হান্স এঞ্জেন্সবার্গারের কবিতা: মধ্যবিত্তের গান

মধ্যবিত্তের গান

আমাদের কোন অভিযোগ নাই
আমাদের চাকুরী স্থায়ী
আমরা কেউ অনাহারে নাই
আমরা দিব্বি আছি

ঘাস বাড়ছে
বাড়ছে জিডিপি
বাড়ছে নোখ
বাড়ছে অতীত

সব রাস্তা ফাঁকা
সব চুক্তি সারা
সব সাইরেন বন্ধ
সবকিছু ঝিমাচ্ছে

আমরা ঘাস চিবাচ্ছি
আমরা জিডিপি চিবাচ্ছি
আমরা নোখ চিবাচ্ছি
আমরা অতীত চিবাচ্ছি

আমাদের লুকানোর কিছু নাই
আমাদের হারানোর কিছু নাই
আমাদের বলার কিছু নাই
আমাদের সব আছে

ঘড়ি সারানো হয়েছে
বিল পরিশোধ হয়েছে
কাপড় রোদে শুকাচ্ছে
শেষ বাসটা চলে যাচ্ছে

বাসটা ফাঁকা

আমাদের কোন অভিযোগ নাই
আমরা কিসের জন্য তাহলে বসে আছি?

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: হাইকু

হাইকু

অন্তহীন রাত্রি
আজ একটি ঘ্রাণের চেয়ে
বেশি কিছু নয়


ঠিক ভোর হওয়ার আগে ভুলে যাওয়া
স্বপ্নই কি ছিল সেটি,
নাকি আদতে তা কিছুই ছিল না?


লোকটা মারা গেছে
তার মুখমন্ডলের দাঁড়ি সে কথা জানে না
তার নোখ তখনো বেড়ে চলেছে


চাঁদের আলোয়
যে-ছায়া ক্রমেই বড় হয়
সে একটাই ছায়া


পুরোনো হাত এখনো
কবিতার লাইন সাজিয়ে চলেছে
বিস্মৃতির দিকে

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রা মানে কি?

প্রশ্নটাই যে অবান্তর। এর উত্তর আমার ভাল ভাবেই জানা।

এর মানে স্তব্ধতায় প্রহর গোনা, আর কখন সশব্দে বেজে উঠবে এলার্ম এই ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, এর মানে স্বাভাবিক শ্বাস ফেলার নিস্ফল ম্যাজিক, এর মানে শরীরের ভার এপাশ ওপাশ করে সইয়ে নেবার, এর মানে জোর করে চোখের পাতা বন্ধ করে রাখা, এ কোন তীক্ষ্ণ চেতনা নয়–জ্বরেরই মগ্ন অবস্থা যেন, এর মানে বহু দিন আগে পড়া কোন বিচ্ছিন্ন স্তবক বিড়বিড় করে আওড়ানো ফের, এর মানে যখন অন্যেরা ঘুমন্ত তখন একা একা জেগে থাকার অপরাধবোধ, ঘোরের ভেতরে অবচেতনে ডুবে যেতে চাওয়া, তবু অবচেতনে ডুবে যেতে না পারা, এর মানে বেঁচে থাকার ত্রাস, ত্রাসের মধ্যে বেঁচে থাকা, এর মানে আরো একটি ধন্দলাগা দিনের শুরু।

জীবনী-শক্তি মানে কি?

এর মানে এক মানব দেহে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা আতংক, যে-দেহের ক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে,এর মানে দশকের পর দশক ধরে অনিদ্রার মধ্যে বাস, কোন সময়ের এককেই যাকে মাপা যায় না,এর মানে নিজের ভেতরে বয়ে বেড়ানো অনেক সমুদ্র আর পিরামিডের ভার,অনেক দুর্লভ গ্রন্থরাজি, প্রাচীন বংশের ধারা, হজরত আদম যেসব ভোর দেখেছিলেন তার স্মৃতি, এর মানে এক জায়গাতে আটকে থাকার অনুভূতি, যেরকম আমি বাঁধা পড়ে আছি আজ এই দেহের সাথে, আমার কন্ঠস্বরের সাথে, যার আওয়াজ আমি শুনতে চাই না সেই স্বীয় নামের সাথে, প্রতিদিনের অসংখ্য খুচরো বিবরণ, যার উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যে-ল্যাটিন আমি জানি না অথচ যার জন্যে আমি তৃষ্ণার্ত, এসব কিছুর সাথে,এর মানে হচ্ছে নিজেকে কেবলই মৃত্যুর ভেতরে ডোবানোর চেষ্টা, তবু মৃত্যুর মধ্যে ডুবতে না পারা, এর মানে হচ্ছে বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকতে হবে এই বোধে আবারও চলতে শুরু করা।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আত্মহত্যা

আত্মহত্যা
একটা নক্ষত্রও, আজ এই রাতে অবশিষ্ট থাকবে না।
থাকবে না রাত্রিরও কোন অবশেষ।
আমার মৃত্যুর সাথে
এই বিশ্বের অসহ্য বোঝা নেমে যাবে।
আমি সরিয়ে ফেলব সব পিরামিড, সব পদকগুলো,
সব কটি মহাদেশ, সব মুখচ্ছবি।
আমি মুছে ফেলব তিল তিল করে জমানো অতীত।
আমি ইতিহাসকে করব ছাই, ছাইকে—আরো ধূসর কিছু।
এই মুহূর্তে আমি শেষ সূর্যাস্তকে দেখছি।
এই মুহূর্তে আমি শুনছি শেষ পাখীর গান।
কেউ আমার এই শূণ্যতার উত্তরাধিকারী নয়।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: চতুস্পদী

চতুস্পদী
অন্যদেরও মৃত্যু এই সময়ে, কিন্তু সেসব দূর অতীতের গল্প।
এই সমাগত ঋতু–সবাই জানে–মৃত্যুর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
ইয়াকুব আল -মনসুরের নিতান্ত প্রজা আমি,
তবে কি আমারও মৃত্যু হবে গোলাপের মত, আর আরিস্ততল?

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আদম তোমারই দেহের ছাই

আদম তোমারই দেহের ছাই
তরবারি সেভাবেই খসে পড়বে, যেভাবে বৃক্ষ থেকে ফল।
কৃষ্টালও ততটা নাজুক, যতটাই গ্রানাইট পাথর।
সব কিছুই ছাই হয় তার নিজস্ব নিয়মে।
লোহাতে যেমন লুকানো তার মর্চে-ধরা স্বভাব। ধ্বনিতে যেমন প্রতিধ্বনি।
আদি পিতা আদম –সে তোমারই দেহের ছাই।
প্রথম স্বর্গোদ্যানই হবে শেষ স্বর্গোদ্যান।
নাইটিংগেল পাখী ও গ্রীক কবি পিন্ডার দুজনই অভিন্ন কলরব।
সূর্যোদয় সূর্যাস্তরই প্রতিচ্ছবি।
মাইসেনিয়ান সম্রাট—কবরে শায়িত এক স্বর্ণালী মুখোশ মাত্র।
সবচেয়ে উঁচু দেয়ালও সবচেয়ে জরাজীর্ণ ভগ্নস্তূপ।
রাজা উরকুইজা, আততায়ীর ছোরা যাকে ছুঁতে পারেনি, তারও পরিণতি এমন।
আয়নায় যে মুখ আজকে নিজেকে দেখেছে
সে গতকালের মুখ নয়। রাত্রি তাকে বদলে ফেলেছে রাতারাতি।
কাল এভাবেই সূক্ষ্ম, অনবরত, ভাংচুর করছে আমাদের।

হিরাক্লিটাসের সেই প্রবাদের অবিরল বয়ে যাওয়া
জল যদি হতে পারতাম আমি,
যদি হতে পারতাম সেই আদি ও অকৃত্রিম অগ্নি,
কিন্তু আজ এই দীর্ঘ অফুরান দিনের শেষে
নিজেকে আমার একা লাগছে এবং মনে হচ্ছে,
আমি কখনোই আর পরিত্রাণ পাব না।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: সীমানাগুলো

সীমানাগুলো
ভার্লেনের একটি লাইন আর কখনোই মনে পড়বে না আমার।
কাছের একটি রাস্তা যেখানে আমার যাওয়া হবে না কোনদিন।
একটি আয়না শেষবারের মত দেখে নিল আমাকে।
একটি দরজা পৃথিবীর শেষ দিন অব্দি বন্ধ হয়ে গেল।
আমার লাইব্রেরীর অনেকগুলো বই (মিলিয়ে দেখছি এখন)
আর কখনোই খোলা হবে না।
এই গ্রীষ্মে আমার বয়স হবে পঞ্চাশ।
মৃত্যু আমাকে ব্যবহার করে চলেছে ক্রমাগত।

নাজিম হিকমতের কবিতা: রোমিও ও জুলিয়েট বিষয়ে

রোমিও ও জুলিয়েট বিষয়ে
রোমিও বা জুলিয়েট হওয়া কোন অপরাধ নয়;
ভালবাসার জন্যে মৃত্যুবরণ করাও কোন অপরাধ নয়।
যেটা দেখার, সেটা হচ্ছে—তুমি নিজে রোমিও বা জুলিয়েট
হতে পারবে কিনা,
আমি বলতে চাইছি, এসবই তোমার হৃদয়ের বিষয়-আশয়।।

যেমন, ব্যারিকেডের ভেতরে যুদ্ধ করা,
বা উত্তর মেরু অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়া,
বা ধমনীতে কোন ঔষধের
পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সম্মতি দেয়া—
এসব করতে গিয়ে মৃত্যু হয় যদি
তা কি কোন অপরাধ হবে?

রোমিও বা জুলিয়েট হওয়া কোন অপরাধ নয়;
ভালবাসার জন্যে মৃত্যুবরণ করাও কোন অপরাধ নয়।

ধরো, তুমি পৃথিবীর প্রেমে পুরোপুরি বিবশ,
কিন্তু সে তো জানেও না—তুমি বেঁচে আছো কিনা।
তুমি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে চাইছ না,
কিন্তু সে নিশ্চিত তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে—
আমি বলতে চাইছি, তুমি আপেল ভালবাসো,
তার মানে কি এই যে আপেলও তোমাকে ভালবাসবে?
আমি বলতে চাইছি, জুলিয়েট যদি রোমিওকে আর ভালবাসতে না চায়
—অথবা জুলিয়েট কখনোই যদি রোমিওকে ভাল না বাসত—
তাতেও কি সে কোন অংশে কম রোমিও হত?

রোমিও বা জুলিয়েট হওয়া কোন অপরাধ নয়;
ভালবাসার জন্যে মৃত্যুবরণ করাও কোন অপরাধ নয়।

নাজিম হিকমতের কবিতা: তোমাদের হাত আর মিথ্যে রটনাগুলো নিয়ে

তোমাদের হাত আর মিথ্যে রটনাগুলো নিয়ে
তোমাদের হাত থমথমে, যেমন হয়ে থাকে পাথরেরা;
বিষণ্ণ, যেমন জেলের ভেতরের সব গান;
জড়োসড়ো নিজের ভারে, যেমন সব ভারবাহী জীব;
তোমাদের হাত ফুলে আছে অনাহারে থাকা শিশুর চেহারার মত ।
তোমাদের হাত ছন্দময়, যেন অনায়াসে উড়ে চলা মৌমাছি;
পরিপূর্ণ, যেমন দুধে উপচে ভরা স্তন;
সাহসী, প্রকৃতির মত;
তোমাদের হাত রুক্ষ চামড়ার নিচে লুকিয়ে রাখে
তার কোমল স্পর্শ।

এই পৃথিবী কোন ষাড়ের শিঙ্গের মধ্যে নয়—
তোমাদের হাতের মধ্যেই তার ভর রেখে চলেছে।
ভাই, ও ভাই আমার,
তারা তোমাদের কাছে মিথ্যে রটাচ্ছে।
অথচ তোমরা অনাহারে আছো,
বাঁচার জন্যে পর্যাপ্ত রুটি-মাংসের প্রয়োজন যেখানে
সেখানে সাদা চাদর বিছানো টেবিলে বসে
অন্তত একবেলা ভালো করে খাওয়ার আগেই তোমরা বিদায় নিচ্ছ
এই পৃথিবী থেকে—যার প্রতিটা শাখা ফলের ভারে ঝুঁকে আছে।
ও ভাই আমার,
এশিয়া, আফ্রিকা, নিকট ও মধ্য প্রাচ্য, প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ
বা আমার দেশ
যেখানেই থাকো (তোমরাই গোটা বিশ্বের শতকরা সত্তর ভাগ),
তোমাদের হাতের মতই বুড়িয়ে গেছো তোমরা, আর সেরকমই ভুলো-মনা;
তোমাদের হাতের মতই তোমরা সজাগ, অবাক-করা, তারুণ্যে দীপ্ত ।
ও ভাই আমার,
আমার ইউরোপের ও আমেরিকার ভায়েরা,
তোমরাও চৌকশ, সাহসী, আর মনভোলা, তোমাদের হাতের মত—
তোমাদের হাতের মতই তোমাদের সহজে বশ করা যায়,
সহজেই ভোলানো যায়…

ভাই, ও ভাই আমার,
যদি চ্যানেল গুলো মিথ্যে বলে,
যদি সংবাদপত্র গুলো মিথ্যে বলে,
যদি বই গুলো মিথ্যে বলে,
যদি দেয়ালের পোস্টার আর পত্রিকার বিজ্ঞাপন গুলো মিথ্যে বলে,
যদি রূপালী চিত্রে নারীদের উরু গুলো মিথ্যে বলে,
যদি প্রার্থনা গুলো,
ঘুমপাড়ানি ছড়া গুলো,
স্বপ্ন গুলো মিথ্যে বলে,
যদি জিপসি যাদুকরেরা মিথ্যে বলে,
যদি নিরাশাকরোজ্জ্বল দিনের রাত গুলোর জ্যোছনারা মিথ্যে বলে
যদি গলার স্বর গুলো,
যদি অক্ষর গুলো মিথ্যে বলে,
যদি সবাই এবং সবকিছু মিথ্যে বলে,
তাহলে জানবে, তারা আসলে চাচ্ছে
তোমাদের হাত গুলো যেন কাদার মত সুবাধ্য থাকে,
যেন অন্ধকারের মত অন্ধ থাকে,
যেন মূক-বধির হয়ে থাকে ভেড়া বা কুকুরের মত—
যাতে তোমাদের হাত গুলো কখনো বিদ্রোহ না করে বসে।
যেন কোনদিনই এই নশ্বর, এই বাসযোগ্য পৃথিবী থেকে
(যেখানে আমরা ক্ষণকালের অতিথি)
এই বনিক সাম্রাজ্য, এই নিষ্ঠুরতা, মুছে না যায়।

ইস্তাম্বুল সিম্ফোনি: নাজিম হিকমতের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ :বিনায়ক সেন
“তুমি বলেছিলে :’যদি ওরা তোমাকে মেরে ফেলে আমি বাঁচব না!’ কিন্তু তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা আমার, বাতাসে কালো ধোঁয়ার মতো মুছে যাবে আমার স্মৃতিগুলো। [কেননা] বিংশ শতকে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।” এই লাইন ক’টি যার লেখা তিনিই তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত।

বেট্রল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, জর্জি আমাদু, পাবলো পিকাসো, ইলিয়া এরেনবুর্গ, পল রোবসন, ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর প্রিয় কবির সারিতে ছিল নাজিম হিকমতের নাম। নাজিমের একটি কবিতা এভাবে আশা প্রকাশ করেছে :’আমি মরতে চাই না, কিন্তু যদি মৃত্যু আসে, তবু আমি বেঁচে থাকব তোমাদের মাঝে, আমি বেঁচে থাকব আরাগঁর কবিতায়, তার ঠিক সেই লাইনটিতে যেখানে সে আসন্ন সুখের দিনগুলোর কথা লিখেছে। আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আর রোবসনের গানে’। ১৯৫০ সালে নেরুদা এই বলে তাকে সম্মানিত করেছিলেন :’নাজিমের কবিতায় সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে’।

চিরটা কাল বামপন্থার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু ভিন্ন ধরনের বামপন্থি ছিলেন তিনি। স্তালিনকে ঘিরে ব্যক্তি-পূজার নিন্দা করেছিলেন স্তালিনের জীবদ্দশাতেই খোদ মস্কোতে বসেই। স্তালিনের গোয়েন্দা দফতরের প্রধান বেরিয়ার গুপ্তচরেরা তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকত_ এ কথা ইয়েভতুশেঙ্কো জানিয়েছেন ‘রোমান্টিক কম্যুনিস্ট’ বইয়ের ভূমিকায়। পূর্ব-পশ্চিম সব মহাদেশ থেকে কবিতার উপকরণ আহরণ করেছেন তিনি। তার প্রিয় তিনজন কবি ছিলেন তিন ভিন্ন ভুবনের। তুরস্কের সূফী-সন্ত জালালুদ্দিন রুমি, ফরাসি আধুনিকতার শার্ল বোদলেয়ার, আর রুশ বিপ্লবের ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। যদিও নাজিম বলবেন, এরা আসলে এক ভূগোলেরই অধিবাসী_ তিনজনই তাদের কালের মানবচিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘মানবের মানচিত্র’ নামে পরবর্তীতে নাজিম নিজেই লিখেন একটি মহাকাব্য যা এখনও বাংলায় অনূদিত হতে বাকি।

বামপন্থার আদর্শের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে নাজিমকে তুরস্কের সরকার বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৫৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। পুরো মেয়াদ অবশ্য কারাবাসে থাকতে হয়নি কবিকে। প্রকৃতপক্ষে ১৭ বছর জেলে ছিলেন তিনি। এর আবার ১৩ বছর ছিল বিরতিহীন_ ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫১ সাল অব্দি। জেল পর্ব ছিল তার লেখার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্ব। ১৯৩৮ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সামরিক একাডেমীর ক্যাডেটদের উস্কে দিয়েছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সেসব ক্যাডেট নাকি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল! জ্যাঁ পল সার্ত্রে, পাবলো পিকাসো, ত্রিস্তান জারা তার মুক্তির জন্য বিশ্ব-জনমত গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জনমতের চাপে ছাড়া পেলেন ঠিকই, কিন্তু দেশে থাকতে পারলেন না বাদবাকি জীবন। ১৯৫১ সালেই তাকে যেতে হলো নির্বাসনে। সেই কারণটা জানা গেল ২০০৬ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তুরস্কের ওরহান পামুকের সুবাদে।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে পামুক শুধু একদিনের জন্য ইস্তাম্বুলের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের সম্পাদক হলেন। জার্নালিজমের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু এর আগে কখনও সরাসরি সাংবাদিকতায় আসেননি। সম্পাদক হয়ে রোববারের প্রথম পাতাজুড়ে প্রকাশ করলেন একজনের ছবি। ছবির নিচে লেখা_ ‘থুথু ফেলো এতে’। ছবিটা কবি নাজিম হিকমতের। ১৯৫১ সালে তুরস্কের সরকারি কাগজগুলো এভাবেই নাজিমের ছবি ছাপিয়ে জনগণকে উস্কানি দিয়েছিল ছবিটাকে ঘৃণা করতে। দৃশ্যত নাজিমের অপরাধ ছিল দুটি। প্রথম অপরাধ, ১৯১৫ সালে আরমেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য [যার দায় তুরস্কের সরকার এখনও স্বীকার করেনি] তিনি জনগণের হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় অপরাধ, কুর্দিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। পামুক তার সম্পাদকীয়তে আরও লিখলেন, ‘সেই ১৯৫১ সাল থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিকের সম্পর্কটা [নাজিমের বিরুদ্ধে ৫০ বছর আগে যেমন ছিল] তেমনই রয়ে গেছে।’

নাজিমের কবিতায় রাষ্ট্রের কাছে ঘা-খাওয়া এক শান্ত, গর্বিত এবং লড়াকু মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার কথা পাওয়া যায়। কিন্তু তার কবিতার প্রধান সুর বিষণ্ন। তিনি অপেক্ষা করে থাকেন সেই দিনের মুখ চেয়ে, যেখানে প্রতিটা মানুষ বেড়ে উঠবে ‘বৃক্ষের মতো একা স্বাধীন সত্তা নিয়ে, কিন্তু থাকবে অরণ্যের যৌথ চেতনায়।’ ১৯০২ সালে তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয় নাজিম হিকমতের জন্ম। যেখানে জন্ম সেখানে আর ফেরা হয়নি কোনদিন। বলতেনও_ ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না’। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন জেলে থাকতেই। কিন্তু বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন আরও অনেক বছর। তার জেল পর্বের একটি কবিতা বলেছিল :’আমরা ভেঙে পড়ব না, শত্রুদের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্যে হলেও অতিরিক্ত একটি দিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।’ ১৯৬৩ সালে মস্কোয় এক রোদেলা সকালে বেরিয়েছেন প্রতিদিনের মতো দৈনিক খবরের কাগজ আনতে। বাসার সামনেই চিঠিপত্র রাখার বাক্স। কাগজটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়লেন।

এর বছর দুই আগে, ১৯৬১ সালে নিজের এক সংক্ষিপ্ত জীবনী বলে গিয়েছিলেন তিনি কবিতার আকারে। কন্সতান্তিন সিমোনভ থেকে এডোয়ার্ড হির্শ_ সবাই বলবেন, এটিও নাজিমের বিস্ময়কর রচনাশৈলীর একটি উদাহরণ। পাবলো নেরুদার মতো নাজিম হিকমত কোনো বিশদ আত্মস্মৃতি রেখে যাননি তার ঘটনাবহুল জীবনের ওপর। অবশ্য অন্যরা পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে লিখবেন। যেমন বের হবে ঔপন্যাসিক ওরহান কেমালের ‘নাজিম হিকমতের সাথে জেলে’ বা তার পত্নী পিরাইয়ের সঙ্গে পত্রালাপ। তারপরও নাজিমের কবিতাই হবে তার সবচেয়ে অনুপ্রাণিত জীবনী, এবং একই সঙ্গে তার সময়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্মৃতিকথা।

এ রকম কিছু কবিতা এখানে [যার কয়েকটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি] রুশ ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে নতুনভাবে ভাষান্তর করা হলো বাংলায়।