[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৯] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৮

আমার দ্বিতীয় পছন্দ হলো, মহিউদ্দিন আলমগীরের ‘ফেমিন ইন সাউথ এশিয়া : পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাস স্টারভেশন’। এটি ১৯৮০ সালে প্রকাশিত। আলমগীর বইটি লেখেন যখন তিনি বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৯৭০-এর দশকে। আমার তৃতীয় পছন্দ হলো, ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত মার্টিন র‌্যাভালিয়নের ‘মার্কেটস অ্যান্ড ফেমিনস্‌’। আমার তালিকার চতুর্থ অবস্থানে আছে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ১৯৭৯ সালের প্রকাশিত ‘পলিটিক্স অব ফুড অ্যান্ড ফেমিন ইন বাংলাদেশ’- এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, প্রথম তিনটির মত বই নয় যদিও, কিন্তু চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তথা মার্কিন হস্তক্ষেপের ভূমিকার বিরুদ্ধে উন্মোচনমূলক প্রথম প্রতিবাদ (ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি সাময়িকীতে প্রকাশিত)। সবশেষে উল্লেখ করব অধ্যাপক নূরুল ইসলামের ‘দ্য বার্থ অব এ নেশন : এন ইকোনমিস্ট’স টেল’ বইটির দুর্ভিক্ষ-সংক্রান্ত পরিচ্ছেদটি। এর বাইরে অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী তার একাধিক লেখায় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, সেনের ‘এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টে’র তত্ত্ব এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তত্ত্বীয় দিক নিয়ে বিশদভাগে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, বাংলা ১১৭৬ সালের বা বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তর নিয়ে যেখানে গবেষণাপত্রের অপ্রতুলতা রয়ে গেছে, ইংরেজি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সে প্রেক্ষিতে- বিভিন্ন নিরিখের কাজের মধ্য দিয়েই- এক বহুল আলোচিত বিষয়।

এসব লেখা-পত্র থেকে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের প্রভাবক ও কার্যকারণ সম্পর্কে যেসব প্রবণতা মোটা দাগে বেরিয়ে আসে তা নিম্নরূপ। প্রথমত, উপর্যুপরি বন্যার তীব্র আঘাত। ব্রহ্মপুত্র সে বছর যেন ফুঁসে উঠেছিল। অন্যান্য নদ-নদীর পানিও অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ছিল। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের শেষের বন্যায় আউশ ধানের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। ১৭ই জুলাই দেশের সব বড় নদীগুলোর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে, অর্থাৎ আউশ ফসল ওঠার মৌসুমেই বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ে ধানক্ষেতে-মাঠে। এই ক্ষতিটা সামাল দেওয়া যেত আমন ধানের আবাদের মাধ্যমে। কিন্তু আউশ ধান নষ্ট হওয়ার ১৫ দিনের মাথায়- অর্থাৎ জুলাইয়ের শেষে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই পানি আবার হুহু করে বাড়তে থাকে। যেসব জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি হচ্ছিল সেগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। ১লা আগস্ট চট্টগ্রাম ও সিলেটের সাথে ঢাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বন্যার পানি বেড়ে ওঠার কারণে। ১১ই আগস্ট নাগাদ ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের সমস্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আগস্টের মাঝামাঝি বন্যার পানি বাড়তে বাড়তে সে বছরের রেকর্ড-উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছে। এতে করে নতুন বোনা আমন ধানের একটা বড় অংশ ক্ষতির কবলে পড়ে। কিন্তু মূল আঘাতটা আসে সেপ্টেম্বরে। এ সময় বন্যার পানি ধীরে ধীরে জমার কথা। কিন্তু সে বছর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আবারো বিপদসীমা অতিক্রম করে। এতে করে আগস্ট মাসের বন্যার পরে যতটুকু আমন ধান বেঁচেছিল সেটুকুও (রোপা আমনের অধিকাংশ) বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। এ রকম উপর্যুপরি বন্যার আঘাতের পর সেপ্টেম্বরের শেষে এসে দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হওয়ার সরকারি ঘোষণা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না সেদিন।

দ্বিতীয়ত, প্রায় ৬ হাজারের মতো লঙ্গরখানা খোলা না হলে আরো অনেক মৃত্যু আমাদের দেখতে হতো। সন্দেহ নেই। তবে আরো বেশি সংখ্যায় এবং দীর্ঘদিনের জন্য লঙ্গরখানা খোলার/চালু রাখার জন্য চাই প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের মজুদ, আর সেই মজুদের সরকারি ক্ষমতা কমে গিয়েছিল সে বছর আন্তর্জাতিক তথা মার্কিন ষড়যন্ত্রে। ১৯৭৩ সাল থেকেই বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য ‘সাহায্য’ (ফুড এইড) হিসেবে দেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মার্কিন সরকার। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে অবস্থাটা এত গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যে, বাংলাদেশ বাধ্য হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে খাদ্য সাহায্যের অনুরোধ জানাতে। রাশিয়া ছিল নিজেই আমেরিকা ও কানাডা থেকে খাদ্যশস্যের এক বড় আমদানিকারক। প্রায় ২ লক্ষ টন খাদ্যশস্য রাশিয়ার ক্রীত মজুদ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের সাহায্যার্থে প্রেরণের জন্যে এক জরুরি অনুরোধ জানানো হয়। রাশিয়া সেই ডাকে তখন সাড়াও দেয়। নইলে, ১৯৭৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসেই সেদিন এ দেশের পাবলিক রেশন প্রদানের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। যুক্তরাষ্ট্রের বিরূপ নীতির ফলে (নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র তখন রাষ্ট্র-ক্ষমতায়) সে দেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানির ধারা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের আগে থেকেই ছিল নিম্নাভিমুখী। এর ফলে ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে বাংলাদেশের মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল গড়ে মাসে ২ লাখ ৩২ হাজার টন, ১৯৭৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের মার্চ পর্যন্ত তা নেমে আসে গড়ে মাসে ৭৪ হাজার টনে মাত্র। অর্থাৎ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কয়েক মাস আগে থেকেই খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এর একমাত্র বিকল্প হতে পারত আন্তর্জাতিক বাজারে গিয়ে সরাসরি খাদ্যশস্য কেনা। কিন্তু সেখানেও খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে- ১৯৭২-৭৩ সালে যার দাম ছিল টনপ্রতি ১১৫ ডলার, ১৯৭৩-৭৪ সালে তার দাম গিয়ে দাঁড়ায় টনপ্রতি ১৯৯ ডলারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য কেনার মত যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না সরকারের হাতে সেদিন। ১৯৭৩ সালের ২য় ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল যেখানে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭৪ সালের ২য় ত্রৈমাসিকে সেই রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬০ মিলিয়ন ডলারে। দুর্ভিক্ষ যখন চলছিল, সেই ৩য় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে যায়- সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ৪০ মিলিয়ন ডলারে। বাড়তি খাদ্যশস্য সাহায্য পাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সেদিন খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ বাড়ানোর জন্যে। কিন্তু সে সম্ভাবনাও বানচাল হয়ে যায় যখন কিউবায় পাট রপ্তানি করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ- এই অজুহাতে খাদ্যশস্য রপ্তানি করা বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলার দাবি রাখে।

১৯৭৪ সালের ২৯শে মে (এরই মধ্যে তীব্র মৌসুমী বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বিধ্বংসী বন্যা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। অকস্মাৎ ডেভিড বোস্টার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের কাছে জরুরি সাক্ষাৎকার চাইলেন। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবায় ৪০ লক্ষ পাটের ব্যাগ রপ্তানির পরিকল্পনা করছে, এ রকম খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে বলে বোস্টার জানতে পেরেছেন। এটা করা হলে মার্কিন খাদ্যশস্য ‘সাহায্যের’ নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ কোনো খাদ্য-সাহায্য পাবে না। ‘পাবলিক ল ৪৮০’ অনুযায়ী শত্রু দেশ ভিয়েতনাম ও কিউবার সাথে বাণিজ্য করা কোনো দেশ মার্কিন খাদ্য-সাহায্যের সুবিধে পাবে না। এটাই সে দেশের কংগ্রেসের বিধান। তখন বোস্টারকে জানানো হল যে, (ক) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের শোচনীয় পরিস্থিতি লাঘবের জন্যে হলেও এই পাট রপ্তানি করা দরকার, এবং (খ) চাইলে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে ‘অনুমতির অব্যাহতি’ (ওয়েভার) দিতে পারেন, বিশেষত যেখানে ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ কৃষিপণ্যই কেবল রপ্তানি করা হচ্ছে দরিদ্র বাংলাদেশ থেকে। তাতে মার্কিন পক্ষের অবস্থান নমনীয় হল না। রাষ্ট্রদূত বোস্টার সাফ জানিয়ে দিলেন, যদিও পাটের থলি হয়তো বা ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ কৃষিপণ্য, তবুও প্রেসিডেন্টের কথিত ‘ওয়েভার’ মেলার কোনো সম্ভাবনাই নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের উত্তরে হতবাকই হয়েছিল। কেননা, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের পর থেকেই কিউবার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হচ্ছিল এবং সে সম্পর্কে গোড়া থেকেই মার্কিন কূটনীতিবিদেরা ওয়াকিবহাল ছিলেন। তদুপরি, প্রায় একই সময়ে মিসর যখন কিউবায় রপ্তানি করছিল, তখন তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। মিসর থেকে কিউবায় তুলা রপ্তানিতে সেদিন কোনো বাধা ওঠেনি; কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাট রপ্তানিতে সেদিন প্রবল বাধা উঠেছিল। এই রহস্যের উত্তর খোঁজাও দুস্কর নয় : কিসিঞ্জারের কাছে আনোয়ার সাদাতের ‘মিসরকে’ হাতে রাখা জরুরি ছিল। আর বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া বাংলাদেশকে চাপের মুখে রেখে নতি-স্বীকার করানোর কিসিঞ্জারী নীতি পূর্বাপর তৎপর ছিল। এ কথা ক্রিস্টোফার হিচেনস তার ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয়ত, শুধু খাদ্যশস্যের সামগ্রিক মাথাপিছু প্রাপ্যতার বিষয়টিকে চুয়াত্তরের ‘দুর্ভিক্ষের ব্যাখ্যা’ হিসেবে নিলে সরলীকরণ করা হবে। প্রাপ্যতা একটি নির্ণায়ক, একমাত্র, এমনকি প্রধান নির্ণায়ক নাও হতে পারে। ১৯৭৪ সালের উপর্যুপরি বন্যায় প্রচুর ফসলহানির পরেও এটা বলা যেতে পারে। যেমন, ১৯৭৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতার (উৎপাদন+আমদানি) পরিমাণ ছিল ১১.৫৭ মিলিয়ন টন, ১৯৭৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৩৬ মিলিয়ন টনে। মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতার পরিমান (availability) ১৯৭৩ সালে ছিল দৈনিক ১৫.৩ আউন্স, যা ১৯৭৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় দৈনিক ১৫.৯ আউন্সে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দেখলে দুর্ভিক্ষের বছরে মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা এর আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি বৈ কম ছিল না। জেলা পর্যায়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিসংখ্যানও এ তথ্যকে বাড়তি সমর্থন দেয়। ১৯৭৩ সালের তুলনায় ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে ছিল প্রায় প্রতিটি জেলাতেই (কেবল বরিশাল ও পটুয়াখালী ছাড়া)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হলো দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে উপদ্রুত তিনটি বৃহত্তর জেলায়- রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে তো যায়ইনি বরং লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এ তিনটি জেলায় মাথাপিছু খাদ্যশস্য প্রাপ্যতাও ছিল ১৯৭৩ সালের তুলনায় বেশি। এর থেকে অমর্ত্য সেন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ‘খাদ্যশস্যের সামগ্রিক প্রাপ্যতা ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষকে ব্যাখ্যা করতে সামান্যই সহায়ক হতে পারে।’ সেনের মতে, সে বছর উপর্যুপরি বন্যার কারণে ভিত্তহীন গ্রামীণ শ্রেণি তথা কৃষিমজুর ও স্বল্পবিত্ত বর্গাচাষিদের কর্মসংস্থানের পরিসর সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাস্তবে কমে গিয়েছিল। সেটাকে পুষিয়ে নিতে পারত পরীক্ষিত ‘পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম’ (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বা রুরাল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ইত্যাদি)। কিন্তু শেষোক্ত ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারেনি দুই কারণে : (ক) সরকারের কাছে ঐ সিস্টেমের মধ্য দিয়ে বণ্টন করার মতো যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না; (খ) ঐ সিস্টেমটি মূলত শহর এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষদের রক্ষার জন্য রেশন-ব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারেই বেশি সচেষ্ট ছিল; (গ) ছয় হাজারের মতো লঙ্গরখানা চালু হলেও তা যথেষ্ট ছিল না ব্যাপক পরিসরে দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য।

চতুর্থত, খাদ্যশস্যের বাজারে বেসরকারি খাতের মজুদদারি প্রবণতাও খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্যকে আরো বেশি করে উস্কে দিয়েছিল। মোটা চালের দামের ইনডেক্স ((Index of retail prices) যদি ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে হয় ১০০, তা আগস্ট মাসে বেড়ে হয় ১২১, সেপ্টেম্বর মাসে তা লাফ দিয়ে চড়ে যায় ১১৫-এ, আর অক্টোবর মাসে তা আরো বর্ধিত হয়ে পৌঁছায় ১৭৮-এ। কেবল মাত্র ডিসেম্বর মাসে তা আবার নেমে দাঁড়ায় ১৩৩-এ। সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসের উচ্চ ও অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধি দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৮] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৮

পূর্ব প্রকাশের পর

৩. [অসুস্থ অবস্থায় মাওলানা ইদরিস শুয়ে আছেন শিয়ালদহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তিনি একা নন, তার পাশে দুর্ভিক্ষে না খেতে পেরে মারা যাচ্ছে এমন অনেকেই শুয়ে আছে। এদেরকে আলাদা করা হয়েছে। এরপর শোনা যাক হুমায়ূনের বর্ণনায়]

‘হাসপাতালে রোগীর জায়গা নেই। স্বেচ্ছাসেবীরা কিছু সাহায্যের চেষ্টা করছে। সেই সাহায্য কোনো কাজে আসছে না। মাওলানাকে সকালবেলা একটা রুটি দেওয়া হয়েছে। মাওলানা রুটি খাননি। রুটি চারপাশে পড়ে আছে, সেখানে পিঁপড়া উঠেছে। মাওলানা আছেন প্রবল ঘোরে। সারাক্ষণই তার মনে হচ্ছে মাথার ভেতর দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে।’

[এরপর একটু যখন ভালো হবেন মাওলানা ইদ্রিস স্বয়ং ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসায়, তার দেখা হয়ে যাবে তরুণ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। তিনি তখন ‘গণদেবতা’ লিখছেন। যিনি কখনও হাদিস-কোরানের বাইরে কোনো গল্প-উপন্যাস পড়েন নাই, তাকে তারাশংকর পড়ে শোনাবেন ‘গণদেবতা’ স্তবক : ‘সোঁ সোঁ শব্দে প্রবল ঝড়। ঝড়ে চালের খড় উড়িতেছে, গাছের ডাল ভাঙিতেছে। বিকট শব্দে ওই কার টিনের ঘরের চাল উড়িয়া গেল।’ এ যেন গল্পের মধ্যে গল্প …]

১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এর প্রভাব সারা বাংলাতেই অনুভূত হয়েছিল। অমর্ত্য সেন তার পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন বইতে লিখেছেন যে, এই দুর্ভিক্ষ অগ্রসর হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় বিস্তৃত ছিল ১৯৪২-র শুরু থেকে ১৯৪৩-র মার্চ পর্যন্ত, যখন আদিগন্ত দুর্ভিক্ষের নগ্ন পদধ্বনি শোনা গেছে। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৪৩ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলেছে; এই পর্বে অনাহারে গ্রাম-বাংলার মানুষ মরতে শুরু করছিল। বিভৃতিভূষণের অশনি-সংকেত প্রথম পর্যায় থেকে শুরু হয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায় চলেছে ১৯৪৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৪ সালের শেষ নাগাদ। এই পর্যায়ে খাদ্য-সংকট পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মৃত্যুর হার কমার পরিবর্তে ক্রমেই বেড়ে চলছিল। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের ‘সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত’ জেলাদের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, নোয়াখালী, ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, মেদিনীপুর, ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলী। ‘মাঝারি ক্ষতিগ্রস্ত’ এলাকার মধ্যে ছিল যশোর, খুলনা ও বরিশাল আর ‘সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত’ জেলাগুলোর মধ্যে ছিল রংপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, নদিয়া প্রভৃতি। অর্থাৎ এ তালিকা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে বিশেষভাবে পীড়িত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের জেলাগুলো। জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা, ঔপনিবেশিক সরকারের চাল মজুদ করার নীতি বা তথাকথিত ‘ডিনায়েল পলিসি’, চালের পণ্যবাহী ছোট-মাঝারি নৌকাগুলো (১০ জনের বেশি লোক উঠতে পারে এমন সব নৌকা) ধ্বংস করে ফেলা এসবই পূর্ববঙ্গের স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যাভাব বাড়িয়ে দিয়েছিল ও দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশরা নিজেরাই তাদের তৈরি উনিশ শতকের ‘ফেমিন কোর্ড’ অনুসরণ করেনি। করলে, পঞ্চাশের মন্বন্তর সহজেই এড়ানো যেত। শেষ পর্যন্ত এ রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন অমর্ত্য সেন।

সংকটটা আরও সহজে সমাধান করা যেত যদি প্রাদেশিক সরকার আরও সচেষ্ট হতো। বাংলায় তখন খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকার। সুব্রত রায়চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের… জনবিরোধী কার্যকলাপের পাশাপাশি… নাজিমুদ্দিন সরকারও মুনাফার মৃগয়ায় মেতে ছিল। এই সময়ে ৬ টাকা বেশি দরে খাদ্য বিক্রি করে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার… ৭৫ লাখ টাকা মুনাফা করে। বেঙ্গল মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইস্পাহানীকে সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় চাল বাংলা থেকে সংগ্রহের জন্য। দুর্ভিক্ষ পরবর্তী ফেমিন কমিশনের কাছে ইস্পাহনী ঐ মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, ১৯৪২ সালের মে মাসের মধ্যেই দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ‘চল্লিশ হাজার মণ’ চাল কিনে তিনি যুদ্ধের জন্য মজুদের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ১৯৪৩ সালের মে মাস নাগাদ এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ‘২,৩৫,৫৫৭ মণ’, যা ইস্পাহানী প্রতি মণ ১৪ টাকা ১২ আনা ৭ পাই দরে বাংলা সরকারের কাছে বিক্রি করেছিল- যখন বাজার মূল্য ছিল ৩২ টাকা মণ। এতে করে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, দুর্ভিক্ষে যখন লোক মারা যাচ্ছে, তখন এত পরিমাণ চাল মজুদ করার অর্থ কী? বোঝাই যাচ্ছে, চার্চিলকে তো বটেই, তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারকেও কিছুটা দায়-দায়িত্ব নিতে হবে এই দুর্ভিক্ষ নিবারণে ব্যর্থতার জন্য। বেঙ্গল মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির সম্পাদক চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি পেছনে রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব না এড়ানোর জন্য লীগ নেতৃবৃন্দকে পরোক্ষভাবে সতর্ক করে দিচ্ছেন। এলা সেনের পূর্বোক্ত বইটি থেকে তা তুলে দিচ্ছি :

From March or April this year (1943) People began to starve because rice had disappeared from the market and the black market rate was so high… it was beyond the reach of the people… Many people had to quit their villages in search of food in the town; these who remained in the villages had to perish… Bengal is threatened with physical extinction and moral collapse. Where will be the Muslim League if hundreds of thousands of Muslims die? What will be the meaning of Pakistan where there will be skeleton-like sub-humans in desolate villages?

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের নিয়ে কি কাঙ্ক্ষিত আদর্শের ‘পাকিস্তান’ গড়ে তোলা যাবে? এই ছিল চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রশ্ন। পরবর্তীতে, দেশভাগের পর মুসলিম লীগ যে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল তারও পেছনে ছিল সাধারণ জনমানুষের খাদ্য-সংকটের যথাযথ মোকাবেলা না করতে পারার ব্যর্থতা। সেটি আমরা বদরুদ্দিন উমরের ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’র সুবাদে অনেক আগেই জেনেছি।

তবে সরকারের বাইরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সমাজের পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় অনেকেই দুর্ভিক্ষের মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিলেন। চট্টগ্রাম ছিল অত্যন্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকা। সেখানে পুর সমাজ, বিশেষত প্রগতিমনা অংশের উদ্যোগে দুর্ভিক্ষ-নিবারণের চেষ্টা হয়েছিল। ‘নিচের থেকে উদ্যোগের এই উদাহরণগুলোকে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা দরকার, এতে করে দুর্যোগ প্রতিরোধে পুর সমাজের সম্ভাব্য তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার দিকটি স্পষ্ট হবে। সব কিছুর জন্য- অনুদান থেকে বিদ্যাদানের প্রয়োজন অবধি- রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভর করার ধারা এক রুগ্‌ণ মানসিকতার পরিচায়ক। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর স্মৃতিচারণ ‘স্মৃতির সন্ধানে’ গ্রন্থটির বিরল একটি অধ্যায়ের নাম ‘যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের খণ্ডচিত্র’। তরুণ মাহবুব উল আলম লিখছেন : ‘ইতোমধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শহরে তিনটি লঙ্গরখানা খুলি এবং কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত বেবি হোমেও নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। … দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণকার্য চালাতে গিয়ে আমি কমিউনিস্ট পার্টির আরও নিকটবর্তী হয়ে ওঠি। … এ ছাড়া আগে থেকেই আমার মামার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল পূর্ণেন্দু দস্তিদার, কল্পনা দত্ত, কল্পতরু সেনগুপ্ত … প্রমুখ কীর্তিমান পার্টি নেতাদের সঙ্গে। … একদিন মা প্রস্তাব করলেন [একজন প্রতিবেশী হিন্দু রমণী যাকে মাতৃহারা মাহবুব উল আলম ‘মা’ বলে ডাকতেন এবং যিনি ভাবতেন ‘পূর্বজন্মে’ মাহবুব নিশ্চয়ই ‘ব্রাহ্মণ ছিলেন’] চল দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্যার্থে আমরা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। … সবাই দুর্ভিক্ষের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমি নতুন মায়ের নির্দেশে কয়েকদিনের মধ্যে একটি নাটক খাড়া করলাম। দুর্ভিক্ষের ওপর বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ … নাটকের কোনো কপি ছিল না। ফলে এই নাটক রচনায় আমি কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সাহায্য নিয়েছিলাম, মনে পড়ে। খুব উৎসাহের সঙ্গে স্থানীয় মুসলিম হলে আমার ‘ভাঙন’ নাটকটি অভিনীত হলো। … অনেক টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। যদ্দুর মনে পড়ে, টাকাটা ত্রাণকার্যে রত বেবি হোমসহ বেশ ক’টি সাহায্য সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল।’

পুর সমাজের পর্যায়ে দুর্ভিক্ষ-নিবারণে ত্রাণকার্য পরিচালিত হলেও দুর্ভিক্ষের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া চলেছি আরও বহু বছর ধরে। ১৯৪৩-৪৪ সালের পটভূমি ও কার্যকারণ সূত্র নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ততটা আলোচনা বা অনুসন্ধান হয়নি। ২০০৭ সালে এসে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘এভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের দিনগুলো শেষ হলো বটে, কিন্তু আমাদের সমাজ জীবনে তাতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষত এত বছর পরেও শুকায়নি।’ এদিকটা গবেষকদের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।

৬. ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ

সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে। ঢাকা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে। রৌদ্র ঝকঝকে দিন। মিরপুর রোড যথারীতি ব্যস্ত। রাস্তার এধারে হকারের বইপত্র দেখছি। পাশে ন্যুমার্কেটগামী রিকশার ভিড়। রাস্তার ওধারে ২ টাকা দামের কিমা পরোটা ভাজা হচ্ছে, তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। হঠাৎ করে চোখে পড়ল এই শাহরিক ব্যতিব্যস্ততার মধ্যে একজন তিরিশ-ঊর্ধ্ব নারী টেনে টেনে রাস্তা পার হচ্ছেন। হেঁটে নয়- শুয়ে, নিজেকেই ক্লান্তভাবে টানছেন। তার পরনে কোনো কাপড় নেই! এ রকম দৃশ্য এর আরে আমি কখনও দেখিনি। গল্পের বইতেও পড়িনি। আমার ধারণা, ঢাকা শহরও এর আগে এ রকম হতবাক করা দৃশ্য এর আগে কখনও দেখেনি। এর পরে যথারীতি আমার বাস এল। সেটায় চড়ে বাড়ি ফিরে গেছি আর সব দিনের মত। কিন্তু দৃশ্যটা এখনও জীবন্ত হয়ে আছে মনে। জিজ্ঞেস করাতে কে একজন বলল, ‘বুঝলে না। দুর্ভিক্ষ চলছে রংপুরে। এরা সেই রংপুর থেকে খাবারের খোঁজে ঢাকা শহরে চলে এসেছে।’ এরপর যতবার গেছি ঐ জায়গা দিয়ে, প্রতিবারই মনে পড়েছে সেই অজানা অনাল্ফম্নী নারীর কথা। সে বেঁচেছিল কিনা সে বছর, অথবা এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না। মহিউদ্দিন আলমগীরের হিসাব উদ্ৃব্দত করে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল প্রায় পনেরো লাখ মানুষ।’ হতে পারে, সেই নারী প্রায় ছয় হাজার লঙ্গরখানার একটিতে আশ্রয় পেয়েছিল, অথবা হতে পারে, সেই আশ্রয় পাওয়ার পরেও সে বাঁচতে পারেনি। মানুষ তো শুধু ক্ষুধায় মারা যায় না, এর সাথে জড়িয়ে থাকে, কত নিগ্রহ-অসম্মান, কত অসুখ-বিসুখ। এ জন্যেই বলে ‘নারী ও মন্বন্তর’। আমার নিজের ধারণা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের যে প্রজন্ম নিজেদের ‘লস্ট জেনারেশন’ ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল, তার পেছনে ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের এক দীর্ঘ প্রলম্বিত প্রভাব ছায়া ফেলে থাকবে। স্বাধীনতা-উত্তর যৌবনিক উচ্ছ্বাসের আনন্দময় মুহূর্তগুলো সাময়িককালের জন্যে হলেও ঢেকে গিয়েছিল দুর্ভিক্ষজনিত আতঙ্ক, বিষাদ ও হতাশায়। তর্ক উঠলেও বলা যেতে পারে, সামাজিক মূল্যবোধের প্রকৃত অবক্ষয়ের শুরু সেই থেকে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখালেখির শেষ নেই। এর কার্যকারণ, মৃত্যুর ব্যাপ্তি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফ্যাক্টরের তুলনামূলক গুরুত্ব এ নিয়ে আজও চর্চা হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল পাঁচটি রচনার এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমেই আসবে অমর্ত্য সেনের ‘প্রভাটি অ্যান্ড ফেমিন’ গ্রন্থটি, যার কথা এর আগে বলেছি। এটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৭] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৭

পূর্ব প্রকাশের পর

এত বেড়ে যাওয়ায় গঙ্গাচরণ যাও-বা কিছু কিনতে পারলো, নবীন পাড়ূই কিছুই কিনতে পেল না। মাছ ধরে তার যা উপার্জন তাতে করে তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে খাদ্যশস্যের মূল্য। কীভাবে অমর্ত্য সেন কথিত ‘এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টের’ দ্রুত অবনতি হচ্ছিল, তার বিবরণ মেলে তাদের কথায়]

‘গঙ্গাচরণ বললে- নবীন, চাল নেবে না?

– না বাবাঠাকুর। একটা সিকি কম পড়ে গেল।

– তবে তো মুশকিল। আমার কাছেও নেই যে তোমাকে দেবো।

– আধসের পুঁটিমাছ ধরেলাম সামটার বিলে। পেয়েলাম ছ’আনা। আর কাল মাছ বেচবার দরুন ছেল দশ আনা। কুড়িয়ে-বুড়িয়ে একটা টাকা এনেলাম চাল কিনতি। তা আবার চালের দাম চড়ে গেল কী করে জানব?

– তাই তো!

আধপেটা খেয়ে আছি দু’দিন। চাষিদের ঘরে ভাত আছে। আমাদের তা নেই। আমাদের কষ্ট সকলের অপেক্ষা বেশি। জলের প্রাণী, তার ওপর তো জোর নেই? ধরা না দিলে কী করছি! যেদিন পালাম সেদিন চাল আনলাম। যেদিন পালাম না সেদিন উপোস। আগে ধান-চাল ধার দিত। আজকাল কেউ কিছু দেয় না।’

৩. [চাল-সংগ্রহ অভিযানের কারণে অনেক বড় বড় দোকানেও কেনার জন্য চাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না]

‘কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার। বড় বড় তিন-চারটি দোকান খুঁজে বেড়ালে, সকলেরই এক বুলি- চাল নেই। গঙ্গাচরণের মনে পড়লো বৃদ্ধ কুণ্ডু মশায়ের কথা। …কিন্তু সেখানেও তথৈবচ। গঙ্গাচরণ দোকানঘরটিতে ঢুকবার সময় চেয়ে দেখলে বাঁ পাশের যে বাঁশের মাচায় চালের বস্তা ছাদ পর্যন্ত সাজানো থাকে। সে জায়গা একদম খালি। হাওয়া খেলচে।…

গঙ্গাচরণ বললে- কিছু চাল দিতে হবে।

– কোথায় পাব, নেই।

– এক টাকার চাল, বেশি নয়। এই লোকটাকে উপোস করে থাকতে হবে। দিতেই হবে আপনাকে।

কুণ্ডু মশায় সুর নিচু করে বললে- সন্ধ্যের পর আমার বাড়িতে যেতে বলবেন, খাবার চাল থেকে এক টাকার চাল দিয়ে দেবো এখন।

গঙ্গাচরণ বললে- ধান-চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?

– কী করব বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুট হওয়ার পর কী করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন! সবারই সে দশা। তার ওপর শনচি পুলিশে নিয়ে যাবে চাল কম দামে মিলিটারির জন্য।…

– আমরা না খেয়ে মরব?

– যদিন থাকবে, দেবো। …

– …বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক, নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে! কী খেয়ে বাঁচবে মানুষ?

– বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কনটাকটারদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি। এই রকম অনেকেই করেচে খবর নিয়ে দেখুন।’

৪. [মতি মুচিনী মারা যাচ্ছে। গঙ্গাচরণকে গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘বড্ড জ্বর দাদাঠাকুর, তিন দিন খাইনি, দুটো ভাত খাব।’ তার পরের বিবরণী বিভূতিভূষণের লেখাতেই শুনুন]

‘অনঙ্গ-বৌ শুনতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কিন্তু সেও অত্যন্ত দুর্বল। উঠে মতির কাছে যাওয়ার শক্তি তারও নেই!

বললে- ওগো মতিকে কিছু খেতে দিয়ে এসো-

– কী দেবো?

– দুটো কলাইয়ের ডাল আছে ভিজনো। এক মুঠো দিয়ে এসো।

– ও খেয়ে কি মরবে? তার জ্বর আজ কত দিন তা কে জানে? মুখ-হাত ফুলে ঢোল হয়েচে। কেন ও খাইয়ে নিমিত্তের ভাগি হবো!

খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো অনঙ্গ। কিন্তু অন্য কিছুই ঘরে নেই। কী খেতে দেওয়া যায়, এক টুকরো কচু ঘরে আছে বটে, কিন্তু তা রোগীর খাদ্য নয়। … ভেবেচিন্তে অনঙ্গ-বৌ বললে- হ্যাঁ গা, কচু বেটে জল দিয়ে সিদ্ধ করে দিলে রোগী খেতে পারে না?

– তা বোধ হয় পারে। মানকচু?

[ব্রাহ্মণ পণ্ডিত স্কুলের শিক্ষক গঙ্গাচরণের উনোনেরই যদি এই দশা হয় আরও নিম্ন-আয়ের সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হচ্ছিল, তা এর থেকে অনুমেয়।]

৫. [অবশেষে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর ঘটনা সত্য বলে প্রমাণ হলো। বিভূতিভূষণ তার অননুকরণীয় বর্ণনার সেই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা লিখছেন। সে বর্ণনা চার্চিল-কেইনস্‌ বা ঔপনিবেশিক ভারতের ভাইসরয়রা কেউ পড়েননি, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনিসংকেত’ ছবির কল্যাণে পরে মতি মুচিনীর মৃত্যুসমগ্র পশ্চিমা জগতে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল]

‘গ্রামে থাকা খুব মুশকিল হয়ে পড়লো মতি মুচিনীর মৃত্যু হওয়ার পরে। অনাহারে মৃত্যু এই প্রথম। এর আগে কেউ জানত না বা বিশ্বাসও করেনি যে অনাহারে আবার মানুষ মরতে পারে। এত ফল থাকতে গাছে গাছে, নদীর জলে এত মাছ থাকতে, বিশেষ করে এত লোক যেখানে বাস করে গ্রামে ও পাশের গ্রামে, তখন মানুষ কখনও না খেয়ে মরে? কেউ না কেউ খেতে দেবেই। না খেয়ে সত্যিই কেউ মরবে না।

কিন্তু মতি মুচিনীর ব্যাপারে সকলেই বুঝলে, না খেয়ে মানুষে তাহলে তো মরতে পারে। এত দিন যা গল্পে-কাহিনীতে শোনা যেত, আজ তা সম্ভবের গণ্ডির মধ্যে এসে পৌঁছে গেল। কই, এই যে একটা লোক মারা গেল না খেয়ে, কেউ তো তাকে খেতে দিলে না? কেউ তো তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলে না? সকলের মনে বিষম একটা আশঙ্কার সৃষ্টি হলো। সবাই তো তাহলে না খেয়ে মরতে পারে!’

‘অশনিসংকেত’ ছাড়াও সে সময়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তার ‘মন্বন্তর’ উপন্যাস (দুর্ভিক্ষের ওপরে লেখা বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকটি তখনই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল)। ১৯৪২ সালের শীত-মৌসুমের খাদ্যশস্য বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেল দক্ষিণ বঙ্গের জেলাগুলোতে। ‘মন্বন্তরে’ তারাশঙ্কর লিখেছেন :’লোক কয়েকটি মেদিনীপুরের অধিবাসী। ঘরবাড়ি ভেঙে মাটির ঢিবি হয়ে গেছে, গরু-বাছুর ভেসে গেছে, জলোচ্ছ্বাসে জমির বুকে চাপিয়ে দিয়েছে বালির রাশি। অন্ন নেই- এমনকি তৃষ্ণা মিটিয়ে জলপান করবারও উপায় নেই- জল লবণাক্ত হয়ে গেছে।’ এই বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষের প্রাগ-পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। মন্বন্তরে বিজয়দা নীলাকে লিখছে :’এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি- ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজন্মা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত দান টেনে নিচ্ছে।’ মন্বন্তর উপন্যাসটি সমসাময়িকতায় বিদ্ধ হলেও আদর্শ প্রচারের কারণে ততটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারাশঙ্কর একদিকে মহাত্মার অনুসারী, অন্যদিকে বামপন্থি চিন্তাধারার প্রভাবও স্বীকার করে নিচ্ছেন। এ দুইয়ের মিলিত উচ্ছ্বাস মাঝেমধ্যেই তার পাত্র-পাত্রীদের কথার মধ্যে উপচে পড়ে। একটি উদাহরণ দিই, শহর কলকাতায় তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত জনস্রোত ঢুকে পড়েছে। বাকিটা তারাশঙ্করের বর্ণনায় শুনুন :

‘নীচে পথর উপর থেকে ক্ষীণ কাতর কণ্ঠে ডাক উঠল- ভাত দাও মা চারটি, বাসি ভাত! নীলা এবং কানাইয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। এ মন্বন্তর শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাসাটা তাদের কাছে অপরাধ বলে মনে হলো।

বিজয়দা লেখা সমাপ্ত করে বললো- কানাই ভাই, এইবার কাজে নেমে পড়ো, নীলা ভাই, কমরেডের সঙ্গে তুমিও লেগে পড়ো। …

নীলা এবার বললে- বলুন, কী করব? কাজ বলে দিন।

– কাজ অনেক। মানুষকে, এ মন্বন্তরের দুর্যোগ পার করে নিয়ে যেতে হবে।’

পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আরও কথাসাহিত্য লেখা হয়েছে বাংলায়। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গোপাল হালদারের ট্রিলজি- ‘পঞ্চাশের পথ’, ‘ঊনপঞ্চাশি’ ও ‘১৩৫০’। লঙ্গরখানা খোলার কথা আছে অনেক গল্পে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গ্রন্থের ‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পে গ্রাম ছেড়ে নিরন্ন মানুষের অশক্ত পথচলার বিবরণ পাই। দুর্ভিক্ষের সময়ে ওয়ালীউল্লাহ কলকাতায় অবস্থান করছিলেন এবং বামধারার ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পে তিনি লিখছেন :’তিনু কিছু বললে না। হঠাৎ কী হয়েছে তার- নদীর অপর তীর দেখবার জন্য তার মনটা আকুল হয়ে উঠেছে। তার আশঙ্কা হচ্ছে- মহাসাগরের তীরে যেন বসে রয়েছে। পথ ভুল করে কি তারা সীমাহীন মহাসাগরের তীরে এসে বসেছে মরণের পারে যাবে বলে?… ক’দিন হলো মতি উধাও হয়ে গেছে গাঁ থেকে এবং তার খোঁজে সে এদের সঙ্গ নিয়েছে। তা ছাড়া গাঁয়ে যে রকম বীভৎস আকাল লেগেছে, সেখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।’ দুর্ভিক্ষের কারণে জমি সামান্য টিপসই দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল নিরন্ন কৃষক, এ কথা শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ আমাদের জানিয়েছে। আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ উপন্যাসে জয়গুণ ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচারণ করছে এভাবে :’পঞ্চাশ সনের কথা মনে হয়। একটা রোজাও রাখা হয়নি। রোজা রাখার কথা মনেও হয়নি। এক বাটি ফেনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে কত জায়গায়-কত বাড়িতে তাকে ঘুরতে হয়েচে… মাঝেমধ্যে সারারাত সারাদিন কেটেছে, একটা দানাও পড়েনি পেটে।’

হুমায়ূন আহমেদ তার ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরকে প্রোথিত করেছেন। তাতে করে দেখা যায়, শুধু পশ্চিমবঙ্গে এবং কলকাতায় নয়, এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। চাল কিনে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের সুরক্ষিত করার জন্য ‘প্রকিউরমেন্ট পলিসি’ দুর্ভিক্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ফিরে যাই হুমায়ূনের বর্ণনায় :

১. [আর, পি, সাহার কথা মনে রেখেই কি নিচের এই স্তবকটি লিখেছিলেন হুমায়ূন? স্মর্তব্য, রণদা প্রসাদ পরে ‘দানবীর’রূপে সমধিক পরিচিতি পেলেও তার ‘প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়ন’ হয়েছিল যুদ্ধের বাজারে- দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে- ধান-চালের মজুদদারি করেই]

‘বান্ধবপুর বাজারে এককড়ি সাহার চালের আড়ত। তিনি সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধের কারণে এখন রমরমা অবস্থা। ধান-চালের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আরও বাড়বে- এ রকম গুজব বাতাসে ভাসছে। সব চাল নাকি মিলিটারিরা কিনে নিবে।… দেশের চাল সব সরকার কিনছে। এদিকে আবার বার্মা মুলুক থেকে চাল আসা বন্ধ। জাপানিরা বার্মা দিয়ে ভাতবর্ষে ঢুকবে।’

২. [এটা গেল দুর্ভিক্ষের ‘ব্যাকগ্রাউন্ডের’ কথা। এবার হুমায়ূন দেখাবেন কী করে মজুদদারি শুরু হয়ে গেল সরকারি ক্রয়-অভিযানের আড়ালে]

‘এককড়ি হারিকেন নিভিয়ে দিয়েছেন। কেরোসিনের সাশ্রয় করতে হবে।… আধো অন্ধকারে এককড়ি দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, চাল কিনা শুরু করো। দাম কিছু বেশি হলেও কিনবা। বড় নৌকা নিয়ে ভাটি অঞ্চলের দিকে যাও। সেখানে ধান-চাল দুইই সস্তা।’

[ক্রমশ]

Original in সমকাল