রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বিদেশি বন্ধুরা (Tagore and his Foreign Friends)

বিনায়ক সেন
Tagore
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য :ব্যক্তিগত সংলাপ?

২০০৩ সালের প্যারিসে এক ক্যাফের টেবিলে বসে আছেন মুস্তাফা শেরিফ। বসন্তকালের শেষ অপরাহ্নের আলোয় উদ্ভাসিত প্যারিসের পথ-ঘাট। কিন্তু মুস্তাফা শেরিফের সেদিকে মন নেই। ইসলাম ও দর্শন নিয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি আলজেরিয়ায় খ্যাতিমান। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতেই অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের একজন। তিনি আজ গভীরভাবে চিন্তামগ্ন। ক্যাফেটিও সাধারণ রেস্তোরাঁ নয়। প্যারিসের ইনস্টিটিউট অব অ্যারাব ওয়ার্ল্ড-এর টি-রুমে বসে মুস্তাফা শেরিফ বিশেষ একজনের প্রতীক্ষা করছেন। তিনি জাঁক দেরিদাঁ, তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর সেরা দার্শনিক-চিন্তাবিদদের একজন দেরিদাঁ। কিন্তু নতুনত্ব রয়েছে তার আজকের আগমনে। দেরিদাঁ ও মুস্তাফা শেরিফ আজ আলাপ করবেন সভ্যতার সংঘাত ও সংলাপ নিয়ে। বিশেষত ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্য’ এ দুইয়ের মধ্যকার সভ্যতা-সম্পর্কিত সম্পর্ক নিয়ে। শেষ পর্যন্ত তারা উভয়েই মানছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বলতে যে একরৈখিক ধারণা দেওয়া হয়, তা ঠিক নয়। প্রাচ্যও বিভিন্ন, পাশ্চাত্যও বিভিন্ন। এই বিভিন্ন প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সংঘাত যেমন রয়েছে, ঐক্যের যোগসূত্রও রয়েছে। সক্রাতিসের ‘নিজেকে জানো’ উক্তি মেনে আজ প্রাচ্যকে যেমন তার বিভিন্নতাকে বুঝতে হবে, পাশ্চাত্যকেও তেমনি নিজের ভেতরের ভিন্নতাকে নতুন করে জানতে হবে। আন্তঃসভ্যতার সংলাপের এই আহ্বান জানানোর মাস কয়েকের মধ্যেই ক্যান্সারে মারা যাবেন দেরিদাঁ।

দেরিদাঁ-মুস্তাফা শেরিফের আলোচনা ছিল একান্ত ব্যক্তিগত। নিজেদের বুঝ পরিষ্কার করার জন্যই। কিন্তু তারা সংলাপের যে কথা সেদিন তুলেছিলেন, তা একেবারে নতুন নয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত অর্থে দার্শনিক ছিলেন না হয়তো, কিন্তু সভ্যতার সংঘাত ও সংলাপ এ বিষয়ে বিস্ময়কর অভিনিবেশ ছিল তাঁর। তার চিহ্ন পাই একেবারে লেখক জীবনের গোড়ার দিকের লেখাগুলোতেই। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ত্রিশের দিকে। ১৮৯১ সালে ‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে সৈয়দ আমির আলির প্রবন্ধের সূত্র ধরে ‘পাশ্চাত্য ও ইসলাম’ নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ টেনে আনছেন, যা দেরিদাঁ-শেরিফ সংলাপের কথা মনে করিয়ে দেয়। কোনো এক ইংরেজ মহিলা ‘মুসলমান স্ত্রীলোকদের দুরবস্থা বর্ণনা করিয়া নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিতে যে প্রবন্ধ লিখিয়াছেন’ তার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে অনগ্রসরতার কারণ ‘ধর্মে নহে, জ্ঞানবিদ্যা সভ্যতার অভাবে।’ ইউরোপও এক সময় অনগ্রসর ছিল। ইউরোপেও নারীরা অত্যাচারিত ছিলেন, খ্রিস্টধর্মের উপস্থিতি তাতে পরিবর্তন আনতে পারেনি। ইউরোপে ‘তখন কোনো উচ্চ অঙ্গের ধর্মানুষ্ঠানে স্ত্রীলোকের অধিকার ছিল না। জনসমাজে মিশিতে, প্রকাশ্যে বাহির হইতে, কোনো ভোজে বা উৎসবে গমন করিতে তাহাদের কঠিন নিষেধ ছিল।… খ্রিস্টধর্মবৎসল জুস্টিনিয়নের অধিকারকালে কনস্টান্টিনোপলের রাজপথ স্ত্রীলোকদের প্রতি কী নিদারুণ অত্যাচারের দৃশ্যস্থল ছিল।’ তারপর রবীন্দ্রনাথ ইসলামের আবির্ভাব সম্পর্কে সুচিন্তিত মন্তব্য করলেন। আজকের যুগের জন্য প্রাসঙ্গিক বিধায় পুরো উদৃব্দতিটি শোনা দরকার:
‘এমন সময়ে মহম্মদের আবির্ভাব হইল। মর্ত্যলোকে স্বর্গরাজ্যের আসন্ন আগমন প্রচার করিয়া লোকসমাজে একটা হুলস্থূল বাধাইয়া দেওয়া তাহার উদ্দেশ্য ছিল না। সে সময়ে আরব-সমাজে যে উচ্ছৃংখলতা ছিল তাহাই যথাসম্ভব সংযত করিতে তিনি মনোনিবেশ করিলেন। পূর্বে বহুবিবাহ, দাসীসংসর্গ ও যথেচ্ছ স্ত্রী পরিত্যাগে কোনো বাধা ছিল না; তিনি তাহার সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া স্ত্রীলোককে অপেক্ষাকৃত মান্যপদবীতে আরোহণ করিলেন। তিনি বারবার বলিয়াছেন, স্ত্রীবর্জন ঈশ্বরের চক্ষে নিতান্ত অপ্রিয় কার্য। কিন্তু এ-প্রথা সমূলে উৎপাটিত করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত ছিল না। এইজন্য তিনি স্ত্রীবর্জন একেবারে নিষেধ না করিয়া অনেকগুলি গুরুতর বাধার সৃষ্টি করিলেন।… কতকগুলি পরিবর্তন সাধন করিয়া সমাজকে পথনির্দেশ করিয়াছিলেন। তবু সমাজ সেইখানেই থামিয়া রহিল। কিন্তু সে-দোষ মুসলমান ধর্মের নহে, সে কেবল জ্ঞান বিদ্যা সভ্যতার অভাব।’

এই দীর্ঘ উদৃব্দতির পেছনে রবীন্দ্রনাথের উদ্বেগের জায়গা কোথায় তা পরিষ্কার। তিনি চাচ্ছেন যে ইসলাম সম্পর্কে ইউরোপীয় মতই চূড়ান্ত নয় তা স্বপ্রমাণিত করতে। অন্ধকার সব সভ্যতার ভেতরেই আছে, প্রয়োজন হচ্ছে সংঘাতের মুহূর্তগুলো এড়িয়ে সংলাপের ও ঐক্যের মুহূর্তগুলোর ওপরে জোর দেওয়া। এ কাজটি তিনি বিশেষভাবে শুরু করেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরবর্তী পর্বে।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার পর থেকে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এই বিচ্ছিন্নতার পর্ব তাঁকে নানা দিক থেকে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছিল। তাঁর দেশের মানুষের উন্নতি কোন পথে এ নিয়ে দুর্ভাবনা হচ্ছিল কবির। সে লক্ষ্যে আধুনিকতার ধারণাকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইছিলেন তিনি। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে নিরন্তর ও অর্থবহ সংলাপ ছাড়া এই আধুনিকতার পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয় এটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তরুণ বয়সেই। কিন্তু ধন্দ দেখা দিয়েছিল প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে। উনিশ শতকের রেনেসাঁর চিন্তকদের মতো তিনি ফিরতে রাজি ছিলেন না ভারতীয় প্রাচ্যের ‘প্রাচীন মৌলিকত্বে’। শাস্ত্রের অনুশাসনে বিধির তুলনায় নিষেধেরই বেড়া বেশি করে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। তা ছাড়া, উনিশ শতকের রেনেসাঁর চিন্তকেরা ‘প্রাচ্য’ বলতে শুধু স্বজাতীয় প্রাচ্যকেই বোঝাতেন। যেমন, হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা রেনেসাঁর আকর-উৎস বলতে বোঝাতেন বেদ-উপনিষদ-পুরাণ-কাব্য চতুষ্টয়কে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও প্রায় অবিকল মনোজগতের পথে বারে বারে ফিরে যেতেন ধর্মীয়-পুরাণ অনুষঙ্গে ও উৎসে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা তো আরও বেশি করে স্বজাতীয় প্রাচ্যের চর্চা করতেন। প্রাচ্য যে বিভিন্ন ধারার, এবং তার মধ্যে যে বহুমাত্রিকতা রয়েছে, বহু সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের প্রকাশ রয়েছে, সেটা সুদূর লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে দক্ষিণ এশীয় ও দূরপ্রাচ্য অবধি বিস্তৃত ভূপ্রকৃতি ও বিচিত্রবিধ সমাজ-সংস্কৃতি থেকে বেশ বোঝা যায়। তবে এদেশে রবীন্দ্রনাথই প্রথম এ কথা মর্মে-মর্মে ধারণ করেছিলেন এবং নানাভাবে নিজের দেশে ও বিদেশে গিয়ে সে কথা অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমি সন্দেহ করি, তাঁর বিশ্ব-পর্যটনের যতিহীন প্রয়াসের পেছনে ছিল পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশের বিভিন্ন ধারাকে প্রত্যক্ষে জানা-বোঝার তাগিদ। এজন্যেই কবি গিয়েছিলেন বিলেত-আমেরিকার বাইরে জাপানে, চীন দেশে, জাভায়, সিংহল দ্বীপে, মরুতীর্থে মধ্যপ্রাচ্যে তথা আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, মিসরে, এমনকি সুদূর লাতিন আমেরিকায়। কেন এই চরৈবেতি চড়ূয়া স্বভাব? অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতা এসব পরিব্রাজকের মতোই যেন বিশ্ব-পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন কবি। তবে পরিব্রাজনার পেছনে প্রবল ব্যক্তিগত উৎসাহের কারণ নিহিত ছিল অন্যত্র প্রাচ্যীয় বিভিন্নতাকে স্বচক্ষে সপ্রমাণিত করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নিজের জীবন-চর্চা, বিশ্বাস ও রচনাকর্মের মধ্য দিয়ে।

শুধু প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্যও তো বিভিন্ন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সমীকরণের প্রাচ্য-অংশটি যেমনটা একরূপ নয়, পাশ্চাত্য-অংশটিও তেমনি নানা ধারা, ছক ও স্বভাবের। যে পাশ্চাত্য অনবরত প্রাচ্যকে বশীভূত করে শাসন-শোষণ করতে চায় সেটি এক ধরনের। যে পাশ্চাত্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার মাধ্যমে মানব সভ্যতায় অবদান রাখছে সেটি অন্য ধরনের। এ কথাও রবীন্দ্রনাথের সটান উপলব্ধিতে ধরা পড়েছিল। তাঁর ‘ছোট ইংরেজ ও বড় ইংরেজ’ লেখাটি এ রকম চেতনা থেকেই উৎসারিত। তা ছাড়া, পাশ্চাত্য নিজেদের মধ্যেও অনবরত পায়ে লাগিয়ে ঝগড়া বাধাতে পারদর্শী তার বিগত পাঁচশো বছরের ইতিহাস সে কথাই বলে (এমনটা যখন রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন তখনও প্রথম মহাযুদ্ধের শুরু হয়নি)। তার উপর রয়েছে পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের সংস্কৃতিগত ব্যবধান। যেমন রয়েছে ফারাক ইউরোপ ও আমেরিকার ভেতরে। ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুইয়ের মধ্যকার সংলাপকে অনায়াস বাহাস বলে মনে করা কঠিন। কোন ‘প্রাচ্যের’ সাথে কোন ‘পাশ্চাত্যের’ সংলাপের কথা হচ্ছে? সাম্রাজ্য মদমত্ত পাশ্চাত্যের সাথে আত্ম-সংহারী জাতিবিভেদী প্রাচ্যের সাথে সংলাপে তো কবির উৎসাহ থাকার কথা নয়। তা ছাড়া, পাশ্চাত্যের কাছ থেকে কিছু দান হাত পেতে নেওয়ার পাশাপাশি এটাও তো ভাবতে হবে, পাশ্চাত্যকে দেওয়ার মতো আদরণীয় কিছু আদৌ প্রাচ্যের আছে কিনা? নইলে যে একতরফা বিনিময়ই চলতে থাকবে, আর একতরফা বিনিময় কেবল চলতে পারে পরাধীন সত্তার ক্ষেত্রেই। সকল মানব জাতির না করে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য কেউ কি পরস্পরের কাছ থেকে কিছু নিতে বা পরস্পরকে কিছু দিতে সক্ষম? এসব ভাবনা রবীন্দ্রনাথের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ১৯১০-৩০ পর্বের নানা লেখায় এসব প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসবে কখনও জাতীয়তাবাদের সমালোচনায়, কখনও সাম্রাজ্য ও যুদ্ধের প্রসঙ্গে, কখনও ধন-বৈষম্য, কখনও জাতি-বৈষম্য, কখনও কলের সভ্যতার বিশ্লেষণে। রাজনীতি, ধর্ম, সভ্যতা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও মানব-কল্যাণের পরিণতি নিয়ে এসব উদ্বেগ তাঁর শিল্প-সাহিত্য চর্চায় অনবরত ঢুকে পড়তে থাকবে। এরই মধ্য দিয়ে কবি শিলাইদহ ও শান্তিনিকেতনের আশ্রমের ছায়া পেরিয়ে হয়ে উঠবেন বিশ্বের বিবেকবান বুদ্ধিজীবীদের একজন।

কিন্তু এই পালাবদলের বিবরণী অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি কবির বিদেশি বন্ধুদের মনোযোগের বাইরে রাখি। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যকার সংলাপে সমীকরণ খোঁজার চেষ্টা শুধু ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই সংলাপটি কবির সচেতন উদ্যোগে ও তাগিদে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর কাছের ও দূরের বলয়ে। স্বদেশের সহচরেরা যেমন; এই সংলাপের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন বিদেশি পথিকেরাও। এর পূর্ণ ইতিহাস এখনও জানা হয়নি আমাদের। কিন্তু এটুকু জানা যে কবির মননশীল চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর বিদেশি বন্ধুরা, ইংরেজিতে যাকে বলে ইন্টারলকুটর বা সহ-আড্ডাধারীরা। এঁদের মধ্যে যেমন আছেন ইয়েটস-পাউন্ডের মতো কবি, আইনস্টাইনের মতো পদার্থবিদ, রাসেল-বের্গসঁ-শোয়াইটজারের মতো দার্শনিক, ওয়েলস-বার্নার্ডশ-হামসেনের মতো লেখক, ফ্রয়েড-হ্যাভলক এলিসের মতো মনোবিজ্ঞানী, বুনিন-হিমেনেথ-জিদের মতো তাঁর কবিতার নোবেলবিজয়ী অনুবাদক, এমনকি র‌্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ও উড্র উইলসনের মতো রাজনীতিক। এই সংলাপে পরোক্ষভাবে ঘটনা-পরম্পরায় যুক্ত হয়েছেন রাইনের মারিয়া রিল্কে, ফেদেরিকো লোর্কা, লুই বনুয়েল, বরিস পাস্তেরনাক, আন্না আখমাতভা ও পাবলো নেরুদা, যারা সরাসরি কবির সানিনধ্যে আসেননি, কিন্তু বহন করেছেন তাঁর গান, কবিতা বা গদ্য-ভাবনার বীজ। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অনেকটা স্বউদ্যোগে নিজ হাতেই যেন সম্পন্ন করেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার মহাজাতি বৈঠকের। আবার এসবের মধ্য দিয়েই পদ্মা-পারের কবি হয়ে উঠছিলেন এক বিশ্ব-ব্যক্তিত্ব; স্থান করে নিচ্ছিলেন বিশ্ব-কবির সারিতে। অবশ্যই এই মহা-সংলাপ হয়েছিল তাঁর পছন্দের প্রাচ্য ও পছন্দের পাশ্চাত্যের ধারার মধ্যে। এই বৈঠকের ভাষা দ্বিপক্ষীয় সাংস্কৃতিক বা সাহিত্যিক ভাব বিনিময়ের হলেও এর প্রেরণা বহুত্ববাদী, একান্তভাবেই জাতীয়তাবাদের বাইরের ভুবনের। সে কথা ম্যানিফেস্টোর মতো কবি ১৯১৭ সালের ‘ন্যাশনালিজম’ বক্তৃতামালায় সবিস্তারে তুলে ধরছেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমদর্শী সমালোচনায়। ১৯৯১ সালে ন্যাশনালিজম গ্রন্থের ভূমিকায় ইংরেজ দার্শনিক ই.পি. থমসন তাঁকে ‘উত্তর-আধুনিক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেটা রবীন্দ্রনাথের জানার কথা নয়। জার্মান দার্শনিক হাবেরমাস ১৯৯০-র দশকে খুঁজেছিলেন ‘পোস্ট-ন্যাশনালিজম’-এর সম্ভাবনা। সেটাও রবীন্দ্রনাথের জানার কথা নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে তাঁর রচনা-কর্মই উত্তর-আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা ও পোস্ট-ন্যাশনালিজম ধারণার সবচেয়ে কাছাকাছি কী সেই সময়ে, কী এই সময়ে তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে, অন্তত এই ভূখণ্ডে। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর বহুত্ববাদী মনের কারণে, সেখানে নানা-প্রাচ্য ও নানা-পাশ্চাত্যের রঙে ঝিলমিল। এটা তাঁর ভিনদেশি সহ-আলাপীদের তালিকা দেখলেই বোঝা যায়। এনার্কিস্ট, লিবারেল হিউম্যানিস্ট, কট্টর মার্কসিস্ট, ফেবিয়ান সোশ্যালিস্ট, থিওসফিস্ট, ওরিয়েন্টালিস্ট, ফেমিনিস্ট, লজিক্যাল পজিটিভিস্ট, খ্রিস্টীয় আদর্শবাদী, সুফী মতাবলম্বী, মার্টিন বুবেরের মতো ইহুদি আদর্শের প্রচারক, বৈদান্তিক, নাস্তিবাদী, সংশয়বাদী কে নেই রবীন্দ্রনাথের সাথে এই মহাজাতি সংলাপে! আর এই বিদেশি সভায় প্রাচ্যের হয়ে একাই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন কবি। এই সংলাপের যা কিছু ঘটেছে তার অনেকটাই ঘটেছে লোকচক্ষুর অগোচরে, দিনলিপি বা চিঠির নিভৃত পাতায়, অথবা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্যে। অর্থাৎ এখনকার মতো মিডিয়ার ২৪-ঘণ্টা নজরদারির বাইরে, বলা যায় কবির একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার কাঠামোয়। কখনও কখনও অবশ্য সেসব আলোচনা ও পত্রালাপ প্রকাশ পেয়েছে ‘মডার্ন রিভিউ’তে অথবা অনূদিত হয়েছে ‘প্রবাসী’র পাতায়। তবু এর মধ্য দিয়েই আমাদের প্রাচ্যকে বহির্বিশ্ব জানতে পেরেছে। বর্ণবাদী ওরিয়েন্টালিজমের বাইরে যে-প্রাচ্যকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গর্ব করতেন, তার সাথে বিতর্ক ও আড্ডার সুযোগ মিলেছে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিদের। এজন্যেই কি কবির প্রাণপাত কষ্ট স্বীকার, ঘুরে বেড়ানো, দেশ থেকে দেশে (কখনও কখনও ছয় মাস-এক বছর ধরেও ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাঁকে) জাহাজে বা রেলগাড়িতে চড়ে দীর্ঘ যাত্রায়। রুশ চিত্রশিল্পী নিকোলাই রেরিখ তাঁর ‘হিমাবৎ’ (হিমালয়ের সনি্নকটে) গ্রন্থে লিখেছেন, কবির সাক্ষাৎ মেলা ভার, কেননা ‘অক্লান্ত ভাবে তিনি সারা পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’ কেন এই কষ্ট স্বীকার, সে কি কেবল ঘরের বাইরের পৃথিবীকে সম্মান জানানোরা জন্যে, নাকি জাতি হিসেবে ‘বাঙ্গালীকে’ যাতে কেউ কূপমণ্ডূক মনে করতে না পারে, সেজন্যেও? দ্বিতীয়বার আমেরিকা সফরের সময় (১৯১৬-১৭ সালে) টানা ১২১ দিনে প্রায় ৭০০০ মাইল ঘুরে ৫৭টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন কবি। সে তো নিছক খ্যাতির পেছনে দৌড়ানোর জন্যে নয়, অথবা খ্যাতির বিড়ম্বনার পার্শ্বর্-প্রতিক্রিয়াজাতও নয়। বিবেকানন্দের পর কিন্তু ভিন্ন পন্থায় ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে প্রাচ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন কবি মার্কিন দেশের জনসমাজের সম্মুখে এক ব্যাপক ব্যক্তিগত উদ্যোগে। মনে রাখতে হবে, অর্থবহ সংলাপ হয় সমকক্ষদের মধ্যে কেবল। সেভাবেই রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার সব সংলাপে অংশ নিয়েছেন নিজের কোনো অসম্পূর্ণতায় কুণ্ঠাবোধ করা ছাড়াই। যখন নোবেল পাননি তখনও আস্থাশীল ছিলেন নিজের সম্পর্কে। এক কথায়, বিদেশি বন্ধুদের সাথে আলাপে-সংলাপে, বিতর্কে-বাদানুবাদে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট, জ্ঞানোৎসাহী ও উদার শ্রোতা ও বক্তা উভয় ভূমিকাতেই। এর জন্যে প্রতিটি সাক্ষাৎ ও প্রতিটি চিঠির পেছনে তাঁকে যথাসাধ্য প্রস্তুতি নিতে হতো। এই বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন বিপুল ও সর্বব্যাপী, আমাদের আজও তা বিস্মিত না করে পারে না। এরই কিছু অনুচিহ্ন নিয়ে বর্তমান লেখা।

২. তাঁর নোবেলজয়ী অনুবাদকেরা

বিদেশি বন্ধুদের সারিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে চলে আসে তাঁর সৃষ্টিকর্মের অনুবাদকেরা। এখানে শুধু তাঁদেরকেই উল্লেখ করব যারা রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুবাদকদের মধ্যে অগ্রগণ্যই ছিলেন না; পরে তাঁরা নিজেরাই পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। তার মানে এই নয় যে, নোবেল যারা পাননি তাঁরা ছিলেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংলাপের বাইরে। টলস্টয় রবীন্দ্রনাথকে চিনতেন না ঠিকই, কিন্তু কবি তাঁর লেখার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। টলস্টয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ তাঁর তেমন ভালো লাগেনি, তবে টলস্টয়ের আদর্শে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নানা লেখার মধ্যে (বিশেষ করে স্বদেশী-সমাজ পর্বের লেখাগুলোয়) টলস্টয়ের সযত্ন উল্লেখ রয়েছে। টলস্টয়ের মতো রাইনের মারিয়া রিল্কেরও রবীন্দ্রনাথের সাথে সরাসরি কখনও দেখা হয়নি। রিল্কে রাশিয়ায় ছিলেন একটা সময়ে ও রুশ ভাষা ভালো জানতেন; কাব্য-বিষয়ে পাস্তেরনাক-সিভেতায়েভার সাথে বিখ্যাত পত্রালাপ রয়েছে তাঁর। এটা আমরা ভুলে যাই কী করে যে, জার্মান ভাষায় গীতাঞ্জলি অনুবাদের জন্য রিল্কেকেই প্রথমে অনুরোধ করা হয়েছিল প্রকাশকের পক্ষ থেকে। নোবেল প্রাপ্তির আগেই রবীন্দ্রনাথের কথা শুনেছিলেন তিনি তার বন্ধু ওলন্দাজ কবি ভন আদেনের কাছে। ১৯১৪ সালে যখন আদ্রে জিদের করা গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ বার হলো তখন সে অনুবাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রিল্কে নিজে থেকে জার্মান প্রকাশক কুর্ট উয়োলফ্কে চিঠি লিখেছেন। এ বইয়ের দ্রুতই জার্মান অনুবাদ বের হওয়া দরকার এই ছিল রিল্কের মত। চিঠিটা পেয়ে উয়োলফ বরং রিল্কেকেই অনুরোধ করেন অনুবাদ-কর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্যে। কিন্তু রিল্কের তখন চলছে প্রেরণার সংকট। ডুইনো এলিজি অর্ধ-সমাপ্ত হয়ে পড়ে রয়েছে, লেখা আপাতত বেরুচ্ছে না। গীতাঞ্জলির অনুবাদ-কর্মে হাত দিতে হলে অন্য সব কাজ পিছিয়ে যাবে এই আশঙ্কার পাশাপাশি একটি কেজো যুক্তিও দেখিয়েছিলেন তিনি। অনুবাদ যেহেতু করতে হবে ইংরেজি থেকেই, আর ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনায়াস দখল সত্ত্বেও ইংরেজি তাঁর তেমন আয়ত্তে নেই। ফলে সুবিচার করা হবে না লেখাগুলোর প্রতি। ‘আমি নিজের ভিতরে এই কাজটা করার জন্য অনিবার্য আহ্বান শুনতে পাচ্ছি না আর একমাত্র তা থেকেই একটা নিশ্চিতভাবে ভালো কাজ জন্ম নিতে পারে।’ এভাবেই গীতাঞ্জলির অনুবাদ-কর্মের শ্রমসাধ্য কাজটিকে দায়সারাভাবে না দেখে সৃষ্টিশীল গুরুত্বের সাথে দেখেছেন তিনি। অবশ্য এ চিঠির কয়েক বছর বাদে ১৯২১ সালেই জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি ৮ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। এ কাজটি করেছিলেন হেলেন মেয়ার-ফ্রাঙ্ক ও তাঁর স্বামী দার্শনিক ভাষা-তাত্তিবক হাইনরিশ মেয়ার-বেনফি। কোনো বিদেশি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের রচনাবলির প্রকাশ এই প্রথম। ইংরেজিতে তিরিশের দশকের শেষেই সিলেক্টেড ওয়ার্কস বেরিয়েছিল কেবল, রুশ ভাষায় আরও পরে, পঞ্চাশের দশকে।

গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের সাথে আঁদ্রে জিদ কী করে জড়িত হলেন, সে গল্পও কৌতূহলোদ্দীপক। সাঁ জ পার্স ফরাসি লেখক, নোবেল পুরস্কার পান ১৯৬০ সালে, জীবনের শেষ তিন দশকে কাটিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর জিদ নোবেল পান ১৯৪৭ সালে। গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের সাথে দু’জনেই জড়িত ছিলেন :পার্স পরোক্ষভাবে, জিদ প্রত্যক্ষভাবে। ১৯১২ সালে ইয়েটস-এর ভূমিকা সংবলিত গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বের হওয়ার সাথে সাথে তা কেবল ইংল্যান্ডে নয়; ইউরোপের সমগ্র সারস্বত সমাজেরই দৃষ্টি কেড়েছিল। পার্সের বয়স তখন ২৫, লেখক-জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম করছেন। আর জিদের বয়স তখন ৪৩, ইতিমধ্যেই ফরাসি সাহিত্যাকাশে দেদীপ্যমান। পত্রিকায় গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে পার্স উচ্ছ্বসিত হয়ে জিদকে সে কথা জানান। শুধু তা-ই নয়, কবির সাথে উদ্যোগী হয়ে দেখা করেন লন্ডনে এবং গ্রন্থটির ফরাসি অনুবাদের জন্য জিদকেই মনোনীত করতে অনুরোধ করে যান। কেন গীতাঞ্জলির সুর পার্স ও জিদ উভয়কেই এত টেনেছিল সেটা এক চিত্তাকর্ষক আলোচনার বিষয় হতে পারে। কেননা, জিদ গোড়া থেকেই অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট ধারার লেখক, সেটা প্রচলিত নীতিবোধ বা ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, তেমনি পরে স্তালিন পন্থাকে তীব্র ভর্ৎসনা করার বেলাতেও সুস্পষ্ট। গীতাঞ্জলির মরমি ভাবাদর্শের প্রতি তাঁর বরং নির্লিপ্তিই থাকার কথা। তারপরও আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে তিনি যা বলেছিলেন তা হলো, এর সহজ সরাসরি উচ্চারণ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এ কাব্যের বক্তব্যকে বোঝার জন্য কোনো অভিধানের প্রয়োজন নেই বা কোনো ভারতীয় পুরাণ বা শাস্ত্রের সাথে পূর্ব-পরিচয়ের দরকার নেই। এতটাই পাঠক-বন্ধু রচনা এটি। অন্যদিকে, পার্স তরুণ বয়স থেকেই অধুনাপন্থি, আভোগার্দ যাকে বলে, পরে নাজিবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। হয়তো ফরাসি প্রতীকবাদী কবিতা থেকে এই মিতবাক ছোট ছোট কবিতা ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন স্বাদ ও ঘরানার। ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন হিসেবে কল্পনা করা ছাড়াও একে দিব্যি মানবীয় প্রেরণায় পড়ে ফেলা যায়। গীতাঞ্জলির এটি একটি বড় গুণ। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ সে রকম সরল সত্যের আহ্বান হয়তো তাঁদের মনে আলোড়ন তুলে থাকবে। বিশেষ করে অবাক লাগে গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের ভূমিকায় জিদ যখন বোদলেয়ারের সাথে রবীন্দ্রনাথের তুলনা করছেন, অথবা উদাহরণ টানছেন গ্যেটের ফাউস্টের। প্রাচ্যীয় বিচ্ছুরণ তখন একান্তভাবে আর প্রাচ্যের একচেটিয়া থাকছে না, পাশ্চাত্য ঐতিহ্যেরও অংশ হয়ে উঠছে। বা অন্যভাবে বললে, বোদলেয়ার. গ্যেটে বা জিদ নিজেও প্রাচ্যীয় অনুষঙ্গের অন্তর্লীন মুহূর্ত হয়ে উঠছেন। ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা’ এই উন্মাতাল আলো কি কেবল উপনিষদের? বা একে বৈষ্ণব দর্শনের সারাৎসারও বলে মনে করেননি জিদ। বরং এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন মানবীয় ভালোবাসারই দর্শন, যেখানে শাস্ত্রীয় ধর্ম নেই, বরং ভালোবাসাই সেখানে পরম ধর্ম হয়ে আছে। গীতাঞ্জলির এই ব্যাখ্যা জিদের জীবন-দর্শন দ্বারা স্পষ্টতই প্রভাবিত। কবির ‘জীবনদেবতার’ স্বীকৃতি নেই এতে।

গীতাঞ্জলির জিদ-কৃত ভূমিকায় প্রাচ্য-বিষয়ক আরেকটি বহুল-উদৃব্দত অভিযোগের অপনোদন করা হয়েছে। প্রাচ্যীয় শাস্ত্র-সাহিত্যাদি অর্থহীন; এর সমগ্র সম্ভারও ইউরোপের এক তাক বইয়ের চেয়ে মূল্যবান নয় এ রকম একটি আপ্তবাক্যের তিরস্কার ম্যাকলের কলম থেকে ১৮৩০’র দশকে নিঃসৃত হয়েছিল। তার পর থেকেই এক ধরনের হীনম্মন্যতা প্রাচ্যদেশকে তাড়া করে ফিরেছে। জিদ কিন্তু তা বলছেন না। প্রথমত, তিনি বলছেন যে গীতাঞ্জলির সহজ উচ্চারণ তাঁকে স্বস্তি দিয়েছে। কেননা, ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থরাজি তাঁর পড়া নেই, এবং অনন্তকাল হাতে পেলেও তা পড়ে শেষ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, প্রাচ্যের ভাবনার মাঝে কেবল দেবত্ববাদ নয়, সেখানে সংশয়বাদও খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, ‘বহুদেববাদ আসলে প্রকৃত সত্য নয়’। কেননা, অমন যে আকর-গ্রন্থ ঋগ্গ্বেদ সেখানেও বলা হচ্ছে :’এসব তত্ত্ব কে জানে? কে-ই বা এসব নিয়ে কথা বলতে পারে? কোথা থেকে আসে প্রাণী? এই সৃষ্টিই বা কী? এর সামনে দেবতাদেরও বামনের মতো দেখায় কীভাবে এর আরম্ভ হয়েছিল তা কার জানা আছে?’ গীতাঞ্জলি, জিদের চোখে, এ রকমই মুক্ত প্রেরণায় রচিত এবং এই বোধ আধুনিক কাব্যকলারই লক্ষণ।

দেখা যাচ্ছে, ফরাসি দেশেই গীতাঞ্জলির ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-কর্মের (ইংল্যান্ডের চেয়েও আমি বলব) উচ্চ মূল্যায়ন হয়েছিল বেশি করে। সেটি শুধু জিদের স্থিতধী মূল্যায়নেই প্রকাশ পায়নি। ১৯১৫ সালে রোমাঁ রোলাঁ নোবেল পুরস্কার পান (পুরস্কারটা হাতে পান ১৯১৬ সালে)। রোলাঁ যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে আপন করে নিয়েছেন সেরকম উৎসাহ ইংল্যান্ডে ক্রমশ দুষ্প্র্রাপ্য হয়ে উঠছিল। রোলাঁর সাথে গান্ধীর যেমন, যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ পত্রালাপ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছর পূর্তিতে ‘গোল্ডেন বুক অব টেগোর’ সংকলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রোলাঁই। প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ইউরোপ ও এশিয়ার লেখক-শিল্পীদের প্যাসিফিস্ট অবস্থানে একত্রিত করা নিয়ে এঁদের মধ্যে সহমত ছিল। প্রাচ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়ূক, আর পাশ্চাত্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নৈতিক ভিত্তি লাভ করুক এই ছিল রোলাঁর মত। পরে ফ্যাসিবাদবিরোধী জোরালো অবস্থানে যাতে কবি দৃঢ় থাকেন (বিশেষত ১৯২৬ সালে মুসোলিনির ইতালি ভ্রমণের পর) সেক্ষেত্রে রোলাঁ বিশেষভাবে সজাগ অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। তবে রোলাঁ বা আঁরি বারবুসের মতো শান্তি-আন্দোলনের নেতারাই নন; বৃহত্তর ফরাসি সারস্বত সমাজে রবীন্দ্রনাথের স্থান ছিল সাধারণভাবেই খুব উঁচুতে। এক্ষেত্রে পল ভ্যালেরির উদাহরণ টানা যায়।

ফরাসি প্রতীকবাদী আন্দোলনের পুরোধা কবি ভ্যালেরির প্রভাব আধুনিক কবিতার ওপরে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। আধুনিক বাংলা কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়। বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত উভয়েই ভ্যালেরির কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। এহেন ভ্যালেরি রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনীতে এসে কবির সাথে পরিচিত হয়ে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেলেন। ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের আঁকা চিত্রকর্মের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। এই কাজটি করার জন্য সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে এসেছিলেন তিনি। মূল প্রদর্শনীর আগে এক প্রাক্-প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল এবং তাতেই নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন ভ্যালেরি। তিনি কবির আঁকা মূর্ত-বিমূর্ত ধারার ছবিগুলো দেখে মন্তব্য করেছিলেন যে, এসব ছবির প্রদর্শনী এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে তাতে ফরাসি চিত্রকরদের জন্যে তা ‘এক শিক্ষণীয় বিষয় হবে’। প্রাচ্যের চিত্রকলা মানেই মুঘল মিনিয়েচার বা বাংলার সনাতনী পট-চিত্র, রবীন্দ্রনাথ এ ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন। অবচেতনের অস্বচ্ছ আবহে থেকে থেকে ঝিলিক দিচ্ছে মূর্ত অবয়ব, সে-ও মনের অন্ধকার আলোয় ঘেরাটোপে আঁকা, যেন অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের অন্য বিচ্ছুরণ। ইউরোপে এক্সপ্রেশনিজম সবে শুরু হয়েছে, পল ক্লি জার্মানিতে এর নেতৃত্বে, ফ্রান্সে তখনও ততটা ছড়িয়ে পড়েনি, তারই মধ্যে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রদর্শনী। এর তাৎপর্য এই আন্দোলনের অন্যতম তাত্তি্বক ভ্যালেরির প্রখর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার নয়। কিন্তু আরও একটি কারণে অভিভূত হয়েছিলেন ভ্যালেরি। গীতাঞ্জলির শান্ত-সৌম্য চেহারার সন্ত কবি সর্বাধুনিক এক্সপ্রেশনিজমের মূর্ত-বিমূর্ত চিত্রকলার মাধ্যমে নিজেকে পুনরায় প্রকাশিত করছেন, সেটি তাঁকে কিছুটা বিস্মিত না করে পারেনি। কিন্তু প্রধান কারণ ছিল অন্যত্র। ভ্যালেরির সাথে সাক্ষাৎকালে কবি অনর্গল বলতে থাকলেন ভারতবর্ষের দুঃসহ পরিস্থিতির কথা (ততদিনে ১৯২৮ সালের মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা হয়ে গেছে; দেশজুড়ে চলছে ব্যাপক ধর-পাকড়)। আর বললেন প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত ‘দশ লক্ষ ভারতীয় সৈন্যের’ কথা, যাদের ফ্রান্সের মাটিতে কবর দেয়া হয়েছে, অথচ কোনো স্মৃতিসৌধ গড়া হয়নি তাদের নামে। কবির বক্তব্য ছিল, ‘ফ্রান্সের কাছে এতখানি নিষ্ঠুরতা তিনি আশা করেননি।’ দেখা গেছে, যুদ্ধ ও শাান্তির প্রশ্নে ১৯৩০ সালেও এসে কবি আবেগে আলোড়িত হয়ে উঠছেন, যেমনটা হয়েছেন ১৯১৭ সালে ন্যাশনালিজম বক্তৃতামালায়। এই সাক্ষাৎকারে ভ্যালেরি অভিভূত হয়েছিলেন, সে কথা ওকাম্পো তাঁর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বইয়ে আমাদের জানিয়েছেন।

ভ্যালেরি অবশ্য নোবেল পুরস্কার পাননি, যেমন মেলেনি লরেন্স, জয়েস বা পাউন্ডের ভাগ্যে। কিন্তু ইভান বুনিন পেয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। রুশিদের মধ্যে সাহিত্যে তিনিই প্রথম এ পুরস্কার পান। গীতাঞ্জলির নোবেল অনুবাদকদের মধ্যে ইংরেজিতে যেমন ছিলেন ইয়েটস, ফরাসিতে জিদ, আর রুশ ভাষায় বুনিন ও পাস্তেরনাক (আখমাতভাও রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছিলেন, তবে ১৯৬৪ সালে তিনি নোবেল তালিকায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে হয়ে হয়নি)। ১৯১৮ সালে গীতাঞ্জলির রুশ সংকলন প্রকাশ পায় বুনিনের সম্পাদনায়। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার পরে রুশ ভাষাতেই গীতাঞ্জলির অনুবাদ হয়। তবে মূল গ্রন্থটি হাতের কাছে না থাকায় এ কথা সঠিক করে বলা যাচ্ছে না বইটির পুরোটা তাঁরই অনুবাদ কিনা, নাকি অন্য রুশি অনুবাদকরাও (যেমন টলস্টয়-পুত্র ইলিয়া টলস্টয়) তাতে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯১৮ সালের সংস্করণটি মনে হচ্ছে পুশেনিনকভের প্রচেষ্টায় অনূদিত হয়েছিল, তবে সার্বিক সম্পাদনা ছিল ইভান বুনিনের। সেই অনুবাদে বুনিন কতটা হস্তক্ষেপ করেছিলেন, ইয়েটস্-এর মতো কোনো কোনো কবিতা নিজেই ঘষা-মাজা করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা, তা জানার সহজ উপায় নেই। বুনিনের সাথে রবীন্দ্রনাথের কখনও সাক্ষাৎকার হয়নি, যদিও সেটা অনায়াসে হতে পারত। বুনিন অক্টোবর বিপ্লবের পর প্যারিসে চলে যান এবং সেখানে বসেই রুশ বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারকাজে সক্রিয় অংশ নেন। তবে বুনিন কবির কাছে একেবারে অপরিচিত নাম ছিলেন না। প্যারিস প্রবাসী রুশ বুদ্ধিজীবীদের গ্রুপ ১৯২৩ সালে কোলকাতায় কবিকে চিঠি লিখে অর্থ সংগ্রহের জন্য অনুরোধ জানায়। উদ্দেশ্য অক্টোবর বিপ্লবের কারণে বিতাড়িত ভিন্নমতের রুশ বুদ্ধিজীবীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান। এই অনুরোধ আসে মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ ও অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ভিনোগ্রাদভের তরফ থেকে, যার চিঠিতে প্যারিস প্রবাসী গ্রুপ ও বুনিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণের আগে থেকেই রুশ অক্টোবর বিপ্লব সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণভাবে উৎসাহী ও জিজ্ঞাসু ছিলেন। ইংরেজদের সমস্ত (অনেক ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত) প্রচারণা সত্ত্বেও তিনি রাশিয়ার ও রুশ বিপ্লবের বিরোধী দলে নাম লেখাতে চাননি। কয়েক বার ব্যর্থ চেষ্টার পর ১৯৩০ সালে তিনি স্বচক্ষে বিপ্লব-উত্তর কর্মকাণ্ড দেখার জন্য রাশিয়ায় যান। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে সে ভ্রমণের বৃত্তান্ত রয়েছে। কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও বইটির সুর ছিল রাশিয়ার সংস্কার প্রসঙ্গে অনেকটাই প্রশংসাবাচক। এতে প্যারিস প্রবাসী ভিন্নমতের বুদ্ধিজীবীরা (যার মধ্যে বুনিনও ছিলেন) কবির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকবেন। গীতাঞ্জলি অনুবাদের পর রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে বুনিনের নিস্তব্ধতা এর থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। রবীন্দ্রনাথের তরফেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে কোনো তাগিদ লক্ষ্য করা যায়নি। কবির রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল যে, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলায় কিছু ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক অবস্থান মোটের উপর প্রাচ্যের জন্য কল্যাণকর ও বিশ্ব-শান্তির সহায়ক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবির এই অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পাস্তারনাক রবীন্দ্রনাথে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে। ১৯৩৬ সালে গোর্কির মৃত্যুর পরে পাস্তেরনাকই ছিলেন সোভিয়েত লেখক সংঘ রাইটার্স ইউনিয়নের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু মিখাইল বুলগাকভের মতো তিনিও অবস্থার শিকারে পরিণত হন। স্তালিনের সুনজরে থাকার কারণে দুজনে প্রাণে বেঁচে যান ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন চিন্তার লেখা থেকে সরে আসতে হয় এঁদের। বুলগাকভ নিমজ্জিত হন মস্কো আর্ট থিয়েটারে, আর পাস্তেরনাক নিয়োজিত হন অনুবাদ-কর্মে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৩ সাল (স্তালিনের মৃত্যু হয় যে বছর) অবধি পাস্তেরনাক শুধু অনুবাদের কাজই নিষ্ঠার সাথে করে গেছেন। শেকসপিয়র রচনাবলির রুশ অনুবাদ তাঁরই দক্ষ হাতে সুসম্পাদিত হয়। অনুবাদের ধারাবাহিকতায় এক সময় তাঁর চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথের রচনাকর্ম। এর পেছনে পাস্তেরনাকের প্রেমিকা কবি ওলগা ইভিনস্কায়ার (ড. জিভাগো উপন্যাসের লারার চরিত্র তাঁরই আদলে গড়া) বড় অবদান ছিল। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা তিনিই রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। এ বিষয়ে ওলগা লিখেছেন, পাস্তেরনাক পেরেডেলকিনোয় একবার এলে তিনি রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা অনুবাদ করে শুনিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি কবিতা ‘শেষ লেখার’ অন্তর্ভুক্ত, যেটি শুরু হয়েছে ‘ঘণ্টা বাজে দূরে’ লাইনটি দিয়ে। অনুবাদটি শুনে পাস্তেরনাকের চোখে জল এসে গিয়েছিল। এখানে ছোট্ট একটা তথ্যগত ত্রুটি শুধরে রাখি। পাস্তেরনাকের জীবনীকার ক্রিস্টোফার বার্নস লিখেছেন, ১৯৩০-এর দিকে পাস্তেরনাক রাশিয়ার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনোমতেই পাসপোর্ট নাকি জোগাড় করা যাচ্ছিল না। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন মস্কো যান তখন তাকে দিয়েও নাকি চেষ্টা নেয়া হয়েছিল রুশ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানানোর, যাতে পাস্তেরনাকের পাসপোর্টের একটা সুরাহা হয়। এটা কতটা সত্যি তা আরও যাচাই করে দেখা দরকার। পাস্তেরনাক তিরিশের দশকে বেশ কয়েক বার ‘লিটারেরি ডেলিগেশন’-এর সদস্য হয়ে রাশিয়ার বাইরে গিয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল রাইটার্স কংগ্রেসে তিনি সোভিয়েত প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৩৬-৩৮ পর্বে একাধিক বার কবি ওসিপ মান্দেলস্টাম, আন্না আখমাতভা ও মারিনা সিভেতায়েভার জন্যে স্তালিনের কাছে পর্যন্ত দেন-দরবার করতে হয়েছিল তাঁকে। যাদের ওপর দিয়ে তিরিশের দশকে শুদ্ধি অভিযানের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, পাস্তেরনাক তাদের মধ্যে ছিলেন না। বৈষয়িক কোনো কষ্টেও তাঁকে কখনও পড়তে হয়নি। তাঁর বরং কিছুটা অসুবিধে হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে, স্তালিনের মৃত্যুর পর। কিন্তু সেটা ‘ড. জিভাগো’ পর্বের কথা।

গীতাঞ্জলির স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রেও দক্ষ হাতের মধ্যস্থতা ঘটেছে। ইয়েটস, জিদ, বুনিন ও পাস্তেরনাকের মতোই হিমেনেথ পরে নোবেল পুরস্কার পান (১৯৫৬ সালে)। গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ১৯১২ সালে, ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। হিমেনেথ ও তাঁর স্ত্রী জেনোবিয়া মিলে ১৯১৩ থেকে ১৯২০-এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিসেন্ট মুন, গীতাঞ্জলি, গার্ডনার, ডাকঘর, স্ট্রে বার্ডস, রাজা ও রানী, মালিনী ও হাংরি স্টোনস গল্প-সংগ্রহ। স্প্যানিশ ভাষায় এদের অনুবাদ-কর্ম এতই সার্থক যে, পরে হিমেনেথের নিজের বই যেখানে অবিক্রীত অবস্থায় ধুলোচাপা থাকত, রবীন্দ্রনাথের তখন প্রতি বছরে হাজার হাজার কপি বই বিক্রি হতো। তবে ১৯২১ সালে প্যারিস থেকে মাদ্রিদে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও শেষপর্যন্ত আর স্পেনে যাওয়া হয়নি কবির। ফলে রবীন্দ্রনাথের সাথে হিমেনেথ-দম্পতির আর দেখা হয়ে ওঠেনি। সেবার স্পেনে গেলে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেতেন কী অসাধারণ আয়োজন করা হচ্ছিল স্পেনে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্যে। হিমেনেথের ইচ্ছে ছিল স্বীয় জন্মভূমি আন্দালুশিয়ায় কবিকে নিয়ে যাওয়ার। পরিকল্পনা ছিল কত কী! রবীন্দ্রনাথের মুখে বাংলায় কবিতা পাঠ শুনবেন, স্পেনের ছেলেমেয়েরা করবে কবির সামনে তাঁরই লেখা ‘বিসর্জন’ নাটক, আর সেই নাটকে মহড়া দিচ্ছিলেন রুবেন দারিও, লুই বনুয়েল, আর নামভূমিকায় তরুণ লোর্কা স্বয়ং। কী চমৎকারই না হতে পারত রবীন্দ্রনাথের স্পেনে আগমন! ঐতিহাসিক এই অসাক্ষাতের অবশ্য প্রভাব থেকে গিয়েছিল তার পরেও বহু কাল অবধি। এই প্রভাব এসে পড়েছিল হিমেনেথ-লোর্কার সূত্রে পরে আরেক নোবেল জয়ী কবি চিলির পাবলো নেরুদার উপরেও। লাতিন মহাদেশের এই কবি তাঁর সৃষ্টিশীলতার গোড়ার পর্বেই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সে কথা আমাদের জানা। তাঁর ‘বিশটি প্রেমের কবিতা আর একটি হতাশার সঙ্গীত’ কাব্যগ্রন্থের ১৬তম কবিতার স্তোত্র প্রত্যক্ষভাবে শুরু হয় ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ চরণটি দিয়ে। এখানেও দেখতে পাচ্ছি এক প্রাচ্যের সুর কীভাবে অন্য প্রাচ্যকে প্রভাবিত করছে। হিমেনেথ দম্পতি যেখানে রবীন্দ্রনাথের মরমি ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন, নেরুদা সেখানে সেই একই উৎস থেকে খুঁজে নিচ্ছেন অনশ্বর প্রেম ও বিরহের পদাবলি। রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করতে করতে হিমেনেথের এক সময় মনে হয়েছিল, এতে বড় বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ছেন তিনি, ক্ষতি হচ্ছে তার নিজেরই সৃষ্টিকর্মের। সেজন্যে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ কর্ম এক পর্যায়ে বন্ধ পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন। হয়তো স্প্যানিশ ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে, অথবা আন্দালুশিয়ার ভূ-প্রকৃতির মধ্যেই এমন কিছু উপাদান ছিল যা রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতার সমীপবর্তী। লোর্কার সুসি্নগ্ধ গীতিকবিতা বা ব্যালাডগুলো স্মরণ করলে এই সম্ভাবনা দূরান্বয়ী বলে মনে হয় না। এর বহু পরে আরেক নোবেল জয়ী কবি মেক্সিকোব অক্টাভিও পাজ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ১৯৬৭ সালে লিখলেন, এখানে মেক্সিকোয় ‘তরুণরা তেমনই আগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পড়ে, যেভাবে তাদের দাদামশায়রা একশো বছর আগে রোমান্টিক কবিদের রচনা পড়তেন’। পাজ নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে।

লাতিন মহাদেশের আরেক নোবেল জয়ী কবি চিলির গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। গীতাঞ্জলির কিছু কবিতা তিনি অনুবাদ করেন এবং কবির একটি নির্বাচিত কবিতার সংকলনও প্রকাশ করেন। সত্য, মুত্যু, সুন্দর, পার্থিব এসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গদ্যে-পদ্যে যা লিখে গেছেন তা নিয়ে প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন মিস্ত্রাল। মিস্ত্রালের ‘নির্বাচিত গদ্য ও গদ্য-কবিতা’য় একটি অংশ রয়েছে, যার নাম ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য’। রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে তাঁর মনে তাৎক্ষণিক যেসব প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা গদ্য-কবিতার আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন মিস্ত্রাল। আখেরে সেটি নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। মিস্ত্রাল রবীন্দ্রনাথের মতোই ভাববাদী দার্শনিক ছিলেন একথা মনে রাখলে দুই প্রাচ্যের মধ্যকার যোগসূত্র বুঝতে কষ্ট হয় না। মিস্ত্রালের রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত মন্তব্যটির অংশবিশেষ এ রকম ‘গীতাঞ্জলি’র ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে বলছেন :’না, আমার বিশ্বাস হয় না যে আমি হারিয়ে যাব মৃত্যুর পরে। হারাবার হলে তুমি আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলে কেন, যদি নিঃশেষিত আখের ক্ষেতের মত আমাকে এক সময় পরিত্যক্ত ও শূন্য হয়েই পড়ে থাকতে হবে? প্রতিদিন সকালে আমার হৃদয়ে আর কপালে এমন আলো তুমি কেন ছড়াবে, যদি আমাকে আলগোছে বেছে না নেবে, যেমনটা বেছে নেয় শরতের রোদে ভিজে ওঠা আঙুর ক্ষেত থেকে সবচেয়ে পরিপকস্ফ আঙুরটিকে? না, মৃত্যুকে বরফহিম বা মমতাশূন্য বলে মনে হয় না আবার, যেমনটা অন্যদের কাছে ঠেকে। বরং মৃত্যু যেন অনর্গল তেজের বিকীরণ এক, শরীরকে ছাই করে দেয় কেবল আত্মাকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্যে। মৃত্যুর স্পর্শ কঠিন, তিক্ত এবং তীব্র, যেরকম তোমাকে ভালবাসা, তোমার বিস্ময়-জাগানিয়া ভালবাসা!’ মিস্ত্রাল স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু বিষয়ক নশ্বর-অবিনশ্বর সংক্রান্ত ভাবনাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলিতে বলছেন, ‘ওই-যে, চাকা ঘুরছে ঝনঝনি/বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি?’ সে ধ্বনি মিস্ত্রালকেও স্পর্শ করেছে। এখানে বলা দরকার যে, ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির পর মিস্ত্রালই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি ১৯৪৫ সালে নোবেল পেয়েছিলেন তৃতীয় বিশ্ব থেকে। সাহিত্যে প্রাচ্যের তৃতীয় নোবেলপ্রাপ্তি আরও অনেক পরে জাপানে কাওয়াবাতা পান ১৯৬৮ সালে। রবীন্দ্রনাথের মতোই মিস্ত্রাল সক্রিয় ছিলেন নানা ক্ষেত্রে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন গোটা লাতিন মহাদেশে। এ নিয়ে ওকাম্পোর সাথে দীর্ঘদিন ধরে চিঠি বিনিময় হয়েছিল তার। আজ পর্যন্ত ‘ওকাম্পোর সাথে মিস্ত্রালের পত্রালাপ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে রয়েছে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য শিল্প আন্দোলন অনুধাবনের জন্যে। এ দুই বিদুষী সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের সাথেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। উল্লেখ্য, কবির লেখার প্রতি চিলির তরুণ কবি পাবলো নেরুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মিস্ত্রালই প্রথম। ষাটের দশকে ওক্টাভিও পাজও যখন মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত ছিলেন ভারতে, তখন দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক স্মারক বক্তৃতায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ও লাতিন আমেরিকা সংক্রান্ত ‘সভ্যতার আলাপ’ নিয়ে বলতে গিয়ে ওকাম্পো ও মিস্ত্রাল এ দুই অমোচনীয় বন্ধ যোগাযোগের কথা, ও সেই সুবাদে তরুণতর প্রজন্মের ওপরে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা বিশেষ গুরুত্বের সাথে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

তবে রবীন্দ্রনাথ-লাতিন মহাদেশের মধ্যকার উষ্ণ যোগাযোগের ইতিহাসে ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। তিনি বরাবরই ব্যতিক্রমী লেখার ধরনে, চিন্তার ধরনে। শুধু ধরনে নয়; ধারণাতেও। নোবেল পাননি বটে, কিন্তু অনেক বারই তার নাম এসেছিল। বিখ্যাত না পাওয়াদের দলে বোর্হেসের নাম সামনের কাতারে। ‘স্বর্গ হবে এক বিশাল লাইব্রেরির মত’ এ কথাটি যিনি বলেছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের বই পড়েননি, তা তো হওয়ার নয়। শুধু পড়েই ক্ষান্ত হননি, ১৯৩৭ সালে বেরুনো রবীন্দ্রনাথের সিলেক্টেড ওয়ার্কস-এর ম্যাকমিলান এডিশন হাতে পেয়ে দ্রুত এর একটি সমালোচনাও লিখে ফেলেন বোর্হেস। সমালোচনাটি মধুর ছিল না ‘তার সব লেখাই ঘুরেফিরে চন্দ্র আর সূর্যকে নিয়ে।’ বোর্হেস এ রকম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। মহারথীদের মধ্যকার প্রথম সন্দর্শন সব সময় ভালো যায় না। যেমন, রবীন্দ্রনাথ একবার বোদলেয়ারের কবিতা শুনে ‘ফার্নিচার পোয়েট’ বলে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিলেন। বোর্হেসের কাছেও রবীন্দ্রনাথকে একঘেয়ে পুনরুক্তিপ্রবণ বলে মনে হয়ে থাকবে। বোদলেয়ার সম্পর্কে কটূক্তি বোর্হেস ভোলেননি। ১৯২৪ সালের স্মৃতিচারণ করে তিনি যা লিখছেন তা মোটামুটি এই দাঁড়ায় :”তেরো বছর আগে নমস্য ও সুকণ্ঠের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কথা বলার কিছুটা ভীতিকর সুযোগ হয়েছিল আমার। আমরা তখন বোদলেয়ার নিয়ে কথা বলছিলাম। কেউ একজন পাঠ করছিল বোদলেয়ারের ‘ডেথ অব লাভার্স’, যেখানে বিছানা, ডিভান, ফুল, চিমনী, ফায়ারপ্লেসের তাক, আয়না এবং দেবদূতের উল্লেখ ছিল। কবি মন দিয়ে শুনছিলেন কবিতাটি। পড়া শেষ হলে মন্তব্য করলেন, ‘আমি তোমাদের ফার্নিচার পোয়েটকে পছন্দ করি না।’ সে মন্তব্যে আমি মন থেকে সায় দিয়েছিলাম। আজ কবির নিজের লেখাগুলো আবারও পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে রোমান্টিক কাব্যের প্রায় তাৎপর্যহীন অলংকারের সমারোহ তাকে ততটা বিচলিত করেনি, যতটা তাকে টেনেছিল অস্পষ্টতার প্রতি অপ্রতিরোধ্য মোহ। রবীন্দ্রনাথ অসংশোধনীয়ভাবে অস্পষ্ট উচ্চারণ করে থাকেন। তার এক হাজার একটা লাইনের মধ্যে কোথাও কোনো লিরিক্যাল টেনশন নেই, একতিলও বাক পরিমিতি নেই। নির্বাচিত সংগ্রহের ভূমিকায় কবি লিখেছেন, ‘ফর্মের সমুদ্রে ডুবে যেতে হবে এর স্বাদ পাওয়ার জন্য।’ এ ধরনের চিত্রকল্প রবীন্দ্রনাথের সহজেই আসে একাধারে তা অবয়বহীন এবং সহজে যাকে শনাক্ত করা যায় না। অর্থাৎ অস্পষ্টতা, অচিহ্নিত আবেগ, এবং নির্মাণে শৈথিল্য।” এই হচ্ছেন বোর্হেসের রবীন্দ্রনাথ। বোর্হেস যে অনুষ্ঠানের কথা বলছেন তার কিছুদিন বাদেই কবি চলে আসেন আর্জেন্টিনা থেকে। ফিরতি পথে জাহাজ থেকে রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাতে মনে হয়, বোদলেয়ার সম্পর্কে কবির কিছুটা হলেও মত পরিবর্তন হয়েছিল। ওকাম্পোর বাসায় বোদেলেয়ার চর্চা হচ্ছিল মূল ফরাসি ভাষাতে; সেটা বোদলেয়ার-ভক্ত ওকাম্পোর আগ্রহেই। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে লিখেছিলেন, ‘বিজয়া, বোদলেয়ারের সেই যে কবিতাটি তোমার সাথে পড়েছিলাম, তার লিরিক্যাল অর্থটি এতদিন পরে আমার কাছে ধরা দিচ্ছে।’ ত্রিশের দশকে তরুণতর কবিকুলের সাথে বিশেষত বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ ও অমিয় চক্রবর্তীর কথা এখানে বলতে হয় আধুনিক কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তর্কে-বিতর্কে বোদলেয়ার আরও আগ্রহের সাথে পর্যালোচিত হবে। সে রকম কোনো পুনর্চিন্তা বোর্হেসের মনে পরে জেগেছিল কিনা তা এখনও সহজে জানার উপায় নেই। বোর্হেস রবীন্দ্রনাথকে জেনেছিলেন ইংরেজি অনুবাদের সূত্রেই। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধাবলি পড়ার সুযোগ হয়নি। তার শেষ এক দশকের কবিতা তার সহজে জানার উপায় ছিল না অনুবাদের অভাবে। হতে পারে যে ন্যাশনালিজমের সমালোচনা রাশিয়া, সমাজতন্ত্র, সভ্যতার সংকট, সাম্রাজ্যবাদ এসব বিষয়ে বোর্হেসের তুলনামূলক আগ্রহ ছিল কম। ফলে এসব বিষয়ে তিনি ইপি থম্পসন, ইসাহ বার্লিন বা ব্রেখটের মতো উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আমরা যারা নানা দিক থেকে কবিকে দেখার প্রচেষ্টা করেছি, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও পিচ্ছিলতার বোর্হেসীয় অভিযোগ (‘ইমপ্রেসাইজ অ্যান্ড ফ্লুইড’) কিছুটা কষ্টকল্পিত মনে হয় বৈকি। এটা হয়তো কবির কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খাটে; সমগ্র রচনাবলির প্রেক্ষিতে নয়। বরং অত্যন্ত নির্দয় অভিধা বলেই ঠেকবে।

হিমুর শহর (Himu’s City)

Humayan Ahmed
১. হুতোম ও হিমু
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের কথা। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। শহরটা গড়ে উঠছে দ্রুত, গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে একশ্রেণীর মানুষের ধন-সম্পদ। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ধরন ‘স্ট্যাটাস-সিম্বল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাবুদের জীবনচর্চার খুঁটিনাটি নিয়ে লেখা হবে কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। উন্মেষ পর্বের আধুনিকতার নিপুণ চিত্র এটি। কিন্তু রুচি বিচারে বঙ্কিমচন্দ্র হুতোমের নিন্দাই করেছেন। তাঁর পক্ষে নিন্দা করাটাই ছিল স্বাভাবিক। নকশার যত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের উপজীব্য ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের শহর কলকাতার জীবনধারা। ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ভদ্রলোক বাবুরা সে চিত্র মনে রাখতে চাইবেন না, এটাই তো প্রত্যাশিত। তবে ভিন্নমতও ছিল সেকালে। অক্ষয়চন্দ্র সরকার লিখলেন : জীবদ্দশায় আর একখানি পুস্তক আমাকে আলোড়িত করিয়াছিল। আনন্দও পাইয়াছিলাম। সেখানি কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা। ‘আলালের ঘরের দুলালে’ও অনেক স্থানে নকশা বা ফটো তুলিবার চেষ্টা আছে বটে, কিন্তু তাহাতে পল্লী-সমাজের চিত্র যেমন পরিস্ফুট হইয়াছে। কলিকাতার অলিগলির নকশা তেমন ফুটন্ত হয় নাই। নকশা প্রকাশিত হয় ১৮৬২ সালে। পার্থ চ্যাটার্জি মন্তব্য করেছেন যে, ১৮৭০ দশকের পর থেকে শহর কলকাতা ক্রমশ বাংলা গল্প-উপন্যাস থেকে অদৃশ্য হতে থাকবে, এর অলিগলির নকশা আর সেভাবে রূপায়িত হবে না। এর জায়গা নেবে মধ্যবিত্ত পাত্র-পাত্রীরা, যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং যাদের মূল প্রেরণা হবে জাতীয়তাবাদ। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের আর্লি মডার্নিটির জায়গায় আসবে দ্বিতীয়ার্ধের ‘কলোনিয়াল মডার্নিটি’। নববাবু বিলাসের কেচ্ছা কাহিনী, নববাবুদের অবাধ ও অলজ্জিত জীবন চর্চার কাহিনী প্রকাশ করতে। সংকোচ বোধ করবে পরবর্তী সময়ের বাংলা গল্প-উপন্যাস। সেই সঙ্গে নিচুতলার মানুষের অকৃত্রিম চিত্রও হয়ে পড়বে ঝাপসা (মার্কসবাদী হাতেগোনা কিছু ‘সচেতন প্রয়াস’ ব্যতিরেকে)। হুতোমের প্রশংসা করা হবে বটে। কিন্তু তার পদ্ধতি প্রয়োগকে একালের রুচির জন্য অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হবে বঙ্কিমচন্দ্রের রুচি বিচারকে শিরোধার্য করেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘বাঙালা সাহিত্য’ প্রবন্ধে নকশা নিয়ে এরূপ মন্তব্য করবেন যে হুতোম পেঁচাও পরিবর্তন সময়ের একটি মহার্ঘ রত্ন। ইহাতে তৎকালীন সমাজের অতি সুন্দর চিত্র আছে। হুতোম হুতোমীয় ভাষার প্রবর্তক এবং বহুসংখ্যক হুতোমী পুস্তকের আদিপুরুষ। আরও পরে প্রমথ চৌধুরী লিখলেন :’নকশা হচ্ছে তখনকার সমাজের আগাগোড়া বিদ্রূপ এবং অতি চমৎকার লেখা। এ বই সেকালের কলিকাতা শহরের চলতি ভাষায় লেখা। এ রকম চতুর গ্রন্থ বাঙ্গালা ভাষায় আর দ্বিতীয় নেই।’ শহর কলকাতার উঁচু ও নিচুতলার জীবন নিয়ে ঝরঝরে চলিত বাংলায় এ রকম বই আর লেখা হয়নি তার মূল কারণ অন্যত্র। লুণ্ঠন, রক্তারক্তি, উচ্ছেদ ও সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে রচিত হয় আধুনিক শহরের উন্মেষ পর্ব। সেই পর্বের নকশা সব সময়ই উচ্চবর্গের, নগরবাসীর জন্য অস্বস্তিকর। কিছু জিনিস ভুলে যাওয়াই ভালো, যেমন কোনো দূর বা নিকট অতীতের অন্ধকার অপরাধগুলো। সে কারণেই পরবর্তী সময়ে যখন শহরের সমৃদ্ধি আরও বাড়তে থাকে, আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্র, ইংরেজি শিক্ষা, প্রযুক্তি ও জাতীয়তাবাদ যখন থেকে আমাদের রুচির মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়, আমরা তখন উন্মেষ পর্বকে ভুলতে শুরু করি। ভুলতে ভুলতে একসময় মনেই থাকে না কিসের মধ্য দিয়ে শুরু করে কোথায় এসে পেঁছেছি। আধুনিক পুঁজিবাদ তাই মর্মগতভাবে বিস্মরণমূলক। শুধু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে কিছু লেখা, যেমন কলকাতার আদি পর্বের ‘নকশা’ অথবা বাংলাদেশের জন্য হুমায়ূন আহমেদের হিমু-পর্বের রচনাসমূহ।

হুতোমের সঙ্গে হিমুর প্রসঙ্গ আসছে ঠিক কী অর্থে? শহর কলকাতার মতো শহর ঢাকা গড়ে ওঠার অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাই হুমায়ূন আহমেদের লেখায়। বস্তুত তার সমগ্র রচনাকর্ম গত চার দশকের বেশি সময় ধরে এই রাষ্ট্রের, এই সমাজের এবং এই শহরের গড়ে ওঠারই ইতিবৃত্ত। বিশেষত স্বল্পতম সময়ে কী করে একটি আধুনিক নগর-সমাজ গড়ে উঠল? কী করে এই ঢাকা শহরের বুকে একটি ‘নববাবু সমাজ’ আত্মপ্রকাশ করল তার রাখঢাকহীন বর্ণনা উঠে এসেছে হিমুর বয়ানে। এ চিত্র হুমায়ূন না লিখলে আমরা আর কারও কাছ থেকে এ সময়ে পেতাম না, পাইনি এখনও। হিমু আরও নানা কারণে মনে রাখার মতো। হুতোম যেখানে কেবলই ‘নকশা’, কোনো গল্প-উপন্যাস লেখার চেষ্টা করা হয়নি সেখানে, হিমু সেখানে নিজেই এক দীর্ঘ উপাখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বাংলা সাহিত্যে এ রকম চরিত্র নির্মাণ এর আগে কখনও ছিল না। এর পরও কখনও হয়নি। হিমুর ব্যতিক্রমী জীবনচর্চার পাশাপাশি তার সমৃদ্ধ দার্শনিকতা বা অনর্গল ভাবনার জীবন চরিত্রটিকে পাঠকের ঘনিষ্ঠ করেছে। হিমু একই সঙ্গে যুক্ত ও বিযুক্ত ঘটনার কেন্দ্রে ও প্রান্তে, অনুভূতিপ্রবণ এবং নির্বিকার, লজিক এবং অ্যান্টি-লজিক হিমুকে ভাবলে আমার একটি সংস্কৃত-ভাষ্যের কথা মনে পড়ে যায় :’যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন, মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই যোগী এবং তিনিই সর্বকর্মকারী।’ ব্যক্তিগত এসব বিশিষ্টতার কারণে হিমু বিষয়ক রচনা পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। কিন্তু হিমু সমগ্রকে অন্যভাবেও পাঠ করা যায়। এর প্রায় প্রতিটিরই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শহর ঢাকার জীবন। হিমু অনায়াসে এই শহরের উঁচুতলা ও নিচুতলায় যাতায়াত করে রাস্তার ভিক্ষুক, ফুটপাতের খাবার বিক্রেতা, দিনমজুর থেকে শুরু করে একই দিনে যে অবলীলায় চলে যেতে পারে অভিজাততম প্রাসাদে বা হোটেলে। হিমুর এই পারাপার করার ক্ষমতা তাঁকে একধরনের ‘ইন্টারপ্রেটার’-এর ভূমিকা দিয়েছে। সে ক্ষমতাবানদের কাছে ক্ষমতাহীনের অবস্থা তুলে ধরে, আবার ক্ষমতাবানদের তুলে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয় ক্ষমতাহীনদের মধ্যিখানে। অন্য সময়ে, যেন পরীক্ষা করতেই, ক্ষমতাহীনকে বানিয়ে দেয় একদিনের বাদশাহ, যেমন বাদশাহকে পথের ফকির এবং এই চলাচলের মধ্য দিয়ে আর কে না জানে ‘পথ চলাতেই তাঁর যত আনন্দ, সে আবিষ্কার করে ঢাকা শহরের জন্মবৃত্তান্ত। ঢাকার অলিগলির নকশা আমাদের সামনে তুলে ধরে কোনো আড়াল না করে; এমনকি প্রচণ্ড ক্ষমতাধরদের বাধা বা হুমকির তোয়াক্কা না করেই। এখানেই হুতোমের সঙ্গে হিমুর বড় মিল।

২. হিমুর উচ্চবর্গ প্রতিপক্ষ
জন্মসূত্রে প্রাপ্ত কয়েকটি ডালপালা হিমুকে উচ্চবর্গের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। কৃষ্ণের মাতুলবংশ যেমন (কংসকুল) সবসময় অন্যের অনিষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, হিমুর মাতুলবংশও তেমনি সব সময় অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে লিপ্ত। হুমায়ূন আরও কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘পিশাচবংশ’। পিশাচের সংজ্ঞাও নির্দিষ্ট হয়েছে এভাবে : ‘মানুষ হিসেবে মামারা পিশাচ শ্রেণীর। তাঁদের সমস্ত ভালোবাসা নিজের মানুষদের জন্যে। বাইরের কারোর জন্যে নয়।’ প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েও এদের পিশাচ স্বভাব যায়নি। বড় মামা মরবার সময় এক অন্ধকার বৃষ্টির রাতে একজন কেউ মাছ মারবার কোঁচ দিয়ে তাকে গেঁথে ফেলে তিনি তার ‘ডেথ বেড কনফেসনে’ নির্দোষ প্রতিপক্ষ কিছু মানুষকে জড়িয়ে দিয়ে যান। মরবার আগে মেজো মামাকে কানে কানে বললেন ‘এক ধাক্কায় চার শত্রু শেষ। কাজটা মন্দ হয় নাই। এই মেজো মামা আবার গোটা পাঁচেক খুন করেছেন। অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি।’ এহেন মামার বাড়িতে থেকে হিমু ম্যাট্রিক পাস করেছে। হুমায়ূন আহমেদ শুভ-অশুভের ডিভাইন-ডেভিলের গোপন সম্পর্ক-তত্ত্বে বোধকরি বিশ্বাস করতেন। আর সব মানুষ যেখানে যাঁ শ্রেণীর ইয়েস ম্যান গোছের, সেখানে না-শ্রেণীর মানুষেরা হয় শয়তান নয় মহাপুরুষ এ রকম একটি ভাবনা তাঁর মাথায় ছিল হিমুর বংশ লতিকার স্বভাব বর্ণনার ক্ষেত্রে। কিন্তু পরবর্তীতে হিমুর কাহিনী যতই শহরজীবনের অন্তস্থলে এগোতে থাকে, ততই বুঝতে পারি আমরা গ্রামের ফিউডাল পিশাচ বংশের চেয়ে বড় পিশাচ হচ্ছে ঢাকা শহরের নব বাবু সমাজ। তাদের মধ্যে পরার্থপরতার বালাই নেই হিমুর মাতুলবংশের মতই, কিন্তু যেখানে ভিন্নতা সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর এদের অনায়াস কর্তৃত্ব। এরা দুর্নীতিপরায়ণ-নীতিবোধের কোন সংশয় নেই এদের মনে এরা দিনকে রাত করে, অবলীলায় মানুষ খুন করে ধ্রুপদী সংগীতে গা ভাসিয়ে দিতে পারে। গাঁও-গেরামের মাতুলেরা সে তুলনায় চুনোপুঁটি। গ্রাম থেকে ছোট মামা হিমুর জরুরি বার্তা পেয়ে ছুটে এসেছেন, তার সাথে হিমুর কথা হচ্ছে জেলখানার এক ফাঁসির আসামির সাথে দেখা করার অনুমতি করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। ছোট মামা প্রথমে ভেবেছেন, টাকা খরচ করেই কার্যোদ্ধার করবেন, পরে বুঝলেন যে ঢাকা শহরে শুধু টাকা খরচই যথেষ্ট নয়, ক্ষমতার স্থান টাকারও উপরে। হিমু তাই বলল, ‘তুমি পারবে না মামা। তোমার ক্ষমতার বাইরে।’ মামা সব শুনে বললেন, ‘পুলিশে সাজানো মামলা পেছনে আছে বড় খুঁটি। ‘কিছু করা যাবে না।’ ঢাকা শহরের নবলব্ধ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে একটা শ্রেণীর হাতে নবলব্ধ উত্তরোত্তর ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। এই ক্যাপিটালিজমের কাছে ফিওডালিজম অসহায়।

হিমুর দীর্ঘ উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকার নব অভিজাত শ্রেণীর ও তাদের নবলব্ধ ক্ষমতার সম্পর্কে এমন কিছু কঠিন কঠিন কথা বলেছেন যা দুই বাংলার সমসাময়িক সাহিত্যেই অত্যন্ত দুর্লভ। এক-আধবার হলে কথা ছিল না, কিন্তু বইয়ের পর বইয়ে এই কঠিন কথাগুলো স্থান পেয়েছে। হিমুর প্রতিটা বইই আকারে ছোট উপন্যাসিকা বা ছোট উপন্যাস জাতীয় কিন্তু এদের মধ্যে কন্টিনিউটি, সম্পর্ক (ও বিচ্ছেদ) রয়েছে। ফলে সবগুলো মিলিয়ে হিমু-বিষয়ক একটি দীর্ঘ উপাখ্যান বা ন্যারেটিভ ভাবতে কষ্ট হয় না। এই উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে উচ্চচিত্ত সমাজের নীচতা, অমানবিকতা ও পাশবিকতার নির্মম নকশা মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠেছে। হালকা রসিকতা বা ইয়ার্কির ছলে চলা কথোপকথনের মধ্যে হঠাৎই বেরিয়ে পড়েছে থলের বেড়াল, আর এ রকম হলে অজস্র। ‘দরজার ওপাশে’ শুধু একটি বই থেকেই এটা প্রমাণ করা যায়। একগুচ্ছ উদাহরণ :

১. ‘টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না। এক লাখ টাকা থাকলে দুটা খুন করা যায়। প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার। পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে।’
২. ‘জাজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে। আগে জাজ সাহেবরা টাকা খেত না। এখন খায়। অনেক জাজ দেখেছি কাতলা মাছের মত হাঁ করে থাকে।’
৩. ‘বুদ্ধিমান লোক মাঝে মাঝে প্রথম শ্রেণীর বোকার মত কাজ করে। আমিও তাই করেছি। টাকা পয়সা অনেক ব্যাংকেই ছিল। ছিল আমার নিজের নামে। কিছু যে অন্যের নামে রাখা দরকার, কিছু ক্যাশ দরকার এটা কখনো মনে হয়নি।’
৪. ‘একটা বোকা লোক সব সরকারের আমলে মন্ত্রী হয় না। এক সরকারের আমলে হয়, অন্য সরকারের আমলে জেলে চলে যায়।’
৫. ‘পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ কঠিন জিনিস। শরীরের চামড়াটা শুধু থাকবে হাড্ডি যা আছে পানি হয়ে পিসাবের সঙ্গে বের হয়ে যাবে।’

আমাদের এও ভুলে গেলে চলবে না এক-এগারোর প্রবল দাপটের সময় হিমুর মাধ্যমেই হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’ এর মতো সাহসী উপন্যাস। নানা দেশে বিশেষ বাহিনীর অত্যাচারের যে ধারা চালু আছে তার বিরুদ্ধে হিমুকে দিয়ে প্রতিবাদ করিয়েছেন লেখক। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে যে কোনো মানুষই অসহায়, বিশেষ বাহিনীর কাছে আরও বেশি অসহায়। এদেরকে নিয়ে ঠাট্টা ছলে যে কাণ্ড হিমু করেছে তাতে সাধারণ মানুষের চাপা ক্ষোভের প্রকাশ পেয়েছে। একটি উদাহরণ : হিমুকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তিনজনের একটা টিম ঘামবাবু, হামবাবু ও মধ্যমণি এই নাম দিয়ে পাঠকদের সাথে পরিচয় করানো হচ্ছে। সেখানে ছড়া কাটছে হিমু : ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/র‌্যাব এল দেশে/সন্ত্রাসীরা ধান খেয়েছে/খাজনা দেব কীসে?’ এটি ননসেন্স রাইম যার কোনো মানে হয় না, আবার হয়ও। অথবা এই বইয়ের অন্যত্র, হিমুকে যখন ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে, তখন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে এ রকম :

‘বালতিতে কী?

পানি।

দেখাও। পানিও দেখালাম।

তোমার ব্যাগে কী?

একটা বই স্যার।

কী বই?

জঙ্গি বই স্যার। বিরাট বড় এক জঙ্গির জীবনকথা। জঙ্গির নাম চেঙ্গিস খান। নাম শুনেছেন কি-না জানি না।

দেখি বইটা। র‌যাবের এই লোক (কথাবার্তায় মনে হচ্ছে অফিসার) বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। বইটা কার?

আমার মামাতো বোনের মেয়ের। মেয়ের নাম মিতু। ভিকারুননিসা স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। ছাত্রী খারাপ না। স্যার, আমি এখন যেতে পারি?

না। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে।

আমি আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার ক্রসফায়ার হবে?’

অফিসার জবাব দিলেন না।

এর পরপরই এল সেই মোক্ষম লাইন যা হুমায়ূনের একান্ত নিজস্ব আবিষ্কার : ‘পুলিশের সঙ্গে র‌্যাবের এইটাই মনে হয় তফাত। পুলিশ কথা বেশি বলে। র‌যাব চুপচাপ। তারা কর্মবীর। কর্মে বিশ্বাসী। ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠার জন্য, এই সাহসিকতা দেখানোর জন্যে হিমুকে সাধারণ মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।

৩. হিমুর ‘সাব-অলটার্ন’ বন্ধুরা
আগেই বলেছি, হিমু ঠিক সাব-অলটার্ন অর্থাৎ নিম্নবর্গের মানুষ নন। উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে তার অবাধ সামাজিক যাতায়াত, এ দুইয়ের মধ্যে সে বোধকরি শেষ সামাজিক সেতু। ইংরেজিতে ‘গো বিটুইন’ যাকে বলে। কিন্তু এটাও ঠিক, হুমায়ূনের পক্ষপাতিত্ব কোনখানে দূরসম্পর্কের রেশমা খালার প্রসাদ যেটা হচ্ছে গুলশান এলাকার সবচেয়ে অভিজাত বাড়ি তার চোখ-ধাঁধানো বর্ণনা আছে ‘এবং হিমু’ বইতে। একই বাড়িতে ঘরের পর ঘর। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অপূর্ব মিলন যাকে বলে, ইউরোপীয় স্টাইলে বার-ঘরও আছে। ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি দিয়ে করা নামাজ ঘরও আছে। শঠতা ও ধর্মভাবাপন্নতা হুতোমের যুগে যেমন, হিমুর কালেও সমান তালে বিদ্যমান। নকশা-য় বাবুরা সেজে-গুজে ‘বারোইয়ারী’ দুর্গাপূজা দর্শন সেরে বেশ্যা পল্লীতে যাচ্ছেন, এ যুগে এরই রকম-ফের চলছে ধর্মকর্ম ও দুর্নীতিলব্ধ আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা সমান তালে ঠিক রেখে। সেই শঙ্ক ঘোষের কবিতার মতো ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি। দুর্গা-মার কাছে প্রাণ খুলে বর চাইছি যাতে ‘লুটে পুটে’ খাই। এসব প্রবণতা হুমায়ূন তাঁর নানা চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন এর মধ্যে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ উভয় শ্রেণীরই মানুষ রয়েছে। কিন্তু তার মূল পক্ষপাতিত্ব বরাবর ছিল ক্ষমতাহীন অসহায় মানুষদের প্রতি। তাই সন্ত্রাসী ‘আঙুল কাটা জগলু’ হিমুর হাতে পড়ে কেমন নরম মানবিক হয়ে যায়। গরম ভাত ও ডিম সেদ্ধ খাওয়ার জন্য আকুল ক্রসফায়ারের ‘মুরগি ছাদেক’-এর জন্য এক ধরনের সহমর্মিতা বোধ করি আমরা। শুভ্র-র বাবা র‌্যাব অফিসার হামবাবু হঠাৎ ভদ্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। হিমু যুক্তি দেয়, ‘স্যার, মানুষ ক্যান্সার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যত্নে তৈরি করে। … এত যত্নে তৈরি একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মারা পড়ে এটা কি ঠিক?’ কেননা, পিশাচেরও বিচার আছে। ‘পিশাচের কথাও আমরা শুনব। সে কেন পিশাচ হয়েছে এটাও দেখব।’

হিমুর সাব-অলটার্ন বন্ধুদের কথা উঠলেই প্রথমে মনে পড়বে ‘দীনের হাতে দীন’ চরম দরিদ্র মানুষদের কথা যাদের কথা ঘুরে-ফিরে এসেছে হিমুর নানা পর্বে। ইয়াদ সাহেব ভিখেরিদের নিয়ে গবেষণা করছেন, তার বিষয় ‘ভাসমান জনগোষ্ঠী : আর্থ-সামজিক নিরীক্ষার আলোকে’। হিমু এক পর্যায়ে তার মাথায় ঢুকিয়েছে যে ভিক্ষুকের ওপরে কাজ করতে হলে তাকে ভিক্ষুকের সাথে থাকতে হবে। হিমুর পক্ষে ভিক্ষুক-শ্রেণীর সাথে নিশিযাপন কোনো বিষয় না, সে কতবার ফুটপাতে এমন ঘুমিয়েছে। ফুটপাতে বা নিম্নবিত্তদের হোটেলে ভাত খাওয়া বরং হিমুর একটি প্রিয় কাজ। মজনু মিয়ার ভাত মাছের হোটেল, বস্তিতে গিয়ে মাতৃস্থানীয়া মহিলার হাতে রাঁধা মাছের সালুন-তরকারি, ড্রাইভার মকবুলের সাথে শহর অবাধে ঘোরা। তরঙ্গিনী ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মুহিব সাহেবের কাছে বাকিতে চেয়ে জিনিস আনা, মেসের জীবন বাবুর কাছে তার সুখ-দুঃখের কথা শোনা ইত্যাদি। ‘হিমু’ উপন্যাসে মেসের জীবন বাবু এসে হিমুকে এ-ও জানিয়েছেন কোনো একটা রুমে বোর্ডারদের মধ্যে মারামারি রক্তারক্তি কাণ্ড হয়েছে। কেউ মারা যায়নি তাতে, কিন্তু যদি মারা যেত তাহলে তিনি বিপদে পড়তে পারতেন। ‘খুনখারাবি হলে পুলিশ আগে কাকে ধরত? আমাকে। আমি হলাম মাইনরিটি দলের লোক। … সব চাপ যায় মাইনরিটির ওপর। আপনারা মেজরিটি হয়ে বেঁচে গেছেন।’

বেঁচে অবশ্য যাওয়া যায়নি। যারা সততার সাথে জীবন নির্বাহ করতে চান তাদের জন্য দুটো পথই খোলাসা হয়, পিঁপড়ের মতো অসহায় হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। নয়তো সততার পথ ছাড়তে হবে। হিমুর হুমায়ূন তৃতীয় পথে বিশ্বাস করতেন। প্রতিবাদ করে যেতে হবে, প্রতিবাদ করে যেতে হবে এবং প্রতিবাদ করে যেতে হবে। সরবে এবং নীরবে, এক্ষেত্রে কালীপ্রসন্ন সিংহ তার সাথেই রয়েছেন। কলকাতার নববাবু সমাজকে উদ্দেশ করে নকশার উপসংহারে বলছেন : ‘হা বঙ্গবাসীগণ! তোমরা এইরূপেই আপনাদিগকে সভ্য বলে পরিচয় দিয়ে থাক! যাঁদের ধর্ম্ম কর্ম্ম এইরূপ, যাঁদের আমোদ প্রমোদের প্রণালী এই, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই এইরূপ হিপোক্রিট। তাঁরা আবার সভ্য বলে পরিচয় দেন।’

একথা হুমায়ূন আহমেদও বলতে পারতেন, ‘রঙপেন্সিল’ শীর্ষক কলাম-গুচ্ছে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, পবিত্র কোরআন শরিফের একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘এবং বেহেশতে তোমরা প্রবেশ করবে ঈর্ষামুক্ত অবস্থায়!’ হিমুর শহর দরিদ্রকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। মানি লোকের সম্মান করতে জানে না। হিমু পড়তে পড়তে একসময় আমার মনে হয়েছে, এই নিষ্ঠুর, মূক ও বধির শহরে একই সাথে চেতন ও অবচেতনে অবগাহন করা ছাড়া উপায় নেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার। এজন্যেই কি ঢাকার রাস্তায় চলতে চলতে হিমু অনেক সময় জ্যোৎস্নার জগতে হারিয়ে যায়? আর কে না জানে। জ্যোৎস্নার অলৌকিক জগতে একবার ঢুকে গেলে লৌকিক জগতে ফিরে আসা বা না আসা সমান অর্থহীন হয়ে পড়ে।

রাষ্ট্র ও নিরাশ্রয়

মোহভঙ্গের কবিতা

বিনায়ক সেন

১. নাদের আলি, আমি আর কত বড় হব?

১৯৭২ সালে, মনে পড়ে, প্রথম আমাদের হাতে আসে রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের কাব্য-সমগ্র। এর ভূমিকায় জীবনানন্দের কবিতা ও কাব্যবিশ্বাসের গভীর ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল। প্রগতিশীল সমাজ পরিবর্তনের পক্ষের শক্তি ও আত্মিক সমর্থক হিসেবেই কবিকে চিহ্নিত করেছিলেন এই বামপন্থী সাহিত্য-সমালোচক। ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ থেকে উদৃব্দতি দিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর বক্তব্য সপ্রমাণিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ভূমিকাটি পড়ে সে সময় আমার মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। অগ্রণী ‘মার্কসবাদী’ সমালোচক হয়েও তিনি ‘অমার্কসবাদী’ জীবনানন্দের প্রতি এত উৎসাহ নিয়েছিলেন কেন? এটুকু তো জানাই ছিল যে, জীবনানন্দ আদর্শে আস্থাবান কোনো সমর সেন, অরুণ মিত্র বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় নন। জীবদ্দশায় কোনো মার্কসবাদী পার্টি বা ঐ ধারার সাহিত্য-গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত ছিলেন না তিনি। ‘নির্জনতম কবি’র যে শিরোপা বুদ্ধদেব বসু তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলেন তাতে অন্যকিছু তাঁকে ভাবা সহজ ছিল না। তার ওপরে যোগ হয়েছিল তাঁর ‘রূপসী বাংলা’র ক্রমবর্ধমান অতুল জনপ্রিয়তা। সদ্য স্বাধীন দেশে মনে হতো ‘রূপসী বাংলা’ যেন বাংলাদেশকে স্মরণ করেই এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা আগাম ভেবেই কবি লিখেছিলেন! এ দেশের নদী-নালা, মাঠ-পুকুর, বৃক্ষলতা, পাখ-পাখালি, আদিগন্ত ছড়িয়ে থাকা সবুজ ধানক্ষেত, বাংলার রূপকথা ও কিংবদন্তিমালা, কৃষি ও কৃষকের জীবন, গ্রাম ছেড়ে আসা শহরের উঠতি মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও টানাপড়েন_ সব মিলিয়ে তখন ‘রূপসী বাংলা’র কবিকে মনে হতো পূর্ববর্তী এক অন্য ভুবনের মানুষ। এর মধ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শের চিহ্ন খোঁজা মনে হয়েছিল কষ্টকল্পনাই। এর কিছুদিন পরেই হাতে পেলাম আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘শুদ্ধতম কবি’। সৈয়দের গদ্যের ছটা আর জীবনানন্দের কবিতার ওপর ভিনদেশি প্রভাবের নিপুণ বিশ্লেষণ আমাদের প্রজন্মকে বিমোহিত করেছিল। সৈয়দ তাঁর লেখায় জীবনানন্দের কবিকৃতির ওপর জোর দিয়েছেন মূলত আঙ্গিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। কবির সামাজিক আকাঙ্ক্ষাকে বিশেষ কোনো গোচরে আনেননি তিনিও। ফলে জীবনানন্দের ‘অরাজনৈতিক’ ভাবমূর্তি আরও প্রবলভাবে গেড়ে বসে আমাদের তৎকালীন ধারণার মধ্যে। কিন্তু আর কেউ নন, স্বয়ং রণেশ দাশগুপ্ত জীবনানন্দ দাশের কাব্য-সমগ্রের প্রবল ইতিবাচক ভূমিকা লিখেছেন_ এই খটকাটি শেষ পর্যন্ত থেকেই যায় মনের মধ্যে। তাহলে কি জীবনানন্দ সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি তা সম্পূর্ণ নয়? তাঁর কাব্যজীবনের পেছনে [সে সময় তাঁর গদ্য রচনাগুলোর অস্তিত্ব আমরা জানতাম না] রয়ে গেছে সমাজ-রাষ্ট্রবিষয়ক কোনো নিভৃত সমাচার? তখন দেশভাগ, দেশান্তর, উদ্বাস্তু জীবন_ ১৯৪৭-এর এসব রাষ্ট্রিক ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে ভাবার তাগিদ তৈরি হয়নি। বরিশালে বিএম কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন, সেখানেই বেশিরভাগ কবিতা লিখেছেন, দেশ ভাগের পর কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন, এবং ঐ শহরেই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে এক ট্রাম-দুর্ঘটনায় মারা যান। জীবনানন্দবিষয়ক আত্মজৈবনিক তথ্য এটুকুতেই সীমিত ছিল। এ বিষয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ তো বটেই, রণেশ দাশগুপ্তও বিস্তৃত করে কিছু জানাননি তখন। ক্লিনটন বুথ সিলির জীবনানন্দ জীবনী তখনও আসতে বাকি।

এ রকম অনবধানতা ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরেও। সত্তরের দশকে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক উৎসবে, পাড়ার ‘বিচিত্রানুষ্ঠানে’ [তখনও পাড়াকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানাদি হতো এ দেশে] আবৃত্তিযোগ্য কবিতার প্রথম সারিতে থাকত ‘কেউ কথা রাখেনি’। আমরা তখন কেউই বিশেষ খেয়াল করিনি এর অন্যতম চরিত্র নাদের আলিকে, যে কবিকে তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তা-ও আবার যা তা বিল নয়, সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর নাকি একসঙ্গে খেলা করত। এ নিয়ে সুনীলের ব্যাখ্যা পরে শুনেছি : ‘পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমরের খেলা করার ছবিটা মোটেই কাল্পনিক নয়। এ রকম দেখাই যায় মাঝে মাঝে। তবে, পদ্মফুলের বদলে শালুক হতে পারে, আর সাপ হলো খুব সম্ভবত জলঢোড়া।’ ‘তিন প্রহরের বিল’ যে মাদারীপুরের পূর্ব মাইজপাড়ার অপসৃত কোনো এক ব্রাহ্মণপল্লীর কাছেই, সে কথা তখন কারও মাথায় আসেনি। কবিতাটিতে শুধু পূর্ববঙ্গ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দেশভাগ-পরবর্তী শহর কলকাতার কঠিন উদ্বাস্তু জীবনের কথাও। আর ছিল বঞ্চনা থেকে উত্থিত শ্রেণী-বৈষম্য চেতনা_ সেটিও বহু পরে চোখে পড়েছে। চৌধুরীদের বিশাল ভবনের ভেতরে চলছে রাশ-উৎসব, তার গেটে দাঁড়িয়ে কবি দেখছেন সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা কত-না আমোদে হাসছে, তাঁর কৈশোরক অস্তিত্বের দিকে তারা কেউ ফিরেও তাকায়নি! ‘বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস একদিন আমরাও’_ এ শ্রেণী-বৈষম্য চেতনা নয়তো কী!
১৯৭২ সালের জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছে শামসুর রাহমানের ‘স্যামসন’। মুক্তিযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, কিন্তু ন’মাস ধরে পুরো দেশটাকে বন্দিশিবির বানানোর ক্ষোভ তখনও যায়নি। ‘ক্ষমতামাতাল জঙ্গি হে প্রভুরা ভেবেছো তোমরা, তোমাদের হোমরা-চোমরা সভাসদ, চাটুকার সবাই অক্ষত থেকে যাবে চিরদিন?’ এই ত্রুক্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ স্বর প্রাত্যহিকতার জগৎ থেকে তুলে নিয়ে কবিতায় সাজানো হয়েছিল। ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন নবজাত রাষ্ট্রের প্রধান কবিকণ্ঠটি। অসহায় অন্ধ শৃঙ্খলিত মিল্টন-বর্ণিত প্যারাডাইস লস্টের ‘স্যামসন’-এর তুলনায় এ এক অন্য স্যামসন প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে। তখন সত্যই ছিল প্রদীপ্ত হওয়ার সময়। ১৯৭১-এ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়ে এটাই ছিল প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা, সার্থকতমও। এর আগে বাংলা কবিতায় এই স্বর শোনা যায়নি:

‘আমাকে করেছো অন্ধ, যেন আর নানা দুষ্কৃতি
তোমাদের কিছুতেই না পড়ে আমার চোখে। স্মৃতি
তাও কি পারবে মুছে দিতে? যা দেখেছি এতদিন_
পাইকারি হত্যা দিগ্গি্বদিক রমণীদলন আর ক্ষান্তিহীন
রক্তাক্ত দস্যুতা তোমাদের, বিধ্বস্ত শহর, অগণিত
দগ্ধ গ্রাম, অসহায় মানুষ, তাড়িত, ক্লান্ত; ভীত
_এই কি যথেষ্ট নয়? পারবে কি এসব ভীষণ
দৃশ্যাবলি আমূল উপড়ে নিতে আমার দু-চোখের মতন?
দৃষ্টি নেই, কিন্তু আজো রক্তের সুতীব্র ঘ্রাণ পাই,
কানে আসে আর্তনাদ ঘনঘন, যতই সাফাই
তোমরা গাও না কেন, সব কিছু বুঝি ঠিকই…’

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে স্বাধীনতা সাম্যের স্পৃহা জাগে, কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘পাওয়ার, প্রফিট আর প্রিভিলেজ’ এই তিন উপাদানের সম্মোহক প্রভাবে পড়ে যারা হয়তো সমাজ-রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে পারতেন, সংকটে পথ দেখাতে পারতেন, তারাও সে পথ ছেড়ে চলে গেছেন অন্য এক বলয়ে। এলিট আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগহীনতা এখন এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, আজ তারা দুই ভিন্ন গ্রহের অধিবাসী :পরস্পরের ভাষা বুঝতেও তারা অক্ষম। শামসুর রাহমানের কবিতা রাষ্ট্র তথা এলিট শ্রেণীর এই ব্যর্থতাকে তুলে ধরে।

সত্তর দশক থেকে শুরু করে শামসুর রাহমানের কবিতায় ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসা নিরাশার ছায়া তাঁর কবিতার বইয়ের নিরাশাকরোজ্জ্বল নামকরণের মধ্যেই সুস্পষ্ট। ধারাবাহিকভাবে শোক, ক্ষোভ ও বেদনার পতাকা উড়িয়েছে তাঁর কবিতার বইগুলি : দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, আমি অনাহারী, শূন্যতায় তুমি শোকসভা, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে, অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই, শিরোনাম মনে পড়ে না, ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ, এক ফোঁটা কেমন অনল, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার, খুব বেশি ভালো থাকতে নেই, ধ্বংসের কিনারে বসে, গৃহযুদ্ধের আগে, খণ্ডিত গৌরব, হরিণের হাড়, উজাড় বাগানে, স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নে বেঁচে আছি, ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে, গন্তব্য নাই বা থাকুক, গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান ইত্যাদি।

জীবনানন্দের কোনো মোহ ছিল না ১৯৪৭ নিয়ে, সুনীলের মোহভঙ্গ হয়েছিল পঞ্চাশ-ষাটের দশকের অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে_ তারও পেছনে ছিল দেশভাগজনিত মানবিক বিপর্যয়। শামসুর রাহমানকে দেশভাগের সূত্রে দেশান্তরিত হয়ে আসতে হয়নি এ দেশে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকে ঘিরে যে প্রচণ্ড আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে, তাকে ক্রমশ বিলীন হতে দেখেছেন তিনি। নিজেকে দেশান্তরিত উদ্বাস্তু মনে করার কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু তিনি ছিলেন দেশের ভেতরেই মানসিক এক উদ্বাস্তু, একধরনের ‘ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পারসন’। বাংলা সাহিত্যের তিনজন প্রধান কবিরই মোহভঙ্গ হয়েছিল আধুনিক রাষ্ট্রের বিষয়ে। ঔপনিবেশিকতার অবসান হলেই নবযুগের সূচনা হবে রাতারাতি_ এ কথা তিনজনের কেউই চিন্তা করতেন না। তবে নবযুগের আকাশে পূর্ণিমা না আসুক ঘোর কৃষ্ণপক্ষে তা ঢেকে যাবে না, এটাও তাঁরা বিশ্বাস করতেন। বাস্তবতা ছিল আরও নির্মম। এ কথা মেনে নিতে তাদের কষ্ট হওয়ারই কথা। তিনজনার কষ্টের কার্যকারণ এক নয়; যে সময়ে তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পরিণতি প্রাপ্তি তা-ও ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ভূগোলের। তারপরও তা একই কষ্টের গল্প। নিরাশ্রয়ের কষ্ট ছিল তিনজনেরই জীবনে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন, কবির মৃত্যু না হলে ফুল জন্মায় না। এই তিন বাঙালি কবির মৃত্যুতে পৃথিবীতে তিনটি আশ্চর্য জাতের গোলাপের জন্ম হয়েছিল।

২. বিভিন্ন কোরাস

‘তরুণ’ ও ‘পরিণত’ মার্কসের মধ্যে যেমন, তরুণ ও পরিণত জীবনানন্দের মধ্যেও বোধকরি সে রকম একটি বিভাজন রেখা রয়ে গেছে। অনেকটা ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার যেমন বলেছিলেন_ জীবনের দুই পর্বের রচনার মধ্যে এপিস্টেমোলজিক্যাল ব্রেক বা জ্ঞানতাত্তি্বক ছেদ! তাঁর কাব্যজীবনের ‘আগের’ নাকি ‘পরের’ পর্বটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ_ এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। ‘বনলতা সেন’ ও তার পূর্ববর্তী কবিতাকে বুদ্ধদেব বসু অনেক বড় করে দেখেছিলেন। বুদ্ধদেবের কথা উল্লেখ করেই জীবনানন্দ এক চিঠিতে প্রভাকর সেনকে জানিয়েছিলেন, “আমার কবিতার জন্য বেশ বড় স্থান দিয়েছিলেন তিনি প্রগতিতে এবং পরে ‘কবিতা’য় প্রথম দিক দিয়ে। তারপরে ‘বনলতা সেন’-এর পরবর্তী কাব্যে আমি তাঁর পৃথিবীর অপরিচিত, আমার নিজেরও পৃথিবীর বাইরে চলে গেছি বলে মনে করেন তিনি।” সবাই অবশ্য এ ধারণায় শামিল ছিলেন না। অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বনলতা সেন পরবর্তী যুগের কবিতাই বরং জীবনানন্দের শ্রেয়তর অবদান। এ মতটিকেও অগ্রাহ্য করেননি জীবনানন্দ। ঐ একই চিঠিতে জানাতে ভোলেননি যে, ‘নিরুক্ত ও পূর্বাশা’র সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে করেন আমার শেষের দিকের কবিতায় আমার পারিপাশর্ি্বক চেতনা পৌঢ় পরিণতি লাভ করেছে। এ পারিপাশর্ি্বকতা অবশ্য সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে। তরুণতর কবিরা অবশ্য এসব মূল্যায়ন নিয়ে মাথা থামাননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘জীবৎকালে তেমন কিছু স্বীকৃতিও পাননি তিনি।… মৃত্যুর পরে অনেক পত্রিকাই তাঁকে অগ্রাহ্য করে, কোনো কোনোটি আবার তাঁর সম্পর্কে ভুলভাল বিবরণও ছাপে। অথচ তখন জীবনানন্দ দাশই ক্রমশ হয়ে উঠছেন আমাদের প্রধান আরাধ্য পুরুষ। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা কবিতার ভাষা আমূল বদলে ফেলার কৃতিত্বের কারণে’ এই সম্মান।

একই চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ টেনে তাঁর কাব্যজীবনের দুই পর্যায় সম্পর্কে দুই ভিন্ন ও বিপরীতধর্মী মূল্যায়ন লক্ষ্য করার পর অবশেষে জীবনানন্দ যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায়_ তিনি একই সঙ্গে বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন কোরাসের লোক, বহুবিধ কণ্ঠস্বরকে ধারণ করতে আগ্রহী এবং অনবরত নতুন পথ খুঁজে চলেছেন। শুধু আঙ্গিকের নিরীক্ষায় নয়, বিষয়বস্তু বা চেতনার নানা চিত্রণেও তিনি উৎসাহী। বুদ্ধদেব ও সঞ্জয় যা বলেছেন তাঁর সম্পর্কে, তাকে তিনি অস্বীকার করছেন না, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। কেননা, তার ভাষায়, ‘আরও দু’চার রকম চেতনা আছে, আজও যাদের কবিতায় শুদ্ধ করে নিয়ে নির্ণয় করে দেখতে আমি ভালোবাসি।’ সেই চেতনাগুলোর প্রকৃতি বা প্রকার নিয়ে কবি আর কিছু বলেননি। কিন্তু নতুনতর বক্তব্য, উপলব্ধি বা দর্শন কী করে শিল্পসম্মত করে কবিতায় তুলে আনা যায়, তারই অবিরাম তালাশের মধ্যে আছেন, এটুকু অন্তত ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্বেই জানিয়েছিলেন তিনি_ ‘কেহ যাহা জানে নাই কোন এক বাণী/আমি বয়ে আনি।’ এটা শুধু আত্মপ্রকাশের ঘোষণা ছিল না, তার সারা জীবনের অঙ্গীকারও ছিল। নতুনতর ‘বাণী’ উপলব্ধি ও চেতনাকে কবিতার ‘ফর্মে’ ধরার জন্য অনবরত নিরীক্ষার মধ্যেই আমৃত্যু থাকতে হয়েছে তাকে। কখনও সফল হয়েছেন, কখনও হননি ততটা_ সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।

শুধু চিঠির জনান্তিকে নয়, তাঁর কাব্যচর্চার বিভিন্ন ও বিপরীতধর্মী মূল্যায়নের বিষয়টি প্রকাশ্যেও আনলেন এক পর্যায়ে। ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় লিখলেন : ‘আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারও মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরও নানা রকম আখ্যা চোখে পড়েছে।’ এসব আখ্যা অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন না কবি, কিন্তু এটুকু কেবল তার পাঠক-সমালোচকদের জানাতে চাইছেন যে, এসব অভিধাই ‘আংশিকভাবে সত্য_ কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।’ এখানে ‘সমগ্র কাব্য’ বলতে শুধু গ্রন্থিত কবিতাকে বুঝলে চলবে না, অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত কবিতাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় গ্রন্থর্ভূত কবিতার সংখ্যা ১৬২। ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর হিসাব থেকে জানা যায়, জীবনানন্দের অগ্রন্থিত ও আবিষ্কৃত কবিতার সংখ্যা হবে প্রায় ৬৬০ [এখন আরও বেশি] অর্থাৎ জীবদ্দশায় গ্রন্থর্ভূত কবিতার তুলনায় চার গুণেরও বেশি।

‘অগ্রন্থিত জীবনানন্দ’-এর বিশ্লেষণ স্বতন্ত্র মনোযোগের দাবিদার_ সে কাজ এখনও বাকি অথবা হয়ত সবে শুরু হয়েছে। অগ্রন্থিত কবিতার বিপুল সম্ভারকে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে রচনার কাল-নিরূপণ একটি বড় সমস্যা। উদাহরণত, তার ‘ছায়া আবছায়া’ [প্রতিক্ষণ থেকে ২০০৪ সালে ভূমেন্দ্র গুহ ও গৌতম মিত্র সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত] সংকলনটি পড়ে মনে হয় বিভিন্ন সময়ের রচনা, তাঁর ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র মতোই। শেষোক্ত কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল ১৯৩৪ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর থেকে মনে হয় কাব্যের ‘আদি পর্যায়’ ও ‘অন্তিম পর্যায়’ এই বিভাজন রেখা কবি তার নিজের ক্ষেত্রে হয়তো স্বীকার করতে চাননি। হয়তো সেটা চৈতন্যের [শিল্প-চৈতন্য, ব্যক্তি-চৈতন্য ও সমাজ-চৈতন্যের] বিভিন্ন প্রবণতা ও ধারাকে তিনি একই সময়ে নিজের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখেছিলেন বলে।

‘অগ্রন্থিত জীবনানন্দ’ আলোচনার আরও একটি বড় প্রশ্ন হলো, গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত/অপ্রকাশিত কবি-সত্তা কি একই ভাবনা-চিন্তা দর্শন ও বিবর্তনকে তুলে ধরছে, নাকি জীবনানন্দের কাব্য-চর্চায় আগে জানা যায়নি এমন কোনো দিককে [নিরীক্ষামূলক হয়ত-বা] নির্দেশ করছে? জীবনানন্দের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটা যে অবান্তর নয় তার বড় প্রমাণ ‘রূপসী বাংলা’। ১৯৩৪ সালের মার্চ মাসে এর কবিতাগুলো লেখা হয়, অথচ জীবদ্দশায় এর অস্তিত্ব অনুমান পর্যন্ত করা যায়নি। আর এ কথা তো সুবিদিত যে, জীবনানন্দের জনপ্রিয়তার পেছনে ‘বনলতা সেন’ যেমন, ‘রূপসী বাংলা’ও বড় ভূমিকা রেখেছে। অপ্রকাশিত জীবনানন্দের মধ্যে রূপসী বাংলার মতো নতুনতর কোনো চেতনা অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে হয়তো-বা; সে সম্ভাবনা বিপুল পরিমাণ অগ্রন্থিত কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রবল। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে জীবনানন্দের গদ্য-রচনা প্রকাশের পর। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এতগুলো গল্প ও উপন্যাস প্রায় প্রকাশযোগ্য করে গড়ে তুলে শেষ পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে দিয়েছিলেন, যেমন অবলীলায় তিনি বাক্সবন্দি করে রেখেছিলেন তার কবিতার অজস্র পাণ্ডুলিপি। এ-ও একধরনের মমিকরণ [মামিফিকেশন]_ দীর্ঘকাল পরে কোনো প্রত্নতাত্তি্বক সেসব মমিকে খুঁড়ে বের করবেন সে রকম কোনো প্রত্যাশায়? এসব রচনা প্রকাশের পর প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটবার পর প্রশ্ন উঠছে। জীবনানন্দের গল্প ও উপন্যাসের সঙ্গে তাঁর কবিতার আন্তঃসম্পর্ক কী তা নিয়ে। গদ্য-পদ্যের সম্পর্কের আলোচনা রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিচারের জন্য তেমন আবশ্যিক বিষয় নয়, যতটা জরুরি তা জীবনানন্দের ক্ষেত্রে। কেননা, এক অর্থে জীবনানন্দের কবিতা ও গল্প-উপন্যাস একই বিষয়-ভাবনার দুই শিল্পিত উৎসারণ।

৩. ইতিহাসের অবসাদের সময়

রহস্য শেষ পর্যন্ত অধরা থাকে বলেই কবিতা রহস্যময়ী এবং রহস্যের কারণেই পদ্য-রচনাটি ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে। কেননা, কবিতা তা যতই আটপৌঢ়ে বিষয়ের আর মুখের কথার কাছাকাছি হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত শিল্পসম্মত হয় কোনো [অব্যাখ্যাত] রহস্যের কারণে। ‘কবিতার কথা’য় সেই রহস্যময়ীর উল্লেখ আছে। জীবনানন্দের গদ্য-পাঠ তাঁর কবিতার রহস্য-ঘেরা মনোভূমিকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। কবিতা বিচারের জন্য কবির ‘হৃদয়ে’ কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার উপাদান কীভাবে কাজ করছে তা দেখার ‘স্বতন্ত্র সারবত্তা’ আছে_ এ কথা জীবনানন্দ নিজেই ‘কবিতার কথা’য় বলেছিলেন। কবির কল্পনার ভেতরে ‘চিন্তা ও অভিজ্ঞতা’ খুঁজে পাওয়ার জন্য আমরা দ্বারস্থ হতে পারি তাঁর গদ্য-রচনার কাছে। গল্প-উপন্যাসগুলো ধারাবাহিকভাবে পড়তে শুরু করলে স্পষ্ট হয় কেন জীবনানন্দের তিরিশের কবিতা বদলে গেল চলি্লশে এসে, বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশভাগ ও এর পরবর্তী সময়ের চাপে। গদ্য-পাঠের এই অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় তার পদ্যের মোড়-পরিবর্তন ও তার কার্যকারণ। কবির এই পালাবদল ইতিহাস-চেতনার সূত্রে ততটা নয়, যতটা সমকালীন সমাজ-রাষ্ট্র রাজনীতির সূত্রে প্রাপ্ত। সঞ্জয় ভট্টাচার্য যেমন বলেছিলেন পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। ‘অনেক মৃত্যু পার হয়ে এসেছি আমরা, অনেক শেষ দেখার প্রাণ বিনিময় করে এসেছি_ স্বদেশী সন্ত্রাসবাদে, মারীতে, মন্বন্তরে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, দাঙ্গায়।’ সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জীবনানন্দকেও যেতে হয়েছে। এ কারণেই চলি্লশের গদ্য-রচনাগুলোর কাছে বারবার ফিরে যেতে হয় আমাদের [যাই কি আমরা সেভাবে?]। তার ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কবিতাগুচ্ছের পূর্ণতর উপলব্ধির জন্য। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য কেননা তিনি মনে করতেন ‘কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ ব্যক্তি-জীবনে বৈবাহিক অবসাদ যেমন, সমাজ-রাষ্ট্রের পালাবদলে ঝক্কিও তেমনি তাকে প্রবলভাবে সামলে চলতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কলকাতায় উদ্বাস্তু-প্রায় জীবনযাপনের এদিক-ওদিক মেলাবার চেষ্টাতেই বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর অন্তঃকরণ। এর একটি বিশ্বস্ত চিত্র পাই তার সে সময়কার গদ্য রচনায়।

‘বেলা অবেলা কালবেলা’-র তীক্ষষ্ট রাজনৈতিক বোধ কোনো বিশেষ সমাজ-দর্শনের তাগিদে স্ফূরিত হয়নি। এটি জীবনানন্দের একান্ত নির্দলীয় প্রগতিশীল চেতনা, যাকে চলি্লশের যুগের বামপন্থিরা কেউ কেউ চিনতে ভুল করেছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা ননি ভৌমিকের কাছে অপরিচিত ঠেকেছিল প্রখ্যাত বাম-ডান মতাদর্শকের বাইরে একটি তৃতীয় অবস্থানের খোঁজার চেষ্টা। আর কংগ্রেসি বলয়ের সজনীকান্ত দাস দক্ষিণপন্থি রক্ষণশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চলছিলেন_ পূর্বাপর সেটি তিরিশের যুগেই ‘শনিবারের চিঠি’র আক্রমণাত্মক নন্দনতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। জীবনানন্দ কোনো শিবিরেই ভরসা পাননি, যদিও তার মতাদর্শ ছিল সমাজ-প্রগতিকে লক্ষ্য করে : অসাম্প্রদায়িক, গরিব মানুষের প্রতি সহমর্মী, বৈষম্য-বিরোধী, নারীমুক্তির পক্ষে, ব্যক্তি ও সমাজের শুভবুদ্ধির জন্য সচেষ্ট এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা-মদমত্ত পরাক্রমশীলতার বিরুদ্ধে। ‘সময়ের তীরে’ কবিতায় তিনি সবাইকেই একহাত নিলেন, আমেরিকা-ভারত-রাশিয়া কোথাও মানুষের সর্বাত্মক মুক্তির প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত হতে দেখেননি বলে। উদৃব্দতিটা এ রকম [কত আগে লেখা এই সত্যভাষণ ভাবা যায়!]:

‘তোমাকে আমেরিকার কংগ্রেস-ভবনে দেখতে চেয়েছিলাম,
কিংবা ভারতের;
অথবা ক্রেমলিনে কি বেতসতন্বী সূর্যশিখার কোনো স্থান আছে
যার মানে পবিত্রতা শান্তি শক্তি শুভ্রতা_ সকলের জন্যে!
নিঃসীম শূন্যে শূন্যের সংঘর্ষে স্বতরুৎসারা নীলিমার মতো কোনো রাষ্ট্র কি নেই আজ আর
কোনো নগরী নেই
সৃষ্টির মরালীকে যা বহন করে চলেছে মধু বাতাসে
নক্ষত্রে_ লোক থেকে সূর্যলোকান্তরে!’

সত্যিই তো কোথাও কী এমন রাষ্ট্র নেই আজ আর অথবা এমন কোনো নগরী নেই যেখানে সকলের জন্য রয়েছে ‘শান্তি শক্তি শুভ্রতার’ আয়োজন! এই কথাগুলো ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্বের আস্থাবান লাইন ‘প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ’ এর প্যাস্টোরাল দৃশ্য থেকে কতটাই আলাদা! এই পরিবর্তন কবির চিন্তায় এলো কী করে? এর একটি পূর্বাভাস পাওয়া যায় জীবনানন্দের গদ্য রচনায়, বিশেষত সময়কালীন উপন্যাসে। চলি্লশের দশকের কবিতা ও উপন্যাসগুলো পাশাপাশি পাঠ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এর মধ্যে আবার ১৯৪৮ সাল জীবনানন্দের সৃষ্টিকর্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরই প্রকাশিত হয় ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থ এবং রচিত হয় ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র বেশকিছু কবিতা। রাজনীতি, রাষ্ট্র, নগর, দেশভাগ, যুদ্ধ, দাঙ্গা, বাণিজ্য, স্বাধীনতা, যন্ত্র-সভ্যতা প্রভৃতি সমসাময়িক প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে এতে। আছে ‘পাওয়ার ও পার্টি পলিটিক্সে’র কথাও। এখানে কবির বর্ণনাভঙ্গি তির্যক, স্বর কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের, কখনও অনুকম্পার, পরিহাসের। এ এক অন্য জীবনানন্দের নির্মাণ, যা বিচলিত করেছিল বুদ্ধদেব বসুকে [‘কি লিখছেন জীবনানন্দ আজকাল!’]। ঐ ১৯৪৮ সালেই_ আমাদের এখন জানা হয়েছে জীবনানন্দ লিখলেন চার চারটি উপন্যাস : [আরও বেশি হয়তো বা] ‘সুতীর্থ’, ‘জলপাইহাটি’, ‘মাল্যবান’ ও ‘বাসমতীর উপাখ্যান’। আমি শুধু শেষের উপন্যাসটি ধরে কিছু উদাহরণ দেব জীবনানন্দের কাজে গদ্য-পদ্যের যোগসূত্র দেখানোর জন্য। অন্যান্য উপন্যাসও একই যোগসূত্রকে তুলে ধরে।
সমকালীনতায় ক্রমশ তলিয়ে যাওয়ার পর্বান্তগুলো স্পষ্ট হয় ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসে। মানুষের মধ্যে অবিরাম প্রীতির অভাব দেখে ব্যথিত কবির মন_ কবিতা ও উপন্যাস দুই বর্ণনা রীতিতেই তা ফুটে উঠেছে। ‘কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই’ কবিতায় যেমন, উপন্যাসেও সেই হতাশা_ নিরাশ্বাস এসেছে। ‘বাসমতীর উপাখ্যান’-এ এই নিরাশার উৎস সমকালীন রাজনীতি, দেশভাগ, দাঙ্গা আর ইতিমধ্যেই ফিকে হয়ে আসা ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার আনন্দ। দেশভাগের পর দেশের চেহারা কী রকম দাঁড়াবে তা নিয়ে কোনো আশাবাদ ছিল না তাঁর মনে। একধরনের নৈর্ব্যক্তিক নির্লিপ্তি নিয়ে তিনি ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেছিলেন। ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসের একটি অংশ নিম্নরূপ:

‘শিগগিরই তো দেশ স্বাধীন হবে।’

‘সে ভিড়ের মধ্যে আমাদের কোনো স্থান হবে না।’

‘এই বলছ? কী করে বুঝলে?’ রমা বললে, ‘চোখে বুঝি দূরের জিনিস দেখতে পাও?’

‘হ্যাঁ, নির্ঘাত। মিলিটারিতে চেষ্টা করলে অবিশ্যি কমিশন পাওয়া যেত, মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার বয়স নেই। অন্য কোনো কাজ পাওয়া যাবে না। যেসব ছেলের পরীক্ষার খাতা দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। চাকরি ও ব্যবসার বাজারে ওদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল; কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ওরা পথ কেটে নিতে জানে, স্বাধীন ভারতে ওদের সুবিধা হবে।’

‘ওদের সুবিধে হবে বলতে চাও বুঝি তুমি?’ রমা যেন অবহিত হয়ে স্ফটিকের ভেতর দিয়ে গ্গ্নানিকর ভবিষ্যৎটাকে দেখে, তবুও সেটাকে অবিশ্বাস করবার চেষ্টা করে বললে।

‘হ্যাঁ, ওদের; আর ওদের মতন ছোকরা আর বুড়োদের। কিন্তু আমাদের কোনো মীমাংসা হবে না। মীমাংসার ভার যাদের ওপরে বাংলাদেশের সেসব অন্ধদের তো এখনই দেখছি আমি; রাতারাতি ভোল বদলাবে এরা। এদের আওতায় সমস্ত দেশ অন্ধ, খোঁড়া, নুলো, বোবায় ভরে যাবে, টাকা চাকরি ব্যবসা, সবই ওদের; দেশ স্বাধীন হলো বলে ভালো লাগবে আমাদের। কিন্তু অন্যসব দিক দিয়ে খুবই খারাপ লাগবে। সপরিবারে মরেও যেতে পারি।… স্বাধীনতার কোনো সেবকও আমাদের দিকে ফিরে তাকাতে যাবে না।’

ভাবতে কিছুটা অবাক লাগে যে, স্বাধীনতার এক বছর না যেতেই ঔপনিবেশিকতা-উত্তর ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ সম্পর্কে কী রকম মোহভঙ্গ হয়েছিল জীবনানন্দের। আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন:

‘… পুলিশ সেক্রেটারিয়েট সবই বেশ জুতিয়ে সুখে থাকবে।’

‘জুতিয়ে?… তাহলে দুঃখ হবে কাদের?’

‘যারা দুঃখের জন্য জন্মেছিল তাদের।… ব্রিটিশ আমলে যারা ঘাড় পেতে দুঃখ সহ্য করেছিল এবারেও বহন করবার ক্ষমতায় খুব সম্ভব আরও বেশি দুঃখ সহ্য করতে হবে তাদের। কিন্তু আরও খানিকটা চোখ খুলে যাবে তাদের, মানুষের জীবন সম্বন্ধে, আশা ও আশাবাদ সম্বন্ধে যা ভুল বুঝেছিল শুধরে নিতে পারবে, আরও স্পষ্ট একটা দার্শনিক সংস্থানে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে মনে হচ্ছে।’

আমি বলতে চাইছি, জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ স্বাধীনতা-উত্তর [ঔপনিবেশিকতা-উত্তর] ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ সম্পর্কে মোহভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। তিনি যে সমাজকে প্রতিষ্ঠা হতে দেখতে চেয়েছিলেন তা ‘পাওয়ার, প্রফিট আর প্রিভিলেজ’_ এই তিনের অশুভ প্রভাবের বাইরের সমাজ। তবে তা প্রখ্যাত বামপন্থার প্রগতিশীল সমাজের ধারণার মধ্যেও সীমিত থাকেনি। কেননা একমাত্র মার্কসকেই তিনি আঁকড়ে ছিলেন না তাঁর শ্রেয়তর সমাজকে সংজ্ঞায়িত করার প্রশ্নে। উপন্যাসে বলেছেন যে, ইউরোপের স্কিনোজা, ফ্রয়েড, মার্কস, আইনস্টাইন আর ‘আমাদের দেশের আগের কালের পণ্ডিতরা যা রেখে গেছেন।’ তার ভিত্তিতে সেই সমাজের সংজ্ঞায়নের কাজ শুরু করতে হবে। এ কারণেই বারেবারে তাঁর এই সময়কার কবিতায় ফিরে এসেছে জ্ঞানসমাজের কথা, নিছক জ্ঞানের নয়, হৃদয়ের শুভ্রতা-শুদ্ধ জ্ঞান চর্চার কথা। সে সমাজ গড়াও সহসা সম্ভব নয়, সে অনেক শত শতাব্দীর ‘মনীষীদের কাজ’_ এ রকম বলেছেন কবিতায়। এ-ও আধুনিতারই নির্মাণ, তবে যুদ্ধ আর বাণিজ্যকে অবলম্বন করা কোনো বণিক-আধুনিকতার নয়। এটি অন্য এক ‘বিকল্প আধুনিতা’র নির্মাণ। বেলা অবেলা কালবেলা কাব্যের ‘প্রয়াণপটভূমি’ কবিতায় তাঁর স্বভাবজ ভঙ্গিতে বলছেন [আমি নির্বাচিত অংশ গদ্যকারে তুলে ধরছি]: ‘মানবহৃদয়, দিন কি শুধু গেল? শতাব্দী কি চলে গেল! আজকে যখন সান্ত্বনা কম, নিরাশা ঢের, চেতনা কালজয়ী হতে গিয়ে প্রতি পদেই আঘাত পেয়ে অমেয় কথা ভাবে। ইতিহাসের ব্যাপক অবসাদের সময় এখন, তবু নরনারীর ভিড় নব নবীন প্রাক্ সাধনার;_ নিজের মনের সচল পৃথিবীকে ক্রেমলিনে লন্ডনে দেখে তবুও তারা আরো নতুন অমল পৃথিবীর।’ না, জীবনানন্দের কবিতাকে শুধু নির্জন ইতিহাসচেতনার জন্য স্মরণ করলে ভুল হবে। নিছক মতাদর্শগত প্রগতিশীলতার মধ্যেও বদ্ধ ছিলেন না তিনি। বাসমতীর উপাখ্যানে আমরা এ নিয়ে স্পষ্ট বাদানুবাদ পড়ি:

‘সুমিতা কমিউনিজম নিয়ে আছে। ওর সঙ্গে মনে বনে না আমার।’

‘আমি ভেবেছিলুম তুমিও কমিউনিস্ট।’

‘সেটা ভুল ভেবেছিলেন।’

‘তুমি কংগ্রেসের?’

‘না।’

‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম’ প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ পরে বললেন, ‘যেন কংগ্রেস-কমিউনিজম ছাড়া আর পৃথিবী নেই।’

‘আছে, সেখানে পলিটিক্সও আছে হয়তো_ কিন্তু আজকালকার চারদিককার সব চালু পলিটিক্স নেই।’

‘রাজনীতি বলতে এক ভিন্ন ধরনের বোধকে জীবনানন্দ ধারণ করেছিলেন ভেতরে। তার বর্ণনা-বিশ্লেষণ পাই তাঁর গদ্য-রচনায়। এই বর্ণনা-বিশ্লেষণকে বাদ দিয়ে পাশ কাটিয়ে আমরা বুঝতে পারব না পুরোপুরি_ কেন তিনি লিখেছিলেন, এত অনায়াসে সেকালে বসেই লিখতে পেরেছিলেন বেলা অবেলা কালবেলা কাব্যের ‘সামান্য মানুষ’ কবিতার শেষ স্তবকটি:

‘প্রতিটি মাঘের হাওয়া ফাল্গুনের আগে এসে দোলায় সে সব।
আমাদের পাওয়ার ও পার্টি-পলিটিক্স
জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরেক রকম শ্রীছাঁদ।
কমিটি মিটিং ভেঙে আকাশে তাকালে মনে পড়ে_
সে আর সপ্তমী তিথি : চাঁদ।’

৪. যার যা হারিয়ে গেছে

দেশভাগ জীবনানন্দকে বিপর্যস্ত করেছিল, কিন্তু ততদিনে তার কবিখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত, ফলে চাকরি জুটিয়ে যাহোক সংসার চালানোর মতো অবস্থা তিনি করে নিতে পেরেছিলেন। অনটন ছিল। কিন্তু তার ভেতরেই অফুরন্ত সৃষ্টির মধ্যে ব্যাপৃত ছিলেন তিনি আমৃত্যু। দেশভাগের রাজনীতি ও উদ্বাস্তুতা এসব তিনি যথাসম্ভব যুক্তি-জিজ্ঞাসা দিয়ে মোকাবেলা করেছিলেন। তা ছাড়া কলকাতা তাঁর কাছে অপরিচিত কোনো শহর ছিল না। এই শহরেই তিনি তিরিশের দশকের গোড়ায় বেশকিছু দিন ছিলেন। ‘কল্লোল’ ও ‘কালি-কলম’ যুগের অংশীদারও ছিলেন তিনি। অধ্যাপনা করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন, খুব কাছ থেকে নগর-জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। ফলে চলি্লশের দশকের শেষে যখন কলকাতায় এলেন পারিপাশর্ি্বককে [পরিবর্তন সত্ত্বেও] চিনতে-বুঝতে অসুবিধে হয়নি তাঁর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলকভাবে কঠিন। দেশভাগ তাঁর জন্য আরও বেশি ক্লেশকর অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে এসেছিল। আক্ষরিক অর্থেই প্রথম দিকে ‘রিফিউজি’ বা শরণার্থী হিসেবেই নিজেকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। এখানে আমার শুধু যোগ করার_ দেশভাগের অভিজ্ঞতা তার কবিতা ও গদ্যরচনাকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করেছে। যার অমোচনীয় প্রভাব বিস্তৃত ছিল তাঁর জীবনে, আমৃত্যু। সুনীলের সৃষ্টির এই বিশেষ দিকটি নিয়ে আরও বেশি করে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এদিক থেকে কবিদের মধ্যে বাংলাদেশে তার নিকটতম তুলনা হবেন সম্ভবত শহীদ কাদরী। গদ্য-রচনায় হাত দেননি যদিও, কিন্তু শহীদ কাদরীর পঞ্চাশের দশকে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসা তার চৈতন্যের ওপরে গভীর আত্মজৈবনিক প্রভাব ফেলেছিল। শহীদের ‘উত্তরাধিকার’-এর বহু কবিতায় দেশভাগ, যুদ্ধ, দাঙ্গা, উদ্বাস্তুতার ছাপ রয়ে গেছে। ‘কলকাতা’ দেশভাগ-উত্তর শহীদ কাদরীর জন্য ফরাসি মনোবিজ্ঞানী দার্শনিক লাকাঁর উদ্ভাবিত ‘অপর’-এর মতো কাজ করেছে। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশও তেমনি ‘অপর’ হয়ে থেকে গেছে সুনীলের রচনায়।

দেশভাগের অভিঘাত সুনীলের জীবনে সরাসরিভাবে পড়েনি। জয় গোস্বামীর ‘নন্দর মা’ কবিতায় যেভাবে শরণার্থীদের দেশত্যাগ করতে হয়েছিল, সুনীলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। সুনীলের বাবা দেশভাগের আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সুনীলরা সপরিবারে সেখানেই একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তবে সরাসরিভাবে না হলেও দেশভাগের অপ্রত্যক্ষ অভিঘাত হয়েছিল প্রবল ও সুদূরপ্রসারী। এ নিয়ে সুনীল বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ আত্মজৈবনিক গদ্য ও কবিতা লিখেছেন। ‘ইতিহাসের পরিহাস’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলাম, পূর্ব বাংলায় আমাদের নিজস্ব বাড়িঘর, বাগান, পুকুর অন্য একটি রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে গেছে। সেখানে ফিরে যেতে হলে আমাদের একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। আমরা আর ফিরে যাইনি।’ ব্যবহারিক জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশভাগ সুনীলের কৈশোর-যৌবনকে আক্রান্ত করেছিল দু’ভাবে। প্রথমত, পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় গ্রামের বাড়ি থেকে আর আসার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-শরিকরা দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। এর চাপ সুনীলের পরিবারের ওপরও পড়েছিল। সুনীলের বর্ণনায় তার একটি চিত্র পাই:

‘দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারটিও উদ্বাস্তু হয়ে গেল বটে, কিন্তু আমরা কোনো সরকারি সাহায্য নিইনি, জবরদখল কলোনিগুলোতেও আশ্রয় নিতে হয়নি। আমার বাবার একটি স্কুল মাস্টারির চাকরি ছিল, তখনকার দিনে তার মাইনে ছিল যৎসামান্য। আমাদের চার ভাইবোন ও মা ছাড়াও পূর্ববঙ্গ থেকে আগত কিছু কিছু আত্মীয়স্বজনকে সেই সময় আশ্রয় দিতে হয়েছিল, সবাই মিলে আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম এবং কোনোক্রমে আত্মসম্মান বজায় রেখে বেঁচে ছিলাম। আমি তখন ১৩ বছরের কিশোর, দারিদ্র্যের কষ্ট বিশেষ অনুভব করতাম না, কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরুলে কিংবা স্কুলে গেলে টের পেতাম, অন্যরা আমাদের বহিরাগত বলে মনে করে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা যখন এক কোটির কাছাকাছি হয়ে গেল, সেই বিরাট সংখ্যার মানুষ সারা পশ্চিম বাংলায় বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছিল, তখন আমার সহপাঠীদের কেউ কেউ আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলত, আমিও সেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের একজন। অবিভক্ত বাংলায় আমি ছিলাম যাদের সঙ্গে সমান সমান, বাংলা ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি হয়ে গেলাম তাদের চোখে অবাঞ্ছিত। আমাদের কৈশোর হলো খুব সংক্ষিপ্ত। আমাদের গুরুজনরা অনবরত বলতেন, যে কোনো উপায়ে যে কোনো একটা জীবিকা জোগাড় করো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখানে বাঁচার একমাত্র উপায় খুব দ্রুত উদ্বাস্তু পরিচয়টা মুছে ফেলে মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যাওয়া। স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই আমি জীবিকা অর্জন শুরু করি, কিন্তু উদ্বাস্তু পরিচয়টা কখনও মুছে ফেলতে পারিনি।’

দেশভাগের প্রভাব পড়েছিল সুনীলের সাহিত্য জীবনেও। সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’-এর পটভূমিকা দেশভাগ ও দেশত্যাগের পরবর্তী ‘শিকড়হীনতা’। তাঁর ‘অর্জুন’ উপন্যাসে রয়েছে উদ্বাস্তু কলোনির গল্প। পরবর্তীকালে এই সময় নিয়ে লেখা ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে দেশভাগের আখ্যান বিবৃত হয়েছে। দুই বাংলার মানুষের জীবন সমান্তরালভাবে বর্ণিত হয়েছে আরও বৃহৎ প্রেক্ষাপটে। তবে শুধু গদ্য রচনায় নয়, কবিতায়ও প্রভাব পড়েছে দেশভাগ ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত উদ্বাস্তু জীবনের। উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ্যা পরবর্তীতে সিপিএমের জন্য বড় শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সুনীলের ব্যাখ্যায়, ‘বাংলা ভাগের জন্য কংগ্রেস দলকে দায়ী করে উদ্বাস্তুরা প্রথম থেকেই সরকারবিরোধী, সেই সুযোগ নিল বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি। পশ্চিম বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুত্থান ও শক্তিবৃদ্ধির মূলে আছে উদ্বাস্তুরা। ক্রমে কমিউনিস্টরা পশ্চিম বাংলার ক্ষমতা দখল করে ওদেরই সাহায্যে, যাদের বলা যেতে পারে ‘এক্সটারনাল প্রলেতারিয়েত।’ দেশভাগ, উদ্বাস্তুতা ও বিপন্ন সময়ের সঙ্গে নকশাল আন্দোলনেরও যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন সুনীল। মন্তব্যটা তাৎপর্যপূর্ণ নকশাল আন্দোলনের সামাজিক পটভূমি বোঝার জন্য:

‘একটা সময় তো আমরা বাউণ্ডুলের মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতাম।… কারণ সময়টাই তখন ছিল খুব অস্থির। ভবিষ্যৎ-টৎ খুব বেশি দেখতে পেত না কেউ।… আমাদের সময় সবটাই অনিশ্চিত। কিছু পরে নকশাল আন্দোলন তো ওই অস্থিরতা থেকেই শুরু। আমাদের তখন একটু বয়স হয়ে গিয়েছে। সত্তর সালে যদি আমাদের আর একটু কম বয়স হতো তো আমরাও নকশাল করতাম। পঞ্চাশের দশকে আমরা রাজনীতির দিকে ছুটিনি। তার বদলে ভাষা নিয়ে যত ভাঙচুর করেছি। ভাষার মধ্যেই গুলি চালিয়েছি, বোমা ফাটিয়েছি। ওই সময় একটা কবিতাতে লিখেছিলাম, ‘আমিও পৃথিবী, স্বর্গ, কলেজ স্ট্রিটের মহাঅগি্নকাণ্ড দেখে শিল্পকে প্রহার করি, ভেঙেচুরে নষ্ট করি, লাথি মেরে নরকে পাঠাই’_ ওটা কিন্তু এক ধরনের নকশাল অ্যাটিটিউডই বটে। আমাদের দিচ্ছে না কিছু করতে। কাজেই আমরা সব ভেঙেচুরে নষ্ট করে যাব। এই অস্থিরতা বোধ আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াত।’ এই অস্থিরতাবোধ_ যার জন্ম হয়েছিল দেশভাগ, উদ্বাস্তুতা ও অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে_ ক্রমশ সৃষ্টি করেছিল এক নতুন নান্দনিক চেতনারও। এর অনিবার্য পরিণতি_ ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর অভ্যুদয়। এঁদের দ্রোহ শুধু সমকালীন সমাজের চলতি সংস্কার বা রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে চালিত ছিল না। এঁরা উদ্বাস্তু সময়ের সন্তান বলেই পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষদের সাংস্কৃতিকভাবে সহমর্মী করে তুলতে চেয়েছিলেন। ততদিনে পূর্ববঙ্গে ঘটে গেছে বাহান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৫৩ সালে ‘কৃত্তিবাস’-এর প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন:

‘কৃত্তিবাস বাংলাদেশের তরুণতম কবিদের মুখপত্র।… বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে পাকিস্তানের কবিদের স্থান প্রায় অনুল্লেখ্য। তাতে কোনো দুঃখ থাকত না_ যদি না তাদের কেউ কেউ আশ্চর্য সার্থক কবিতাও লিখতেন। বাংলাদেশের শারীরিক মানচিত্রের মতোই কাব্যের মানচিত্রও খণ্ডিত হয়েছে। কিন্তু উভয় বঙ্গে বাংলা ভাষার পূর্ণ অধিকার সম্বন্ধে যেন আমাদের কখনও না সন্দিগ্ধ হতে হয়। পাকিস্তানের তরুণ কবিরা আমাদের সমদলীয়, সহকর্মীও।’

এরই মধ্যে পূর্ববঙ্গে প্রকাশ পাবে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘নতুন কবিতা’। সেখানে এবং কৃত্তিবাসে অচিরেই লিখবেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ। পূর্ববঙ্গ অবশ্য এগুবে তার নিজস্ব নিয়মে, নিজের শক্তিতে, নিজের পরিণতির দিকে_ অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনেক চড়াই-উৎরাই, অনেক রক্ত আর অশ্রুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেটা অন্য ইতিহাস। ‘দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন ও সুনীলের সাহিত্যকর্ম’ নিয়ে মোটামুটি একটি গবেষণাগ্রন্থ লিখে ফেলা যায় [কেউ নিশ্চয় করবেন আগামীতে]। এত অসংখ্য বার এসবের উল্লেখ রয়ে গেছে বলে সুনীলের গদ্যে ও কবিতায়! শেষ দিকের কবিতাগুলোতে তো বারবার ফিরে এসেছে এসব প্রসঙ্গ তাঁর স্মৃতি-সত্তার অনুষঙ্গ হয়ে। ‘ভালবাসার খণ্ডকাব্য’ গ্রন্থের ‘ভোরবেলার স্বপ্ন’ কবিতাটি তারই একটি উদাহরণ। সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক সবাই উপস্থিত। কবি ভাবছেন :

“দু’পাশে কিসের এত ধ্বংসস্তূপ?
নিবেদিতা বললেন, এটা কোন দেশ, চিনতে পারছি না।
গান লিখছেন রবীন্দ্রনাথ আর গুন গুন করে সুর ভাজছেন
এক সময়, মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন খুব মৃদু কণ্ঠে
তোমরা দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে পারলে না?
কৃষ্ণনগরের বাড়িতে দিলীপকে গান শেখাচ্ছেন তার বাবা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
আচমকা থেমে গিয়ে হা-হা করে হাসতে লাগলেন দ্বিজেন্দ্রলাল
জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ
কী ভেবে লিখেছিলাম, আর আজ তার কী অর্থ
সকল দেশের রানী যে চাকরানী হতে চলেছে এই দেশ?
… … … … …
জীবনানন্দ কালি ঢেলে দিচ্ছেন রূপসী বাংলার পাণ্ডুলিপিতে
হঠাৎ আপন মনে বলে উঠলেন মহাপৃথিবী না ছাই!
জন্মভূমিটাই থাকল না!
… … … … …
বিভূতিভূষণ দাঁড়িয়ে আছেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সামনে
বারবার ডাকছেন অপু, অপু, ছেলেরা কেউ গ্রাহ্য করছে না
… … … … …
রেডিওর সামনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ
শুনছেন নিজেরই গান
… … … … …
এক সময় খেয়াল হলো। তাঁর একটা গান তো কেউ আর গায় না
সীমান্তের ওপারেও না, এ পারেও না
সহ্য করতে পারবেন না বলে এতদিন সীমান্ত দেখতে যাননি
আজ গিয়ে দাঁড়ালেন সেখানে
এখন শিলাইদহে যেতে তাঁর ভিসা লাগবে
নিজেই গলা খুলে ধরলেন তার সেই প্রিয় গানটি
বাঙালির গান, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক…
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক…
এ কী রবীন্দ্রনাথ কাঁদছেন?”

মৃত্যুর বছরখানেক আগে প্রকাশিত হয় সুনীলের ‘বালুকণার মতন অ-সামান্য’ কাব্যগ্রন্থটি। এটি ‘প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও কবিতাপ্রেমী’ রণজিৎ গুহকে উৎসর্গ করা। সেখানে আবারও তিনি একই থিমে ফিরে আসলেন, এবারে আত্মজৈবনিক সূত্রে [যা আগে গদ্য-রচনায় আমরা লক্ষ্য করেছি]:

‘আমার বাবা মৃত্যুর আগে বলেছিলেন,
আমি বাড়ি যাচ্ছি!
তখন আমরা সামান্য ভাড়া বাড়িতে থাকি
পূর্ববঙ্গের দেশের বাড়ির কথা বাবা কখনও
উচ্চারণ করতেন না
তবু মৃত্যুর আগে… বাবা… বাড়ির স্বপ্ন
সে কোন স্বপ্নের দেশে ছিল আমাদের সেই বাড়ি।
… … … … …
এই দেশ বিভাগ, বাংলা-বিভাগ এখনও
শেল হয়ে বিঁধে আছে আমার বুকে
এটা ইতিহাস, মেনে নেওয়াও তো উচিত
কিন্তু যখনই ভাবি, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে
কী করতেন
বাংলা ছিল যার প্রাণ, তিনি কি আর একদিনও
বাঁচতেন
মাঝে মাঝে এইসব ইতিহাসের মুখে
জুতো মারতে ইচ্ছে হয় না?’

এই ন্যারেটিভের বিপরীতেও অবশ্য অন্য ন্যারেটিভ রয়েছে। সীমান্তজুড়ে নির্মিত হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, তাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঝুলে আছে ফেলানী। তিস্তার হিস্যা পায় না বাংলাদেশের জনপদ। অবৈধ সীমান্ত-বাণিজ্য চলে অবাধে। সুন্দরবন নষ্ট করার আন্তঃরাষ্ট্রীয় আয়োজন হয় রামপালে, কিন্তু এদেশের কোনো বাংলা টিভি চ্যানেলই প্রদর্শিত হয় না বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গে! চলি্লশ বছর পরেও ছিটমহলের সামান্য কিছু সংখ্যক মানুষের মানবিক দাবি পূরিত হয় না। দেশভরা শুধু স্মৃতি নয়। তা এখনও আমাদের আধুনিক রাষ্ট্র-ইতিহাসকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সুনীল কি এসব সাম্প্রতিক ও ততটা সাম্প্রতিক নয় তেমন বিষয়গুলো নিয়ে গদ্যাকারে বা কবিতার শব্দে সাজিয়ে কিছু লিখেছিলেন? অথবা লেখার কথা ভাবছিলেন, জানতে ইচ্ছে করে।

৫. প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে

শামসুর রাহমান সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা মন্তব্য করেছিলেন, যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লেখার অতুলনীয় ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। বাস্তবিক, সৃষ্টির প্রাচুর্যে শুধু একজনের সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে, তিনি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের সৌভাগ্য যে, গত চার দশকে আমাদের কবিতার ভুবনে সক্রিয় ছিলেন শামসুর রাহমান আর আমাদের গল্প-উপন্যাসের ভুবনে হুমায়ূন আহমেদ। বহু সংস্কৃতির এদেশে ‘সেক্যুলার’ প্রাণশক্তির নিভৃত কেন্দ্রে ছিলেন এঁরাই। এক দাপুটে রাষ্ট্র আর বহুগাঠনিক দ্বন্দ্বে বিকীর্ণ সমাজের পরিবেশ এদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। কবিতার ঐতিহ্য ও মৌলিকতার বিষয়ে ভাবনায় শামসুর রাহমান তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। গ্যেটে যেমন অনুরক্ত হয়েছিলেন কালিদাস ও হাফিজের কবিতার প্রতি, শামসুর রাহমান হাত বাড়িয়ে ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডারের দিকে। সেই সঙ্গে এদেশের ও এ জনপদের সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ছিল। একদিকে পারিবারিক আবহর কারণে ঊর্দু ভাষা ছিল তার অনায়াস আয়ত্তে, অন্যদিকে ইংরেজি ছিল তার পাঠের মাধ্যম। কখনও ভাষা-ব্যবহারে জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেননি। তরুণতর কবিদের কাছে তাঁর পরামর্শ ছিল, যা কিছু মূল্যবান তা যে উৎসেরই হোক না কেন তাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে উদার অবস্থান গ্রহণের: ‘আমরা অনেক সময় ভুলে যাই যে, বিদেশি সাহিত্য পরিক্রমায় আমরা যত পারদর্শীই হই না কেন, স্বদেশের নানা পুরাণ, লৌকিক কাব্য এবং বিভিন্ন যুগের কাব্যস্মৃতির প্রতি আনুগত্য না থাকলে কাব্যক্ষেত্রে অসামান্য সিদ্ধি লাভ অসম্ভব।’ এক্ষেত্রে স্বদেশীয় সাহিত্যকে ‘হিন্দু যুগ’ ও ‘মুসলিম যুগ’ করে পাঠ করার সাম্প্রদায়িক প্রবণতার চরম বিরোধী ছিলেন তিনি। আত্মপরিচয়ের [আইডেনটিটি] ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিজীবনে যেমন, কবিতার ক্ষেত্রেও বিচিত্র সব সূত্র, উৎস ও ঐতিহ্য থেকে আহরণ করেছেন বিষয়-চিন্তা, শব্দাবলি, উপমা, প্রেক্ষিত ও চিত্রকল্প। লালন-বর্ণিত চৈতন্য প্লাবিত নদীয়ার ‘তিন পাগলের’ কথাই তিনি শুধু জানতেন না, জানতেন সুফী সূত্রও_ মৌলানা জালালুদ্দিন রুমী, হাফিজ, নানা মাহজাবের ও ঘরানার চিন্তা দর্শন। কিন্তু এ নিয়ে আতিশয্য ছিল না তার মধ্যে_ সেটা বাউল-দর্শন হোক আর সুফী সন্ত-সাধুদের দর্শনই হোক। ‘স্বদেশীয়’ বলতেই জাতীয়তাবাদী যে অবস্থানের মানসিকতা বঙ্গভঙ্গ আমল থেকে এদেশে চালু আছে তাতে তার অন্তরাত্মা সায় দেয়নি। সেটা কূপমণ্ডূকতায় বিশ্বাস করতেন না বলে। অথচ আমাদের জাতীয় সংগ্রামে ও প্রগতিশীল জন-আন্দোলনে তাঁর কবিতাই ছিল রাজনৈতিক প্রেরণার বড় একটি উৎস। সাংস্কৃতিক কোনো নির্দিষ্ট ঘরানা নিয়েই বাড়াবাড়ি করা তাঁর রুচিবিরুদ্ধ ছিল। তাঁর প্রিয় কবি ছিলেন স্বদেশে_ রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, আর বিদেশে_ রুমী, বোদলেয়ার, এলিয়ট, ইয়েটস ও নেরুদা। কিন্তু এঁদের কারোকেই অনুসরণ করেননি তাঁর কাব্যজীবনে। কাব্যকৃতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিষয়ের বিচিত্রবিধ অভিগামিতায় তিনি প্রায় একাই বাংলাদেশের কবিতাকে আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক যুগে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি ছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী, ফ্যাসিবাদবিরোধী ও ধর্মান্ধতাবিরোধী অবস্থাতে। তরুণতর কবিদের বলেছিলেন_ সিরিল কনোলির সূত্র ধরে_ সুরা, নারী লোলুপতা ও সাংবাদিকতা কবিতার শত্রু, এই তালিকায় তিনি যোগ করেছিলেন_ ‘ফ্যাসিবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর উত্থানের পেছনেই সাংস্কৃতিক-দার্শনিক রেনেসাঁ কাজ করে। ১৯৪৭ সালের পরে এদেশের জনগোষ্ঠীর ‘উত্থানের’ পেছনেও সাংস্কৃতিক ‘রেনেসাঁ’ আন্দোলন ক্রিয়াশীল ছিল। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে গড়ে উঠে তা একুশ শতাব্দীতে পেঁৗছেছে। এই ইতিহাস লিখতে গেলে শামসুর রাহমানের কবিতার ছায়ায় আমাদের দাঁড়াতেই হবে। তারপরও তাঁকে জীবনের শেষ দশ-পনেরো বছর রাষ্ট্রের নিরাশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। সন্ত্রাস শেষ পর্যন্ত কবিকেও ছুঁলো। অতর্কিত প্রাণনাশের ভয় ঢুকে পড়েছে তাঁর নিত্যকার জীবনযাপনের মধ্যে। ব্যক্তি মানুষ যে কত বিপন্ন, কত অসহায়-আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতাসীন বলয়ের হুমকির মুখে_ এটা তারই একটি দৃষ্টান্ত।

শামসুর রাহমানের শেষ দিকের কাব্যগ্রন্থগুলোতে এক সদা-সশংক সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। নাগিব মাহফুজকে নব্বই দশকের গোড়ায় ছুরিকাহত করেছিল মিসরের মৌলবাদী শক্তি। শামসুর রাহমানের ওপরও এ রকম আক্রমণের চেষ্টা করা হয় নব্বই দশকের শেষ দিকে। ‘কবিতা এক ধরনের আশ্রয়’ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে তার সে সময়কার মনোভাব ফুটে উঠেছে :

‘আজকাল রাতের বেশিরভাগ সময় নির্ঘুম কাটে। যেটুকু ঘুমাই,
হিজিবিজি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে নয়, জাগ্রত অবস্থাতেই প্রায়শই
একটি ধাবমান/ধারালো কুড়াল নাচতে থাকে দৃষ্টিপথে। এক
হিংস্র তরুণ ধেয়ে আসছে আমার দিকে। মূর্তিমান এক
বিভীষিকা দেখে আমি পাথরের মতো স্থির, বাকশক্তিরহিত।’

নিজেকে মার্চেন্ট অব ভেনিসের অ্যান্টোনিওর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে অ্যান্টোনিও এক জায়গায় বলছেন, ‘আই নো নট হোয়াট আই এম সো স্যাড।’ এর প্রভাব কবিতাতেও পড়েছে:

“ভোরবেলা কারা এসে ঘরে ঢুকে পড়ে; চোখ দুটি
কচলাতে কচলাতে দেখি,_ কয়েকটি রুক্ষ পশু
মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে, ‘এক্ষুনি বেরিয়ে যাও
এই ঘর ছেড়ে,
এখানে থাকার অধিকার বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে,
তুমি বনবাদাড়ে আস্তানা খুঁজে নাও।’

বিভ্রান্ত, নির্বাক আমি চেয়ে থাকি হাবার ধরনে, ভয়ঙ্কর
ভূমিকম্প ভীষণ দুলিয়ে
এবং ধুলিয়ে দেয় সবকিছু; তাসের ঘরের
মতো ধসে পড়ে চতুর্দিক, ‘গীতবিতান’ এবং
গালিবের গজল নিমেষে মুছে যায়…”

এ রকম উদাহরণ যত্রতত্র তাঁর কবিতার লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া একদার সাজানো ঘর-গৃহস্থালিজুড়ে।

শামসুর রাহমানের এই ভীত-সন্ত্রস্ত কবিতাগুলোকে শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার স্মারক হিসেবে না দেখে এই সময়ের রাষ্ট্রের সমাজ-বিরুদ্ধ নাগরিক-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হিসেবে আমরা পড়তে পারি। ১৯৪৭-উত্তর আধুনিক [ভারতীয়] রাষ্ট্র নিয়ে জীবনানন্দের মধ্যে কোনো মোহ ছিল না। দেশভাগের মধ্য দিয়ে মানব-ভূখণ্ড গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই যে দুর্দশায় ও বিপর্যয়ে পতিত হয়েছিল তা শুধু জিডিপি-এর স্বল্পকালীন পতনে এবং একপর্যায়ে এর পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। একেকটা পরিবারের জন্য, ব্যক্তিজীবনের জন্য, এই দেশভাগের প্রতিক্রিয়া শুধু একপুরুষে নয়, পুরুষানুক্রমে চলেছে। আধুনিক রাষ্ট্র সেই ক্ষতিটুকু ‘জনকল্যাণ’ দিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি_ এমনকি স্বীকারও করেনি যে, দেশভাগের ফলে বৈষয়িক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তের এপারের ও ওপারের দু’তরফের জনগোষ্ঠী। সুনীল লিখেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা অনেক বেশি আধুনিক ও মহৎ’ আদর্শ হতে পারে, কিন্তু ‘নেহরুর… সেই মহৎ আদর্শের দাম দিতে কয়েক কোটি মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর-সম্পত্তি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ দাঙ্গায় কিংবা অনাহারে কিংবা রোগ-ভোগে প্রাণ দিয়েছে।’

এ তো গেল সেকালের কথা। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পরও আমাদের কালেও নিঃসহায় মানুষের বিপন্নতা কমেনি সীমান্তের এপারে বা ওপারে। রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বলা হয় [শুনেছি], যুধ্যমান মানব-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রলয় থামাতেই রাষ্ট্রের উদ্ভব। কিন্তু কালক্রমে আধুনিক রাষ্ট্র_ এই আধুনিক বণিক রাষ্ট্র_ নিজেই নেমেছে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকায় : মানব-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। রাষ্ট্র আর দুর্বলের আশ্রয়দাতা নয়, নিরাশ্রয়ের জনক। এ রকম রাষ্ট্রের প্রতি মোহভঙ্গ হতে বাধ্য। জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই মোহভঙ্গেরই কবিতা ও গদ্য লিখে গেছেন তাঁদের যার যার জীবনের শেষ অধ্যায়ে।

জনজীবনের অর্থনীতি

বিনায়ক সেন

১. মিল ও অমিল

প্রতিটি শাস্ত্রই তার নিজের চারদিকে একটা সীমারেখা এঁকে দেয় বা বেড়া তুলে দেয়, যাতে করে বেড়ার ভেতর থেকে কেউ বাইরে যেতে না পারে, বা বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। রামায়ণে সীতার দেবর লক্ষ্মণ সীতার ভিটের চারদিকে একটি রেখা টেনে দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত যে-ই আসুক না কেন, সীতা যেন ঐ রেখার বাইরে পা না রাখেন। তাহলেই তিনি বিপদমুক্ত থাকবেন। বাংলা প্রবচনে একেই বলা হয়েছে_ লক্ষ্মণরেখা। শাস্ত্রগুলোও তেমনি তার চতুর্দিকে লক্ষ্মণরেখা এঁকে নিজেকে অন্য শাস্ত্রের প্রভাবমুক্ত বা ‘বিপদমুক্ত’ রাখতে চেয়েছে। বিশেষত এটা ঘটে এনলাইটেনমেন্ট-পরবর্তী ইউরোপে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে যখন শাস্ত্রগুলো ক্রমান্বয়ে একাডেমিক সনদ দানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ‘ফ্যাকাল্টি’ হতে থাকে। বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রতিটি শাস্ত্রকেই তার নিজস্ব গণ্ডী দাঁড় করাতে হয়েছিল, সন্দেহ নেই। তবে সমাজে অত্যধিক শ্রম-বিভাজনের কারণে অতিমাত্রায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে কোথাও কোনো সার্বিক দার্শনিক (নৈতিক) ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে কি-না_ এ প্রশ্ন এডাম স্মিথ তার ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ বইতেই তুলেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে নীতিশাস্ত্র (ও অন্যান্য শাস্ত্রের) বিচ্ছিন্নতার কারণে ক্ষতি হয়েছে যেমন অর্থশাস্ত্রের, তেমনি নীতিশাস্ত্রেরও। এরকম একটি মত জোরে-শোরে উত্থাপন করেছিলেন অমর্ত্য সেন তার ‘এথিকস্ অ্যান্ড ইকোনমিক্স’ গ্রন্থে। আমি এসব সূত্র ধরে এই লেখায় মোটের উপর বলতে চেয়েছি যে, সাহিত্যের সঙ্গে অর্থশাস্ত্রের বিচ্ছিন্নতার কারণে অর্থনীতি নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনাও বেশ কিছুটা পরিমাণে ‘সংকীর্ণ’ হয়ে পড়েছে। এতে করে ক্ষতি হয়েছে দুই পক্ষেই। সাহিত্যে সর্বাধিুনিক অর্থনৈতিক চিন্তাগুলো সেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। আবার অর্থশাস্ত্রেও সাহিত্যে বিবৃত জনজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো যথাযথ স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে শাস্ত্রটির জনবিচ্ছিন্ন বিদ্যায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটাকে এক ধরনের ‘একাডেমিক প্রটেকশনিজম’-এর ফলপরিণাম হিসেবে দেখা যেতে পারে।

অথচ সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্রের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও এ দুই মানবিক বিদ্যার (হিউম্যানিটিক) মধ্যে ‘নাড়ির বন্ধনকে’ অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘সাহিত্য’ বলতে আমি মহাকাব্য, পুঁথি, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ সবকিছুকেই এক জায়গায় জড়ো করছি। বাংলায় ইকোনমিক্স শব্দটার ভাষান্তরে অর্থনীতি ও অর্থশাস্ত্র দুই-ই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দ্বিত্বতা এড়ানোর জন্য আমি এখানে ইকোনমিক্স অর্থে অর্থশাস্ত্র আর ইকোনমি অর্থে অর্থনীতি ব্যবহার করছি। সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল দেখতে পাওয়া যায় বিষয়বস্তুর অভিন্ন ঝোঁকের মধ্যেই। উন্নয়ন ও সাম্যের ধারণা দুই বিদ্যার ক্ষেত্রেই অভিনিবেশের বিষয়। কোন নীতি জনহিতৈষী বা কোন নীতিই বা জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর_ এসব আলাপ উভয়বিধ বিদ্যারই চর্চার বিষয়। এটা ঠিক যে, জনজীবনের যেসব ধারণা সাহিত্যে অনায়াসে চলে আসে, তাকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করে বিচারের প্রয়াস চলে অর্থশাস্ত্রে। শুধু বিশেষভাবে সংজ্ঞার ঝোঁক নয়, বিচার-পদ্ধতিতেও গাণিতিক ও ইকোনমেট্রিক মডেল নির্মাণ ও পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ যোগ করা হয় আধুনিক অর্থশাস্ত্রে। তারপরও সমাজ-প্রগতির বা অধোগতির তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি কার্য-কারণ বোঝার তাগিদ পাওয়া যায় সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্র উভয়ের মধ্যেই। একই ভাষার রকমফের সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যেমন দুই ভিন্ন জাতি, ঠিক তেমনভাবেই একই ঝোঁক ও মূল্যবোধ ধারণ করা সত্ত্বেও সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্র দুই ভিন্ন বিদ্যার আদল পায়। এই মৌলিক মিলের জায়গাটিকে ধরে রাখতে পারলে দুই বিদ্যারই বিকাশে তা আরো পুষ্টি জোগাবে সেটি এখানে আরো একবার মনে করিয়ে দেওয়া। এই মৌলিক মিলের অনেক উদাহরণ রয়ে গেছে বাঙালির অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে। বাংলা সাহিত্যের নানা উদাহরণের মধ্যে পাওয়া যাবে প্রাগ্রসর অর্থনৈতিক চিন্তার পদচ্ছাপ (ফুটপ্রিন্টস)। আবার সাহিত্যের অভিজ্ঞতার মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক অর্থনৈতিক কূটভাষের সরল সূত্র। এমনকি অনেক অর্থনৈতিক নীতিমালার সম্ভাব্য ধারণা-অভিজ্ঞান। এ রকম দুটো উদাহরণ হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস। এ দুটি লেখার সূত্র ধরে আমি পরবর্তী দুই অধ্যায়ে সাহিত্যে অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে কিছু বাড়তি প্রসঙ্গের উল্লেখ করব।

২. স্মিথ, ডিকেন্স, মিল ও বঙ্কিম

খোলা বাজার বা অবাধ বাজার-অর্থনীতি নিয়ে আমাদের জনমনে কম-বেশি ভুল-শুদ্ধ একটা ধারণা চালু আছে। বিশেষ কতগুলো শর্তসাপেক্ষে এ অবাধ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার অর্থনীতি হচ্ছে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সমাধানের পথ_ এরকম একটি বক্তব্যের শাস্ত্রীয় সূচনা হয় স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ বইয়ে। এই বাজার-অর্থনীতি কোনো সর্বজ্ঞ পরিকল্পনাকারীর হাত ধরে কাজ করে না। বস্তুত কেউই এর পরিচালনার দায়িত্বে নেই। সমাজের সব ইকোনমিক এজেন্টেই স্বীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে যুক্ত হন। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তির স্বপ্রণোদিত উদ্যমের ফল হয় সামগ্রিকভাবে সবার জন্য শুভ। এই চমৎকার পরিণতির পেছনে কোনো নিখিল প্রজ্ঞার হাত নেই_ যা আছে তা হলো বাজারের অদৃশ্য হাতের জাদু। সেই থেকে স্মিথের ইনভিজিবল হ্যান্ড-এর তত্ত্ব অর্থশাস্ত্রে চালু হয়ে রয়েছে। বাজারের এই ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্ব অনেকগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে এ পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার নজর কেড়েছে দার্শনিক মিশেল ফুকোর একটি বিশ্লেষণ। তিনি এক জায়গায় বলছেন যে, অদৃশ্য হাত-এর তত্ত্বে রাজা বা সার্বভৌম ক্ষমতা পুরোপুরি অস্বীকৃত। রাজা রাষ্ট্রের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা বা রাষ্ট্রক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অপ্রয়োজনীয় সত্তা। অর্থাৎ ফুকোর ব্যাখ্যায়, সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে যাওয়ার এক পর্যায়ে রাজার অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংকুচিত করার জন্য ১৬৮৮ সালের ‘গ্গ্নোরিয়াস রিভুল্যুশন’ যেসব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিল তারই সর্বোচ্চ তাত্তি্বক স্বীকৃতি মেলে ১৭৭৬ সালে স্মিথের লেখায় বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্বে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাজার যদি কোনো আবশ্যিক ভূমিকা না-ই থাকে, তাহলে তার অস্তিত্বের একটি বড় অংশই মহিমা হারিয়ে ফেলে। এদিক থেকে দেখলে ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্ব আসলে একটি অন্তর্ঘাতমূলক রাজদ্রোহী তাত্তি্বক তৎপরতা_ সর্বময় ক্ষমতার মালিক রাজা বা সার্বভৌমের বিরুদ্ধে। ফুকো তাই লিখেছেন, ‘ইকোনমিক্স ইজ আ ডিসিপ্লিন উইদাউট টোটালিটি।’ আমার নড়বড়ে অনুবাদে তা দাঁড়ায় এমন :’অর্থশাস্ত্র হচ্ছে এমন একটি বিদ্যা যা রাজার পক্ষে গোটা রাষ্ট্রকে শাসন করা সম্ভব এ রকম সার্বভৌম-কেন্দ্রিক ধারণাকে সরাসরি নাকচ করে।… উদারনৈতিকতাবাদের জন্মই এই সূত্রে। এক দিকে আইনের যুক্তিতে গোটা সমাজের উপরে সার্বভৌম ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, আর অন্যদিকে আধিপত্যের হাত গলে যাওয়া অসংখ্য নাগরিকের/প্রজার বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক স্বার্থের (স্বাধীন) অন্বেষণ। এ দুই প্রবণতার মধ্যে মৌলিক বিরোধ রয়ে গেছে।’

বাজারের অদৃশ্য হাতের তত্ত্বকে এভাবে র‌্যাডিক্যাল ধারায় মহিমান্বিত করার চেষ্টা সবাইকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে টমাস কার্লাইল এই অদৃশ্য হাতের তত্ত্বকে নির্ভর করা শাস্ত্রটিকেই অভিহিত করলেন ‘এক বিষণ্ন বিজ্ঞান’ (ডিসমাল সায়েন্স) হিসেবে। অন্যদিকে অলিভার টুইস্ট, ব্রিক হাউস, হার্ড টাইমস প্রভৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে চার্লস ডিকেন্স ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রকে অস্বীকার করে দেখালেন যে, সমাজের কল্যাণসাধন এই অর্থশাস্ত্রের অভিপ্রায় নয়। শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র্য, বৈষম্য এসব অভিজ্ঞতা মূর্ত হয়ে উঠল তার উপন্যাসে। পরিবেশ দূষণ, অনগ্রসর নগর পরিকল্পনা, কারখানায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধিমালার অনুপস্থিতি, জনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা_ এসব বিতর্ক জন্মে উঠেছিল ইউরোপে আরও পরে; কিন্তু ডিকেন্সের লেখায় এসব বিতর্কের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ডিকেন্সের এই লেখাগুলো যখন প্রকাশিক হচ্ছে, ততদিনে আত্মপ্রকাশ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কার্লাইল ও ডিকেন্সের সমালোচনার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। কার্লাইল ১৮৪৯ সালে অর্থশাস্ত্রকে বলেছেন, ‘বিষণ্ন বিজ্ঞান’; এর ঠিক এক বছর আগে, ১৮৪৮ সালে বেরিয়েছে জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’। বইটি মৌলিক গোত্রের না হলেও স্মিথ-রিকাভো-ম্যালথাসের ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রকে সুপাঠ্যবই হিসেবে বিন্যস্ত করেছিলেন মিল। পরবর্তী প্রায় একশ’ বছর ধরে বাংলার (ও ভারতের) জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতিকরা যেমন, উচ্চপর্যায়ের সরকারি চাকরি-প্রার্থী এদেশের ভদ্র সম্প্রদায়ের প্রায় সবাইকেই মিলের বইটির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল অর্থশাস্ত্রের পরীক্ষায় পাসের জন্য। বঙ্কিমের অর্থনৈতিক চিন্তাতেও এ বইয়ের গভীর প্রভাব ছিল। তবে বঙ্কিম তার বিভিন্ন লেখায় ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণে আরও কিছু প্রসঙ্গের সূত্রপাত করেন, যা তার চিন্তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

অন্যত্র আমি বঙ্কিমচন্দ্রের ১৮৭২ সালের লেখা ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ এবং সে লেখায় অর্থশাস্ত্রীয় বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে আমি তিনটি প্রসঙ্গের পুনরুক্তি করা প্রয়োজন মনে করছি। প্রথমত, দেশের শ্রীবৃদ্ধির (এখনকার পরিভাষায়_ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) প্রশ্নটিকে তিনি সরাসরিভাবে সম্পদ-বণ্টন তথা ভূমি-বণ্টন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করেছিলেন। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বললেন, ‘আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, আমাদের দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে… আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে।’ কী মঙ্গল, তা-ও বললেন। চাষের অধীনে জমি বাড়ছে, রেললাইন বসেছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে, বাণিজ্য দ্রব্য নিয়ে স্টিমার চলছে নদীবক্ষে, শহরে সন্ধ্যার পরে গ্রামের আলো জ্বলছে, ‘ফুলিস্কেপ কাগজে বঙ্গদর্শনের জন্য সমাজতত্ত্ব’ লেখা হচ্ছে, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হচ্ছে, সাহেবদের আসবাবপত্র আসছে, সেই সাথে তাদের আদব-কায়দাও আসছে। এসব বলার পরই এল তার পয়লা সওয়াল : ‘এরই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞসার আছে, কাহার এত মঙ্গল? হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাথায় খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্ম্ম বিশিষ্ট বলছে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে, উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?… দেশের মঙ্গল? দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন?… যেখানে তাহাদের মঙ্গল নাই সেখানে দেশের কোন মঙ্গল নাই।’ অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কোনো সামগ্রিক সূচকই উন্নয়নের সূচক নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কতটা গরিবমুখিন হচ্ছে সেটিই প্রধান বিচার্য।

দ্বিতীয়ত, ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নতুন জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন করেছিল তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন বঙ্কিম। আজকের ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা সে যুগেও ছিল রক্ষণশীল ও জমিদারি ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সমর্থক। এদের সমালোচনা করে বঙ্কিম প্রজাওয়ারী (রায়তওয়ারী) ব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তি দিলেন। তার ভাষায়, লর্ড কর্নওয়ালিস ‘মহাভ্রমে পতিত হইয়া প্রজাদিগের আরও গুরুতর সর্বনাশ করিলেন’_ তিনি ‘রাজস্বের কন্ট্রাক্টরদিগকে ভূস্বামী করিলেন’। অথচ, ”প্রজারাই চিরকালের ভূস্বামী; জমিদারেরা কস্মিনকালে কেহ নহেন_ কেবল সরকারি তহশীলদার। কর্নওয়ালিশ যথার্থ ভূস্বামীর নিকট হইতে ভূমি কাড়িয়া লইয়া তহশীলদারকে দিলেন… এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বঙ্গদেশের অধঃপাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মাত্র কস্মিনকালে ফিরিবে না।” সম্পত্তির উপর মালিকানার ধরন যে অর্থশাস্ত্রের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা, এখানে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, এই অবস্থার যে দ্রুত নিরসন করা যাচ্ছে না, তার কারণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগী শুধু জমিদারেরা নন, উচ্চ শ্রেণীর কৃতবিদ্য লোকেরাও অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্র সম্প্রদায় তথা বাবুরা (এ ‘বাবুদের’ নিয়ে তার একটি স্বতন্ত্র তীক্ষষ্ট ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধও রয়েছে)। বঙ্গদর্শন পত্রিকার শুরুতে ‘পত্রসূচনা’য় বঙ্কিমচন্দ্র স্পষ্ট করে জানালেন যে, বাঙালির উন্নতি বলতে তিনি কখনোই কেবল সুশিক্ষিতের উন্নতি বোঝাচ্ছেন না। তার ভাষ্যে, ‘সমগ্র বাঙালির উন্নতি না হইলে দেশের কোন মঙ্গল নাই। সমস্ত দেশের লোক ইংরেজি বুঝে না, কস্মিনকালে বুঝিবে, এ মত প্রত্যাশা করা যায় না।… সুতরাং বাঙ্গালায় যে কথা উক্ত না হইবে, তাহা তিন কোটি বাঙ্গালী কখন বুঝিবে না, বা শুনিবে না। এখনও শুনে না, ভবিষ্যতে কোন কালেও শুনিবে না। যে কথা দেশের সকল লোকে বুঝে না, বা শুনে না, সে কথায় সামাজিক বিশেষ কোন উন্নতির সম্ভাবনা নাই’। দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিম বাংলা ভাষার জনভিত্তিক প্রসারকে উন্নতির আরম্ভ-বিন্দু হিসেবে দেখেছেন এমনকি অধস্তন ও কৃতবিদ্য শ্রেণীর মধ্যে। ‘সমকক্ষতা’ স্থাপনের একটি পাটাতন হিসেবে দেখেছেন। ভূমি-বণ্টনের অনাব্যতার প্রতিক্রিয়া দেখানোর পাশাপাশি ভাষায় সমকক্ষতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে তিনি শুধু অর্থনৈতিক সমতা-অর্জনের উপায় হিসেবে নয়, দেশের উন্নতির ভিত্তি হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। এভাবে তিনি কার্লাইল-ডিকেন্সের ‘বিষণ্ন বিজ্ঞান’ সমালোচনার উত্তর খুঁজছেন উপনিবেশিক পরিস্থিতিতে। বেন্থাম-মিলের উপযোগীবাদী তত্ত্বকে তিনি সজোরে নাড়া দিচ্ছেন গুরু-শিষ্যের মধ্যকার সমীহ ভাবকে বজায় রেখেই। মিলের ইউটিলিটারিয়ান দর্শন নিয়ে তিনি কমলাকান্তের দফতরেও পরিহাস করেছেন। তার ভাষ্যে আবারও ফিরে যাই ‘এরূপ কখন কোন দেশে হয় নাই যে, ইতর লোক চিরকাল এক অবস্থায় রহিল, ভদ্রলোকদিগের অবিরত শ্রীবৃদ্ধি হইতে লাগিল। বরং যে যে সমাজের বিশেষ উন্নতি হইয়াছে, সেই সেই সমাজে উভয় সম্প্রদায় সমকক্ষ, বিমিশ্রিত এবং সহৃদয়তাসম্পন্ন। যতদিন এই ভাব ঘটে নাই_ যতদিন উভয়ে পার্থক্য ছিল, ততদিন উন্নতি ঘটে নাই। যখন উভয় সম্প্রদায়ের সামঞ্জস্য হইল, সেই দিন হইতে শ্রীবৃদ্ধি আরম্ভ।’ এক অর্থে ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রের যে-উদ্বোধন ঘটেছিল স্মিথ-রিকার্ডো-মিলের হাত ধরে, তার মধ্যে উন্নয়ন অর্থশাস্ত্র ছিল না। এবারে উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রের কিছু মৌলিক উপাদানের প্রতি ইঙ্গিত দিলেন বাংলার প্রথম অর্থশাস্ত্রবিশারদ বঙ্কিমচন্দ্র। তার কথিত সহৃদয়তাসম্পন্ন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকেও হাল আমলের ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ তত্ত্বের পূর্বলেখ বলে মনে হয়।

দুর্ভাগ্য যেটা, তা হলো বাঙালি বলতে বঙ্কিমচন্দ্র বর্ণ-নির্বিশেষে ধর্ম-নির্বিশেষে অভিন্ন জাতিসত্তা বোঝাননি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এই অন্ধত্ব বিশেষ করে দেখা দিয়েছিল বাংলার মুসলমান সমাজকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে। দেশের শ্রীবৃদ্ধির অসঙ্গতির আলোচনায় পরান মণ্ডল, হাসিম শেখ ও রাজা কৈবর্ত্তের উল্লেখ তবু পাই, কিন্তু জাতি-নির্মাণের প্রকল্পে কোথাও ‘হাসিম শেখ’কে দেখতে পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক চিন্তায় বঙ্কিমচন্দ্র সমতাবাদী, কিন্তু রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় তিনি যে নেশনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেখানে মুসলমানদের স্থান করে দেননি। ১৯৬৪ সালে আবুজাফর শামসুদ্দীন এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র ফরাসি বিপ্লব নিয়ে পড়েছেন। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কেও জানতেন, সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি নিয়েও কখনও কখনও প্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে হিন্দুর ধর্মীয় পুনরুত্থান ছাড়া আর কিছুই যে বুঝতে পারেননি এটি একটি ঐতিহাসিক আশ্চর্য! এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রথমবারের মতো উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রে যে বাঙালি চিন্তকের মধ্যে মৌলিকত্ত্ব কিছুটা লক্ষ্য করা যায়, সেই চিন্তকের মধ্যেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে সুগভীর ফাটল থেকে গিয়েছিল। ফলে কার্লাইল-ডিকেন্সের বিষণ্নতার কলঙ্ক থেকে অর্থশাস্ত্রকে মুক্ত করা বঙ্কিমের মতো তীক্ষষ্টধীর পক্ষেও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এক অর্থে এটি একটি ব্যর্থতার মডেল হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তী বছরগুলোয়। অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে প্রাগ্রসর ধারণার আশ্রয়ের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে অনগ্রসর ধারণাকে লালন করার এই পরস্পরবিরোধী ধারা উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথমার্ধের অনেক বাঙালির তত্ত্ব চর্চার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মোরশেদ শফিউল হাসানের অধুনাকালের গবেষণা ‘পূর্ব বাঙলায় চিন্তাচর্চা ১৯৪৭-১৯৭০ : দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়া’ গ্রন্থে যেসব আকর-উপাদান জড়ো করা হয়েছে, তাতে করে পাকিস্তান-উত্তর পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাঙালি মুসলিম ‘রেনেসাঁ’ পর্বের বিভিন্ন মুসলমান চিন্তাবিদের মধ্যেও বঙ্কিম-প্রদর্শিত ফাটলের পথ ধরে চলবার প্রবণতা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। আকরম খাঁ থেকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবুল হাশিম, আবুল মনসুর আহমদ থেকে আবুল ফজল কেউই বঙ্কিম-প্রদর্শিত স্ববিরোধিতার পথ থেকে নিজেদেরকে আড়াল করতে পারেননি।

৩. দুর্ভিক্ষের অর্থনীতি

অমর্ত্য সেন যেসব কারণে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল দুর্ভিক্ষের কার্যকারণ নিয়ে তাঁর মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিনস্’। যেটা লক্ষ্য করার তাহলো দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যেসব রচনা পাওয়া যায় তার মধ্যে সেন-উলি্লখিত কার্যকারণের একটি পূর্ব অনুমান মেলে। ১৭৭০-এর মহামন্বন্তর (যার ফলে, সরকারি হিসাবেই অবিভক্ত বাংলার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী মৃত্যুবরণ করেছিলেন) অমর্ত্য সেনের গ্রন্থের আলোচনায় আসেনি। যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়নি উনিশ শতকের অন্তত ৫টি দুর্ভিক্ষ, যথাক্রমে ১৮৬৫/৬৬, ১৮৭৩/৭৪, ১৮৮৪, ১৮৯১/৯২ ও ১৮৯৫/৯৭। তিনি তার গ্রন্থে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর ও বাংলাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কার্যকারণ ও সংঘটন।

তবে সাহিত্যের আকর-উপাদান খুঁজলে বাংলার বিভিন্ন দুর্ভিক্ষের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়, যাতে শুধু সেনের এনটাইটেলমেন্ট তত্ত্বের প্রমাণ্যতাই মেলে না, পাওয়া যায় আরও বাড়তি কিছু উপাদানের অস্তিত্ব। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি মুসলমান-বিদ্বেষী উপাদানের কারণে এখন অনেকটাই অর্থনৈতিক ডিসকোর্সের বাইরে। এমনকি অর্থশাস্ত্রের ছাত্রছাত্রীরাও দুর্ভিক্ষের অর্থনীতি বোঝার প্রয়োজনে কদাচিৎ ‘আনন্দমঠ’ পড়ে দেখতে চান। বঙ্কিম অবশ্য ‘আনন্দমঠ’ লিখেছিলেন ১৭৭০-এর মহামন্বন্তর ঘটে যাওয়ার একশো বছর পরে (১৮৮০ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত)। এই দুর্ভিক্ষের আকর-উপাদান তিনি জড়ো করেছিলেন হান্টার সাহেবের লেখা ‘দ্য এনালস্ অব রুরাল বেঙ্গল’ পড়ে। দুর্ভিক্ষ বোঝার দৃষ্টিকোন থেকে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি পড়লে কয়েকটি সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে।

প্রথমত, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষের পেছনে প্রকৃতিসৃষ্ট কিছু উপাদান (যেমন দুর্ভিক্ষের আগের পরপর তিনটি বছরেই ভালো ফসল না হওয়া) ক্রিয়াশীল থাকলেও একে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষই বলতে চেয়েছেন লেখক। সামগ্রিকভাবে সুশাসনের অভাব একটি বড় কারণ ছিল এই দুর্ভিক্ষের পেছনে। মনে রাখতে হবে যে এই সময়ে কোম্পানির শাসনের গোড়া পত্তন হচ্ছিল। ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের পর, বিশেষত ১৭৬৫ সালের পর থেকে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসন গেড়ে বসতে থাকে। ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ হয় এমনই একটি উত্তরণকালীন পর্যায়ে_ যখন না কোম্পানি না দেশীয় নবাবেরা (যেমন রেজা খাঁ) পূর্ণ শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম হচ্ছিলেন। আর উত্তরণকালীন পর্যায়ের সুযোগ নিয়ে শাসনব্যবস্থায় অরাজকতা নেমে এসেছিল। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা সরাসরিভাবে মহাজনী কারবারে যেমন, তেমনি প্রত্যক্ষভাবে লুণ্ঠনকার্যেও জড়িত হয়ে পড়েন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট-এর কালে এডমন্ড বার্কের উত্থাপিত অভিযোগে এটি ছিল একটি বড় বিষয়। দ্বিতীয়ত, প্রচণ্ড খরার মুখে বাংলার ‘চৈতালি’ শস্যের বিনষ্ট হওয়ার পরিস্থিতিতে সরকার বছরের গোড়াতেই কোম্পানির সেনাবাহিনীর জন্য ‘৮০ হাজার মণ চাল মজুদ করার’ নীতি নেয়। ফলে বাজারে দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো চালের সরবরাহ আরও কমে যায়। তৃতীয়ত, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসে ব্যাপকভাবে কুটিরশিল্পের ধ্বংসের কারণে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, সে সময়ে রাজস্ব-সংগ্রহের ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আসে। মোগল আমলে গোটা গ্রাম সমষ্টিগতভাবে রাজস্ব দিত। গ্রামপ্রধান সে রাজস্ব সংগ্রহ করে মোগল সরকারের ঘরে পাঠিয়ে দিতেন। উত্তরণশীল এই পর্বে গ্রামভিত্তিক রাজস্ব সংগ্রহের পরিবর্তে ব্যক্তি বা পরিবারভিত্তিক রাজস্ব-ব্যবস্থা চালু হলো এবং সেটাও করা হলো ভিন্ন উপায়ে। আগে যেখানে উৎপাদিত শস্যের হিসাবে খাজনা দেওয়া হতো, এখন সেটা হতে থাকল নগদ অর্থে। দুর্ভিক্ষের আলামত সত্ত্বেও রাজস্ব-সংগ্রহের মোট পরিমাণ কমল না। আকাড়ার সময়ের সুযোগ নিয়ে মজুদদারি করে চালের ব্যবসায় এ সময়ে বিনিয়োগ করেছিলেন রাজকর্মচারীরা। সুপ্রকাশ রায় তার ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইতে জানিয়েছেন যে, ‘বাংলা ও বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক, তাহাদের সকল আমলা-গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান, চাউল ক্রয় করিতে লাগিল’। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রশাসনিক নির্দেশে আন্তঃজেলা খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্র নিজেই যেখানে মজুদদারি, ব্যবসায় নিয়োজিত সেখানে শুধু বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’কে এখানে দোষ দেওয়া চলে না। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল আন্তঃজেলা খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানি অবাধ করে দেওয়ার পক্ষে জোরালো অভিমত রেখেছিলেন।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এসব উপাদান ছাড়াও আরও রয়েছে দুর্ভিক্ষের ক্রমবিস্তৃতির বিবরণ, এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের মাংস মানুষে খাওয়ার আতঙ্ক উদ্রেককারী উল্লেখ। দীর্ঘ উদ্ধৃতির এখানে সুযোগ নেই, তারপরও একটি ছোট্ট বিবরণ দিচ্ছি যার থেকে দুর্ভিক্ষের বিস্তৃতির বিভিন্ন পর্যায়কে বিশ্লেষণাত্মক উপায়ে শনাক্ত করা সম্ভব:

‘অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল। রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল। তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল। তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না, [ওদিকে সরকার] একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয় দিল।… লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিত আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়! উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল, গোরু বেচিল, লাঙল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কেনে! খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাষ খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল।… অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’

১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষের যে বিবরণ ‘আনন্দমঠ’-এ পাই তার সঙ্গে বিভূতিভূষণের ‘অশনিসংকেত’-এর তুলনা করলে আধুনিক দুর্ভিক্ষের সঙ্গে অষ্টাদশ-উনিশ শতকের দুর্ভিক্ষের বেশ কিছু মিল ও অমিল চোখে পড়বে। যারা চরম দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে অর্থশাস্ত্রীয় গবেষণায় উৎসাহী তাদের জন্য। এরকম সাহিত্যিক তুলনা-প্রতিতুলনা বিরল অন্তর্দৃষ্টি জোগাতে পারে। ‘অশনিসংকেত’ উপন্যাসে (দুর্ভিক্ষ যখন দানা বাঁধছে) গঙ্গাচরণ চালের ব্যবসায়ী কুণ্ডু মশায়কে জিজ্ঞেস করলেন_ ‘ধান চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?’ উত্তরে কুণ্ডু মশায় বললেন, ‘কি করবো বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুঠ হবার পর কি করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন। সবারই সে দশা। তারপর শুনচি পুলিসে নিয়ে যাবে চাল কম দমে মিলিটারির জন্যে’। জাপানের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে রেঙ্গুন থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেল, জাপানের সঙ্গে আরও বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ইচ্ছে করেই ভেঙে দেওয়া হলো। মজুদদারি ব্যবসা তো ছিলই। সাধারণ ব্যবসায়ী ও কিছুটা অবস্থাপন্ন গৃহস্থেরাও যাকে বলে ‘প্যানিক হোর্ডিং’ করা শুরু করল। সরকার বাহাদুর নিজেই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আমদানিকৃত চালের একটা বড় অংশ পাঠিয়ে দিলেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধরত সেনাদের কাছে। এই নীতির জন্য সাম্প্রতিক এক গবেষণায় চার্চিলকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। আর দেশের ভেতরে বড় বড় আড়তদারকে বাধ্য করা হলো সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে। এই ধান ক্রয় করা হতো কন্ট্রাক্টরদের মাধ্যমে_ এর মধ্যে সে সময় বড় ভূমিকা পালন করেছিল পরবর্তীকালের শিল্পপতি ইস্পাহানির মতো ব্যবসায়ী গ্রুপেরা। অর্থনীতিবিদ আবদুল্লাহ্ ফারুক তার ‘কয়েকজন বাঙালী শিল্পোদ্যোক্তার জীবনী’ বইতে জানিয়েছেন যে, এ সময় মজুদদারি ও ফাটকাবাজি ব্যবসায় লগি্ন করে লাভবান হয়েছিলেন ‘দানবীর’ রণদাপ্রসাদ সাহারাও। তাই উপন্যাসে কুণ্ডু মশাইকে গঙ্গাচরণ বলছেন, ‘বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক। নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে’। উত্তরে কুণ্ডু মশাই বললেন, ‘বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কন্ট্রাক্টরদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি।’

তারাশংকরের ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসে পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম থেকে বিজয় নীলাকে লিখেছে, ‘এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি_ ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজমা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত ধান টেনে নিচ্ছে।’ সরবরাহে ঘাটতির কারণে বাজারে চালের দামও বাড়ছিল দ্রুত হারে। সুব্রত রায় চৌধুরী তার ‘কথাসাহিত্য মন্বন্তরের দিনগুলিতে’ বইতে বিভূতিভূষণের ‘অশনিসংকেত’ থেকে চালের দামবৃদ্ধি সম্পর্কে একটি সারণি উপস্থাপন করেছেন। তাতে দেখা যায়, সে বছর ফাল্গুনে চালের দর মণপ্রতি ছিল ৬ টাকা, সেটা চৈত্রের শেষে দাঁড়ায় ২০ টাকা। আশ্বিন মাসে অনঙ্গ বৌ মতিকে বলছে যে, চালের দাম দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকায়। অন্যদিকে, উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের পারিশ্রমিক ছিল নিম্নরূপ_ গঙ্গাচরণের ক্ষেত্রে মাসিক আয় ১২ টাকা, দুর্গা পণ্ডিত পেতেন মাসে ৬ টাকা ৪৫ পয়া, নবীন বাড়ূই পেতেন দৈনিক ১৬ আনা করে, আর জেলে বৌ আরও কম_ দৈনিক ১০-১২ আনা করে। চালের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এদের সকলেরই প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছিল কয়েক মাসের মধ্যেই। এক পর্যায়ে নবীন বাড়ূই, জেলে বৌ বা মতি মুচিনীর হাতে কোনো কাজও ছিল না। মতি তো মারাই গেল। অর্থাৎ সাহিত্যেও অমর্ত্য সেন-ব্যাখ্যাত এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্ট তত্ত্বের ন্যারেটিভ বিশ্বস্ততার সঙ্গে রূপায়িত হচ্ছিল।

দুঃখের বিষয়, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজটি বঙ্কিমচন্দ্র ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজটি বিভূতিভূষণ (বা তারাশংকর) করেছিলেন ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে বা অন্যত্র কোনো বিশ্বস্ত সাহিত্যিকে বিবরণী আমরা পাইনি এখনো। সত্তর-আশি দশকের বাংলাদেশের অব্যাহত সুশাসনহীনতা, রাজনৈতিক খুন ও গুমখুন, সামরিক শাসনের অভ্যুদয়, লুটপাটের অর্থনীতি এরকম নানা উপসর্গের পেছনে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও দুর্ভিক্ষজনিত মূল্যবোধের ক্ষয় একটি মৌলিক বিনাশের সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। অন্তত এমনটাই আমার কাছে মনে হয়েছে। ১৯৭৪ নিয়ে নীরবতা এদেশের সাহিত্য ও অর্থনীতি চর্চা উভয়ের ক্ষেত্রেই ফলদায়ী হয়নি। কবিরা স্পষ্টভাষী বলে সে সময়ে কিছুটা পরিমাণে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। রফিক আজাদ যেমন লিখেছিলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’। শহীদ কাদরীও তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম দেন_ ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’। শামসুর রাহমানও লিখেছেন, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ বা ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’র মতো কাব্য-শিরোনাম। তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। সাধারণভাবে আমাদের সুবাধ্য সুশীল সমাজ ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ও তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো অব্যাখ্যাত কারণে নীরব থাকাটাকেই শ্রেয়তর অবস্থান বলে মনে করেছে।

লেখক
গবেষক
প্রাবন্ধিক

মারিনা সিভেতায়েভার কবিতা: শিরোনাম-হীন


লোহার ছোট্ট কৌটা খুলে
বার করেছি দুঃখের উপহারঃ
ছোট্ট একটা আংটি, তাতে
মুক্তার পাথর বসানো— জ্বলছে

বেড়ালের মত নিঃশব্দে এবার বেরিয়ে যাওয়ার পালা
আমার মুখে-ঠোঁটে হাওয়ার ঝাপ্টা
ভেসে আসছে কান্না, পাখিরা ডানা মেলল…
আমার বাঁদিকে—রাজহংসীরা, ডানদিকে—কাকেদের ভীড়,
আমাদের চলার পথ—দুদিকে সরে যাচ্ছে

তুমি যেদিকে চলেছো সেদিকে কুয়াশার মেঘ
তোমার পথ হারালো স্বপ্নে-ডোবা অরণ্যে
তোমার পথ হারালো তপ্ত বালুর মধ্যে
তোমার আত্মা—ফেটে পড়ছে চিৎকারে
তোমার চোখ—মুছে নিচ্ছে নীরবে

আর আমার দেহের উপরে—জড়ো হচ্ছে পেঁচাদের দল
আর আমার দেহের উপরে—জোরে শ্বাস ফেলছে ঘাস


কেউ কোনকিছু ধ্বংস করে নি আমাদের,
আমি সুখী—আমাদের এই বিচ্ছেদে।
সহস্র যোজন দূরত্বে থেকে
এই নাও, আমার চুম্বন।

আমাদের ছিল–দুই মেরুর প্রতিভা।
আমার স্বর এই প্রথম—হঠাৎই শান্ত হয়ে এল।
আমার এই ছেড়া-খোঁড়া কবিতায়
তোমার এসে যায় না কিছু।

তুমি যেদিক পানে উড়াল দিচ্ছ,
ঈগলছানা আমার,
সফল হও, প্রার্থনা করি।
সূর্যের অসহ্য আলো তুমি এত সহজে
সইতে পারলে,
আমার তারুণ্যে ভরা সেদিনের তাকানো
সে কি আরো অসহ্য ছিল?

কেউ তোমাকে এতটা মমতায় দ্যাখে নি।
শেষবারের মত—কোন প্রত্যাশা নিয়ে বলছি না—
সহস্র বছরের ওপার থেকে দিচ্ছি,
এই নাও, আমার চুম্বন।


আমার এই বিশাল শহরে এখন—রাত্রি।
রাস্তায় নামলাম যখন, ঘরবাড়ী সব—ঘুমাচ্ছে।
যেখানেই যাই, আমার পিছু ছাড়ে না—বাতাস।
কারো জানালা থেকে ভেসে আসছে—গান।
ভোর না হওয়া অব্দি
বুকের হাড়-পাঁজর কাঁপিয়ে—জোর হাওয়া উঠবে।
দিনের ডালপালা সরিয়ে বার হয়ে এসো—স্বাধীন।
বন্ধুরা, আমি তোমাদেরই স্বপ্নে ছিলাম—এক পড়শী।

খামোখা জল ফেলো না
বাবা-মা’র কথা ভেবে। ওঠো। ঈশ্বর আছেন।
রাতের এই রাস্তা ধরে চলো সেদিকে,যেখানে
ধারে-কাছে নেই কোন কাঁপা হারিকেনের আলো
বা নেড়ি কুত্তাদের দল।


আজ অথবা কাল, কোন একদিন, এই বরফ গলবে।
তুমি তখন শীতে কাঁপছো পশমের চাদর গায়ে—একা।
ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমার,
ততদিনে শুকিয়ে গেছে তোমার ঠোঁট।

টলমল করে হাঁটবে তখন, পানাহারে অরুচি।
তোমার চারপাশ থেকে ছিটকে পড়েছে সকলেই।
এই কি ছিল সেই অঙ্গুলি, যার জন্যে
কাতর রগোঝিন ছুরি শানিয়েছিল একদা?

আর চোখ, তোমার সে চোখ, সে-ও কবে
বয়সের সাথে নিভে গেছে বৃত্তাকার গর্তে।
তুমি হয়ত তখন কারো কাঁধে ভর দিয়ে
ফিরে আসছ নিজের বিষণ্ণ ভিটেয়।

দূরে, খোলা রাস্তায়, দ্যাখো জেগে আছে একটা সারস।
দরোজা হাট করে খোলা—রাতের হাওয়া দিচ্ছে।
এসো তবে, হে আমার অনাকাংখিত অতিথি,
দাঁড়াও, আমার এই আলোকময় শান্ত কোনে।

বেট্রোল্ট ব্রেশটের কবিতা: যারা আগামীতে জন্ম নেবে তাদের প্রতি

যারা আগামীতে জন্ম নেবে তাদের প্রতি

সত্যি,কী সময়ে বাস আমার!
সোজা-সাপটা কথা বলাও এখন মূর্খতা।
যার কপালে কোন ভাঁজ পড়ে নি সে আসলে বোধশক্তিহীন।
আর যে লোকটা হেসে চলেছে,
সে এখনো তার দুঃসংবাদ পায় নি।

এ কী সময়ে বাস যখন
বৃক্ষ নিয়ে আলাপও অপরাধ,
পাছে ধরা পড়ে যায়
লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা
তাদের দুষ্কর্মগুলো?
এ কী সময়ে বাস যখন
এই যে লোকটা রাস্তা পার হয়ে গেল
সে এরই মধ্যে গুম,
অস্থির অপেক্ষায় থাকা তার বন্ধুরা
যার হদিশ কোনদিনই পাবে না।

এসব ভাবলে আমি বেশ আছি।তবে
বলতে পারো, এ-ও দুর্ঘটনাই এক ।
আমার এই বেঁচে যাওয়ার পেছনে
কোন জোরালো যুক্তি নেই। আমার ধারণা,
নেহাৎই কাকতালীয় ভাবে, আমি বেঁচে গেছি।
(কপাল যেদিন মন্দ হবে, সেদিন নির্ঘাত সমাধি)

আমাকে বোঝানো হয়েছে
খাবে-দাবে,আর খোশ মেজাজে থাকবে,
সব কিছু ঠিকঠাক চলছে, এই ভেবে।
আমি বুঝে পাই না
একজন অনাহারী, অন্যের পাত থেকে কেড়ে না খেলে
একজন তৃষ্ণার্ত, অন্যের হাত থেকে ছিনিয়ে না নিলে
যেখানে প্রতিদিনের আহার পানীয় জোটে না
তার পক্ষে কীভাবে ঠিকঠাক চলা সম্ভব?
অথচ, এরপরও, চলছি।

আমিও প্রজ্ঞ্বাবান হতে চাই।
প্রজ্ঞ্বা কিসে, তা প্রাচীন গ্রন্থে লেখাঃ
“পার্থিবের দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলো
শঙ্কাহীন জীবন কাটাও
সংঘাতে জড়িয়ে পড়ো না
সত্যকে আঁকড়ে অসত্যকে জয় করো
বাসনা পূর্ণ করো না
বাসনাকে অতিক্রম করো”।
এতসব করা আমার সাধ্যাতীত।
সত্যি,কী সময়ে বাস আমার।


এক বিশৃংখল সময়ে আমি শহরে এসেছিলাম
চারপাশে দুর্ভিক্ষ তখন।
এক বিদ্রোহের সময়ে
আমি জনতার কাতারে এসে দাঁড়াই,
বিদ্রোহী হয়ে উঠি তাদের দেখাদেখি।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।

এক নিরন্তর যুদ্ধের মধ্যে আহার সারতে হয়েছে আমাকে।
চারপাশে খুনীদের রেখেই আমি ঘুমাতে গিয়েছি।
ভালোবেসেছি বাধাবন্ধনহীন, আর নিসর্গকে
আস্বাদন করেছি প্রচন্ড অধৈর্যে।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।

আমার সময়ে সব পথেরই শেষ হত
কোন-না-কোন গাড্ডায়।
আমার কথাই আমাকে চিনিয়ে দিয়েছে
আততায়ীদের নিকট,
চাইলেও একে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
শুধু এটুকু জানতাম, আমাকে সরিয়ে দিলে
যারা ক্ষমতায়, তারা আরো নিরাপদে থাকবে—
সবকিছুর মধ্যে কেবল এটাই ছিল আশার দিক।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।

আমাদের জনবল ছিল সামান্য, আর গন্তব্য
যদিও-বা ছিল অনেক দূরে, চিনতে কষ্ট হয় নি।
এ-ও জানতাম, আমার একার পক্ষে
সেখানে পৌঁছানো হবে না।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।


তোমরা
যারা মহাপ্লাবনের পরে উপরে উঠে আসবে,
যার গভীরে একদিন আমরা তলিয়ে গেছি,
তোমরা যখন আমাদের ব্যর্থতার কথা বলবে
তখন এই অন্ধকার সময়ের কথা
বলতে ভুলো না, যার গ্রাস থেকে
নিজেদের সেদিন বাঁচাতে পেরেছিলে।