হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আদম তোমারই দেহের ছাই

আদম তোমারই দেহের ছাই
তরবারি সেভাবেই খসে পড়বে, যেভাবে বৃক্ষ থেকে ফল।
কৃষ্টালও ততটা নাজুক, যতটাই গ্রানাইট পাথর।
সব কিছুই ছাই হয় তার নিজস্ব নিয়মে।
লোহাতে যেমন লুকানো তার মর্চে-ধরা স্বভাব। ধ্বনিতে যেমন প্রতিধ্বনি।
আদি পিতা আদম –সে তোমারই দেহের ছাই।
প্রথম স্বর্গোদ্যানই হবে শেষ স্বর্গোদ্যান।
নাইটিংগেল পাখী ও গ্রীক কবি পিন্ডার দুজনই অভিন্ন কলরব।
সূর্যোদয় সূর্যাস্তরই প্রতিচ্ছবি।
মাইসেনিয়ান সম্রাট—কবরে শায়িত এক স্বর্ণালী মুখোশ মাত্র।
সবচেয়ে উঁচু দেয়ালও সবচেয়ে জরাজীর্ণ ভগ্নস্তূপ।
রাজা উরকুইজা, আততায়ীর ছোরা যাকে ছুঁতে পারেনি, তারও পরিণতি এমন।
আয়নায় যে মুখ আজকে নিজেকে দেখেছে
সে গতকালের মুখ নয়। রাত্রি তাকে বদলে ফেলেছে রাতারাতি।
কাল এভাবেই সূক্ষ্ম, অনবরত, ভাংচুর করছে আমাদের।

হিরাক্লিটাসের সেই প্রবাদের অবিরল বয়ে যাওয়া
জল যদি হতে পারতাম আমি,
যদি হতে পারতাম সেই আদি ও অকৃত্রিম অগ্নি,
কিন্তু আজ এই দীর্ঘ অফুরান দিনের শেষে
নিজেকে আমার একা লাগছে এবং মনে হচ্ছে,
আমি কখনোই আর পরিত্রাণ পাব না।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: সীমানাগুলো

সীমানাগুলো
ভার্লেনের একটি লাইন আর কখনোই মনে পড়বে না আমার।
কাছের একটি রাস্তা যেখানে আমার যাওয়া হবে না কোনদিন।
একটি আয়না শেষবারের মত দেখে নিল আমাকে।
একটি দরজা পৃথিবীর শেষ দিন অব্দি বন্ধ হয়ে গেল।
আমার লাইব্রেরীর অনেকগুলো বই (মিলিয়ে দেখছি এখন)
আর কখনোই খোলা হবে না।
এই গ্রীষ্মে আমার বয়স হবে পঞ্চাশ।
মৃত্যু আমাকে ব্যবহার করে চলেছে ক্রমাগত।

মধ্যাহ্নের সমাজ

বিনায়ক সেন

১.
কেন মধ্যাহ্ন উপন্যাসটি লিখতে হলো_ তাকে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সময়কে’ ধারণ করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। সচরাচর যেসব বিষয় নিয়ে তার চরিত্ররা মাথা ঘামায় না- রাজনীতি, কাল, সমাজ- সে সবকিছুকে আর গল্পের বাইরে রাখা গেল না। কেননা, গল্পটাই কতদূর এগুলো মানুষ- তা নিয়ে। ১৯০৫ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের সমাজ কীভাবে বদলে যেতে থাকল এ রকম কোনো ইতিহাসবোধে তাকে পেয়ে বসেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি-প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরীফকে জানিয়েছিলেন যে, নিজের জীবন ভাঙিয়ে আর কত উপন্যাস লেখা যায়! সে জন্যেই নাকি তাকে একা এবং কয়েকজন, সেই সময়, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’র মতো ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। তিনি খুব সচেতন প্রয়োজনেই এই ইতিহাস-প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন বোধ করি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ব্যাখ্যাটা এরকম :’আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তো বা ব্রেনের কোথাও শর্ট সার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়_ চেষ্টা করে দেখি, সমস্যাটাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগুতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তার পরেও…’

এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘তারপরেও’ বলতে গল্প ছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন সচেতনতার প্রতি কি তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন? আর ইতিহাস-গল্প মিলিয়ে যদি কিছু লিখবেন তাহলে ১৯০৫ সাল থেকেই তা শুরু করবেন কেন? সময় ধরার ইচ্ছের কথা বলছেন, কিন্তু কোন কালপর্বে শুরু করে কোথায় তার যতি টানবেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে যে-সময়কে অনুভব করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ অবধি। কেন এই বিশেষ সময়ের টানাপোড়েনের মধ্যে তাকে প্রবেশ করতে হলো_ সেটা একটা প্রশ্ন। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, উপন্যাসটিতে যে সমাজকে তিনি এঁকেছেন, সেই সমাজচিত্র সে সমাজকল্পিত, না বাস্তব_ সে প্রশ্নে পরে আসা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্রটাকে তিনি কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে আঁকলেন? আজকের যুগের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিচালিত সমাজের প্রেক্ষিতে মধ্যাহ্নের সমাজকে মনে হবে কোন অচিনপুরের গল্প_ এক আধুনিক ইউটোপিয়া। এই উপন্যাস ভর করে আছে আদর্শস্থানীয় দুই চরিত্রের ওপরে, যার একজন হরিচরণ সাহা এবং অন্যজন মওলানা ইদ্রিস। এই দুই শুভবোধসম্পন্ন মানুষ_ বস্তুত নিয়ত এবাদতে রত সূফী-সন্তই বলা চলে তাদের_ যারা সবসময়েই কী করে মানুষের উপকার করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত, তারাই উপন্যাসের ঘটনাবলির ওপরে বৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন শুরুর লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের শুরু হয় যে-পুকুরঘাটে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ হয় একই পুকুরঘাটে; কেবল শুরুর দৃশ্যে ছিলেন হরিচরণ, শেষের দৃশ্যে মওলানা ইদ্রিস। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র_ ভালো স্বভাবের ও মন্দ স্বভাবের চরিত্ররা সবাই এদেরকে নিয়েই, এদেরকে পাশে রেখেই যার যার জীবন কাটায়, যার যার মতো করে মৃত্যুবরণ করে।

মধ্যাহ্নের সমাজের বড় শক্তি তার অন্তর্নিহিত নৈতিক শ্রেয়বোধ। এর প্রধান উৎস হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিসের মতো মানুষেরা হলেও অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষ যারা, তারাও প্রবল মানবিকতায় আক্রান্ত। তারা পারতপক্ষে অন্যায় করেন না, বা করলেও পরিহার্য বলে আত্মগ্গ্নানিতে ভুগতে থাকেন। জুলেখা, শরীফা, মনিশংকর, শিবশংকর, আতর_ এরা সবাই পৃথিবীতে ভালোমানুষের পাল্লা ভারী করেছে। আর লাবুস তো জুলেখার পুত্র সন্তান হলেও আসলে হরিচরণ-মওলানা ইদ্রিসের আধ্যাত্মিক সন্তান। লাবুস শহরে এলে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটত, খুবই স্বাভাবিক হতো তার হিমু-হওয়া! তার মানে এই নয় যে, এই সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত ছিল না। সংঘাত-দ্বন্দ্ব-অনাচার ছিল যদিও, কিন্তু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। হরিচরণের নিজের পাটের আড়ত রয়েছে, ‘সাহা’ যেহেতু সেহেতু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা তার উপার্জনের স্বাভাবিক উৎস। সুতরাং বাণিজ্যবিরোধী ছিল না ওই সমাজ। যে অঞ্চল নিয়ে এই উপন্যাস তার হাওরেই সওদাগররা ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় তাদের নৌবাণিজ্যের নাও ভাসিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ধারা থাকলেও এ ধরনের সমাজে টাকার শক্তিতে মানুষের ক্ষমতাকে মাপা হয়নি। শশাংক পালের মতো জমিদার বা ধনু শেখের মতো কুটিল ব্যবসায়ী মানুষও সমীহ করে চলেছে হরিচরণকে_ সেটা তার অর্থের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি তার নৈতিক স্বভাবের কারণে। আরেকটি দিক হচ্ছে, মধ্যাহ্নের সমাজে স্বার্থপরতাই ব্যক্তির একমাত্র প্রণোদনা নয়; এখানে পরার্থপরতার বোধ সহজাতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বিভিন্ন স্তরে। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের আজকের এই অপরাহ্নের সমাজ বাণিজ্যিক বোধের সমাজ। ঊনিশ-বিশ শতকের [অন্তত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ও মোটা দাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত] অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর মূল্যবোধের থেকে আজকের এই সমাজ মৌলিকভাবেই আলাদা। মধ্যাহ্নে অনায়াসে সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণী ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে। এখানে বৃক্ষের অসুখ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, জুলেখা গায় উকিল মুন্সি ও রাধারমণের গান, রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদের হাহাকার, হাওরের ঢেউয়ে বেজে ওঠে। সেটা যে কেবল নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য_ তা মনে করেননি লেখক। ব্যাপক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আদান-প্রদানকে ধারণ করেছিল এই মধ্যাহ্নের সমাজ। সেখানে কোন চিহ্নটা কার, বা কোন গানের লাইনটা কোন সম্প্রদায়ের জীবনবোধ থেকে উঠে এসেছে_ সেটা হিন্দুর নাকি মুসলমানের, মজুরের নাকি অবস্থাপন্ন কৃষকের_ সেটা বের করাটা দুরূহ। ওই সমাজের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি।

এ রকম সমাজের কাহিনী কি ইউটোপিয়ার মতো শোনাচ্ছে? হোক ইউটোপিয়া, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই কল্পকথা নির্মাণে [নাকি বাস্তবেই গল্পটা এভাবেই তিনি শুনেছিলেন] এত শ্রম ও মেধা ঢালবেন কেন? আমার ধারণা, মধ্যাহ্নের ভূমিকায় পুরো কারণটা হুমায়ূন আহমেদ বলেননি। শুধু ‘সময়’কে ধরার জন্য ওই বিশেষ কালপর্বের প্রতি চোখ ফেরাননি তিনি; আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তার। কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল আমাদের মন ও মননকে নাড়া দেওয়ার জন্যে। হয়তো উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সমাজের অন্তরাল প্রাণশক্তির উৎস কোথায়, তা দেখানো চোখে আঙ্গুল দিয়ে।

২.
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিষ্কৃতি নাই।’ মধ্যাহ্ন উপন্যাসে সেই পাপকে অবলীলাক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পাপের মধ্যে সহাবস্থানকেই চূড়ান্ত মানেনি। শশাংক পালের মতো অত্যাচারী জমিদারেরা এতকাল নিরীহ রায়তের পেছনে লেগেছে। তার মৃত্যুর পরে ধনু শেখের মতো ব্যবসায়ীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। শশাংক পালের যোগাযোগ ছিল কোলকাতার প্রশাসনের সাথে, ধনু শেখ নিয়েছে মুসলিম লীগের আশ্রয়। স্বদেশী আন্দোলনের তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর হাতে আহত হতে হয় তাকে; শেষ পর্যন্ত এলাকার মানুষই দাঙ্গা ঘটানোর ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাকে দায়ী করে এবং তার ক্ষমতার ভিত দুর্বল করে দেয়। আর শশাংক পালের মৃত্যু হয় কোনো অব্যাখ্যাত ব্যাধিতে। শশাংক পাল_ ধনু শেখের প্ররোচনার কারণে হোক, আর দুই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমে বেড়ে যাওয়া ভেদবুদ্ধির কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মধ্যাহ্নের সমাজেও ঢুকতে থাকে। রাতের অন্ধকারে একদল আরেক দলের লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়, একপক্ষ আরেক পক্ষের জাতিনাশ ধর্মনাশ করে, বাড়িতে আগুন লাগায়, পুলিশের কাছে মিথ্যে মামলা দিয়ে, হুমকি দিয়ে এলাকা পরিত্যাগে বাধ্য করে, নষ্ট মেয়ের অপবাদ দেয়, হাওরের নির্জনে এনে ধর্ষণ করে, জায়গা-জমি বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এসবই হয়, কিন্তু এটা মধ্যাহ্নের সমাজের অন্দরমহলকে ছুঁতে পারে না। কোনো লৌকিক বা অলৌকিক কারণে এর মানুষগুলো পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে।
পরস্পরের পাশে সহায়-সমর্থনের উদাহরণ অনেক এই উপন্যাসে। আমি এখানে দু’একটি উদাহরণ দেব। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে মওলানা ইদ্রিস রওনা হয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দিকে। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বগুড়ার পরিবর্তে রংপুরে চলে গেছেন। এক পর্যায়ে রাত হলে তাকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে একটি হিন্দু পরিবার। লক্ষণ দাসের পরিবার কাছেরই এক মন্দিরের সেবায়েত। ঐ বাড়ীতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার। খাবারেরও ব্যবস্থা হয়েছে_ অবশ্য রাখা হয়েছে উঠানেই। লোকটা তাকে বলেছে, ‘মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।’ মওলানা তাতেই খুশী। তিনি নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে দোয়া চাইলেন যাতে এই পরোপকারী পরিবারটির প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। এ সময়ে কপালে চওড়া করে সিন্দুর দেয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মওলানার সামনে এসে দাঁড়াল প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকে। মওলানার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল চলে যেতে : ‘দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকাপয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন’।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে পাপ আছে তা অস্বীকার না করে স্বীকার করাই ভাল, স্বীকার করলে যদি আমরা পরিত্রাণের পথ পাই। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেও, করার মাঝেই, থমকে দাঁড়িয়েছে অথবা স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ধনু শেখ এলাকার মসজিদের ইমাম নিয়ামত হোসেনকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ‘জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। … তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?’ আপাতত সম্মতি দিলেও চে’গুয়েভারার চেয়ে কোন অংশে কম যান না ইমাম নিয়ামত হোসেন। রাতের অন্ধকারে মনিশংকরের কাছে গিয়ে বলে দিয়েছেন, কাল জুম্মার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। শুধু তা-ই নয়, পরদিন জুম্মার নামাজ শেষে ইমাম নিয়ামত মওলানা ইদ্রিসকে আমন্ত্রণ জানালেন কিছু বলার জন্যে। ইদ্রিসকে বহুদিন ধরে হরিচরণ সাহার বাসায় আশ্রয়ের পর থেকেই হিন্দুদের সঙ্গে উঠা-বসা করার জন্যে একঘরে করে রেখেছে ধনু শেখ। মওলানা ইদ্রিস দাঙ্গা ঘটানোর পরিস্থিতি বদলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সুরা হুজুরাত এর তের নম্বর আয়াতের স্মরণ করলেন, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করে পরে বিভক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে, যাতে তারা ‘একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে’। দোয়া পাঠের সময় ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়।

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে এক উদারনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এলাকায়। অত্যাচারী শশাংক পাল মারা যাওয়ার পর তার মুখাগি্ন করতে তার স্বধর্মের কেউ রাজী হলো না। হয়তো তিনি সারাজীবন অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলেন বলে, হয়তো অত্যাচারী ছিলেন বলে। মুসলমান হয়ে মওলানা ইদ্রিস এগিয়ে এলেন এক্ষেত্রে। সমস্যা হলো পুরোহিতের সাথে তাকেও কিছু মন্ত্র পড়তে হলো শেষকৃত্যের প্রয়োজনে। এর জন্যে কাফের বলে ফতোয়া দেওয়া হলো তার বিরুদ্ধে। লাবুস এসে প্রতিবাদ করে বলল, ‘লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু মুসলমান কী? লাশ নামাজ কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না’। অন্যত্র, লাবুস ও ইদ্রিসের মধ্যে অন্য একটি ধর্মীয় আলাপের বিনিময় হয়। ইদ্রিসের শিশুবয়সী মেয়ে পুষ্পরাণীকে দুধ খাওয়ানোর কেউ নেই। তার স্ত্রী জুলেখা তাকে পরিত্যাগ করে গেছেন। এদিকে গ্রামের বাগাদিপাড়ার মেয়ে ষোল সতেরো বয়সী কালী গতকালই তার মেয়েকে হারিয়েছে। পুষ্পরাণীকে পেয়ে সাগ্রহে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে সে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠেই শোনা যাক : ‘মাওলানা ইদ্রিস লাবুসের কাছে হিন্দু-মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দু-মুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই। লাবুসের কথায় মাওলানা হকচকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেননি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।’ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাত্যহিকের সাংস্কৃতিক ব্যবহারিক বিনিময়ের এ রকম অনেক উদাহরণ আরো ছড়িয়ে আছে। আজকের এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যুগে ধর্ম-ধর্ম করে আমাদের নগর ও গ্রামের জীবন এখন ব্যতিব্যস্ত। লাবুস-মওলানা ইদ্রিস হরিচরণের মতো চরিত্ররা কি আছে এখনো আমাদের আশেপাশে কোথাও?

৩.
তাহলে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানে মিলে একটা যে অভিন্ন সংস্কৃতি, তলার দিকে গড়ে উঠেছিল, শত কংগ্রেসী লীগ রাজনীতির ডামাডোলেও যেটা পুরোপুরি ধসে যায়নি, সে রকম কোন শুভনীতিবোধসম্পন্ন অস্তিত্বকেই অমাদের ‘মধ্যাহ্ন’ অর্থাৎ ‘স্বর্ণযুগ’ বলছেন লেখক? আজ সেই মধ্যাহ্ন গড়িয়ে এই সমাজ_ এই তিমিরবিলাসী সমাজ উপনীত হয়েছে তার অপরাহ্নে। ‘অপরাহ্ন’ কথাটা আমি ‘লেইট ক্যাপিটলিজম’-এর তাত্তি্বক সাহিত্য-সমালোচক ফ্রেডেরিক জেমসনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। বণিজ্যনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে, শিল্পকেও মানবসত্ত্বাকে ক্রমাগত ‘ব্যবহৃত-ব্যবহৃত’ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বর্জ্যের মতো পাগলার লেগুনের মতো অন্ধকার কোণে। হুমায়ূন আহমেদ এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীনির্ভর সমাজকে মন থেকে কখনো মেনে নিতে পারেননি। হিমুকে দিয়েছেন এই বাণিজ্যিক সমাজকে বিদ্রূপ করার মনোমুগ্ধকর ক্ষমতা। ‘অয়োময়’-এর মীর্জা হেরে যাচ্ছে উঠতি বণিক শ্রেণীর কাছে, যেভাবে ধনু শেখের কাছে হেরে গিয়েছিল শশাংক পাল। তবু স্রষ্টার পক্ষপাতিত্ব পরাজিতের দিকেই। সত্যজিতের ‘জলসাঘর’-এর শেষ দৃশ্যে বিশ্বাম্ভর কোথায় মিলিয়ে যান সে খবর আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমাদের মনে থেকে যায় শেষ সঙ্গীত সভার নৃত্যগীতের রেশ। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষে আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ আসন্ন, ভিটেমাটি ছাড়ছে দু’তরফেই, নতুন রাষ্ট্রজীবনের শুরু হবে সীমান্তের দু’দিকেই। পাকিস্তান হচ্ছে ‘কৃষকের ইউটোপিয়া’ গবেষকরা রায় দিয়েছেন, শুধু কিছু মানুষের মনে শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। হরিচরণ সাহা মারা গেছেন, লাবুস মৃত্যুশয্যায়, মওলানা ইদ্রিস সবচেয়ে বেশি নিরাশ্রয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।’ হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিস ছিলেন এই পাপবিদ্ধ সমাজের রক্ষাকবচ_ তারা আঁকড়ে ছিলেন সমাজের ভালোত্বকে শুভবোধকে, মঙ্গলকামনাকে। তারা সমাজকে অন্ধকারর্ খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে দেননি।

মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষটা এ রকম। লাবুস, যে কিনা আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎকে নায়কের মতো লালন করেছে, সে মারা যাচ্ছে। কোনো অব্যাখ্যাত অসুখে তাকে আক্রান্ত করেছে। অসুখ নিয়েই সে এসেছে নির্জন পুকুরের ঘাটে এবং সেখানে হঠাৎই সে তার মৃত মাকে দেখতে পাচ্ছে কাছে। একপর্যায়ে মা’র কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার এই মৃত মার নাম জুলেখা। যিনি জীবিত থাকাকালে স্বয়ং উকিল মুন্সীকে গান শুনিয়েছেন এবং নজরুল যাকে দিয়ে কলকাতায় গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি এবারে গুনগুন করে গান ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বইটির শেষ দুটি লাইন, যা পড়তে থাকলে এখনো আমি এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করি : ‘মওলানা ইদ্রিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে। পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনোখানে।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোসেন মিয়া ময়নাদ্বীপের সমতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, হুমায়ূন আহমেদের বান্ধবপুর তেমনি একটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র, সেখানে সব গোত্রের ও বর্ণের মানুষেরা মানবিক মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরবে। তবে এই অপরাহ্নের সমাজের কাছে হুমায়ূনের এই ইতিহাসপাঠ কল্পজগতের ভাষ্য বলে মনে হতে পারে।

তিমিরবিনাশী দুই কবি

বিনায়ক সেন

দু’জনেই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। বিদেশী অনুষঙ্গে তাদের মননচর্চা ছাত্রাবস্থা থেকেই বিশিষ্ট হয়ে উঠছিল। মালার্মে-ভালেরী তো ছিলেনই, আরো ছিলেন রিল্কে, ইয়েটস, এলিয়ট, এলুয়ার, আরাগঁ, অডেন। জীবনানন্দের জন্য বাড়তি প্রেরণা ছিলেন কীটস; শামসুর রাহমানের জন্য পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতার ঋতুবদলের প্রধান উৎস বোদলেয়ার। উভয়ের জন্যই এক অভিন্ন আশ্রয়স্থল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শামসুর রাহমান তার নানা কবিতায় বেশুমার ব্যবহার করেন অগ্রজ ও সমসাময়িক কবিদের নাম। শুধু য়ুরোপীয় সাহিত্যের সূত্রে নয়, হাত বাড়ান তার বাইরেও যেমন জালালুদ্দিন রুমী, নাজিম হিকমত, গার্সিয়া লোরকা, পাবলো নেরুদা, সেজার ভায়েহো। জীবনানন্দ এটা প্রায় কখনোই করেননি এত গভীরভাবে বিদেশী সাহিত্য পড়া ও পড়ানোর মধ্যে নিমজ্জিত থেকেও। ব্যতিক্রম হয় শুধু রবীন্দ্রনাথের বেলায়। দু’জনের কবিতায় নানা সময়ে ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ। তবে গদ্য রচনায় ও পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায় জীবনানন্দ নিবিষ্ট আলোচনা করছেন বিদেশী নক্ষত্রমণ্ডলের সেখানে ইয়েটস, রিল্কে, হার্ডি, হাউসম্যান, সিটওয়েল, এলিয়ট, পাউন্ড, ডে-লুইস, স্পেন্ডর, অডেন, কামিংস কেউ বাদ পড়ছেন না। দু’জনেই আবার সমসাময়িকদের রচনা নিয়ে মনোযোগী আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছেন। জীবনানন্দ নিয়ে সুধীন্দ্রনাথ কোনো অব্যাখ্যাত কারণে একটি বাক্যও মন্তব্য করেননি [অন্তত তার জীবদ্দশায়]। সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জীবনানন্দ উচ্ছ্বসিত আলোচনা করেছেন এমনকি কাব্যবিচারে তাকে স্থান দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু-অমিয় চক্রবর্তীর উপরে। শোনা যাক তারই অননুকরণীয় কণ্ঠে :

‘সুধীন্দ্রনাথ আজকাল কবিতা লেখা একদম ছেড়ে দিয়েছেন। এই কবির প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিস। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশী-বিদেশী খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। … আধুনিক সাহিত্যের প্রায় কারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ; তার নিজের এষণার কবিতালোকে তিনি আধুনিক প্রায় সকল কবির চেয়েই বেশি আন্তরিক নন কি?’

‘সুধীন্দ্রীয় কাব্য’ এই অভিধাও জীবনানন্দেরই দেয়া। এই কাব্য একাধারে ‘নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক’। শামসুর রাহমানও তার সমসাময়িক ও তরুণ প্রজন্মের কবি-শিল্পী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলোচনা করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে উৎসর্গ করেছেন স্মরণীয় সব কবিতা। এতে হয়তো বিস্ময়ের কিছু নেই :শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৫টি। [এর সমতুল্য কাব্যগ্রন্থ রচনা কোনো বাঙালি কবিরই আজো নেই)। কিন্তু মনের বিশাল উদারতাও ছিল সমকালীনের প্রতি এত ঘনিষ্ঠ মনোযোগের পেছনে একটা কারণ। রশীদ করীম [যিনি শামসুর রাহমান সম্পর্কে একাধিক নিবিষ্ট লেখার জন্ম দিয়েছেন তার কাব্যকৃতির নানা দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে] আড্ডার ছলে জানাচ্ছেন ‘বেচারা শামসুর রাহমান একবার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নামের সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে রশীদ করীমের নামটি উচ্চারণ করে বড়ই নাকাল হয়েছিলেন।’ ঐ লেখাতেই রশীদ করীম জানিয়েছেন যে শামসুর রাহমান তাকে রহস্য করে বলেছেন, ‘আমার সাম্প্রতিক লেখাগুলোতে আপনাদের নাম বড় বেশি উলি্লখিত হচ্ছে। কিছুদিন একেবারে ‘ব্ল্যাক-আউট’ করতে হবে। নামগুলো শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ এবং আরো কিছু কিছু নাম’। এর সত্যতায় সন্দেহের কিছু নেই। শামসুর রাহমানের নিজের সৃষ্ট ক্ষুদ্রায়তন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সমসাময়িক ও তরুণ প্রজন্মের দেশী-বিদেশী কবি-সাহিত্যিকের ওপরে আলোচনা।

জীবনানন্দকে পারলে সবাই কোন না কোন সময়ে, কখনো কোন কারণ ছাড়াই, ঠুকেছেন। অনেক ক্ষেত্রে ঠোকা হয়েছে পরস্পরবিরোধী কারণে ও উপলক্ষে। কেন আরো বেশি করে জনগণের কবি হয়ে উঠতে পারেননি এই অভিযোগে কবিকে ‘তুলোধোনা’ করেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জীবনানন্দর মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণায় সুভাষ লিখেছেন, ‘আমি আকথা কুকথা লিখলেও আমার প্রতি স্নেহ-মমতায় কোনো টান পড়েনি’ এবং এমন আভাস দিয়েছেন যে, তার পূর্বতন সমালোচনাটুকু লেখা হয়েছিল ‘সাতটি তারার তিমির’ না পড়েই! আবার, ‘সাতটি তারার তিমির’ ও এর পরবর্তী সময়ে সমাজ-ইতিহাস-দর্শনবিদ্ধ কবিতা লেখার কারণে ‘কবিতা’ পত্রিকার গোষ্ঠী [বুদ্ধদেব বসুসহ] তাদের প্রাক্তন সমর্থন ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। বুদ্ধদেবের এই ক্রমনিরাসক্তি জীবনানন্দের চোখ এড়ায়নি। প্রভাকর সেনকে লেখা ১৯৪৬ সালের এক চিঠিতে জীবনানন্দ আক্ষেপহীনভাবে বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে প্রগতির ও বুদ্ধদেব বসুর কাছে আমার কবিতা ঢের বেশি আশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল … অতএব সাহস ও সততা দেখাবার সুযোগ লাভ করে চরিতার্থ হলাম বুদ্ধদেব বাবুর বিচারশক্তির ও হৃদয়বুদ্ধির; আমার কবিতার জন্য বেশ বড় স্থান দিয়েছিলেন তিনি ‘প্রগতি’তে এবং পরে ‘কবিতা’য় প্রথম দিক দিয়ে। তারপরে ‘বনলতা সেন’-এর পরবর্তী কাব্যে আমি তার পৃথিবীর অপরিচিত, আমার নিজেরও পৃথিবীর বাইরে চলে গেছি বলে মনে করেন তিনি। এর বিপরীতে ‘পূর্বাশা’ [ও ‘নিরুক্ত’]পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে করেছেন যে, জীবনানন্দের শেষের দিকের কবিতায় বরং তার ‘পারিপাশর্ি্বক চেতনা প্রৌঢ় পরিণতি’ লাভ করেছে। এই প্রশংসায় অবশ্য পুরোপুরি সায় ছিল না জীবনানন্দের কেননা সমাজ-ইতিহাস চেতনার বাইরে আরো কয়েকটি নতুন ‘সুর’ রয়ে গেছে আবিষ্কারের অপেক্ষায় এমনটা তার মনে হয়েছিল। ‘সাতটি তারার তিমির’ এর কবিতা রূপ নিয়েছে ‘দার্শনিকতায় এবং সে দর্শনও অবোধ্য’ এই অভিযোগ উঠেছে আবু সঈদ আয়ুব, অশোক মিত্র, তরুণতর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছ থেকে। যদিও কবির মৃত্যুর পর নীরেন্দ্রনাথ তার পূর্বতন অবস্থান কিছুটা শুধরে নিয়ে বলেছেন :’তার এই সময়ের কবিতা যদি আমাদের কাছে ঈষৎ দুর্বোধ্য লাগে তার ভাবনানিব্যাসকে যদি ঈষৎ অসচ্ছ অস্পষ্ট অবয়ব বলে মনে হয় তাতে বিস্ময়বোধের কারণ নেই। তার কারণ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে মহৎ কবিমাত্রেই আমাদের থেকে দু-দশ বছর সামনে এগিয়ে থাকেন।’
তুলনামূলকভাবে ছোট পরিসরে শামসুর রাহমানকেও কাছের ও দূরের বলয় থেকে নানা বিরুদ্ধ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রেমের বনাম রাজনৈতিক কবিতা, তাৎকাল্য প্রবণতা বনাম কালোত্তীর্ণতা, নগরকেন্দ্রিকতা বনাম বৃহত্তর জনজীবন মুখীনতা, বিদেশী উপমা-উৎপ্রেক্ষা বনাম লোকজ উপমা অনুষঙ্গের অনুসৃতি, স্লোগান-ধর্মী বনাম শিল্পকলাসম্মত বিধি, নিজের কাব্যকলার ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি বনাম ক্রমাগত নবায়ন নানা কারণে [এবং কখনো কোন কারণ ছাড়াই] কবিকে এ দেশে বিভিন্ন অসুখী সমালোচনার তোপে পড়তে হয়েছে। তবে এসব কাব্যবিচার নিয়ে দু’জনের মধ্যেই এক ধরনের নির্লিপ্তি অনুভব করা যায়। আধুনিক বাংলা কবিতার দুই প্রধান স্থপতি রবীন্দ্র-উত্তর যুগের জীবনানন্দ দাশ ও জীবনানন্দ-উত্তর যুগের শামসুর রাহমান দু’জনেই সমসাময়িকতায় বিদ্ধ হয়েও ছিলেন মূলত আত্মবৃত কবি। অন্নদাশংকর রায় জীবনানন্দকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসেবে, আর শামসুর রাহমান আমরণ কবিতারই ধ্যান করেছেন। দু’জনেই ছিলেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের সচরাচর নিঃসঙ্গকামিতার মাপকাঠিতেও ‘পাবলিক লাইফ’ থেকে অনেকটাই দূরত্বে। জীবনানন্দের শেষের দিকের কবিতাগুলোয় আদর্শগত অবস্থান এক নিজস্ব প্রগতিবাদী দৃষ্টিকোণে বিবর্তিত হচ্ছিল, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক ক্যাম্পে তিনি ছিলেন না। শামসুর রাহমান নানা প্রগতিবাদী আন্দোলন ও অবস্থানের সাথে কবিতার মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে ছিলেন একান্ত নির্জনতাপ্রিয়। জীবনানন্দের মধ্যে এটা তীব্র মাত্রায় ছিল বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘যে অতিলৌকিক আবহাওয়া তার কবিতার, তা-ই যেন মানুষটিকেও ঘিরে থাকত সবসময় তার ব্যবধান অতিক্রম করতে ব্যক্তিগত জীবনে আমি পারিনি। সমসাময়িক অন্য কোনো সাহিত্যিকও না।’

কবির সাথে আমার যৎসামান্য যে পরিচয় ঘটেছিল তাতে আমার ধারণা হয়েছে, শামসুর রাহমানও ছিলেন দিনের অধিকাংশ প্রহর নিরালায় থাকতে ভালোবাসেন এমন একজন মানুষ। বিশ্বসাহিত্যের উপরে অগাধ দখল সত্ত্বেও কখনো তাকে সেসব নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি বা কেউ দেখেছে বলে শুনিনি। নিজস্ব পড়াশোনাটাকে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই রেখে দিতেন অন্যের কাছে শুনতেই চাইতেন বেশি। তার ক্ষুদ্রায়তন প্রবন্ধগুচ্ছ তার নানা ধরনের পড়াশোনার বিশেষত কবিতার পঠন-পাঠনের নানা অভিজ্ঞতার সামান্যই তুলে ধরেছে।

একবার রবার্ট ব্লাই-এর অনুবাদে সেজার ভায়েহোর একটি কবিতা পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে শামসুর রাহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘প্যারিসে মারা যাব আমি কোন বৃষ্টির সন্ধ্যায়’ কবিতাটি তার চোখে পড়েছে কিনা। উত্তরে মুহূর্ত বিলম্ব না করে তিনি জানালেন, ওটি তার একটি প্রিয় কবিতা এবং ওর প্রভাবে তিনি ষাটের দশকের শেষে নিজেই একটি কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। নাজিম হিকমতেরও নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন তিনি এবং শেষের দিকের বেশ কিছু কবিতায় নাজিমের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। আসলে, জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমান উভয়ের কবিতাতে নানা মহাদেশ থেকে আলো ঠিকরে পড়েছে, কিন্তু নিজেদের তারা উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন কেবল এই কারণে যে নিজেদেরকে তারা বদ্ধ পুকুরে ঘেরাও করে রাখতে চাননি। তার এক কবিতায় শামসুর রাহমান বলেছেন, বিশ্ব-সভ্যতার নানা সময়ের অনেক প্রতিভার কাছে দায়বদ্ধ বলেই তিনি প্রতিক্রিয়ার হুমকির মুখে পিছু হটতে চান না। তাছাড়া বিদেশী অনুষঙ্গ কিংবা চিত্রকল্প ব্যবহার করার আরেকটি প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘পাঠকের মানসিক দিগন্তকে একটুখানি প্রসারিত করে দেয়া।’ এ বিষয়ে আল মাহমুদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার কিছুটা মতভিন্নতা ছিল বলে রশীদ করীম জানিয়েছেন আমাদের। এই সূত্রেই আমরা বাংলা কবিতায় ব্রাকের মাছ, সেজানের আপেল আর মাতিস-শাগালের কুহকিনীদের আকাশে উড়তে দেখেছি।

২. জীবনানন্দকে যারা গাঁও-গেরামের কবি, আধুনিকতা-বিচ্ছিন্ন নির্জনতার কবি বলে মনে করেন এখনো এ রকম রয়ে গেছেন কেউ কেউ তারা তার যুক্তিধর্মী মানসগঠনকে ভুলে যান। পারিবারিক পটভূমির বিষয়টিও সময় সময় তাদের খেয়ালে থাকে না। জীবনানন্দের যুক্তিধর্মী মানসগঠন [যার জমিন ছেলেবেলাতেই নির্মিত হয়ে গিয়েছিল] সম্পর্কে প্রথমেই মনে রাখবার বিষয় হলো এই পরিবারের ব্রাহ্ম-সমাজীয় পটভূমি। বাবা সত্যনন্দ দাশ শুধু ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতার দায়িত্বই পালন করেননি, তাকে ঘিরে ‘এক উন্মেষধর্মী সংঘ গড়ে উঠেছিল সেখানে সাহিত্যিক, শৈল্পিক, নৈতিক, রাষ্ট্রীয় আলোচনায় বিকেলবেলা ও রাত্রিগুলো যেন কেমন একটি স্বাধিকার ফিরে পেত।’ তাছাড়া তার ধর্মজীবনও ছিল লক্ষ্য করার। শুধু যে বরিশালের ব্রাহ্মসমাজের তিনি আচার্য ও বক্তা ছিলেন তা-ই নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় তার অবাধ বিচরণ ছিল। জীবনানন্দের বর্ণনায়, তার পিতা ‘সেকালের ঊনবিংশ শতাব্দীর ডারউইন, হাক্সলি, মিল এঁদের মতামত যেমন পর্যালোচনা করেছেন, তেমনই ওয়েলস-রাসেল এমনকি আধুনিক রাশিয়ার নববিধানের সঙ্গেও তিনি অপরিচিত ছিলেন না।’ পিতার ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁর ধর্মবিশ্বাস কোনো দিন আঘাত পেতে ভয় পেত না। ব্রাহ্মসমাজের পুরাচার্যদের কাছ থেকে ও নিজের পিতার কাছ থেকে যে ধর্মবিশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন পুনরায় নিজের অন্বেষায় সে জিনিস অর্জন না করে ভোগ করবার মতোন অলস পাণ্ডিত্য তাঁর কোনো দিন ছিল না।’ এই ব্রহ্মবাদী পিতার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েই জীবনানন্দের ‘সজাগ প্রাজ্ঞ মন ইতিহাসধারার মুখোমুখি বসে ব্যক্তিগত দুঃখকে কখনো আক্ষেপে পরিণত হতে দেয়নি।’ সাহিত্যের আদি মূল্যবোধও তিনি পেয়েছিলেন কিছুটা পিতার এবং কিছুটা তার মা’র বাবা চন্দ্রনাথ দাশ ও মা কুসুম কুমারীর কাছ থেকে। কুসুম কুমারী বিদুষী ছিলেন :’বাবা-র ও পিসেমশায়ের অবর্তমানে তিনি বরিশাল-এর ব্রাহ্মসমাজে আচার্যের কাজ করতেন।’ কুসুমকুমারী কবিতা লিখতেন, তার সন্তানদের চেয়ে পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, যদিও বিয়ের কারণে এন্ট্রান্স দেওয়া হয়নি, তারপরও তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব অনুভব করা যায় সামান্য কয়েকটি বাক্যে।

চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে জীবনানন্দ একটি কবিতা লিখেছিলেন, সেটি পড়ে মা লিখলেন :’চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছ, ভালোই করেছ। কিন্তু রামমোহন-এর ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে। মহর্ষির ওপরেও।’ ছেলেবেলায় ঘুমানোর আগে বসে থাকতেন কখন মা দিনের সব কাজ শেষ করে ঘরে আসবেন। ‘সমস্ত দিনের শেষে দু’চারটে পত্র-পত্রিকা-বই নিয়ে’ মা পড়ছেন। আর মায়ের ‘মুখচোখের সামনের সেই প্রদীপটির দিকে তাকিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ছেন’ এই ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকের সেই অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর স্মৃতিচারণ। অন্যদিকে এটাও কবির মনে হয়েছে যে, কুসুমকুমারী যখন সময় সময় ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন, তখন ‘সেই আরাধনা উপাসনা আশ্চর্য নির্ঝরের মতো ধ্বনিত হয়ে তবুও ধ্বনির অতীত অর্থগৌরবের দিকে আমাদের মর্ম ফিরিয়ে রাখত; কোথাও ঠেকতেন না। তাল কেটে যেত না পুনরুক্তি ছিল না, কিন্তু যে সাহিত্যিকের ও কবির গরিমা তার প্রাপ্য ছিল, সেটাকে অন্তর্দমিত করে রাখলেন তিনি প্রকাশ্য কোনো পুরস্কার নিতে গেলেন না।’ আর পিতার ক্ষেত্রে যে ‘ভারতীয় দর্শন ও ভারতবর্ষের উপনিষদই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণের জিনিস ছিল’ একথা তো আগেই জানিয়েছেন। তবে বাড়তি যে উপাদানটি লক্ষ্য করার তাহলো পিতাকে নিয়ে কবির নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাটি : ‘প্রায় রোজ শেষরাতে বিশেষত হেমন্তকালে ও শীতকালে উপনিষদ-এর শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে তিনি আমাদের অপরূপ সূর্য-চেতনার প্রভাতে নিয়ে আসতেন।’ জীবনানন্দের এই স্মৃতিচারণা না বুঝলে কীভাবে তার ভেতরের যুক্তিধর্মী মানস ও নন্দনতাত্তি্বক অনুভব গড়ে উঠেছিল, তার উৎস নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এমনকি কিছু কিছু রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতি জীবনানন্দীয় সন্দেহের পেছনে তার পিতৃদেবের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল বলে আজ মনে হয়।

সত্যানন্দ দাশের ভাবাদর্শ নিয়ে বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন, ‘বিদেশের আগে নিজের দেশের অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রিক দুরবস্থা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েও তিনি প্রচলিত ন্যাশনালিজম ও স্বদেশপ্রীতির ভিতরের পার্থক্য অনুভব করতেন। তথাকথিত ন্যাশনালিজমকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখলেও দেশাত্মবোধ তাঁর কাছে গৌরবের জিনিস ছিল। রাষ্ট্রিক আন্দোলনে তিনি নিবেদনের বা ভিক্ষা মানসিকতার পক্ষপাতী ছিলেন না। জনসাধারণের সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যে একটি বিভেদ রয়ে গেছে, তা না ঘোচালে অল্পস্বল্প বা বিশেষ রাষ্ট্রিক পরিবর্তনেও যে কোনও দেশেরই স্থায়ী মঙ্গল হবে না। এ-সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন। দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ পর্বের জাতীয়তাবাদের সমালোচনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ সত্যানন্দ দাশের সূত্রে জীবনানন্দকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র পর্বে এসে নেশনের ব্যভিচার নিয়ে যেসব কবিতা জীবনানন্দ পরবর্তীতে লিখেছিলেন তার পূর্বসাক্ষ্য এখানেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। শামসুর রাহমান সে তুলনায় ভিন্ন ঘরানার মানুষ। কিন্তু নিজের মা, বাবা, ভাই, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে অনেকগুলো স্মরণীয় ও পৃথকভাবে আলোচ্য কবিতা লিখেছেন তিনি সারা জীবনে। মাকে নিয়ে তার বিখ্যাত কবিতা ‘কখনো আমার মাকে’ কাব্যজীবনের প্রথম পর্বেই রচিত হয়ে গিয়েছিল। কুসুমকুমারীর মত কবিতা লিখতেন না তিনি, এমনকি গুনগুনিয়ে গানও করতে শোনেননি মাকে। কিন্তু জীবনের সংকটময় মুহূর্তে নৈতিক সাহস যুগিয়েছেন তিনিই কবিকে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হামলায় কায়রোয় ছুরিকাহত হয়েছিলেন নাগিব মাহফুজ, সেই একইভাবে একই যুগে এ রকম হামলার মুখোমুখি হয়েছিলেন এদেশে হুমায়ুন আজাদ ও শামসুর রাহমান। সেই আতঙ্কের রেশ ও মহাপতনের শব্দ শোনা যায় কবির শেষ দিককার কাব্যগ্রন্থগুলোয়। তবে সেখানেও তার আঁকড়ে-ধরার উৎসমূল তার মা। মার সাথে হয়তো কোনদিন আর দেখা হবে না জেনেও স্বপ্নে তিনি শুনতে পান মা তাকে ভরসা দিচ্ছেন, বলছেন, যতক্ষণ তিনি সত্যের পথে অছেন, কোন ভয় নেই তার। অন্যত্র, মাতামহীর টাইপরাইটার অলৌকিকভাবে আবৃত্তি করতে থাকে কোরানের আয়াত, আওড়ায় ফার্সি বয়েত। কবির স্বপ্নের দ্বীপে তার মাতামহী হয়ে দাঁড়ান প্রজ্ঞাবান প্রস্পেরো। আর এসবই ধরা পড়ে কবির কাছে যখন তিনি ভাবছিলেন উপনিষদ তর্জমা করার সময় যুবরাজ দারাশিকোর মনে কি ভাবনার দোলা দিচ্ছিল, অথবা কী রকম জীবন ছিল সেইসব ইহুদীদের যারা আউসভিৎসের কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর দিন গুনছিলেন।

৩. ২০ শে মে ১৯৫৩’র চিঠিতে সুরজিৎ দাশগুপ্তকে জীবনানন্দ লেখেন, ‘আমার কবিতা সম্বন্ধে নানা জায়গায় নানা রকম লেখা দেখেছি/মন্তব্য শুনেছি; প্রায় চোদ্দআনি আমার কাছে অসার বলে মনে হয়েছে।’ অসারত্বের একটি নবতর নমুনা পাওয়া যায় ঐ উক্তির পাঁচ বছর পরে বেরুনো সুকুমার সেন-এর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে। ততদিনে কবি বেঁচে নেই। জীবনানন্দের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি গোবিন্দচন্দ্র দাসের সাথে কবির নৈকট্য দাবী করে বসেন : ‘গোবিন্দচন্দ্র দাসের পর জীবনানন্দই একমাত্র যাহার রচনায় পূর্ববঙ্গের নিজস্ব আবেষ্টনের রূপ ও রস ধরিয়াছে। তবে জীবনানন্দের অবলম্বিত বিশিষ্ট শিল্পকৌশলে সে প্রাকৃতিক আবেষ্টন শেষ অবধি কতকগুলি যেন সিম্বলে বিধৃত হইয়া হারাইয়া গিয়াছে’। এখন বোঝা যায় কেন অধ্যাপকদের উদ্দেশ্য করে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা’!

বেঁচে থাকলে গোবিন্দচন্দ্র দাসের সাথে তুলনা জীবনানন্দকে আরো বেশি আহত করত কেননা সহজাত বা স্বভাবকবিত্ব বিষয়টিকে বরাবরই প্রতিভার নিতান্ত প্রাথমিক লক্ষণ বলে জ্ঞান করেছেন তিনি। সহজাতের হাত ধরে চূড়ান্ত পরিণতিতে পেঁৗছানো দুরূহ। ‘কবিতা, তার আলোচনা’ প্রবন্ধে তিনি সহজ কবিগুণকে আরো দর্শন সচেতন ও জ্ঞানশুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ‘পৃথিবীর ও নিজের জীবনের ক্রমিক অভিজ্ঞতায়, কোন অভিজ্ঞতার কী মূল্য সেই চেতনায়, বিজ্ঞান কী দিতে পারছে, পারবে, জ্ঞান কী দিল’ এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে তরুণ কবিস্বভাবকে ‘আরো সজাগ ও তপঃশক্তিশীলভাবে শিক্ষিত ও অনুভূতিঘন ও সুস্পষ্ট’ করে তোলার পরামর্শ ছিল তার। তার মানে এই নয় যে, কবিকে তিনি বৈজ্ঞানিক, অর্থনীতিবিদ বা দার্শনিক হয়ে যেতে বলছেন। সেখানে একটা সীমারেখা টানতেই হয়েছে তাকে : ‘দার্শনিকের মতো এতটা সচেতন ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নয় কান্ট’এর মতো বা মার্ক্স’এর মতো নয়’, কিন্তু তবুও আরো প্রশিক্ষিতভাবে অগ্রসর হতে বলছেন তরুণ কবিকে এবং এ পথেই কেবল নিজেকে সফল ও শুদ্ধ করে নেয়া সম্ভব। তরুণ-কবির কাছে রিল্কে যে-উপদেশ দিয়েছিলেন, সেভাবেও এই রচনাটিকে দেখতে পারি আমরা। বাংলাদেশে মনন-বিরোধী চর্চার একটা ধারা বেশ কিছুকাল ধরে চালু হতে শুরু করেছে মনন-বিরোধী এক ‘বাউলিয়ানার চর্চা’ বলা যেতে পারে একে। জীবনানন্দের প্রবন্ধ-সমগ্র ঘাঁটলে এ রকম ধারার প্রতি তার সায় থাকত না এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বনলতা সেন-উত্তর জীবনানন্দের প্রেক্ষিতে তো এটা নিদ্বর্িধায় বলা যায়। লোককবি ও কবিতা সম্পর্কে তার বক্তব্য অশ্রদ্বেয় কিছু ছিল না, কিন্তু একে শিল্পের আদর্শকল্প ভাবতে চাননি কখনোই : ‘লোক কবিতা বলতে না বোঝায় আমাদের দেশে সেটা ভালো জিনিস, কিন্তু নিজের স্বভাবগুণকে আরও শিক্ষিত, ক্রমেই বেশি-শিক্ষিত করে নিয়ে ঢের বেশি পরিণতির পথে চালিয়ে নিতে পারা যায়। অনেক বৈষ্ণব কবির সহজাত কবিত্ব ছিল শিক্ষিত হয়েছিলেন কিন্তু ততবেশি শিক্ষিত দেশ, সমাজ, সে কালের বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক জ্ঞান ও প্রস্থান সম্পর্কে শিক্ষাদীক্ষায় সে-রকম কিছু সিদ্ধ-হয়ে উঠতে পারেন নি’। যারা মৌলিকভাবেই লোক দর্শনের অনুচিন্তন করেছিলেন সন্ত কবীর, দাদূ থেকে শুরু করে লালন ও হাসনরাজা তাদের কবিতায় ও গানে জীবনের ক্রমিক অভিজ্ঞতা, দর্শন ও জ্ঞানচর্চা অকৃত্রিমভাবে বিকাশমান হয়েছে। অথেনটিসিটি-এর কোন খামতি ছিল না তাতে। হুমায়ূন আহমেদের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবনে যুক্তির বাইরের হিমু ও যুক্তির ভেতরের মিসির আলী পরস্পরের সমর্থক হিসাবে কাজ করে যায়। সেখানেও অথেনটিসিটির-এর কোন ঘাটতি নেই। তবে র‌্যাশনালিজম পাশ্চাত্যের বিশেষ মানসিক গড়ন নয়, যেমন নয় মরমীবাদ প্রাচ্যের একচেটিয়া অধিকারে বীজগণিতের বীজ যেমন পাই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সভ্যতার চর্চায়, তেমনি ক্যালকুলাসের উদ্বোধন হয়েছিল মঞ্জুলা, দ্বিতীয় আর্যভট্ট ও দ্বিতীয় ভাস্করাচার্য্যের রচনা। থিওসফিক্যাল সোসাইটিগুলো বাজার পেয়েছিল পাশ্চাত্যেই [সে সুবাদে উনিশ-বিশ শতকে এদেশের নাগরিক বাবু সমাজে প্লানচেট-এর বেহ্তর আমদানি হয়েছিল]। সম্প্রতি ইংলন্ডের এক দোকানদারনী আমাকে বুঝিয়েছেন যে প্রাচ্যে তোমরা চর্চা করো মিস্টিকের, আর পাশ্চাত্যে আমরা চর্চা করি ম্যাজিকের। সুতরাং স্বভাবগুণকে মরমীগুণের আধার হিসেবে দেখে ভক্তিবাদেই প্রাচ্যের মুক্তি; এতে সায় থাকার কোন কথা ছিল না জীবনানন্দের ক্ষেত্রে। সমসাময়িক ইতিহাস, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্ম, রাজনীতি সমস্ত জটিল বর্তমানকে কবিতার অনুভবে আরো ভালোভাবে ব্যক্ত কী করে করা যায় সে রকম একটা চ্যালেঞ্জ বুকে নিয়ে জীবনানন্দ ধূসর পাণ্ডুলিপি-বনলতা সেন-এর চিরচেনা ভূমি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিছক পর্বান্তর নয়_ ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটির তারার তিমির’ ও [মরণোত্তর] ‘বেলা অবেলা ও কালবেলা’ ছিল সেই সচেতন সিদ্ধান্তেরই কতিপয় শিল্প-প্রকল্প। এতে করে শিল্পোত্তীর্ণতার সফলতা-ব্যর্থতার যেসব অনিশ্চয়তা থাকল সেসব ঝুঁকি নিয়েই তিনি কাজ করেছেন।

এক ভিন্ন পটভূমি থেকে শামসুর রাহমানও নিজেকে সঙ্গী করেছিলেন ঐ একই অভিযানে। তিনিও বিশ্বাস করতেন আধুনিকতার থেকে পিছিয়ে নয়, আধুনিকতার বাইরে নয়, এক ‘অন্য আধুনিকতার’ জন্ম দিয়েই কাব্যের [ও সমাজেরও] মুক্তি ঘটবে। যে তিমিরবিনাশী ‘আশা-ভরসার সমাজের’ স্বপ্ন দেখতেন জীবনানন্দ তা একদিনে হবার ছিল না। সে তো বার্লিনের দেয়ালের পতনের এবং ওয়াল স্ট্রিটের অধুনাতন বিপর্যয়ের পর আজ আমরা সহজেই বুঝতে পারি। যে ধরনের সমাজে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি ঘটবে, সে ‘অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’ এ রকম একটি জ্ঞান-আশ্রিত মানবিক সমাজ জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমানের আদর্শস্থানীয় ছিল। জ্ঞানের বিহনে যেমন প্রেম নেই, প্রেমের বিহনে তেমনি জ্ঞানও সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু : ‘এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কংকাল।’ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শামসুর রাহমান হঠাৎই আবার জীবনানন্দীয় সুরে বলে ওঠেন : ‘হয়তো তখন আরও অগ্রসর মানব-মানবী জন্ম নেবে।’ তবে দু’জনে এই উপলব্ধিতে পেঁৗছেছিলেন যার যার নিজস্ব যানে করে।

৪. দুর্বোধ্যতার যে অভিযোগই আবু সঈদ আইয়ুব আনুন না কেন, বা [এর বিপরীতে] স্বভাব-কবিত্বের যে তকমাই সুকুমার সেন দিতে চান না কেন, জীবনানন্দের মৃত্যুর পরবর্তী তিন দশকে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের মতোই অমোঘ ও ‘সর্বনেশে’ হয়ে উঠছে জীবনানন্দের প্রভাব। শুরু হয়ে গেছে জীবনানন্দের যুগ। অশোক মিত্র ১৯৬৫ সালে তারইকৃত পূর্বতন তিক্ত সমালোচনার মোড় ঘুরিয়ে ‘ভয়ে ভয়ে’ বললেন, ‘আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগেকার রবীন্দ্রানুস্মৃতির মতোই, বর্তমানের জীবনানন্দীয় ঘোর, আমার ধারণায়, বাংলা কাব্যকে এক জায়গায় আটকে রেখেছে, জীবনানন্দকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে না আসতে পারলে মুক্তি অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের সৃষ্টি জ্যোতির্ময়তম। কিন্তু সে জন্যই বলছি, তাঁর সর্ব সমাচ্ছন্ন করা প্রভাব পরম সর্বনাশের ব্যাপার।’ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ যিনি রচনা করেছেন এ কথা অবশ্য তার বহু আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। সেই যে জীবনানন্দের কবিতায় ‘রূপালী স্নান’ করে উঠে নিজের স্বভূমির দিকে পা বাড়ালেন কিছু ফলদ ব্যতিক্রম বাদ দিলে মূলত শামসুর রাহমান জীবনানন্দের প্রভাব থেকে নিজেকে সচেতনভাবেই আগলে রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘আমার নিজের কবিসত্তার বিকাশের তাগিদে কখনও কখনও স্বেচ্ছায় জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার থেকে কিয়দ্দূরে থেকেছি কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা দেখাইনি কস্মিনকালেও।’ পরের দিকে ‘নিদ্রার কুয়াশায়’ কবিতা-আকারে বলেছেন, ‘অম্লান জীবনানন্দ, পল এলুয়ার, ইয়েটস্ ফেলেছেন নিরিবিলি ছায়া’ তাঁর কোনো কোনো কবিতায়। ‘নেমকহারাম নই, করবো না অস্বীকার’ বলেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পাঠকদের যে এক কবিতার থেকে অন্য কবিতার জন্ম হতে পারে, যেমন এক শলাকার আগুন থেকে অন্য শলাকায় আগুন নেওয়া যেতে পারে। এ নিয়ে চায়ের পেয়ালায় নিরর্থক ঝড় তোলা।

শামসুর রাহমান যে জীবনানন্দকে পাশে সরিয়ে তার নিজস্ব ভূ-ভাগ দখলের দিকে অনায়াসে এগিয়ে যেতে পারলেন তার একটা বড় কারণ ছিল ষাটের দশকের স্বাধিকার-প্রমত্ত আন্দোলন। ‘বাংলাদেশ’ এই দেশের কাব্যভুবনের নিভৃত নায়ক শামসুর রাহমানকে দিয়ে ক্রমাগতভাবে মোহন শব্দাবলি লিখিয়ে নিচ্ছিল যার অভিজ্ঞতা জীবনানন্দের মধ্যে থাকার কথা ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন ও স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রের কাঠামো-উপরিকাঠামোজুড়ে কুরে কুরে খাওয়া সন্ত্রাস, অপশাসন ও অগণতান্ত্রিকতা, আর এসবের বিপরীতে ‘গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান’ শামসুর রাহমানের দুই-তৃতীয়াংশ কাব্যসম্ভারের বিশেষ চরিত্র নির্ধারণ করে দিয়েছে। কবির শেষ দিন পর্যন্ত এ কথা বলা যায়।

এর বিপরীতে জীবনানন্দের শেষ জীবনের কবিতা ক্লিষ্ট হয়েছে দেশভাগের আগে ও পরের রাজনীতি, দাঙ্গা, মন্বন্তর ও উদ্বাস্তুতার ছায়ায়। শহীদ কাদরীকে কলকাতা ছেড়ে এসে ঢাকায় নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে হয়েছে তার গোড়ার দিকের কবিতায় যুদ্ধের যে ছায়াপাত ঘটে যাকে তিনি ‘উত্তরাধিকার’ বলছেন র্যাঁবোর মতো তা হলো দেশভাগের আগে-পরের যুদ্ধের ছায়া, নরকের ঋতু। শামসুর রাহমানকে তুলনীয়ভাবে দেশান্তরিত হতে হয়নি। কিন্তু জীবনানন্দকে ছেড়ে আসতে হয়েছে পূর্ববঙ্গ, বরিশাল, ধানসিঁড়ি; ছেড়ে আসতে হয়েছে ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশন, ব্রাহ্মসমাজ, নারকেল-সুপারির বন, যেখানে ‘এক মাইল শান্তি কল্যাণ হয়ে’ছিল। তার শেষ জীবনের কবিতার লাইনের অর্থদ্যোতনা, অস্পষ্টতা, জটিলতা ও দ্বন্দ্বের যে ক্রমাগত বিরোধাভাস পাই এর পেছনে উপদ্রুত উদ্বাস্তু জীবন, কলকাতায় গিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার তুমুল প্রাণপাত প্রচেষ্টা, অর্থনৈতিক টানাপড়েনের গ্গ্নানি, যুদ্ধ-মন্বন্তর-দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশভাগ আর এসবের সাথে জড়িত পথনির্দেশহীনতা বেশ কিছুটা পরিমাণে দায়ী। শামসুর রাহমান ও জীবনানন্দ দু’জনেই এক অর্থে জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিজেকে ‘নিজভূমে পরবাসী’ বলে মনে করে থাকবেন। শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করা শেষ দিককার একটি কবিতায় স্পষ্ট করে শামসুর রাহমান বলেছিলেনও সে কথা। তবে দু’জনেই ছিলেন তিমিরবিনাশী সমাজের বিপরীতে নিষ্কম্প দাঁড়ানো তিমিরবিনাশী সমাজের অভ্যুদয়ের আশায়।

ইস্তাম্বুল সিম্ফোনি: নাজিম হিকমতের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ :বিনায়ক সেন
“তুমি বলেছিলে :’যদি ওরা তোমাকে মেরে ফেলে আমি বাঁচব না!’ কিন্তু তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা আমার, বাতাসে কালো ধোঁয়ার মতো মুছে যাবে আমার স্মৃতিগুলো। [কেননা] বিংশ শতকে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।” এই লাইন ক’টি যার লেখা তিনিই তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত।

বেট্রল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, জর্জি আমাদু, পাবলো পিকাসো, ইলিয়া এরেনবুর্গ, পল রোবসন, ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর প্রিয় কবির সারিতে ছিল নাজিম হিকমতের নাম। নাজিমের একটি কবিতা এভাবে আশা প্রকাশ করেছে :’আমি মরতে চাই না, কিন্তু যদি মৃত্যু আসে, তবু আমি বেঁচে থাকব তোমাদের মাঝে, আমি বেঁচে থাকব আরাগঁর কবিতায়, তার ঠিক সেই লাইনটিতে যেখানে সে আসন্ন সুখের দিনগুলোর কথা লিখেছে। আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আর রোবসনের গানে’। ১৯৫০ সালে নেরুদা এই বলে তাকে সম্মানিত করেছিলেন :’নাজিমের কবিতায় সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে’।

চিরটা কাল বামপন্থার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু ভিন্ন ধরনের বামপন্থি ছিলেন তিনি। স্তালিনকে ঘিরে ব্যক্তি-পূজার নিন্দা করেছিলেন স্তালিনের জীবদ্দশাতেই খোদ মস্কোতে বসেই। স্তালিনের গোয়েন্দা দফতরের প্রধান বেরিয়ার গুপ্তচরেরা তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকত_ এ কথা ইয়েভতুশেঙ্কো জানিয়েছেন ‘রোমান্টিক কম্যুনিস্ট’ বইয়ের ভূমিকায়। পূর্ব-পশ্চিম সব মহাদেশ থেকে কবিতার উপকরণ আহরণ করেছেন তিনি। তার প্রিয় তিনজন কবি ছিলেন তিন ভিন্ন ভুবনের। তুরস্কের সূফী-সন্ত জালালুদ্দিন রুমি, ফরাসি আধুনিকতার শার্ল বোদলেয়ার, আর রুশ বিপ্লবের ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। যদিও নাজিম বলবেন, এরা আসলে এক ভূগোলেরই অধিবাসী_ তিনজনই তাদের কালের মানবচিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘মানবের মানচিত্র’ নামে পরবর্তীতে নাজিম নিজেই লিখেন একটি মহাকাব্য যা এখনও বাংলায় অনূদিত হতে বাকি।

বামপন্থার আদর্শের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে নাজিমকে তুরস্কের সরকার বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৫৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। পুরো মেয়াদ অবশ্য কারাবাসে থাকতে হয়নি কবিকে। প্রকৃতপক্ষে ১৭ বছর জেলে ছিলেন তিনি। এর আবার ১৩ বছর ছিল বিরতিহীন_ ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫১ সাল অব্দি। জেল পর্ব ছিল তার লেখার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্ব। ১৯৩৮ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সামরিক একাডেমীর ক্যাডেটদের উস্কে দিয়েছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সেসব ক্যাডেট নাকি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল! জ্যাঁ পল সার্ত্রে, পাবলো পিকাসো, ত্রিস্তান জারা তার মুক্তির জন্য বিশ্ব-জনমত গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জনমতের চাপে ছাড়া পেলেন ঠিকই, কিন্তু দেশে থাকতে পারলেন না বাদবাকি জীবন। ১৯৫১ সালেই তাকে যেতে হলো নির্বাসনে। সেই কারণটা জানা গেল ২০০৬ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তুরস্কের ওরহান পামুকের সুবাদে।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে পামুক শুধু একদিনের জন্য ইস্তাম্বুলের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের সম্পাদক হলেন। জার্নালিজমের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু এর আগে কখনও সরাসরি সাংবাদিকতায় আসেননি। সম্পাদক হয়ে রোববারের প্রথম পাতাজুড়ে প্রকাশ করলেন একজনের ছবি। ছবির নিচে লেখা_ ‘থুথু ফেলো এতে’। ছবিটা কবি নাজিম হিকমতের। ১৯৫১ সালে তুরস্কের সরকারি কাগজগুলো এভাবেই নাজিমের ছবি ছাপিয়ে জনগণকে উস্কানি দিয়েছিল ছবিটাকে ঘৃণা করতে। দৃশ্যত নাজিমের অপরাধ ছিল দুটি। প্রথম অপরাধ, ১৯১৫ সালে আরমেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য [যার দায় তুরস্কের সরকার এখনও স্বীকার করেনি] তিনি জনগণের হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় অপরাধ, কুর্দিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। পামুক তার সম্পাদকীয়তে আরও লিখলেন, ‘সেই ১৯৫১ সাল থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিকের সম্পর্কটা [নাজিমের বিরুদ্ধে ৫০ বছর আগে যেমন ছিল] তেমনই রয়ে গেছে।’

নাজিমের কবিতায় রাষ্ট্রের কাছে ঘা-খাওয়া এক শান্ত, গর্বিত এবং লড়াকু মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার কথা পাওয়া যায়। কিন্তু তার কবিতার প্রধান সুর বিষণ্ন। তিনি অপেক্ষা করে থাকেন সেই দিনের মুখ চেয়ে, যেখানে প্রতিটা মানুষ বেড়ে উঠবে ‘বৃক্ষের মতো একা স্বাধীন সত্তা নিয়ে, কিন্তু থাকবে অরণ্যের যৌথ চেতনায়।’ ১৯০২ সালে তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয় নাজিম হিকমতের জন্ম। যেখানে জন্ম সেখানে আর ফেরা হয়নি কোনদিন। বলতেনও_ ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না’। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন জেলে থাকতেই। কিন্তু বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন আরও অনেক বছর। তার জেল পর্বের একটি কবিতা বলেছিল :’আমরা ভেঙে পড়ব না, শত্রুদের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্যে হলেও অতিরিক্ত একটি দিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।’ ১৯৬৩ সালে মস্কোয় এক রোদেলা সকালে বেরিয়েছেন প্রতিদিনের মতো দৈনিক খবরের কাগজ আনতে। বাসার সামনেই চিঠিপত্র রাখার বাক্স। কাগজটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়লেন।

এর বছর দুই আগে, ১৯৬১ সালে নিজের এক সংক্ষিপ্ত জীবনী বলে গিয়েছিলেন তিনি কবিতার আকারে। কন্সতান্তিন সিমোনভ থেকে এডোয়ার্ড হির্শ_ সবাই বলবেন, এটিও নাজিমের বিস্ময়কর রচনাশৈলীর একটি উদাহরণ। পাবলো নেরুদার মতো নাজিম হিকমত কোনো বিশদ আত্মস্মৃতি রেখে যাননি তার ঘটনাবহুল জীবনের ওপর। অবশ্য অন্যরা পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে লিখবেন। যেমন বের হবে ঔপন্যাসিক ওরহান কেমালের ‘নাজিম হিকমতের সাথে জেলে’ বা তার পত্নী পিরাইয়ের সঙ্গে পত্রালাপ। তারপরও নাজিমের কবিতাই হবে তার সবচেয়ে অনুপ্রাণিত জীবনী, এবং একই সঙ্গে তার সময়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্মৃতিকথা।

এ রকম কিছু কবিতা এখানে [যার কয়েকটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি] রুশ ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে নতুনভাবে ভাষান্তর করা হলো বাংলায়।

নাজিম হিকমতের পৃথিবী

বিনায়ক সেন | তারিখ: ০৩-০৬-২০১১
আরো দেখুন: নাজিম হিকমতের কবিতা

নির্বাসিত নাজিম
‘নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়’ এমন একটি লাইন আমাদের যৌবনের আকাশে তারকাখচিত হয়ে গিয়েছিল। অনুবাদক ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫২ সালে বেরুনো বইয়ের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, যদিও বেশিরভাগ কবিতাই ইংরেজি পাঠ থেকে নেওয়া, কিছু কিছু কবিতা ফরাসি থেকেও অনূদিত। ফরাসি থেকে অনুবাদের কাজে তিনি গীতা মুখোপাধ্যায় ও (পরবর্তীতে নিম্নবর্গের ইতিহাস-খ্যাত) রণজিৎ গুহের সাহায্য নিয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিচারণায় পড়েছি, (১৯৫১ কি ’৫২ সালে কলকাতায়, জানি না কী করে, আমাদের বন্ধু ডেভিড কোহেনের হাতে এসেছিল নাজিম হিকমতের একগুচ্ছ কবিতার ইংরেজি তর্জমা। ইংরেজি খুব উচ্চাঙ্গের নয়। তবু পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন জানা যাচ্ছে ইংরেজিতে নাজিম হিকমতের কবিতার প্রথম সংকলন বের হয় কলকাতা থেকেই—পরিচয় প্রকাশনী থেকে ১৯৫২ সালে। ইংরেজিতে এর আগে নাজিম হিকমতের কোনো কাব্য-সংকলন প্রকাশ পায়নি। কেন এ রকম একটি সংকলন আর সব জায়গা থাকতে কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতে হবে সেটাও খানিকটা রহস্যজনক। এর পেছনের কার্য-কারণ সূত্র এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।

গত শতকে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল ম্যাকার্থিবাদের দাপট। সর্বত্র কমিউনিজমের চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সিনেটর ম্যাকার্থি—‘আন-আমেরিকান’ কর্মকাণ্ডের জন্য হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন একের পর এক কবি-নাট্যকার-শিল্পী-বিজ্ঞানীরা। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও বাদ যাচ্ছেন না। এদের মধ্যে ছিলেন লেখক আর্থার মিলার, এলিয়া কাজান, লিলিয়ান হেলম্যান, হাওয়ার্ড ফাস্ট, ডরোথি পার্কার, ইরউইন শ, ল্যাংস্টন হিউজ, সাংবাদিক উইলিয়াম শীরার, গায়ক পিট সিগার, নোবেল-জয়ী বিজ্ঞানী লাইনাস পাওলিং প্রমুখ। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মুক্তচিন্তার নামে দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এসবের মধ্য দিয়ে কার্যত তাঁরা পরিণত হয়েছেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমর্থকে। এ রকম বৈরী পরিবেশে কমিউনিস্ট কবি নাজিম হিকমতের অনুবাদ আমেরিকায় প্রকাশ করা সহজ ছিল না। নাজিমের অনুবাদ যাঁরা সেদিন করেছিলেন (তাঁদের নাম যথাক্রমে নিলুফার ও রোসেট) তাঁদেরকেও ছদ্মনামের আশ্রয় নিতে হয়। ফলে অনুবাদক হিসেবে ছাপা হয় আলি ইউনূসের নাম। ‘আলি’ খুবই প্রচলিত নাম, আর ‘ইউনূস’ এসেছিল ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ইউনূস এমরে-র থেকে। অনুবাদকেরা জানতেন, দরবেশ কবিকুলের মধ্যে রুমি ছাড়া এমরের কবিতা নাজিমের খুব প্রিয় ছিল। যা হোক, অনুবাদ তো হলো, কিন্তু ছাপানো নিয়ে সমস্যা গেল না। এই সময়ে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভারত থেকে আসা কিছু শিক্ষার্থী’ (ওদের নাম এখনো জানা যায়নি এবং ওদের অধিকাংশ বাঙালি হলে বিস্ময়ের কিছু নেই) নাজিমের এই অনুবাদ হাতে পান। পড়ে তাঁরা এতই বিমোহিত হয়ে পড়েন যে, এই মহার্ঘ বস্তু দ্রুত জনসমক্ষে আনার জন্য পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। এভাবেই ‘পরিচয়’ প্রকাশনী থেকে (হয়তো ডেভিড কোহেনের হাত ঘুরেই) ১৯৫২ সালে ৩৫টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে ‘নাজিম হিকমতের নির্বাচিত কবিতা’র প্রথম সংকলন।

যেহেতু নাজিম আজীবন কবিতা লিখেছেন তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে, তাঁর কবিতার অনুবাদ কিছুটা দেরিতে হলেও পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে রুশ ভাষায়, তার পরে ফরাসিতে এবং গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি হারে ইংরেজিতে। তাঁর কবিতার পাঠকের সংখ্যা ইংরেজি-জানা বৃত্তে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, তাঁর স্বদেশীয় মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমীর মতো নাজিম হিকমতও আধুনিক ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যের ভুবনে এখন একটি অতি প্রিয় নাম। অন্তত দশটি কাব্য-সংকলন, একাধিক জীবনী গ্রন্থ, স্মৃতিচারণা ও চিঠিপত্র নিয়ে নাজিমিয়ানা এখন ইংরেজিতে অনুবাদের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়েছে। নিজের কবিতার অনুবাদ নিয়ে ১৯৬১ সালের দিকে লেখা একটি কবিতায় নাজিম লিখেছিলেন, ‘তিরিশটি-চল্লিশটি ভাষায় আমার লেখা প্রকাশিত, কিন্তু আমার তুরস্কে, আমার তুর্কি ভাষায় আমার লেখা নিষিদ্ধ।’ ১৯৫১ সালের ২৫ জুলাই তুরস্কের সরকার তাঁর নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে মৃত্যুর ৪৬ বছর পর সেই নাগরিকত্ব ফিরে পান তিনি। এখন ইস্তাম্বুলের এশিয়া অংশে চালু হয়েছে নাজিমের প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে ‘পিরাইয়ে কাফ্যে’, খোলা হয়েছে নাজিম হিকমত আকাদেমি, সেখানে প্রতিদিন ভিড় করে সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষ।

এক নিঃসঙ্গ বিপ্লবী
১৯০২ সালে তাঁর জন্ম তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয়। যেখানে জন্ম সেখানে কখনো আর ফিরে যাননি। বলতেন, ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না আমি।’ তারপরও ফিরে গিয়েছিলেন মস্কোতে—একবার নয়, বার তিনেক। প্রথমবার ১৯২১ সালে—মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। দ্বিতীয়বার ১৯২৮ সালে—তুরস্কের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে। তৃতীয়বার ১৯৫১ সালে—জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৬৩ সালে মস্কোতেই তাঁর মৃত্যু। ঘর থেকে প্রতিদিনের মতো বের হয়েছেন সকালের পত্রিকা আনতে, পত্রিকাটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়েন আকস্মিকভাবে। অনেক দিনের বুকের অসুখ নিয়ে এর বছর কয়েক আগেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা—‘এঞ্জাইনা প্যাক্টোরিস’। ১৯২১ সালে যখন মস্কোয় পড়তে যান তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর। ১৪ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘কেউ কেউ জানে উদ্ভিদ জগতের রহস্য, কেউ কেউ জানে মাছেদের ভুবন, কেউ বা জানে তারাদের নাম, আর আমি জানি সব ধরনের নিঃসঙ্গতার ভাষা।’

রেজিস দেব্রে এক সময়ে চে গুয়েভারার বলিভিয়ার অভিযানের সঙ্গী ছিলেন (এবং পরবর্তীতে হয়েছিলেন ফ্রান্সের সোশ্যালিস্ত প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর উপদেষ্টা)। তিনি নাজিমের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্যারিসে। বিশ্ব জনমতের চাপে তুরস্কের জেল থেকে তিনি সবে ছাড়া পেয়েছেন। ‘কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন কীভাবে’—এই প্রশ্নের উত্তরে নাজিম বলেছিলেন: ‘পার্টি করে মানুষ সাধারণত দুই কারণে। এক, তারা আসে মেহনতি শ্রেণীর থেকে। মেহনতি শ্রেণীর পার্টিতে খেটে-খাওয়া মানুষেরা আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। আমার পরিবার ছিল আমলাদের পরিবার (নাজিমের নানা ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর “পাশা”—সুলতানদের দরবারে এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী)। দুই, আর পার্টিতে যারা আসে, তারা আসে বুদ্ধির তাড়নায়—বই পড়ে, চিন্তা করে, মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। কিন্তু আমি এসেছিলাম হূদয়ের টানে। ১৯ বছর বয়সে যখন মস্কোয় যাই আমার একমাত্র ইচ্ছে ছিল লেনিনের সঙ্গে দেখা করব, দেখা করে বলা, “আপনার সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি আমাকে বলে দিন। আপনি কী করে বিপ্লব সমাধা করলেন তার রহস্য আমাকে বলুন।” আসলে আমার ইচ্ছে ছিল, লেনিনের কাছ থেকে এরকম কোনো গোপন চাবিকাঠি পকেটে নিয়ে আমি নিজ দেশ তুরস্কে ফিরে যাব। তারপর “বিপ্লব করে” গরিবী ঘুচাব দেশের মানুষের।’ লেনিনের সঙ্গে অবশ্য সরাসরি কখনো দেখা হয়নি নাজিমের। কিন্তু ১৯২৪ সালে লেনিন যখন মারা গেলেন তখন সেই অগণন শোক মিছিলের মধ্যে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন।

মস্কোয় থাকতেই কমিনটার্নের সংস্পর্শে গড়ে ওঠা তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নাজিমও জড়িয়ে পড়েন। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মুস্তফা সুফির মৃত্যু ঘটে কিছুটা রহস্যজনকভাবে দেশে ফেরার পথে সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়ে। লেনিনের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নাজিম ফিরে যান তুরস্কে। এরই মধ্যে তুরস্কে খেলাফতের অবসান হয়েছে, রিপাবলিক ঘোষিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মোস্তফা কামাল (পরে আতাতুর্ক অভিধা পেয়েছেন)। কমিউনিস্টদের সঙ্গে প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি নিয়ে চলছিল আতাতুর্কের রিপাবলিকান পার্টি। কিন্তু সে অবস্থা অল্প দিনেই বদলে যায়। নিষিদ্ধ হয় ‘প্রগ্রেসিভ রিপাবলিকান পার্টি’ (প্রকাশ্য সংগঠন ছিল এটি বামপন্থীদের)। কমিউনিস্ট পার্টি চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। তুরস্কে ফিরে গিয়ে নাজিম প্রকাশ্যে কাজ করেছেন প্রথমে বিভিন্ন পত্রিকায়, উদ্দেশ্য—লেখালেখি। আবার গোপনে যুক্ত থেকেছেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে—ইস্তাম্বুলে পার্টির গোপন কংগ্রেসেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে গোপন ইশতেহার বিলির দায়ে তুরস্কের আদালত তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আত্মগোপনরত অবস্থায়। নাজিমকে আবারও দেশ ছেড়ে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দিয়ে চলে আসতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে প্রবাসে থাকাকালীনই সাধারণ ক্ষমতায় রাজবন্দীদের মামলা তুলে নেওয়া হলে এর আগেকার ১৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করা হয় নাজিমের ওপর থেকে। ১৯২৮ সালে নাজিম তুরস্কে ঢুকতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন, তিন মাস জেল খেটে আবার বেরিয়ে আসেন। এর পর থেকে তুরস্কেই ছিলেন তিনি কিন্তু বিরতিহীনভাবে ‘আজ গ্রেপ্তার, কাল ছাড়া আবার পরশু গ্রেপ্তার’ এরকম চক্রের মধ্য দিয়ে। এ সময়ের আতাতুর্ক শাসনের লক্ষণীয় দিক ছিল বামপন্থীদের কোণঠাসা করার পাশাপাশি আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা। য়ুরোপের অনেক দেশের আগেই ১৯৩০ সালে তুরস্কের মহিলারা পায় ভোটাধিকার, স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগও পায় তারা। শরিয়াপন্থীদের সঙ্গে রিপাবলিকপন্থীদের রাজনৈতিক লড়াইও চলতে থাকে। কিন্তু নাজিমকে ক্রমাগত বিব্রত হতে হয় একের পর এক মামলায়। নাজিম নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন কি-না সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয় ছিল না। গোপন বনাম প্রকাশ্যে কাজ নিয়ে পার্টি মধ্যে মতদ্বৈততা ছিল। নাজিম ছিলেন প্রকাশ্যে কাজের পক্ষে এবং এ কারণে ১৯৩২ সালে পার্টি থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু নাজিম নিজেই ছিলেন মার্কসবাদী পার্টির জীবন্ত প্রতীক। ফলে পার্টির সদস্যপদ হারালেও তাঁর বিরুদ্ধে হয়রানি মামলা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এখন জানা যাচ্ছে যে, স্বয়ং আতাতুর্ক এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুক্রু কায়া নাজিমের কবিতা গোপনে ভালোবাসতেন বলে বামপন্থী সত্ত্বেও তাঁকে দীর্ঘদিনের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখতে চায়নি তুরস্কের সরকার। ছোট ছোট মামলায় জড়িয়ে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত রাখাই ছিল দমন-পীড়নের উদ্দেশ্য। একটি উদাহরণ দিলে রাষ্ট্রের এই কূটকৌশলটি পরিষ্কার হবে।

১৯৩১ সালের ৬ মে নাজিম গ্রেপ্তার হন লেখার জন্য; ছাড়া পান ওই বছরের ১০ মে। ১৯৩৩ সালে ১৮ মার্চ আবার গ্রেপ্তার হন লেখার কারণে। এবার রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলী সরকারকে উৎখাত করার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দাবি করে। ওই বছরের ২৯ জুলাই ছয় মাসের কারাদণ্ড পান। ওই একই বছরের ২৭ আগস্ট তাঁকে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় ব্যঙ্গ কবিতা লেখার জন্য। ১৯৩৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তাঁকে দেওয়া হয় আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড সম্পূর্ণ অন্য একটি মামলায়, যদিও সেটাও লেখারই জন্য। ১৯৩৪ সালের ৪ আগস্ট রিপবালিকের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে নাজিম আবারও সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পান। এসব ডামাডোলের মধ্যেই আবার তাঁর কয়েকটি কবিতা সরকারি অনুমোদনে কলেজের পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়। ইতিমধ্যে স্পেনে শুরু হয়ে গেছে ফ্রাঙ্কোবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন। এই অবস্থায় ১৯৩৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নাজিম আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামিনে ছাড়া পান। এসবের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কবিতা ছড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সীমানার বাইরে। সুররিয়ালিস্তরা প্যারিসে তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেছে এরই মধ্যে। কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি তাঁর কবিতার ওপরে গানের রেকর্ড বের করেছে। নাজিম নিজে বিভিন্ন নাটক লিখে মঞ্চস্থ করাচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে লিখছেন চিত্রনাট্য এমনকি ১৯৩৭ সালে নিজেই নির্মাণ করেছেন এক শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র ‘সূর্যের দিকে’ (এর আগে ইস্তাম্বুল সিম্ফনি ও বুর্মা সিম্ফনি নামে আরও দুটি তথ্যচিত্রও তাঁর পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে।) রাশিয়ায় তখন চলছে কুখ্যাত মস্কো শো-ট্রায়াল—লেনিনের সহকর্মী বুখারিন রাদেক, জিনোভিয়েভ কামেনেভদের বিরুদ্ধে। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে প্রায় একইভাবে সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য কারণ দেখিয়ে মায়াকোভস্কি-মেইয়ের হোল্ডের সহকর্মী নাজিমের বিরুদ্ধে তুরস্কেও চলছে প্রহসন-বিচার। ১৯৩৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেষবারের মতো গ্রেপ্তার হলেন নাজিম হিকমত। এবার তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে ২৮ বছর চার মাসের দীর্ঘ কারাদণ্ড। হয়তো আতাতুর্ক বেঁচে থাকলে এমনটা হতো না। কিন্তু আতাতুর্ক মারা যান ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর। ফলে ওই দণ্ডের আর রদবদল হয়নি।

নাজিমের মতো আর কোনো কবিকে বিংশ শতাব্দীতে এতো ক্ষান্তিহীন ভাবে আইনি মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয়নি, এতবার গ্রেপ্তারও করা হয়নি, সম্ভবত আর কাউকে। যদি সব কারাদণ্ডের আদেশ বহাল থাকত— ইলিয়া এরেনবুর্গ হিসাব করে বের করেছেন—তাহলে তাঁকে জেলের মধ্যে কাটাতে হতো এক দুটো বছর নয়, এক দুই দশকও নয়—মোট ৫৬ বছর। এতটাই বিপজ্জনক ছিলেন ‘সিস্টেমের জন্য’ নীলচক্ষু সোনালী চুলের কবি নাজিম হিকমত!

মায়াকোভস্কি, বোদলেয়ার ও রুমি
কবিতায় যে নন্দনতত্ত্ব নাজিম প্রবর্তন করেছিলেন তার জন্য তিনি অকুণ্ঠ ঋণ-স্বীকার করেছেন তিনজনের কাছে। একজন রুশ কবি (কারো কারো মতে, ‘অক্টোবর বিপ্লবের কণ্ঠস্বর’) ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। দ্বিতীয় জন, আধুনিক ফরাসী কবিতা যার হাতে জন্ম সেই কিংবদন্তীসম শার্ল বোদলেয়ার। আর তৃতীয় জন, নিজ দেশের—‘মরমী কবি’ জালালুদ্দিন রুমি। মায়াকোভস্কির প্রভাব পড়েছিল তার প্রথম দিকের কবিতায়। এ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন যে, সিঁড়ি-ভাঙা মাত্রায় মুক্ত ছন্দে নাজিমও তার কবিতার লাইন সাজিয়েছেন। মায়াকোভস্কির মতই তার কবিতায় দেখা দিত নানা অপ্রত্যাশিত বাঁক, তার কবিতার তীর্যক সুরও একই উৎস থেকে প্রাপ্ত। নাজিমের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল মায়াকোভস্কির। উভয়ে একই মঞ্চ থেকে কতবার কবিতা-পাঠ করেছেন উদাত্ত গলায়। বিশের দশকের শুরুতে মস্কো তখন হয়ে উঠছে নব-নিরীক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্র। কবিতা, নাটক, সিনেমা, উপন্যাস-সর্বত্র চলছে নতুন প্রলেতারীয় কালচারকে চিনে-নেওয়ার পালা। ১৯২১-২৪ ও পরে ১৯২৫-২৮ কালপর্বে নাজিমের কবি-জীবন এই নব-নিরীক্ষা আন্দোলনৈর পরিবেশে অগ্রসর হয়েছে।

একবার মায়াকোভস্কি ও নাজিম একই মঞ্চে কবিতা পড়বেন। হাত-পা নেড়ে মায়াকোভস্কি তাঁর কবিতা উচ্চগ্রামে পড়ে গেলেন। এরপর নাজিমের পালা। স্বভাবতই কিছুটা স্নায়ুর চাপে ছিলেন। মায়াকোভস্কি তাঁকে বললেন, ‘দ্যাখো বাপু, তুমি তো পড়বে কবিতা তুর্কি ভাষায়, এখানকার রুমী দর্শকেরা সেসবের বিন্দু-বিসর্গ জানে না। সুতরাং মনের সুখে তুমি পড়ে যাও। দেখবে প্রচুর হাত তালি পাবে।’

এরেনবুর্গ তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, মায়াকোভস্কি নয় বরং নাজিমের কবিতার নিকটতম তুলনা হতে পারে কেবল পল এলুয়ারের কবিতা। সেটা সম্ভবত এলুয়ারের ওলগার সাথে নাজিমের কবিতায় পিরাইয়ের বহুল উল্লেখের কথা ভেবে লেখা। এলুয়ার ও নাজিম উভয়েই অবিশ্রান্তভাবে নিজেদের প্রিয়তমাসুদের প্রসঙ্গ এনেছেন কবিতায়। নাজিম নিজে অবশ্য বলেছেন অন্য কথা। মায়াকোভস্কির মত কংক্রিট কিছুটা কর্কশ গদ্য-ছন্দের চেয়ে আরো অনেক মৃদু-স্বরের কবিতা তার। জেলপর্বের কবিতায় আসলেই নাজিমের স্বর অনেক খাদে নেমে গিয়েছিল—যেন নিজের কথা অন্য কারো জন্যে নয়, কেবল তার নিজের জন্যে লেখা অথবা তার প্রিয়তমার মুখোমুখি বসে স্বাগত উচ্চারণে শোনানোর জন্যে লেখা।

দেব্রে তাঁর সাক্ষাৎকারে নাজিমকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কার জন্যে কবিতা লেখেন, নাজিমের উত্তর ছিল সোজাসাপ্টা: ‘কবিতাকে আগে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। একজন বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক, বামপন্থী, দায়বদ্ধ কবি (যে-নামেই তাকে চিহ্নিত করুন না কেন) তিনি হবেন এক সদা-সক্রিয় কবি: তিনি শুধু মানুষের হূদয়ের কথাই বলবেন না, হূদয়কে তিনি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত করবেন।.. লেনিন যখন বেঁচে ছিলেন, সেই সময়ের মস্কোয় মায়াকোভস্কি ও ইয়েসেনিনের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সেসময় বড় বড় জমায়েতে কবিতা পড়া হত। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমার দেশেও তো কবিরা যুগ যুগ ধরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে ঘুরে জনগণের সামনে কবিতা পাঠ করেছেন। জেলে যাওয়ার আগে আমিও কবিতা লিখতাম বহু শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ব বলে। পরে যখন জেলে থাকতে হল অনেক দিন ধরে, তখন থেকে আমার স্বরও নেমে যেতে থাকল। আমার শ্রোতা বলতে কেউ ছিল না, বা থাকলেও এক-দুজন মাত্র। একজনকে শোনাতে পারলেও আমার মনে হত তখন এর মধ্য দিয়েই আমি পৃথিবীর সব মানুষের কাছে যেতে পারছি’।

নাজিম তার এক কবিতায় একবার নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বলো, হিকমত-পুত্র, কোন শহরে তুমি মরতে চাও’? উত্তর দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আমি মারা যেতে চাই ইস্তাম্বুলে, মস্কোয় এবং প্যারিসেও।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমার মৃত্যুগুলোকে আমি পৃথিবীর উপরে বীজের মত ছড়িয়ে দিয়েছি, এর কিছু পড়েছে ওদেসায়, কিছু ইস্তাম্বুলে, আর কিছু প্রাগে। সবচেয়ে যে-দেশকে আমি ভালোবাসি সেটি হচ্ছে পৃথিবী। যখন আমার সময় আসবে, আমাকে পৃথিবী দিয়ে মুড়ে দিও’। অনেক শহরের মধ্যে প্যারিস যে মাঝে-মাঝেই ঘুরে-ফিরে আসে তার কবিতায় তার একটা প্রধান কারণ ছিলেন বোদলেয়ার। ‘প্যারিস স্প্লীন’ থেকে গদ্য-ছন্দের এক নতুন সুষমা তিনি আহরণ করেছিলেন। ফরাসি ভাষায় দখল থাকায় মূলের স্বাদ নিতে বাধা হয়নি তারা নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনের নানা খুঁটিনাটি কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছিল তার কবিতায় বোদলেয়ারের প্রেরণাতেই। অন্যত্র তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমি কবিতা লিখতে শুরু করি পনেরো বছর বয়সে। ঐ সময়ে ভালোবাসা ও মৃত্যু কবিতাকে আচ্ছন্ন করে থাকে। বাবার দিক থেকে আমি একেবারেই প্রাচ্যপন্থী, আর মা’র দিক থেকে পুরোপুরি য়ুরোপীয়। আমি বোদলেয়ার দ্বারা পুরোপুরি আচ্ছন্ন দিলাম, কিন্তু আমার দেশের দরবেশ কবিকুলও আমার চৈতন্যে প্রভাব ফেলেছিলেন। আমি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণে তৈরি’।

প্যারিসের কোন জিনিসটি সবচেয়ে ভালো লাগে? সে হচ্ছে প্যারিসই। এখানে কি তোমার দেখা হয়েছে তোমার কমরেডদের সঙ্গে? হ্যাঁ, আমি দেখেছি নামিক কামাল, জিয়া পাশা, মুস্তফা সুফি ওদের। আমি দেখেছি আমার তরুণী বয়সের মাকে—তিনি ছবি আঁঁকছেন, ফরাসিতে কথা বলছেন অনর্গল— পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী তিনি। বলো তো. প্যারিসকে কেমন দেখায়? তাকে দেখায় প্যারিস বাসীর মতো। বলো, আদমের পুত্র, এবারে বলো—তুমি কি প্যারিসকে বিশ্বাস করো, হ্যাঁ, আমি প্যারিসকে বিশ্বাস করি।’ তাঁর প্রিয় বন্ধু লুই আরাগঁ, পল এ লুয়ার, ত্রিস্তান জারা, পাবলো পিকাসো—এদের স্মৃতি প্যারিসকে ঘিরেই। এ কারণেই অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি বেঁচে থাকব আরাগঁ-র কবিতায়, আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আমি বেঁচে থাকব মার্সাইয়ের ডক শ্রমিকদের মধ্যে।’ শহর নিয়ে এরকম অনর্গল প্রশস্তি-গাঁথা আর কোথাও নেই: নেরুদা করেননি তার মান্টিয়াগো নিয়ে, কার্দেনাল করেননি তাঁর মানাগুয়া নিয়ে, পুশকিন করেননি তার সেই পিটার্সবাগ নিয়ে। নাজিম নিজেও আর কোনো শহরকে নিয়ে এতটা প্রেমময় কাব্য লেখেননি।

দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থরাজি : দুর্লভ সময়ের হলফনামা

বিনায়ক সেন

বোর্হেস বলেছিলেন, বেহেশত্ নিশ্চয়ই হবে এক বিশাল গ্রন্থাগার।আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও বইটি হাতে পেয়ে স্বাক্ষরপত্রে কিছু লিখতে অনুরোধ করায় কবি শহীদ কাদরী লিখেছিলেন, ‘এই নশ্বর গ্রহ থেকে এক দিন সব স্বাক্ষরই মুছে যাবে—মনে রেখো।’ তাই গ্রন্থরাজি নিয়ে সান্ত্বনার কিছু নেই। তার পরও এই লেখা।

‘কুঝনেস্কি মস্ত’ (কুঝনেস্কি সেতু) মস্কোর প্রাচীনতম মেট্রো স্টেশনের একটি। মেট্রো থেকে বের হয়ে হাতের ডান দিকে এগোলে দু-তিনটি দোকানের পরই একটি পুরোনো বইয়ের স্বর্গরাজ্য। সেখানে হঠাৎই পেয়ে যাই একদিন হিলফেরডিংয়ের লেখা ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল বইটি। জর্মন থেকে রুশ ভাষায় অনুবাদ। প্রকাশনার তারিখ ১৯২৪—লেনিন সে বছর মারা গেলেন। মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে তখন জোরেশোরে পড়ানো হচ্ছে ‘ইম্পিরীয়লিজম’— সাম্রাজ্যবাদের অর্থনীতি। প্লেখানভ, কাউটস্কি, লেনিন, হবসন, হিলফেরডিং, রোজা লুক্সেমবুর্গ, বুখারিন। তখনকার মস্কোয় (সত্তরের দশকের কথা বলছি) যত সহজে মার্কসীয় ধারার বইপত্র পাওয়া যেত, ততটা সহজে পাওয়া যেত না ‘বুর্জোয়া অর্থনীতি’র বইপত্র।

ফলে বইখানা হাতে পেয়ে ৯০ রুবলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা ছাত্রবৃত্তির বাজেটে বেশ কিছুটা টান পড়লেও আমি তখন আনন্দে আটখানা। এ রকমই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত জর্জ কাট্কভের দ্য ট্রায়াল অব বুখারিন হাতে পেয়ে। সোভিয়েত প্রসিকিউটর ভিশিনস্কি ও বুখারিনের মধ্যকার সেই বাদানুবাদ এখনো পাঠককে বিমর্ষ করবে। ১৯৩৮ সালে স্তালিন ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার মনগড়া অভিযোগে বুখারিনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালের পর থেকে নিকোলাই বুখারিনের মর্যাদা আবারও সরকারিভাবে ফিরিয়ে আনে সিপিএসইউ। অবশ্য তখনকার মস্কোয় বুখারিনের বা ট্রটস্কির রচনা পাওয়া সম্ভব ছিল না (দ্য হিস্টরি অব রাশান রিভল্যুশন বইটির ১৯৩৬ সালের একটি ইংরেজি অনুবাদ আমার সংগ্রহে রয়েছে)। এ বইগুলো পেয়েছিলাম আরও দুই দশক পরে—ওয়াশিংটনের একটি পুরোনো বইয়ের দোকানে।

মনে হয় দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সেটাই শুরুর বিন্দু আমার। তারপর বেশ কিছু দুর্লভ রচনার হদিস পেয়েছি মস্কোতেই। বর্তমানে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ১৯৮১ সালে আমাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রথম বাঙালি মুসলিম কমিউনিস্ট পাবনা-সিরাজগঞ্জের গোলাম আম্বিয়া খান লোহানীর বিষয়ে খোঁজখবর করতে। তখনো আমার জানা ছিল না, লোহানীও বুখারিনের মতো মস্কোয় ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের কোনো এক দিনে স্তালিনীয় নিষ্পেষণের কবলে মৃত্যুবরণ করেছেন। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের (‘চ্যাটো’ বলে যিনি খ্যাত—সরোজিনী নাইডুর ভ্রাতা) নেতৃত্বাধীন বার্লিন গ্রুপের সঙ্গে মস্কোয় আগমন তাঁর, ১৯২১ সালে। লেনিনের কাছে লেখা বিখ্যাত ‘চট্টোপাধ্যায়-লোহানী-খানখোজে’-এর উপনিবেশবিষয়ক থিসিসের মূল রচয়িতা ছিলেন আমাদের লোহানী। এ কথা এম এন রায় তাঁর স্মৃতিকথায় আগেই জানিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই মতি ভাইয়ের কৌতূহল।

খুঁজতে খুঁজতে হাজির হই লেনিন রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে। সাধারণ সেকশনে লোহানীর লেখা পাওয়া যাবে না জেনে দ্বারস্থ হই লেনিন গ্রন্থাগারের আর্কাইভে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে দিনের পর দিন ঘেঁটে উদ্ধার করি লোহানীর রচনা। তখনকার দিনের (আমি ১৯২২-১৯৩২ পর্বের কথা বলছি) কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, পেজেন্ট ইন্টারন্যাশনাল, মোপর প্রভৃতি জার্নালে সন ধরে ধরে খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যাই লোহানীর অদ্যাবধি বাংলায় বা ইংরেজিতে অপ্রকাশিত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। সেসব এখনো উল্টেপাল্টে দেখি, আর ভাবি সেই সময়ের কথা—কী হয়েছে, আর কী হতে পারত, তা নিয়ে মনের মধ্যে ঝড় ওঠে।

২.
দুই পর্বে মিলিয়ে ওয়াশিংটনে ছিলাম নয় বছর। জীবিকার জন্য কাজের বাইরে (বিশ্বব্যাংকে আমি তখন কর্মরত) শখ বলতে সময় পেলেই বইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ানো। বলতে দ্বিধা নেই, ওয়াশিংটনের প্রায় সব পুরোনো বইয়ের দোকানে অনেক অপরাহ্ন ও সন্ধে ব্যয় করেছি। জর্জ টাউনের কয়েকটি দোকান ছিল প্রসিদ্ধ, আর ছিল ‘দ্যুপন্ট সার্কেল’ মেট্রোয় ঢোকার মুখে দু-তিনটা দোকান। এক-দুটো আবার রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত খোলা থাকত। এগুলোর কোথাও কোথাও পেয়ে যাই অর্থনীতিবিষয়ক বেশ কিছু বইয়ের প্রথম দিককার সংস্করণ। যেমন, নোবেল অর্থনীতিবিদ আর্থার লুইসের ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং বইয়ের ১৯৬৫ সালের সংস্করণ (এসব বইয়ের কোনো আধুনিক সংস্করণ বহুদিন বাজারে নেই)। অথবা চিরায়ত গ্রন্থ রেভারেন্ড প্রফেসর ম্যালথাসের এন এসে অন দ্য প্রিন্সিপাল অব পপুলেশন অ্যান্ড ইটস্ এফেক্টস্ অন হিউম্যান হ্যাপিনেস-এর ১৮৯০ সালের সংস্করণ। কার্ল কাউটস্কির দ্য এগ্রারিয়ান কোয়েশ্চেন অবশ্য পাই ই-বে সূত্রে। অর্থনীতির কিছু দুর্লভ বই ঢাকার রাস্তাতেও পেয়েছি। আশির দশকে তোপখানা রোডে সিপিবি অফিসের সামনের ফুটপাতে যেমন এক দিনেই পেয়ে গিয়েছিলাম গ্যারি বেকার রচিত হিউম্যান ক্যাপিটাল-এর ১৯৬৪ সালের সংস্করণ এবং অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত প্রথম বই বেসিক ডেমোক্রেসিস্, ওয়ার্কস প্রোগ্রামস্ অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান। স্যারকে সে কথা বলাতে তিনি দার্শনিকসুলভ মুচকি হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘আমিও শুনেছি, আমার বইগুলো এখন ফুটপাতে পাওয়া যাচ্ছে!’

৩.
তবে পরবর্তীকালে অর্থনীতির বাইরেও অন্য কিছু বিষয়ে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ-সংগ্রহের আগ্রহ জন্মাতে থাকে। এলেন অ্যান্ড আনউইন থেকে প্রকাশিত রাধাকৃষ্ণন সম্পাদিত হিস্টরি অব ফিলোসফি ইস্টার্ন অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন ১৯৬৭ সালের পর থেকেই বাজারে নেই। দুই খণ্ডের এ বইটি সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে প্রথম দেখেছিলাম। বহু দিন পরে ওয়াশিংটনে বইটির দুই খণ্ড হাতে পেয়ে শিহরিত হই। এর একটি প্রবন্ধ ‘সায়েন্টিফিক থট ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ অত্যন্ত মূল্যবান একটি রচনা, যার তুলনীয় কিছু এর আগেও হয়নি, পরেও হয়নি। ১৯০৬ সালের সংস্করণে সৈয়দ আমীর আলীর বিরল রচনা ইসলামও একইভাবে খুঁজে পাই পুরোনো বইয়ের দোকানে। এই বইয়ে সুফী মতাদর্শের ওপর আমীর আলীর গভীর আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়।

আমার সংগ্রহে সবচেয়ে পুরোনো বই দুটি। একটি হচ্ছে, ১৮৬০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ওড়িশা ও বাংলার দুর্ভিক্ষের ওপর ‘পেপারস’-এক বিপুলায়তন তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ১৮৭১ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত স্যার বার্টল ফ্রেরের অন্য দ্য ইমেপন্ডিং বেঙ্গল ফেমিন: হাও ইট উইল বি মেট অ্যান্ড হাও টু প্রিভেন্ট ফিউচার ফেমিন্স ইন ইন্ডিয়া। এটি তুলনামূলকভাবে ছোট বই, ১১২ পাতার কিন্তু বিশ্লেষণের নিরিখে পরবর্তীকালের অমর্ত্য সেনের পোভার্টি অ্যান্ড ফেমিন বিষয়ক গ্রন্থের সঙ্গে একযোগে পড়ার মতো।

১৮৮৬ সালের সংস্করণ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত বাংলায় প্রকাশিত বই-পুস্তিকার ক্যাটালগ অধ্যাপক ব্লুমহার্ডটের একটি অবশ্যমান্য আকর-গ্রন্থ। এই ক্যাটালগ ঘাঁটলে উনিশ শতকের বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান গ্রন্থকারদের রচনারাজির বৈচিত্র্য চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। এই দুটি খণ্ড যেকোনো সংগ্রাহকের জন্য আদরনীয়। ১৯৪৭-১৯৭১ কালপর্বে পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের একটি অনুরূপ ক্যাটালগ কেউ প্রস্তুত করলে বাঙালি মাত্রেরই তিনি কৃতজ্ঞতাভাজন হতেন।

কবিতার প্রতি আকৈশোর পক্ষপাতিত্বের কারণে কিছু বই সংগ্রহের লোভ থেকে নিজেকে নিরস্ত করতে পারিনি। ১৯০০ সালে প্রকাশিত কিটসের চার খণ্ডের পকেট বুকসাইজের কবিতা-সংগ্রহের পাতাগুলো এখনো অটুট। এজরা পাউন্ডের জীবনের শেষ ৩০ বছর রাজনীতির ভুল পরিক্রমায় পরিকীর্ণ। এ সময়ের স্মৃতি বহন করছে—এজরা ও ডরোথি পাউন্ডের মধ্যকার ১৯৪৫-৪৬ কালপর্বের পত্রালাপ, যার নাম ‘লেটারস ইন কেপটিভিটি’। রিলকে, পাস্তারনাক ও মারিনা সভিতায়েভ অসম বয়সী তিন দিকপাল কবির মধ্যকার ১৯২৬ সালের পত্রালাপ আরও একটি বিরল বই। দুষ্প্রাপ্য মানেই যে তা ‘পুরোনো’ হতে হবে তা নয়। নাজিম হিকমত নিয়ে সম্প্রতি পশ্চিমের সাহিত্য মহলে প্রবল উৎসাহ জাগ্রত হয়েছে, তার সর্বশেষ নিদর্শন হাতে এসেছে কিছুকাল হলো। জেলে যে ১০ বছর ছিলেন নাজিম, সে সময়ে তাঁর সহবন্দী ছিলেন কবি ওরহান কেমাল। তাঁরই স্মৃতিচরণা: ইন জেইল উইথ নাজিম হিকমত। ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর ভূমিকাসংবলিত সাইমে গক্সু ও এডোয়ার্ড টিমস্-এর নাজিম হিকমতের প্রামাণ্য জীবনী-গ্রন্থ রোম্যান্টিক কমিউনিস্ট প্রকাশনার পর এটি তুরস্কের বিখ্যাত কবির ওপর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশনা। এখানে বলে রাখি, অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেক আগে বাংলাতে নাজিম হিকমতের অনুবাদ হয় ১৯৫১ সালে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফরাসি থেকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সাহায্য নেন রণজিৎ গুহের (পরবর্তী সময়ে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ হিসেবে খ্যাত)।

আমাদের প্রজন্মের এক বড় অংশেরই বুদ্ধিবৃত্তির হাতেখড়ি হয়েছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের মুক্তিচিন্তা ও কাম্যু-সার্ত্রের থিওরি অব দি অ্যাবসার্ড ও অস্তিত্ববাদের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার পর পরের বাংলা নাটকগুলো যেমন ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ এমনি এমনি আকাশে ওড়ায়নি। এর পেছনেও ছিল কাম্যু, সার্ত্রে, বেকেট, অ্যালবির অ্যাবসার্ড অনুপ্রেরণা। এর বিপরীতে ছিলেন সদা-বুদ্ধিদীপ্ত রাসেল। বিভিন্ন পত্রিকার লেটারস্ টু এডিটর কলামে রাসেল তাঁর জীবনের নানা পর্যায়ে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, তা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘ইওরস্ ফেইথফুলিল বার্ট্রান্ড রাসেল’ একেকটি চিঠি টুকরো টুকরো বৈদূর্যমণি। এ রকম কিছু কিছু রচনার অত্যাধুনিক সংস্করণ থাকা সত্ত্বেও আমার মূল আগ্রহ ছিল প্রথম সংস্করণের প্রতি। এভাবেই আমি সংগ্রহ করি আলবেয়ার কাম্যুর দ্য মিথ অব সিসিফাস্ অ্যান্ড আদার এসেস্-এর ১৯৫৫ সালের সংস্করণ, অন্দ্রে জিদের ১৯৩৫ সালের আত্মজীবনী ইফ ইট ডাই, সার্ত্রের আত্মজীবনী ১৯৬৪ সালের সংস্করণ দ্য ওয়ার্ডস।

লা নুই বেঙ্গলিখ্যাত মির্চা এলিয়াদ নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে-এর কল্যাণে বাঙালি পাঠক মাত্রেরই আগ্রহের শেষ নেই। এলিয়াদ সম্পর্কে এটুকু জানতাম যে চউসেস্কুর রুমানিয়া থেকে নির্বাসিত হয়ে প্রথমে প্যারিসে, পরে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।

ভারতীয় ও পাশ্চাত্য ধর্মশাস্ত্রের ওপর একাধিক ইতিহাস বইয়ের রচয়িতা। জন্মস্থান রুমানিয়ায় তাঁর খ্যাতি অবশ্য ঔপন্যাসিক ও গ্রন্থকার হিসেবে—রুমানিয়ার আধুনিক সাহিত্যের প্রাণপুরুষ তিনি। লা নুই বেঙ্গলি যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের আগ্রহ জাগাবে এলিয়াদের চার খণ্ডে সম্পূর্ণ জর্নাল বা তাঁর (অসমাপ্ত) দুই খণ্ডেরআত্মজীবনী। এখনো এই আত্মজীবনীর এক অংশে গিয়ে আমাদের হূদস্পন্দন থেমে যায়, যেখানে তাঁর সঙ্গে মৈত্রেয়ীর প্রথম অনুরাগের উন্মেষ হচ্ছে। আমার অক্ষম অনুবাদে তা দাঁড়ায় এই রকম: ‘আমার লেখা ইসাবেল-এর প্রথম কপিগুলো হাতে পেলাম, এবং মৈত্রেয়ী, যিনি নিজেও ছিলেন কবি, আমাকে এর পর থেকে ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করলেন। আমি তার সমকক্ষ হতে পারলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত একই চিন্তা-চেতনের পরিবারের সদস্য হতে পারলাম সেদিন। এবং এভাবেই, পরিবারের আর সবাই যখন উপরতলায়, আমরা নীচতলার লাইব্রেরীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। আমাদের উপর দায়িত্ব ছিল ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসবিষয়ক বইয়ের ভেতরে যেসব দার্শনিক পরিভাষা পাওয়া যায় তার নির্ঘন্ট দাঁড় করানোর। একদিন ইনডেক্স কার্ডের বাক্সে আমাদের হাত মিলে গেল, এবং আমরা আর সেই বাঁধুনি থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে পারিনি।’ এর পরের ঘটনা পাঠকদের জানা। মৈত্রেয়ী দেবীর দার্শনিক পিতা এই মিলনকে (গায়ত্রী স্পিভাকের ভাষায়—‘ঔপনিবেশিক সংঘাতকে) সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। এলিয়াদকে অচিরেই বিদায় করা হয় মৈত্রেয়ীর পিতৃভবন থেকে, যে পিতাকে এলিয়াদ তাঁর বইয়ের সর্বত্র ‘অধ্যাপক’ নামে বর্ণনা করে গেছেন। ‘আমাদের মধ্যে আর কখনো দেখা হয়নি’—মৈত্রেয়ী সম্পর্কে এরপর তাঁর আত্মজীবনী নীরব। এলিয়াদের প্রতি এ রকম কোনো গোপন বেদনাবোধ থেকে সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেছি তাঁর প্রধান প্রধান দর্শন-রচনা, উপন্যাস ও ছোটগল্প। একই আগ্রহে সম্ভবত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর রচনার প্রতি আগ্রহ জন্মায়, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ওকাম্পোর লরেন্স অব এরাবিয়া। লরেন্সের অধ্যাপক ভাই এই বইটিকে বলেছেন লরেন্সের জীবনীগুলোর মধ্যে ‘সবচেয়ে গভীর ও সমঞ্জস্য’ রচনা বলে।

৪.
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বইয়ের ইংরেজি অনুবাদগুলোর প্রথম বা (না পারলে) দ্বিতীয়-তৃতীয় সংস্করণ খোঁজার আগ্রহ ও উত্তেজনা থেকে আর সবার মতো আমিও দূরে থাকতে পারিনি। এর অধিকাংশ বই-ই ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত। ১৯১৫ সালের সংস্করণ রবীন্দ্রনাথের অনুবাদেওয়ান হানড্রেড পোয়েমস্ অব কবীর। অনুবাদটির ক্ষেত্রে এভেলীন আন্ডারহিল সহায়তা করেছিলেন কবিকে, একটি বিশদ ভূমিকা লেখা ছাড়াও। রবীন্দ্রনাথের ওপর পনেরো শতকের সন্তকবি কবীরের প্রভাব নিয়ে লিখেছেন কবীরের জীবনী তুলে ধরার পাশাপাশি। দেখা যাচ্ছে, এই অনুবাদকর্মে শুধু ক্ষিতিমোহন সেনের সংগৃহীত পাঠ (হিন্দি/ বাংলা) ছাড়াও অজিত কুমার চক্রবর্তীর ইংরেজিতে কৃত অনুবাদের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। অনেকেরই হয়তো জানা যে, গীতাঞ্জলি-র মাধ্যমে কবির ঋষি ভাবমূর্তির পাশাপাশি নারীবাদী একটি ভাবমূর্তিও ছড়িয়ে পড়েছিল পাশ্চাত্যের বিদ্বৎসভায়। এর বড় কারণ, ১৯১৪ সালের সংস্করণে চিত্রাঙ্গদার ইংরেজি নাট্যরূপ চিত্রার প্রকাশনা। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিল মিসেস উইলিয়াম ভন মুডিকে (হ্যারিয়েট মুডি হিসেবে অধিক পরিচিত)। মুডি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগী, নিখাদ কাব্যপ্রেমী ও পারিবারিক বন্ধু। চিত্রা গ্রন্থটি ইংরেজিতে প্রকাশের পরপরই এর সমালোচনা লেখেন বসন্ত কুমার রায় ও হ্যামিলটন মেবি (এঁরা যুক্তভাবে আরও লিখেছেন)। সমালোচনার নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ—রবীন্দ্রনাথ টেগোর- দ্য ফেমিনিস্ট পোয়েট অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে অবশ্য ন্যাশনালিজমের কবি হিসেবে ভাবতেন কি না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। বসন্ত কুমার রায় ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ টেগোর: দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ পোয়েট্রি শীর্ষক জীবনীগ্রন্থ লিখেছিলেন (ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশ পায় সেটি)। সমালোচনাটির এক জায়গায় বসন্ত হ্যামিলটন জুটি লেখেন: ‘নারীবাদবিষয়ক রবীন্দ্রনাথের দর্শন যেভাবে চিত্রা গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে, তা পাশ্চাত্যের নারীবাদীদের কাছেও খুব বেশি র্যাডিকেল বলে মনে হতে পারে।’

গীতাঞ্জলির ১৯১৪ সালের সংস্করণ পর্যন্ত কেবল পৌঁছাতে পেরেছি আমি। এর ভূমিকায় স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথ এই অনুবাদটিকে মূলত গদ্য-কর্ম হিসেবেই দেখেছিলেন—মূল বাংলা থেকে ইংরেজিতে ‘গদ্যে অনুবাদ’ (প্রোজ-ট্রান্সলেশনস) এভাবেই পাঠকদের কাছে পরিচিত হতে চেয়েছেন। বইটির শুরুতে ১৯১২ সালে করা রোদেনস্টাইনের কবি-প্রতিকৃতি ছাপা হয়েছে, বইটি উৎসর্গও করা হয়েছে রোদেনস্টাইনকেই। এ বইটি আদিতে যিনি কিনেছিলেন কোনো এক অজ্ঞাতনামা আর এস এম (নাম বোঝার উপায় নেই) জনৈকা এলিজাবেথকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন এই বলে: ‘এলিজাবেথকে—যার অদ্বিতীয় রূপ, যার মনের শক্তি এবং যার ব্যক্তিত্বের মাধুর্য এই কবিতাগুলোর মতই।’ পেনসিলের হস্তাক্ষরে লেখা—কালস্রোতে এখনো মুছে যায়নি।

রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের কয়েকটি দুর্লভ সংগ্রহ আমি খুঁজে পেয়েছি কাকতালীয়ভাবে। ১৯২১ সালের মে মাসে প্রকাশিত দ্য মেন্টর পত্রিকার পুরোটা জুড়েই ছাপা হয় রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি রচনা ‘উইমেন’। এর শুরুতে বিশেষভাবে মেন্টর পত্রিকার জন্য একটি ইংরেজি কবিতা লেখেন কবি। প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে নারীর সৃষ্টিশীলতাকে আহ্বান করা হয়েছে সংক্ষেপে এটুকুই বলার। ন্যাশনালিজম গ্রন্থে সংকলিত ‘ন্যাশনালিজম ইন দ্য ওয়েস্ট’ প্রবন্ধটি দেখা যাচ্ছে গ্রন্থের বাইরেও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে লিবারেল পত্রিকা দ্য আটলান্টিক মান্থলি জার্নালে। বিখ্যাত এই পত্রিকাটির ১৯১৭ সালের জানুয়ারি-জুন পর্বের সব সংখ্যা আমার হাতে আসে। তাতে দেখতে পাই, কবির রচনার পাশাপাশি ছাপা হচ্ছে একই ধারার বিষয়ে বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনালিজম’, হেনরি ফোর্ডের ‘রাইটস্ অ্যান্ড রংস্ অব প্যাসিফিজম’ জোসেফ কনরাডের ওপর সাম্প্রতিক আলোচনা।

এ তো গেল প্রথম মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা রচনাসমূহ। আসন্ন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আশঙ্কায় ইউরোপে গড়ে উঠেছিল যুদ্ধবিরোধী নাগ মঞ্চ।

তারই একটি ছিল প্যারিসে অবস্থানরত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন’। এর উদ্যোগে বিভিন্ন খোলা চিঠির একটি প্রকাশনা সিরিজ বের হয়েছিল তিরিশের দশকে। তারই অংশ হিসেবে, পৃথক পুস্তিকা হিসেবে ১৯৩৫ সালে আত্মপ্রকাশ পায় গিলবার্ট মারে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যকার পত্রালাপ। এর একটি অংশের অনুবাদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের আদি—রূপ:

‘একটা সময় ছিল যখন আমরা য়ুরোপের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন ছিলাম। য়ুরোপ আমাদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। আমরা মনে করতাম যে সারা পৃথিবীতে মুক্তির বাণী ছড়িয়ে দেওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য। তার সাহিত্য ও শিল্পকলার মাধ্যমে আমরা তার ভাবের দিকটিকেই চিনেছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, য়ুরোপের…কর্মকাণ্ডের মূল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকা—যেখানে তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল মুনাফার আহরণ, সাম্রাজ্যের পরিচালনা এবং বাণিজ্যের সম্প্রসারণ। য়ুরোপের গুদাম এবং বাণিজ্য দপ্তরগুলো, তার পুলিশ চৌকি এবং সৈন্যের ব্যারাকগুলো বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে, আর একই সঙ্গে সংকুচিত হয়েছে তার মানবিক সম্পর্কের দিকগুলো…এই বেষ্টনী ভেদ করে য়ুরোপের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা প্রাচ্যে আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না।’
সেসব এক ভিন্ন সময়ের কথা বা আমাদের সময়েরও কথা। এভাবেই দুর্লভ যুগের হলফনামা থেকে যায় দুষ্প্রাপ্য কিছু গ্রন্থের পাতায়। বোর্হেসের কথাই যেন সত্য হয়।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০১, ২০১১