মারিনা সিভেতায়েভার কবিতা: শিরোনাম-হীন


লোহার ছোট্ট কৌটা খুলে
বার করেছি দুঃখের উপহারঃ
ছোট্ট একটা আংটি, তাতে
মুক্তার পাথর বসানো— জ্বলছে

বেড়ালের মত নিঃশব্দে এবার বেরিয়ে যাওয়ার পালা
আমার মুখে-ঠোঁটে হাওয়ার ঝাপ্টা
ভেসে আসছে কান্না, পাখিরা ডানা মেলল…
আমার বাঁদিকে—রাজহংসীরা, ডানদিকে—কাকেদের ভীড়,
আমাদের চলার পথ—দুদিকে সরে যাচ্ছে

তুমি যেদিকে চলেছো সেদিকে কুয়াশার মেঘ
তোমার পথ হারালো স্বপ্নে-ডোবা অরণ্যে
তোমার পথ হারালো তপ্ত বালুর মধ্যে
তোমার আত্মা—ফেটে পড়ছে চিৎকারে
তোমার চোখ—মুছে নিচ্ছে নীরবে

আর আমার দেহের উপরে—জড়ো হচ্ছে পেঁচাদের দল
আর আমার দেহের উপরে—জোরে শ্বাস ফেলছে ঘাস


কেউ কোনকিছু ধ্বংস করে নি আমাদের,
আমি সুখী—আমাদের এই বিচ্ছেদে।
সহস্র যোজন দূরত্বে থেকে
এই নাও, আমার চুম্বন।

আমাদের ছিল–দুই মেরুর প্রতিভা।
আমার স্বর এই প্রথম—হঠাৎই শান্ত হয়ে এল।
আমার এই ছেড়া-খোঁড়া কবিতায়
তোমার এসে যায় না কিছু।

তুমি যেদিক পানে উড়াল দিচ্ছ,
ঈগলছানা আমার,
সফল হও, প্রার্থনা করি।
সূর্যের অসহ্য আলো তুমি এত সহজে
সইতে পারলে,
আমার তারুণ্যে ভরা সেদিনের তাকানো
সে কি আরো অসহ্য ছিল?

কেউ তোমাকে এতটা মমতায় দ্যাখে নি।
শেষবারের মত—কোন প্রত্যাশা নিয়ে বলছি না—
সহস্র বছরের ওপার থেকে দিচ্ছি,
এই নাও, আমার চুম্বন।


আমার এই বিশাল শহরে এখন—রাত্রি।
রাস্তায় নামলাম যখন, ঘরবাড়ী সব—ঘুমাচ্ছে।
যেখানেই যাই, আমার পিছু ছাড়ে না—বাতাস।
কারো জানালা থেকে ভেসে আসছে—গান।
ভোর না হওয়া অব্দি
বুকের হাড়-পাঁজর কাঁপিয়ে—জোর হাওয়া উঠবে।
দিনের ডালপালা সরিয়ে বার হয়ে এসো—স্বাধীন।
বন্ধুরা, আমি তোমাদেরই স্বপ্নে ছিলাম—এক পড়শী।

খামোখা জল ফেলো না
বাবা-মা’র কথা ভেবে। ওঠো। ঈশ্বর আছেন।
রাতের এই রাস্তা ধরে চলো সেদিকে,যেখানে
ধারে-কাছে নেই কোন কাঁপা হারিকেনের আলো
বা নেড়ি কুত্তাদের দল।


আজ অথবা কাল, কোন একদিন, এই বরফ গলবে।
তুমি তখন শীতে কাঁপছো পশমের চাদর গায়ে—একা।
ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমার,
ততদিনে শুকিয়ে গেছে তোমার ঠোঁট।

টলমল করে হাঁটবে তখন, পানাহারে অরুচি।
তোমার চারপাশ থেকে ছিটকে পড়েছে সকলেই।
এই কি ছিল সেই অঙ্গুলি, যার জন্যে
কাতর রগোঝিন ছুরি শানিয়েছিল একদা?

আর চোখ, তোমার সে চোখ, সে-ও কবে
বয়সের সাথে নিভে গেছে বৃত্তাকার গর্তে।
তুমি হয়ত তখন কারো কাঁধে ভর দিয়ে
ফিরে আসছ নিজের বিষণ্ণ ভিটেয়।

দূরে, খোলা রাস্তায়, দ্যাখো জেগে আছে একটা সারস।
দরোজা হাট করে খোলা—রাতের হাওয়া দিচ্ছে।
এসো তবে, হে আমার অনাকাংখিত অতিথি,
দাঁড়াও, আমার এই আলোকময় শান্ত কোনে।

বেট্রোল্ট ব্রেশটের কবিতা: যারা আগামীতে জন্ম নেবে তাদের প্রতি

যারা আগামীতে জন্ম নেবে তাদের প্রতি

সত্যি,কী সময়ে বাস আমার!
সোজা-সাপটা কথা বলাও এখন মূর্খতা।
যার কপালে কোন ভাঁজ পড়ে নি সে আসলে বোধশক্তিহীন।
আর যে লোকটা হেসে চলেছে,
সে এখনো তার দুঃসংবাদ পায় নি।

এ কী সময়ে বাস যখন
বৃক্ষ নিয়ে আলাপও অপরাধ,
পাছে ধরা পড়ে যায়
লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা
তাদের দুষ্কর্মগুলো?
এ কী সময়ে বাস যখন
এই যে লোকটা রাস্তা পার হয়ে গেল
সে এরই মধ্যে গুম,
অস্থির অপেক্ষায় থাকা তার বন্ধুরা
যার হদিশ কোনদিনই পাবে না।

এসব ভাবলে আমি বেশ আছি।তবে
বলতে পারো, এ-ও দুর্ঘটনাই এক ।
আমার এই বেঁচে যাওয়ার পেছনে
কোন জোরালো যুক্তি নেই। আমার ধারণা,
নেহাৎই কাকতালীয় ভাবে, আমি বেঁচে গেছি।
(কপাল যেদিন মন্দ হবে, সেদিন নির্ঘাত সমাধি)

আমাকে বোঝানো হয়েছে
খাবে-দাবে,আর খোশ মেজাজে থাকবে,
সব কিছু ঠিকঠাক চলছে, এই ভেবে।
আমি বুঝে পাই না
একজন অনাহারী, অন্যের পাত থেকে কেড়ে না খেলে
একজন তৃষ্ণার্ত, অন্যের হাত থেকে ছিনিয়ে না নিলে
যেখানে প্রতিদিনের আহার পানীয় জোটে না
তার পক্ষে কীভাবে ঠিকঠাক চলা সম্ভব?
অথচ, এরপরও, চলছি।

আমিও প্রজ্ঞ্বাবান হতে চাই।
প্রজ্ঞ্বা কিসে, তা প্রাচীন গ্রন্থে লেখাঃ
“পার্থিবের দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলো
শঙ্কাহীন জীবন কাটাও
সংঘাতে জড়িয়ে পড়ো না
সত্যকে আঁকড়ে অসত্যকে জয় করো
বাসনা পূর্ণ করো না
বাসনাকে অতিক্রম করো”।
এতসব করা আমার সাধ্যাতীত।
সত্যি,কী সময়ে বাস আমার।


এক বিশৃংখল সময়ে আমি শহরে এসেছিলাম
চারপাশে দুর্ভিক্ষ তখন।
এক বিদ্রোহের সময়ে
আমি জনতার কাতারে এসে দাঁড়াই,
বিদ্রোহী হয়ে উঠি তাদের দেখাদেখি।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।

এক নিরন্তর যুদ্ধের মধ্যে আহার সারতে হয়েছে আমাকে।
চারপাশে খুনীদের রেখেই আমি ঘুমাতে গিয়েছি।
ভালোবেসেছি বাধাবন্ধনহীন, আর নিসর্গকে
আস্বাদন করেছি প্রচন্ড অধৈর্যে।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।

আমার সময়ে সব পথেরই শেষ হত
কোন-না-কোন গাড্ডায়।
আমার কথাই আমাকে চিনিয়ে দিয়েছে
আততায়ীদের নিকট,
চাইলেও একে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
শুধু এটুকু জানতাম, আমাকে সরিয়ে দিলে
যারা ক্ষমতায়, তারা আরো নিরাপদে থাকবে—
সবকিছুর মধ্যে কেবল এটাই ছিল আশার দিক।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।

আমাদের জনবল ছিল সামান্য, আর গন্তব্য
যদিও-বা ছিল অনেক দূরে, চিনতে কষ্ট হয় নি।
এ-ও জানতাম, আমার একার পক্ষে
সেখানে পৌঁছানো হবে না।
এভাবেই আমার সময় আমি পার করে দিয়েছি,
পৃথিবীতে যতটা সময় আমার বরাদ্দে ছিল।


তোমরা
যারা মহাপ্লাবনের পরে উপরে উঠে আসবে,
যার গভীরে একদিন আমরা তলিয়ে গেছি,
তোমরা যখন আমাদের ব্যর্থতার কথা বলবে
তখন এই অন্ধকার সময়ের কথা
বলতে ভুলো না, যার গ্রাস থেকে
নিজেদের সেদিন বাঁচাতে পেরেছিলে।

সেজার ভায়েহো-এর কবিতা: জনতা

জনতা

যখন যুদ্ধ থেমে গেছে এবং সে নিহত যুদ্ধভূমিতে
একজন তার কাছে গিয়ে বলল,
“যেও না তুমি, আমি ভালবাসি তোমাকেই”।
কিন্তু সেই মৃতদেহ
মৃত্যুর দিকে গড়িয়ে চলল। বিষণ্ণ সে দৃশ্য।

তখন দু’জন এল তার পাশে, কানের কাছে
মুখ নিয়ে বলল— “ছেড়ে যেও না আমাদের,
সাহস করে ফিরে চলো আবার”।
কিন্তু সেই মৃতদেহ
মৃত্যুর দিকে গড়িয়ে চলল। বিষণ্ণ সে দৃশ্য।

তারপর জনা কুড়ি, এবং তাদের পিছু
আরো একশো, হাজারো লোকের ভীড়
চিৎকার করে বলল,
“এতজনের ভালবাসা, তবু মৃত্যুই জয়ী হবে?”
কিন্তু সেই মৃতদেহ
মৃত্যুর দিকে গড়িয়ে চলল। বিষণ্ণ সে দৃশ্য।

লক্ষ জনতা জড়ো হয়েছিল সেদিন
তার চারদিকে বাজছিল একটি কথাই—
“থেকে যাও ভাই, যেও না”।
মৃতদেহ তা শুনতে পায় নি।
সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছিল।

তখন পৃথিবীর সকল মানুষ
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল,
সবাই মিলে ঘিরে ধরল তাকে।
মৃতদেহ বিষণ্ণ চোখে দেখল ওদের,
বুকের মধ্যে প্রচন্ড নাড়া খেল সে।
একসময় আস্তে উঠে বসল,
তারপর প্রথম যে-মানুষটি তাকে ডেকেছিল,
তার কাঁধে ভর দিয়ে
হাঁটতে লাগল…

ডব্লিউ, এস, মেরুইন-এর কবিতা: রাতের ব্লু-বেরী

রাতের ব্লু-বেরী

তাহলে এভাবেই রাত্রি শুষে নেয়
একের পর এক,
কিছু আগেও নয়, কিছু পরেও নয়

আমার মা বলতেন
অন্ধকারে আমি কখনো ভয় পাইনি
জন্মাবার পর যখন
প্রথম চোখ মেলেছি তখন থেকেই

কিকরে তিনি জানতেন
অত আগেই সেকথা
যেখানে তার বাবা মারা গেছেন
মনে রাখার মত বয়সের আগেই
যার কিছুদিন পরে
তার মা মারা গেলেন
এর কিছুদিন বাদে—তার দিদিমা
যার কোলে-পিঠে তিনি মানুষ
এর পরপরই
একমাত্র ভাই ছেড়ে গিয়েছিল তাকে
এবং প্রায় সমসাময়িক ঘটনা
তার প্রথম সন্তান—
সে-ও কিছুদিন বেঁচে ছিল কি ছিল না

আন্তনিও মাচাদোর কবিতা: কে বলবে

কে বলবে
আসুন,সবাই মিলে গান ধরি। জানা-বোঝা? বাদ দিন, কিছুই আসলে জানা হয়নি আমাদের।
এক গোপন সমুদ্র থেকে আমাদের আসা, অন্য কোন অজানা সমুদ্রে ভেসে যাব।
এই দ্বৈত রহস্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রবল ধাঁধা
আমরা এখনো সেই হিরন্ময় সিন্দুকের চাবি খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আলোয় আর কোন কিছু উদ্ভাসিত হয় না, সন্তেরাও আলখোল্লার বাইরে কিছু শিখিয়ে যাননি।
শব্দ এখানে কি আর বলবে? পাথরের ফাঁক দিয়ে গড়ানো জলের ধারা—সে-ই বা কি আর বলবে?

এলেন গিন্সবার্গের কবিতা: লালন অনুসরণে

লালন অনুসরণে

এভাবেই আমি পৃথিবীর পথে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম
সেই-যে তারুণ্যবেলায় উইলিয়াম ব্লেক
আমাকে উস্কে দিলেন, তারপর কত মহামুনির নিষেধঃ
‘ওরে জড়াস নে বিষয়ের আশে,
বরং তৈরী হ মৃত্যুর জন্যে’
সেই যুবা বয়স থেকেই শুনছি এসব
আর এখন তো নিজেই আমি পৌঢ় নাগরিক এক,
বাঁধা পড়ে আছি লক্ষাধিক বইয়ের ভেতরে,
লক্ষাধিক চিন্তার জালে, লক্ষাধিক মুদ্রার স্তূপে,
লক্ষাধিক বাসনায়, তাহলে কবে
এ দেহের মায়া ছেড়ে যাওয়া হবে আমার?
এলেন গিন্সবার্গ বলে, আকন্ঠ ডুবে আছি আমি ক্লেদে।


প্রেমিকের পায়ের কাছে বসেছিলাম, সে বললে,
‘চুলোয় যাক এসব, শুধু নিজেকে সামলে চলো,
পা ফেলো দেখে-শুনে, নিয়মিত যোগে-ধ্যানে, আর
মেজাজটাকে বশে রাখো’
আমি এখন প্রায় বৃদ্ধ
আর বছর কুড়ি বাঁচবো কিনা জানিনা, হয়ত আর
কুড়ি হপ্তাও বাঁচবো না, পর মুহূর্তেই হয়ত
ডাক পড়বে আমার, হয়ত এরই মধ্যে
আমার পুনর্জন্ম ঘটে গেছে কীট-পতঙ্গের মধ্যে কে জানে
এলেন গিন্সবার্গ বলে, কীকরে জানব আমি
যা কিছু চলছে সব দেখছি কিনা স্বপ্নের ঘোরে–


এখন রাত বাজে দুটো। খুব ভোরে উঠে ছুটতে হবে
ট্যাক্সিতে মাইল কুড়ি–প্রতি দিনের মত নিজের খ্যাতির পেছনে।
শিল্প-কলা যোগ-ধ্যান করতে করতে এই ধান্দায় জানিনা
কীকরে জড়িয়ে পড়লাম।
কতিপয় মোহন শব্দের জন্য
আমি নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছি
শরীরকে ব্যবহার করেছি
নিজের নির্যাস ছড়ানোর জন্যে
আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে বিবশ কামনায়
হয়ত উচ্ছ্বাস ছিল আমার প্রাণেও
কিন্তু শেষ কবে প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়েছি
তা মনে পড়েনা
আমার সমস্ত উক্তি কেবলি নিজেকে জাহিরের উছিলা
আমার বাসনাগুলো কবেই লুপ্ত
যদি মোক্ষই সত্যি করে চেয়ে ছিলাম
তাহলে লোলচর্ম এই দেহের ভেতরে
আমি কীকরে আটকে পড়লাম?
শুধু কয়েকটা শব্দের টানে,ভালবাসার মোহে,
আকন্ঠ বড়াই আর বাসনায় ডুবে
একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে?
এলেন গিন্সবার্গ বলে, কী যে বেড়াজালে আমি গেছি জড়িয়ে।


রাতে আমার ঘুম আসেনা, অন্ধকারে জেগে থেকে
আমি ঘনায়মান মৃত্যুর কথা ভাবি–
যখন দশ বছরের ছিলাম মহাবিশ্ব কত বড়
তা নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না
সেসময়ের তুলনায়
মৃত্যু এখন অনেকই কাছে চলে এসেছে–
যদি এবারে একটু না জিরোই
মৃত্যু আরো দ্রুত চলে আসবে
আর যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে
পরিত্রাণের পথ বন্ধ হবে আমার–
ঘুমন্ত বা জাগ্রত, এলেন
গিন্সবার্গ পড়ে থাকে বিছানায় এই মধ্য রাতে।


ভোর চারটা
তারপর ওরা আমার জন্যে এল
আমি বাথরুমের মধ্যে নিজেকে লুকালাম
ওরা বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ফেলল
সেটা গিয়ে পড়ল একটা নিরীহ ছেলের ওপর
কাঠের দরজাটা নিরীহ ছেলেটার ওপর পড়ে
যেন কঁকিয়ে উঠল
কোনভাবে আমার ছায়াটাকে লুকিয়ে রেখে
কোমডের মধ্যে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনলাম
ওরা ঘরের অন্য কোন থেকে আমার বদলে
টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে—
এভাবে আর কতদিন আমি ধোঁকা দিয়ে পারব?
অচিরেই ওরা দেখবে আমি ধরা পড়িনি
ওরা আবার ফিরে আসবে আমার জন্যে, তখন
এ দেহ আমি আবার কোথায় লুকাব?
আমি কি ‘আমিই’, নাকি ‘অন্য কেউ’, অথবা
আসলে আদৌ ‘কেউ’ নই?
তাহলে এই ভারী শরীর, এই দুর্বল হৃৎপিন্ড,
এই চুঁইয়ে পড়া কিডনি—এরা কারা?
পয়ষট্টি বছর ধরে এ কোন কয়েদি
জেল খেটে চলেছে
এই লাশের ভেতরে?
আমি ছাড়া আর কে এত
বুঁদ হয়ে আছে নেশায়?
অচিরেই এই খেলার সমাপ্তি, তাতেই বা
কার কি এলো গেলো, বলো?
সত্যই কি আসবে সে মাহেন্দ্র ক্ষণ? সত্যি কি হবে
তবে সেই ভবিষ্যৎ বাণী?


আমারও সুযোগ এসেছিল, কিন্তু সেটা আমি হারিয়েছি,
একবার দুবার নয়, এরকম সুযোগ পেয়েছি অনেকবার
কিন্তু সেসব গুরুত্বের সাথে নেইনি।
বলতে গেলে আমিও অভিভূত হয়েছিলাম, এমনকি প্রায় পাগল
হতে চলেছিলাম ভয়ে, পাছে
অমরত্বের বিরল সুযোগটা হারাই, তারপরও হারিয়েছি দেখো।
এলেন গিন্সবার্গ তোমাদের সাবধান করছে
আমাকে অনুসরণ করে
ধ্বংসের পথে এগিও না।

হান্স এঞ্জেন্সবার্গারের কবিতা: দোহা গান

দোহা গান
কথা বলা খুব সোজা
কিন্তু কথা তো আর খাওয়া যায় না
তাহলে রুটিই সেঁকো
রুটি সেঁকাও শক্ত
তাহলে হও রুটিওয়ালা

কিন্তু শুধু রুটি বানিয়ে রুজি হয় না
তাহলে ঘর-বাড়ী বানাও
বাড়ী করাও সহজ নয়
তাহলে হও ঢালাই-মিস্ত্রি

কিন্তু পাহাড়ে ঘর তোলাও কঠিন
তাহলে পাহাড়কেই সরাও
পাহাড় সরানোও সাধ্যের বাইরে
তাহলে হও পয়গম্বর

কিন্তু চিন্তাকে শোনা যায় না
তাহলে ভাষণ দিয়ে বেড়াও
ভাষণ দেয়াও মুখের কথা নয়
তাহলে হও—যা তুমি তা-ই

নিজের মধ্যে অনবরত বিড়বিড় করতে থাকো
এক অকর্মার ধাড়ি

হান্স এঞ্জেন্সবার্গারের কবিতা: মধ্যবিত্তের গান

মধ্যবিত্তের গান

আমাদের কোন অভিযোগ নাই
আমাদের চাকুরী স্থায়ী
আমরা কেউ অনাহারে নাই
আমরা দিব্বি আছি

ঘাস বাড়ছে
বাড়ছে জিডিপি
বাড়ছে নোখ
বাড়ছে অতীত

সব রাস্তা ফাঁকা
সব চুক্তি সারা
সব সাইরেন বন্ধ
সবকিছু ঝিমাচ্ছে

আমরা ঘাস চিবাচ্ছি
আমরা জিডিপি চিবাচ্ছি
আমরা নোখ চিবাচ্ছি
আমরা অতীত চিবাচ্ছি

আমাদের লুকানোর কিছু নাই
আমাদের হারানোর কিছু নাই
আমাদের বলার কিছু নাই
আমাদের সব আছে

ঘড়ি সারানো হয়েছে
বিল পরিশোধ হয়েছে
কাপড় রোদে শুকাচ্ছে
শেষ বাসটা চলে যাচ্ছে

বাসটা ফাঁকা

আমাদের কোন অভিযোগ নাই
আমরা কিসের জন্য তাহলে বসে আছি?

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: হাইকু

হাইকু

অন্তহীন রাত্রি
আজ একটি ঘ্রাণের চেয়ে
বেশি কিছু নয়


ঠিক ভোর হওয়ার আগে ভুলে যাওয়া
স্বপ্নই কি ছিল সেটি,
নাকি আদতে তা কিছুই ছিল না?


লোকটা মারা গেছে
তার মুখমন্ডলের দাঁড়ি সে কথা জানে না
তার নোখ তখনো বেড়ে চলেছে


চাঁদের আলোয়
যে-ছায়া ক্রমেই বড় হয়
সে একটাই ছায়া


পুরোনো হাত এখনো
কবিতার লাইন সাজিয়ে চলেছে
বিস্মৃতির দিকে

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রা মানে কি?

প্রশ্নটাই যে অবান্তর। এর উত্তর আমার ভাল ভাবেই জানা।

এর মানে স্তব্ধতায় প্রহর গোনা, আর কখন সশব্দে বেজে উঠবে এলার্ম এই ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, এর মানে স্বাভাবিক শ্বাস ফেলার নিস্ফল ম্যাজিক, এর মানে শরীরের ভার এপাশ ওপাশ করে সইয়ে নেবার, এর মানে জোর করে চোখের পাতা বন্ধ করে রাখা, এ কোন তীক্ষ্ণ চেতনা নয়–জ্বরেরই মগ্ন অবস্থা যেন, এর মানে বহু দিন আগে পড়া কোন বিচ্ছিন্ন স্তবক বিড়বিড় করে আওড়ানো ফের, এর মানে যখন অন্যেরা ঘুমন্ত তখন একা একা জেগে থাকার অপরাধবোধ, ঘোরের ভেতরে অবচেতনে ডুবে যেতে চাওয়া, তবু অবচেতনে ডুবে যেতে না পারা, এর মানে বেঁচে থাকার ত্রাস, ত্রাসের মধ্যে বেঁচে থাকা, এর মানে আরো একটি ধন্দলাগা দিনের শুরু।

জীবনী-শক্তি মানে কি?

এর মানে এক মানব দেহে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা আতংক, যে-দেহের ক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে,এর মানে দশকের পর দশক ধরে অনিদ্রার মধ্যে বাস, কোন সময়ের এককেই যাকে মাপা যায় না,এর মানে নিজের ভেতরে বয়ে বেড়ানো অনেক সমুদ্র আর পিরামিডের ভার,অনেক দুর্লভ গ্রন্থরাজি, প্রাচীন বংশের ধারা, হজরত আদম যেসব ভোর দেখেছিলেন তার স্মৃতি, এর মানে এক জায়গাতে আটকে থাকার অনুভূতি, যেরকম আমি বাঁধা পড়ে আছি আজ এই দেহের সাথে, আমার কন্ঠস্বরের সাথে, যার আওয়াজ আমি শুনতে চাই না সেই স্বীয় নামের সাথে, প্রতিদিনের অসংখ্য খুচরো বিবরণ, যার উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যে-ল্যাটিন আমি জানি না অথচ যার জন্যে আমি তৃষ্ণার্ত, এসব কিছুর সাথে,এর মানে হচ্ছে নিজেকে কেবলই মৃত্যুর ভেতরে ডোবানোর চেষ্টা, তবু মৃত্যুর মধ্যে ডুবতে না পারা, এর মানে হচ্ছে বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকতে হবে এই বোধে আবারও চলতে শুরু করা।