক। এভাবেই আগামীর সমাজ-রাষ্ট্রকে দেখেছেন তারা।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৬] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৬

[গত সংখ্যার পর]

৫.

তবে ষাটের দশকের কবিতার প্রগতিপন্থা অন্যভাবেও সংক্রমিত হয়েছিল। পঞ্চাশের যুগেই বাম-প্রগতিশীল ধারার সাথে জাতীয়তাবাদী ধারার অন্তর্লীন যোগাযোগ গড়ে উঠতে থাকে। সেটা বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে ষাটের দশকে। এই যোগাযোগ রাজনৈতিক আন্দোলনে যেমন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ক্রমশ এক নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে থাকে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠকদের পক্ষ থেকে সচেতনভাবে ‘জাতীয়তাবাদী’ ধারার প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী ধারার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য ছিলেন, তাদের মধ্যে শামসুর রাহমানের নাম প্রথমেই চলে আসবে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা শামসুর রাহমানের সাথে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, প্রেরণা জোগাতেন, কোনো বিশেষ দিবস বা উপলক্ষে বাংলার এই প্রতিভাবান কবি যাতে কবিতা লেখেন, সে সম্পর্কে সচেতন প্ররোচনা ছিল তাদের।

যে কোনো কারণেই হোক, ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে শামসুর রাহমানের প্রসঙ্গ আসেনি। এর একটি কারণ হতে পারে, পঞ্চাশের দশকের কবি হিসেবে তার অভ্যুদয়। তবে ঘনিষ্ঠ বিচারে শামসুর রাহমানকে ছাড়া ষাটের কবিতায় আধুনিকতার নির্মাণ ও পুনর্জাগরণের বিষয়টি আলোচনা করা প্রায়-অসম্ভব। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। সে হিসেবে, বাংলা কবিতার ষাটের দশক তার হাত দিয়েই শুরু। বস্তুত, ষাটের দশকেই বের হতে থাকে সাড়া-জাগানো তার একের পর এক কাব্যগ্রন্থ :রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৬), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮) ও নিজ বাসভূমে (১৯৭০)। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় লেখা ‘বন্দীশিবির থেকে’ (১৯৭২) থেকে পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে যে গোটা ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি-সংগ্রাম তার কবিতার মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে গ্রন্থিত হয়ে এসেছে। রৌদ্র করোটিতেই তিনি লিখেছেন ‘লালনের গান’; রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন কবিতা যখন তার গানকে বেআইনি করা হয়েছে; ভাষা আন্দোলন ও বাংলা কবিতার অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে সমর্থন করে লিখেছেন বিধ্বস্ত নীলিমার ‘বাংলা কবিতার প্রতি’; আয়ুব শাহীর স্বৈরাচার শাসনের ছায়ায় লিখেছেন নিরালোকে দিব্যরথের ‘সকল প্রশংসা তার’; রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে মনে রেখে লিখেছেন ‘টেলেমেকাস’; গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে লিখেছেন নিজ বাসভূমের এক ঝাঁক প্রতিবাদী কবিতা- ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯’, ‘পুলিশ রিপোর্ট’, ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা’, ‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি’, ‘কবিয়াল রমেশ শীল’, ‘কী যুগে আমরা করি বাস’, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’, ‘এ যুদ্ধের শেষ নেই’, অথবা ‘আমি কথা বলাতে চাই’। ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম শামসুর রাহমানের অন্তরঙ্গে-বহিরঙ্গে যেমন অনুভবযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল, তেমনি এসব আন্দোলন-সংগ্রাম নিছক রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে আটকে না থেকে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আইডেনটিটি বা আত্মসত্তা খুঁজে পেয়েছিল তার ও তার সহযাত্রীদের কবিতা-গানের মাধ্যমে।

এইসবই পুরোনো, বহু-চর্চিত প্রসঙ্গ। রাজনীতি ও সংস্কৃতি এ দুইয়ের মধ্যে ইতিহাসের গভীর এরিয়েলে অলক্ষ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে যায়। শামসুর রাহমানের ষাটের দশকের লেখায় ক্রম-বাড়ন্ত রাজনৈতিক, এমনকি শ্রেণি-সচেতনতার যে লক্ষণ দেখতে পাই তার কারণ নিহিত ছিল সে সময়ের পরিবেশে, হাওয়ায়, এমনকি দেয়াল-লিখনে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝি স্পষ্ট হয়। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কবির সাথে দেখা হলে আমি বলি যে আমার বহুদিনের ইচ্ছা যে তিনি যেন সেজার ভায়েহোর একটি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ভায়েহোর কোন কবিতাটির কথা বলছেন? কবিতাটির নাম শুনে তিনি বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বললেন, আপনি হয়তো জানেন না, এই কবিতাটির আদলে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম ষাটের দশকেই, আমার নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থে সেটি আছে। অস্বীকার করব না যে আমি কিছুটা পরিমাণে চমকে উঠেছিলাম। ষাটের দশকের কবি-সাহিত্যিকেরা যারা এ দেশের নব-জাগরণের অধ্যায় নীরবে সৃষ্টি করেছিলেন তাদের পঠন-পাঠনে কোনো খামতি ছিল না। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টির সাথে তাদের যেমন পরিচিতি ছিল, প্রগতিবাদী সাহিত্যের সাথেও তাদের যোগসূত্র ছিল নিবিড়। পেরুর কবি সেজার ভায়েহো মার্কসবাদে অনুপ্রাণিত কবি ছিলেন, ১৯২৮ ও ১৯২৯ সালে পরপর দু’বার তিনি রাশিয়ার নতুন নির্মাণ দেখতে যান, ১৯৩১ সালে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, ১৯৩৬-৩৯ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে তিনি দু’বছর সক্রিয় অংশ নেন জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বাহিনীর বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের অংশ হয়ে। ১৯৩৮ সালে প্যারিসে ৪৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আমি ভেবেছিলাম যে শামসুর রাহমানকে আমি তার সম্ভাব্য অজানা কোনো এক কবির সম্পর্কে আগ্রহোদ্দীপক তথ্য দিচ্ছি। অথচ প্রায় তিন দশক আগেই কবি সেজার ভায়েহো সম্পর্কে জেনেছেন; শুধু জেনেছেন নয়, তার কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের এক শ্রেষ্ঠ কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলাদেশের ষাটের দশকের নব-জাগরণের এমনি ছিল গভীর মানবিক নির্মাণ, যা দেশ-মাটির জলে শেকড় ছাড়লেও অতিক্রম করে গিয়েছিল দেশ-কালের গণ্ডী।

সেজার ভায়েহোর কবিতাটি ছিল এ রকম :

I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in ParisÑ and I don’t step asideÑ
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.

It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.

Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also

with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads… I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in Paris and I don’t step aside
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.

It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.

Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also

with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads…

বিষণ্ণ, অতি-ব্যক্তিক, অমোঘ পরিণতির দিকে ধাবমান, কবি-জীবনের সায়াহ্নকালীন এই উচ্চারণ তরুণতর শামসুর রাহমানের হাতে পড়ে এক অন্য রূপ পেয়েছিল। ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিবেচনা’ কবিতাটির অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি (পাঠক, পুরোটা পড়ে নেবেন, এই ভরসা রাখি) :

‘সেদিনও কি এমনি অক্লান্ত ঝরঝর বৃষ্টি হবে এ শহরে?

ঘিনঘিনে কাদা

জমবে গলির মোড়ে সেদিনও কি এমনি,

যেদিন থাকব পড়ে খাটে নিশ্চেতন,

নির্বিকার, মৃত?

আলনায় খুব

সহজে থাকবে ঝুলে সাদা জামা। বোতামের ঘরগুলো যেন

করোটির চোখ, মানে কালো গহ্বর। জুতো জোড়া

রইবে পড়ে এক কোণে, যমজ কবর। কবিতার

খাতা নগ্ন নারীর মতোই চিৎ হয়ে

উদর দেখিয়ে

টেবিলে থাকবে শুয়ে আর দেয়ালের টিকটিকি

প্রকাশ্যেই করবে সঙ্গম।

যেদিন মরব আমি, সেদিন কি বার হবে, বলা মুশকিল।

শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?

যেবারই হোক,

সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা

না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে, পথঘাট,

পুণ্যবান শবানুগামীরা বড় বিরক্ত হবেন।’

এই সাক্ষাতের আরও কিছুকাল পরে- ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, এ দেশেও বাম-প্রগতিশীল মহলে নানা জিজ্ঞাসার টানাপড়েন দেখা দিয়েছে- কবির সাথে তার শ্যামলীর বাসায় দেখা হয়েছিল। এসব ভাঙন, বিলুপ্তিবাদ, অস্থিরতা কবির ভালো লাগেনি। বেশ জোরের সাথেই অনুযোগ করেছিলেন, ‘এখন তো আর পার্টির থেকে কেউ আমার কাছে আসে না। আগে তারা কত আসতেন, আমাকে দিয়ে তারা কত কবিতা লিখিয়েছেন। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে।’

৬.

এবার বোধহয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। এই প্রবন্ধটিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইটিকে উপলক্ষ করে ষাটের দশকের কবিতা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছি। প্রথমত, বলার কথা ছিল এই যে, ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলন তথা আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রাম এমনিতেই সফলতা পায়নি। ‘আন্দোলন’ যে ‘মুক্তি-সংগ্রামে’ পরিণত হয়েছিল তার পেছনে যেমন অর্থনীতিবিদদের গড়া ‘দুই-অর্থনীতি’ শীর্ষক বৈষম্যের তত্ত্ব যুক্তি-ভিত্তি জুগিয়েছিল ষাটের দশকের শিল্প আন্দোলন, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার আন্দোলনও কাজ করে থাকবে। আধুনিক বাংলা কবিতার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন সাংস্কৃতিক নব-জাগরণের ধারার সাথে যুক্ত হয়েছিল। ষাটের দশকের ‘রেনেসাঁ’ ছাড়া আমরা বিশ্বতালে তাল রেখে চলা শিখতে পারতাম না, আমাদের সেই বিরল আত্মবিশ্বাসটুকু আত্মস্থ হতো না যেটি না আসলে একটি সংগ্রামরত জাতি জগৎ-সম্মুখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, যেমন পারে না একটি অর্বাচীন বালক ভাব প্রকাশের ভাষাহীন হয়ে সৃষ্টিশীল হতে, শত মেধা থাকা সত্ত্বেও। ষাটের দশকের কবিতার ভুবন, তার শিল্পলোক, সেই বালকটিকে এক মেধাসম্পন্ন জাগতিক সম্ভাবনার একটি আত্মনির্ভর পাটাতন দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে একটি জাতি-নির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায়।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল