দারিদ্র্য কমলেও আয়-বৈষম্য বাড়ছে

সমকাল প্রতিবেদক
শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে দারিদ্র্য কমেছে। এটি গর্বের বিষয় হলেও আত্মতুষ্টির কিছু নেই। কেননা দারিদ্র্য হ্রাসের পাশাপাশি ধনী-গরিবের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। শহর এবং গ্রামে উভয় ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। মূলত সম্পদের অসম বণ্টন ও অবৈধ আয়ের উৎসের কারণে আয় বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন তারা। ‘দারিদ্র্য বিমোচন : কোথায় আমাদের অবস্থান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খোন্দকার। প্যানেল আলোচকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি মনোয়ার হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু কাওসার। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিই আমাদের উন্নয়নের প্রধান বাধা। দুর্নীতিকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতি কমাতে পারলে জনগণ উন্নয়নের সুফল আরও বেশি পেত। প্রায় তিন ঘণ্টার প্রাণবন্ত আলোচনায় দারিদ্র্যের কারণ এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে হলে আয় বৈষম্য কমাতে হবে। কারণ আয় বৈষম্য থেকে দারিদ্র্যের উৎপত্তি। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ার পেছনে কারণগুলো তুলে ধরেন বক্তারা।

তারা বলেন, প্রভাবশালীরা জমি দখল, জলাশয় দখল করে সম্পদ তৈরি করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। এসব অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীদের সম্পদ আরও বাড়ছে। অথচ গরিবের কাজের সুযোগ নেই, শিক্ষা নেই, ফসল উৎপাদন করলেও ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, ব্যাংক থেকে ঋণের সুযোগও তাদের নেই। ফলে দরিদ্র মানুষগুলোর জীবনের পরিবর্তন হচ্ছে না। দারিদ্র্য দূর করতে উৎপাদনমুখী কাজে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তারা।

পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খোন্দকার অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, গুলশান ক্লাবে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। যারা জুয়া খেলার পেছনে কোটি টাকা খরচ করে বুঝতে হবে তারা কত বড়লোক। তিনি বলেন, দারিদ্র্য মাপার বিষয় নয়, এটি অনুধাবনের বিষয়। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা অনুধাবন করা গেলে সত্যিকার অর্থে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। মন্ত্রী বলেন, ২০০৫ সালের তুলনায় দারিদ্র্য আরও কমেছে। শিগগির এ ঘোষণা দেওয়া হবে।

ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব এখনও প্রকাশ করা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়াতে পারে ৩২ শতাংশ। যদি তাই হয় তাহলে দুই বছরে কমবে ৮ শতাংশ, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির কারণ নেই। আমাদের এখনও অনেক কিছু করণীয় আছে।

অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন বলেন, দারিদ্র্য কমেছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হলেও সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যার একটি ফ্ল্যাট ছিল তার ১০টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। অথচ গরিবরা ক্রমেই গরিব হচ্ছে। আয়কর ফাঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদ দখল, ঋণ পরিশোধ না করা ইত্যাদি অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দারিদ্র্য নিয়ে ভাবতে হলে বৈষম্য কমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত ৫ কোটি লোক দরিদ্র। কাজেই আমাদের আত্মতুষ্টির কারণ নেই। দারিদ্র্য কমাতে হলে গরিবদের উৎপাদনমুখী কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি। ড.ফরাস উদ্দিন মনে করেন, দারিদ্র্যের মূল কারণ কাজের সুযোগের অভাব। যারা গরিব তাদের সম্পদও নেই, নেই কাজের সুযোগও। দারিদ্র্যকে বহুমাত্রিক অভিশাপ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এগোতে পারবে না। দারিদ্র্য কমাতে শিক্ষা বিশেষ করে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ভোকেশনাল শিক্ষা ফ্রি করার প্রস্তাব করেন তিনি।

ড. সেলিম রায়হান দারিদ্র্য হ্রাসের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ১৯৯০-এর দশকে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৮ শতাংশ। ২০০০ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। ২০০৫ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ। এলডিসিভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ অগ্রগতি অনেক ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আন্তনিও মাচাদোর কবিতা: কে বলবে

কে বলবে
আসুন,সবাই মিলে গান ধরি। জানা-বোঝা? বাদ দিন, কিছুই আসলে জানা হয়নি আমাদের।
এক গোপন সমুদ্র থেকে আমাদের আসা, অন্য কোন অজানা সমুদ্রে ভেসে যাব।
এই দ্বৈত রহস্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রবল ধাঁধা
আমরা এখনো সেই হিরন্ময় সিন্দুকের চাবি খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আলোয় আর কোন কিছু উদ্ভাসিত হয় না, সন্তেরাও আলখোল্লার বাইরে কিছু শিখিয়ে যাননি।
শব্দ এখানে কি আর বলবে? পাথরের ফাঁক দিয়ে গড়ানো জলের ধারা—সে-ই বা কি আর বলবে?

এলেন গিন্সবার্গের কবিতা: লালন অনুসরণে

লালন অনুসরণে

এভাবেই আমি পৃথিবীর পথে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম
সেই-যে তারুণ্যবেলায় উইলিয়াম ব্লেক
আমাকে উস্কে দিলেন, তারপর কত মহামুনির নিষেধঃ
‘ওরে জড়াস নে বিষয়ের আশে,
বরং তৈরী হ মৃত্যুর জন্যে’
সেই যুবা বয়স থেকেই শুনছি এসব
আর এখন তো নিজেই আমি পৌঢ় নাগরিক এক,
বাঁধা পড়ে আছি লক্ষাধিক বইয়ের ভেতরে,
লক্ষাধিক চিন্তার জালে, লক্ষাধিক মুদ্রার স্তূপে,
লক্ষাধিক বাসনায়, তাহলে কবে
এ দেহের মায়া ছেড়ে যাওয়া হবে আমার?
এলেন গিন্সবার্গ বলে, আকন্ঠ ডুবে আছি আমি ক্লেদে।


প্রেমিকের পায়ের কাছে বসেছিলাম, সে বললে,
‘চুলোয় যাক এসব, শুধু নিজেকে সামলে চলো,
পা ফেলো দেখে-শুনে, নিয়মিত যোগে-ধ্যানে, আর
মেজাজটাকে বশে রাখো’
আমি এখন প্রায় বৃদ্ধ
আর বছর কুড়ি বাঁচবো কিনা জানিনা, হয়ত আর
কুড়ি হপ্তাও বাঁচবো না, পর মুহূর্তেই হয়ত
ডাক পড়বে আমার, হয়ত এরই মধ্যে
আমার পুনর্জন্ম ঘটে গেছে কীট-পতঙ্গের মধ্যে কে জানে
এলেন গিন্সবার্গ বলে, কীকরে জানব আমি
যা কিছু চলছে সব দেখছি কিনা স্বপ্নের ঘোরে–


এখন রাত বাজে দুটো। খুব ভোরে উঠে ছুটতে হবে
ট্যাক্সিতে মাইল কুড়ি–প্রতি দিনের মত নিজের খ্যাতির পেছনে।
শিল্প-কলা যোগ-ধ্যান করতে করতে এই ধান্দায় জানিনা
কীকরে জড়িয়ে পড়লাম।
কতিপয় মোহন শব্দের জন্য
আমি নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছি
শরীরকে ব্যবহার করেছি
নিজের নির্যাস ছড়ানোর জন্যে
আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে বিবশ কামনায়
হয়ত উচ্ছ্বাস ছিল আমার প্রাণেও
কিন্তু শেষ কবে প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়েছি
তা মনে পড়েনা
আমার সমস্ত উক্তি কেবলি নিজেকে জাহিরের উছিলা
আমার বাসনাগুলো কবেই লুপ্ত
যদি মোক্ষই সত্যি করে চেয়ে ছিলাম
তাহলে লোলচর্ম এই দেহের ভেতরে
আমি কীকরে আটকে পড়লাম?
শুধু কয়েকটা শব্দের টানে,ভালবাসার মোহে,
আকন্ঠ বড়াই আর বাসনায় ডুবে
একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে?
এলেন গিন্সবার্গ বলে, কী যে বেড়াজালে আমি গেছি জড়িয়ে।


রাতে আমার ঘুম আসেনা, অন্ধকারে জেগে থেকে
আমি ঘনায়মান মৃত্যুর কথা ভাবি–
যখন দশ বছরের ছিলাম মহাবিশ্ব কত বড়
তা নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না
সেসময়ের তুলনায়
মৃত্যু এখন অনেকই কাছে চলে এসেছে–
যদি এবারে একটু না জিরোই
মৃত্যু আরো দ্রুত চলে আসবে
আর যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে
পরিত্রাণের পথ বন্ধ হবে আমার–
ঘুমন্ত বা জাগ্রত, এলেন
গিন্সবার্গ পড়ে থাকে বিছানায় এই মধ্য রাতে।


ভোর চারটা
তারপর ওরা আমার জন্যে এল
আমি বাথরুমের মধ্যে নিজেকে লুকালাম
ওরা বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ফেলল
সেটা গিয়ে পড়ল একটা নিরীহ ছেলের ওপর
কাঠের দরজাটা নিরীহ ছেলেটার ওপর পড়ে
যেন কঁকিয়ে উঠল
কোনভাবে আমার ছায়াটাকে লুকিয়ে রেখে
কোমডের মধ্যে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনলাম
ওরা ঘরের অন্য কোন থেকে আমার বদলে
টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে—
এভাবে আর কতদিন আমি ধোঁকা দিয়ে পারব?
অচিরেই ওরা দেখবে আমি ধরা পড়িনি
ওরা আবার ফিরে আসবে আমার জন্যে, তখন
এ দেহ আমি আবার কোথায় লুকাব?
আমি কি ‘আমিই’, নাকি ‘অন্য কেউ’, অথবা
আসলে আদৌ ‘কেউ’ নই?
তাহলে এই ভারী শরীর, এই দুর্বল হৃৎপিন্ড,
এই চুঁইয়ে পড়া কিডনি—এরা কারা?
পয়ষট্টি বছর ধরে এ কোন কয়েদি
জেল খেটে চলেছে
এই লাশের ভেতরে?
আমি ছাড়া আর কে এত
বুঁদ হয়ে আছে নেশায়?
অচিরেই এই খেলার সমাপ্তি, তাতেই বা
কার কি এলো গেলো, বলো?
সত্যই কি আসবে সে মাহেন্দ্র ক্ষণ? সত্যি কি হবে
তবে সেই ভবিষ্যৎ বাণী?


আমারও সুযোগ এসেছিল, কিন্তু সেটা আমি হারিয়েছি,
একবার দুবার নয়, এরকম সুযোগ পেয়েছি অনেকবার
কিন্তু সেসব গুরুত্বের সাথে নেইনি।
বলতে গেলে আমিও অভিভূত হয়েছিলাম, এমনকি প্রায় পাগল
হতে চলেছিলাম ভয়ে, পাছে
অমরত্বের বিরল সুযোগটা হারাই, তারপরও হারিয়েছি দেখো।
এলেন গিন্সবার্গ তোমাদের সাবধান করছে
আমাকে অনুসরণ করে
ধ্বংসের পথে এগিও না।

হান্স এঞ্জেন্সবার্গারের কবিতা: দোহা গান

দোহা গান
কথা বলা খুব সোজা
কিন্তু কথা তো আর খাওয়া যায় না
তাহলে রুটিই সেঁকো
রুটি সেঁকাও শক্ত
তাহলে হও রুটিওয়ালা

কিন্তু শুধু রুটি বানিয়ে রুজি হয় না
তাহলে ঘর-বাড়ী বানাও
বাড়ী করাও সহজ নয়
তাহলে হও ঢালাই-মিস্ত্রি

কিন্তু পাহাড়ে ঘর তোলাও কঠিন
তাহলে পাহাড়কেই সরাও
পাহাড় সরানোও সাধ্যের বাইরে
তাহলে হও পয়গম্বর

কিন্তু চিন্তাকে শোনা যায় না
তাহলে ভাষণ দিয়ে বেড়াও
ভাষণ দেয়াও মুখের কথা নয়
তাহলে হও—যা তুমি তা-ই

নিজের মধ্যে অনবরত বিড়বিড় করতে থাকো
এক অকর্মার ধাড়ি

হান্স এঞ্জেন্সবার্গারের কবিতা: মধ্যবিত্তের গান

মধ্যবিত্তের গান

আমাদের কোন অভিযোগ নাই
আমাদের চাকুরী স্থায়ী
আমরা কেউ অনাহারে নাই
আমরা দিব্বি আছি

ঘাস বাড়ছে
বাড়ছে জিডিপি
বাড়ছে নোখ
বাড়ছে অতীত

সব রাস্তা ফাঁকা
সব চুক্তি সারা
সব সাইরেন বন্ধ
সবকিছু ঝিমাচ্ছে

আমরা ঘাস চিবাচ্ছি
আমরা জিডিপি চিবাচ্ছি
আমরা নোখ চিবাচ্ছি
আমরা অতীত চিবাচ্ছি

আমাদের লুকানোর কিছু নাই
আমাদের হারানোর কিছু নাই
আমাদের বলার কিছু নাই
আমাদের সব আছে

ঘড়ি সারানো হয়েছে
বিল পরিশোধ হয়েছে
কাপড় রোদে শুকাচ্ছে
শেষ বাসটা চলে যাচ্ছে

বাসটা ফাঁকা

আমাদের কোন অভিযোগ নাই
আমরা কিসের জন্য তাহলে বসে আছি?

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: হাইকু

হাইকু

অন্তহীন রাত্রি
আজ একটি ঘ্রাণের চেয়ে
বেশি কিছু নয়


ঠিক ভোর হওয়ার আগে ভুলে যাওয়া
স্বপ্নই কি ছিল সেটি,
নাকি আদতে তা কিছুই ছিল না?


লোকটা মারা গেছে
তার মুখমন্ডলের দাঁড়ি সে কথা জানে না
তার নোখ তখনো বেড়ে চলেছে


চাঁদের আলোয়
যে-ছায়া ক্রমেই বড় হয়
সে একটাই ছায়া


পুরোনো হাত এখনো
কবিতার লাইন সাজিয়ে চলেছে
বিস্মৃতির দিকে

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রার দুই রূপ

অনিদ্রা মানে কি?

প্রশ্নটাই যে অবান্তর। এর উত্তর আমার ভাল ভাবেই জানা।

এর মানে স্তব্ধতায় প্রহর গোনা, আর কখন সশব্দে বেজে উঠবে এলার্ম এই ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, এর মানে স্বাভাবিক শ্বাস ফেলার নিস্ফল ম্যাজিক, এর মানে শরীরের ভার এপাশ ওপাশ করে সইয়ে নেবার, এর মানে জোর করে চোখের পাতা বন্ধ করে রাখা, এ কোন তীক্ষ্ণ চেতনা নয়–জ্বরেরই মগ্ন অবস্থা যেন, এর মানে বহু দিন আগে পড়া কোন বিচ্ছিন্ন স্তবক বিড়বিড় করে আওড়ানো ফের, এর মানে যখন অন্যেরা ঘুমন্ত তখন একা একা জেগে থাকার অপরাধবোধ, ঘোরের ভেতরে অবচেতনে ডুবে যেতে চাওয়া, তবু অবচেতনে ডুবে যেতে না পারা, এর মানে বেঁচে থাকার ত্রাস, ত্রাসের মধ্যে বেঁচে থাকা, এর মানে আরো একটি ধন্দলাগা দিনের শুরু।

জীবনী-শক্তি মানে কি?

এর মানে এক মানব দেহে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা আতংক, যে-দেহের ক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে,এর মানে দশকের পর দশক ধরে অনিদ্রার মধ্যে বাস, কোন সময়ের এককেই যাকে মাপা যায় না,এর মানে নিজের ভেতরে বয়ে বেড়ানো অনেক সমুদ্র আর পিরামিডের ভার,অনেক দুর্লভ গ্রন্থরাজি, প্রাচীন বংশের ধারা, হজরত আদম যেসব ভোর দেখেছিলেন তার স্মৃতি, এর মানে এক জায়গাতে আটকে থাকার অনুভূতি, যেরকম আমি বাঁধা পড়ে আছি আজ এই দেহের সাথে, আমার কন্ঠস্বরের সাথে, যার আওয়াজ আমি শুনতে চাই না সেই স্বীয় নামের সাথে, প্রতিদিনের অসংখ্য খুচরো বিবরণ, যার উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যে-ল্যাটিন আমি জানি না অথচ যার জন্যে আমি তৃষ্ণার্ত, এসব কিছুর সাথে,এর মানে হচ্ছে নিজেকে কেবলই মৃত্যুর ভেতরে ডোবানোর চেষ্টা, তবু মৃত্যুর মধ্যে ডুবতে না পারা, এর মানে হচ্ছে বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকতে হবে এই বোধে আবারও চলতে শুরু করা।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আত্মহত্যা

আত্মহত্যা
একটা নক্ষত্রও, আজ এই রাতে অবশিষ্ট থাকবে না।
থাকবে না রাত্রিরও কোন অবশেষ।
আমার মৃত্যুর সাথে
এই বিশ্বের অসহ্য বোঝা নেমে যাবে।
আমি সরিয়ে ফেলব সব পিরামিড, সব পদকগুলো,
সব কটি মহাদেশ, সব মুখচ্ছবি।
আমি মুছে ফেলব তিল তিল করে জমানো অতীত।
আমি ইতিহাসকে করব ছাই, ছাইকে—আরো ধূসর কিছু।
এই মুহূর্তে আমি শেষ সূর্যাস্তকে দেখছি।
এই মুহূর্তে আমি শুনছি শেষ পাখীর গান।
কেউ আমার এই শূণ্যতার উত্তরাধিকারী নয়।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: চতুস্পদী

চতুস্পদী
অন্যদেরও মৃত্যু এই সময়ে, কিন্তু সেসব দূর অতীতের গল্প।
এই সমাগত ঋতু–সবাই জানে–মৃত্যুর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
ইয়াকুব আল -মনসুরের নিতান্ত প্রজা আমি,
তবে কি আমারও মৃত্যু হবে গোলাপের মত, আর আরিস্ততল?

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আদম তোমারই দেহের ছাই

আদম তোমারই দেহের ছাই
তরবারি সেভাবেই খসে পড়বে, যেভাবে বৃক্ষ থেকে ফল।
কৃষ্টালও ততটা নাজুক, যতটাই গ্রানাইট পাথর।
সব কিছুই ছাই হয় তার নিজস্ব নিয়মে।
লোহাতে যেমন লুকানো তার মর্চে-ধরা স্বভাব। ধ্বনিতে যেমন প্রতিধ্বনি।
আদি পিতা আদম –সে তোমারই দেহের ছাই।
প্রথম স্বর্গোদ্যানই হবে শেষ স্বর্গোদ্যান।
নাইটিংগেল পাখী ও গ্রীক কবি পিন্ডার দুজনই অভিন্ন কলরব।
সূর্যোদয় সূর্যাস্তরই প্রতিচ্ছবি।
মাইসেনিয়ান সম্রাট—কবরে শায়িত এক স্বর্ণালী মুখোশ মাত্র।
সবচেয়ে উঁচু দেয়ালও সবচেয়ে জরাজীর্ণ ভগ্নস্তূপ।
রাজা উরকুইজা, আততায়ীর ছোরা যাকে ছুঁতে পারেনি, তারও পরিণতি এমন।
আয়নায় যে মুখ আজকে নিজেকে দেখেছে
সে গতকালের মুখ নয়। রাত্রি তাকে বদলে ফেলেছে রাতারাতি।
কাল এভাবেই সূক্ষ্ম, অনবরত, ভাংচুর করছে আমাদের।

হিরাক্লিটাসের সেই প্রবাদের অবিরল বয়ে যাওয়া
জল যদি হতে পারতাম আমি,
যদি হতে পারতাম সেই আদি ও অকৃত্রিম অগ্নি,
কিন্তু আজ এই দীর্ঘ অফুরান দিনের শেষে
নিজেকে আমার একা লাগছে এবং মনে হচ্ছে,
আমি কখনোই আর পরিত্রাণ পাব না।