আকবর আলি খানের রচনাকর্ম

আকবর আলি খান বহুমাত্রিক সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। সাধারণত দুই ধরনের সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ দেখা যায়। একদল নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডিতেই বিচরণ করতে ভালোবাসেন, তাঁদের আমরা স্পেশালিস্ট বলি। আরেক দল আছেন, তাঁরা নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে আরও বহুবিধ ক্ষেত্রে উৎসাহ দেখান, বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। আকবর আলি খান ছিলেন দ্বিতীয় ধারার সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসাহ প্রসারিত হয়েছিল বনলতা সেন থেকে দারিদ্র্য বিশ্নেষণ অবধি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশিষ্টতা খোঁজার পাশাপাশি পরার্থপরতার অর্থনীতি অনুসন্ধান, সুশাসন সম্পর্কিত ফ্রেন্ডলি ফায়ার বইটি থেকে আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। তবে বহুবিধ বিষয়ে বিচরণ করলেও, তিনি প্রথমত ও প্রধানত ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। ইতিহাসচিন্তা তাঁর সমাজচিন্তাকে ধারণ করেছে। তাঁর অর্থনৈতিক বিশ্নেষণকে সমৃদ্ধ করেছে। এসবই জানা কথা। আমি এখানে কয়েকটি বইয়ের সূত্রে, যে সুবাদে আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা করার, সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলব।
১. নেশনের প্রাক-ইতিহাস
প্রথমেই আসি তাঁর সবচেয়ে মৌলিক ও সুবিদিত কারণে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ডিসকভারি অব বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বইটির শিরোনাম শুনে পাঠকমাত্রেরই মনে পড়তে পারে ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া শীর্ষক জওহরলাল নেহরুর বইটির কথা। জওহরলাল নেহরু লিখিত বইটি ছিল মূলত বর্ণনামূলক এবং সময়ের ধারাবাহিকতাকে ধরার চেষ্টা। পক্ষান্তরে আকবর আলি খানের ডিসকভারি অব বাংলাদেশ মূলত বিশ্নেষণাত্মক এবং তাঁর অভিনিবেশ ছিল- কী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণ করা যায়।
বাংলাদেশ বা পূর্ববঙ্গকে ঘিরে যে ভূখণ্ড বা তার অধিবাসী যারা, তাদের যে বৈশিষ্ট্য, তা তাদেরকে ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা করে। শুধু তাই নয়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড-ভূগোলের অধিবাসীদের থেকেও তাদের বিশিষ্ট করে। সেই বিশিষ্টকরণের সূত্র খুঁজছিলেন আকবর আলি খান। সেদিক থেকে এটি একটি চমৎকার পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণজাত গবেষণা গ্রন্থ। এখানে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল কয়েকটি। একটি হচ্ছে- এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতার দিক কী কী। তিনি সেই ক্ষেত্রে দেখেছিলেন- এই ভূখণ্ড লেস রেজিমেন্টেড, কম শৃঙ্খলাবদ্ধ। তিনি যেটা বলেছেন, বাংলাদেশের গ্রাম হচ্ছে ওপেন জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। এর বিপরীতে উত্তর ভারতীয় গ্রামগুলোকে বলেছেন ক্লোজড জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। সেই সমস্ত গ্রামে ঢুকতে গেলে একটা সীমানা প্রাচীর পেরোতে হয়। বাউন্ডারি দেওয়া। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের তুলনাতেও বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে মনে হয়েছে, সেগুলো অনেক ছড়ানো ছিটানো। সেখানে অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে, ফাটল রয়ে গেছে। তিনি বলছেন, এর কারণ বোধকরি এই যে, এই গ্রামগুলো কোনো সবল ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর কখনও ছিল না বা মাথা নত করেনি। বরং অন্যান্য জায়গা থেকে অত্যাচারিত বা এক্সক্লুডেড হয়ে যারা এই ভূখণ্ডে এসেছে, তারা সহজে আশ্রয় নিতে পেরেছে। জিওগ্রাফির সঙ্গে সোশ্যাল এক্সক্লুশন এবংপলিটিক্যাল ইসলামের একটি আন্তঃসংযোগ তিনি স্থাপন করেছেন। এই সূত্রে তিনি আরও লক্ষ্য করেন, ইসলাম যে এই পূর্ববঙ্গে একাদশ শতক থেকে বিস্তার লাভ করেছিল, তার পেছনে মূলত কোন কোন উপাদান কাজ করেছে। এ নিয়ে আলাদা করে তাঁর আরেকটি বই বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। যার নাম ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য :একটি ঐতিহাসিক বিশ্নেষণ’।
সেখানে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য ছিল- অসির বলে ইসলাম প্রচারিত হয়নি। তখনকার যুগে বাংলার, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনপদ বলে কিছু ছিল না। এটি ছিল মূলত প্রত্যন্ত এলাকা, যেটিকে এগ্রারিয়ান ফ্রন্টিয়ার বলেছেন তিনি। এক কথায়- জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের শুরুতে আমরা যে রকম বর্ণনা পাই :জঙ্গলাকীর্ণ একটি ভূখণ্ড এবং সেখানে মূলত যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বা নির্যাতিত অথবা সহায়সম্বলহীন, মরিয়া- ডেসপারেট, সেই জনগোষ্ঠীই কেবল বাস করতে উৎসাহী হবে। এই ডেসপারেট জনগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গের তুলনামূলক অনগ্রসর, বিপৎসংকুুুল, জঙ্গলাকীর্ণ, নদীপরিকীর্ণ, শ্বাপদসংকুুল এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের জীবনধারণের জন্য বসবাসের স্বার্থে সেই জঙ্গল কেটে জনপদ গড়েছে। এই বন কেটে বসত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন একাধারে ধর্মীয় ও কৃষক নেতা। এই কৃষকদের জন্য যাঁরা বাঁচার লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের মধ্যে পুরোভাগে ধর্মীয় নেতারা ছিলেন। সেই সুবাদে ইসলাম এখানে সহজে বঞ্চিত, অন্ত্যজ, এক্সক্লুডেড মানুষের মাঝে আসন গাড়তে সক্ষম হয়। এই ব্যাখ্যাটি রিচার্ড ইটন আদিতে দিয়েছিলেন তাঁর দ্য রাইজ অব ইসলাম-এ দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার গ্রন্থে। কিন্তু এখানে আকবর আলি খান কিছু কারেক্টিভ এনেছেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় মাজারের কনসেনট্রেশন সম্পর্কিত ম্যাপ তৈরি করে দেখিয়ে বলেছেন- সর্বত্র কিন্তু পীর-আউলিয়ার সমাবেশ এক রকম ছিল না। তারপরও ইসলামের ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে। সুতরাং এটা শুধু পেজেন্ট কাম রিলিজিয়াস লিডারশিপের ব্যাপার ছিল না। এটার আরেকটা কারণ ছিল- ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে যাঁরা এই ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে নতুন ধর্ম ও রীতি অভ্যাসের ভলান্টারি অ্যাডাপটেশন। অনেকটা পুশ-পুল ইফেক্টের মতো দুটি দিকই এখানে কাজ করেছে।
ওই বইতে আকবর আলি খান আরেকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, কেন আমাদের দেশে বৃহৎ অর্গানাইজেশন, সোশ্যাল অর্গানাইজেশনগুলো সফল হয় না। কেন আমাদের দেশে স্তালিনীয় কায়দার সুশৃঙ্খল দল দাঁড়ায় না। কেন আমাদের দেশে বড় যেসব উদ্যোগ আমরা নিতে চাই, সেগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাঁর ধারণা, যে কারণে আমরা অপেক্ষাকৃত মুক্তগ্রাম, মুক্তসমাজ এবং অন্যকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী (যার একটি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গাকে আমরা অতি স্বল্প সময়ে আশ্রয় দিতে পেরেছি); এসব যেমন আমাদের শক্তির দিক, তেমনি আমাদের দুর্বলতার দিক হচ্ছে- আমরা কারও একক নেতৃত্ব বা লিডারশিপের ধার ধারি না। এর ফলে আমাদের ভেতর একটি সেন্ট্রিফিউগাল টেন্ডেন্সি (কেন্দ্রবিমুখী প্রবণতা) সৃষ্টি হয়। আমাদের সমাজ সংগঠনে একটি অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
তাঁর উত্তর হচ্ছে, এই ধরনের সমাজ-মানসিক কাঠামোয় সেই ধরনের অর্থনৈতিক সংগঠন বেশি কার্যকর হবে, যেখানে ইন্ডিভিজুয়ালিজম, ব্যক্তি উদ্যোগ বা স্বল্প পরিসরের গ্রুপ-উদ্যোগগুলো কাজ করবে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি দেখালেন, আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে দ্রুততম সময়ে ব্যক্তিখাত গড়ে উঠল, বিকাশপ্রাপ্ত হলো। এক কথায় বলতে গেলে মার্কেট লিবারেলিজমের পক্ষে একটা সোশিওলজিকাল আর্গুমেন্ট তিনি উপস্থাপন করলেন। আরেকটি উদাহরণ তিনি দিলেন, কেন গ্রামীণ ব্যাংক বা ব্র্যাকের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো এখানে সফল হলো। কেননা এগুলোর দল সংখ্যা মূলত পাঁচ থেকে দশ, ঊর্ধ্বে ত্রিশ। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরের অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো এই অঞ্চলে কাজ করতে বেশি সক্ষম বা কাজে বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা। তিনি আরও একটি যুক্তি সেখানে দিলেন, সেটি হচ্ছে- অ্যাগ্রো ইকোলজিকাল আর্গুমেন্ট। তিনি বললেন, দক্ষিণ ভারত বা পশ্চিম ভারতে যেখানে অপেক্ষাকৃত শুস্ক মৌসুমি এলাকা, যেখানে মূলত সারফেস ওয়াটার-নির্ভর সেচ ব্যবস্থা করতে হয় কৃষিকাজের জন্য, সে ক্ষেত্রে কৃষকদের রাষ্ট্রের ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভর করতে হয়। এই কারণে ওইসব এলাকায় আমরা ক্যানাল ইরিগেশন (খাল খনন) সিস্টেম পাই, আমরা হাইড্রোলিক সভ্যতার (জলকেন্দ্রিক সভ্যতা) নিদর্শন পাই। এর বিপরীতে আমরা যখন পূর্ব বাংলায় আসি, দেখি যে নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে এখানে গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশন অপেক্ষাকৃত সফলতা পায় এবং গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশনের মধ্যেও সেখানে ডিপ টিউবওয়েলের চাইতে দেখতে পাই শ্যালো টিউবওয়েল উদ্যোগের ছড়াছড়ি।
এক কথায় বলতে গেলে, আকবর আলি খানের ইতিহাসচর্চার মধ্যে পূর্ববঙ্গের বৈশিষ্ট্য খোঁজার ক্ষেত্রে তিনি অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, ইকোলজি, প্রযুক্তি, মানুষের মনস্তত্ত্বসহ বিভিন্ন ছড়ানো ছিটানো ফ্যাক্টটরকে একত্রে সন্নিবেশিত করতে পেরেছেন। এজন্য তাঁর বিচার-বিশ্নেষণগুলো অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে।
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে বলে রাখি, তিনি ভূমিকাতে আরও একটি কথা বলেছিলেন। তাঁর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করা। পরবর্তী সময়ে তিনি আমাকে একান্তেও বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মাল্টিপল থিয়েটারে হয়েছিল। মঞ্চের এক অংশের ওপর যদি কেবল আলোকপাত করা হয়, তাহলে ভুল হবে। একই সময়ে অন্য থিয়েটারগুলোতেও সেই নাটকের অন্যান্য অংশ অভিনীত হচ্ছিল। সে কারণে ওই ধরনের কম্প্রিহেনসিভ হিস্ট্রি লেখার জন্য যে ধরনের পরিশ্রম, যে ধরনের কালেক্টিভের সমবেত সাধনার প্রয়োজন, সেটি নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব হবে বলে তিনি দেখছেন না। বিশেষত সমসাময়িক রাজনীতির বাদানুবাদের কারণে; তাঁর ভাষায়- ডিউ টু কনটেম্পরারি পলিটিকাল স্কোয়াবলস। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি বসে না থেকে যেটি করতে পারেন সেটি হচ্ছে- এই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ইতিহাসের একটি প্রাক-ইতিহাস রচনা করা। ডিসকভারি অব বাংলাদেশের যে উন্মোচন, সেটি প্রাক-ঐতিহাসিক ন্যারেটিভের একটি নিদর্শন।
বইটি আমাকে এত বেশি আকৃষ্ট করেছিল যে আমি বইটির শুধু একটি বুক রিভিউ নয়, একটি রিভিউ আর্টিকেল রচনা করি। সেটি একটি গবেষণাধর্মী জার্নাল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। সেখানে আকবর আলি খানের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আমি কিছুটা বাহাস করার চেষ্টা করি। কিছু কিছু অভিযোগ আমি সেখানে এনেছিলাম। যেমন আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম- তিনিও বঙ্কিমের মতো আমাদের বলছেন- বাঙালির ইতিহাস নাই, এই ইতিহাস কে লিখিবে, আমি লিখিব তুমি লিখিবে; সেই রকম একটি জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার উৎসাহে তিনি এই বইটি লিখলেন কিনা? কেননা আমরা যদি দুইশ-তিনশ বছর আগে যাই, সেখানে তো ন্যাশনালিজমের- এজ আ পলিটিকাল কনসেপ্ট- কোনো স্ম্ফুরণ দেখি না। এটি তো অনেক পরের ঘটনা। রেনাঁ এবং তাঁর পরবর্তী যাঁরা পলিটিকাল ন্যাশনালিজমের প্রবক্তা, তাঁদের সময়ের ঘটনা। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে। আমার আপত্তি ছিল এই বইয়ের সাবটাইটেলে। সাবটাইটেল ছিল- এক্সপ্লরেশনস ইনটু ডাইনামিকস অব এ অব হিডেন নেশন। উনি যেটাকে হিডেন ন্যাশনালিজম বলছেন, সেটাকে ফর্মুলা হিসেবে নিলে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তা হলো, আমরা এই রকম হিডেন ন্যাশনালিজমের উৎস সন্ধানে চর্যাপদ বা তারও আগে পিছিয়ে যেতে পারি। আর এতে করে ইতিহাসের নিয়মের বরখেলাপ হয় কিনা? তদুপরি আমি কিছুটা রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম গ্রন্থের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের সমস্যাটাকে বড় করে দেখেছিলাম। জাতীয়তাবাদকে এজ এ কনসেপ্ট- স্বয়ম্ভু, অ্যাবসোলুট, অবশ্যপালনীয় কনসেপ্ট হিসেবে অন্তত তখন পর্যন্ত মনে করিনি।
জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে তাঁর একটি প্রধান বক্তব্য ছিল- জাতীয়তাবাদ শুধু একটি মাত্রায় গড়ে ওঠে না। সেখানে ভৌগোলিক এবং আদর্শিক- এই দুটো মাত্রাতেই প্রভাব আসে। এবং আকবর আলি খান পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে দেখেছেন- এখানে ফেইথ মূলত ইসলাম হলেও, নানা ধরনের সংকর বিশ্বাসের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে ফেইথের মধ্যেও অনেক রকমের বৈচিত্র্য এসেছে। অন্যদিকে আবার আমাদের ভৌগোলিক কিছু অভিন্নতার কারণে, নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে, বন্যা-ঝড় এসব প্রাত্যহিক উপদ্রবের কারণে আমাদের কতগুলো জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। কতগুলো সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এখানে আমরা দেখতে পাই, যেগুলো আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের যে পিউরিটি, তার পাশাপাশি ভৌগোলিক ইমপিউরিটির সঙ্গে মিলেমিশে মিথস্ট্ক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশ্বাস ও বসতি- এই দুই উপাদান মিলে এমন একটি জাতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পূর্ববঙ্গে, যেটি অন্য কোনো ভূখণ্ডের সঙ্গে মেলে না। কারণ তারা এ দেশের মতো এতটা পরিমাণে নদীনির্ভর দেশ নয়, যতটা পরিমাণে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা ঝড়-বাদল ও নদীর ওপরে নির্ভরশীল। এটিও জাতীয়তাবাদের বিচার-বিশ্নেষণের ক্ষেত্রে তাঁর একটি অনন্য অ্যাপ্রোচ।
এক অর্থে, যদিও এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক পুরোপুরি নয়, তবু না মনে করে পারছি না, আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও যখন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিতে সংসদে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন- আমার চোখে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাংলার মাটি, জল, নদী, আকাশ। এর বেশি আপনারা আর সংজ্ঞায়িত করতে যাবেন না। গেলেই বিপদ বাধবে। আরও বেশি ঠোকাঠুকি হবে। বঙ্গবন্ধু একটা পর্যায়ে বুঝেছিলেন যে, জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করতে গেলেই বিপদের সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে একটু এমবিগু্যয়াস এবং ইকোলজিকাল ফ্রেমে দেখলে অনেক বেশি নিরাপদ উপস্থাপনা হয়। আকবর আলি খানও অনেকটা এই আলোকেই বারবার জোর দিয়েছেন ফেইথ ও হ্যাবিট্যাটের মিথস্ট্ক্রিয়ার ওপরে। বিশ্বাস ও বসতির পারস্পরিক প্রভাব সমুচয়ের ওপরে।
২. স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতার অর্থনীতি
আকবর আলি খানের দ্বিতীয় বইটি ছিল পরার্থপরতার অর্থনীতি নিয়ে এবং নামেই এর বৈচিত্র্যের পরিচয়। আমরা জানি, আমাদের সনাতন অর্থনীতি মূলত স্বার্থপরতার অর্থনীতি। কেননা তার প্রথম সবকই হলো- এডাম স্মিথের অনুসরণে- মানুষ যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে, সেটি তার নিজস্ব স্বার্থ দ্বারা প্ররোচিত হয়েই করে। কিন্তু বাজার অর্থনীতির অদৃশ্য হাতের কল্যাণে বিভিন্ন স্বার্থমুখী উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনে।
কিন্তু স্বার্থপরতার অর্থনীতি বা ইন্ডিভিজুয়াল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিপরীতে আকবর আলি খানের বইয়ের নামটি ছিল- পরার্থপরতার অর্থনীতি। পরার্থপরতা, যেখানে স্বার্থের কোনো বালাই নেই, পরোপকার করছি নিঃস্বার্থভাবে; সেটির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা। এর মানে এই নয় যে, লেখক বলছেন, স্বার্থপরতার অর্থনীতির কোনো জায়গা নেই আমাদের জীবনে এবং আমাদেরকে সব সময় বা বেশিরভাগ সময় পরোপকার, নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে আর পুরো দেশ-সমাজটা এভাবে পরিচালিত হবে।
এ ধরনের কোনো ইউটোপীয় ধারণায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি শুধু বলছেন, সমাজ, রাষ্ট্র বা অর্থনীতি যদি কেবল ব্যক্তিস্বার্থনির্ভর নীতিতে পরিচালিত হয়, তাতে সমাজে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না এবং এ ক্ষেত্রে তিনি কেনেথ এরোর এই উক্তি মনে করিয়ে দিয়েছেন- পুঁজিবাদকে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি চালাতে হলেও, তাকে একটা পর্যায়ে নিঃস্বার্থ, জনস্বার্থমুখিন, ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিস্ট, ওয়েলফেয়ার স্টেটমূলক নীতিমালা গ্রহণ করতে হয়। এভাবে স্বার্থপরতাকে টিকিয়ে রাখতে হলেও পরার্থপরতা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা দৈনন্দিন জীবনযাপনে যে ধরনের পণ্যসেবা ভোগ করে থাকি, তার সবটাই বাজার থেকে প্রাপ্ত না। যেমন আইনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য, টিকাদান, জনশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা। এসব বিষয় বাজারদরে যাচাই করা যায় না। এগুলো সর্বমানুষের মৌলিক অধিকার। যেটা আমাদের সংবিধানেও আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য- এগুলো হচ্ছে মৌলিক প্রয়োজন। এই বেসিক নিডস সব সময় বাজার দ্বারা প্রাপ্ত হয় না। বাজারমুখিন কর্মকাণ্ড এগুলোর প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে পারে, সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে কিন্তু শুধু বাজারনির্ভর ব্যবস্থায় কোনো দেশই ১০০ শতাংশ নিরক্ষরতা দূর করতে পারেনি, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা-মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তৃত করতে পারেনি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বেসিক নিরাপত্তা বিধান করতে পারেনি।
এই বইটি লেখার পেছনে স্পষ্টতই দেখা যায়, সেই সময় আকবর আলি খান ভাবছিলেন কোন ধরনের সমাজ হবে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী। সেটি কি কেবলই অবাধ বাজারমুখিন অর্থনীতি হবে, সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি হবে, নাকি পাশাপাশি সামাজিক দায়দায়িত্ব বহনকারী প্রতিষ্ঠানাদি সংগঠন আয়োজন গড়ে তুলবে। নিজে তিনি দীর্ঘকাল সরকারের অর্থ সচিব ছিলেন, পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। তিনি খুব কাছ থেকে সরকার ও রাষ্ট্রের কার্যাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও হয়তোবা তাঁর মনে হয়েছে, বই লিখে জানান দেওয়া উচিত- আমরা বাজার অর্থনীতির দিকে সদর্পে হাঁটছি বটে কিন্তু তার রশিটা থাকতে হবে পরার্থপর জনকল্যাণের অর্থনীতির কেন্দ্রে। এবং এ দুটোরই সম্মিলন তিনি চেয়েছেন : বাজার ও রাষ্ট্র, স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা, মানুষের ব্যক্তি প্রয়োজন ও সামষ্টিক প্রয়োজন। এক পর্যায়ে তিনি সামাজিক পুঁজি এবং এর মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়েছেন অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশের জন্য।
এই বইটিরও আমি একটি সমালোচনা লিখি ২০০১ সালে। এটি বিআইডিএস কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক ‘উন্নয়ন সমীক্ষা’-তে বেরোয়। সেখানে আমি এই বইটির মূল প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে বলি, বাংলাদেশের মতো দেশে যদি আমরা ওয়েলফেয়ার স্টেট বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে আমাদের নীতিমালার মধ্যে কত শতাংশ আমরা ব্যক্তি উদ্যোগের অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি আর কত শতাংশ পরার্থপরতার অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি, সেগুলোর চুলচেরা বিশ্নেষণ হওয়া উচিত। প্রতি বছর বাজেট এলে যে কথা আমরা প্রায়ই মনে রাখি না।
৩. তার আগে চাই গণতন্ত্র
২০১০-এর দশকে এসে আকবর আলি খানের রচনায় আমরা বিষয়াদির একটা বিপুল বৈচিত্র্য দেখতে পাই। ক্রমে তিনি অর্থনৈতিক ইতিহাস, ইকোনমিক হিস্টোরিয়ান অথবা অর্থনীতিবিদের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচরণ করতে থাকেন। সেখানে তিনি যা কিছু তাঁর কাছে উৎসাহজনক মনে হয়েছে, কৌতূহলকে উস্কে দিয়েছে, তা তিনি অনুসন্ধান করতে পিছপা হননি। অনেক সময় এ ক্ষেত্রে বিতর্কেরও জন্ম নিয়েছে।
যেমন বনলতা সেন আলোচনায় তাঁর একটি মত হচ্ছে- বনলতা সেন বলে সত্যিই একজন ছিলেন এবং বাস্তব জীবনেই তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল। হয়তো প্রেম বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল- এ রকমও তিনি স্পষ্ট করে ইঙ্গিত দিয়েছেন। থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার- এটির তিনি একটি ফ্রয়েডীয় বিশ্নেষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে তিনি ভূমেন্দ্র গুহর ‘জীবনানন্দ দাশের ডায়রি’ ব্যবহার করেছেন, যেটি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। জীবনানন্দের কবিতা বিশ্নেষণে তথ্য বিচারের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন আকবর আলি খান।
সুশাসনের বিষয়টি তাঁকে বিভিন্ন সময় ভাবিয়েছে। একটা বড় কারণ, তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। স্বল্পকালীন হলেও তিনি রাষ্ট্রের উচ্চতর মহল, উচ্চতর স্তর থেকে সুশাসনের সমস্যা আমাদের মতো দেশে প্রত্যক্ষ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান হন। সেই কমিশনের অস্তিত্ব এখন নেই।
সেখান থেকেও তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমাদের দেশে কত ধরনের রেগুলেশনের সমস্যা। রেগুলেশন বাস্তবায়নের সমস্যা। যানবাহন, রাস্তার ট্রাফিক, বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংকের ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে ওয়াসার জলের কোয়ালিটি, জনস্বাস্থ্য থেকে জনশিক্ষা- সব জায়গায়ই আমরা দেখতে পাচ্ছি গুণগত মান নির্ণয়ের সমস্যা। একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, একটা প্রমিতীকরণ, একটা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ধরে গুণমানকে বজায় রাখার সমস্যা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সুশাসন নিয়ে তিনি একাধিক বই বাংলা ও ইংরেজিতে রচনা করেছেন এবং সেখানে তাঁর মূল বক্তব্য হচ্ছে- একেবারে যে রাতারাতি একটি দুঃশাসনের থেকে আমরা সুশাসনের উচ্চতম স্তরে পৌঁছে যাব, ব্যাপারটা এমন নয়। মানুষের মধ্যে সুশাসনের চাহিদা গড়ে উঠতে হয় এবং সুশাসনের চাহিদাটি গড়ে ওঠে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষা বৃদ্ধি- সেগুলোর সাপেক্ষে। কিন্তু এর মানে এ-ও নয়, আমরা নিষ্ফ্ক্রিয় বসে থাকব বা একটা দীর্ঘ সময়ের দিকে মুখ রেখে চলব এবং অজানা সুশাসনের ভবিষ্যতের দিকে এগোব।
সময় লাগলেও কতিপয় ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অবিলম্বে জরুরি। যেখানে আমরা কোনোভাবে ছাড় দিতে প্রস্তুত নই। যেমন- আপনি যদি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন এক্স-রে মেশিনটি ঠিকমতো কাজ করছে না, ইসিজি মেশিনটি সঠিক ফল দিচ্ছে না বা সময়মতো সেখানে জরুরি বিভাগে ডাক্তার বা নার্সকে পাচ্ছেন না, যেখানে আপনি আপনার রোগী নিয়ে এসেছেন জরুরি চিকিৎসার জন্য, সেই ধরনের সুশাসনের অভাব কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না বা সাময়িক অসুখ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
একইভাবে আমরা যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে সুশাসনের কথা বলি, ধরা যাক বেসিক এডুকেশনের ক্ষেত্রে যদি শিক্ষকের অনুপস্থিতি থাকে, যদি শিক্ষক স্কুলে না পড়িয়ে কোচিং সেন্টারে পড়াতে বেশি আগ্রহী হন, যদি কোচিং সেন্টারই স্কুলের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়- এ ধরনের সুশাসনের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বিশৃঙ্খলা এবং সর্বোত্তম সুশাসনের মাঝখানে আমাদের যে কোনো চয়েস নেই, তা বলা যাবে না। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবিলম্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যদিও আরও বৃহত্তর বলয়ে রেগুলেশন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সময় লাগবে। তিনি এ নিয়ে অনেক উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার’ বইতে।
এ ক্ষেত্রে বলে রাখি, আকবর আলি খানের রচনার প্রসাদগুণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তিনি সরসভাবে জটিল তত্ত্বের কথা বলতে পারেন। সেজন্য প্রয়োজনে তিনি অনেক সময় নাসিরউদ্দিন হোজ্জার বিভিন্ন গল্প বলে বিষয়টাকে প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর লেখাতে প্রায়ই স্কিট, চুটকি নানা ধরনের এনিকডোটাল রম্য কাহিনি বা বিবরণ থাকে এবং সেটি এত বেশি প্রাসঙ্গিকভাবে আসে যে তা বিশ্নেষণেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর এ রকম একটি বই বোধ করি ২০১৩-এর দিকে বেরিয়েছিল। তার নাম আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। যেটার রিভিউ হয়েছিল কলকাতার দেশ পত্রিকায়। দেশ পত্রিকার সমালোচক লিখেছেন, বইটি পড়ে এটুকুন অন্তত বলতে পারা যায় যে লেখক কষে বাংলা লিখতে জানেন! তাঁর লেখার যে ধারা এবং লেখার যে সরস রচনাশৈলী, তা দেখে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। সেটি মিথ্যা নয়, কারণ তাঁর অত্যন্ত সুলিখিত সাবলীল ইংরেজিতে নির্মিত রচনা এবং পরবর্তীকালে তাঁর বাংলা লেখাগুলোতেও দেখেছি হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে, সহজ যুক্তির মাধ্যমে, কখনও কোনো সামান্য উদ্ধৃতির মাধ্যমে তিনি গুরুগম্ভীর বিষয়টির অবতারণা করেছেন এবং সাধারণ পাঠকের মধ্যে সহজেই তাঁর বিষয়বস্তুটি গেঁথে যাচ্ছে। এটি তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য।
শেষ পর্যায়ে আকবর আলি খান অনেক লেখা লিখেছেন। এর মধ্যে একটি-দুটি বলে আমি শেষ করব। একটি হচ্ছে, দারিদ্র্য নিয়ে তিনি একটি সুবিশাল গ্রন্থ লিখেছেন এবং সেখানে তিনি দারিদ্র্যের উৎপত্তি, ইতিহাস, তার মূল্যায়ন পদ্ধতি, দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতিমালা- এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি নিয়ে আমি বিশদ আলোচনা এখানে করতে চাই না কিন্তু যেটি আমার বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, শেষের কয়েক বছরে তিনি বারবার গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ এনেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায় এবং আগে যদি তাঁর যুক্তি ছিল- আমাদের দেশের অধিবাসীরা অর্থনৈতিক কারণেই মার্কেট লিবারেল বা বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে পারে, কারণ তারা অনেক বেশি অসামষ্টিক বা অনেক বেশি ইন্ডিভিজুয়াল, ব্যক্তিকেন্দ্রিক; পরবর্তী সময়ে সেটাকে তিনি কাউন্টার পয়েন্ট ধরে লিখলেন, শুধু মার্কেট লিবারেল ক্যাপিটালিজমের পথে হাঁটলেই চলবে না, পরার্থপরতা বা জনকল্যাণের কথাও ভাবতে হবে। সেজন্য পরার্থপরতার অর্থনীতি লেখা হয়েছিল।
কিন্তু মার্কেটই করি আর নন-মার্কেটই করি, উভয়টাতেই আমাদের লাগবে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, প্রমিতীকরণ, রেগুলেশন, তার বাস্তবায়ন, সুশাসনের বাস্তবায়ন। সেজন্য তিনি সুশাসনকেন্দ্রিক রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু এই সুশাসনকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে গণতন্ত্র না এলে আমাদের মতো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এই কনক্লুশনটির আগে থেকে পূর্বাভাস মেলেনি। মার্কেট লিবারেলিজমের পাশাপাশি ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম, আবার এ দুইকে বাস্তবায়ন করার জন্য সুশাসনের অর্থনীতি আর সুশাসনের অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন বা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা- এটি যে প্রবলতর পূর্বশর্ত, সেটি আগে তিনি অনুধাবন করেননি। কিন্তু ২০০০ দশকের শেষের দিকে এসে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে সেটির উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সর্বশেষ যে রচনা প্রকাশিত হয়েছে সমকালে, কালের খেয়াতে গত ৯ সেপ্টেম্বর সেখানেও এর প্রমাণ মেলে। আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নিয়ে আলোচনা উপলক্ষে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ছিল না বলে পাকিস্তানে ফেডারেলিজমটা টেকেনি এবং ফেডারেলিজম ভেঙে টু ইউনিটের প্রস্তাবনা করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধানে যেসব অধিকার থাকতে পারত, সেগুলো আসেনি। দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠে এবং দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বৈষম্য, বিশেষ করে আঞ্চলিক বৈষম্য আরও গেড়ে বসে। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’। আকবর আলি খান লিখতে পারতেন- ‘তার আগে চাই গণতন্ত্র’।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আবুল মনসুর আহমেদের যুক্তি মেনেই বলতে হয়- গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের ধারা টিকিয়ে রাখা কঠিন। অন্য অনেক দেশে হয়তো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র ছাড়াই এবং দীর্ঘকাল সেভাবে চলতে চলতে একসময় গণতন্ত্র আঙুর ফলের মতো জনগণের পাত্রে এসে পড়ে যায়, সে রকম অবস্থা আমাদের নয়। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের মতো মডেল নিয়ে আমরা চলতে পারব না। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’-এর মডেলটিকে আকবর আলি খান কার্যত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান। এ ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে- অন্তত আমাদের মতো দেশের যে মনস্তত্ত্ব, অস্থিরতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর কাউকে স্ট্যালিনীয় কায়দার এককেন্দ্রিক শাসনের কেন্দ্রে না মানার প্রবণতা- এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের পৃথক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় যেখানে দীর্ঘকাল, ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে চলেছে একদলীয় এককেন্দ্রিক শাসন, তার সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা তাই যথাযথ হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁর কনক্লুশন মূলত দাঁড়ায় এই যে- আমাদের দেশের মুক্তি মিলবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়েই এবং এক দলের দীর্ঘকাল শাসনে না থাকার মধ্য দিয়েই এটার সফল পরিণতি হয়তো দেখা যাবে।
আকবর আলি খানের এই বক্তব্যও আমাদের সচকিত করে, কেননা এখানে তিনটি কথা বলেছেন। একটি বলেছেন যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভবন দরকার। ডিসেন্ট্রালাইজেশন দরকার। আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে এই ডিসেন্ট্রালাইজেশন সহসা সম্ভব নয়, সেটি পাঁচ-দশ বছরের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে হয়। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি কোনোভাবেই ছাড় দিতে নারাজ, সেটি হচ্ছে সময়মতো কারচুপিহীন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা। সেটি তাঁর দিক থেকে নূ্যনতম পূর্বশর্ত ওই ধরনের সুশাসনসমৃদ্ধ পরার্থপরতার মূল্যবোধে ঋদ্ধ একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির সফল বিকাশের জন্য এবং সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কিছু সংস্কার আনতে হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার সাপেক্ষে সংসদ সদস্য বণ্টনের কথা। উইনারস টেক ইট অল- সেই ধরনের প্রচলিত নির্বাচনের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি বলেছেন, আমরা কি নিউজিল্যান্ডের মতো বা অন্য যেসব দেশ আনুপাতিক ভোটপ্রাপ্তির বিচারে সংসদে প্রার্থী সংখ্যা নির্ধারণ করবে, সেই দিকে যেতে পারি কিনা। অর্থাৎ প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশনের সিস্টেমে যেতে পারি কিনা। এতে তিনি বলেছেন, প্রতিযোগী দলের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে এবং অনেক বেশি স্ট্যাবল গণতন্ত্রের জন্ম হবে। তবে লেখক এ নিয়ে তাঁর শেষ কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে আরও গবেষণা করা উচিত।
এ বিষয়টি নজরুল ইসলাম বা অন্যদের লেখায় আগেও এসেছিল, কিন্তু এটি দেখলাম আকবর আলি খানেও খুব বিশদভাবে এসেছে। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আরও গবেষণা জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ তিনি চান অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি, সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি পলিটিকাল উন্নয়ন হোক। সমানতালেই হোক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন না এলে যে অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং সামাজিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে- এ কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
৪. সংক্ষিপ্তসার
এক কথায় বলতে গেলে আকবর আলি খান ছিলেন একজন বহুমাত্রিক মননের মানুষ। আটাত্তর বছরের জীবনে তিনি একাধিক ভূমিকা পালন করেছেন- কখনও সরকারি আমলা হিসেবে, কখনও শিক্ষক হিসেবে, কখনও সাহসী প্রাবন্ধিক হিসেবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি আঁচড়ও তাঁর মধ্যে থেকে গিয়েছিল এবং এর ফলে তাঁকে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, সেটি তিনি কখনও প্রকাশ্যে বলেননি। যেমন বলেননি শেষের দিকে তাঁর স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর কত কষ্ট হতো লিখতে এবং এক পর্যায়ে তিনি লিখতেই পারতেন না, যেহেতু তাঁর ডান হাতটাই তখন কাজ করত না। তখন তিনি মুখে বলে যেতেন এবং অন্যরা লিখতেন এবং তিনি সেটাকে সেভাবেই কারেকশন করে বা কম কারেকশন করে প্রকাশের জন্য তৈরি করতেন।
এটি যে কোনো লেখকের পক্ষেই যন্ত্রণা এবং তাঁর মতো এত খুঁতখুঁতে লেখক, এত পুর্ণাঙ্গ লেখকের পক্ষে তো এ যন্ত্রণা আরও বেশি। তা সত্ত্বেও তিনি একপ্রকার নিজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেই এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তার ফলে আমরা অনেক রচনা পেয়েছি। এটি আমাদেরকে তাঁকে সব সময় মনে করিয়ে দেবে।
আকবর আলি খানের রচনা, তাঁর সব লেখাপত্র সবাই আরও মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, বিতর্ক করবেন, আলোচনা করবেন এবং আরও উন্নত গবেষণার দিকে অগ্রসর হবেন- এই আশা রাখছি। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্যই তাঁর রচনাবলির সংগ্রহ অবিলম্বে প্রকাশ হওয়া এখন জরুরি।

মধ্যাহ্নের সমাজ

হুমায়ূন আহমেদ [১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২]

কেন ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসটি লিখতে হলো তাঁকে- এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সময়কে’ ধারণ করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। সচরাচর যেসব বিষয় নিয়ে তাঁর চরিত্ররা মাথা ঘামায় না- রাজনীতি, কাল, সমাজ- সে সবকিছুকে আর গল্পের বাইরে রাখা গেল না। কেননা, গল্পটাই কতদূর এগোলো মানুষ- তা নিয়ে। ১৯০৫ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের সমাজ কীভাবে বদলে যেতে থাকল এ রকম কোনো ইতিহাসবোধে তাঁকে পেয়ে বসেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি-প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরীফকে জানিয়েছিলেন যে, নিজের জীবন ভাঙিয়ে আর কত উপন্যাস লেখা যায়! সে জন্যেই নাকি তাঁকে ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’র মতো ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। তিনি খুব সচেতন প্রয়োজনেই এই ইতিহাস-প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন বোধ করি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ব্যাখ্যাটা এরকম :’আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই নি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তো বা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি, সময়টাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগোতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তার পরেও।’
এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘তারপরেও’ বলতে গল্প ছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন সচেতনতার প্রতি কি তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন? আর ইতিহাস-গল্প মিলিয়ে যদি কিছু লিখবেন তাহলে ১৯০৫ সাল থেকেই তা শুরু করবেন কেন? সময় ধরার ইচ্ছের কথা বলছেন, কিন্তু কোন কালপর্বে শুরু করে কোথায় তার যতি টানবেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে যে-সময়কে অনুভব করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ অবধি। কেন এই বিশেষ সময়ের টানাপোড়েনের মধ্যে তাঁকে প্রবেশ করতে হলো- সেটা একটা প্রশ্ন। তার চেয়েও গুরুত্বপূূর্ণ প্রশ্ন হলো, উপন্যাসটিতে যে সমাজকে তিনি এঁকেছেন, সেই সমাজচিত্র সে সমাজকল্পিত, না বাস্তব, সে প্রশ্নে পরে আসা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্রটাকে তিনি কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে আঁকলেন? আজকের যুগের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিচালিত সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যাহ্নের সমাজকে মনে হবে কোন অচিনপুরের গল্প- এক আধুনিক ইউটোপিয়া। এই উপন্যাস ভর করে আছে আদর্শস্থানীয় দুই চরিত্রের ওপরে, যাঁর একজন হরিচরণ সাহা এবং অন্যজন মওলানা ইদ্রিস। এই দুই শুভবোধসম্পন্ন মানুষ- বস্তুত নিয়ত এবাদতে রত সূফী-সন্তই বলা চলে তাদের- যাঁরা সবসময়েই কী করে মানুষের উপকার করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত, তাঁরাই উপন্যাসের ঘটনাবলির ওপরে বৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন শুরুর লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের শুরু হয় যে-পুকুরঘাটে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ হয় একই পুকুরঘাটে; কেবল শুরুর দৃশ্যে ছিলেন হরিচরণ, শেষের দৃশ্যে মওলানা ইদ্রিস। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র- ভালো স্বভাবের ও মন্দ স্বভাবের চরিত্ররা সবাই এদের নিয়েই, এদের পাশে রেখেই যার যার জীবন কাটায়, যার যার মতো করে মৃত্যুবরণ করে।
মধ্যাহ্নের সমাজের বড় শক্তি তার অন্তর্নিহিত নৈতিক শ্রেয়বোধ। এর প্রধান উৎস হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিসের মতো মানুষেরা হলেও অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষ যাঁরা, তাঁরাও প্রবল মানবিকতায় আক্রান্ত। তাঁরা পারতপক্ষে অন্যায় করেন না, বা করলেও পরিহার্য বলে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। জুলেখা, শরীফা, মনিশংকর, শিবশংকর, আতর- তাঁরা সবাই পৃথিবীতে ভালোমানুষের পাল্লা ভারী করেছেন। আর লাবুস তো জুলেখার পুত্রসন্তান হলেও আসলে হরিচরণ-মওলানা ইদ্রিসের আধ্যাত্মিক সন্তান। লাবুস শহরে এলে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটত, খুবই স্বাভাবিক হতো তার হিমু-হওয়া! তার মানে এই নয় যে, এই সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত ছিল না। সংঘাত-দ্বন্দ্ব-অনাচার ছিল যদিও, কিন্তু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। হরিচরণের নিজের পাটের আড়ত রয়েছে, ‘সাহা’ যেহেতু সেহেতু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা তার উপার্জনের স্বাভাবিক উৎস। সুতরাং বাণিজ্যবিরোধী ছিল না ওই সমাজ। যে অঞ্চল নিয়ে এই উপন্যাস তার হাওরেই সওদাগররা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় তাদের নৌবাণিজ্যের নাও ভাসিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ধারা থাকলেও এ ধরনের সমাজে টাকার শক্তিতে মানুষের ক্ষমতাকে মাপা হয়নি। শশাংক পালের মতো জমিদার বা ধনু শেখের মতো কুটিল ব্যবসায়ী মানুষও সমীহ করে চলেছে হরিচরণকে- সেটা তার অর্থের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি তার নৈতিক স্বভাবের কারণে। আরেকটি দিক হচ্ছে, মধ্যাহ্নের সমাজে স্বার্থপরতাই ব্যক্তির একমাত্র প্রণোদনা নয়; এখানে পরার্থপরতার বোধ সহজাতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বিভিন্ন স্তরে। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের আজকের এই অপরাহেপ্তর সমাজ বাণিজ্যিক বোধের সমাজ। উনিশ-বিশ শতকের [অন্তত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ও মোটা দাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত] অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর মূল্যবোধের থেকে আজকের এই সমাজ মৌলিকভাবেই আলাদা। মধ্যাহ্নে অনায়াসে সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে। এখানে বৃক্ষের অসুখ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, জুলেখা গায় উকিল মুন্সি ও রাধারমণের গান, রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদের হাহাকার, হাওরের ঢেউয়ে বেজে ওঠে। সেটা যে কেবল নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য, তা মনে করেননি লেখক। ব্যাপক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আদান-প্রদানকে ধারণ করেছিল এই মধ্যাহ্নের সমাজ। সেখানে কোন চিহ্নটা কার, বা কোন গানের লাইনটা কোন সম্প্রদায়ের জীবনবোধ থেকে উঠে এসেছে- সেটা হিন্দুর নাকি মুসলমানের, মজুরের নাকি অবস্থাপন্ন কৃষকের- সেটা বের করাটা দুরূহ। ওই সমাজের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি।
এ রকম সমাজের কাহিনি কি ইউটোপিয়ার মতো শোনাচ্ছে? হোক ইউটোপিয়া, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই কল্পকথা নির্মাণে [নাকি বাস্তবেই গল্পটা এভাবেই তিনি শুনেছিলেন] এত শ্রম ও মেধা ঢালবেন কেন? আমার ধারণা, মধ্যাহ্নের ভূমিকায় পুরো কারণটা হুমায়ূন আহমেদ বলেননি। শুধু ‘সময়’কে ধরার জন্য ওই বিশেষ কালপর্বের প্রতি চোখ ফেরাননি তিনি; আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল আমাদের মন ও মননকে নাড়া দেওয়ার জন্যে। হয়তো উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সমাজের অন্তরাল প্রাণশক্তির উৎস কোথায়, তা দেখানো চোখে আঙ্গুল দিয়ে।
২.
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিস্কৃতি নাই।’ মধ্যাহ্ন উপন্যাসে সেই পাপকে অবলীলাক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পাপের মধ্যে সহাবস্থানকেই চূড়ান্ত মানেনি। শশাংক পালের মতো অত্যাচারী জমিদারেরা এতকাল নিরীহ রায়তের পেছনে লেগেছে। তার মৃত্যুর পরে ধনু শেখের মতো ব্যবসায়ীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। শশাংক পালের যোগাযোগ ছিল কলকাতার প্রশাসনের সাথে, ধনু শেখ নিয়েছে মুসলিম লীগের আশ্রয়। স্বদেশি আন্দোলনের তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর হাতে আহত হতে হয় তাকে; শেষ পর্যন্ত এলাকার মানুষই দাঙ্গা ঘটানোর ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাকে দায়ী করে এবং তার ক্ষমতার ভিত দুর্বল করে দেয়। আর শশাংক পালের মৃত্যু হয় কোনো অব্যাখ্যাত ব্যাধিতে। শশাংক পাল, ধনু শেখের প্ররোচনার কারণে হোক, আর দুই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমে বেড়ে যাওয়া ভেদবুদ্ধির কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মধ্যাহ্নের সমাজেও ঢুকতে থাকে। রাতের অন্ধকারে একদল আরেক দলের লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়, একপক্ষ আরেক পক্ষের জাতিনাশ, ধর্মনাশ করে, বাড়িতে আগুন লাগায়, পুলিশের কাছে মিথ্যে মামলা দিয়ে, হুমকি দিয়ে এলাকা পরিত্যাগে বাধ্য করে, নষ্ট মেয়ের অপবাদ দেয়, হাওরের নির্জনে এনে ধর্ষণ করে, জায়গা-জমি বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এসবই হয়, কিন্তু এটা মধ্যাহ্নের সমাজের অন্দরমহলকে ছুঁতে পারে না। কোনো লৌকিক বা অলৌকিক কারণে এর মানুষগুলো পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে।
পরস্পরের পাশে সহায়-সমর্থনের উদাহরণ অনেক এই উপন্যাসে। আমি এখানে দু’একটি উদাহরণ দেব। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে মওলানা ইদ্রিস রওনা হয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দিকে। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বগুড়ার পরিবর্তে রংপুরে চলে গেছেন। এক পর্যায়ে রাত হলে তাঁকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে একটি হিন্দু পরিবার। লক্ষণ দাসের পরিবার কাছেরই এক মন্দিরের সেবায়েত। ওই বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। খাবারেরও ব্যবস্থা হয়েছে- অবশ্য রাখা হয়েছে উঠানেই। লোকটা তাকে বলেছে, ‘মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।’ মওলানা তাতেই খুশি। তিনি নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে দোয়া চাইলেন, যাতে এই পরোপকারী পরিবারটির প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। এ সময়ে কপালে চওড়া করে সিঁদুর দেয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মওলানার সামনে এসে দাঁড়াল প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকে। মওলানার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল চলে যেতে : ‘দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকাপয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন’।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে পাপ আছে তা অস্বীকার না করে স্বীকার করাই ভালো, স্বীকার করলে যদি আমরা পরিত্রাণের পথ পাই। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেও, করার মাঝেই, থমকে দাঁড়িয়েছে অথবা স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ধনু শেখ এলাকার মসজিদের ইমাম নিয়ামত হোসেনকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ‘জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?’ আপাতত সম্মতি দিলেও চে’ গুয়েভারার চেয়ে কোনো অংশে কম যান না ইমাম নিয়ামত হোসেন। রাতের অন্ধকারে মনিশংকরের কাছে গিয়ে বলে দিয়েছেন, কাল জুমার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। শুধু তা-ই নয়, পরদিন জুমার নামাজ শেষে ইমাম নিয়ামত মওলানা ইদ্রিসকে আমন্ত্রণ জানালেন কিছু বলার জন্যে। ইদ্রিসকে বহুদিন ধরে হরিচরণ সাহার বাসায় আশ্রয়ের পর থেকেই হিন্দুদের সঙ্গে উঠা-বসা করার জন্যে একঘরে করে রেখেছে ধনু শেখ। মওলানা ইদ্রিস দাঙ্গা ঘটানোর পরিস্থিতি বদলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সুরা হুজুরাত এর তেরো নম্বর আয়াতের স্মরণ করলেন, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করে পরে বিভক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে, যাতে তারা ‘একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে’। দোয়া পাঠের সময় ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে এক উদারনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এলাকায়। অত্যাচারী শশাংক পাল মারা যাওয়ার পর তার মুখাগ্নি করতে তাঁর স্বধর্মের কেউ রাজি হলো না। হয়তো তিনি সারাজীবন অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলেন বলে, হয়তো অত্যাচারী ছিলেন বলে। মুসলমান হয়ে মওলানা ইদ্রিস এগিয়ে এলেন এক্ষেত্রে। সমস্যা হলো পুরোহিতের সাথে তাঁকেও কিছু মন্ত্র পড়তে হলো শেষকৃত্যের প্রয়োজনে। এর জন্যে কাফের বলে ফতোয়া দেওয়া হলো তাঁর বিরুদ্ধে। লাবুস এসে প্রতিবাদ করে বলল, ‘লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু মুসলমান কী? লাশ নামাজ কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না’। অন্যত্র, লাবুস ও ইদ্রিসের মধ্যে অন্য একটি ধর্মীয় আলাপের বিনিময় হয়। ইদ্রিসের শিশুবয়সী মেয়ে পুষ্পরানীকে দুধ খাওয়ানোর কেউ নেই। তার স্ত্রী জুলেখা তাকে পরিত্যাগ করে গেছেন। এদিকে গ্রামের বাগাদিপাড়ার মেয়ে ষোলো-সতেরো বয়সী কালী গতকালই তার মেয়েকে হারিয়েছে। পুষ্পরানীকে পেয়ে সাগ্রহে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে সে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠেই শোনা যাক : ‘মাওলানা ইদ্রিস লাবুসের কাছে হিন্দু-মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দু-মুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই। লাবুসের কথায় মাওলানা হকচকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেননি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।’ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাত্যহিকের সাংস্কৃতিক ব্যবহারিক বিনিময়ের এ রকম অনেক উদাহরণ আরও ছড়িয়ে আছে। আজকের এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যুগে ধর্ম-ধর্ম করে আমাদের নগর ও গ্রামের জীবন এখন ব্যতিব্যস্ত। লাবুস-মওলানা ইদ্রিস হরিচরণের মতো চরিত্ররা কি আছে এখনও আমাদের আশেপাশে কোথাও?
৩.
তাহলে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানে মিলে একটা যে অভিন্ন সংস্কৃতি, তলার দিকে গড়ে উঠেছিল, শত কংগ্রেসী লীগ রাজনীতির ডামাডোলেও যেটা পুরোপুরি ধসে যায়নি, সে রকম কোনো শুভনীতিবোধসম্পন্ন অস্তিত্বকেই আমাদের ‘মধ্যাহ্ন’ অর্থাৎ ‘স্বর্ণযুগ’ বলছেন লেখক? আজ সেই মধ্যাহ্ন গড়িয়ে এই সমাজ- এই তিমিরবিলাসী সমাজ উপনীত হয়েছে তার অপরাহেপ্ত। ‘অপরাহপ্ত’ কথাটা আমি ‘লেইট ক্যাপিটলিজম’-এর তাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচক ফ্রেডেরিক জেমসনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। বাণিজ্যনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে, শিল্পকেও মানবসত্ত্বাকে ক্রমাগত ‘ব্যবহূত-ব্যবহূত’ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বর্জ্যের মতো পাগলার লেগুনের মতো অন্ধকার কোণে। হুমায়ূন আহমেদ এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর সমাজকে মন থেকে কখনও মেনে নিতে পারেননি। হিমুকে দিয়েছেন এই বাণিজ্যিক সমাজকে বিদ্রূপ করার মনোমুগ্ধকর ক্ষমতা। ‘অয়োময়’-এর মির্জা হেরে যাচ্ছে উঠতি বণিক শ্রেণির কাছে, যেভাবে ধনু শেখের কাছে হেরে গিয়েছিলেন শশাংক পাল। তবু স্রষ্টার পক্ষপাতিত্ব পরাজিতের দিকেই। সত্যজিতের ‘জলসাঘর’-এর শেষ দৃশ্যে বিশ্বাম্ভর কোথায় মিলিয়ে যান সে খবর আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমাদের মনে থেকে যায় শেষ সংগীতসভার নৃত্যগীতের রেশ। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষে আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ আসন্ন, ভিটেমাটি ছাড়ছে দু’তরফেই, নতুন রাষ্ট্রজীবনের শুরু হবে সীমান্তের দু’দিকেই। পাকিস্তান হচ্ছে ‘কৃষকের ইউটোপিয়া’ গবেষকরা রায় দিয়েছেন, শুধু কিছু মানুষের মনে শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। হরিচরণ সাহা মারা গেছেন, লাবুস মৃত্যুশয্যায়, মওলানা ইদ্রিস সবচেয়ে বেশি নিরাশ্রয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।’ হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিস ছিলেন এই পাপবিদ্ধ সমাজের রক্ষাকবচ- তাঁরা আঁকড়ে ছিলেন সমাজের ভালোত্বকে শুভবোধকে, মঙ্গল কামনাকে। তাঁরা সমাজকে অন্ধকার খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে দেননি।
মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষটা এ রকম। লাবুস, যে কিনা আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎকে নায়কের মতো লালন করেছে, সে মারা যাচ্ছে। কোনো অব্যাখ্যাত অসুখে তাকে আক্রান্ত করেছে। অসুখ নিয়েই সে এসেছে নির্জন পুকুরের ঘাটে এবং সেখানে হঠাৎই সে তার মৃত মাকে দেখতে পাচ্ছে কাছে। একপর্যায়ে মার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার এই মৃত মার নাম জুলেখা। যিনি জীবিত থাকাকালে স্বয়ং উকিল মুন্সীকে গান শুনিয়েছেন এবং নজরুল যাঁকে দিয়ে কলকাতায় গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি এবারে গুনগুন করে গান ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বইটির শেষ দুটি লাইন, যা পড়তে থাকলে এখনও আমি এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করি : ‘মওলানা ইদ্রিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে। পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনোখানে।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোসেন মিয়া ময়নাদ্বীপের সমতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের বান্ধবপুর তেমনি একটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র, সেখানে সব গোত্রের ও বর্ণের মানুষেরা মানবিক মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরবে। তবে এই অপরাহেপ্তর সমাজের কাছে হুমায়ূনের এই ইতিহাসপাঠ কল্পজগতের ভাষ্য বলে মনে হতে পারে।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের মাইলফলক


পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক আমাদের ঋণ দেবে কী দেবে না, কিংবা অন্য কোনো পক্ষের কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাব কী পাব না; অথবা কারও সাহায্য ছাড়া আমরা নিজেরাই সেতুটা নির্মাণ করতে পারব কিনা- এমন নানা প্রশ্নমুখর বাস্তবতার দিনে ২০১২ সালে আমি বলেছিলাম, আমাদের অসাধারণ কিছু করতে হবে। আমাদের জানান দেওয়া উচিত যে, আমরা বাঙালি জাতি- আমাদের ইচ্ছে মতো নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর অভ্যাসটা তোমাদের বদল করতে হবে। আমরা আর সেই আগের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাসের পাত্র হওয়া জাতি নেই। বিশ্বকে জানান দেওয়ার জন্যই হোক বা নিজেদের উন্নতির জন্যই হোক, নিজেদের শক্তি দিয়ে সেই স্বপ্টেম্নর পদ্মা সেতুটা একদিন সত্যিই বানানো সম্ভব হতে পারে- বলা যায়, এ নিয়ে আমার এক ধরনের আস্থা ছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মোটা দাগে যে হিসাবগুলো সেদিন আমাদের সামনে ছিল, সেই হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে খুব সাধারণভাবেই আমার ভাবনা হয়েছিল এবং এখনও হয় যে, যাঁরা সন্দেহপ্রবণ, তাঁরা সেদিন কেন ভেবেছিলেন যে এটা আমাদের নিজেদের টাকায় করা সম্ভব নয়? আজকে আমাদের জিডিপি ৪১০ বিলিয়ন ডলার- পদ্মা সেতুর সেতু অংশের খরচ দিয়ে তাকে ভাগ করলে আসে ১ শতাংশেরও কিছুটা কম। অর্থাৎ আমরা আজকে আমাদের জিডিপি’র ১ শতাংশ খরচ করেই একটা পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারি।
২০১২ সালে এই পরিসংখ্যানগুলো হয়তো আরেকটু দুর্বল ছিল। তখনও আমাদের রপ্তানি অত বেগবান হয়নি, আমাদের রেমিট্যান্সও ততটা বেগবান ছিল না তখন, আমাদের সক্ষমতাটাও অতটা পরিস্কার হয়নি হয়তো। হয়তো সে জন্যেই আমাদের অনেকের মনে সন্দেহটা ছিল। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাতো একটা সেতু মাত্র- এত বড় একটা দেশ, তার বৈদেশিক আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে নিজের টাকায় এমন একটা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না?
আমরা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক সাহায্যের ছায়ায় ছিলাম। একটা বড় গাছের ছায়ার নিচে থাকলে যেমন অন্য চারাগাছগুলো বেড়ে উঠতে পারে না, তেমনি আমাদের আত্মবিশ্বাসের চারাগুলোও এতদিন বেড়ে উঠতে পারেনি। ছায়াটা সরে যেতেই আমরা দেখতে পারলাম যে আমাদের মাথার ওপরে তো দিব্যি রোদ আছে- আমরা এখন নিজেদের মতো করেই বড় হতে পারব। ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক সাহায্য ছিল আমাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। সেটা কমতে কমতে আজকের দিনে এসে ১ শতাংশে পরিণত হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনটা পরিসংখ্যানে ঘটলেও মনের মধ্যেতো ঘটেনি এর আগে। মনে মনে হয়তো এখনও আমরা ভাবছি যে, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আমরা বোধ হয় চলতে পারব না, কেউ না করে দিলে কিংবা কেউ হাতে ধরে না শিখিয়ে দিলে আমরা হয়তো পারব না। কিন্তু দিন একটু একটু করে বদলে গেছে- আমাদের তরুণ প্রকৌশলী, যাঁরা পদ্মা সেতুর কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটাও দেখার মতো। তাঁরা অনেকেই এখন বলছেন যে, তাঁরা ভবিষ্যতে যেকোনো জটিল প্রকল্প সামাল দিতে পারবেন। এই আত্মনির্ভরতাগুলো একেকটা জাতি ধাপে ধাপে অর্জন করে থাকে। একের পর এক ধাপ পার হয়ে হয়ে কিংবা কিছু কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে আবিস্কার করতে শেখে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের আত্মবিশ্বাসের একটা বৃহত্তম ধাপ। তার আগে যেমন ৬-দফার মাধ্যমে দুই অর্থনীতি শীর্ষক একটা যুক্তির ধাপ আমরা পার হয়ে এসেছি, যার মাধ্যমে আমাদের ভেতর স্বাধিকার আন্দোলন করার জন্য একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। এগুলোই আমাদের জাতি গঠনের একেকটা মাইলফলক। আমি মনে করি আমাদের সংবিধান আমাদের জন্য যেমন একটি মাইলফলক, পদ্মা সেতুও তেমনি একটি মাইলফলক। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আসলে এত বড় রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলাম- মূলত তখনই আমরা এলডিসি অতিক্রম করে গিয়েছিলাম। হিসাবে আমাদের এলডিসি অতিক্রম হয়তো আরও পরে হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে এলডিসিস্তর থেকে আমরা তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম, যখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন আমরা নিজেদের টাকাতেই এটা করতে পারব। সেতুর অর্থনৈতিক অভিঘাত এবং অন্যান্য অনেক বিশ্নেষণের চেয়েও এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি ঘটনারই যেমন একটা ব্যবহারিক মূল্য থাকে, তেমনি তার একটা আত্মন্তিক মূল্যও থাকে। পদ্মা সেতুর সেই আত্মন্তিক গুরুত্বটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। একটা কঠিন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর থেকে যার মাধ্যমে আমরা একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে, নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম একটা জাতি হিসেবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি। সেখানে অনেক ঝুঁকি ছিল; এবং অনেকেই বলেছেনও যে, এই ঝুঁকি আমরা সামলাতে পারব না; কিংবা আমাদের রয়েসয়ে চলা উচিত। কেননা বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থা যদি আমাদের থেকে সরে যায়, তাহলে আমাদের উন্নয়ন ধসে পড়বে, আমরা না খেয়ে মারা যাব, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, আমরা নৈরাজ্যের মধ্যে গিয়ে পড়ব ইত্যাদি। কিন্তু তেমন পরিস্থিতিতেই আমরা আশার আলো দেখেছিলাম- আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ছিল, আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল, রেমিট্যান্স বাড়ছিল। এ সমস্ত আরও অনেক কারণেই তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা ভাবতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে কিন্তু অতটাতো দুর্বল আমরা নই।
আমি সেদিন বলেছিলাম পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থানের জন্য আমাদের বাজেটে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, সেতুর প্রস্তাবিত ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় মুদ্রা এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমেই সংস্থান করা সম্ভব ছিল। আজকেও বলছি, স্থানীয় মুদ্রায় পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থান করা আমাদের পক্ষে তখনও কঠিন ছিল না, এখনও কঠিন নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ সংস্থান নিয়ে খানিকটা প্রশ্নবোধকতা ছিল, এখন তা একেবারেই নেই। এখন আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের যে প্রবাহ, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের যে স্ট্রেংথ, আমাদের খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা- এ অবস্থায় দাঁড়িয়েই আমরা আজ জিডিপির মাত্র ২-৩ শতাংশ খরচ করে পদ্মা সেতুর মতো আরও দুইটা সেতু তৈরি করতে সক্ষম।

আমি মনে করি আমাদের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের একটা নির্দেশক হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। আমরা বলছি না যে, অন্যদের সাহায্য ছাড়া কিংবা বিদেশি প্রযুক্তি ছাড়া, বিদেশের সঙ্গে মেলবন্ধন ছাড়া আমরা সবকিছুই করে ফেলব- কিন্তু আমরা এটা বলছি যে, যদি কেউ নাও আসে তবুও এখন একলা চলার শক্তি আমাদের আছে। এটাতো আগে বলতে পারতাম না। এখন আমরা বলতে পারি। কেবল বলতেই পারি তা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তাকে সমর্থনও করে; আমাদের বুদ্ধিমত্তার সামর্থ্য তাকে সমর্থন করে, আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি বা কৃৎকৌশলগত সামর্থ্য সেটাকে সমর্থন করে, আমাদের প্রকৌশলীরা সেটাকে সমর্থন করেন, অর্থনীতিবিদরা সেটাকে নিয়ে ভাবতে পারেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটা নিয়ে আরও দূরদর্শীভাবে পথরেখা আঁকতে পারেন। এ সমস্ত বিষয়ই হচ্ছে আমাদের উন্নতির জন্য মূল্যবান উপাদান, যার মাধ্যমে মূলত একটা জাতি পরিপকস্ফ হয়ে ওঠে এবং আমি মনে করি বাংলাদেশের ৫০ বছরে সংবিধান থেকে শুরু করে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ- এই যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, এটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইতিহাস।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের যে পর্যায়ে আছে, এটা হচ্ছে মেগা প্রকল্পের পর্যায়। পৃথিবীর উন্নত সব দেশেরই এসব বড় ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাছাড়া আমাদের জনকল্পনাতেও আজ উন্নত যোগাযোগের চাহিদা ও স্বপ্টম্ন তৈরি হয়েছে। বলা যায়, যার একটা রূপান্তর হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের একটা নতুন জোয়ার তৈরিতে নিঃসন্দেহে এই সেতু অবদান রাখতে সক্ষম হবে। যে জোয়ার স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক শিল্পক্ষেত্রগুলোর একটা অংশ খুলনা শহরের দিকে স্থানান্তরিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা শহরটি আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম শহরে পরিণত হবার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিরই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের নতুন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ একত্র হয়ে একটা বড় ধরনের ফলাফল এনে দেবে।
সব মিলিয়ে আমি যেটা বলতে চাই তা হলো, এই সেতু নির্মাণের একটা ব্যবহারিক উপকারিতা আছে- সেটা আমরা ভোগ করব; সেটা আগামীতে আরও বাড়বে, সেটা আরও বাড়ানোর জন্য আমাদের স্থানীয়ভাবে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে সেতুর প্রতীকী তাৎপর্য- এর আত্মন্তিক তাৎপর্য। তা হচ্ছে যে, আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। একটা বৃহৎ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের টাকায় নিজেদের সেতু নির্মাণ করেছি। এটা যখন করতে পেরেছি, তাহলে আগামীতে অবশ্যই আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পারব।

লেখক :অর্থনীতিবিদ মহাপরিচালক, বিআইডিএস

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


পঞ্চমত, কমন গুড-এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য ও গণশিক্ষা ছাড়াও চলে আসবে গণপরিবহনের প্রসঙ্গ। দেশের গণপরিবহন ‘গণ’ ছাড়া চলবে তা তো হতে পারে না। উচ্চবিত্তরা চলবেন প্রাইভেট গাড়িতে; মধ্যবিত্তরা চলবেন গাড়িতে বা উবারে করে, অথবা রিকশায় চড়ে; আর গরিবরা চলবেন বাসে-টেম্পোতে করে, আর অতিদরিদ্ররা হেঁটে। বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার মতো পরিবহন খাতেও চলছে নানামুখী ধারা। কেবল নেই তাতে প্রকৃত অর্থে গণপরিবহন, যেখানে ধনী-মধ্যবিত্ত-গরিব একসঙ্গে চলে। অথচ উন্নত দেশে ভ্রমণের প্রথম চোখে পড়ার বিষয়ই হলো সেখানকার গণপরিবহনের বিকশিত রূপ। বাসে বলুন, ট্রামে বলুন, ট্রলি বাসে বলুন, ট্রানজিট রেলে অথবা মেট্রোতে বলুন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষই একসঙ্গে চড়ছে ও চলছে। এই একই দৃশ্য আমি ছাত্রাবস্থায় মস্কো শহরে দেখেছি এবং পরবর্তীকালে কর্মজীবনের বড় অংশ যেখানে কেটেছে সেই ওয়াশিংটনে দেখেছি। অর্থাৎ সনাতনি সমাজতন্ত্র ও আধুনিকতম পুঁজিবাদে গণপরিবহনকে গুরুত্বপূর্ণ ‘কমন গুড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিভক্তি থাকবেই, কিন্তু তাই বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো প্রকট বিভক্তি থাকতেই হবে এমন কোনো কঠোর নিয়ম নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা মাত্রাতিরিক্তভাবে বিভক্ত। এই শ্রেণিবিভক্ত পরিবহন ব্যবস্থা দূর না হলে এবং প্রকৃত অর্থে সবার জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো সবার জন্য গণপরিবহন (তথা ‘সিস্টেম অব মাস ট্রানজিট’) প্রবর্তিত না হলে গণতন্ত্র সকলের জন্য অর্থবহ হবে না। এটা চলতে থাকলে ক্রমাগত যানজটে ও বায়ুদূষণে শুধু যে স্বাস্থ্যহানি ও কালক্ষেপণের অর্থনৈতিক মাশুল দিতে হবে তা-ই নয়। আমার ধারণা, উপযুক্ত গণপরিবহন না থাকার কারণে আমাদের ‘প্রাইভেট সেভিংস’ কমে যাচ্ছে (টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত যানবাহন কেনার জন্যে); শহর এলাকায় বসতি আরও বেশি ঘন হয়ে উঠছে এবং বাড়িভাড়া আরও বেশি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ছে, যার ভুক্তভোগী সবাই কম-বেশি হচ্ছেন, কিন্তু বিশেষভাবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্নবিত্তের মানুষেরা। সমাজতন্ত্রীরা এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। প্রকৃত অর্থে সবার জন্য সুলভ ও নান্দনিক গণপরিবহন শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রেরও দাবি।

ষষ্ঠত, জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও গণপরিবহন এদের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান হচ্ছে পরিবেশসম্মত উন্নয়ন এবং নিরাপত্তাপূর্ণ জীবন (শেষেরটি না বললেও চলে)। দুঃখের বিষয়, ঐতিহাসিকভাবে পুঁজিবাদী দেশগুলো যখন গড়ে উঠেছিল এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল তখন পরিবেশ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক হঠকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে এসব দেশ পরিবেশ বিষয়ে আরও সচেতন হয়ে ওঠে এবং নানামুখী উদ্যোগ নিতে থাকে। আমাদের দেশে কী বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, কী উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নির্বাচনে পরিবেশ-সচেতনতাকে যথেষ্ট আমলে নেওয়া হয় না। নদী নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা প্রকল্পগুলোয় অনেক ক্ষেত্রেই নদীরক্ষা বা শহররক্ষার নামে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি এখন এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গেছে যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র উপন্যাসের নামের মতো চারপাশ থেকে ধ্বনি উঠেছে কেবলু ‘কাঁদো, নদী কাঁদো’। নদীমাতৃক দেশে আমরা এখনও নদীভিত্তিক পরিবহন ও জনপদ গড়ে তুলতে পারিনি। নদী মরুভূমিতে হারিয়ে যায়নি, পানি উন্নয়ন পরিকল্পনার ফাঁদে পড়ে এমনকি স্মৃতি থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী নিশ্চিহ্ন, আর বেঁচে-বর্তে থাকা প্রায় অধিকাংশ নদীর শাখা-প্রশাখা মরে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত সমস্যাবলি। পরিবেশের পরিবর্তনের ঝুঁকির সঙ্গে মানানসই শহর কী করে গড়ে তোলা যাবে- এসব প্রশ্ন উঠছে। উপদ্রুত উপকূলের জনপদ ভাঙনের মুখে। বাংলাদেশ দুঃস্বপ্ন দেখে- সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ সমুদ্রের নোনাজলে তলিয়ে যাচ্ছে। একই সমস্যা দেখি বন-পাহাড় রক্ষার ক্ষেত্রেও। পাহাড় বৃক্ষহীন, বন উজাড়, পাহাড়ে নামছে ধস, বিপন্ন পশু-পাখি- তারা কার কাছে ফরিয়াদ চাইবে? সমাজতন্ত্রীরা এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।

সবশেষে বলব, বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের তুলনায় আয়-বৈষম্য নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের মানদণ্ডে কিছুটা বেশি। এই বৈষম্য সময়ের সঙ্গে অল্প অল্প করে বাড়ছে। এখন সেটা বেড়ে প্রায় বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বৈষম্য মাপার জিনি সূচক ১৯৭৩/৭৪ সালের ০.৩৬ থেকে ক্রমশ বেড়ে ২০১৬/১৭ সালে ০.৪৮-এ এসে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃত আয়-বৈষম্য আরও বেশি হবে, কেননা সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ধনী লোকেরা বিবিএসের আয়-ব্যয় জরিপে কদাচিত অন্তর্ভুক্ত হন। শুধু আয়-বৈষম্য নয়, সম্পদ-বৈষম্যেও আমাদের অবনতি হচ্ছে। ২০১৯ সালের MICS জরিপ অনুযায়ী সারা দেশের মাত্র ৬ শতাংশ খানায় কম্পিউটার বা ল্যাপটপ আছে; ৫০ শতাংশের এখনও একটি টেলিভিশন নেই; ইন্টারনেট যোগাযোগ নেই ৬২ শতাংশ গৃহে।

কেউ কেউ বলতে পারেন, দেশে যে বৈষম্য বাড়ছে এতে অতটা দুশ্চিন্তার কিছু নেই। স্বল্প-আয়ের দেশগুলোয় আয়-বৈষম্যের মাত্রা কম থাকে; এরপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় আয় বাড়তে থাকলে আয়-বৈষম্য বাড়তে থাকে; সেটি বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে এসে আবার কমতে শুরু করে। অর্থাৎ আয়ের সঙ্গে বৈষম্যের মাত্রার সম্পর্ক সরলরেখার মতো নয়। প্রথমে কম, মাঝখানে বেশি, এবং সবশেষে আবারও কম। এই প্রবণতাকে নোবেল-অর্থনৈতিক সাইমন কুজনেস্‌ প্রথম শনাক্ত করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে জরিপের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বিচার করলে বৈষম্যের কমা-বাড়া-কমার প্রবণতা আর প্রমাণিত থাকছে না। আয় বাড়লেও বৈষম্য কমার লক্ষণ নেই; এমনকি বৈষম্যের উল্লম্ম্ফনের জন্যেই ওইসব দেশে জাতীয় আয় যথাযথভাবে বাড়তে পারছে না। গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট যে, যেসব দেশে বৈষম্য অতি উচ্চমাত্রায় (জিনি সূচক ০.৫০-র থেকে বেশি) অবস্থান করছে, সেসব দেশে প্রবৃদ্ধি একসময় শ্নথ হয়ে আসে এবং দারিদ্র্য নিরসনের গতিও থমকে যায়। মোট কথা, জাতীয় আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়-বৈষম্যও বাড়ছে-এতে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ওপরের আলোচনা থেকে এটুকু স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘কমন গুড’ তথা জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, গণপরিবহন, পরিবেশ সংবেদনশীল উন্নয়ন বিষয়ে অনেক প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়ে গেছে। সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়েও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে সমতামুখীন সমাজ চেয়েছিলেন তা এখনও ‘অসমাপ্ত প্রকল্প’ হিসেবেই রয়ে গেছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং আদর্শিক আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। শাসক দল আর ৫০ বছর আগেকার মতো গরিব-মধ্যবিত্তের পার্টি নয়; এটি এখন অনেক বেশি ধনিক শ্রেণিনির্ভর পার্টি। ১৯৭২-৭৫ সালে যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ছিলেন তারা এখন হয়তো উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা ধনিক শ্রেণির কাতারে। এর পেছনে খানিকটা তথ্য-প্রমাণও রয়েছে। ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টে সংসদ-সদস্যের বেশিরভাগই ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মধ্য কৃষক, চিকিৎসা, শিক্ষকতা বা আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। খুব কমই ছিলেন তখন বৃহৎ ট্রেডার ও শিল্পপতি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন সংসদ সদস্যের অধিকাংশই কোনো-না-কোনো শিল্পের মালিক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। মধ্য কৃষক বা মধ্যবিত্ত ঘরের থেকে আসা সংসদ সদস্য খুবই কম (কৃষক-শ্রমিক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা সংসদ সদস্য নেই বললেই চলে)। এ তথ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের বিশ্নেষণ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সংসদ-সদস্যদের শ্রেণি-পরিচয়ে এই ধনিক-অভিমুখীনতার কারণে বিশেষ কায়েমী স্বার্থের বলয়ের দ্বারা অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এবং এই যুক্তিতে জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও গণপরিবহনের ক্ষেত্রে নাটকীয় শুভ পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে বৈকি। বৈষম্যরোধকারী নীতিমালা গ্রহণেও সংসদ সদস্য বা নীতিপ্রণেতাদের তৎপর হতে দেখা যায় না তেমন। কররাজস্ব নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে (যেমন সম্পদ-কর বসানোর ক্ষেত্রে) অথবা সরকারি ব্যয় বরাদ্দে সামাজিক সুরক্ষার অংশ বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ‘কমিটমেন্ট’ আবশ্যক ছিল তা দৃশ্যত পরিলক্ষিত হয় না। সংসদের অধিকাংশ সদস্য উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনিক শ্রেণিভুক্ত হওয়ার কারণে গরিব শ্রেণি অভিমুখীন নীতিমালা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। শুধু তা-ই নয়, কেবল ধনিক শ্রেণির স্বার্থে নীতিমালা বা প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার (যাকে বলে ‘পলিসি ক্যাপচার’ বা ‘রেন্ট ক্যাপচার’) আশঙ্কা দেখা দেয়।

কিন্তু এই যুক্তিটা সঠিক না-ও হতে পারে। এমনও হতে পারে যে আমাদের দেশে ঐতিহ্যবাহী ধনিক শ্রেণি বা ক্লাসিক বুর্জোয়া পরিবার-গোষ্ঠী আদিতে না থাকার কারণে ধনিক পরিবারের সংখ্যা কালক্রমে বেড়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র হাতে-গোনা কিছু পরিবারের কাছে জিম্মি হয়নি। এই যুক্তিতে যেভাবে ভারতে টাটা-বিড়লা বা পাকিস্তানে আদমজী-দাউদ কয়েকটি একচেটিয়া (মনোপলি) পরিবার শিল্প-ব্যবসা খাতে আত্মপ্রকাশ করেছিল আমাদের দেশে এখনও সেই প্রবণতা দেখা দেয়নি। বেসরকারি ব্যাংক-বীমা ও শিল্প খাতে শতাধিক বৃহৎ ধনিকগোষ্ঠী বিচরণ করলেও তাদের নীতিমালা প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা সীমিত। এদের একটা বড় অংশেরই রয়েছে রপ্তানিমুখীন গার্মেন্টস শিল্প চালানোর অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ এক দশক বা দুই দশক আগেও তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদের এখনও মনোপলি বা একচেটিয়া পুঁজির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। ফলে তাদের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের তরফে (নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে) এখনও একটি আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা ‘রিলেটিভ অটোনমি’ রয়ে গেছে। সবকিছুর জন্যে তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার দরকার নেই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের। এর ফলে-কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া-অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা তাদের উন্নয়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন সেসবের দ্রুতই সমাধান করা গেছে। কভিড-উত্তরকালে প্রবৃদ্ধি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল রাষ্ট্র দ্রুতই তার মীমাংসা দিতে পেরেছে। কভিড-উত্তর ইনসেনটিভ প্যাকেজের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই বেসরকারি গার্মেন্টস্‌ খাতের জন্য ব্যয়িত হয়েছে ‘ওয়েজ সাবসিডি’ হিসেবে। এর সুফল পেয়ে থাকবেন গার্মেন্টস্‌ কারখানার শ্রমিকেরা। তারপরও বলতে হয়, বেসরকারি খাতনির্ভর উন্নয়নের পথে নতুন প্রযুক্তি বা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলেও বেসরকারি মালিকদের সংগঠন বা সাধারণভাবে এদেশের পুঁজিপতি শ্রেণি নিজের গরজে এদেশের রাষ্ট্রকে একটি ‘জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে’ (‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’) পরিণত করে ফেলবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। হয় শক্ত হাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব (যেমন, বিসমার্কের জার্মানিতে ‘সোশ্যাল স্টেট’-এর ক্ষেত্রে) বা দেশের ভেতরে ‘নিচে থেকে’ গড়ে-ওঠা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন অথবা শাসক দলের ওয়েলফেয়ার স্টেটমুখী সচেতন পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ চিন্তাধারাকে একবিংশ শতাব্দীর পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করতে পারে। শুধু বেসরকারি ব্যবসায়ী শিল্পপতি-ব্যাংকারদের দিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন, সংসদ বা শ্রেণি এককভাবে এই কাজটি করতে পারবে না।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রের অর্থ যদি হয় সামাজিক ন্যায়বিচার (সোশ্যাল জাস্টিস), আর সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থ যদি হয় ‘ন্যায়ের’ বাস্তবায়ন, তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- ন্যায় কী এবং সেই ন্যায়দর্শনের ভিত্তি কী? নিচের উদাহরণটি প্রমাণ করে, সব সময় এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। প্রায়োগিক নীতিমালা অনেক সময় ডগমাটিক হলে চলে না। অবস্থাভেদে নীতিকে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনকে আশ্রয় করে চলতে হয়। অমর্ত্য সেন একটি ছোট্ট উদাহরণের মাধ্যমে এটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইতে যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের চেহারা কেমন হওয়া উচিত- তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। বইতে পাত্রপাত্রীর নাম তিনি যেভাবে দিয়েছেন, এখানে আমি তা একটু বদলে দিলাম। ধরা যাক, যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদের নাম আসগর, করিম ও শ্যামল। এদের মধ্যে একটি বাঁশি কে পাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসগর খুব ভালো বাঁশি বাজায়। এটা শ্যামল ও করিম উভয়েই জানে। যেহেতু এটি রাষ্ট্র থেকে দেওয়া হচ্ছে, তাই বাঁশিটা পাওয়ার অধিকার তারই। আবার করিমের জন্ম খুব দরিদ্র পরিবারে। সে কখনও এমন সুন্দর বাঁশি দেখেনি। এমন একটি বাঁশি পাওয়ার আকুতি তার মধ্যে আছে। তারও দাবি, তাকেই এটা দেওয়া হোক। আর এদের মধ্যে শ্যামলের দাবি, বাঁশি বানানো তার পিতৃপুরুষের কাজ, সে-ই এই বাঁশি বানিয়েছে। তার থেকেই রাষ্ট্র নিয়েছে, এখন দিতে চাইছে। তাই এটি তারই প্রাপ্য। এখন কার বাঁশি পাওয়া উচিত, সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টিতে তা দেখতে চাইলে একেক দৃষ্টিকোণ থেকে একেক ধরনের উত্তর পাব। যিনি দক্ষতাকে সম্পদ বণ্টন বা পুনর্বণ্টনের মূল ভিত্তি বলে মনে করেন, তিনি আসগরকে বাঁশি দেওয়ার পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যারা হিতবাদী (ইউটিলিটারিয়ান) দর্শনের লোক, যাদের মধ্যে জেরেমি বেন্থাম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো উদারনৈতিক বা লিবারেল দর্শনের প্রবক্তারাও পড়েন, তারা বলবেন- করিমকেই এটা দেওয়া সামাজিকভাবে ন্যায়সংগত। আবার মার্ক্সবাদীরা যুক্তি দেবেন, শ্যামলের বানানো জিনিস তাকে না দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা শ্যামলেরই প্রাপ্য।
ওপরের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, সামাজিক ন্যায়ের কোনো একক বা সর্বাত্মক সংজ্ঞা নেই, যেটা দিয়ে সব রকমের বণ্টন নীতিমালা গ্রহণ করতে পারি। একেক সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের একেক রকমের ন্যায়দর্শনের আশ্রয় নিতে হয়। এর তাৎপর্য হচ্ছে, সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একমাত্রিক চিন্তার সুযোগ নেই। সমাজতন্ত্রের ধারণার মধ্যে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনের চর্চার ও অবস্থাভেদে তার বিশিষ্ট প্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে। যেমন :বাঁশিটা আসগর, করিম ও শ্যামল- এই তিনজনার মধ্যে কাকে দেওয়া হবে, এই জটিল ন্যায়সংকটের পাশাপাশি আরও কয়েকটা প্রসঙ্গ অবতারণা করা যায়। বাঁশিটা কে পাবে, এর উত্তর মুলতবি থাকলেও এটা পরিস্কার যে বাঁশিটা অন্তত এমন কাউকে দেওয়া উচিত নয়, যিনি কিনা কেবল বাঁশির ‘মজুতদারী’ করেছেন। ধরা যাক, তার নাম সোহেল। অর্থাৎ তিনি আসগরের মতো দক্ষ বাঁশিবাদকও নন; করিমের মতো একটা বাঁশি হাতে পাওয়ার অভাববোধজনিত তীব্র আকুতিও তার নেই; আবার শ্যামলের মতো বাঁশিটা তিনি উৎপাদনও করেননি। তার শুধু আগ্রহ, বেশি বেশি করে বাঁশি কিনে ‘স্টক’ করে রাখা, আর দাম বেশি পেলে সেটা বিক্রি করে ‘ব্যক্তিগত মুনাফা’ বৃদ্ধি করা। মুনাফা অর্জন ছাড়া বাঁশির সুর-লহরী নিয়ে তার কোনো বাড়তি আগ্রহ নেই। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের নীতি খুব পরিস্কার :আসগর, করিম বা শ্যামল যাকেই অবশেষে বাঁশিটি দেওয়া হোক না কেন, অন্তত সোহেলকে ওই বাঁশিটি দেওয়া ন্যায়সংগত হবে না। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়মীমাংসা জটিল হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সোহেলের মতো লোকদের কাছে যাতে করে উত্তরোত্তর বাঁশির ঘণীভবন (কনসেন্ট্রেশন) বাড়তে না থাকে- অর্থনীতির পরিভাষায় concentration of economic power, যাতে করে সহনশীল মাত্রার মধ্যে বিরাজ করে- সেদিকে রাষ্ট্র খেয়াল রাখবে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কাছে প্রত্যাশা। ন্যায়দার্শনিক জন রাউলস আরেকটি প্রত্যাশার কথা বলেছেন। ‘টু প্রিন্সিপলস্‌ অব জাস্টিস’ নীতিতে সমাজে কতটা আয়বৈষম্য গ্রহণযোগ্য, তার একটি ফর্মুলা তিনি বেঁধে দিয়েছেন। মানুষের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিক চাহিদা পূরণের (primary goods) দরকার হয়। এই চাহিদাকে যেসব পণ্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে পড়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ‘যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর’ স্বাধীনতা, ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ প্রভৃতি। স্বাধীনতার চাহিদাকেও আমি প্রাইমারি গুডসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছি, কেননা (রাউলসের মতে) স্বাধীনতা ছাড়া শুধু অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতির সংস্থান অনেকখানি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এটা বোঝাতেই তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের জীবন পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।’ যা হোক, রাউলসের ফর্মুলাটি হলো, সমাজের সবচেয়ে অভাবপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের ‘মৌলিক চাহিদা’ সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে (যাকে অন্যত্র তিনি ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপল’ বলেছেন)। এদের ‘মৌলিক চাহিদা’ আগে পূরণের পর সমাজে যেটুকু বৈষম্য থাকবে, তা হয়তো ‘গ্রহণযোগ্য’। সমাজতন্ত্রের ন্যায়দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মনোগ্রাহী হলেও (এ জন্যই এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে) কতগুলো সমস্যা তার পরও থেকেই যায়।
প্রথমত, এই রাউলসীয় ফর্মুলা থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে সমাজ থেকে দারিদ্র্য যদি আগে দূর যায়, তাহলে আপেক্ষিক বৈষম্য নিয়ে দুর্ভাবনার অত দরকার নেই। এটি ন্যায়ের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে, কিন্তু সমাধানটি সবার ভালো না-ও লাগতে পারে। সমাজ থেকে না হয় দারিদ্র্য মুছে গেল, তারপরও মানুষ আপেক্ষিক বৈষম্য সম্পর্কে আলাদাভাবে সংবেদনশীল। উন্নত দেশের মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলোর সিইও যে বেতন পান, সেই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে নিচের স্তরের কর্মচারী (যিনি হয়তো দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে দাঁড়ানো) পান তার চেয়েও ৪০ ভাগ কম পারিশ্রমিক। এতটা বৈষম্য সমাজে কি থাকা উচিত? এ প্রশ্নটা সমাজতন্ত্রীরা করবেন। কতটা বৈষম্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য, এটি শুধু অর্থনীতিবিদরা ঠিক করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত, মৌলিক চাহিদা ও তার ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত যে ‘দারিদ্র্য’, তাকে আরও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে হবে। এসব চাহিদার কিছু কিছু পূরণ হবে ‘প্রাইভেট গুডস’-এর (বা বাজার থেকে অভিরুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিসপত্র বা সেবা কেনার) দ্বারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বাসস্থান এসব প্রয়োজন কি শুধু ‘প্রাইভেট গুডস’-এর বলয়ে থাকবে, নাকি সেগুলো পড়বে ‘পাবলিক গুডস’-এর বলয়ে (অথবা প্রাইভেট-পাবলিক ‘মিশ্র’ খাতে)? কানাডায়-যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য খাতকে মূলত ‘কমন গুডস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড একই পথের অনুসারী। এসব দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত চিকিৎসাসেবার সুযোগ সীমিত। এর অর্থ দাঁড়ায় যে এসব দেশে অসুখে ভুগলে কোনো পরিবার বা ব্যক্তি বিপন্ন বোধ করেন না। কেননা, তিনি জানেন যে তার চিকিৎসাসেবার প্রায় সব দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সোভিয়েত পতনের পরও পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই স্বাস্থ্য খাতকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ হিসেবেই দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদার বিষয়টি ‘মৌলিক নীতিমালার’ অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্যটি এখন ‘মৌলিক অধিকারের’ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবাকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ করা হয়নি। হালআমলের ‘ওবামা কেয়ার’-এর মাধ্যমে কিছু কিছু স্বাস্থ্যসেবাকে কোনো কোনো গ্রুপের জন্য (যেমন- ৬৫-ঊর্ধ্ব লোকেদের জন্য) নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে রাষ্ট্রের তরফে, এটা ঠিক। কিন্তু অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবাই অধিকাংশ মানুষের জন্য এখনও ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এ দেশে আমেরিকার পথে (যেখানে স্বাস্থ্যসেবা মূলত ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপরে নির্ভরশীল) এগোব, নাকি যুক্তরাজ্য-রাশিয়ার পথে এগোব (যেখানে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র সাধারণভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার)? এই বিতর্কটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা তুলবেন।

তৃতীয়ত, কোন পণ্য, সেবা বা প্রয়োজন কতটা পরিমাণে ব্যক্তি খাতে বা রাষ্ট্রীয় খাতে থাকবে, তা যুগের হাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। এর অর্থ, আগে থেকেই ঠিক করা যাবে না যে ক, খ, গ, ঘ খাতগুলো শুধু ব্যক্তি খাতে থাকবে; আর য, র, ল, ব খাতগুলো শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকবে। সমাজতন্ত্র মানে ১০০% রাষ্ট্রায়ত্ত খাত- এ ধরনের ধারণার বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর কালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহদায়তন শিল্প খাতে কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকলেও ক্ষুদ্র-মাঝারি খাতগুলো তখন ব্যক্তি খাতে ছিল। ক্রমে ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ইনভেস্টমেন্ট সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত শতকের আশি-নব্বই দশকে আলোচনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। সে সময়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হয় যে প্রায় সব খাতের অর্থনৈতিক ইউনিটকেই কেবল ব্যক্তি খাতের জন্য সংরক্ষিত করা হতে থাকে। এতে করে বাধাবন্ধনহীন ব্যক্তিগত মুনাফাচালিত ও সংকীর্ণ স্বার্থের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। মুখে ব্যক্তি খাত বলা হলেও প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত করপোরেট ক্যাপিটালিজমের দিকেই ধাবিত হয়। ব্যাংক-বীমা খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিরাষ্ট্রীয়করণ ও অবাধ ঋণপ্রবাহের মাধ্যমে রাতারাতি এক বৃহৎ ধনিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে আশি-নব্বইয়ের দশকে এবং পরেও তা অব্যাহত থাকে। ব্যাংকিং খাতের জন্য এই বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্বত্র সুফলদায়ী হয়নি। অনাদায়ী ও মন্দ ঋণের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বেড়েছে তা-ই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ‘নিচে থেকে’ গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতেও ব্যর্থ হয় অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। এককথায়, আমরা সে সময়ে অতিমাত্রায় বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র- যেটি একটি জনকল্যাণধর্মী মিশ্র খাতের সমর্থক- এই বল্কগ্দাহীন মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের বিকাশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে।

চতুর্থত, বৈষম্য শুধু আয়ের ক্ষেত্রে নয়, জীবনযাত্রার অন্যান্য আয়বহির্ভূত সূচকেও একে বিচার করতে হবে। রাউলস যখন দরিদ্রতমদের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা বলেছিলেন, তিনি গরিব ও ধনীর জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবেননি। প্রত্যেকের জন্যই শিক্ষা একটি পাবলিক বা কমন গুড। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা হবে প্রায় সবার জন্য সমান মানসম্পন্ন। উন্নত দেশে এসব স্তরে কোনো বৈষম্য করা হয় না। পাবলিক এডুকেশন (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সবার জন্য সমান গুণসম্পন্ন এবং অবৈতনিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও এই ব্যবস্থা বিদ্যমান। পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে এবং রাশিয়ায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণও অনেক ক্ষেত্রে অবৈতনিক- শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভার সঙ্গে সংগতি রেখে সেখানে টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার’ কথা বললেও এখন পর্যন্ত একটি ‘কমন স্কুল সিস্টেম’ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যার মাধ্যমে ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা গা ঘষাঘষি করে এক শ্রেণিতে পড়ালেখা করতে পারবে। এখন মাদ্রাসায় যায় মূলত অতিদরিদ্রদের ছেলেমেয়েরা; বাংলা মিডিয়াম স্কুলে যায় গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা; আর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যায় উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম আরও সূক্ষ্ণ প্রভেদ করা সম্ভব। এর ফলে চাকরিজীবনে প্রবেশের আগেই বিভিন্ন আয়ের মানুষের মধ্যে গভীর শ্রেণিবিভাজন ঘটে যায়। কমন স্কুল না থাকার জন্য সামাজিক (ঊর্ধ্বমুখী) সচলতা কমে যায়। নিচের আয়ের মানুষ ওপরের আয়ের স্তরে প্রবেশ লাভ করতে ব্যর্থ হয় প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নানা স্তরের মধ্যে পাঠদানের গুণে-মানে বৈষম্যের কারণে। সংগত কারণেই এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আলোচনার একটি মুখ্য বিষয়বস্তু।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


অর্ধ-সত্যের ভিত্তিতে ডিজইনফরমেশন ক্যামপেইন চালানোর পটভূমি গড়ে দিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ঠান্ডা যুদ্ধ। ‘ঠান্ডা’ হলেও যুদ্ধের রক্তারক্তিতে সেটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধের চেয়ে কম যায় না। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ওয়াশিংটন পোস্ট তড়িঘড়ি করে লিখল যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আবার সবকিছু পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে: ‘ইসলামাবাদ, পিকিং এবং ওয়াশিংটন তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করবে বলে মনে হয়।’
এই সূত্রে প্রবন্ধের লেখক লুই সিমনস্‌ মৃত্যুর কারণও নির্দিষ্ট করলেন:
‘যদিও এ অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ হিসেবে শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী শাসন, তার অযোগ্যতা এবং দুর্নীতিপরায়ণতার কথা তুলে ধরা হয়েছে, তবু প্রথম থেকেই দিল্লি-মস্কোর সঙ্গে বেশি মাখামাখির জন্য জনগণ মুজিবকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল। অতীতে যেমন দুঃখ-দুর্দশার জন্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যেই অর্থনৈতিক শোষণ চালু করার জন্য ভারত সরকার ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অভিযুক্ত করেছে। পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে উদ্ভূত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে ঘাত-প্রতিঘাতের জন্ম দিয়েছে, তারই ফল হচ্ছে শেখ মুজিবের পতন ও মৃত্যু।’
লুই সিমনস্‌ আরও বললেন, ‘হঠাৎ এই গতি পরিবর্তন শুধু মিসেস গান্ধীকে নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বিচলিত করতে বাধ্য। এতদিন তারা চীনকে আগলে রাখার প্রয়াসে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এসেছিলেন।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে বৃহৎ পরাশক্তির দ্বন্দ্ব, ভারত, চীন, পাকিস্তান ইত্যাকার শক্তির ভারসাম্যের সমীকরণ জড়িত এমনটাই ইঙ্গিত করা হলো।
এটা এখন অনেকটাই স্পেকুলেশনের বিষয় যে মুজিব-হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিক্সন প্রশাসন-সিআইএ জড়িত ছিল, কী ছিল না। মিজানুর রহমান খানের গবেষণাধর্মী বইটিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। লরেন্স লিফসুলজ্‌ তার ‘বাংলাদেশ :দ্য আনফিনিশড রিভোলিউশন’ বইতে স্পষ্ট ইংগিত করেছিলেন যে সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার আয়োজন সম্পর্কে পূর্বাপর অবগত ছিল। খোন্দকার মোশতাক আমেরিকান লবির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন বহুকাল থেকেই (অন্তত ১৯৭১ সাল থেকে তো বটেই)-একথা এখন প্রমাণিত।  Rogue States এবং Killing Hope-র লেখক উইলিয়াম ব্লুমকে আমি চিঠি লিখেছিলাম মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকা প্রসঙ্গে তিনি কিছু জানেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, মুজিব-হত্যা তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল না। তিনি তার বইয়ে মূলত লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার ওপরেই মনোনিবেশ করেছেন। পক্ষান্তরে, আমার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তিগত আলাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞরা সিআইএ-র জড়িত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেননি। ঢাকায় সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে অভ্যুত্থানের বিষয়টি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ন্যাপ-সিপিবির পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে অরক্ষিত থাকার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে। কমরেড মণি সিংহ নিজে এ বিষয়ে বলেছিলেন, মোজাফফর আহমদও বলেছিলেন বাড়তি নিরাপত্তা গ্রহণের বিষয়ে। দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিংগার গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্‌স স্পষ্টত অবস্থান নিয়েছিলেন মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকার পক্ষে। সেখানে হিচেনস সরাসরিভাবে অভিযোগটি তুলেছেন: ‘Kissinger was responsible for the killing of thousands of people, including Sheikh Mujibur Rahman’। একদিন নিশ্চয়ই এর পক্ষে বা বিপক্ষে অকাট্য প্রমাণ মিলবে। কোনো গোপন উইকিলিকসে ফাঁস হয়ে পড়বে মার্কিন প্রশাসনের আর্কাইভে লুকিয়ে থাকা, এখনও অপ্রকাশিত, কোনো দলিল-পত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের দেশি-বিদেশি চক্রান্তের খুঁটিনাটি।
তবে মুজিব-হত্যার পরপরই যেভাবে ইং-মার্কিন মূলধারার পত্র-পত্রিকাগুলো সমস্বরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ক্যারেকটার-এসাসিনেশনে লেগে গিয়েছিল তা আজ কিছু অবাক করে বৈকি। তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে শুধু ‘ডিক্টেটর’ বলে আক্রমণ করা নয়, তার পরিবারের সদস্যদের কারও কারও প্রতি কল্পিত অভিযোগ ছড়াতেও তারা সেদিন দ্বিধা করেনি। গুজবের প্রকাশ ও প্রচার করা সাধারণত সৎ সাংবাদিকতার নিয়ম-রীতিবিরুদ্ধ। প্রায় অসভ্যতার পর্যায়ে এটি পড়ে। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্‌ পত্রিকায় কেভিন রেপার্টি মুজিব সম্পর্কে কল্পিত অভিযোগ এনে লিখেছেন :’নিজের পরিবারের লোকজনের আর্থিক স্বার্থ আদায়ের প্রতি তার নজর ছিল। তিনি নিজে ঘুষ নিয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। কারণ তা নেওয়ার তো তার প্রয়োজন ছিল না।…তবে অনেকেই তার ছেলেদের এবং অন্য আত্মীয়দের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।…গল্পটি সত্য না বানানো তা বিচার করতে যাওয়া অবান্তর, কারণ বহু লোক এ গল্পের সত্যতায় বিশ্বাস করে এবং এ গল্প বহু লোকের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে।’ এই হচ্ছে পাশ্চাত্যের সৎ-সাংবাদিকতার নমুনা! দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করে- কখনও শেখ মনি, কখনও গাজী গোলাম মোস্তফাকে ঘিরে গাল-গল্প বানিয়ে এবং গুজব ছড়িয়ে। এর জন্য ঢাকার তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে মুজিববিদ্বেষী মনোবৃত্তিও কম দায়ী নয়। মুজিব খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না; মুজিব বুদ্ধিজীবীদের অপছন্দ করেন; মুজিব সবসময় ইনসিকিওরিটিতে ভুগতে থাকেন; মুজিব তার অহমিকাবোধে আবদ্ধ; এসব কথা পাশ্চাত্যের অনেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনর্গল লিখতে দ্বিধা করেননি। এভাবে ‘ফেইক নিউজ’ তারা তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে শুধু ‘হক-কথা’কে দায়ী করলে ভুল করা হবে। আজ তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,’ ‘আমার দেখা নয়াচীন’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে সেদিনের জটিল-কুটিল সমালোচক স্বভাবের ঢাকার মধ্যবিত্তদের অনেকেরই কিছুটা হলেও বোধোদয় ঘটছে হয়তো। তারা এখন ভাবছেন যে শেখ মুজিবকে ‘যতটা অশিক্ষিত’ বলে মনে করে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম, ততটা অশিক্ষিত তিনি নন আসলে। চিন্তাবিদ না হলেও সবকিছু নিয়েই চিন্তা করতে পারেন দেখছি! ঢাকার মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে এই অসাধুতা গত ৫০ বছর ধরে দেখে আসছি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মুজিব নাকি ইংরেজি বলতে ভুল করেছিলেন, সে নিয়ে কী হাস্য-তামাশা সেদিন মধ্যবিত্তদের ড্রইং রুমে। আজ তারাই বলছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে আমাদের তাকে বুঝতে। হি ওয়াজ আ গ্রেট, গ্রেট ম্যান।’ এই শঠতা আমাদের পীড়া দেয়। এই মধ্যবিত্তের সঙ্গে শঠতার দৌড়ে সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটেছেন সেদিনের বিদেশি সাংবাদিকেরা। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করাই ভুল হয়েছিল এমন মন্তব্য ছিল তাদের। ১৯৭৫ সালের ৩০ জানুয়ারি সংখ্যায় বোস্টন হেরাল্ড মন্তব্য করেছে:
”আরও পরিহাস এই যে, যে পাকিস্তানের উৎপীড়ন থেকে তিনি তার দেশবাসীকে মুক্ত করেছিলেন, সেই পাকিস্তান আজ অধিকতর মুক্ত এবং সমৃদ্ধ। গত সোমবার ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌’ প্রকাশ করেছে যে, তিন বছর আগে পরাজয় ও অবমাননা ভোগ সত্ত্বেও পাকিস্তান আজ অপ্রত্যাশিতভাবে এশিয়া মহাদেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সজীব দেশ হিসাবে দেখা দিয়েছে। যদিও এখনও গরিব দেশ, কিন্তু পাকিস্তানে অনাহারে লোক মরছে না। তাদের জীবনযাত্রার মান বেড়ে চলেছে এবং ‘দি টাইমস্‌’ পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের সরকার ধ্বংসাবশেষ কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।…পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আদর্শবাদীরা যখন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য চিৎকার করছিল, তখন আমেরিকার উচিত ছিল, পাকিস্তানকে আরও সবল সমর্থন দেওয়া।’

অবশ্য ভুট্টোর পাকিস্তানের এই প্রশংসা অচিরেই মুছে যাবে পাশ্চাত্যের সাংবাদিকবলয় থেকে। আফগানিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে ঠান্ডা যুদ্ধের লড়াইয়ে বিশ্বস্ত সাথি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন জেনারেল জিয়াউল হক। এবং ভুট্টোকে ‘হঠকারী পপুলিস্ট’ বলে ছুড়ে দেওয়া হবে অস্বীকারের খাতায়।

১৫. বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত প্রকল্প ও আজকের বাংলাদেশ
বাকশালের মাধ্যমে সমতামুখিন সমাজের স্বপ্টম্ন বাস্তবায়নের নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা বাকশালের কর্মসূচিতে ধারণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি বড় স্তম্ভ ছিল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ। সেটি বাকশালের কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে সেভাবে আলোচনায় আসেনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ফলে বাহাত্তরের সংবিধান ও বাকশাল কর্মসূচিতে বিধৃত সমতামুখিন সমাজের সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া হয়। শুধু ভুলে যাওয়াই নয়, অর্থনীতি-রাজনীতি চলতে থাকে এক নিষ্ঠুর অমানবিক সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫-১৯৯০ পর্বে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছে একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সে সময়ে যারা ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর গঠন বা তার কার্যাবলির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকতেন, তাদের প্রত্যেকেই নানা ধরনের দৈহিক-মানসিক-বৈষয়িক হয়রানির শিকার হতেন। আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে নিছক বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে ১৫ আগস্টের শোকসভায় উপস্থিত থাকাকে বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্ণধাররা ভালো চোখে দেখতেন না। তা সে বিলেতেই হোক, আর তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেই হোক। মৃত বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা হচ্ছে, তাকে প্রতীক রেখে তরুণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হচ্ছে এক জায়গায়, তাকে মনে রেখে তারা সমতামুখিন সমাজের কথা বলছে, এটা জিয়া-এরশাদের সামরিক সরকার আর তাদের অধীন দূতাবাসগুলোর পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হতো। যারা সেদিন সেসব গোপন বা প্রকাশ্য সভায় জড়ো হতেন ওয়াশিংটনে, লন্ডনে, মস্কোয় কিংবা ঢাকায়; তারা ঝুঁকি নিয়েই অংশ নিতেন সেখানে। তাদের নামের তালিকা চলে যেত গোয়েন্দা দপ্তরে। জীবিত মুজিবের তুলনায় মৃত মুজিবের প্রভাব প্রতিবছরেই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর নাম ক্রমশ অর্থনৈতিক সমতা, সামাজিক ন্যায় এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমার্থক ধারণায় পরিণত হচ্ছিল সচেতন অথবা অসচেতনভাবে। এই যোগাযোগ সময়ের সঙ্গে আরও দৃঢ় গণভিত্তি পেয়েছে। আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং সমতামুখিন আকাঙ্ক্ষার আলোচনা তাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’? এ প্রশ্ন আজ উঠতেই পারে।
সমকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে গতিধারা বিশ্নেষণের কাজটি বর্তমান লেখার আওতার বাইরে। কিন্তু কিছু প্রাথমিক মন্তব্য করা যায়। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ ধারণাটি নিয়ে সর্বস্তরে (পাঠ্যবইসহ বলছি) যতটা আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল, ততটা এ দেশে এখনও হয়নি। ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজতন্ত্র নির্মাণের’ বর্তমান কালের চ্যালেঞ্জ আলোচনা করার জন্য নূ্যনতম শর্ত হলোু সমাজতন্ত্রকে আগে ‘কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা। বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির অংশ হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে ঠিকই (২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে), কিন্তু এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে করা হয়নি। গণতন্ত্র ও মার্কেট-ইকোনমি রেখে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কীভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প হতে পারে, তা নিয়ে গভীর আলোচনার দরকার রয়েছে। স্বাধীনতা, উৎপাদন-নৈপুণ্য এবং বণ্টনগত সাম্যু এই ত্রিবিধ লক্ষ্যের মধ্যে সমীকরণ কষতে হবে এবং উন্নয়নের নানামাত্রিক ঝোঁকের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। সামাজিক ন্যায়-দর্শনের একটি উদাহরণ দিয়ে সমস্যাটি চিহ্নিত করা যায়।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


কর্নেল হামিদ এ রকম একটি নির্মম ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন ১৯৭৭ সালের বগুড়া সেনানিবাসের বিদ্রোহকে উপলক্ষ করে। আমি সেটি তুলে ধরছি-
”এবার শুরু হলো জিয়ার শুদ্ধি অভিযান। বিদ্রোহী বিমান ও সৈনিকদের পাকড়াও করে তাদের নির্মমভাবে ঢালাও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হলো। সংক্ষিপ্ত বিচারের সুবিধার্থে মার্শাল ল’ আইন করে বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হলো। এই সময় জেনারেল এরশাদ ছিলেন ডেপুটি চিফ। তারই তত্ত্বাবধানে এসব সংক্ষিপ্ত ট্রায়াল সুষ্ঠুভাবে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। শুরু হলো ত্বরিতগতিতে বিচারের নামে প্রহসনের পালা। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কয়েক শত সৈনিক ও বিমান সেনাদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। সেনা বা বিমানবাহিনীর কোনো প্রতিষ্ঠিত আইনকানুন এ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়নি। পাঁচটি কারাগারে একসঙ্গে ৮-১০ জন করে পর্যায়ক্রমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ফাঁসি ছাড়াও এলোপাতাড়ি ফায়ারিংয়ে মারা যায় শত শত। ফায়ারিং স্কোয়াডেও বহুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ঢালাওভাবে গ্রেপ্তারের পর বহু সৈনিকের মৃত্যু ঘটে অমানবিক নির্যাতনে। ৩ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি রাতে সেনা ও বিমানবাহিনী ব্যারাক থেকে সৈনিকদের ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নির্যাতন ক্যাম্পে, তারা আর ফিরে আসেনি। ক্যান্টনমেন্টজুড়ে হাহাকার। কান্নার রোল। কত সৈনিক, বিমান সেনা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলল, কতজন প্রাণ হারাল, ‘গুপ্তহত্যার’ শিকার হলো, এর কোনো হিসাব নেই। বিমানবাহিনীর কার্যক্রম ক্ষমতা নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়। সরকারি হিসাব মতেই শুধু দুই মাসে ফাঁসিতে লটকানো হয় ১১৪৩ জন সৈন্যকে, যার মধ্যে বিমান সেনাই ছিল ৫৫১ জন। হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া হয়নি। তারা আজও খুঁজে ফিরে তাদের প্রিয়জনকে। কোথায় যে এত লাশ গুম করা হলো, তাও এক রহস্য। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নাকি অভ্যুত্থান, তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। অনেকেরই ধারণা, এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এক নিধনযজ্ঞ। মধ্যরাতে সিগন্যাল লাইন্স ও কুর্মিটোলা এয়ারফোর্স ব্যারাকে কে বা কারা স্লোগান দিয়ে আহক্ষান জানিয়ে শুরু করে বিদ্রোহ, তা আজও রহস্য।
পাক-ভারতের ইতিহাসে কোনো সামরিক অভ্যুত্থানে এত লোকের ফাঁসি, হত্যা, প্রাণহানি, জেল আর কখনও ঘটেনি। কী আশ্চর্য! এতবড় মর্মান্তিক ঘটনার কখনও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। কেউ দাবিও করেনি। কী বিচিত্র এই দেশ!”

আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু ও তার বাকশালের শত্রুদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। অতিদক্ষিণপন্থি স্বাধীনতাবিরোধী, অতিবামপন্থি নকশাল ধারার, জাসদ-গণবাহিনী, জাতীয়করণের ফলে ক্ষিপ্ত ধনিকগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত মধ্যবিত্ত, পাকিস্তানপন্থি, চীনপন্থি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী-বিশাল একটি স্পেকট্রাম বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এর মধ্যে সবার আগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ, যারা কোনোমতেই বাংলাদেশের সৃষ্টিকে মেনে নিতে পারে নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইসলামিক রিপাবলিকের বদলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ঘোষণা। এর গুরুত্ব শুধু দক্ষিণপন্থি পত্রিকা ইত্তেহাদ থেকেই উচ্চারিত হয়নি, এর সঙ্গে কোরাস মিলিয়েছিল বিলেত-আমেরিকার মেইনস্ট্রিম পত্রিকারাও। কর্নেল ফারুকের বয়ান দিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্টে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি ইসলামবিরোধী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল :’সবশেষে মুজিব তাহার ঈমান অর্থাৎ পবিত্র ইসলামের সাথে বেঈমানী করেন।’ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিয়্যুর ২৯ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় যা লেখা হয়েছে তার মানে দাঁড়ায় যে মুজিবের ‘সাম্প্রদায়িক’ কর্মকাণ্ডের জন্যই পাকিস্তান ভেঙে যায়। উদ্ধৃতিটির কুযুক্তিটি একটু শোনা যাক আবার :’পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের জন্য সূক্ষ্ণ পদক্ষেপ নিতে শেখ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন… তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, পাকিস্তানের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী ছিল। দেশের ভাঙনকে ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি ব্যর্থ হয়েছেন এমন কোনো সদিচ্ছা দেখাতে, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের আকস্মিক অভিযান নিবৃত্ত করতে পারত। এরপর যে ট্র্যাজেডি শুরু হলো তার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও ভুট্টো নিঃসন্দেহে দায়ী। তাহলেও বলতে হবে যে, শেখের বাগ্মিতার ফলেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও রক্তপাত শুরু হয় এবং তাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের একান্ত অনুগতরা নৃশংস অভিযান আরম্ভ করার অজুহাত পায়।’ দক্ষিণপন্থি সমালোচনার আরেকটি ধারা সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের অংশ করাকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাঁড় করায়। ১৭ আগস্ট ১৯৭৫-এর সানডে টাইমস পত্রিকায় এন্থনি মাসকারেনহাস এরকম যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন :
‘মুজিবের পতনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশ শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ইসলামের মর্যাদার এই অবমাননা অনিশ্চয়তাসূচক প্রমাণিত হয়েছে।…এই পটভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছিল। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাক আহমেদ বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করে রাতারাতি জনসমর্থন লাভ করেছেন।’
বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকা ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় একই অভিমত তুলে ধরেছিল। মার্টিন ওয়ালকট সেখানে লিখেছেন :”তাছাড়া আদর্শগত প্রশ্নও ছিল। মুজিব নতুন জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক মস্কোপন্থি রাজনীতিবিদকে স্থান দিয়েছিলেন, ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে প্রাচীনপন্থি মুসলমানগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, নতুন শাসকরা বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করেছেন।” বস্তুত, দলিল-পত্র ঘাটলে দেখা যায় যে দেশের ভেতরে ও বাইরের চরম দক্ষিণপন্থি ও চরম বামপন্থি শক্তি অবশেষে কৌশলগত একবিন্দুতে মিলিত হয়েছিল-সেটা হলো তীব্র ভারত ও রাশিয়ার বিরোধিতা। তাদের যুক্তি ছিল :বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্টে নিহত হয়েছেন তার কারণ তিনি নিজেই; তার সরকার এবং তার প্রস্তাবিত বাকশাল ব্যবস্থা ছিল ঘোরতরভাবে রুশ-ভারতপন্থি। এই ‘ডিসইনফরমেশন ওয়ার’ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এনায়েতুল্লাহ খান ‘শেখ মুজিবের উত্থান পতন’ প্রবন্ধে তার ভাষায় বাংলাদেশের ‘মধ্যবিত্ত মানসের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করেছেন নিল্ফেম্নাক্ত ভাবধারায়:
”বিগত সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের দুঃখী জনগণ এই অবাক প্রদর্শনীর মৌন দর্শক ছিলেন। তাদের নিঃশব্দ আর্তিতে ধ্বনিত হচ্ছিল কতিপয় লুটেরার অট্টরোল। আর তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র-যারা সমাজতন্ত্রের ছলে, মৈত্রীর ছদ্মবেশে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের আবডালে বাংলাদেশকে বৈদেশিক স্বার্থের অবারিত লীলাক্ষেত্রে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে বাঙালি বুর্জোয়ার নিকৃষ্টতম মেরুদণ্ডবিহীন মুৎসুদ্দীকুল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি ধ্বংসকল্পে পরদেশী বাণিজ্যিক পুঁজির সেবা-দানের ভূমিকায় নিয়োজিত ছিল। এরই সাংগঠনিক রূপ ছিল ‘দেশপ্রেমিক'(?)দের ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। এই ঐক্যজোটের নীলনকশা পরিশেষে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে রূপায়িত হয়। ফলতঃ বাংলাদেশ একদিকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাববলয়ে আবর্তিত হয় এবং অন্যদিকে পূর্ব ভারতের ধ্বংসোন্মুখ শিল্পকেন্দ্রের প্রায় ঔপনিবেশিক পশ্চাদভূমিতে পরিণত হয়। দেশের উৎপাদিকা শক্তিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করবার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীতে বিরল। অষ্টাদশ শতকের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের লুটেরা বাণিজ্যিক পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সাদৃশ্য লক্ষণীয়।”
বাংলাদেশ সম্পর্কে এনায়েতুল্লাহ খানের উপসংহার ছিল যে এটি নিক্ষিপ্ত হয়েছে যুগপৎ ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের’ (অর্থাৎ রুশ প্রভাববলয়ের) এবং ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদের’ ফাঁদে। মার্কিনপন্থি লিবারেল ও চীনপন্থি অতিবাম মহলে সে সময়ে এটি চালু থিসিস ছিল। এই মূল্যায়ন সমর্থন করেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত চীনঘেঁষা বামপন্থি পত্রিকা ফ্রনটিয়ার। এর ১৯৭৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় দেখতে পাই অনুরূপ প্রচারণা :’…ভারতীয় হস্তক্ষেপের ফলে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসীন হলো তাদের মতো স্বার্থপর নেতৃত্ব কোনো দেশে সত্যিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পর আর দেখা যায়নি। দেশটি যে অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য-সহায়তা বাংলাদেশের কোনো কাজে আসেনি। আরামদায়ক বন্দিদশা থেকে শেখ মুজিব প্রত্যাবর্তনের পর দেশের অবস্থা মন্দ থেকে মন্দতর হয়েছে।’ ফ্রন্টিয়ার যে এরকম অভিমত রাখবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সমর সেন সম্পাদিত পত্রিকাটির মতাদর্শ ছিল তখনকার মাওবাদ তথা নকশালবাড়ির পথ। এজন্যেই ১৯৭৫ সালের বাকশাল প্রবর্তনকে তারা মনে করেছেন প্রকৃত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ বলে :’ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনীতি স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। এর প্রধান দিক হচ্ছে বাংলাদেশের বামপন্থি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম।’ অতিডানপন্থি ইত্তেহাদ গ্রুপ, এনায়েতুল্লাহ খানের লিবারেল সুরের হলিডে, আর অতিবামপন্থি ফ্রন্টিয়ার একই সুরে তখন কথা বলেছে। তিন ধারাই তখন মিলে যাচ্ছিল মুজিব-সরকার উৎখাতের যৌথ প্রযোজনায়। ১৯৭৪-৭৫ সালে পাশ্চাত্য থেকে প্রকাশিত মূলধারার পত্র-পত্রিকা ঘাঁটলে আজকের যুগে যেটা ‘হাইব্রিড ওয়ার’ বলে অভিহিত হচ্ছে (যেখানে প্রথাগত যুদ্ধের সঙ্গে অপপ্রচার ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ জড়িত থাকে) তার প্রাথমিক লক্ষণগুলো পাওয়া যায়। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানোর জন্য পূর্ণ সত্য বা পূর্ণ মিথ্যা কোনোটিই বলার দরকার নেই। এর জন্য ‘অর্ধ-সত্য’ বলাই যথেষ্ট-তাতে করে সত্য বলার ভানও করা যায়, আবার ডিসইনফরমেশন ক্যামপেইনও দিব্যি চালানো যায়। এনায়েতুল্লাহ খান-ফ্রন্টিয়ার বলছিলেন যে মুজিব বামপন্থি বিপ্লবীদের ধ্বংস করতে চাচ্ছেন। এবার আগস্ট অভ্যুত্থানের কারণ বলতে গিয়ে গার্ডিয়ান (১৬ আগস্ট ১৯৭৫) লিখল যে, বঙ্গবন্ধুকে আসলে হত্যা করা হয়েছে তার বামপন্থি বিপ্লবী আদর্শের কারণেই। উদ্ধৃতিটি মনোযোগের দাবি রাখে। প্রগতির পথে চলার একপর্যায়ে তিনি শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনীকে চটিয়ে দিয়েছিলেন-সেটাই তার নিহত হওয়ার কারণ। ‘মুজিব নিজেই দায়ী’-অন্য কাউকে এর জন্য দায়ী করা চলে না : ‘কিন্তু নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এবং দেশে কিছুটা প্রগতি আনার জন্য তার শেষ পদক্ষেপেই তার পতন ডেকে এনেছে। বামপন্থি আদর্শে তিনি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনী তার প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল। অথচ তাদের সমর্থনেই তিনি প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ অবস্থায় মুজিব নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুঁজছিলেন। তাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্য মস্কোপন্থি দলগুলোও উৎসাহ জুগিয়েছিল।’
যুক্তি হিসেবে বলা হলো যে, গ্রামে বহুমুখী সমবায় করার সমাজতান্ত্রিক নীতিই মুজিবের সর্বনাশ ডেকে এনেছে:
‘মে মাসে মুজিব ঘোষণা করলেন যে, গ্রামে গ্রামে বাধ্যতামূলকভাবে কৃষি সমবায় গঠন করা হবে, গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনিক পরিবর্তন করা হবে এবং জাতীয় দল গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। সংক্ষিপ্ত হলেও এ কর্মসূচি আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী, পেশাদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেককেই আতঙ্কিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বামপন্থি হয়ে ওঠাই শেষ পর্যন্ত তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


‘ব্রেকফাস্ট উইথ ইভিল’ বইতে আশিস নন্দী যে ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটির’ কথা বলেছিলেন তার মর্মার্থ ছিল রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক ভায়োলেন্স একপর্যায়ে সামাজিক ভায়োলেন্সের স্লুইসগেট খুলে দেয়। ‘প্রাগ-আধুনিক’ যুগে সহিংসতা প্রকাশ পেত লাঠিসোটা, রড-হকিস্টিক, ছুরি-কিরিচ এসব অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। কচিৎ-কদাচিৎ ব্যবহূত হতো বন্দুক-পিস্তল ধরনের মারণাস্ত্র। সাদত হাসান মান্টো তার অনুগল্পগুলোয় পার্টিশন-রায়টের যে রক্তশীতল করে দেওয়া বিবরণী রেখে গেছেন তাতে লাঠিসোটা ছুরি-কৃপাণের ব্যবহারই ছিল চোখে পড়ার মতো। ষাটের দশকের শেষে নকশাবাড়ী আন্দোলনে ‘জোতদার খতমের’ কাজে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার জন্য। চারু মজুমদারপন্থিরা শ্রেণিশত্রুর গলা কাটার জন্য গ্রাম-এলাকায় ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন- ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার পাতায় এমনটাই পরে শুনেছি। অবশ্য পরে শহর এলাকার ছাত্র-যুবকরা এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে পাইপগান ও হাতে বানানো বোমার প্রচলন ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। এই ‘টেকনিক’ আমাদের দেশেও অতি-বামপন্থিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২-৭৫ সালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে এসব ‘প্রাগ-আধুনিক’ অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ব্যবহূত কিছু ‘আধুনিক’ সমরাস্ত্র যেমন এসএলআর রাইফেল ও স্টেনগান এসবেরও আংশিক প্রয়োগ হয়েছিল কোথাও কোথাও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দূর থেকে নয়, একেবারে গলাকাটা দূরত্বে এসে শ্রেণিশত্রু খতমের ধারাই ছিল সহিংসতার মূল কালচার। পরবর্তী সময়ে অতি-বাম সহিংসতার সংস্কৃতি অতি-ডানপন্থিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার সময় ‘রগ কাটা’ পদ্ধতির প্রচলন হয়। পায়ের রগ কেটে প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করার পদ্ধতিকে দাবি করা হয় একই সঙ্গে আতঙ্ক লাগানো এবং এফেক্টিভ পদ্ধতি হিসেবে। টেকনিক একবার উদ্ভাবিত হলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং যে কোনো আইডিওলজি প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন হলে ব্যবহূত হতে পারে।
তবে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিনির্ভর, গণ-আকারে সহিংসতার প্রথম ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই আমরা ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময়ে। বস্তি এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এর আগে শহরের বুকে কখনও ট্যাঙ্ক চলেনি। শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক’ ও সাঁজোয়া বাহিনী, আর গর্জে ওঠা ‘রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান’ সেদিন ‘খই ফুটিয়েছিল’ যত্রতত্র। শহরের বুকে ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান গুলি ছুড়ছে- এ দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘আধুনিক’ যুগে আমরা প্রবেশ করি। দ্বিতীয়বারের মতো এই আধুনিক সহিংসতার মুখোমুখি হই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। শহরের বুকে রাতের অন্ধকারে আবারও নামে ট্যাঙ্কের বহর (যদিও তখন জানা ছিল না যে সেগুলো গোলাবিহীন)। নামে মেশিনগান এবং ভারী মারণাস্ত্র সুসজ্জিত ঘাতক বাহিনী। প্রধান লক্ষ্য তাদের ৩২ নং সড়কের বাড়ি। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে সামরিক বাহিনী, ট্যাঙ্ক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে প্রাসাদকে লক্ষ্য করে। প্রাসাদের ভেতরে আত্মরক্ষার জন্য হাতে স্টেনগান নিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে, এবং যুদ্ধ করতে করতেই মারা গেছেন তিনি- এ কথা আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শুনেছি। সিআইএ এই অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল তা-ও জেনেছি। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় এ রকম আকছার ঘটে থাকে, এমনটাই ভেবেছি। শুধু আয়েন্দের মতো নির্বাচিত সিভিলিয়ান শাসকের বিরুদ্ধে নয়, অনির্বাচিত সামরিক শাসকের বিরুদ্ধেও মিলিটারি ক্যু ঘটে থাকে। গত শতকের ৫০-৬০-৭০-৮০-র দশকের লাতিন রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্যু ঘটবে, এটা অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ঘটনা। ঠান্ডা যুদ্ধের বাহানায় তখন পিরিয়ডিক সামরিক অভ্যুত্থানকে ‘নিউ নরমাল’ হিসেবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশেও এটা কী করে ঘটতে পারে?

প্রশ্নটা বোকার মতো করলাম, নাকি এর পেছনে কোনো যুক্তি আছে- সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি উদাহরণ দিই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ‘প্রাগ-আধুনিক’ সহিংসতার যুগে কেমন ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের একটি স্মৃতিচারণায়। ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখা’ একটি অনুষ্ঠানে (বিআইডিএস আয়োজিত) তিনি বলেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু নিয়মিতভাবে তার বিপদে পড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সাহায্য করতেন। মাসে কাদের কত সাহায্য দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, তার হিসাব রাখার জন্য একটি লগবুক রাখতেন তোফায়েল আহমেদ (সে সময়ে তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব)। একদিন বঙ্গবন্ধু খাতাটি দেখতে চান। সেখানে লেখা ছিল মওলানা ভাসানী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখের নাম। কারও নামের পাশে মাসিক ৫০০ টাকা, কারও নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা। শাহ আজিজ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ভুট্টোর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন (পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হন)। ১৯৭২-৭৫ পর্বে ভাসানী তার প্রকাশিত ‘হক-কথা’ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুজিব সরকারের সক্রিয় বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন। দেশে উগ্র ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব প্রচারে ‘হক-কথার’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শাহ আজিজ, ফজলুর কাদের চৌধুরী, সবুর খান সে সময়ে জেলে ছিলেন দালাল-আইনে। মোদ্দা কথা, এখনকার রাজনৈতিক কালচার অনুযায়ী এসব বিতর্কিত ও অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে নিন্দিত অনেক ‘বিরোধী’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদার সাহায্যের তালিকায়। ৫০ বা ৬০-র দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখা সরকারি দল-বিরোধী দল নির্বিশেষে- এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। একই আবহাওয়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন শেখ মুজিব। এখন তিনি রাষ্ট্রনায়ক, কিন্তু সেই রাজনৈতিক আচার-সহবত বা বৃহত্তর অর্থে নৈতিকতাবোধ তিনি ভুলে যেতে পারেন না। তোফায়েল আহমেদকে একপ্রকার তিরস্কারই করলেন লগবুকে লেখা নামগুলো দেখে। ‘এভাবে কেন এদের নামের পাশে টাকার অঙ্ক লিখে রেখেছ? পুরো নাম লিখবে না। মওলানা ভাসানী না লিখে, লিখবে এম. বি; শাহ আজিজ না লিখে লিখবে এস.এ’- সাংকেতিকভাবে নামের ও সাহায্যের রেকর্ড রাখতে বললেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নৈতিকতার এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। সিরাজুল আলম খান ও আ স ম রবের জাসদ তার সরকারের চরম বিরুদ্ধাচরণ করেছিল ১৯৭২-৭৫ পর্বে। কিন্তু এর পরও সস্নেহে তিনি তারই হাতে গড়া ছাত্রলীগের ‘বিদ্রোহী’ অংশকে নিশ্চিহ্ন করতে চাননি। সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব বা শাজাহান সিরাজকে কারাবন্দি করা হয়নি। হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা প্রকাশ্যে যেখানেই বিচরণ করতেন, সে খবর বঙ্গবন্ধু রাখতেন কিন্তু তাদের কারাবন্দি করার প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু যারা চরম বামপন্থি বা চরম ডানপন্থি দলের বা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বাধ্য হয়ে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নয়, সে আমলের বা প্রাগ-আধুনিক পলিটিক্সের যুগে প্রায় সব জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যেই ছিল। তারা অনেকটা এপিক মহাকাব্যের রথী-মহারথীদের মতো। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ, কিন্তু যুদ্ধের পরে (অর্থাৎ সূর্য অস্ত গেলে) পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ-সখ্যের সম্পর্ক থাকত। ‘মহাভারত’-এর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে কুরু-পাণ্ডবরা পরস্পরের সঙ্গে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কঠোর যুদ্ধ করেছেন। সূর্যাস্তের পরে পরস্পরের শিবিরে গিয়েছেন মৃতদের প্রতি শোক-সমবেদনা জানাতে। এই নৈতিকতা বঙ্গবন্ধু ও তার যুগের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল এবং যাদের মধ্যে সেটা দেখা যেত না, তারা রাজনৈতিক মহলে দল-নির্বিশেষে নিন্দিত হতেন।

কিন্তু এসবই প্রাগ-আধুনিক রাজনৈতিক যুগের কথা। ৭৫-এর আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও তাদের প্ররোচিত বা প্রেরিত ঘাতক বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের নৈতিকতাবোধের কোনো লেশমাত্র ছিল না। আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, যান্ত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর গণহত্যায় কুশলী ঘাতক দলের কাছে প্রতিপক্ষ মানে শত্রুপক্ষ, আর শত্রু মানেই নিধনযোগ্য ছলে-বলে-কৌশলে। আমাদের দেশে ঘাতকরা ‘কৌশলের’ সূক্ষ্ণ আশ্রয় নেওয়ারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা এর চমকপ্রদ উদাহরণ।
ঘাতকদের মধ্যে পৌরাণিক নৈতিকতাবোধ না থাকলেও পুরাণের নিকৃষ্টতর উদাহরণকে তারা গ্রহণ করেছিল। ‘মহাভারতে’ মহারথী অশ্বত্থামা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও রাতের অন্ধকারে শত্রু শিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর পাঁচজন সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। যুদ্ধের ময়দানে নয়, যুদ্ধের বাইরে তা-ও নাবালক শিশুসন্তানদের হত্যা সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যা বা ‘ব্রহ্মহত্যার’ পর্যায়ে পড়ে। ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা অশ্বত্থামার পথকেই বেছে নিয়েছিল। শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, স্ত্রী-পরিজন শিশুসন্তানকেও হত্যা করেছিল, এমনকি ভ্রূণ হত্যা করতেও তাদের বাধেনি। সেরনিয়াবত বা শেখ মনির পরিবারের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এসব হত্যা শুধু নির্মমতাই নয়, এটা সমস্ত ন্যায়নীতি ও ঔচিত্যবোধের বাইরে। এর জন্য অশ্বত্থামাকে যেমন পুরাণ অনুযায়ী অনন্তকাল ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটাতে হবে, তেমনি বাংলাদেশেও ১৫ আগস্টের প্রতিফল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বয়ে বেড়াতে হবে আরও দীর্ঘকাল। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জেলহত্যার মতো পাশবিক হত্যাকাণ্ড। রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে সে রাতে যা ঘটেছিল তা অবিশ্বাস্য ও বর্ণনাতীত। মোসলেহউদ্দিনকে জেলগেটে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলেন না ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। কেননা সে উচ্চ স্বরে বলছিল যে জাতীয় ‘চার নেতাকে’ হত্যা করার জন্যই সে এসেছে জেলগেটে তার বাহিনীসহ এবং এসেছে প্রেসিডেন্টের আদেশেই! জেলার তখন বঙ্গভবনে যোগাযোগ করায় দাবির ন্যায্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ তার বইতে লিখেছেন এ বিষয়ে। তার বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামানের স্বহস্তে লিখিত জেলহত্যা রিপোর্টটি তুলে দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বরে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয় যে চারজন সেনাসদস্যসহ ক্যাপ্টেন মোসলেহ জেলগেট পৌঁছান এবং বলেন তিনি চার বন্দি জাতীয় নেতাকে ‘গুলি করবেন’। ‘এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই।’ এই ছিল জেলারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। পরে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করে প্রথমে মেজর রশিদ ও পরে প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়। কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ‘জেলগেট থেকে আইজি প্রিজন সরাসরি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে জেলগেটে মোসলেহউদ্দিনের আগমন ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। মোশতাক জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তাদের জেলে ঢোকার নির্দেশ দেন। হতবাক আইজি! খোদ প্রেসিডেন্ট বেআইনি নির্দেশ দিলে বেচারা আইজি-ডিআইজি কী করতে পারে? ঘটনার ২১ বছর পর বর্তমানে জেলহত্যার প্রামাণ্য দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে ছিল। এতে দেখা যায় খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশিদ চার জাতীয় নেতাকে হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন।’
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা সহিংসতার সমস্ত নিয়মনীতি অতিক্রম করে আমাদের সমাজকে সহিংস করে তোলে। এ রকম সমাজে-রাষ্ট্রে সব ধরনের সহিংসতাকেই অনুমোদন দেওয়া সম্ভব (এরই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা করা সম্ভব হয়েছে)। এ ধরনের সহিংসতার সংস্কৃতি কোনো সমাজে একবার গেড়ে বসলে তার মূলোৎপাটন সহজ নয়। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর ঘটেছিল বলেই নির্মমতার একটি সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রজীবনেও এক দীর্ঘ অশুভ ছায়া ফেলেছিল। ১৯৭৬-৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনামলের শুরুর পর্যায়ে অনেকগুলো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়েছিল। সেগুলোর বিচার হয়েছিল লাতিন আমেরিকার কায়দায়- সামরিক শাসন নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেনি।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


স্বাধীনতার পরে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্যজোটের দরকার ছিল দেশকে প্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সেটি জানতেন। প্রথমে ত্রিদলীয় আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবি ঐক্যজোট ও পরে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তার স্বীকৃতি মেলে। অ-ধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রণী এমন অনেক দেশেই এটি দেখা গেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তি একত্র হয়েছে। যুগোস্লাভিয়ায় এটা ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্নভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের নানা পর্যায়ে এ ধরনের ঐক্যজোট হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ নানা ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্যের নানা অভিব্যক্তি দেশে দেশে দেখা যায়। জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্য-বিরোধের ‘ডায়ালেকটিক’ অবশ্য একটি পৃথক আলোচনার বিষয়বস্তু, যা এই লেখার পরিধির বাইরে। এখানে শুধু এটাই যোগ করার যে এ দেশেও একপর্যায়ে এরকম ‘ঐক্যজোট’ বাড়ার প্রয়োজনীয়তা ঐতিহাসিকভাবেই দেখা দিয়েছিল (যার সমসাময়িক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়)। তবে ঐক্যজোটে যোগ দেওয়া মানে নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ নয়। বাকশালের মতো ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও অন্যান্য দলের নিজস্ব ‘রাজনৈতিক সত্তা’ বিলোপ হয়ে যায় না। ন্যাপ-সিপিবির নির্দেশে যারা সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সবাই নিজ নিজ পার্টির নির্দেশেই সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন। সবাই যে সাগ্রহে যুক্ত ছিলেন এমনও নয়-কিন্তু কমিউনিস্ট শৃঙ্খলা মেনে সেদিন তাদের তা করতে হয়েছিল। আবার, কেউ কেউ বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি বলে আহতও বোধ করেছিলেন। এ বিষয়ে সিপিবির নীতি ছিল পরিস্কার। দলটি ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে সমন্বয় করার লেনিনীয় নীতিতে পূর্বাপর অটুট ছিল। বাকশাল গঠন করার পরপরই ‘গোপন ও প্রকাশ্য কাজের সমন্বয়’ এ বিষয়টি চিঠির আকারে তৎকালীন সিপিবির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়:
‘যারা প্রকাশ্যে কাজ করেন একটা কথা খেয়াল রাখা দরকার যে একমাত্র নিজেদের বিশ্বাসভাজন লোক ছাড়া তারা কারও নিকট পার্টিগত পরিচিতি প্রকাশ করিবেন না। প্রত্যেক পার্টি সভ্যকেই কোন না কোন ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত থাকিতে হয়। একমাত্র নিজেদের ইউনিটের সভ্য ছাড়া ও ঊধর্ক্ষতন কমিটির নির্দিষ্ট লোক ছাড়া এর অস্তিত্ব আর কারও নিকট প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। এতে বিপদের আশংকা বাড়ে। ইউনিটের সভা গোপনেই করিতে হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নেওয়া সত্ত্বেও বাইরে কাজ করার সময় তা আলাদাভাবে কার্যকরী করাই যুক্তিসঙ্গত। তা না হলে ইউনিটের অস্তিত্ব ও সভ্যদের পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ অবস্থায় ইউনিট সভ্যদেরকে একে অন্যের সংগে পরিচয় আছে তাও অস্বীকার করতে হয়। পার্টির গোপন ও প্রকাশ্য কাজগুলি নিয়মমাফিক সুষ্ঠুভাবে চললে এবং তার ভিতরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন ঠিকমত হলে পার্টির অগ্রগতি ঠিকমত চলা সম্ভব হয়।’
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির পরে কোনো একসময়ে সিপিবির উপরোক্ত চিঠিটি প্রমাণ করে বাকশালের ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলীয় রাজনৈতিক সত্তা ‘বিলোপ’ করেনি। নতুন পরিস্থিতিতে তারা শুধু তাদের কাজের ধারা বদলেছিল ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে নতুন ধারায় সমন্বয় সাধন করে। এ কথা সম্ভবত ন্যাপের সম্পর্কেও খাটে।
নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখা সম্পর্কে সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও বাকশালের প্রগতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চরিত্র শনাক্ত করতে সিপিবি সেদিন ভুল করেনি- এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে বাকশাল সম্পর্কে পার্টির ইতিবাচক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে- সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে-সিপিবির হাতেলেখা একটি সার্কুলারে অভ্যুত্থান-উত্তর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল নিয়ে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রাখা হয়। এর থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিপিবির পূর্বাপর সমর্থনের দার্শনিক-রাজনৈতিক ভিত্তি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশে তখন ছিল অত্যন্ত জটিল ও বিপদসংকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সিপিবি তখন আন্ডাগ্রাউন্ডে। সে-রকম পরিস্থিতিতে বাকশালকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হলো:

‘৭ই নভেম্বর এক প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মূলগতভাবে এই সরকার দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল।
১. এই সরকার দেশে পূর্ণভাবে সামরিক শাসন এবং সামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসন কায়েম রাখিয়াছে।

২. এই সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল নীতিসমূহকে বাতিল করিয়া দেশে পুঁজিবাদ নীতি অনুসরণ করিয়া সাম্রাজ্যবাদী খপ্পরে পড়িতেছে। দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, মাওবাদী, পাকিস্তানপন্থি প্রভৃতিরা এই সরকারের সমর্থক। এরা প্রগতিশীলদের নির্মূল করিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অনুসরণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদী চীন এই সরকারের দৃঢ় সমর্থক। ভারত বিরোধিতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ইহাদের মূল আওয়াজ। সাম্রাজ্যবাদ নহে, ভারতই ইহাদের মূল শত্রু।

৩. জাসদের সরকার বিরোধিতাসহ দেশে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করিতেছে। জাসদ ও চার নীতি পরিবর্তনকারী উগ্র দক্ষিণপন্থিদের চাপ বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা রহিয়াছে।

৪. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়া যে সাম্রাজ্যবাদী মাওবাদী চক্রান্ত শুরু হইয়াছে তাহাকে পরাস্ত করিয়া বঙ্গবন্ধুর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অনুসারী একটি দেশপ্রেমিক সরকার কায়েম করা আমাদের লক্ষ্য।

৫. বঙ্গবন্ধুর নীতির অনুসারী একটি দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও দক্ষ দেশপ্রেমিক সরকার কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া ‘দক্ষিণ প্রতিক্রিয়া ও উগ্র বামকে জনগণের মধ্যে হইতে বিচ্ছিন্ন করা’ এই আওয়াজের ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শিবিরের শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইতে।

৬. বঙ্গবন্ধুর আমলে জনগণের মধ্যে নানারূপ বিভ্রান্তি বিরাজ করিতেছিল। একদলীয় শাসন যে উন্নত ধরনের গণতন্ত্র ইহা জনসাধারণ বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি জনগণকে হতাশ করিয়া তুলিয়াছিল। দেশের ব্যাপক অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়বাদী চেতনা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কূটকৌশল সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশবাসী ভারতের সাহায্য নিয়াছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদের চক্রান্ত প্রতিরোধে যে ভারত ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মৈত্রীর ও সাহায্যের প্রয়োজন আছে তারা তাহারা বুঝিয়া উঠে নাই। গণচেতনার এই দুর্বলতার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদ গ্রহণ করে।

৭. একমাত্র মুজিববাদী নয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকলকেই ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে।

৮. দেশপ্রেমিক শিবিরের রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্বন্ধে মোটামুটি সমঝোতা থাকিলেও কৌশল ও পদ্ধতির প্রশ্নে মতানৈক্য আছে। একটি ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়িয়া তুলিতে না পারিলে শত্রুরা লাভবান হইবে।

৯. ইদানীংকার ঘটনাবলী প্রমাণ করিয়াছে যে (৭ নভেম্বরের পরে) সরকার নিরপেক্ষতার যে নীতি ঘোষণা করিয়াছে ইহা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তাহারা দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা, মাওবাদ ও পাকিস্তানপন্থি শক্তিদের বিনা বাধায় কাজ করিতে দিতেছে, আর বামপন্থি প্রগতিশীল শক্তিকে দমন করিতেছে।

১০. সরকার জাতীয়করণ নীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করিয়া ব্যক্তিগত পুঁজিকে অবাধভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ করিয়া দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির উপরে পুরাপুরি নির্ভর করিবার পথ গ্রহণ করিয়াছে।

১১. রাজনৈতিকভাবে ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠন, সাম্প্রদায়িক নীতির অনুকরণ, সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির নজীরবিহীন প্রসার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম অবনতি যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোককে ভাবিত করিয়া তুলিতেছে।’

ওপরের দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে সিপিবি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিল। বাকশাল-ব্যবস্থাকে এমনকি ‘উন্নত ধরনের গণতন্ত্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। বাস্তবিকই ১৯৭৫ সালে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির এক এলায়েন্স গঠিত হয়েছিল, যা স্বাভাবিক নিয়মে অগ্রসর হলে দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারত।
বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিষ্ঠুর মৃত্যু সমাজের জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। সমাজ-মনোবিদ আশিস নন্দী যাকে বলেছিলেন ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটি’ সেটি ভিন্নতর মাত্রা পায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে।
‘শাকের আহমেদ’ এই ছদ্মনামে সিপিবির একজন নেতা ‘মহান একুশের আবেদন ও আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ’ প্রবন্ধে ৭৫-পরবর্তী সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ করে যা লিখেছিলেন তাতে করে ক্রমবর্ধমান নিষ্ঠুরতাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতাকে তীব্র আকারে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেখানে লেখক তার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে:
আজ একদল বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ নিয়ে বিদ্রূপ করছেন, যেন দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ জন শোষিত নির্যাতিত সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী প্রমুখ মেহনতি মানুষ আর জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ জন শোষক ও নির্যাতকদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন যেন এই দুই অংশের মানুষের একই রকম অধিকারই হলো প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এ কথা কে না বোঝেন যে শোষক আর শোষিত, নির্যাতনকারী আর নির্যাতিত যদি সমান অধিকার ভোগ করে তা হলে দেশ হতে কোনদিনও শোষণ-নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। শোষক ও নিপীড়কদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ করা, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প গ্রহণ করা। গণতন্ত্রকে হত্যা করা তো নয়ই, বরং তাই হলো প্রকৃত গণতন্ত্র, ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠার পথ।

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম থেকে আরম্ভ করে আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকরা প্রায় প্রতি দিনই ‘আইনের শাসন’ ‘ন্যায়ের শাসন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রব সেরনিয়াবাতের দুবছরের নাতিকে বা বঙ্গবন্ধুর দশ বছরের পুত্রকে যারা গুলি করে হত্যা করল কিংবা ঢাকা জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী দশায় দেশের চারজন বিশিষ্ট নেতাকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করল সেই নরপশুদের কী করা হচ্ছে? তারা শুধু বহাল তবিয়তেই নেই, তাদের নিরাপত্তা ও বিলাস-ব্যসনের জন্য এই সরকার পাহারাদার এবং খোরপোষেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীরা এই সম্পর্কে কোন প্রতিবাদ বা দাবী উত্থাপন করা তো দূরের কথা, তারা এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চুপও নন, বরং তারা নানাভাবে সরকারের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনই করছেন। নিজের অরক্ষিত বাসগৃহে ডাকাতের মত ঢুকে সরল বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, শেখ মুজিবের সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধূদের হত্যা, শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা, রব সেরনিয়াবাতের বাড়ীর অতিথি ও চাকরদের হত্যা, জেলে আবদ্ধ তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখকে হত্যা-এই সকল জঘন্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডকে এরা সমর্থন করেন এবং এতে আনন্দ উল্লাসও প্রকাশ করেন।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


এ রকমই ছিল বাকশাল গড়ার পটভূমি। এমনটাই আমি ভাবতে চাই। বাকশালের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর মধ্যে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই প্রতিশ্রুতির আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর যেটা ধূসরতম দিক সেটাও ৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনের অব্যাহত নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষিতে আজ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে মনে হয়। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে এমন কিছু প্রগতিশীল সংস্কার এটি আনতে চেয়েছিল, যা পরবর্তী সামরিক-বেসামরিক যে কোনো যুগের অবাধ বাজার অর্থনীতির অন্ধ অনুসরণের মানদণ্ডে আজ নিছক ঘোষণা হিসেবেও বিস্ময়কর ঠেকে বৈকি। বাহাত্তরের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষাকে বাকশালের কর্মসূচি শুধু ধারণই করেনি, একে বাস্তবায়ন করার কনক্রিট প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সামনে সত্যি বলতে গেলে আর কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পন্থা খোলাও ছিল না সেদিন। কী করতে পারতেন তিনি সেদিন? সিপিবি-ন্যাপের বক্তব্য ছিল দেশ বাঁচানোর জন্য একটি ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ গঠন, যেখানে এ দলগুলো আরও বেশি ‘স্বতন্ত্র’ সত্তায় বিচরণ করতে পারবে। মুজিব যে কোনো কারণেই হোক সেই পথে এগোতে চাননি। তিনি একটি নতুন দল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে কথিত জাতীয় ফ্রন্টের সবাই থাকবে। বিষয়টি সেদিক থেকে দেখলে একান্তভাবেই ‘ফর্মের’ বিষয়। দেশের স্বার্থে নিজেকে বা তার হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙচুর করে নতুন ‘ফর্মের’ সন্ধান করতে হয়েছিল তাকে। এ নিয়ে তার বেদনাবোধের পরিচয় পাই ২৫ জানুয়ারির (১৯৭৫) ভাষণের একাধিক মুহূর্তে। দেশের কঠিন অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বাকশালের সম্ভাব্য ভূমিকা একটি কেবল আপৎকালীন প্রয়োজনীয়তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এক গুচ্ছ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদাহরণ :
১. নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন সম্পর্কে বললেন :’সংবিধানের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, স্পিকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করছে, এ কথা যেন কেউ মনে না করে যে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে।’
২. বিরাজমান রাজনৈতিক অরাজকতা নিয়ে মন্তব্য করলেন :’বিশৃঙ্খল জাতি কোনোদিন বড় হতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ফ্রি স্টাইল। এটা হবে না, ওটা হবে না। আজ যাকে arrest
করব, বলবে যে, আমি অমুক পার্টির লোক। একে arrest করব, অমুক পার্টির লোক। ওকে arrest
করব, অমুক পার্টির লোক।’
৩. দেশে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে মুজিব বলেন, ‘বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, … এই সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে Constituent Assemblyর যারা সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেও কয়েক জনকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি, আমরা যা কোনোদিন দেশে শুনি নাই, ঈদের নামাজের জামাতে, এই সংসদের একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কাদের হত্যা করা হয়েছে? হত্যা করা হয়েছে তাদের, যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা।’
৪. পাক-মার্কিন নীতির অনুসারী দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল এবং পাক-চীন নীতির অনুসারী উগ্র বামপন্থি শক্তির দিকে (এর মধ্যে জাসদকেও আগ বাড়িয়ে রাখতে হবে) ইঙ্গিত করে মুজিব বলেন, ‘কোন রাজনৈতিক দল, যাদেরকে আমরা অধিকার দিয়েছিলাম, একটা কোনোদিন condemn তারা করেছে এদের বিরুদ্ধে? না, তারা condemn করেনি। তারা মুখে বলেছে- অধিকার চাই। তারা মিটিং করেছে, সভা করেছে। পার্টি করতে তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী করেছে তারা? আমরা বলেছি, যা আমাদের সংবিধানে আছে যে, ভোটের মাধ্যমে তোমরা সরকারের পরিবর্তন করতে পার। সে ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম বাই-ইলেকশনের মাধ্যমে। বাই-ইলেকশনসমূহ আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি, জনগণ তাদের ভোট না দিলে আমরা কী করব? তখন তারা বলেছে, এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। মুখে তারা বলেছে- আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করি। তারা অস্ত্র জোগাড় করেছে, সেই অস্ত্র, যে অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছে।…আর, তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ঘরে ঢুকে শৃগাল-কুকুরের মতো মানুষকে হত্যা করেছে।’
৫. বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন :’বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা hot bed of international clique হয়েছে। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেওয়া হয়, এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হয়।’
৬. এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক দুর্গতি। এ নিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন বঙ্গবন্ধু :’আজ সত্যি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। কারণ, আমরা কী নিয়ে শুরু করেছিলাম?…আমাদের food কিনতে হয়। আমাদের food deficit কত? আমাদের এখন নানা রকম কাজ। মানুষ দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মারা যায়। আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তার পরে বাংলাদেশে হলো draught। তারপর হলো সারা দুনিয়াজুড়ে inflation।…শুধু আমরা না, সমস্ত দুনিয়ায় যারা অনুন্নত দেশ, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আসল ভয়াবহ বন্যা। এত বড় বন্যা আমার জীবনে আমি দেখেছি কিনা, সন্দেহ। না ছিল খাবার। ৫৭০০ লঙ্গরখানা করা হলো এবং relief operation চালানো হলো।…বাঁচাতে পারলাম না সকলকে।…এখনও মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। গায়ে তাদের কাপড় নাই।’
৭. এই দুঃখী মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য সাময়িককালের জন্য হলেও কিছু নতুন পরিবর্তন আনতে হয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় :’আমি একদিন তো বলেছি এই হাউসে, স্পিকার সাহেব, যে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের, এবং সেজন্য আজকে আমাদের শাসনের পরিবর্তন করতে হয়েছে।’
৮. এটা কোনো একনায়কের কথা নয়; দেশবাসীর কাছে আবেদন করছেন তিনি। ব্যাখ্যা করছেন কেন নিজের বিরুদ্ধে তাকে যেতে হচ্ছে :’আমি সকলের কাছে আবেদন করব, আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব। আজ আপনারা constitution সংশোধন করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তো ক্ষমতা কম ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন, আমার দুই-তৃতীয়াংশ majority দরকার। তা আমার আছে। মাত্র ৭ জন ছাড়া সমস্ত সদস্যই আমার। তবু আপনারা amendment করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সিটে আমি আর বসব না- এটা কম দুঃখ না আমার। আপনাদের সঙ্গে এই হাউসের মধ্যে থাকব না- এটা কম দুঃখ নয় আমার।’
৯. এর পরে এলো ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রসঙ্গ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘প্রথম বিপ্লব’:’তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি সংবিধানকে। কারণ, একটা সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার, অবিচার হতে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন। আজ আমি বলতে চাই, This is our Second Revolution। এই Revolution আমাদের এই Revolution হবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এর অর্থ :অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’
১০. সবশেষে সবাইকে আহ্বান জানালেন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে :’আমি এই হাউস থেকে, জনাব স্পিকার, আপনার মাধ্যমে দেশবাসীকে, দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলব, যারা দেশকে ভালোবাসেন, চারটি principleকে ভালোবাসেন- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা; এই চারটিকে, তারা আসুন, কাজ করুন। দরজা খোলা আছে। সকলকেই আহ্বান জানাচ্ছি, যারা এই মতে বিশ্বাস করেন।…দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।’
যদি তার এই ডাক শুনে কেউ না-ও আসে, তাহলে একলাই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে এবং স্রোতের বিপরীতে চলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এ জন্যই অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সামনে গুনগুন করে গাইছিলেন এই ভাষণের দুই সপ্তাহ আগে- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে….’। ৬-দফার সময়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র চলাকালীন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের পর্বে, ৭ মার্চের ঘোষণায়, ২৫ মার্চের কালরাতে রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন পর্বে আলটিমেটলি এ রকম সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একাই নিতে হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ তার সঙ্গে ছিলেন সে সময়ে। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ছিল কেবল তার একার। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের পর থেকেই এটা দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনো পথ তার সামনে খোলা ছিল না।
আগেই বলেছি, বাকশাল বাস্তবায়ন করার সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অভিপ্রায়টি স্পষ্টই ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন। বাকশালের গঠনতন্ত্রের প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছিল সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার কথা। বাহাত্তরের সংবিধানের চেয়েও আরও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে মানবাধিকার, স্বাধীনতা, শোষণমুক্ত, সুষম বণ্টনের ‘সাম্যভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল সেখানে। এর সাম্প্রতিক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার নয়। ৭ জুন, ১৯৭৫ (শনিবার) বাংলাদেশ গেজেটের সংখ্যায় বিধৃত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’:
‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত একক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ- বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি বিধান, নর-নারী ও ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং মানব-সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের স্বীকৃতি, মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃস্টি, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন, কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতি ও অনগ্রসর জনগণের উপর শোষণ অবসানের জন্য পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও ক্রমিক যান্ত্রিকীকরণ এবং সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন, কৃষি ও শিল্পের প্রসার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণে কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান, মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও অধিকতর কর্মসংস্থান, বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রয়োজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ গণমুখী সার্বজনীন সুলভ গঠনাত্মক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-স্বাস্থ্য রক্ষাসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণের মৌলিক সমস্যাবলির সুসমাধান, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতির সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, বিচার-ব্যবস্থার কালোপযোগী জনকল্যাণকর পরিবর্তন সাধন এবং গণজীবনের সর্বস্তর হইতে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা- এ সকল নীতিসমূহ ও উদ্দেশ্যাবলী সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত উদ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে রূপায়িত করিতে…সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করিবে।’
মিথ্যে ইউটোপিয়ার কথা দেশবাসীকে সেদিন শোনাচ্ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজের একান্ত বিশ্বাসের কথাই বলছিলেন। আবারও বলছি, এটি কোনো তৃতীয় বিশ্বের একনায়কের কথা নয়। বরং সমাজ বদলের লড়াইয়ে যার সামনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন একজন ডেসপারেট মানুষের উপলব্ধি ছিল কথাগুলো :
‘আজকে আমাদের কথা কী? আমাদের শোষণহীন সামাজ গড়তে হবে। এটায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজকে থেকে নয়, আপনি মেম্বার ছিলেন প্রথম দিন থেকে, স্পিকার সাহেব। আপনি জানেন, এই দল এই সংজ্ঞা নিয়ে সংগ্রাম করেছে। কারও কাছে কোনোদিন আপস করে নাই, মাথা নত করে নাই। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি, নতুন পয়সাওয়ালা এদের কাছে আমার আত্মবিক্রয় করতে হবে? এদের অধিকারের নামে এদেরকে আমরা ফ্রি স্টাইলে ছেড়ে দিতে পারি না। কক্ষণও না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয় নাই, দিতে পারে না।’
বাকশাল এই একক জাতীয় রাজনৈতিক দল বা মঞ্চ কি পারত তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে? আয়েন্দে কি সফল হতে পারতেন? অ-ধনবাদী বিকাশের পথে চলতে আগ্রহী এমন অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এ প্রশ্ন আজ তোলা যায়। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাকশাল তার উদ্দেশ্য পূরণে অনেক দূর পর্যন্ত সফল হতো। উদেশ্য পূরণ হলে আবারও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পরিচিত ছকে ফিরে যেতেন তিনি। সামগ্রিক বিষয়গত ও বিষয়ীগত ফ্যাক্টর বিচার করেই এ রকম বলা যায়।
প্রথমত, যে সময়ে বাকশালের গঠনতন্ত্র প্রণীত হয় (অর্থাৎ জুন, ১৯৭৫) সে সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শুভ পরিবর্তনের চিহ্ন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ১৯৭৩/৭৪ সালের ওপেক দেশভুক্ত জোটের সিদ্ধান্ত ও তার প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি-তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী যে মূল্যস্ম্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা ক্রমশ কমে আসতে থাকে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। বিদেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে থাকে। খাদ্যশস্যের দাম কমে আসতে থাকে এবং এর জোগানও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ ও ৭৪ পরপর দু’বছরের বিধ্বংসী বন্যা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ পার হয়ে দেশে প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ফলনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এটা ঠিক যে, উচ্চ ফলনশীল ধানের প্রযুক্তি, বিশেষত শুকনো মৌসুমের বোরো ধানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সাফল্য আসে আরেকটু পরে। উফশী ধানের অধিকাংশ জাতই উদ্ভাবিত হয় ১৯৭৫ সালের পরে। যেমন, বি.আর-১ (চান্দিনা) বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালে; বি.আর-২ (মালা) ১৯৭১ সালে; বি.আর-৩ (বিপ্লব) বেরোয় ১৯৭৩ সালে; বি.আর-৪ (ব্রিশাইল) বের হয় ১৯৭৫ সালে; বি.আর-৭ (ব্রি-বালাম) ১৯৭৭ সালে; বি.আর-৮ (আশা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-৯ (সুফলা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-১০ (প্রগতি) ও বি.আর-১১ (মুক্তা) ১৯৮০ সালে। অর্থাৎ ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উফশী ধানের প্রযুক্তিতে নতুন নতুন জাত সংযোজিত হতে থাকে, যার সূচনা কেবল বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পেরেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা চলে, দু-তিন বছরের মধ্যেই দেশের খাদ্য-পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন চলে আসত অবজেকটিভ নিয়মেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুফল দুঃখী মানুষের মধ্যে নিজের হাতে ছড়িয়ে দিতে পারেননি। এদেশের কৃষি গবেষণার ভিত্তি গড়ে ওঠা অবধি শুধু দেখে যেতে পেরেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, শুধু অর্থনৈতিক (বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটজনিত মূল্যস্ম্ফীতি বা দেশের ভেতরে কৃষিপ্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রসার) দিক নয়, সাংগঠনিক দিক থেকেও বাকশাল দু-তিন বছরের মধ্যে একটি সক্ষমতর রাজনৈতিক মঞ্চে রূপান্তরিত হতে পারত। আমার আশাবাদের কারণ, সে সময়ে বাকশালের ভেতরে সিপিবি-ন্যাপ এ দুই প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন থেকে এক ঝাঁক সাংগঠনিক প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে আগ্রহী হয়ে এই সমাবেশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এবং এ রকম আরও ঘটুক, তার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিকে গড়ে ওঠা স্বল্পস্থ্থায়ী আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবির ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’-এর মূল ব্যক্তিত্বরা বাকশালের এক মঞ্চে আবার একত্র হয়েছিলেন দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরের বৃহত্তর রাজনৈতিক তাগিদে। যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই দলীয় পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে এক মঞ্চে জড়ো হতে চাননি ঠিক (এ প্রসঙ্গে অচিরেই আসছি), কিন্তু এই একত্র-সমাবেশের সাংগঠনিক ফলাফল হতে পারত অভূতপূর্ব। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা আন্দোলনের মূল ভরকেন্দ্রগুলো বাকশালে ধারণ করা হয়েছিল। বাকশালের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ‘পরিচালনা কমিটি’ তথা নেতৃত্বে বামপন্থিদের লক্ষণীয় উপস্থিতি ছিল। কৃষক সংগঠন পরিচালনার জন্য ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মণি সিংহ, পীর হাবিবুর রহমান, জীতেন ঘোষ, বজলুর রহমান প্রমুখ। শ্রমিক সংগঠন পরিচালনার জন্য ৩২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মনজুরুল আহসান খান, আবদুস সালাম খান প্রমুখ। মহিলা সংগঠনের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মালেকা বেগম, আয়শা খানম, নূরজাহান বেগম প্রমুখ। যুব সংগঠনের ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন নূরুল ইসলাম, মতিউর রহমান প্রমুখ। ছাত্র সংগঠনের ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ-উল-আলম লেনিন, মাহবুব জামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া বাকশালের ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। মনে রাখতে হবে, শুধু দু’জনের অন্তর্ভুক্তি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা) ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য ‘ক্রিয়াশীল গণপরিষদ’কে মাতিয়ে রেখেছিল। বলা বাহুল্য, এতজন প্রতিভাবান বামপন্ িবুদ্ধিদীপ্ত সাংগঠনিক প্রতিভা বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-মহিলা অঙ্গ সংগঠন পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত হলে সংগঠনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে (ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে) একটি শুভ ও ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা অবাস্তব ছিল না। অধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রসর হওয়া এমন অনেক দেশেই এ রকম এক দল বা এক মঞ্চ গড়ার উদাহরণ ইতোপূর্বে (ও পরে) দেখা গেছে। অর্থাৎ সাংগঠনিক দিক থেকে নিতান্ত ‘হিউম্যান রিসোর্স’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও বাকশালের সাংগঠনিক রূপরেখা ও কর্মপদ্ধতি কালক্রমে যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারত।
তৃতীয়ত, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও সংগঠন-প্রক্রিয়া বাকশালের গণভিত্তিকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করতে পারত। মহকুমা প্রশাসনকে জেলা প্রশাসনে রূপান্তর করে জেলা পর্যায়ে ক্ষমতা-কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীভবন ঘটার বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে বিচার-ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীভবনের প্রশ্নর আলোচিত হচ্ছিল। শুধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীভবন নয়, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নিজ নিজ এলাকায় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে ‘বহুমুখী সমবায়’ গড়ে তোলার জন্য। এর বস্তুগত ভিত্তি ছিল গোটা গ্রামের ‘সোশ্যাল মোবিলাইজেশন’। এর মধ্য দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে সমতামুখী সমাজের আদর্শ ও সংগঠন সম্প্রসারিত হওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনাও খুলে যায়।
চতুর্থত, ভাবাদর্শগত লড়াইয়ের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল বাকশাল কাঠামোয়। এর গঠনতন্ত্রের ৮ম ধারায় ২য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, দলের সদস্য ‘নিজের রাজনৈতিক এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান ও সচেতনতার মান উন্নয়নে সদা সচেষ্ট থাকিবেন, দলের প্রচারিত পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য পাঠ করিবেন এবং প্রচার করিবেন।’ সেখানেও ‘গঠনমূলক আলোচনা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্য পরিচালনা পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধন’ করার কথাও বলা হয়েছিল। এসব বাক্যে বামপন্থি ভাষাভঙ্গির প্রভাব আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু বাস্তবিকই নতুন দল গড়ে নতুন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্যাডার’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে কথা তিনি ‘৭২ সাল থেকেই অনেক বার বলে এসেছেন। সমাজতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ছাড়া সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যায় না- এ উপলব্ধি তার বহুবার হয়ে থাকবে।
পঞ্চমত, বাকশাল কর্মসূচি সফল হওয়ার বড় চাবিকাঠি ছিলেন মুজিব নিজেই। তিনি একাই ছিলেন এ কর্মসূচির রক্ষাকবচ। এটি বাস্তবায়নে তার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতিও ছিল না। পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধাচরণ করলেও তিনি প্রতিকূলতার সামনে নুয়ে পড়ার মানুষ নন। তদুপরি অনেক নেতার মধ্যেই যা দেখা যায়নি অতীতে, তার ছিল প্রচণ্ড কাণ্ডজ্ঞান। এ কথা বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জোরের সঙ্গে বলেছেন। রাজনৈতিক কলাকৌশল, সুবিবেচনাবোধ তার ও তার অগ্রজ প্রজন্মের ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাদের মধ্যে টানটান ছিল। অনেক বামপন্থি নেতার তুলনায় এ ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে ছিলেন। বাকশালের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হচ্ছে ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে। কিন্তু কার্যত এটি ছিল একটি জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম, যার মধ্যে উপদল বা গ্রুপ গড়ার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না থাকলেও এর উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু হিসাবের মধ্যে রেখেছিলেন। হায়দার আকবর খান রনো-রাশেদ খান মেনন এদেরকে দলে আকৃষ্ট করার জন্য বলেওছিলেন সেই সম্ভাবনার কথা- সে কথা কিছু আগে আমি উল্লেখ করেছি (বলশেভিক পার্টিতেও এমন আলাদা প্ল্যাটফর্ম ছিল)। এত তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যায় বামপন্থি ন্যাপ-সিপিবির তরুণ নেতৃত্বকে বাকশালের অঙ্গ সংগঠনে সম্পৃক্ত করলে সেসব প্রতিষ্ঠান আর আগের গতানুগতিক ধারায় চলতে পারবে না- এটিও তিনি হিসাবে নিয়েছিলেন। সাংগঠনিক, আদর্শিক ও মানসিকভাবে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি এ দুই ধারার একত্র-সমাবেশের মধ্য দিয়ে কালক্রমে একটি নতুন ‘রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি’র বিকাশ ঘটবে দলের ভেতরেই- এটা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত ছিল না। এর মধ্য দিয়ে তার নিজেরও সত্তার প্রগতিশীল রূপান্তর ঘটতে পারত; যেমনটা ঘটেছে কিউবার কাস্ত্রো বা যুগোশ্নাভিয়ার টিটোর বেলায়। আমার কল্পনায় এ রকম সম্ভাবনা অপার্থিব বলে মনে হয় না।
আগেই বলেছি, বাকশালের গঠনতন্ত্র ও সংগঠন সম্পর্কিত উপরোক্ত বিবরণীটি নিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ জুন। এর প্রায় আড়াই মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বাকশাল গঠনের একান্ত প্রাথমিক ও অস্ম্ফুট পর্যায়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। অস্ম্ফুট বলছি এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাকশালের কোনো  causal link নেই। যে জিনিস বাস্তবায়নই হয়নি, সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রশ্ন ওঠে না। বঙ্গবন্ধু বাকশাল না করলেও তাকে হত্যা করা হতো। হত্যা করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল তার হত্যাকারীরা বহুদিন থেকে। এখন যে প্রায়ই বলতে শুনি, সেনাবাহিনীর ‘কিছু বিপথগামী সদস্য’ ঘটনাটি ঘটিয়েছে- সেটি নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। হত্যাকারীরা বিপথগামীপাড়ার মস্তান নয় যে হুট করে এমন কাণ্ড ঘটাবে। এর পেছনে ছিল দক্ষিণপন্থি দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা। এই শক্তির অবয়ব জানা বা অন্তত অনুমান করা কঠিন নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান যারা ঘটিয়েছে, যাদের সমর্থনে বা প্রত্যক্ষ মদদে ঘটিয়েছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ বাহানায়; বাংলাদেশেও তারা সেভাবে ঘটিয়েছে। শুধু আমরা হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতায় অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি।
পূর্বাপর বঙ্গবন্ধুর শত্রুর অভাব ছিল না। এই শত্রুদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাকশাল কর্মসূচির আগে ও পরে এরা দেশের ভেতরে-বাইরে সক্রিয় ছিল। নূহের নৌকার মতো সবাইকে ক্ষমাশীল উদারতায় জলে-ডোবা থেকে নৌকায় ওঠানোর উদারতা দেখালেও তার শত্রুদের চরিত্র-বদল হয়নি। বরং কালক্রমে তারা আরও জোটবদ্ধ হয়েছে। পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এক জায়গায় তারা ছিল একমত- যে করেই হোক শেখ মুজিবকে উৎখাত করতে হবে। এ জন্য মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার, গুজব ছড়ানো, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকারে রাজনীতিকদের খুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ কাউন্টার-রিভলিউশনের কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা থেকে শত্রুরা বিরত থাকেনি। অথচ এত ঝুঁকির কথা জেনেও বঙ্গবন্ধু নিজের সিকিউরিটি বিষয়ে ছিলেন একান্তভাবেই উদাসীন। মানুষ যে জন্তু হতে পারে- সেটা তিনি জানতেন। তাই বলে তার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ অস্ত্র উঁচিয়ে ধরতে পারে- এটি তার রাজনৈতিক কল্পনার বাইরে ছিল। যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃৃতির মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন; জেল-জুলুম অতীতে সয়েছেন; জেল থেকে বেরিয়েও এসেছেন; সে রকম মানস-আবহাওয়ায় ১৫ আগস্ট কল্পনাতীত ছিল।
[ক্রমশ]