‘২০০১ সালেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল’/‘ভারতের সঙ্গে আমাদের ৩টি কাঁটাতারের বাধা আছে’ -ড. বিনায়ক সেনের সাথে সাক্ষাত্কার

ড. বিনায়ক সেন। অর্থনীতিবিদ।  বিশ্বব্যাংকে সিনিয়র ইকোনোমিষ্ট হিসেবে যুক্ত র্ছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনডিপিসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩)। বাংলাদেশের প্রথম অন্তবর্তীকালীন দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (আইপিআরএসপি) করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিসি)-এ গবেষণা পরিচালক এর দায়িত্বে রয়েছেন।

উন্নয়ন গবেষণায় ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’, ‘জন ক্ষমতায়ন’, ‘নৈতিকতা ও উন্নয়ন’ ইত্যাদি বিষয় তাঁর আগ্রহ ও ভাবনার জায়গা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘প্রতিচিন্তা’-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন সাপ্তাহিক-এর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাহরাম খান

সাপ্তাহিক : পুরনো বছরের শেষে এবং নতুন বছরের শুরুতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি। কেউ বলছেন আমরা বড় ধরনের সমস্যায় আছি এবং সহসাই উত্তরণ ঘটবে না। আবার অনেকে বলছেন সমস্যা আছে তবে সঙ্কট নেই। আপনার দৃষ্টিতে দেশের অর্থনীতি কোন জায়গায় আছে বলে মনে করেন?

ড. বিনায়ক সেন : প্রশ্নটা যত ভালো বা সুন্দর এর উত্তরটা ততই কঠিন। আমি হতাশাবাদীদের দলে পড়ি না। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশাবাদের যে গল্প উঠেছে আমার মন তাতে পুরোপুরি সায় দেয় না। আমাদের অর্থনীতি নিয়ে চরম হতাশাবাদের যেমন কোনো কারণ নেই, তেমনি অযৌক্তিক আশাবাদেরও কোনো কারণ নেই। প্রথমত, এই সরকারের প্রথম তিন বছর মুদ্রা সম্প্রসারণ নীতি নিয়ে চলছিল। এর মূল লক্ষ্যটা ছিল যাতে প্রবৃদ্ধি আরো বেগবান করা যায়। প্রাইভেট সেক্টরে প্রতি বছর ২৪ থেকে ২৬ শতাংশ ঋণ প্রদান করা হয়েছে। যা হোক, ২০০৯-২০১১ পর্বে সম্প্রসারণশীল মুদ্রাস্ফীতির কারণে বর্তমানে সরকারের সঙ্গে আইএমএফ-এর দরকষাকষি চলছে। ২০০১-১১ পর্বে ব্রোড মানি (গ২)  সরবরাহ ছিল ২২-২৩ শতাংশ। এখন আইএমএফ বলছে এই মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধিকে ১০-১২ শতাংশে নামিয়ে আনতে। সেটা উচিত হবে না। সরকার তাই সঠিকভাবেই যুক্তি দেখিয়েছে যে প্রবৃদ্ধি যেহেতু ৬ শতাংশ বা তার উপরে, আর মূল্যস্ফীতি যেহেতু ১০ শতাংশ বা তার উপরে, সেহেতু মুদ্রা সরবরাহ ১৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা ঠিক হবে না। এতে করে প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধিও গতিশীল হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বেগবান করার ঝোঁকটা সরকারের শুরু থেকেই ছিল। বাংলাদেশের গত দুই দশকের দিকে  তাকালে দেখা যাবে আমরা একটা রুদ্ধ পথে চলেছি (টাইট-রোপ ওয়াকিং করেছি)। এর মধ্যেও আমরা অনেক অর্জন করেছি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল)সহ বেশ কিছু ইতিবাচক অর্জন হয়েছে। এসব অর্জনের সঙ্গে আরেকটি বিষয় হলো আমাদের সরকারের ব্যয়ের পরিধিটা তুলনামূলকভাবে ছিল সীমিত। তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে সরকারি ব্যয় যেখানে জিডিপির ২০ শতাংশ বা তার বেশি, সেখানে আমাদের দেশে বহু বছর ধরে সেটা ১৫-১৭ শতাংশের মধ্যে আছে। এর জন্য বড় কারণ হলো অবশ্য কর আদায় কম হওয়া। দ্বিতীয়ত, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় কখনোই এমন পর্যায়ে যায়নি যেটা দিয়ে ৯-১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। এবার রেমিট্যান্স, বৈদেশিক সাহায্য এবং রপ্তানি কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়েছে। ঠিক ২০০১ সালেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষে এসে। এরপর ক্ষমতায় আসা বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান একটা অভিযোগ করতেন যে শূন্য কোষাগার রেখে গেছে আওয়ামী লীগ। সেই সময়ে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক দাতারা ঢাকায় এসে কড়াশর্তে ঋণের ব্যাপারে আলোচনা করে। ২০০২ সালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ায় সেই সমস্যা থেকে অনেকটা উত্তরণ হয়েছিল। আজ দশ বছর পর এসেও বৈদেশিক সাহায্য, রেমিট্যান্স রপ্তানি এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়াতে আগের পরিস্থিতি আবার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই স্বল্পমেয়াদি মূল সমস্যাটি হচ্ছে, হঠাৎ করে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদটা কমে যাওয়া। এর ফলে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যের উপর চাপ পড়েছে। টাকা-ডলারের বিনিময় হারে প্রভাব পড়েছে।

তাই সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে ২০১১-১২ অর্থবছরটা একটু কঠিন বছর হিসেবেই বিবেচিত হবে। তবে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬-৭ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে। প্রয়োজনে প্রবৃদ্ধিকে কিছুটা খেসারত দিয়ে হলেও সামষ্টিক অর্থনীতিকে সন্তোষজনক জায়গায় আনতে হবে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতিটা কমাতে হবে। আমদানি কমিয়ে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। আমদানি কমালে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারপরও এই উদ্যোগগুলো নিতে হবে অনেকটা বাধ্য হয়েই।

সাপ্তাহিক : আওয়ামী লীগ ২০০১ এর মতো এবারও একই সমস্যায় দুর্বলতা দেখাল। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি বলেই কি এই অবস্থা?

বিনায়ক সেন : এটা শুধু আওয়ামী লীগের জন্য না। সব সরকারের আমলেই কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে আমরা বলে এসেছি। এক দশক আগে আমি এবং বর্তমান বিআইডিএসের মহাপরিচালক মুস্তফা মুজেরি ২০০৩ সালে সরকারের পক্ষ হয়ে আইপিআরএসপি করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম তেলের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের বাজারেও বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে আমাদেরও কমাতে হবে। কারণ তেলের ভর্তুকির সুবিধা শুধু গরিব মানুষ পায় না। এই সুবিধার বেশিরভাগ ধনী মানুষ পায়। তাছাড়া তেল আমাদের নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য না। এর থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে যদি আরো বেশি সুযোগ দেয়া হয় সেটা ভালো উদ্যোগ হবে। কারণ এর পুরোটার সুফল ভোগ করে গরিব মানুষেরা।

সাপ্তাহিক : আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাটা কি পর্যায়ে আছে?

বিনায়ক সেন : সাধারণভাবে বলতে গেলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা একটা প্রবল চাপের মধ্যে আছি। তবে এই চাপটা বৈশ্বিক অর্থনীতির ব্যতিক্রম ধারায় নয়। কারণ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে প্রতিবেশী দেশগুলোও এই সমস্যা মোকাবিলা করছে। আমাদের ওপর এই চাপটা যে আসবে তা বছরের শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। বিশেষ করে গত বছরের (২০১১) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী আমাদের বলেছিলেন, সামনের বছরটা আমাদের জন্য একটু চাপের হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের দিকে যেন একটু বেশি নজর দেয়া হয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় বাড়তি উদ্যোগ না নিলে সমস্যা হতে পারে। তাই হয়েছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা সমস্যায় রেমিট্যান্স প্রবাহের ছন্দপতন এই সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে আমরা মনে করেছিলাম। যদি তথ্যগত দিক বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে বিগত ছয় মাসে আমরা তেমন কোনো বৈদেশিক সাহায্য পাইনি। উপরন্তু নানান ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আমরা আরো বেশি দিয়ে দিয়েছি। আরেকটা বিষয় হলো ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার ব্যাপারটিকে অনেকেই বড় করে দেখাচ্ছেন। এটা মূলত জনতুষ্টিবাদী পপুলিস্ট মত প্রচার ছাড়া আর কিছু না। বর্তমান সমস্যার এটা কারণ নয়, সমস্যা মোকাবিলার একটি উপায় মাত্র। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে মার্শাল-লার্নার কন্ডিশনের কথা আমরা জানি। অবমূল্যায়নের মাধ্যমে আমদানি নিরুৎসাহিত হয়ে রপ্তানি উৎসাহিত হবে, যা চলতি বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করবে।

তাই আমি মনে করি, বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক ভাঙ্গাগড়া চলছে তার শুরু যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে। এখন চলছে ইউরোপে। ভবিষ্যতে এটা ব্যাপক আকারে হলে আমাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। তবে আমরা যেসব প্রোডাক্ট নিয়ে রপ্তানি বাজারে আছি সেগুলো খুব বেশি প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। হিসাব কষে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিতে হবে।

সাপ্তাহিক : অনেকে বলছেন এডিপি কাটছাঁট করতে হবে…

বিনায়ক সেন : এডিপি কাটছাঁট জনতুষ্টিবাদী পপুলিস্ট কথা হিসেবে বিবেচিত। আমাদের ১৬৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে মাত্র চারভাগের একভাগ এডিপি বরাদ্দে থাকে। এর মধ্যে দশ ভাগ বাস্তবায়ন হয় না। সেই জায়গায় কাটছাঁট করলে তো গরিবের ওপর চাপ পড়বে। যেমন ধরুন একটা কালভার্ট যদি কোনো গ্রামে তৈরি হয় তাহলে একজন নিজের হাতে টাকা না থাকলেও গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটা রিকশাভ্যান কিনবে। তার হাতে টাকা আসবে। নিজে চলবে, ঋণের কিস্তি দিবে আবার সঞ্চয়ও করবে। এই যে একটা প্রভাব, এটা কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই এডিপি খাতে হাত দেয়ার আগে চিন্তা করতে হবে। তবে কিছু মেগা প্রজেক্টের ক্ষেত্রে কাটছাঁটের চিন্তা করা যেতে পারে। সরকারের চলতি ব্যয়কে চরমভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যয়-সাশ্রয়মূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সরকার অপ্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ বন্ধ রাখতে পারে যেগুলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তাই আমি মনে করি গ্রামীণ অবকাঠামো কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে কোনো কাটছাঁট করা ঠিক হবে না। কারণ এগুলো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও সঞ্চয়ে অবদান রাখে।

ফিসক্যাল পলিসি এবং মনিটরিং পলিসির মধ্যে একটা সঙ্গতিহীনতা আছে এখনো। কারণ আমাদের দেশে সামষ্টিক অর্থনীতিতে সমন্বয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মেকানিজম কাজ করছে না। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার মতো আমাদের পরিকল্পনা কমিশনে কোনো দক্ষ অর্থনীতিবিদ ও প্রযুক্তিবিদ নেই। আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ে কোনো অর্থ উপদেষ্টা নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও কুশলী অর্থনীতিবিদ পরামর্শকদের দ্বারা যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়। অথচ এর সবই রয়েছে ভারতে ও পাকিস্তানে। এই কারণেই বলছি, অর্থনীতিতে নিবিড় তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই।

সরকারকে চিন্তা করতে হয় তার ঋণের বিষয়ে। এই ঋণ কিসের জন্য? যদি উৎপাদনমুখী খাতের জন্য হয় তাহলে অন্য কথা, যেমন বিদ্যুৎ খাতে। আর যদি অনুৎপাদনশীল খাতের জন্য ঋণ হয় তাহলে সমালোচনার অনেক জায়গা আছে। আবার বিদ্যুৎ নিয়ে যারা এখন উচ্চবাচ্য করছেন তারাই কিন্তু কয়েক বছর আগে এগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। প্রয়োজনের বাইরে কথা বললে তো হবে না।  কুইক রেন্টাল ব্যয়বহুল পদ্ধতি ঠিকই, কিন্তু কুইক রেন্টাল পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন করে যে বিদ্যুৎ এলো তার প্রবৃদ্ধি-অভিঘাতও বিবেচনায় নিতে হবে।

সাপ্তাহিক : ২০০৭ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনীতির যে মন্দাবস্থা শুরু হয়েছিল সেই সময়ে বাংলাদেশ ভালো করেছে। এবার আমরা চাপে পড়লাম কেন?

বিনায়ক সেন : গত দশকের শেষ দিকে যে বিশ্বমন্দা আমরা আমেরিকায় দেখেছি তা প্রথমে হাউজিং সেক্টরের সমস্যা নিয়ে শুরু হয়। এরপর আক্রান্ত হয় ঐ দেশের ব্যাংক সেক্টর, এরপর সেটি উৎপাদন খাতকে প্রভাবিত করা শুরু করে। শ্রমের বাজারের উপরও প্রভাব পড়তে থাকে ধীরে ধীরে। ফলে পুরো অর্থনীতিকে চাপে ফেলে। আর সেই সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির যে মন্দাবস্থা চলছিল তখন আমাদের দেশে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি যে কোনো কারণেই হোক বৈদেশিক সাহায্যের গতিটা ভালো ছিল। একই সঙ্গে রেমিট্যান্সের প্রবাহও সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বৈদেশিক সাহায্যও প্রতিকূলে যায়, একই সঙ্গে রেমিট্যান্সও কমতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে আরব-অসন্তোষকে কেন্দ্র করে।

আবার চলতি অর্থবছরের আগের বছরে আমাদের রপ্তানির বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ছিল ৪১ শতাংশ। যা ছিল অভাবনীয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এটা এখন কমছে, কমে এখন ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তখন তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে গিয়েছিল। এখন সেটা বাড়ছে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমরা কোনো সরকারের আমলেই সফল হইনি। তবে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কয়েকটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ও বর্তমান সমস্যায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান রেখেছে। যেমনÑ পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অধ্যাপক ইউনূস ও তার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত ঝামেলা এবং রাজনৈতিকভাবে অহেতুক অসময়োপযোগী বাগ্বিতণ্ডা। এগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব বেশি অর্থনৈতিক বিষয় মনে না হলেও সামগ্রিকভাবে এসব বিষয় সমস্যায় পুষ্টি যোগায়। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এটা সরকারকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যে প্রবৃদ্ধি বাড়া সত্ত্বেও, দারিদ্র্য ক্রমাগত কমা সত্ত্বেও, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সাফল্য সত্ত্বেও কোনো নির্বাচিত সরকারকেই জনগণ পরপর দু’বার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেনি। এর কারণ কি? এটা একটা ধাঁধা। আমার ধারণা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা বিনয়ী, কতটা আন্তরিক, কতটা শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যবহার করেন সেসব সূচককে জনগণ খুবই গুরুত্ব দেয় পুনরায় ভোট দিয়ে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে। এখন যে সমস্যা চলছে তার শেষ এখানেই নয়। ইউরোপের সমস্যা যদি গ্রিস-ইটালি ছাড়িয়ে ফ্রান্স-জার্মানিতে ছড়ায়, সেটা আমাদের জন্য আরো বড় হুমকি হতে পারে। যদিও এমনটা হবেই এমন মনে করছি না। আবার যদি হয়ও তাহলে আমাদের যেসব খাতে উৎপাদন-রপ্তানি আছে সেগুলো বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। তাই খুব বেশি চিন্তা না নিয়ে আমাদের সতর্ক হয়ে চলতে হবে। সতর্কতা সবসময়ই অবলম্বন করা প্রয়োজন কি কথায়, কি কাজে।

সাপ্তাহিক : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমস্যার ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ সমস্যা তৈরি করল কেন? এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জন কিভাবে সম্ভব?

বিনায়ক সেন :  বৈদেশিক সাহায্য এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের অর্জনগুলো আন্তর্জাতিক সমাজে ঠিকমতো তুলে ধরা হচ্ছে না। না হয় আমাদের এই অবস্থা থাকবে কেন? আমরা কি আফ্রিকার দেশ? আন্তর্জাতিকভাবেই তো আমাদের স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে যে এমডিজি অর্জন, জেন্ডার সমতা, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, দারিদ্র্য নিরসন, ঋণের পরিশোধ এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বেশি। এখন কোথায় একজন মন্ত্রীকে ঘিরে বিতর্ক হলো সেই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে সবকিছু থেমে যাবে এটা তো ঠিক না। হ্যাঁ দুর্নীতি হলে সেটাও আমরা আমলে নেব। তার মানে এই নয় যে, একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে সরকার অনেক বেশি সময় নিয়েছে। কিন্তু আমরা ক্রমাগত খারাপ করছি বিষয়টা সে রকম নয়। যেমন মুডিস (আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা) টিআই (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল) এসব সংস্থার রেটিংয়েও আমরা ভালো করছি। ঋণ, ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রেও আমরা ভালো করছি। তাহলে আমরাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকার কথা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে। তবে বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে দাতাদের মনস্তত্ত্বের প্রতি আরো নজর দেয়া উচিত ছিল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বিতর্কিত যে মন্ত্রীকে সরানো হলো তাকে আইসিটি খাতের দায়িত্ব দেয়া উচিত ছিল না। শুধু এ কারণে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রায় পাস হয়ে যাওয়া ৮০ মিলিয়ন ডলারের একটি বৈদেশিক সাহায্য বিশ্বব্যাংকের বোর্ড বাতিল করে দেয়। অথচ এই সাহায্যটি এখন পাওয়া গেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ পরিস্থিতি আরো সহনীয় পর্যায়ে আসত। আমার মতে, এরকম বিতর্কিত ব্যক্তিকে এখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না দেয়াই দেশের স্বার্থে  উচিত ছিল। অবস্থা ভালো হলে এসব ব্যক্তির অন্যত্র ব্যবহার হতে পারত।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় পাইপলাইনে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে সেগুলো ঠিকমতো আসে না কেন? এর জন্য দরকার উচ্চপর্যায়ের উদ্যোগ। যেমনটা ঐতিহাসিকভাবে সিঙ্গাপুরে কোরিয়ায় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সচিবদের টার্গেট দেয়া হোক যে, এই সময়ের মধ্যে পাইপলাইনে আটকে থাকা সাহায্যকে ছাড়িয়ে আনার কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। সেজন্য বিদেশিরা কি কিভাবে পেতে চায় সেগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তিনি (সচিব) ব্যবস্থা করবেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সচিবদের বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের (প্রকল্প পরিচালকদের) ইনসেনটিভের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ক্রাইসিস নতুন কিছুর জন্ম দেয়। সে রকম মৌলিক উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে। রাজনীতিবিদদের এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। শুধু যে নিয়মে ছিলাম ঘুরেফিরে সেই নিয়মেই থাকব এটা হতে পারে না। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে হবে বা রাখব না এসব বিষয় নিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলে হবে না। রাজনীতিবিদদের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত হতে হবে। বর্তমানে যে চাপের মুখে অর্থনীতি এখনই অর্থনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করার সময়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে এটা করা যায়, প্রকল্প-সাহায্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা করা যায়। কর আদায়ের ক্ষেত্রে এটা করা যায়। এটাই এখন জনদাবি নাগরিক সমাজের দাবি হওয়া উচিত। দেশের উন্নতির সঙ্গে এটি গভীরভাবে জড়িত। শুধু অর্থমন্ত্রী অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবেন আর মাথা ঘামাবেন বিষয়টা ঠিক না। আইন প্রণেতা, সরকারি দল, বিরোধী দল সবাইকে এই বিষয়গুলোকে নিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। চিন্তা করতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সেসব দেশেই বৈদেশিক সাহায্য বিনিয়োগের সুন্দর ধারাবাহিকতা থাকে।

সাপ্তাহিক : প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না থাকলেও দেশ চলেছে। এখনো চলতে কোনো সমস্যা হবে না…

বিনায়ক সেন : রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ফোরামে নানান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী এই কথা কোন দৃষ্টি থেকে বলেছেন সেটা আমি জানি না। কিন্তু তিনি যদি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনায় এরকম কথা বলতেন তাহলে আমরা সেটা নিয়ে কথা তুলতাম তবে এই ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ আমি দিতে চাই। চীন ১৯৯৫ সাল থেকেই এলডিসি থেকে বেরিয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু সেই সময়েও তারা বিশ্বব্যাংকের কাছে বলেছিল যে, আমাদের দেশে অনেক দরিদ্র লোকজন আছে তাই ওউঅ ঋণের মতো সহজ শর্তে ১% সুদের ঋণটা চালু রাখা হোক। দেখুন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। তখন তারা যে অবস্থায় ছিল তখন ঐ ঋণ না পেলেও যে খুব সমস্যা হতো তা কিন্তু নয়। অথচ তারা বলেছে, চেয়েছে। আমার কথা হচ্ছে আমাদের ভেতরে কি শক্তি আছে সেটা তো নিজেরা বুঝব। তাই বলে সুবিধাজনক সুযোগ ছাড়ব কেন? ঠিক আছে আমাদের কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক অর্জন আছে। খাদ্য ঘাটতির কারণে যে রাজনৈতিক সমস্যা হয় এরকম কোনো পরিস্থিতিতে হয়ত আমরা নেই। তাই বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার চেয়ে সামনের দিনে এই পরিস্থিতিকে কিভাবে আরো শক্ত করা যায় সেই উদ্যোগ নেয়া দরকার। তাই সর্বোচ্চ রাজনৈতিক জায়গা থেকে আমরা সামনের দিনের ইতিবাচক অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করার দিকনির্দেশনা পেলে বেশি উপকৃত হব।

সাপ্তাহিক : সামষ্টিক অর্থনীতির অব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টা যদি বুঝিয়ে বলেন।

বিনায়ক সেন : সামষ্টিক অর্থনীতি হলো অর্থনীতির আর্থিক খাত, রিয়েল সেক্টর বা উৎপাদনশীল খাত, বৈদেশিক খাত সব দিকের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখা। এখানে একটা সূচক আরেকটার উপর নির্ভরশীল। ফলে যে কোনো একটি বা দুটি বিষয় যখন তার স্বাভাবিকতা হারায় তখন বাকি সূচকগুলোও প্রভাবিত হয়। তেমনি এখন আমাদের যে অব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে তার মানে অর্থনীতির সব শাখা এলোমেলো হয়ে যায়নি। বরং যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে আশাব্যঞ্জক বা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকার কথা ছিল সেটা হয়নি। যার কারণে সামগ্রিকভাবে প্রভাব পড়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির কাজ শুধু মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখা না। বরং প্রবৃদ্ধি গতিশীল রেখে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন এবার আমাদের সরকারের ঋণগ্রহণ হয়েছে অনেক বেশি, ফলে প্রকল্প অব্যবস্থাপনা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস এসব ইস্যু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে এত হৈ হুল্লোড় করার কিছু নেই। বেশি গ্রোথ যখন হয় তখন মূল্যস্ফীতি একটু বেশি থাকে। এখন যে মুদ্রা সংকোচন নীতিতে চলছে তা ঠিক পথেই চলছে। আমি আশাবাদী আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই আমরা আইএমএফ-এর থেকে বাজেট সহায়তা পাব যেসব পদক্ষেপ আমরা বাস্তবোচিতভাবে নিচ্ছি সেই সুবাদে। এবং তখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ পরিস্থিতির ওপর চাপও অনেকটা কমে আসবে। তবে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় না থাকলে মুদ্রা সংকোচন নীতি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা যাবে না, যতটা প্রয়োজন সেভাবে।

সাপ্তাহিক : আপনি বলছেন বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ভর্তুকি পুরোপুরি উঠিয়ে নিতে। কিন্তু স্বাভাবিক দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভর্তুকি তুলে দেয়াটা কি যুক্তিসঙ্গত?

বিনায়ক সেন : এটা ঠিক যে ভর্তুকি পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে প্রধানত এর ব্যবহারকারীরা একটু চাপে পড়বে। কিন্তু ভর্তুকি দিয়ে অর্থনীতিকে যদি আরো বেশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে যাই তাহলে এর জন্য সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যেমন ভর্তুকি দেয়াতে যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তারা উপকৃত হচ্ছেন। কিন্তু সরকার তো শুধু তাদের নয়। ফলে ভর্তুকির ভার বহন করছেন বিদ্যুৎ যারা ব্যবহার করেন না তারাও। সে জন্যই আমি বলছি মন্দার বছরে অর্থনীতির চাপটাকে সবাই শেয়ার করে নিলে উত্তরণ সহজ হয়। একইসঙ্গে আমি আগে বলেছি যে, কাটছাঁটের বছরেও যেন কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে যাতে কাটছাঁট না করা হয়। এখন প্রবৃদ্ধিকে কিছুটা কমিয়ে এনে হলেও সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা জরুরি। সেখানে বেহিসেবিভাবে চলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের অর্থনীতি সেই চাপ সামলাতে পারবে না। এই বাস্তবতা সবাইকে বুঝতে হবে। এ নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ নেই।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি যেমন বাড়ছে মানুষের ন্যূনতম আয়ও কিন্তু বাড়ছে। আগে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে কৃষি মজুরির সমন্বয় হতে ৩-৪ বছর লাগত। এখন সেটা ১-২ বছরের মধ্যে সমন্বয় হয়। অর্থাৎ দ্রুত সমন্বয় হয়। যেমন পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিকশাওয়ালারা তাদের ভাড়া বাড়িয়ে দেন। কৃষি শ্রমিকরা তাদের দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে দেয়। এখন কৃষি মজুরদের দৈনিক মজুরির রেট ২০০-৩০০ টাকা। এতে করে এখন ৫-৭ কেজি চাল হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে ক্ষেতমজুর সমিতি আড়াই সের চালকে ন্যূনতম মজুরি করার কথা ভেবেছিল। ফলে দাম যতই বাড়–ক মানুষ সেটাতে মোটামুটি মানিয়ে নিতে পারছে। এখন সঞ্চয় বিনিয়োগের শক্ত ভিত্তিতে আমরা এমন এক অর্থনীতিতে আছি যেখানে শুধু মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভেঙে পড়ব না। তাই সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভর্তুকি কত কমিয়ে আনতে পারে সরকার।

সাপ্তাহিক : ব্যাংকিং খাতের ক্ষেত্রে গত বছরটা কেমন গেল?

বিনায়ক সেন : এটা একটা ভালো প্রশ্ন। ব্যাংকিং একটা অজানা খাতে পরিণত হয়েছে। ’৮০ দশকে ব্যাংকিং সেক্টরে বড় আলোচনা ছিল এই খাতের টাকা যাচ্ছে কোথায়? এই লুটেরারা কারা? ’৯০ এর দশকে এটা কিছুটা কমে এসেছে। তবে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালকদের নিয়ে কথা উঠেছে। কিন্তু ২০০০ এর দশকে কারা কি করছে তার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি আমি যতটুকু অনুমান করতে পারি গত এক দশকে আর্থিক খাত নিয়ে যতগুলো সংবাদ শিরোনাম হয়েছে তার বেশিরভাগই হয়েছে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বা বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে। ব্যাংকিং খাতের বিষয়টি তেমন আলোচনায় আসেনি। এই প্রাইভেট সেক্টরের বৃহৎ ঋণের প্রবাহ এটা গেছে তাদের কাছে? এমনকি সরকারি ঋণের ক্ষেত্রেও ওঠানামাটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তলিয়ে দেখার বিষয়।

আমার ধারণা মন্দা ঋণকে যেভাবে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বিষয়টা সেরকম নয়। মনে হচ্ছে ক্যাশ রিকভারি নয়, মূলত রিশিডিউলিং ও মন্দ ঋণ মওকুফ (রাইট অফ) করে মন্দ ঋণকে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক নিয়োগ এবং তাদের সম্পর্কে যেসব খবর শোনা যায় তাতে এই সন্দেহটা বাড়ে। তবে আশির দশকের তুলনায় এখন একটু পার্থক্য আছে। যেমন আগে বড় ধরনের ঋণ নিয়ে সেগুলো দিয়ে গাড়ি-বাড়ি, ভোগ বিলাসিতায় ব্যবহার করে ঋণটাকে প্রথমেই মন্দা বানিয়ে ফেলা হতো। এখনকার সময়ে ঋণগ্রহীতারা কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিচ্ছে। কেউ গার্মেন্টস বা রপ্তানিমুখী ব্যবসা করছে কেউ দেশের ভেতরের অর্থনীতিতেও টাকাটা কাজে লাগাচ্ছে, তারপরও এর ওপর যদি নজরদারি থাকে তাহলে আরো উন্নতি হবে সন্দেহ নেই।
সাপ্তাহিক : আর ব্যাংকগুলো যে শেয়ারবাজারে গেল…

বিনায়ক সেন : শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়ার বিরোধী ছিলাম আমি। শেয়ার মার্কেট তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সেখানে ব্যাংকের মতো বৃহৎ পুঁজির প্রতিষ্ঠান ঢুকলে বাজার আরো তেজী হবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়ে ভুল সিগনালে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। হয়েছেও তাই। আরেকটা হলো কর মওকুফ করা। ব্যাংকে এফডিআর করলেও আমাকে কর দিতে হয়। অথচ শেয়ার মার্কেটের বড় বড় পুঁজির লোকেরা কোনো কর দেবে না এটা কিভাবে হয়? ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি হতে পারে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কিভাবে হলো। তিনি  বললেন, কিভাবে কিভাবে জানি এটা হয়ে গেছে।

তারপর আসুন সঙ্কট উত্তরণে কমিটি গঠন বিষয়ে। তারাও পুঁজিবাজারে ব্যাংককে জড়িত করে রাখল এবং পুঁজিবাজারে আয়কৃত অর্থ করমুক্ত রাখল, উপরন্তু কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগও রাখা হলো। তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে বিশৃঙ্খলাটা পুঁজিবাজারে তৈরি হয়েছে সেখান থেকে তারা কি শিক্ষা গ্রহণ করল? আবার বিভিন্ন ধরনের ফান্ড তৈরি করে বাজার দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো কোনো দীর্ঘমেয়াদি ফল দেবে না। মানুষের আস্থাই হলো এই বাজারের বড় মূলধন। আমার মূল কথা হলো, ব্যাংক খাতকে পুঁজিবাজারের থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবেÑ বিশেষত, সেকেন্ডারি মার্কেটে তারা বিনিয়োগ করতে পারবে না। আরেকবার পুঁজিবাজারে ধস নামলে সমগ্র ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সাপ্তাহিক : ইব্রাহীম খালেদের তৈরি প্রতিবেদন কতটুকু আমলে নেয়া হয়েছে?

বিনায়ক সেন : ওঁর প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে তাদেরই কেউ কেউ মার্কেট পুনর্গঠনে দায়িত্ব পেয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায় সরকার কতটুকু বিষয়টা আমলে নিয়েছেন। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর মতো সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে যেখানে মীমাংসা করার জন্য জড়িত করা হলো সেখানেও প্রধান দুটি ভুল শোধরানো হয়নি। তার একটা হলো ব্যাংক খাতকে জড়িত রাখা হলো এবং কর মওকুফের সঙ্গে কালো টাকাও ছাড় পেল।

সাপ্তাহিক : শেয়ারবাজারের অব্যবস্থাপনাকে বর্তমান সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা বলে অনেকের অভিযোগ…

বিনায়ক সেন : শুধু শেয়ারবাজার না। আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে বর্তমান সরকারের কয়েকটি ভুলকে উপলব্ধি করি। প্রথমত, পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতা তৈরির নেপথ্য কারিগররা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দ্বিতীয়ত ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তির সঙ্গে অহেতুক বিতর্কে জড়ানো যেটা আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব রাখছে। তৃতীয়ত, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যেভাবে তাদের আপত্তি জানিয়েছে (সাধারণত তারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে বলার চেয়ে আগে সরকারকে গোপনে জানায়)। তারপরও সরকার ঐ মন্ত্রীকে সময়মতো সরায়নি এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত ঝামেলা। এসব মামলার বিষয় দুদক দেখবে। এগুলো নিয়ে হৈ চৈ করা সরকারের কাজ নয়। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ করার চেয়ে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা করা উচিত ছিল। এখনও সময় আছে সতর্ক হওয়ার। রাজনৈতিক শান্তি না থাকলে অর্থনৈতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না। অন্যদিকে, সামনের নির্বাচন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে হবে নাকি অ-তত্ত্বাবধায়কে হবে সেটা নিয়ে বিতণ্ডায় থাকা আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। অথচ এসব বিতর্কে সরকার তার যথেষ্ট শক্তি ক্ষয় করছে। বিরোধী দলও এই অভিযোগের বাইরে নয়। কিন্তু এসব সমস্যাকে আমি সরকারের স্বেচ্ছাকৃত ভুল বলব। যেগুলো থেকে দূরে থাকা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

সাপ্তাহিক : পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন একদিকে অনেক টাকা লুটেরা গোষ্ঠী নিয়ে গেল। অন্যদিকে সরকার বিভিন্ন খাতের টাকা ফান্ড করে বাজারকে তেজি করার চেষ্টা করছে। যেখানে দোষীদের বিচার তো হয়ইনি উপরন্তু আরেক কালো টাকার গোষ্ঠীকে অবাধে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন?

বিনায়ক সেন : কালো টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে যে এই সমস্যার সমাধান হবে না সেটা অনেক অর্থনীতিবিদ ইতোমধ্যে বলেছেন। এটা নিয়ে আর ব্যাখ্যা করার দরকার নেই বলে আমার মনে হয়। আমার কথা হচ্ছে আমাদের এখানে ন্যূনতম সুশাসন নিশ্চিত করার মানসিকতা না থাকায় কালো-সাদা টাকার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই। যে কারণে বলা যায় কালো টাকা অলস পড়ে নেই। কোনো না কোনো খাতে সেটা ব্যবহার হচ্ছে। আমি মনে করি ফাইনান্সিয়াল সেক্টরের মধ্যে ক্যাপিটাল মার্কেট একটি অংশ মাত্র। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে যারা তরুণ সমাজের জন্য কর্মসংস্থান করতে চেয়েছিলেন তারা ভুল করেছেন। তাছাড়া আমাদের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন তারা পুঁজিবাজারের মাধ্যমে কিন্তু উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেনি যেমন, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। তাদের উন্নয়ন হয়েছে মূলত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এবং ব্যাংক খাতের সঠিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এটা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য।

পুঁজিবাজার নিয়ে আমাদের ঐতিহাসিক দুর্ভাগ্য আছে। ১৮৪৭ সালে প্রথম বাঙালি শিল্প উদ্যোক্তাদের বড় ধাক্কা দেয় শেয়ার মার্কেট। দ্বারকানাথ ঠাকুরদের সব কোম্পানি ধ্বংস হয় পুঁজিবাজারের অভাবনীয় দরপতনের কারণে। পুঁজিবাজারের আরেকটি বড় পতন আমাদের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময়। বর্তমান সময়েও আমাদের পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে তেমন কোনো অবদান রাখেনি। আমাদের উন্নয়ন মূল অবদান রেখেছে সরকারি বিনিয়োগ, ব্যাংকিং খাত এবং আমাদের রপ্তানি।

তবে পুঁজিবাজারে আমাদের বৃহৎ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জড়িত করতে পারলে ইতিবাচক ফল হতো। যেমন ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের সম্পদ কম-বেশি বেক্সিমকোর সমান। বা কিছু বৃহৎ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে যেগুলো সারা বছরই ভালো উৎপাদনে থাকে তাদেরকে যদি পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ত করা যায় এবং এসব প্রতিষ্ঠানের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রাইমারি শেয়ার যদি ক্ষুদ্রঋণের পরিবার বা শ্রমিক পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা হতো তাহলে পুঁজিবাজারে নতুন প্রাইমারি শেয়ার যেমন আসত, তেমনি এসব প্রতিষ্ঠানের গরিব সদস্যরাও ডিভিডেন্ড আয় থেকে বাড়তি উপার্জন করতে সক্ষম হতেন। ফলে কর্মীদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা বেড়ে কাজের গতিকে প্রভাবিত করত। এগুলোকে আমি প্রাইমারি মার্কেটে যুক্ত থাকার বিষয়ে বলছি। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে কিছু সতেজ রক্ত প্রবাহিত হতো যা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করত, আস্থা বাড়ত।

সাপ্তাহিক :  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাকে কিভাবে দেখছেন?

বিনায়ক সেন : আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নেই। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শুধু দোষারোপ করলে চলবে না। পৃথিবীর যেসব অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার পথে বা এখন শক্তিশালী সেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের মতো করে চলে। কিন্তু আমাদের সরকারের একটা ব্যাংকিং বিভাগ আছে। সেখানে নিজেদের দলীয় অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়ে সব নিজেদের মতো পরিচালনা করতে চায়। দলীয় লোক নিয়োগ দিতেও আপত্তি থাকত না যদি তারা সংশ্লিষ্ট খাতের যোগ্য ব্যক্তি হতেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুটি বিষয়কে ইতিবাচক উল্লেখ করতেই হবে তার একটি হলো জোর করে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা তারা করেনি। দ্বিতীয়ত পরিস্থিতি অনুযায়ী মুদ্রা সংকোচন নীতি নিয়ে চলেছে। এখন সরকার যদি তার ব্যয়ে কোনো কাটছাঁট না করে আগের মতোই চলতে চায়, ব্যাংক ঋণ নিতে থাকে তাহলে তো সমস্যা হবেই। আমাদের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মাঝে কোনো সমন্বয় নেই।

সাপ্তাহিক : আমাদের সরকারি ব্যয় কি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি?

বিনায়ক সেন : সাধারণত ২০-২১ শতাংশ সরকারি ব্যয় থাকে। সে তুলনায় আমাদের কমই হয়। কিন্তু যেহেতু আমরা একটু চাপে আছি সেই ক্ষেত্রে এদিক-সেদিক কাটছাঁটের চিন্তা করতে হবে মন্দা বছরের তাড়নায়। তবে গ্রাম উন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব রক্ষা করতে হবে। কারণ এগুলো সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ে অবদান রাখে।

সাপ্তাহিক : আপনি বলছেন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি ঠিক রাখতে, অন্যদিকে ব্যাংক ঋণ নেয়া বন্ধ করতে। তাহলে সরকার টাকা পাবে কোথায়?

বিনায়ক সেন : সরকারের হাতে যেসব মেগা প্রজেক্ট আছে সেগুলোকে আপাতত বন্ধ রেখে, যতটা সম্ভব সরকারি ব্যয় কমিয়ে এবং ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়ে সরকারকে একটা সমন্বয়ের মধ্যে আসতে হবে। এখন ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়ার কথা বললেই অনেকেই হৈ চৈ করে ওঠেন। কিন্তু আমি এক মধ্য খামারের কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি। তারা বলছে সারের ভর্তুকি উঠিয়ে দিলেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। কারণ কৃষক ভালো দাম পাচ্ছেন। এখন পণ্যের দাম বাড়ছে অনেক বেশি অথচ আমাদের ভর্তুকি মানসিকতা কমছে না। এটা ঠিক না। নব্বইয়ের দশকে ধানের দাম তেমন পেত না কৃষক। এখন তো ভালো পাচ্ছে। তাই কৃষিপণ্যের তুলনামূলক উচ্চ দামের স্তরে প্রবেশ করেও আমাদের ভর্তুকি মানসিকতা থাকবে ২০ বছর আগের মতোÑ এটা কিভাবে হয়?

সাপ্তাহিক : সরকারের আয় বাড়ানোর জন্য আর কি করা যেতে পারে?

বিনায়ক সেন : খুব দুঃখের বিষয় হলো আমরা যখন আর্থিক বছর নিয়ে আলোচনা করছি তখন মূল উপজীব্য হচ্ছে রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক সাহায্য ইত্যাদি। কিন্তু ইতিবাচক অর্থে মূল আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত ছিল রাজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর। এর কারণ হচ্ছে কর আদায়ে আমরা পারদর্শী নই। আমেরিকাতে এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কর গোয়েন্দা হিসেবে। আমাদের দেশেও কর সেভাবে আদায় হচ্ছে না। একদিকে মানুষ কর দিতে আগ্রহী না। অন্যদিকে করনীতিতে থাকছে বিশাল ফাঁকির সুযোগ। না হয় আমরা এত পিছিয়ে থাকতাম না। নানান বিষয়ে কমিশন হয় একটা কর কমিশন করে এর আইনসহ সংশ্লিষ্ট দিকগুলো দেখলেই হয়। এটা করা হবে না। বলা হয় দুর্নীতি আমাদের বড় সমস্যা। আমি বলি অত্যন্ত দক্ষ এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক কর গোয়েন্দা নিয়োগ করুন। দেখবেন দৃশ্য পাল্টে যাবে। আর শুধু গতানুগতিক পদ্ধতিতে কর আদায় করলে হবে না। আধুনিক অনেক চিন্তা-চেতনা ও পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ হচ্ছে সেগুলো দেখেও আমাদের জন্য উপযুক্ত একটি পদ্ধতি বেছে নিতে পারি। কর আদায় বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো না গেলে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা কাটবে না, বা মন্দার বছরে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা আগামীতেও থেকে যাবে।

সাপ্তাহিক :  দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে বলে অভিযোগ অনেকের…

বিনায়ক সেন : পাকিস্তান আমলে যেমন মুষ্টিমেয় পরিবারের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত ছিল আমাদের দেশে তেমনটি তৈরি হয়েছে কিনা সেটা গবেষণার বিষয়। ১৯৮৮ সালে আমি এবং এমএম আকাশ একটি কাজ করেছিলাম। সেখানে ৩৬টি পরিবারের বিষয় এসেছিল। এখন এ বিষয়ে কোনো কাজ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে যে পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা হয়েছে তাতে এই সংখ্যা বেড়েছে অনেক তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তবে একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের আয় বেড়ে জীবনযাত্রাও পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে অতি উচ্চবিত্ত এবং অতি দরিদ্রদের আয় বেড়েছে। বেকায়দায় আছে মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তদের আবার দুটি শ্রেণী মনে করি আমি। একটা উচ্চমধ্যবিত্ত, আরেকটি হলো মধ্য মধ্যবিত্ত। মধ্য মধ্যবিত্ত তুলনামূলকভাবে সমস্যায়। জিনিসপত্রের দাম ওঠানামা করলে উচ্চবিত্তের জন্য কোনো সমস্যা না। উচ্চমধ্যবিত্তও তেমন কোনো প্রভাবিত হয় না। কিন্তু মধ্য-মধ্যবিত্তের আয় নির্দিষ্ট হওয়াতে সমস্যায় পড়ে। অন্যদিকে মজুরি শ্রমনির্ভর গরিব শ্রেণীর অনেকেই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাদের মজুরির সামঞ্জস্য করতে পারে খুব দ্রুত, তাই তারাও একটা ব্যালেন্সের মধ্যে থাকতে পারে। সামনের দিনে দারিদ্র্য বিমোচনকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হয়। কিন্তু আমার মতে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান। কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ বয়সে তরুণ, তারা পর্যায়ক্রমে চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে। সেখানে তারা প্রথমেই বড় ধরনের বৈষম্যের শিকার হবে শিক্ষার দিক দিয়ে। যেমনটা বর্তমানে হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। অর্থাৎ কে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করেছেন সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা হবে। বাংলা মাধ্যমে পড়েছে  না ইংরেজি  মাধ্যমে পড়েছে। এখন একজন মধ্যবিত্তের সাধ্য নেই তার সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবে। তাই এক দেশে অনেক ধারায় শিক্ষা অর্জন হচ্ছে। যা বৈষম্যের সঙ্গে অদক্ষতা তৈরি করে। এই বিষয়টা দেখতে হবে। আরেকটি হলো কারিগরি শিক্ষা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অথবা বৃত্তি দিয়ে মেয়েদের পড়িয়ে বসিয়ে রাখলে হবে না। এসব করে আমরা এমডিজি অর্জন করতে পারব, কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে। পড়াশোনা করে তারা শুধু ভালো মা হবে নাকি উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগবে এটা দেখতে হবে। কারণ যে মেয়েটি শিক্ষার্জন করেছে তার মনমানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে নিশ্চয়ই। তার মতের প্রাধান্য দিতে হবে। না হয় অসন্তোষ বাড়বে। ইনক্লুসিভ গ্রোথ-এর জন্য মহিলারা যাতে শ্রমবাজারে আরো বর্ধিত আকারে অংশ নিতে পারেন সেদিকে নজর রাখা জরুরি।

সাপ্তাহিক : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। এই দুইয়ের মিশ্রণও খুব ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এসবের বাইরে নতুন কিছু চিন্তার জায়গা আছে কি?

বিনায়ক সেন : বর্তমান বিশ্বে অনেক ধরনের গণতন্ত্র আছে। আবার নানান ধরনের সমাজতন্ত্রও আছে। এগুলো মানুষকে পরিতৃপ্তি না দিলেও নতুন পথ না থাকায় মন্দের ভালোর মধ্যে থাকছে। তবে মানুষের মাঝে যে আকাক্সক্ষা দেখা যায় সেটা হলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসন তাদের পছন্দ। গণতন্ত্র মানে অবাধ নির্বাচন শুধু নয়, এটি গণতন্ত্রের সংকীর্ণ সংজ্ঞা। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করা। এটাই গণতন্ত্রের আধুনিকতম ধারণা। একদিন ভোট দিলেই মানুষের কাজ শেষ বিষয়টা এরকম নয়। যেমন এখন বলা হয় আমেরিকায় গণতন্ত্র থাকলেও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র নেই। অন্যদিকে চীনে গণতন্ত্র না থাকলেও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র আছে। এখন কথা হচ্ছে দুটি প্রক্রিয়াতেই মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। এ জন্য আমরা নিজেও এটা নিয়ে লিখেছি প্রতিচিন্তা নামক একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। এই দুটি ধারার বাইরে তৃতীয় আরেকটি ধারাতে আমরা প্রচেষ্টা চালাতে পারি। বর্তমান বিশ্বে চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে ইত্যাদি ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো আমেরিকার প্রতি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি রেখে, আইএমএফের সহযোগিতা না নিয়েও অর্থনৈতিকভাবে ভালো করছে। জনকল্যাণমুখী উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছে। সামরিক বাহিনীর শাসনকে সাংবিধানিকভাবে প্রত্যাখান করেছে। আমি বলছি না তাদেরটাই শেষ পথ কিন্তু তারা এগুলো দিয়ে ভালো করছেন। তেমনি আমরা জনঅধিকারের ভাষায় নতুন পথে চলতে পারি কিনা সেই চেষ্টায় যাওয়া উচিত। গরিবরা শুধু কোনোমতে বেঁচে থাকবে আর ধনীরা আরো ধনী হতে থাকবে এটা হওয়া উচিত না।

সাপ্তাহিক : অতি ধনীদের জীবযাপন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

বিনায়ক সেন : সম্প্রতি ভারতের ধনীদের বিষয়ে অরুন্ধতী রায় তাঁর ব্রোকেন রিপাবলিক বইতে লিখেছেন যে ভারতের অতি ধনীরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছেন। তারা সামাজিক খবর তো রাখেনই না, সেই ভাষাও বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। তেমনিভাবে আমাদের বাংলাদেশের অতি উচ্চবিত্তদেরও এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত একটা উদাহরণ দিই। কিছুদিন আগে আমাদের দুজন বন্ধু দেশের বাইরে থেকে দীর্ঘদিন পর আসছেন। সে উপলক্ষে কয়েকজন মিলে শতাধিক লোকের আয়োজন করলেন ঢাকা ক্লাবে। আমাকে দাওয়াত করল। কার্ডে ড্রেস কোড নিয়েও কিছু নির্দেশনা আছে। আমি বললাম যে, এই অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের স্বাগত জানানোর কাজটা আমি করতে পারব না। তারা আমার বন্ধুÑ তাদের সঙ্গে কথা হবে পারিবারিক পরিবেশে। আর যদি সবাই মিলে বিশেষ আয়োজন বা গেট টুগেদারের আয়োজন করি তাহলে অন্য জায়গায় করা যায়। ঢাকা ক্লাবের মতো এত ব্যয়বহুল জায়গায় কেন? এই যে আমাদের শ্রেণী উত্তরণ এবং চরিত্র পরিবর্তন তা সত্যিই অভাবনীয়।

সাপ্তাহিক : ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট প্রসঙ্গে আপনার মত কি?

বিনায়ক সেন : ভারতের সঙ্গে আমাদের ৩টি কাঁটাতারের বাধা রয়েছে। একটি হচ্ছে ভৌগোলিক কাঁটাতারের বেড়া- যা দিয়ে আমাদের দেশের সীমান্তের চারপাশে বেড়া তৈরি করে আমাদের ভূখ-কে সন্ত্রাসী ভূখ- মনে করে অভিবাসীদের যাওয়া-আসা বন্ধ করতে চেয়েছে। অর্থাৎ ভৌগোলিক কাঁটাতার প্রমাণ করে যে তারা আমাদেরকে আস্থায় নেয়নি। দ্বিতীয় কাঁটাতারটি হচ্ছে মানসিক। আমাদের এখানে অবাধে ভারতীয় চ্যানেল দেখানো হচ্ছে, অথচ আমাদের কোনো চ্যানেল সে দেশে প্রদর্শিত হয় না। আমাদের উন্নতি, আমাদের নাটক, আমাদের গান, আমাদের সমাজ নিয়ে জানবার কোনো সম্ভাবনাই নেই সাধারণ ভারতবাসীর। এই কাঁটাতারটি আরো মর্মান্তিক। তৃতীয় কাঁটাতারটি হচ্ছে বিনিয়োগের কাঁটাতার। আমাদের দেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে যে ভারসাম্যহীনতা অনেক দিন ধরে চলছে তা কমিয়ে আনার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেভাবে সেটা হচ্ছে না। বরং টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তা নিয়ে প্রহসনÑ এসবের মধ্য দিয়ে আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হচ্ছে। আমি মনে করি, এই তিনটি কাঁটাতার ভৌগোলিক, মানসিক ও বিনিয়োগের কাঁটাতার দূর না হওয়া পর্যন্ত ট্রানজিট সুবিধে তড়িঘড়ি করে দেয়া উচিত হবে না। কাঁটাতার উঠিয়ে নিলে ট্রানজিট দেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। কাটাঁতার উঠিয়ে নেয়ার বিনিময়ে ট্রানজিট এই হচ্ছে আমার প্রস্তাব।

ছবি : কাজী তাইফুর

একে একে নিভে যাচ্ছে বাতি?

বিনায়ক সেন

অর্থশাস্ত্র যদি বিষণ্ন বিষয় হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সেই অর্থশাস্ত্রের সবচেয়ে বিষণ্ন অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে দুই কীর্তিমান বিদেশি অর্থনীতিবিদ লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন করা গেলে উন্নয়নের কম-দুরূহ সমস্যাকেও সমাধান করা সম্ভব। এই অর্থে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষা ক্ষেত্র বলা যেতে পারে।’ স্বাধীনতার চলি্লশ বছরেও দেশটিকে নিয়ে হতাশাবাদের ধ্বনি বন্ধ হলো না। আমরা যদি শিখরের দ্বারপ্রান্তেও এসে কখনও পেঁৗছাই তাহলেও আমাদের দুর্গম অভিযান যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে দেখছেন তারা বলবেন, ‘এই তো, যাক না আরও একটু ওপরে তারপরেই দেখবে ওটা কীভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে খাদে পড়ে যায় নির্ঘাত’! আর সে হতাশার সুরও ছিল একেক দশকে একেক রকম।

প্রথমে [সত্তর দশকেই] শোনা গেল জনসংখ্যা নিয়ে হতাশাবাদ। আদিতেই ছিল জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব, তার ওপর অব্যাহত হারে দ্রুত জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি_ এ দুইয়ে মিলে সৃষ্টি হয়েছে এক ‘ম্যালথাসীয় বিষবৃত্ত’, যার থেকে বেরোনোর সম্ভাবনা নেই এ দেশের। তারপর শোনা গেল কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদন নিয়ে হতাশাবাদ। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সেই হতাশাবাদের গুঞ্জন আরও উস্কে দিয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত রাজত্ব করা এই কৃষি-হতাশাবাদের মোদ্দা কথা ছিল_ এ দেশের কৃষিতে উৎপাদন-সম্পর্ক এতটাই শোষণমূলক [আধা-সামন্তবাদী, আধা-পুঁজিবাদী] যে, এখানে গরিব কৃষকদের পক্ষে উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধান বীজ ফলানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর ধনী কৃষকদের আগ্রহ যেহেতু কৃষির চেয়ে অকৃষির দিকে [অধিকন্তু সামন্তবাদী জোতদারদের মতো সুলভে উদ্বৃত্ত আহরণের প্রতি], সুতরাং কৃষির আধুনিকায়নের সম্ভাবনাও এখানে সুদূরপরাহত। ‘শৃঙ্খলে বাঁধা এ দেশের কৃষি’_ এ রকম বললেন কেউ; অন্য একজন লিখলেন, ঔপনিবেশিক কাঠামোয় ‘অচলাবস্থাই’ এ দেশের কৃষির নিয়তি। আরও কেউ কেউ পূর্বাভাস দিলেন আশু অনিবার্য দুর্ভিক্ষের। রফতানিমুখী উন্নয়ন নিয়েও হতাশা ব্যক্ত হলো আশির দশকে। তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া [বা পরবর্তী যুগের চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড] এসব পূর্ব এশীয় দেশকে অনুসরণ করে এই দুর্ভাগা ভূখণ্ড কখনোই রফতানিমুখী উন্নয়নের ছকে সাফল্য পাবে না_ এই ছিল মত। এবং এই নৈরাশ্যের মূলে ছিল বাংলাদেশে লুটেরা ধনিক শ্রেণীর আধিপত্য এবং উৎপাদনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উদ্যোক্তাদের অভাব। আর শেষোক্তরা না থাকলে প্রাথমিক পণ্য [কৃষিজ পণ্য] রফতানিকারক দেশ থেকে শিল্পপণ্য রফতানিকারকের তালিকায় নাম লেখানো শক্ত। হতাশাবাদ গড়ে উঠেছিল নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও। বাইরের পর্যবেক্ষকদের চোখে আমাদের নারীরা ইতিহাসের অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত যেন; পর্দার আড়ালেই তাদের জীবনযাপন। ফলে তাদের পক্ষে উৎপাদনমুখী খাতে অংশ নেওয়া প্রায় অসম্ভব মনে করা হতো সত্তরের দশকে। নারী শিক্ষার বিষয়ে সাফল্য কখনও আসবে_ এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে অংশ নেবে_ এটিও ছিল তাদের চিন্তার বাইরে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দড়ি বানানো বা চিড়া-মুড়ি বানানো ছাড়া গ্রামবাংলার নারীদের পক্ষে আর কী করা সম্ভব_ এ কথা নব্বইয়ের দশকেও শোনা গেছে! নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে নৈরাশ্য জনসংখ্যা নিয়ে নৈরাশ্যের যুক্তিকে আরও সবল করেছিল, যেমন প্রশ্নকীর্ণ করেছিল শিল্পপণ্য রফতানিতে এ দেশের সম্ভাবনাকেও।

গত দুই দশকের বাস্তব তথ্য পরিসংখ্যান অবশ্য জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন, রফতানিমুখী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে হতাশার রায়কে ইতিমধ্যেই মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। তারপরও হতাশাবাদীরা আশ্বস্ত হতে পারেননি। ২০০০-এর দশক থেকে বিশেষভাবে শোনা যাচ্ছে সুশাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে নৈরাশ্য। এবারে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে এ দেশের কিছু কিছু চেঁচিয়ে বলার মতো সাফল্য আর আগের মতো অস্বীকার করছেন না। কিন্তু এবারে তাদের যুক্তি ভর্তৃহরির নন্দনতত্ত্বের চেয়েও সূক্ষ্ম : সুশাসনের অভাবের কারণে_ বিশেষত রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ভেতরকার পরস্পর বিধ্বংসী অস্থিরতার কারণে এসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্যের আসলে কোনো স্থিরতা বা নিশ্চয়তা নেই। এই মতে, যতটুকু সাফল্য অর্জিত বাংলাদেশের এ পর্যন্ত, সেসবই ক্ষণস্থায়ী পরিণতি মাত্র। অচিরেই অস্থিরতা ও নৈরাজ্য গ্রাস করবে এই ভূখণ্ডকে। এদের মধ্যে যারা দীর্ঘমেয়াদি পরিণাম নিয়ে ভাবেন, তারা এই রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন পরিবেশগত হুমকিকে। পুরো দেশটা ভাসছে নূহের নৌকায় এবং সেই ভাসমান নৌকার ওপরে থেকেই আমরা ভ্রাতৃদ্রোহী যুদ্ধে লিপ্ত_ এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখাতে চান তারা আমাদের।

২. যে বছর চলে গেল অর্থাৎ ২০১১ খ্রিস্টীয় সালে আরও একটি ক্ষুদ্রমাপের নৈরাশ্য যুক্ত হয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে হতাশা। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে; বৈদেশিক সাহায্য সেভাবে আসছে না; বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে; টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে; রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি আর সমালে উঠতে পারছে না আমদানি ব্যয়ের চাহিদা; সরকার ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নতুন করে সরবরাহ করেছে ঠিকই; কিন্তু নতুন বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো [যেমন কুইক রেন্টাল] চালু রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাড়তি তেল আমদানির কারণে। তেলের দামও বিশ্ববাজারে বাড়ন্ত, তাই বর্ধিত হারে ডলার গুনতে হচ্ছে, আবার ভর্তুকি কিছুটা কমাতে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে দেশের ভেতরের মূল্যস্ফীতি; বৈদেশিক অর্থায়নের আকস্মিক হ্রাসের মুখে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের দুটো প্রধান উৎস [যথাক্রমে, কর আহরণ ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধার কর্জ]_ এদের মধ্যে বাধ্য হয়ে অনেক বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের ওপর। রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর এই পদ্ধতি যেমন আরও উস্কে দেবে মূল্যস্ফীতিকে, তেমনি আগামী বছরগুলোর বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাবদ সুদাসল মেটানোর ক্ষেত্রেও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে ২০১১-১২ অর্থবছরের এডিপি কাটছাঁট করার দিকে অগ্রসর হতে হবে অচিরেই [যেসব চলক ওপরে বলা হলো এরা পরস্পর সম্পর্কিত]। সেই সঙ্গে বাড়তি দুর্ভাবনার মতো সুপ্ত হয়ে থাকবে শেয়ারবাজারের সংকট-মোকাবেলা ও তাকে চাঙ্গা করে রাখার চ্যালেঞ্জ। মোটাদাগে এই হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশার মূল সুর। তবে এর বিপরীতে অর্থনীতিতে অন্য প্রবণতাও আছে, যা না বললে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে যথার্থভাবে বোঝার এবং তা মোকাবেলা করার কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গত ডিসেম্বর মাসেরই কোনো একটি দিনে একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের শিরোনাম ছিল_ ‘দাম নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকারে ছিল, উদ্যোগ ছিল না’! এর উপ-শিরোনামে বলা হলো কীভাবে বর্তমান সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি ২০০৯ সালের জানুয়ারির ৬ শতাংশ থেকে এখন দাঁড়িয়েছে ১১.৬ শতাংশে। ঠিক একই দিনে, ওই বাংলা দৈনিকের সহযাত্রী ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম ছিল_ ‘অর্থনীতিতে এ বছরেও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা’! দুটো শিরোনামের মধ্যেই পুরো সত্য নেই। একদিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা, অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা_ এই দুটো প্রবণতাই সত্য বর্তমান [২০১১-১২] অর্থবছরের বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য। এবং এই কারণে এটা আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

৩. আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, আমাদের অর্থনীতি আর আগেকার মতো কৃষিনির্ভর অর্থনীতি নেই। এই অর্থনীতির চাকাকে অনেকটাই এখন বিশ্বমানে তাল রেখে চলতে হচ্ছে। এতকাল আমরা বিশ্বায়নের বাইরে থেকে বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখেছি [সভা-সেমিনার, টক-শো বা আই-ফোনে ইন্টারনেটে এর কথা বলেছি, পড়েছি বা শুনেছি]। এখন আমরা গোলকায়নের কেন্দ্রের ভেতরে : ‘সমুদ্র পাড়ি দেওয়া শেষ, এখন প্রকৃত যাত্রার শুরু’ জর্জ লুকাচের সেই প্রবচনের মতো। ফলে বিশ্বায়নের সুবাদে বাড়তি প্রবৃদ্ধি অর্জন যেমন আমাদের সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতা, তেমনি বিশ্বায়নের ঝুঁকিরও আমরা নিত্য মুখোমুখি। সেই ঝুঁকির প্রথম বড় তিক্ত স্বাদ আমরা গ্রহণ করছি এখন_ যার শুরু ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দিয়ে [যার কবলে হিমশিম খাচ্ছে আমেরিকা ও হাল আমলের ইউরো জোনভুক্ত দেশগুলো কম-বেশি]। এখানে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, বাড়তি প্রবৃদ্ধি গ্রহণের পাশাপাশি উচ্চ প্রবৃদ্ধির বেদনাকেও স্বীকার করে নেওয়া ও সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশের ওপর সেই বেদনার ভারকে যথাসম্ভব সহনীয় করে তোলা, যতদিন পর্যন্ত বিশ্ব পরিস্থিতি আবারও মন্দা কাটিয়ে না উঠছে।

দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনীতি একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করেছে। এটা শুধু আমাদের অর্থনীতি নয়, ভারত ও শ্রীলংকার মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ২০০০-এর দশকের শুরুতে শুধু ২-৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে স্বাভাবিক ধরা হতো; দ্বিতীয়ার্ধে তা বেড়ে ৫-৬ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা ও মূল্যস্ফীতি একে ১০ শতাংশের ওপরে নিয়ে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশেই।

আরব অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি, কিন্তু সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির চাপও সেখানে যুক্ত হয়ে থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে কী করে মূল্যস্ফীতিকে সামাল দেওয়া যায়?

তৃতীয়ত, সনাতনী মনিটারিস্টদের মতে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ‘সামগ্রিক চাহিদা’কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; বিশেষত সরকারি ব্যয়জনিত সৃষ্ট চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এই মতের পরিপ্রেক্ষিতে এর সার্বিক প্রয়োজন মেনে নিয়েও আরেকটু সৃষ্টিশীল হয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে। এই সরকারের প্রথম তিন বছরে বেশকিছুটা সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি নিয়ে চলা হচ্ছিল এবং এর সুফল উচ্চ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি। তখন এই নীতি নিয়ে চলা সম্ভব হয়েছিল। তার বড় দুটি কারণ ছিল বৈদেশিক সাহায্যের অব্যাহত প্রবাহ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রার বর্ধিত জোগান। এই দুটো ক্ষেত্রেই চলতি অর্থবছরে ভাটা পড়ায় সরকারকে তার অবস্থান কিছুটা বদলাতে হবেই এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয়হীনতা। যেমন_ রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে যতটা পারা যায় অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কুইক রেন্টালের দ্বারা প্রদত্ত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কেননা, সরকার যে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ঋণ নিচ্ছে তার একটি বড় কারণ তেল-বিদ্যুতের ওপর অব্যাহত ভর্তুকি রাখা প্রয়োজনীয়। এই ভর্তুকি প্রত্যাহারের ফলে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কিছুটা বাড়লেও তাকে ‘মন্দ বছরের দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম’ হিসেবেই দেখতে হবে।

চতুর্থত, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি মানে এই নয় যে, এডিপি কাটছাঁট করতে হবে। এডিপি যতটা পারা যায় রক্ষা করতে হবে অন্য সব অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কমিয়ে এনে। যেসব মেগা প্রকল্প সবার চোখে পড়ে [যেমন_ শহর এলাকার অত্যাধুনিক হাইওয়ে, ফ্লাইওভার বা মেগা আন্তঃসড়ক প্রকল্প] সেগুলোর প্রবৃদ্ধি-অভিঘাত ও বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্যের ওপর অভিঘাত বিচার করে প্রয়োজনে সেসব আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। তবে এডিপির যেসব প্রকল্প বৃহত্তর জনসাধারণকে উপকৃত করবে_ যেমন কৃষি, গ্রাম উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় অবকাঠামো প্রভৃতি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্ষা করতে হবে। কেননা, এসব খাতে সরকারি ব্যয় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, জনগণের সঞ্চয় বাড়াতে সাহায্য করে। এই কারণে ২০১১-১২ অর্থবছরে কেইনসীয় [প্রবৃদ্ধি-বর্ধক] ও মনিটারিস্ট [মূল্যস্ফীতি-সংকোচক] নীতিমালার মধ্যে এক ধরনের বাস্তবোচিত মিশ্রণকে অনুসরণ করা যেতে পারে।

পঞ্চমত, এটা সুবিদিত যে, বাংলাদেশ ব্যাংককে তার মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক সরকারের রাজস্ব-বিনিয়োগের পলিটিক্যাল ইকোনমির মধ্যে বাস করতে হচ্ছে। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংক দক্ষতার সঙ্গে তার মুদ্রানীতি পরিচালনা করছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ধারায় অবমূল্যায়িত হচ্ছে [একে জোর করে আটকে ধরে রাখার নীতি হতো সর্বনাশা!]। এর ফলে আশা করা যায়, আমদানি নিরুৎসাহিত হবে এবং আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ভারসাম্যে উন্নতি ঘটবে। টাকার বর্তমান অবমূল্যায়নের ধারাকে সরকারের ব্যর্থতা মনে করলে তা হবে এক ধরনের জনতুষ্টিবাদী ভাঁওতাবাজির ফাঁদে পা দেওয়া। সরকার যদি তার মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয়সাধন করতে পারে এবং রাজস্বনীতির মধ্যে জনগণের জন্য সুফলদায়ী বিনিয়োগকে বিশ্বমন্দার [বিশেষত ইউরো-জোনের মন্দার] বছরেও রক্ষা করতে পারে, তবে ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে উচ্চারিত এই নতুন হতাশাবাদও ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হবে।

সবশেষে বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে আরও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা চাই, যেমন চলা চাই রাজনৈতিক বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে আরও শিষ্টাচারসম্মত ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। বিশ্বায়নের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ছিদ্রযুক্ত জাহাজ নিয়ে চললে শুধু সমুদ্রকে দায়ী করলে অব্যাহতি পাওয়া যায় না_ এ কথা রবীন্দ্রনাথ কত আগে বলে গিয়েছেন। কিসিঞ্জার ‘চীন সম্পর্কে’ তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থে বলেছেন যে, পাশ্চাত্য যেখানে প্রতিপক্ষকে শুধু যুদ্ধ করে পরাস্ত করতে শিখেছে [ভন ক্লসউইটজদের মন্ত্রণা মেনে], চীন সেখানে যুদ্ধ না করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে শিখেছে [সুন-জু-এর মতো যুদ্ধ বিশারদদের তত্ত্ব মেনে]। এ কারণে পাশ্চাত্য দাবার চালকে শিরোধার্য বলে রপ্ত করেছে, যেখানে চীন ‘ওয়ে চি’ নামক খেলাকে আদর্শস্থানীয় মনে করেছে। এই ‘ওয়ে চি’ খেলার বিশেষত্ব হচ্ছে, প্রতিপক্ষের চালকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি্বকভাবে বানচাল করে দেওয়া এবং ক্রমে তার অবস্থানকে ঘেরাও করা। ‘যখন যুদ্ধ করবে, তখন ভান ধরবে যে তুমি যুদ্ধ করছ না; আর যখন যুদ্ধ করবে না তখন ভান ধরবে যাতে মনে হয় তুমি বুঝি যুদ্ধ করছ।’ ওই ছলনার দরকার। কেননা, কিসিঞ্জার আজ বার্ধক্যে এসে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সুন-জুর কথা_ যুদ্ধের চেয়ে ধ্বংসাত্মক আর কিছুই হতে পারে না। সে কারণে শান্তিই শিরোধার্য, শান্তিকেই যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। ‘মহাভারত’-এও দেখি : কৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডবের জন্য শুধু পাঁচটি গ্রাম চেয়ে কুরু-পাণ্ডবের মধ্যকার ভ্রাতৃদ্রোহী মহাযুদ্ধ নিবারণ করতে চেয়েছিলেন।

এসব বলা এই কারণে যে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সুস্থিরতা না থাকলে শুধু অর্থনৈতিক নীতিমালা দিয়ে [তার যে রূপই আমরা এ দেশ এ বছরে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করি না কেন] দেশের অর্থনৈতিক শান্তি বা অর্থনৈতিক সুস্থিরতা আসবে না বা তা রক্ষা করা যাবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা এখনও সুন-জু থেকে শিক্ষা নিতে অনেকখানিই পিছিয়ে রয়েছি।

Bangladesh on a rising tide

Noted economist Binayak Sen said Bangladesh is now on a rising tide; there are a few countries in the world that are both rising socially and economically.

Sen was speaking at a national seminar on rural employment opportunities at Bangabandhu International Conference Centre styled ‘Sharing of REOPA experience, results and lessons learnt’.

The project, REOPA (Rural Employment Opportunities for Public Assets), is a social safety net programme arranged by the Local Government Division with United Nations Development Programme (UNDP) and European Union (EU) as development partners.

Sen said development should not be measured from economic data alone; rather, it should consider the confidence levels or helplessness of the people. These are not considered in the Millennium Development Goal (MDG) of the United Nations, he said.

He also said if the local governments work well, then the social safety net programmes will work better.

The REOPA project is ending this December and the seminar was arranged to share experiences, results and the lessons learnt, with project stakeholders. At the seminar, a report was also published.

Speakers at the programme highly appreciated the people who implemented the workforce, as it was a successful one. A beneficiary of the project, Nurjahan Begum of Belkuchi in Sirajganj district, expressed gratitude as she is now a self-employed woman. She makes compost fertiliser at home.

In response to a question, she said she wants to see herself as a local government representative in the future. A number of women of her village are self employed under this project, she added.

The REOPA project was designed to respond to the needs of the most vulnerable groups of people in rural Bangladesh. It focused on generating employment and alleviating poverty through effective local government institutions, community partnerships and pro-poor service delivery, said Goran Jonsson, international team leader of the project.

Jahangir Kabir Nanak, state minister of the local government, rural development and cooperatives ministry (LGRD), said 15 percent of the national budget is allocated for the social safety net programmes, where more than 80 programmes are currently going on.

Abu Alam Md Shahid Khan, LGRD secretary, Milko Van Gool, head of cooperation of EU, and Stefan Priesner, country director of UNDP, also spoke at the programme.

তৃতীয় ইউটোপিয়ার মুখোমুখি

তারিখ: ০৪-১১-২০১১


১. উত্তর-ঔপনিবেশিকতা ও ইউটোপিয়া
আমরা এক আধুনিক ইউটোপিয়ার সন্ধানে আছি। আগামী এক দশকে দেশ কোন পথ ধরে অগ্রসর হবে, তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের সীমা নেই। এর একটা বড় কারণ, জনসংখ্যার ঘনত্ব বিচারে বিশ্বের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। তার ওপর রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিরন্তর ঝুঁকি। অব্যাহত বিশ্বমন্দা-পরিস্থিতিও আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে। এ রকম একটা জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন কোন পথে অগ্রসর হবে, তা চলতি উন্নয়নের ছকে নির্ণয় করা সহজ নয়। উন্নয়নের প্রচলিত পাঠ্যবইগুলো এ রকম একটি দেশের অভিজ্ঞতাকে মনে রেখে লেখা হয়নি। এ দেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ (সদ্য প্রয়াত) আবু আবদুল্লাহকে দুই দশক আগে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘১০০ বছর পর কোন ধরনের বাংলাদেশকে দেখতে চান আপনি?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘১০০ বছর পর এ দেশের কতটা ভূখণ্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাবে, সে নিয়ে আসুন, ভাবি।’ এই ভৌগোলিক উদ্বেগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শামসুর রাহমান লেখেন, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’। এটা এক অর্থে নতুন ইউটোপিয়ারই অন্বেষণ। জন্মের মুহূর্ত থেকেই বাংলাদেশ এই তালাশের মধ্যে আছে। নইলে কবির মনে হতো না যে দেশটা কী করে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো গভীর রাতে মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠছে, যার মুখে ‘শতাব্দীর গাঢ় বিশদ শ্যাওলা আর ভীষণ ফাটল, যেন বেদনার রেখা’।
ইউটোপিয়া হচ্ছে ‘ত্রুটিযুক্ত বাস্তবতার ত্রুটিমুক্ত প্রতিফলন’—এক ‘পারফেক্টেড রিয়ালিটি’। দার্শনিক মিশেল ফুকো এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেন ইউটোপিয়াকে। হাইপার-পাওয়ার নিয়ন্ত্রিত এই বৈরী বিশ্বে তীব্র অপমান ও প্রবল অস্বীকারের মধ্যে বাস করে আমরা ইউটোপিয়াকে আঁকড়ে ধরি এবং এর মাধ্যমে আমাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক সত্তার স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করি। এই চেষ্টার আদি রূপ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ইউটোপিয়া-সংক্রান্ত রচনা—ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস। সেই সূত্রে ফিউচার স্টাডিজের একটি নতুন প্রত্যয় তিনি বাংলায় আমাদের উপহার দিলেন, যার নাম ভবিষ্য-বিচার। রবীন্দ্রনাথও প্রবলভাবে আক্রান্ত ছিলেন ইউটোপিয়ায়। প্রথমে লিখলেন ‘স্বদেশী সমাজ’, তারপর নেশনের ন্যারেটিভকে প্রতিহত করতে করতে পৌঁছালেন এমন এক সমাজকল্পে, যার নাম ‘নো-নেশনের সমাজ’। বিল অ্যাশক্রফটের মতো তাত্ত্বিক মনে করেন, উপনিবেশবিরোধী ক্রিটিক্যাল ইউটোপিয়ার আদি চিন্তকদের একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যেমন ছিলেন আফ্রিকার পটভূমিতে ফ্রানস ফেনন।
‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের শেষে রবীন্দ্রনাথ প্রতীক্ষা করেন প্রাচ্যদিগন্তে নব সূর্যোদয়ের। অন্যত্র শুনতে পান ‘ঐ মহামানব আসে’—নতুন রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশের সম্ভাব্য আবির্ভাবের বার্তা। ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ সংগ্রহের একটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু বোঝানোর জন্য ভূদেব বেছে নেন আগ্রহ-জাগানিয়া শিরোনাম—‘নেতৃপ্রতীক্ষা’। আজও আমরা এক নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমাবেশের প্রতীক্ষায় আছি। এর কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় (এবং এ দেশে) নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র ও অসহিষ্ণু গণতন্ত্রের মধ্যে ভেদরেখা ক্রমেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

২. প্রজা বনাম তন্ত্র
এ দেশের সামাজিক ইতিহাসে ইউটোপিয়ার দুটো ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ আমরা অতীতে প্রত্যক্ষ করেছি। ‘প্রথম ইউটোপিয়া’ ছিল ‘পাকিস্তান’ নামক ধারণাটিকে ঘিরে। পাকিস্তান আন্দোলনে এই ভূখণ্ড প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছিল—তার মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষকবর্গের ইউটোপিয়া। পাকিস্তান ছিল তাদের চোখে এক আদর্শ রাষ্ট্র, যেখানে অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক পীড়ন থেকে কৃষকের মুক্তি আসবে, তাঁদের স্বার্থের দেখভাল করবে এক নতুন সমতাবাদী রাষ্ট্র। যেখানে প্রজায় ও তন্ত্রে বিরোধ হবে না। ১৯০১-১৯৪৭ পর্বে বাংলাদেশের কৃষি খাত ‘ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি’-এর চাপে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানের কৃষি খাত (ভারতের চেয়ে) উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়ে চলছিল। অর্থাৎ দুই অঞ্চলে ভিন্ন দুই কারণে পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। প্রবল অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে উপায়ান্তরহীন হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছিল পূর্ব বাংলার গরিব বর্গাচাষি ভূমিহীন কৃষককুল। অন্যদিকে, পাকিস্তানে এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল সামন্ততান্ত্রিক শক্তি, মূলত বৃহৎ ভূস্বামী ও ধনী কৃষকেরা। ইতিহাসবিদ আহমেদ কামাল তাঁর স্টেট এগেইনস্ট নেশন বইয়ে দেখিয়েছেন, প্রথম ইউটোপিয়াটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মলাভের কয়েক বছরের মধ্যেই কী করে ভেঙে পড়ে।
ষাটের দশকে নেশন ও ন্যাশনালিজমকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় ‘দ্বিতীয় ইউটোপিয়া’, যার পরিণতি—১৯৭১। এই আন্দোলনে ক্রিয়াশীল ছিল শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের ‘ওপরে ওঠার’ স্বাভাবিক শ্রেণী-আকাঙ্ক্ষা। তবে শুধু মধ্যবিত্তের ওপর ভর করে বিজয় সম্ভব ছিল না। ১৯৭১ সালের নয় মাসে মুক্তিযুদ্ধ এক নতুন সামাজিক শক্তিতে বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে: মধ্যবিত্ত ছাপিয়ে ক্রমেই বেড়ে উঠছিল সাধারণ নিম্নবর্গ মানুষের উপস্থিতি। এ পর্যন্ত গবেষণায় স্পষ্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল গ্রামের সাধারণ মেহনতি মানুষ, যারা ছিল আধুনিক শিক্ষার বাইরে। ১৯৭১ সালের ইউটোপিয়ায় এক ভিন্নতর সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কয়েকটি মৌলিক প্রতিশ্রুতিকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছিল। সেসব প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই স্বাধীনতার ৪০ বছরে প্রতিষ্ঠা পায়নি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ‘দিনবদলের পালা’ ছিল নির্বাচনী ইচ্ছাপূরণের কড়চা কেবল, যার অধিকাংশই আজ ভুলে যেতে বসেছে শাসক দল। এভাবেই দ্বিতীয় ইউটোপিয়া ভেঙে পড়েছে আজ।

৩. জ্যাক সাহেবের ফরিদপুর
আমরা বর্তমানে এক নতুন (তৃতীয়) ইউটোপিয়ার প্রাক-মুহূর্তে অবস্থান করছি। কিন্তু একে কেবল উন্নয়নবাদী প্রতর্কে বর্ণনা করা যাবে না। ‘এ দেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের স্তরে উন্নীত হবে’—এই অবস্থান আমাদের প্রগতিকে পর্যবসিত করে জিডিপির নিতান্ত সূচকে। জিডিপির পরিসংখ্যানে গরিব-মেহনতি মানুষের সামাজিক জাগরণের (মবিলিটি) আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় না।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১০ সালে ফরিদপুরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর (জেলা প্রশাসক) জে সি জ্যাক দারিদ্র্যের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা চালান। এটাই ছিল ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম দারিদ্র্য জরিপ, যার সঙ্গে আধুনিক কালের পারিবারিক আয়-ব্যয় জরিপের তুলনা চলে। ১৯১৬ সালে এই জরিপের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে জ্যাক সাহেব তাঁর দ্য ইকোনমিক লাইফ অব আ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট বইটি রচনা করেন। এ বইয়ে জ্যাক দারিদ্র্যকে তিনটি সুনির্দিষ্ট স্তরে বিভাজন করেন। তাঁর হিসাব অনুযায়ী ১৯১০ সালে ফরিদপুরে ‘চরম দারিদ্র্যে’ বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২০.৭ শতাংশ; এর ঠিক পরই ‘স্বল্প-দারিদ্র্যে’ বাস করত ২৮.২ শতাংশ; আর ৫১.১ শতাংশ ছিল ‘দারিদ্র্যসীমার ওপরে’। অর্থাৎ মোটা দাগে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ১৯১০ সালে দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিল। জ্যাকের জরিপের ৯৫ বছর পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০৫ সালে যে জরিপ চালায়, তাতে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় দারিদ্র্যের মধ্যে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০.৮ শতাংশে। অর্থাৎ ৯৫ বছরে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় দারিদ্র্য কমেছে মাত্র ১০ শতাংশ (শতাব্দীজুড়ে এই সূচকের বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে)।
একুশ শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমার প্রবণতা বেগবান হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ২০১০ সালের অতি সাম্প্রতিক আয়-ব্যয় জরিপেও দেখা যাচ্ছে চরম দারিদ্র্যের প্রবল উপস্থিতি। গোটা দেশের (শহর-গ্রাম মিলিয়ে) মোট ৩২ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশই হচ্ছে চরম দরিদ্র। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের বর্ধিত প্রবাহ, মাইক্রো ফাইন্যান্সের প্রসার, দ্রুত নগরায়ণ—এসব সত্ত্বেও কেন দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠী এখনো থেকে গেল চরম দারিদ্র্যে এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ থেকে গেল দারিদ্র্যের ভেতরে?
আর এসবই হিসাব করা হয়েছে সরলতম প্রয়োজনের সূচকে। যদি গণতান্ত্রিক ভোটে সবার মতামত নিয়ে আমরা দারিদ্র্যসীমা সংজ্ঞায়িত করতাম (অন্তত যে ধরনের পভার্টি-লাইন শ্রীলঙ্কায় বা লাতিন আমেরিকায় চালু, তা যদি এ দেশে ব্যবহার করা হয়), তাহলে দারিদ্র্য-প্রবণতার ক্ষেত্রে শাসকবর্গের আত্মতুষ্টির সাম্প্রতিক চিত্র অনেকখানি বদলে যেত। ‘ইকোনমিকস’ শব্দটা যার সূত্রে আমরা প্রাপ্ত, সেই অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল যা বলেছিলেন তা মোটা দাগে এই, ‘কেন সমাজের একদল মানুষ সুসংস্কৃত জীবন যাপন করবে, আর অন্য একদল মানুষ উদয়াস্ত কায়িক শ্রমে নিজেদের জীবনীশক্তি ধ্বংস করবে—এটি হচ্ছে অর্থশাস্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন।’ পাঠক, লক্ষ করবেন, প্রশ্নটা ক্যাপিটাল গ্রন্থের লেখক মার্কস করছেন না, করছেন নব্য-ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্রের প্রবক্তা প্রিন্সিপলস অব ইকোনমিকস-এর মার্শাল সাহেব।

৪. নাগরিক অধিকারের ভাষা
দারিদ্র্য, বিশেষত চরম দারিদ্র্য, এ দেশ থেকে সহজে মুছে যাবে না, বা আজ কমে এলেও কোনো আকস্মিক বা প্রত্যাশিত দুর্বিপাকে দারিদ্র্য আবারও বেড়ে যেতে পারে। এর কারণ, আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্র এখনো ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলছে না। চরম দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকরী সামাজিক নিরাপত্তা চাওয়া প্রজাকুলের পক্ষ থেকে কোনো সকাতর আবেদন নয়; এটা পাওয়া নাগরিক হিসেবে তার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার।
সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, দেশে এরই মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ রকম বিচিত্রবিধ ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী’ চালু হয়েছে। এবং এ বাবদ মোট সরকারি ব্যয়ের (রাজস্ব/উন্নয়ন মিলিয়ে) প্রায় ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। মূল সমস্যাটা ধরা পড়ে মাথাপিছু বরাদ্দের হার বিবেচনায় নিলে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রী বৃত্তি, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি—এসব কর্মসূচিতে প্রতিমাসে সুবিধাভোগী-পিছু যে টাকা (৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মাসে) দেওয়া হয়, তা কেবল দুই বা তিন দিনের কৃষিমজুরির সমান। এই অর্থ এতই নগণ্য যে একে ‘টোকেনিজম’ বা লোক দেখানো কর্মসূচি বললে অত্যুক্তি হয় না। ফলে এসব কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে দারিদ্র্যসীমা পেরোনো যায় না। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তর থেকে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের ঝরে পড়াও বন্ধ করা যায় না। মঙ্গা এলাকায় ১০০ বা ৮০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পে কাজ করে যেটুকু আয় হয়, তাতে করে দারিদ্র্যসীমার অর্ধেক পথও পাড়ি দেওয়া যায় না। কিন্তু এসব কর্মসূচিতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়াতে গেলে বর্তমান রাজস্ব কাঠামোয় তা অর্জন করা দুরূহ। এর জন্য বিত্তবান শ্রেণীর ওপর করারোপ করে নতুন সম্পদ আহরণ করা প্রয়োজন। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের কর-রাজস্বের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ১০-১১ শতাংশ। এই হার যদি আরও ২-৩ শতাংশ বাড়ানো যেত (দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদেরই কর-জিডিপি অনুপাত সর্বনিম্নে) এবং আহরিত বাড়তি সম্পদটুকুর পুরোটাই যদি সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে আসত, তাহলে আরও দ্রুত হারে আমরা চরম দারিদ্র্য মুছে ফেলতে পারতাম। যে দেশে বণ্টনমূলক ভূমি-সংস্কার করার অবকাশ সীমিত, সে দেশে বিত্তশালী শ্রেণীর ওপর বর্ধিত করারোপের মাধ্যমেই কেবল পুনর্বণ্টনমূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এখানেই তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার হতে পারত। অন্তত তাই প্রত্যাশিত ছিল ‘দিনবদলের সরকার’-এর কাছ থেকে।
কিন্তু আমরা সেদিকে অগ্রসর হইনি, বরং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে যেসব বৃহৎ বিনিয়োগকারী সমবেতভাবে দুই-তিন হাজার কোটি টাকার বেশি (অনুমানে বলছি) লাভ করেছেন, তাঁদের মুনাফার ওপর কর মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে শেয়ারবাজার যখন তেজি হয়ে উঠছিল সেই সূচনাপর্বেই। এবারের বাজেটে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের অধিকারীদের ওপর ১০ শতাংশ সম্পদ-কর সারচার্জ হিসেবে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এই বাড়তি রাজস্ব (যদি আহরিত হয়ও) চরম দরিদ্রদের জন্য ব্যয়িত হবে—এই মর্মে কোনো প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত নেই। বলা হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্তমানে যা ব্যয় করা হচ্ছে, তা জিডিপির আড়াই শতাংশ এবং এই অর্থ প্রকৃত গরিবদের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না, তা জানার জন্য জাতীয় পর্যায়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সহায়তায় চরম দরিদ্রদের ওপর ‘ন্যাশনাল ডেটাবেইস’ তৈরি করা হবে। অথচ প্রায় একই সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দেশে কালোটাকার মোট পরিমাণ জিডিপির ৮১ শতাংশ (সর্বোচ্চ হিসাব) অথবা ন্যূনপক্ষে ৪২ শতাংশ (সর্বনিম্ন হিসাব)। এই কালোটাকার বণ্টনের ওপর জাতীয় পর্যায়ে কোনো জরিপ নেই, নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে না। বর্তমান রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশে তা জানারও উপায় নেই। যেমন জানার উপায় নেই গত দুই দশকে আর্থিক খাত থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে ধনিক গোষ্ঠীর ‘লুটপাটের কাহিনি’ (আশির দশকে একতা পত্রিকায় এ নিয়ে একবার কিছু তথ্য বেরিয়েছিল)। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর দোহাই দিয়ে আজ আড়াল করে রাখা হচ্ছে গণতন্ত্রের দুই দশকে প্রাথমিক পুঁজি আহরণের ‘দ্বিতীয়’ পর্যায়কে, যা স্বৈরতন্ত্রের অধীনে ‘প্রথম’ পর্যায়ের লুণ্ঠনের চেয়ে আরও সর্বগ্রাসী লুণ্ঠনের চিত্রকে তুলে ধরতে পারত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধভাবে ভূমি দখল, জলাশয় দখল, বনজ সম্পদ দখলের মধ্য দিয়ে পুঁজি আহরণের আরও নানা সূত্র। বাংলাদেশে ‘এলিট প্রবৃদ্ধি’ নিয়ে আমরা কোনো গবেষণাই হাতে নিতে পারিনি।
দারিদ্র্য থেকে উত্থান যদি নাগরিক অধিকার হয়ে থাকে, তাহলে অধিকারের ভাষাতেই ভবিষ্যতে নাগরিক সমাজকে কথা বলতে হবে। রক্ষণশীল অর্থশাস্ত্রের একটি মতে, দারিদ্র্যকে এখনো কেবল ব্যক্তিগত দায়দায়িত্বের বিষয় হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। এতে সমাজ, রাষ্ট্র ভূমিকা রাখে অত্যন্ত পরোক্ষভাবে। এই মতের সঙ্গে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক অধিকার ধারণার নিরন্তর বিরোধ রয়ে গেছে। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ‘সর্বজনীনতা’র যে উত্থান আমরা এ দেশে (ও ইউরোপে) দেখেছি, এর একমাত্র যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও সর্বজনীন অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া। এর মানে দাঁড়ায়, এক দেশে দুই অর্থনীতি ও দুই সমাজ চলতে পারে না। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেখানে যা যা ঘটবে, তার শুরুর বিন্দু এই ভাবনার সূত্রে গাঁথা। একেই আমরা ‘তৃতীয় ইউটোপিয়া’ বলছি। এর সম্ভাব্য আশু কর্মসূচি হতে পারে এ রকম।
দরিদ্রদের ওপরে ওঠা নিশ্চিত করতে হলে বিশেষত বংশানুক্রমিক ধরে চলা চরম দারিদ্র্যকে দূর করতে হলে উচ্চশিক্ষায়, আধুনিক খাতের কর্মসংস্থানে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে এদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে। এক, উন্নত মানের প্রতিটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত করতে হবে এবং তার সুফল যেন দরিদ্র জনগোষ্ঠী পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণত, সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুল, সানবিমস স্কুল, হলিক্রস বা নটর ডেম কলেজের মতো এলিট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ সিট তোলা থাকবে চরম দরিদ্র ও দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য। ভারতে ইতিমধ্যেই এলিট স্কুলগুলোর ২৫ শতাংশ সিট গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। এতে করে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা উন্নত শিক্ষার সুযোগ পেয়ে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মতোই অধিক আয় ও সম্মানের পেশায় যেতে পারবে। দুই, দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা খাসজমির ওপর চরম দরিদ্র গোষ্ঠীর প্রাথমিক অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অকৃষি খাতে ব্যবহারের কারণ দেখিয়ে সরকারি খাসজমিকে বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়ার প্রথা বন্ধ করতে হবে। তিন, দেশের সব নাগরিকের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য-বিমা চালু করার অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার দিয়ে চরম দরিদ্র ও দরিদ্র পরিবারের জন্য অবিলম্বে স্বাস্থ্য-বিমা ও পুষ্টি কর্মসূচি চালু করতে হবে। চার, শুধু মঙ্গা মৌসুমে নয়, বছরের সব মৌসুমে গ্রামে কর্মনিশ্চয়তার কর্মসূচি চালু করতে হবে। পাঁচ, গরিব পরিবারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রীদের জন্য বিশেষ আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। ছয়, গ্রামে যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে, তা শহরের দরিদ্র পরিবারের জন্যও প্রসারিত করা চাই। সাত, চরম দরিদ্রদের জন্য পাইলট পর্যায়ে যেসব ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ইতিমধ্যে সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে, তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। আট, গ্রাম ও পৌরসভা এলাকার স্থানীয় সরকার কাঠামোকে আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে জোরদার করতে হবে, যাতে এসব কাঠামো জনগণের কাছে থেকে তাদের দৈনন্দিনের সমস্যা সমাধানে সরাসরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। জাতীয় বাজেটের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে বছরে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া যায়, যাতে এই অর্থ স্থানীয় সমস্যা সমাধানে ব্যবহূত হতে পারে। নয়, এসব উদ্যোগের জন্য যে বাড়তি সম্পদ জোগান করতে হবে, তার জন্য বিত্তশালী শ্রেণীর আয় ও সম্পদের ওপর বর্ধিত করারোপ করার কোনো বিকল্প নেই। অতিরিক্ত জোগানকৃত অর্থ চরম দরিদ্রদের জন্য সামাজিক তহবিল সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সম্পূরক আমদানি শুল্কের অংশ হিসেবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তহবিলের জন্য ‘সারচার্জ’ বসানো হয়ে থাকে। এ রকম ব্যবস্থা আমাদের দেশেও নেওয়া যায়। দশ, মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রতিহত করার জন্য গরিব ও ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীকে সারা দেশে আরও ব্যাপক সরকারি ও এনজিও সহায়তা দিয়ে ‘লিগ্যাল এইড’ কার্যক্রম চালু করতে হবে, যাতে তারা বর্তমান নিঃসহায় অবস্থা থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারে। পরিবেশবিরোধী কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও আরও সক্রিয় আইনি প্রতিরোধ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকেও আরও স্বাধীনভাবে কাজ করার পাশাপাশি গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এবং এগারো, গরিবদের জন্য যেসব সামাজিক, উন্নয়নমূলক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে—যাদের দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত—তাদের ভূমিকাকে আরও কার্যকর, স্বচ্ছ, বাধামুক্ত ও বেগবান করতে হবে। এই নতুন ‘১১ দফা’ একটি উদাহরণ মাত্র। এর সঙ্গে আরও অনেক করণীয় যুক্ত হতে হবে।
এসবই যেকোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হারে বাস্তবায়নযোগ্য স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক অধিকারের চৌহদ্দিরও সম্প্রসারণ ঘটবে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোয় ও চলতি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দরিদ্র ও চরম-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে এসব দাবির স্বীকৃতি মেলা সহজ নয়। এসব দাবির পক্ষে সাংবিধানিক ও আইনি স্বীকৃতি আদায়ের এবং তা বাস্তবায়নের জন্য দলনির্বিশেষে নাগরিক (রাজনৈতিক-সামাজিক) সমাবেশ-আন্দোলন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশে বিবদমান দুই রাজনৈতিক পরাশক্তির দৃষ্টি, অন্যদিকে নাগরিকদের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণসাধন তাদের লক্ষ্য নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যে বসন্ত এসেছে, ভবিষ্যতে তা আমাদের দেশেও আসতে বাকি।
বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক, গবেষণা পরিচালক বিআইডিএস।

ইস্তাম্বুল সিম্ফোনি: নাজিম হিকমতের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ :বিনায়ক সেন
“তুমি বলেছিলে :’যদি ওরা তোমাকে মেরে ফেলে আমি বাঁচব না!’ কিন্তু তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা আমার, বাতাসে কালো ধোঁয়ার মতো মুছে যাবে আমার স্মৃতিগুলো। [কেননা] বিংশ শতকে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।” এই লাইন ক’টি যার লেখা তিনিই তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত।

বেট্রল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, জর্জি আমাদু, পাবলো পিকাসো, ইলিয়া এরেনবুর্গ, পল রোবসন, ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর প্রিয় কবির সারিতে ছিল নাজিম হিকমতের নাম। নাজিমের একটি কবিতা এভাবে আশা প্রকাশ করেছে :’আমি মরতে চাই না, কিন্তু যদি মৃত্যু আসে, তবু আমি বেঁচে থাকব তোমাদের মাঝে, আমি বেঁচে থাকব আরাগঁর কবিতায়, তার ঠিক সেই লাইনটিতে যেখানে সে আসন্ন সুখের দিনগুলোর কথা লিখেছে। আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আর রোবসনের গানে’। ১৯৫০ সালে নেরুদা এই বলে তাকে সম্মানিত করেছিলেন :’নাজিমের কবিতায় সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে’।

চিরটা কাল বামপন্থার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু ভিন্ন ধরনের বামপন্থি ছিলেন তিনি। স্তালিনকে ঘিরে ব্যক্তি-পূজার নিন্দা করেছিলেন স্তালিনের জীবদ্দশাতেই খোদ মস্কোতে বসেই। স্তালিনের গোয়েন্দা দফতরের প্রধান বেরিয়ার গুপ্তচরেরা তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকত_ এ কথা ইয়েভতুশেঙ্কো জানিয়েছেন ‘রোমান্টিক কম্যুনিস্ট’ বইয়ের ভূমিকায়। পূর্ব-পশ্চিম সব মহাদেশ থেকে কবিতার উপকরণ আহরণ করেছেন তিনি। তার প্রিয় তিনজন কবি ছিলেন তিন ভিন্ন ভুবনের। তুরস্কের সূফী-সন্ত জালালুদ্দিন রুমি, ফরাসি আধুনিকতার শার্ল বোদলেয়ার, আর রুশ বিপ্লবের ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। যদিও নাজিম বলবেন, এরা আসলে এক ভূগোলেরই অধিবাসী_ তিনজনই তাদের কালের মানবচিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘মানবের মানচিত্র’ নামে পরবর্তীতে নাজিম নিজেই লিখেন একটি মহাকাব্য যা এখনও বাংলায় অনূদিত হতে বাকি।

বামপন্থার আদর্শের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে নাজিমকে তুরস্কের সরকার বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৫৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। পুরো মেয়াদ অবশ্য কারাবাসে থাকতে হয়নি কবিকে। প্রকৃতপক্ষে ১৭ বছর জেলে ছিলেন তিনি। এর আবার ১৩ বছর ছিল বিরতিহীন_ ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫১ সাল অব্দি। জেল পর্ব ছিল তার লেখার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্ব। ১৯৩৮ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সামরিক একাডেমীর ক্যাডেটদের উস্কে দিয়েছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সেসব ক্যাডেট নাকি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল! জ্যাঁ পল সার্ত্রে, পাবলো পিকাসো, ত্রিস্তান জারা তার মুক্তির জন্য বিশ্ব-জনমত গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জনমতের চাপে ছাড়া পেলেন ঠিকই, কিন্তু দেশে থাকতে পারলেন না বাদবাকি জীবন। ১৯৫১ সালেই তাকে যেতে হলো নির্বাসনে। সেই কারণটা জানা গেল ২০০৬ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তুরস্কের ওরহান পামুকের সুবাদে।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে পামুক শুধু একদিনের জন্য ইস্তাম্বুলের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের সম্পাদক হলেন। জার্নালিজমের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু এর আগে কখনও সরাসরি সাংবাদিকতায় আসেননি। সম্পাদক হয়ে রোববারের প্রথম পাতাজুড়ে প্রকাশ করলেন একজনের ছবি। ছবির নিচে লেখা_ ‘থুথু ফেলো এতে’। ছবিটা কবি নাজিম হিকমতের। ১৯৫১ সালে তুরস্কের সরকারি কাগজগুলো এভাবেই নাজিমের ছবি ছাপিয়ে জনগণকে উস্কানি দিয়েছিল ছবিটাকে ঘৃণা করতে। দৃশ্যত নাজিমের অপরাধ ছিল দুটি। প্রথম অপরাধ, ১৯১৫ সালে আরমেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য [যার দায় তুরস্কের সরকার এখনও স্বীকার করেনি] তিনি জনগণের হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় অপরাধ, কুর্দিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। পামুক তার সম্পাদকীয়তে আরও লিখলেন, ‘সেই ১৯৫১ সাল থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিকের সম্পর্কটা [নাজিমের বিরুদ্ধে ৫০ বছর আগে যেমন ছিল] তেমনই রয়ে গেছে।’

নাজিমের কবিতায় রাষ্ট্রের কাছে ঘা-খাওয়া এক শান্ত, গর্বিত এবং লড়াকু মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার কথা পাওয়া যায়। কিন্তু তার কবিতার প্রধান সুর বিষণ্ন। তিনি অপেক্ষা করে থাকেন সেই দিনের মুখ চেয়ে, যেখানে প্রতিটা মানুষ বেড়ে উঠবে ‘বৃক্ষের মতো একা স্বাধীন সত্তা নিয়ে, কিন্তু থাকবে অরণ্যের যৌথ চেতনায়।’ ১৯০২ সালে তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয় নাজিম হিকমতের জন্ম। যেখানে জন্ম সেখানে আর ফেরা হয়নি কোনদিন। বলতেনও_ ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না’। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন জেলে থাকতেই। কিন্তু বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন আরও অনেক বছর। তার জেল পর্বের একটি কবিতা বলেছিল :’আমরা ভেঙে পড়ব না, শত্রুদের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্যে হলেও অতিরিক্ত একটি দিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।’ ১৯৬৩ সালে মস্কোয় এক রোদেলা সকালে বেরিয়েছেন প্রতিদিনের মতো দৈনিক খবরের কাগজ আনতে। বাসার সামনেই চিঠিপত্র রাখার বাক্স। কাগজটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়লেন।

এর বছর দুই আগে, ১৯৬১ সালে নিজের এক সংক্ষিপ্ত জীবনী বলে গিয়েছিলেন তিনি কবিতার আকারে। কন্সতান্তিন সিমোনভ থেকে এডোয়ার্ড হির্শ_ সবাই বলবেন, এটিও নাজিমের বিস্ময়কর রচনাশৈলীর একটি উদাহরণ। পাবলো নেরুদার মতো নাজিম হিকমত কোনো বিশদ আত্মস্মৃতি রেখে যাননি তার ঘটনাবহুল জীবনের ওপর। অবশ্য অন্যরা পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে লিখবেন। যেমন বের হবে ঔপন্যাসিক ওরহান কেমালের ‘নাজিম হিকমতের সাথে জেলে’ বা তার পত্নী পিরাইয়ের সঙ্গে পত্রালাপ। তারপরও নাজিমের কবিতাই হবে তার সবচেয়ে অনুপ্রাণিত জীবনী, এবং একই সঙ্গে তার সময়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্মৃতিকথা।

এ রকম কিছু কবিতা এখানে [যার কয়েকটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি] রুশ ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে নতুনভাবে ভাষান্তর করা হলো বাংলায়।

কাঁটাতারের দেয়াল

বিনায়ক সেন | তারিখ: ০৭-০৯-২০১১

ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা বিষয়ে গোড়া থেকেই বাংলাদেশের জনমনে তিনটি মূল অভিযোগ ক্রিয়াশীল ছিল। প্রথমত, দুই বন্ধুসুলভ প্রতিবেশীর মধ্যে ভৌগোলিক কাঁটাতারের বেড়া থাকা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, দূর ঐতিহাসিক কাল থেকেই যারা প্রতিবেশী, তাদের মধ্যে মানসিক কাঁটাতারও থাকা উচিত নয়। এই কাঁটাতার যে আছে, তার বড় প্রমাণ বাংলাদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতবর্ষে প্রচারিত হতে না দেওয়া। এটা দেওয়া হয় না ওপরের নির্দেশেই। তৃতীয়ত, এর আগে পানি চুক্তি, দক্ষিণ বেরুবাড়ীর বিনিময়ে তিনবিঘা করিডর দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা-ও রক্ষিত হয়নি। এমনকি সাম্প্রতিক কালে সীমান্ত হত্যা বন্ধে রাবার বুলেটের প্রতিশ্রুতিও তারা রক্ষা করেনি।

ফলে এবারও যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি পালন করবে, তার ভরসা কী? ’৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর (র‌্যাটিফাই) করলেও ভারতীয় পার্লামেন্ট অদ্যাবধি তা অনুস্বাক্ষর করেনি। তিনবিঘা করিডরের অধিকারের বদলে তারা দিচ্ছে কেবল ২৪ ঘণ্টা ব্যবহারের সুযোগ। এ রকম উদাহরণ অজস্র।

বাংলাদেশ সরকারের তরফে বলা হচ্ছিল, ট্রানজিট ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত ভারতের চাহিদা বাংলাদেশ মেনে নিলে ভারতীয় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে আমাদের পণ্যের ওপরে আরোপিত অশুল্ক সব বাধা দূর করা হবে, অথবা অভিন্ন নদীতে ন্যায্য পানির হিস্যা পাব। অতীতের অভিজ্ঞতা মনে রাখলে এ ব্যাপারে আশঙ্কা রয়েই যায়। সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিটি ভেস্তে গেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের জনগণ মোটেই বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হয় না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেন্দ্র-রাজ্য সরকার মিলিয়ে জটিলতার অজুহাত তুলে যেভাবে আসন্ন চুক্তিস্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গেল, তাতে কার্যত তাদের সদিচ্ছার অভাবই প্রকাশ পেয়েছে। সেই তুলনায় আমাদের সরকারি পক্ষের উপদেষ্টা ও মন্ত্রীসহ যাঁরা এ ব্যাপারে অতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন, তাঁদের আচরণ বাড়াবাড়িই ঠেকেছে।

কলকাতা বন্দর বাঁচানোর অজুহাতে ফারাক্কা বাঁধ করা হলেও বাঁচেনি কলকাতা বন্দর। অথচ আমাদের অনেক নদ-নদী এই বাঁধের কারণে মরে গেছে এবং আরও নদী মৃতপ্রায়। তিস্তা নদীর উজানে ব্যারাজ করা হয়েছে আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই। এখন শেষ মুহূর্তে কেন্দ্র-রাজ্যের বিরোধের কথা তুলে পানি চুক্তি না হতে পারাটা আমাদের চরমভাবে হতাশ করবে বৈকি। এই হতাশার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতেই হয়, আমরা তড়িঘড়ি করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে তাদের প্রবেশাধিকার দিতে চাই না। এ-সংক্রান্ত বিশদ কারিগরি পর্যালোচনাও করা হয়নি। বাংলাদেশের রপ্তানি ৪০ শতাংশ বাড়ায় ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতার ওপর যথেষ্ট চাপ বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এই অবস্থায় মনমোহন সিংয়ের সফর উপলক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে আমাদের প্রয়োজন হিসাব না করেই, বন্দরগুলোর ধারণক্ষমতা আমলে না নিয়েই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। বরং উপযুক্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের পর মংলা বন্দরকেই ট্রানজিটের নৌ-কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

খেয়াল করা দরকার, সড়ক-রেল ও নৌ-ট্রানজিট আলোচনার মধ্যে ভারত শেষ মুহূর্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে, কিন্তু তিস্তা ও তিনবিঘা করিডরের সুষ্ঠু মীমাংসা থেকে তারা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বর্তমান অবস্থায়, ট্রানজিট থেকেও বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ কম। কারণ, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর অর্থনীতি এখনো নাজুক এবং খারাপ রাস্তার কারণে তাদের দিক থেকে বড় আকারের মালামাল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পরিবহনের সুযোগও কম।

অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। মান নিয়ন্ত্রণের নামে কড়াকড়ির জন্য বাংলাদেশের শুকনো খাদ্য, হিমায়িত খাদ্য এবং তৈরি পোশাক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আমাদের ওষুধ ও চামড়াজাত পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারে নানা বাধা সৃষ্টি করেও রেখেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এটাও দেখতে হবে যে ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেল দেখতে দেওয়া এবং সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে, ভারতের দিক থেকে ভৌগোলিক ও মানসিক কাঁটাতার অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত ট্রানজিট দেওয়া হবে চরম বোকামি।

বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ।

Binayak sees no step to cope with prices

Dhaka, June 10: Terming the budget for the next fiscal realistic renowned economist Dr Binayak Sen felt that though there are concrete measures in the budget for internal revenue mobilization, mobilising external resources would be a major challenge for the government. He also said many new taxes were imposed to achieve the internal revenue target. Talking to The Independent on Friday Dr Sen also noted that the budget lacked emphasis on decentralization of the public expenditure which he felt was crucial to address the challenges of budget implementation.

‘At least 10 per cent of the budget should be devolved to the local government” he said.
Focusing on the revenue mobilization measures, he said, many new taxes have been imposed to achieve the internal revenue target.

“Once upon a time the revenue mobilization capacity of the country was poor but the government has made significant development in this sector,” Dr. Sen told The Independent. He felt that though the role of foreign aid was going down with the passage of time, concessional foreign loans played a crucial role in the economy during periods of uncertainty.

In this connection he mentioned that during the fiscal uncertainty in 2007-08, the then government had managed to get concessional foreign loans from the World Bank which helped it to face the crisis.

“FDI is a major source of external resources but one cannot attract FDI overnight as it requires a long time strategy. The governments needs to concentrate on it,” he added.

He also felt that the budget lacked guidelines to cope with the rising prices of commodities. The government needs to formulate a strategy to absorb the shock of the high prices of food, oil and instability in the foreign exchange sector.

Dr. Sen, however, observed that lack of preparedness resulted in the recent crash in the capital market. In this connection he mentioned that former finance minister late Shah ASMA Kibria had an advisory council which used to advise him on economic management on a regular basis but the present government does not have any such council.

‘The government should use the expertise of the economists on a regular basis through such a council,” he suggested adding that such institutional mechanism helped a lot during crisis periods.

Sen proposed an alternative outlook to expedite project implementation by prioritizing seven to eight sectors identifying a few projects under these sectors instead of the present culture of identifying over 800 projects in the budget and then facing non-implementation over 40 percent of these projects.

He further offered a formula to implement at a faster pace by decentralizing the annual development project and allocate Tk 1 crore performance incentive to the newly-elected union parishads which perform well in revenue generation and project implementation.

He proposed that the government should introduce health insurance at the mass level like in neighbouring India where the government contributes the funding but implements it by private companies.

“The government could solve many of the acute problems like nutrition and family planning if it set cross conditionality for the people who are already served by the government under the social safety net,” he suggested.

Explaining his satisfaction over the fast pace in reducing poverty he said, ‘This is our economic strength. If the global shocks like high commodity and high fuel prices, low external assistance were not there, the GDP growth rate could be over 7 to 8 per cent in the current fiscal year.”

প্রবৃদ্ধি নিয়ে একটি সাম্প্রতিক বিতর্ক

তারিখ: ১০-০৬-২০১১

বিশেষভাবে এ বছরের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাড়তি সংশয় জানানোর কোনো কারণ নেই। এ নিয়ে অবশ্য সিপিডিসহ প্রকাশ্যে সংশয় ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। সবকিছুই বলা হচ্ছে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে। বাস্তবতা হলো, যাঁরা বলছেন প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭, আর যাঁরা বলছেন ৬ দশমিক ৩ বা তারও কম—উভয়ের কাছেই পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত নেই। সে উপাত্ত আসবে আরও কয়েক মাস পর, তখন পূর্ণ অর্থবছরের হিসাব পাওয়া যাবে। প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব বর্তমানের প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে তখন বাড়তেও পারে, একই থাকতে পারে, আবার কমতেও পারে। যেমন, ২০০৯-১০-এর প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার বেশি ছিল। তা ছাড়া কেবল এ বছরেই ৬-এর অধিক প্রবৃদ্ধির হার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা তো নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫-০৬-এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৬, ২০০৬-০৭-এ ৬ দশমিক ৪, এমনকি ২০০৭-০৮-এ বিশ্বমন্দার মুখেও প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২। সে হিসাবে যে বছরে রপ্তানি বেড়েছে ৪১ শতাংশ, আমদানির বড় অংশ হচ্ছে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি, কৃষিতে বোরো ধানে বাম্পার ফলন, আমনও খারাপ হয়নি, ক্ষুদ্র ঋণ ও বাণিজ্য ঋণের সম্প্রসারণশীল প্রবাহ ব্যক্তি খাতে গিয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাক্কলিত হয়ে থাকলে এত সংশয়াপন্ন হওয়ার কোনো কারণ ঘটে কি? যা-ই হোক, আবারও বলছি, প্রবৃদ্ধির হার প্রসঙ্গে চূড়ান্ত মীমাংসা করার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমরা বৃক্ষকে দেখতে চেয়ে অরণ্যকে যেন দেখতে ভুলে না যাই। আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের অর্থনীতিতে, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি খাতে গত এক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, বরং তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে ‘রাজনীতি হচ্ছে’ (যা কেউ কেউ বলছেন) এ রকম অভিযোগ তাই ব্যক্ত করা আমার বিচারে সংগত নয়। এতে করে বিবিএসকেও খাটো করা হয়। অথচ ভারতে সিএসও বা পাকিস্তানের এফবিএসের তুলনায় বিবিএস কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই, যাঁরাই ভারতের বা পাকিস্তানের স্টেট জিডিপি বা প্রভিন্সিয়াল জিডিপি উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা জানেন। সর্বোপরি পূর্ববর্তী বছরগুলোয় (বিশেষত সুতীব্র বিশ্বমন্দার ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০-এ) অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল শ্লথতর, অর্থনীতিতে তখন অব্যবহূত ক্যাপাসিটির সৃষ্টি হয়েছিল, এ বছরে এসে তা ব্যবহূত হয়েছে (যে জন্য কাঁচামাল আমদানিও বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে ২০১০-১১তে) সে কারণেও প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে কেন যেখানে বিনিয়োগের অনুপাত তেমন একটা বাড়েনি, সেটা শুধু এ বছরের জন্যই ‘বিশেষভাবে’ বাধা হতে যাবে কেন? বিনিয়োগের অনুপাত তো ২০০২-০৩ সাল থেকেই ২৪ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। সুতরাং এই ধাঁধার রহস্য উন্মোচন করতে গেলে কার্যত ২০০২-০৩ সাল থেকেই প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যে উপাত্ত আমরা পাই, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে এবং সম্যক আলোচনা করতে হবে। শুধু সংশয় প্রকাশ করে ছেড়ে দিলে চলবে না। তা ছাড়া বিনিয়োগের হিসাবও অবমূল্যায়িত হতে পারে, কেননা, এক দশক আগের তুলনায় এখন বিনিয়োগের সিংহভাগ হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এবং এই খাতে বিনিয়োগে গত এক দশকে যে পরিমাণগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে, তা এখনো পরিসংখ্যানে যথাযথভাবে ধরা পড়ছে না।
বিনিয়োগ মোটামুটি একই পর্যায়ে থাকার পরও প্রবৃদ্ধি কেন ২০০২-০৩ সালের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ২০১০-১১ সালের ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে, তার অনেকগুলো ব্যাখ্যা হতে পারে। যদি আমরা হ্যারড-ডোমার সরলীকৃত দুনিয়ার মধ্যেই থাকি (যেখানে সঞ্চয় ও ভৌত বিনিয়োগই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালক), সেই নিরিখেও বলা যেতে পারে যে বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা ২০০২-২০১১ কালপর্বে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়ে থাকবে। বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার প্রধান উৎস ছিল দুটি। প্রথমত, গ্রাম থেকে শহরে দ্রুত হারে স্থানান্তরিত হয়েছে শ্রমশক্তি (২০০১ সালের ২৫ শতাংশের তুলনায় বর্তমানে নগর জনসংখ্যা ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে)। এই রি-লোকেশন অ্যাফেক্টের কারণে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃ িদ্ধ পাওয়ার কথা। গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয়বৈষম্য বৃদ্ধির পেছনে একটা বড় কারণ হলো, গ্রামের তুলনায় শহরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি। শুধু মাত্রায় বেশি নয়, আমার অনুমান, শহরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা গ্রামের তুলনায় আরও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। না হলে এক উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী গত এক দশকে শহরে পাড়ি জমানো সত্ত্বেও নগর-দারিদ্র্য দ্রুত হারে কমে যেত না। কেউ কেউ বলতে পারেন যে গ্রাম থেকে যারা শহরে জড়ো হয়েছে, তারা অধিকাংশই এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, সুতরাং এখানে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে সেই ধারণা কতটা যুক্তিযুক্ত? এ পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শহরে কর্মকাণ্ডে আগের চেয়ে অনেক গতিশীলতা এসেছে, আয় বেড়েছে এবং লক্ষণীয়ভাবে দারিদ্র্য কমেছে। নগর অর্থনীতির ‘আকর্ষণীয় ক্ষমতা’ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো।
দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ অর্থনীতির ভেতরেও বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। আরও উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সেটা যেমন ঘটেছে কৃষি অর্থনীতির ভেতরে (যেমন, বাণিজ্যিক কৃষির বিস্তারে), তেমনি ঘটেছে গ্রামীণ অকৃষি অর্থনীতির ভেতরেও। এই শেষোক্ত ধারার বড় প্রমাণ হচ্ছে, গ্রামীণ অকৃষি অর্থনীতিতে পুঁজির চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। এর পরোক্ষ সমর্থন মেলে মাইক্রো-ফাইন্যান্স খাতে পুঁজির বর্ধিত জোগানের জন্য একই ব্যক্তির নানা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ (মাল্টিপল লোন) নেওয়ার প্রবণতায়। এ ধরনের ঋণের ৮০ শতাংশই নেওয়া হয়েছে আরও বেশি করে পুঁজি সংগ্রহের জন্য। তার মানে, গ্রামে মাথাপিছু পুঁজির পরিমাণ বেড়েছে এবং তা বেড়েছে আরও বেশি করে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যাওয়ার কারণে। গ্রামে এখন মজুরি-শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে এবং এক হিসাবে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত মজুরি-শ্রমিকের সংখ্যা গ্রামের মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। পারিবারিক শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে মজুরি-শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কারণে গ্রামের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। এতে করে প্রবৃদ্ধিও বাড়ার কথা বিনিয়োগের সামগ্রিক অনুপাত একরূপ থাকা সত্ত্বেও।
২০০২-২০১১ কালপর্বে প্রবৃদ্ধির উত্তরোত্তর বাড়ার পেছনে শ্রমশক্তির বর্ধিত নিয়োজনও অনেকাংশে কাজ করে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। যেসব নারী আগে ‘ঘর-গৃহস্থালির’ অর্থনীতিতে আটকে থাকতেন, তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন সরাসরি শ্রমের বাজারে অংশ নিচ্ছেন। এক দশক আগেও শ্রমের বাজারে নারীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ১৫-২০ শতাংশ, এ হার এখন ৩০-৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কৃষিতে ও অকৃষিতে, ক্ষুদ্র ঋণের (ও কিছুটা বাণিজ্যিক ঋণের) সম্প্রসারণে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে এটা হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশই শ্রমঘন কাজে নিয়োজিত, ফলে বিনিয়োগের অনুপাত একই থাকলেও শুধু নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের কারণেই প্রবৃদ্ধি বেশ কিছুটা বাড়ার কথা। এ ধারা আরও বেগবান করা গেলে (পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় এ হার ৭০-৮০ শতাংশ) এ দেশের প্রবৃদ্ধির হার ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজি সঞ্চয়ের বর্ধমান প্রবণতা, শ্রমবাজারে নারীর উত্তরোত্তর অংশগ্রহণ এসব প্রবৃদ্ধির ‘সরবরাহগত’ দিককে নির্দেশ করে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়ার ক্ষেত্রে ‘চাহিদাগত’ দিকও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আলোচনায় প্রায়ই আসে না সেটা হলো, এক দশক ধরে দ্রুত হারে দারিদ্র্য কমে যাওয়ার ধারা এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হারকেও বাড়িয়ে থাকবে। গোড়ার পর্বের দারিদ্র্য অবস্থা নিরসনের সঙ্গে পরবর্তী প্রবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে, সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে এটা সুস্পষ্ট। আমাদের দেশে দুই দশক ধরেই দারিদ্র্য কমছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় আমলেই কমেছে। কিন্তু দারিদ্র্য বিশেষভাবে কমেছে ২০০০-২০১০ কালপর্বে (সেটা ২০০০, ২০০৫, ২০১০ সালের দারিদ্র্য-উপাত্ত বিচার করলেই দেখা যায়)। দারিদ্র্য অব্যাহতভাবে কমার অর্থ গ্রামীণ বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্রয়ক্ষমতা এসেছে। এই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে কৃষি, কৃষিজাত শিল্প, অকৃষি পণ্য ও সেবা খাতগুলোর সম্প্রসারণ ঘটেছে সুদূর গ্রামাঞ্চলেও। ফলে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় উত্তরোত্তর বর্ধমান ‘অভ্যন্তরীণ ভোগ’ (ডমেস্টিক কনসাম্পশন) প্রবৃদ্ধির এক নতুন নিয়ামকে পরিণত হচ্ছে। এ কথা এক দশক আগেও অতটা খাটত না। অর্থাৎ এই নিরিখেও আমরা দেখছি যে বিনিয়োগের অনুপাত একই থাকলেও বর্ধিত ভোগের কারণেও প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে রপ্তানি ও প্রবাসী-আয়ের পাশাপাশি ‘স্থানীয় বাজার’-এর সম্প্রসারণ আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
কিন্তু আমরা কেবল হ্যারড-ডোমার দুনিয়াতেই আবদ্ধ নেই এবং শুধু সরলীকৃত হ্যারড-ডোমার সমীকরণের নিরিখেই প্রবৃদ্ধিকে বিচার করলে চলবে কেন। ভৌত বিনিয়োগ ছাড়াও প্রবৃদ্ধির আরও দুটো প্রধান নিয়ামক হলো মানব-পুঁজির (হিউম্যান ক্যাপিটাল) গঠন ও প্রযুক্তিগত বিকাশ। মানব-পুঁজি গঠনে (শিক্ষার বিস্তারে যেমন) ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যে বিনিয়োগ হয়েছে, তার সুফল আমাদের এখন পেতে শুরু করার কথা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেসরকারি খাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। দুই দশক আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার যেখানে ছিল ৪০-৫০ শতাংশ, এখন তা ৭০-৮০ শতাংশ। গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের পাসের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও গুণগত মানকে আগের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই শ্রমশক্তির শিক্ষাগত মাত্রা বেড়েছে, আধাদক্ষ ও দক্ষ শ্রমশক্তির অনুপাত বেড়েছে, যার শুভ প্রভাব পড়তে বাধ্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সেই সূত্রে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির ওপরও।
ধীরলয়ে হলেও প্রযুক্তিগত উন্নতির বিশিষ্ট অবদান (যা ধরা পড়ে ‘টোটাল ফ্যাক্টর প্রডাক্টিভিটির পরিসংখ্যানে) বিভিন্ন খাতওয়ারি প্রবৃদ্ধির মধ্যে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। কৃষকেরা উন্নত বীজ ব্যবহার করছেন (শুধু উফশী ধান নয়, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও); শিল্প ও নির্মাণ খাতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে; সুদূর গ্রামেও মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে তথা বিনিয়োগ সহজতর হচ্ছে। সুতরাং প্রবৃদ্ধির হার বিচারের ক্ষেত্রে একপেশেভাবে শুধু বিনিয়োগের অনুপাতের দিকে তাকানো অসংগত।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করছে। এর প্রস্তুতি কয়েক বছর ধরেই (২০০৪-০৫ সালের পর থেকেই) চলছিল। এই কৃতিত্ব যেমন বিএনপির, তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বর্তমান সরকারের অংশেও কিছুটা বর্তায়। প্রবৃদ্ধির হার বেগবান হলে দারিদ্র্য আরও দ্রুত হারে কমে আসবে, এ নিয়েও বিতর্ক নেই। কিন্তু যে প্রশ্ন এখানে তোলা যায় সেটা হলো, প্রবৃদ্ধির চরিত্র নিয়ে। যেকোনো প্রবৃদ্ধিই সমান হারে দারিদ্র্য কমায় না। না হলে গ্রোথ কমিশনের মতো এত র্যাডিক্যাল নয় এমন কমিশনও ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ আর ‘কনভেনশনাল গ্রোথ’-এর মধ্যে পার্থক্য টানত না। বাংলাদেশের জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধির কৌশল রচনায় একটা বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করছে কি না। আমাদের আয় বাড়ছে, কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে কি না পরিবেশদূষণ, পাবলিক স্পেসের (যেমন—নদী, জলাশয়, পার্ক, উন্মুক্ত ময়দান) ক্রমবিলুপ্তি এবং তীব্র যানজটের কারণে। তাই আমাদের জন্য শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয়, আরও জানা প্রয়োজন ‘গ্রিন জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি কতটা হচ্ছে। পরিবেশ-বিধ্বংসী প্রবৃদ্ধি কেবল পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর তা নয়, অর্থনৈতিক সাম্যের জন্যও ক্ষতিকর। পরিবেশ ধ্বংস করে যাঁরা নতুন প্রবৃদ্ধির জন্ম দিচ্ছেন (তুরাগ নদ বা বুড়িগঙ্গা ভরাট করে নির্মাণ প্রকল্প করলে তা এক হিসেবে ‘নতুন প্রবৃদ্ধি’, অন্য হিসেবে পরিবেশের সর্বনাশ), এসব বিনিয়োগকারীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সুশাসনের দুর্বলতার জন্য। এসব বিনিয়োগকারীর মুনাফার একটা বড় অংশ কর ফাঁকি দেওয়া অর্থ, যা সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। এসব বিনিয়োগকারীর ওপর পরিবেশের ক্ষতি করার জন্য নিদেনপক্ষে বাড়তি কর (এনভায়রনমেন্টাল ট্যাক্স) আরোপ করা উচিত। কেননা, পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির ভুক্তভোগী সবাই—ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব-নির্বিশেষে। পরিবেশ-সহনশীল বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রয়োজন। বর্তমান বাজেটের ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করব ‘জনগণতান্ত্রিক’ সমন্বিত পাবলিক র্যাপিড ও মাস ট্রানজিটের গুরুত্বের কথা। আমাদের বিদ্যমান রেলপথ, জলপথ ও সড়কপথ (যা আছে তাকে ব্যবহার করে বা এর কিছুটা পরিমার্জনা করে) আমাদের নতুন করে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। যেসব ভাবনা ইতিমধ্যেই পরিবহন-অর্থনীতিবিদেরা করেছেন বৃহৎ ও মাঝারি আকারের শহরগুলোর জন্য, তা এখনই বাস্তবায়নে নিয়ে আসতে হবে। এদিকে বাজেট কিছুটা হলেও দৃষ্টি দেবে, এ আশা করছি।
ড. বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

নাজিম হিকমতের কবিতা: পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব, ঝরাপাতা

তারিখ: ০৩-০৬-২০১১

পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব
তুমি মাকড়সার মতো, ভাই আমার,
অন্ধকারের আড়ালে বেঁচে আছো
ভীতু মাকড়সার মতো।
তুমি চড়ুইয়ের মতো, ভাই আমার,
ছোট্ট ডানা মেলে এদিক-ওদিক
অস্থির চড়ুইয়ের মতো।
তুমি শামুকের মতো, ভাই আমার,
নিজের মধ্যে তৃপ্ত
গুটানো শামুকের মতো।
তুমি সব সময় এক অজানা আশঙ্কায়, ভাই আমার,
যেন কোনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে
তোমার নিত্য বসবাস।

তুমি একা নও এমন, তোমার মতন যারা
সংখ্যায় তারা পাঁচ-দশ নয়—লাখ লাখ
দুঃখজনক, কিন্তু সত্যি।
তুমি ভেড়ার মতো, ভাই আমার,
কেউ তোমাকে লাঠি দেখালে
দ্রুত দলের মধ্যে ভিড়ে যাও
আর যখন ছুটতে থাকো কসাইখানার দিকে
তখনো মুখে বেশ একটা গর্বের ভাব।
এ জন্যেই বলছি, তুমি হলে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব
মাছেদের চেয়েও অদ্ভুত
যারা জলের বাইরের সমুদ্রকে দেখতে পায় না।
জগ জোড়া যে-অত্যাচার চলছে
তা আসলে হচ্ছে তোমারই কারণে।
আমরা যদি এখনো অভুক্ত থাকি, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ি,
রক্তে ভেসে যাই,
আমাদের যদি এরপরও আঙুলের মতো পিষে-দলে
ওরা মদিরা বানায়
তাহলে এর জন্যে দায়ী হচ্ছো
তুমি—
এ কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে ঠিকই,
কিন্তু এসবের অধিকাংশ দায়, ভাই আমার,
কেবল তোমার একার।

ঝরাপাতা
আমি পাতা ঝরার কথা পেয়েছি পঞ্চাশ হাজার কবিতায়
উপন্যাসে লেখায়
আমি পাতা ঝরার ছবি দেখেছি পঞ্চাশ হাজার সিনেমার দৃশ্যে
পাতা ঝরতেও দেখেছি পঞ্চাশ হাজার বার
এলোমেলো উড়তে ফিরতে পচে যেতে
আমার পায়ের তলায় করতলে আঙুলে মচমচ শব্দ তুলে
পঞ্চাশ হাজার বার ওদের মৃত্যু আমাকে দেখতে হয়েছে
তার পরও পাতা ঝরার দৃশ্যে আমি আলোড়িত না হয়ে পারি না
বিশেষ করে ওরা যখন ঝরতে থাকে বুলেভার্দে
বিশেষ করে যখন ঝরতে থাকে চেস্টনাট গাছের পাতারা
তার ওপর যদি শিশুরা ভিড় জমায় চারপাশে
তার ওপর যদি রোদ ওঠে সেদিন
কোনো বন্ধুর ভালো খবর পাই
আর সেদিন যদি বুকের অসুখটা দেখা না দ্যায়
যদি বুঝতে পারি আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে যায়নি
বিশেষ করে আমার চারপাশের মানুষকে ভালো থাকতে দেখি
ঝরা পাতার দৃশ্যে আমি আলোড়িত না হয়ে পারি না
বিশেষ করে ওরা যখন ঝরে পড়তে থাকে বুলেভার্দে
বিশেষ করে যখন ঝরতে থাকে
চেস্টনাট গাছের পাতারা
অনুবাদ: বিনায়ক সেন