[তুমুল গাঢ় সমাচার ৩] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৩

[গত সংখ্যার পর]

এসব বিভিন্ন ধারার উৎস থেকে ষাটের দশকের সাহিত্য জগতে নানামুখী প্রভাব যে অনায়াসে এসে পড়তে পারছিল, তার একটা বড় কারণ ছিল এসব উৎসের মধ্যে সম্পূরক স্ববিরোধিতা। ক্লেদজ কুসুম-এর বোদলেয়ার তরুণ বয়সে ১৮৪৮ সালের বিপ্লব-প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন; এই বিপ্লবে বুক বেঁধেই মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছিলেন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। সার্ত্র-কাম্যু অস্তিত্ববাদী হয়েও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে নাজি-অধিকৃত ফ্রান্সে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এবং নিয়মিত ‘কমবেট’ পত্রিকায় লেখালিখি করেছেন; অ্যালেন গিন্সবার্গ পারিবারিক সূত্র এবং মতাদর্শগতভাবে ছিলেন বামপন্থার দিকে ঝুঁকে : পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিনাশই তার কাম্য ছিল (যদিও তার ‘অন্য বামপন্থা’ ছিল প্রথাগত বামপন্থার বাইরে)। আমি বলতে চাইছি, ষাটের কবিতা তথা সাহিত্যলোকে অবক্ষয়ের ঋতু নেমে আসার পেছনে নানাবিধ প্রেরণা ক্রিয়াশীল থাকলেও মোটের ওপর তা সমাজমুখী চিন্তা-ভাবনার দূরবর্তী ছিল না। এবং সে কারণেই রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চাপে যখন দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছিল তখন তারা সহজেই অবক্ষয়ী নেতিবাদ থেকে সমাজমুখী ইতিবাদে চলে যেতে পেরেছিলেন। তবে এই চলে যাওয়া তাদের জন্য একমুখী উৎক্রমণ ছিল না। সমাজমুখী প্রেরণার পর্বেও তারা তাদের পূর্বের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মনোভঙ্গি হারাননি। এ জন্যই নির্মলেন্দু গুণ লিখতে পেরেছিলেন ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’র এত দ্বিত্বতা-ধর্মী শিরোনাম; আবুল হাসান ‘রাজা যায় রাজা আসে’র মতো নির্বিকার পর্যবেক্ষণ, বা জন্ম নিয়েছিল আবদুল মান্নান সৈয়দের সাড়া-জাগানো গল্প-গ্রন্থ ‘সত্যের মত বদমাশ’ (যা ছিল ভুল কারণে নিষিদ্ধ বই তখনকার দিনে, এবং যা মিশেল ফুকোর ‘রিজিম অব ট্রুথ’কে একবারের জন্য হলেও মনে করাবে)। এই বিপরীত সন্নিপাতই রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য, যেখানে অন্তর্মুখী স্বভাব ও বহির্মুখী পদচারণা, প্রেম ও দ্রোহ, ব্যক্তিগত অবক্ষয় বোধ ও সামষ্টিক পরার্থপরতা একসাথে ক্রিয়াশীল থাকে। ষাটের প্রধান প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের জন্যই এ কথা খাটে- ওই দশকের প্রথম পর্ব-দ্বিতীয় পর্ব নির্বিশেষে। বিপরীতের একত্র-সমাবেশ এই থিসিসকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এভাবে :

‘আমাদের প্রথম তারুণ্যকে জ্বালিয়ে তুলেছিল অবক্ষয়; এ আমাদের অনুভূতিকে তীব্রভাবে উদ্দীপিত করেছিল, কিন্তু (প্রথম যৌবনের প্রচণ্ডতায় ও অপরিণতির কারণে) একে আমরা ভালভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। তাই অবক্ষয় নিয়ে আমরা হৈ-চৈ করলেও এ ধারণায় আমাদের চোখে পড়ার মতো সাফল্য কম। কিন্তু জাগরণকে আমরা দেখেছিলাম কিছুদিন পরে, সামান্য একটু পরিণত বয়সে। তা ছাড়া এর সঙ্গে শৈল্পিক দূরত্বও আমাদের ছিল দ্বিতীয় লেখকদের চেয়ে বেশি। তাই ওদের চেয়ে আমরা একে আত্মস্থ করেছিলাম অনেক বেশি নিবিড়ভাবে এবং এতে আমাদের সাফল্যও হয়েছিল ওদের চেয়ে বেশি। লেখক-জীবনের সূচনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বিশেষ করে রফিক আজাদ ছিল আমণ্ডুপদনখ অবক্ষয়ের চেতনায় প্রোথিত। কিন্তু ধীরে ধীরে গভীর দেশাত্মবোধ এবং উচ্চতর সংঘ-চেতনাকে তারা আত্মস্থ করেছিল।’

কিন্তু তার মানে কি এই যে, ষাটের দ্বিতীয় পর্বের জাতীয়তাবাদ এবং সমাজচেতনা একে একে গ্রাস করেছিল অবক্ষয়ের কবি-সাহিত্যিকদের? তারা কি হয়ে পড়েছিলেন জাতীয়তাবাদের দাস? রাষ্ট্র-ক্ষমতার জনবিচ্ছিন্ন চরিত্রকে গোড়া থেকেই কি তারা সন্দেহের চোখে দেখেননি? ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট’ বলে করেননি কি প্রতিবাদ? ‘অথেনটিক’ তথা অকৃত্রিম জাগরণের একটি কুলক্ষণই হলো তার রাজশক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য বলার ক্ষমতা। এ জন্যই রফিক আজাদ স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই অনায়াসে বলতে পারেন একই সাথে আশা ও হতাশায় বিদ্ধ স্থিতধী পঙ্‌ক্তিমালা। একগুচ্ছ বিচ্ছিন্ন উদাহরণ তার ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’ (১৯৭৪) গ্রন্থ থেকে-সেসব আজও কী সাম্প্রতিক শোনায়!

যেখানে রয়েছো স্থির-মূল্যবান আসবাব, বাড়ি;
কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না।
শব্দহীন চ’লে যাবে জীবনের দরকারি গাড়ি-
কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না।
আমার জীবনে স্থায়ী কোন সকাল-দুপুর নেই,
সারাক্ষণ ব্যেপে থাকে- অপরাহেপ্ত-মনোধিমণ্ডলে।
সম্পূর্ণ বর্জন নয়, গ্রহণে-বর্জনে গড়ে নেই
মানুষের বসবাসযোগ্য চিরস্থায়ী ঘর-বাড়ি;
বহিরঙ্গে নাগরিক-অন্তরঙ্গে অতৃপ্ত কৃষক;
স্থান-কাল পরিপার্শ্বে নিজ হাতে চাষাবাদ করি
সামান্য আপন জমি, বর্গা-জমি চষি না কখনো।
অ্যাটম বোমার থেকে দু’বছর বড় এই আমি
ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে মেরু-দূর প্রভেদ মানি না।
ক্ষীয়মাণ মূল্যবোধে, সভ্যতার সমূহ সংকটে
আমি কি উদ্বিগ্ন খুব?-উদ্বিগ্নতা আমাকে সাজে কি?
রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনীতি, নেতা, নানাবিধ আইন-কানুন
নিয়ন্ত্রিত ক’রে যাচ্ছে যথারীতি প্রকাশ্য জীবন,
ভিতর-মহল জেঁকে বসে আছে লাল বর্ণমালা।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে;
ক্ষুুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন-
সম্মুখে যা-কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে;
থাকবে না কিছু বাকি- চলে যাবে হা-ভাতের গ্রাসে।

যেজন প্রকৃত বিষাদগ্রস্ত সেই কেবল গভীর দেশাত্মবোধে আলোড়িত হতে পারে- এই ধূসর পাণ্ডুলিপি শুধু জীবনানন্দ লেখেননি। রফিক আজাদ যেমন ‘বেশ্যার বেড়াল’-এর মতো কবিতা লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ‘গান হতে বলি’; নির্মলেন্দু গুণ যেমন লিখেছেন ‘হুলিয়া’, তেমনি দুর্ভিক্ষের ঘনায়মান দৃশ্যপটকে মনে রেখে ‘সর্বগ্রাসী হে নাগিণী’র বিখ্যাত সূচনা-পঙ্‌ক্তি (সঙ্গত কারণেই তার প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে পরবর্তীতে বিবেচিত হয়েছে)। আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’-এর পরাবাস্তববাদী ভুবনে বিচরণ করে অসাধারণ সব লাইন লিখে গেলেন। এই এক কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে পরাবাস্তববাদ (ও ‘জীবন আমার বোন’-এর পাস্তেরনাক) আমাদের জাগরণের সাথী হয়ে গেল। আজও যখন পড়ি চমৎকৃত না হয়ে পারি না: ‘এই রাত্রিরা বেথেলহাম-কে ব্রথেলে পরিণত করে’; ‘সিংহের খাঁচায় বসে আমি গল্প লিখছি মনে মনে’; ‘দাও আমাকে সুযোগ বিশুদ্ধ পাগল কি বিশুদ্ধ মাতাল কি বিশুদ্ধ চরিত্রহীন কি বিশুদ্ধ ভালোমানুষের’; ‘খটখটে মাটির ভিতর উনিশ বছর আমি ছিপ ফেলে বসে আছি আত্মার সন্ধানে’; অথবা ‘পাপের ভিতর গোলাপ থাকে, এমনকি শব্দের পাপেও, কবিরা যেমন’। ১৯৬৯ সালে উত্তাল দেশের পরিস্থিতিতে তিনি যখন ভাবছেন তার নিজের জীবনের পরিণতি নিয়ে, তখনও স্বদেশ সকাল বেদনার্ত উঠে আসতে দেখতে পাই। ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসায়’ তাকে বলতে শুনি এভাবে :

আমি দীপহীন অন্ধকার ঘরে একা
এরি মাঝখানে নিজের আগুনে জ্বালিয়েছি লণ্ঠন আমার,
এই শতাব্দীর সন্ধ্যাকালে।
এ আঁধারে দু-হাত পেয়ালা করে
তারা-জ্বলা পানি খাবো বলে নেমে যাবো ভীষণ জীবনে।
আমার নিজের তৈরি, নিজের আগুনে জ্বালা
লণ্ঠন কি সঙ্গে যাবে? লণ্ঠন কি সঙ্গে সঙ্গে যাবে?
চিৎকারে ছুটেছি একটি কালো ঘোড়া, পরে নিয়ে
মানুষের ছদ্মবেশ; দীপ্র, সান্দ্র আত্মা বিক্রি করে
জীবনের লঘু-গুরু প্রত্যেকটি দোকানে ফিরেছি,
শরীরে ধারণ করে একমাত্র লাশের প্রচ্ছদ।

আর ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’ পর্যায়ে এসে ভেঙে পড়বে পূর্বেকার সব মায়াবী আয়না। কালো ঘোড়া তখন উৎফুল্ল শাদা ঘোড়া হয়ে যাবে। তিনি বলে উঠবেন :

মন্বন্তর আমাকে এক জন্ম দিয়েছে
মহোত্থান আমাকে দ্বিতীয় জন্ম দিক
সমস্ত দৃশ্যচ্ছবি আমি ধরে ফেলি
কালো হাওয়া
সমস্ত শব্দমালা আমি ধরে ফেলি
লাল হাওয়া
আমি শূন্যে প্রোথিত হয়েও জাগ্রত রেখেছি আমার স্বপ্নের এ্যানটেনা
আমার হাত ফসকে শাদা একটি ঘোড়া বেরিয়ে গেছে প্রান্তরে
ফাল্কগ্দুনের এই দিন

সুবিদিত যে, ঐতিহাসিকভাবে পরাবাস্তবাদীদের মধ্যে দুই দল হয়ে গিয়েছিল। এক দল আন্দ্রে ব্রেতোর নেতৃত্বে ‘প্রগতিশীল’ রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছিলেন, ৪র্থ ইন্টারন্যাশনালের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন (এর বিনিময়ে ট্রটস্কি হাত দিয়েছিলেন ব্রেতো-রচিত সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টোর খসড়ার পরিমার্জনায়)। আরেক দল থেকে গিয়েছিলেন জাগরণবিমুখ স্ব্বপ্নের মায়াচ্ছন্নতায় (এদের কেউ কেউ ভিড়ে গিয়েছিলেন সালভাদর দালির ফ্যাসিবাদী ক্যাম্পে)। ষাটের শেষের দিকে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এমনই বিভাজন হয়তো ঘটে থাকবে প্রথম ষাটের চন্দ্রাহত কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে। আদিতে পরাবাস্তববাদে আক্রান্ত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন সময়ের সাথে সাথে আরও সমাজমনস্ক থিমের মধ্যে ঢুকে গেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্য পরিবর্তনটা সাময়িক হলেও তার সমগ্র কাব্যচর্চার জন্য এটি যে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড়-ফেরা, তা এখন বির্তকের ঊর্ধ্বে।

এক-অর্থে, ‘কণ্ঠস্ব্বর’-এর প্রথম সংখ্যার ম্যানিফেস্টো ধারার উচ্চারণ ও তৃতীয় সংখ্যার ম্যানিফেস্টো ধারার উচ্চারণের মধ্যে একটি বিপরীতমুখী ভাবের প্রকাশ দেখতে পাই। প্রথম ধারার উচ্চারণে ছিল শুধু শিল্প-তাড়িতদের কথা: ‘যারা সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ প্রেমিক, যারা উন্মাদ, অপচয়ী, বিকারগ্রস্ত, অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী’ তাদের মানবিক শৈল্পিক স্বীকৃতির প্রচ্ছন্ন তাগিদ ছিল সেই আহ্বানে। ‘কণ্ঠস্বর’ তৃতীয় সংখ্যায় পড়ি অন্যরকম (যদিও একটি আরেকটিকে অস্বীকার করে না) প্রেরণা :’যারা জীবনকে অনুভব করতে চান শত তলে, শত পথে, বিঘ্নিত রাস্তায়; আঙ্গিকের জটিলাক্ষরে, চিন্তার বিচিত্র সরণিতে; কটু স্বাদে ও লোনা আঘ্রাণে, সততায়, শ্রদ্ধদ্ধায়, বিস্ময়ে অভিভূতিতে ও পাপে; মহত্ত্বে ও রিরংসায়; উৎকণ্ঠায় ও আলিঙ্গনে’ সেই তরুণদের ডাক দেওয়া হবে সেখানে। এই পরিবর্তনটা ঘটেছিল সমাজ-রাজনীতির পালাবদলের হাত ধরেই। এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিজের ব্যাখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ :’ষাটের দশকের বিপুল সামষ্টিক উত্থান এবং গণজোয়ারের মুখে এই জাতির সমস্ত ব্যক্তিগত বিবেচনা যখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তখনও আমাদের ধারার লেখকদের ভেতর জাতীয়তাবাদী চেতনার পাশাপাশি ব্যক্তিক মনোভঙ্গি এবং অনিকেতের চেতনা নিবিড়ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’কে আমি এর একটি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। ষাটের প্রায় প্রতিটি লেখকের লেখাতেই এই ব্যাপারটা কমবেশি ঘটেছে।’

এক হিসেবে, এটা বিতর্কাতীত বিষয় হওয়া উচিত। ব্যক্তিগত বিবেচনা ও সামষ্টিক বোধ- এ দুইয়ের মধ্যে কোন অলঙ্ঘ্য দেয়াল কল্পনা করা যায় না। ফ্রয়েড ও মার্কস উভয়েই পুঁজিবাদকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন, যে রকম জাক লাকাঁ ও মিশেল ফুকো। ব্যক্তিগত বেদনা ও সামষ্টিক ক্ষোভ এদের প্রতিতুলনা চলতে পারে কেবল সীমিত অর্থে ও পরিসরে ঘোরতর স্তালিনবাদী না হলে সবাই স্বীকার করবেন যে, মান্দেলস্টাম (যিনি গুলাগ বন্দিশিবিরে প্রাণ হারিয়েছিলেন) ও মায়াকোভস্কি (যিনি বিপ্লবকে কবিতায় ধারণ করেছিলেন) উভয়েই জলে-পড়া পিঁপড়েদের ডাঙায় তুলতে চেয়েছিলেন। আখমাতভাকে কি এক পর্যায়ে ‘বুর্জোয়া ডেকাডেন্সের’ অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়নি? তাহলে বিশেষভাবে ষাটের প্রথম ভাগের কবি-সাহিত্যিকদের কেন অবক্ষয়বাদী বলে চিহ্নিত হতে হবে এবং নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে? এই প্রেক্ষিতে আমি শহীদ কাদরীর পালাবদলকে বাড়তি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাই।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

১. ‘ভালবাসার সাম্পান’

নিস্তরঙ্গ ষাটের দশকের সূচনাপর্ব। ঢাকা তখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায় এক ‘মনোরম মনোটনাস’ শহর। দোর্দণ্ড প্রতাপে সে সময়ে শাসন করছেন জেনারেল আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালে জারি হয়েছে তার সামরিক শাসন। এর ফলে কিছুকালের জন্যে হলেও প্রচণ্ড অবসাদের ঘুম নেমে এসেছে পূর্ব পাকিস্তানে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এসব স্মৃতি ততদিনে অনেকটাই ফিকে। যেন প্রচণ্ড কোনো আঘাতে কুঁকড়ে গেছে পূর্ব বাংলার বিদ্রোহী সত্তা। পাকিস্তানের তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা চলছে, আর সেই সাথে চলছে শ্রীবৃদ্ধির আয়োজন। পরিকল্পনা কমিশনের তরুণ অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানের মাহবুব উল হক লিখছেন বই দ্য স্ট্র্যাটেজি অব ইকোনমিক প্লানিং, যেখানে তিনি প্রবৃদ্ধি বেগবান করার জন্য কেন আপাতত অসম আঞ্চলিক উন্নয়ন দরকার, তার যুক্তিজাল বিস্তার করবেন। অস্থির উত্তাল পঞ্চাশের প্রথম ভাগের পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ সে সময় এক ধরনের সুস্থিতির পর্যায়ে ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। দেশের সেরা ছাত্ররা যোগ দিচ্ছেন লোভনীয় সিভিল সার্ভিসে, ‘সিএসপি’র কাতারে। অন্যরা ব্যস্ত মধ্যবিত্ত জীবনের সাথে মানানসই কোনো চাকরি পাওয়ার খোঁজে। গুটিসুটি পাখা মেলছে এক ক্ষীণকায় বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণি- ইপিআইডিসি কর্তৃক অর্থায়িত কল-কারখানাকে কেন্দ্র করে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তখন বন্ধ্যা সময়। যেন ব্যর্থ হয়েছে ১৮৪৮ সালের ইউরোপের আন্দোলন-সংগ্রাম, ফ্রান্সে গেড়ে বসেছে লুই বোনাপার্টের দুঃশাসন, প্রতিক্রিয়ার আঘাতে অবশ অপুষ্পক পরিবেশ চারদিকে। অবধারিত চক্রে বিপ্লব-প্রয়াসের পর নেমে এসেছে পুনরুজ্জীবনের কাল। অচিরেই নিষিদ্ধ হবে রবীন্দ্রনাথের নাটকের মঞ্চায়ন, এমনকি তার গানের প্রচার। একটা ভালো কবিতা লেখার জন্য তখন সংগ্রাম করতে হবে, একটা ভালো গল্পের জন্য জীবনক্ষয়ী যুদ্ধে নামতে হবে, এমন দমবন্ধ পরিস্থিতি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর রাজনৈতিক অর্থনীতি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :

‘ষাটের দশকে আমাদের সমাজে অবক্ষয় এসেছিল দুটি পর্যায়ে। প্রথম ঢেউটি এসেছিল শ্বাস-চেপে-ধরা সামরিক নিগ্রহের হাত ধরে।… ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২-র মধ্যে ঘটেছিল মূল ঘটনাটি, যদিও এর জের চলেছিল একাত্তর অব্দি। …এর পরেরটা এসেছিল সামরিক স্বৈরশাসনের উপজাত হিশেবে। সামরিক শাসনের দম-আটকানো ও নিরানন্দ পরিবেশকে আইয়ুব খান পুষিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সমাজজীবনে অবাধ ও জবাবদিহিতাহীন বিত্তের সচ্ছল ও কল্লোলিত স্রোতধারা বইয়ে দিয়ে। অর্থ সংগ্রহের জন্য উন্নত দেশগুলোর দরজায় দরজায় ধরণা দিয়ে দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। হঠাৎ-আসা সেই সুলভ বিপুল ও অনোপার্জিত বিত্ত সমাজজীবনের বন্দরে-বন্দরে রজতধারায় সচ্ছল ঢেউ জাগিয়ে তোলে।

আমাদের জাতির সুদীর্ঘ জীবনে বিত্তের পদপাতের ঘটনা এই প্রথম। বিত্তের দাঁতাল লোভ জাতির সুপ্ত চেতনার ভেতর থেকে জেগে উঠে এই সময় হয়ে ওঠে উদ্দাম। বর্বর অবাধ অলজ্জ অপরিমেয় রজতলিপ্সার সামনে ধসে পড়ে শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভেতর থেকে গড়ে-উঠে এই সমাজের নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের দৃঢ়প্রোথিত ইমারত। সবরকম ন্যায় নীতি হাস্যকর, অর্থহীন ও পরিত্যাজ্য হয়ে পড়ে।… নতুন অর্জিত মুদ্রার সঙ্গে নতুন অর্জিত পাপ এসে প্রবেশ করে সমাজজীবনে।’

এরকম একটি পরিবেশে কতিপয় সাহিত্য-পাগল যুবক কবিতা-প্রবন্ধ-গল্পের ভুবনে দুদ্দাড় প্রবেশ করেন। তাদের দীপ্তিমান সৃষ্টিশীলতা দিয়ে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন যে তাতে করে সেদিন শুধু নক্ষত্রলোকেই তাৎক্ষণিক ঝড় ওঠেনি, মর্ত্যলোকেও জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল, যার নিকটতম তুলনা কেবল হতে পারে রেনেসাঁ বা নবজাগৃতি (রেনেসাঁর ‘বুর্জোয়া’ চরিত্রের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই বলছি)। পঞ্চাশের দশকে যার শুরু, কিন্তু গোটা ষাটের দশকজুড়েই যার বিরতিহীন চর্চা চলেছে পতনে ও উত্থানে, অবক্ষয়ে ও বিদ্রোহে, স্ব্বাক্ষরে ও বক্তব্যে, এক বিচিত্রবিধ কণ্ঠস্বরে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তোলে। ষাটের প্রথম ভাগের রচনাগুলিকে তাই শুধু অবক্ষয়ের পাঠ হিসেবে দেখা চলে না, যেমন চলে না ষাটের দ্বিতীয় ভাগের রচনাগুলিকে কেবল বিদ্রোহের চিহ্ন হিসেবে। আধুনিক কবিতার জনক শার্ল বোদলেয়ারের মধ্যে যেমন তাপ ও সন্তাপ, অবক্ষয়ী স্খলন ও অক্ষয় উত্থান পাশাপাশি কাজ করেছিল, তেমনি ষাটের সব পুরোধা কবি-সাহিত্যিকর ক্ষেত্রেই এটা সামগ্রিকভাবে খাটে।

এই প্রবন্ধে আমি আরো যেটা প্রচ্ছন্নে বলার চেষ্টষ্টা করেছি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দুটি ভিন্ন যুক্তি-তর্ক আলাদাভাবে ষাটের দশকে উঠেছিল। একটি হচ্ছে, পাকিস্তানি কাঠামোর বিরুদ্ধে পরস্পর-বিরোধী দুই অর্থনৈতিক সত্তার দ্বন্দ্ব, যাকে আমরা ‘দুই-অর্থনীতি’ শীর্ষক বৈষম্যের যুক্তি হিসেবে পাঠ করেছি। ষাটের দশকের গোড়া থেকেই এই যুক্তি নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখ বাঙালি অর্থনীতিবিদের লেখা থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে। এটাই শেষে পরিণতি পায় ৬-দফার দাবিসমূহে; ষাটের দশকের মধ্যভাগে। পাকিস্তানি স্ব্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পূর্ব বাংলার রেনেসাঁর জন্য দুই-অর্থনীতি শীর্ষক থিসিস ও তৎসংলগ্ন বৈষম্য-চেতনা ছিল একটি মূল স্তম্ভ্ভ। দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে, পাকিস্তানি কালচার গড়ার অবিরাম প্রয়াস ভেঙে একটি আধুনিক বাঙালি মননশীলতার মাথা তোলা, যা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে কখনো উদাসীন মাটির পিদিমের মতো, কখনো স্বেচ্ছাচারী বারুদের মতো জ্বলে উঠেছিল ষাটের রচনাকর্মে, বিশেষ করে সে যুগের কবিতার শরীরে। অর্থশাস্ত্রের বৈষম্য-সংবেদনশীলতা ও কবিতার আধুনিকতা এই দুটি দূরবর্তী জগতের অলক্ষ্য যোগাযোগে সৃষ্টি হলো সেই অনুপম মুহূর্তের, যাকে আমরা প্রকৃতই ‘আমাদের আধুনিকতা’ বলে দাবি করতে পারি। এই আধুনিকতা একান্তভাবেই আমাদেরই সৃষ্টি; কোনো ইউরোপের ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বা এমনকি উনিশ শতকের বাংলায় রেনেসাঁ তথা পুনরুজ্জীবনবাদী আধুনিকতার সাথে এর চরিত্র বা গতি-প্রকৃতি মেলে না। ষাটের দশকের সেদিনের তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকরা যে-আধুনিক বোধের সূচনা করে গিয়েছিলেন তার আয়োজন ছাড়া শুধু অর্থনৈতিক অসাম্যের যুক্তিতে পূর্ববাংলার জাগরণ সংঘটিত হতো না এবং সেপথ বেয়ে স্বাধীনতা শব্দটিও আমাদের করায়ত্ত হতো না। সময়ের এই গ্রন্থি থেকে দাঁড়ালে ষাটের প্রথম দিককার কবিতা-গদ্যের ভুবনের অবক্ষয়কে আর অবক্ষয় বলে মনে হয় না; বরং প্রতীতি হয় সামন্তবাদী সমাজের বিপরীতে অবক্ষয়-পেরুনো এক নিঃসঙ্গ আর্ত-দীর্ণ পথ-পরিক্রমা বলে। একইভাবে, ষাটের দ্বিতীয় ভাগের কবিতা ও গদ্য রচনাকেও নিরবচ্ছিন্ন সমাজমনস্ক বিপ্লব-অন্ব্বেষী প্রচেষ্টা বলে মনে হয় না; মাঝে মাঝেই ধরা পড়ে তার আত্ম-অনুকম্পাপ্রবণ মায়া-জাগানো শোকগ্রস্ত অন্তর্মুখী স্বভাব। এভাবেই রাষ্ট্র্রনৈতিক অন্যায় ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্বারা আহত অবক্ষয়ী মন পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়িয়েছে সত্তরে বা একাত্তরে। এভাবেই ষাটের কাব্যভুবন গভীর সমাচার সৃষ্টি করেছে, জন্ম দিয়েছে এক পরিশীলিত আধুনিক মনের, যা একটি মুক্ত সংস্কৃতির পূর্বশর্ত। এই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃৃতিক চেতনার ভিত্তিতেই আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর সংবিধানের কাঠামো গড়ে উঠেছিল। এটাই এই প্রবন্ধের মূল কথা, যার পূর্বাভাস প্রথম পেয়েছিলাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘ভালবাসার সাম্পান’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায়। পড়ে সচকিত, দীপিত, উজ্জীবিত হয়েছিলাম। আমার সরাসরি শিক্ষক তিনি। তাঁকে ঘিরে তাঁর প্রিয় ষাটের দশককেই শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো এই লেখার মাধ্যমে।

২. অবক্ষয় ও জাগরণ :বৈপরীত্যের একত্র-সমাবেশ

ষাটের প্রথম ভাগের অবক্ষয়-চেতনা যে দ্বিতীয় ভাগে এসে সমাজ-রাজনীতি বোধে দীক্ষিত-তাড়িত হতে থাকে, সেটি ছিল খুব স্বাভাবিক পালাবদল। আবদুল মান্নান সৈয়দ পরবর্তী সময়ে বহিঃপৃথিবীর এই অনুপ্রবেশ সম্পর্কে এভাবে লিখেছেন বাহাত্তরে এসে :’আমার কবিতায় বহিঃপৃথিবী আর-কখনো এতো প্রবলভাবে প্রবেশ করেনি। … এক-হিশেবে এ এক তীব্র মোড়-ফেরা।’ এরই পরিণতিতে আমরা পেলাম ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’ :স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে চলাফেরার আনন্দ ও গৌরব সেখানে যতিচিহ্নহীন গদ্যকবিতার অতিব্যক্তিক চিত্রল ছন্দে ‘পাথর প্রহত হঠাৎ-উচ্ছ্বসিত ঝরনাজলের মতো’ বেজে উঠেছিল। এই উচ্ছ্বাস শুধু তার ক্ষেত্রেই ঘটেনি, এ ধরনের আবেগকে ধারণ করেছিলেন ষাটের অবক্ষয়ের সব একদা-সারথীই। এর চিহ্নসমূহ ক্রমেই পরিস্ম্ফুুট হচ্ছিল ষাটের দ্বিতীয় ভাগ থেকেই। ‘কণ্ঠস্বর’ এবং ছয়-দফা ষাটের মধ্যভাগে প্রায় এক-বছরের ব্যবধানে জন্মায়। এটাকে কেবল হতাশ থেকে আশাবাদে উত্তরণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে সামষ্টিক জাতীয়তাবাদে পালাবদল বললে সবটা ধরা পড়ে না। জাগরণের জন্য প্রথমে এক সর্বব্যাপী অবক্ষয়-বোধের প্রয়োজন ছিল। নানাভাবে এই যুক্তিটিকে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।

প্রথমত, পুঁজিবাদী আধুনিকতা তথা আধুনিকতা-বোধের সাথে ‘উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার’ একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মার্কস একে ‘এলিয়েনেশন’ বলেছিলেন, আমাদের কবিকুল এই জনম-একাকিত্বকে অলজ্জিত নিনাদে প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। নিজ দেশে তারা ‘বহিরাগত’ বলে নিজেদের মনে করেছিলেন- এই ভাবটি আধুনিক বিচ্ছিন্নতার নানা উৎসের কথা মনে করায়। কাম্যুর আউটসাইডার কি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে প্রভাবিত করেনি এবং সেই সূত্রে ‘বহিরাগত’ ভাবটি কি অস্তিত্ববাদের সূত্রেই প্রতিফলিত হয়নি ষাটের দশকে-মানসে? অন্যদিকে, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্রেগরি করসো ও তাদের সহচরেরা যখন পঞ্চাশের-ষাটের পটভূমিতে আর্তরব করে উঠলেন, সেই বিটনিকদের আন্দোলন সরাসরি প্রভাব ফেলে থাকবে ষাটের কবিতায় (ষাটের দশকের শুরুতে গিন্সবার্গ কলকাতায় আসবেন, কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে তার, আর কৃত্তিবাসের সাথে কণ্ঠস্বর গোষ্ঠীর, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের লালন সম্পর্কেও কবিতা লিখবেন তিনি)। অপর দিকে, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা বিত্তহীন অন্তঃসারশূন্য বিমর্ষ এক পৃথিবীকে নতুনভাবে মেলে ধরেছিল ষাটের কবিদের সামনে। বিভিন্নমুখী উৎস থেকেই ‘বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার’ শিল্প-প্রেরণা বা প্ররোচনা এসেছিল সেদিন- এটাই আমি বলতে চাই। সেখানে মার্কসের পাশাপাশি বোদলেয়ার, সার্ত্র-কাম্যুর অস্তিত্ববাদী দর্শন থেকে জাঁ ককতো ও গিন্সবার্গ সবাই ছিলেন। সেখানে গোড়া থেকেই জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথও ছিলেন (আজ মনে হয়, ‘দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ’-এর রবীন্দ্র-বিরোধিতা ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করে পাওয়ার চেষ্টা-সেটা ক্রমপ্রকাশ্য হয়েছিল-বিশেষ করে তার গানের ভুবনকে কেন্দ্র করে)। শহীদ কাদরী যেমন লিখেছিলেন আদি প্রত্যুষেই, ‘আমাদের চৈতন্যপ্রবাহে তুমি ট্রাফিক আইল্যান্ড’-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

ইশতেহার কি আমাদের জন্য (What is our manifest?)

আমরা ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে সময়ের গ্রন্থিগুলো পার হচ্ছি। অনেকটা যেন রজ্জুপথে চলা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই মহাপতনের দিকে। একটা জাতি এত দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম চাপের মধ্যে থেকে সুস্থ থাকতে পারে না। তাই সামগ্রিকভাবে এবারের নির্বাচনটা আর দশটা নির্বাচনের মতো গতানুগতিক নির্বাচন নয়। তার দুটি কারণ। একটি কারণ হচ্ছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অচিরেই পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার যে সরকার নির্বাচিত হবে, সে সরকারই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। কেবল উৎসব উদযাপনই নয়, এর সঙ্গে আরও কিছু দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জও তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন- পঞ্চাশ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলাম, পঞ্চাশ বছর পরে এসে আমাদের অর্জনটাই বা কী হলো, আর আমরা সামনের পথটাই বা কীভাবে পাড়ি দেব? এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সময় এসে গেছে।

যেভাবে গত দশটি বছর পার করেছি, সামনের দশটি বছর ততটা নির্বিঘ্নে কাটবে না। সেই অর্থে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এবং এতে যে দলগুলো অংশগ্রহণ করছে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সেই তাগিদটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে এমডিজির পরে এখন এসডিজি এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজিগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা; আরেকটি হচ্ছে ২০৩০ সালে অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিটা গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশি হয়। আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। অঙ্কের হিসাবে বললেও সেটি ১১ বছর। এই ১১ বছরের মধ্যেই আমাদের দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্য হ্রাসকারী দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে হবে। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কিন্তু আলাদাভাবে কিছু লক্ষ্য গ্রহণ করেছি। যেমন এর একটি হচ্ছে, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো।

১. আদি প্রতিশ্রুতি ও তার আজকের অর্থ

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ইশতেহারে কী থাকা উচিত, তা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হতে পারে। আমি যে আলোচনাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, সেটা হচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও অস্তিত্বগতভাবে মানুষের মতোই। তারও সত্তার পরিবর্তন হয়। মানুষের সত্তা যেমন একই রূপ থাকে না; শৈশবে-কৈশোরে, যৌবনে বা বার্ধক্যে তার রূপ বদল হয়। তেমনি রাজনৈতিক দলেরও কিন্তু সত্তার বিবর্তন হয়। এর অর্থ হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও তার মূল নীতিমালাগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল নীতিমালার মধ্যে যেটা মৌলিক, যেটা আমাদের সংবিধানে রয়েছে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এ চারটি নীতি ১৯৭২ সালে যে অর্থ নিয়ে এসেছিল, সে অর্থ আজও তারা সমানভাবে বহন করে কি-না এবং বহন করে থাকলে এর নতুনতর অর্থ কী, সেটা খোঁজার জায়গা হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। নির্বাচনী ইশতেহারে সে সম্পর্কে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং সুচিন্তিত বক্তব্য থাকা উচিত। যেমন ধরা যাক, আগে সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝানো হতো এবং অনেকেই বুঝতেন জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানা, উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা এবং এ জাতীয় পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে যেটা এসেছিল। ধারণাটা যখন এসেছে তখনও কিন্তু বিতর্কটা হয়েছিল, এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী? এবং আমাদের গণপরিষদে একটা দীর্ঘ বিতর্কও হয়েছিল এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় সে অর্থটা কেমন, তা নিয়ে। মার্ক্স কখনও চিন্তা করেননি যে, বৈষম্য বাড়লে সমাজতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হবে আর বৈষম্য কমলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। সেভাবে তিনি সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়ন করেননি। তিনি সমাজতন্ত্রকে একটি নতুন মৌলিক সভ্যতার ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে একদিকে বাজার পুঁজিবাদকে আশ্রয় করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার আমরা সমাজতন্ত্রের কথাও বলছি। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদও থাকছে, আবার সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাও থাকছে। দুটো মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের চেহারাটা কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি সুইডেন বা জার্মানির মতো একটা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি! না কানাডার মতো সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি, নাকি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতে চাচ্ছি, যেখানে ট্রাম্পচালিত সরকার আসে এবং প্রধানত নানা ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে স্বাস্থ্য খাতের নিশ্চয়তা নেই, হাই স্কুলের পরে শিক্ষার খরচ চালানো নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার কানাডা, সুইডেন বা জার্মানির মতো দেশে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের অধিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী ধারার হলেও জনগণকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মৌলিক সুবিধাদি কতটা পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কত গভীরে দেওয়া হবে- সেটার ওপরে ভিত্তি করে এক দেশ কিন্তু আরেক দেশ থেকে আলাদা। আমরাও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারি। বাংলাদেশ যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, তার অর্থটা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিজে মনে করি যে, আমাদের দেশে নিজস্ব ধরনের একটা সামাজিক গণতন্ত্র গড়ে ওঠার বস্তুগত অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আজকের অবস্থাটা থেকে আমরা যদি একটা সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চাই, তাহলে লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট করে বলা দরকার; এবং সেটাকে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

ঠিক তেমনিভাবে আসে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বোঝানো হতো, ধর্ম এবং রাষ্ট্র পরস্পর বিযুক্ত। ধর্ম হচ্ছে প্রাইভেট স্ম্ফিয়ারের আর রাষ্ট্রকার্য হচ্ছে পাবলিক স্ম্ফিয়ারের। সেই বিযুক্তির ধারণা থেকে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞাটা আমরা পেয়েছি বা নানাভাবে এসেছে, তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধর্ম পালনের সমান অধিকার। এ ক্ষেত্রে যেমন একটা স্লোগান প্রচলিত আছে- ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।

কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আরেকটু চিন্তা করার সুযোগ আছে। দার্শনিক হাবেরমাস যেমন বলেছেন, ‘উই হ্যাভ এনটার্ড ইনটু এ পোস্টসেকুলার এজ’। অর্থাৎ আমরা এখন এক ধর্মনিরপেক্ষতা-উত্তর সমাজে বাস করছি। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ যে শক্তি, তাকে এখন নতুন করে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে যেতে হচ্ছে। এই যে সংলাপে নতুন করে যেতে হচ্ছে, ধর্মীয় শক্তিকে সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্বীকার করতে হচ্ছে- এটা কিন্তু নতুন উপলব্ধি। সেটা ইউরোপে বসে ২০০৪ সালে তিনি লিখেছিলেন। কথাটা আমাদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও সত্য এবং বাংলাদেশের জন্যও সত্য। আমরা এখন শুধু অসাম্প্রদায়িকতা এবং শুধু ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই সংজ্ঞাতে আটকে না থেকে একটু বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে পারি- কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য শক্তিকে আমরা সামাজিক রূপান্তরের কাজে ও উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে পারি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমরা যে স্বীকৃতি দিয়েছি, সেটাকে কেউ কেউ বলতে পারেন, এই স্বীকৃতিটা এসেছে ওই ধরনের উপলব্ধি থেকে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে তারা মূলধারার শিক্ষাস্তরের সঙ্গে কতটুকু পরিমাণে সমান, সেটা নিরূপণের দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তায়। এই নিরূপণে যদি দেখা যায়, দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়ে গেছে, ঘাটতি রয়ে গেছে- তাহলে সেই ঘাটতিগুলো পূরণে আরও যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। সেটাকেই মূলত প্রকৃত স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্রের মতো এ বিষয়টিকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা যারা ভাবেন, তারা এখন নতুন করে বলুক- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তারা এখন কীভাবে দেখছেন? সেটা কি মুসলিম লীগের সেই মুসলিম বেঙ্গলের পুরনো ধারণার মধ্যেই আটকে আছে, নাকি তাকে আরও সম্প্রসারিত করে নতুনভাবে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দেখছেন; যে জাতীয়তাবাদের অংশ আদিবাসী থেকে শুরু করে সমতল ও পাহাড়ের সবাই; নাকি যেখানেই বাঙালি আছে, তাদের সবাই এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত? এককথায় প্রতিটি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের মূল চারটি আদর্শের বা প্রতিশ্রুতির সমসাময়িক অর্থবহতা সম্পর্কে একটা প্রতিফলন দরকার এই নির্বাচনী ইশতেহারগুলোয়।

২. দারিদ্র্য কমছে, বৈষম্য বাড়ছে

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইশতেহারে আমাদের জন্য প্রত্যাশিত কী কী প্রসঙ্গ আসতে পারে? একটা হচ্ছে, যে অর্থনীতিতে গত এক দশকে কিছু কিছু ইতিবাচক প্রবণতা জন্ম নিয়েছে, তার মধ্যে মোটামুটি স্বীকৃত একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই যে আজকে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬-সাড়ে ৬ শতাংশ করে বাড়ছে; কোনো কোনো বছর ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এটি ভালো দিক। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা, দারিদ্র্যও ধীরে ধীরে কমে আসার কথা। বাস্তবে দারিদ্র্য কমছেও। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত করতে পারি, মেয়েদের স্কুলগামিতার হার বাড়ছে, শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। এই যে প্রবৃদ্ধি বাড়া, দারিদ্র্য কমে আসা, মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়া- এর কারণে কতগুলো সামাজিক সূচকেও পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের সূচকে, বিশেষ করে প্রিভেনটিভ হেলথ কেয়ারে এবং শিক্ষাসূচকে আমরা অনেকগুলো ধাপ পার হচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গেই আবার জড়িত হয়ে পড়ছে কতগুলো নেতিবাচক দিক; যেগুলোকে ইতিবাচক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাচ্ছে না। অ্যাঙ্গেলসের একটা কথা ছিল যে, বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়তে থাকলে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রভুত্ব করার সামর্থ্য কমে যায়। আমাদের দেশেও বোধকরি এটা ঘটেছে। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’-এর শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্র যেমন লিখেছিলেন, ‘আজিকালি শোনা যায় দেশের খুব শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।’ এই শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্যও সত্য। কিন্তু তারপরই বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে, ‘কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? আমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, আমি তুমি কি দেশ! হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত- তাহাদের কি শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে?’ এই প্রশ্নটা তিনি রেখেছিলেন। এই প্রশ্নটাতে আমাদের টুইস্টটা হচ্ছে, হ্যাঁ এই শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দারিদ্র্য কমছে। তবে সবার কমছে না, এখনও কিছু চরম দরিদ্র পরিবার রয়ে গেছে হাওর অঞ্চলে বা বিভিন্ন উপদ্রুত উপকূলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কমছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি যেটা হচ্ছে, বৈষম্য বল্কগ্দাহীনভাবে বাড়ছে। সেটা বাড়ছে সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানেই। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, বৈষম্য ৪৪ শতাংশ থেকে এখন ৪৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সাধারণত বলা হয় যে, যখন জিনি কোইফিশিয়েন্ট ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা অতি উচ্চ বৈষম্যের স্তরে প্রবেশ করি, যাতে শুধু লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ও চীন প্রবেশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৈষম্যের হার ৪৫ শতাংশের মতো। ইউরোপিয়ান অনেক দেশে বৈষম্যের হার আরও কম। সুতরাং যদিও আমরা নিল্ফেম্নান্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছি- তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের প্রবৃদ্ধির অর্জনটা অনেকখানি ম্লান হয়ে যাচ্ছে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে। সে জন্যই ইশতেহারে একটা সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, প্রবৃদ্ধি বাড়াব, দারিদ্র্য কমাব; কিন্তু বৈষম্যকে বেশিদূর বাড়তে না দিয়েই। অর্থাৎ বৈষম্যের লাগাম ধরে রেখেই আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াব। এটা একটা মৌলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যদি বৈষম্যকে এভাবে বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দুটো কুফল দেখা দেবে। প্রথমত, প্রবৃদ্ধি একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক জিনি সূচকের বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে সামাজিক বৈষম্য। একশ্রেণির সঙ্গে আরেক শ্রেণির বৈষম্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। আমি সন্দেহ করি, সাম্প্রতিককালে যে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- আগামীতে হয়তো আমরা এমন আরও তরুণের আন্দোলন দেখতে পাব- যার পেছনে কাজ করেছে বা করবে এই বৈষম্যের উস্কানি। তার কারণ হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখছি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির সুফলগুলো সবার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। কর্মসংস্থানগুলো গুণগত মানের হয়ে, উপযুক্ত হয়ে তার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন একটা সামান্য ধরনের সামাজিক অস্থিরতা বা নড়াচড়াই বড় ধরনের দুর্বিপাকের আশঙ্কা বয়ে নিয়ে আসছে- এটার মূল কারণ হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান যথাযথ মানের হতে পারছে না। এবং সেইসঙ্গে মানুষে মানুষে যে আয়বৈষম্য, সম্পদে বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য, যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্য- এসব মানুষকে আহত করছে। সেটা নানাভাবে, নানা উপায়ে বহিঃপ্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আমাদের মতো দেশে এখনও পর্যন্ত যথার্থ অর্থে একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দাঁড়ায়নি। যেটা উন্নত বিশ্বে তো বটেই, মাঝারি উন্নত দেশেও আছে। যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই একই ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন। মূলত তারা একই র‌্যাপিড ম্যাস ট্রান্সপোর্টে চড়ে কাজে যাচ্ছেন। এর ফলে একে অপরের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যাতায়াত করতে করতে একটা অভিন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠছে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিটি ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা একেকটি নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য বাঁধা। উচ্চবিত্তরা নিজস্ব গাড়িতে চড়ছেন, মধ্যবিত্ত বাস-রিকশায় চড়ছেন, নিম্নবিত্ত হেঁটে যাচ্ছেন।

সুতরাং বৈষম্যের ব্যাপারে যে কোনো সময়ের নির্বাচনের তুলনায় এবার আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করি। তাদের ইশতেহারে চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকায় সর্বশীর্ষে এই বৈষম্য দূর করার কথা রাখা উচিত। শুধু একটি নীতি নিয়ে এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সকলের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ বৃদ্ধি করা- উন্নত বাসস্থান, উন্নত শিক্ষা, উন্নত কর্মসংস্থান, উন্নত ঋণপ্রাপ্তি প্রভৃতি সুযোগ যাতে কেবল ধনীদেরই মধ্যে সীমিত না থাকে। রাষ্ট্রের পুনর্বণ্টনমূলক নীতিমালাকে, যথা- রাজস্ব-ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে ফলপ্রসূ সম্পত্তি-করের প্রবর্তন করতে হবে।

৩. ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ?

বৈষম্যের পরে আমি যে দ্বিতীয় নেতিবাচক প্রবণতার কথাটি বলছি সেটি হচ্ছে, ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদের আশঙ্কা। আমার ধারণা, আমাদের দেশে ক্রমশ একটা ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ ব্যবস্থা গেড়ে বসছে। মূলত পুঁজিবাদের যে স্বাভাবিক শক্তি, নিজেকে নিজে শোধন করার যে প্রক্রিয়া- সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় এই ঝুঁকির মাধ্যমে। পুঁজিবাদ সব সময়ই পুঁজিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ঝুঁকির সামনে ঠেলে দিয়ে। আবার বাজারের বাইরের অনেক বিষয়ও পুঁজিবাদের বিকাশে কাজ করে। যেমন আমি চাইলেই আমার পাশের জমিটা দখল করতে পারি না। আমি চাইলেই ব্যাংকের টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত না দিয়ে দিনের পর দিন চলতে পারি না। চাইলেই মুনাফা থেকে যে কর-রাজস্ব দেওয়ার কথা, তা পরিশোধ না করে বড় ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারি না। অনেক উন্নত দেশের জন্যই এসব কথা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বে তো বটেই, গত এক দশকেও দেখছি এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের জন্য এই ঝুঁকিগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে বাজারের যে ঝুঁকি, সেটা থাকলেও বাজারবহির্ভূত যে ঝুঁকি- অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য তাকে যে ঝুঁকিগুলো বহন করতে হবে, সেগুলো কমে গেছে। তার মানে পুঁজিপতিরা এসব নিয়ম না পালন করে উল্টো এসবকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। এটাকেই আমরা বলছি ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ। এই ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদেই ক্রনি পুঁজিবাদের জন্ম হয়। এবং ক্রনি পুঁজিবাদের কারণেই তারা এটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছে। কারণ তারা ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে। যার সুবাদে প্রচুর ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করেও অনেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন বিনিয়োগগুলোর ওপর নানাভাবে এসবের প্রভাব পড়ছে। নতুন ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, নতুন ঋণের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, আইন না মানার একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। আর এই সবকিছুকেই আমি সামগ্রিকভাবে ‘ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ’ নামে আখ্যায়িত করছি। এই টার্মটি ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে, পুঁজিবাদের ভেতরে থেকেই পুঁজিবাদের যে অবনতি হচ্ছে, এর মাধ্যমে সেটাকে প্রশ্ন করা সম্ভব। এ রকম ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ যদি চলে, তাহলে সেই ঝুঁকিটা আসলে সমাজকেই বহন করতে হয়। পুঁজিপতি শ্রেণি সেই ঝুঁকি বহন করছে না। অথচ কথা ছিল উল্টোটা হওয়ার, যে পুঁজিপতি শ্রেণি ঝুঁকি নেবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে- এর মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে উল্টো। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে চাই শক্ত মেরুদণ্ডের নিয়মনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জোট। এটা শুধু একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। আবার এটা না হলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিকাশের পরবর্তী ধাপে যেতে পারব না।

৪. রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব

এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা কোনো বায়বীয় বিষয় নিয়ে হবে না, এটা হবে সেই নির্বাচনী দর্শনের যে পুনঃসংজ্ঞায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছিলাম, সেটাকে কেন্দ্র করে। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা হতে হবে এই যে, নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেটাকে মোকাবেলা করার জন্যই। আমাদের নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। এর জন্য নতুনভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আগে আমরা ভাবতাম, পুঁজিবাদী দেশ হওয়ার অর্থই হচ্ছে আমরা পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সুফলগুলো লাভ করব। কিন্তু এখন দেখা গেছে, এখানে পদে পদে রাষ্ট্রের একটা সহায়ক ভূমিকা রয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে সে দায়িত্ব পালন করবে, তার জন্য দরকার তার তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসন। সে যাদের ওপর খবরদারি করবে, সে তাদের বন্ধু হতে পারবে না। রাষ্ট্রকে তাই একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা একটা প্রাথমিক ধাপ, যাতে করে তারা সহসাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে না পারেন। এ ছাড়া মেধাবী তরুণদের সরকারি কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থেই মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে। এবং এ আমলাতন্ত্র হতে হবে উন্নয়ন আমলাতন্ত্র। শুধু সরকারি দপ্তর বা রাষ্ট্রযন্ত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাসপাতাল- সর্বত্রই। সবখানেই আমরা দেখতে চাই সবচেয়ে যোগ্য মেধাবী নেতৃত্ব। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো উপায়েই এসব করতে হবে। আমরা যদি ছোট মাপের স্বপ্নও দেখে থাকি, বড় মাপের কিছু মানুষকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের সম্মানিত করতে হবে। সেটা না করলে আমাদের ছোট মাপের স্বপ্নও দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।

নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই দায়িত্ব আছে পরস্পরের কাছাকাছি আসার। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণির এই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে। এখানে কেবল পার্টির যারা বুদ্ধিজীবী তাদেরকেই নয়, ননপার্টিজান বুদ্ধিজীবীদেরও জায়গা করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেভাবেই হোক, এই দূরত্ব বেশি দিন থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। তাই আমাদের এমন একটা সামাজিক অঙ্গীকার দরকার, যেখানে সব পক্ষের প্রাজ্ঞজনের স্থান আছে। সবাই যাতে বুঝতে পারে, আমি যে রাজনৈতিক মতেরই হই না কেন, আমার একটা আলাদা আদরণীয় স্থান আছে রাষ্ট্রসভায়। এটাই ভারতবর্ষীয় রীতি :রাজন্যবর্গ সব সময়েই পণ্ডিতদের সম্মান করে এসেছেন।

৫. বহুবার বলা তবু অসমাপ্ত যে কাজগুলো

সর্বশেষ যে কথাগুলো বলতে চাই, সে কথাগুলো বহু মানুষ বহুবার বলেছেন; কিন্তু কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তা বাস্তবায়িত হতে হতে হয়নি। সেখান থেকে তিনটা কাজের কথা আমি বলতে চাই, যা অসমাপ্ত থেকে গেছে। অথচ এর ব্যাপারে করণীয়গুলো সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই একমত। সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের জন্য অবশ্যপালনীয় একটা কাজ। কারণ, জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের দেশ হচ্ছে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। অষ্টম দেশ রাশিয়া! আর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মোট জনসংখ্যার আকারটাই আসলে প্রধান বিবেচ্য। এমনকি আমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারও হই, তা সত্ত্বেও সীমিত আকারে হলেও এক-তৃতীয়াংশ বাজেট নিচের দিকের সরকারগুলোকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি। এখন সেটা পুরনো ১৯ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, নাকি ৬৪ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, সেই যৌক্তিক বিভাজনটাও করা উচিত।

দ্বিতীয়ত, এই বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে প্যারাডক্সটি হচ্ছে, যে সরকারকে আমরা স্থানীয় সরকারে নির্বাচন করছি, তাকে আমরা ক্ষমতায়ন করছি না। যেমন উপজেলা সরকার- নির্বাচন করেছি, ক্ষমতায়ন করিনি। অন্যদিকে যেটি নির্বাচিত এবং ক্ষমতায়িত, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ সরকার- তার ক্ষমতা অতিসংকুচিত। সে সামান্যই অর্জন করতে পারে, কারণ তার হাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু এটা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বইও লিখেছেন, অনেক সভা-সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব একটা এগোয়নি। ভারত তাদের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীতে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে যে, সেখানে তিন স্তরের সরকার হবে। আর সেই তিন স্তরের সবচেয়ে নিচের স্তর হলো গ্রাম পঞ্চায়েত। দু-একটা রাজ্য বাদ দিলে এখন সেখানে সর্বত্রই এই তিন স্তরের সরকার চলছে। এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নিয়মিতভাবেই অর্থনৈতিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। স্থানীয় স্বশাসনের এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজস্ব আহরণের পরিমাণও বেড়ে গেছে।

এর পরের যে চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে, আমাদের গুণগত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের ধনী-গরিবে বৈষম্য শুধু অর্থে নয়, সম্পদে নয়, শিক্ষার গুণেও। কেউ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়ছে, কেউ আবার একেবারে নিম্নমানের স্কুলে পড়ছে। কেউ আবার এ দুই ধারার বাইরে মাদ্রাসায় পড়ছে। কেউ আবার একটা পাঁচমিশালির মধ্যে আছে। দেশের আগামীর সন্তানদের এ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা থাকা উচিত নির্বাচনী ইশতেহারে। যে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে কেমন দেশ চাই? আমরা কি সার্ভিস সেক্টর নেশন হবো নাকি আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং নেশন হবো? এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার যে চিন্তা- তার একটা প্রতিফলন ইশতেহারে থাকবে না, তা তো হয় না। তা ছাড়া যেখানে প্রচলিত শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ, সেখানে অপ্রথাগত বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রভূত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে, চীনের অভিজ্ঞতাও হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। আর শুধু বর্তমানে আটকে না থেকে, ২০৩০ সালে আমাদের কী ধরনের দক্ষতা লাগবে, সেই দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা এখন থেকেই তো করতে হবে।

তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সবকিছুর মূলে থাকে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে যেমন একজন ব্যক্তিমানুষের জীবনে বিঘ্ন ঘটে, তেমনি জাতীয় জীবনেও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় সব সময়ই যে কোনো আলোচনায় অবকাঠামো, আইন, উন্নয়ন এসব নানা বিষয়ের আড়ালে পড়ে যায় স্বাস্থ্যসেবা। তাই স্বাস্থ্য খাত নিয়েও অবশ্যই ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকা চাই। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু সময়ের দাবি অনুযায়ী যেন সে অগ্রগতি খুবই নগণ্য। গরিব-মধ্যবিত্ত নাগরিকের সুচিকিৎসা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে পরিকল্পনার উপস্থিতি ইশতেহারে থাকা উচিত।

সবশেষে বলতে চাই, গত পাঁচ বছরের ম্যাক্রো পরিসংখ্যানেও আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়া সত্ত্বেও এবং দারিদ্র্য কমার পরও কিছু কিছু সূচকে একটা নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন ধরুন, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহকে আমরা যদি জিডিপির অনুপাতে প্রকাশ করি, তাহলে দেখা যাবে এটা কমে গেছে। যদি আমরা রফতানি প্রবৃদ্ধি হার দেখি, সেটাও কমে গেছে। এই অবনতিশীল প্রবণতাকে ফেরাতে হবে। একই সঙ্গে বরাবরই আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছিলাম, বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ২০১০-এর দশকে খুব একটা বাড়েনি। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা মেটানো গেলেও তার আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ দিকগুলোর প্রতি নতুন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রসঙ্গ থাকলে বলা যাবে যে ইশতেহার আমাদের জন্য। তবে সবকিছুই কালের এবং শ্রেণিস্বার্থের অধীন।

Original in সমকাল

বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ (Bangladesh’s expanding middle-class)

middle_class_info

Prothom-Alo: সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যবিত্ত
বাংলাদেশে দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হচ্ছে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশাল অংশ চাকরি করে। তারা এখন ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা জমির মালিক। তারা ইন্টারনেটও ব্যবহার করে। টাকাপয়সা রাখে ব্যাংক হিসাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন মধ্যবিত্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মধ্যবিত্ত হবে। এ তথ্য বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)। গবেষণাটি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। গতকাল বৃহস্পতিবার গবেষণার এ ফল প্রকাশ করা হয়। যাঁরা দৈনিক দুই থেকে তিন ডলার (পিপিপি হিসাবে) আয় করেন, তাঁদের মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ হিসাবটি স্বীকৃত। বিআইডিএস এ গবেষণাটি করেছে ঢাকা শহরের ১২টি এলাকায়। গবেষণার নমুনার সংখ্যা ৮০৯। গবেষণাটি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্তের সেই হিসাবটি ২০১০ সাল ধরে করা হয়েছে। অতীতের একই প্রবণতা ধরে নেওয়া হলে ২০১৫ সালে এসে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী মোট জনগোষ্ঠীর সাড়ে ২২ শতাংশ হবে। বিস্তারিত ->

সমকাল (Samakal): ২০৩০ সালে মধ্যবিত্ত হবে ৩৩ শতাংশ
দেশে মধ্যবিত্তের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত দুই দশকে মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৩ সালে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএসের এক বছরের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে ‘বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের আকার ও প্রবৃদ্ধি’ বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন। বিস্তারিত ->

Financial Express: BIDS study reveals growing middle class BD’s dramatic success
There has been a significant rise in the share of middle class group in the country over the last one decade (1992-2000). If the trend continues, the middle income class will comprise about 25 per cent of the country’s total population in 2025 and 33 per cent in 2030. Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) Researcher Director Dr Binayak Sen revealed the information while presenting a keynote paper on “Size and Growth of Middle Class in Bangladesh” at BIDS Research ALMANAC, 2014-2015. Read more ->

Daily Star: Bangladesh’s middle-class expanding
One-fourth, or 25 percent, of the total population will belong to the middle-class income category by 2025, thanks to greater access to education, finance and IT services, and private sector employment, a recent study found. At present, 20 percent of the population belongs to the middle-income category in Bangladesh in contrast to 24.1 percent in neighbouring India. Read more ->

Dhaka Tribune: BIDS: Middle-class people to reach 33% by 2030
The middle-class group is expected to stand at 33% of the country’s total population by 2030, says Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS). Over the last two decades, the country witnessed a remarkable rise in middle class group, it said, adding that if the trend continues, the country is expected to add 25% of its total population by 2025. It said only 9% of the population belonged to this category decades back and in 2010, this group accounted for 20%. BIDS Research Director Binayak Sen revealed the information in his keynote paper on “Size and Growth of Middle Class in Bangladesh” at the BIDS dissemination event on presentations from the BIDS Research Almanac 2014-2015, at BIDS yesterday. Read more ->

One-third population to be middle-class by ’33
The size of middle class population in the country may soar to one-third of the total population by the year 2033, which is now 20 percent, says a latest BIDS study. The study entitled: ‘Size and Growth of Middle Class in Bangladesh: Trends, Drivers and Policy Implications,’ published on Thursday, considered those in the segment whose per day income is 2 to 3 US dollars. Research Director at the Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) Dr Binayak Sen, who conducted the study, said the middle-class size now more than doubled to 20 percent from 1990 level of 9 percent and it could soar to 25 percent by 2025 and to 33 percent by 2033, according to their assessment. Read more ->

আমি আশাবাদী (I am optimistic)

অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন বছরটা ভালোই যাবে মনে হচ্ছে। এর বড় দিক হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য এখন অনেক কম। সরকার যেহেতু তেলের মূল্য পুরোপুরি সমন্বয় করেনি, সেহেতু এ খাত থেকে আয় জমা হচ্ছে। স্থানীয় অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধিজনিত অর্থ সরবরাহে এই অর্থ কাজে লাগবে। অন্যদিকে রফতানি বাজারে অশুভ কোনো ছায়া দেখতে পাচ্ছি না। মধ্যপ্রাচ্যে সামান্য যে আঞ্চলিক গোলযোগ হচ্ছে, তা অভিবাসনের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা সৃষ্টি করবে না।

দ্বিতীয়ত, গত দুই বছরের সঙ্গে তুলনা করলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগে আস্থা ফিরতে সহায়ক হবে। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আর্থিক খাতে অনিয়মের মূলে আঘাত হানা যাবে কি-না! অনিয়মের রাশ টেনে ধরতে না পারলে অর্থায়নের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়ে যাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কার্যকর অর্থায়নের খুবই দরকার। এ খাতের উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী করা গেলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে তারা নতুনভাবে অবদান রাখতে পারবেন।

অর্থনীতিতে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটা পালাবদল আসে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল একভাবে গেছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল অন্যভাবে যাবে। আমার মনে হয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি হবে আগামী কয়েক বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি বড় উৎস। এতদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন হয়েছে তুলনামূলক বেশি। পদ্মা সেতু এবং একে ঘিরে রাস্তাঘাট, রেলপথসহ অবকাঠামোর যে উন্নয়ন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হবে, তা নতুন এক ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করবে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের অনেক সম্ভাবনা এখনও কাজে লাগানো হয়নি। বেসরকারি বড় উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ সেখানে যাচ্ছে। ওই এলাকা দিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি সমুদ্রকেন্দ্রিক ব্লু ইকোনমির নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সুতরাং ওই অঞ্চলে যে গুণগত পরিবর্তন আসছে, তা অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।

অর্থনীতির সম্ভাবনা বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসুর সঙ্গে একমত। আমি মনে করি, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি চীনের কাছাকাছি চলে যাবে। কারণ চীনের গতি শ্লথ হচ্ছে, আর আমাদের বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য এখন দরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ সেরে ফেলা এবং সম্ভাবনাময় বিশেষ এলাকার দিকে নজর দেওয়া। তা করতে পারলে খুব সহজেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি আট শতাংশে নিয়ে যাওয়া যাবে।

আরেকটি বিষয় বলা দরকার এবং তা হলো, মানব উন্নয়নের সাফল্য ধরে রাখতে হবে। বিশেষত শ্রমশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির কাজে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। যুবশক্তিকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে দেশের ভেতরে ও বিদেশে কর্মসংস্থানে গুণগত পরিবর্তন আসবে। এটা যে কতটা ফলদায়ক তার লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের জনশক্তি বিশেষত নারীরা বিদেশে কাজ পাচ্ছেন।
আমাদের মধ্যবিত্তের আকার গত দুই দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। মধ্যবিত্তের আরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এটা করতে হলে গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের মধ্যবিত্তের সমপর্যায়ে উন্নত শিক্ষা দিতে হবে। ইংরেজি মাধ্যমের বাইরে শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। গরিবের সন্তান দুর্বল মানের শিক্ষায় আটকে যাচ্ছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। মধ্যবিত্ত হতে গেলে গরিবদের সেবা খাতে আসতে হবে। কৃষি শ্রমিক হিসেবে থাকলে হবে না। সুতরাং কীভাবে গরিবকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত করা যায়, তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে। আমি প্রত্যাশা করি, ‘দারিদ্র্য’ শব্দটি একদিন ইতিহাসে পরিণত হবে।

রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বিদেশি বন্ধুরা (Tagore and his Foreign Friends)

বিনায়ক সেন
Tagore
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য :ব্যক্তিগত সংলাপ?

২০০৩ সালের প্যারিসে এক ক্যাফের টেবিলে বসে আছেন মুস্তাফা শেরিফ। বসন্তকালের শেষ অপরাহ্নের আলোয় উদ্ভাসিত প্যারিসের পথ-ঘাট। কিন্তু মুস্তাফা শেরিফের সেদিকে মন নেই। ইসলাম ও দর্শন নিয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি আলজেরিয়ায় খ্যাতিমান। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতেই অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের একজন। তিনি আজ গভীরভাবে চিন্তামগ্ন। ক্যাফেটিও সাধারণ রেস্তোরাঁ নয়। প্যারিসের ইনস্টিটিউট অব অ্যারাব ওয়ার্ল্ড-এর টি-রুমে বসে মুস্তাফা শেরিফ বিশেষ একজনের প্রতীক্ষা করছেন। তিনি জাঁক দেরিদাঁ, তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর সেরা দার্শনিক-চিন্তাবিদদের একজন দেরিদাঁ। কিন্তু নতুনত্ব রয়েছে তার আজকের আগমনে। দেরিদাঁ ও মুস্তাফা শেরিফ আজ আলাপ করবেন সভ্যতার সংঘাত ও সংলাপ নিয়ে। বিশেষত ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্য’ এ দুইয়ের মধ্যকার সভ্যতা-সম্পর্কিত সম্পর্ক নিয়ে। শেষ পর্যন্ত তারা উভয়েই মানছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বলতে যে একরৈখিক ধারণা দেওয়া হয়, তা ঠিক নয়। প্রাচ্যও বিভিন্ন, পাশ্চাত্যও বিভিন্ন। এই বিভিন্ন প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সংঘাত যেমন রয়েছে, ঐক্যের যোগসূত্রও রয়েছে। সক্রাতিসের ‘নিজেকে জানো’ উক্তি মেনে আজ প্রাচ্যকে যেমন তার বিভিন্নতাকে বুঝতে হবে, পাশ্চাত্যকেও তেমনি নিজের ভেতরের ভিন্নতাকে নতুন করে জানতে হবে। আন্তঃসভ্যতার সংলাপের এই আহ্বান জানানোর মাস কয়েকের মধ্যেই ক্যান্সারে মারা যাবেন দেরিদাঁ।

দেরিদাঁ-মুস্তাফা শেরিফের আলোচনা ছিল একান্ত ব্যক্তিগত। নিজেদের বুঝ পরিষ্কার করার জন্যই। কিন্তু তারা সংলাপের যে কথা সেদিন তুলেছিলেন, তা একেবারে নতুন নয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত অর্থে দার্শনিক ছিলেন না হয়তো, কিন্তু সভ্যতার সংঘাত ও সংলাপ এ বিষয়ে বিস্ময়কর অভিনিবেশ ছিল তাঁর। তার চিহ্ন পাই একেবারে লেখক জীবনের গোড়ার দিকের লেখাগুলোতেই। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ত্রিশের দিকে। ১৮৯১ সালে ‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে সৈয়দ আমির আলির প্রবন্ধের সূত্র ধরে ‘পাশ্চাত্য ও ইসলাম’ নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ টেনে আনছেন, যা দেরিদাঁ-শেরিফ সংলাপের কথা মনে করিয়ে দেয়। কোনো এক ইংরেজ মহিলা ‘মুসলমান স্ত্রীলোকদের দুরবস্থা বর্ণনা করিয়া নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিতে যে প্রবন্ধ লিখিয়াছেন’ তার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে অনগ্রসরতার কারণ ‘ধর্মে নহে, জ্ঞানবিদ্যা সভ্যতার অভাবে।’ ইউরোপও এক সময় অনগ্রসর ছিল। ইউরোপেও নারীরা অত্যাচারিত ছিলেন, খ্রিস্টধর্মের উপস্থিতি তাতে পরিবর্তন আনতে পারেনি। ইউরোপে ‘তখন কোনো উচ্চ অঙ্গের ধর্মানুষ্ঠানে স্ত্রীলোকের অধিকার ছিল না। জনসমাজে মিশিতে, প্রকাশ্যে বাহির হইতে, কোনো ভোজে বা উৎসবে গমন করিতে তাহাদের কঠিন নিষেধ ছিল।… খ্রিস্টধর্মবৎসল জুস্টিনিয়নের অধিকারকালে কনস্টান্টিনোপলের রাজপথ স্ত্রীলোকদের প্রতি কী নিদারুণ অত্যাচারের দৃশ্যস্থল ছিল।’ তারপর রবীন্দ্রনাথ ইসলামের আবির্ভাব সম্পর্কে সুচিন্তিত মন্তব্য করলেন। আজকের যুগের জন্য প্রাসঙ্গিক বিধায় পুরো উদৃব্দতিটি শোনা দরকার:
‘এমন সময়ে মহম্মদের আবির্ভাব হইল। মর্ত্যলোকে স্বর্গরাজ্যের আসন্ন আগমন প্রচার করিয়া লোকসমাজে একটা হুলস্থূল বাধাইয়া দেওয়া তাহার উদ্দেশ্য ছিল না। সে সময়ে আরব-সমাজে যে উচ্ছৃংখলতা ছিল তাহাই যথাসম্ভব সংযত করিতে তিনি মনোনিবেশ করিলেন। পূর্বে বহুবিবাহ, দাসীসংসর্গ ও যথেচ্ছ স্ত্রী পরিত্যাগে কোনো বাধা ছিল না; তিনি তাহার সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া স্ত্রীলোককে অপেক্ষাকৃত মান্যপদবীতে আরোহণ করিলেন। তিনি বারবার বলিয়াছেন, স্ত্রীবর্জন ঈশ্বরের চক্ষে নিতান্ত অপ্রিয় কার্য। কিন্তু এ-প্রথা সমূলে উৎপাটিত করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত ছিল না। এইজন্য তিনি স্ত্রীবর্জন একেবারে নিষেধ না করিয়া অনেকগুলি গুরুতর বাধার সৃষ্টি করিলেন।… কতকগুলি পরিবর্তন সাধন করিয়া সমাজকে পথনির্দেশ করিয়াছিলেন। তবু সমাজ সেইখানেই থামিয়া রহিল। কিন্তু সে-দোষ মুসলমান ধর্মের নহে, সে কেবল জ্ঞান বিদ্যা সভ্যতার অভাব।’

এই দীর্ঘ উদৃব্দতির পেছনে রবীন্দ্রনাথের উদ্বেগের জায়গা কোথায় তা পরিষ্কার। তিনি চাচ্ছেন যে ইসলাম সম্পর্কে ইউরোপীয় মতই চূড়ান্ত নয় তা স্বপ্রমাণিত করতে। অন্ধকার সব সভ্যতার ভেতরেই আছে, প্রয়োজন হচ্ছে সংঘাতের মুহূর্তগুলো এড়িয়ে সংলাপের ও ঐক্যের মুহূর্তগুলোর ওপরে জোর দেওয়া। এ কাজটি তিনি বিশেষভাবে শুরু করেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরবর্তী পর্বে।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার পর থেকে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এই বিচ্ছিন্নতার পর্ব তাঁকে নানা দিক থেকে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছিল। তাঁর দেশের মানুষের উন্নতি কোন পথে এ নিয়ে দুর্ভাবনা হচ্ছিল কবির। সে লক্ষ্যে আধুনিকতার ধারণাকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইছিলেন তিনি। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে নিরন্তর ও অর্থবহ সংলাপ ছাড়া এই আধুনিকতার পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয় এটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তরুণ বয়সেই। কিন্তু ধন্দ দেখা দিয়েছিল প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে। উনিশ শতকের রেনেসাঁর চিন্তকদের মতো তিনি ফিরতে রাজি ছিলেন না ভারতীয় প্রাচ্যের ‘প্রাচীন মৌলিকত্বে’। শাস্ত্রের অনুশাসনে বিধির তুলনায় নিষেধেরই বেড়া বেশি করে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। তা ছাড়া, উনিশ শতকের রেনেসাঁর চিন্তকেরা ‘প্রাচ্য’ বলতে শুধু স্বজাতীয় প্রাচ্যকেই বোঝাতেন। যেমন, হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা রেনেসাঁর আকর-উৎস বলতে বোঝাতেন বেদ-উপনিষদ-পুরাণ-কাব্য চতুষ্টয়কে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও প্রায় অবিকল মনোজগতের পথে বারে বারে ফিরে যেতেন ধর্মীয়-পুরাণ অনুষঙ্গে ও উৎসে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা তো আরও বেশি করে স্বজাতীয় প্রাচ্যের চর্চা করতেন। প্রাচ্য যে বিভিন্ন ধারার, এবং তার মধ্যে যে বহুমাত্রিকতা রয়েছে, বহু সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের প্রকাশ রয়েছে, সেটা সুদূর লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে দক্ষিণ এশীয় ও দূরপ্রাচ্য অবধি বিস্তৃত ভূপ্রকৃতি ও বিচিত্রবিধ সমাজ-সংস্কৃতি থেকে বেশ বোঝা যায়। তবে এদেশে রবীন্দ্রনাথই প্রথম এ কথা মর্মে-মর্মে ধারণ করেছিলেন এবং নানাভাবে নিজের দেশে ও বিদেশে গিয়ে সে কথা অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমি সন্দেহ করি, তাঁর বিশ্ব-পর্যটনের যতিহীন প্রয়াসের পেছনে ছিল পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশের বিভিন্ন ধারাকে প্রত্যক্ষে জানা-বোঝার তাগিদ। এজন্যেই কবি গিয়েছিলেন বিলেত-আমেরিকার বাইরে জাপানে, চীন দেশে, জাভায়, সিংহল দ্বীপে, মরুতীর্থে মধ্যপ্রাচ্যে তথা আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, মিসরে, এমনকি সুদূর লাতিন আমেরিকায়। কেন এই চরৈবেতি চড়ূয়া স্বভাব? অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতা এসব পরিব্রাজকের মতোই যেন বিশ্ব-পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন কবি। তবে পরিব্রাজনার পেছনে প্রবল ব্যক্তিগত উৎসাহের কারণ নিহিত ছিল অন্যত্র প্রাচ্যীয় বিভিন্নতাকে স্বচক্ষে সপ্রমাণিত করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নিজের জীবন-চর্চা, বিশ্বাস ও রচনাকর্মের মধ্য দিয়ে।

শুধু প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্যও তো বিভিন্ন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সমীকরণের প্রাচ্য-অংশটি যেমনটা একরূপ নয়, পাশ্চাত্য-অংশটিও তেমনি নানা ধারা, ছক ও স্বভাবের। যে পাশ্চাত্য অনবরত প্রাচ্যকে বশীভূত করে শাসন-শোষণ করতে চায় সেটি এক ধরনের। যে পাশ্চাত্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার মাধ্যমে মানব সভ্যতায় অবদান রাখছে সেটি অন্য ধরনের। এ কথাও রবীন্দ্রনাথের সটান উপলব্ধিতে ধরা পড়েছিল। তাঁর ‘ছোট ইংরেজ ও বড় ইংরেজ’ লেখাটি এ রকম চেতনা থেকেই উৎসারিত। তা ছাড়া, পাশ্চাত্য নিজেদের মধ্যেও অনবরত পায়ে লাগিয়ে ঝগড়া বাধাতে পারদর্শী তার বিগত পাঁচশো বছরের ইতিহাস সে কথাই বলে (এমনটা যখন রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন তখনও প্রথম মহাযুদ্ধের শুরু হয়নি)। তার উপর রয়েছে পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের সংস্কৃতিগত ব্যবধান। যেমন রয়েছে ফারাক ইউরোপ ও আমেরিকার ভেতরে। ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুইয়ের মধ্যকার সংলাপকে অনায়াস বাহাস বলে মনে করা কঠিন। কোন ‘প্রাচ্যের’ সাথে কোন ‘পাশ্চাত্যের’ সংলাপের কথা হচ্ছে? সাম্রাজ্য মদমত্ত পাশ্চাত্যের সাথে আত্ম-সংহারী জাতিবিভেদী প্রাচ্যের সাথে সংলাপে তো কবির উৎসাহ থাকার কথা নয়। তা ছাড়া, পাশ্চাত্যের কাছ থেকে কিছু দান হাত পেতে নেওয়ার পাশাপাশি এটাও তো ভাবতে হবে, পাশ্চাত্যকে দেওয়ার মতো আদরণীয় কিছু আদৌ প্রাচ্যের আছে কিনা? নইলে যে একতরফা বিনিময়ই চলতে থাকবে, আর একতরফা বিনিময় কেবল চলতে পারে পরাধীন সত্তার ক্ষেত্রেই। সকল মানব জাতির না করে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য কেউ কি পরস্পরের কাছ থেকে কিছু নিতে বা পরস্পরকে কিছু দিতে সক্ষম? এসব ভাবনা রবীন্দ্রনাথের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ১৯১০-৩০ পর্বের নানা লেখায় এসব প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসবে কখনও জাতীয়তাবাদের সমালোচনায়, কখনও সাম্রাজ্য ও যুদ্ধের প্রসঙ্গে, কখনও ধন-বৈষম্য, কখনও জাতি-বৈষম্য, কখনও কলের সভ্যতার বিশ্লেষণে। রাজনীতি, ধর্ম, সভ্যতা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও মানব-কল্যাণের পরিণতি নিয়ে এসব উদ্বেগ তাঁর শিল্প-সাহিত্য চর্চায় অনবরত ঢুকে পড়তে থাকবে। এরই মধ্য দিয়ে কবি শিলাইদহ ও শান্তিনিকেতনের আশ্রমের ছায়া পেরিয়ে হয়ে উঠবেন বিশ্বের বিবেকবান বুদ্ধিজীবীদের একজন।

কিন্তু এই পালাবদলের বিবরণী অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি কবির বিদেশি বন্ধুদের মনোযোগের বাইরে রাখি। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যকার সংলাপে সমীকরণ খোঁজার চেষ্টা শুধু ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই সংলাপটি কবির সচেতন উদ্যোগে ও তাগিদে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর কাছের ও দূরের বলয়ে। স্বদেশের সহচরেরা যেমন; এই সংলাপের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন বিদেশি পথিকেরাও। এর পূর্ণ ইতিহাস এখনও জানা হয়নি আমাদের। কিন্তু এটুকু জানা যে কবির মননশীল চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর বিদেশি বন্ধুরা, ইংরেজিতে যাকে বলে ইন্টারলকুটর বা সহ-আড্ডাধারীরা। এঁদের মধ্যে যেমন আছেন ইয়েটস-পাউন্ডের মতো কবি, আইনস্টাইনের মতো পদার্থবিদ, রাসেল-বের্গসঁ-শোয়াইটজারের মতো দার্শনিক, ওয়েলস-বার্নার্ডশ-হামসেনের মতো লেখক, ফ্রয়েড-হ্যাভলক এলিসের মতো মনোবিজ্ঞানী, বুনিন-হিমেনেথ-জিদের মতো তাঁর কবিতার নোবেলবিজয়ী অনুবাদক, এমনকি র‌্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ও উড্র উইলসনের মতো রাজনীতিক। এই সংলাপে পরোক্ষভাবে ঘটনা-পরম্পরায় যুক্ত হয়েছেন রাইনের মারিয়া রিল্কে, ফেদেরিকো লোর্কা, লুই বনুয়েল, বরিস পাস্তেরনাক, আন্না আখমাতভা ও পাবলো নেরুদা, যারা সরাসরি কবির সানিনধ্যে আসেননি, কিন্তু বহন করেছেন তাঁর গান, কবিতা বা গদ্য-ভাবনার বীজ। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অনেকটা স্বউদ্যোগে নিজ হাতেই যেন সম্পন্ন করেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার মহাজাতি বৈঠকের। আবার এসবের মধ্য দিয়েই পদ্মা-পারের কবি হয়ে উঠছিলেন এক বিশ্ব-ব্যক্তিত্ব; স্থান করে নিচ্ছিলেন বিশ্ব-কবির সারিতে। অবশ্যই এই মহা-সংলাপ হয়েছিল তাঁর পছন্দের প্রাচ্য ও পছন্দের পাশ্চাত্যের ধারার মধ্যে। এই বৈঠকের ভাষা দ্বিপক্ষীয় সাংস্কৃতিক বা সাহিত্যিক ভাব বিনিময়ের হলেও এর প্রেরণা বহুত্ববাদী, একান্তভাবেই জাতীয়তাবাদের বাইরের ভুবনের। সে কথা ম্যানিফেস্টোর মতো কবি ১৯১৭ সালের ‘ন্যাশনালিজম’ বক্তৃতামালায় সবিস্তারে তুলে ধরছেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমদর্শী সমালোচনায়। ১৯৯১ সালে ন্যাশনালিজম গ্রন্থের ভূমিকায় ইংরেজ দার্শনিক ই.পি. থমসন তাঁকে ‘উত্তর-আধুনিক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেটা রবীন্দ্রনাথের জানার কথা নয়। জার্মান দার্শনিক হাবেরমাস ১৯৯০-র দশকে খুঁজেছিলেন ‘পোস্ট-ন্যাশনালিজম’-এর সম্ভাবনা। সেটাও রবীন্দ্রনাথের জানার কথা নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে তাঁর রচনা-কর্মই উত্তর-আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা ও পোস্ট-ন্যাশনালিজম ধারণার সবচেয়ে কাছাকাছি কী সেই সময়ে, কী এই সময়ে তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে, অন্তত এই ভূখণ্ডে। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর বহুত্ববাদী মনের কারণে, সেখানে নানা-প্রাচ্য ও নানা-পাশ্চাত্যের রঙে ঝিলমিল। এটা তাঁর ভিনদেশি সহ-আলাপীদের তালিকা দেখলেই বোঝা যায়। এনার্কিস্ট, লিবারেল হিউম্যানিস্ট, কট্টর মার্কসিস্ট, ফেবিয়ান সোশ্যালিস্ট, থিওসফিস্ট, ওরিয়েন্টালিস্ট, ফেমিনিস্ট, লজিক্যাল পজিটিভিস্ট, খ্রিস্টীয় আদর্শবাদী, সুফী মতাবলম্বী, মার্টিন বুবেরের মতো ইহুদি আদর্শের প্রচারক, বৈদান্তিক, নাস্তিবাদী, সংশয়বাদী কে নেই রবীন্দ্রনাথের সাথে এই মহাজাতি সংলাপে! আর এই বিদেশি সভায় প্রাচ্যের হয়ে একাই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন কবি। এই সংলাপের যা কিছু ঘটেছে তার অনেকটাই ঘটেছে লোকচক্ষুর অগোচরে, দিনলিপি বা চিঠির নিভৃত পাতায়, অথবা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্যে। অর্থাৎ এখনকার মতো মিডিয়ার ২৪-ঘণ্টা নজরদারির বাইরে, বলা যায় কবির একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার কাঠামোয়। কখনও কখনও অবশ্য সেসব আলোচনা ও পত্রালাপ প্রকাশ পেয়েছে ‘মডার্ন রিভিউ’তে অথবা অনূদিত হয়েছে ‘প্রবাসী’র পাতায়। তবু এর মধ্য দিয়েই আমাদের প্রাচ্যকে বহির্বিশ্ব জানতে পেরেছে। বর্ণবাদী ওরিয়েন্টালিজমের বাইরে যে-প্রাচ্যকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গর্ব করতেন, তার সাথে বিতর্ক ও আড্ডার সুযোগ মিলেছে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিদের। এজন্যেই কি কবির প্রাণপাত কষ্ট স্বীকার, ঘুরে বেড়ানো, দেশ থেকে দেশে (কখনও কখনও ছয় মাস-এক বছর ধরেও ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাঁকে) জাহাজে বা রেলগাড়িতে চড়ে দীর্ঘ যাত্রায়। রুশ চিত্রশিল্পী নিকোলাই রেরিখ তাঁর ‘হিমাবৎ’ (হিমালয়ের সনি্নকটে) গ্রন্থে লিখেছেন, কবির সাক্ষাৎ মেলা ভার, কেননা ‘অক্লান্ত ভাবে তিনি সারা পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’ কেন এই কষ্ট স্বীকার, সে কি কেবল ঘরের বাইরের পৃথিবীকে সম্মান জানানোরা জন্যে, নাকি জাতি হিসেবে ‘বাঙ্গালীকে’ যাতে কেউ কূপমণ্ডূক মনে করতে না পারে, সেজন্যেও? দ্বিতীয়বার আমেরিকা সফরের সময় (১৯১৬-১৭ সালে) টানা ১২১ দিনে প্রায় ৭০০০ মাইল ঘুরে ৫৭টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন কবি। সে তো নিছক খ্যাতির পেছনে দৌড়ানোর জন্যে নয়, অথবা খ্যাতির বিড়ম্বনার পার্শ্বর্-প্রতিক্রিয়াজাতও নয়। বিবেকানন্দের পর কিন্তু ভিন্ন পন্থায় ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে প্রাচ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন কবি মার্কিন দেশের জনসমাজের সম্মুখে এক ব্যাপক ব্যক্তিগত উদ্যোগে। মনে রাখতে হবে, অর্থবহ সংলাপ হয় সমকক্ষদের মধ্যে কেবল। সেভাবেই রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার সব সংলাপে অংশ নিয়েছেন নিজের কোনো অসম্পূর্ণতায় কুণ্ঠাবোধ করা ছাড়াই। যখন নোবেল পাননি তখনও আস্থাশীল ছিলেন নিজের সম্পর্কে। এক কথায়, বিদেশি বন্ধুদের সাথে আলাপে-সংলাপে, বিতর্কে-বাদানুবাদে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট, জ্ঞানোৎসাহী ও উদার শ্রোতা ও বক্তা উভয় ভূমিকাতেই। এর জন্যে প্রতিটি সাক্ষাৎ ও প্রতিটি চিঠির পেছনে তাঁকে যথাসাধ্য প্রস্তুতি নিতে হতো। এই বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন বিপুল ও সর্বব্যাপী, আমাদের আজও তা বিস্মিত না করে পারে না। এরই কিছু অনুচিহ্ন নিয়ে বর্তমান লেখা।

২. তাঁর নোবেলজয়ী অনুবাদকেরা

বিদেশি বন্ধুদের সারিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে চলে আসে তাঁর সৃষ্টিকর্মের অনুবাদকেরা। এখানে শুধু তাঁদেরকেই উল্লেখ করব যারা রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুবাদকদের মধ্যে অগ্রগণ্যই ছিলেন না; পরে তাঁরা নিজেরাই পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। তার মানে এই নয় যে, নোবেল যারা পাননি তাঁরা ছিলেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংলাপের বাইরে। টলস্টয় রবীন্দ্রনাথকে চিনতেন না ঠিকই, কিন্তু কবি তাঁর লেখার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। টলস্টয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ তাঁর তেমন ভালো লাগেনি, তবে টলস্টয়ের আদর্শে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নানা লেখার মধ্যে (বিশেষ করে স্বদেশী-সমাজ পর্বের লেখাগুলোয়) টলস্টয়ের সযত্ন উল্লেখ রয়েছে। টলস্টয়ের মতো রাইনের মারিয়া রিল্কেরও রবীন্দ্রনাথের সাথে সরাসরি কখনও দেখা হয়নি। রিল্কে রাশিয়ায় ছিলেন একটা সময়ে ও রুশ ভাষা ভালো জানতেন; কাব্য-বিষয়ে পাস্তেরনাক-সিভেতায়েভার সাথে বিখ্যাত পত্রালাপ রয়েছে তাঁর। এটা আমরা ভুলে যাই কী করে যে, জার্মান ভাষায় গীতাঞ্জলি অনুবাদের জন্য রিল্কেকেই প্রথমে অনুরোধ করা হয়েছিল প্রকাশকের পক্ষ থেকে। নোবেল প্রাপ্তির আগেই রবীন্দ্রনাথের কথা শুনেছিলেন তিনি তার বন্ধু ওলন্দাজ কবি ভন আদেনের কাছে। ১৯১৪ সালে যখন আদ্রে জিদের করা গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ বার হলো তখন সে অনুবাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রিল্কে নিজে থেকে জার্মান প্রকাশক কুর্ট উয়োলফ্কে চিঠি লিখেছেন। এ বইয়ের দ্রুতই জার্মান অনুবাদ বের হওয়া দরকার এই ছিল রিল্কের মত। চিঠিটা পেয়ে উয়োলফ বরং রিল্কেকেই অনুরোধ করেন অনুবাদ-কর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্যে। কিন্তু রিল্কের তখন চলছে প্রেরণার সংকট। ডুইনো এলিজি অর্ধ-সমাপ্ত হয়ে পড়ে রয়েছে, লেখা আপাতত বেরুচ্ছে না। গীতাঞ্জলির অনুবাদ-কর্মে হাত দিতে হলে অন্য সব কাজ পিছিয়ে যাবে এই আশঙ্কার পাশাপাশি একটি কেজো যুক্তিও দেখিয়েছিলেন তিনি। অনুবাদ যেহেতু করতে হবে ইংরেজি থেকেই, আর ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনায়াস দখল সত্ত্বেও ইংরেজি তাঁর তেমন আয়ত্তে নেই। ফলে সুবিচার করা হবে না লেখাগুলোর প্রতি। ‘আমি নিজের ভিতরে এই কাজটা করার জন্য অনিবার্য আহ্বান শুনতে পাচ্ছি না আর একমাত্র তা থেকেই একটা নিশ্চিতভাবে ভালো কাজ জন্ম নিতে পারে।’ এভাবেই গীতাঞ্জলির অনুবাদ-কর্মের শ্রমসাধ্য কাজটিকে দায়সারাভাবে না দেখে সৃষ্টিশীল গুরুত্বের সাথে দেখেছেন তিনি। অবশ্য এ চিঠির কয়েক বছর বাদে ১৯২১ সালেই জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি ৮ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। এ কাজটি করেছিলেন হেলেন মেয়ার-ফ্রাঙ্ক ও তাঁর স্বামী দার্শনিক ভাষা-তাত্তিবক হাইনরিশ মেয়ার-বেনফি। কোনো বিদেশি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের রচনাবলির প্রকাশ এই প্রথম। ইংরেজিতে তিরিশের দশকের শেষেই সিলেক্টেড ওয়ার্কস বেরিয়েছিল কেবল, রুশ ভাষায় আরও পরে, পঞ্চাশের দশকে।

গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের সাথে আঁদ্রে জিদ কী করে জড়িত হলেন, সে গল্পও কৌতূহলোদ্দীপক। সাঁ জ পার্স ফরাসি লেখক, নোবেল পুরস্কার পান ১৯৬০ সালে, জীবনের শেষ তিন দশকে কাটিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর জিদ নোবেল পান ১৯৪৭ সালে। গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের সাথে দু’জনেই জড়িত ছিলেন :পার্স পরোক্ষভাবে, জিদ প্রত্যক্ষভাবে। ১৯১২ সালে ইয়েটস-এর ভূমিকা সংবলিত গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বের হওয়ার সাথে সাথে তা কেবল ইংল্যান্ডে নয়; ইউরোপের সমগ্র সারস্বত সমাজেরই দৃষ্টি কেড়েছিল। পার্সের বয়স তখন ২৫, লেখক-জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম করছেন। আর জিদের বয়স তখন ৪৩, ইতিমধ্যেই ফরাসি সাহিত্যাকাশে দেদীপ্যমান। পত্রিকায় গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে পার্স উচ্ছ্বসিত হয়ে জিদকে সে কথা জানান। শুধু তা-ই নয়, কবির সাথে উদ্যোগী হয়ে দেখা করেন লন্ডনে এবং গ্রন্থটির ফরাসি অনুবাদের জন্য জিদকেই মনোনীত করতে অনুরোধ করে যান। কেন গীতাঞ্জলির সুর পার্স ও জিদ উভয়কেই এত টেনেছিল সেটা এক চিত্তাকর্ষক আলোচনার বিষয় হতে পারে। কেননা, জিদ গোড়া থেকেই অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট ধারার লেখক, সেটা প্রচলিত নীতিবোধ বা ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, তেমনি পরে স্তালিন পন্থাকে তীব্র ভর্ৎসনা করার বেলাতেও সুস্পষ্ট। গীতাঞ্জলির মরমি ভাবাদর্শের প্রতি তাঁর বরং নির্লিপ্তিই থাকার কথা। তারপরও আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে তিনি যা বলেছিলেন তা হলো, এর সহজ সরাসরি উচ্চারণ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এ কাব্যের বক্তব্যকে বোঝার জন্য কোনো অভিধানের প্রয়োজন নেই বা কোনো ভারতীয় পুরাণ বা শাস্ত্রের সাথে পূর্ব-পরিচয়ের দরকার নেই। এতটাই পাঠক-বন্ধু রচনা এটি। অন্যদিকে, পার্স তরুণ বয়স থেকেই অধুনাপন্থি, আভোগার্দ যাকে বলে, পরে নাজিবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। হয়তো ফরাসি প্রতীকবাদী কবিতা থেকে এই মিতবাক ছোট ছোট কবিতা ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন স্বাদ ও ঘরানার। ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন হিসেবে কল্পনা করা ছাড়াও একে দিব্যি মানবীয় প্রেরণায় পড়ে ফেলা যায়। গীতাঞ্জলির এটি একটি বড় গুণ। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ সে রকম সরল সত্যের আহ্বান হয়তো তাঁদের মনে আলোড়ন তুলে থাকবে। বিশেষ করে অবাক লাগে গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের ভূমিকায় জিদ যখন বোদলেয়ারের সাথে রবীন্দ্রনাথের তুলনা করছেন, অথবা উদাহরণ টানছেন গ্যেটের ফাউস্টের। প্রাচ্যীয় বিচ্ছুরণ তখন একান্তভাবে আর প্রাচ্যের একচেটিয়া থাকছে না, পাশ্চাত্য ঐতিহ্যেরও অংশ হয়ে উঠছে। বা অন্যভাবে বললে, বোদলেয়ার. গ্যেটে বা জিদ নিজেও প্রাচ্যীয় অনুষঙ্গের অন্তর্লীন মুহূর্ত হয়ে উঠছেন। ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা’ এই উন্মাতাল আলো কি কেবল উপনিষদের? বা একে বৈষ্ণব দর্শনের সারাৎসারও বলে মনে করেননি জিদ। বরং এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন মানবীয় ভালোবাসারই দর্শন, যেখানে শাস্ত্রীয় ধর্ম নেই, বরং ভালোবাসাই সেখানে পরম ধর্ম হয়ে আছে। গীতাঞ্জলির এই ব্যাখ্যা জিদের জীবন-দর্শন দ্বারা স্পষ্টতই প্রভাবিত। কবির ‘জীবনদেবতার’ স্বীকৃতি নেই এতে।

গীতাঞ্জলির জিদ-কৃত ভূমিকায় প্রাচ্য-বিষয়ক আরেকটি বহুল-উদৃব্দত অভিযোগের অপনোদন করা হয়েছে। প্রাচ্যীয় শাস্ত্র-সাহিত্যাদি অর্থহীন; এর সমগ্র সম্ভারও ইউরোপের এক তাক বইয়ের চেয়ে মূল্যবান নয় এ রকম একটি আপ্তবাক্যের তিরস্কার ম্যাকলের কলম থেকে ১৮৩০’র দশকে নিঃসৃত হয়েছিল। তার পর থেকেই এক ধরনের হীনম্মন্যতা প্রাচ্যদেশকে তাড়া করে ফিরেছে। জিদ কিন্তু তা বলছেন না। প্রথমত, তিনি বলছেন যে গীতাঞ্জলির সহজ উচ্চারণ তাঁকে স্বস্তি দিয়েছে। কেননা, ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থরাজি তাঁর পড়া নেই, এবং অনন্তকাল হাতে পেলেও তা পড়ে শেষ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, প্রাচ্যের ভাবনার মাঝে কেবল দেবত্ববাদ নয়, সেখানে সংশয়বাদও খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁর দৃষ্টিতে, ‘বহুদেববাদ আসলে প্রকৃত সত্য নয়’। কেননা, অমন যে আকর-গ্রন্থ ঋগ্গ্বেদ সেখানেও বলা হচ্ছে :’এসব তত্ত্ব কে জানে? কে-ই বা এসব নিয়ে কথা বলতে পারে? কোথা থেকে আসে প্রাণী? এই সৃষ্টিই বা কী? এর সামনে দেবতাদেরও বামনের মতো দেখায় কীভাবে এর আরম্ভ হয়েছিল তা কার জানা আছে?’ গীতাঞ্জলি, জিদের চোখে, এ রকমই মুক্ত প্রেরণায় রচিত এবং এই বোধ আধুনিক কাব্যকলারই লক্ষণ।

দেখা যাচ্ছে, ফরাসি দেশেই গীতাঞ্জলির ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-কর্মের (ইংল্যান্ডের চেয়েও আমি বলব) উচ্চ মূল্যায়ন হয়েছিল বেশি করে। সেটি শুধু জিদের স্থিতধী মূল্যায়নেই প্রকাশ পায়নি। ১৯১৫ সালে রোমাঁ রোলাঁ নোবেল পুরস্কার পান (পুরস্কারটা হাতে পান ১৯১৬ সালে)। রোলাঁ যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে আপন করে নিয়েছেন সেরকম উৎসাহ ইংল্যান্ডে ক্রমশ দুষ্প্র্রাপ্য হয়ে উঠছিল। রোলাঁর সাথে গান্ধীর যেমন, যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ পত্রালাপ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছর পূর্তিতে ‘গোল্ডেন বুক অব টেগোর’ সংকলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রোলাঁই। প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ইউরোপ ও এশিয়ার লেখক-শিল্পীদের প্যাসিফিস্ট অবস্থানে একত্রিত করা নিয়ে এঁদের মধ্যে সহমত ছিল। প্রাচ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়ূক, আর পাশ্চাত্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নৈতিক ভিত্তি লাভ করুক এই ছিল রোলাঁর মত। পরে ফ্যাসিবাদবিরোধী জোরালো অবস্থানে যাতে কবি দৃঢ় থাকেন (বিশেষত ১৯২৬ সালে মুসোলিনির ইতালি ভ্রমণের পর) সেক্ষেত্রে রোলাঁ বিশেষভাবে সজাগ অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। তবে রোলাঁ বা আঁরি বারবুসের মতো শান্তি-আন্দোলনের নেতারাই নন; বৃহত্তর ফরাসি সারস্বত সমাজে রবীন্দ্রনাথের স্থান ছিল সাধারণভাবেই খুব উঁচুতে। এক্ষেত্রে পল ভ্যালেরির উদাহরণ টানা যায়।

ফরাসি প্রতীকবাদী আন্দোলনের পুরোধা কবি ভ্যালেরির প্রভাব আধুনিক কবিতার ওপরে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। আধুনিক বাংলা কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়। বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত উভয়েই ভ্যালেরির কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। এহেন ভ্যালেরি রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনীতে এসে কবির সাথে পরিচিত হয়ে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেলেন। ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের আঁকা চিত্রকর্মের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। এই কাজটি করার জন্য সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে এসেছিলেন তিনি। মূল প্রদর্শনীর আগে এক প্রাক্-প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল এবং তাতেই নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন ভ্যালেরি। তিনি কবির আঁকা মূর্ত-বিমূর্ত ধারার ছবিগুলো দেখে মন্তব্য করেছিলেন যে, এসব ছবির প্রদর্শনী এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে তাতে ফরাসি চিত্রকরদের জন্যে তা ‘এক শিক্ষণীয় বিষয় হবে’। প্রাচ্যের চিত্রকলা মানেই মুঘল মিনিয়েচার বা বাংলার সনাতনী পট-চিত্র, রবীন্দ্রনাথ এ ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন। অবচেতনের অস্বচ্ছ আবহে থেকে থেকে ঝিলিক দিচ্ছে মূর্ত অবয়ব, সে-ও মনের অন্ধকার আলোয় ঘেরাটোপে আঁকা, যেন অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের অন্য বিচ্ছুরণ। ইউরোপে এক্সপ্রেশনিজম সবে শুরু হয়েছে, পল ক্লি জার্মানিতে এর নেতৃত্বে, ফ্রান্সে তখনও ততটা ছড়িয়ে পড়েনি, তারই মধ্যে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রদর্শনী। এর তাৎপর্য এই আন্দোলনের অন্যতম তাত্তি্বক ভ্যালেরির প্রখর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার নয়। কিন্তু আরও একটি কারণে অভিভূত হয়েছিলেন ভ্যালেরি। গীতাঞ্জলির শান্ত-সৌম্য চেহারার সন্ত কবি সর্বাধুনিক এক্সপ্রেশনিজমের মূর্ত-বিমূর্ত চিত্রকলার মাধ্যমে নিজেকে পুনরায় প্রকাশিত করছেন, সেটি তাঁকে কিছুটা বিস্মিত না করে পারেনি। কিন্তু প্রধান কারণ ছিল অন্যত্র। ভ্যালেরির সাথে সাক্ষাৎকালে কবি অনর্গল বলতে থাকলেন ভারতবর্ষের দুঃসহ পরিস্থিতির কথা (ততদিনে ১৯২৮ সালের মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা হয়ে গেছে; দেশজুড়ে চলছে ব্যাপক ধর-পাকড়)। আর বললেন প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত ‘দশ লক্ষ ভারতীয় সৈন্যের’ কথা, যাদের ফ্রান্সের মাটিতে কবর দেয়া হয়েছে, অথচ কোনো স্মৃতিসৌধ গড়া হয়নি তাদের নামে। কবির বক্তব্য ছিল, ‘ফ্রান্সের কাছে এতখানি নিষ্ঠুরতা তিনি আশা করেননি।’ দেখা গেছে, যুদ্ধ ও শাান্তির প্রশ্নে ১৯৩০ সালেও এসে কবি আবেগে আলোড়িত হয়ে উঠছেন, যেমনটা হয়েছেন ১৯১৭ সালে ন্যাশনালিজম বক্তৃতামালায়। এই সাক্ষাৎকারে ভ্যালেরি অভিভূত হয়েছিলেন, সে কথা ওকাম্পো তাঁর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বইয়ে আমাদের জানিয়েছেন।

ভ্যালেরি অবশ্য নোবেল পুরস্কার পাননি, যেমন মেলেনি লরেন্স, জয়েস বা পাউন্ডের ভাগ্যে। কিন্তু ইভান বুনিন পেয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। রুশিদের মধ্যে সাহিত্যে তিনিই প্রথম এ পুরস্কার পান। গীতাঞ্জলির নোবেল অনুবাদকদের মধ্যে ইংরেজিতে যেমন ছিলেন ইয়েটস, ফরাসিতে জিদ, আর রুশ ভাষায় বুনিন ও পাস্তেরনাক (আখমাতভাও রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছিলেন, তবে ১৯৬৪ সালে তিনি নোবেল তালিকায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে হয়ে হয়নি)। ১৯১৮ সালে গীতাঞ্জলির রুশ সংকলন প্রকাশ পায় বুনিনের সম্পাদনায়। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার পরে রুশ ভাষাতেই গীতাঞ্জলির অনুবাদ হয়। তবে মূল গ্রন্থটি হাতের কাছে না থাকায় এ কথা সঠিক করে বলা যাচ্ছে না বইটির পুরোটা তাঁরই অনুবাদ কিনা, নাকি অন্য রুশি অনুবাদকরাও (যেমন টলস্টয়-পুত্র ইলিয়া টলস্টয়) তাতে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯১৮ সালের সংস্করণটি মনে হচ্ছে পুশেনিনকভের প্রচেষ্টায় অনূদিত হয়েছিল, তবে সার্বিক সম্পাদনা ছিল ইভান বুনিনের। সেই অনুবাদে বুনিন কতটা হস্তক্ষেপ করেছিলেন, ইয়েটস্-এর মতো কোনো কোনো কবিতা নিজেই ঘষা-মাজা করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা, তা জানার সহজ উপায় নেই। বুনিনের সাথে রবীন্দ্রনাথের কখনও সাক্ষাৎকার হয়নি, যদিও সেটা অনায়াসে হতে পারত। বুনিন অক্টোবর বিপ্লবের পর প্যারিসে চলে যান এবং সেখানে বসেই রুশ বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারকাজে সক্রিয় অংশ নেন। তবে বুনিন কবির কাছে একেবারে অপরিচিত নাম ছিলেন না। প্যারিস প্রবাসী রুশ বুদ্ধিজীবীদের গ্রুপ ১৯২৩ সালে কোলকাতায় কবিকে চিঠি লিখে অর্থ সংগ্রহের জন্য অনুরোধ জানায়। উদ্দেশ্য অক্টোবর বিপ্লবের কারণে বিতাড়িত ভিন্নমতের রুশ বুদ্ধিজীবীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান। এই অনুরোধ আসে মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ ও অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ভিনোগ্রাদভের তরফ থেকে, যার চিঠিতে প্যারিস প্রবাসী গ্রুপ ও বুনিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণের আগে থেকেই রুশ অক্টোবর বিপ্লব সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণভাবে উৎসাহী ও জিজ্ঞাসু ছিলেন। ইংরেজদের সমস্ত (অনেক ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত) প্রচারণা সত্ত্বেও তিনি রাশিয়ার ও রুশ বিপ্লবের বিরোধী দলে নাম লেখাতে চাননি। কয়েক বার ব্যর্থ চেষ্টার পর ১৯৩০ সালে তিনি স্বচক্ষে বিপ্লব-উত্তর কর্মকাণ্ড দেখার জন্য রাশিয়ায় যান। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে সে ভ্রমণের বৃত্তান্ত রয়েছে। কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও বইটির সুর ছিল রাশিয়ার সংস্কার প্রসঙ্গে অনেকটাই প্রশংসাবাচক। এতে প্যারিস প্রবাসী ভিন্নমতের বুদ্ধিজীবীরা (যার মধ্যে বুনিনও ছিলেন) কবির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকবেন। গীতাঞ্জলি অনুবাদের পর রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে বুনিনের নিস্তব্ধতা এর থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। রবীন্দ্রনাথের তরফেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে কোনো তাগিদ লক্ষ্য করা যায়নি। কবির রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল যে, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলায় কিছু ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক অবস্থান মোটের উপর প্রাচ্যের জন্য কল্যাণকর ও বিশ্ব-শান্তির সহায়ক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবির এই অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পাস্তারনাক রবীন্দ্রনাথে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে। ১৯৩৬ সালে গোর্কির মৃত্যুর পরে পাস্তেরনাকই ছিলেন সোভিয়েত লেখক সংঘ রাইটার্স ইউনিয়নের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু মিখাইল বুলগাকভের মতো তিনিও অবস্থার শিকারে পরিণত হন। স্তালিনের সুনজরে থাকার কারণে দুজনে প্রাণে বেঁচে যান ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন চিন্তার লেখা থেকে সরে আসতে হয় এঁদের। বুলগাকভ নিমজ্জিত হন মস্কো আর্ট থিয়েটারে, আর পাস্তেরনাক নিয়োজিত হন অনুবাদ-কর্মে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৩ সাল (স্তালিনের মৃত্যু হয় যে বছর) অবধি পাস্তেরনাক শুধু অনুবাদের কাজই নিষ্ঠার সাথে করে গেছেন। শেকসপিয়র রচনাবলির রুশ অনুবাদ তাঁরই দক্ষ হাতে সুসম্পাদিত হয়। অনুবাদের ধারাবাহিকতায় এক সময় তাঁর চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথের রচনাকর্ম। এর পেছনে পাস্তেরনাকের প্রেমিকা কবি ওলগা ইভিনস্কায়ার (ড. জিভাগো উপন্যাসের লারার চরিত্র তাঁরই আদলে গড়া) বড় অবদান ছিল। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা তিনিই রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। এ বিষয়ে ওলগা লিখেছেন, পাস্তেরনাক পেরেডেলকিনোয় একবার এলে তিনি রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা অনুবাদ করে শুনিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি কবিতা ‘শেষ লেখার’ অন্তর্ভুক্ত, যেটি শুরু হয়েছে ‘ঘণ্টা বাজে দূরে’ লাইনটি দিয়ে। অনুবাদটি শুনে পাস্তেরনাকের চোখে জল এসে গিয়েছিল। এখানে ছোট্ট একটা তথ্যগত ত্রুটি শুধরে রাখি। পাস্তেরনাকের জীবনীকার ক্রিস্টোফার বার্নস লিখেছেন, ১৯৩০-এর দিকে পাস্তেরনাক রাশিয়ার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনোমতেই পাসপোর্ট নাকি জোগাড় করা যাচ্ছিল না। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন মস্কো যান তখন তাকে দিয়েও নাকি চেষ্টা নেয়া হয়েছিল রুশ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানানোর, যাতে পাস্তেরনাকের পাসপোর্টের একটা সুরাহা হয়। এটা কতটা সত্যি তা আরও যাচাই করে দেখা দরকার। পাস্তেরনাক তিরিশের দশকে বেশ কয়েক বার ‘লিটারেরি ডেলিগেশন’-এর সদস্য হয়ে রাশিয়ার বাইরে গিয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল রাইটার্স কংগ্রেসে তিনি সোভিয়েত প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৩৬-৩৮ পর্বে একাধিক বার কবি ওসিপ মান্দেলস্টাম, আন্না আখমাতভা ও মারিনা সিভেতায়েভার জন্যে স্তালিনের কাছে পর্যন্ত দেন-দরবার করতে হয়েছিল তাঁকে। যাদের ওপর দিয়ে তিরিশের দশকে শুদ্ধি অভিযানের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, পাস্তেরনাক তাদের মধ্যে ছিলেন না। বৈষয়িক কোনো কষ্টেও তাঁকে কখনও পড়তে হয়নি। তাঁর বরং কিছুটা অসুবিধে হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে, স্তালিনের মৃত্যুর পর। কিন্তু সেটা ‘ড. জিভাগো’ পর্বের কথা।

গীতাঞ্জলির স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রেও দক্ষ হাতের মধ্যস্থতা ঘটেছে। ইয়েটস, জিদ, বুনিন ও পাস্তেরনাকের মতোই হিমেনেথ পরে নোবেল পুরস্কার পান (১৯৫৬ সালে)। গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ১৯১২ সালে, ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। হিমেনেথ ও তাঁর স্ত্রী জেনোবিয়া মিলে ১৯১৩ থেকে ১৯২০-এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিসেন্ট মুন, গীতাঞ্জলি, গার্ডনার, ডাকঘর, স্ট্রে বার্ডস, রাজা ও রানী, মালিনী ও হাংরি স্টোনস গল্প-সংগ্রহ। স্প্যানিশ ভাষায় এদের অনুবাদ-কর্ম এতই সার্থক যে, পরে হিমেনেথের নিজের বই যেখানে অবিক্রীত অবস্থায় ধুলোচাপা থাকত, রবীন্দ্রনাথের তখন প্রতি বছরে হাজার হাজার কপি বই বিক্রি হতো। তবে ১৯২১ সালে প্যারিস থেকে মাদ্রিদে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও শেষপর্যন্ত আর স্পেনে যাওয়া হয়নি কবির। ফলে রবীন্দ্রনাথের সাথে হিমেনেথ-দম্পতির আর দেখা হয়ে ওঠেনি। সেবার স্পেনে গেলে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেতেন কী অসাধারণ আয়োজন করা হচ্ছিল স্পেনে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্যে। হিমেনেথের ইচ্ছে ছিল স্বীয় জন্মভূমি আন্দালুশিয়ায় কবিকে নিয়ে যাওয়ার। পরিকল্পনা ছিল কত কী! রবীন্দ্রনাথের মুখে বাংলায় কবিতা পাঠ শুনবেন, স্পেনের ছেলেমেয়েরা করবে কবির সামনে তাঁরই লেখা ‘বিসর্জন’ নাটক, আর সেই নাটকে মহড়া দিচ্ছিলেন রুবেন দারিও, লুই বনুয়েল, আর নামভূমিকায় তরুণ লোর্কা স্বয়ং। কী চমৎকারই না হতে পারত রবীন্দ্রনাথের স্পেনে আগমন! ঐতিহাসিক এই অসাক্ষাতের অবশ্য প্রভাব থেকে গিয়েছিল তার পরেও বহু কাল অবধি। এই প্রভাব এসে পড়েছিল হিমেনেথ-লোর্কার সূত্রে পরে আরেক নোবেল জয়ী কবি চিলির পাবলো নেরুদার উপরেও। লাতিন মহাদেশের এই কবি তাঁর সৃষ্টিশীলতার গোড়ার পর্বেই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সে কথা আমাদের জানা। তাঁর ‘বিশটি প্রেমের কবিতা আর একটি হতাশার সঙ্গীত’ কাব্যগ্রন্থের ১৬তম কবিতার স্তোত্র প্রত্যক্ষভাবে শুরু হয় ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ চরণটি দিয়ে। এখানেও দেখতে পাচ্ছি এক প্রাচ্যের সুর কীভাবে অন্য প্রাচ্যকে প্রভাবিত করছে। হিমেনেথ দম্পতি যেখানে রবীন্দ্রনাথের মরমি ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন, নেরুদা সেখানে সেই একই উৎস থেকে খুঁজে নিচ্ছেন অনশ্বর প্রেম ও বিরহের পদাবলি। রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করতে করতে হিমেনেথের এক সময় মনে হয়েছিল, এতে বড় বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ছেন তিনি, ক্ষতি হচ্ছে তার নিজেরই সৃষ্টিকর্মের। সেজন্যে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ কর্ম এক পর্যায়ে বন্ধ পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন। হয়তো স্প্যানিশ ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে, অথবা আন্দালুশিয়ার ভূ-প্রকৃতির মধ্যেই এমন কিছু উপাদান ছিল যা রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতার সমীপবর্তী। লোর্কার সুসি্নগ্ধ গীতিকবিতা বা ব্যালাডগুলো স্মরণ করলে এই সম্ভাবনা দূরান্বয়ী বলে মনে হয় না। এর বহু পরে আরেক নোবেল জয়ী কবি মেক্সিকোব অক্টাভিও পাজ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ১৯৬৭ সালে লিখলেন, এখানে মেক্সিকোয় ‘তরুণরা তেমনই আগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পড়ে, যেভাবে তাদের দাদামশায়রা একশো বছর আগে রোমান্টিক কবিদের রচনা পড়তেন’। পাজ নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে।

লাতিন মহাদেশের আরেক নোবেল জয়ী কবি চিলির গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। গীতাঞ্জলির কিছু কবিতা তিনি অনুবাদ করেন এবং কবির একটি নির্বাচিত কবিতার সংকলনও প্রকাশ করেন। সত্য, মুত্যু, সুন্দর, পার্থিব এসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গদ্যে-পদ্যে যা লিখে গেছেন তা নিয়ে প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন মিস্ত্রাল। মিস্ত্রালের ‘নির্বাচিত গদ্য ও গদ্য-কবিতা’য় একটি অংশ রয়েছে, যার নাম ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য’। রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে তাঁর মনে তাৎক্ষণিক যেসব প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা গদ্য-কবিতার আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন মিস্ত্রাল। আখেরে সেটি নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। মিস্ত্রাল রবীন্দ্রনাথের মতোই ভাববাদী দার্শনিক ছিলেন একথা মনে রাখলে দুই প্রাচ্যের মধ্যকার যোগসূত্র বুঝতে কষ্ট হয় না। মিস্ত্রালের রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত মন্তব্যটির অংশবিশেষ এ রকম ‘গীতাঞ্জলি’র ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে বলছেন :’না, আমার বিশ্বাস হয় না যে আমি হারিয়ে যাব মৃত্যুর পরে। হারাবার হলে তুমি আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলে কেন, যদি নিঃশেষিত আখের ক্ষেতের মত আমাকে এক সময় পরিত্যক্ত ও শূন্য হয়েই পড়ে থাকতে হবে? প্রতিদিন সকালে আমার হৃদয়ে আর কপালে এমন আলো তুমি কেন ছড়াবে, যদি আমাকে আলগোছে বেছে না নেবে, যেমনটা বেছে নেয় শরতের রোদে ভিজে ওঠা আঙুর ক্ষেত থেকে সবচেয়ে পরিপকস্ফ আঙুরটিকে? না, মৃত্যুকে বরফহিম বা মমতাশূন্য বলে মনে হয় না আবার, যেমনটা অন্যদের কাছে ঠেকে। বরং মৃত্যু যেন অনর্গল তেজের বিকীরণ এক, শরীরকে ছাই করে দেয় কেবল আত্মাকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্যে। মৃত্যুর স্পর্শ কঠিন, তিক্ত এবং তীব্র, যেরকম তোমাকে ভালবাসা, তোমার বিস্ময়-জাগানিয়া ভালবাসা!’ মিস্ত্রাল স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু বিষয়ক নশ্বর-অবিনশ্বর সংক্রান্ত ভাবনাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলিতে বলছেন, ‘ওই-যে, চাকা ঘুরছে ঝনঝনি/বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি?’ সে ধ্বনি মিস্ত্রালকেও স্পর্শ করেছে। এখানে বলা দরকার যে, ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির পর মিস্ত্রালই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি ১৯৪৫ সালে নোবেল পেয়েছিলেন তৃতীয় বিশ্ব থেকে। সাহিত্যে প্রাচ্যের তৃতীয় নোবেলপ্রাপ্তি আরও অনেক পরে জাপানে কাওয়াবাতা পান ১৯৬৮ সালে। রবীন্দ্রনাথের মতোই মিস্ত্রাল সক্রিয় ছিলেন নানা ক্ষেত্রে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন গোটা লাতিন মহাদেশে। এ নিয়ে ওকাম্পোর সাথে দীর্ঘদিন ধরে চিঠি বিনিময় হয়েছিল তার। আজ পর্যন্ত ‘ওকাম্পোর সাথে মিস্ত্রালের পত্রালাপ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে রয়েছে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য শিল্প আন্দোলন অনুধাবনের জন্যে। এ দুই বিদুষী সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের সাথেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। উল্লেখ্য, কবির লেখার প্রতি চিলির তরুণ কবি পাবলো নেরুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মিস্ত্রালই প্রথম। ষাটের দশকে ওক্টাভিও পাজও যখন মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত ছিলেন ভারতে, তখন দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক স্মারক বক্তৃতায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ও লাতিন আমেরিকা সংক্রান্ত ‘সভ্যতার আলাপ’ নিয়ে বলতে গিয়ে ওকাম্পো ও মিস্ত্রাল এ দুই অমোচনীয় বন্ধ যোগাযোগের কথা, ও সেই সুবাদে তরুণতর প্রজন্মের ওপরে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা বিশেষ গুরুত্বের সাথে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

তবে রবীন্দ্রনাথ-লাতিন মহাদেশের মধ্যকার উষ্ণ যোগাযোগের ইতিহাসে ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। তিনি বরাবরই ব্যতিক্রমী লেখার ধরনে, চিন্তার ধরনে। শুধু ধরনে নয়; ধারণাতেও। নোবেল পাননি বটে, কিন্তু অনেক বারই তার নাম এসেছিল। বিখ্যাত না পাওয়াদের দলে বোর্হেসের নাম সামনের কাতারে। ‘স্বর্গ হবে এক বিশাল লাইব্রেরির মত’ এ কথাটি যিনি বলেছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের বই পড়েননি, তা তো হওয়ার নয়। শুধু পড়েই ক্ষান্ত হননি, ১৯৩৭ সালে বেরুনো রবীন্দ্রনাথের সিলেক্টেড ওয়ার্কস-এর ম্যাকমিলান এডিশন হাতে পেয়ে দ্রুত এর একটি সমালোচনাও লিখে ফেলেন বোর্হেস। সমালোচনাটি মধুর ছিল না ‘তার সব লেখাই ঘুরেফিরে চন্দ্র আর সূর্যকে নিয়ে।’ বোর্হেস এ রকম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। মহারথীদের মধ্যকার প্রথম সন্দর্শন সব সময় ভালো যায় না। যেমন, রবীন্দ্রনাথ একবার বোদলেয়ারের কবিতা শুনে ‘ফার্নিচার পোয়েট’ বলে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিলেন। বোর্হেসের কাছেও রবীন্দ্রনাথকে একঘেয়ে পুনরুক্তিপ্রবণ বলে মনে হয়ে থাকবে। বোদলেয়ার সম্পর্কে কটূক্তি বোর্হেস ভোলেননি। ১৯২৪ সালের স্মৃতিচারণ করে তিনি যা লিখছেন তা মোটামুটি এই দাঁড়ায় :”তেরো বছর আগে নমস্য ও সুকণ্ঠের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কথা বলার কিছুটা ভীতিকর সুযোগ হয়েছিল আমার। আমরা তখন বোদলেয়ার নিয়ে কথা বলছিলাম। কেউ একজন পাঠ করছিল বোদলেয়ারের ‘ডেথ অব লাভার্স’, যেখানে বিছানা, ডিভান, ফুল, চিমনী, ফায়ারপ্লেসের তাক, আয়না এবং দেবদূতের উল্লেখ ছিল। কবি মন দিয়ে শুনছিলেন কবিতাটি। পড়া শেষ হলে মন্তব্য করলেন, ‘আমি তোমাদের ফার্নিচার পোয়েটকে পছন্দ করি না।’ সে মন্তব্যে আমি মন থেকে সায় দিয়েছিলাম। আজ কবির নিজের লেখাগুলো আবারও পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে রোমান্টিক কাব্যের প্রায় তাৎপর্যহীন অলংকারের সমারোহ তাকে ততটা বিচলিত করেনি, যতটা তাকে টেনেছিল অস্পষ্টতার প্রতি অপ্রতিরোধ্য মোহ। রবীন্দ্রনাথ অসংশোধনীয়ভাবে অস্পষ্ট উচ্চারণ করে থাকেন। তার এক হাজার একটা লাইনের মধ্যে কোথাও কোনো লিরিক্যাল টেনশন নেই, একতিলও বাক পরিমিতি নেই। নির্বাচিত সংগ্রহের ভূমিকায় কবি লিখেছেন, ‘ফর্মের সমুদ্রে ডুবে যেতে হবে এর স্বাদ পাওয়ার জন্য।’ এ ধরনের চিত্রকল্প রবীন্দ্রনাথের সহজেই আসে একাধারে তা অবয়বহীন এবং সহজে যাকে শনাক্ত করা যায় না। অর্থাৎ অস্পষ্টতা, অচিহ্নিত আবেগ, এবং নির্মাণে শৈথিল্য।” এই হচ্ছেন বোর্হেসের রবীন্দ্রনাথ। বোর্হেস যে অনুষ্ঠানের কথা বলছেন তার কিছুদিন বাদেই কবি চলে আসেন আর্জেন্টিনা থেকে। ফিরতি পথে জাহাজ থেকে রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাতে মনে হয়, বোদলেয়ার সম্পর্কে কবির কিছুটা হলেও মত পরিবর্তন হয়েছিল। ওকাম্পোর বাসায় বোদেলেয়ার চর্চা হচ্ছিল মূল ফরাসি ভাষাতে; সেটা বোদলেয়ার-ভক্ত ওকাম্পোর আগ্রহেই। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে লিখেছিলেন, ‘বিজয়া, বোদলেয়ারের সেই যে কবিতাটি তোমার সাথে পড়েছিলাম, তার লিরিক্যাল অর্থটি এতদিন পরে আমার কাছে ধরা দিচ্ছে।’ ত্রিশের দশকে তরুণতর কবিকুলের সাথে বিশেষত বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ ও অমিয় চক্রবর্তীর কথা এখানে বলতে হয় আধুনিক কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তর্কে-বিতর্কে বোদলেয়ার আরও আগ্রহের সাথে পর্যালোচিত হবে। সে রকম কোনো পুনর্চিন্তা বোর্হেসের মনে পরে জেগেছিল কিনা তা এখনও সহজে জানার উপায় নেই। বোর্হেস রবীন্দ্রনাথকে জেনেছিলেন ইংরেজি অনুবাদের সূত্রেই। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধাবলি পড়ার সুযোগ হয়নি। তার শেষ এক দশকের কবিতা তার সহজে জানার উপায় ছিল না অনুবাদের অভাবে। হতে পারে যে ন্যাশনালিজমের সমালোচনা রাশিয়া, সমাজতন্ত্র, সভ্যতার সংকট, সাম্রাজ্যবাদ এসব বিষয়ে বোর্হেসের তুলনামূলক আগ্রহ ছিল কম। ফলে এসব বিষয়ে তিনি ইপি থম্পসন, ইসাহ বার্লিন বা ব্রেখটের মতো উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আমরা যারা নানা দিক থেকে কবিকে দেখার প্রচেষ্টা করেছি, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও পিচ্ছিলতার বোর্হেসীয় অভিযোগ (‘ইমপ্রেসাইজ অ্যান্ড ফ্লুইড’) কিছুটা কষ্টকল্পিত মনে হয় বৈকি। এটা হয়তো কবির কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খাটে; সমগ্র রচনাবলির প্রেক্ষিতে নয়। বরং অত্যন্ত নির্দয় অভিধা বলেই ঠেকবে।

তিমিরবিনাশী সমাজের দিকে? (Towards an Enlightened Society?)

বিনায়ক সেন

১. প্রথাগত মতাদর্শের বিপর্যয়
আমরা অর্থনীতিবিদ্যার একটি সংকটের মধ্যে আছি। কোনো আপ্তবাক্যেই আমরা আর আস্থাবান থাকতে পারছি না। একসময়ের বহুশ্রুত ‘মিশ্র-অর্থনীতি’ এখন আর প্রায় ব্যবহারই হয় না বলতে গেলে। আমাদের যৌবনে মিশ্র-অর্থনীতিই ছিল সব তত্ত্বের সারাৎসার। ব্যক্তি খাত থাকবে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ছাড়া অর্থনীতির চাকা দ্রুত এগোবে না_ এ রকম একটি স্লোগান আমাদের খুবই প্রভাবিত করেছিল। কেইনসীয় অর্থনীতির উত্থান, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর ধারণা, উপনিবেশ থেকে সবে বেরোনো দেশগুলোর রাষ্ট্রের উপায়ান্তরহীন ভূমিকা এর পেছনে কাজ করে থাকবে। এরই ভাবাদর্শগত ছায়ায় কেটেছে বাংলাদেশের সত্তরের দশক।

আশির দশকের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় তেল-সংকটের পর থেকে শুরু করে প্রায় দুই দশক একচ্ছত্র রাজত্ব করেছে অন্য একটি ধারণা। অবাধ বাজার অর্থনীতির তত্ত্ব অর্থনীতির যুক্তি-তর্কে যতটা তারও বেশি সহায়-সমর্থন পেয়েছিল রেগান-থ্যাচারের রাজনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়ে। তেল-সংকটের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লাতিন আমেরিকায় দেখা দেয় ঋণ পরিশোধের সংকট। এখানেই প্রথম শুরু হয় ‘কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি’_ আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের তখন মন্ত্র ছিল ‘স্টেবিলাইজেশন, লিবারেলাইজেশন এবং গ্রোথ’। অবাধ বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করলে শুধু সংকটের অবসান ঘটবে তা-ই নয়, অর্থনীতির প্রধান প্রধান সমস্যারও অবসান ঘটবে। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় প্রথাগত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে গেছে। মিশ্র-অর্থনীতি ও পরিকল্পনাময় অর্থনীতির বিপরীতে বাজার অর্থনীতির মতাদর্শকে সেদিন মনে হচ্ছিল অপ্রতিরোধ্য ও সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত আদর্শ বলে। দার্শনিক কান্ট_ হেগেলের ছাত্র ফুকোয়ামা যখন লিখলেন, বার্লিন দেয়ালের পতনের মধ্য দিয়ে শ্রেণী-যুদ্ধের তথা ইতিহাসের অবসান ঘটেছে তখন তা সময়ের স্বাভাবিক দাবি হিসেবেই অনেকে গ্রহণ করেছেন।

বার্লিনের দেয়াল ভাঙার পর আরও প্রায় ২৫ বছর কেটে গেছে। এ সময়ের অভিজ্ঞতা অবাধ বাজার অর্থনীতির ও তার আদর্শের সমাজ-রাষ্ট্রের পক্ষে যায়নি। প্রথমত, অর্থনীতিবিদ পিকেটি দেখিয়েছেন যে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ধারণা পরিত্যাগ করার ফলে উন্নত বিশ্বের সমাজ হয়েছে আরও বেশি বৈষম্যমূলক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের তিন দশকে (গোল্ডেন এইজ অব ক্যাপিটালিজম) জাতীয় আয়ে পুঁজির তুলনায় শ্রমের অনুপাত যা-ওবা বাড়ছিল, সে ধারা কমতে থাকে সত্তরের দশকের শেষদিকে এবং পরবর্তী দু’দশকে তা একেবারেই শুকিয়ে আসে। ফলে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই বেড়েছে সম্পদ, আয় ও ক্ষমতার বৈষম্য। অবাধ বাজার অর্থনীতি শ্রীবৃদ্ধি এনেছে বটে; কিন্তু তার সুফল পেয়েছে মূলত একটা শ্রেণী : বড় কারবারের মালিক, সিইও, ব্যাংকার, শিল্পপতি, পুঁজিবাজারের ফটকাবাজ, রাজনৈতিক প্রকল্পের সুবিধাভোগী লবিস্ট বা দালালগোষ্ঠী। এরা সমাজের ১ শতাংশ অথচ এদের কাছে এসব দেশের ৬০ শতাংশ সম্পদ চলে গেছে। গত ২৫ বছরের অবাধ বাজার অর্থনীতির ফলে জন্ম নিয়েছে ‘সুপার-রিচ’ নামক একটি শ্রেণীর। এদেরই ওপর প্রগ্রেসিভ হারে কর বসানোর প্রস্তাব করেছেন তিনি; আয়ের ওপরে কর তো বটেই, সম্পদের ওপরও দৃষ্টি তার। পিকেটির মতই যে শিরোধার্য তা নয়, তবে তার বইটির প্রশংসা করে সমালোচনা লিখেছেন তিনজন নোবেলজয়ী, এটাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো তথ্য নয় (এর মধ্যে আছেন_ রবার্ট সলো, পল ত্রুক্রগম্যান ও জোসেফ স্টিগলিৎস)। অবাধ বাজার অর্থনীতি যে আপনাআপনি বণ্টনের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না সেটা পিকেটি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বড় আকারে প্রমাণ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে না আনা গেলে সামাজিক দুর্বিপাক বাড়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় নতুন করে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলো দেখা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে_ ফার্গুসনসহ বিভিন্ন শহরে বর্ণ-বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভের একটি উদাহরণ_ এদের পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কার্যকারণ। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, আয়-বৈষম্য, ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকট ও চলমান মন্দা, সামাজিক খাত বিশেষত স্বাস্থ্য খাতের অচলাবস্থা নির্ধন ও স্বল্পবিত্ত মানুষের মন থেকে ‘একটি বাড়ি, অনেক সুযোগ’-এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া আমেরিকান ড্রিম ভেঙে দিয়েছে। এখন ভরসা তৃতীয় বিশ্বের অভিবাসী সস্তা শ্রম ও মেধার জোগানের ওপর। কিন্তু মন্দা পরিস্থিতিতে এ নিয়েও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে অভিবাসী ও স্থানীয় শ্রমের ভেতরই।

তৃতীয়ত, অবাধ বাজার অর্থনীতির তত্ত্ব রাজত্ব করেছে শুধু অর্থনৈতিক যুক্তি-তর্কের ওপর নির্ভর করে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। অবাধ বাজার অর্থনীতি বা নিও-লিবারেলিজম হচ্ছে ‘একটা প্যাকেজ’। সেখানে একটা নিলে আরও কিছু উপাদান ফাও হিসেবে গছিয়ে দেওয়া হয়। এ রকমই একটি ‘ফাও’ হচ্ছে নিউ কনজারভেটিজম, মূলত খ্রিস্টীয় ধর্মাদর্শের ওপরে এর ভিত্তি দাঁড় করানো হয়েছে, যার ব্যাখ্যাও অতি-সংকীর্ণ ধর্মবোধের দ্বারা নির্মিত। লিও স্ট্রাউসের মতবাদকে নিউ কনজারভেটিজমের অনুপ্রেরণা বলে ধরা হলেও এর অনুসারীরা গুরুমারা শিষ্যে পরিণত হয়েছেন। সামাজিক নীতিতে শিষ্যরা ‘ফ্যামিলি ভ্যালুস’-এর গুণকীর্তন করেন, ধর্মীয় নীতিতে তারা ‘ইসলামিস্ট’ শক্তিকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন এবং রাজনীতিতে তারা শুধু সেসব সরকারকেই মানতে প্রস্তুত যারা হবেন তাদের একনিষ্ঠ স্বার্থবাহী। সাদ্দামকে সরানোর জন্য ইরাক যুদ্ধ শুরু করার কিছুদিন পরই লিও স্ট্রাউসের কন্যা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ খোলা কলম লিখে প্রতিবাদ করলেন। তার বক্তব্য_ পল উলফোভিচ, রিচার্ড পারলে, কন্ডোলিজা রাইস এসব ‘নিউ-কন’ তাত্তি্বকরা যা বলছেন তার সঙ্গে লিও স্ট্রাউসের দর্শনের কোনো মিল নেই। বুশের ইরাক আক্রমণের তীব্র সমালোচকে পরিণত হন তিনি (যেমন_ মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মওদুদীর ছেলে এ দেশে এসে)।

চতুর্থত, অবাধ বাজার অর্থনীতির মতাদর্শ সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সে সূত্রে কান্টের ‘চিরস্থায়ী শান্তির’ মতো নিখিল প্রশান্তি বিশ্বে নেমে আসবে, যুদ্ধ বিগ্রহহীন বিশ্বের তত্ত্বও প্রচার করেছিল। দেখা গেল যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ হয়নি, বরং তা ক্রমাগত নতুন নতুন মাত্রা পেয়ে চলেছে স্থানীয় ও আঞ্চলিক নানা পর্যায়ে। সোভিয়েতের অবসান হলেও যুদ্ধের অবসান হয়নি, সমরবাদ আজও বাড়-বাড়ন্ত। ২০১৪ সালে নিঃশব্দে পালিত হলো ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরুর শতবার্ষিকী। ১০০ বছর আগে লেনিন লিখেছিলেন_ ‘যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্য চলতে পারে না।’ ওবামার যুগে এসেও দেখতে পাচ্ছি এ কথা খাটছে। লেনিনের অনেক কথা হয়তো মিলেছে অথবা মেলেনি; কিন্তু অন্তত এ পর্যবেক্ষণটি আজও এতসব এক বিশ্ব তত্ত্ব, পোস্ট মডার্নিজম, পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিজমের পরও সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে।

আর ‘গণতন্ত্র’? অবাধ বাজার অর্থনীতির সঙ্গে বলা হয়েছিল গণতন্ত্র সর্বত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। আমি সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কে যাচ্ছি না। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা থাকবেন বা না থাকবেন এটি ঠিক করা গণতন্ত্রের একটি আবশ্যকীয় দিক। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক সংজ্ঞার বাইরে যাওয়ারও দরকার আছে। অমর্ত্য সেন এক বক্তৃতায় বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসনকার্য চালানো’ (গভর্নিং বাই ডিসকাশন)। এটিও গণতন্ত্রের একটি মর্মগত উপলব্ধি। অন্যদিকে সমাজের ‘সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়নের’ কথাও আমরা শুনেছি_ এটি বোধকরি ম্যাক্সিম্যালিস্ট অভিধা। এই ৩টি সংজ্ঞার যেটিকেই আশ্রয় করা হোক না কেন, বার্লিন দেয়াল পতনের পরের ২৫ বছরে গণতন্ত্রের অবস্থা বিশ্বজুড়েই ভালো নয়। অনেক দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে আবার পিছু হটতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও দেখা দিচ্ছে মিশ্র বা ‘সংকর গণতন্ত্রের’ নানা অসম্পূর্ণ রূপ। ২০০০-এর দশক থেকে অনেকটা ইরাক যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত এসবের সমান্তরালে_ গণতন্ত্রের প্রবণতায় অসুস্থতা বা পিছু হটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। লিটারেচারে একে বলা হচ্ছে, পশ্চাৎপসরণ বা ডেমোক্রেটিক ব্যাকট্রেকিং। শুধু তাই নয়, পার্থ চ্যাটার্জি লিখেছেন, পুঁজিবাদ নিজেই হয়ে পড়েছে তার বিঘোষিত গণতন্ত্রের বিরোধী সত্তা। ক্যাপিটালিজম এগেইনস্ট ডেমোক্রেসি।

নিরঙ্কুশ পরিকল্পনার অর্থনীতি নিয়ে মোহভঙ্গের যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত কারণ রয়েছে। মিশ্র অর্থনীতির প্রতিও আস্থা নেই। বাকি ছিল_ অবাধ বাজার অর্থনীতি। ২৫ বছর আগে তার যে অপ্রতিরোধ্য ভাবমূর্তি ছিল সেটি এখন অনেকটাই ঝাঁপসা হয়ে এসেছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি সমালোচনার মুখে পড়ছে ওপরে বর্ণিত ৫টি কারণে। সাধারণভাবে এখন আর বলা যাবে না যে, একটি আদর্শ অর্থনীতির মডেল আমাদের চোখের সামনে রয়েছে_ আমাদের কাজ হচ্ছে তাকে কেবল যথাসাধ্য অনুসরণ করা। আমাদের ঝুঁলিতে নিরঙ্কুশ পরিকল্পনার অর্থনীতি, মিশ্র অর্থনীতি ও অবাধ বাজার অর্থনীতির বিশ্ব-অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সেসব খণ্ডচিত্র মাত্র। এই অর্থে আমি বলেছি শুরুতে, আমরা অর্থনীতিবিদ্যার একটি সংকটের মধ্যে আছি। জীবনানন্দ ‘তিমিরবিনাশী’ সমাজের প্রতীক্ষায় ছিলেন। আমাদের সে লক্ষ্যে তত্ত্বগত চর্চাকে নিরুৎসাহ করা নয়, বরং আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সে চর্চাকে আরও বেশি মেধা, মনন ও নিষ্ঠায় ধারালো করে তুলতে হবে।

২. ব্যাস্টিক ও সমষ্টির মেলবন্ধন
চোখের সামনে কোনো আরাধ্য অর্থনৈতিক মতাদর্শ আর নেই, এক অর্থে এটা ভালোই। রাস্তাটা এখন ডেড-এন্ডে পেঁৗছেছে অভিযানের সমাপ্তি, এখনই প্রকৃত যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হতে পারে। কোনোটা জাতীয়তাবাদসম্মত, কোনোটা পুঁজিবাদী ধারার, কোনোটা সমাজতন্ত্রের পক্ষে_ এসব বিবেচনা আর বড় নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বিশ্বজোড়া গরিবরা ওপরে উঠছে, মধ্যবিত্তের আকার বড় হচ্ছে, নারীদের কণ্ঠস্বর ও অবস্থান জোরালো হচ্ছে, অভিবাসীরা মেধা ও প্রবৃদ্ধির জোগান দিচ্ছেন। আর রয়েছে সারাবিশ্বেরই এক-তৃতীয়াংশের বেশি তরুণ-যুবাগোষ্ঠী_ এরা সবকিছুই গ্রহণ করতে প্রস্তুত; কিন্তু কোনো কিছুকে পরীক্ষা না করে যাচাই-বাছাই না করে নির্বিচারে মেনে নেওয়ার পাত্র নয়। গর্বাচেভ সমাজতন্ত্রকে নবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সে কথা রাখেননি, বরং গোটা ব্যবস্থাকেই অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। ওবামা পুঁজিবাদকে সহনীয় ও মানবিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সে কথা রাখতে পারেননি, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আমলেই জড়িয়ে পড়েছে নতুন নতুন ড্রোন যুদ্ধ, আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং নতুন স্নায়ুযুদ্ধে। এরা নিজেদের দেশে প্রথম দিকে ‘চেইঞ্জ-এজেন্ট’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সাধারণ মানুষ তাতে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু শেষাবধি তারা হতাশই হয়েছে। আমি ক্লিনটন-ডেমোক্র্যাট আর বেল্গয়ারের নিউ লেবারের কথা না-ই তুললাম এখানে। সামগ্রিকভাবে একটি উদার-সহনশীল জনকল্যাণমুখী সুষম বণ্টনের সমাজ দিতে পারেনি এদের শাসনাধীন সরকারগুলো।

কিন্তু তাতে জনসমস্যার সমাধান খোঁজার তাগিদ তো কমে যায়নি। তবে প্রশ্নটাকে এখন নতুন করে পেশ করতে হবে। অন্ধ মতাদর্শ নয়, বরং বাস্তব অনুশীলনে ও ক্রমাগত তত্ত্বচর্চার পরিশীলনে যা নিজ দেশের মানুষের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ’ বলে মনে হবে তার একাধিক বিকল্প মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। একেক দেশের পরিস্থিতিতে তা হবে হয়তো একেক রকম, যদিও এ নবভাবনার কিছু প্রাথমিক সূত্রের তত্ত্ব-তালাশ করা সম্ভব। এই তত্ত্ব-তালাশের উৎস হতে হবে নানা স্থানিক সূত্রে গাঁথা। এতে সাহিত্য থাকবে, বিজ্ঞান থাকবে, সংস্কৃতি থাকবে, প্রশাসন থাকবে_ এর চিন্তার উৎস হবে বিভিন্ন, স্বেচ্ছাকৃতভাবে ‘একলেকটিক’। একলেকটিক হওয়া মানে_ বহু উৎসের প্রতি হাত বাড়ানো; নির্বিচারে অগ্রসর হওয়া নয়। এখানে রবীন্দ্রনাথ, মার্কস উভয়ই থাকবেন, মিল ও গ্রামসি এরাও থাকবেন, যেমন থাকবেন লালন ও রামমোহন রায়, রোকেয়া ও গান্ধী, চার্বাক, সন্ত কবীর ও ইবনে আরাবি। হারিয়ে যাওয়া ইসলামী সভ্যতা ও লোকজ দর্শন-সংস্কৃতি, আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন জাদুঘর ও উপনিষদের দুর্লভ গ্রন্থরাজি, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য, সব মানবিক জ্ঞানের আধার হবে এই নতুন মননশীলতা। বাংলাদেশে নতুন সভ্যতার নির্মাণ করতে চাইলে এই বহুমুখী সংগ্রহশীলতার প্রয়োজন। তিনটি উদাহরণ টানছি।

বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ রচনাটির কথা অনেকেরই মনে আছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান চালচিত্রের এক জায়গায় মিল খুঁজে পাই। প্রবৃদ্ধি নাকি সমতামুখী প্রবৃদ্ধি, এই বিতর্ক বোঝার জন্য রচনাটি জরুরি পাঠ্য বলে মনে হতে পারে, অন্তত পরিকল্পনাবিদ ও অর্থনীতিবিদদের জন্য। সেখানে বঙ্কিম শুরু করেছেন এই বলে_ ‘আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, আমাদের দেশে বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বটে; কিন্তু তাতে করে কি জনকল্যাণ বাড়ছে, বণ্টন আরও সুষম হচ্ছে? এ প্রশ্ন বঙ্কিম তুললেন সেখানে। অবকাঠামো নির্মাণ মানেই ‘দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে’ এ ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন_

‘কি মঙ্গল, দেখিতে পাইতেছ না? ঐ দেখ, ভাগীরথীর যে উত্তাল তরঙ্গমালায় দিগ্গঞ্জ ভাসিয়া গিয়াছিল, অগি্নময়ী তরণি ক্রীড়াশীল হংসের ন্যায় তাহাকে বিদীর্ণ করিয়া বাণিজ্য দ্রব্য বহিয়া ছুটিতেছে। ঐ যে দেখিতেছ, রাজপথ, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ঐ স্থানে সন্ধ্যার পর, হয় কাদায় পিছলে পা ভাঙিয়া পড়িয়া থাকিতে, না হয় দস্যু হস্তে প্রাণত্যাগ করিতে; এখন সেখানে গ্যাসের প্রভাবে কোটি চন্দ্র জ্বলিতেছে_ এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে, কাহার এত মঙ্গল? ঐ যে হাসিম শেখ, আর রামা কৈর্বত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাতায়, খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্তিচর্মাবশিষ্ট বলদে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চসিতেছে, উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?_ বল দেখি চষ্মা নাকে বাবু! ইহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে? তুমি লেখাপড়া শিখিয়া ইহাদিগের কি মঙ্গল সাধিয়াছ?’

বঙ্কিমচন্দ্রের অবস্থান স্পষ্ট : শুধু অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটালেই বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলেই দেশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। ‘দেশের মঙ্গল? দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন?_ হিসাব করিলে তাহারাই দেশ_ দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী; যেখানে তাহাদের মঙ্গল নাই, সেখানে দেশের মঙ্গল নাই।’ অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি যদি সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে না পারে সে প্রবৃদ্ধিতে কীসের মঙ্গল, কীসের জনকল্যাণ?

বঙ্কিমচন্দ্র কোনো বামপন্থি ছিলেন না। না হয়েও, তিনি আজকের দিনের পরিভাষায় যাকে বলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বা সমতামুখী প্রবৃদ্ধি কিসে এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। জন স্টুয়ার্ট মিলের ছাত্র (যদিও ‘একলব্য ছাত্র’_ কেননা মিলের সাথে তার কখনও দেখা হয়নি) বিধায় বঙ্কিম ‘প্রিন্সিপালস অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ ভালো করে পড়েছিলেন। ‘বাণিজ্যের তুলনামূলক সুবিধা-তত্ত্বে’ তার আস্থা ছিল। ওই লেখাতেই তিনি বলেছেন, ‘বিদেশীয় বাণিজ্য কারণ আমাদিগের দেশের ধনবৃদ্ধি হইতেছে।’ কিন্তু সেটা স্বীকার করার অর্থ এই নয় যে, দেশের ভেতরে অন্যায় সম্পদ যারা কেন্দ্রীভূত করছেন বৈধ ও অবৈধ উপায়ে তাদের ছাড় দিতে হবে। যেমন_ জমিদার শ্রেণীভিত্তিক যে ভূমি ব্যবস্থা তাকে তিনি সর্বাংশে নিন্দা করেছেন : ‘জীবের শত্রু জীব; মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য; বাঙালি কৃষকের শত্রু বাঙালি ভূস্বামী। ব্যাঘ্রাদি বৃহজ্জন্তু, ছাগাদি ক্ষুদ্র জন্তুগণকে ভক্ষণ করে; জমিদার নামক, বড় মানুষ, কৃষক নামক ছোট মানুষকে ভক্ষণ করে।’ সমস্ত তথ্য-উপাত্ত বিচার করে বঙ্কিম এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, জমিদারি ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়াই ভালো, এর পরিবর্তে বাংলায় চালু হওয়া উচিত রায়তওয়ারি বা প্রজাওয়ারি মালিকানায় জমি বন্দোবস্ত। এ রকম র‌্যাডিকেল প্রস্তাব যার, তিনি বাস্তবে কোনো সোশ্যালিস্ট বা সিন্ডিক্যালিস্ট ছিলেন না। অর্থনীতির নির্মোহ বিশ্লেষণই তাকে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের (আজকের পরিভাষায়, রফতানিমুখী উন্নয়নের) পাশাপাশি কৃষক ও গ্রামমুখিন উন্নয়ন চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রশ্নে অবিচল রেখেছিল। ১৮৭২ সালে লেখা প্রবন্ধটি হান্টারের ‘এনালস্ অব রুরাল বেঙ্গল’ গবেষণার পূর্বসূরি। রচনাটির যুক্তিগুলো বাংলার প্রথম আদমশুমারির আগেই পরিকল্পিত হয়েছিল।

‘দেশের শ্রীবৃদ্ধি’ ও ‘কৃষকের কল্যাণ’_ যথাক্রমে সামষ্টিক ও ব্যাস্টিক এ দুই অর্থনৈতিক দিককে বঙ্কিম তার লেখায় মেলাতে চেয়েছেন। সে চিন্তায় সুশাসনেরও স্থান রয়েছে। সেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা রয়েছে, রয়েছে ‘আদিম ধনসঞ্চয়’-এর কথাও। ‘রুল অব ল’-এর জাঁতাকলে পড়ে কত কৃষক আইন-আদালত করে কবে সর্বস্ব হারাল তার মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে এতে। বস্তুত, উন্নয়ন অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্রের এ লেখাটির তুল্য বিশ্লেষণাত্মক লেখা সর্বত্রই দুর্লভ। এটি উন্নয়ন অর্থনীতির পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পঠিত হতে পারবে।

দ্বিতীয় উদাহরণটি রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে নেওয়া। রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাতেও ব্যাস্টি ও সমষ্টির কল্যাণের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা বড় আকারে উত্থাপিত হয়েছে। রাশিয়ায় বলশেভিক মত চলছে; কিন্তু সে মত কালের বিচারে টিকবে কি-না এ নিয়ে তার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যকে আজকের দিনেও অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়। নতুন সোভিয়েত ব্যবস্থাকে নির্বিচারে গাল-মন্দও করেননি, আবার ভক্তি বিগলিত চোখেও দেখতে চাননি। তিনি লিখছেন, ‘সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে মার্কসীয় অর্থনৈতিক মতটা সম্পূর্ণ গ্রাহ্য কি-না সে কথা বলবার সময় আজও আসেনি; কেননা এ মত এতদিন প্রধানত পুঁথির মধ্যেই টলে টলে বেড়াচ্ছিল, এমন বৃহৎ ক্ষেত্রে এত বড় সাহসের সঙ্গে ছাড়া পায়নি। পরীক্ষার ভিতর দিয়ে পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এ মতের কতটুকু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আজ নিশ্চিত কেউ বলতে পারে না।’ স্বার্থপরতা একেবারে ছেড়ে দিলে আপদ বাড়তে পারে, মানব প্রকৃতির স্বভাবজ সম্পত্তি-পরায়ণতা একেবারে ছেঁটে ফেলতে চাইলে এ ‘সিস্টেম’ হয়তো টিকবে না। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি পরার্থপরতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য খুঁজেছেন। এই মেলানোর তত্ত্বে তার পক্ষপাতিত্ব অবশ্য সামষ্টিক জনকল্যাণের দিকে, বাজার অর্থনীতির স্বার্থবুদ্ধির প্রতি নয়। এ ক্ষেত্রে নিখুঁত সমাধান তার জানা নেই : “ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যখন উৎকট স্বার্থপরতায় পেঁৗছিয়ে সমাজে নানা প্রকার উৎপাত মথিত করে তখন উপদেষ্টা বলেন, ‘স্বার্থ থেকে স্ব-টাকে এক কোপে দাও উড়িয়ে। তাহলেই সমস্ত ঠিক চলবে।’ তাতে হয়তো উৎপাত কমতে পারে। কিন্তু চলার পথ বন্ধ হওয়া অসম্ভব নয়।” ব্যক্তির জন্য ইনসেনটিভ ও জনকল্যাণের ওয়েলফেয়ার ইকোনমিক্সের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে রবীন্দ্রনাথ এ প্রশ্নে পূর্বাপর সচেতন ছিলেন। ১৯২০-এর দশকে লেখা ‘সংহতি’ প্রবন্ধেও এর পূর্বলেখ পাই আমরা।

তৃতীয় উদাহরণটি নজরুলের ‘ছুৎমার্গ’ রচনা থেকে নেওয়া। শ্রেণীর নামে, জাতের নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে সামাজিক ছুৎমার্গকে প্রশ্রয় দিলে কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়নই সামাজিক উন্নতির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারে না। এডাম স্মিথের মতাদর্শ ছিল সামাজিক ছুৎমার্গহীন এক ‘অর্থনৈতিক মানব’-এর সমাজের। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ অবাধ বাজার অর্থনীতিকে শিরোধার্য করেছে, কিন্তু ‘অর্থনৈতিক মানব’ তত্ত্বকে যৌক্তিকভাবে স্বীকার করেনি। ফলে বেশকিছুটা প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন ঘটলেও সামাজিক জাত-পাত-ধর্ম-আচার প্রভৃতির ভেদবুদ্ধি থেকে আমাদের মতো দেশগুলোর মুক্তি মেলেনি। সামাজিকভাবে আমরা ‘ছাড়া-ছাড়া’ থাকব আর অর্থনৈতিকভাবে আমরা ‘একত্রিত’ হব_ বাজার অর্থনীতির এই সামাজিক মতাদর্শ অবাস্তব। আমেরিকা-ইউরোপের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, শত মাল্টিকালচারালিজম আওড়ানো সত্ত্বেও সেখানে ‘সামাজিক প্রভেদ’ ঘুচেনি বা ‘সামাজিক দেওয়া-নেওয়ার’ সম্পর্ক বিভিন্ন সামাজিক বর্গের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পায়নি। নজরুল লিখছেন, ‘আমাদের গভীর বিশ্বাস যে, হিন্দু মুসলমান মিলনের প্রধান অন্তরায় হইতেছে এই ছোঁয়াছুঁয়ির জঘন্য ব্যাপারটাই। … বিবেকানন্দ বলিয়াছেন যে, ভারতে যেদিন হইতে এই ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটার উৎপত্তি সেদিন হইতেই ভারতের পতন, মুসলমান আগমনে নয়। … মানুষ হইয়া মানুষকে কুকুর-বিড়ালের মতো এত ঘৃণা করা মনুষ্যত্বের ও আত্মার অবমাননা করা নয় কি? … হিংসা, দ্বেষ জাতিগত রেষারেষির কি সাংঘাতিক বীজ রোপণ করিতেছ তোমরা! অথচ মঞ্চে দাঁড়াইয়া বলিতেছ, ‘ভাই মুসলমান এস, ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই!’ ‘কী ভীষণ প্রতারণা! মিথ্যার কি বিশ্রী মোহজাল! এই দিয়া তুমি একটা অখণ্ড জাতি গড়িয়া তুলিবে?’ নরেন্দ্র মোদির আধুনিক ভারত-তত্ত্ব বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলে যাওয়ার কংগ্রেসি তত্ত্ব এ প্রেক্ষিতেই আমাদের দেখতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক উদারীকরণ করে ভারতীয় সমাজ আধুনিক হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে সামাজিক ‘ছুৎমার্গ’ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারছে। জাত-পাতের ব্যবধান ডিঙিয়ে পরস্পরকে আপনার, ‘সমকক্ষ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ‘কাছের করে’ জানতে হবে। নইলে কাঙ্ক্ষিত সমাজের সূত্রপাত ঘটবে না।

ইচ্ছা করেই অন্যান্য বাঙালি তাত্তি্বক, চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকদের কথা এ প্রসঙ্গে বাদ রাখলাম। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমার বলার কথা ছিল যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন চিন্তা বড় বেশি পরনির্ভরশীল তত্ত্বের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্থানীয় চিন্তার সূত্রে অর্থনৈতিক তত্ত্বকে আমরা সেভাবে দাঁড় করাতে পারিনি। অথচ সে সম্ভাবনা বিশদভাবে রয়ে গেছে পূর্বসূরিদের চিন্তা-ভাবনায়। প্রবৃদ্ধি হলেই আমরা ধরে নিচ্ছি তা অবধারিতভাবে জনকল্যাণমুখী এবং সে কারণেই ফি-বছর প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিতর্ক একটি প্রথাগত সংলাপে পরিণত হচ্ছে। সমতামুখিন প্রবৃদ্ধি কিসে সাধিত হবে সে ধরনের প্রশ্নে আমরা প্রবেশ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছি। দারিদ্র্য কমছে বলে কিছুটা আত্মপ্রসাদ বোধ করছি, দারিদ্র্য কমার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাইছি না। তুলনামূলকভাবে অদক্ষ শ্রমের কল্যাণ হচ্ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তুলনামূলকভাবে অদক্ষ শ্রমজীবী মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানরা আগামীতে মধ্যবিত্তে পরিণত হবে কি-না এই মৌলিক সামাজিক সচলতার প্রশ্নটি অধরাই থেকে যাচ্ছে। তা ছাড়া, হাড় ভাঙা খাটুনির পর হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত্তের পুষ্টির সমস্যা এখনও চলে যায়নি। দেশের হয়তো শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, ‘মঙ্গলের ছড়াছড়ি হচ্ছে’; কিন্তু ‘চরম দরিদ্রে’ থাকা মানুষরা কিন্তু এখনও সংখ্যায় প্রায় ২ কোটির মতো। এরা এখনও ‘দীনের হতে দীন’। তিন বেলা হয়তো এরা খেতে পারছে; কিন্তু মৌলিক অনেক নাগরিক সুবিধা থেকে এরা এখনও বঞ্চিত। ক্ষমতার কাছে এরা এখনও অসহায়। মধ্য আয়ের দেশ হয়তো অচিরেই আমরা হতে পারব; কিন্তু চরম দরিদ্র মানুষের অবস্থার পরিবর্তন না হলে এই শ্রীবৃদ্ধিতে সান্ত্বনা নেই। আছে কি?

লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতি বিশ্লেষক

হিমুর শহর (Himu’s City)

Humayan Ahmed
১. হুতোম ও হিমু
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের কথা। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। শহরটা গড়ে উঠছে দ্রুত, গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে একশ্রেণীর মানুষের ধন-সম্পদ। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ধরন ‘স্ট্যাটাস-সিম্বল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাবুদের জীবনচর্চার খুঁটিনাটি নিয়ে লেখা হবে কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। উন্মেষ পর্বের আধুনিকতার নিপুণ চিত্র এটি। কিন্তু রুচি বিচারে বঙ্কিমচন্দ্র হুতোমের নিন্দাই করেছেন। তাঁর পক্ষে নিন্দা করাটাই ছিল স্বাভাবিক। নকশার যত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের উপজীব্য ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের শহর কলকাতার জীবনধারা। ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ভদ্রলোক বাবুরা সে চিত্র মনে রাখতে চাইবেন না, এটাই তো প্রত্যাশিত। তবে ভিন্নমতও ছিল সেকালে। অক্ষয়চন্দ্র সরকার লিখলেন : জীবদ্দশায় আর একখানি পুস্তক আমাকে আলোড়িত করিয়াছিল। আনন্দও পাইয়াছিলাম। সেখানি কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা। ‘আলালের ঘরের দুলালে’ও অনেক স্থানে নকশা বা ফটো তুলিবার চেষ্টা আছে বটে, কিন্তু তাহাতে পল্লী-সমাজের চিত্র যেমন পরিস্ফুট হইয়াছে। কলিকাতার অলিগলির নকশা তেমন ফুটন্ত হয় নাই। নকশা প্রকাশিত হয় ১৮৬২ সালে। পার্থ চ্যাটার্জি মন্তব্য করেছেন যে, ১৮৭০ দশকের পর থেকে শহর কলকাতা ক্রমশ বাংলা গল্প-উপন্যাস থেকে অদৃশ্য হতে থাকবে, এর অলিগলির নকশা আর সেভাবে রূপায়িত হবে না। এর জায়গা নেবে মধ্যবিত্ত পাত্র-পাত্রীরা, যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং যাদের মূল প্রেরণা হবে জাতীয়তাবাদ। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের আর্লি মডার্নিটির জায়গায় আসবে দ্বিতীয়ার্ধের ‘কলোনিয়াল মডার্নিটি’। নববাবু বিলাসের কেচ্ছা কাহিনী, নববাবুদের অবাধ ও অলজ্জিত জীবন চর্চার কাহিনী প্রকাশ করতে। সংকোচ বোধ করবে পরবর্তী সময়ের বাংলা গল্প-উপন্যাস। সেই সঙ্গে নিচুতলার মানুষের অকৃত্রিম চিত্রও হয়ে পড়বে ঝাপসা (মার্কসবাদী হাতেগোনা কিছু ‘সচেতন প্রয়াস’ ব্যতিরেকে)। হুতোমের প্রশংসা করা হবে বটে। কিন্তু তার পদ্ধতি প্রয়োগকে একালের রুচির জন্য অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হবে বঙ্কিমচন্দ্রের রুচি বিচারকে শিরোধার্য করেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘বাঙালা সাহিত্য’ প্রবন্ধে নকশা নিয়ে এরূপ মন্তব্য করবেন যে হুতোম পেঁচাও পরিবর্তন সময়ের একটি মহার্ঘ রত্ন। ইহাতে তৎকালীন সমাজের অতি সুন্দর চিত্র আছে। হুতোম হুতোমীয় ভাষার প্রবর্তক এবং বহুসংখ্যক হুতোমী পুস্তকের আদিপুরুষ। আরও পরে প্রমথ চৌধুরী লিখলেন :’নকশা হচ্ছে তখনকার সমাজের আগাগোড়া বিদ্রূপ এবং অতি চমৎকার লেখা। এ বই সেকালের কলিকাতা শহরের চলতি ভাষায় লেখা। এ রকম চতুর গ্রন্থ বাঙ্গালা ভাষায় আর দ্বিতীয় নেই।’ শহর কলকাতার উঁচু ও নিচুতলার জীবন নিয়ে ঝরঝরে চলিত বাংলায় এ রকম বই আর লেখা হয়নি তার মূল কারণ অন্যত্র। লুণ্ঠন, রক্তারক্তি, উচ্ছেদ ও সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে রচিত হয় আধুনিক শহরের উন্মেষ পর্ব। সেই পর্বের নকশা সব সময়ই উচ্চবর্গের, নগরবাসীর জন্য অস্বস্তিকর। কিছু জিনিস ভুলে যাওয়াই ভালো, যেমন কোনো দূর বা নিকট অতীতের অন্ধকার অপরাধগুলো। সে কারণেই পরবর্তী সময়ে যখন শহরের সমৃদ্ধি আরও বাড়তে থাকে, আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্র, ইংরেজি শিক্ষা, প্রযুক্তি ও জাতীয়তাবাদ যখন থেকে আমাদের রুচির মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়, আমরা তখন উন্মেষ পর্বকে ভুলতে শুরু করি। ভুলতে ভুলতে একসময় মনেই থাকে না কিসের মধ্য দিয়ে শুরু করে কোথায় এসে পেঁছেছি। আধুনিক পুঁজিবাদ তাই মর্মগতভাবে বিস্মরণমূলক। শুধু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে কিছু লেখা, যেমন কলকাতার আদি পর্বের ‘নকশা’ অথবা বাংলাদেশের জন্য হুমায়ূন আহমেদের হিমু-পর্বের রচনাসমূহ।

হুতোমের সঙ্গে হিমুর প্রসঙ্গ আসছে ঠিক কী অর্থে? শহর কলকাতার মতো শহর ঢাকা গড়ে ওঠার অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাই হুমায়ূন আহমেদের লেখায়। বস্তুত তার সমগ্র রচনাকর্ম গত চার দশকের বেশি সময় ধরে এই রাষ্ট্রের, এই সমাজের এবং এই শহরের গড়ে ওঠারই ইতিবৃত্ত। বিশেষত স্বল্পতম সময়ে কী করে একটি আধুনিক নগর-সমাজ গড়ে উঠল? কী করে এই ঢাকা শহরের বুকে একটি ‘নববাবু সমাজ’ আত্মপ্রকাশ করল তার রাখঢাকহীন বর্ণনা উঠে এসেছে হিমুর বয়ানে। এ চিত্র হুমায়ূন না লিখলে আমরা আর কারও কাছ থেকে এ সময়ে পেতাম না, পাইনি এখনও। হিমু আরও নানা কারণে মনে রাখার মতো। হুতোম যেখানে কেবলই ‘নকশা’, কোনো গল্প-উপন্যাস লেখার চেষ্টা করা হয়নি সেখানে, হিমু সেখানে নিজেই এক দীর্ঘ উপাখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বাংলা সাহিত্যে এ রকম চরিত্র নির্মাণ এর আগে কখনও ছিল না। এর পরও কখনও হয়নি। হিমুর ব্যতিক্রমী জীবনচর্চার পাশাপাশি তার সমৃদ্ধ দার্শনিকতা বা অনর্গল ভাবনার জীবন চরিত্রটিকে পাঠকের ঘনিষ্ঠ করেছে। হিমু একই সঙ্গে যুক্ত ও বিযুক্ত ঘটনার কেন্দ্রে ও প্রান্তে, অনুভূতিপ্রবণ এবং নির্বিকার, লজিক এবং অ্যান্টি-লজিক হিমুকে ভাবলে আমার একটি সংস্কৃত-ভাষ্যের কথা মনে পড়ে যায় :’যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন, মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই যোগী এবং তিনিই সর্বকর্মকারী।’ ব্যক্তিগত এসব বিশিষ্টতার কারণে হিমু বিষয়ক রচনা পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। কিন্তু হিমু সমগ্রকে অন্যভাবেও পাঠ করা যায়। এর প্রায় প্রতিটিরই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শহর ঢাকার জীবন। হিমু অনায়াসে এই শহরের উঁচুতলা ও নিচুতলায় যাতায়াত করে রাস্তার ভিক্ষুক, ফুটপাতের খাবার বিক্রেতা, দিনমজুর থেকে শুরু করে একই দিনে যে অবলীলায় চলে যেতে পারে অভিজাততম প্রাসাদে বা হোটেলে। হিমুর এই পারাপার করার ক্ষমতা তাঁকে একধরনের ‘ইন্টারপ্রেটার’-এর ভূমিকা দিয়েছে। সে ক্ষমতাবানদের কাছে ক্ষমতাহীনের অবস্থা তুলে ধরে, আবার ক্ষমতাবানদের তুলে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয় ক্ষমতাহীনদের মধ্যিখানে। অন্য সময়ে, যেন পরীক্ষা করতেই, ক্ষমতাহীনকে বানিয়ে দেয় একদিনের বাদশাহ, যেমন বাদশাহকে পথের ফকির এবং এই চলাচলের মধ্য দিয়ে আর কে না জানে ‘পথ চলাতেই তাঁর যত আনন্দ, সে আবিষ্কার করে ঢাকা শহরের জন্মবৃত্তান্ত। ঢাকার অলিগলির নকশা আমাদের সামনে তুলে ধরে কোনো আড়াল না করে; এমনকি প্রচণ্ড ক্ষমতাধরদের বাধা বা হুমকির তোয়াক্কা না করেই। এখানেই হুতোমের সঙ্গে হিমুর বড় মিল।

২. হিমুর উচ্চবর্গ প্রতিপক্ষ
জন্মসূত্রে প্রাপ্ত কয়েকটি ডালপালা হিমুকে উচ্চবর্গের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। কৃষ্ণের মাতুলবংশ যেমন (কংসকুল) সবসময় অন্যের অনিষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, হিমুর মাতুলবংশও তেমনি সব সময় অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে লিপ্ত। হুমায়ূন আরও কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘পিশাচবংশ’। পিশাচের সংজ্ঞাও নির্দিষ্ট হয়েছে এভাবে : ‘মানুষ হিসেবে মামারা পিশাচ শ্রেণীর। তাঁদের সমস্ত ভালোবাসা নিজের মানুষদের জন্যে। বাইরের কারোর জন্যে নয়।’ প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েও এদের পিশাচ স্বভাব যায়নি। বড় মামা মরবার সময় এক অন্ধকার বৃষ্টির রাতে একজন কেউ মাছ মারবার কোঁচ দিয়ে তাকে গেঁথে ফেলে তিনি তার ‘ডেথ বেড কনফেসনে’ নির্দোষ প্রতিপক্ষ কিছু মানুষকে জড়িয়ে দিয়ে যান। মরবার আগে মেজো মামাকে কানে কানে বললেন ‘এক ধাক্কায় চার শত্রু শেষ। কাজটা মন্দ হয় নাই। এই মেজো মামা আবার গোটা পাঁচেক খুন করেছেন। অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি।’ এহেন মামার বাড়িতে থেকে হিমু ম্যাট্রিক পাস করেছে। হুমায়ূন আহমেদ শুভ-অশুভের ডিভাইন-ডেভিলের গোপন সম্পর্ক-তত্ত্বে বোধকরি বিশ্বাস করতেন। আর সব মানুষ যেখানে যাঁ শ্রেণীর ইয়েস ম্যান গোছের, সেখানে না-শ্রেণীর মানুষেরা হয় শয়তান নয় মহাপুরুষ এ রকম একটি ভাবনা তাঁর মাথায় ছিল হিমুর বংশ লতিকার স্বভাব বর্ণনার ক্ষেত্রে। কিন্তু পরবর্তীতে হিমুর কাহিনী যতই শহরজীবনের অন্তস্থলে এগোতে থাকে, ততই বুঝতে পারি আমরা গ্রামের ফিউডাল পিশাচ বংশের চেয়ে বড় পিশাচ হচ্ছে ঢাকা শহরের নব বাবু সমাজ। তাদের মধ্যে পরার্থপরতার বালাই নেই হিমুর মাতুলবংশের মতই, কিন্তু যেখানে ভিন্নতা সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর এদের অনায়াস কর্তৃত্ব। এরা দুর্নীতিপরায়ণ-নীতিবোধের কোন সংশয় নেই এদের মনে এরা দিনকে রাত করে, অবলীলায় মানুষ খুন করে ধ্রুপদী সংগীতে গা ভাসিয়ে দিতে পারে। গাঁও-গেরামের মাতুলেরা সে তুলনায় চুনোপুঁটি। গ্রাম থেকে ছোট মামা হিমুর জরুরি বার্তা পেয়ে ছুটে এসেছেন, তার সাথে হিমুর কথা হচ্ছে জেলখানার এক ফাঁসির আসামির সাথে দেখা করার অনুমতি করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। ছোট মামা প্রথমে ভেবেছেন, টাকা খরচ করেই কার্যোদ্ধার করবেন, পরে বুঝলেন যে ঢাকা শহরে শুধু টাকা খরচই যথেষ্ট নয়, ক্ষমতার স্থান টাকারও উপরে। হিমু তাই বলল, ‘তুমি পারবে না মামা। তোমার ক্ষমতার বাইরে।’ মামা সব শুনে বললেন, ‘পুলিশে সাজানো মামলা পেছনে আছে বড় খুঁটি। ‘কিছু করা যাবে না।’ ঢাকা শহরের নবলব্ধ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে একটা শ্রেণীর হাতে নবলব্ধ উত্তরোত্তর ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। এই ক্যাপিটালিজমের কাছে ফিওডালিজম অসহায়।

হিমুর দীর্ঘ উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকার নব অভিজাত শ্রেণীর ও তাদের নবলব্ধ ক্ষমতার সম্পর্কে এমন কিছু কঠিন কঠিন কথা বলেছেন যা দুই বাংলার সমসাময়িক সাহিত্যেই অত্যন্ত দুর্লভ। এক-আধবার হলে কথা ছিল না, কিন্তু বইয়ের পর বইয়ে এই কঠিন কথাগুলো স্থান পেয়েছে। হিমুর প্রতিটা বইই আকারে ছোট উপন্যাসিকা বা ছোট উপন্যাস জাতীয় কিন্তু এদের মধ্যে কন্টিনিউটি, সম্পর্ক (ও বিচ্ছেদ) রয়েছে। ফলে সবগুলো মিলিয়ে হিমু-বিষয়ক একটি দীর্ঘ উপাখ্যান বা ন্যারেটিভ ভাবতে কষ্ট হয় না। এই উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে উচ্চচিত্ত সমাজের নীচতা, অমানবিকতা ও পাশবিকতার নির্মম নকশা মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠেছে। হালকা রসিকতা বা ইয়ার্কির ছলে চলা কথোপকথনের মধ্যে হঠাৎই বেরিয়ে পড়েছে থলের বেড়াল, আর এ রকম হলে অজস্র। ‘দরজার ওপাশে’ শুধু একটি বই থেকেই এটা প্রমাণ করা যায়। একগুচ্ছ উদাহরণ :

১. ‘টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না। এক লাখ টাকা থাকলে দুটা খুন করা যায়। প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার। পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে।’
২. ‘জাজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে। আগে জাজ সাহেবরা টাকা খেত না। এখন খায়। অনেক জাজ দেখেছি কাতলা মাছের মত হাঁ করে থাকে।’
৩. ‘বুদ্ধিমান লোক মাঝে মাঝে প্রথম শ্রেণীর বোকার মত কাজ করে। আমিও তাই করেছি। টাকা পয়সা অনেক ব্যাংকেই ছিল। ছিল আমার নিজের নামে। কিছু যে অন্যের নামে রাখা দরকার, কিছু ক্যাশ দরকার এটা কখনো মনে হয়নি।’
৪. ‘একটা বোকা লোক সব সরকারের আমলে মন্ত্রী হয় না। এক সরকারের আমলে হয়, অন্য সরকারের আমলে জেলে চলে যায়।’
৫. ‘পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ কঠিন জিনিস। শরীরের চামড়াটা শুধু থাকবে হাড্ডি যা আছে পানি হয়ে পিসাবের সঙ্গে বের হয়ে যাবে।’

আমাদের এও ভুলে গেলে চলবে না এক-এগারোর প্রবল দাপটের সময় হিমুর মাধ্যমেই হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’ এর মতো সাহসী উপন্যাস। নানা দেশে বিশেষ বাহিনীর অত্যাচারের যে ধারা চালু আছে তার বিরুদ্ধে হিমুকে দিয়ে প্রতিবাদ করিয়েছেন লেখক। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে যে কোনো মানুষই অসহায়, বিশেষ বাহিনীর কাছে আরও বেশি অসহায়। এদেরকে নিয়ে ঠাট্টা ছলে যে কাণ্ড হিমু করেছে তাতে সাধারণ মানুষের চাপা ক্ষোভের প্রকাশ পেয়েছে। একটি উদাহরণ : হিমুকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তিনজনের একটা টিম ঘামবাবু, হামবাবু ও মধ্যমণি এই নাম দিয়ে পাঠকদের সাথে পরিচয় করানো হচ্ছে। সেখানে ছড়া কাটছে হিমু : ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/র‌্যাব এল দেশে/সন্ত্রাসীরা ধান খেয়েছে/খাজনা দেব কীসে?’ এটি ননসেন্স রাইম যার কোনো মানে হয় না, আবার হয়ও। অথবা এই বইয়ের অন্যত্র, হিমুকে যখন ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে, তখন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে এ রকম :

‘বালতিতে কী?

পানি।

দেখাও। পানিও দেখালাম।

তোমার ব্যাগে কী?

একটা বই স্যার।

কী বই?

জঙ্গি বই স্যার। বিরাট বড় এক জঙ্গির জীবনকথা। জঙ্গির নাম চেঙ্গিস খান। নাম শুনেছেন কি-না জানি না।

দেখি বইটা। র‌যাবের এই লোক (কথাবার্তায় মনে হচ্ছে অফিসার) বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। বইটা কার?

আমার মামাতো বোনের মেয়ের। মেয়ের নাম মিতু। ভিকারুননিসা স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। ছাত্রী খারাপ না। স্যার, আমি এখন যেতে পারি?

না। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে।

আমি আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার ক্রসফায়ার হবে?’

অফিসার জবাব দিলেন না।

এর পরপরই এল সেই মোক্ষম লাইন যা হুমায়ূনের একান্ত নিজস্ব আবিষ্কার : ‘পুলিশের সঙ্গে র‌্যাবের এইটাই মনে হয় তফাত। পুলিশ কথা বেশি বলে। র‌যাব চুপচাপ। তারা কর্মবীর। কর্মে বিশ্বাসী। ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠার জন্য, এই সাহসিকতা দেখানোর জন্যে হিমুকে সাধারণ মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।

৩. হিমুর ‘সাব-অলটার্ন’ বন্ধুরা
আগেই বলেছি, হিমু ঠিক সাব-অলটার্ন অর্থাৎ নিম্নবর্গের মানুষ নন। উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে তার অবাধ সামাজিক যাতায়াত, এ দুইয়ের মধ্যে সে বোধকরি শেষ সামাজিক সেতু। ইংরেজিতে ‘গো বিটুইন’ যাকে বলে। কিন্তু এটাও ঠিক, হুমায়ূনের পক্ষপাতিত্ব কোনখানে দূরসম্পর্কের রেশমা খালার প্রসাদ যেটা হচ্ছে গুলশান এলাকার সবচেয়ে অভিজাত বাড়ি তার চোখ-ধাঁধানো বর্ণনা আছে ‘এবং হিমু’ বইতে। একই বাড়িতে ঘরের পর ঘর। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অপূর্ব মিলন যাকে বলে, ইউরোপীয় স্টাইলে বার-ঘরও আছে। ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি দিয়ে করা নামাজ ঘরও আছে। শঠতা ও ধর্মভাবাপন্নতা হুতোমের যুগে যেমন, হিমুর কালেও সমান তালে বিদ্যমান। নকশা-য় বাবুরা সেজে-গুজে ‘বারোইয়ারী’ দুর্গাপূজা দর্শন সেরে বেশ্যা পল্লীতে যাচ্ছেন, এ যুগে এরই রকম-ফের চলছে ধর্মকর্ম ও দুর্নীতিলব্ধ আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা সমান তালে ঠিক রেখে। সেই শঙ্ক ঘোষের কবিতার মতো ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি। দুর্গা-মার কাছে প্রাণ খুলে বর চাইছি যাতে ‘লুটে পুটে’ খাই। এসব প্রবণতা হুমায়ূন তাঁর নানা চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন এর মধ্যে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ উভয় শ্রেণীরই মানুষ রয়েছে। কিন্তু তার মূল পক্ষপাতিত্ব বরাবর ছিল ক্ষমতাহীন অসহায় মানুষদের প্রতি। তাই সন্ত্রাসী ‘আঙুল কাটা জগলু’ হিমুর হাতে পড়ে কেমন নরম মানবিক হয়ে যায়। গরম ভাত ও ডিম সেদ্ধ খাওয়ার জন্য আকুল ক্রসফায়ারের ‘মুরগি ছাদেক’-এর জন্য এক ধরনের সহমর্মিতা বোধ করি আমরা। শুভ্র-র বাবা র‌্যাব অফিসার হামবাবু হঠাৎ ভদ্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। হিমু যুক্তি দেয়, ‘স্যার, মানুষ ক্যান্সার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যত্নে তৈরি করে। … এত যত্নে তৈরি একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মারা পড়ে এটা কি ঠিক?’ কেননা, পিশাচেরও বিচার আছে। ‘পিশাচের কথাও আমরা শুনব। সে কেন পিশাচ হয়েছে এটাও দেখব।’

হিমুর সাব-অলটার্ন বন্ধুদের কথা উঠলেই প্রথমে মনে পড়বে ‘দীনের হাতে দীন’ চরম দরিদ্র মানুষদের কথা যাদের কথা ঘুরে-ফিরে এসেছে হিমুর নানা পর্বে। ইয়াদ সাহেব ভিখেরিদের নিয়ে গবেষণা করছেন, তার বিষয় ‘ভাসমান জনগোষ্ঠী : আর্থ-সামজিক নিরীক্ষার আলোকে’। হিমু এক পর্যায়ে তার মাথায় ঢুকিয়েছে যে ভিক্ষুকের ওপরে কাজ করতে হলে তাকে ভিক্ষুকের সাথে থাকতে হবে। হিমুর পক্ষে ভিক্ষুক-শ্রেণীর সাথে নিশিযাপন কোনো বিষয় না, সে কতবার ফুটপাতে এমন ঘুমিয়েছে। ফুটপাতে বা নিম্নবিত্তদের হোটেলে ভাত খাওয়া বরং হিমুর একটি প্রিয় কাজ। মজনু মিয়ার ভাত মাছের হোটেল, বস্তিতে গিয়ে মাতৃস্থানীয়া মহিলার হাতে রাঁধা মাছের সালুন-তরকারি, ড্রাইভার মকবুলের সাথে শহর অবাধে ঘোরা। তরঙ্গিনী ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মুহিব সাহেবের কাছে বাকিতে চেয়ে জিনিস আনা, মেসের জীবন বাবুর কাছে তার সুখ-দুঃখের কথা শোনা ইত্যাদি। ‘হিমু’ উপন্যাসে মেসের জীবন বাবু এসে হিমুকে এ-ও জানিয়েছেন কোনো একটা রুমে বোর্ডারদের মধ্যে মারামারি রক্তারক্তি কাণ্ড হয়েছে। কেউ মারা যায়নি তাতে, কিন্তু যদি মারা যেত তাহলে তিনি বিপদে পড়তে পারতেন। ‘খুনখারাবি হলে পুলিশ আগে কাকে ধরত? আমাকে। আমি হলাম মাইনরিটি দলের লোক। … সব চাপ যায় মাইনরিটির ওপর। আপনারা মেজরিটি হয়ে বেঁচে গেছেন।’

বেঁচে অবশ্য যাওয়া যায়নি। যারা সততার সাথে জীবন নির্বাহ করতে চান তাদের জন্য দুটো পথই খোলাসা হয়, পিঁপড়ের মতো অসহায় হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। নয়তো সততার পথ ছাড়তে হবে। হিমুর হুমায়ূন তৃতীয় পথে বিশ্বাস করতেন। প্রতিবাদ করে যেতে হবে, প্রতিবাদ করে যেতে হবে এবং প্রতিবাদ করে যেতে হবে। সরবে এবং নীরবে, এক্ষেত্রে কালীপ্রসন্ন সিংহ তার সাথেই রয়েছেন। কলকাতার নববাবু সমাজকে উদ্দেশ করে নকশার উপসংহারে বলছেন : ‘হা বঙ্গবাসীগণ! তোমরা এইরূপেই আপনাদিগকে সভ্য বলে পরিচয় দিয়ে থাক! যাঁদের ধর্ম্ম কর্ম্ম এইরূপ, যাঁদের আমোদ প্রমোদের প্রণালী এই, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই এইরূপ হিপোক্রিট। তাঁরা আবার সভ্য বলে পরিচয় দেন।’

একথা হুমায়ূন আহমেদও বলতে পারতেন, ‘রঙপেন্সিল’ শীর্ষক কলাম-গুচ্ছে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, পবিত্র কোরআন শরিফের একটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘এবং বেহেশতে তোমরা প্রবেশ করবে ঈর্ষামুক্ত অবস্থায়!’ হিমুর শহর দরিদ্রকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। মানি লোকের সম্মান করতে জানে না। হিমু পড়তে পড়তে একসময় আমার মনে হয়েছে, এই নিষ্ঠুর, মূক ও বধির শহরে একই সাথে চেতন ও অবচেতনে অবগাহন করা ছাড়া উপায় নেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার। এজন্যেই কি ঢাকার রাস্তায় চলতে চলতে হিমু অনেক সময় জ্যোৎস্নার জগতে হারিয়ে যায়? আর কে না জানে। জ্যোৎস্নার অলৌকিক জগতে একবার ঢুকে গেলে লৌকিক জগতে ফিরে আসা বা না আসা সমান অর্থহীন হয়ে পড়ে।

চায়ের পেয়ালায় ঝড় (Tempest in a Teacup)

বিনায়ক সেন

এবারের বাজেট যে পরিবেশে দেওয়া হচ্ছে তা সম্ভবত বাজেটের আলোচনার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৫ জানুয়ারির নিরুত্তাপ নির্বাচন অলক্ষ্যে থেকে বাজেট নিয়ে তর্ক-বিতর্কের পরিবেশের ওপর এক ধরনের নিরুৎসাহের সৃষ্টি করেছে।
budget
সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে যে সরকার গঠিত হতো, সেই সরকারের প্রথম বাজেট ও বর্তমান বাজেটের সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যে কোথায় যেন একটা নৈতিক ফাঁক থেকে গেছে। এই রাজনৈতিক ছন্দপতনের প্রভাব বাজেট আলোচনার ওপরও পড়তে বাধ্য।

৬ শতাংশ থেকে উত্তরণ কি সম্ভব? :বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন তার নিজস্ব গতিশীলতা নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। বাজেটের আকার-প্রকার যা-ই হোক, তা এই গতিশীলতার ক্ষেত্রে খুব একটা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটাতে পারবে না। এ দেশের কৃষি খাতকে ধরে রেখেছে বাংলার কৃষক, রফতানি খাতকে ধরে রেখেছে তৈরি পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিক আর রিয়েল এস্টেট ও নির্মাণ খাতের প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ক্ষুদ্র ঋণ খাতের উত্তরোত্তর প্রসার গ্রাম ও শহরের নিচুতলার অর্থনীতিকে সেবা, পরিবহন ও ক্ষুদ্র বাণিজ্য খাতের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধিমুখী করে রেখেছে। এ অর্থনীতি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও পণ্ডিতরা চায়ের পেয়ালায় ঝড় তুলবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত পাঁচ বছরে এ অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৬.২ শতাংশ, না হয় কমিয়েই বলি_ মোটা দাগে ৬ শতাংশ। আরেকটা যমুনা সেতুর মতো পদ্মা সেতু না হলে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগ স্থাপিত না হলে, গভীর সমুদ্র বন্দর না হলে, ঢাকায় মেট্রোরেল না হলে, আন্তঃশহর রেলব্যবস্থা জোরদার না হলে, পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে এই প্রবৃদ্ধির হারকে ৮ শতাংশে উন্নীত করা যাবে না। সুশাসন নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, ম্যাক্রো-কাঠামো নিয়ে যে সূক্ষ্ম বিচারই প্রয়োগ করি না কেন, রাজস্ব কাঠামোয় যত বৈপ্লবিক পরিবর্তনই আনি না কেন, কিছুতেই কিছু হবে না_ যদি ভৌত অবকাঠামোগত খাতে একটি বড় ধরনের ‘ধাক্কা’ না আসে। বাকি কাজটা জনগণ সুশাসনের অভাবের মধ্যেও করে নিতে পারবে। নিজেদের দারিদ্র্য কমাতে পারবে।

স্থানীয় সরকারের প্রসঙ্গ :এবারের বাজেটে স্থানীয় সরকারের ভূমিকাটি পুনরায় জোরেশোরে উপস্থাপিত হয়েছে। বর্তমানের কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামোর গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাস ও বিকেন্দ্রীকরণের জন্য চাই নিচের দিকের স্থানীয় সরকারের ওপর অধিকতর ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ। কিন্তু বাজেটে এটা করার জন্য পূর্বশর্ত আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এর জন্য ‘দক্ষ ও প্রশিক্ষিত আমলাতন্ত্রের’ প্রয়োজন হবে। আমার মতে, ‘বিশেষায়িত আমলাতন্ত্রের’ জন্য অপেক্ষা না করে এখনই ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া শুরু হওয়া প্রয়োজন। অন্তত ১০ শতাংশ বাজেট-বরাদ্দ সরাসরি উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা যেত। এতে করে স্থানীয় সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে স্থানীয় পরিষদের পক্ষে স্থানীয় প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হতো, যা কেবল এডিপির মাধ্যমে সমাধান করা কঠিন। ভূমি মালিকানা সনদ এবং ভূমি জরিপ ও রেকর্ড সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শহর এলাকায় ভূমি, গৃহায়ন বা সম্পদের ওপর কোনো জরিপ করার তাগিদ দেখা যায়না বাজেটের মধ্যে। গ্রামের তুলনায় শহরে জমি বা সম্পত্তির ওপরে মালিকানার বণ্টন আরও অসম। এটার সঙ্গে শহর এলাকায় সম্পত্তি কর বসানোর প্রশ্নটিও জড়িত। গ্রামের ক্ষেত্রে ভূমি মালিকানা সনদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিত্তহীন ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বণ্টনের কথা উচ্চারিত হয়নি বা এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কী করে আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে উন্নীত করা যাবে, সে নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই।

সম্পদ আহরণ তথা অর্থায়নের প্রশ্ন :বাজেটে যথার্থভাবেই স্থানীয়ভাবে সম্পদ আহরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং প্রত্যক্ষ কর, বিশেষত আয়করের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিত্তশালীরা বেশি হারে আয়করের ওপর ‘সারচার্জ’ দেবেন, এটাও ঠিক আছে সুষম উন্নয়নের স্বার্থে। কিন্তু এ দেশে এখনও ‘সম্পদ কর’ (ওয়েলথ ট্যাক্স) নেই। যেমনটা আছে পাশের দেশ ভারতে বা পাশ্চাত্যের উন্নত দেশে। এটা বাস্তবায়িক হলে অনায়াসে ১০০০-২০০০ কোটি টাকা আহরণ করা যেত। আয়করের সারচার্জের ক্ষেত্রেও সম্পত্তির মূল্যায়নে ‘ফেয়ার মার্কেট ভ্যালু’ প্রয়োগ করা উচিত ছিল। তবে শুধু স্থানীয় উদ্যোগে সম্পদ সমাবেশ করাই যথেষ্ট নয়। আমরা এখনও স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে রয়েছি। আরও কিছুদিন সেই তালিকায় থাকব। সে ক্ষেত্রে কম সুদে বৈদেশিক সাহায্য জোরদারভাবে সংগ্রহের প্রতি আমাদের আরও সচেষ্ট হওয়া উচিত।

মধ্যবিত্তের অর্থনীতিতে উত্তরণ চাই :সবশেষে, মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে একটা কথা বলতে চাই। আমরা শুধু মধ্য আয়ের দেশ নয়, মধ্যবিত্তের দেশে পরিণত হতে চাই। কেবল ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করে এটা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী; দরকার উন্নত মানের শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা। সংস্কৃতি খাতে যত ব্যয় হয়েছে, তার সিকিভাগও ব্যয় হয় না এ দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে। ‘আইসিটি’ আর বিজ্ঞান গবেষণা এক জিনিস নয়। শিক্ষা খাতে তাই ব্যয় বরাদ্দ আরও বেশি হারে বাড়ানো প্রয়োজন। ভারতে যেমন বিশ্বখ্যাত উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান (যথা_ আইআইটি এবং আইআইএম) রয়েছে, সে রকম প্রতিষ্ঠান সামান্য সরকারি সহায়তা পেলে আমাদের দেশেও গড়ে উঠতে পারে। বস্তুত পিপিপির জন্য উঁচু মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা একটি জরুরি বিবেচনা হতে পারে। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে আগামী ১০ বছরে আমাদের উচ্চশিক্ষার মান শুধু নয়, আমাদের আমলাতন্ত্রের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের চিত্রটাই আমূল বদলে যাবে। একটি মধ্যবিত্ত অর্থনীতি নির্মাণের জন্য এটি অবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। এ ব্যাপারে এ বাজেটের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আশা করেছিলাম।

Original article at Samakal here.

রবীন্দ্রনাথ ও মধ্যপ্রাচ্য (Tagore and the Middle East)

বিনায়ক সেন

১. সভ্যতার সংঘাত
Rabindranath Tagore
বার্লিন দেয়াল পতনের দু’বছরের মাথায় ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হলো স্যামুয়েল হান্টিংটনের নাটকীয় থিসিস_ ‘সভ্যতার সংঘাত’। ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর ডানপন্থি রক্ষণশীলদের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক। সেখানেই হান্টিংটন এ বক্তৃতাটি দিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে প্রভাবশালী ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ সাময়িকীতে থিসিসটি আরও সুসংগঠিতভাবে প্রকাশ পেল। সেখানে তিনি যা লিখলেন তা অনুবাদে দাঁড়ায় মোটামুটি এ রকম :’আজকের পৃথিবীর সমস্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মৌলিক উৎস এবার থেকে আর ভাবাদর্শ বা অর্থনৈতিক কার্যকারণের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রধান উৎস হবে সাংস্কৃতিক। বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়া জাতি-রাষ্ট্রসমূহ এবার থেকে সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কারণেই পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। সভ্যতার সংঘাত এবার থেকে বিশ্বরাজনীতিতে নিয়ামক শক্তি হয়ে দেখা দেবে। বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যেকার বিভেদরেখা ধরেই আগামী দিনের যুদ্ধের রেখা নির্মিত হবে।’ ‘বিভিন্ন সভ্যতা’ মানে পাশ্চাত্য (পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা) সভ্যতার সাথে অন্যসব সভ্যতার লড়াই। তবে নন-ওয়েস্টার্ন সভ্যতাসমূহের মধ্যে হান্টিংটন বিশেষ করে চিহ্নিত করেছিলেন ইসলাম প্রভাবিত সভ্যতা বা মুসলিম সভ্যতাকে। ভারত ও রাশিয়াকে ফেললেন ‘সুইং সভ্যতা’র কাতারে, অর্থাৎ একপ্রকার দোদুল্যমান মিত্র হিসেবে। ‘আমরা এবং তারা’_ এই লড়াই কার্যত দাঁড়িয়ে গেল পাশ্চাত্য বনাম ইসলামী সভ্যতার লড়াইয়ে। হান্টিংটনের বইয়ের পূর্ণ শিরোনাম ছিল ‘সভ্যতার সংঘাত এবং বিশ্বব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস’। সভ্যতার সংঘাত_ এই শব্দবন্ধটি অবশ্য তার আগেই ব্যবহৃত হয়েছে ১৯২৬ সালের একটি বইয়ে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বেসিল ম্যাথিউস লিখেছেন অনুসন্ধানী গ্রন্থ :’ইয়াং ইসলাম অন ট্রেক :স্টাডি ইন দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস্’। এ বই প্রকাশের ৬ বছর পরে ১৯৩২ সালে পারস্যে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। মূলত ইরান এবং অংশত ইরাক ভ্রমণের বিবরণী নিয়ে লেখা হবে ‘পারস্য যাত্রী’। উপমহাদেশের বাইরে এটাই হবে তার শেষ বিদেশ ভ্রমণ। তবে নিছক ভ্রমণ কাহিনী ছিল না বইটি। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য, বিশেষত মুসলিম সভ্যতার সাথে ঘনিয়ে ওঠা সংঘাত-তত্ত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ দেখা যাচ্ছে অবহিত ছিলেন। এ নিয়ে বইয়ের নানা স্থানে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে, যার পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণ ও সমকালীন গুরুত্ব কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়। এ নিয়েই কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছি এখানে।

২. আকাশ-সাম্রাজ্যবাদ
‘দূরত্ব’ তৈরি করতে পারলে অন্যপক্ষকে শত্রুপক্ষ ভাবা সহজ এবং সেই শত্রুর বিনাশ সাধনও অনায়াসসাধ্য হয়ে ওঠে। সভ্যতার সংঘাত-তত্ত্বের মূলে রয়েছে নানা সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে অপরিচিতের দেয়াল তুলে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা। বিভিন্ন গোত্র, জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে অচেনা দেয়াল তুলে বৈরী ভাবনা সৃষ্টির প্রয়াসের বিরুদ্ধে কোরআন শরীফে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে :’আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পার।’ অপরিচিতকে সহজেই হত্যা করা যায় এবং এ কাজে প্রযুক্তিগত উন্নতি বাড়তি উৎসাহ যোগাতে পারে। এখানে ‘দূরত্ব’ বলতে শুধু ভৌগোলিক দূরত্বকে বোঝানো হচ্ছে না; মানস ভূগোলের ব্যবধানকেও নির্দেশ করা হচ্ছে। জাতিতে জাতিতে ‘দূরত্ব’ সৃষ্টি করার জন্য চাই নয়া ধারাভাষ্য, নতুন জ্ঞান-উৎপাদন; যার মাধ্যমে আপনকে পর, পরকে শত্রু এবং শত্রুকে দূর থেকে অধুনাতন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই নির্মূল করা সম্ভব। দূরত্ব-সৃষ্টির মাধ্যমে ‘অপরায়ন’ (মানে পর করে দেওয়ার) রাজনীতি ও এর আধুনিক কলাকৌশল রবীন্দ্রনাথের চোখে ধরা পড়েছিল। তখন সবেমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী ভাগবাটোয়ারা শেষ হয়েছে, যদিও খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ ও প্রতিরোধ চলছে বিভিন্ন অঞ্চলেই। এই পরিস্থিতিতেই মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন (দীর্ঘ উদৃব্দতি কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে দিচ্ছি):

“বোগদাদে ব্রিটিশদের আকাশফৌজ আছে। সেই ফৌজের খ্রিস্টান ধর্মযাজক আমাকে খবর দিলেন, এখানকার কোন শেখদের গ্রামে তারা প্রতিদিন বোমাবর্ষণ করছেন। সেখানে আবালবৃদ্ধবনিতা যারা মরছে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঊর্ধ্বলোক থেকে মার খাচ্ছে; এই সাম্রাজ্যনীতি ব্যক্তিবিশেষের সত্তাকে অস্পষ্ট করে দেয় বলেই তাদের মারা এত সহজ। খ্রিস্ট এসব মানুষকেও পিতার সন্তান বলে স্বীকার করেছেন, কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মযাজকের কাছে সেই পিতা এবং তার সন্তান হয়েছে অবাস্তব; তাদের সাম্রাজ্য-তত্ত্বের উড়োজাহাজ থেকে চেনা গেল না তাদের; সেজন্য সাম্রাজ্যজুড়ে আজ মার পড়ছে সেই খ্রিস্টেরই বুকে। তাছাড়া উড়োজাহাজ থেকে এসব মরুচারীকে মারা যায় এতটা সহজে, ফিরে মার খাওয়ার আশঙ্কা এতই কম যে, মারের বাস্তবতা তাতেও ক্ষীণ হয়ে আসে। যাদের অতি নিরাপদে মারা সম্ভব, মারওয়ালাদের কাছে তারা যথেষ্ট প্রতীয়মান নয়। এই কারণে, পাশ্চাত্য হননবিদ্যা যারা জানে না, তাদের মানবসত্তা আজ পশ্চিমের অস্ত্রীদের কাছে ক্রমশই অত্যন্ত ঝাপসা হয়ে আসছে।”

আকাশের দূরত্ব থেকে দেখলে নিচের মানুষের অস্তিত্ব মানবেতর পর্যায়ে চলে যায়, আর সে অবস্থায় প্রযুক্তি সহায়ক হলে মানব-হত্যায় আত্মার সন্তাপ হয় আরও কম। বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ-বর্ণিত বাগদাদে আমরা দেখিনি কি আকাশ থেকে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ বা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফগানিস্তানে উপর্যুপরি ‘ড্রোন আক্রমণ?’ সরাসরি নৈকট্যে কমান্ডো সৈন্য পাঠিয়ে গুলিবর্ষণের চেয়ে অন্তরীক্ষে থেকে মনুষ্যবিহীন স্বয়ংক্রিয় রিমোট চালিত বিমান (ড্রোন) আক্রমণ অনেক বেশি ‘বিবেকসম্মত পন্থা’ বলে পাশ্চাত্যে বিবেচিত হয়েছে! একেই লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্ব নির্মিত উড়োজাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে।’ সভ্যতার সংঘাত-তত্ত্ব এ রকমই একটি আক্রমণাত্মক-তত্ত্ব নির্মিত উড়োজাহাজ যা বুশ, সাদ্দাম, ব্লেয়ার, লাদেন সবাইকেই একযোগে ককপিটে বহন করতে সক্ষম। দাঙ্গা বাধানোয় কুশলী শ্যারন বা হালের মোদিও এর থেকে বাদ যাবেন না। সমস্যা জট পাকিয়েছে শুধু পাশ্চাত্যের মনের গভীরে নয়, সংকট দেখা দিয়েছে প্রাচ্যেও। এ যুগে নৈর্ব্যক্তিক মনন মানবতাবিদ্ধ না হলে হয়ে উঠতে পারে আবেগ-অনুভূতিহীন মারের যন্ত্র_ আ কিলিং মেশিন।

গীতায় অর্জুন যে আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে বন্ধু-স্বজনদের ওপরে অস্ত্রাঘাতে শেষ পর্যন্ত বিব্রত হলেন না, অর্জুন-বিষাদ যে এত ক্ষণস্থায়ী হলো, এর পেছনেও রয়েছে সাম্রাজ্য-বিস্তারের অমোঘ যুক্তি। তার মানে বিষয়টা শুধু পাশ্চাত্যের লোভের আগ্রাসনের নয়, সমস্যাটা প্রাচ্য-মনেরও। অর্জুন দক্ষ তীরন্দাজ। যোজন যোজন দূরত্বে থেকে নিষ্কাম মানসলোকে ডুবে গিয়ে সে যখন ‘শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরোয়, তখন সে নির্মমভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না। কেননা হিসাবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে বাস্তবের পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আঁধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়োজাহাজ-অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর।’ দেখা যাচ্ছে, পাশ্চাত্যের নিরাবেগ যুক্তির দর্শন ও প্রাচ্যের নিরাবেগ মোহমুক্তির দর্শন মিলতে পারে। মিলছে একই মারের বিন্দুতে_ একই ক্ষমতা প্রয়োগের ভরকেন্দ্রে। ‘সেখান থেকে যাদের ওপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য’ বুঝি এই যে_ শরীরের মৃত্যু হয়, কিন্তু আত্মার মৃত্যু হয় না! এভাবেই নিঃসহায়রা যুগে যুগে পড়ে পড়ে মার খেয়েছে। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দর্শনের এক অন্ধকার দিকের এই রবীন্দ্র-কৃত ব্যাখ্যা আমাদের চেতনাকে সচকিত করে দেয়। ‘সেন্টিমেন্টের বালাই নেই’ এমন আধুনিক যুগকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিমনস্কতার নামে বরণ করতে রবীন্দ্রনাথ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। নবযুগের পুষ্পক-রথ, দিব্যাস্ত্র বা গাণ্ডীবের টংকার কোন দেবত্বকে ইঙ্গিত করে না। ‘জাভাযাত্রীর পত্রে’ তাই তিনি নিদ্বর্িধায় লিখতে পেরেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে মানুষ যদি একেবারে মরে, তবে সে এই জন্যেই মরবে_ সে সত্যকে জেনেছিল কিন্তু সত্যের ব্যবহার জানেনি। সে দেবতার শক্তি পেয়েছিল, দেবত্ব পায়নি।’ ‘পারস্য যাত্রী’তে এ নিয়ে পাশ্চাত্যকে দুষেছেন এই বলে যে, ‘য়ুরোপ দেবতার অস্ত্র পেয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে দেবতার চিত্ত পায়নি।’ অন্যদিকে প্রাচ্য এত ধর্মাশ্রিত ধর্ম নিয়ে কথা বললেই গায়ে ফোস্কা’ পড়ে যায়, তবু ধর্মের স্থৈর্য্য ও ধৈর্য তার অর্জন হয় নি।

৩. হাফেজ-সাদির দেশে
গর্বাচভের চরিত্রে একটি বড় ত্রুটি ছিল রাজনৈতিক দ্বিধা ও সংশয়ের ভেতরে বিরামহীনভাবে ভুগতে থাকা। তাঁর অনিচ্ছুক পৌরোহিত্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। কিন্তু সব পতন-স্খলনের মধ্যে একটি সত্য-উপলব্ধি ছিল তাঁর। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সত্যের ওপরে মার্কসবাদীদের একচেটিয়া অধিকার নেই এবং কোনো ভাবাদর্শই মানবকল্যাণের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আগুনের, পরে যেমন মানুষের সভ্যতা-নিরপেক্ষভাবে অধিকার রয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপরে যেমন রয়েছে, বাজার-ব্যবস্থার, পরেও তেমনভাবেই স্বাভাবিক দাবি রয়েছে। মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশে আগুন আবিষ্কারের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল পণ্য-বিনিময় ব্যবস্থা তথা পণ্য-অর্থনীতির আবিষ্কার। সমাজতন্ত্রের অর্থনীতিতেও নিতান্ত ভাবাদর্শ-তাড়িতভাবে অন্ধ না হলে এই পণ্য-অর্থনীতির সর্বাধুনিক ব্যবহার হতে পারত। পারস্যে আসার ঠিক দু’বছর আগে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, মানুষের স্বভাবের সঙ্গে সহজেই মেলে এমন রীতিনীতির সঙ্গে আপোসরফা করা প্রয়োজন। কিছু কিছু প্রগতির ধারণা জন্মায় হয়তো কোনো বিশেষ দেশ বা ভূগোলে, কিন্তু তাতে সহজাত অধিকারবোধ করে সব দেশের ও সভ্যতার মানুষই। অক্টোবর বিপ্লবের বৈষম্য-বিরোধী ধারণাও তেমনি। বিপ্লবের এত বছর পরেও ‘বৈষম্যকে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না’ এই ধারণার মৃত্যু হয়নি। রাশিয়ায় গিয়ে এই ধারণার প্রতি যেমন আকৃষ্ট হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পারস্যে গিয়ে তেমনি মরমীবাদের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। হাফিজ-সাদী বা রুমীর কবিতার প্রতি যেমন। পারস্যের এই মরমি কবিদের মধ্য দিয়ে ইসলামি সভ্যতার যে পরিচয় মেলে তা চিরকালের অনুভূতি; সব ধর্মের ও সংস্কৃতির মানুষের কাছেই তা আদরণীয় সঞ্চয়। ঠিক এই যুক্তিতেই ইউরোপের চেয়ে পারস্যেই তাঁকে ভালো বুঝতে পারবে এ কথা কবি বিশ্বাস করতেন : ‘কাব্য পারসিকদের নেশা, কবিদের সঙ্গে এদের আন্তরিক মৈত্রী। আমার খ্যাতির সাহায্যে সেই মৈত্রী আমি কোনো দান না দিয়েই পেয়েছি। অন্য দেশে সাহিত্যরসিক মহলেই সাহিত্যিকদের আদর, পলিটিশিয়ানদের দরবারে তার আসন পড়ে না। এখানে সেই গণ্ডি দেখা গেল না। যাঁরা সম্মানের আয়োজন করেছেন তারা প্রধানত রাজদরবারিদের দল। মনে পড়ল ঈজিপ্টের কথা। সেখানে যখন গেলেম রাষ্টনেতারা আমাদের অভ্যর্থনার জন্যে এলেন। বললেন, এই উপলক্ষে তাদের পার্লামেন্টের সভা কিছুক্ষণের জন্যে মুলতবি রাখতে হলো। প্রাচ্যজাতীয়ের মধ্যেই এটা সম্ভব। এদের কাছে আমি শুধু কবি নই, আমি প্রাচ্য কবি। সেই জন্যে এরা অগ্রসর হয়ে আমাকে সম্মান করতে স্বভাবত ইচ্ছা করেছে, কেননা সেই সম্মানের ভাগ এদের সকলেরই।’

নোবেলপ্রাপ্তির পর সেলিব্রেটির প্রতি আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই আগ্রহবোধের মধ্যে আত্মীয়তাবোধের প্রকাশ দেখেছেন। ‘ইন্দো-এরিয়ান’ সূত্রে পারস্যের সঙ্গে তার ‘রক্তের সম্পর্ক’ রয়েছে এ কথা অনুমানের পর আসল কথাটা পাড়লেন : ‘এখানে একটা জনশ্রুতি রটেছে যে, পারসিক মরমিয়া কবিদের রচনার সঙ্গে আমার লেখার আছে স্বাজাত্য। … বিনা বাধায় এদের কাছে আসা সহজ, সেটা স্পষ্ট অনুভব করা গেল। এরা যে অন্য সমাজের, অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের, অন্য সমাজগণ্ডির, সেটা আমাকে মনে করিয়ে দেবার মতো কোনো উপলব্ধি আমার গোচর হয়নি।’ মরমিয়া কবি বা সুফী-সাধকের সঙ্গে নিজের মিলের প্রসঙ্গ পারস্যে এসেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম আবিষ্কার করলেন এমনটা নয়। তিনি নিজেকে সুফী-সাধক কবিদের কাছের লোক বলেই ভেবেছেন বহুকাল থেকে। পারস্যে উষ্ণ অভ্যর্থনার উত্তরে তিনি তাঁর ‘সুফী’ পরিচয়টাকেই বিশেষ করে তুলে ধরেছিলেন : ‘আপনাদের পূর্বতন সুফী-সাধক কবি ও রূপকার যাঁরা আমি তাঁদেরই আপন, এসেছি আধুনিক কালের ভাষা নিয়ে; তাই আমাকে স্বীকার করা আপনাদের পক্ষে কঠিন হবে না।’ বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনর্গল ফার্সি জানতেন। কবির নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ‘আমার পিতা ছিলেন হাফেজের অনুরাগী ভক্ত। তাঁর মুখ থেকে হাফেজের কবিতার আবৃত্তি ও তার অনুবাদ অনেক শুনেছি। সেই কবিতার মাধুর্য দিয়ে পারস্যের হৃদয় আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল।’ অন্যত্র লিখেছেন, ‘অবশেষে হাফেজের সমাধি দেখতে বেরোলুম, পিতার তীর্থস্থানে আমার মানস অর্ঘ্য নিবেদন করতে।’ দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার মতো ভিন্নতর অর্থে পারস্যও তাঁর কাছে সভ্যতার এক ‘তীর্থস্থান’ বলে মনে হয়েছিল। সেটা শুধু আচার্য পিতৃদেবের স্মৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ নিবেদনের সুবাদে তাঁর নে এসেছিল এরকম ভাষার কোন কারণ নেই। এর প্রধান কারণ ছেলেন তিনি নিজেই। পারস্য-যাত্রার বহু আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের ভেতরে মধ্যপ্রাচ্য, ইসলাম ও মরমীবাদের প্রতি আগ্রহ দেখে দিয়েছিল। ব্যক্তিগত আকর্ষণ থেকেই তিনি সুফীবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে বেড়ে উঠেছেন তখন সুফীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কোন ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছিল না। রামমোহন স্বয়ং ব্রাক্ষ্ম মতের প্রচারে খ্রিস্টীয় ইউনিটেরিয়াল চার্চ-এর পাশাপাশি কোরআন ও ইসলাম থেকে প্রেরণা লাভ করেছিলেন। মুতাজেল্লা সম্প্রদায়ের যুক্তিবাদী ধরো তাঁকে বাড়তি উৎসাহ দিয়েছিল।

কিন্তু এরকম সে আমলে অনেকেই ছিলেন। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ‘কালচারের লড়াই’ (১৯৩০) বলে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরী বিদ্যাবিনোদ কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জীবন-চরিত থেকে একটি উদ্ধৃতি দেন।তাতে লেখা : ‘ফির্দ্দোসি, সাদি, ওমর খৈয়াম, জামি, জালাল উদ্দিন রুমী প্রভৃতি পারস্যের বাণীপুত্রগণও তাঁহার সথা ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র বাহ্যিক আচারে হিন্দু হইলেও অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে তিনি ভক্ত সুফী হইয়া উঠিয়াছিলেন।

দুই পক্ষেই এটা ঘটেছিল। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘পারস্য প্রতিভা’ গ্রন্থে মুক্তবুদ্ধির চিন্তাবিদ মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্ ইসলামী ধারায় সুফীমতের গুরুত্ব বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরেছিলেন। তিনি এ-ও দেখিয়েছিলেন যে কোরআনের শিক্ষার সাথে উপনিষদের ব্রক্ষ্মসূত্রের ‘সুন্দর ঐক্য’ রয়েছে : ‘বেদান্তের সহিত সুফীমতের প্রধান সাদৃশ্য _ এ উভয়ই শুধু একেশ্বরবাদ নহে অধিকন্তু উভয়ের চৈতন্যে বিশ্বাসী অদ্বৈতবাদ।’ পারস্যে যাত্রার আগে ‘পারস্য প্রতিভা’ বইটি রবীন্দ্রনাথের হাতে পেঁৗছেছিল কিনা জানি না, তবে সন্দেহ নেই। অবশ্য বরকতুল্লাহ্র যুক্তির সাথে পরবর্তী সময়ে আহমদ শরীফের বিশ্লেষণে সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি ‘বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য’ গ্রন্থে পারস্যের সুফীমতকে দ্বৈতবাদীদের দলে ফেলেছেন : ‘কুফায়াকুল’ দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে ‘একোহম বহুস্যাম’ অদ্বৈতবাদ নির্দেশক। সুফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী, কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিণামে অদ্বৈত সত্ত্বার প্রয়াসে। সুফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরনের কাঙালি।… সুফীমতবাদের সাথে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যান্তিক সাদৃশ্য ও আচারিক মিল।’ আমাদের পক্ষে এসব গূঢ় তত্ত্বালাপের মর্মার্থ বোঝা সহজ নয়। কিন্তু যেটা লক্ষ্য করার_ তা হলো বিভিন্ন ধর্মের ও দর্শনের মধ্যে ‘সংঘাত যতটা, মিলের বা দেওয়া-নেওয়ার প্রবণতাও ইতিহাসে ততটা কম নয়। এই ‘মিলের ইতিহাস’ লিখতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পারস্যবাসী মরমী বন্ধুদের পাশাপাশি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সুফীতত্ত্বের স্থানীয় বিকাশের প্রসঙ্গ চলে আসবে। হাফেজকে যে বাংলার শাসক একবার বেড়িয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন, তা এমনি এমনি নয়_ তার পেছনে সভ্যতার সংলাপের সাংস্কৃতিক তাগিদও কাজ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের একাধিক বক্তৃতায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই তাগিদ থেকেই। ১৯১৫ সালে মুসলমান ঘরে জন্ম নেওয়া কিন্তু সন্ত রামানন্দের শিষ্য কবীরের কবিতার ইংরেজি তর্জমা প্রকাশের উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ। এর আগে ও পরে আর কেউই কবীরের কবিতা অনুবাদে প্রবৃত্ত হননি বস্তুত। বেদান্ত, সুফীবাদ বৈষ্ণব ও বাউল ভাবের দর্শনের সাথে কবির একান্ত ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার একটি অলিখিত ইতিহাস রয়ে গেছে আজ অবধি। অন্ধ অনুসরণের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি অনীহা থেকেই রবীন্দ্রনাথ এটা করেছিলেন। কবীরের ইংরেজি তর্জমার ভূমিকায় কবীর সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক এভলিন আন্ডারহিল লক্ষ্য করেন যে, কবীরের গানে পারস্য মরমী কবিদের (আত্তার, সাদি, রুমি, হাফেজ) গভীর প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন ধারার ও ধর্মের মরমী দর্শনের মধ্যে অনায়াস যাতায়াত ছিল কবীরের। এভলিনের একথাটি রবীন্দ্রনাথের নিজের ক্ষেত্রেও খাটে। তাঁর ‘মনের মানুষ’-এর ধারণাটি কোন বিশেষ ধর্মের বা ঘরানার মধ্যে পড়ে না। এর মধ্যে নানা ধর্মের মরমীবাদের ছায়ামতি ঘটেছে যেমন, নিজস্ব ধর্ম নিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী চিন্তারও প্রভাব পাই। কিন্তু তা ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে নিজস্ব একান্ত মরমী ভাবাদর্শকে তিনি কখনো প্রয়োগ করতে চাননি। জানতেন, এতে করে মরমী দর্শন ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা কোনো অংশেরই কল্যাণ সাধন হবে না। মরমীবাদে ব্যক্তিজীবনে ধ্যানকেন্দ্রী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাকে রেখেছিলেন নিরঙ্কুশ ধর্মনিরপেক্ষতায়_ ইহজাগতিকতার চৌহদ্দিতেই। যখন সুফী-সাধক বলে নিজেকে পরিচিত করাচ্ছেন তখনও পারস্যের বিদ্বৎ সমাজকে জানাতে ভোলেননি যে, তিনি ইউরোপের আধুনিকতারও সমঝদার। ইউরোপের যা সভ্যতা তা গ্রহণ করতে হবে।

৪. অন্ধ ধর্মাচারের বোঝা
সভ্যতার সংঘাত-তত্ত্বের বয়ান করে হান্টিংটন নবপর্যায়ে পাশ্চাত্যের কূটনীতির মূল অভিপ্রায়কে ব্যক্ত করেছিলেন মাত্র। কিন্তু সংঘাত-তত্ত্বের দায়দায়িত্ব প্রাচ্যও এড়াতে পারে না। অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের ও মিথ্যে ধর্মাচারের দৌরাত্ম্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নানা লেখায়, প্রবন্ধে ও চিঠিপত্রে আক্ষেপ করেছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস ক্রমশ একটি খাদের দিকে গড়িয়ে চলছিল, এ কথা তিনি জানতেন। ধর্ম-বিভক্ত সমাজে কী করে সত্যিকারের ধর্মবোধ জাগ্রত হতে পারে সার্বিক মানবকল্যাণকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে এর জন্য তিনি দেশে-বিদেশে শুভ দৃষ্টান্ত খুঁজে বেড়াতেন। তুরস্কের কামাল আতার্তুক মোল্লাতন্ত্রকে বশে এনেছেন বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “কামাল পাশা বললেন মধ্যযুগের অচলায়তন থেকে তুরস্ককে মুক্তি নিতে হবে। তুরস্কের বিচার বিভাগের মন্ত্রী বললেন : মেডিয়াভেল প্রিন্সিপলস্ মাস্ট গিভ ওয়ে টু সেক্যুলার ল’স। উই আর ক্রিয়েটিং আ মডার্ন, সিভিলাইজড্ নেশন।” মধ্যযুগের শাসন থেকে তুরস্ককে বেরিয়ে আসতে হবে, কেননা ‘পরিপূর্ণভাবে বুদ্ধিসঙ্গতভাবে প্রাণযাত্রা নির্বাহে বাধা দেয় মধ্যযুগের পৌরাণিক অন্ধ সংস্কার’। এর জন্য প্রয়োজনে যেন কিছুটা বল প্রয়োগেও কবি প্রস্তুত : ‘আধুনিক লোক ব্যবহারে’ মধ্যযুগের অন্ধ সংস্কারের প্রতি ‘নির্মম হতে হবে’ এই ছিল কামাল পাশার অনুসারীদের ঘোষণা। অন্যদিকে ইরানের রেজা শাহ ছিলেন কসাক সৈন্য দলের অধিপতি মাত্র, বিদ্যালয়ে ‘য়ুরোপের শিক্ষা তিনি পাননি’, এমনকি ‘পারসিক ভাষাতেও তিনি কাঁচা’। এসব বলার পর প্রশস্তির সুরে বললেন, ‘আমার মনে পড়ল আমাদের আকবর বাদশাহের কথা। কেবল যে বিদেশির কবল থেকে তিনি পারস্যকে বাঁচিয়েছেন তা নয়, মোল্লাদের আধিপত্য জালে দৃঢ়বদ্ধ পারস্যকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রতন্ত্রকে প্রবল ও অচল বাধা থেকে উদ্ধার করেছেন।’ কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক, রেজা শাহ্র ইরান তার পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে তা বেশ বোঝা যায়।

আর উপমহাদেশ? হাফেজের সমাধি যেখানে সেখানকার গভর্নরকে কবি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জটিল ধর্মের পাকে আপাদমস্তক জড়িভূত’ যে ভারতবর্ষ তার মুক্তি আসবে কীভাবে? উত্তরে গভর্নর বললেন, ‘সাম্প্রদায়িক ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে যতদিন না ভারত একাত্ম হবে’ ততদিন এই সমাজের নিষ্কৃতি নেই। রবীন্দ্রনাথ তারপর আক্ষেপ করে বলছেন, ‘অন্ধ আচারের বোঝার তলে পঙ্গু আমাদের দেশ, বিধিনিষেধের নিরর্থকতায় শতধাবিভক্ত আমাদের সমাজ।’ হাফেজের সমাধিতে যখন গেছেন, দেখলেন সমাধিরক্ষক একখানি বড় চৌকো আকারের বই এনে উপস্থিত করল। সেটা ছিল হাফেজেরই একটি কাব্যগ্রন্থ। এ সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে বিশ্বাস ছিল যে, কোনো একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বুঝে এই গ্রন্থ খুলে যে কবিতাটি বেরোবে তার থেকেই বোঝা যাবে সে ইচ্ছাটি সফল হবে কিনা। রবীন্দ্রনাথ সে বইয়ের পাতা খোলার আগে চোখ বুজে মনে মনে ইচ্ছা করলেন, ‘ধর্ম নামধারী অন্ধতার প্রাণান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়।’ এর বছর পনেরোর মধ্যেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ও দেশান্তরের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারতবর্ষ’। হিন্দু ও মুসলমান এ দুই সম্প্রদায় নিয়ে এক ‘মহাজাতি’ গঠনের স্বপ্ন ছিল তাঁর। ১৯৪৭-এর দেশভাগ সে ক্ষেত্রে তাঁর স্বপ্নের বিপরীতে হলেও হয়তো তারপরও পুরোপুরি হতোদ্যম হতেন না তিনি। ঘরের বিবাদ অহর্নিশি চলার চেয়ে ঘর ভাগ হওয়াই ভালো।

‘পারস্য যাত্রী’র একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে এশিয়ার নবজাগরণের বা রেনেসাঁর কথা। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এশিয়া জাগছে এবং প্রতিটি দেশেই এই জাগরণপর্ব চলছে যার যার মতো করে। রবীন্দ্রনাথ কায়মানোবাক্যে চেয়েছেন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার পাশাপাশি প্রাচ্যও উঠে দাঁড়াক : ‘এ কথা বলা বাহুল্য যে, এশিয়ার প্রত্যেক দেশ আপন শক্তি প্রকৃতি ও প্রয়োজন অনুসারে আপন ঐতিহাসিক সমস্যা স্বয়ং সমাধান করবে… তাই আমি এই কামনা ঘোষণা করি যে, আমাদের মধ্যে সাধনার মিলন ঘটুক। এবং সেই মিলনে প্রাচ্য মহাদেশ মহতী শক্তিতে জেগে উঠুক_ তার সাহিত্য, তার কলা, তার নূতন নিরাময় সমাজনীতি, তার অন্ধসংস্কারমুক্ত বিশুদ্ধ ধর্মবুদ্ধি, তার আত্মশক্তিতে অবসাদহীন শ্রদ্ধা’ নিয়ে। এশিয়ার এই নবজাগরণের তালিকার মধ্যে যেমন ছিল দূরপ্রাচ্যের জাপান ও চীন, তেমনি ছিল নিকট মধ্যপ্রাচ্য। পশ্চিম এশিয়ার নব-আন্দোলিত মুসলমান সমাজের এক বড় ধরনের উত্থানের প্রতীক্ষা করছিলেন কবি। তিনি জানতেন মিসর, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান প্রভৃতি দেশের প্রাগ্-ইসলামি ঐতিহ্য এবং ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগের বিবরণী। আব্বাসীয় আমলের সুশাসন, বিজ্ঞান-সাধনা ও শিল্পকলা তাঁকে বিমোহিত করেছিল। বা তারও আগের সম্রাট দরিয়ুসের রেখে যাওয়া ভগ্নাবশেষের সাথে মোয়েনজো দারেরি সমসাময়িক সভ্যতার মিল খুঁজে পেয়ে রোমাঞ্চ অনুভব করেছেন। দরিয়ুসের গ্রন্থাগার ধ্বংস করে দিয়েছিলেন আলেকজান্দার_ সেই গ্রন্থাগারে বহু সহস্র চর্মপত্র রক্ষিত ছিল। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাও ছিল। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাও ছিল। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আলেকজান্দার আজ জগতে এমন কিছুই রেখে যাননি যা এই পার্সিপোলিসের ক্ষতিপূরণস্বরূপে তুলনীয় হতে পারে।’

পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা এশিয়ার এই নবজাগরণকে যেমন বাধাগ্রস্ত করতে পারে, তেমনি শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সাম্প্রদায়িক ধর্মবুদ্ধি বা ভেদবুদ্ধি। এশিয়াকে জাগতে হলে এর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতেই হবে, কেননা ‘সাম্প্রদায়িক ধর্মবুদ্ধি মানুষের যত অনিষ্ট করেছে এমন বিষয়বুদ্ধি করেনি। বিষয়াসক্তির মোহে মানুষ যত অন্যায়ী, যত নিষ্ঠুর হয়, ধর্মমতের আসক্তি থেকে মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়ভ্রষ্ট, অন্ধ ও হিংস্র হয়ে ওঠে। ইতিহাসে তার ধারাবাহিক প্রমাণ আছে।’

এ ক্ষেত্রেই শুভ দৃষ্টান্ত হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার কথা মনে এলো তাঁর : ‘নবযুগের আহ্বানে পশ্চিম এশিয়া কী রকম সাড়া দিচ্ছে সেটা স্পষ্ট করে জানা ভালো। খুব বড় করে সেটা জানবার এখনও সময় হয়নি। … কিন্তু সত্য ছোটো হয়েই আসে। সেই সত্য এশিয়ার সেই দুর্বলতাকে আঘাত করতে শুরু করেছে যেখানে অন্ধসংস্কারে, জড় প্রথায়, তার চলাচলের পথ বন্ধ। এ পথ এখনও খোলসা হয়নি, কিন্তু দেখা যায় এই দিকে তার মনটা বিচলিত।’ কী সেই সত্য? ‘এশিয়ার নানা দেশেই এমন কথা উঠেছে যে, সাম্প্রদায়িক ধর্ম মানবের সকল ক্ষেত্রজুড়ে থাকলে চলবে না।’ অর্থাৎ ধর্মাচরণ থাকবে কেবল কিছু নির্দিষ্ট এলাকায়_ সর্বত্র নয়; এবং রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য মানলে, রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তো নয়ই। রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অবিমিশ্রভাবে সেক্যুলারিজমের সমর্থক।

৫. সভ্যতার সংলাপ
‘পারস্য-যাত্রী’ গ্রন্থটি খুঁটিয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যের সমাজে নবজাগরণের সংকেতের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদের সাথে ‘সংলাপ’-এর তাগিদ অনুভব করা যায়। রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করেছেন। আবার ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে মুক্তি খুঁজেছেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের বাইরে। সেখানে তিনি ব্যক্তিগত ধর্মীয় মূল্যবোধকে (যা ছিল ‘মিশ্র’ চরিত্রের) সাহসের সাথে লালন ও ক্রমবিকশিত করেছেন। খ্রীস্টিয় ইউরোপ এনলাইটেনমেন্ট-এর পর্ব পেরিয়েও যেমন যুক্ত হতে পারেনি বিশ্ব মানবতাবাদে, ধর্মাশ্রিত প্রাচ্যও তেমনি উপনীত হতে পারেনি মানবকল্যাণমুখী, ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের উদার জমিনে। এদিকটি রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। ‘পারস্য-যাত্রী’ রচনার কালে যেমন, আজকের দিনেও ‘কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্ম ধর্মের বিশুদ্ধ প্রাণতত্ত্ব নিয়ে টিকে নেই’ _ কি পাশ্চাত্যে, কি প্রাচ্যে। আমরা ভুলে যাই, ‘যে সমস্ত ইটকাঠ নিয়ে সেই সব সম্প্রদায়কে কালে কালে ঠেকো দিয়ে দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে তারা সম্পূর্ণ অন্য কালের আচার বিচার প্রথা বিশ্বাস জনশ্রুতি।’ আজকের দিনে হলে এ কথা লেখার জন্য রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার মামলা উঠত। কটূক্তির কারণে তাঁর শিলাইদহের-সাজাদপুরের-পতিসরের বাড়িতে আক্রমণ পর্যন্ত হতে পারত একদল ধর্মোন্মাদের দ্বারা। অন্যত্র পড়ি, ‘আরব পারস্যকে ধর্ম দিয়েছে’, বিনিময়ে পারস্য তার শিল্পগুণ দিয়ে ইসলামকে আরো ‘ঐশ্বর্যশালী’ করেছে। এক জায়গায় এ মন্তব্যও করেছেন, ‘মাদুরার মন্দির, ইস্পাহানের মসজিদ এসব প্রাচীনকালের অস্তিত্বের দলিল _ এখনকার কালকে, যদি সে দখল করে তবে তাকে জবরদখল বলব।’ এ কথা বলার জন্য এ যুগে তাঁর বিচার দাবি করতেন নিশ্চয় কেউ কেউ। কেননা ঊনিশ-বিশ শতকের গোড়ার দিককার অসহিষ্ণুতার চেয়ে একবিংশ শতকের সূচনা-পর্বে এসে ধর্ম_ প্রসঙ্গে অসহিষ্ণুতার মাত্রা দক্ষিণ এশিয়ায় আরো বেড়ে গিয়েছে। সমাজতাত্তি্বক আশিস নন্দী একথা আক্ষেপ করে বলেছিলেন। হাফেজের সমাধিতে গিয়ে যে-রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁকে এ রকম তিরস্কারের গ্গ্নানি এর আগেও অবশ্য অনেকবার সইতে হয়েছে। হাফেজকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, মনে মনে, ‘আমরা দু’জনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারেনি… নিশ্চিত মনে হলো, আজ কত শত বৎসর পরে জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’ পারস্য থেকে ফিরে গিয়ে ১৯৩৩ সালে স্পষ্ট করে বলেছেন মনের কথাটা : ‘আমার স্বভাবে এবং ব্যবহারে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব নেই’, দুই পক্ষেরই অত্যাচারে ‘আমি সমান লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হই’। অথচ পরস্পরকে বাদ দিয়ে এদের এক পা চলারও উপায় নেই। পারস্য-যাত্রীতে কথাটা উপমা দিয়ে বলেছেন : ‘এই দুই বিপরীতধর্মী সম্প্রদায়কে নিয়ে আমাদের দেশ। এ যেন দুই যমজ ভাই পিঠে পিঠে জোড়া; একজনের পা ফেলা আর-একজনের পা ফেলাকে প্রতিবাদ করতেই আছে। দুইজনকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করাও যায় না, সম্পূর্ণ এক করাও অসাধ্য।’ এক্ষেত্রে মিল আসবে তখনই যখন ‘বিভিন্নতাকে’ শক্তি বলে জানব। বিভিন্নের মধ্যেকার সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিধি নিষেধের বেড়াগুলো ভেঙে যাবে। যতদিন তা না হয়; ততদিন বিভিন্নের মধ্যে ‘সংলাপ’ চলুক – সংঘাতকেই বড় করে দেখা না যেন হয়। এ-ই ছিল রবীন্দ্রনাথের দাবি আমাদের কাছে।

১৯৭৯ সালের ‘ইসলামি বিপ্লবে’র পর খোমেনী-উত্তর ইরানে অনেক নাটকীয়ও বিতর্কিত পরিবর্তন এসেছে গত তিন দশকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতি পারস্যের অনুরাগ যেন এখনো অটুট। ২০১১ সালের ২৯ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকীতে ইরানের পার্লামেন্টে (মজলিস) উন্মোচন করা হয়েছে তাঁর স্মরণে একটি প্রস্তরফলক। তাতে উৎকীর্ণ তাঁর ‘পারস্যে জন্মদিনে’ কবিতাটি এবং তাঁর একটি চমকপ্রদ প্রতিকৃতি। প্রায় একই সময়ে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে। রক্ষণশীলতার কোনো কুযুক্তি এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রেজা শাহ্র ইরানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এ তথ্য জানার পরও ‘বিপ্লবী’ ইরানের কাছে রবীন্দ্রনাথের সমাদর একটুকু কমেনি। এক্ষেত্রে ইরানের ইসলাম তার অন্তরের শক্তিরই প্রমাণ দিয়েছে! এক্ষেত্রে শিয়া-সুন্নী পারস্য-আরব এ ধরণের বিভাজন রেখা টেনে ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা হবে পণ্ডশ্রম। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য নানা সভ্যতার মধ্যে ‘সংঘাত’ যেমন, ‘সংলাপ’ও চলছে একই সাথে।

পারস্যে রবীন্দ্রনাথকে সম্মাননা দেওয়ার সময় বসরার গভর্নর শেখ সাদির একটি কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন। কবিতাটির অংশবিশেষ রবীন্দ্রনাথের হাতে অনূদিত হয়ে ‘পারস্য-যাত্রীর’ পরিশিষ্টে সংকলিত হয়েছে। চতুষ্পদীটি এ রকম :

‘হায় মানুষ! এই জগৎটা শুধু দৈহিক অহং-এর পুষ্টির জন্য নয়;
যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাওয়া বড়োই কঠিন;
ভোরের পাখির সুরলহরী নিদ্রিত মানুষ জানে না
মানুষের জগৎটা যে কী, তা পশু কেমন করে জানবে!’

Original post on Samakal here.